অদ্বৈত : অদ্বৈতবিচার এবং অদ্বৈতপ্রকাশ

খ. অদ্বৈত : অদ্বৈতবিচার এবং অদ্বৈতপ্রকাশ

অদ্বৈতপ্রকাশ মতে, অদ্বৈত স্বয়ং শিব। অদ্বৈতের পিতা লাউড় নিবাসী কুবের আচার্য। মাতা লাভাদেবী (মতান্তরে নাভা)। কুবের আচার্য অত্যন্ত ধনবান ব্যক্তি। ‘রাজধানীতে ছিল তাঁর দ্বার-পণ্ডিত কার্য।’ এখানে রাজধানী বলতে বঙ্গের রাজধানী গৌড় বোঝায়। কারণ তাঁরই ‘মন্ত্রণাবলে শ্রীগণেশ রাজা।/গৌড়িয়া বাদশাহে মারি গৌড়ে হৈল রাজা।।’ (অ.প্র. ২)। বক্তিয়ার খিলজির (১২০৩-০৪) পর থেকে গৌড়ের সুলতানি বংশ হয়ে মুর্শিদাবাদের নবাবি বংশ পর্যন্ত (১৭৫৭) প্রায় সাড়ে পাঁচশো বছরের মধ্যে গৌড়ে মাত্র কিছু কালের জন্য (১৪১৭-১৪১৯) হিন্দুরাজা গণেশ রাজত্ব করেন। সেই গণেশ প্রবল প্রতাপশালী ইলিয়াস শাহী বংশের শিহাবউদ্দিন বায়াজিদ শাহ্র মত প্রতাপান্বিত শাসককে পরাজিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন কুবের পণ্ডিতের ‘মন্ত্রণাবলে’ জানলে বিস্মিত হতে হয়। সম্ভবত গণেশের রাজত্বকাল অন্তে (গণেশের পুত্র যদু ‘জালালুদ্দিন’ নাম ও ইসলামধর্ম গ্রহণ করেন) কুবের পণ্ডিত লাউড়ের নবগ্রামে ফিরে আসেন। এই লাউড়ের রাজা ছিলেন দিব্যসিংহ। গৌড় থেকে ফিরে কুবের পণ্ডিতের ‘বিবাহান্তে ক্রমে তাঁর বহুপুত্র হৈল/পুত্রগণ মৈলে তার বিবেক হৈল।। তবে গঙ্গাতীরের রম্যে শান্তিপুরে আইলা। লাভা সহ কিছুদিন তাহা গোঙাইলা।’ পুনরায় গর্ভলক্ষণ দেখা দেয় লাভার। লাউড় থেকে ইতিমধ্যে রাজা দিব্যসিংহের এক পত্র পেয়ে লাউড়ে রাজসমীপে উপনীত হন।

সেই গ্রামের লোক তাঁরে সম্মান করিল।।
বহুদিন পরে রাজা দেখি আচার্যেরে।
প্রণমি কুশল পুছে আনন্দ অন্তরে।।
রাজা কহে কহ কহ তর্কপঞ্চানন।
মঙ্গল কাহিনী আর বিলম্ব কারণ।।
তোমার সৎসঙ্গ মোর আনন্দের খনি।
তুয়া বিনা রাজ্যপাট শূন্য করি মানি।। অ.প্র. ২

কুবের লাউড়ে আসার কালে লাভাদেবী অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন একথা আগেই উল্লেখ করেছি। ইতোপূর্বে তাঁর ‘বহু পুত্র’ মারা যায়। গর্ভাবস্থায় অথবা প্রসূত হওয়ার পর তার উল্লেখ পাইনা। গর্ভাবস্থায় হতে পারে। অনুষঙ্গ শচীদেবীর আটবার গর্ভপাত। কুবের আচার্যের পুত্র কমলাক্ষ (অদ্বৈত) ভাবাবেশে জানতে পারেন শচীর ‘গর্ভে কৃষ্ণচন্দ্রের প্রকট সম্ভবে।’ জানতে পেরে প্রবীণ অদ্বৈত শচীকে প্রণাম করলে ‘সাধারণ গর্ভ হেতু গর্ভপাত হইলা।’ এইভাবে আটবার শচীর গর্ভপাত হয় (অদ্বৈতের প্রণাম হেতু)। বৈষ্ণবভাবে, যে গর্ভে পুরুষোত্তম শ্রীকৃষ্ণ জন্মগ্রহণ করবেন, সে গর্ভ আর কারও আধার হতে পারে না। ‘অষ্টম গর্ভ’ বিষয়টিও লক্ষ্যণীয়। নবম গর্ভে বিশ্বরূপ। দশম গর্ভে বিশ্বন্তর। যাইহোক, অনুরূপ লাভাদেবীর ‘বহুপুত্র হইল’ এবং মারা গেলে শ্রীহট্টের লাউড়ে লাভাদেবী পুনশ্চ গর্ভবতী হন এবং অদ্বৈতচন্দ্রের জন্ম হয়। মহাপ্রভু চৈতন্যের জন্মের অনেক আগে থেকে যিনি চৈতন্যলীলার উপযুক্ত জমি প্রস্তুত করে রাখবেন বঙ্গদেশে তার জন্য অদ্বৈতের প্রকাশ। চৈতন্যচরিতামৃত বা চৈতন্যভাগবতে অদ্বৈত-জন্মের বা কুবের-লাভা পর্বের বিবরণ পাওয়া যায় না। যদিও

অদ্বৈতের কারণে চৈতন্য অবতার।
সেই কথা প্রভু কহিয়াছেন বার বার।। চৈ.ভা. ১১

নিত্যানন্দপ্রভুর জন্মস্থান জন্মলগ্ন কিন্তু বিশদে দিয়েছেন ভক্ত-শিষ্য বৃন্দাবনদান :

ঈশ্বর আজ্ঞায় আগে শ্রীঅনন্ত ধাম।
রাঢ়ে অবতীর্ণ হইলা নিত্যানন্দ রাম।।
মাঘ মাসে শুক্ল ত্রয়োদশী শুভ দিনে।
পদ্মাবতী নামে একচাকা নামে গ্রামে।। চৈ.ভা. ১২

যাইহোক, ঈশানের বর্ণনায় ‘মাঘী সপ্তমীতে প্রভু প্রকট হইলা।

………………………………………
কমলাক্ষ নাম তান বাছিয়া রাখিলা।।’ অ.প্র. ৪

এই অনুচ্ছেদের প্রথমেই বলেছি, অদ্বৈত মহাদেব স্বরূপ। অদ্বৈতপ্রকাশে দেখছি ‘সদাশিব সদানন্দ’ চিত্তে যোগ সাধনা করেন ‘সপ্তশত বৎসর।’ যথাক্রমে সাধনায় তুষ্ট হয়ে মহাবিষ্ণু শিবকে দর্শন দিলেন এবং বললেন, “তোর মোর এক আত্মা ভিন্নমাত্র দেহ।’ এখানে কিঞ্চিৎ বিসম্বাদের সম্ভাবনা দেখা গেল। ভাগবতসমাজে শিব বৈষ্ণবপ্রধান। এই শিবই বলছেন,

সত্ত্বং বিশুদ্ধং বসুদেবশব্দিতং যদিয়তে তত্র পুমান পাবৃত:
সত্ত্বে চ তস্মিন ভগবান বাসুদেবো হ্যধোক্ষজো মে নমসা বিধীয়তে।

শ্রীমদভাগবত। ৪।৪।পৃ. ৩৮৪

শিবের উক্তি, ‘সর্বেন্দ্রিয়াতীত ভগবান বাসুদেবকেই আমি প্রণাম নিবেদন করে থাকি।’ অদ্বৈতপ্রকাশে হরি-হরের মিলনের সংবাদ পাওয়া গেল। এরপর :

এত শুনি মহাবিষ্ণু শিবাভিন্ন হঞা
শান্তিপুরে লাভাগর্ভে প্রবেলিকা গিঞা। অ.প্র-২

এরও আগে দেখছি,

পূর্বে ধনপতি কুবের শিব পুত্র লাগি।
বহু তপ জপ কৈলা হঞা অনুরাগী।।
তপে তুষ্ট হঞা শিব তথাস্তু কহিলা।
তথি লাগি ধরায় কুবের জনমিলা।। অ.প্র. ২

কমলাক্ষ রাজকুমারের সঙ্গে লেখাপড়া শুরু করেন। অসামান্য মেধাসম্পন্ন কমলাক্ষ বিভিন্ন শাস্ত্রে সুপণ্ডিত হয়ে ওঠেন। যথা—

শ্রুতিধর প্রভু পড়ে কলাপ ব্যাকরণ।
দৃষ্টিমাত্র শিখে সূত্র অর্থ বিবরণ।।
তিন বৎসরেতে গ্রন্থ সমাপ্ত করিলা।
সবে কহে দৈব বিদ্যা কমলাক্ষ পাইলা। অ.প্র.

সববিদ্যা বিশারদ হয়ে বাল্যকাল থেকে ভগবতগত প্রাণ। এর আগে মাতা লাভাদেবীর স্বপ্ন মত সর্বতীর্থ এনে উপস্থিত করেছিলেন বালক কমলাক্ষ। এই সর্বতীর্থ কালে গড়ে উঠবে নবদ্বীপে। কালে নবদ্বীপ হয়ে উঠবে বিদ্যাচর্চার কেন্দ্র। নবদ্বীপকে ঘিরে শুধু বাংলা নয় ভারতীয় শাস্ত্র সুক্ত স্মৃতি ন্যায় ব্যাকরণ থেকে বৈদিক ও সংস্কৃত সাহিত্যের বিদ্যাচর্চা কেন্দ্রের মহাক্ষেত্র গড়ে উঠবে। সেই বিদ্যাচর্চা কেন্দ্রের অন্যতম দিকদর্শী আচার্য হয়ে উঠবেন কমলাক্ষ।

এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করি, ভারতীয় বিদ্যাচর্চার প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে ওঠে তক্ষশিলায়। বৌদ্ধধর্মের বিকাশের পর দ্বিতীয় বিশ্ববিদ্যালয় নালন্দায়। এরপর কাশীতে গড়ে ওঠে সনাতন বিদ্যাচর্চা কেন্দ্র। সবই ভারতের পশ্চিমে। পরের স্বীকৃত বিদ্যাচর্চাকেন্দ্র পূর্বে—নবদ্বীপে। চৈতন্যজন্মের আগেই নবদ্বীপে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বিদ্যান ও বিদ্যার্থীদের সমাগম ঘটতে থাকে। যথা-

কারো জন্ম নবদ্বীপে, কারো চট্টগ্রামে।
কেহো রাঢ়ে, উড্রদেশে, শ্রীহট্টে পশ্চিমে।।
নানাস্থানে অবতীর্ণ হৈলা ভক্তগণ।
নবদ্বীপে আসি হৈল সভার মিলন।। চৈ.ভা. ১০

নবদ্বীপের পণ্ডিতদের মধ্যে যারা আছেন :

শ্রীবাস পণ্ডিত আর শ্রীরাম পণ্ডিত।
চন্দ্রশেখর দেব ত্রৈলোক্য-পূজিত।।
ভবরোগ-বৈদ্য শ্রীমুরারী নাম যাঁর।
শ্রীহট্টে এইসব বৈষ্ণবের অবতার।।
পুণ্ডরীক বিদ্যানিধি বৈষ্ণব-প্রধান।
চৈতন্যবল্লভ দত্ত বাসুদেব নাম।।
চাটিগ্রামে হৈল ইঁহা সভার প্রকাশ।
বুঢ়নে হইলা অবতীর্ণ হরিদাস।।
রাঢ়মাঝে একচাকা নামে আছে গ্রাম।
তঁহি অবতীর্ণ নিত্যানন্দ ভগবান।।
…………………………………….
সেই নবদ্বীপে বৈসে বৈষ্ণবাগ্রগণ্য।
অদ্বৈতআচার্য নাম সর্বলোকে ধন্য।। চৈ.ভা. ১১

কমলাক্ষ মাত্র বারো বছর বয়সে শান্তিপুরে আসেন। লাউড়ের সমৃদ্ধি বা রাজানুগ্রহ থেকে (সম্ভবত: কাউকে কিছু না জানিয়ে) সরে এসে তিনি শান্তিপুর-নবদ্বীপকে সাধনক্ষেত্র তথা চৈতন্য-আবির্ভাবের বীজ-ক্ষেত্র গড়ে তোলেন। তাঁর ‘শোচ্যদেশে’ আগমনের যথাযথ কারণ না জানলেও ঈশান সংক্ষেপে যা বলেছেন :

বঙ্গের জাতীয় ইতিহাস গ্রন্থের বিবরণ অনুযায়ী, খ্রিষ্টিয় পঞ্চদশ শতাব্দীর প্রথমদিকে লাউড় দেশ শাসন করতেন কাত্যায়ণ গোত্রের যে ব্রাহ্মণ রাজা তাঁর নাম দিব্যসিংহ। দিব্যসিংহের রাজধানী ছিল লাউড়ের নবগ্রামে। নবগ্রামবাসী নরসিংহ নাড়িয়ালের পুত্র কুবের পণ্ডিত তাঁর পূর্বপুরুষ ‘আরুওঝা নাড়ুলী গ্রামে বাস করতেন বলিয়া তিনি “নাড়িয়াল” নামে পরিচিত হন এবং সিদ্ধ শোত্রীয় পদ প্রাপ্ত হন। অদ্বৈতকে নানা সময় গৌরাঙ্গ ‘নাড়া’ বলে সম্বোধন করছেন, ‘নাড়িয়াল’ কি তার উৎস?

ইঁহার বংশজাত শ্রীপতি শ্রীহট্টস্থ লাউড়াধিপতির সভা পণ্ডিত হইয়া লাউড়ে আসিয়া বাস করেন। শ্রীপতির অন্বয়জাত নরসিংহ নাড়িয়াল বিদ্যা শিক্ষার জন্য শ্রীহট্ট হইতে গৌড় রাজধানী সন্নিধানে রামকেলী গ্রামে গমন করেন এবং তত্রস্থ জটাধর সর্বাধিকারীর নিকট সংস্কৃত ও পারস্য ভাষাদি শিক্ষা করেন।—কৃষ্ণদাস।। অদ্বৈতবাল্যলীলাসূত্রম।

কুবেরাচার্য প্রসঙ্গে শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত গ্রন্থে অচ্যুতচরণ তত্ত্বনিধি লিখছেন :

লাউড়বাসী নরসিংহের পুত্র কুবের তীক্ষ্ণবুদ্ধি সম্পন্ন ব্যক্তি ছিলেন। তাঁহার পিতা শান্তিপুরে এক বাড়ী করিয়াছিলেন এবং মধ্যে মধ্যে তথায় বাস করিয়া কুবের শান্তিপুরেই শিক্ষালাভ করিয়া তর্কপঞ্চানন উপাধি প্রাপ্ত হন, পরে ময়ূর ভট্টের অন্বয়জাতা লাভাদেবীকে তিনি শান্তিপুরে বিবাহ করেন। বিবাহের পর তাঁহার পিতৃবিয়োগ হয়।

পিতার মৃত্যুর পর কুবেরাচার্য্য গয়াধামে গমন পূর্ব্বক পিতৃকৃত্য সমাপ্ত করত: শান্তিপুর হইতে লাউড়ে (শ্রীহট্টে) আগমন করেন। তৎকালে লাউড় রাজ্য রাজা দিব্যসিংহের শাসনাধীন ছিল। দিব্যসিংহ কুবেরাচার্যের অগাধ জ্ঞান-গৌরবে বিমুগ্ধ হইয়া তাঁহাকে স্বীয় মন্ত্রিত্বে নিয়োজিত করেন।

শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত।।৪। পৃ ৩০-৩১

লাউড়িয়া কৃষ্ণদাসের বাল্যলীলাসুত্রম-এ উল্লেখ :

অথো কুবেরঃ সুবিচক্ষণশ্চ
প্রভুত শাস্ত্রে সুমতিঃ প্ৰশান্তঃ
শ্রীলাউড়ং শান্তিপুরাদ্য যোহি
তদ্দেশে পালেন মুহুঃ সমাদৃত।
সতর্কপঞ্চানন আৰ্য্য চূড়ো
নিত্যাদি শাস্ত্রের্বহুিভিরভিজ্ঞঃ
তদ্রাজ্য পালেন সুশাস্ত্র দর্শিনা
দত্তং স্বমন্ত্রিত্ববাপ যত্নং। — বাল্যলীলাসূত্রম

অচ্যুতচারণের মতে, লাউড়ে থাকাকালে কুবের পণ্ডিতের ছয় পুত্র ও এক কন্যা জন্মগ্রহণ করে। সকলেই অকালে গতায়ু হন। এই ঘটনার সঙ্গে জগন্নাথগৃহিনী শচীদেবীর গর্ভধারণ ও গর্ভপাতের মিল পাওয়া যায়। একথা আগেই উল্লিখিত হয়েছে। যাইহোক, সাত সন্তানের মৃত্যুর পর কুবের সস্ত্রীক শান্তিপুর গমন করেন। বোঝা যাচ্ছে, এ বঙ্গের সঙ্গে কুবেরের একটি সম্পর্ক আগে থাকতেই গড়ে উঠেছিল। অচ্যুতচরণের বর্ণনায়—

রাজমন্ত্রী কুবেরের সুমন্ত্রণা প্রভাবে লাউড় রাজ্য অচিরেই সমৃদ্ধি সম্পন্ন হইয়া উঠে। মন্ত্রী কুবেরের দক্ষতায় রাজা সুখী, জন-হিতৈষণায় প্রজাবৰ্গ প্রফুল্ল অমায়িকতার প্রতিবেশীবর্গ বাধ্য ছিল। কিন্তু কুসুমেও কীট থাকে, কুবেরের মনেও সুখ ছিল না; তাহার কারণ লাউড়ে আসিয়া ক্ৰমান্বয়ে তাঁহার ছয়টি পুত্র জাত হইয়া অচিরকাল মধ্যে গতায়ু হয়। তাহার পরে একটি কন্যা জাত হয়, কন্যাটিও ভ্রাতৃগণের পথানুসরণ করে। কুবেরাচার্য্যের এই পুত্রগণের নাম যথা—লক্ষ্মীকান্ত, শ্রীকান্ত, হরিহরানন্দ, কুশল, সদাশিব ও কীৰ্ত্তিচন্দ্র।

এত গুলি পুত্রকন্যার মৃত্যু ঘটিলে পিতামাতার মনে কিরূপ ভাবোদয় হয়, তাহা না বলিলেও চলে। কুবেরের আর দেশে থাকিতে ইচ্ছা হইল না, তিনি পত্নীর সহিত শান্তিপুরে চলিয়া গেলেন এবং কিছুকাল উভয়ে তথায় সেই স্থানে অবস্থিতি কালে লাভাদেবীর গর্ভ লক্ষণ প্রকাশ পায়, এই গর্ভজাত সন্তানটি বাঁচিবে কি না সন্দেহ হওয়া অস্বাভাবিক নহে, কুবের দৈব লাভাশায় নারায়ণের পূজা ও দরিদ্র সেবায় অনেক ব্যয় করিতে লাগিলেন। এই সময়ে কুবের, রাজা দিব্যসিংহের এক পত্র পাইলেন ও দেশে আসিলেন। কুবের স্বদেশে আগমন করিয়া প্রতিবাসিবর্গের সহিত প্রথমে সাক্ষাৎ করিলেন, তাঁহারা সকলেই পরম আনন্দিত হইলেন—”সেই গ্রামের লোক তাঁরে সম্মান করিলা।” তারপর রাজার সহিত দেখা হইল, রাজাও হৃষ্টচিত্তে তাঁহাকে গ্রহণ করিলেন। রাজা বলিলেন-

“মন্ত্রি, তোমার অনুপস্থিতে আমার কার্য্য অচল হইয়া পড়ে, অধিক কি, ‘তুয়া বিনা রাজ্যপাট শুন্য করি মানি।”

কুবের কিদৃশ দক্ষ মন্ত্রী ছিলেন, ইহাতেই বুঝা যায়। রাজাকে মন্ত্রী যে উত্তর দিলেন, তাহা এই—

দরিদ্র ব্রাহ্মণে দয়া কর নিরবধি।—শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত।।২।৩৭৮

এই সূত্রে বিজয়পুরীর নাম প্রসঙ্গত উল্লেখ্য। এঁর পূর্ব নিবাস ছিল শ্রীহট্টের লাউড়ে। কুবেরপত্নি লাভাদেবীর পুরোহিতপুত্র বিজয়কে ‘ভাই’ সম্বোধন করতেন লাভাদেবী। মাধবেন্দ্রপুরী এনার সতীর্থ ছিলেন। এঁর সন্ন্যাস-নাম হয় বিজয়পুরী। অদ্বৈতের বৈষ্ণব-জীবনে বিজয়পুরীর বিশেষ প্রভাব ছিল বলে বোধ হয়। প্রেমবিলাসও অদ্বৈতমঙ্গলে এঁর উল্লেখ আছে। যথা-

নাভাদেবী ভাই যারে বলে সৰ্ব্বক্ষণ।
সে বিপ্ৰ সন্ন্যাসী হৈল লক্ষীপতি স্থানে।
বিজয়পুরী নাম তার সর্ব্বলোক শুনে।।—প্রেমবিলাস
প্রেম পদ গদ দুৰ্ব্বাসা সাক্ষাৎ।
শ্রীমাধব পুরির সতীর্থ হয় যে বিখ্যাত।।— অদ্বৈতমঙ্গল

কুবের-নাভার সন্তান অদ্বৈত শান্তিপুর গিয়ে যে চৈতন্যলীলার বীজভূমি প্রস্তুত করবেন, সেই অদ্বৈতের মনোভূমি আগে থেকেই প্রস্তুত হচ্ছিল লাউড়ে। অন্তত লাউড়িয়া কৃষ্ণদাসের রচনায় এমন বিবরণ পাওয়া যায়। আমরা আগেই উল্লেখ করেছি, লাউড়ের নবগ্রামবাসী নরসিংহের পুত্র কুবের তর্কপঞ্চানন রাজা দিব্যসিংহের মন্ত্রী ছিলেন। কুবেরাচার্য ছিলেন বিদ্যান, বুদ্ধিমান ও ধর্মপরায়ণ। তাঁর প্রভাবে লাউড় দেশ সমৃদ্ধ হয়। তাঁর পাণ্ডিত্য নবদ্বীপ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। কুবেরাচার্যের ঔরসে ও তদীয় স্ত্রী লাভা দেবীর (মতান্তরে নাভাদেবী) গর্ভে অদ্বৈতাচার্যের জন্ম।

শাকে রস প্রাণ গুণেন্দু মান
শ্রী লাউড়ে পুণ্যময়েহি মাঘে;
শ্রীসপ্তমী পুণ্যতিথৌসিতেহভু
অদ্বৈতচন্দ্রঃ কৃপয়াবতীর্ণঃ।।

অদ্বৈতের পিতৃদত্ত নাম কমলা (বা কমলাক্ষ)। তিনি লাউড়ের পণাতীর্থের মহিমা প্রকাশ করিয়াছিলেন। ….অদ্বৈত ভবিষ্যতে যে একজন মহাপুরুষ বলিয়া খ্যাত হইবেন, তখনই তাহার লক্ষণ ব্যক্ত হইয়াছিল; তখনই তাঁহার সর্বভূতে দয়া ও গুরুজনে একান্ত ভক্তি ইত্যাদি দর্শনে সকলেই প্রীত হইতেন। তিনি অতিশয় মেধাবী ছিলেন। যে কোন বিষয়, যত কেন কঠিন হউক, একবার মাত্র পাঠ করিলেই কদাপি তাহা ভুলিতেন না। এইজন্য সকলে তাঁহাকে ‘শ্রুতিধর’ বলিত।

-শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত। ২য় ভাগ। ৩ খণ্ড। ৩৭৮

অদ্বৈতের শান্তিপুরলীলার বহু বিবরণ বৃন্দাবন দাস থেকে কৃষ্ণদাস পরিচয় দিয়েছেন। কিন্তু লাউড়িয়া কৃষ্ণদাস এবং তারপর ঈশাননাগরের বিবরণ ব্যতিরেকে অদ্বৈতের বাল্যজীবন, কৈশোর তথা শান্তিপুর-পূর্ব ঘটনা অজানিতই থাকত পাঠক ও ভক্তের কাছে। অচ্যুতচরণের বিবরণে অন্তত তার প্রকাশ দেখতে পাই।

অতঃপর অদ্বৈতের মহিমার কথা চতুর্দ্দিকে বিস্তৃত হইয়া পড়িল, বহু লোক আকৃষ্ট হইয়া তাঁহার শিষ্যত্ব স্বীকার করিতে লাগিল; এই সময়ে লাউড়ের রাজা দিব্যসিং কাশী গমন ব্যপদেশে শান্তিপুরে উপস্থিত হন। কিন্তু তাঁহার আর কাশী যাওয়া হইল না, অদ্বৈতের এক হুংকারে তিনি বৈষ্ণবধৰ্ম্ম গ্রহণ পূৰ্ব্বক কৃষ্ণদাস নামে খ্যাত হন; লাউড়-বাসী বলিয়া শান্তিপুরে তিনি লাউড়িয়া কৃষ্ণদাস নামে সংজ্ঞিত হইতেন। তিনি অদ্বৈতের বাল্যলীলা সংস্কৃত ভাষায় লিপিবদ্ধ করেন, তদ্ব্যতীত বাঙ্গালার “বিষ্ণুভক্তি রত্নাবলি” রচনা করেন। কৃষ্ণদাস পরে শান্তিপুর হইতে বৃন্দাবনে গমন করিয়াছিলেন এবং তথায় বাস করেন, সেই স্থানে তিনি কৃষ্ণদাস ব্রহ্মচারী নামে খ্যাত হইয়াছিলেন। ইঁহার পূর্ব্বে কোন বাঙ্গালী বৃন্দাবনে গিয়া বাস করেন নাই। অতএব বৃন্দাবনে বাঙ্গালী সাধুগণের স্থায়ীরূপে বাস করার সূত্রপাত এই শ্রীহট্টবাসী কর্তৃক হইয়াছিল বলিতে পারা যায়। কৃষ্ণদাসের কথা পূৰ্ব্বে বলা গিয়াছে।

এই সময়ের অল্পপরে তাঁহার সহিত নৃসিংহ ভাদুড়ীর দুহিতা শ্রীদেবী ও সীতাদেবীর বিবাহ হয়। অদ্বৈতের পাঁচ পুত্র, যথা-অচ্যুতানন্দ, কৃষ্ণমিশ্র, স্বরূপ, জগদীশ ও বলরাম মিশ্র। ইঁহাদের বংশীয়গণ বঙ্গের নানাস্থানে ‘গোস্বামী’ উপাধিতে খ্যাত হইয়া সসম্মানে বাস করিতেছেন।

প্রসিদ্ধ যবন হরিদাস অদ্বৈতের অতি অনুগত ছিলেন, তিনি শান্তিপুরে অদ্বৈত প্রভুর সঙ্গে বাস করিতেন। অদ্বৈতের শিষ্য সংখ্যা অনেক, শ্রীচৈতন্যচরিতামৃতাদি গ্রন্থে তাঁহাদের নামাবলী লিখিত আছে। কথিত আছে যে, আসামের শঙ্করদেব অদ্বৈতের শিষ্যরূপে কিছুকাল শান্তিপুরে ছিলেন। অদ্বৈত প্রভুর শ্রীহট্টবাসী আর এক শিষ্যের সংবাদ আমরা পূর্ব্বে বলিয়াছি, তিনি ‘অদ্বৈত প্রকাশ গ্রন্থ’ রচয়িতা ঈশানদাস।

—শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত।৪। ১৯

অদ্বৈত তাঁর সাধনক্ষেত্র ও লীলাক্ষেত্র হিসাবে শান্তিপুরকে বেছে নিলেন কেন, আমরা তার উল্লেখ করেছি। সেই বিবরণ কিঞ্চিৎ বিশদ হলেও অপ্রাসঙ্গিক হবে না বিবেচনার বিস্তৃত বর্ণনায় যাবার চেষ্টা করছি।

অদ্বৈত যখন শান্তিপুরে অবস্থিতি করিতেছিলেন, তৎকালে এদেশে বৈষ্ণব ধর্ম্মের কোনরূপ আলোচনা ছিল না, লোকের মতি ধর্ম্মের দিকে বড় ধাবিত হইত না। নবদ্বীপ শান্তিপুরাদি স্থানের ব্রাহ্মণবর্গ বিদ্যাচর্চ্চা লইয়া ব্যস্ত থাকিতেন, সাধারণ লোকেরাও বিষয় ব্যাপারে নিবিষ্ট থাকিত, ধর্ম্মে কাহারই মতি ছিল না। লোকের নৈতিক অবনতি অবলোকনে অদ্বৈত অত্যন্ত আকুলিত হইতেন, অহরহঃ তিনি এই চিন্তা করিতেন যে, কিরূপে লোকের হিত হইবে-কিরূপে তাহাদের দুর্গতি দূর হইবে। এইরূপ চিন্তা করিতে করিতে তন্ময় হইয়া কখন কখন তাঁহার বাহ্যজ্ঞান বিলোপ হইয়া যাইত, মন দৈববলে বলীয়ান হইয়া উঠিত, নৈরাশ্য চলিয়া যাইত; আবিষ্ট ভাবে তদবস্থায় তিনি কখন কখন উন্মত্তের ন্যায় বলিয়া উঠিতেন-দেশের এই দূর্গতি দূর করিতেই হইবে; যদি আবশ্যক হয়, ভগবানকে অবতীর্ণ করাইব, তাহা না হইলে আমার নাম মিথ্যা। কিন্তু সাধারণ সময়ে সৰ্ব্বদাই তিনি দেশের নৈতিক অধোগতি লক্ষ্য করিয়া হরিদাসাদির সহিত ক্রন্দন করিতেন। লোকের পাপাশক্তি দৃষ্টে যাঁহাদের অন্তরে দাহ উপস্থিত হয়, নয়নে জল ঝরিতে থাকে, তাঁহাদের দুঃখ দূর করা লোকের সুসাধ্য নহে। অদ্বৈত নিরুপায় হইয়া ভাবিলেন যে, লোকের আন্তরিক অশান্তি, লোকের দূর্গতি ভগবৎ শক্তি ব্যতীত দূর করিবার ক্ষমতা কাহারই নাই। কিন্তু ভগবান তাঁহার প্রার্থনা শুনিবেন কেন?

একদা শাস্ত্রান্বেষণে তিনি একটি শ্লোক দেখিতে পাইলেন, শ্লোকটির মর্ম্ম এই, যে কেহ তুলসীমঞ্জরী ভক্তিভরে হরিচরণে সমর্পণ করেন, ভগবান তাঁহার সঙ্কল্প পূরণ করিয়া থাকেন। শাস্ত্র বাক্য বিশ্বাস করিয়া তিনি এই সঙ্কল্প আবির্ভূত হইয়া সমস্ত পতিত জনের উদ্ধার করেন।

একটি নিভৃত স্থানে উপবেশন পূৰ্ব্বক নিয়ত নিয়মিত রূপে কিছুদিন সেবা করিলে, সহসা তাঁহার চিত্ত প্রফুল্ল হইয়া উঠিল, তিনি শান্তিপুর হইতে নবদ্বীপে আগমন করিলেন ও তথায় সাময়িক ভাবে বাস করিতে

লাগিলেন।’—তদেব, পৃ. ২০

ধর্মাচরণ ও ধর্মপ্রচার এক নয়। শান্তিপুরে যে পরিসরে তিনি ধর্মাচরণে ব্যাপৃত ছিলেন, নবদ্বীপের পরিমণ্ডল তার থেকে অনেক বড়ো। তাই তিনি নবদ্বীপেও অবস্থান করলেন কিছুকাল। তার বিবরণ নিম্নরূপ :

অদ্বৈতের এই যে জীব দুঃখ কাতরতা এবং জীব-দুঃখ দূর করিবার জন্য দুৰ্জ্জয় তপস্যা, ইহা দুৰ্ল্লভ পদার্থ। নিজের মুক্তি কামনায় অনেকেই তপস্যা করেন কিন্তু পরের মুক্তির তরে তপশ্চার্য্যা দুর্লভ। অদ্বৈতের বিশ্বাসও দুৰ্ল্লভ, আর তাহার সফলতাও অসামান্য। নবদ্বীপ আসিয়া অদ্বৈত নিজ গৃহে গীতা ও ভাগবতের ভক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা করিতে প্রবৃত হইলেন। দুই একজন করিয়া নাগরিক তাঁহার ব্যাখ্যা শুনিতে আসিতেন। এইরূপে নবদ্বীপে একটি আদিবৈষ্ণব সভার প্রতিষ্ঠা হয়। এই সভায় নবদ্বীপ-প্রবাসী শ্রীহট্টের শ্রীবাস, শ্রীরাম, শ্রীপতি, শ্রীনিধি, চন্দ্রশেখর, মুরারিগুপ্ত, জগদীশ প্রভৃতি একত্রিত হইতেন। শ্রীহট্টের জগন্নাথ মিশ্রের জ্যেষ্ঠ পুত্র বিশ্বরূপও আসিতেন ও অদ্বৈতের ব্যাখ্যান শুনিয়া তৃপ্তিলাভ করিতেন।

অদ্বৈতের এই কাণ্ড দর্শনে পণ্ডিতবর্গ অবজ্ঞার হাসি হাসিতেন, কিন্তু অদ্বৈতের নিষ্ঠা ও বিশ্বাস, তদীয় বাক্যের দৃঢ়তা ও জীবনের লক্ষ্য বিচার করিয়া তাঁহারা বিস্মিত হইয়া যাইতেন। যাহা হউক, নবদ্বীপে অদ্বৈতের অনুরাগীর দল ক্রমশঃই বৰ্দ্ধিত হইয়া উঠিয়াছিল।

যে বিশাল ভক্তি-প্রবাহে একদিন শান্তিপুর ডুবুডুবু হইয়াছিল, নবদ্বীপ ভাসিয়া গিয়াছিল, যে স্রোত গৌড় বঙ্গ আপ্লাবিত করিয়া সাগর তীরে পৌঁছিয়াছিল, তাহার উৎপত্তি ভূমি এই অদ্বৈত সভা বলা যাইতে পারে। অদ্বৈতের আরাধনার ফল তাঁহার নবদ্বীপ আগমনের কিছুকাল পরেই তিনি প্রাপ্ত হন; তাঁহার বৈষ্ণব সভা সংস্থাপনের তাঁহার গীতা ও ভাগবত বিচারের ফল কিছুকাল পরেই তিনি প্রাপ্ত হন। জগন্নাথ মিশ্রের দ্বিতীয় পুত্র বিশ্বম্ভর মিশ্র-যিনি শ্রীমহাপ্রভু অথবা শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য নামে পশ্চাৎ খ্যাত হন, তাঁহার আবির্ভাবেই অদ্বৈতের মনোরথ পূর্ণ হয়। উপসংহারে আমরা তাঁহার অমৃত-বর্ষী লীলাকথা প্রকীর্তনে লেখনী পবিত্র করিব।—তদেব, পৃ. ২১ অদ্বৈত-দর্শন তথা প্রজ্ঞার কিছু অনুষঙ্গ প্রসঙ্গত উল্লেখ্য :

অদ্বৈতের জ্ঞানব্যাখ্যা একটি প্রসিদ্ধ ঘটনা। শ্রীমহাপ্রভু বৃদ্ধ-তপস্বী অদ্বৈতাচার্য্যকে গুরুবৎ ভক্তি করিতেন, সময় সময় পদধূলি গ্রহণ করিতেও কুণ্ঠিত হইতেন না; ইহাতে অদ্বৈত মরমে মরিয়া যাইতেন। অদ্বৈতাদি ভক্তবর্গ শ্রীমহাপ্রভুর ভগবত্ত্বা সত্য কি না, তদ্বিষয়ে কঠোর পরীক্ষা করিয়াছিলেন। যাহার অতিরিক্ত পরীক্ষা করা যাইতে পারে না, তদ্রূপ পরীক্ষা করিয়া তাঁহাদের দৃঢ় বিশ্বাস জন্মিয়াছিল যে, শ্রীগৌরাঙ্গ মনুষ্য নহেন। সুতরাং বয়সে বালক হইলেও শ্রীগৌরাঙ্গকে বৃদ্ধ অদ্বৈত আন্তরিক শ্রদ্ধা করিতেন; পদধূলি লইতে তাহার শতবার ইচ্ছা হইত, কিন্তু লৌকিক ব্যবহারে পারিতেন না। এদিকে শ্রীগৌরাঙ্গ বিপরীত ব্যবহার করিয়া বসিতেন। ইহাতে অদ্বৈতের অন্তর ব্যথিত না হইবার কথা কি? এইরূপ ব্যবহার করে অদ্বৈতের অসহ্য হইয়া উঠিল – ভগবানের উপর ভক্তের অভিমান হইল। অভিমানের উত্তেজনায় তিনি মনে করিলেন— “দেখিব কেমন ভগবান! তিনি যে ভক্তিবাদের পক্ষপাতী, জ্ঞানব্যাখ্যা করিয়া ভক্তির প্রাধান্য উড়াইয়া দিব, আমি তাহাতে দোষ দিব, ইহাতে তিনি শাস্তি করেন কি না দেখিব। আমি দণ্ডও হইতেই চাহি; দণ্ড ব্যক্তি পূজার্হ নহে; সুতরাং দণ্ড প্রাপ্তিই আমার অভীষ্ট সিদ্ধির উপায়।”

এবে জ্ঞানবাদ আমি করিব প্রচার।
যাহাতে প্রভুর হয় ক্রোধের সঞ্চার।।
শুনিয়া অবশ্য প্রভু আসি শান্তিপুর।
নিজ হাতেতে শাস্তি করিবে আমারে।—প্রেম বিলাস

বলা গিয়াছে যে, অদ্বৈতের এই জ্ঞানব্যাখ্যা কল্পিত, ইহার বহুপূর্ব্বে অদ্বৈত যোগবাশিষ্ট ও শ্রীমদ্ভাগদগীতার ভক্তিমার্গানুযায়ী ভাষ্য প্রণয়ন করিয়াছিলেন এই সুঅবসরে সেই দুই ভাষ্য গ্রন্থ শ্রীমহাপ্রভুকে দেখাইলেন। শ্রীমহাপ্রভু উহা পাঠ করিয়া ইহার অত্যন্ত সুখ্যাতি করিলেন। অদ্বৈত কৃত এ দুইখানা ভাষ্য গ্রন্থ এক্ষণে কোথায়? ইহা কি বিলুপ্ত হইয়া গিয়াছে?

অতঃপর অদ্বৈত আপন শিষ্যগণ সমীপে প্রকৃত তথ্য ব্যক্ত করিলেন, ভক্তিই যে স্বশ্রেষ্ঠ-পঞ্চম পুরুষার্থ, তাহা বুঝাইয়া দিলেন। পূৰ্ব্ব ব্যাখ্যা শ্রবণে যাঁহারা সংশয়ান্বিত হইয়াছিল, তাঁহাদের মধ্যে অনেকেই প্ৰবুব্ধ হইল, কিন্তু দুৰ্ব্বদ্ধি তার্কিকগণ বিতর্ক উপস্থিত করিয়া, অদ্বৈত কর্তৃক পরিবর্জ্জিত হইল। এইরূপে অনেক শিষ্য পরিত্যক্ত হইয়া পূৰ্ব্ববঙ্গে আগমন করিয়াছিল, তথায় তাঁহারা বিবিধ মতবাদের সৃষ্টি করিয়া, লোকের ভ্রান্তি উৎপাদিত করিয়াছিল বলিয়া জ্ঞাত হওয়া যায়। অনেকে অনুমান করেন, বৈষ্ণব ধর্ম্মাশ্রিত যে সকল উপধর্ম্ম বঙ্গভূমে পরিলক্ষিত হয়, তন্মধ্যে কোন কোনটি ইহাদের কাঁহার কাহারও কর্তৃক কল্পিত হইয়া থাকিবে।

শ্রীমহাপ্রভু চন্দ্রশেখর আচার্য্যরত্নের গৃহে কৃষ্ণলীলা নাটকাভিনয় করিয়াছিলেন, এই অভিনয়ে শ্রীমহাপ্রভুর শিক্ষানুসারে অদ্বৈতকে কৃষ্ণ সাজিতে হইয়াছিল। পরে এই ঘটনা হইতে, তাঁহার শিষ্যগণ মধ্যে কেহ কেহ “অদ্বৈত গোবিন্দ” বলিয়া একটা মতের সৃষ্টি করেন, ইঁহারা অদ্বৈতকে স্বয়ং ভগবান বলিয়া ধার্য্য করিয়াছিলেন; কিন্তু ইঁহারাও অদ্বৈত কর্তৃক পরিবর্জ্জিত হন;

তাহাতেই এই অভিনব মত বিলুপ্ত হইয়া যায়। একথা এস্থলে উল্লেখ করার উদ্দেশ্য এই যে, ইহাতে অদ্বৈতের মাহাত্ম্য অনেকটা উপলব্ধি হইবে, তাঁহার মহিমায় শিষ্যবর্গ কীদৃশ আকৃষ্ট ছিলেন এবং তাঁহাকে কিরূপ উচ্চভাবে দর্শন করিতেন, এতদ্বারা তাহা বুঝা যায়।

শ্রীমহাপ্রভু নবদ্বীপে ভক্তবর্গ সহ যে যে লীলা করেন, তাঁহার প্রায় প্রত্যেকটিতে অদ্বৈতের যোগ ছিল, যাঁহারা গৌরলীলা অধ্যয়ন করিয়াছেন, ইহা তাঁহাদের অবিদিত নহে। শ্রীমহাপ্রভু সন্ন্যাস গ্রহণ করিয়া প্রথমেই শান্তিপুরে অদ্বৈত গৃহে উপনীত হইয়াছিলেন। অদ্বৈত হারানিধি পুনঃপ্রান্তে পরম হর্ষিত হন। অদ্বৈত-গৃহ-তৎক্ষণাৎ ভক্তবর্গে পরিপুরিত হইয়া উঠিয়াছিল, মহামহোৎসব আরম্ভ হইয়াছিল। শ্রীমহাপ্রভুকে লইয়া ভক্তগণ তখন হরিসঙ্কীর্ত্তন আরম্ভ করিয়াছিলেন সেই কীৰ্ত্তনে অদ্বৈত কর্তৃক বিদ্যাপতি কৃত একটি সুন্দর পদগীত হইয়াছিল, পদটি এই—

“কি কহব রে সখি, আনন্দ ওর,
চিরদিনে মাধব মন্দিরে মোর।।” ইত্যাদি

শান্তিপুরে কয়েকদিন ভক্তের আনন্দ বিধান পূর্বক শ্রীগৌরাঙ্গ অবশেষে নীলাচলে যাত্রা করেন। অন্যান্য ভক্তবর্গসহ অদ্বৈত প্রতিবর্ষে নীলাচলে গিয়া তাঁর সঙ্গে সম্মিলিত হতেন ও রথোৎসবের পরে ফিরে আসিতেন। একবার অদ্বৈত শ্রীমহাপ্রভুকে বড়ই উত্যক্ত করছিলেন। শ্রীমহাপ্রভু সহজ অবস্থায় কখনও এরূপ ভাব প্রকাশ করেন নাই যে, তিনি অবতার। অবতার বলে দৈবাৎ কেউ উল্লেখ করলে তিনি বড়ই বিব্রত হতেন, তাই ভক্তগণ ভয়ে একথা মুখে আনতেন না। নীলাচলে একদিন অদ্বৈত তাহাই করিয়া বসিলেন। শ্রীচৈতন্য বিষয়ক সঙ্গীত করিতে তিনি ভক্তবর্গকে অনুরোধ করিলেন, ভক্তবর্গ এই কঠিন অনুরোধ রক্ষা করিতে ভীত হইলেও বৃদ্ধ ঋষিকল্প অদ্বৈতের বাক্য তাহারা লঙ্ঘন করিতে না পারিয়া প্রস্তুত হইলেন; বিশেষতঃ অদ্বৈতের এই কথাটি সকলেরই মনের কথা ছিল। অদ্বৈত স্বয়ংই হর্ষে সঙ্গীত রচনা করিয়া দিলেন। তাহাই শ্রীগৌরাঙ্গ বিষয়ক আদি সঙ্গীত, অতএব শ্রীগৌরাঙ্গ বিষয়ক সঙ্গীতের আদি রচয়িতাও শ্রীহট্টবাসী।

—শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত।৪।২৫

শ্রীগৌরাঙ্গ বিষয়ক সে সঙ্গীতটি দুটি এস্থলে উদ্ধৃত করা হইল—

১। শ্রীচৈতন্য নারায়ণ করুণা সাগর।
দীন দুঃখিতের বন্ধু, মোরে দয়া কর।।

২। শ্রীরাগ-

পুলকে রচিত গায়, সুখে গড়াগড়ি যায়
দেখরে চৈতন্য অবতারা।
বৈকুন্ঠ নায়ক হরি, দ্বীজরূপে অবতরি,
সঙ্কীর্তনে করেন বিহারা।।
কনক জিনিয়া কান্তি, শ্রীবিগ্রহ শোভে রে,
আজানু লম্বিত মালা সাজে রে।
সন্ন্যাসীর রূপে আপন রসে বিহ্বল,
না জানি কেমন সুখে নাচে রে।।
জয় জয় গৌর- সুন্দর করুণাসিন্ধু,
জয় জয় সম্প্রতি, নবদ্বীপ পুরন্দর,
জয় জয় গৌর– বৃন্দাবন রায়া রে।
চরম কমল দেহ ছায়া রে।।

মহাপ্রভু ও অদ্বৈতের কৌতুক বিবরণের নানা প্রসঙ্গ আমরা শ্রীচৈতন্যভাগবতে ও শ্রীচৈতন্যচরিতামৃতে পাই। বিশেষত একটি প্রহেলিকা। যার প্রসঙ্গ তুমি শ্রদ্ধেয় বিমানবিহারী মজুমদার কিছু প্রাসঙ্গিত প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন। প্রহেলিকাটি ও তৎপ্রসঙ্গে দুটি অনুষঙ্গ ও ব্যাখ্যা তুলে ধরা হল :

বাউলকে কহিও লোক হইল বাউল।
বাউলকেও কহিও হাটে না বিকায় চাউল।।
বাউলকে কহিও কাজে নাহিক আউল।
বাউলকে কহিও ইহা করিয়াছে বাউল।।

পণ্ডিত রাম নারায়ণ বিদ্যারত্ন অর্থ করেছেন যে, কৃষ্ণ প্রেমোন্মত্তকে (শ্রীমহাপ্রভুকে বলো, লোক কৃষ্ণ প্রেমে উন্মত্ত হয়েছে; আর কেউ বাকি নাই যে কৃষ্ণ প্রেম নেবে—প্রেম আর বিকায় না। আর বলো যে এই প্রেম বিতরণ কার্যে কোন ত্রুটি হয় নাই। আর পাগল অদ্বৈতই এর বক্তা।

দ্বিতীয় ব্যাখ্যাটি নিম্নরূপ :

ভক্তবর্গ এই গূঢ়ার্থবোধক বাক্যের অর্থ পরিগ্রহ করিতে না পারিয়া শ্রীমহাপ্রভুকে তাহার তাৎপর্য্য জিঞ্জাসিলে তিনি বলিয়াছিলেন, “আচার্য্য তন্ত্রজ্ঞ পূজক, তিনি দেবতার আবাহন করিয়া পুনঃ যথা সময়ে বিসর্জ্জন করিয়া থাকেন, তাঁহার কথার অর্থ তিনিই বুঝেন।” ইহার পর হইতেই শ্রীমহাপ্রভুর ভাব অন্যরূপ হইল, তিনি একরূপ বাহ্য জ্ঞান বিরহিত হইয়াই সৰ্ব্বদা থাকিতেন; এবং তদবস্থায় অপ্রকট হন। অপ্রকটের পর প্রহেলীর অর্থ ভক্তবর্গ বুঝিতে পারিয়াছিলেন। এই প্রহেলিকা তদীয় লীলা সম্বরণের জন্য ইঙ্গিত মাত্র।

তবে প্রভু কমলাক্ষ হরি হররূপী।
অন্তর্হিত হইলেন গৌরলীলা জপি।।
দ্বাদশবর্ষ বয়:ক্রমে শান্তিপুরে গেলা।
ষড়দর্শন শাস্ত্র ক্রমে পড়িতে লাগিলা।। – অ.প্র.-৮

ষড়দর্শন পড়া যদি অভিলাস হয়ে থাকে তাহলে কুবের পণ্ডিতের আপত্তির কারণ থাকার কথা নয়। পুত্রের অদর্শনে লোক পাঠিয়ে কুবের বহু খোঁজাখুঁজি করেন। ‘খুঁজিয়া না পাঞা চক্ষে বহে অশ্রুধার।’ অবশেষে কমলাক্ষের পত্র পেয়ে কুবের-লাভা সব অবগত হন এবং ‘তরি আপোহয়া’ নদীয়া গমন করেন। পিতা-পুত্রে মিলন হন। পিতার পরামর্শে কমলাক্ষ ‘বেদান্তবাগীশ শান্ত দ্বিজবরের বাটি’ গিয়ে ‘বেদ চারিখান’ পাঠ করেন দু-বছর ধরে। এখানে কমলাক্ষর এক অপূর্ব লীলার কথা পাই অদ্বৈতপ্রকাশে। ছাত্রদের নিয়ে বেদজ্ঞ আচার্য এক বিল-এর তীরে নিয়ে আসেন। বিল-মধ্যে এক সুন্দর পদ্ম দেখতে পেয়ে সেটি যে কোন একজনকে তুলে আনতে বলেন। কাঁটাভর্তি ও বিলে গুরু নির্দিষ্ট ওই পদ্মটির চারিপাশে ‘কালসর্পগণ তাহে করয়ে বিহার।’ কমলাক্ষ বলেন, তিনি পারবেন পদ্মটি তুলে আনতে। গুরু বলেন, ‘এই সুদুর্গমে না করিহ দর্প।’ কমলাক্ষ পদ্মে পদ্মে পা দিতে দিতে সেই পদ্মটি তুলে এনে ‘ভক্তি করি গুরুদেবে করিল অর্পন।’ বেদ শিক্ষার সমাপনান্তে কমলাক্ষ ‘বেদ পঞ্চানন’ পদবি প্রাপ্ত হন। বিদ্যাশিক্ষা চর্চার পাশাপাশি ‘পিতৃমাতৃ সেবায়’কমলাক্ষ একবৎসর নিবেদিত প্রাণ হয়ে থাকেন। কালে ‘নব্বই বৎসর অতিক্রান্তে’ কুবের আচার্য ও লাভাদেবী প্রয়াত হলেন। পিতৃ আজ্ঞা অনুযায়ী পিণ্ডদান নিমিত্ত কমলাক্ষ ‘গয়াধামে গেলা যাঁহা হয় বিষ্ণুক্ষেত্র।’ গয়াধাম থেকে কমলাক্ষের তীর্থভ্রমণ শুরু হল। পূর্বাপর বিবরণ থেকে বিশ্বম্ভরের পিতৃবিয়োগের পর গয়া-গদাধর দর্শনে ঐশী মনবৈকল্য, সন্ন্যাস-অভিলাস এবং নীলাচল যাত্রার সাযুজ্য পাওয়া গেলেও অদ্বৈতপ্রকাশ স্বতন্ত্র। বরং নীলাচলবাসী গৌরচন্দ্র নিত্যানন্দ বললেন:

এই কথা তুমি গিয়া কহিও সভারে।
আমি যাই নীলাচলচন্দ্র দেখিবারে।।
সভার অপেক্ষা আমি করি শান্তিপুরে।
রহিবাঙ শ্রী অদ্বৈত আচার্য্যের ঘরে।। —চৈ.ভা. ২৪৯

দেখা যাচ্ছে, নীলাচলসহ তীর্থদর্শন ও লীলাপ্রকাশের পর মহাপ্রভু বঙ্গে প্রবেশকালে শান্তিপুরে অদ্বৈতগৃহে উপস্থিত হবেন এবং সেখানে সকল ভক্তমগুলি সমবেত হবেন এই মর্মে নির্দেশ দিয়ে গেলেন। শান্তিপুরকে বেছে নিলেন সম্ভবত দুটি কারণে—প্রথমত, শচী-বিষ্ণুপ্রিয়া তথা সংসার থেকে একটু দূরে থাকতে চাইলেন। দ্বিতীয়ত, শান্তিপুর তখন অদ্বৈতের কারণে নববৃন্দাবন স্বরূপ। শান্তিপুরকে ডুবিয়ে তবে মহাপ্রভু নদীয়া ভাসালন। নদীয়া এখানে নবদ্বীপ অর্থে।

গয়াধাম থেকে কমলাক্ষ যে সকল তীর্থাদি পরিভ্রমণ করেন তা নিম্নরূপ : গয়া, পুরুষোত্তম, নাভিগয়া, পুরীধাম, দণ্ডকারণ্য, প্রভাস, পুষ্কর, কুরুক্ষেত্র, বদ্রিকাশ্রম, গোমুখ, গণ্ডকী, মিথিলা, অযোধ্যা, বারাণসী, ত্রিবেণী (প্রয়াগ), গোবর্ধন, বৃন্দাবন, মথুরা ইত্যাদি। তীর্থযাত্রাপথ শ্রীচৈতন্যের প্রায় অনুরূপ। এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। চৈতন্যদেবের তীর্থভ্রমণ শুরু হয় চব্বিশ বছর বয়সে। আনুমানিক ১৫০৯ খৃষ্টাব্দে। কমলাক্ষের তীর্থযাত্রার সময়কাল আনুমানিক ১৪৫৩-৫৪ খ্রিঃ। শের শাহের (১৫৪০-৪৫ খ্রিঃ) আগে এদেশের রাস্তাঘাট ভালো যেমন ছিল না, নির্ভরযোগ্যও ছিল না। তারমধ্যে যে দু-একটি পথ ধরে তীর্থযাত্রীগণ যাতায়াত করতেন, গতায়তে তেমন তারতম্য ঘটতো না। রাস্তার মধ্যে গৌড় থেকে পান্ডুয়া পর্যন্ত একটি মোটামুটি নির্ভরযোগ্য রাস্তার বিবরণ পাওয়া যায়। পূর্ববঙ্গে সোনারগাঁ থেকে আগ্রা হয়ে সিন্ধু পর্যন্ত বিস্তৃত ‘সড়ক-ই-আজম্’ নামে যে রাজপথটি (অধুনা গ্র্যাণ্ড ট্রাঙ্ক রোড) শেরশাহ নির্মাণ করেন, তার রেখাসূত্র অপ্রতুল নয়। বিপদসংকুল হলেও রাস্তা একটি ছিল। শের শাহ রাস্তাটির উন্নত সংস্কার করেন। সংযোগ করেন, সরাইখানা। ডাক-চৌকি চালু করেন। এসব অবশ্য মহাপ্রভুর তীর্থ পরিক্রমণের চারদশক পরের কথা। ঈশানের বিবরণ থেকে কমলাক্ষের তীর্থযাত্রা কালে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায়। এক. নীলাচলে মাধবেন্দ্রপুরীর সঙ্গে সাক্ষাৎকার। মাধবেন্দ্রর প্রশ্নের উত্তরে কমলাক্ষ জানান :

প্রভু কহে কমলাক্ষাচার্য্য মোর নাম।
ভাগীরথীতীরে শান্তিপুর ধামে গ্রাম।।

মাধবেন্দ্রকে নাম বললেন, ‘কমলাক্ষ।’ পুরীধাম থেকে যখন চলে আসছেন, তখন তাঁর নাম ‘শ্রীঅদ্বৈত।’

একদিন শ্রীঅদ্বৈত উঠিয়া প্রভাতে।
পুরীরাজে প্রণমিয়া চলিলা তুরিতে।। — অ.প্র. ৯

এরপর ‘কমলাক্ষ’ নামটি আর পাওয়া যায় না। কমলাক্ষ থেকে ‘অদ্বৈত’ নাম গ্রহণ বা প্রাপ্তিতে মাধবেন্দ্রপুরীর কোন যোগ থাকতেও পারে। দ্বিতীয়ত, মিথিলায় বিদ্যাপতির দর্শন লাভ :

তবে শ্রীঅদ্বৈতপ্রভু আইলা মিথিলায়।
সীতার জন্মস্থান দেখি ধুলায় লোটায়।।
………………………….
বটবৃক্ষ তলে দেখে এক দ্বিজরায়।
গন্ধর্বের সম কৃষ্ণগুণামৃত গায়।।
…………………………………
বিপ্র কহে মোর নাম দ্বিজ বিদ্যাপতি।’ অ.প্র.। ১০

এখানে একটি বিতর্ক উত্থাপন করেছেন বিমানবিহারী মজুমদার :

ঈশান যদি অদ্বৈতের সমসাময়িক হয়েন তবে সেই যুগের ইতিহাস-ঘটিত কোন ভুল তাঁহার হইতে পারে না। তিনি বলেন যে অদ্বৈতের সহিত বিদ্যাপতির সাক্ষাৎকার হইয়াছিল। কিন্তু অধুনা (হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ‘কীর্ত্তিলতা’র ভূমিকায়ও Journal of Letters, Vol. XVI, 1927; এবং ‘Vidyapati’ by Basanta Kumar Chattejree) সুষ্ঠুরূপে প্ৰমাণিত হইয়াছে যে বিদ্যাপতি ১৪৪৮ খ্রিষ্টাব্দের বেশী পরে জীবিত ছিলেন না। পূৰ্ব্বে দেখাইয়াছি যে ঈশানের মতানুসারে অদ্বৈত ১৪৫২-৫৩ খ্রিষ্টাব্দের পূর্ব্বে মাধবাচার্য্য-স্থানে যায়েন নাই, তাহারও পরে মিথিলায় যায়েন। বিদ্যাপতি তখন পরলোকে, তাঁহার সহিত অদ্বৈতের সাক্ষাৎকার কিরূপে হইতে পারে? বিমানবিহারী মজুমদার।৪৫৩

শ্রীশ্রীগৌড়ীয় বৈষ্ণব সাহিত্যে উল্লেখ আছে ‘শ্রী বিদ্যাপতি ঠাকুর মিথিলাবাসী ব্রাহ্মণ এবং মিথিলারই ব্রাহ্মণরাজা শিবসিংহের সভাসদ ছিলেন। মিথিলার প্রচলিত রাজপঞ্জী হিসাবে শিবসিংহ ১৩৬৮ শকে (১৪৪৬ খ্রিঃ) সিংহাসনে আরূঢ় হন। …তাঁহার মৈথিলী ভাষায় রচিত পদে জানা যায়—’অনলরন্ধ্রকর লখন নরব্বই সক্ক সমুদ্দকর আগিণি সসী।’ অর্থাৎ ২৯৩ লাহ্মনাব্দে (১৪০০ খ্রিঃ) শিবসিংহ রাজা হইয়াছেন এবং ‘বিসফী’ নামক গ্রাম কবিকে দান করিয়াছেন। ….ভূমিদানপত্র ও উহার কাল সম্বন্ধে মতদ্বৈত থাকলেও কিন্তু পূর্বোক্ত মৈথিল পদ রচনার কালানুক্রমে ২০/২৫ বৎসর পূর্বে (১৩০০ শকে কবির জন্ম স্বীকার করিতে হয়।’ শ্রীশ্রীগৌড়ীয় বৈষ্ণব সাহিত্য।।২য় পরিচ্ছেদ।পৃ ২৯

১৩০০ শক অর্থাৎ ১৩৭৮ খ্রিষ্টাব্দে জন্ম ধরলে ১৪৫২-৫৩-তে বিদ্যাপতি-অদ্বৈত মিলন অসম্ভব কখনোই নয়। বিদ্যাপতির জীবনকাল শতাধিক বৎসর। ঈশাননাগরের অদ্বৈতপ্রকাশে দুই মহাত্মার মিলনের কাল নিয়ে কোন অসংগতি আছে বলে মনে হয় না।

শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত গ্রন্থে অচ্যুতচরণ চৌধুরী তত্ত্বনিধি লিখছেন, ‘বিদ্যাপতির প্রাপ্ত, বীসপী গ্রামের দানপত্রে ২৯৩ লহ্মণাব্দ (১৪০১ খ্রিষ্টাব্দ) দৃষ্ট হয়। রাজা শিবসিংহের গৌড়রাজ্যে থাকা কালেই ইহা প্রদত্ত হইয়াছিল। বিদ্যাপতি কৃত “দুর্গাভক্তিতরঙ্গিনী” শিবসিংহের রাজত্বকালে (১৪৪৭-১৪৫১ খ্রিঃ) রচিত হয়। এই সময়ের মধ্যে অদ্বৈত মিথিলায় গিয়া থাকিবেন এবং তখন উভয়ের দেখা সাক্ষাৎ হওয়ার খুবই সম্ভাবনা। দেখাও যায় যে অদ্বৈত বিদ্যাপতির পদ গাইতে ভালবাসিতেন।’ শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত।পৃ-১৭

বসন্তকুমারের ১৯২৭-এর অনেক পরে ১৯৭৪-এ বিদগ্ধ অধ্যাপক সুবোধচন্দ্ৰ সেনগুপ্ত সম্পাদিত অভিধানে দেখছি, ‘অনুমান করা যায় এই মৈথিলী কবির জন্মকাল ১৩৭৪ খ্রিষ্টাব্দ।’ সুবলচন্দ্র মিত্র মহোদয় লিখছেন, ‘বিদ্যাপতি ১৪০০ হইতে ১৫০৬ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত সময়ে জীবিত ছিলেন এই কথা কেহ কেহ বলিয়া থাকেন। চৈতন্যদেব যখন জন্মগ্রহণ করেন তখন বিদ্যাপতি অতিশয় বৃদ্ধ হইয়াছিলেন।’ সু.মি./৯২৪। এই দুই মতকে গ্রহণ করলে ১৪৫২-৫৪ খ্রিঃ অব্দে অদ্বৈত-বিদ্যাপতি মিলন কখনোই অবান্তর নয়। তৃতীয়ত, গিরি-গোবর্ধনে (দ্বাদশ আদিত্য তীর্থে) স্বপ্ন দর্শনের পর ‘কুঠারী-কোদালী’ দিয়ে মাটি খুঁড়ে মদনমোহন মূর্তি উদ্ধার। উদ্ধৃত বিগ্রহ পরে মদনগোপাল নামে শান্তিপুরে অদ্বৈতধামে পূজিত।

তদবধি শ্রী বিগ্রহ মদনমোহন।
মদনগোপাল নামে হৈলা প্রকটন।— অ.প্র. ১৬

পঞ্চম অধ্যায়ে আমরা দেখি ‘পুরীরাজ শ্রীমন্মাধবেন্দ্র/শান্তিপুরে উদয় হইলা ভক্তিচন্দ্ৰ।’ মাধবেন্দ্র পুরী অদ্বৈতকে যুগল সাধনায় উৎসাহিত করেন :

পুরী কহে বাছা তুঁহু শুদ্ধ প্রেমবান।
শ্রীরাধিকার চিত্রপট করহ নির্মাণ।।
শ্রীকৃষ্ণ দর্শনে হয় গোপীভাবোদয়।
অতএব যুগলসেবা সর্বশ্রেষ্ঠ হয়।।—অ.প্র|২৮

ষষ্ঠ অধ্যায়ে আমরা শ্যামদাসের বিবরণ পেলাম। শ্যামদাস কাশীধামে শিবের আরাধনা করতে যান। স্বয়ং মহাদেব তাঁকে রাত্রিশেষে (স্বপ্নে) জানালেন, শিবের বর পেতে হলে শ্যামদাসকে শান্তিপুরে যেতে হবে। কারণ শান্তিপুরে দ্বিজ সর্ব্বদেশ জিনি শিবের বরে’ বাস করছেন অদ্বৈত। শ্যামদাসের কথঞ্চিৎ দ্বিধা ছিল। সেটুকু দ্বিধার নিরসন হল দৈববাণীতে :

সাক্ষাৎ হরি হর এই কমলাক্ষাচাৰ্য্য।
তেঞি ইঁহার শ্রীঅদ্বৈত নাম হৈল ধাৰ্য।।

এরপর দিব্যসিংহ রাজা আসবেন লাউড় থেকে। মহারাজ স্বয়ং অদ্বৈতচরণে দণ্ডবৎ করলেন। ‘সেই হৈতে রাজার নাম হইল কৃষ্ণদাস।’ কৃষ্ণদাস ফুল্লবাটিতে পুষ্পশোভিত বাটি নির্মাণ করেন। ফুল্লবাটি না ফুলিয়া—এ নিয়ে বিমানবিহারী মজুমদার প্রশ্ন তুলেছেন। ছন্দের কারণে অথবা ফুলের বাটি প্রকাশার্থে—যাইহোক, বৈষ্ণবসাহিত্যে গ্রামনামের প্রকারভেদ বহুবিধ বর্তমান। চৈতন্যচরিতগ্রন্থে কাটোয়া, কন্টকনগরী, কাঁটাদুপা (কাঁটাদ্বীপ), ইন্দ্ৰাণী—প্ৰায় সবকটি নামই পাওয়া যায় চরিতকথা গুলিতে। নাম মাহাত্মে স্থানমাহাত্ম ক্ষুন্ন হয় না। সপ্তম অধ্যায়ে হরিদাসের শান্তিপুর আগমনবার্তা পাই। ঈশান সুনির্দিষ্ট করে বলেছেন হরিদাসের জন্ম ‘ত্রয়োদশ শত দ্বিসপ্ততি শকমিতে।’ হরিদাস বহুস্থান ভ্রমণ করে শান্তিপুর আসেন :

ব্রহ্ম হরিদাস কহে মুঞি ম্লেচ্ছাধম।
আসিয়াছোঁ তুয়া পদ করিতে দর্শন।—অ.প্র. ২৬

ঈশানের বয়ানে হরিদাসকে

তিলক তুলসি মালা দিল পরাইয়া।
কাটিতে কৌপিন ডোর দিলেন পরাইয়া।।

ধীরে ধীরে শান্তিপুর মুখর হয়ে ওঠে। হরিদাস এলেন। অন্যান্য ভক্তাদি এলেন। রাজার মত ‘রত্ন সিংহাসনে প্রভু অদ্বৈত বসিলা।’ এলেন যদুনন্দন, কৃষ্ণদাস, হরিদাস, শ্যামদাস, নৃসিংহ, শ্রীবাস পণ্ডিত, নৃসিংহ ভাদুড়ী প্রমুখ ভক্ত ও বৈষ্ণব আচার্যগণ। সকলের দেখভালের জন্য সচেতন মনোনিবেশ বিরাজিতা অদ্বৈতগৃহিণী সীতা দেবী। সর্বতোভাবে ভূমি প্রস্তুত। এবার সেই-কলি-ত্রাতা নদীয়ানন্দন শ্রীচৈতন্যের আবির্ভাব ঘটবে। অদ্বৈত আগেই বুঝেছিলেন :

শচী গর্ভ দুগ্ধার্ণবে গৌরচন্দ্রোদয়।
বুঝিলা আচার্য শচীর শ্রীঅঙ্গ ছটায়।

দশমাস পার হয়ে গেল। প্রসব হল ন। ‘ক্রমেতে দ্বাদশ মাস অতীত হইল।’ ত্ৰয়োদশ মাসে প্রকট হলেন বিশ্বম্ভর মিশ্র :

চৌদ্দশত সাত শকের ফাল্গুনী পূর্ণিমা।
সেই দিনে রাহু আসি গ্রাসিল চন্দ্ৰমা।।
সিংহ রাশি সিংহ লগ্নে সৰ্ব্ব শুভ যোগে।
পৃথি পুলকিত হৈল কৃষ্ণ অনুরাগে।
সন্ধ্যায় চিন্ময় হরিনাম বলাইঞা।
শ্রীকৃষ্ণ প্রকট হইলা গৌরাঙ্গ হইঞা।।— অপ্ৰ. ৪৩

অদ্বৈতপ্রকাশের দশম অধ্যায় পর্যন্ত যে সকল বিবরণ ও লীলামাধুর্য আস্বাদন করি, কৃষ্ণদাসের বাল্যলীলা ছাড়া অন্যত্র অপ্রতুল। সেই অর্থে অদ্বৈতপ্রকাশ অদ্বৈতজীবনের প্রাক্-পূর্ব (জন্ম-বাল্য-কৈশোর-যৌবন) প্রকাশের দিক্-দিশারী। বিশ্বন্তর-জন্মের পর থেকে অদ্বৈতের ভূমিকার পূর্ণতর বিবরণ পাওয়া যাবে জয়ানন্দ, মুরারী, কবিকর্ণপুর, বৃন্দাবনদাস ও কৃষ্ণদাস সহ অন্যদের রচনায়। আমরা অদ্বৈতপ্রকাশের পাশাপাশি সে সকল বর্ণনাদি নিয়ে বিচার বিশ্লেষণের প্রয়াস করব এবং মহাজন চরিতের রসমাধুর্যের স্বাদ গ্রহণ করব।

অদ্বৈত নামটি মনে পড়লেই শ্বেত শ্বশ্রুগুম্ফ বহুল এক তন্ময় সাধুপুরুষের ছবি ভেসে ওঠে। গোবিন্দদাসের করচায় চমৎকার এক ছবি আছে অদ্বৈতের :

অবশেষে আইল তথি অদ্বৈত গোঁসাই।
এমন তেজস্বী মুহি কভু দেখি নাই।।
পক্ক কেশ পক্ক দাড়ী বড় মোহনিয়া।
দাড়ী পড়িয়াছে তাঁর হৃদয় ছাড়িয়া।।
হরিধ্বনি সহ বুড়া করয়ে চীৎকার।—গোবিন্দদাসের কড়চা/১৯

যেন জন্ম থেকে দাড়ি-গোঁফ নিয়ে আবির্ভূত হয়েছিলেন তিনি। উত্তরকালে গৌড়ীয় বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের মধ্যে যে পঞ্চতত্বে তৈলচিত্র কাঠ খোদাই ছবি এবং মুদ্রিত ছবি পাওয়া যায়, তাতে অদ্বৈতের শ্মশ্রুগুম্ফ ছবিই দেখতে পাই। অদ্বৈতপ্রকাশ এবং কৃষ্ণদাসের বাল্যলীলা না পড়লে আমরা অদ্বৈতের প্রাক্-প্রৌঢ় রূপাদি থেকে বঞ্চিত হতাম। বঞ্চিত হতাম কুবের পণ্ডিত-লাভাদেবীর পূর্বকথা থেকে। হট্টের-লাউড়-নবগ্রাম এবং দিব্যসিংহাদির বিবরণও পেতাম না। বৈষ্ণবজগতের এই অনুপম ত্রয়ীর একজনের পূর্বকথা অজ্ঞাতই থাকতো। বৃন্দাবনদাসের কথামত ‘নিত্যানন্দ অদ্বৈত অভেদ প্রেম জান।’ এখানেই আর একটি সূত্র দিয়েছেন বৃন্দাবনদাস। তিনি সম্যক অবগত ছিলেন, নিত্যানন্দ-অদ্বৈত নিয়ে বৈষ্ণবসমাজে বিতর্ক অপ্রতুল নয়। দুই-এর গৌরব মহিমা, অবস্থান নিয়েও কলহ ছিল। নিত্যানন্দ-অনুগামী বৃন্দাবন সূত্র দিচ্ছেন :

যে কিছু কলহলীলা দেখহ দোঁহার।
সে সব অচিন্ত্যরঙ্গ ঈশ্বর-ব্যাভার।।
………………………………………
যেন না বুঝি দোঁহার কলহ-পক্ষ ধরে। —চৈ.ভা. ১৩১

চৈতন্যের ঠিক পরেই কার অবস্থান, পাশাপাশিই বা কার অবস্থান এই নিয়ে বিতর্ক সেই কাল থেকে অদ্যাবধি চলে আসছে। কৃষ্ণদাস কবিরাজ অবশ্য অবস্থান নির্ধারণ করেই দিয়েছেন,

নিত্যানন্দ অবধূত সভাতে আগল।—চৈ.চ. ৮১

একথা অনস্বীকার্য যে শ্রীচৈতন্যলীলার প্রধান সঙ্গী ও নিত্য সহচর নিত্যানন্দ গৌড়ীয় সমাজে যে ভক্তিরস প্রচারের ঢেউ তোলেন, সর্বকালের বৈষ্ণবসমাজ তাঁর কাছে চিরকৃতজ্ঞ থাকবেন। তিনি যে চৈতন্যকীর্তন গাইতেন, শব্দ ভেদে অধুনা রূপান্তরিত ‘চৈতন্য সেব, চৈতন্য গাও, লও চৈতন্যের নাম। চৈতন্যে যে ভক্তি করে সেই মোর প্রাণ।।’চৈ.চ.। মধ্য-১। পরে বিখ্যাত প্রভাতিসঙ্গীত : ‘ভজ গৌরাঙ্গ কহ গৌরাঙ্গ…’ ইত্যাকার। একক চৈতন্যবিগ্রহ প্রথম নির্মাণ করেন বংশীবদন। কাননবিহারী গোস্বামী লিখছেন, “বিষ্ণুপ্রিয়া দেবীর প্রিয়বিরহবেদনা প্রশমনের জন্য বংশীবদন নবদ্বীপে শ্রীগৌরাঙ্গের দারুমূর্তি নিজে নির্মাণ করে প্রতিষ্ঠা করেন। শ্রীচৈতন্যের জীবৎকালে এটি প্রথম প্রকাশিত বিগ্রহ। ইনিই নবদ্বীপের ধামেশ্বর ‘আদি মহাপ্রভু’ বিগ্রহ। বিষ্ণুপ্রিয়াদেবী এই বিগ্রহেরই সেবা করতেন। ….মূর্তির পিঠে বংশীবদনের নাম উৎকীর্ণ আছে।’ কাননবিহারী গোস্বামী।। ৯

গৌরীদাসের গৌর-নিতাই বিগ্রহ নির্মাণের কথা মুরারীগুপ্তের কড়চায় পেলেও তার বিশদ বিবরণ দিয়েছেন ঈশাননাগর :

শ্রীমান গৌরীদাস শিল্পকার্যে পটুতর।
ঐছে শিল্প নাহি জানে দেবশিল্পীবর।।
সাক্ষাতে রাখিয়া তিঁহ গৌরনিত্যানন্দে।
দারুব্রহ্মে দুইমূর্তি গড়িলা আনন্দে।। —অ.প্র. ২০

নিতাই-গৌর (কীর্তনাদিতে এই ভাবেই উচ্চারিত। যথা ‘ভজ নিতাই গৌর রাধেশ্যাম/হরেকৃষ্ণ হরেরাম’) মূর্তি নির্মাণের পর ‘গৌরীদাস অদ্বৈতপ্রভুর কাছে গিয়ে যুগলবিগ্রহ প্রতিষ্ঠা কীভাবে করতে হবে, জানতে চান। অদ্বৈতাচার্যের জ্যেষ্ঠ পুত্র অচ্যুতানন্দ নিজে অভিষেক কাজটি সম্পন্ন করার জন্য পিতার কাছে অনুমতি চান।’ বাণীপ্রসন্ন মিশ্ৰ : ৮২

কীভাবে অর্চিত হবে যুগলবিগ্রহ তার নির্দিষ্ট পথ দিলেন অদ্বৈত :

হাসি সীতানাথ কহে জানিয়া না জান।
স্বয়ং কৃষ্ণ নদীয়ায় হৈলা অবতীর্ণ।।
রাধা অঙ্গ কান্তে ঢাকা সর্ব কলেবর।
যৈছে বস্ত্র আবরণে দৃশ্য রূপান্তর।।
তেঁহ গোপালের দশাক্ষরী মন্ত্র ধ্যানে।
মহাপ্রভুর পূজা হৈব কহিনু সন্ধানে।।
কৃষ্ণ-আবরণী বলি পুজিহ রাধায়।
পূজা সিদ্ধ হৈবে ইথে নাহিক সংশয়।।
নারায়ণ মন্ত্রেতে পুজিবা নিত্যানন্দ।
হইবে পূজন সিদ্ধ পাইবা আনন্দ।। অ.প্র. ২০/১১

স্বয়ং অদ্বৈত যুগলমূর্তি স্বীকৃতি তো দেনই, অৰ্চন-বিধিও নির্দিষ্ট করে দেন। উত্তরকালে দশাক্ষর-চতুরাক্ষর নিয়ে প্রচুর বিসম্বাদের সূত্রপাত হয়। যে ‘কলহ’ (বৃন্দাবনদাসের যেদিকে ইঙ্গিত) বিবাদের ঢেউ গৌড়ীয়-বৈষ্ণব সমাজকে বহু খণ্ডিত করেছে উত্তরকালে, সে প্রসঙ্গ আপাততঃ নিষ্প্রয়োজন। এই প্রসঙ্গে একটি কথা উল্লেখ করা যেতে পারে, নিত্যানন্দের দুই পত্নী বসুধা ও জাহ্নবীদেবী (মতান্তরে জাহ্নবা) গৌরীদাসের ভাইঝি। সূর্যদাসের কন্যা।

.

ঈশাননাগর অদ্বৈতপ্রকাশে অদ্বৈতচরিত অপরূপ আঁকবেন এ বিষয়ে সংশয় থাকার কথা নয়। তিনি যেমন দেখেছেন, যেমন শুনেছেন (অচ্যুত কৃষ্ণদাস শ্যামদাস প্রমুখের মুখে) তেমনই তুলে ধরতে প্রয়াসী হয়েছেন। অলৌকিকত্বের কিছু অংশ বাদ দিলে গ্রন্থটি অদ্বৈত জীবনের বহুবিধ ধারা দর্শন প্রজ্ঞা ও সহনশীলতার দিক-দিশারী সন্দেহ নেই। মানুষ দেবতা হবে, না দেবতা মানুষ—এই তত্ত্ব নিয়ে প্রচুর বিতর্কের অবকাশ আছে। জীবনচরিত যাঁরা লেখেন, তাঁরা অনেকাংশে নৈব্যক্তিক নন। মথি-যোহন-ল্যুক প্রমুখ যাঁরা যিশুর জীবনী (নিউ টেস্টামেন্ট) লিখেছেন, তাঁরা ঐশী মাহাত্মকেই বড়ো করে দেখেছেন। ‘বাবরনামা’ ‘আকবরনামা’ বাদশাহ্রদের অসীম কৃতিত্বের কথাভাস, সম্পূর্ণ ইতিহাস নয়। জীবনী যে নিরপেক্ষ হতে পারে তার প্রথম নিদর্শন বওয়েলের লেখা স্যামুয়েল জনসনের জীবনী। বাংলাভাষায় নিরপেক্ষ অবস্থান থেকে রচিত চরিতকথা বা জীবনী হিসাবে প্রশান্তকুমার পালের রবিজীবনী-র নাম মনে আসে। চৈতন্যচরিতামৃত বা চৈতন্যভাগবত কেন রবিজীবনীর মত নয় এই অর্বাচীন প্রশ্ন করার মত নির্বুদ্ধিতা প্রকাশ করছিনা। ষোড়শ শতকের ভক্তির সঙ্গে একবিংশের যুক্তির মিশ্রণও ঘটাতে চাইছি না। শুধু স্থান কাল পাত্রের সুসমজ্ঞস সম্পর্ক বিন্যাসের প্রসঙ্গ উল্লেখ করতে চাইছি। চৈতন্যদেবের মধ্য দিয়ে মধ্যযুগে যে ভক্তিআন্দোলনের ঢেউ বঙ্গদেশকে ভাসিয়ে দিয়েছিল, তা শুধুমাত্র ভক্তি আন্দোলন ছিল না। ছিল এক সমাজবিপ্লব। শুধুমাত্র ‘হরিবোল’ এই ধ্বনির (স্লোগান!) মধ্য দিয়ে লক্ষ লক্ষ আ-চণ্ডাল ভারতবাসীকে সংকীর্তনে (মিছিলে!) উপস্থিত করে যে জনমত তিনি গড়ে তুলেছিলেন, তার তুলনা বিশ্বে বিরল। সমকালীন তন্ত্র-লোকাচার-শক্তিউপাসনার নামে তামসিকতা এবং কাজির মত শাসকের প্রতিনিধিও গুটিয়ে গিয়েছিলেন এই মহান যুগস্রষ্টার কাছে।

আগেই উল্লেখ করেছি, অদ্বৈত হরি-হরের অবতার স্বরূপে মহাপ্রভুর লীলাক্ষেত্র প্রস্তুত করেন। অদ্বৈতপ্রকাশ মতে, গৌরাঙ্গ অদ্বৈতের নিকট প্রথম আসেন বিদ্যার্থী হিসাবে। যথা,

একদিন শ্রীঅদ্বৈত বেদ পঞ্চানন।
পড়াইয়াছে ছাত্রগণে বেদ দরশন।।
হেন কালে শ্রী গৌরাঙ্গ গদাধর সনে।
পড়িবার তরে আইলা আচার্য্যের স্থানে।।—অপ্ৰ. ৪৭

গৌরাঙ্গ এসেছিলেন বিদ্যানগর থেকে। গদাধর ‘আদ্য হইতে’ গৌরের ‘পাঠ বিবরণ শোনালেন আচার্য্যকে,

প্রথমে শ্রীগঙ্গাদাস পণ্ডিতের স্থানে।
দুই বর্ষ ব্যাকরণ কৈলা সমাপনে।।
দুই বর্ষে পড়িলা সাহিত্য অলঙ্কার।
তবে গেলা বিষ্ণুমিশ্রের গোচর।।
তাঁহা দুই বর্ষে স্মৃতি জ্যোতিষ পড়িলা।
সুদর্শন পণ্ডিতের স্থানে তবে গেলা।।
তাঁর স্থানে ষড়দর্শন পড়িলা দুই বর্ষে।
তবে গেলা বাসুদেব সাৰ্ব্বভৌম পাশে।।
তাঁর স্থানে তর্কশাস্ত্র পড়িলা দ্বিবৎসরে।
এবে তুয়া পাশে আইলা বেদ পড়িবারে।।—অ.প্র.-৪৮

গৌরাঙ্গ ‘১৪২৩ বা ১৪২৪ শকে অর্থাৎ ১৬/১৭ বৎসর বয়সে অদ্বৈতের নিকট পড়িতে আসিয়া ছিলেন।’ বিমানবিহারী-৪৩৮। গৌরাঙ্গ এসেছিলেন বেদ পড়তে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে :

ক্রমে গৌরের একবৰ্ষ হৈল অতিক্ৰম।
তাহে বেদ ভাগবত হইল পঠন।।

এক বৎসরে বেদ ভাগবত পড়া সমাপ্ত হল! বিস্ময়ের কারণ। ঈশান যুক্তি দিয়েছেন,

তা দেখি আশ্চর্য মানে পণ্ডিতের গণ।
আচার্য্য কহয়ে গৌরের অলৌকিক গুণ। — অ.প্র.-৫০

অদ্বৈতের নিকট পড়ার কথা অন্যান্য চরিতকথায় বিশদ পাই না। চৈতন্যভাগবতে পাই:

নবদ্বীপে আছে অধ্যাপক শিরোমণি।
গঙ্গাদাস পণ্ডিত যে হেন সান্দীপণি।।
ব্যাকরণ শাস্ত্রের একান্ত তত্ববিৎ।
তাঁর ঠাঞি পড়িতে প্রভুর সমীহিত।।—চৈ.ভা. ৩৬

এই কালে যে গৌরসুন্দর ধীময় এবং তন্নিষ্ঠ পাঠক (যথা অদ্বৈতপ্রকাশে), চৈতন্যভাগবতে তিনি অত্যন্ত দুরন্ত। তাঁর ক্রোধ সীমা ছাড়িয়ে যায়। গোপাল কিন্তু গোপগৃহে দুরন্ত হলেও ক্রোধী ছিলেন না। কিন্তু বৃন্দাবনদাসের গৌরের ক্রোধ ভয়ানক :

ঘরে মাত্র হয় দরিদ্রতার প্রকাশ।
আজ্ঞা যেন মহামহেশ্বরের বিলাস।।
কি থাকুক, না থাকুক, নাহিক বিচার।
চাহিলেই না পাইলেই রক্ষা নাহি আর।।
ঘর দ্বার ভাঙ্গিয়া ফেলেন সেই ক্ষণে।
আপনার অপচয় তাহে নাহি মানে।।
যতেক আছিল গঙ্গা-জলের কলস।
আগে সব ভাঙিলেন হই ক্রোধবশ।। চৈ.ভা-৩৯

সব ভাঙতে থাকেন গৌরাঙ্গ। তেল, ঘি, লবণ, ছোট বড় ঘট, তন্ডুল, কার্পাস, ধান, লোন, বড়ি, মুগ্ধ (মুগডাল)। বস্ত্র ছিঁড়ে ফেললেন। ঘর দ্বার ভেঙে বৃক্ষের উপর লাঠি মারতে থাকলেন। তাঁর ক্রোধ-মূর্তি দেখে শচী ভয়ে কাতর :

গৃহের উপান্তে শচী সশঙ্কিত হৈয়া।
মহাভয়ে আছেন যে হেন লুকাইয়া।।—চৈ.ভা. ৩৯

কৃষ্ণদাসের গৌরসুন্দর দুরন্ত হলেও ক্রোধী নন। তাঁর লীলায় ব্রজেন্দ্রনন্দনের দুষ্টুমির আভাস মিলতে পারে :

একদিন শচীদেবী পুত্রেরে ভৎসিয়া।
ধরিবারে গেলা পুত্র গেলা পলাইয়া।।
উচ্ছিষ্ট গর্তেতে ত্যক্ত হাতীর উপর।
বসিয়াছেন সুখে প্রভু দেব বিশ্বম্ভর।। – চৈ.চ. ১২২

কৃষ্ণদাসও বলছেন গৌরের পড়ার সূত্রপাত প্রথমে পিতার কাছে :

কতদিনে মিশ্র পুত্রে হাতে খড়ি দিল।
অল্প দিনে দ্বাদশ ফলা অক্ষর শিথিল।।

এরপর একটু বয়স বাড়লে

গঙ্গাদাস পণ্ডিত স্থানে পড়ে ব্যকরণ।
শ্রুতমাত্রে কন্ঠে কৈল সূত্র বৃত্তিগণ।।—চৈ.চ. ১২৩

অদ্বৈতপ্রকাশে গৌর বেদাভ্যাসের জন্য অদ্বৈতগৃহে আসেন। চৈতন্যভাগবতে গৌর-অদ্বৈত মিলন অনেক পরে। সম্ভবতঃ শ্রীহট্টের লোকজনদের প্রতি গৌরের বিশেষ আগ্রহ ছিল না। এমন একদিনের কথা আছে আদিখণ্ডে। বিদ্যা-রস-ক্রীড়া করে বসে ছিলেন। ক্রমে শিষ্যগণ এলেন। একজনের কপালে তিলক না দেখে তিরস্কার করে বললেন, কপালে তিলক না থাকলে তাকে শ্মশান সদৃশ বেদে বলে। ‘এতেক’ ঔদ্ধত্য প্রভু করেন কৌতুকে।’ আর শ্রীহট্টের লোক দেখলে ব্যঙ্গ করেন :

বিশেষ চালেন প্রভু দেখি শ্রীহট্টিয়া।
কদর্থেন সেই মত বচন বলিয়া।।
ক্রোধে শ্রীহট্টিয়াগণ বোলে “হায় হায়।
তুমি কোন দেশী তাহা কহ ত’ নিশ্চয়।।
পিতামাতা আদি করি যতেক তোমার
বল দেখি শ্রীহট্টে না জন্ম হয় কার।।—চৈ.ভা. আদি। ৭৩

এ হেন শ্রীহট্টিয়া অদ্বৈতের সঙ্গে গৌরসুন্দরের মিলন বৃন্দাবনদাসের মধ্যখণ্ডের ষষ্ঠ অধ্যায়ে। সিলেটি ভাষা অদ্যাপি তথাকথিত ‘মান্য বাংলা উচ্চারণ’ এর কাছে কিঞ্চিত দুর্বোধ্য।

প্রসঙ্গত ষোড়শ-সপ্তদশ শতকে নবদ্বীপের বাংলাকেই মান্য বাংলা বলে ধরা হত। কলকাতা অনেক পরে। বৃন্দাবন দাসের জন্ম (১৫০৭) নবদ্বীপে। তাঁর গুরু নিত্যানন্দ বীরভূমের। কৃষ্ণদাস কবিরাজ (১৫৩০-১৬১৫)-এর জন্ম বর্ধমান জেলায়। চৈতন্যচরিতের উপাদান গ্রন্থের রচয়িতা বিমানবিহারী মজুমদারের নদীয়া জেলায় কুমারখালি (৭ জানুয়ারি, ১৯০০)। মাধ্যমিক স্তরের পড়াশোনা নবদ্বীপ হিন্দু স্কুল। নবদ্বীপ অথবা বীরভূম-বর্ধমান-এর উচ্চারণের তারতম্য আছে। ঈশানের রচনার নানা স্থানে ‘তান’ (তাইন), ‘অইমু’ ইত্যাকার শব্দ পাই। পূর্ববঙ্গীয় মহাজন ও বুধমগুলি সচরাচর রাঢ় বা দক্ষিণবঙ্গে এলে দীর্ঘদিন বসবাস করলেও উচ্চারণ রীতি ত্যাগ করেন না। সম্ভবত: অদ্বৈতও ত্যাগ করেননি। অদ্বৈতের উচ্চারণ নিয়ে গৌর ব্যঙ্গ না করলেও প্রথমদিকে সম্পর্কে অম্লমধুরতা বিরাজিত। রামাই

পণ্ডিতকে দিয়ে তাঁর আগমনবার্তা পাঠিয়ে অদ্বৈতকে আসতে বলেন গৌর।

চলহ রামাঞি! তুমি অদ্বৈতের বাস।
তাঁর স্থানে কহ গিয়া আমার প্রকাশ।।…

রামাই গিয়ে বিশ্বম্ভরের আবির্ভাব বার্তা জানিয়ে পূজার সাজ নিয়ে তাঁর সমীপে যেতে বললেন অদ্বৈতকে। অদ্বৈত রামাই-কে একটু বাজিয়ে দেখলেন। যেতে বললেই যেতে হবে!

কোথায় গোসাঞি আইলা মানুষ ভিতরে।
কোন শাস্ত্র বোলে নদীয়ায় অবতরে।।
মোর ভক্তি অধ্যাত্ম বৈরাগ্য জ্ঞান মোর।
সকল জানয়ে শ্রীনিবাস—ভাই তোর।।—চৈ.ভা., ১২৮

রামাই বললেন (গৌরের কথার পুনরাবৃত্তি করে), যার জন্য এত সাধনা করেছ, আরাধন করেছ, ক্রন্দন করেছ—সেই তাঁর আগমন ঘটেছে। অদ্বৈত বুঝলেন। বুঝে একটি মারাত্মক অস্ত্র ছাড়লেন, কী ভাবে বোঝা যাবে তিনিই সেই—যিনি আমার সাধনার ধন!

আপন ঐশ্বর্য যদি মোহরে দেখায়।
শ্রীচরণ তুলি দেয় আমার মাথায়।।
তবে সে জানিমু মোর হয় মোর প্রাণনাথ
সত্য সত্য সত্য এই কহিলঁ তোমাত।।—চৈ.ভা. ১২৮

অবতার ও অবতারী-তত্ত্ব জটিল অথচ মধুময়। নারিকেলের মত। বহিরঙ্গে শক্ত খোলা। অন্তরঙ্গে জল। গৌর-স্থানে অদ্বৈত গেলেন। শ্রীগোবিন্দমন্ত্রে গৌরকে বন্দনা করলেন, ‘নমো

ব্রহ্মন্যদেবায় গো-ব্রাহ্মণ হিতায় চ’-ইত্যাকার। বৃন্দাবনদাস লিখছেন,

কোটি বৃহস্পতি জিনি অদ্বৈতের বুদ্ধি।
ভালমতে জানে যেই চৈতন্যের শুদ্ধি।।
বর্ণিতে চরণ—ভাসে নয়নের জলে।
পড়িলা দীঘল হই চরণের তলে।।
সৰ্ব্বভূত-অন্তৰ্য্যামী শ্রী গৌরাঙ্গ রায়।
চরণ তুলিয়া দিলা অদ্বৈত মাথায়।।—চৈ.ভা. ১৩১

কৃষ্ণদাস কবিরাজের বিবরণে এই ‘চরণ তুলিয়া’ দেবার উল্লেখ পাই না। লীলাপ্রকাশের নানা ক্ষেত্রে কৃষ্ণদাস যেখানে বৃন্দাবন দাসের প্রতিধ্বনি করছেন, তিনি উপরিউক্ত রচনায় বিরত থাকলেন কেন জানিনা। বরং মহিমান্বিত রূপে বর্ণনা করলেন তাঁকে।

মহাবিষ্ণুর্জগতকৰ্ত্তা মায়য়া য: সৃজত্যদঃ।
তস্যাবতার এবায়মদ্বৈতাচার্য ঈশ্বর।।—চৈ.চ.।১।১২।২১

আরও বলা হল :

অদ্বৈতং হরিণাদ্বৈতাচার্য্যাং ভক্তিশংসনাৎ।
ভক্তাবতারমীশত্তমদ্বৈতাচার্য্যমাশ্রয়ে।।—তদেব

কৃষ্ণদাসের অদ্বৈত-বর্ণনের চুম্বক :

আচার্য গোসাঞি প্রভুর ভক্ত অবতার।
কৃষ্ণ অবতার হেতু যাঁহার হুঙ্কার।।—চৈ.চ. ৪৬

মহাবিষ্ণুর অংশ অদ্বৈত গুণধাম।
ঈশ্বরের অভেদ হৈতে অদ্বৈত পূর্ণ নাম।।—চৈ.চ.। ৮০

কবি কর্ণপুর, মুরারীগুপ্ত, বৃন্দাবনদাস, লোচনদাস, কৃষ্ণদাস কবিরাজ সহ জীবনীকারগণ চৈতন্য-অদ্বৈত সাক্ষাৎকারের প্রথম সাক্ষাৎকারের যে বিবরণ দিয়েছেন তা সহমত্যে নয়। হওয়া সম্ভবও নয়। বৃন্দাবনদাসের মত প্রথম দর্শনে অদ্বৈতের মাথায় চরণ তুলে দেওয়া অন্যত্র পাই না। সন্ন্যাসের পর চৈতন্য-চরণ বন্দিত হচ্ছে, এ বিবরণ প্রভুত। বিশেষত, বিশ্বম্ভর যদি অদ্বৈতের কাছে বেদ-ভাগবত পড়ে থাকেন, যতই দুরন্ত হোন, যৌবনে জ্ঞানের প্রাখর্যে অহংকারী হোন, প্রবীনের মাথায় চরণ তুলে দেবার মত কাজ করবেন বলে মনে হয় না।

অবশ্য মাদৃশ শাস্ত্রজ্ঞানে অজ্ঞ অভাজনের পক্ষে লীলামাহাত্ম অনুধাবণ করা প্রায় অসম্ভব। ঈশানের মতে, বিশ্বম্ভর-অদ্বৈত মিলন অনেক আগে। শচী-জগন্নাথকে আগেই চিনতেন অদ্বৈত। বাল্যে বিশ্বম্ভরকে পড়িয়েছেন। এই যুক্তি অসম্ভব নয়। নদিয়ার শ্রেষ্ঠ জ্যোতিষশাস্ত্রবিদ, ‘জ্যোতিষশাস্ত্রেতে তিনি সাক্ষাৎ গর্গমূর্তি’, সেই নীলাম্বর চক্রবর্তী শচীর জনক। নীলাম্বরের অনুমতি ব্যতিরেকে জগন্নাথ-গৃহে কোন সিদ্ধান্তই গৃহিত হওয়া সম্ভব নয়। নীলাম্বর জানতেন, তাঁর এক দৌহিত্র গৃহত্যাগী। অন্যটিকে লেখাপড়া শেখানোর জন্য যত্নবান হতে গেলে অদ্বৈতকে বাদ দেওয়া যায় না। নদিয়া-শান্তিপুরের দূরত্ব ত্রিশ কিলোমিটারের মত। তাছাড়া সেখানে ‘বেদপঞ্চানন’ অদ্বৈতের নাম বঙ্গ ছাড়িয়ে ভারতের নানা প্রদেশে কস্তুরিবৎ। অদ্বৈত অবশ্য জন্মের পরেই বিশ্বম্ভর-দর্শনের ভাগ্যলাভ করেন। ‘শ্রীনন্দনন্দন শ্রীরাধার ভাব কান্তি করিয়া গ্রহণ’ চোদ্দশত সাত শকের ফাল্গুনি পূর্ণিমায় অবতীর্ণ হলেন। সেদিন দোল পূর্ণিমা। চন্দ্রগ্রহণ ছিল। জন্মের পর গৌরাঙ্গ দুগ্ধপান করেননি। চোখ বোজা। দুখ খাচ্ছেন না নবজাতক। শচী-জগন্নাথ এই দৃশ্য দেখে ‘মহাদুঃখী হৈলা।’

হেনকালে মোর প্রভু আচার্য্য গোসাঞি। নিজ প্রভু দেখিবারে আইলা সেই ঠাঞি।।

প্রভুরে দেখিয়া মিশ্র দণ্ডবৎ কৈলা।
শোকের কারণ প্রভু তাহানে পুছিলা।। — অ.প্র. । ৪৩

বৃন্দাবন দাসের বিপরীত বর্ণনা পেলাম। জগন্নাথ মিশ্র অদ্বৈতকে গৃহে নিয়ে গেলেন এবং প্রণিপাত করলেন। যে শিশু জন্মের পর দুধ খান নি, চোখ বন্ধ করে ছিলেন অদ্বৈতকে দেখে সেই শিশু

প্রেমে ডগমগ অঙ্গ অদ্বৈত দেখিয়া।
গৌররূপী শ্রীগোবিন্দ উঠিল হাসিয়া।। অ.প্র.।৪৩

গৌর তখন সদ্যোজাত। অদ্বৈত বাহান্ন। শিশু-নারায়ণের উদ্দেশে ‘শ্রীঅদ্বৈতের বাহ্যস্ফুৰ্তি হৈল’ :

দণ্ডবৎ করি করপুটে নিবেদিল।
অহে বিভু আজি দ্বিপঞ্চাশ বৰ্ষ হৈল।।
তুয়া লাগি ধরাধামে এ দাস আইল।। অ.প্র. ৪৩

লোচনদাসের চৈতন্যমঙ্গলে শচীর গর্ভাবস্থায় শান্তিপুর থেকে নবদ্বীপ আগমনের বিবরণে আছে। এছাড়া গর্ভবন্দনারও বিবরণ দেওয়া হয়েছে।

অদ্বৈতপ্রকাশের বিবরণ আরও বিশদ এবং গূঢ়। তেমন, গৌরসুন্দরকে অদ্বৈত প্ৰশ্ন করেন :

শ্রী অদ্বৈত কহে যদি আইলা ভুবনে।
কৈছে দুগ্ধ নাহি খাও কহ মোর স্থানে।।

গৌর বললেন অদ্বৈত-রূপী মহাদেবকে :

মহাপ্রভু কহেন শুনহ পঞ্চানন।
অনুরূপে মাতি বিধি হৈলা বিস্মরণ।।
মন্ত্র প্রদানের আগে হরিনাম দিবে।
কর্ণবুদ্ধি হয় সিদ্ধ নামের প্রভাবে।।

গৌর জানিয়ে দিলেন, তাঁর মাতা ‘দীক্ষা হৈলা না শুনিলা হরিনাম।’ অতএব তাঁর দুগ্ধপানে অনীহা। তখন

শচীরে বোলাঞা প্রভু হরিনাম দিলা।
পূর্বদত্ত মন্ত্র পুন স্মৃতি করাইলা।। অ.প্র.।৪৩

এখানে ‘মন্ত্র’ নিয়ে কিছু জিজ্ঞাসা থেকে যায়। প্রশ্ন হল, কোন মন্ত্র? বিমানবিহারী ‘মন্ত্রে’র বিষয়ে কিছু প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন :

অদ্বৈত শচী ও জগন্নাথকে মন্ত্র দেন। সেই মন্ত্র হইতেছে ‘চতুরক্ষর
গৌর-গোপাল-মহামন্ত্র’। শচীর দীক্ষার পর বিশ্বরূপের জন্ম হয়।

(১০ অ. পৃ. ৪১)।

শচী দীক্ষা গ্রহণ করিলেন বটে, কিন্তু হরিনাম লইলেন না, তাই নিমাই
জন্মিয়া তাঁহার স্তন্য পান করিলেন না। (১০ অ.পৃ. ৪৩)।

‘কোন ভারতী নাকি বিশ্বম্ভরকে যজ্ঞসূত্র দেন এবং জগন্নাথ মিশ্র নাকি তাঁহাকে বিষ্ণুমন্ত্র দেন।’

কালে তানে ভারতী দিলেন যজ্ঞসূত্র।
শাস্ত্রমতে মিশ্ররাজ দিলা বিষ্ণুমন্ত্র। পৃ. ৪৫

তাহা হইলে গয়ায় ঈশ্বর পুরীর নিকট দীক্ষা লওয়ার পূর্ব্বে শ্রীচৈতন্যের আর একবার দীক্ষা হইয়াছিল।

পঞ্চবর্ষবয়স্ক শিশু কৃষ্ণ মিশ্র একদিন মাকে না বলিয়া ‘গৌরায় নমঃ’ মহামন্ত্র উচ্চারণ-পূর্ব্বক কলা খাইয়াছিলেন। সে দিন গৌরাঙ্গ আর ভাত খান নাই

এত কহি তিহোঁ এক ছাড়িলা উদ্ধার।
রম্ভার গন্ধ পাঞা সভে হৈল চমৎকার।। – অ.প্র./৪৯

গৌরমন্ত্রোদ্ধার নিয়ে অদ্যাবধি বিতর্কের অবসান হয় নাই। মত, মতান্তরকে ঘিরে বহুবিধ মনান্তরও হয়েছে। শ্রীমদ্ গোবিন্দদেব কবি শ্রীগৌরকৃষ্ণোদয়-এ এই বিতর্কের একটি সম্ভাব্য সমাধানসূত্র দেবার চেষ্টা করেছিলেন। শিবানন্দ সেনের ইষ্টমন্ত্র বিষয়ক সন্দেহ-নিরসনে নকুল ব্রহ্মচারীর আবেশে উক্ত…..

‘তোমাকে যে চতুরক্ষর গৌরমন্ত্র দেওয়া হইয়াছে, ঐ মন্ত্রই স্মরণীয়, কীর্তনীয় ও জপ্য, ইহাতেই সবার্থসিদ্ধি হয়, তাহাতে আর পূর্বকালীন (অন্য বিষয়ে) শুশ্রূষা (শ্রবণেচ্ছা) বা দেশকালাদির অপেক্ষা নাই।২৬।। সর্বকামী যোগীন্দ্রগণ যে নিত্য পুজোপযোগী মন্ত্রদ্বারা আমার সেবা করে, সেই মন্ত্র কিন্তু অন্য প্রকার। এই যুগে সকল মন্ত্রই সত্ত্বহীন, (প্রাণশূন্য) কিন্তু তোমাদের যে মন্ত্র, সে মন্ত্র ঐরূপ নহে।২৭।। ‘দশাক্ষর’ গৌরমন্দ্রোদ্ধার’-

ঙেহন্তং গৌরং পিণ্ডবীজাবসানে তদ্বৎ কৃষ্ণং মন্মথান্তে নিযোজ্য।
হার্দান্তশ্চে সর্ববর্ণৈরূপাস্য মুর্দ্ধান্তোহয়ং সোপবীতৈ দশার্ন।।

…তারপরে আবার ‘গৌরগায়ত্রী’ বলিতেছেন (রহস্যভেদে তাহার অনুবাদ দিলাম না)।

মন্নামেত্ত্বা বিদ্মহেহন্তং সতুর্য্যং ধীমহ্যন্তং ঙেহন্তং বিশ্বম্ভরঞ্চ
তন্নো গৌর: প্রাদিচোহত্রিমরুচ্চাৎ গায়ত্রেষা গণতস্ত্রাণকর্ত্রী।

গৌড়ীয় বৈষ্ণব সাহিত্য।। পৃ. ২/৯৪

গৌরগোপালমন্ত্র, গৌরমন্ত্র, গৌরগায়ত্রী, দশাক্ষর, চতুরক্ষর ইত্যাদি নিয়ে নানা সময় অজস্র বিতর্কের সুত্রপাত ঘটেছে। এই প্রসঙ্গে অদ্বৈত বংশের গোস্বামীগণ মন্ত্রবিষয়ক একটি নির্দেশিকা প্রকাশ করেন। যথা-

দশাক্ষর-গোপালমন্ত্রেণৈব

শ্রীকৃষ্ণ-চৈতন্য-দেবস্যোপাসনা বিধেয়া না্যান্যেনেতি। চৈতন্যভাগবততাদৌ শ্রীমদদ্বৈতাচাৰ্য্য-পাদানাং তথৈব তদৰ্চ্চন-দর্শনাৎ। চরিতামৃতাদাবাচার্য্যমন্যথাকৃত্য প্ৰবৰ্ত্তমানানাং পাষণ্ডিত্ব-শ্রবণাচ্চ। যস্যোপাসনয়া বশীকৃতো ভগবান্ শ্রীকৃষ্ণচৈতন্যদেবঃ কলাবপ্যবতীর্ণ: শ্রীসীতানাথ এব তৎপ্রীতি সম্পাদকোপাদানানামভিজ্ঞো নান্য:। বিশেষতঃ শ্রীমহাপ্রভুপাদানাং দশাক্ষরবিদ্যায়াং প্রীত্যতিশয়ো লক্ষ্যতে, পরমাগ্রহপূর্ব্বকং শ্রীমদীশ্বর-পুরী-মহানুভাবতো লোকশিক্ষার্থং তয়ৈব দীক্ষিতত্বাৎ। চৈতন্যমত বোধিনী পত্রিকা।। জ্যৈষ্ঠ ১/৬/১২৩

কৃষ্ণদাস সম্বন্ধে ‘গৌরনামের’ উল্লেখ আছে, তার বর্ণনা প্রসঙ্গত: উল্লেখ্য। গৌরাঙ্গ বেদাভ্যাসের জন্য অদ্বৈতগৃহে থাকতেন। সীতা ও সীতানাথের অত্যন্ত প্রিয় এই ছাত্র। ‘জগন্মাতা সীতা যাঁর গৌরগত প্রাণ।’ তিনি জানতেন :

গৌরাঙ্গের প্রিয়বস্তু নাম চাঁপাকলা।
ঐচে ভুজ্ঞাইতে তেঁহো লুকাঞা রাখিলা।।

অদ্বৈতের দ্বিতীয় পুত্র শিশু কৃষ্ণদাস আর পাঁচজন শিশুর মতই ‘ফিরে খাদ্য অন্বেষিয়া। সীতাদেবী গৃহে ছিলেন না। গঙ্গাস্নানে গিয়েছিলেন। কৃষ্ণদাস বালখিল্য চপলতায় ভাবলেন, চাঁপাকলা আত্মস্থ করতে হবে। দৈব অপরাধের ভয়ও আছে। পৈটিক তাড়নাও আছে। রসনারূপ বাসনার জয় হল। (চার শতক পরে বঙ্গের কবি লিখবেন ‘জেনো বাসনার সেরা বাসা রসনায়’।) কৃষ্ণদাস তাই করলেন,

গৌরে ভুঞ্জাইতে কলা মায়ের আছে সাধ।
মুঞি যদি খাঙ তবে দৈব অপরাধ।।
পুন ভাবে নিবেদিয়া করিব ভক্ষণ।
গৌরাঙ্গ প্রসাদ হৈলে নাহিক দূষণ।।
আগে প্রণব মহামন্ত্র করি উচ্চারণ।
গৌরায় নম: বলি কৈলা নিবেদন।।
মহাপ্রসাদ জ্ঞানে কলা শিরে ছুয়াইয়া।
ভোজন করিলা শিশু আনন্দিত হঞা।— অপ্ৰ. ৪৯

এই “গৌরায় নম:” নিয়ে কিছু প্রাসঙ্গিত প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে। ঈশানের অদ্বৈতপ্রকাশে-ই এই সংশয়ের অবসান করা হয়েছে। কৃষ্ণদাসের শিশুসুলভ উত্তরে সীতা খুশি না হয়ে ‘ষষ্ঠিহাতে শিশুর পিছে চলিলা ধাইয়া।’ অদ্বৈতের সমীপে সব বিবরণ নিবেদিত হল। অদ্বৈত জানতে চাইলেন, ‘কৃষ্ণমিশ্র, কি দোষ করিলা।’ কৃষ্ণমিশ্র জানালেন, ‘গৌরে নিবেদিয়া খাইনু দোষ নহে জানি।’ শিশু জানায় সপ্রণব ‘গৌরায় নম:’ বলে খেয়েছেন। সমাধান সূত্র নিম্নরূপ :

প্রভু কহে গৌরায় স্থলে কৃষ্ণায় কহা যুক্ত।
শিশু কহে গৌর নামে কৃষ্ণনাম ভুক্ত।—অপ্ৰ. ৪৯

গৌরাঙ্গসুন্দর পরে বললেন, তাঁর খিদে নেই। তাঁর খাওয়া হয়ে গেছে।

গৌর কহে নিদ্রায় কেবা কলা খাওয়াইলা।।
এত কহি তিহোঁ এক ছাড়িলা উদগার।
রম্ভার গন্ধ পাঞা সভে হৈলা চমৎকার।।

‘গৌরায় নম:’ বলার পর কৃষ্ণদাসকে অদ্বৈত যতই ‘গৌরাঙ্গ স্থলে কৃষ্ণায় কহা যুক্ত’ বলুন, তর্কের নিরসন হয় না। বরং ‘অদ্বৈতপ্রকাশে যে সুকৌশলে গৌরমন্ত্র প্রচারের ব্যবস্থা করা হইয়াছে সে বিষয়ে সন্দেহ নাই’ (বিমানবিহারী মজুমদার/৪৬৪)

যতই শিবানন্দ সেন-এর চতুরাক্ষর বালগোপাল মন্ত্রে দীক্ষার কথা উঠুক, হেমাভ শব্দ থাকাতে গৌরগোপাল মন্ত্র হিসাবে অভিহিত করার কথা বলা হোক, বিতর্কের উপশন হয় না। গৌরমন্ত্র নিয়ে বিবাদ বিসম্বাদ শুধু অদ্বৈত-ঈশানের ক্ষেত্রে প্রযুক্ত নয়। দীর্ঘদিন ধরে এই বিতর্ক বলবৎ। এই বিতর্কে ঘৃতাহুতি দিতে কোন পক্ষকেই ‘তৃণাদপি সুনীচেন’ বা ‘তরোরিব সহিষ্ণু’ হতে দেখা যায় না। বিমানবিহারী মজুমদারের একটি অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরা যেতে পারে :

গৌরমন্ত্র নরহরি সরকার ঠাকুরের সময় হইতে চলিয়া আসিতেছে বলিয়া অনেকের বিশ্বাস। শ্রীখণ্ডের ঠাকুরেরা আমাকে বলিয়াছেন যে তাঁহারা বংশানুক্রমে গৌরমন্ত্র দিয়া আসিতেছেন। কিন্তু শ্রীগৌরাঙ্গের স্বতন্ত্র মন্ত্রের অস্তিত্ব কোন দিনই সকল শ্রেণীর লোকের দ্বারা স্বীকৃত হয় নাই। ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ হইতে আরম্ভ করিয়া ১৫/২০ বৎসর পূর্ব্ব পৰ্য্যন্ত গৌরমন্ত্রের স্বাতন্ত্র্য লইয়া ভীষণ দলাদলি চলিয়াছিল। আমি যখন ফোর্থ কি থার্ড ক্লাসে পড়ি, অর্থাৎ ১৯১৩/১৪ খৃষ্টাব্দে, তখন নবদ্বীপের বড় আখড়ার নাটমন্দিরে গৌরমন্ত্র-বিচারের একটি সভায় উপস্থিত ছিলাম, মনে পড়ে। বৃন্দাবন, পুরী, কালনা প্রভৃতি স্থান হইতে বড় বড় বৈষ্ণব পণ্ডিত সেই সভায় উপস্থিত হইয়াছিলেন। স্বদেশী সভায় লাঠালাঠি হয় পরে দেখিয়াছি, কিন্তু বৈষ্ণব সভায় লাঠি চলিতে সেই প্রথম দেখি। সভা আধ ঘন্টার মধ্যেই ভাঙ্গিয়া যায়। পরদিন “সোনার গৌরাঙ্গের” বাড়ীতে কয়েকজন পণ্ডিত মিলিয়া কি এক সিদ্ধান্ত করিয়াছিলেন, মনে নাই।—বিমানবিহারী/পৃ. ৪৫১

অদ্বৈতপ্রকাশে চৈতন্য-অদ্বৈতের (লীলাচ্ছলেও) মতানৈক্য পাই না। সেখানে অদ্বৈত সর্বদা গৌরগত প্রাণ। চৈতন্যভাগবতের মধ্যখণ্ডে পাই, চৈতন্য বলছেন :

ক্রোধমুখে বোলে প্রভু “আরে আরে নাঢ়া।
বোল দেখি জ্ঞান-ভক্তি দুইকে কে বাঢ়া?”
অদ্বৈত বোলয়ে “সৰ্ব্ব-কাল বড় জ্ঞান।
যার জ্ঞান নাহি তার ভক্তিতে কি কাম।।”
‘জ্ঞান বড়’ অদ্বৈতের শুনিয়া বচন।
ক্রোধে বাক্য পাসরিল শ্রীশচীনন্দন।।
পিঁড়া হৈতে অদ্বৈতরে ধরিয়া আনিয়া।
স্বহস্তে কিলায় প্রভু উঠানে পারিয়া।।—চৈ.ভা. পৃ. ১৯৮

চৈতন্যচরিতামৃতে মধ্যলীলা খণ্ডে চৈতন্য-অদ্বৈতের লীলাচ্ছলে মধুর মতানৈক্য অন্যভাবে প্রকাশিত :

প্রভু কহে সন্ন্যাসীর ভক্ষ্য নহে উপকরণ।
ইহা খেলে কৈছে হবে ইন্দ্রিয়বারণ।।
আচার্য কহে ছাড় তুমি আপনা চাতুরী।
আমি জানি তোমা সন্ন্যাসের ভারিভুরি।।
আচার্য কহে নীলাচলে খাও চৌয়ান্নবার।
একবার অন্ন খাও শত শত ভার।।—চৈ.চ. পৃ, ১৭৩

অর্থাৎ নীলাচলে চৈতন্য চুয়ান্নবার প্রচুর পরিমাণে আহার গ্রহণ করেন। অদ্বৈত চৈতন্যকে স্বয়ং জগন্নাথ বললেন। জগন্নাথের চুয়ান্নভোগের প্রতি ইঙ্গিত করা হল। দাস্যভাব থেকে মাধুর্যে অনুপম উত্তরণ। চৈতন্যভাগবতেও মধ্যখণ্ডে মহাপ্রভুর ‘দিব্য অন্ন ঘৃত দুগ্ধ পায়স’ খাওয়ার সংক্ষিপ্ত বিবরণ আছে। কৃষ্ণদাস কবিরাজের ভোজনপর্ব বেশ দীর্ঘ ও সুবিন্যস্ত। অদ্বৈতপ্রকাশে আহার-পর্বটি অতিশয় সংক্ষিপ্ত :

সীতামাতা পাক কৈলা অমৃত নিছিয়া।
তিন ঠাকুর সেবা কৈলা ভক্তগণ লৈয়া।।—অ.প্ৰঃ ৬৬

পূর্বোক্ত দুই জীবনীতে অবধৌতের ভাত ছিটানোর বিবরণ থাকলেও অদ্বৈতপ্রকাশে নাই। নিত্যানন্দের ছিটানো ভাত অদ্বৈতের গায়ে লাগালে কিঞ্চিৎ কথান্তর হয়। পরে মিলন।

নত্যানন্দ অদ্বৈত হৈল কোলাকোলি।
প্রেমরসে দুই প্রভু মহাকুতুহলি।।
প্রভু বিগ্রহের দুই বাহু দুই জন।
প্রীত বই অপ্রীত নাহিক কোনক্ষণ।।
তবে যে কলহ দেখ সে কৃষ্ণের লীলা।
বালকের প্রায় বিষ্ণু বৈষ্ণবের খেলা।।—চৈ.ভা.-২০১

বৃন্দাবন দাস বারবার বলছেন দুজনের ‘অপ্রীত নাই’, ‘কলহ নাই’। যদি বিবাদ নাই থাকে, উত্থাপন কেন?

.

অদ্বৈতপ্রকাশে অষ্টাদশ অধ্যায়ে বিশেষ কিছু ঘটনার কথা উল্লেখিত হয়েছে যার অনুপম মাধুর্য শতধা বিস্তৃত। অন্যান্য চরিতগ্রন্থে অংশ বিশেষ থাকলেও দু-একটি বিবরণ একান্তভাবে অদ্বৈতপ্রকাশে বর্ণিত। দীর্ঘদিন চৈতন্য অদর্শনে ব্যাকুল সীতাদেবী আকুল বাৎসল্যভাবে অদ্বৈতকে বললেন,

কতদিন গেল নাহি দেখি গোরাচাঁদে।
নিরবধি তার লাগি মন প্রাণ কাঁদে।
…………………………………….
কবে প্রিয়তম বস্তু গৌরে সমর্পিয়া।
জুড়াইমু গৌর বিচ্ছেদ দাবদগ্ধ হিয়া।। -অ.প্র.১৮/৭৮

ভক্তের মনোবাঞ্চা ভগবানের অগোচর থাকে না। সীতা ও সীতানাথ তীব্র গৌর-বিরহ থেকে মুক্তি পাওয়ার উপায় এসে গেল।

হেনকালে এক বৈষ্ণব প্রভু নমস্কারি।
সেন শিবানন্দ বার্তা কহয়ে ফুকরি।।’
………………………………………..
রথযাত্রা উপলক্ষে শ্রীপুরুষোত্তমে।
তিনি সব তলিবেন লই গৌরগণে।।

সকল গৌর-গণের মহামিলনের মহাসুযোগ এসে গেল। ঈশানেরও যাবার সুযোগ এলো। মহার্ঘ এই সুযোগ ছাড়ার প্রশ্নই ওঠে না।

শ্রীগুরু বৈষ্ণব কৃপায় মুঞি নরাধম।
সেই সঙ্গে ভৃত্যকার্যে করিনু গমন।।

যাওয়া হল। মিলন হল, কীর্তনাদি হল কিন্তু সীতাদেবীর ইচ্ছা অধরা রয়ে গেল। ‘মনোমত শ্রীগৌরাঙ্গে নারি খাওয়াইতে।’ গৌর যেখানেই যান ‘বহুত সন্ন্যাসী তার সঙ্গে সদা ফিরে।’ খাদ্যদ্রব্য পেলেই ‘সব দ্রব্য খাওয়ায় গোরা সন্ন্যাসীরে দিয়া।’ বাৎসল্যের অনুপম প্রকাশ। সীতার একান্ত বাসনা, গৌরকে একা খাওয়াবেন, ‘একা গৌড়ে পাঙ যদি যায় মনোব্যথা।’ সে সুযোগ এসে গেল এক বর্ষণক্লান্ত দিনে। চৈতন্য স্বয়ং উপস্থিত হলেন সীতানাথের বাসায়, ‘একলে আসিলা অদ্বৈতের বাসা ঘরে।’ সীতা পরম যত্নে ‘তাঁর সেবা লাগি বহু আয়োজন কৈলা।’

মহাপ্রভুকে কাছে পেয়ে ঈশানও ব্যাকুল। গৌরের শ্রীপাদপদ্মে সহস্তে পরিমার্জনের জন্য তাঁর হৃদয় মথিত হল। ‘গৌরের পাদ ধৌত লাগি মুঞি কীট গেনু।’ চৈতন্য বিব্রত হলেন। তিনি সন্ন্যাসী। তৎক্ষণাৎ বলে উঠলেন, ‘রহ রহ বিপ্র বিষ্ণু-তনু।’ ঈশান ব্রাহ্মণ। তিনি ভাবলেন, শুধুমাত্র ব্রাহ্মণত্বের কারণে বিরিঞ্চি-বাঞ্চিত এই চরণযুগলের সেবা থেকে বঞ্চিত হবেন!

মুঞি কহি হায় হায় কি মোর দুর্ভাগ্য।
শ্রীগৌরাঙ্গ পদ সেবায় হইনু অযোগ্য।।
পুনঃ কহি অনন্তাদ্যের সেব্য যে চরণ।
তাহা মোর প্রাপ্তি শিশুর চন্দ্র-স্পর্শ সম।।

ঈশান বৈষ্ণব ভাবানুরাগে বিচার করলেন, গৌর-চরণ আর ব্রাহ্মণত্ব—দুই-এর মাঝে বেড়াস্বরূপ উপবীত। ব্রাহ্মণত্ব ও বৈষ্ণবত্ব সহজে ভাঙলেন বেড়া।

তবে সেবাবাদী এই যজ্ঞসূত্র হয়।
আর আত্মঅভিমান স্বভাবে জন্মায়।।
ইহা লাগি শ্রীবৈষ্ণবের করয়ে বর্জ্জনে।
এত ভাবি যজ্ঞসূত্র ছিনু তখনে।।’

অদ্বৈত নিষেধ করলেন। তৎক্ষণাৎ যুক্তি দিলেন ঈশান,

‘কি কাজ গৌর-সেবা-বাদী উপবীতে।

পুনশ্চ অদ্বৈত ঈশানের ‘পৈতা দিলা’ এবং গৌরকে ঈশানের ঐকান্তিক বাসনা সম্পর্কে স্পষ্টভাবে বললেন,

মোর খেদে প্রভু গৌরে কহে বারেবার।
ভক্ত মনে দুঃখ দেহ এই অবিচার।।
প্রভু বাক্যে মহাপ্রভুর মৌনাবলম্বনে।
তিঁহ কহে যাহ ঈশান শ্রীপাদ সেবনে।।
শুনি মুঞি ডুবিলাঙ আনন্দসাগরে।
গুরু-কৃপা গৌরসেবায় আজ্ঞা দিলা মোরে।। —অ.প্র.।১৮।৮১

চৈতন্যচরিতামৃতে দেখেছি লীলাচ্ছলে অদ্বৈত গৌরসুন্দরকে খাওয়া নিয়ে সরল উক্তি করছেন। পূর্বে বর্ণিত হয়েছে সেই মাধুর্যমণ্ডিত লীলারস। অদ্বৈতপ্রকাশেও দেখছি, ভোজন পর্বে মধুররস, ‘গৌরের প্রিয়বস্তু যত সীতা যত্নে দিলা।’ গৌরাঙ্গ জানালেন, ‘জন্মে হেন গুরুতর ভোজন না করি।’ অদ্বৈত বললেন,

মোর কাছে ছাপা নাই তোর চতুরাঞি।।
তোর জিহ্বায় আছে নিত্য তিন মহাশক্তি।
ভক্ত-শ্লাঘা সাধু-উপদেশ দৈন্য-উক্তি।।—অ.প্র.।১৮।৮১

এখানে ঈশান অদ্বৈতের রসিক চরিত্রকে দার্শনিকতায় নিয়ে গেলেন। রেখে গেলেন নান্দনিক স্বাতন্ত্র। পরম্পরা বজায় রেখে বৈষ্ণব ভাবধারার মৌলিকত্ব।

তবে যে বিশেষ বিবরণে ঈশান চিরপ্রণম্য হয়ে থাকবেন, তা হল গৌর-বিরহিনী বিষ্ণুপ্রিয়া বর্ণনা। চৈতন্যভাগবত আচার্যগৃহে পুনঃসম্মিলনে (অন্তখণ্ড/২৪৭)। আমরা গৌর-জননীর বিষাদময়ী ছবি দেখতে পাই।

শচীদেবী শোকে রহিলেন জড় হৈয়া।
কৃত্রিম-পুতলী যেন আছে দাণ্ডাইয়া।।—চৈ.ভা.।২৪৭

চৈতন্যচরিতামৃত ক্রন্দনরতা শচীর বিবরণ অত্যন্ত মর্মস্পর্শী / বেদনাবিধুর

কান্দিয়া কহেন শচী বাছারে নিমাঞি।
বিশ্বরূপ সম না করিহ নিঠুরাঞি।।
সন্ন্যাসী হৈয়া মোরে না দিলা দরশন।
তুমি তৈছে হৈলে মোর হইবে মরণ।।—চে.চ.।১৭৬

পুত্র-বিরহে জননীর এই রকম আরও অনেক উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু বিষ্ণুপ্রিয়া সম্পর্কে এক নিশ্ছিদ্র নীরবতা!

নীলাচলে থাকাকালীন গৌরসুন্দরের জননীর কথা মনে আসে। তাই প্ৰিয় পার্শ্বদ জগদানন্দকে পাঠান নদীয়ায়।

প্রভুর অত্যন্ত প্রিয় পণ্ডিত জগদানন্দ।
…………………………………..
প্রতি বৎসর প্রভু তাঁরে পাঠান নদীয়াতে।।—চৈ.চ.।৬২২

দ্বাদশ পরিচ্ছেদে দেখলাম, জগদানন্দ শচীর চরণ বন্দনা করে ‘জগন্নাথের বস্ত্র প্রসাদ কৈল নিবেদন।’ আবার ঊনবিংশ পরিচ্ছেদে পুনশ্চ—

জগদানন্দ নদীয়া গিয়া মাতাকে মিলিলা।
প্রভুর যত নিবেদন সকল কহিলা।।
আচাৰ্য্যাদি ভক্তগণে মিলিলা প্রসাদ দিয়া।
মাতা ঠাঞি আজ্ঞা লৈল মাসেক রহিয়া।।—চৈ.চ.। ৬২৮

এরপর অদ্বৈতর সঙ্গে সাক্ষাৎ, কুশলাদি বিনিময়। বিষ্ণুপ্রিয়া প্রসঙ্গে আশ্চর্য নীরবতা। অদ্বৈতপ্রকাশে পূর্ব বিবরণের সঙ্গে বিশেষ তারতম্য নাই। যথারীতি জগদানন্দের ভুমিকা পূর্ববৎ :

শ্রীজগদানন্দ গৌরের ভক্ত কণ্ঠহার।
শচী মায়ের সেবা কৈলা বিভিন্ন প্রকার।। অ.প্র.

এরপর ‘শান্তিপুরে যাঞা প্রভু পদে প্রণমিলা।’ প্রভুও একটি ‘তরজা’-র মাধ্যমে, ‘বাউলকে কহিও লোক হইল আউল’ ইত্যাদি, তাঁর বর্তমান অবস্থা জানালেন। কিছুকাল পর জগদানন্দ নীলাচলে গৌর সমীপে উপনীত হয়ে সকল বিবরণ পুঙ্খানুপুঙ্খ নিবেদন করলেন, কুশলাদি জ্ঞাপন করলেন, তারপরেই শোনালেন সেই অনুপম সমাচার। এই অংশটুকু পড়ার পর বৈষ্ণব-সাধক-ভক্ত ছাড়, কোন সাধারণ পাঠকও অশ্রুসংবরণ করতে পারবেন না। যথা-

বিষ্ণুপ্রিয়া মাতার কথা কি কহিমু আর।
তান ভক্তি নিষ্ঠা দেখি হৈনু চমৎকার।।
শচী মাতার সেবা করেন বিবিধপ্রকারে।
সহস্রেক জনে নারে ঐছে করিবারে।।—অ.প্র.

প্রতিদিন ভোরে উঠে শচীমাতার সঙ্গে গঙ্গাস্নানে যান। স্নান করে ফিরে আসেন অ-চেতন গৃহে। সারা দিনমানে আর একবারের জন্য বাইরে যান না বিষ্ণুপ্রিয়াদেবী। চাঁদ সূর্যও তাঁর মুখ দেখতে পায় না। বস্তুত নদিয়া-চন্দ্রের বিরহে কুমুদিনীর মত তিনি নম্র। অনেক ভক্তবৃন্দের আগমন ঘটে গৃহে। নিশ্চয় ভিক্ষার্থী, প্রার্থীও আসেন। প্রসাদের জন্যও মানুষের আগমন ঘটে। তাঁরা কেউ কোনদিন বিষ্ণুপ্রিয়ার মুখ দেখতে পান না। ‘শ্রীচরণ বিনা মুখ দেখিতে না পায়।’ স্বয়ং গৌরসুন্দরের চোখের সম্মুখে যে বদকমল একদা প্রস্ফুটিত ছিল, অধুনা তা লোকান্তরালে। সেই শ্রীমুখ বুঝিবা জন্মজন্মান্তরের বিরহকে বুকে ধারণ করে অপ্রকাশ। পুরুষোত্তম শ্রীকৃষ্ণ যখন বৃন্দাবন ছেড়ে মথুরা চলে গেলেন, তারপর প্রভাস ইত্যাদি—চিরবিরহিনী শ্রীমতীর ছবিটিও যেন মানবসভ্যতার ইতিকথায় অশ্রুতে লেখা হয়ে আছে। শ্রীমদভাগবতমে গোপী-সাক্ষাৎ, উদ্ধবের পুনঃপুনঃ যুক্তির অবতারণ গোপীদের খণ্ডন এবং অবশেষে উদ্ধবের সেই জলভারনম্র শ্লোক স্মত! ‘বন্দে নন্দব্রজস্ত্রীনাং পাদরেণু ভীক্ষ্ণস/যাসাং হরিকথাগীতম পুণাতি ভুবনত্রয়ম্।। বিষ্ণুপ্রিয়াও (হয়ত উপেক্ষার নয়) অপেক্ষার প্রতিমূর্তি।

তান কন্ঠধ্বনি কেহ শুনিতে না পারে।
মুখপদ্ম ম্লান সদা চক্ষে জল ঝরে।।
শচীমাতার পাত্রশেষমাত্র সে ভুঞ্জিয়া।
দেহ রক্ষা করে ঐছে সেবার লাগিয়া।।—অপ্ৰ. ৯৫

নিজের জন্য রান্না বিষ্ণুপ্রিয়া করেন না। নিজ পাত্রে বা থালায় আহারও করেন না। শচীর খাওয়া হলে সেই পাত্রেই ভুক্তাবশেষ গ্রহণ করে দেহরক্ষা করেন। সারাদিন গৌর-গর্ভধারিণী শ্মশ্রুমাতার সেবা করেন। যদি সেবার মধ্যে সামান্য অবসর মেলে, ‘বিরলে বসিয়া নাম করে নিরন্তর।’

হরিনামামৃতে তান মহারুচি হয়।
সাধ্বী শিখামণি শুদ্ধ প্রেমপূর্ণকায়।।
তব শ্রীচরণে তাঁর গাঢ় নিষ্ঠা হয়।
তাহান কৃপাতে পাইনু তাঁর পরিচয়।।
তব রূপ-সাম্য চিত্রপট নিৰ্ম্মাইলা।
প্রেমভক্তি মহামন্ত্রে প্রতিষ্ঠা করিলা।।
সেই মূর্তি নিভৃতে করেন সুসেবন।
তব পাদপদ্মে করি আত্মসমর্পণ।।
তাঁর সদ্‌গুণ শ্রীঅনন্ত কহিতে না পারে।
এক মুখে মুঞি কত কহিমু তোমারে।।— অপ্ৰ। ১৫

অনুপম এই বিরহবিধুরার প্রতিটি অবস্থা ও মুহুর্ত যেন বহুমূল্য হীরক-বর্ণে গ্রথিত। অশ্রু প্লাবিত হয় নয়নে। কিন্তু নাটকের ‘এ্যান্টি ক্লাইম্যাক্সে’র মত সবটুকু শোনার পর যখন মহাপ্রভুর প্রতিক্রিয়া শুনি :

মহাপ্রভু কহে আর না কহ ঐ বাত।
শান্তিপুরে আচার্যের কহ সুসংবাদ।।

আমাদের অন্তরের অন্তঃস্থলে কোথায় যেন কাঁটার বেদনা অনুভব করি।

এই বেদনা সহস্রাধিক হয়ে পড়ে দ্বাবিংশ অধ্যায়ে। মহাপ্রভুর অপ্রকটের পর। নবদ্বীপচন্দ্র অস্তাচলে গেলেন নীলাচলে।

মহাপ্রভুর অপ্রকটের কথা বৃন্দাবনদাস প্রকাশ করতে চাননি। জয়ানন্দ বিবরণ দিলেও কবিরাজ গোস্বামী ইঙ্গিতমাত্র দিয়েছেন। ঈশানও বিশদে যেতে চাননি। শুধু জানা যায়, ক্ষেত্রবাসী ভক্ত একজন শান্তিপুরে এলেন। লোকাচার মত সেই ভক্তের অশ্রু বিমোচন করে গৌরাঙ্গের কুশল জানতে চাইলেন অদ্বৈত। ভক্ত বললেন : ‘অপ্রকট হৈল তিঁহো হঞাছে প্রবাদ।’ দ্বাবিংশ পরিচ্ছেদে নিত্যানন্দের অপ্রকটের বিবরণ অতি সংক্ষিপ্ত : ‘অলক্ষেতে নিত্যানন্দ অন্তৰ্দ্ধান কৈলা।’ পারত্রিক কার্যাদির দিনে ‘খড়দহে হৈল পুন: মহাসংকীর্তন।’ অদ্বৈত আপ্রাণ চেষ্টা করেন গৌড়ীয় বৈষ্ণবদের সব শাখা-প্রশাখাকে সমন্বিত করে একটি স্থায়ী মতৈক্যে উপনীত হওয়ার।

সাত সম্প্রদায়ে বাজে চতুৰ্দ্দশ মাদল।
শত শত বাজে সুমধুর করতাল।।
প্রতি সম্প্রদায়ে নাচে এক এক জন।
সৰ্ব্ব সম্প্রদায়ে নাচে কুবেরনন্দন।।—অ.প্রা.

প্রতিটি সম্প্রদায়ের সঙ্গে নৃত্যরত অদ্বৈত মধুর মিলনোৎসবের সূচনা করতে চেয়েছিলেন। গৌরাঙ্গ ও নিত্যানন্দ থেকে বয়সে অনেক প্রবীণ এই পরম ভাগবত সর্বান্তকরণে একটি যোগসূত্রে সকলকে বাঁধতে চাইলেন। শ্রাদ্ধকর্মে এক ঐতিহাসিক কাজ করলেন নিত্যানন্দপুত্র বীরভদ্র। সবিনয়ে অদ্বৈতকে বললেন, আপনারা তিনজন (গৌর-নিত্যানন্দ-অদ্বৈত) আগে যেমন একসঙ্গে ভোজনে বসতেন, আজও সেই ব্যবস্থা করা হোক। অদ্বৈতের অনুমতিতে বীরভদ্র-

পহিলে শ্রীমহাপ্রভুর ভোগ লাগাইলা।
তাহার দক্ষিণে নিত্যানন্দের ভোগ দিলা।।
গৌরাঙ্গের বামে প্রভু বসিলা আপনে।

ঘোষিত হল—

শ্রীচৈতন্য নিত্যানন্দ অদ্বৈতগোসাঞি।
তিনে এক একে তিন ভিন্ন ভেদ নাঞি।। — অপ্ৰ

কাতর অদ্বৈত গৌরবিরহ, অসুস্থতা সত্ত্বেও একদিনের জন্যও বিস্মৃত হননি বিষ্ণুপ্রিয়াকে। ঈশানকে নবদ্বীপ পাঠালেন বিষ্ণুপ্রিয়ার কুশলাদি জানার জন্য। ইতোমধ্যে শচী অনন্তলোকে গমন করেছেন। অদ্বৈত সমীপে ঈশান নিবেদন করলেন মর্মস্পর্শী ভাষায় বিষ্ণুপ্রিয়ার অবস্থা। শচীদেবীর অন্তর্ধানের পর বিষ্ণুপ্রিয়া স্বেচ্ছায় ভক্ত সহ সকলের জন্য চিরতরে দ্বার রুদ্ধ করে দিলেন।

তাঁর আজ্ঞা বিনা তানে নিষেধ দর্শনে।
অত্যন্ত কঠোর ব্রত করিলা আপনে।

সেই ব্রত এত কঠোর, এত মর্মন্তুদ যে ভক্ত-পাঠকের হৃদয় বিগলিত হবেই। মাদৃশ অর্বাচীনের পক্ষে তার বিবরণ অসাধ্য প্রায়। ঈশানের বিবরণ থেকে তুলে দেওয়া হল :

প্রত্যুষেতে স্নান করি কৃতাহ্নিক রঞা।
হরিনাম করি কিছু তণ্ডুল লইয়া।।
নাম প্রতি এক তণ্ডুল মৃৎপাত্রে রাখয়।
হেন মতে তৃতীয় প্রহর নাম লয়।।
জপান্তে সেই সংখ্যার তণ্ডুলমাত্র লঞা।
যত্নে পাক করে মুখ বস্ত্রেতে বান্ধিয়া।। —অ.প্র.।১০২

সেই রান্নায় কোন উপকরণ থাকে না। লবণ থাকে না। শুধুমাত্র অন্ন ভোগ দেওয়া হয় মহাপ্রভুর উদ্দেশে আকুতি সহকারে। এরপর আচমন করে ‘মুষ্টিক প্রসাদমাত্র ভুজ্ঞেন আপনি।’ প্রসাদান্ন অবশেষে ভক্ত মধ্যে বিতরণ করা হয়। ঈশানের প্রবল ইচ্ছা ছিল, বিষ্ণুপ্রিয়ার অবস্থা একবার স্বচক্ষে দেখেন। ‘ভাবিনু মাতারে কৈছে পাইমু দর্শন।’ সৌভাগ্যবশত, সুযোগ এসে যায়। রাম পণ্ডিত, গদাধর, দামোদরের সঙ্গে ঈশান ভিতরে গেলেন।

তবে বিষ্ণুপ্রিয়া মাতার আজ্ঞা অনুসারে।
মো অধমে লঞা পণ্ডিত গেলা অন্তঃপুরে।।
যাঞা দেখি কাণ্ডাপটে মায়ের অঙ্গ ঢাকা।
কোটি ভাগ্যে শ্রীচরণ পাইনুমাত্র দেখা।।—তদেব

কানাৎ বা পর্দার আড়ালে নিজেকে সর্বদা অগোচরে রাখতেন বিষ্ণুপ্রিয়া। ঈশান শোকাহত চিত্তে বলছেন,

যে কষ্ট সহেন মাতা কি কহিমু আর।
অলৌকিক শক্তি বিনা ঐছে সাধ্য কার।।—তদেব

কবি কর্ণপুরের শ্রীচৈতন্যচন্দ্রোদয় দ্বিতীয়াঙ্কে শ্রী অদ্বৈতসহিত পরিহাসছলে (মহাপ্রভুর) শান্তিপুর-ত্যাগের কারণ নির্ণয় এবং বিষ্ণুপ্রিয়াদেবীর বিষ্ণুভক্তিস্বরপিনীত্ব নির্ধারণের মধুময় বিবরণ থাকলেও ঈশানের মত মর্মস্পর্শী বলে বোধ হয় না।

‘সওয়া শতবর্ষ’ ধরাধামে থেকে ‘অনন্ত অর্বুদ লীলা’ প্রকাশ করে অদ্বৈত অপ্রকট হলেন ১৫৫৮ খ্রিষ্টাব্দে। অদ্বৈত পরলোকগমনের কিছুকাল পর্বে ঈশানকে বলেন, লাউড়ে গিয়ে ‘গৌরনাম প্রচারিহ মোর জন্মস্থানে।’ পঁয়ষট্টি বছর পর আবার শ্রীহট্টে আসেন ঈশান। তখন তাঁর বয়স সত্তর বছর। এর মধ্যে আবার সীতাদেবীর আদেশ, বিবাহ করতে হবে। জগদানন্দের সঙ্গে পূর্বদেশে আসেন। বিবাহ করেন এবং ‘বংশরক্ষা’ করেন ‘প্রভুর আজ্ঞা পালিবারে।’ ‘চৌদ্দশত নবতি শকাব্দে’ অদ্বৈতপ্রকাশ রচনা সাঙ্গ করেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *