2 of 2

৫৩. হরিশের মৃত্যু

হরিশের মৃত্যু নবীনকুমারের বক্ষে একেবারে তীব্ৰ শেলসম বাজলো। কয়েক দিন প্রায় হতচেতনের মতন পড়ে রইলো সে। অমন স্বাস্থ্যবান, আমন তেজস্বী, সব সময় উৎসাহে ভরপুর মানুষটি চলে গেল অকস্মাৎ! আর যে সময় হরিশকে দেশবাসীর সবচেয়ে প্রয়োজন ছিল, সেই সময়টা সে অপসৃত হলো! বিশ্বনিয়ন্তার এ কি অবিচার! আর কী-ই বা বয়েস হয়েছিল। হরিশের, মাত্র সাঁইত্রিশ বৎসর!

এক সময় শোক সামলে উঠতেই হলো নবীনকুমারকে। হরিশ বহু কাজ অসমাপ্ত রেখে গেছেন, এখনই সেগুলি জোড়া লাগাবার চেষ্টা না করলে একেবারেই নষ্ট হয়ে যাবে। বিশেষত হিন্দু পেট্রিয়টের মতন পত্রিকা বন্ধ হতে দেওয়া চলে না কিছুতেই।

হরিশ অর্থ উপাৰ্জন করেছেন প্রচুর, আবার তাঁর খরচের হাতও ছিল অতি দরাজ, নীল চাষীদের জন্য তিনি অকুণ্ঠভাবে ব্যয় করেছেন। মৃত্যুর পর দেখা গেল হরিশ ভবানীপুরে একটি ছোট বসত বাড়ি আর হিন্দু পেট্রিয়টের মুদ্রাযন্ত্র ছাড়া আর কিছুই রেখে যাননি। তাঁর বিধবা পত্নী ও মাতার গ্রাসাচ্ছাদন হবে কী করে তারও কোনো ব্যবস্থা নেই।

হরিশের শ্ৰাদ্ধ শান্তি চুকে যাবার পর নবীনকুমার একদিন ধীর পদে হিন্দু পেট্রিয়ট দফতরের সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে এলো। এখানে হরিশ নেই, তাঁর উচ্চ কণ্ঠস্বর, দরাজ হাস্য আর শোনা যাবে না, এ যেন কল্পনাই করা যায় না। নবীনকুমারের শরীর অবশ হয়ে আসে। তার মনে হয়, পৃথিবীতে তার আর একজনও বন্ধু নেই।

পত্রিকা দফতরে একটি যুবক একলা চুপ করে বিষণ্ণ বদনে বসে আছে। এই যুবকটির নাম শম্ভুচন্দ্র মুখোপাধ্যায়। এই যুবকটি কিছুদিন হরিশের সঙ্গে পত্রিকা সম্পাদনায় সহকারিত্ব করেছে। ছাত্রাবস্থা থেকেই অনেক পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে শাদ্ভুচন্দ্র, এক সময় সে নিজেও স্বতন্ত্রভাবে একটি কাগজ বার করতে চেয়েছিল, কিন্তু অর্থের সঙ্গতি নেই। যুবকটি ইংরেজী লেখে চমৎকার, যুক্তিজ্ঞান বেশ তীক্ষ্ণ এবং হৃদয়ে স্বদেশপ্রীতি আছে। এই দফতরেই শঙ্কুচিন্দ্রের সঙ্গে পরিচিত হয়ে তাকে নবীনকুমারের ভালো লেগে যায়, এক কথায় নবীনকুমার তার পরিকল্পিত পত্রিকার জন্য কিনে দেয় একটি মুদ্রণ যন্ত্র। শম্ভুচন্দ্র তখন মুখার্জিস ম্যাগাজিন নামে পত্রিকা বার করলো, কিন্তু চললো না বেশীদিন।

শম্ভুচন্দ্ৰ নবীনকুমারের চেয়ে সামান্য বয়েসে বড় হলেও নবীনকুমারকে দেখে সে সসম্ভ্রমে উঠে দাঁড়ালো। দুজন পরস্পরের দিকে চেয়ে রইলো কয়েক মুহূর্ত, একটিও কথা বললো না। পুরুষ মানুষ অন্য পুরুষ মানুষের সামনে আর কী ভাষায় শোক প্রকাশ করবে! নীরবতাই এখানে বাঙ্ময়।

হরিশ নেই বলেই ঘরখানি যেন নিদারুণ শূন্য মনে হচ্ছে। নবীনকুমার চর্তুদিকে চক্ষু বোলাতে লাগলো। সর্বত্রই হরিশের চিহ্ন। দেওয়ালে একটি হুকে ঝুলছে এক গাদা পৈতে। ব্ৰাহ্মণ সন্তান হরিশ মুখুজ্যে ব্ৰাহ্ম হবার পর ঢাক ঢোল পিটিয়ে, লোকজন ডেকে উপবীত পরিত্যাগ করেননি বটে, তবে ঐ সুতোগাছিগুলোর প্রতি তাঁর বিশেষ সম্মানবোধও ছিল না। প্রায়ই গা থেকে পৈতে খুলে বুলিয়ে রাখতেন দেয়ালে, কখনো কখনো গ্যালি প্রফের আপতন বোঝার জন্য ঐ পৈতে দিয়েই মেপে নিতেন, আবার বাড়ি ফেরার সময় পরে নিতেন গলায়। শেষদিন আর পরা হয়নি।

নবীনকুমার জিজ্ঞেস করলো, এ পত্রিকা বন্ধ হয়ে যাবে?

শম্ভুচন্দ্ৰ বললো, আর তো উপায়ান্তর দেখি না! এ ছাপাখানাও রক্ষা করা যাবে না বুঝি। নীলকর সাহেবরা ওঁর নামে মানহানির মামলা বুলিয়ে রেখেছে, ওঁর মৃত্যু হলেও প্রতিশোধ নেবার জন্য সাহেবরা এই ছাপাখানা ক্ৰোক করে নিতে পারে।

নবীনকুমার জিজ্ঞেস করলো, তা পারে?

শম্ভুচন্দ্ৰ বললো, সাহেবদের পক্ষে অবশ্যই সম্ভব। এই ছাপাখানাটিও গেলে হরিশের পরিবার একেবারে সর্বস্বান্ত হবে!

নবনীকুমার কয়েক মুহূর্ত মাত্র চিন্তা করলো। তারপর প্রশ্ন করলো, আর কেউ যদি তার আগেই এই ছাপাখানা এবং পত্রিকার স্বত্ব কিনে নেয়!

—তা হলে বাঁচানো যেতে পারে অবশ্য!

—এই ছাপাখানার মোট দাম কত হবে বলে আপনার মনে হয়?

—যন্ত্রটি পুরোনো হয়ে গ্যাচে, টাইপগুলিও বহু ব্যবহৃত, তা তবুও হাজার বারোশো টাকা দাম উঠবে নিশ্চয়!

—আপনি হরিশের মা ও স্ত্রীকে গিয়ে বলুন, আমি পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে এই সমুদয় কিনে নিতে চাই।

—কত টাকা বললেন?

—পাঁচ হাজার টাকা। আশা করি সেই টাকার সুদে দুই বিধবার সারা জীবনের খরচ চলে যাবে। শভুচন্দ্র খানিকক্ষণ বিস্মিতভাবে তাকিয়ে রইলো। তারপর অস্ফুট স্বরে বললো, আপনি হাজার টাকার জিনিস পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে কিনবেন? এমন অদ্ভুত দরদরির কতা কখনো শুনিনি। কলকাতা শহরে বড় মানুষ অনেকই আচে, কিন্তু আপনার মতন সৎ কাজে ব্যয় করতে জানে কজন? আপনি…

নবীনকুমার হাত তুলে এই সব অবাস্তর কথা বন্ধ করিয়ে দিয়ে বললো, আপনি ব্যবস্থা করুন, আমি কালকের মধ্যেই টাকা দিয়ে সইপত্তর করে সব পাকা করে নিতে চাই। আমি নামে মালিক হলেও এ পত্রিকা চালাতে হবে আপনাকেই।

—আমি চালাবো?

—হাঁ। আপনি একা না পারেন, গিরিশ ঘোষকে ডেকে নিন, কাগজের ব্যাপারে তাঁর অভিজ্ঞতা আচে—আপনারা সম্পাদনার ভার নেবেন, খরচপত্তরের দায়িত্ব সব আমার। এ পত্রিকা কিছুতেই বন্ধ হতে দেওয়া হবে না!

যে কথা সেই কাজ! নবীনকুমারের অধ্যাবসায়ে কয়েকদিনের মধ্যেই হিন্দু পেট্রিয়ট পত্রিকা আবার চালু হয়ে গেল। সেখানেই নিবৃত্ত হলো না নবীনকুমার। হরিশের স্মৃতি রক্ষার জন্য সে উঠে-পড়ে লাগলো। স্বদেশের জন্য উৎসগীকৃতপ্ৰাণ হরিশকে যদি দেশবাসী ভুলে যায়। তবে তার চেয়ে কৃতঘ্নতা আর কিছুই নেই।

কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে নিয়ে নবীনকুমার গঠন করলো হরিশচন্দ্র মেমোরিয়াল কমিটি। হরিশচন্দ্রের স্মৃতিরক্ষার্থে যার যথাসাধ্য দান করার জন্য আবেদন জানিয়ে মর্মস্পশী ভাষায় একটি পুস্তিকা প্রণয়ন করে বিতরণ করলে সে। এই স্মৃতিভাণ্ডারে প্রথমে সে নিজেই দিল পাঁচ শত টাকা। কিন্তু দেখা গেল দরিদ্র সাধারণ মানুষ অনেকেই এক টাকা, দুটাকা, পাঁচ টাকা পাঠালেও বিশিষ্ট ধনী যাঁরা পাঁচ শত, হাজার টাকা দানের মৌলিক প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তাঁরা কেউ আসলে কিছুই দিলেন না। নবীনকুমার তখন মেমোরিয়াল কমিটির কাছে এক প্রস্তাব দিল, হরিশের নামে এক স্মৃতি মন্দির নির্মাণ করা হোক, যেখানে থাকবে একটি গ্রন্থাগার, উৎসাহী ছাত্রদের জন্য গবেষণার সুযোগ এবং একটি পাবলিক হল, যেখানে দেশীয় লোকেরা সভাসমিতি করতে পারবে। এ শহরে স্থানীয় লোকদের ব্যবহার উপযোগী একটিও হল নেই। এবং এই স্মৃতি মন্দিরের জন্য নবীনকুমার এখুনি বাদুড়বাগানে দুই বিঘা জমি দান করতে প্ৰস্তুত আছে।

তবু কমিটির সভ্যদের বিশেষ কোনো উৎসাহ দেখা গেল না। সকলেই যে-যার স্বাৰ্থ সামালাতে ব্যস্ত। চাঁদ যা উঠেছে তা অন্য কাজে লাগাবার জন্য এক একজন এক একরকম পরামর্শ দেয়। কমিটির সম্পাদক কৃষ্ণদাস পালের খুব আগ্রহ ও লোভ হরিশের পত্রিকাটি হস্তগত করার।

বীতশ্রদ্ধ হয়ে নবীনকুমার নিজেকে সরিয়ে নিয়ে গেল। এই সব ব্যাপার থেকে। হরিশের মতন স্বাৰ্থত্যাগী মানুষকেও যদি মৃত্যুর পরেই লোকে এমন অবজ্ঞা প্রদর্শন করে, তা হলে এ দেশে আর সত্যিকারের আদর্শবান পুরুষ জন্মাবে কী করে? জীবিতাবস্থায় হরিশকে নিয়ে যারা মাতামাতি করেছে, যারা তার স্তুতি গেয়েছে, এখন তারাই বক্রভাবে বলে, হ্যাঁ, হরিশ অনেক বড় বড় কাজে হাত দিয়েছিলেন বটে, কিন্তু নিজেই অমিতাচার করে অকালে প্ৰাণটা খোয়ালেন।

মেমোরিয়াল কমিটির সভা থেকে একদিন রাগতভাবে বেরিয়ে গিয়ে গাড়িতে উঠে নবীনকুমার মনে মনে বলতে লাগলো, বন্ধু, পরকাল বলে কিচু আচে কিনা আমি জানি না, তুমি কোনো জায়গা থেকে আমার কতা শুনতে পাবে কি না তাও জানি না, তবু আমি বলচি, আর যে-ই তোমায় ভুলে যাক, আমি যতকাল বেঁচে থাকবো, আমি তোমায় কখনো একদিনের জন্যও বিস্মৃত হবো না! বন্ধু, এমনভাবে আমায় এক ফেলে চলে গ্যালে!

নিজ গৃহে সারা দিনের মধ্যে বোধ হয় একদণ্ডও কাটায় না। নবীনকুমার। শোক ভুলবার জন্য সে নিজেকে যেন শত কাজের মধ্যে ড়ুবিয়ে দিয়েছে। শুধু কাজ আর কাজ! সান্ধ্য বিনোদনের জন্যও সে যায় না কোথাও। হরিশের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই মুলুকচাঁদের আখড়া বন্ধ হয়ে গেছে, নবীনকুমারও আর মদ্য পান করে না। সর্বক্ষণ সে লেখাপড়া নিয়ে ব্যস্ত।

একেবারে মুখের ভাষায় সে যে ছোট ছোট নকশাগুলি লিখছিল, সেগুলি একসঙ্গে মিলিয়ে সে বই আকারে ছাপিয়ে বার করে দিল নিজের নাম গোপন করে। প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে পাঠক-সমাজ একেবারে তাজ্জব। এ কার রচনা? এমন নির্মম সত্য, রঙ্গব্যঙ্গময় সমাজচিত্র কার হাত দিয়ে বারুলো? টেকচাঁদ ঠাকুরের চেয়েও এ লেখার ভাষায় জোর অনেক বেশী। মহাভারত অনুবাদের সুগভীর ভাষা যার হাত দিয়ে বেরুচ্ছে, সেই ব্যক্তির পক্ষে যে এমন তীক্ষ্ণ, তীব্র, চটুল চলতি বাংলা লেখা সম্ভব, তা কারুর সুদূরতম কল্পনাতেও এলো না। একই সঙ্গে নবীনকুমার হাত দিল আবার নতুন নাটক রচনায়, আর মহাভারতের কাজ তো চলছেই। নীলদর্পণ নাটকখানি প্ৰথম সংস্করণ নিঃশেষিত হবার পর আর কেউ ভয়ে প্রকাশের ভার নিতে চাইছে না, নবীনকুমার নিজ ব্যয়ে নিজের মুদ্রণশালা থেকে সেই বই ছাপিয়ে বার করে দিল।

সরোজিনী প্রতি রাত্ৰে সাজগোজ করে স্বামীর ঘরে আসে, তার স্বামী তার দিকে মনোযোগ দেবারও সময় পায় না। রূপের জাল দিয়ে ঘেরা একটি বিদেশী লণ্ঠন কিনেছে নবীনকুমার, যা বাতাসের ঝাপটায় নিবে যায় না। সেই লণ্ঠন জেলে সে অধিক রাত্রি পর্যন্ত লেখাপড়ার কাজ করে যায়।

সরোজিনী কিছুক্ষণ দ্বারের কাছে কুণ্ঠিতার ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর এক সময় স্বামীর কাছে এসে আড়ষ্টভাবে বলে, অনেক রাত হলো যে, আপনি এবার শুতে আসবেন না?

নবীনকুমার মুখ না ফিরিয়েই বলে, আমার দেরি হবে, তুমি ঘুমিয়ে পড়ো গে!

সরোজিনী তবু জিজ্ঞেস করে, আপনার কত দেরি হবে?

নবীনকুমার পাঠে নিমগ্ন থেকে অন্যমনস্কভাবে উত্তর দেয়, তার ঠিক নেই।

এক প্রশ্ন বারবার জিজ্ঞেস করলে নবীনকুমার হঠাৎ অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয় বলে সরোজিনী আর কিছু বলে না। নিঃশব্দে আরও একটুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে আস্তে আস্তে ফিরে যায়। তার সূক্ষ্ম রেশমী বস্ত্র পরা, বাহুতে ফুলের সাজ আর সারা শরীরে চন্দন সৌরভ ব্যর্থ হয়। নিজের শয্যায় ফিরে গিয়ে সে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে। কিছুদিন হলো তার পতি দেবতাটির কেন এমন পরিবর্তন হলো, সে কিছুতেই বুঝতে পারে না। আগেও তো উনি অনেক কাজে ব্যস্ত থাকতেন, কিন্তু রাত্ৰে শয়ন কক্ষে সরোজিনীকে কাছে ডেকে নরম সোহাগ বাক্য বলতেন প্রতিদিন! নিত্য নতুন কত না কৌতুক উদ্ভাবন করতেন। উনি। কত না খুনসুটি। সেই মানুষটি এই ক মাসে এমন বদলে গেলেন!

সরোজিনী এই নিয়ে তার মা ও দিদিদের কাছে কান্নাকাটি করেছে। সকলেই শুনে বিস্মিত হয়। বাড়ির বাইরে রাত কাটায় না, বাগানবাড়িতে রক্ষিতা পোষে নি, নিজ গৃহে থেকেও পত্নীর দিকে নজর দেয় না; এ আবার কেমন ধারা কাণ্ড! এমন তো হয় না। হরিশ মুখুজ্যে ওর বন্ধু ছিল, তাঁর মৃত্যুতে নবীনকুমার মনে আঘাত পেয়েছে ঠিক কথা, কিন্তু সেও তো হয়ে গেল। কয়েক মাস। ব্যাটাছেলে বন্ধু মারা গেলে কোনো পুরুষমানুষ এমন মনমরা হয়ে থাকে? তা ছাড়া, এরকম সময়ে তো সবাই ঘরের মানুষকেই বেশী করে আঁকড়ে ধরে।

সবাই সরোজিনীকে দোষ দেয়। সে-ই নিশ্চয়ই তার স্বামীকে বশ করতে পারছে না। যে সধবা মেয়েমানুষ নিজের স্বামীর সঙ্গে এক শয়নকক্ষে থেকেও স্বামীকে কাছে পায় না, সে মেয়েমানুষের মরণও ভালো। দিদিরা পরামর্শ দেয়, ওরে সরো, একদম হাত-আলগা দিসনি, সাপটে ধর, দরকার হয় পায়ে পড়বি, একবার মন ছাড়াছাড়ি হয়ে গেলে কেঁদেও কুল পাবি না।

সরোজিনী সত্যিই এক মধ্য রাত্রে দৌড়ে এসে নবীনকুমারের পায়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে।

নবীনকুমার চমকে উঠে বলে, এ কি, এ কি!

তার চোখে জল। নবীনকুমারের পায়ে মাথা কুটতে কুটতে সে বললো, আজ। আপনাকে বলতেই হবে, আমি কী দোষ করিচি! কেন আমায় দেকালেই আপনি হাত নেড়ে বলেন, চলে যাও, চলে যাও! আমি কি বিষ পিমড়ে, আমায় আপনার সহ্য হয় না? বলুন তবে, আমি আগুনে ঝাঁপ খেয়ে মর্বো!

নবীনকুমার টেবিলের ওপর মস্ত বড় একটা কাগজ বিছিয়ে তার ওপর পেন্সিলের দাগ কেটে কী সব হিসেব করছিল। হাতের পেন্সিলটি সরিয়ে রেখে সে সরোজিনীর মুখখানি ধরে ওপরে তুললো। তারপর বিরক্তিচাপা ঈষৎ অস্থির কণ্ঠে বললো, আঃ, সরোজ, কেন ছেলেমানুষী করে। দেকচো না আমি ব্যস্ত রাইচি। কাজের সময় এ রকম বিরক্ত করো না।

সরোজিনী চোখের জল মুছে ফেলে হঠাৎ শান্ত হয়ে যায়। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বললো, ঠিক, কাজের সময় বিরক্ত করতে নেই। আর আপনাকে বিরক্ত কবে না। তবে আমার মা জিজ্ঞেস করতে বলেচেন, রাত জেগে আপনি কী এত কাজ করেন, তা দিনের বেলা সারা যায় না? এ রকম রাত জাগিলে যে আপনার শরীর নষ্ট হবে। যারা পেটের ভাত জোটাবার জন্য কাজ করে তারাও তো এমন দিনরাত্তির খাটে না। ভগমনের কৃপায় আমাদের অভাব নেই—

নবীনকুমার শুকনো হেসে বললো, পেটের ভাত জোটাবার জন্য বেশী খাটতে হয় না। ঠিকই, কিন্তু মনের ভাত জোটাতে গেলে সময়ের হিসেব কল্লে চলে না। আমি এখন যে কাজে হাত দিইচি, সেটা তোমায় বোঝালেও বুঝবে না।

সরোজিনী বললো, তবু বলুন। একটু, মা জানতে চেয়েচেন।

—আমি বাংলা দৈনিক কাগজ বার কচ্চি।

–কী?

—ঐ যে বললুম, তুমি বুঝবে না। সাহেবরা ইংরেজীতে ডেলি নুযুঁজ পেপার বার করে, কখনো দেকোচো? লোকে সকালে জলখাবার খেতে বসার আগেই ফেরিওয়ালারা বাড়ি বাড়ি সেই কাগজ দিয়ে যায়। আমি এবার সেই রকম বার কচ্চি, বাংলা ডেলি ন্যুজ পেপার। তার নাম পরিদর্শক।

এবারেও কিছু হৃদয়ঙ্গম হলো কিনা বোঝা গেল না, সরোজিনী তার স্বামীর মুখের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে রইলো।

বস্তুত নবীনকুমারের এই নতুনতম উদ্যমটি দেখে তার পরিচিত সকলেই স্তম্ভিত হয়ে গেছে। পত্র-পত্রিকার ব্যাপারে নবীনকুমারের আগ্রহ সেই কৈশোর থেকেই। কোনো পত্রিকাই বন্ধ হয়ে যাক, সে সহ্য করতে পারে না। আর্থিক অনটনে কোনো পত্রিকা উঠে যাবার উপক্রম হলেই, নবীনকুমার সেটি কিনে নিয়ে আবার চালু করে দেয়। এমনকি একবার দূরবীন নামে একটি উর্দু পত্রিকার সঙ্কটদশার কথা শুনে নবীনকুমার তৎক্ষণাৎ সেই পত্রিকাটি ক্রয় করে তার এক মুসলমান বন্ধুকে সেটি আবার দিয়ে দেয় চালাবার জন্য। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সুবিখ্যাত তত্ত্ববোধিনী পত্রিকাকেও সে একটি মুদ্রণ যন্ত্র কিনে উপহার দিয়েছে। কিন্তু এবারের ব্যাপারটি সব কিছুকে ছাড়িয়ে যায়। দুই ব্ৰাহ্মণ মিলে পরিদর্শক নামে একটি উচ্চাকাঙ্ক্ষী পত্রিকা প্ৰকাশ করেন এবং কয়েক মাস পরেই তাদের সামর্থ্যে ও উৎসাহে ভাঁটা পড়ে। নবীনকুমার অমনি সেই পত্রিকার স্বত্ব কিনে নিয়েছে, এবং এটা সে নিজেই চালাতে চায় দৈনিক পত্রিকা হিসেবে। বাংলায় আবার দৈনিক পত্রিকা, তাও একুশ বৎসর বয়েসের যুবক তার সম্পাদক! এ যে ঈশ্বর গুপ্ত মশাইকেও টেক্কা দেবার চেষ্টা!

পত্রিকাটির প্রকাশ কবে থেকে শুরু হবে তার ঠিক নেই এখনো, তবে কয়েকদিন ধরেই প্রবলভাবে সেই পত্রিকা সংক্রান্ত হিসেব নিকেশ চলছে। সকলেরই ধারণা, নবীনকুমারের যখন একবার ঝোঁক চেপেছে, তখন ও পত্রিকা সে বার না করে ছাড়বে না। একদিকে মহাভারত অনুবাদের মতন বিশা কাজ, অন্যদিকে দৈনিক পত্রের প্রকাশ!

নবনীকুমার সরোজিনীকে দৈনিক পত্রের ব্যাপারটা বোঝাবার চেষ্টা করছিল, মধ্য পথে হঠাৎ সরোজিনী বললো, আমি একটা কতা জিগ্যেস করবো?

–বলো!

—আপনি কুসোমদিদির বের জন্য কত কথা বলেচিলেন, কত আপনার উৎসাহ, সেই কুসোমদিদি আমাদের এ বাড়িতে বউঠান হয়ে এলো, আর আপনি তার সঙ্গে একটাও কথা বলেন না কেন?

প্রসঙ্গটির আকস্মিকতায় নবীনকুমার থমকে গেল। চক্ষু তারকা দুটি উজ্জ্বল হয়ে উঠলো তার। নিশ্বাস যেন স্তব্ধ হয়ে গেল।

তারপর সে বললো, তোমার কুসুম দিদির বিয়ে হবার দরকার ছেল, বিয়ে হয়েচে…ভালো হয়েছে…আমরা সবাই খুশী হয়িচি…

—আপনি কুসোমদিদি-বউঠানের সঙ্গে একদিনও কতা বললেন না-এ বাড়িতে এলো…

—আমি কাজে ব্যস্ত, আমার কারুর সঙ্গেই কতা বলার সময় নেই। তোমার সঙ্গেও তো কতা কইতে পারি না।

—কুসোমদিদি-বউঠান সুধোচ্ছিলেন,উনি আপনাকে কী বলে ডাকবেন, ঠাকুরপো না আগের মতন মিতেনীর বর?

—ওনার যা খুশী তাই ডাকবেন-আমি কী জানি!

—আপনি তালে আজও এখন শুতে যাবেন না? আমি যাই?

–যাও!

সরোজিনী চলে যাবার পর নবীনকুমার খানিকক্ষণ বিবৰ্ণ মুখে গুম হয়ে বসে রইলো। তারপর থরথর করে কাঁপতে লাগলো তার শরীর, ঠিক অত্যধিক জ্বরতপ্ত রোগীর মতন। চেয়ার থেকে নেমে সে ভূঁয়ের ওপর শুয়ে পড়লো টানটান হয়ে। তার শরীরের একেবারে অতল থেকে কাতর শব্দ বেরিয়ে আসতে লাগলো। আঃ! আঃ!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *