অদ্বৈতপ্রকাশ – ১৫

পঞ্চদশ অধ্যায়

জয় জয় শ্রীচৈতন্য জয় সীতানাথ।
জয় নিত্যানন্দ-রাম ভক্তগণ সাথ।।
এবে কহি প্রভুর আর মুখ্য শাখাগণে।
ক্রমভঙ্গ দোষে পূৰ্ব্বে না কৈলোঁ লিখনে।।
চৌদ্দ শত ছাব্বিশ শকের পৌষ মাসে।
সীতার চতুর্থ পুত্র তাহে পরকাশে।।
কেহ করে ইন্দ্র আসি লভিলা জনম।
কেহ কহে চন্দ্ৰ আসি হৈলা প্রকটন।।
যথা কালে জ্যোতির্বিদ পুরোহিত আইলা।
জাত বালকের তত্ত্ব গণিয়া কহিলা।।
দ্বিজ বলে এই শিশু কুবেরাবতার।
কমলার কৃপা বড় ইহার উপর।।
বৃহস্পতির সমতুল হৈব বুদ্ধিমান।
বিদ্যাবান হৈব আর অতি রূপবান।।
কিন্তু সদ্ধর্মে করিবে কুতর্কাদি বাদ।
শেষে সাধু সঙ্গে সেই ঘুচিবে প্রমাদ।।
শুনি বৈষ্ণবের গণ হরিধ্বনি করে।
স্ত্রীগণে দেয় হুলুধ্বনি আনন্দ অন্তরে।।
দ্বিজ কহে এই বালক হৈব বলবান।
অতএব নাম রাখিলাঙ বলরাম।।
তবে শ্রীমান বলরাম সাত মাসের হৈলা।
দেখি সীতানাথ তার অন্নাশন কৈলা।।
তাহে কৃষ্ণে ভোগ দিয়া কৈলা মহোৎসব।
ভুজ্ঞাইলা অন্ধ দীন ব্রাহ্মণ বৈষ্ণব।।
বস্ত্ৰ কৌড়ি সমর্পিয়া সভারে তুষিলা।
আশীষ করিয়া সভে নিজ স্থানে গেলা।।
তবে চৌদ্দ শত ত্রিশ শকে জ্যৈষ্ঠ মাসে।
সীতার যমজ পুত্র তাহে পরকাশে।।
যথা কালে দুই শিশুর নামকরণ কৈলা।
স্বরূপ জগদীশ নাম বাছিয়া রাখিলা।।
জ্যোতিষী কহয়ে দোঁহে হৈব বুদ্ধিমান।
বিষয়-পান্ডিত্য হৈব রাজার সমান।।
লব কুশ সম দোঁহার প্রণয়োপজিবে।
গন্ধর্ব্বের সম সুললিত কণ্ঠ হবে।
তবে যথা কালে মহা পরসাদ দিয়া।।
অন্নাশন কৈলা দোঁহার আনন্দিত হঞা।
ব্রাহ্মণ বৈষ্ণব পাঞা সভে আশীৰ্ব্বাদ কৈলা।।
এক দিন প্রভু কৃষ্ণের আরাত্রিক সারি।
ভক্ত সঙ্গে হরিনাম করে উচ্চ করি।।
হেন কালে আসি তঁহি বৈষ্ণব এক জন।
প্রভুর আগে কহে নদীয়ার বিবরণ।।
বৈষ্ণব কহয়ে নিমাঞি গৃহত্যাগ কৈলা।
কন্টক নগরে যাঞা মস্তক মুণ্ডিলা।।
কেশব ভারতী তারে সন্ন্যাসী করিলা।
শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য নাম তাহার রাখিলা।।
তান শোকে শচীমাতার নাহি বাহ্য-জ্ঞান।
মুচ্ছা হঞা পড়ে কভু নাহি স্থানাস্থান।।
কভু হা নিমাঞি বুলি কান্দে উচ্চস্বরে।
সেই খেদ বজ্রাঘাতে পাষাণ বিদরে।।
কভু উন্মাদিনী সমা ইতি উতি ধায়।
কভু মরিবার তরে গঙ্গাতীরে যায়।।
বিষ্ণুপ্রিয়া মাতার কথা কহনে না যায়।
অবিশ্রান্ত অশ্রু মেঘে জগৎ ভাষায়।।
শুনিয়া হইল প্রভুর স্তম্ভ উদ্দীপন।
প্রহরেক পরে তিহোঁ করয়ে ক্রন্দন।।
কারণ জানিয়া সীতা কান্দে উচ্চস্বরে।
অদ্বৈতের গণ ভাসে শোকের সাগরে।।
দ্বিতীয় প্রহরে প্রভুর হৈল উচ্চহাস।
কার শক্তি সমুঝিতে পারে তদাভাস।।
গৌর প্রেমাবেশে সেই নিশি ভোর হৈল।
তবে প্রভু অন্তরঙ্গ ভক্ত স্থানে বৈল।।
মহাসাগরের কুল মিলে বহু কালে।
কৃষ্ণ দয়া সিন্ধুর কূল কভু নাহি মিলে।।
জীব উদ্ধারিতে কৃষ্ণের নানা লীলা স্ফূরে।
ভক্ত বাঞ্ছা পুরাইতে কত দৈন্য করে।।
ভক্তাধীন কৃষ্ণ নিত্য সৰ্ব্ব শাস্ত্রে কয়।
এই লীলায় তার পূর্ণ দিলা পরিচয়।।
কহিতে কহিতে হৈলা প্রেমেতে বিহ্বল।
কহে তোর ভারিভুরি বুঝিলু সকল।।
যৈছে নট লোকে মাতায় সাজি নানা বেশ।
তৈছে লোক শিক্ষাইতে হৈলি ন্যাসী বেশ।।
তবে শ্রীঅদ্বৈত চন্দ্রের বাহ্য স্ফূৰ্ত্তি হৈল।
উচ্চস্বরে নাম-সংকীর্ত্তন আরম্ভিল।।
হেনকালে শ্রীআচার্য্যরত্ন মহাশয়।
সীতানাথের ঘরে আসি হইলা উদয়।।
তারে দেখি পুছে প্রভু উৎকণ্ঠিত মনে।
কহ কহ ঝাট নদীয়ার বিবরণে।।
শ্রীআচার্য্যরত্ন কহে শুনহ গোসাঞি।
সন্ন্যাস করিয়া হেথা আইলা নিমাঞি।।
শিহরিয়া প্রভু কহে কাহাঁ তিঁহো রয়।
আচার্য্যরত্ন কহে গঙ্গা-পারেতে উদয়।।
নৌকা লঞা যাহ তাঁরে পার করি আন।
প্রেমাবেশে উপবাসী আছে চারি দিন।।
শুনি মোর প্রভু দুঃখে হাহাকার করি।
শীঘ্র গঙ্গা পারে উত্তরিলা লঞা তরী।।
প্রেমাবিষ্ট গৌর অদ্বৈতেরে দেখি ভণে।
কিবাশ্চৰ্য্য আচাৰ্য্য হঞ আইলা বৃন্দাবনে।।
শুনি প্ৰভু কহে যাহাঁ তোমার উদয়।
তাহাঞি শ্রীব্রজধাম সৰ্ব্ব শাস্ত্রে কয়।।
এত কহি শ্ৰীচৈতন্য নিত্যানন্দে লঞা।
শান্তিপুরে গেলা প্রভু গঙ্গা পার হঞা।।
গৌরাঙ্গের সন্ন্যাসী বেশ দেখি সীতামাতা।
কত খেদ কৈলা তার নাহিক ইয়ত্তা।।
তবে মাতা রান্ধে অন্ন ব্যঞ্জন বহুত।
পিষ্টকাদি রান্ধিলা গৌরাঙ্গের প্রিয় যত।।
সদন্ধাজ্য পক্কদ্রব্য দিব্যামৃত পুর।
গাঢ় নিষ্ঠায় মাতা পাক করিলা প্রচুর।।
তুলসী মঞ্জরী দিলা ভোগের উপরে।
কৃষ্ণে ভোগ লাগাইলা আনন্দ অন্তরে।।
তবে গৌর নিত্যানন্দে করি আবাহন।
দিব্য পীঠে বসাইলা করিায় যতন।।
আচাৰ্য্য আগ্রহে দোঁহে ভোজনে বসিলা।
পারশ করিতে প্রভু নিজে দাণ্ডাইলা।।
তাহা দেখি হাসি গৌর কহে সীতানাথে।
শিব হীন যজ্ঞ সিদ্ধ না হয় কোন মতে।।
হাসি মোর প্রভু কহে তুহুঁ মূল শিব।
তব কৃপায় শিবত্ব লভয়ে সৰ্ব্ব জীব।।
মহাপ্রভু কহে তুহুঁ ছাড় ভারিভুরি।
তোমা ছাড়ি মুঞি কিছু খাইতে না পারি।।
তাহা শুনি উচ্চহাসি নিত্যানন্দ কয়।
মোর এক বাত শুন গৌর দয়াময়।।
এই পেটুক বামুনারে না কর আদর।
চারি হাতে ভুঞ্জিলেহ না পুরে উদর।।
কভু মাথা দিয়া ভুঞ্জে অগ্নির সমানে।
ঐছে মহাবিদ্যায় অধিকার নাহি আনে।।
শুনি শ্রীঅদ্বৈত কহে হাস্য প্রেমরোষে।
বহুরূপী হঞা তুহুঁ ভুঞ্জ দেশে দেশে।।
একাঞি অনন্ত মুখে করহ আহার।
তুয়া পেট পুরাইতে শক্তি আছে কার।।
হেন মতে দোহেঁ দোহাঁর তত্ত্ব প্রকাশিলা।
শুনি গৌর মন্দ মন্দ হাসিতে লাগিলা।।
মধ্যস্থ হইয়া তবে মহাপ্রভু বোলে।
দোহাঁর তুলনা হৈব ভোজনের তুলে।।
শুনি মোর প্রভু কহে শুদ্ধভক্তি ভাবে।
একমাত্র তুহুঁ পরিমাণ শূন্য ভবে।।
তোমাতে অনন্ত জগতের মান হয়।
অন্য তৌল যন্ত্রের কাজ না দেখি হেথায়।।
হেন মতে মহাপ্রভু প্রভু দুই জন।
ঠারেঠোরে বস্তুতত্ত্ব কৈলা উদ্ঘাটন।।
ভোজনাস্তে তিন ঠাকুর বিশ্রাম করিয়া।
সাধু সঙ্গের মহাশক্তি কহে ফুকারিয়া।।
ঊর্দ্ধবাহু হঞা বোলে শুন সৰ্ব্বজন।
সাধু সঙ্গের অবিচ্ছিন্ন স্বাভাবিক গুণ।।
তৃণ হইতে আপনারে নীচ করি মানে।
বৃক্ষাপেক্ষায় যার ক্ষম আছয়ে সহনে।
মান পাইবার বাঞ্ছা নাহি যার মনে।
সর্ব্বদা সুব্রত যেই অন্যের মান দানে।।[১]
নিরন্তর হরিনাম করয়ে কীৰ্ত্তন।
এই হয় সাধুগণের স্বরূপ লক্ষণ।।
সাধুর চরণাশ্রয় কর সৰ্ব্বজন।
তাহাতে মিলিবে সত্য নিত্য সাধ্য ধন।
অনন্ত শাস্ত্রের মর্ম্ম কে বুঝিতে পারে।
যেই জ্ঞানী সেই সাধু-ধৰ্ম্ম-রথে চড়ে।।
সর্ব্ব শাস্ত্রের সার সাধু করিয়া গ্রহণ।
সুলভ সৎপথ যাহা করে প্রকটন।।
সেই পথে যেই চলে সেই চক্ষুষ্মাণ।
তারে যেই বিমুখ সেই অন্ধের সমান।।
যৈছে কাচ ছেদিতে হীরার মাত্র ক্ষম।
ছিদ্র পাইলে সূত্রাদির হয় গমাক্ষম।।
তৈছে সাধুর প্রচারিত পথে যেই চরে।
অজ্ঞ হইলেও সেই যায় ভব পারে।।
ইহা লাগি পুরাতন ঋষিগণে কয়।
সাধুসঙ্গ বিনা না হয় নিৰ্ম্মল হৃদয়।।
সৰ্ব্ব জীবে সম দয়া সাধুর স্বভাবে।
সঙ্গ মাত্রে আপন স্বভাব দেয় জীবে।।
যৈছে কুমিরা কীটের স্বতঃ সঙ্গ গুণে।
তৎস্বারূপ্য লভে সত্য অন্য কীটগণে।।
সাধুসঙ্গ বিনা না হয় ভজন নির্ণয়।
সদাচার আর কৃষ্ণ ভক্তির উদয়।।
মহাপাপী দুরাচারী হয় যদি কেহ।
সাধু সূর্যোদয়ে ধ্রুব পূত হয় সেহ।।
স্পর্শমণির স্পর্শে যৈছে লৌহের স্বর্ণত্ব।
তৈছে সাধুসঙ্গে জীব হয় নিত্য মুক্ত।।
হেন মতে কত শত সদ্ধর্ম বর্ণিলা।
শুনি শ্রীবৈষ্ণববৃন্দ আনন্দে ডুবিলা।।
হেথা নবদ্বীপে মহাপ্রভুর জননী।
শান্তিপুরে গৌর আইলা লোকমুখে শুনি।।
নদীয়ার গৌরভক্তগণেরে মিলিঞা।
শান্তিপুরে উত্তরিলা আনন্দিত হঞা।।
শ্রীচৈতন্য মায়ে দেখি দন্ডবত কৈলা।
পুত্ৰমুখ চাঞা শচী কান্দিতে লাগিলা।।
শচী কহে নিমাঞি তোর এ বেশ দেখিয়া।
শেলাঘাত সম মোর বিদরিছে হিয়া।।
ক্রমে মাতার শোক-সিন্ধুর তরঙ্গ বাঢ়িল।
সেই স্রোতে জীবগণ ভাসিতে লাগিল।।
মহাপ্রভু মাতারে কহিলা মহাযোগ।
শুন তান সৰ্ব্ব শোক হইল বিয়োগ।।
তবে শচী পাক কৈলা সুসন্ধি শাল্যন্ন।
গৌরের প্রিয় ঘৃত-পক্ক বিবিধ ব্যঞ্জন।
অমৃত নিছিয়া পায়সাধি মিষ্ট অন্ন।।
গণ সহ আনন্দে ভুঞ্জিলা শ্রীচৈতন্য।
হেনমতে দিন কত সীতানাথের ঘরে।
যে আনন্দ হৈল তাহা কে বর্ণিতে পারে।।
দিনে মহাপ্রভু নাম উপদেশ দিলা।
রাত্রে পার্ষদ ভক্ত সঙ্গে সংকীৰ্ত্তন কৈলা।।
প্রেমানন্দে গৌরগণ হঞা উনমত্ত।
প্রেমাশ্রুতে শান্তিপুর কৈলা অভিষিক্ত।।
একদিন শ্রীগৌরাঙ্গ সভাকার স্থানে।
বিদায় মাঁগয়ে অতি মধুর বচনে।।
শুনি সর্ব্ব ভক্তের শোক-বিষ-উথলিল।
সেই জ্বালায় সৰ্ব্ব জীব ছট ফট কৈল।।
শচীর শোকানলের কথা কি করিমু আর।
অগ্নি আসিলেহ পুড়ি হয় ছারখার।।
হাহাকার রবে মাতা কহে গোরাচাঁদে।
কাহাঁ যাইবে মোরে বন্দি করি শোক ফাঁদে।।
নদীয়ায় নাহি যাবি তাহে নাঞি ক্ষতি।
হরি ভজ এই দেশে করিয়া বসতি।
মহাপ্রভু কহে মাতা না কহ ঐ বাত।
স্বদেশে রহিলে সন্ন্যাসীর ধর্ম্মবাদ।।
যদ্যাপি শ্রীশচী পুত্র বাৎসলোর খনি।
পুত্রে আজ্ঞা কৈলা দুস্তর অবিদ্যারে জিনি।।
মাতা কহে বৃন্দাবন হয় দূর দেশ।
শ্রীপুরুষোত্তমে রহ পাইমু সন্দেশ।।
মাতৃ আজ্ঞা শিরে ধরি শ্রীগৌরাঙ্গ চলে।
প্রিয় ভক্তগণ তান পড়ে পদতলে।।
ভক্তগণ কহে তোঁহে পাঙ কি না পাঙ।
জনমের মত দেখি পরাণ জুড়াঙ।।
শুনি শ্রীচৈতন্য কহে করুণার্দ্র হঞা।
তুমি সবে খেদ না করিহ মো লাগিয়া।।
শুধু এইবার নহে জনমে জনমে।
তুমি সব ছাড়া মুঞি নাহি এক ক্ষণে।।
যৈছে এই জন্মে সভে কৈলা মহোৎসব।
তৈছে আর দুই জন্মে করিয়া উৎসব।।
মোর মাত্র খালি দেহ তোরা পঞ্চপ্রাণ।
সভে ছাড়ি শূন্য দেহে যাইমু কোন স্থান।।
সন্ন্যাসীর ধর্ম্ম এবে রক্ষণ কারণ।
দেশে দেশে তীর্থক্ষেত্র করোঁ পর্যটন।।
সভে মিলে কর নিতি নাম সংকীৰ্ত্তন।
ধর্ম্মের প্রচার আর সাধুর সেবন।।
ইথে প্রেমানন্দ লভ্য হইব নিৰ্য্যাস।
মোহর লাগিয়া সভে না ভাব হুতাশ।।
হেন মতে গোরা সৰ্ব্ব ভক্তে প্রবোধিয়া।
শ্রীপুরুষোত্তমে চলে প্রেমাবিষ্ট হঞা।
সঙ্গে চলে নিত্যানন্দ আর শ্রীমুকুন্দ।
দামোদর পন্ডিত আর শ্রীজগদানন্দ।।
পথে কত পতিত পাষন্ডী দুরাচারে।
উদ্ধারিলা শ্রীচৈতন্য নিজ কৃপা দ্বারে।।
সঙ্গী চারি জন নাম উচ্চ করি গায়।
প্রেমাবেশে গৌর-সিংহ গৰ্জ্জিয়া চলয়।।
ক্রমে চলি চলি শ্রীরেমুণা ধামে গেলা।
গোপীনাথ দেখি সভে মহানন্দী হৈলা।।
নাচয়ে গৌরাঙ্গ প্রেমে হঞা মাতোয়ারা।
ক্ষণে কান্দে ক্ষণে ধায় হই দিশাহারা।।
নিত্যানন্দ প্রভুর প্রেমবন্যা উথলিল।
আকর্ষিয়া সৰ্ব্বজীবে তাহে ডুবাইল।।
তবে সাক্ষীগোপালে করিয়া দরশন।
উত্তরিলা গৌরচন্দ্র শ্রীপুরুষোত্তম।।
জগন্নাথে দেখি মহাভাব উপজিল।
কভু কান্দে কভু হাসে যৈছে মাতোয়াল।।
তবে গোরা প্রেমাবেশে হইলা মূৰ্চ্ছিত।
বহুক্ষণে বাহ্য স্ফূর্ত্তি নহিল কিঞ্চিত।।
তাঁহা সাৰ্ব্বভৌম ভট্টাচার্য বিজ্ঞতম।
পণ্ডিতের শিখামণি বৃহস্পতিসম।।
তিঁহো গৌর অঙ্গে দেখি দিব্য মহাভাব।
কহে এই জন মহাপুরুষ সম্ভব।।
তবে শ্রীগৌরাঙ্গ নিজ গৃহে লঞা গেলা।
নিত্যানন্দ আদি আসি তাহাঞি মিলিলা।।
গৌরে বেড়ি সভে করে নাম সংকীর্ত্তন।
হরি বলি উঠি গোরা করয়ে কৰ্ত্তন।।
তবে ভট্ট শ্রীমহাপ্রসাদ আনাইলা।
যতনে চৈতন্যে গণ সহ ভুঞ্জাইলা।।
দিন কত পরে গৌরের বিভূতি প্রকাশ।
দেখি ভট্ট-মনে হৈল ভক্তির উল্লাস।।
পূর্ব্বে সাৰ্ব্বভৌম ছিলা শুষ্ক জ্ঞানীচর।
গৌর স্পর্শমণির গুণে হৈলা ভক্তবর।।
তবে গৌর দক্ষিণের তীর্থাদি ভ্রমিলা।
তাহে রায়-রামানন্দের সহিত মিলিলা।।
ভক্তি-শাস্ত্রের সুসিদ্ধান্তে রায় পটুতর।
যারে মোর প্রভু কহে কৃষ্ণ পরিকর।।
রামানন্দ বক্তা তাঁহা শ্রীচৈতন্য শ্রোতা।
অমানুষি ভাব সেই ভক্ত মন মাতা।।
তবে গৌর পুন শ্রীপুরোষত্তমে আইলা।
জগন্নাথ দেখি শুদ্ধ প্রেমে মগ্ন হৈলা।।
রাজা প্রতাপ-রূদ্রে কৃপা কৈলা ভক্ত ভাসে।
ভক্ত-বাঞ্চা পুরাইতে ঐশ্বৰ্য্য প্রকাশে।।
ষড়ভূজ হৈলা গোরা দয়ার নাঞি ওর।
সেরূপ নিরখি ভক্ত প্রেমে হৈলা ভোর।
সেই রূপামৃত গঙ্গা কেহ ভাগ্যে পিলা।
কেহ তাহা না পাইয়া হাহাকার কৈলা।।
স্বয়ং ভগবানের হয় দয়ামৃত মূৰ্ত্তি।
নিশ্চয় ভক্তদ্বারে তাঁর দয়া পায় স্ফুর্ত্তি।।
তবে জগন্নাথের রথ-যাত্রা উপলক্ষে।
গৌরাঙ্গ দেখিতে প্রভু চলিলা শ্রীক্ষেত্রে।।
আচার্য্যের সঙ্গে ভক্ত চলে অগণন।
সেই সঙ্গে কৃষ্ণমিশ্র যাইতে কৈলা মন।।
শ্রীঅদ্বৈত কহে পথ অতি সুদুৰ্গম।
এবে যাইবারে তোহার নাহি প্রয়োজন।।
কৃষ্ণমিশ্র কহে এই অসার সংসার।
শ্রীগৌরাঙ্গের পদাশ্রয় সেই সত্যসার।।
যদ্যপি নিত্য বৈরাগ্য কৃষ্ণমিশ্রের হয়।
গৌরাঙ্গ ধ্যানেতে হৈল বৈরাগ্যাতিশয়।।
তাহা জানি সীতামাতা কৃষ্ণদাসে কর।
শ্রীক্ষেত্রে যাইতে তোর না হইল সময়।।
শুন কৃষ্ণমিশ্র মাতৃবাক্য শিরে ধর।
গৃহে রহি কৃষ্ণ ভজ সর্ব্ব শুভ কর।।
তোর জ্যেষ্ঠ অচ্যুতের কুমার বৈরাগ্য।
কৃষ্ণ আর পিতৃ-সেবায় তোরে মানি যোগ্য।।
তোর ভার্য্যা শ্রীবিজয়া সহ মন্ত্ৰ লহ।
কৃষ্ণ সেবায় সৰ্ব্বসিদ্ধি নাহিক সন্দেহ।।
এত কহি দোহেঁ লঞা গঙ্গাতীরে গেল।
আপনার সিদ্ধ মন্ত্র দোহাঁকারে দিলা।।
নিত্য-সিদ্ধ কৃষ্ণমন্ত্র পাইয়া দম্পতী।
প্রেমানন্দে মাতৃপদে কৈলা নতি স্তুতি।।
সংক্ষেপে কহিনু এই গূঢ় বিবরণ।
তবে শ্রীঅদ্বৈত কৈলা শ্রীক্ষেত্রে গমন।
নিজ গণ পাঞা গৌর মহানন্দী হৈলা।।
মহাসংকীৰ্ত্তন করি নগর ভ্রমিলা।।
আগে আচার্য্যেরে দিলা করিয়া সম্মান।
মধ্যে গৌর নিত্যানন্দ পিছে ভক্ত যান।।
হইল অদ্ভুত নৃত্য লোকে চমৎকার।
কীৰ্ত্তন মাধুর্য্যে মন ডুবিল সভার।।
কেহ হাসে কেহ কান্দে প্রেমের স্বভাবে।
কেহ মেঘ সম গর্জ্জে হরে কৃষ্ণ রবে।।
বহু ক্ষণে হরি সংকীৰ্ত্তন নিবৰ্ত্তিয়া।
স্নানে গেলা মহাপ্রভু ভক্তগণ লঞা।।
শ্রীঅদ্বৈত নিত্যানন্দের কৌতূক বাঢ়িল।
শুদ্ধ ভক্তগণ লঞা জল ক্রীড়া কৈল।।
প্রেমাবেশে গোরা অদ্বৈতেরে শোয়াইলা।
মোর প্রভু জলে শুতি ভাসিতে লাগিলা।।
কিবা ভাবাবেশে গৌর উঠে তান বুকে।
মহা প্রভু লঞা প্রভু ভাসে অনুরাগে।
কিবা শক্তি প্রকাশিলা নাহি পাঙ ওর।
দেখি ভক্তগণ হৈলা প্রেমানন্দে ভোর।।
যৈছে মহাবিষ্ণু শুইলা অনন্তশয্যায়।
তৈছে অদ্বৈতাঙ্গ-শয্যার গৌর লীলোদয়।।
অপূর্ব্ব দোহাঁর নর-লীলা প্রকটনে।
হরি হরি ধ্বনি করে সর্ব্ব ভক্তগণে।।
হেন মতে গৌর করি শেষ-শায়ী লীলা।
গণ সহ আচার্য্যের নিমন্ত্রণ গেলা।।
স্বগণ কৃষ্ণ-চৈতন্য করিলা ভোজন।
সীতানাথ প্রেমাবেশে করয়ে স্তবন।।
এ হেন অদ্ভুত লীলা না দেখিনু মুঞি।
দেখিলা প্রত্যক্ষে মহা ভাগ্যবন্ত যেই।।
শ্রীপাদ নিত্যানন্দ প্রভুর মুখাজ-নিঃসৃত।
এই লীলারসামৃত পিয়া হৈনু পুত।।
চৈতন্যাদ্বৈতের লীলার নাহিক গণন।
সূত্র লব মাত্রে মুঞি করিনু লিখন।।
শ্রীচৈতন্য শ্রীঅদ্বৈত পদে বার আশ।
নাগর ঈশান কহে অদ্বৈত-প্ৰকাশ।।

ইতি শ্রীঅদ্বৈত-প্ৰকাশে পঞ্চদশোহধায়ঃ।

১. ‘তৃণাদপি সুনীচেন’… ইত্যাদি