সারাদিন পরিশ্রম, তার উপরে রাত্ৰি জাগরণ ও মাত্ৰাহীন সুরাপানের ফলে এক সময় নবীনকুমার গুরুতর পীড়ায় শয্যাশায়ী হলো। সপ্তাহকালের মধ্যেই জীবনসংকট দেখা দিল তার, বড় বড় চিকিৎসকরা হতাশ হলেন। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের বিশিষ্ট বন্ধু, প্ৰখ্যাত চিকিৎসক দুর্গাচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ও নবীনকুমারকে দেখতে এসে বেশ চিন্তিত হয়ে পড়লেন, তিনি হরিশ মুখুজ্যের চিকিৎসা করেছিলেন, নবীনকুমারের রোগে যেন হরিশেরই লক্ষণ দেখতে পেলেন। কিন্তু হরিশের তবু সাঁইত্রিশ বৎসর বয়স হয়েছিল, নবীনকুমারের যে সবে মাত্র তেইশ!
সাহেব ডাক্তাররা এসে নিয়মমাফিক ঔষধ দিয়ে গেছেন, দুজন কবিরাজকে এনেও দেখানো হয়েছে। ছোট ভাইয়ের চিকিৎসার জন্য গঙ্গানারায়ণ পরামর্শ নিয়েছে শহরের শ্রেষ্ঠ বিশেষজ্ঞদের কাছে। দ্বারকানাথ ঠাকুরের খরচে যে-দুজন বঙ্গসন্তান প্রথম বিলাতে ডাক্তারি পড়তে যায়, তাদের মধ্যে একজন সূৰ্যকুমার চক্রবর্তী। খ্রিস্টিয়ান হয়ে ফিরে এসে সূৰ্যকুমার গুডিভ চক্রবতী নাম নিয়েছেন। বর্তমানে দেশীয় চিকিৎসকদের মধ্যে তাঁরই সবচেয়ে বেশী নাম ডাক। এই সূৰ্যকুমারের সঙ্গে গঙ্গানারায়ণের পূর্ব থেকেই পরিচয় ছিল, সুতরাং সূৰ্যকুমারের মতামতের ওপরেই বেশী নির্ভর করতে লাগলো সে।
সূৰ্যকুমার একদিন গঙ্গানারায়ণকে নিভৃতে বললেন, মিঃ সিংহ, আমি আপনাকে একটি প্লেইন টুথ বলতে চাই। যে-কোনো রোগেই, যত ভালো মেডিসিনই থাক, সবেত্তিম ঔষধ হলো উইল টু লিভ, উইল টু সারভাইভ-এই উইল পাওয়ারের মতন ঔষধ আর নেই। আপনার কনিষ্ঠের মধ্যে সেইটিই আমি ল্যাকিং দেকচি।। হোয়াই-দিস ইয়াং ম্যান ইজ সো মোরোজ! একটি কথা পর্যন্ত বলে না–
গঙ্গানারায়ণ বললো, শরীর খুবই দুর্বল হয়ে পড়েচে।
সূৰ্যকুমার বললেন, এমন উইক নয় যে বাকশক্তি নেই, এমন ফীবল নয় যে কতা শুনতে পাবে না! অথচ সে আমাদের কোনো প্রশ্নের উত্তর দেয় না, আমাদের কতা শুনতে পাচ্ছে কি না, তাও বোঝা যায় যা…
—ডক্টর চক্রবর্তী এর প্রতিকার তো আপনাকেই কত্তে হবে।
—দিস ইয়ং ফেলো ইজ অ্যানাদার ভিকটিম অব ইনটেমপারেন্স, তা তো বোঝাই যাচ্চে! সাচ ইজ দি স্যাড স্টেট অফ অ্যাফেয়ার ইন আওয়ার কান্ট্রি যে ভালো ভালো ইয়ংম্যানেরা বিলাতি প্রথার মোহে-সে। যাক, কিন্তু বয়েস বেশী হয়নি, লীবারটি এমন কিছু ড্যামেজড় হয়নি যে সারিয়ে তোলা যাবে না। কিন্তু এই নৈরাশ্য কেন? অর্থ-সম্পদ, সুখ-ভোগ কোনো কিচুরই অভাব নেই কো।
—কিন্তু ও তো এমন কিচু বেশী ড্রিঙ্ক করে না। কত হুমন্দো হুমন্দো মাতাল দিবারাত্র বোতল সেবা করে, তারপরও তারা অনেক বয়স পর্যন্ত দিব্য চলে ফিরে বেড়ায় আর ছোটকু তো মাত্র কয়েক মাস…
—সেই কতাই তো বলচি! এক্ষেত্রে মোস্ট ইম্পট্যান্টি হচ্চে উইল পাওয়ার…একটি রোগ আচে, তার নাম মেলানকোলিয়া, প্ৰাচীন গ্ৰীস দেশের উচ্চবংশীয় ব্যক্তিদের এই রোগ হতো, অতিরিক্ত সুখভোগ ও স্বেচ্ছাচার থেকে এই জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণা রোগ জন্মায়—
—ডক্টর চক্রবর্তী, আমার ভাইটি যে নিছক ভোগী ও স্বেচ্ছাচারী নয়, তা নিশ্চয় আপনি জানেন? কত বড় মহৎ অন্তঃকরণ তার, দেশের লোক তার নামে ধন্য ধন্য করে, সে প্ৰতিভাবান।
—তবু এ রোগের লক্ষণ দেখে মেলানকোলিয়াই বোধ হয়। আমার। আমাদের চিকিৎসাশাস্ত্ৰে এ ব্যাধির কোনো দাওয়াই নেই। এ বিষয়ে আপনি আমাদের রেসপেকটেড সীনিয়র কলিগ দুর্গামোহনবাবুর সঙ্গে কনসালট্ করতে পারেন।
—তিনিও তো দেকচেন।
—তিনি আপনাদের ফ্যামিলি ফ্রেণ্ড, তিনি যদি পারেন। আপনার ভাইকে কতা বলতে, তবেই উন্নতি সম্ভব। আমার কোনো প্রশ্নের তো সে জবাবই দেয় না!
একথা ঠিকই, অসুস্থ হবার পর থেকে নবীনকুমার কারুর সঙ্গে বিশেষ কথা কয় না। সরোজিনী বা গঙ্গানারায়ণের শত প্রশ্নের সে শুধু হুঁ-হাঁ উত্তর দেয়। কয়েক বৎসর পূর্বে নবীনকুমার কঠিন পীড়ায় শয্যাশায়ী হয়ে শ্রবণ ক্ষমতা একেবারেই হারিয়ে ফেলেছিল। এবার তার তেমন কিছু হয়নি, চক্ষু-কর্ণ-নাসিকা ইত্যাদি ইন্দ্ৰিয়গুলি সম্পূর্ণ সজাগই আছে, কিন্তু যে-কোনো কারণেই হোক, সে তার জিহ্বার ব্যবহার করতে নারাজ। এবারে তার রোগের প্রধান উপসর্গ বমি। কিছু তার পেটে সহ্য হয় না, যে-কোনো খাদ্য, এমনকি ঔষধ পর্যন্ত গলাধঃকরণ করলেই সে উগরে দেয়। কোনো চিকিৎসকই এই বমি বন্ধ করতে পারছেন না। শরীর একেবারে কঙ্কালসার হয়ে বিছানার সঙ্গে মিশে আছে, শুধু তার চক্ষুদুটি অত্যুজ্বল। মুখখানিতে বিমৰ্ষতার কালিম লিপ্ত। যতক্ষণ জাগ্রত অবস্থায় থাকে, সে শুধু ঘরের কড়িকাঠ দেখে।
কোনো প্রবল দুঃখ বা অভিমানে যে নবীনকুমার জীবন ত্যাগের সঙ্কল্প নিয়েছে, তাও নয়। কোনো অভিযোগ নেই তার, কোনো দাবি নেই। এমনিই তার আর কিছু ভালো লাগে না। তার মতন চঞ্চল ও জেদী স্বভাবের যুবকের এই আকস্মিক পরিবর্তনই সকলের কাছে অস্বাভাবিক লাগে। কথা বলে না কেন সে?
সরোজিনী মনের দিক থেকে আজও প্রাপ্তবয়স্ক হয়নি। যে-কোনো বিপদেই সে শুধু পাশবদ্ধ পক্ষিণীর মতন ছটফট করতে জানে। তার এমন রূপবান, গুণবান স্বামী, অথচ গত দু-এক বৎসর ধরেই সে সরোজিনীর প্রতি কেমন যেন নিরাসক্ত হয়ে পড়েছে। কী করে স্বামীকে ফেরাতে হয়, সে বুদ্ধি তার নেই। নবীনকুমারের নিদারুণ অসুখের সংবাদ শুনে তার পিত্ৰালয়ের লোকেরা ছুটে এসেছে। কিন্তু তারা আসায় হইচই হাঙ্গামাই বেড়েছে। এ বাড়িতে, গঙ্গানারায়ণ চিকিৎসার ব্যাপারে তো কোনো কিছু বাদ রাখেনি!
গঙ্গানারায়ণ বারবার কাতরভাবে জিজ্ঞেস করে, তোর কী হয়েচে, ছোটকু, আমায় খুলে বল। ডাক্তাররা তো বলেচেন, তুই সেরে উঠবি! বমি বন্ধ হলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। তবু তুই এত মন-মরা হয়ে থাকিস কেন? কী হয়েচে তোর মনে?
নবীনকুমার সংক্ষিপ্তভাবে বলে, কিচু না!
—তোর কিচু খেতে ইচ্ছে করে? কারুকে দেকতে ইচ্ছে করে? ওস্তাদ ডাকবো, তুই গান শুনিবি?
–নাঃ!
—হাওয়া ফেরাবার জন্য তুই কোতাও যেতে চাস?
–নাঃ!
—সবি না না করিস কেন? তুই কী চাস বল! লক্ষ্মী ভাইটি আমার, তোর মনের মধ্যে কী আচে আমায় বল!
—কিচু না!
এইভাবে কী করে আর কথা চালানো যায়। তবু গঙ্গানারায়ণ হার মানে না। নিজের স্ত্রী কুসুমকুমারীকেও সে বলেছে নবীনকুমারের সেবা করতে। সরোজিনীর সঙ্গে কুসুমকুমারী এই কক্ষে প্রায়ই এসে বসে থাকে। তার সঙ্গেও কথা বলে না। নবীনকুমার। এর আগে কুসুমকুমারীর বিবাহের পর এ বাড়িতে যে-কয়েকবার তার সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছে, নবীনকুমার তাকে সম্ভ্রমের সঙ্গে বৌঠান ও আপনি বলে সম্বোধন করেছে। কুসুমকুমারী যে এক সময় তার প্রথমা পত্নীর মিতেনী ছিল, সে সম্পর্ক সে অস্বীকার করেছে।
কুসুমকুমারী কৌতুক করতে চেয়েছে তার সঙ্গে, দেবরের সঙ্গে সে তো কৌতুক করতেই পারে। কিন্তু নবীনকুমার আমল দেয়নি। হরিশের মৃত্যুর পর থেকেই সে পারিবারিক জীবন সম্পর্কে উদাসীন।
দুর্গাচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রতিদিনই একবার করে আসেন। অন্যান্য রোগী দেখার পাট চুকিয়ে এখানে আসতে তাঁর একটু রাত হয়। নবীনকুমারের শয্যার শিয়রের পাশে তিনি চিন্তিত ও বিষণ্ণ মুখে বসে থাকেন। এমন রোগ তাঁর আগে চোখে পড়েনি। সামান্য বমি থামানো যাচ্ছে না। এ ভেদ বমিও নয়, তাহলে তিনদিনের বেশী কাটতো না। কোনো আহাৰ্যই পেটে না গেলে এ রোগী বাঁচবে কী করে?
দুর্গাচরণের মনে পড়ে, এই নবীনকুমারেরই হাতে-খড়ির সময় তিনি আচার্য হয়ে এসেছিলেন বিদ্যাসাগরের সঙ্গে। তখন এ পঞ্চমবর্ষীয় বালক। সেই বয়সেই কী চমকপ্ৰদ ছিল এর ব্যবহার, একদিনেই ইংরেজী-বাংলা বর্ণমালার একটি করে অক্ষর লিখে দেখিয়েছিল। তারপর থেকে তিনি এই বালকটির উত্থান লক্ষ করছেন। এর সব কিছুই এর বয়েসের তুলনায় অতি অগ্রসর। ত্রয়োদশ বৎসরে এ স্থাপন করেছে বিদ্যোৎসাহিনী সভা, চতুর্দশ বৎসরে স্বগৃহে মঞ্চ বেঁধে এমন নাটকের অভিনয় করলো, যাতে সাহেবরা পর্যন্ত তাজ্জব। সে নিজেই ছিল পরিচালক ও নায়ক। পঞ্চদশ বৎসরে সে তারও ওপরে হলো স্বয়ং নাট্যকার। অষ্টাদশ বৎসরে সে হাত দিল মহাভারত অনুবাদের মতন সুবিশাল কাজে। সেই যুবকের এই পরিণতি! তেইশ বৎসর বয়সে সে অতিরিক্ত মদ্যপানের ফলে যকৃৎ আহত করে শয্যাশায়ী। চক্ষু দুটি ব্যতীত সম্পূর্ণ নিষ্প্রাণ মুখ, যেন হতাশার প্রতিচ্ছবি! অতিরিক্ত প্ৰতিভাবানদের কি এমনই হয়? তাদের মেধা ধারণ করার মতন ক্ষমতা শরীরের থাকে না!
বিদ্যাসাগর মহাশয়ও নবীনকুমারের এই রূপান্তরের কথা শুনে খুব দুঃখ পেয়েছেন। দুর্গাচরণের কাছ থেকে তিনি নিয়মিত সংবাদ নেন নবীনকুমারের। তিনি দুর্গাচরণকে সখেদে বলেছেন, বুনিয়াদি বংশগুলির মধ্যেই বুঝি এই অভিশাপ আছে, বাপ-পিতামহর ধারা ছাড়তে পারে না কিছুতেই। তবে যাই বলো, ঐ ছেলেটির ওপর আমি ঠিক রাগ করতে পারি না।
দুর্গাচরণ মাথা ঝুঁকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, বাবা নবীন, শুনলুম তো আজ সারাদিনে তুমি এককণা খাদ্যও গ্রহণ করো নি। এখন একটু ঘোলের সরবত খাবে?
নবীনকুমার বললো, না।
দুর্গাচরণ বললেন, একেবারে কিছু না খেলে কী করে চলে? বমির ভয় পাচ্ছে তো? এক বাটি ঘোল খেয়েই দ্যাখো না।
–নাঃ।
—একেবারেই ইচ্ছে নেই!
–নাঃ।
দুর্গাচরণ চমকে উঠলেন। নবীনকুমারের মুখে কিসের গন্ধ? এ তো ব্র্যাণ্ডি ছাড়া কিছু নয়!
—নবীন, তুমি আবার মদ্যপান শুরু করেছে?
নবীনকুমার চুপ!
দুর্গাচরণ নিচু হয়ে দেখলেন, পালঙ্কের তলায় ফরাসী কনিয়াকের একটি বোতল রক্ষিত আছে। কী সর্বনাশের কথা! যে রোগীর উদরে একদানা অন্ন নেই, সে করছে। মদ্যপান! এ যে বিষ! ঘরে কোনো গেলাস বা জলের পাত্রও নেই, অর্থাৎ কোনো সময়ে নিরালা পেয়ে নবীনকুমার ঐ বোতল থেকে নির্জলা চুমুক দিয়েছে।
কাছেই দাঁড়িয়ে ছিল গঙ্গানারায়ণ, তার দিকে চেয়ে তিনি বললেন, এ সব কী? এ যে ছেলেটাকে একেবারে মেরে ফেলার পাকা ব্যবস্থা! কে ওকে ঐ ব্র্যাণ্ডির বোতল এনে দিয়েছে?
গঙ্গানারায়ণ তখনই লোকজন ডাকাডাকি ও হইচই শুরু করে দিল। এবং আসামী খুঁজে পেতে মোটেই বিলম্ব হলো না। কে আর নবীনকুমারকে ব্র্যাণ্ডি এনে দেবে, অতি প্ৰভুভক্ত দুলালচন্দ্র ছাড়া? দুলালচন্দ্ৰ তো এ কক্ষের দ্বারের পাশে প্রায় সর্বক্ষণই দণ্ডায়মান থাকে।
একটু জেরা করতেই দুলালচন্দ্র স্বীকার করে ফেললো, সে কী করবে, সে তো জীবনে কখনো নবীনকুমারের কোনো হুকুম অমান্য করে নি! প্ৰভু চাইলেও সে দেবে না, তার ঘাড়ে কাটা মাথা!
অত্যন্ত উত্যক্তের মতন হয়ে দুর্গাচরণ বললেন, আর আমি কোনো কথা শুনতে চাই না। মানুষটাকে যদি বাঁচাতে চাও, তো জোর করে কিছু খাওয়াতে হবে। নিয়ে এসো এক বাটি ঘোল।
নবীনকুমারের সামনে এসে তিনি চিকিৎসক নয়, পারিবারিক অভিভাবকের মতন কঠোর স্বরে বললেন, ওসব মতলোব তোমার খাটবে না। আর! এবার জোর করে…ঐ গঙ্গা একদিক ধরবে, আমি একদিক ধরে জোরের সঙ্গে ঠোঁট ফাঁক করে গেলাবো; এত সহজে তুমি আমাদেরকে ফক্কি দিয়ে চলে যেতে চাও?
নবীনকুমার কোনো প্রতিবাদ করলো না, একটি কথাও বললো না, মুখ হাঁ করলো। সরোজিনী ঝিনুকে করে ঘোলের সরবত ঢেলে দিতে লাগলো তার মুখে। পুরো এক পাথরের বাটি ভর্তি ঘোলই পেটে গেল নবীনকুমারের। এবং শেষ হওয়া মাত্র সে উঠে বসে ওয়াক তুললো। সবটাই বেরিয়ে গেল আবার।
সকলে কিছুক্ষণের জন্য নির্বাক। স্বেচ্ছায় মানুষ এভাবে বমি করতে পারে না। সত্যিই কোনো খাদ্য-পানীয় নবীনকুমারের পেটে সইছে না।
দুর্গাচরণ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, আগে থেকেই খালি পেটে ব্র্যাণ্ডি গিলেছে, এর পর আর ঘোল সইবে কেন? তবু হাল ছাড়া চলবে না। কাল সক্কাল থেকে এরকমভাবে আবার খাওয়াবে। না খেতে চায় জোর করবে!
এর পর সরোজিনী এবং গঙ্গানারায়ণ যুগপৎ অনেকক্ষণ ধরে হা-হুতাশ ও কাকুতি-মিনতি করলো নবীনকুমারের সামনে। নবীনকুমার নীরব, নিঃস্পন্দ হয়ে রইলো।
গঙ্গানারায়ণ দুলালচন্দ্ৰকে শাসিয়ে দিল, ফের যদি সে নবীনকুমারের কাছে মদের বোতল নিয়ে যায়, তা হলে তৎক্ষণাৎ তার চাকরি তো খতম হবেই, তাকে মারতে মারতে দেশ-ছাড়া করে দেওয়া হবে।
পরের দিনটিও কাটলো প্ৰায় একইভাবে। সারা দিনে তিন চার বার খাদ্য খাওয়ানো হলো নবীনকুমারকে। প্রত্যেকবারই সে বমি করলো।
সূৰ্যকুমার গুডিভ চক্রবর্তী একটি রবারের নল দিয়ে তার পেটের একেবারে মধ্যে তরল খাদ্য পৌঁছে দেবার চেষ্টা করলেন, তাতেও বিশেষ সুফল হলো না।
সূৰ্যকুমার জিজ্ঞেস করলো, নবীনবাবু, শুধু একটি কতার উত্তর দিন আমাকে। যাস্ট ওয়ান আনসার। আপনার বাঁচতে ইচ্ছে করে না?
একটুক্ষণ চুপ করে থেকে ঈষৎ ভ্রূকুঞ্চিত করে চিন্তান্বিত হলো নবীনকুমার। তারপর স্নান খসখসে। গলায় বললো, হ্যাঁ, করে!
সেদিন রাত্রি দশটার পর কিছুক্ষণের জন্য নবীনকুমারের কক্ষ ফাঁকা। এক সময় পা টিপে টিপে প্রবেশ করলে দুলালচন্দ্ৰ। চোরের মতন এদিক ওদিক চেয়ে ঝটু করে চাদরের আড়াল থেকে বার করলো একটি ব্র্যাণ্ডির বোতল। ফিসফিসিয়ে বললো, ছোটবাবু এনিচি!
সঙ্গে সঙ্গে একটি নাটকীয় কাণ্ড হলো। সেই কক্ষটি যেন একটি মঞ্চ। দুদিকের দুই দ্বারা যেন উইংস। সেই দুই দ্বার দিয়ে ঝটিতি এসে ঢুকলো দুই নারী, সরোজিনী ও কুসুমকুমারী। তারা এসে দাঁড়ালো দুলালের দুপাশে।
কুসুমকুমারী বললো, ওটা দে আমাকে।
দুলাল প্রভুর দিকে তাকিয়ে ইতস্তত করতে কুসুমকুমারী দাপটের সঙ্গে এক ধমক দিয়ে বললো, দে বলচি! তোর এত সাহস! আজি তোর এ বাড়ি থেকে পাট উঠলো, যা বিদেয় হয়ে যা!
সরোজিনী বললো, আপদ, তুই এক্ষুনি দূর হ!
দুলালচন্দ্ৰ বোতলটি মেঝেতে নামিয়ে রেখে দৌড়ে প্রস্থান করলো।
কুসুমকুমারী বললো, আমরা দুই বোনে এখেনে উপোসী হয়ে বসচি। সারা রাত থাকবো, আপনি না খেলে আমরাও খাবো না। আয় সরোজ
সত্যিই এই বাড়ির দুই বধু পালঙ্কের কাছে মেঝেতে বসলো পাশাপাশি। এই নাট্যে অবশ্য নবীনকুমার এখনো একটিও সংলাপ উচ্চারণ করলো না।
ব্র্যাণ্ডির বোতলটি এখনো মেঝের ওপর দাঁড় করানো। কুসুমকুমারী সেদিকে তাকিয়ে আছে এক দৃষ্টে। তার চক্ষে জল এসে যাচ্ছে। তার পিত্ৰালয়ে এ দ্রব্যটির কোনো প্রভাব সে দেখেনি। কিন্তু অনেকদিন আগে, যেন তার পূর্বজন্মে, অৰ্থাৎ তার প্রথম বিবাহের সময় সে দেখেছে। ঐ বোতলের জন্য দুর্গামণির জীবনটা কেমন নষ্ট হয়ে গেছে। অনেক দিন পর দুর্গামণির কথা মনে পড়ে মুচড়ে উঠছে তার বক্ষ। সরোজিনীর জীবনও সে কিছুতেই বিনষ্ট করতে দেবে না।
একটু পরে সে বললো, কোনো দাসীকে ডাক, ওটা নিয়ে গিয়ে আস্তাকুড়ে ফেলে দিয়ে আসুক!
এবার নবীনকুমার বললো, ওটা আমায় দাও, সরোজ!
সরোজিনী সভয়ে তাকালো কুসুমকুমারীর দিকে।
নবীনকুমার পাশ ফিরে তার দৃষ্টির চুম্বকে সরোজিনীকে আকৃষ্ট করতে চেয়ে এবং একটি হাত বাড়িয়ে হুকুমের সুরে বললো, দাও!
সরোজিনী বললো, ও দিদি…।
কুসুমকুমারী উঠে দাঁড়ালো। পালঙ্কের কাছে এসে তার নীল চক্ষুমণি দুটি স্থিরভাবে নবীনকুমারের দিকে রেখে কোমল অনুনয়ের স্বরে বললো, ছিঃ, আমন করে না! কেন এই সর্বনাশ কচ্চেন আপনি—
নবীনকুমার খুব থেমে থেমে বললো, অনেক রাত হয়েচে, নিজের ঘরে যান, বৌঠান—।
–না, আমি যাবো না। আমি সরোর সঙ্গে এখেনে থাকবো। সরো ছেলেমানুষ, আপনাকে ভয় পায়, আমি তো পাই না…আপনি কিচু না খেলে আমরাও না খেয়ে থাকবো, দেকি আপনি কতদিন পারেন!
গা থেকে চাদরটি সরিয়ে নবীনকুমার আস্তে আস্তে উঠে বসলো। দেখলে ভয় হয়, যেন একটা জীবন্ত কঙ্কাল। তার গায়ের নিমাটি ঢলঢল করছে। গলার ওপর মাথাটা যেন শরীরের তুলনায় অনেক বড়।
নবীনকুমারকে পালঙ্কের বাইরে একটা পা বাড়াতে দেখে কুসুমকুমারী বললো, ও কি, ও কি কচ্চেন?
উত্তর দেবার কোনো প্রয়োজন বোধ না করে অমানুষিক চেষ্টায় নবীনকুমার নামতে চেষ্টা করলো পালঙ্ক থেকে। ইদানীং অন্তত দুজন ধরাধরি না করলে সে মাটিতে দাঁড়াতেই পারে না, এখন সে একা যাবার চেষ্টা করছে।
সরোজিনী চিৎকার করে কেঁদে উঠে বলতে লাগলো, ও মা গো, কী হবে, কী সর্বনাশ, ওগো কে কোতায় আচো–
দাসী-বাদী, আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে ছুটে এলো গঙ্গানারায়ণ। নবীনকুমার তখন মাটিতে নেমে দাঁড়িয়েছে। সরোজিনী আর কুসুমকুমারী তাকে দুদিক থেকে ধরতে যেতেইসে রুক্ষম্বরে বললো, ছেড়ে দাও!
গঙ্গানারায়ণ ভাইকে জড়িয়ে ধরে বললো, কী হয়েচে, ছোট্কু? তুই কী চাস!
নবীনকুমার বললো, সবাইকে ঘর ছেড়ে চলে যেতে বলে। নইলে আমি এখেনে থাকবো না।
—বলচি, বলচি, সবাই চলে যাবে, তুই আগে শো—।
নবীনকুমারকে প্ৰায় জোর করেই ধরে এনে গঙ্গানারায়ণ শুইয়ে দিল পালঙ্কে। অন্যান্য কৌতূহলীদের চলে যাবার হুকুম দিয়ে গঙ্গানারায়ণ কুসুমকুমারীকে বললো, দোরটা বন্ধ করে দাও!
নবীনকুমার বললো, ঐ ব্র্যাণ্ডির বোতলাটা দাও আমাকে!
–তুই, তুই…এই অবস্থায়…ডাক্তাররা বলেচেন—
–দাও!
—না, কিছুতেই না! তুই এমন ছেলেমানুষী করিস নি, ছোট্কু!
——তোমরা আমায় মেরে ফেলতে চাও? এ কতা বোঝে না যে শুধু ঐ ব্র্যাণ্ডি খেলেই আমার বমি হয় না!
—কিন্তু খালি পেটে ওটা খেলে—
—দাও!
—ছোট্কু, তুই শুয়ে পড়। যদি খেতেই হয় আমি তোর গলায় দুচার ফোঁটা ঢেলে দিচ্চি, আর জেদ করিস নি, ছোট্কু—
অতি শীর্ণকায় এবং মৃতপ্রায় নবীনকুমার যে এখনো এই সিংহ পরিবারের প্রধান পুরুষ, তা তার ব্যবহারে স্পষ্ট ফুটে ওঠে। গঙ্গানারায়ণের কথা গ্ৰাহ্য না করে শয্যার ওপর উপবিষ্ট অবস্থায় সে হাত বাড়িয়ে বসে রইলো।
গঙ্গানারায়ণ মেঝে থেকে তুলে নিল বোতলটি। কুসুমকুমারী আর্তস্বরে বললো, আপনি দিচ্চেন?
গঙ্গানারায়ণ তবু নিরুপায়ভাবেই বোতলটি এগিয়ে দিল কনিষ্ঠের হাতে।
কম্পিত হাতে ছিপিটি খুলে বোতলের মুখটি ওষ্ঠে ছোঁয়ালো নবীনকুমার। কিন্তু দুচার ফোঁটার বেশী তার মুখে গেল কি না সন্দেহ! বোতলটি সে ধরে রাখতে পারলো না। তার হাত থেকে খসে পড়ে সেটি ভেঙে গেল টুকরো টুকরো হয়ে। সমস্ত কক্ষ পূর্ণ হয়ে গেল তীব্র সুরার গন্ধে।