অদ্বৈতপ্রকাশ – ২২

দ্বাবিংশ অধ্যায়

জয় জয় শ্রীচৈতন্য জয় সীতানাথ।
জয় নিত্যানন্দ-রাম ভক্তগণ সাধ।।
মহাপ্রভুর অপ্রকটে প্ৰভু দুই জন।
বিরহে আকুল হঞা করয়ে ক্রন্দন।।
যে সকল দশা চক্ষে করিনু দর্শন।
মুঞি ছার কীট তাহা লিখিতে অক্ষম।।
কৃষ্ণ বিনু যৈছে দশা ব্রজগোপীকার।
তৈছে দশা দৌঁহকার স্ফুলে অনিবার।।
কভু উপবাসী রহে কভু কিছু খান।
কভু দুই চারি দিনে করে জলপান।।
বিরহে বিবশ তনু কভু নাহি স্ফুলে।
হা গৌরাঙ্গ বলি কভু ডাকে উচ্চৈঃস্বরে।।
এক দিবসেরে করে শতযুগ জ্ঞান।
দোঁহাকার দশা দেখি গলয়ে পরাণ।।
কেবল গৌরাঙ্গ নাম উল্লাস অন্তর।
হেন মতে গত হৈল অষ্টম বৎসর।।
একদিন শান্তিপুরে শ্রীঅদ্বৈতাচাৰ্য্য।
গৌরগুণ স্তুতি প্রেমে হইলা অধৈর্য্য।।
হেনকালে পত্রী আইল দন্ডবৎ হৈতে।
লিখিলা শ্রীনিত্যানন্দ আচার্য্যে যাইতে।।
পত্ৰী পাঞা শ্রীঅদ্বৈত হই ত্বরান্বিত।
নিত্যানন্দ পুরে গিয়া হৈলা উপনীত।।
নিত্যানন্দ শ্রীঅদ্বৈতের শুভ সম্মিলনে।
মহানন্দে পরস্পর কৈলা আলিঙ্গনে।।
দুহুঁ দোঁহা দেখি হঞা প্রেমেতে মগন।
গোরা বুলি ফুকারিয়া করয়ে ক্রন্দন।।
কতক্ষণে দোঁহাকার বাহ্যস্ফূৰ্তি হৈল।
তবে দোহে একাসনে নিৰ্জ্জনে বসিল।।
ক্রমে সপ্তরাত্রি দোঁহে বসিয়া নিৰ্জ্জনে।
কিবা কথাবাৰ্ত্তা কহে কেহ নাহি জানে।
অষ্টম দিবসে শ্রীঅদ্বৈত মহারঙ্গে।
গৌরগুণকীর্ত্তন করয়ে ভক্ত সঙ্গে।।
মধ্যে নাচে নিত্যানন্দ প্রেমে অগোয়ান।
শ্রীগৌরাঙ্গ পাদপদ্ম করিয়া ধেয়ান।।
যতেক মহান্ত প্রেমে বাহ্য পাশরিলা।
অলক্ষ্যেতে নিত্যানন্দ অন্তৰ্দ্ধান কৈলা।।
বাহ্যস্ফূৰ্ত্তি পাই যত মহান্তের গণ।
নিত্যানন্দে না দেখিয়া করে অন্বেষণ।।
সৰ্ব্বতত্ত্ব জ্ঞাতা প্রভু অদ্বৈত ঈশ্বর।
বুঝিলা শ্রীনিত্যানন্দ হৈলা অগোচর।।
হাহাকার করি বুলে যৈছে উনমাদ।
কহ কি লাগিয়া কৈলা ঐছে পরমাদ।।
একে মুঞি গোরাচাঁদের বিষম বিচ্ছেদে।
মৃতপ্রায় হঞা আছি মনের বিষাদে।।
তবু ছিনু বাঁচিয়া তোমার মুখ চাই।
তুমিহ ছাড়িলা যদি এবে কাঁহা যাই।।
ঐছে এত কহি প্রভু বিলাপ করিল।
তার এক বিন্দু মুঞি লিখিতে নারিল।।
নিত্যানন্দের অপ্রকট জানি ভক্তগণ।
কাঁহা নিত্যানন্দ বুলি করয়ে ক্রন্দন।।
কান্দি প্রভু বীরভদ্র ধুলায় লোটায়।
শ্রীঅদ্বৈতচন্দ্ৰ সভাকারে প্রবোধয়।।
মহা মহোৎসবের উদ্যোগ করাইলা।
যাঁহা যাঁহা ভক্ত তাঁহা পাতি পাঠাইলা।।
যথা কালে আইলা যত মহান্তের গণ।
খড়দহে হৈল পুন হৰ্ষ উদ্দীপন।।
মহোৎসব দিনে করি স্নান সমাপন।
সভে মিলি আরম্ভিলা মহা সংকীৰ্ত্তন।।
সাত সম্প্রদায়ে বাজে চতুৰ্দ্দশ মাদল।
শত শত বাজে সুমধুর করতাল।।
প্রতি সম্প্রদায় নাচে এক এক জন।
সৰ্ব্ব সম্প্রদায়ে নাচে কুবের নন্দন।।
যৈছে সেই কীৰ্ত্তনানন্দ প্রত্যক্ষ করিনু।
বাহুল্যের ভবে তৈছে লিখিতে নারিনু।।
সংকীৰ্ত্তন অন্তে যত শ্ৰীবৈষ্ণবগণ।
গৌরাঙ্গের লীলারস করে আস্বাদন।।
তবে প্রভু বীরভদ্র স্থান উপস্কারি।
এত স্থানে তিন ঠাঁই কৈলা যত্ন করি।।
তিন ভোগ লাগাইলা তাঁহায়ি রাখিলা।
তবে শ্রীঅদ্বৈত স্থানে কহিতে লাগিল।।
মোরএক অভিলাষ কহি তব ঠাঞি।
বালকের বাঞ্ছা পূর্ণ করহ গোসাঞি।।
যৈছে মহাপ্রভু আর প্রভু দুইজনে।
একত্রে বসিয়া পূর্ব্বে করিলা ভোজনে।।
তৈছে আজি কর মোর গৃহেতে ভোজন।
দেখিয়া সফল হোক এ ছার নয়ন।।
ভাব বুঝি সকল মহান্ত সায় দিল।
ভোগ লাগাইতে তবে মোর প্রভু গেলা।।
পহিলে শ্রীমহাপ্রভুর ভোগ লাগাইলা।
তাহান দক্ষিণে নিত্যানন্দের ভোগ দিল।।
গৌরাঙ্গের বামে প্রভু বসিলা আপনে।
দেখি হরিধ্বনি করে শ্রীবৈষ্ণব গণে।।
ভোজন আরতি করে প্রভু বীরচন্দ্র।
ধূপ দীপ জ্বালি নেহারয়ে মুখচন্দ্র।।
নব অনুরাগে যত মোহান্তের গণ।
গৌরাঙ্গের ভোজনারতি করয়ে কীর্তন।।
কিম্বা সে অপূৰ্ব্ব শোভা আনন্দের কন্দ।
তাহা সভ বর্ণিতে না পারোঁ মুঞি ভাগ্য মন্দ।
সভা মধ্যে বীরভদ্র বাহু তুলি বলে।
মোর এক কথা শুন বৈষ্ণব সকলে।।
যেবা কেহ করিবেক অন্ন মহোৎসবে।
ঐছে আগে তিন প্রভুর ভোগ লাগাইবে।।
পরে সেই মহাপ্রসাদ লইয়া যতনে।
সমর্পিবে সাধু দ্বিজ বৈষ্ণবের গণে।।
তিন প্রভু ভোজনে হয় মহাযজ্ঞ পূর্ণ।
তিন প্রভুর ভোজনে হয় ভদ্রাসন ধন্য।।
শ্রীচৈতন্য নিত্যানন্দ অদ্বৈতগোসাঞি।
তিনে এক একে তিন ভিন্ন ভেদ নাঞি।।
তিনে ভেদ বুদ্ধি করিবেক যেই জন।
কভু সেই না পাইবে চৈতন্য-চরণ।।
গৌর কৃপা বিনু প্রেম ভক্তি না লভিবে।
এ হেন দুর্লভ জন্ম বিফলে যাইবে।।
যে উৎসবে তিন প্রভুর ভোগ না সারিবে।
দক্ষযজ্ঞ সম তার যজ্ঞ না পারিবে।।
অন্নদান ফললাভ নারিবে করিতে।
সৰ্ব্বনাশ হৈবে যজ্ঞ যাইবে অধঃপাতে।।
পরকালে হৈব তার নরকে বসতি।
চন্দ্ৰ সূৰ্য্য থাকিতে না পাইবে অব্যাহতি।।
বীরচন্দ্রের মুখে তেন বাক্য শুনি সবে।
তথাস্তু তথাস্তু কহে সকল বৈষ্ণবে।।
তবে উঠিলেন প্রভু করিয়া ভোজন।
আচমন করি কৈলা তাম্বুল সেবন।।
তবে বীরভদ্র প্রভু হরষিত হঞা।
সেই মহাপ্রসাদন্ন দিলা বিবৰ্ত্তিয়া।।
ব্রাহ্মণ বৈষ্ণব সাধু মহান্তাদি যত।
মহাপ্রসাদ পাঞা সভে মানিলা কৃতাৰ্থ।।
উৎসবান্তে বীরচন্দ্র প্রভুর আঞা পাঞা।
পশারের উদ্যোগ করিলা হর্ষ হঞা।।
হরিদ্রা মিশ্রিত দধি নবীন হান্ডীতে।
শোভা করে নবআম্র-পল্লব তাহাতে।।
নূতন বস্ত্রেতে তাহা করি আচ্ছাদন।
অদ্বৈতের আগে তিহঁ করিলা স্থাপন।।
মোর প্রভুর আজ্ঞামতে শ্রীঅচ্যুতানন্দ।।
পশার করিলা করি কীর্ত্তন আনন্দ।।
দধিমঙ্গল করি যত শ্রীগৌরাঙ্গের গণ।
গোকুলীয়া গোপভাবে করয়ে নৰ্ত্তন।।
যে আনন্দ হৈল তাহার কূল নাহি দেখি।
আত্মশোধিবারে সূত্র লব মাত্র লিখি।।
উৎসবান্তে ভক্তগণ নিজস্থানে গেলা।
মো সভারে লঞা প্রভু শান্তিপুরে আইলা।।
নিজ ঘরে আসি প্রভু বিষাদিত মনে।
আন বোল নাহি মুখে হরেকৃষ্ণ বিনে।।
একদিন মুঞি কীট প্রভু আজ্ঞা দ্বারে।
নবদ্বীপের তত্ত্ব জানি আইনু শান্তিপুরে।।
প্রভুপদে কৈনু দন্ডবত নমস্কার।
প্রভু কহে ঈশানদাস কহ সমাচার।।
মুঞি কহিলাঙ নবদ্বীপ-বাসী গণ।
গৌরাঙ্গাপ্রকটে সভার সুদুঃখিত মন।।
ভাগ্যে পন্ডিত দামোদরে পাইনু দর্শন।
তিহোঁ কহে কাঁহা ইহা কৈলা আগমন।।
বিষ্ণুপ্রিয়া মাতা শচীদেবীর অন্তর্দ্ধানে।
ভক্তদ্বারে দ্বার-রুদ্ধ কৈলা স্বেচ্ছাক্রমে।।
তাঁর আজ্ঞা বিনা তানে নিষেধ দর্শনে।
অত্যন্ত কঠোর ব্রত করিলা ধারণে।।
প্রত্যুষেতে স্নান করি কৃতাহ্নিক রঞা।
হরিনাম করি কিছ তণ্ডুল লইয়া।।
নাম প্রতি এক তণ্ডুল মৃৎপাত্রে রাখয়।
হেন মতে তৃতীয় প্রহর নাম লয়।।
জপান্তে সেই সংখ্যার তণ্ডুল মাত্র লঞা।
যত্নে পাক করে মুখ বস্ত্রেতে বান্ধিয়া।।
অলবণ অনুপকরণ অন্ন লঞা।
মহাপ্রভুর ভোগ লাগায় কাকুতি করিয়া।।
বিবিধ বিলাপ করি দিয়া আচমনী।
মুষ্টিক প্রসাদ মাত্র ভুজেন আপনি।।
অবশেষে প্রসাদান্ন বিলায় ভক্তেরে।
ঐছন কঠোর ব্রত কে করিতে পারে।।
বজ্রাঘাত সম বাক্য করিয়া শ্রবণ।
ভাবিনু মাতারে কৈছে পাইনু দৰ্শন।।
হেনকালে আইলা তাঁহা দাস গদাধর।
শ্রীরামপন্ডিত আদি ভকত প্রবর।।
প্রসাদ লইতে সভে দামোদর সনে।
অন্তঃপুরে প্রবেশিলা সজল নয়নে।।
তবে বিষ্ণুপ্রিয়া মাতার আজ্ঞা অনুসারে।
মো অধমে লঞা পণ্ডিত গেলা অন্তঃপুরে।।
যাঞা দেখি কান্ডাপটে মায়ের অঙ্গ ঢাকা।
কোটি ভাগ্যে শ্রীচরণ মাত্র পাইনু দেখা।।[১]
ভক্ত কৃপা লবে কিঞ্চিৎ পাইনু প্রসাদ।
কৃতার্থ হইনু মনের ঘুচিল বিষাদ।।
যে কষ্ট সহেন মাতা কি কহিনু আর।
অলৌকিক শক্তি বিনা ঐছে সাধ্য কার।।
তাহা শুনি মোর প্রভু করয়ে ক্রন্দন।
কৃষ্ণ ইচ্ছা মানি করে খেদ সম্বরণ।।
বিষ্ণুপ্রিয়া মাতার দশা চক্ষে যে দেখিনু।
কহিতে পরাণ ফাটে লিখিতে নারিনু।।
তবে কিছুদিন পরে প্রভু সীতানাথ।
শ্রীঅঙ্গনে বসি পড়ে শ্ৰীমদ্ভাগবত।।
হেনকালে এক শুদ্ধ বৈষ্ণব আইলা।
প্রভুর আগে তিঁহো অষ্ট-অঙ্গে প্রণমিলা।।
প্রভু তারে কহে এবে কাঁহা হৈতে আইলা।
তিহোঁ কহে প্রভু বীরভদ্র পাঠাইলা।।
বিংশতি বৎসর তার বয়স এখনে।
অদীক্ষিত আছেন গুরু যোগ্য পাত্র বিনে।।
তেঞি তব স্থানে মন্ত্র লইবার আশে।
নৌকা-যোগে তিহোঁ আসিতেছে প্রেমাবেশে।।
প্রভু কহে বীরের এই বুদ্ধি নহে শুদ্ধ।
ইহা তার নিজগণের সম্মতি বিরুদ্ধ।।
মোর কথা বুঝাইয়া কহ যাঞা বীরে।
জাহ্নবা মাতার স্থানে মন্ত্র লইবারে।।
তাহা শুনি শ্রীবৈষ্ণব খড়দহে গেলা।
জাহ্নবা স্থানে প্রভুর আজ্ঞা নিবেদিলা।।
শুনি শ্রীজাহ্নবা এক সাধু পাঠাইলা।
ফিরাইয়া আনি বীরে দীক্ষিত করিলা।।
এবে শুন শ্রীঅদ্বৈত প্রভুর অন্তর্দ্ধান।
যে তথা শিখিতে মোর ফাটায়ে পরাণ।।
একদিন প্রভুর হৈল মহাভাবাবেশ।
কাঁহা নিমাই বলি বুলে করিয়া উদ্দেশ।।
বহুক্ষণে আচার্য্যের বাহ্য স্ফুৰ্ত্তি হৈল।
তবে নিজ প্রিয়-পুত্রগণে বোলাইল।।
প্রভু কহে মোর দুঃখ শুন বৎসগণ।
মোর দুষ্টগণে করে গৌরাঙ্গ নিন্দন।।
ইহা মোর পরাণে নাহিক সহ্য হয়।
তার প্রায়শ্চিত্তে দেহ তাজিমু নিশ্চয়।।
অতএব শ্রীগৌরাঙ্গের প্রিয় ভক্তগণে।
মোর আজ্ঞা জানাইয়া আনহ এখানে।।
এত কহি মোর প্রভু হইলা স্তম্ভিত।
ঝাট সৰ্ব্বস্থানে তত্ত্ব দিলা শ্রীঅচ্যূত।।
প্রভুর আজ্ঞা পাতি পাঞা প্রভু বীরচন্দ্র।
শান্তিপুরে আসিলেন লঞা ভক্তবৃন্দ।।
অম্বিকা হইতে আইলা পন্ডিত গৌরীদাস।
নবদ্বীপের ভক্ত যত আইলা প্রভুর পাশ।।
ভক্তগণ লঞা আইলা সরকার ঠাকুর।।
পণ্ডিত প্রবর আইলা কবিকর্ণপুর।।
শ্যামদাস বিষ্ণুদাস শ্রীযদুনন্দন।
আর যত অদ্বৈতের প্রিয় শিষ্যগণ।।
শান্তিপুরে আসি সভে প্রভুর চরণে।
অষ্ট অঙ্গে প্রণমিয়া করিলা স্তবনে।।
প্রভু কহে তোরা সভে মোর প্রিয়তম।
মোর এক বাক্য সত্য করিহ পালন।।
শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর গুণ আর ধৰ্ম্ম।
যথাসাধ্য প্রচারিবা এই মোর মর্ম্ম।।
শ্রীগৌরাঙ্গ-দ্বেষী যত পাষণ্ডী অসভ্য।
তা সভার সঙ্গ ত্যাগ অবশ্য কৰ্ত্তব্য।।
এবে তোরা সভে করি গৌরাঙ্গ কীৰ্ত্তন।
মোর চিত্ত মনোবাঞ্চা করহ পুরণ।।
শুনি সর্ব্ব ভক্তগণের প্রেম উপজিল।
গৌর-নাম গুণ সংকীর্ত্তন আরম্ভিল।।
শ্রীঅচ্যূত কৃষ্ণমিশ্র গোপাল ঠাকুর।।
প্রভু বীরভদ্র নরহরি রস-পুর।।
গৌরীদাস পণ্ডিত আর পণ্ডিত দামোদর।
সাত জনে নৃত্য করে অতি মনোহর।।
গৌরগুণ শুনি প্রভুর প্রেম উথলিল।
সংকীৰ্ত্তন মধ্যে আসি নাচিতে লাগিল।।
ক্রমে সংকীর্ত্তন সিন্ধুর তরঙ্গ বাঢ়িলা।
মহাভাবে শ্রীঅদ্বৈত তাহাতে ডুবিলা।।
স্তম্ভ আদি রত্ন প্রভু সর্ব্বাঙ্গে পরিলা।
কাঁহা প্রাণগোরা বলি কান্দিতে লাগিলা।।
প্রভুর অদ্ভুত ভাব জীবে না সম্ভবে।
প্রভুরে ঘিরিয়া প্রেমে কান্দে ভক্ত সবে।।
তবে প্রভু কহে এই পাইনু গৌরাঙ্গ।
কদম্ব কুসুম সম হৈল তান অঙ্গ।
হঠাৎ মদনগোপালের শ্রীমন্দিরে গেলা।।
প্রাকৃত জনের প্রভু অগোচর হৈলা।
প্রভু চাহি ভক্তগণ ইতি উতি ধায়।
তানে নাহি পাঞা কান্দি ধুলায় লোটায়।।
শ্রীঅচ্যূত বুঝি শ্রীঅদ্বৈত-অন্তৰ্দ্ধানে।
ফুকারিয়া কান্দি কহে সৰ্ব্ব গৌরগণে।।
গৌর-প্রেম কল্পবৃক্ষের এক স্কন্ধ ছিল।
তাহে গৌরের অপ্রকট সম্পূর্ণ নহিল।।
আজি সে গৌরাঙ্গলীলা হৈল সমাধান।
শুনি সৰ্ব্ব ভক্তগণ কান্দে অবিশ্রাম।।
হা গৌরাঙ্গ হা গৌরাঙ্গ হা নিত্যানন্দ।
হায় ভক্ত-অবতার শ্রীঅদ্বৈতচন্দ্র।।
এই বোল বিনু সভার মুখে নাহি আন।
সেই খেদে সত্য সত্য গলয়ে পাষাণ।।
দিবা রাত্রি গেল কার নাহি বাহ্যজ্ঞান।
দ্বিতীয় দিবসে সবে কৈলা গঙ্গাস্নান।।
শ্রীঅচ্যূত প্রভু মহামহোৎসব কৈলা।
মহাপ্রসাদ পাঞা সভে নিজ স্থানে গেলা।।
সওয়া শত বর্ষ প্রভু রহি ধরাধামে।
অনন্ত অর্বুদ লীলা কৈলা যথাক্রমে।।
সে লীলা অমিয়-সিন্ধু দুর্গম্য দুষ্পার।
অনন্ত না পায় অন্ত মুঞি কোন ছার।।
আত্ম-শোধিবারে এই দুঃসাহস কৈনু।
লীলা সিন্ধুর এক বিন্দু ছুঁইতে নারিনু।।
বিদ্যা বুদ্ধি নাহি মোর কৈছে গ্রন্থ লিখি।
কি লিখিতে কি লিখিনু ধরম তার সাথী।।
লাউড়িয়া কৃষ্ণদাসের বাল্যলীলা সূত্র।
যে গ্রন্থ পড়িলে হয় ভূবন পবিত্ৰ।।
যে পড়িনু যে শুনিনু কৃষ্ণদাস মুখে।
পদ্মনাভ শ্যামদাস যে কহিলা মোকে।
পাপ চক্ষে যে লীলা মুঞি করিনু দর্শন।
প্রভু আজ্ঞা মতে তাহা করিনু গ্রন্থন।।
চৌদ্দশত নবতি শকাব্দ পরিমাণে।
লীলাগ্রন্থ সাঙ্গ কৈনু শ্ৰীলাউড় ধামে।।
শ্রীধাম লাউড়ে মুঞি আইনু যে কারণে।
সংক্ষেপে সে গূঢ় তত্ত্ব কহি সাধু স্থানে।।
এক দিন প্রভু মোরে কহে সংগোপনে।
গৌরাঙ্গ বিচ্ছেদ আর সহে না পরাণে।।
ঝাট মুঞি জীব লোকের হৈমু অগোচর।
গৌরনাম গৌরগুণ কর নিরন্তর।।
আর এক কথা কহি শুন সাবধানে।
তুঞি মোর প্রিয় শিষ্য আত্মজ সমানে।।
মোর অগোচরে দুঃখ না ভাবিহ মনে।
গৌরনাম প্রচারিহ মোর জন্মস্থানে।।
এই মোর আজ্ঞা সত্য করিহ পালন।
এত কহি কৈলা প্রভু মৌনাবলম্বন।।
মুঞি ভাবো যদি গুরু-আজ্ঞা রক্ষা হয়।
তবে মোর জন্ম কৰ্ম্ম সফল নিশ্চয়।।
তবে প্রভুর অন্তর্দ্ধানে সীতাঠাকুরাণী।
কি ভাবি এই আদেশিলা কিছু নাহি জানি।।
অরে ঈশানদাস তোরে করি বড় স্নেহ।
মোর তুষ্টি হয় তুই করিলে বিবাহ।।
মুঞি কহিলাঙ মাতা বুঝি আজ্ঞা কর।
এই আজ্ঞা পালিতে নাহিক সাধ্য মোর।।
সপ্ততি বৎসর প্রায় মোর বয়ঃক্রম।
ইথে কোন দ্বিজ কন্যা করিবে অর্পণ।।
মাতা কহে কৃষ্ণ সদা ভক্ত বাঞ্ছা পুরে।
তেঞি ভক্ত বাঞ্ছা কল্পতরু নাম ধরে।।
পূৰ্ব্ব দেশে যাহ শ্রীজগদানন্দ সনে।
বিয়া করাইবে ইহোঁ করিয়া যতনে।।
তাঁহা গৌর গৌর-ধর্ম্ম করিয়া প্রচার।
তাহে বহু জীবগণ হইবে নিস্তার।।
তোমার সন্ততি হৈব মহাভাগবত।
হরিনাম দিয়া জীবে করিবেক মুক্ত।।
শিরে ধরি এই সীতামাতার আদেশ।
জগদানন্দ রায় সঙ্গে আইনু পূৰ্ব্বদেশ।।
বংশরক্ষা করি প্রভুর আজ্ঞা পালিবারে।
ঝাট চলি আইনু মুঞি শ্রীধাম লাউড়ে।।
ইহাঁ রহি এই গ্রন্থ করিনু লিখন।
গুরু-আজ্ঞা মাত্র মুঞি করিনু রক্ষণ।।
সূত্রমাত্র লিখি মুঞি ঐছে আজ্ঞা মতে।
ইথে কিছু দোষ গুণ না রহু আমাতে।।
এই ভিক্ষা মাগোঁ শ্রোতা বৈষ্ণব-চরণে।
মো অধমের অপরাধ ক্ষম নিজগুণে।
মুঞি অতি বৃদ্ধ মোর নাহি কিছু জ্ঞান।।
শ্রীচৈতন্য পদে গ্রন্থ কৈনু সম্প্রদান।
মোর যাহা সাধ্য তাহা করিনু লিখন।।
দয়া করি শোধন করিবে সাধুগণ।
গুরু কৃষ্ণ বৈষ্ণবের শ্রীচরণ সার।
সবাকার পদে মোর কোটি নমস্কার।।
এই তিন এক বস্তু ভিন্ন-মাত্র কায়।
জীব নিস্তারিতে নানারূপে প্রকটয়।।
কুণ্ডল হারেতে যৈছে দৃশ্য রূপান্তর।
স্বর্ণ এক কারণ তাহা জীবের গোচর।।
এই তিন হয় দয়াসিন্ধু অবতরী।
এই তিনের পদ মোর ভব পারের তরী।।
এই তিনের পদে মোর এই নিবেদন।
মহা অপরাধী মুঞি না যায় গণন।।
নিজগুণে অপরাধ করহ মার্জ্জন।
পতিত-পার্বন নাম কর প্রকটন।।
মো সম পতিত আর ত্রিজগতে নাঞি।
অন্তে যেন পাঙ রাঙা শ্রীচরণে ঠাঞি।।
শ্রীচৈতন্য শ্রীঅদ্বৈত পদে যার আশ।
নাগর ঈশান কহে অদ্বৈত-প্ৰকাশ।

ইতি শ্রীঅদ্বৈত-প্রকাশে দ্বাদশোধ্যায়ঃ

মহাপ্রভু শচীসুত শ্রীগৌর-গোবিন্দ।
তাঁর স্কন্ধ শ্রীঅদ্বৈত প্রভু নিত্যানন্দ।।
এই তিন এক আত্মা মোর প্রাণধন।
এই তিনের পদে সদা রহু মোহ মন।।
শ্রীচৈতন্যনিত্যানন্দাদ্বৈতাচন্দ্রেভ্যো নমঃ।

সমাপ্তশ্চায়ং গ্রন্থঃ।।