অদ্বৈতপ্রকাশ – ২০

বিংশ অধ্যায়

জয় জয় শ্রীচৈতন্য জয় সীতানাথ।
জয় নিত্যানন্দ রাম ভক্তগণ-নাম।।
এবে শুন নিত্যানন্দপ্রভুপাদ লীলা।
মহাপ্রভুর আজ্ঞায় তিঁহ গৌড় দেশে গেল।
উদ্ধারণ দত্ত হয় প্রভুর কৃপা পাত্র।
নিজ প্রভুর সেবা তিঁহ করে অহোরাত্র।।
ক্রমে শ্ৰীমান্ নিত্যানন্দ আইলা অম্বিকায়।
ধরিলা মোহন রূপ দেবের বিস্ময়।।
সেই রূপে সর্ব্ব চিত্ত হইল মোহন।
সভে কহে এই কোন রাজার নন্দন।।
হেন কালে সূৰ্য্যদাস পন্ডিত আইলা।
নিত্যানন্দের রূপ দেখি আশ্চৰ্য্য মানিলা।।
সূর্যাদাস কহে তানে বিনয় করিয়া।
তাঁহা তব ধাম নাম কহ বিবরিয়া।।
উদ্ধারণ কহে ইহোঁ ব্ৰাহ্মণ উত্তম।
রাঢ়ী শ্রেণী সর্ব্বশাস্ত্রে অতি উচ্চতম।।
ন্যায়-চূড়ামণি ইহাঁর শাস্ত্রের আখ্যাতি।
নিত্যানন্দ নাম প্রেমানন্দ পুরে স্থিতি।।
শুনি হর্ষে কহে সূৰ্য্যদাস মতিমান্।
মোহর আশ্রমে আসি করহ বিশ্রাম।।
শুনি নিত্যানন্দ হাসি তার ঘরে গেলা।
যত্নে দ্বিজ প্রভুরে ভোজন করাইলা।।
গ্রামের রমণীগণ ঝাঁকে ঝাঁকে আইলা।
নিত্যানন্দের রূপ দেখি সভে প্রশংসিলা।।
সূর্য্যদাস-পত্নীস্থানে নারীগণ কয়।
এই পাত্র হৈলে তোর কন্যার যোগ্য হয়।।
সূর্য্যদাসের দুই কন্যা কমলার সমা।
বসুধা জাহ্নবা রূপে গুণে নিরুপমা।।
শ্রীককুস্মি মহারাজ সূর্য্যদাস পণ্ডিত।
তার পত্নী সাধ্বী সতী গূণে বিভূষিত।।
তিঁহ কহে তোরা সভে কর আশীর্ব্বাদ।
সৎপাত্রে দুহিতা দিতে নাহি কার সাধ।।
কিন্তু পন্ডিতের কিবা ইচ্ছা নাহি জানি।
তার মন হৈল তবে শুভ করি মানি।।
হেনকালে আইল সূৰ্য্যদাস সুপন্ডিত।
নারীগণ কহে তাঁহে হঞা হরষিত।।
বিবাহের যোগ্যা দুই কন্যা তুয়া ঘরে।
বিধি দয়া করি হেথা মিলাইল বরে।।
কিবা বুদ্ধি করিয়াছ কহ দেখি শুনি।
পণ্ডিত কহয়ে সৰ্ব্ব মত হৈলে মানি।।
এত কহি সূৰ্য্যদাস গেলা বহির্দ্বারে।
আত্মীয় কুটুম্ব গণে আনে নিজ ঘরে।।
পন্ডিত সভারে কহে বিনয় করিয়া।
আগন্তুকে কন্যা দান কহ সমুঝিয়া।।
সভে কহে কতি ইহার ঘর নাহি জানি।
অজ্ঞাত-কুলশীল লোকে না পুছয়ে জ্ঞানী।।
কন্যা দানের যোগ্য পাত্র সহজ না হয়।
শিবে কন্যা দিয়া দক্ষ ছাগ-মুণ্ড পায়।।
হেন মতে নানা কথা করে আলাপন।
তাহা বুঝে নিত্যানন্দ করিলা গমন।।
গঙ্গাতীরে প্রভু নিত্যানন্দ চলি গেলা।
ভাবাবেশে গৌরীদাস তাঁহারে চিনিলা।।
নিত্যানন্দে প্রণমিয়া কহে গৌরীদাস।
অনন্ত অর্বুদ তুয়া লীলার প্রকাশ।।
শুনি অট্ট হাসি প্ৰভু গঙ্গাতীরে গেলা।
তাহার নিরাশে গৌরীদাস দুঃখী হৈলা।।
শ্রীগৌরীদাস পণ্ডিত নহে সাধারণ।
ব্রজে সেই কৃষ্ণ-প্রিয়সখাতে গণন।।
মোর প্রভু কহে যারে সুবল গোপাল।
রাধাকৃষ্ণের গূঢ় লীলা জানয়ে সকল।।
এবে রাধাকৃষ্ণ অবতীর্ণ নদীয়ায়।
সখাগণ হৈলা আসি লীলার সহায়।।
মহাপ্রভুর অন্তরঙ্গ ভক্ত গৌরীদাস।
যবে গৌর সঙ্গে কৈলা কীৰ্ত্তন-বিলাস।।
গৌর নিতাই সঙ্গ বিনু ঘরে নাহি রয়।
তার বন্ধুগণ মহাপ্রভুরে কহয়।।
এই বালকেরে আজ্ঞা কর দার গ্রহে।
সভার আনন্দ যদি থাকে নিজ গৃহে।।
মহাপ্রভু কহে ভাল করিমু তাহাঞি।
সুস্থ হঞা থাক সভে কোন চিন্তা নাই।।
তবে সন্ধ্যায় পন্ডিত ঠাকুর গৌরীদাস।
পুষ্পমালা লঞা আইলা মহাপ্রভুর পাশ।।
শ্রীগৌরাঙ্গের কন্ঠে মালা নিজে পরাইলা।
প্রেমে গদ গদ হঞা দণ্ডবৎ কৈলা।।
ব্রজের শুদ্ধভাব গৌরের উদ্দীপন হৈলা।
আইস প্রাণসখা বলি তারে কোলে কৈলা।।
অবিশ্রান্ত অশ্রু গোরার বহে দুনয়নে।
বস্ত্র দ্বারে গৌরীদাস মুছায় আপনে।।
শ্রীরাধার ভাব মহা-সমুদ্র গম্ভীরে।
ডুবিলা শ্রীগোরাচাঁদ নাহি বাহ্য স্ফূরে।।
প্রহরেক পরে তান হইল চেতন।
গৌরীদাসের হস্ত ধরি করয়ে নর্তন।।
নিত্যানন্দ আদি প্রেমে করয়ে গর্জ্জন।
সর্ব্ব ভক্ত মেলি করে মহাসংকীর্ত্তন।।
হইল অদ্ভুত নৃত্য-গীত-মহোৎসব।
বর্ণিতে নাহিক ক্ষম তার এক লব।।
সংকীৰ্ত্তন অস্তে গৌর নিতাই বসিলা।
নির্জ্জনে শ্রীগৌরীদাসে ডাকিয়া কহিলা।।
মহাপ্রভু কহে শুন প্রাণ প্রিয়তম।
বিবাহ করিয়া তুহুঁ রহ নিজাশ্রম।।
গৌরীদাস কহে তুয়া আজ্ঞা বেদসার।
তাহা যেই লঙ্ঘে সেই অতি দুরাচার।।
কিন্তু তুহা বিনু মুঞি রহিতে না পারি।
সলিল বিহনে যৈছে মীন প্রাণতরী।।
শুনি হাসি গোরা চাহে নিত্যানন্দ পানে।
তিঁহ কহে গৌরমূর্ত্তি করহ নির্মাণে।।
গোরা কহে এক মূৰ্ত্তি নহে সুশোভন।
নিত্যানন্দের প্রতিমূর্ত্তি করহ স্থাপন।।
ইথে পাইবা মো দোঁহার সদা পরকাশ।
আনে না কহিবা মোর এই গূঢ় ভাষ।।
শুনি গৌরীদাস প্রেমানন্দে পূৰ্ণ হৈল।
গৌর নিত্যানন্দ পদে দন্ডবত কৈল।।
শ্রীমান গৌরীদাস শিল্পকার্য্যে পটুতর।
ঐছে শিল্প নাহি জানে দেব শিল্পীবর।।
সাক্ষাতে রাখিয়া তিঁহ গৌর নিত্যানন্দে।
দারু ব্রহ্মে দুই মূর্ত্তি গড়িলা আনন্দে।।
গৌর নিত্যানন্দের সেই অবিকল মূৰ্ত্তি।
দৃষ্টিমাত্র জীবে হয় প্রেমানন্দ স্ফূৰ্ত্তি।।
তবে গৌরনিতাই আলিঙ্গিয়া গৌরীদাসে।
নাম প্রেম প্রচারিতে গেলা অন্য দেশে।।
সেই দুই মুৰ্ত্তি প্রতিষ্ঠিতে গৌরীদাস।
যুক্তি করি গেলা শ্রীঅদ্বৈত প্রভুর পাশ।।।
সীতানাথ পদে তিঁহ কৈলা নমস্কার।
প্রভু তাঁরে যত্ন করি পুছে সমাচার।।
হেথা কিবা লাগি বাছা কৈলা আগমন।
গৌরীদাস আদ্যোপান্ত কৈলা নিবেদন।।
প্রভু কহে শিল্পী তুহুঁ মহাভাগ্যবান।
গৌর নিত্যানন্দ মূর্ত্তি কৈলা নিরমাণ।।
প্রতিষ্ঠা করিমু মুঞি সেই মোর ভাগ্য।
উদ্যোগ করহ যাঞা দ্রব্য যথাযোগ্য।।
তাহা শুনি শ্রীঅচ্যূত কহে যোড় হাতে।
মোরে আজ্ঞা কর প্রভু যাঙ অম্বিকাতে।।
কিবা ধ্যান মন্ত্রে পূজা হৈব নিৰ্ব্বাপণ।
দয়া করি কহ সত্য না কর গোপন।।
হাসি সীতানাথ কহে জানিয়া না জান।
স্বয়ং কৃষ্ণ নদীয়ায় হৈলা অবতীর্ণ।।
রাধা-অঙ্গ কান্তে ঢাকা সর্ব্ব কলেবর।
যৈছে বস্ত্র আবরণে দৃশ্য রূপান্তর।।
তেঁই গোপালের দশাক্ষরী মন্ত্র ধ্যানে।
মহাপ্রভুর পূজা হৈব কহিনু সন্ধানে।।
কৃষ্ণ-আবরণী বলি পূজিহ রাধায়।
পূজা সিদ্ধি হৈব ইথে নাহিক সংশয়।।
নারায়ণ মন্ত্রেতে পূজিবা নিত্যানন্দ।
হইবে পূজন সিদ্ধ পাইবা আনন্দ।।
শুনি শ্রীঅচ্যূতনন্দ কহয়ে বিনয়ে।
তুয়া আজ্ঞা মতে কার্য্য করিমু নিশ্চয়ে।।
কিন্তু খন্ডবাসী সুপন্ডিত নরহরি।
সরকার ঠাকুর ঘেঁহ প্রেমের গাগরি।।
শ্রীচৈতন্যের অন্তরঙ্গ ভক্তেতে গণন।
যাঁরে কৃষ্ণের নিত্য সাথী কহে সাধুগণ।।
তিঁহ মোরে কহে গৌরের পূজা মতান্তরে।
ইহার কারণ কিবা কহ প্রভু মোরে।।
প্রভু কহে শ্ৰীকৃষ্ণ-চৈতন্য প্ৰেমাণবে।
ভক্তি অনুসারে পূজা সকলি সম্ভবে।।
কৃষ্ণের প্রতিজ্ঞা দৃঢ় আছে ভক্ত মাঝে।
যে যৈছে ভজয়ে কৃষ্ণ তারে তৈছে ভজে।।
শুনি শ্রীঅচ্যুতানন্দ আনন্দে মাতিলা।
গৌরীদাস সঙ্গে তিঁহ অম্বিকাতে গেলা।।
মহা সমারোহে দুই মুৰ্ত্তি প্রতিষ্ঠিলা।
গৌরীদাস প্রেমানন্দে মহোৎসব কৈলা।।
গৌরীদাস সর্ব্ব ভক্তের প্রিয়তম বড়।
মহাপ্রভু প্রভুদ্বয়ে যার প্রেম গাঢ়।।
এই গূঢ়তত্ত্ব কিবা জানোঁ মুঞি ক্ষুদ্র।
অচ্যূত-প্রভুর আজ্ঞায় লিখি সুত্ৰ মাত্ৰ।।
হেথা প্রভু নিত্যানন্দ গঙ্গাতীরে বসি।
উদ্ধারণে তত্ব কথা কহে হাসি হাসি।।
হেনকালে বসুধার মৃত-দেহ লঞা।
গঙ্গাতটে আইলা পন্ডিত দুঃখী হঞা।।
সৎকার করিতে সভে উদ্যোগ করিলা।
তঁহি প্রভু আসি সূৰ্য্যদাসেরে কহিলা।
এই কন্যা যদি মুঞি জীয়াইতে পারি।
তবে মোরে কন্যা দিবা কহ সত্য করি।।
শুনিয়া পন্ডিত কহে তার বন্ধুগণ।
জীয়াইলে কন্যা দিব করিলাঙ পণ।।
তাহা শুনি নিত্যানন্দ আনন্দিত মনে।
মৃত-সঞ্জীবন নাম দিলা তার কাণে।।
হরিনামামৃত পিয়া বসুধা উঠিলা।
অলৌকিক কার্য্যে সভে বিস্ময় মানিলা।।
সূৰ্য্যদাস হর্ষে কন্যা লঞা গেল ঘরে।
মহানন্দে সর্ব্বজন হরিধ্বনি করে।।
নিত্যানন্দে কেহ কহে ইহোঁ মহামুনি।
কেহ কহে মায়ারূপী দেব অনুমানি।।
সূর্য্যদাস নিত্যানন্দে ঘরে লঞা গেলা।
লক্ষণে প্রভুরে চিনি প্রেমাবিষ্ট হৈলা।।
মহাভাগ্য মানি তিঁহ নিত্যানন্দ-চান্দে।
সমারোহে কন্যাদান কৈলা মহানন্দে।।
বসুধা দেবীকে প্রভু বিবাহ করিলা।
যৌতুক ছলে জাহ্নবারে আত্মসাথ কৈলা।।
তাঁহা হৈতে প্রভু খড়দহ গ্রামে গেলা।
তঁহি শ্যামসুন্দরের সেবা প্রকাশিলা।।
মহাপ্রভুর অগ্রকটে শ্রীবসুধা-মাতা।
শুভক্ষণে এক পুত্র প্রসবিলা তথা।।
নিত্যানন্দাজ তিহঁ হয় সদানন্দ।
জগতে বিখ্যাত নাম হৈল বীরচন্দ্র।।
মোর প্রভু কহে যারে সঙ্কর্ষণের ব্যূহ।
তাঁর রূপ দেখি জীব মাত্রে হয় মোহ।।
সাধু মুখে শুনি আর যে কিছু দেখিনু।
তার সূত্র বিন্দুমাত্র প্রকাশ করিনু।।
হেথা শ্রীঅদ্বৈত প্রভু গৌরাঙ্গ বিচ্ছেদে।
কাঁহা প্রাণনাথ বলি ফুকারিয়া কান্দে।।
ক্রমে গৌর-প্রেমসিন্ধুর তরঙ্গ বাঢ়িল।
ভক্ত-কল্পবৃক্ষ সীতানাথে ডুবাইল।।
তিন দিন পরে প্রভু ভাসিয়া উঠিলা।
গৌরাঙ্গ দেখিতে মনে যুক্তি স্থির কৈলা।।
হা গৌরাঙ্গ তুয়া চির-বিচ্ছেদ অনলে।
ভক্ত-মন-প্ৰাণ পোড়াইলি অবহেলে।।
ভক্তি বিলাইতে তোর হৈল প্রকটনে।
জ্ঞান প্রকাশিয়া তাপ দিমু তোর মনে।।
একবার জ্ঞান ব্যাখ্যা করি পাইমু তোরে।
পুনঃ শুভ জ্ঞান শিক্ষাইমু সভাকারে।।
দেখিমু ইহাতে কর কিবা ব্যবহার।
না পাঙ চরণ যদি নাশিমু সংসার।।
এত ভাবি শিষ্যগণে ডাকি নিজ পাশে।
জ্ঞান-যোগ উপদেশ দেয় মৃদু ভাষে।।
ভক্তি হৈতে জ্ঞান বড় জ্ঞানিগণে কয়।।
ভক্তির চরমে হয় জ্ঞানের উদয়।।
জ্ঞান যোগে যেই জন ঈশ্বরে ভজয়।।
দিব্য পুষ্পরথে সেই ভব পারে যায়।
পূৰ্ব্বতন ঋষিগণ জ্ঞান-যোগ দ্বারে।
ভক্তি মুক্তি পাইলা নিজ বাঞ্ছা অনুসারে।।
ইত্যাদি অনেক জ্ঞান উপদেশ দিলা।
গুরু বাক্য শিষ্যগণ স্বীকার করিলা।।
যদ্যপি মৌখিকে প্রভু জ্ঞান-প্রকাশিলা।
দ্বিগুণ নিয়ম কৃষ্ণ-সেবার করিলা।।
গাঢ় অনুরাগে শ্রীতুলসী কৃষ্ণে দিলা।
নানাবিধ মিষ্ট-অন্ন ভোগ লাগাইলা।।
নয়ন মুদিয়া করে গৌরাঙ্গ-চিন্তন।
মৰ্ম্ম না বুঝিয়া কান্দি বেড়ায় গৌরগণ।।
মুক্তি বাখানিল শুনি শ্রীশচীনন্দন।
অন্তৰ্য্যামী অন্তরে জানিলা ভক্ত-মন।।
ভক্ত-বাঞ্ছা পুরাইতে পুরুষোত্তম হৈতে।
অদ্বৈতের ঘরে গোরা আইলা আচম্বিতে।।
গৌর-অঙ্গ-গন্ধ পাঞা চাহে সীতানাথ।
দেখে অগ্রে স্ফূর্ত্তি পায় চল-জগন্নাথ।।
অচিন্ত্য চৈতন্য-কৃপা দেখি ভক্ত প্ৰতি।
মহাপ্রেমে শ্রীঅদ্বৈত করে দৈন্য-স্তুতি।।
শত অষ্ট-অঙ্গ করি গৌরাঙ্গ চরণে।
কহে মোর সম ভাগ্য নাহি ত্রিভুবনে।।
গোরা কহে তুহুঁ নিত্য-ভক্ত-অবতার।
শুদ্ধ-ভক্তি বসে মোহে করিলা প্রচার।।
মোর কার্য্য হৈতে সত্য তোর কার্য্য বড়।
বাঞ্ছা পুরাইতে তোর হইনু গোচর।।
তবে গোরা আচার্য্যের বাঞ্ছা অনুসারে।
আনন্দে ভোজন কৈলা নানা উপহারে।।
ভোজনানে করি তিঁহ তাম্বুল চৰ্ব্বন।
মিষ্ট ভাষে শ্রীঅদ্বৈতে করয়ে ভর্ৎসন।
মোরে দেখিবারে দিলা জ্ঞান যোগ শিক্ষা।
জীবের ভাবী ক্লেশে তুহুঁ না কৈলা অপেক্ষা।।
মোরে দেখিবারে যদি তব মন হয়।
চিন্তামাত্র তাঁহা মুঞি হইমু উদয়।।
আর কভু জ্ঞানযোগ মুখে না আনিবা।
শুদ্ধ-ভক্তি শিক্ষাইয়া জীব নিস্তারিবা।।
শ্রীঅদ্বৈত কহে বাঞ্ছা মতে পাইনু বর।
এবে দয়া করি অপরাধ ক্ষমা কর।।
মহাপ্রভু কহে ভক্তের কোটি অপরাধ।
দয়া করি ক্ষমি কৃষ্ণ করয়ে প্রসাদ।।
হেন কালে সেই স্থানে সীতামাতা আইলা।
গৌরে দেখি প্রেমাশ্চৰ্য্য আনন্দে ডুবিলা।।
ফুকারিয়া কান্দে মাতা গৌরে কোলে করি।
গোরা কহে মাতা মোর তৃষ্ণা হৈল ভারি।।
শুনি সীতা ক্ষীর সর গঙ্গাজল আনি।
বাৎসল্যে গৌরাঙ্গ মুখে দিলেন আপনি।।
সুধাধিক্য সেই সভ মহানন্দে খাঞা।
অন্তর্দ্ধান কৈলা গোরা দোঁহে প্রবোধিয়া।।
সীতাদ্বৈত দোঁহে গৌর-দয়া সঙরিয়া।
সকল দিবস রহে প্রেমেতে মাতিয়া।।
তবে প্রভু প্রেম-সম্বরিয়া সন্ধ্যাকালে।
শিষ্যগণে ডাকি কহে শুনহ সকলে।।
পূর্ব্বে জ্ঞান বড় কহি চিত্তের বৈষম্যে।
এবে বিচারিয়া দেখি নাহি ভক্তির সাম্যে।।
জ্ঞানেতে ঈশ্বরে জানি ভক্ত্যে তাঁরে পাই।
জ্ঞান হৈতে ভক্তি শ্রেষ্ঠ বহু শাস্ত্রে গাই।।
জ্ঞানের চরমে মুক্তি জানিহ নিশ্চয়।
মুক্ত জনের শেষে হয় অভিমানোদয়।।
মুক্তি অভিমানী কৃষ্ণ-সেবা নাহি করে।
সেই অপরাধে পুনঃ ডুবয়ে সংসারে।।
অতএব ভক্তিযোগ হয় সর্ব্বোত্তম।
ভক্তিপথে প্রবর্ত্তকের নাহিক পতন।।
ভক্তি মহিমার অন্ত অনন্ত না জানে।
ভক্তিদেবীর দাসী মুক্তি শাস্ত্র পরিমাণে।।
নিষ্ঠাভক্তি দ্বারা কর শ্রীকৃষ্ণ-সেবন।
অনায়াসে ভব-বন্ধন হইবে মোচন।।
ইত্যাদি অনেক ভক্তি উপদেশ দিলা।
তিন শিষ্য বিনা বভে ভক্তিবÍসে গেলা।।
কামদেব-নাগর আর আগল পাগল।
এই তিনে নাহি মানে আচার্য্যের বোল।।
এই তিনে কহে শুন আচার্য্য গোসাঞি।
তব উপদেশের ইয়ত্তা কিছু নাঞি।।
ক্ষণে কহ জ্ঞান বড় ক্ষণে ভক্তি বড়।
জ্ঞান বর্থে মোরা চিত্ত করিয়াছোঁ দৃঢ়।।
প্রভু কহে যদি তোরা আজ্ঞা না মানিলি।
মুখ না দেখিমু আর মোর ত্যহ্য হৈলি।।
যে আজ্ঞা বলিয়া তারা পূর্ব্বদেশে গেলা।
আচাৰ্য্য হইয়া নিজমত চালাইলা।।
গৌর লীলাগণে মোর কোটি নমস্কারে।
অলৌকিক খেলা গৌরের দেখে ভক্তিদ্বারে।।
নিত্যলীলা শ্রীগৌরাঙ্গ করে ভক্ত-দেশে।
মহাভাগ্যে শুদ্ধ-ভক্তি-চক্ষে মাত্র ভাসে।।
মোরে কোটি দয়া কৈলা অদ্বৈত-ঈশ্বর।
তেঁই দিব্যলীলা সূত্র করিনু প্রচার।।
শ্রীচৈতন্য শ্রীঅদ্বৈত পদে যায় আশ।
নাগর ঈশান কহে অদ্বৈত-প্ৰকাশ।।

ইতি শ্রীঅদ্বৈত-প্ৰকাশে বিংশোহধ্যায়ঃ।