অদ্বৈতপ্রকাশ – ১৪

চতুৰ্দ্দশ অধ্যায়

জয় জয় শ্রীচৈতন্য জয় সীতানাথ।
জয় নিত্যানন্দ রাম ভক্তগণ সাথ।।
তবে কিছু দিন পরে শ্রীশচীনন্দন।
পিতৃকার্য্যে গয়া ধামে করিলা গমন।।
ভক্তি করি গদাধরের পদে পিণ্ড দিলা।
তহিঁ শ্রীঈশ্বরপুরীর সাক্ষাত পাইলা।।
পুরীরাজে দেখি নিমাঞি দন্ডবৎ কৈলা।
তিহোঁ সসম্ভ্রমে গৌরচন্দ্রে আলিঙ্গিলা।।
পুরীরাজে বক্তা শ্রীমান্ বিশ্বম্ভর শ্রোতা।
সমগ্র রজনী আলাপিলা কৃষ্ণ-কথা।।
হরি-কথামৃত পিয়া দোঁহে হৈলা মত্ত।
প্রেমাবেশে নাচে কান্দে যৈছে উনমত্ত।।
পর দিন মহাপ্রভু দেখি শুভক্ষণ।
পুরীরাজ স্থানে মন্ত্র করিলা গ্রহণ।।
দশাক্ষর মন্ত্র তাহে কৃষ্ণ অধিষ্ঠান।[১]
প্রত্যক্ষেতে দেখাইলা কৃষ্ণ মুৰ্ত্তিমান।।
দেখিয়া অপূর্ব্বরূপ শ্রীশচীনন্দন।
শুদ্ধপ্রেমে মত্ত হৈয়া করয়ে ক্রন্দন।।
পুরীরাজে প্রণমিয়া কহে বারে বার।
বড় কৃপা করি কৈলা মো ছারে উদ্ধার।।
পুরী কহে তত্ত্ব জানি না করিহ দৈন্য।
জীব শিক্ষাইতে ধরায় হৈলা অবতীর্ণ।।
স্বতন্ত্র ঈশ্বর তুহুঁ চিদানন্দময়।
তব মায়া নাটে কার নাহি ভ্রম হয়।।
তুয়া গূঢ় প্রতিবিম্ব মন্ত্র-দরপণে।
দেখিয়া বিস্ময় হৈলা আপনার মনে।।
যৈছে শিশু নিজ বিম্ব দেখি ক্রীড়া করে।
তৈছে নিজ বিম্ব দেখি তব প্রেমাঙ্কুরে।।
রাধা অঙ্গ কান্ত্যে কৈলা অঙ্গ আচ্ছাদন।
রাধা ভাবে কর স্বমাধুৰ্য্য আস্বাদন।।
শুনি মহাপ্রভু করি বিষ্ণু স্মরণ।
কহে গুরু কিবা কহ মুঞি অভাজন।।
তুয়া দিব্য ভক্তি চক্ষে না হয় অন্য স্ফুৰ্ত্তি।
সৰ্ব্বত্র দেখয়ে চিদানন্দ কৃষ্ণ-মূৰ্ত্তি।।
পুরীরাজ প্রেমাবেশে তাহা না শুনিয়া।
অট্ট অট্ট হাসে নাচে উৰ্দ্ধবাহু-হঞা।।
লোকের সংঘট দেখি প্রেম সঙ্কোচিলা।
গৌরে গাঢ় আলিঙ্গিয়া কৃতাৰ্থ মানিলা।।
তবে কুমারহট্টে গেলা গৌর বিশ্বম্ভর।
পুরীরাজের জন্মস্থান অতি পূণ্যতর।।
কুমারহট্টের গৌর বহু প্ৰশংশিলা।
পুরীরাজে প্রণমিয়া বিদায় মাগিলা।।
ক্রমে মহা প্রভু নবদ্বীপ ধামে আইলা।
প্রিয়বন্ধু ভক্তবৃন্দ আসিয়া মিলিলা।।
গৌরে দেখি বন্ধুগণ স্মিত মুখে কহে।
কাহে নব বেশ নিমাঞি দেখি তব দেহে।।
দ্বাদশ অঙ্গেতে কৈলা তিলক রচন।
সর্বঅঙ্গে হরিনাম করিলা লিখন।।
তুলসীকাষ্ঠের মালা কন্ঠেতে পরিলা।
শঙ্খ চক্রাকার চিহ্ন কেন বা ধরিলা।।
শুনি গোরা কহে উপহাস না করিহ।
তিলকাদি ধারণের নিত্যতা জানিহ।।
তিলক তুলসী মালা যেই না ধরয়।
তার সন্ধ্যা পূজাদি বিফল শাস্ত্রে কয়।।
অতএব ইহাকে সদ্‌বেশ করি মানি।
সদ্‌বেশের অনন্ত শক্তি কহে মহামুনি।।
সদ্‌বেশধারণ চিত্ত শুদ্ধির কারণ।
গুরু পরম্পরা ধর্ম্ম দেহ পূজ্যতম।।
সদ্‌বেশ ধরিয়া জীব জীবন্মুক্তি পায়।
সদ্‌বেশে পূতনা দিব্যগতি প্রাপ্ত হয়।।
শুনি সবে কহে গৌরের হৈল ভাবান্তর।
আনন্দে ডুবিল ভক্ত মানস-মকর।।
গৌরের প্রিয়তম শ্রীপন্ডিত গদাধর।
গৌরে পুছে কহ গয়ার শুভ সমাচার।।
মহাপ্রভু কহে ধরাধাম তীর্থরাজ।
পাদপদ্ম তীর্থ তহিঁ করয়ে বিরাজ।।
অনাথের বন্ধু হরি দয়ার ভান্ডার।
পদ চিহ্ন দ্বারে জীবে করয়ে নিস্তার।।
সেই দেখে গয়াসুরের শিরঃ স্থিত পদ।
অন্তে সেই পায় দেব-দুর্লভ পদ।।
সেই হরিপদে যেই করে পিন্ড দান।
তার মাতৃপিতৃ-কূল পায় পরিত্রাণ।।
বহুস্থানে বহু রূপে হরি কৃপা করে।
ভাগ্যবত্ত সুবিশ্বাসী জীবে মাত্র স্ফুলে।।
কহিতে কহিতে হইল প্রেম উদ্দীপন।
লোকাপেক্ষা নাহি করি করয়ে ক্রন্দন।।
কৃষ্ণ কৃষ্ণ রবে গোরা ছাড়য়ে হুঙ্কার।
ভক্তগণ কহে ঠাকুর হৈল পরচার।।
মহাপ্রভুর প্রেম দেখি কান্দে ভক্তগণ।
সভে মিলি আরম্ভিলা নাম সংকীৰ্ত্তন।।
ক্রমে সংকীর্তনের প্রেম-তরঙ্গ বাঢ়িল।
গৌর গদাধর দোঁহে বহু নৃত্য কৈল।।
শ্রীবাসাদি কহে এবে হইমু বিজয়।
শ্রীগৌরাঙ্গে হৈল যবে মহাপ্রেমোদয়।।
গয়া হইতে নিমাঞি পন্ডিত আইলা ঘরে।
শুনি বহু পঢ়ুয়া আইলা পঢ়িবারে।।
কেহ ব্যাকরণ পড়ে কেহ দরশন।
সর্ব্বসূত্রে গৌর করে কৃষ্ণের বর্ণন।।
ছাত্রগণ কহে বিদ্যাসাগর কিবা কহ।
ইথে না কর সন্দেহ মহাপ্রভু কহে।।
শব্দ ব্রহ্ম কৃষ্ণ ইহা চারিবেদে কয়।
ইহা বৈ অর্থ মোর নাহিক স্ফুরয়।।
শুনি শ্রীঅচ্যুতের হৈল বৈরাগ্য উদয়।
শ্রীগৌরাঙ্গের সঙ্গে তিহো কৃষ্ণ গুণ গায়।।
আর যে যে ছাত্রের ছিল পরম সৌভাগ্য।
অচ্যুতের উপদেশে পাইলা বৈরাগ্য।।
মহাপ্রভুর প্রেমোল্লাস দেখি ভক্তগণ।
শ্রীঅদ্বৈত স্থানে সব কৈলা নিবেদন।।
যদ্যপি আচার্য্য গৌরের জানে সব তত্ত্ব।
তবু তার প্রকাশ শুনি হৈলা প্রেমোন্মত্ত।।
ভাবাবেশে কহে ভক্ত স্থানে সীতানাথ।
শুন শুন কহি মুঞি গূঢ় এক বাত।।
নিত্য মোর গীতা পারায়ণের নিয়ম।
অর্থগ্রহণ করি যাঙ করিতে পঠন।।
এক দিন এক শ্লোকে হইল সংশয়।
উপবাস করি মুঞি রহিল শুতিয়া।।
স্বপ্নে এক জন মোরে কহিলা হাসিয়া।।
উঠহ আচাৰ্য্য কাহে কর উপবাস।
এই শ্লোকের এই অর্থ জানিহ নির্যাস।।
শুনি মোর মনে হৈল অতি চমৎকার।
চক্ষু মেলি দেখি আগে গৌর বিশ্বম্ভর।।
দেখিতে দেখিতে তেঁহো হৈলা অন্তৰ্দ্ধান।
বুঝিলু নিমাঞি হয় পুরুষ প্রধান।।
ধুমদৃষ্টে যৈছে হয় অগ্নি অনুমান।
তৈছে অলৌকিক গুণে ঈশ্বরের প্রমাণ।।
প্রেম মহাসিন্ধু কৃষ্ণ স্বয়ং ভগবান।
কৈছে লুকাইতে পারে তরঙ্গ তাহান।।
সত্যানুসরণ ঈশ্বরের লীলা হয়।
আপনে আচরি ধর্ম্ম জীবেরে শিখায়।।
কহিতেঞি হৈল প্রভুর মহাভাবাবেশ।
কহে প্রেম বন্যায় ভাসাইমু সৰ্ব্ব দেশ।।
সঘনে হুঙ্কার করে লোকে চমৎকার।
ভক্তগণের মনে হৈল আনন্দ অপার।।
সাধু সমুঝিলা কৃষ্ণ হৈলা অবতীৰ্ণ।
শুদ্ধ প্রেমদানে বিশ্ব করিবেন ধন্য।।
তবে সভে সংকীৰ্ত্তন করে প্রেমানন্দে।
হাসে কান্দে নাচে গৰ্জ্জে যৈছে মেঘবৃন্দে।।
এবে শুন প্রভু নিত্যানন্দের বিজয়।
যাহার শ্রবণে জীবের হয় প্রেমোদয়।।
রাঢ়দেশে একচাকা নামে গ্রাম ধন্য।
যহি নিত্যানন্দ-রাম হৈলা অবতীর্ণ।।
বসুদেব অবতার হাড়াই পন্ডিত।
তান পুত্র নিত্যানন্দ সদাই আনন্দিত।।
পদ্মাবতী মাতা তাঁর সাধ্বী শিখামণি।
মোর প্রভু কহে যাঁরে সাক্ষাত রোহিণী।।
তের শত পঁচানব্বই শকে মাঘ মাসে।
শুক্লাত্রয়োদশীতে রামের পরকাশে।।
ব্রজে বলরাম যেই সেই নিত্যানন্দ।
অবতীর্ণ হৈলা বিতরিতে প্রেমানন্দ।।
সন্ন্যাসীর সঙ্গ ছলে গৃহত্যাগ কৈলা।
বহু তীর্থ ভ্রমি শেষে ব্রজধামে গেলা।।
তঁহি কিছু দিন রহি প্রভু নিত্যানন্দ।
গৌর পরকাশে মনে পাইলা প্রেমানন্দ।।
ন্যাসী চূড়ামণি দয়া গুণের আকর।।
নিত্য সিদ্ধ বলদেবে দেখি বিশ্বম্ভর।
গণ সহ তাঁর পদে কৈলা নমস্কার।।
গৌর-সূর্য্যের ছটা পড়ি নিত্যানন্দ চাঁদে।
শুদ্ধ প্রেমামৃত জ্যোৎস্নায় ব্যাপে অবিচ্ছেদে।।
গৌরে দেখি স্বয়ং ভগবানের লক্ষণ।
কৃষ্ণ জ্ঞানে হৈল তান স্তম্ভ উদ্দীপন।।
নিত্যানন্দ স্তম্ভিত দেখিয়া গৌররায়।
নিত্যানন্দ প্রকাশিতে সৃজিলা উপায়।।
ভক্ত দ্বারে ভাগবতের শ্লোক পঢ়াইলা।
শুনি নিত্যানন্দ প্রেমে মুচ্ছিত হইলা।।
চেতন পাইয়া প্রভু করয়ে ক্রন্দন।
কভু নাচে কভু হাসে উনমত্ত সম।।
কভু কৃষ্ণ পাইলা বুলি ছাড়য়ে হুঙ্কার।
কভু অবিশ্রান্ত নেত্রে বহে অশ্রুধার।।
নিত্যানন্দের প্রেমানন্দ মেঘ বরিষণে।
ভক্ত-নেত্র-গঙ্গা স্রোত বহয়ে দ্বিগুণে।।
তাহে গৌর-প্রেমসিন্ধুর তরঙ্গ বাড়িল।
সর্ব্বজ্ঞের মন-মকর তাহাতে ডুবিল।।
তাঁহা হৈতে তিহোঁ শ্ৰীধাম নবদ্বীপে আইলা।
কতোক্ষণ পরে সভে সুস্থির হইলা।
নন্দন আচার্য্য ঘরে অবস্থিতি কৈলা।।
নিত্যানন্দের আগমন জানি বিশ্বম্ভর।
গোপনে করয়ে তত্ত্ব-ভক্তের গোচর।।
এক মহাপুরুষ সৎকল্পতরু প্রায়।
ভক্তি-ফল সমর্পিতে আইলা হেথায়।।
চল সভে যাইবাঙ তাঁহার গোচর।
দেখিলে জানিবা তান মহিমা বিস্তর।।
শুনি সৰ্ব্বভক্তগণ উৎকণ্ঠিত হৈলা।
মহাপ্রভু সঙ্গে সভে আনন্দে চলিলা।।
শ্রীনন্দন আচার্য্যের ঘরে উত্তরিলা।
নিত্যানন্দে দেখি সভে বিস্ময় মানিলা।।
অলৌকিক রূপ তাঁর প্রকাণ্ড শরীর।
কোটি-সূৰ্য্য কান্তি প্রকৃতি গম্ভীর।।
ললাটে তিলক শোভে যৈছে চন্দ্ৰ প্রভা।
তুলসী কাঠের মালার কন্ঠ করে শোভা।।
হাস্য যূত মুখপদ্ম পরম সুন্দর।
শ্রীগৌরাঙ্গ নিত্যানন্দে সদৈন্যে কহিলা।।
তুহুঁ শুদ্ধ ভক্তি-মেঘ দয়া প্রকাশিলা।
বরিষণ করি মোরে পবিত্র করিলা।।
কোটি সিংহরব সম তুয়া গরজনে।
বিশ্ব ভাসাইয়া প্রেমে হেন বাসোঁ মনে।।
শুনি নিত্যানন্দ হাসি কহে মৃদুভাসে।
অতি গুরুত্বের গতি নিম্নে পরকাশে।।
প্রেম মহাসিন্ধু তুহুঁ মেঘের কারণ।
তব দয়া সূৰ্য্যাকর্ষণ দ্বিতীয় কারণ।।
হেন মতে তিহোঁ শুদ্ধ ভক্তির উল্লাসে।
গৌরহরি বস্তুতত্ত্ব গূঢ় পরকাশে।।
তবে নিত্যানন্দ সঙ্গে শ্রীশচীনন্দন।
নিতি সংকীৰ্ত্তন করে লঞা ভক্তগণ।।
এক দিন শ্রীঅদ্বৈত মনে বিচারিলা।
ভক্তি প্রসারিতে কৃষ্ণ নবদ্বীপে আইলা।।
ভক্তি হইতে জ্ঞান বড় করিমু ব্যাখ্যান।
ইথে কিবা আচরয়ে স্বয়ং ভগবান।।
এই গূঢ় ভাবাবেশে আচাৰ্য্য গোসাঞি।
যোগবাশিষ্ঠের ব্যাখ্যায় করে চতুরাঞি।।
শিষ্যগণে প্রভু কহে জ্ঞান ভক্তির বড়।
জ্ঞানাৎপরতরং নহি এই কথা দৃঢ়।।
শিষ্যগণ দুঃখী হঞা ভাবে মনে মনে।
বিপরীত বৃদ্ধি প্রভুর উপজিল কেনে।।
যেই প্রভু কহে ভক্তি মহারাণী হয়।
জ্ঞান তার দাসের দাস জানিহ নিশ্চয়।।
ভক্তিশূন্য জ্ঞানে নাহি মিলে সারাৎসার।
তুষার-ঘাতীর যৈছে ক্লেশ মাত্রসার।।
সেই প্রভু কহে ভক্তির কিবা প্রয়োজন।
অহংব্রহ্ম জ্ঞানে মুক্তি কহে শ্রুতিগণ।।
হেথা নবদ্বীপে সৰ্ব্ব-জ্ঞান বিশ্বন্তর।
পূৰ্ব্বেঞি জানিয়া ছিলা আচার্য্যের অন্তর।।
নিত্যানন্দে সঙ্গে লঞা ধাইয়া চলিলা।
মদ্যপেরে দয়া করি শান্তিপুরে গেলা।।
মহাপ্রভুর শুভাগতি জানিয়া আচাৰ্য্য।
দৃঢ় করি জ্ঞান-ব্যাখ্যার বাঢ়ার মাধুর্য্য।।
হেন কালে শ্রীচৈতন্য নিত্যানন্দ সনে।
উত্তরিলা আসি শ্রীঅদ্বৈতাচার্য্য স্থানে।।
ক্ষীরনিধি হৈতে যৈছে বিষ উদ্ধারণ।
তৈছে সীতানাথ মুখে ভক্তির খণ্ডন।।
ভনিয়া আচাৰ্য্য মানি গৌর ভগবান।
রজঃ স্বীকারিয়া ক্রোধে হৈলা কম্পবান।।
উচ্চস্বরে কহে নাঢ়া কিবা বুদ্ধি তোর।
স্পর্শমণি ছাড়ি কাচে করহ আদর।।
লোকে কহে আচাৰ্য্য হয় ভক্তি প্রয়োজক।
এবে দেখি হৈলি তুঞি ভক্তির কন্টক।।
তোরে সংহারিয়া করোঁ ভক্তি সংস্থাপন।
ত্রিলোকে কাহার শক্তি করিবে খণ্ডন।।
এত কহি মহাপ্রভু শ্রীনৃসিংহাবেশে।
পিণ্ডা হৈতে আচার্যেরে ফেলে নীচ দেশে।।
গৌরে দেখি ভক্তি রক্ষার গাঢ় অনুরাগ।
প্রেমে মূৰ্চ্ছা হৈলা শ্রীঅদ্বৈত মহাভাগ।।
তাহা দেখি হাহাকার করে শিষ্যগণ।
সৰ্ব্বজ্ঞা শ্রীসীতা প্রেমে করয়ে ক্রন্দন।।
কতক্ষণে মোর প্রভুর বাহ্যস্ফূর্ত্তি হৈল।
তবে বিশ্বম্ভর তানে কহিতে লাগিল।।
অরে নাঢ়া মনে যদি এই ছিল আশ।
তবে কাহে মোরে তুঞি করিলি প্রকাশ।।
বেদে কহে ব্রহ্মের অংশ মধ্যে জীব গণ্য।
যৈছে দুগ্ধ দধি হয় বহু তারতম্য।।
সোহং জ্ঞানে জীবের কৃষ্ণে অপরাধ হয়।
ক্ষণিক মুকতি পাঞা পুন ভবে যায়।।
শুনি ভক্ত অবতার ভক্তি নেত্রে চায়।
ভক্তরূপে কৃষ্ণ প্রকট দেখিবারে পার।।
দ্বিভুজ মুরলীধর শিরে শিখি-পাখা।
রাধা অঙ্গ কান্ত্যে তার সর্ব্ব অঙ্গ ঢাকা।
যদ্যপি অদ্বৈত কৃষ্ণ-সৰ্ব্বতত্ত্ব জান।
সিদ্ধরূপ দেখি প্রেমে হৈলা অজ্ঞান।।
সংজ্ঞা পাঞা কহে অপরাধ হৈল মোর।
এবে ভক্তি বিলাইবাঙ আজ্ঞা পাইলু তোর।।
এত কহি দুই গ্রন্থ আনি সযতনে।
গৌর নিত্যানন্দ আগে করিলা স্থাপনে।।
শ্রীযোগবাশিষ্ঠ আর শ্রীভগবদ্গীতা।
এই দুয়ের ভাষ্য মোর প্রভু রচয়িতা।।
ভক্তিবর্গ ভাষ্য সেই অতি চমৎকার।
গৌরে দেখাইলা প্রভু করিয়া আদর।।
শ্রীগৌরাঙ্গ সেই দুই ভাষ্য পাঠ করি।
শুদ্ধপ্রেমে আর্দ্র হঞা কহয়ে ফুকারি।।
এই দুই ভক্তিবর্থ ভাষ্য যে রচিলা।
সেই অপ্রাকৃত ভক্তি-সাগর মখিলা।।
সেই কৃষ্ণের আত্মরূপ ভক্ত অবতার।
তাঁহার চরণে মোর কোটি নমস্কার।।
ঊর্দ্ধবাহু হঞা কহে প্ৰভু নিত্যানন্দ।
এই ভাষ্যকার হয় জগতের বন্দ্য।।
শুনি শ্রীঅদ্বৈত কহে সকলি সম্ভবে।
ভক্তমান বাঢ়াইতে কৃষ্ণের স্বভাবে।।
কৃষ্ণ কৃপায় ভক্ত-হৃদে নিত্যাসরস্বতী।
উদয় হইয়া ভক্তিতত্ত্ব করে স্ফূর্তি।।
কৃষ্ণ বড় দয়াময় পতিতপাবন।
তাঁর অবতীর্ণ জীব নিস্তার কারণ।।
এত কহি ভাবাবেশে করবে রোদন।
গৌর নিত্যানন্দ প্রেমে করয়ে নর্তন।।
হরিদাস হরি বলি গভীর গৰ্জ্জয়।
অচ্যূতাদির হৈল শুদ্ধ প্রেম-স্তম্ভোদয়।।
তবে মহাপ্রভু আর প্রভু দুই জন।
মহা প্রেমাবেশে ফুকারয়ে ঘনে ঘন।।
আইস আইস জীবগণ আর ভয় কারে।
মায়া রোগের মহৌষধি দেয় সভাকারে।।
সেই মহৌষধি এক বিন্দু পান কৈলে।
পাইবা অটল প্রেমানন্দ অবহেলে।।
শুনি ভক্তগণের শুদ্ধ-প্রেম উপজিল।
সভে মিলি হরিসংকীর্ত্তন আরম্ভিল।।
মহাপ্রভু অবিচিন্ত্য-প্রেমকল্পবৃক্ষ।
দুই প্রভু হয় তার দুই স্কন্ধ মুখ্য।।
তিনে এক বস্তু কেবল রূপ মাত্র ভেদ।
যৈছে রাম নৃসিংহাদির কিঞ্চিৎ প্রভেধ।।
কেহ ভক্তরূপ কেহ ভক্তের স্বরূপ।
কেহ ভক্ত অবতার তিন রসকূপ।।
তিন বেদরূপ হয় তিনের হুঙ্কার।
হরিনামে নিস্তারিলা সকল সংসার।।
কতক্ষণে নিবৰ্ত্তিয়া নাম-সংকীৰ্ত্তন।
যুক্তি করে কৈছে হৈব ধৰ্ম্ম প্ৰবৰ্ত্তন।।
হেথা গৌর-গত প্রাণা সীতা পাক-ঘরে।
বস্ত্রে মুখ বান্ধি রান্ধে হরিষ অন্তরে।।
বহুত ব্যঞ্জন শাক আর পিঠা পানা।
ঘৃতপক্ক পায়সান্ন অমৃত উপমা।।
মুঞি অধম কৈলা তার জলের টহল।
মোর প্রতি মাতা স্নেহ করয়ে অটল।।
তবে মদনগোপালে ভোগ লাগাইলা।
তুলসী-মঞ্জরী ভোগের উপরে অর্পিলা।।
ভোগ সরাইয়া আসন দিলা তিন ঠাঞি।
দক্ষিণে নিতাই মধ্যে বসিলা নিমাঞি।।
অদ্বৈত বসিলা বামে করি দৈন্যপানা।
পরিবেশন করে সীতা যৈছে অন্নপূর্ণা।।
তিন ঠাকুর সেবা কৈলা নানাবিধ রসে।
তাহার উচ্ছিষ্ট মাগে শ্রীঈশান দাসে।।
ভোজনান্তে মহাপ্রভু যুকতি করিয়া।
নবদ্বীপে গেলা দুই প্রভুরে লইয়া।।
তিনে মিলি হরিনাম করিলা বিস্তার।
কত শত মহাপাপী করিলা নিস্তার।।
জগাই মাধাই আর কাজির উদ্ধার।
কৈলা অত্যাদ্ভূত লীলা লোক চমৎকার।।
এই লীলা কথা লিখিবারে নাঞি ক্ষম।
মুঞি করাইলু মাত্র দিগ দরশন।।
শ্রীচৈতন্য শ্রীঅদ্বৈত পদে যার আশ।
নাগর ঈশান কহে অদ্বৈত-প্রকাশ।।

ইতি শ্রীঅদ্বৈত-প্ৰকাশে চতুৰ্দ্দশোহধ্যায়ঃ।

১. ঈশ্বরপুরী প্রদত্ত মন্ত্র দশাক্ষর