দুলালের ধারণা, তার বাবুর মাথাটি বিগড়ে গেছে একেবারে। অতি অল্প বয়েস থেকেই সে নবীনকুমারের নানা প্রকার উৎকট বাতিকের সঙ্গে পরিচিত, যুবাবিয়েসে তার খামখেয়ালিপনা বেড়েছে বই কমেনি, সদাসর্বদা দুলাল ছায়ার মতন তার পশ্চাতে থেকে তাল সামলেছে। কিন্তু এখন এ কী অবস্থা, এর যে কোনো প্রকার মাথামুণ্ডু নেই। এ নিশ্চয়ই এক প্রকার গুপ্ত উন্মাদ-রোগ।
এ বিষয়ে দুলাল আর পাঁচ জনের সঙ্গে পরামর্শ করারও সাহস পায় না। অন্তত গঙ্গানারায়ণকে একবার জানানো কর্তব্য, কিন্তু গঙ্গানারায়ণের সামনে এসেও দুলাল বলি বলি করেও কথাটি মুখ ফুটে বলতে পারে না। তার পশ্চাতে তার সম্পর্কে দুলাল কিছু আলোচনা করেছে, একথা নবীনকুমার জানতে পারলে চটে একেবারে আগুন হবে, এমন কি দুলালের গদোনও চলে যেতে পারে।
নবীনকুমারের সঙ্গে ঘুরে ঘুরে এই নগরীর বড় মানুষদের সমাজ সম্পর্কে তার অভিজ্ঞতা হয়েছে যথেষ্ট, বাইরের ঠাট-ঠমক ভেদ করে অনেকেরই ভেতরের আসল স্বরূপটি জানতে তার বাকি নেই। সেই সব মানুষদের তুলনায় তার মনিব নবীনকুমার সিংহকে সে অগাধ শ্রদ্ধা না করে পারে না। তবু, এতদিন পর দুলালের ইচ্ছে হয় তার মনিবকে ছেড়ে চলে যেতে।
এতকাল নবীনকুমারের সংস্পর্শে থেকে তার চরিত্রের খানিকটা প্রভাব দুলালের ওপরেও পড়েছে।অন্যান্য সাধারণ মানুষদের তুলনায় তার মন অনেকখানি মুক্ত, ভূত-প্ৰেত কিংবা দেব-দ্বিজের প্রতি তার অহেতুক ভয় বা ভক্তি নেই। কোনোদিন পাঠশালা-বিদ্যালয়ে না গেলেও সে নিজের চেষ্টায় কিছুটা লেখাপড়া শিখেছে। সে নিয়মিত সংবাদপত্র পাঠ করে এবং সুন্দর চিঠি লিখতে পারে। সিংহ-বাড়ির অনেকেই পত্র-রচনার প্রয়োজনে দুলালের শরণাপন্ন হয়। তার হস্তাক্ষর দেখে চমৎকৃত হয়ে নবীনকুমার একদিন বিশেষ তারিফ করেছিল। এবং যে-কমাস নবীনকুমার পরিদর্শক-এর সম্পাদক ছিল, তখন মধ্যে মধ্যে সে দুলালকে দিয়ে নিজের রচনা কপি করিয়েছে।
দুলাল যেমন নবীনকুমারের সব হুকুম বিনা বাক্যব্যয়ে পালন করে, সেইরকম নবীনকুমারও দুলালের প্রতি সর্বদা উদার হস্ত। কিছুদিন আগে সে দুলালের পুত্রের নামে একটি বেশ বড় বাড়ি লিখে দিয়েছে, দুলালের বর্তমান বেতন একশো পঁচিশ টাকা, সওদাগরি হৌসের ইংরেজী জানা, পাশ করা কেরানীরা এর অর্ধেক বেতনও পায় না। এ ছাড়া নবীনকুমারের যখন তখন খুশির বখশিশ, তো আছেই। দুলালের আহার বাসস্থান বাবদ কোনো ব্যয় নেই, তার পুত্রটি বেশ ডাগরটি হয়েছে, এখন ইস্কুলে পড়তে যায়, নবীনকুমারের নির্দেশে সে-খরচও বহন করে এস্টেট। পদমর্যাদায় দুলালচন্দ্ৰ যদিও এখনো নবীনকুমারের নিজস্ব ভৃত্য এবং শরীররক্ষী, কিন্তু মনে মনে সে রূপান্তরিত হয়ে গেছে মধ্যবিত্তে। এবং মধ্যবিত্তের প্রধান কাম্য সামাজিক পরিচিতির ঠাঁট, দুলালের অন্তরেও সে আকাঙ্খা জাগা স্বাভাবিক। তাই সে আর ভৃত্য থাকতে চায় না, সে নিজেই নিজের জন্য ভৃত্য রাখতে চায়।
বস্তুত, সারা জীবন সে যদি শুধু পরের গোলামীই করে যাবে, তা হলে আর অর্থ সঞ্চয় করে লাভ কী হলো! স্ত্রী-পুত্র নিয়ে নিজস্ব গৃহে সে যে পৃথক একটি সংসার পেতে বসবে, তার উপায় নেই, কারণ, তার নিজস্ব কোন সময়ই নেই। নবীনকুমার কখন হুটহাট করে কোথায় যায় তার ঠিক নেই, এবং যখনই ডাক আসবে, তখনই দুলালকে যেতে হবে। জুড়িগাড়ির পশ্চাতে দণ্ডায়মান থাকতে হয় দুলালকে, লোকে মনে করে সে বুঝি সহিস শেখ ইদ্রিসের সহকারী। যে-সব মানুষ তার নোখেরও যুগ্য নয়, তারাও তাকে তুই সম্বোধনে কথা বলে। মধ্যবিত্ত মানসিকতা সদ্য যার মনে জেগেছে, তার কাছে এর চেয়ে অসহ্য পীড়াদায়ক আর কী হতে পারে!
দুলালের হাতে এখন যা নগদ অর্থ আছে, তা দিয়ে অনায়াসেই সে একটি ব্যবসা শুরু করতে পারে। তার খুব ইচ্ছে একটি বইয়ের দোকান খোলা। স্কুল-কলেজের সংখ্যা যেমন দিন দিন বাড়ছে, তেমন বই-খাতা-কালি-কলম-দোয়াতের চাহিদাও বাড়ছে হু-হু করে। পটলডাঙ্গা কিংবা সানকিভাঙা অঞ্চলে একখানা বাড়ি ভাড়া করে সে দিব্যি একটি দোকান খুলে বসতে পারে। বইয়ের দোকান খুললে অতিরিক্ত লাভ হবে এই, সে নিজে বিনি। পয়সায় সব বই পড়ে ফেলতে পারবে। দুলাল ইদানীং প্রায়ই এই স্বপ্নটি দেখে। মস্ত বড় দোকানে খাটাখাঁটি করছে। কর্মচারীরা, পেছন দিকে ক্যাশের টেবিলে বসে আছে দুলাল, পরণে ফরাসডাঙার তাঁতীদের বেঁচে থাক বিদ্যেসাগর ধুতি, মলমলের পাঞ্জাবী, কাঁধে গোলাপী রঙের উড়নি, চোখে চশমা, মুখে পান, মাথার চুল টেরি-কাটা, বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা পাঠ্য বইয়ের লাটু কেনবার সময় বেশী কমিশন পাবার লোভে, এই যে দুলালবাবু, আপনার সঙ্গে একটা প্রাইভেট কথা ছিল, এই বলে খাতির করে কথা বলবে। নবীনকুমারের জন্য বিভিন্ন সময় পুস্তক ক্রয় করতে গিয়ে দুলাল এইরকম দৃশ্য দেখেছে।–পুস্তক ব্যবসায়ী বলে পাড়া-প্রতিবেশীরা অতিরিক্ত খাতির করবে। দুলালকে, চাঁদা চাওনীরা এসে বলবে, আপনার মোশাই দোকানের আমন রমরমা, আপনি অন্তত পঞ্চাশটি টাকা না দিলে কী মান থাকে…।
কিন্তু নবীনকুমার স্বেচ্ছায় মুক্তি না দিলে দুলালের এই স্বপ্ন সম্ভব হবেই বা কী করে! দুলাল কারুর কাছে দাসখৎ লিখে দেয় নি, মহারানীর রাজত্বে সে স্বাধীনভাবে যেখানে খুশী চলে যেতে পারে, কিন্তু এতখানি কৃতঘ্ন আর নিমকহারাম যে সে নিজেই হতে পারবে না।
রাত কত তার ঠিক নেই, চতুর্দিকে ঘুটফুটে অন্ধকার, এক মজা পুকুরের ধারে দাঁড়িয়ে আছে নবীনকুমারের জুড়িগড়ি। পেছনের তক্তাটিতে বসে আছে দুলালচন্দ্র। মুখখানি তার বিরক্তিতে তিক্ত, ইচ্ছে থাকলেও ঘুমোবার উপায় নেই, এমন মশার উপদ্রব। মাঝে মাঝে ঢুলুনি আসছে আবার ঘুম ভেঙে যাচ্ছে এক ঝাঁক মশার আক্রমণে। মশা মারার চটাস চটাস শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই। ঘোড়ারা দাঁড়িয়েই ঘুমোয়, গাড়ির ছাদে শেখ ইদ্রিশও কাঁথা কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে, মশার কামড়ে তারাও ছটফট করে মাঝে মাঝে। নবীনকুমার কোথা থেকে কী অবস্থায় বা কখন ফিরবে, তার কোনোই ঠিক নেই। এইরকম অবস্থায় আরও বহু বিনিদ্র রজনী যাপন করেছে দুলাল, কিন্তু এখন যেন সহোর সীমা ছাড়িয়ে গেছে। শারীরিক কষ্টটাই বড় কথা নয়, নবীনকুমারের অদ্ভুত জীবন-যাপন পদ্ধতিই তার কাছে বেশী কষ্টকর। জোড়াসাঁকোর সিংহ-বাড়ির প্রধান পুরুষের এই পরিণতি!
চন্দ্রনাথের বাসাবাড়িটি ভস্মীভূত হবার পর তাদেব আর কোনোরকম সন্ধান পাওয়া যায় নি। তাদের খুঁজে বার করবার জন্য নবীনকুমার গণ্ডা গণ্ডা লোক নিযুক্ত করেছিল, ব্যর্থ হয়েছে সকলেই। চন্দ্রনাথ যেন উপে গেছে কপূরের মতন। অথবা ভূত ধরার ওঝা নিজেই এখন ভূতপূর্ব।
কিন্তু নবীনকুমার কিছুতেই তা মানতে রাজি নয়। চন্দ্রনাথের শরীরের গুরুতর জখম সে নিজের চক্ষে দেখেছে, ওরকম আহত অবস্থায় কোনো মানুষের পক্ষে কিছুতেই বেশী দূর যাওয়া সম্ভব নয়। শত্ৰু পক্ষের চক্ষু এড়িয়ে সে নিশ্চিত এই নগরীর কোথাও আত্মগোপন করে আছে।
নবীনকুমার-নিযুক্ত চরেরা ব্যর্থ হবার পর নবীনকুমার নিজেই সে ভার নিয়েছে। প্রতিদিন সন্ধ্যাকালে ভূতগ্ৰস্তের মতন সে গৃহ থেকে নিৰ্গত হয়, তারপর বিভিন্ন কু-পল্লীত অনুসন্ধান চালায়। নবীনকুমারের ধারণা, আত্মগোপন করার পক্ষে ঐ সব অঞ্চলই বেশী সুবিধাজনক। কারুর কাকুতি-মিনতি, অনুরোধ-উপরোধে সে কৰ্ণপাত করে না। সবচেয়ে ভয়ংকর কথা, সম্প্রতি সে একা যেতে শুরু করেছে। বাড়ি থেকে সে জুড়ি গাড়িতেই বার হয় বটে, তারপর কোনো এক স্থানে সে গাড়িকে অপেক্ষা করতে বলে পরিভ্রমণ করে পদব্ৰজে। হ্যাঁ, পদব্রজে, অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে ধনীকুলচূড়ামণি রামকমল সিংহের একমাত্র সন্তান নবীনকুমার সিংহ সাধারণ পাঁচপেঁচি মানুষের মতন পায়ে হেঁটে পথে পথে ঘুরছে। অনেক সময়ই লোকে তাকে চিনতে পারে, সবিস্ময়ে তাকায়। সমাজের উঁচু মহলে এই বিষয়ে নানা রকম গুঞ্জন শুরু হয়েছে, দু একটি বাংলা সংবাদপত্রে বাঁকা মন্তব্যও প্রকাশিত হয়েছে। লোকে চিনুক বা বিরূপ মন্তব্য করুক, তার চেয়েও বড় কথা, এর মধ্যে বিপদের সম্ভাবনা আছে পদে পদে। এই সব পল্লীতে খুনে-ঠ্যাঙাড়ের অবাধ বিচরণ, তাদের হাতে যে-কোনো মুহূর্তে পড়তে পারে নবীনকুমার। তবু সে ভ্রূক্ষেপহীন। দুলালকেও সে সঙ্গে নিতে চায় না। দুলাল গোপনে তাকে অনুসরণ করবার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে। নবীনকুমারের এ আচরণের অর্থ বার করা সত্যিই তো দুঃসাধ্য। যদি শখ হয় রাখুক না সে দশ-বিশটা রক্ষিতা, যদি মদ্যপানের নেশা ধরে থাকে, এক সমুদ্র ব্র্যাণ্ডি-শ্যাম্পেন পান করতে তাকে কে বাধা দেবে? কিন্তু অন্ধকার গলি ঘুজিতে পায়ে হেঁটে হেঁটে ঘুরে সে বুনিয়াদী সমাজের নাম ডোবাতে চাইছে কেন? একে উন্মাদ-দশা ছাড়া আর কী বলা যায়?
কোনো গলির মাথায় হলুদ রঙের অর্ধেক চাঁদ উঠেছে, বাকি আকাশে মেষরোম মেঘ, কেমন যেন অপ্রাকৃত আলো পড়েছে পৃথিবীতে, শীতের বাতাসে যাই যাই শব্দ। পথ চলতে চলতে হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে যায় নবীনকুমার। তার মনে প্রশ্ন জাগে, আমি এমনভাবে কোথায় চলেছি, কেন চলেছি? কোন আলেয়ার সন্ধানে আমি এমন ঘুরে ঘুরে মরছি!
আলেয়াই বটে! শুধু তো চন্দ্রনাথকে খুঁজে বার করার জন্য তার এত শিরঃপীড়া নয়। সে চায় সেই রমণীটিকে আর একবার দেখতে। কে সেই রমণী? কোনো ভদ্রঘরের কুলবধু নিশ্চয়ই নয়, তা হলে অত রাতে চন্দ্রনাথের সঙ্গে সে আসবে কেন? চন্দ্রনাথকেও নবীনকুমার যতটা চিনেছে, তাতে তাকে কারুর বাড়ির বউ-ঝি ফুসলে আনার মতন প্রবৃত্তির মানুষ মনে হয়নি। বরং স্ত্রী জাতি সম্পর্কে তার ব্যবহারে খানিকটা বিরাগ ভোবই প্রকাশিত হতো। তা হলে কে ঐ নারী?
নবীনকুমার তো একথা কারুকে বলতে পারবে না যে এক অজ্ঞাতকুলশীলা রমণীকে অবিকল তার মায়ের মতন দেখতে বলেই সে তাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে! সে নিজের মাকেই দেখেনি কতদিন, হরিদ্বারে মাতৃ সন্নিধানে যাবে বলে সঙ্কল্প নিয়েছিল, তাও এখন শিকেয় তোলা। ঐ রমণীটিকে দ্বিতীয়বার না দেখতে পেলে তার কিছুতেই শান্তি হবে না।
মাঝে মাঝে সে নিজেই নিজের কাছে প্রশ্ন তোলে যে, ওর সঙ্গে দ্বিতীয়বার সাক্ষাৎ হলেই বা কী হবে? একজন বিপথগামিনী স্ত্রীলোকের সঙ্গে তার মায়ের মুখের আদল যদি থাকেও, তাতেই বা কী আসে যায়? তাকে খুঁজে বার করবার জন্য এই গোঁয়াতুমি কেন? এর উত্তর নবীনকুমার নিজের কাছে দিতে পারে না। দুলাল ঐ স্ত্রীলোকটির সঙ্গে বিম্ববতীর কোনো মিল খুঁজে পায়নি, হয়তো সবটাই নবীনকুমারের দৃষ্টিবিভ্রম। তবু সে আর একবার মিলিয়ে দেখবেই। সন্ধে হবার পর এই জেদ ছাড়া তার আর কিছুই মনে থাকে না।
সুস্থ মস্তিষ্কে, স্বচ্ছ চোখে নবীনকুমার ঐ সব গৃহে প্রবেশ করতে পারে না, কারণ নোংরা পরিবেশ, নানা রকম খাদ্য পানীয়ের মিশ্রিত বিকট গন্ধ তাকে পীড়া দেয়। অপরিচ্ছন্নতার প্রতি তার তীব্ব ঘৃণাবোধ আছে। সেই জন্য সে শুরু থেকেই মদ্য গলায় ঢেলে চক্ষু রঙীন করে নেয়, তখন আর নাকে অন্য কোনো ভ্ৰাণ আসে না। এক গৃহ থেকে অন্য গৃহে পরিক্রমার সময় মদ্যপান বাড়তেই থাকে। এক-একটি বারবনিতার কক্ষের দ্বারে আঘাত করে সে বাইরে দাঁড়ায়। প্রথমে বারবনিতাটির মুখ দেখে সে নিরাশ হয়, গলায় এক ঢোঁক ব্র্যাণ্ডি নেয়, তারপর চন্দ্ৰনাথ ও সেই রমণীটির বর্ণনা দিয়ে বলে, এরা কোতায় থাকে জানো? দ্বিতীয়বার নিরাশ হয়ে সে কুর্তার পকেট থেকে দশ-বিশ টাকা বার করে বারবনিতাটির দিকে ছুঁড়ে দেয়।
এইভাবে গত কয়েক মাসে নবীনকুমার দুই সহস্র চারশত বাহাত্তরটি রূপোপজীবিনীর মুখ দর্শন করেছে। কিন্তু স্পর্শ করেনি। একজনকেও। তার পরিচ্ছন্নতার বাতিক, অপরের উচ্ছিষ্ট খাদ্য সে প্ৰাণ গেলেও গ্রহণ করতে পারবে না।
দিনের বেলায় নবীনকুমার স্বাভাবিকভাবে কিছু কাজ কর্ম করে। গীতা অনুবাদের কাজ শুরু হয়েছে, সম্পূর্ণ রামায়ণের গদ্য অনুবাদের জন্য তোড়জোড় চলছে। দরিদ্র গ্রন্থকারদের পুস্তক রচনায় সাহায্য ও প্রকাশের ব্যয় বাবদ সে মুক্তহস্তে সাহায্য করে। দুটি স্কুল ও একটি মাদ্রাসা স্থাপনের ব্যাপারে সে প্রধান পৃষ্ঠপোষক। আদালতে দেশীয় বিচারক নিয়োগের ব্যাপারে একটা আন্দোলন গড়ে তোলায় সে মুখ্য ভূমিকা নিয়েছে। কিন্তু রাত্রিকালে সে অন্য মানুষ।
একদিন নবীনকুমারের নামে পার্শেল যোগে একটি পুস্তিকা এলো। সেটির নাম আপনার মুখ আপনি দেখা। কয়েকটি পৃষ্ঠা অবহেলার সঙ্গে ওল্টাতেই তার মনোযোগ আকৃষ্ট হলো বিশেষ ভাবে। পুস্তিকাটি তার সম্পর্কেই লিখিত। হুতোম প্যাঁচার নক্সা লিখে সে সমাজের অনেক ভণ্ড মহৎবাবুদের বিষ নজরে পড়েছিল, তাদেরই কেউ কোনো ভাড়াটে লেখক দিয়ে এই আক্রমণাত্মক রচনাটি লিখিয়েছে। এতে নবীনকুমারের নাম দেওয়া হয়েছে নববাবু। ওষ্ঠে মৃদু-মৃদু হাস্য রেখে নবীনকুমার পুস্তিকাটি পড়ে যেতে লাগলো। ভাড়া করা লেখকটি লিখেছে। অনেক কিছুই, নবীনকুমারের বাল্যকাল, তাঁর নাটক ও অভিনয়ের প্রশংসাই করেছে, যদিও এর ভাষা একেবারে হুতোমের নকশারই অক্ষম নকল। ক্রমে দেখানো হয়েছে, এই নববাবু কেমন ভাবে মদ, মেয়েমানুষে আসক্ত হলো। বিদ্যোৎসাহিনী সভা স্থাপনের ভড়ং করে নববাবু আসলে ইয়ার-বক্সীদের নিয়ে পঞ্চ ম-কারের চাচা করেন,-নববাবু সভ্যবাবুদিগকে মেয়েমানুষের কথা জিজ্ঞাসা করায় ঘোষজা বলিলেন, মহাশয়, অনেক বেটীর সঙ্গে আলাপ আছে, আর আলাপ না থাকলে অবিদ্যাদের সঙ্গে আলাপ করবার মুশকিল। কি? মিত্রবাবু বলিলেন, মহাশয়, আলাপ নাই। এমত মেয়েমানুষ নাই!-বাবু বলিলেন, কেন গো, আপনি যে সতী সাবিত্রীর মতন কথা কোচেন, তবে এ পথে এসে কেন দাঁড়ালেন? খানকী হয়ে তোমাদের কি এরূপ কথা বলা সাজে?–
পড়া শেষ করে নবীনকুমার খুব এক চোট হাসলো। এর আগে সংবাদপত্রে দু-একটা ছুটোছটা মন্তব্য তারও চক্ষু এড়ায়নি। ব্যাপার তবে এতদূর গড়িয়েছে যে এখন তাকে নিয়ে বই লেখা হয়! এই লেখকের ধারণা যে নবীনকুমার এ শহরের কোনো মেয়েমানুষকেই ভোগ করতে বাকি রাখেনি। ভাবুক, ওদের যা ইচ্ছে ভাবুক।