অদ্বৈতপ্রকাশ – ১২

দ্বাদশ অধ্যায়

জয় জয় শ্রীচৈতন্য জয় সীতানাথ।
জয় নিত্যানন্দ রাম ভক্তগণ সাথ।।
এক দিন শ্রীঅদ্বৈত বেদপঞ্চানন।
পড়াইয়াছে ছাত্রগণে বেদ দরশন।।
হেন কালে শ্রীগৌরাঙ্গ গদাধর সনে।
পড়বিার তরে আইলা আচার্য্যের স্থানে।।
গৌর গদাধরে দেখি প্রভু ভাবাবেশে।
আইস আইস কহে আর খল খল হাসে।।
তদাভাসে গৌর গদাধর সমুঝিলা।
লোক শিখাইতে আচার্য্যেরে প্রণমিলা।।
আচাৰ্য্য গোসাঞি দোঁহে কৈলা আলিঙ্গন।
তবে এক স্থানে বসিলেন তিন জন।।
শ্রীঅদ্বৈত গৌরচন্দ্রে পুছে মৃদু ভাষে।
কাঁহা হেতে আইলা নিমাঞি কহ সবিশেষে।।
বহু দিনে তোমা সঙ্গে হইল সাক্ষাৎ।
এত দিনে কি পড়িলা কহ সেহি বাত।।
গৌর কহে শুন গুরু বেদপঞ্চানন।
বিদ্যানগর হৈতে আইনু তোমার সদন।।
আন শাস্ত্রে দেখিবারে মন নাহি ভায়।
বেদার্থ শুনিতে মুঞি আইলু হেথায়।।
এত কহি মহাপ্রভু ঈষত হাসিলা।
মন বুঝি গদাধর কহিতে লাগিলা।।
গদাধর কহে শুন বেদ পঞ্চানন।
আদ্য হৈতে কহি গৌরের পাঠ বিবরণ।।
প্রথমে শ্রীগঙ্গাদাস পন্ডিতের স্থানে।
দুই বর্ষে ব্যাকরণ কৈলা সমাপনে।।
দুই বর্ষে পড়িলা সাহিত্য অলঙ্কার।
তবে গেলা শ্রীমান বিষ্ণুমিশ্রের গোচর।।
তাঁহা দুই বর্ষে স্মৃতি জ্যোতিষ পড়িলা।
সুদর্শন পন্ডিতের স্থানে তবে গেলা।।
তাঁর স্থানে ষড়দর্শন পড়িলা দুই বর্ষে।
তবে গেলা বাসুদেব সাৰ্ব্বভৌম পাশে।।
তাঁর স্থানে তর্কশাস্ত্র পড়িলা দ্বি-বৎসরে।
এবে তুয়া পাশে আইলা বেদ পড়িবারে।।
শুনি আচার্য্যের বাঢ়ে অনন্ত উল্লাস।
কহে শ্রুতিধর শক্তি ইহাতে প্রকাশ।।
স্তব শুনি মহাপ্রভু নতশির হৈলা।
হেনকালে এক ছাত্র তানে প্রশ্ন কৈলা।।
কহ নিমাঞি পর ব্রহ্মাস্তিত্ব কৈছে জানি।
গৌর কহে ব্রহ্মাণ্ডের প্রত্যক্ষে অনুমানি।।
ছাত্র কহে স্বভাবসিদ্ধ ব্ৰহ্মাণ্ড আছয়।
গৌর কহে অনিত্যের নিত্যত্ব কৈছে হয়।।
ছাত্র কহে পরমাণু গণের নিত্যত্ব।
গৌর কহে জড়ের কভু না হয় কর্তৃত্ব।।
আরেত পাঁচের হয় কৰ্তৃত্ব কল্পনা।
এক ঈশ্বর চিদানন্দ কহে মুনি জনা।।
কারণ বিনে না সম্ভবে কার্য্যের উৎপত্তি।
সেই কৰ্ত্তা সুনিশ্চিত যাহে সৰ্ব্বশক্তি।।
হেন মতে বহু তর্ক নাহি তার লেখা।
হেন কালে কৃষ্ণদাস তাঁহা দিলা দেখা।।
পঞ্চম বৎসরের শিশু অদ্বৈত কুমার।
মৃদু মৃদু হাসি কহে সিদ্ধান্তের সার।।
অহে ছাত্র আগে ভক্তি-চক্ষু কিনি লহ।
এখনি দেখিবা আগে ঈশ্বর বিগ্রহ।।
সাক্ষাতে থাকিতে বস্তু চিনিতে না পার।
তোমার অজ্ঞতা দেখি দুঃখ পাইনু বড়।।
ভাল বলি প্রভু মোর ছাড়য়ে হুঙ্কার।
কৃষ্ণদাসে কোলে করি নাচে বহুতর।।
তবে মহাপ্রভু কৃষ্ণদাসে কোলে কৈলা।
আনন্দে তাহার নাম কৃষ্ণমিশ্ৰ থুইলা।।
তবে গৌর বেদ পড়ে পরম যতনে।
আচার্য্য পড়ায় তাঁরে অতি সাবধানে।।
এক দিন শুন এক অপূৰ্ব্ব আখ্যান।
জগন্মাতা সীতা যাঁর গৌরগত প্রাণ।।
গৌরাঙ্গের প্রিয়বস্তু নাম চাঁপা কলা।
গৌরে ভুজ্ঞাইতে তেঁহো লুকাঞা রাখিলা।।
মাতা গঙ্গাস্নানে গেলা শূন্য ঘর পাঞা।
কৃষ্ণমিশ্র ফিরে খাদ্য বস্তু অন্বেষিয়া।।
চাহিতে চাহিতে পক্ক রম্ভ ফল পাইলা।
নিত্য কৃষ্ণভক্ত শিশু মনে বিচারিলা।।
গৌরে ভুঞ্জাইতে কলা মায়ের আছে সাধ।
মুঞি যদি খাঙ তবে দৈব অপরাধ।।
পুন ভাবে নিবেদিয়া করিমু ভক্ষণ।
গৌরাঙ্গ প্রসাদ হৈলে নাহিক দূষণ।।
আগে প্রণব মহামন্ত্র করি উচ্চারণ।
গৌরায় নমঃ বলি কৈলা নিবেদন।।
মহাপ্রসাদ জ্ঞানে কলা শিরে ছুয়াইয়া।
ভোজন করিলা শিশু আনন্দিত হঞা।।
গঙ্গাস্নান করি সীতা মাতা আসি ঘরে।
গৌরে সমর্পিতে রম্ভা ভাবিলা অন্তরে।।
যাহা রাখিছিলা রম্ভা তাঁহা না পাইলা।
পুত্রগণে খাইল ভাবি দুঃখিত হইলা।।
আগে শ্রীঅচ্যুতানন্দে ডাকি জিজ্ঞাসিলা।
গোরার্থ রাখিলু রম্ভা কেবা তাহা খাইলা।।
শ্রীঅচ্যুত কহে মাতা তুহু সৰ্ব্ব জ্ঞাতা।
মোর ব্যবহার জান মোর মন কথা।।
বাল্য চাপল্যে গৌর-সেবার দুগ্ধ খাইনু।
তোমার তাড়নে তাহা হৈতে শিক্ষা পাইনু।।
কিবা কহোঁ অচ্যুত মহিমা মুঞি ছার।
শ্ৰীকৃষ্ণচৈতন্য সহ অভোদাত্মা যার।।
গৌরাবেশে তিঁহো গৌর সেবার দুগ্ধ খাইলা।
তাহে অচ্যুতের মাতা চাপড় মারিলা।।
সেই চাপড়ের চিহ্ন গৌর অঙ্গে লাগে।
তাহা দেখি চমৎকার হৈলা সভ লোকে।।
ভগবানের নিত্য-সিদ্ধ ভক্ত আর ভক্তি।
এই দুই বস্তুর হয় অবিচিন্ত্য শক্তি।।
চিন্ময়ী ভকতি আর চিন্ময় ভক্তগণ।
কৃষ্ণ সহ অভেদাত্মা শাস্ত্রের লিখন।।
তবে সীতা কৃষ্ণদাস মিশ্রে বোলাঞিলা।
তারে পুছে গৌর সেবার রম্ভা কে খাইলা।।
কৃষ্ণমিশ্র কহেন মাতা তাহে কি দূষণ।
গৌরে নিবেদিয়া মুঞি করিনু ভক্ষণ।।
তাহা শুনি সীতামাতা ঈশদ হাসিলা।
যষ্ঠি হাতে শিশুর পিছু চলিলা ধাইয়া।।
ভয়ে কৃষ্ণমিশ্র গেলা অদ্বৈত গোচর।
সীতারে পশ্চাতে দেখি কহে প্রভুবর।।
না মারিহ মুঞি আগে শুনি বিবরণ।
সীতা ক্ষান্ত দিলা শুনি প্রভুর বারণ।।
প্রভু কহে কৃষ্ণমিশ্র কি দোষ করিলা।
কৃষ্ণমিশ্র মৃদুস্বরে তাঁহারে কহিলা।।
গৌরে ভুঞ্জাইতে কলা রাখিলা জননী।
গৌরে নিবেদিয়া খাইনু দোষ নহে জানি।।
প্রভু কহে কিবা মন্ত্রে কৈলা নিবেদন।
শিশু কহে সপ্রণব গৌরায় নমঃ।।
প্রভু কহে গৌরায় স্থলে কৃষ্ণায় কহা যুক্ত।
শিশু কহে গৌরনামে কৃষ্ণনাম ভুক্ত।।
আশ্চৰ্য্য মানিলা প্ৰভু তাহান বচনে।
প্রেমাবিষ্ট হঞা চুম্বে শিশুর বদনে।।
পুত্রের সিদ্ধান্ত শুনি সীতার বিস্ময়।
মনে ভাবে ধন্য ধন্য আমার তনয়।।
তবে ভোজনার্থে সভে করিলা আহ্বান।
গৌর কহে মোহর ভোজন সমাধান।।
প্রভু কহে তুহুঁ কতি আহার করিলা।
প্রভু কহে নিদ্ৰায় কেবা কলা খাওইলা।।
এত কহি তিহোঁ এক ছাড়িলা উদগার।
রম্ভার গন্ধ পাঞা সভে হৈলা চমৎকার।।
শ্রীঅদ্বৈত ভাবে কৃষ্ণ ভক্তাধীন হয়।
কৃষ্ণমিশ্র দত্ত কলা ভূঞ্জিলা নিশ্চয়।।
মুঞি মহাভাগ্যবান যার হেন পুত্র।
ইহার চরিত্রে জগৎ হইব পবিত্র।।
ভাবিতেই হৈলা প্ৰভু প্রেমার্দ্র হৃদয়।
অবিশ্রান্ত অশ্রুধারা দুই নেত্রে বয়।।
সেই তত্ত্ব শুনি সীতা প্রেমে হঞা ভোর।
মনে ভাবে মোর পুত্রের ভাগ্যে নাঞি ওর।।
মুঞি রত্নগর্ভা ভাগ্যবতী সুনিশ্চয়।
যার গর্ভে শুদ্ধ কৃষ্ণ ভক্তের উদয়।।
তবে এক দিন এক ব্রাহ্মণকুমার।
আসি আচার্য্যের পদে কৈলা নমস্কার।।
শ্রীঅদ্বৈত কহে তুমি কাহার নন্দন।
কিবা লাগি আইলা হেথা কহ বিবরণ।।
দ্বিজসুত কহে মুঞি তব দাস-সুত।
লোকনাথ নাম মোর চক্রবর্ত্তী খ্যাত।।
পদ্মনাভ চক্রবর্ত্তীর হঞ মুঞি পুত্র।
যশোরিয়া খ্যাতি যাঁর তব কৃপাপাত্র।।
চিনিলু বুলিয়া প্রভু তারে আলিঙ্গিলা।
লোকনাথ কহে মোরে পবিত্র করিলা।।
প্রভু কহে ঘরের কুশল আগে কহ।
লোকনাথ কহে তুহা যৈছে অনুগ্রহ।।
প্রভু কহে কাছে একা আইলা এত দূরে।
লোকনাথ কহে আইনু পড়িবার তরে।।
প্রভু কহে ভাল ভাল রহ এই স্থানে।
তাহাঞি পড়হ তোর যাহা লয় মনে।।
লোকনাথ কহে মোর পিতার সম্মত।
শ্রীমদ্ভাগবত পড়োঁ কৃষ্ণলীলামৃত।।
শ্রীঅদ্বৈত কহে তব পিতা ভক্তিযুত।
ভাগবত রস পানে সদা উনমত্ত।।
তবে শ্রীমান্ গদাধর পন্ডিতের সাথ।
সটীক শ্রীভাগবত পড়ে লোকনাথ।।
তা দোঁহার পাঠ শুনি শুনি গৌরচন্দ্র।
শ্লোকার্থ কণ্ঠস্ব কৈলা পাঞা মহানন্দ।।
এক দিন সীতানাথ বিচারিয়া মনে।
গোপালের অন্নাশন কৈলা শুভক্ষণে।।
সেই দিনে শুন এক অপরূপ লীলা।
বিধি মতে শিশুর আগে নানা দ্রব্য থুইলা।।
শ্রীগোপাল দাস তাহা কিছু না ছুইলা।
শ্রীগৌরাঙ্গের পাদপদ্ম পরশন কৈলা।।
দেখি মোর প্রভু প্রেমে হঞা মাতোয়ারা।
কহে এই শিশু হৈব ধার্ম্মিকের চূড়া।।
বিপ্রপদ বিষ্ণুপদ সমতুল হয়।
বিপ্রপদে সৰ্ব্ব তীর্থগণ বিরাজয়।।
হেন মতে প্রভুপাদ বহু ব্যাখ্যা কৈলা।
প্রকারে গৌরাঙ্গ বস্তু তত্ত্ব উঘারিলা।।
তাহা শুনি ভক্তবৃন্দের আনন্দ বাঢ়িল।
সভে মিলি নাম সংকীর্ত্তন আরম্ভিল।।
শ্রীঅদ্বৈত নাচে আর নাচে হরিদাস।
শ্রীঅচ্যুতানন্দ নাচে আর কৃষ্ণদাস।।
কৃষ্ণমিশ্রের নৃত্য দেখি মহাপ্রভুর হাস।
গৌরে নাচাইলা ভক্তে করিয়া প্রয়াস।।
হেন মতে দিন দিন বাঢ়য়ে আনন্দ।
প্রতি দিন মহোৎসব করে ভক্তবৃন্দ।।
ক্রমে গৌরের এক বৰ্ষ হৈল অতিক্ৰম।
তাহে বেদ ভাগবত হইল পঠন।।
তা দেখি আশ্চৰ্য্য মানে পন্ডিতের গণ।
আচার্য্য কহয়ে গৌরের অলৌকিক গুণ।।
গদাধর পণ্ডিতের অচিন্ত্য মহিমা।
চতুর্মুখে তান গুণ দিতে নারে সীমা।।
ভাগবতে হৈল তাঁর অপূৰ্ব্ব ব্যুৎপত্তি।
যাঁরে প্রভু কহে কৃষ্ণের অন্তরঙ্গা শক্তি।।
শ্রীগৌরাঙ্গ সঙ্গের গুণ অতি চমৎকার।
লোকনাথের হৈল ভাগবতে অধিকার।।
সর্ব্বদা প্রেমাশ্রু ঝরে শ্লোকার্থ শুনিতে।
সভে কহে কৃষ্ণ কৃপা কৈলা লোকনাথে।।
এক দিন লোকনাথ কহে আচার্য্যেরে।
কৃষ্ণ প্ৰাপ্তি কৈছে হৈব কহ প্রভু মোরে।।
প্রভু কহে কৃষ্ণমন্ত্র করহ গ্রহণ।
অচিরাতে করে যেই কৃষ্ণ আকর্ষণ।।
তাহা শুনি লোকনাথ আনন্দিত হৈলা।
গঙ্গাগন্তে মোর প্রভু স্থানে মন্ত্ৰ লৈলা।।
শ্রীবৈষ্ণব মন্ত্ররাজের অবিচিন্ত্য শক্তি।
গ্রহণ মাত্রেতে পাইলা শুদ্ধ প্রেমভক্তি।
তবে লোকনাথ শ্রীঅদ্বৈত পদে ধরি।
প্রেমাবেশে কান্দে বহু দৈন্য স্তব করি।।
প্রভু কহে না কান্দহ মন স্থির কর।
অচিরাতে রাধাকৃষ্ণ প্রাপ্তি হৈব তোর।।
এত কহি প্রভু ধরি লোকনাথের কর।
উপনীত হৈলা মহাপ্রভুর গোচর।।
প্রভু কহে অহে নিমাঞি কর অবধান।
লোকনাথে শিক্ষাইবা তত্ত্বানুসন্ধান।।
এত কহি প্ৰিয় শিষ্যে গৌরে সমর্পিলা।
শ্রীগৌরাঙ্গ লোকনাথে আত্মনাথ কৈলা।।
তবে এক দিন গোরা কহে আচার্য্যেরে।
বিদায় হইতে চাঙ ঘরে যাইবারে।।
প্রভু কহে তোরে বিদায় দিতে প্রাণ ফাটে।
স্বতন্ত্রতা হয় তোর প্রকটাপ্রকটে।।
এত কহি প্ৰভু প্রেমসাগরে ডুবিলা।
প্রেম সম্বরিয়া তবে সভারে কহিলা।।
এই নিমাঞি সর্ব্বশাস্ত্রে অতি বিচক্ষণে।
বিদ্যাসাগর উপাধি মুঞি করিলু স্থাপনে।।[৪]
তাহা শুনি সভে কৈলা জয় জয় ধ্বনি।
ছাত্র কহে বিদ্যাসাগর দেহ পাণ চিনি।।
মহাপ্রভু যথা বিধি সভে সম্মানিলা।
দোঁহে সঙ্গে করি তবে গৃহেরে চলিলা।।
শ্রীগৌরাঙ্গ যাত্রার কথা কি কহিমু আর।
সপরিবারেতে প্রভুর বহে অশ্রুধার।।
হেথা নবদ্বীপে শচীমাতা গোরা বিনে।
বৎসহারা গাভীসম ইতি উতি ভ্রমে।।
হেন কালে গৌরচন্দ্র স্বগৃহে আইলা।
দেখি শচী শূন্য দেহে পরাণ পাইলা।।
গৌরাঙ্গ মাতার পদে কৈলা নমস্কার।
শচী তান গলা ধরি কান্দে অনিবার।।
গোরাচাঁদ কহে মাতা না কান্দ না কান্দ।
ক্ষুধা পাইয়াছে মোর ঝাট গিয়া রান্ধ।।
শুনিয়া তুরিতে শচী রান্ধিবারে গেলা।
ভক্ত সঙ্গে গৌর গঙ্গাস্নান করি আইলা।।
বিষ্ণুপূজা করি অন্ন ভোগ লাগাইলা।
তবে ভক্ত সঙ্গে হর্ষে ভোজন করিলা।।
অপরাহ্নে মহাপ্রভু নগর ভ্রমিলা।
বড় বড় পণ্ডিতেরে তর্কে হারাইলা।।
সভে কহে নিমাঞি পণ্ডিত শিরোমণি।
ঐছে বিদ্যাসাগর আর কাঁহা নাহি শুনি।।
ক্রমে গৌরের বিদ্যা-যশ-সূৰ্য উজলিল।
সেই নবদ্বীপে তান বিবাহ হইল।।
রাজর্ষি ভীষ্মক রূপ বল্লভ আচার্য।
কুলে শীলে মান্য গণ্য দ্বিজগণ-আৰ্য্য।।
তান কন্যা পরমাহ্লাদিনী লক্ষ্মী সতী।
সৰ্ব্ব সদ্গুণ-সম্পূর্ণা অতি রূপবতী।।
শ্রীরুক্মিণী বলি মোর প্রভু যারে কয়।
শ্রীগৌরসুন্দর তানে কৈলা পরিণয়।।
তবে গোরা টোল করি পড়াইলা ছাত্র।
যেই ছাত্রের যেই বাঞ্ছা পড়ে সেই শাস্ত্র।।
শ্রীঅচ্যুতানন্দ আইলা অদ্বৈত-কোঙর।
বুদ্ধ্যে বৃহস্পতি শাস্ত্রে অতি পটুতর।।
তারে পাঞা মহাপ্রভুর আনন্দ অপার।
ব্যাকরণ পঢ়াইলা আর অলঙ্কার।।
একদিন শ্রীঅচ্যুত কহে গৌরচন্দ্রে।
মুখের উপমা ভালি কৈছে হয় চন্দ্ৰে।।
মৃগাঙ্কে কলঙ্ক বহু দেখি বিদ্যমান।
অনুজ্জ্বল রৌপ্যবর্ণ সেহ অপ্রদান।।
তাহা শুনি নিমাই বিদ্যাসাগর আনন্দে।
সস্নেহ প্রশংসি কহে শ্রীঅচুত্যানন্দে।।
আহ্লাদের অংশে হয় মুখের উপমা।
কোন বস্তুর সর্ব অংশে না হয় তুলনা।।
শুনি শ্রীঅচ্যূত কহে বুঝিলু এখন আর এক কথা মোর হৈল উদ্দীপন।।
মদনগোপাল কৃষ্ণ স্বয়ং ভগবান।
তাহাতে কহিনু মুঞি কাহার সমান।।
তাঁহার উপমা দিতে কিছু নাহি পাঙ।
কহিহে উপমা মোর সংশয় ঘুচাও।।
বালকের কথা শুনি শ্রীশচীনন্দন।
বিস্ময় অন্তরে কহে শুন প্রিয়তম।।
শ্রীসচ্চিদানন্দ কৃষ্ণ সৰ্ব্ব-শক্তি পূর্ণ।
তেঁহো উপমান বস্তু তান উপমা শূন্য।।
যৈছে আনারসের উপমান সুধা হয়।
সুধার উপমা কতি সংসারে আছয়।।
শুনি শ্রীঅচ্যুতে কহে তুহু সৰ্ব্ব জ্ঞাত।
সুধা হইতে স্বাদাধিক্য হরি-নামামৃত।।
শ্রীগৌরাঙ্গ কহে কৈছে করোঁ সুবিশ্বাস।
শ্রীঅচ্যূত কহে বস্তু শক্তিতে প্ৰকাশ।।
সুধাপায়ী দেবে নামামৃত করি পান।
পরম কৃতার্থ মানে শাস্ত্ৰেতে প্ৰমাণ।।
শুনি মহাপ্রভু গূঢ় প্রেমে আৰ্দ্ৰ হঞা।
অচ্যূতের শিরে চুম্বে নিজ কোলে লঞা।।
ভক্ত সঙ্গে শ্রীচৈতন্যের লীলা গুহ্যতম।
তার সূত্র বর্ণি তৈছে নাহি মোর ক্ষম।।
শ্রীচৈতন্য শ্রীঅদ্বৈত পদে দ্বার আশ।
নাগর ঈশান কহে অদ্বৈত-প্ৰকাশ।।

ইতি শ্রীঅদ্বৈত-প্ৰকাশে দ্বাদশাহধ্যায়ঃ।

১. পাঁচ বৎসরে অচ্যুতের বিদ্যারম্ভ, ঈশানের আগমন, পাঁচ বছর বয়সে মায়ের দীক্ষা বিশেষ ঐতিহাহিকভাবে তাৎপর্যপূর্ণ।

২. চোদ্দশ আঠার শক্। মধুমাস কৃষ্ণা ত্রয়োদশীর রাত্রি—প্রতক্ষদর্শী/নিকটাত্মীয় ছাড়া জানা সম্ভব না। ঈশান প্রামাণিকতায় অপরিহার্য।

৩. এই চারজন ছাড়া কারও জানা সম্ভব নয়। মাতৃমুখে উত্তরকালে ঈশানের জানা অত্যন্ত স্বাভাবিক।

৪. ইতোপূর্বে বিদ্যাসাগর উপাধির বহুল পরিচয় পাওয়া যায় না। বিশ্বম্ভর মিশ্র কি প্রথম উক্ত উপাধিকারক?