অদ্বৈতপ্রকাশ – ১

প্রথম অধ্যায়

মঙ্গলাচরণ

শ্রীলাদ্বৈত গুরুং বন্দে হরিণাদ্বৈতমেব তং।
প্রকাশিতং-পরং ব্রহ্ম যোহবতীর্ণ: ক্ষিতৌ হরিং।। ১।।
অন্তঃকৃষ্ণবহির্গৌরং কৃষ্ণচৈতন্য সংজ্ঞকং।
প্রেমাধ্বিং সচ্চিদানন্দং সৰ্ব্বশক্তাশ্রয়ং ভজে।। ২।।
শ্রীনিত্যানন্দরামংহি দয়ালুং প্রেমদীপকং।
গদাধরঞ্চ শ্রীবাসং বন্দে রাধেশসেবিনং।। ৩।।

গ্রন্থারম্ভ

জয় জয় শ্রীচৈতন্য জয় সীতানাথ।
জয় নিত্যানন্দরাম ভক্তগণ সাথ।।
কলি ঘোর পাপময় দেখি পঞ্চানন।
কৈছে জীব নিস্তারিমু ভাবে মনে মন।।
তবে বহু বিচারিলা যোগমায়া সহ।
হরি বিনু জীব নিস্তারিতে নাহি কেহ।।
এত কহি সদাশিব সদানন্দ চিত।
কারণ সমুদ্রতীরে হৈলা উপনীত।।
যোগাসনে মহাযোগী যোগ আরম্ভিল।
যোগে সপ্তশত বৎসর অতীত হইল।।
সেই ঘোর তপস্যাতে হঞা তুষ্ট মন।
জগৎকৰ্ত্তা মহাবিষ্ণু দিলা দরশন।।
সাক্ষাৎকারে পঞ্চানন দেখি নারায়ণে।
বহুবিধ স্তুতি কৈ না যায়হ কথনে।।
মহাবিষ্ণু কহে তুহু নহ আর কেহ।
তোর মোর এক আত্মা ভিন্ন মাত্র দেহ।।
এত কহি পঞ্চাননে কৈলা আলিঙ্গন।
দুই দেহ এক হৈল কে জানে তার মন।।[১]
অত্যাশ্চয্য হৈল এক শুন সৰ্ব্বজন।
শুদ্ধ স্বর্ণ বর্ণ অঙ্গ উজ্জ্বল বরণ।।
কৃষ্ণ কৃষ্ণ বলি প্রভু ছাড়য়ে হুঙ্কার।
দৈববাণী হৈল তখন অতি চমৎকার।।
শুন মহাবিষ্ণু তুমি এ হেন মূৰ্ত্তিতে।
অবতীর্ণ হও আগে লাভার গর্ভেতে।।
পাছে মুই অবতীর্ণ হইমু নদীয়ায়।
শচী জগন্নাথ ঘরে দেখিবা আমায়।।
বলরাম আদি করি যত ভক্তগণ।
জীব উদ্ধারিতে সবে লভিবে জনম।।
এত শুনি মহাবিষ্ণু শিবাভিন্ন হঞা।
শান্তিপুরে লাভাগর্ভে প্রবেশিলা গিঞা।।
লাভাদেবী তপস্বিনী সতী ধৰ্ম্মযুতা।
তর্ক পঞ্চানন কুবের আচার্য্য বনিতা।।
পূর্ব্বে ধনপতি কুবের শিব পুত্র লাগি।
বহু তপ জপ কৈলা হৈঞা অনুরাগী।।
তপে তুষ্ট হৈয়া শিব তথাস্তু কহিলা।
তথি লাগি ধরায় কুরের জনমিলা।।
নাম তাঁর হৈল শ্রীমান্ কুবের আচার্য্য।
ধৰ্ম্ম বিদ্যাবলে হৈলা সকলের পূজ্য।।
তার গুণ বর্ণিতে মোহর শক্তি নাই।
নৃসিংহ সন্ততি বলি লোকে যারে গায়।।
যেই নরসিংহ নাড়িয়াল বলি খ্যাত।
সিদ্ধ শ্রোত্রিয়খ্য আরুওঝার বংশজাত।।
যেই নরসিংহের যশঃ ঘোষে ত্রিভুবন।
সৰ্ব্ব শাস্ত্রে সুপন্ডিত অতি বিচক্ষণ।।
যাঁহার মন্ত্রণাবলে শ্রীগণেশ রাজা।
গৌড়িয়া বাদসাহে মারি গৌড়ে হৈল রাজা।।
যাঁর কন্যা বিবাহে হয় কাপের উৎপত্তি।
লাউর প্রদেশে হয় যাঁহার বসতি।।
সেই বংশ উদ্দীপক শ্রীকুবেরাচার্য্য।
রাজধানীতে ছিল তাঁর দ্বারপন্ডিত কার্য্য।।
বিবাহান্তে ক্রমে তাঁর বহু পুত্র হৈল।
পুত্রগণ মৈলে তার বিবেক হইল।।
তবে গঙ্গাতীরে রম্যে শান্তিপুরে আইলা।
লাভা সহ কিছুদিন তাহা গোঙাইলা।।
একদিন শ্রীকুবের তর্কপঞ্চানন।
আকারে জানিলা লাভার গর্ভের লক্ষণ।।
নারায়ণ পূজা কৈল নানা উপহারে।
ব্রাহ্মণ দরিদ্র অন্ধে তুষিলা আহারে।।
হেনকালে রাজপত্রী কুবের পাইলা।
বনিতা সহিতে নিজ দেশেতে চলিলা।।
লাউরেতে নবগ্রামে ছিল তাঁর বাস।
দিব্যসিংহ রাজার যাঁহা রাজত্ব বিলাস।।
তবে কুবের ভার্য্যা সহ নবগ্রামে গেলা।
সেই গ্রামের লোক তাঁরে সম্মান করিলা।।
বহুদিন পরে রাজা দেখি আচার্য্যেরে।
প্রণমি কুশল পুছে আনন্দ অন্তরে।।
রাজা কহে কহ কহ তর্কপঞ্চানন।
মঙ্গল কাহিনী আর বিলম্ব কারণ।।
তোমার সৎসঙ্গ মোর আনন্দের খনি।
তুয়া বিনু রাজ্যপাট শূন্য করি মানি।।
আচাৰ্য্য কহেন ভূপ তুহু দয়ানিধি।
দরিদ্র ব্রাহ্মণে দয়া কর নিরবধি।।
গঙ্গাতীর পূণ্যভূমি অতি রম্যস্থান।
তাঁহা বাস হয় স্বর্গ বাসের সমান।।
তাঁহা হৈতে আসিবারে মনে নাহি ভায়।
তবে যে আইলু চলি তোমার আজ্ঞায়।।
ঈশ্বর কৃপায় পুন হৈল গর্ভাধান।
অদৃষ্টের ফল যেই হয় মূৰ্ত্তিমান।।
রাজা কহে পুণ্য স্থানে হৈল গর্ভাধান।
মঙ্গল হইবে সত্য করি অনুমান।।
পূর্ব্ব শোক পাসরিয়া ঈশ্বরেরে ডাক।
তাঁহান কৃপায় হৈবে অপূৰ্ব্ব বালক।।
এইমতে বহু কথা কহে দুইজন।
হেনকালে আইলা এক গণক ব্রাহ্মণ।।
গণক কহে শুনহ পন্ডিত মহাশয়।
দেবরূপী পুত্র পাইয়া নাহিক সংশয়।।
চিরজীবি হবে সেই ধৰ্ম্মশাস্ত্রবেত্তা।
শুদ্ধ ধর্ম্ম প্রচারিতে দেখি তান সত্তা।।
এত করি গণক সে হৈলা অন্তৰ্দ্ধান।
রাজা পিছে তল্লাসিয়া না পাইলা সন্ধান।।
আশ্চৰ্য্য মানিয়া সবে কহে পরস্পর।
এই জন হৈব বুঝি দেব অবতার।।
আচাৰ্য্য হইলা তুষ্ট দৈবজ্ঞ বচনে।
ঘরে যাঞা সব তত্ত্ব কহে লাভা স্থানে।।
লাভা কহে ঈশ্বরের মহিমা অপার।
তাঁর দয়া হৈলে নাহি রহে দুঃখ ভার।।
ভক্তিভাবে বিষ্ণুপূজা করে সেই জন।
সৰ্ব্বত্র মঙ্গল হয় কহে সাধুগণ।।
তাহা শুনি আচাৰ্য্য বিশুদ্ধ জ্ঞানবান।
কহে প্রিয়ে এই সত্য বেদের প্রমাণ।।
বিষ্ণুর অর্চনে হয় সৰ্ব্ব দেবার্চ্চন।
সৰ্ব্বসিদ্ধ হয় খণ্ডে মায়ার বন্ধন।।
তবে কুবের ভক্তি ভাবে নানা উপহারে।
মহা আড়ম্বরে নারায়ণ পূজা করে।।
বিষ্ণুর প্রসাদ বিপ্রগণে ভুঞ্জাইলা।
অন্ধ আতুর অকিঞ্চনে বস্ত্রদান কৈলা।।
একদিন শুন এক অপূৰ্ব্ব কাহিনী।
রাত্রি শেষে স্বপ্ন দেখে লাভা ঠাকুরাণী।।
নিজ হৃৎকমলে দেখে হরিহর মূর্তি।
তাঁর অঙ্গ কান্ত্যে সর্ব্বদিক হয় স্ফূর্তি।।
হরিসংকীর্ত্তন করে, সমধুর স্বরে।
বাহু তুলি নাচে কান্দে বাক্য নাহি স্ফুলে।।
হরে কৃষ্ণ বলি তেঁহ করয়ে হুঙ্কার।
তাহা শুনি আইলা তথি সূর্য্যের কুমার।।
যমরাজ আসি দেখে রূপের মাধুরী।
হরিহর এক অঙ্গ যৈছে হর গৌরী।।
কৌটী সূৰ্য্য জিনি অঙ্গকান্তি মনোহর।
ঐছে রূপ বর্ণিবারে কেবা শক্তিধর।।
মুখে হরেকৃষ্ণ অঙ্গে পুলক উদগম।
অশ্রুধারা বহে সদা সুরধনী সম।।
বিশুদ্ধ প্রেমেতে তান ডগমগ অঙ্গ।
ক্ষণে নৃত্য করে বাড়ে প্রেমের তরঙ্গ।।
এই অলৌকিক ভাব করি দরশন।
অষ্টাঙ্গেতে প্রণমিলা তপননন্দন।।
বহুবিধ স্বর কৈলা না যায় কথন।
করযোড়ে কহে তবে মধুর বচন।।
শুন প্রভু এ তামস কলিযুগ হয়।
ইথে তুয়া অবতার আশ্চর্য্য বিষয়।।
তোমা দরশনে পাপী পাইবে পরিত্রাণ।
মোর অধিকার তবে হইবে নির্ব্বাণ।।
অতএব প্রভু তুহুঁ হও অপ্রকট।
নিজ দাসে দয়া করি ঘুচাও সঙ্কট।।
শুনি প্রভু ঈষৎ হাসিয়া কহে যমে।
স্থির হও ধর্ম্মরাজ পড়িয়াছ ভ্রমে।।
পাপীর যে ঘোর দুঃখ না কর সন্ধান।
পর দুঃখে দুঃখী হয় সাধু জ্ঞানবান্।।
যদি কহ তাঁর আত্মকর্ম্ম ভোগ করে।
কর্ম্মবন্ধ নাশিবারে কেবা শক্তি ধরে।।
মায়াবৃত তাঁর নিজ হিত নাহি জানে।
তুচ্ছ বাহ্যেন্দ্রিয় সুখে হিত করি মানে।।
রোগী যৈছে কৃপথ্য ভুঞ্জিয়া দুঃখ পায়।
তৈছে সংসারাসক্তের কর্ম্মবন্ধ হয়।।
বিশেষ কলিতে জীব স্বেচ্ছাচার করি।
ঘোর দুঃখ দাবাগ্নিতে যায় গড়াগড়ি।।
জীবের অসহ্য ক্লেশ দেখি মোর মন।
ধৈরজ না ধরে শেষে করিলু এই পণ।।
কৰ্ম্মবদ্ধ বিনাশক যেই মহামন্ত্ৰ।
শুষ্ক কৃষ্ণপ্রেম ভক্তি উৎপাদক যন্ত্র।।
সেই চিন্ময় হরিনাম জীবে শিখাইয়া।
পাপীগণে উদ্ধারিমু শক্তি সঞ্চারিয়া।।
তথি লাগি মুঞি এবে লভিনু জনম।
ধন্য কলিযুগ বলি গাইব সাধুগণ।।
আর এক সুদৃঢ় প্রতিজ্ঞা মোর হয়।
স্বয়ং ভগবানে প্রকট করিমু নিশ্চয়।।
সাঙ্গোপাঙ্গে মহাপ্রভু হৈব অবতীৰ্ণ।
শুষ্ক প্রেমবন্যায় দেশ হৈবে পরিপূর্ণ।।
ইথেহ না ঘুচিবেক তুয়া অধিকার।
নিন্দুক পাষন্ডিগণ না হৈবে উদ্ধার।।
এত শুনি যমরাজ নিজ ঠাঞি গেলা।
স্বপ্ন ভাঙ্গি লাভাদেবী জাগিয়া বসিলা।।
অদ্ভূত স্বপন কথা পন্ডিতে কহিলা।
শুনিয়া আচাৰ্য্য মনে বিষ্ময় মানিলা।।
তবে সাধ্বী লাভাদেবীর দশমাস গেলা।
মাঘী সপ্তমীতে প্রভু প্রকট হইলা।।
শুভদিনে স্নানদান করে হরিধ্বনি।
হুলু হুলু ধ্বনি করে যতেক রমণী।।
সাধুর হৃদয়ে গাঢ় আনন্দ বাড়িল।
কি হেতু আনন্দ তাহা নাহি সমঝিল।
যথা কালে কুবের জ্যোতিষি আনাইলা।
কমলাক্ষ নাম তান বাছিয়া রাখিলা।।
পঞ্চম বৎসরে প্রভুর দেখ চমৎকার।
শ্রীকৃষ্ণনৈবেদ্য বিনু না করে আহার।।
শুভক্ষণে দ্বিজরাজ হাতে খড়ি দিল।
একমাসে বর্ণজ্ঞান প্রভুর হইল।।
শ্রীগৌরাঙ্গ শ্রীঅদ্বৈত পদে যার আশ।
নাগর ঈশান কহে অদ্বৈতপ্রকাশ।।

ইতি শ্রীঅদ্বৈতপ্রকাশে প্রথমোহধ্যায়ঃ।। ১।।

[১. অদ্যাবধি গ্রন্থের তিনটি সংস্করণ পড়েছি। পাঠান্তর ভেদ থাকা অস্বাভাবিক নয়।]