অদ্বৈতপ্রকাশ – ১৯

ঊনবিংশ অধ্যায়

জয় জয় শ্রীচৈতন্য জয় সীতানাথ।
জয় নিত্যানন্দ-রাম ভক্তগণ সাথ।।
এক দিন শ্রীরূপ দেখিলা স্বপ্নাবেশে।
মহাপ্রভু কহে তারে মৃদু মৃদু ভাষে।।
অহে রূপ অপূর্ব্ব নাটক বিরচিলা।
রাধাশ্যামের দিব্য লীলা তাহে প্রকাশিলা।।
সেই সুমধুর পূব নাটক সুন্দর।
শুনিতে মোহর মনে স্পৃহা হৈল বড়।।
এত কহি শ্রীচৈতন্য হৈলা অন্তর্হিত।
জাগি রূপ প্রেমাবেশে হইলা মুৰ্চ্ছিত।।
কথোক্ষণে ভক্তরাজ পাইয়া চেতন।
কাঁহা শ্রীগৌরাঙ্গ বুলি করয়ে ক্রন্দন।।
ক্ষণে কহে তোর দিব্য-লীলা বুঝা ভার।
ভক্তমান বাঢ়াইতে কৈলা অবতার।।
স্বভক্তেরে দেখা দিতে দয়া উপজিল।
তেঁই স্বপ্নে আসি মোরে আদেশ করিল।।
এত কহি করে রূপ উদ্দন্ড নৰ্ত্তন।
হেন কালে আইলা তথি গোঁসাই সনাতন।।
তিঁহ কহে কহ রূপ শুভ সমাচার।
আজি বুঝি গোরা-প্রেম করিলা বিস্তার।।
রূপ কহে প্রভু তুহু সৰ্ব্ব শাস্ত্রবেত্তা।
দরশন দিতে গোরা স্বপ্নে দিলা বার্তা।।
সনাতন কহে তোহার কোটি ভাগ্যোদয়।
গৌরাঙ্গ দেখিলা প্রভু দেখিবা নিশ্চয়।।
শ্রীরূপ কহয়ে তুঞা আজ্ঞা বেদ সমে।
গৌরাঙ্গ দেখিতে যাঙ শ্রীপুরুষোত্তমে।।
এত কহি সনাতনে দন্ডবৎ করি।
শুভ যাত্রা কৈলা তিহঁ স্মরি গৌরহরি।।
গৌর প্রেমাবেশে চলি আইলা শ্রীক্ষেত্রে।
গৌরাঙ্গ দেখিয়া প্রেম ধারা বহে নেত্ৰে।।
শত অষ্ট অঙ্গ কৈলা চৈতন্যচরণে।
গোরা শ্রীরূপেরে কৈলা দৃঢ় আলিঙ্গনে।।
রূপ কহে মুঞি হঙ অস্পৃশ্য পামর।।
স্পর্শিয়া মোহরে কাহে অপরাধী কর।।
মহাপ্রভু কহে তুহু ভাগবতোত্তম।
তব অঙ্গ হয় মন্দাকিনী গঙ্গা সম।।
শ্রীরূপ কহঁয়ে তুহুঁ দয়া রত্নাকর।
তব দয়া লব সৰ্ব্ব মঙ্গল আকর।।
ভাগ্যে তব পদামৃত গনাস্পর্শে যেই।
সুপবিত্র শ্রীবৈষ্ণবের দেহ ধরে সেই।।
যৈছে শালগ্রাম স্পর্শে কুপ নন্দোদক।
দেবের দুর্লভ সর্ব পাপ বিনাশক।।
মহাপ্রভু কহে এই অতি স্তুতি হৈল।
রূপ কহে ইথে স্তুতির বিন্দু না ছুইল।।
তবে গোরা রায়-রামানন্দ আদি স্থানে।
রূপের শুদ্ধ-বৈরাগ্য কহিলা আপনে।।
রূপ সঙ্গে গৌরগণের আনন্দ বাঢ়িল।
শ্রীগৌরাঙ্গে ঘেরি সংকীর্ত্তন আরম্ভিল।।
মহানন্দে কেহ গায় কেহ করে নৃত্য।
কেহ গোরা বুলি কান্দে হঞা প্রেমোন্মত্ত।।
তাহে গৌর প্রেমসিন্ধুর তরঙ্গ বাঢ়িল।
হরেকৃষ্ণ বলি তিঁহ নাচিতে লাগিল।।
ক্ষণে হর্ষ ক্ষণে স্তম্ভ ক্ষণে স্বেদোম।
ক্ষণে প্রাণনাথ বুলি করয়ে ক্রন্দন।।
হেনমতে ভক্ত সঙ্গে শ্ৰীকৃষ্ণ চৈতন্য।
প্রেমামৃত মেঘে জগতেরে কৈলা ধন্য।।
কতক্ষণে হরি সংকীৰ্ত্তন নিবৰ্ত্তিয়া।
স্ব স্ব গৃহে গেলা সবে গৌর আজ্ঞা লঞা।।
একদিন শ্রীগৌরাঙ্গ ভক্তগণ সঙ্গে।
আনন্দে আছেন বসি সৎ কথা প্রসঙ্গে।।
হেন কালে শ্রীরূপ গোসাঞি তথি আইলা।
অষ্ট অঙ্গে গোরাচাঁদে দন্ডবৎ কৈলা।।
গোরা তারে আলিঙ্গিয়া বসিতে কহিলা।
তিঁহ ভক্তে প্রণমিয়া দূরে বসিলা।।
সৰ্ব্ব অন্তর্যামি শ্রীচৈতন্য মহেশ্বর।
শ্রীরূপে কহয়ে জানি তাহার অন্তর।।
সাধু মুখে শুনিয়াছোঁ তব বিরচিত।
নাটক আছয়ে এক শ্রীকৃষ্ণ চরিত।।
তাহা শ্রীবৈষ্ণব মাঝে করহ পঠন।
শুনিতে মোহর হৈল উৎকণ্ঠিত মন।।
রূপ কহে কাঁহা মুঞি নীচ নরাধম।
কাঁহা কৃষ্ণ লীলা হয় সৰ্ব্ব উচ্চতম।।
পক্ষহীন পক্ষীর শক্তি যৈছে উড়িবারে।
তৈছে এই মুর্খের ক্ষম শাস্ত্র পরচারে।।
শিশু ক্রীড়া সম যাহা কহিনু লিখনে।
তাহা প্রকাশিতে হয় লজ্জা ভয় মনে।।
তথাপি শ্রীমুখের আজ্ঞা লঙ্ঘিতে না পারি।
সভে অপরাধ মোর ক্ষম দয়া করি।।
এত কহি কৈলা রূপ নাটক প্রকাশ।
শুনি সর্ব্ব ভক্তগণের বাঢ়ে প্রেমোল্লাস।।
রামরায় আদি কহে প্রেমে মগ্ন হঞা।
পবিত্র হইলু এই নাটক শুনিঞা।।
এ হেন সুরস কৃষ্ণ নামের মহিমা।
কাঁহা নাহি শুনি পদ্য রচন গরিমা।।
মহাপ্রভু প্রেমানন্দে শ্রীরূপেরে কয়।
এই নাটক দুই ভাগে হৈলে ভাল হয়।।
বিদগ্ধ মাধব আর ললিত মাধব।
এই দুই নামে হয় চিত্তের উৎসব।।
শুনি শ্রীবৈষ্ণবগণ হরিধ্বনি করে।
সেই দুই নামে খ্যাত হৈল চরাচরে।।
শ্রীগৌরাঙ্গ সাঙ্গোপাঙ্গের অবিচিন্ত্য ক্ষণে।
শ্রীরূপের যশ-ডঙ্কা বাজে সৰ্ব্ব স্থানে।।
রূপ গোস্বামীর মহা দৈন্যে নাহি ওর।
সগণ গৌরাঙ্গ প্রেমানন্দে হৈলা ভোর।।
দিন কত শ্রীরূপ তাহাঞি কৈলা বাস।
জগন্নাথ দরশনে বাঢ়ে প্রেমোল্লাস।।
তবে মহাপ্রভু তারে আদেশ করিলা।
আজ্ঞা শিরে ধরি তিঁহ ব্রজধামে গেলা।।
শ্রীগৌরাঙ্গ আর তাঁর ভক্তের মহিমা।
চতুর্মুখ আদি কহি দিতে পারে সীমা।।
সাধু মুখে শুনি মন স্থির নাহি হয়।
তেঁই সূত্র মাত্র গণি কহিনু নিশ্চয়।।
এক দিন মহাপ্রভু অচ্যুতের স্থানে।
ভাগবতের ভক্তি টিকা করিলা বাখ্যানে।।
শ্রীঅচ্যূত কহে এই টিকা সৰ্ব্বোত্তম।
স্বামী ভাষ্য আদির আর নাহি প্রয়োজন।।
সর্ব্ব টিকার সার ইথে ব্যাখ্যাধিক্য হয়।
শুনি শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্য অচ্যুতেরে কয়।।
যাহে বহু সাধুর মহত্ব হয় হানি।
তাহা সংগোপন কর মোর আজ্ঞা মানি।।
শুনি শ্রীঅচ্যুত কহে বিস্ময় অন্তরে।
এই আজ্ঞা শুনি মোর পরাণ বিদরে।।
তব কৃত টিকা এই ভক্তি রাজ্যেশ্বর।
শ্লোকের প্রতিপদে হয় রসের ভান্ডার।।
হেন ভক্তি টিকা প্রচারিতে নিষেধিলা।
সত্য দয়াসিন্ধু নাম আজি প্ৰকাশিলা।।
এত কহি প্রেমানন্দে করয়ে ক্রন্দন।
গোরা তাঁরে প্রেমাশ্রুতে করিলা সেচন।।
আহা শ্রীচৈতন্য দয়া অপার জলধি।
শ্রীঅনন্ত আদি যার না পায় অবধি।।
স্ব গৌরব খণ্ডি গোরা জীবে সুখ দেয়।
হেন দৈন্য কৃষ্ণ কভু না কৈলা আশ্রয়।।
পূর্ব্বে গোরা যবে শাস্ত্র কৈলা অধ্যয়ন।
তর্ক শাস্ত্রের টিকা এক কৈলা বিবরণ।।
সেই টিকা লঞা তিঁহ গঙ্গাপারে যায়।
হেনকালে দ্বিজ এক তাহারে পুছয়।।
তব কক্ষে কোন গ্রন্থ কহ মহাশয়।
ন্যায় শাস্ত্রের টিকা এই শ্রীগৌরাঙ্গ কয়।।
দ্বিজ সেই টিকা দেখি করে হাহাকার।
কহে মোর পরিশ্রম হৈল ছার খার।।
ইহা দেখি মোর টিকার হৈবে অনাদর।
শ্রীগৌরাঙ্গ কহে ভয় নাহি দ্বিজবর।।
সেইক্ষণে দয়ানিধির দয়া উপজিল।
নিজ কৃত টীকা গঙ্গামাঝে ডারি দিল।।
তাহা দেখি সেই দ্বিজ মহানন্দে কয়।
হেন ত্যাগ স্বীকারিতে জীবে না পারয়।
তুমিহ নিশ্চয় সাক্ষাৎ বিষ্ণু অবতার।
তোমার চরণে মোর কোটি নমস্কার।।
এত কহি দ্বিজ হর্ষে করিলা গমন।
গোরা চাঁদের যশ-জ্যোৎস্নায় পূরিল ভুবন।।
শ্রীচৈতন্য লীলা গান অবিচিন্ত্য জানি।
মুঞি কীট লীলা সূত্র পরমাণু গণি।।
তবে শ্রীঅচ্যুতে কহে শচীর নন্দন।
মোর দক্ষ নেত্র কাহে করয়ে স্পন্দন।।
শ্রীঅচ্যূত কহে তুহুঁ সুমঙ্গল হয়।
সৰ্ব্বদা মঙ্গলগণ তেঁাঁহে বিরাজয়।।
বুঝি কোন প্রিয় ভক্তের হৈব শুভোদয়।
সে কারণে ভক্তাধীনের নেত্র বিস্কুরয়।।
হেনকালে ব্রজ হইতে ভাগবতোত্তম।
গৌর আগে আসি দান্ডাইলা সনাতন।।
তাহে দেখি শ্রীগৌরাঙ্গ প্রেমানন্দে কয়।
কৃষ্ণ নিত্য ভক্তের সিদ্ধ বাক্য সুনিশ্চয়।।
শ্রীঅচ্যূত কহে তুহুঁ মনের নিয়ন্তা।
নাদ রূপে স্থিতি কৈলে জীবে হয় কৰ্ত্তা।।
শুনি মহাপ্রভু কৈলা শ্রীবিষ্ণু বরণ।
গৌরে দেখি প্রেমাবিষ্ট হইলা সনাতন।।
স্তম্ভ স্বেদ রোমঞ্চাদি করিয়া ধারণ।
প্রেমাশ্রুতে গৌর পদ কৈলা প্রক্ষালন।।
বাহু পশারিয়া গোরা তারে আলিঙ্গিলা।
তিঁহ কহে মোরে মহা অপরাধী কৈলা।।
একে মুঞি হঙ মহা অস্পৃশ্য অধম।
তাহে গাত্রে কণ্ডুরসা ঘৃণার ভাজন।।
মহাপ্রভু কহে কতি তুয়া কণ্ডুরস।
সুনিৰ্ম্মল দেহ দেখি যৈছে সূৰ্য্য ভাস।।
শুনি সনাতন নিজ তনু নিরীখয়।
অরোগ দেখিয়া মনে হইল বিস্ময়।।
অচিন্ত্য কৃষ্ণচৈতন্যের কৃপা স্বীকারিলা।
ঊর্দ্ধবাহু হঞা প্রেমে নাচিতে লাগিলা।।
সৰ্ব্ব ভক্তগণে হর্ষে করয়ে গর্জ্জন।
মহাপ্রভু আরম্ভিলা নাম সংকীৰ্ত্তন।।
কেহ খোল বাজায় কেহ বা করতাল।
কেহ প্রেমে হাসে কান্দে যৈছে মাতয়াল।।
ক্রমে সংকীর্ত্তন সিন্ধুর তরঙ্গ বাঢ়িল।
প্রেমাবেশে শ্রীগৌরাঙ্গ তাহে ডুবি গেল।।
ক্ষণে অশ্রু ক্ষণে কম্প ক্ষণে অচৈতন্য।
ক্ষণে হরি বুলি কান্দে ক্ষণে করে দৈন্য।।
বহু ক্ষণে নাম-সংকীৰ্ত্তন নিবৰ্ত্তিয়া।
আসনে বসিলা গোরা ভক্তগণ লঞা।।
তবে সনাতন গৌরে পুছে মৃদু স্বরে।
ধৰ্ম্ম মধ্যে সনাতনধর্ম্ম কহি কারে।।
মহাপ্রভু কহে তুহুঁ ভাগবতাত্তম।
সৰ্ব্ব শাস্ত্রবেত্তা সৰ্ব্ব বুদ্ধ্যে বিচক্ষণ।।
তথাপিহ পুছিলা সজ্জন ব্যবহারে।
সৎসঙ্গলাপে সাধুর বাঞ্ছা নাহি পুরে।।
শ্রীবৈষ্ণব-ধৰ্ম্ম কহি সনাতন ধর্ম।
তাহা বিনা আনে কহে উপধর্ম সম।।
শ্রীবৈষ্ণব-ধৰ্ম্ম নিত্য-সিদ্ধ বেদে কয়।
উপধর্ম্ম শিব প্রচারিলা কৃষ্ণাজ্ঞায়।।
শিবাজ্ঞা বিফল নহে গৌণে-কাৰ্য্যে সিদ্ধি।
বক্র পথে গতিশীলের যৈছে শ্রম বৃদ্ধি।।
বহু জন্মে অন্য দেব উপাসনা ফলে।
বিষ্ণুমন্ত্র লভ্য হয় চিত্ত-শুদ্ধি হৈলে।।
বিষ্ণু কল্পতরুসম ভক্ত ইচ্ছা দ্বারে।
অতি সুদুর্লভ মোক্ষাদি দান করে।।
সনাতন কহে বুঝিলাঙ স্থূল মৰ্ম্ম।
অনাদি সুসিদ্ধ হয় শ্রীবৈষ্ণব ধৰ্ম্ম।।
মহাপ্রভু কহে শ্রীবৈষ্ণব ধৰ্ম্মোত্তম।
মুখ্য হরিনামে রুচি কহে সাধুগণ।।
ইত্যাদি অনেক ভক্তি তত্ত্ব উঘাড়িলা।
সনাতন আদি ভক্ত মহা হৰ্ষ হৈলা।।
তবে শ্রীমজ্জগন্নাথের রথযাত্রা যোগে।
নানা দেশ হৈতে যাত্রী আইলা একযোগে।।
গৌড়দেশী যাত্রী আইলা মহাপ্রভুর গণ।
নিত্যানন্দ শ্রীঅদ্বৈত আদি ভক্তজন।।
নিজগণ পাঞা গোরা আনন্দিত হৈলা।
ক্রমে সর্ব্ব ভক্তদের কুশল পুছিলা।।
সর্ব্বে গৌরে প্রণমিয়া মঙ্গল কহিলা।
ক্ৰমে শ্রীচৈতন্য সভাকারে আলিঙ্গিলা।।
মহাপ্রভু তবে সৰ্ব্ব ভক্তগণ সঙ্গে।
তীর্থরাজ সিন্ধুস্নান কৈলা অতি রঙ্গে।।
গণ সহ কৈলা জগন্নাথ দরশন।
সভে মেলি কৈলা মহাপ্রসাদ ভক্ষণ।।
কি আনন্দ হৈল তাহে কহনে না যায়।
যার কোটি ভাগ্য সেই দেখিবারে পায়।।
তবে মহাপ্রভু বক্তা শ্রোতা ভক্তগণ।
ব্রজগোপীর ভাব শ্রেষ্ঠ করয়ে বর্ণন।।[১]
শুনি ভক্তগণ শুদ্ধ প্রেমেতে মাতিলা।
গৌর সঙ্গে মহা সংকীর্ত্তন আরম্ভিলা।।
বহু সম্প্রদায়ে বাজে খোল করতাল।
ঊর্দ্ধবাহু হঞা কেহ নাচয়ে রসাল।
অদ্বৈত নাচয়ে ভাল আগে তাঁরে দিলা।
মধ্যে গৌর নিত্যানন্দ নাচিয়া চলিলা।।
পিছে ভক্তগণ নাচে রোমাঞ্চিত হঞা।
অঙ্গ ভঙ্গী করে কত প্রেমেতে মাতিয়া।।
অপূর্ব্ব করিলা নৃত্য লোকের বিস্ময়।
গন্ধৰ্ব্ব নিছিয়া সভে হরিগুণ গায়।।
সংকীৰ্ত্তন-সুধা পিয়া ভকত-চকোর।
কেহ প্রেমাবেশে কান্দে কেহ দেয় কোর।।
কেহ ভাবাবেশে মাতি অট্ট অট্ট হাসে।
মূৰ্চ্ছা হঞা পড়ে কেহ মহা প্রেমাবেশে।।
অদ্ভূত কীৰ্ত্তনানন্দে দেবে আকর্ষয়।
কত পাপী তরি গেল নামের ভেলায়।।
রথযাত্রা দিনে হৈল মহা-মহোৎসব।
বর্ণিতে নাহিক ক্ষম তার এক লব।।
আগে চলে সুভদ্রা মায়ের রথখানি।
পিছে বলরামের রথ চলয়ে আপনি।।
জগন্নাথের রথ টানে লক্ষ লক্ষ জনে।
নড়াইতে নাহি পারে তার এক কোণে।।
আশ্চৰ্য্য মানয়ে তাহে সৰ্ব্ব যাত্রিগণ।
হাসি মহাপ্রভু ডুরি কৈলা আকর্ষণ।।
তান স্পর্শমাত্র রথ বেগেতে চলিল।
সৰ্ব্ব জনে মহানন্দে হরিধ্বনি কৈল।।
করয়ে অপূর্ব্ব লীলা জগন্নাথ-হরি।
যেই তাঁরে দেখে সেই যায় ভব তরি।।
যে যৈছে ভাবয়ে জগন্নাথের স্বরূপ।
দয়া করি তাহে হরি দেখার তৈছে রূপ।।
কেহ দেখে কৃষ্ণমূর্তি কেহ ও বামন।
বেদে কহে পুন তার নাহিক জনম।।
যদি কেহ সারাক্ষণে বিষয় চিন্তয়।
তাহাই দেখয়ে কৃষ্ণে দেখিতে না পায়।।
শ্রীজগন্নাথের দিব্যলীলার নাহি পার।
মহাপ্রসাদের শক্তি দেব অগোচর।।
চন্ডালে আনিলে অন্ন ব্রাহ্মণেতে খায়।
দ্বিধা করিলে মহাব্যাধি তখনই জন্ময়।।
শ্রীমহাপ্রসাদ যদি কুক্কুরাদি খায়।
তার মুখ-ভ্রষ্ট প্রসাদ দেব-ভোগ্য হয়।।
মহাপ্রসাদের গুণ অচিন্ত্য অক্ষয়।
শ্রীঅনন্ত আদি তার অন্ত না জানয়।।
যে জন মহাপ্রসাদ লব মাত্র খায়।
সৰ্ব্বপাপে মুক্ত হঞা শ্রীবৈকুণ্ঠে যায়।।
শ্রীপুরুষোত্তমে যৈছে প্রসাদ মহিমা।
ঐছে কাঁহা নাহি শুনি প্রসাদ গরিমা।।
মুঞি অতি ক্ষুদ্র কীট নাহি মোর ক্ষম।
সূত্র পরমাণু মাত্র করিনু লিখন।।
রথযাত্রা অন্তে গৌর ভক্তগণে ডাকি।
কহে তোরা বহু দুঃখ পাইলা মোর লাগি।।
পুন পুন হেথা আসি নাহি প্রয়োজন।
দেশে রহি কর সদা নাম বিতরণ।।
নিত্যধর্ম্ম প্রচারিতে তোমা সভার জন্ম।
জীবন সফল কর প্রচারিয়া ধৰ্ম্ম।।
দিন কত গূঢ় স্থানে করিমু সেবন।
তবে মোর হয় সর্ব্ব অভীষ্ট পূরণ।।
নিত্যানন্দে বিবাহ করিতে আদেশিলা।
গৌর আজ্ঞায় ভক্তবৃন্দ নিজ দেশে গেলা।।
নিগূঢ় স্থানেতে গোরা প্রবেশ করিয়া।
হরিনাম করে সদা প্রেমে মগ্ন হঞা।।
প্রিয় ভক্তে দেখি কহে হরিনাম সার।
হরিনাম বিনা জীবের গতি নাহি আর।।
নাম কর নাম চিন্ত নাম কর সার।
নামের সহিত হরি করছে বিহার।।
যেই নাম সেই হরি নাহি কিছু ভেদে।
ইহা সপ্রমাণ কহে পুরাণাদি বেদে।।
এবে শুন ব্রহ্ম হরিদাসের নির্মাণ।
যিহ প্রতিদিন করে তিন লক্ষ নাম।।
হরিনামে ঔছে রুচি নাহি দেখোঁ আর।
সৰ্ব্ব ভক্তগণে জন্মাইলা চমৎকার।।
হরিদাস মনে নিজ নির্মাণ জানিয়া।
সংকীৰ্ত্তন মাঝে আসি পড়িলা শুতিয়া।।
মহাপ্রভুর পাদপদ্ম হৃদয়ে ধরিলা।
শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য বলি পরাণ ত্যজিলা।।
দেখি শ্রীগৌরাঙ্গ করে উচ্চ হরিধ্বনি।
ভক্তগণ কহে ইহোঁ সাধু শিরোমণি।।
চৌদিগে শ্রীহরি নামের বাতাস উঠিল।
সংকীৰ্ত্তন ঢেউ তবে বাঢ়িতে লাগিল।।
শ্রীচৈতন্য প্রেমানন্দ সিন্ধুতে ডুবিলা।
সৰ্ব্ব ভক্তগণ তাহে সাঁতার খেলিলা।।
তবে গোরা হরিদাসের সমাধি করিয়া।
মহা মহোৎসব কৈলা আনন্দিত হঞা।।
দয়ার সাগর শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু।
হেন দয়াল অবতার নাহি শুনি কভু।।
সর্ব্ব অবতারি গোরা সর্ব্বশক্তিমান্।
লোক নিস্তারিতে এই লীলার নিধান।।
ব্রহ্মার সুদুর্লভ শুদ্ধ প্রেম আর নাম।
দয়া করি যাচি দিলা নাহি স্থানাস্থান।।
শ্রীগুরু গৌরাঙ্গ পদে কোটি নমস্কার।
তাঁর দয়া লব প্রার্থী হঙ নিরন্তর।।
শ্রীচৈতন্য শ্রীঅদ্বৈত পদে যার আশ।
নাগর ঈশান কহে অদ্বৈত-প্ৰকাশ।।

ইতি শ্রীদ্বৈত-প্ৰকাশে ঊনবিংশোহধ্যায়ঃ।

১. ‘বন্দে নন্দ ব্রজস্ত্রীনাং’…ইত্যাদি