এ এক অদ্ভুত আলোক, ঊষা কিংবা গোধূলি, ঠিক বোঝা যায় না। ছায়া ছায়া, হিম, পট পরিবর্তনের সামান্য চঞ্চলতা মাখা। দীর্ঘ ঘুম অকস্মাৎ ভাঙলে যেমন হয়, সব কিছুই অচেনা লাগে, বিপুল ব্ৰহ্মাণ্ডের মধ্যে নিজের ক্ষুদ্র অস্তিত্বের অবস্থানটা ঠিক ঠাহর হয় না। ঈষৎ শীতের আমেজে গায়ে লেপটে থাকে একাকিত্বের আলোয়ান, মনে হয়। আর কেউ নেই, অথবা আত্মীয় বন্ধু শুভার্থীরা অন্য কোথাও এক স্থানে জড়ো হয়ে ডাকছে, এসো, এসো…শুধু একজনেরই সেখানে পৌঁছোতে দেরি হয়ে যাচ্ছে।
সেই রকম আলো আজ ছড়িয়ে আছে নগরীতে।
প্রকৃতি চলে নিজের নিয়মে, তেমনই এই জীবন। দ্বিপ্রহরে কালো মেঘ কিংবা কাক-জ্যোৎস্নায় প্রকৃত আলো-অন্ধকারের রূপের কোনো হেরফের হয় না। অপরাহ্নর পর ঠিকই সন্ধ্যা নামে।
রাত্রির প্রথম প্রহরে সকলেই জেগে থাকে। সদ্য অন্ধকার হওয়া রাজপথ মাঝে মাঝে জুড়িগাড়ির সহিসের তল্পিদারের হাতের মশালের আলোয় ঝলসে ওঠে। কোনো কোনো বৃহৎ অট্টালিকার ঝাড়লন্ঠনের বিচক্ষুরিত আভা এসে বাইরে পড়ে। পগারের পাশ দিয়ে সাবধানে কোঁচা সামলিয়ে বাড়ি ফিরছেন হৌসের বাবুরা। অবস্থাপন্ন বাবুরা তখন বাড়ি থেকে নিৰ্গত হচ্ছেন ফেটিং, সেলফ ড্রাইভিং, বগি বা ব্ৰাউহামে, ফ্রেণ্ড ও মোসাহেবদের সঙ্গে নিয়ে হাওয়া খেতে।
বেলফুলওয়ালা তার ধামায় গুছিয়ে রাখছে তার সন্ধের সওদা। দিন-আনি দিন-খাইরা মুদি দোকানে চাল কেনবার জন্য ভিড় জমিয়েছে।
শোনা যাচ্ছে শঙ্খের ফুঁ, কাসর ও ঘন্টার আওয়াজ। পূজিত হচ্ছেন বড় বড় অট্টালিকাগুলির গৃহদেবতা এবং বিভিন্ন হরিসভা, কীর্তন সভা ও মন্দিরের দেবদেবীগণ। ব্ৰাহ্ম সমাজগুলির কয়েকটিতে উপাসকেরা জড়ের মতন নিস্তব্ধ-একমাত্র তাদের আচাৰ্যরা অনর্গল সরব। অন্য কোথাও সদ্য ধ্ৰুর্তিত ভক্তিরস, নাচ-গান ও কীর্তনে ভক্তেরা প্রায় উম্মদ, কেশবচন্দ্র সেনকে অনেকে স্বয়ং চৈতন্যজ্ঞানে তাঁর পা জড়িয়ে ধরে কাঁদছে।
মসজিদে মসজিদে শেষ নামাজের পর মুসলমানদের পৃথক পৃথক জটলা, তাদের ভুরুর নিচে প্রগাঢ় ছায়া, বক্ষে আহত অভিমান। নতুন রাজশক্তির সঙ্গে হিন্দুদের কাঁধ ঘেঁষাঘেঁষিতে এত দিন পর্যন্ত তাদের চক্ষে ছিল বিদ্যুপচ্ছটা, এখন দুশ্চিন্তা। লুপ্ত মৰ্য্যদা পুনরুদ্ধারের জন্য অনেকের হৃদয় ফুঁসছে, কেউ কেউ গা ভাসিয়ে দিচ্ছে হিন্দুদের সঙ্গে, কেউ কেউ এতদিন পর মনে করছে, এবার সন্তানদের মাদ্রাসা থেকে ছাড়িয়ে ইংরেজি শেখার ইস্কুলে আর ভর্তি না করালেই নয়।
গীর্জাগুলির শান্ত গভীর পরিবেশে চলেছে সুমহান গান। কৃষ্ণাঙ্গ ধর্মান্তরিতরা এই স্বপ্নে মশগুল যে, এখন তারাও বুঝি রাজার জাতের সমান। হঠাৎ বিদেশী শিক্ষার আলোয় চক্ষু ধাঁধিয়ে যাওয়া যুবক, পথভ্রষ্টা কিংবা নিযাতিতা রমণী এবং শত শত অনাহারক্লিষ্ট মানুষ শরণ নিচ্ছে করুণাময় প্ৰভু যীশুর। রোমান ক্যাথলিক, প্রটেস্টান্ট এবং অন্যান্য ডিনোমিনেশানের চার্চের প্রতিনিধিদের মধ্যেও শুরু হয়েছে সূক্ষ্ম প্রতিযোগিতা, কে কত বেশী অজ্ঞ ভারতীয়কে অন্ধকার থেকে আলোয় নিয়ে আসবে।
সাহেবপাড়ার আদর্লিরা দ্বিতলের খোলা বারান্দায় ছোট বেতের টেবিলের ওপর সযত্নে সাজিয়ে রাখছে শেরি, শ্যাম্পেন, ব্র্যাণ্ডির বোতল এবং নানাবিধ ক্রকারি। গড়ের ময়দানে রাইডিং সেরে এসে তাদের মনিব শ্রান্তি মোচনের জন্য চোটা পেগ-এর হুকুম দেবেন। মেম বিবিরা শয়নকক্ষের দেয়ালে সাঁটা বিশাল বেলজিয়াম দর্পণের সামনে দাঁড়িয়ে প্রসাধন সারবার আগে প্রায় মুক্ত-বসনা হয়ে শরীরের ঘামচিগুলি মেরে নিচ্ছে। ভ্যাপসা গরমের দেশে এই এক জ্বালা।
উচ্চবর্ণের রাজপুরুষগণ সপ্তাহান্ত ব্যারাকপুরের প্যালেসে কাটাবার উদ্দেশ্যে যাত্রার জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন। সেখানে ভাইসরয়ের পার্শ্বচর হয়ে মধ্যরাত্ৰে শৃগাল শিকার উৎসবে অংশ নিতে হবে।
সিমলে, হাটখোলা, আহিরীটোলা, বাগবাজারের বনেদী বাবুরা প্ৰকাণ্ড দিবানিদ্রা থেকে উঠে বিশ্রাম করে নিচ্ছেন একটু। নব্য বাবুদের বাড়ির ভিতর মহলে ঠাকুরঘরে শুরু হয়েছে সন্ধ্যারতি, মাইনে করা পুজুরি বামুন এসে নারায়ণ শিলার গায়ে গাঁদা ফুলের ঠোক্কর মেরে দ্রুত কাজ সরছে। আর বার-মহলে নব্যবাবু তাঁর সতীর্থদের নিয়ে নানা উচ্চাঙ্গের বিষয় ডিসকাশন করছেন।
সেই রকম এক আলোচনার নমুনা :
এক নব্যবাবু জানালার সামনে দাঁড়িয়ে বাইরের মন্থর সন্ধ্যা ও পথের ধারে পুকুরের জলে গাছগুলির অপসৃয়মান রক্তিম ছায়া দেখে প্রাকৃতিক দৃশ্য উপভোগ করতে করতে বললেন, কী বিউটিফুল সীনারি! এ যেন কাণ্টস্টেবল-এর আঁকা ওয়াটার কলারের এক ছবি!
তাঁর এক সুহৃদ প্রায় আর্তনাদ করে উঠলেন, ওহে, কী বল্লে? কী বল্লে? ও নাম অমুনভাবে প্রনানসিয়েট কত্তে নেই।
-কোন নাম?
—ঐ যে আর্টিস্টের নামটি বললে। ও নামের প্রথম সিলেবলটি যে রুচি-দুষ্ট, অশ্লীল!
প্রথম বাবুটি প্রথমে একটু দমে গেলেও ইংরেজি জ্ঞানে তাঁর কোনো বন্ধুর কাছে হেরে যাবার পাত্র নন। তিনি হো-হো করে হেসে উঠে বললেন, ও, তুমি কাণ্টস্টেবল-এর বদলে সেই থিংসটেবলের ব্যাপার বলচো? এ যে দেখি সাক্ষাৎ মিসেস গ্র্যাণ্ডি! জানো, শেক্সপীয়ার ঐ অবসীন শব্দটি কীভাবে ম্যানেজ করেছিলেন? টুয়েলফথ নাইটে আচে, বাই মাই লাইফ, দিস ইজ মাই লেডীজ হ্যাণ্ড! দিজ বী হার সিজ (বড় হাতের সি, বুঝলে?) হার ইউজ, (এটাও ক্যাপিটাল) অ্যাণ্ড হার টিজ (টি ক্যাপিটাল, আর ঐ অ্যাণ্ড-এর মধ্যে এন আছে)…তা হলে কী হলো?
—আরো ছি, ছি, ছি, ছি। ওটাই তোমার মনে পড়লো? শেক্সপীয়রই কি ঐ শব্দটির বদলে ডিয়ারেস্ট বডিলি পার্ট কিংবা পিকিউলিয়ার রিভার ব্যবহার করেননি?
—হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ! ডিয়ারেস্ট বডিলি পার্ট…পিকিউলিয়র রীভর…কী চমৎকার লাইভলি ডেসক্রিপশান! এও তো ছবি!
এইভাবে আলোচনা আরও উচ্চ থেকে উচ্চতর দিকে চললো। বাবুদ্বয় ইংরেজি জ্ঞানের পরাকাষ্ঠা দেখাতে লাগলেন। এবং মস্তিষ্ককে চাঙ্গা করবার জন্য খোলা হলো ব্র্যাণ্ডির বোতল।
শহর গড়িয়ে ছড়িয়ে পড়ছে শহরতলী। সাবেকী আমলে যেখানে ছিল ব্যবসায়ী থেকে রূপান্তরিত নগরবাসী জমিদারদের বাগানবাড়ি, এখন সে সব স্থান আর তেমন নিরালা নেই, ব্যাঙের ছাতার মতন গজিয়ে উঠছে ছোট ছোট বাড়ি, গ্রাম থেকে আসা এক পুরুষের চাকুরিজীবীরা সেখানে স্থায়ী আস্তানা গেড়ে বসছে। তাদের চাহিদা অনুযায়ী আসছে রজক, পরামানিক, তন্তুবায় প্রভৃতি। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সুবাদে ক্ষুদ্র কৃষকেরা জমি থেকে উৎখাত হয়ে পরিণত হচ্ছে ভূমিহীন দাসে, দিন মজুরির আশায় তারাও শহরে আসছে স্রোতের মতন। শুধু বাংলা নয়, উড়িষ্যা, বিহার, এমনকি সুদূর উত্তরপ্রদেশ থেকে।
শহরতলীর বাইরে গ্রাম। রোদুর মিলিয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গেই সেগুলি নিস্তেজ। শত সহস্ৰ যোজনব্যাপী সেই অন্ধকার নিস্তব্ধতা।
শহর আছে, শহরতলী আছে, গঞ্জ, গ্রাম আছে, কিন্তু দেশ নেই। কাবুল-কান্দাহার থেকে কন্যাকুমারিকা, বীমা দেশ থেকে দ্বারকা পর্যন্ত ইংরেজ বেঁধে রেখেছে শাসন শৃঙ্খলে, কিন্তু এটা কার দেশ? সিসিলি দ্বীপের এক উগ্ৰ চরিত্রের পুরুষের সঙ্গে প্যারিস শহরের এক সুশিক্ষিত, নম্র, রুচিবান নাগরিকের যতখানি অমিল, একজন আফ্রিদি, বেলুচিস্থানের পাঠানের সঙ্গে আসামের কোনো ভদ্র বৈষ্ণব গৃহস্থের অমিল তার চেয়ে ঢের গুণ বেশী। এরা কেউ কারুকে চেনে না। তবু এরা এক দেশের নাগরিক হিসেবে পরিচিত। এই অলীক দেশের অবস্থান নেই। কারুর মনে। তবু কেউ দেশ খোঁজে মহাভারতের পৃষ্ঠায়, কেউ মুঘল ইতিহাসে, কেউ বা সার্ভে অফিসের মানচিত্রে।
এই বিপুলাকার ভৌগোলিক পরিধির মধ্যে রয়েছে কয়েকটি অতি ক্ষুদ্র দ্বীপ। সেই সব দ্বীপে রাত্রির প্ৰদীপ জ্বালিয়ে এক একজন চিন্তা করে যাচ্ছে ধর্ম সংস্কারের, শিক্ষা বিস্তারের, নারী-মুক্তির, নিজস্ব সংস্কৃতির জাগরণের, রাজা-প্ৰজা সম্পর্কের উন্নতির, দারিদ্র্য নিবারণের কিংবা চরিত্র পরিশুদ্ধির। স্বাধীন দেশের নাগরিক হবার অতি গোপন স্বপ্নও ঝলসে উঠছে কারুর কারুর চক্ষে। অবশ্য সেই সব আলো তাদের নিজ গৃহের আঙিনা ছাড়িয়ে আর বেশী দূর যেতে পারে না। তবু কয়েকটি প্ৰদীপ জ্বলছে।
প্ৰদীপের চেয়েও শহুরে উৎসবের আলোর রোশনাই চক্ষু ধাঁধিয়ে দেয়। রাত্রির দ্বিতীয় প্রহর ভোগীদের জন্য নির্দিষ্ট, এখন চলেছে তাদের তাণ্ডব।
রানী এলিজাবেথ জলদস্যু দলপতিদের নাইট উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন, কারণ তারা এনেছিল ইংলণ্ডের জন্য ধন-সম্পদ। বর্তমান মহারানী ভিকটোরিয়া আগে থেকেই লর্ড বা ব্যারণ উপাধি দিয়ে নিজস্ব প্রতিনিধি প্রেরণ করছেন এই ভারতভূমিতে; যাদের কাজ আরও অনেক বেশী ব্যাপক, লুণ্ঠন কার্যের সভ্য মার্জিত রূপ দেওয়া। এই মুহূর্তে ব্যারাকপুরের সুরমা কাননের মধ্যে নয়নবিমোহন বৃটিশ-পসন্দ প্রাসাদের ভোজকক্ষে বড় লাট লর্ড মেয়ো সপরিষদ পানাহারে ব্যস্ত। টেবিলে সামান্য আদব-কায়দার ত্রুটি হলে তিনি বিরক্ত হন। তাঁর পোশাকে, চলনে-বিলনে সূক্ষ্ম রুচি ও আভিজাত্যের পরাকাষ্ঠী, তাঁর সুন্দর মুখশ্ৰী দেখে কে বলবে যে তিনি আসলে একটি সুশিক্ষিত দস্যু দলের সর্দার হয়ে এখানে বিরাজ করছেন! তাঁর স্বজাতীয় ইতিহাস লেখকরাই আবার নাদির শা, তৈমুর লংকে দস্যু আখ্যা দিয়ে হীন করেছে, যদিও মহারানীর প্রতিনিধিদের তুলনায় নাদির, তৈমুর নিতান্তই শিশু!
লুণ্ঠনের সময় স্থানীয় কয়েক জনের সাহায্য পেলে কিছুটা সুবিধে হয়। তারাও লুন্ঠিত সম্পদের ছিটেফোঁটা ভাগ পায়। সেই ছিটেফোঁটার ভাগীদাররাই এখন দেশীয় সমাজের শিরোমণি ধনী। ঐশ্বর্যের আকস্মিকতায় বিহ্বল ভাবটা তাদের এখনো কাটছে না। অর্থব্যয়ের জন্য তাদের স্মৃতিতে আছে নবাবী আমলের বিলাস। সুতরাং তারই অনুকরণের চেষ্টা চলছে প্ৰাণপণে। এ রমণী ভোগ শুধু রতি সুখের জন্য নয়, এ সুরাপান নয় ইন্দ্ৰিয়ে আগুন জ্বালাবার জন্য, এ সব কিছুই অপরের চক্ষু ঝলসে দেবার উদ্দেশ্যে। তাই এত বেশী বেশী। এত ক্লেদাক্ত, এত অপৌরুষেয়। নেটিভপাড়ার ঝাড়বাতির আলো ঝলমল বাড়িগুলিতে এখন চলছে বিলাসের নামে নতুন ক্লাব ধনীদের দাপাদাপি। আসলে তারা দুঃখী। তার আমনে মনে জানে, তারা চোর কিংবা ছিঁচকে তস্কর, কোনোক্রমেই তারা শ্বেতাঙ্গ দস্যুদের সমকক্ষ হতে পারবে না। বালক যেমন বাঁশের কঞ্চি দিয়ে তলোয়ার বানিয়ে মনে মনে সেনাপতি সেজে দারুণ বিক্রমে দুপাশের ভেরেণ্ডা গাছ নিধন করে সেই রকমই এই সব উটকে বড় মানুষরা নিজেদের বিবেক খোওয়া গেছে বলে পয়সা ছড়িয়ে যত পারে অন্য মানুষের বিবেক চুৰ্ণ করে যাচ্ছে। ব্যতিক্রম দু-চার জন মাত্র।
মধ্যরাত্রির রাজপথে হঠাৎ হঠাৎ শোনা যায় অনেক মানুষের কোলাহল ও হাসির গররা। বাঘের পশ্চাতে ফেউ-এর মতন কোনো নেশাখের বড় মানুষের সঙ্গে চলেছে গাদাগুচ্ছের দালাল ও ফড়ে। এ দৃশ্য দেখলেই বোঝা যায়, আবার বাঙালদেশ থেকে কোনো উট্কো জমিদার শহরে এসে পয়সা ছড়াচ্ছে। পূর্ব বাংলার কোনো ধনী এলে শহুরে ফন্দীবাজদের মধ্যে বড় ধুম পড়ে যায়। এদের দুচারটি উৎকট বাতিক সহ্য করতে হয় বটে। কিন্তু এদের চিবিয়ে, চুষে, নিঙড়িয়ে সর্বস্বান্ত করতে বেশী দেরি লাগে না।
রাত্রির পর ভোর আসে। প্রতিটি ভোরই প্রতীক্ষ্ণর, মনে হয় নতুন কিছু ঘটবে।
নবীনকুমার বিভ্ৰান্তিকর আলোর স্বরূপ চিনে যেতে পারলো না। জীবনের শেষ কথাটি উচ্চারণ করে অপরাহ্ন তার চেতন্য বিলুপ্ত হয়েছিল, তার হৃৎস্পন্দন থেমে গেল পরদিন প্রত্যুষে। তার সৌন্দৰ্য-পিপাসু মন পূর্ণ যৌবনে এসে একটা বাঁক নিয়েছিল, অকস্মাৎ তাকে চলে যেতে হলো।
বেলা এখন দশটা। সারা বাড়ি সম্পূর্ণ নিস্তব্ধ। সম্মিলিত কান্নার ধ্বনি থেমে গেছে কিছুক্ষণ আগে, এখন যেন কারুর চলাফেরারও কোনো শব্দ নেই। সব কটি ঘরের দরজা এবং সিংহদ্বার হাট করে খোলা। শোকের বাড়ি দেখলেই চেনা যায়।
সরোজিনী অজ্ঞান হয়ে আছে, তার মাথাটি কোলে নিয়ে পাষাণ মূর্তির মতন বসে আছে কুসুমকুমারী। তার দৃষ্টি একেবারে স্থির। পা টিপে টিপে অন্য স্ত্রীলোকেরা এসে উঁকি দিয়ে দেখে যাচ্ছে সেখানে। কেউ কেউ ফিসফিসিয়ে কথা বলছে। কিন্তু কুসুমকুমারীর যেন বাহ্যজ্ঞান নেই। তার কানের কাছে দামামা ধ্বনির মতন বাজছে একটি নাম, এটা যে তারই অপর একটি নাম তাও ঠিক বলা যায় না, কারণ, এই নাম ধরে তো কেউ কোনোদিন তাকে ডাকেনি! তার পুতুল খেলার সঙ্গী, ভাগ্যচক্ৰে যে একদিন তার দেবর হয়েছিল, সে কি মৃত্যুকালে তাঁকে ঐ নাম ধরে ডাকলো, না নামটা শুধু মনে করিয়ে দিল? এ নামের যে কী সার্থকতা, তা তো কুসুমকুমারী জানে না। তার জীবনেরই বা কী সার্থকতা? এই প্রশ্ন কিছুদিন ধরেই কুসুমকুমারীর চিন্তায় ঘুরে ঘুরে আসছে। মানুষ বেঁচে থাকে কোন প্রত্যাশায়? তার জীবনটার বদলে কি নবীনকুমার বেঁচে থাকতে পারতো না? কাল সারা রাত কুসুমকুমারী ঈশ্বরের কাছে সেই প্রার্থনাই করেছে ব্যাকুলভাবে, হে ঠাকুর, আমার জীবনের কোনো মূল্য নেই, আমার জীবনের বিনিময়ে ওঁকে বাঁচিয়ে তোলো! হে ত্ৰিলোকেশ্বর, হে বিপন্নপালক, হে করুণাময়। আমার এই অকিঞ্চিৎকর জীবনটা নিয়ে আপনি ওঁকে পৃথিবীতে রাখুন। উনি অনেক মানুষকে দেখবেন, আমি কাকে দেখবো?
কুসুমকুমারীর চক্ষু এখন শুষ্ক, কিন্তু যতক্ষণ অচেতন নবীনকুমারের বক্ষে প্ৰাণের ক্ষীণ স্পন্দনটুকু ছিল, সে তার সব অশ্রু ঈশ্বরের কাছে নিবেদন করেছে। কিন্তু তিনি বধির ও দৃষ্টিহীন, অথবা সামান্য কোনো নারীর অশুর কোনো মূল্য নেই তাঁর কাছে।
সিংহদ্বারের কাছে এবার খানিকটা গুঞ্জন শোনা গেল, কয়েক জন ছুটে গেল সেদিকে। কুসুমকুমারী একই রকম অনড়ভাবে বসে রইলো।
বাইরে পাল্কী থেকে নামলেন বিধুশেখর। এখন তিনি সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারেন না, তাঁর নাতি প্ৰাণগোপাল সঙ্গে এসেছে, তিনি তার স্কন্ধে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে মুখ তুলে দেখলেন সিংহসদনের দিকে।
বিম্ববতীর গৃহত্যাগের পর তিনি আর এ গৃহে আসেন নি। অনেক বছর হয়ে গেল। এক সময় এখানে প্রতিদিন না এলে তাঁর চলতো না। বিম্ববতী চলে যাবার পর থেকেই বিধুশেখরের শারীরিক অবস্থার দ্রুত অবনতি হতে থাকে। এই শতাব্দীর ঠিক প্রথম বছরে তাঁর জন্ম। এমন কী-ই বা বয়েস হয়েছে তাঁর, শতাব্দী শেষ হতে এখনো অন্তত তিরিশ বছর বাকি। হয়তো সেই পর্যন্ত এমন পঙ্গু অবস্থাতেই বিধুশেখর বেঁচে থাকবেন।
সমগ্র প্রাসাদটির ওপর বিধুশেখর তাঁর এক চক্ষুর দৃষ্টি বোলালেন। এতদিন পরে এলেও এখনো এ-বাড়ি তাঁর নিজের বাড়ি বলে মনে হয়। এ বাড়ির মানুষদের নিয়তিও তাঁর করায়ত্ত ছিল, তিনি ইচ্ছে করলে এই অট্টালিকা ধুলোয় মিশিয়ে দিতে পারতেন যে-কোনো দিন।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিধুশেখর বললেন, চল।
সিঁড়ি দিয়ে উঠতে এখন তাঁর শরীরের সব কটি হাড়ের জোড়ে অসম্ভব যন্ত্রণা হয়। মুখবিকৃতি না করেও কয়েক ধাপ সিঁড়ি উঠেই তিনি হাঁপাতে লাগলেন।
গঙ্গানারায়ণ ছুটে এসে অন্য দিক থেকে তাঁকে ধরতে আসতেই তিনি হাত তুলে বললেন, থাক, থাক, আমি নিজেই পারবো।
বিধুশেখর এখনও গঙ্গানারায়ণের স্পর্শ বাঁচিয়ে থাকতে চান! বরাবরই তিনি যত দূর সম্ভব অন্যের স্পর্শ বাঁচিয়ে চলেন। তাঁর নাতি প্ৰাণগোপাল এখন বেশ বলিষ্ঠকায় কিশোর। সেও একলা দাদুকে টেনে তুলতে পারছে না।
বিধুশেখর আবার দুধোপ উঠলেন। হাঁপরের মতন ওঠা-নমা করতে লাগলো তাঁর বুকের পাঁজরা।
গঙ্গানারায়ণ বললো, এক কাজ কল্লে তো হয়, আপনি একটা চেয়ারে বসুন, তারপর কজনে সেই চেয়ারসুন্ধু আপনাকে তুলে নিয়ে যাবে।
এ প্রস্তাবে আপত্তি না জানিয়ে বিধুশেখর চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলেন।
গঙ্গানারায়ণ নিজে ছুটে ওপরে গিয়ে তার পিতার লাল রেশমি গদি মোড়া মেহগনি কাঠের কেদারাটি নিয়ে এলো। বিধুশেখরকে সেটাতে বসিয়ে তিন-চারজন মিলে ধরাধরি করে নিয়ে এলো নবীনকুমারের ঘরে।
ধপধাপে সাদা চাদরে গলা পর্যন্ত ঢাকা, হাত দুটি বক্ষের ওপরে আড়াআড়ি, নিমীলিত-চক্ষু নবীনকুমারকে দেখলে মনে হয়, কেউ নাম ধরে জোরে ডাকলেই সে জেগে উঠবে।
কেদারা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বিধুশেখর চলে এলেন নবীনকুমারের শিয়রের কাছে। তারপর তাঁর ঠোঁট দুটি নড়তে লাগলো। যেন তিনি কোনো কথা বলছেন, কিন্তু কণ্ঠ দিয়ে কোনো স্বর বেরুচ্ছে না।
ঘরে বহু লোক এসে ভিড় করেছে। বিধুশেখরকে সমীহ মিশ্রিত ভয় করে না এমন কেউ নেই। সেই জন্য কেউ কোনো শব্দ করছে না এবং সকলেই চেয়ে আছে বিধুশেখরের দিকে।
একবার মুখ ঘুরিয়ে খানিকটা উদভ্ৰান্তের মতন বিধুশেখর মানুষগুলিকে দেখলেন। তাঁর মুখে শোক-তাপের কোনো ছাপ নেই। তিনি যেন কাকে খুঁজছেন। তারপর তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, এ কে? এ কি সত্যিই আমাদের সেই ছোটকু?
এ প্রশ্নের কোনো উত্তর হয় না, তাই সকলেই নীরবে রইলো। পিছন দিকে ফুঁপিয়ে উঠলো কজন। শোকের বাড়িতে সকলেই যে শোকে কাঁদে তা নয়। কাঁদতে হয় বলেও অনেকে কাঁদে।
—ছোটকুর এমন কঠিন ব্যামো হয়েছে, আমায় কেউ কোনো খবর দেয়নি কেন?
এ প্রশ্নেরও কোনো উত্তর হয় না। শয্যাশায়ী, রুগ্ন বিধুশেখরকে আগে খবর দিলে সুরাহা তো কিছু হতো না, বরং তাঁকেই অকারণে উদ্বিগ্ন করা হতো।
নাতির দিকে ফিরে বিধুশেখর বললেন, গোপাল, ছোটকুকে যে আমি তোর মতন বয়েসী দেকেচিলুম, বড় দুরন্ত, বড় তেজী। কিন্তু কী মেধা! তারপর কবে সে এত বড়টি হলো, কিচুই তো মনে পড়াচে না! আমায় কিচু না জানিয়ে ও চলে গেল? অ্যাঁ?
প্রাণগোপাল বললো, দাদু, আপনি অন্য কোনো ঘরে বসবেন চলুন।
বিধুশেখর শুষ্ক স্বরে বললেন, হ্যাঁ, তাইচ। আমি আর এখেনে থেকে কী করবো।
বৃদ্ধ দিবাকর এসে বললো, বড়বাবু, বলচিলুম। কি…।
দিবাকর বুঝেছে যে বিধুশেখর যখন এসে পড়েছেন, তখন পরবর্তী কাৰ্যকলাপগুলি সম্পর্কে তাঁর মতামত নিয়েই ব্যবস্থা করতে হবে। নইলে তিনি ক্রুদ্ধ হবেন।
দিবাকর আবার বললো, বলচিলুম কী, বাইরে আরও লোকজন এসেচে, এখুন। অনেক লোক আসবে। তাই জন্য খাটখানা ধরে নিচে নিয়ে রাকলে হয় না?
বিধুশেখর বললেন, তা ঠিক। অনেক লোক আসবে, শহর ভেঙে পড়বে। ছোটকু কত লোককে বিনিময়সায় মহাভারত দিয়েছে। কত মানুষের সাহায্য করেচে…
প্রাণগোপাল আবার বলল, দাদু, আপনি অন্য ঘরে চলুন, সেখেনে বসে কতা বলবেন—
বিধুশেখর আর একবার মুখ ফিরিয়ে ভূতপূর্ব নবীনকুমারকে দেখলেন।
তারপর একেবারেই অকস্মাৎ প্রাণগোপালকে ছেড়ে তিনি ঝাঁপিয়ে পড়লেন নবীনকুমারের শবের ওপর। নদীর বাঁধ ভাঙা বন্যার মতন তীব্ৰ হাহাকারে কান্নায় তিনি বলতে লাগলেন, ছোটকু, ছোটকু, তুই চলে গেলি। ওরে, আমার মুখাগ্নি কে করবে? ছোটকু… ছোটকু… ওরে, তুই যে আমার সব… আমাদের কত পুণ্যের ফলে তুই আমাদের ঘরে এসেছিলি…ছোটকু, ছোটকু। তুই তোর মায়ের কাচে যাচ্চিস…আমাকে ফেলে গেলি…।
এই সুদীর্ঘ জীবনে বিধুশেখর কম মৃত্যু দেখেন নি। সবাই বলে, ওঁর বুকখানা পাথর দিয়ে গড়া। তাঁর চোখের সামনে তার স্ত্রী ও কন্যারা শেষ নিঃশ্বাস ফেলেছে, তাঁর ঘনিষ্ঠতম সুহৃদ রামকমল সিংহ শেষ চক্ষু বুজেছেন তাঁরই কোলে মাথা রেখে, তবু কখনো তিনি স্থৈৰ্য হারান নি। সেই বিধুশেখরকে এমনভাবে ভেঙে পড়তে কেউ কোনোদিন দেখেনি। সারা বাড়ি থেকে লোক ছুটে এলো এই অবিশ্বাস্য দৃশ্য দেখবার জন্য।
নবীনকুমারের মুখখানি চেপে ধরে প্রবল কান্নার সঙ্গে বিধুশেখর ঐ কথাগুলিই বলে চলেছেন। তাঁকে টেনে তোলা যায় না।
শেষ পর্যন্ত জোর করেই তাঁকে তুলে আনতে হলো। কারণ পোস্তার রাজার এক ভাই ও রানী রাসমণির জামাতা মথুরামোহন বিশ্বাস নবীনকুমারকে শেষ দেখার জন্য এসেছেন। আরও অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তি অপেক্ষা করছেন নিচে।
বিধুশেখরকে এনে শুইয়ে দেওয়া হলো অন্য একটি কক্ষে। তিনি কিছুতেই বাড়ি যাবেন না। এখানে সব শেষ হওয়া পৰ্যন্ত থাকবেন। তিনি বালকের মতন অবোধ হয়ে পড়েছেন। মাথা ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে বলছেন, না, না, না, তোরা আমায় যেতে বলিস না।
বার বার তিনি উঠে নবীনকুমারের কাছে যেতে চান। তাঁকে ধরে বসে রইলো প্ৰাণগোপাল।
সেই অবস্থায় বিধুশেখর রইলেন মধ্য দুপুর পর্যন্ত। তখন শোনা গেল এবার মৃতদেহ বাড়ির বার করা হবে। পুরোহিতগণ সেই রকমই নির্দেশ দিয়েছেন। সে কথা শুনে বিধুশেখর বললেন, তিনি আবার দেখতে যাবেন ছোটকুকে।
শয্যায় উঠে বসে তিনি এক হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে অশ্রু মার্জনা করতে লাগলেন। ধীরে ধীরে তাঁর মুখখানি বদলে যেতে লাগলো। তাঁর সুস্থ চক্ষুটিতে ঝিলিক দিল পুরোনো কালের ব্যক্তিত্ব। একটু সামলে নেবার পর তিনি কঠোর গলায় বললেন, শুধু তাই নয়, আমি শ্মশানেও যাবো। ছোটকু অপুত্রক অবস্থায় মরেচে, আমি তার মুখাগ্নি কর্বে। গোপাল, তুই গিয়ে গঙ্গাকে বল—।
গঙ্গানারায়ণের এখন কান্নাকাটি করার অবকাশ নেই। সব কিছুর বন্দোবস্ত করার জন্য তার দিশেহারার মতন অবস্থা। অবশ্য দ্বিপ্রহরের পর তার বন্ধুদের মধ্যে গৌরদাস, রাজনারায়ণ ও বেণী এসে পড়েছেন। তাঁরা পরামর্শ দিতে লাগলেন।
একটি নতুন পালঙ্ক, নতুন গদি-বালিশ-চাদর ও ফুলমালা দিয়ে প্রস্তুত করা হয়েছে। শেষ শয্যা। নবীনকুমারকে সাজানো হয়েছে। বর-বেশে, এখনো তার মুখখানি তাজা। কয়েকজন মিলে যখন ধরাধরি করে নবীনকুমারের শরীরটি তুলছে, তখন প্ৰাণগোপাল সেখানে দাঁড়িয়ে।
প্ৰাণগোপাল এখন প্রেন্সিডেন্সি কলেজে অধ্যয়ন করে, অতিশয় মেধাবী ছাত্র। এই বয়েসেই সে রুশো-ভলতেয়ারের রচনা পড়ে ফেলেছে এবং কোঁৎ-এর পজিটিভিজমের তুলনায় সে রুশোর সাম্যতত্ত্ব বেশী পছন্দ করে। নবীনকুমার অনুবাদিত মহাভারতও সে পড়েছে। নবীনকুমারকে সে ছোট মামা বলে ডাকতো। কিন্তু নবীনকুমারের সঙ্গে তার ঠিক ঘনিষ্ঠতার সুযোগ হয়নি। দূর থেকেই সে নবীনকুমারের প্রতি ভক্তিমিশ্ৰিত অনুরাগ পোষণ করেছে।
প্ৰাণগোপাল দেখলো, নবীনকুমারকে তোলার পর তার প্রাক্তন শয্যা থেকে একটি কাগজ উড়ে গিয়ে নিচে পড়ল। কাগজটি নবীনকুমারের শরীরের তলায় চাপা পড়ে ছিল। তাতে অনেক কিছু লেখা। তার ওপর ছিটে ছিটে রক্ত লাগা। তবু, কৈশোরের কৌতূহলে সে তুলে নিল কাগজটি।
কিন্তু তখনই কাগজটির লেখাগুলি পাঠ করার সুযোগ সে পেল না। সেই মুহূর্তে একটি গোলযোগ ঘটলো।
আলুথালু পোশাকের একটি লোক ছুটে এসে দু হাত তুলে নৃত্য করতে লাগলো, ঘরের মধ্যে। নবীনকুমারের দেহের প্রতি বুকে পড়ে সে বলতে লাগলো, ওহে নবীন, ভুল, ভুল! তুমি যা বলোচো, তাও ভুল! দেবেন্দ্ৰবাবু, কেশববাবুও ভুল বলেচেন। ভগবান নেই। বুঝলে, নেই, নেই! শালা খিদেই হচ্ছে ভগবান। খিদের চেয়ে আর বড় কিছু নেই!
চেহারা আর ভাবভঙ্গি দেখে অন্যদের চিনতে পারার কথা নয় যে এই লোকটিই যদুপতি গাঙ্গুলী। অনাহার ও অপমানের জ্বালায় কিছুদিন আগে তার এক ভাগিনেয় আত্মঘাতী হয়েছে। সেই থেকেই যদুপতির মস্তিষ্ক বিকৃতির লক্ষণ দেখা দিয়েছে একটু একটু।
যদুপতিকে ঠেলে সরিয়ে দেবার পর একজন মন্তব্য করলো, একটা আশ্চর্যের ব্যাপার কী জানো, এরকম কোনো বিশিষ্ট মানুষের মৃত্যু হলেই দু-চারজন লোক পাগলা হয়ে যায়। এরকম আমি অনেকবার দোকিচি।
শবযাত্রা শুরু হবার পর বিধুশেখর সত্যিই জেদ ধরে গেলেন শ্মশানে। তাঁকে তোলা হলো একটি পাল্কীতে। প্ৰাণগোপাল আর গেল না। এ বাড়ির অন্দরমহলে সে খুবই কম এসেছে, এখন ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলো।
কুসুমকুমারীর কোল থেকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে সরোজিনীকে। কুসুমকুমারী। তবু সেইরকম জোড়াসানে বসে আছে একই জায়গায়। কয়েকজন স্ত্রীলোক তাকে নানা কথা বলে তোলবার চেষ্টা করছে, কিন্তু কুসুমকুমারী নিশ্চুপ। দ্বারের পাশে দাঁড়িয়ে প্রাণগোপাল কুমকুমারীকে একটুক্ষণ দেখলো, তার মনে হলো, ইনিই কি সদ্য বিধবা হয়েছেন?
শ্মশানের কাজ শেষ হলো অনেক রাত্রে। নিজের কক্ষে এসে শুতে যাবার আগে সেজবাতিটি নেভাতে গিয়ে প্ৰাণগোপালের মনে পড়লো সেই কাগজটির কথা। সে কামিজের পকেট থেকে কাগজটি এনে মেলে ধরলো আলোর সামনে।
কাগজটিতে নবীনকুমারেরই হস্তাক্ষর, তবে খুবই কাঁপা কাঁপা। অসুস্থ অবস্থায় একেবারে শেষ দিকে নবীনকুমার এতে লিখেছে, হয়তো সবাই যখন ঘুমন্ত সেই সময়ে জেগে ওঠে, বুকের প্রদাহ ভুলবার জন্য।
…আমি পুরোপুরি ভোগের মধ্যে কখনো ড়ুব দিতে পারিনিকো। কেউ যেন আমার ঘাড় ধরে পেছোনে টেনেচে, আবার পুরোপুরি মোহমুক্ত হতেও পারিনি, কেউ যেন আমায় ঠেলে দিয়েছে মোহের দিকে।
…এক দুর্ভাগা জাতির আমি সন্তান, যে জাতি আজিও পর-পদানত। এখন আমি নিজেকে দিয়া সেই জাতির সকলকে বিচার করিতেছি। আমি অনেক সময়েই কোন দিক সম্মুখ আর কোন দিক পশ্চাৎ-অপসারণ তাহা চিনতে পারি নাই।
…এ অজ্ঞানের ঘোর কবে কাটিবে? পূর্ব পুরুষের পাপ আমারে দংশিল কি?
…ধৰ্ম বলো, জাতি বলো, শিক্ষা বলো আর সাহিত্য বলো, যদি সকলকে এক সঙ্গে জড়াইতে না পারে, তা হইলে কোনো সুফল নাই…আর, আমার বুকে বড় ব্যথা, এ কি আমার সব ভুলের জন্য? হ্যাঁ, ভুল করিচি, আবার ঠেকে শিকোচিওতো বটে…চন্দ্রনাথের নিকটে যে রমণীকে দেখিয়াছিলাম, কেন তাহার কথা এখনো এত মনে পড়িতেছে? তিনি আমার কে?…
…খুব বাসনা ছিল পরের শতাব্দীটি দেখে যাবো…কতই বা দূর! সেই এক রাত্রে ঘন ঘন তোপধ্বনির মধ্যে এই শতাব্দীর অবসান হইয়া বিংশ শতাব্দী আসিবে-মনশ্চক্ষে যেন দেখিতে পাই…তাহা কত আলোকোজ্জ্বল…কত আনন্দময়ী…হে অনাগত যুগ, তোমার জয় হউক!
…মরিতে ইচ্ছা করে না, যে-যাহাই বলুক, আমার একেবারেই মরিতে ইচ্ছা করে না! আমায় বাঁচিয়ে দাও, আমায় বাঁচিয়ে দাও, বড় সাধ…
এলোমেলো এবং অসমাপ্ত রচনা। প্ৰলাপের সময় নবীনকুমার যা বলছিল যেন তারই বাকি অংশ। প্ৰাণগোপাল সেই লেখাগুলি পাঠ করলো কয়েকবার।
কৈশোর বড় আত্মকেন্দ্রিকতার সময়। এই বয়েসে মানুষ শুধু ব্যক্তিগত দুঃখ ছাড়া অপরের দুঃখ সম্পর্কে মনোযোগ দিতে চায় না। কৈশোরে আগুন বড় বেশী। কান্না সেজন্য কম। আজ সারাদিনে প্ৰাণগোপাল একবারও অশুপাত করেনি। এখনো সে কাঁদলো না। ঐ কাগজখানি হাতে নিয়ে সে জানলার কাছে দাঁড়িয়ে রইলো অনেকক্ষণ। শত শত তোপধ্বনির মধ্যে আলোকোজ্জ্বল বিংশ শতাব্দীর পদপাতের কথাটাই তার মনে লেগেছে বেশী। যেন সে সেই দিনটি দেখতে পাচ্ছে। তার চোখে এসে লাগছে সেই সুদূরের অন্যরকম আলোর আভা।
।।সমাপ্ত।।