ছাদের ছোট ঘরটিতে বসে নিবিষ্ট মনে পড়াশুনো করছে কুসুমকুমারী।
সারা দিনের প্রায় অধিকাংশ সময়ই কুসুমকুমারী এইখানে কাটায়। স্থানটি বড় নির্জন, বড় মনোরম। গৃহের অন্যান্য বাসিন্দাদের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক থাকে না। দ্বিপ্রহরে চতুর্দিক একেবারে শুনশান, মধ্যে মধ্যে শুধু শোনা যায় পথের ফেরিওয়ালাদের হাঁক, শিল কোটাও! কুয়োর বালতি তোলাবে গো! দাঁতের পোকা ভালো করবে। গো! বাসন চাই, বাসন! মীর্জাপুরী কাঁসার বাসন! হিং চাই, হিং! প্ৰত্যেকের একটি নিজস্ব সুর আছে। কাকের ডাক, শালিকের ডাকের সঙ্গে ফেরিওয়ালাদের এই হাঁক যেন ঠিকঠাক মিলে যায়, সবই মনে হয় প্রকৃতির অঙ্গ।
ছাদের আলসেতে বসেছে এক জোড়া চিল, মাঝে মাঝে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় কুসুমকুমারীর দিকে। চিল দেখলে বড় ভয় হয় তার। কী তীক্ষ্ণ ঠোঁট, আর সব সময় রাগী রাগী চোখ। খুব ছেলেবেলায় কুসুমকুমারীদের বাপের বাড়িতে হিমু নামে একটি বালক ভৃত্য ছিল, একদিন তার কী অবস্থা! বাগবাজারের ভুবন ময়রার দোকান থেকে রসগোল্লা আর রাধাবল্লভী আনতে পাঠানো হয়েছিল তাকে, দু হাতে দুটো চাঙ্গারি নিয়ে আসছিল হিমু, এমন সময় আট দশটা চিল এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে তার ওপরে। ক্ষত বিক্ষত অবস্থায় কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফিরে আছড়ে পড়েছিল হিমু, তার গালে চিলের নোখের আঁচড়ের ফালা ফালা দাগ। সেই থেকে চিল দেখলেই কুসুমকুমারীর বুক কাঁপে। সে যে উঠে গিয়ে চিল দুটোকে তাড়িয়ে দেবে, সে সাহসও নেই।
মাঝে মাঝে অন্যমনস্ক হয়ে যায়, আবার পাঠে মনোনিবেশ করে কুসুমকুমারী। গঙ্গানারায়ণ বড় কড়া শিক্ষক, রোজ তাকে পড়া দিয়ে যায়, রাত্রে এসে ধরে। বৎসর খানেকের মধ্যেই গঙ্গানারায়ণ তাকে অনেকখানি ইংরেজিও শিখিয়েছে। ব্যাকরণের ওপর বেশী জোর দেয়নি। গঙ্গানারায়ণ, প্ৰথমে সে কুসুমকুমারীকে কিছু ইংরেজী কবিতা মুখস্থ করিয়ে দিয়েছে, অর্থনা বুঝে শুধু তোতা পাখির মতন কণ্ঠস্থ করা, তারপর এক এক করে প্রতিটি শব্দের অর্থ বুঝিয়েছে। এরপর এক একটি পুরো কবিতার অর্থ কুসুমকুমারীকে বাংলায় লিখতে হবে। এই রকম এখন কিছুদিন চলছে তার হোম টাস্ক। কোনো ইংরেজী শব্দের অর্থ ভুলে গেলে অভিধান দেখে নিতেও শিখেছে কুসুমকুমারী।
আজকের পাঠ্য শেলীর একটি কবিতা। লাইনস টু অ্যান ইণ্ডিয়ান এয়ার।
গঙ্গানারায়ণ বলেছিল, দ্যাকো, আমাদের কবি কালিদাস যেমন মেঘকে উদ্দেশ করে লিকেচিলেন মেঘদূত কাব্য, সেই রকম একজন ইংরেজ কবি লিকেচেন হাওয়াকে উদ্দেশ করে। ইনি মস্ত বড় কবি, জানো তো পি বি শেলী, মারা গ্যাচেন অল্প বয়েসে, কিন্তু সৃষ্টি করে গ্যাচেন অমর কাব্য। আরও মজার কতা শোনো, ইনি কখনো আসেননিকো আমাদের দেশে, অথচ এই ভারতের সুস্নিগ্ধ বাতাসকে এত ভালোবেসেচেন যে তার ওপরেই লিকে ফেলেচেন একখানা এমন মধুর কবিতা!
দি ওয়াণ্ডারিং এয়ারস দে ফেইণ্ট
অন দ্য ডার্ক দা সাইলেণ্ট স্ট্রিম—
দি চম্পক ওডারস ফেইল
লাইক সুইট থটুস ইন আ ড্রিম;
দি নাইটিঙ্গেল কমপ্লেইন
ইট ডাইজ আপ অন হার হার্ট
অ্যাজ আই মাস্ট ডাই অন দাইন
ও বিলাভেড্ অ্যাজ দাও আর্ট!
ভাবাবেগে উদাত্ত কণ্ঠে পড়তে পড়তে গঙ্গানারায়ণ বলেছিল, মাঝখানে ঐ যে একটা শব্দ শুনলে, দি চম্পক, ওটা কিন্তু আমাদের চাঁপা ফুল। হিন্দু কলেজে আমাদের রিচার্ডসন সাহেব পড়াতে পড়াতে ওটা উচ্চারণ করতেন, দি ছামপাক! আমি বলেছিলুম, স্যার আমাদের চম্পককে কেন ছামপাক বলবো! শুনে রিচার্ডসন সাহেব হেসেছিলেন। আমার বন্ধু মধু, ঐ যে সেদিন বিলেত গ্যালো, ঐ মধু ছিল ছেলেবয়েসে বড্ড ইংরেজ গোঁড়া। সে বলেছিল, না, ইংরেজি বলার সময় কোনো দেশী শব্দ এসে গেল তো তাও উচ্চারণ করতে হবে ইংরেজদের মতনই। মধু গৌরকে ডাকতো গাউর, আমায় ডাকতো দি গ্যানজেস।
এক নিরালায় ইংরেজী কাব্য পাঠ করতে করতে অকস্মাৎ এক সময় লজ্জায় কুসুমকুমারীর গণ্ডদেশ ও কর্ণমূল আরক্ত হয়ে যায়। যেন কোনো অপার্থিব সুখের আলো এসে পড়ে মুখে।
…লেট দাই লাভ ইন কিসেস রেইল
অন মাই লিপস অ্যাণ্ড আইলিডস পেইল
এই লাইন দুটির অর্থ বোঝাবার সময় কী কাণ্ডই না করেছিল গঙ্গানারায়ণ! মাঝে মাঝে কুসুমকুমারীর স্বামীটি যেন একেবারে শিশুর মতন হয়ে যায়!
গঙ্গানারায়ণ বলেছিল, কিসেস রেইন মানে কী বুঝলে তো? বৃষ্টির মতন চুম্বন ঝরে পড়া, কেমন ভাবে ঝরে পড়ে দেখবে? বলতে বলতেই লম্বফ দিয়ে উঠে এসে কুসুমকুমারীকে আলিঙ্গনাবদ্ধ করে আবার বলেছিল, এই এমনি ভাবে-ঠোঁটের ওপরে–চোখের পাতার ওপরে-। ইস, তখনও বেশী রাত নয়, ঘরের বাইরে একজন দাসী বসেছিল, সে যদি কিছু দেখে থাকে!
সুন্দর একটি বাঁধানো খাতায় কুসুমকুমারী সেই ইংরেজী কবিতার বাংলা অর্থ লেখে। এক সময় হঠাৎ ঘোর গর্জন শুনে সে আমূল চমকিত হয়ে যায়। বই খাতা রেখে সে চলে আসে দ্বারের সামনে। আকাশে যে কখন এত মেঘ ঘনিয়েছে, সে টেরই পায়নি। দক্ষিণের আকাশ ভলুকবৰ্ণ মেঘে একেবারে সমাকীর্ণ। দৈত্যসম্রাটের হুংকার কণ্ঠস্বরে বাজ হেঁকে উঠছে, আকাশের এক প্ৰান্ত থেকে আর এক প্রান্ত চিরে চলে যাচ্ছে বিদ্যুৎ। এমন জোর একটা ঝড়ের ঝাপটা এলো যে কুসুমকুমারীর প্রথমে মনে হলো সে অন্ধ হয়ে গেছে। আঁচল চাপা দিল চক্ষে। জানলা দরজাগুলি এই সুযোগে জীবন্ত হয়ে উঠে ছটফট করতে লাগলো।
এই সময় ছাদে একা থাকতে কুসুমকুমারীর গা ছমছম করে। ঝড়ের বেগ প্রশমিত হবার কোনো লক্ষণ নেই। ছোট ঘরটি থেকে বেরিয়ে সিঁড়ির কাছে পৌঁছোবার আগেই কুসুমকুমারী ধরা পড়ে গেল ঝড়ের হাতে। সে তার শাড়ি সামলাবার জন্য শক্ত করে চেপে ধরে রইলো নিজেকে, এদিকে তার মাথার সব চুল যেন ঝড়ের সঙ্গী হতে চায়। এক পা হাঁটতে গেলেই ঘুরে পড়ে যাবার মতন অবস্থা। তারপর হুড়মুড়িয়ে বৃষ্টি আসতেই সব প্রতিরোধ তুলে নিয়ে আত্মসমৰ্পণ করলো কুসুমকুমারী।
কাছাকাছি আর কোনো উচ্চ প্রাসাদ নেই, এই অট্টালিকার ছাদেও উঁচু প্রাচীর দিয়ে ঘেরা, সুতরাং এখানে বৃষ্টি-স্নান করতে কোনো বাধা নেই তার। আঃ কী সুখ, কী সুখ! জীবন এত সুন্দর! স্বৰ্গলোক থেকে নেমে আসা কোনো অপ্সরার মতন কুসুমকুমারী দু হাত ছড়িয়ে নৃত্যের ভঙ্গিতে ঘুরতে লাগলো বৃষ্টির মধ্যে। কাব্যের বর্ণনার চেয়েও সত্যিকারের প্রকৃতির রূপ দুই চক্ষু মেলে দেখা আরও কত বেশী উপভোগ্য। আকাশজোড়া এই যে বিদ্যুৎ-চমক, এই যে প্রবল বজ-নিঘোষ, এর বর্ণনা করতে পারে মানুষের কোনো ভাষা? এই যে এত বড় একটা আকাশ, তাও কি কোনো দিন কোনো কাব্যে ধরা পড়েছে? বাগানের গাছগুলি বৃষ্টির অভ্যর্থনায় নুয়ে নুয়ে পড়ছে।
এক সময় সিঁড়ির মুখে দাঁড়িয়ে কুসুমকুমারী ডাকলো, সরোজ, সরোজ! শিগগির শুনে যা! দু তিনবার ডাকার পর সরোজিনী শুনতে পেয়ে সিঁড়ির কাছে এসে বললো, কী গো, ডাকচো 6<না?
—শিগগির ওপরে উঠে আয়!
—ওমা, দিদি, তুমি একেবারে ভিজে গ্যাচে যে!
—উঠে আয় না মুখপুড়ী! দেরি কচ্চিস কেন? সরোজিনী ওপরে উঠে আসতেই কুসুমকুমারী বললো,আয় বৃষ্টিতে স্নান করি। আমি তো কতক্ষণ ভিজচি, হঠাৎ মনে হলো, আহা আমি একলা একলা এত আনন্দ কচ্চি, সরোজকেও ডাকি!
সরোজিনী ভয় পেয়ে যায়। একটু সিঁটিয়ে গিয়ে বলে, এই বৃষ্টিতে ভিজবো? তুমি কি পাগল না কি দিদি, এ রকম ভিজলে যে সান্নিপাতিক হবে।
—আঃ, এই মেয়েটাকে নিয়ে আর পারি না! সব তাতেই তোর ভয়, সান্নিপাতিক হবে তো হবে! নে আয়!
—ছাতে-ভিজে কাপড়ে…কেউ যদি আমাদের দেকে ফ্যালে?
—এখেনে কে দেকবে। আচ্ছা নে, সিঁড়ির দরজাটা বন্ধ করে দিচ্ছি—
সরোজিনীকে জোর করেই টেনে বৃষ্টির মধ্যে নিয়ে এলো কুসুমকুমারী। উদ্ভাসিত মুখে জিজ্ঞেস করলো, কী, ভালো লাগচে না?
সরোজিনী তেমন উৎসাহিত হতে পারে না, একটু আড়ষ্ট হয়েই থাকে। কুসুমকুমারী তাকে আবার বললো, ইস, একটু আগে যদি আসতি, ঝড়ের সময় যদি দেকতি আকাশটা। ঠিক যেন পাগলা হাতির মতন শুড় তুলে ছুটে আসছিল মেঘগুলো। একেই বলে মেঘের বিপ্ৰক্ৰীড়া।
প্রায় এক ঘণ্টা ধরে স্নান করবার পর দুই তরুণী নেমে যায় নিচে। তারপর ওদের বেশ শীত করতে থাকে। কুসুমকুমারী রান্নাঘরে তার দাসীকে পাঠিয়ে দেয় বিশেষ নির্দেশ দিয়ে। দারুচিনি, এলাচ আর আদা ফোঁটানো এক প্রকার তরল তপ্ত পানীয় সে একটু পরে এনে দিলে কুসুমকুমারী বলে, নে, গরম গরম খেয়ে নে, সরোজ, দেকবি আর কিচু হবে নাকো!
কুসুমকুমারী এর পর গুন গুন করে একটা গান ধরে। জীবন তাকে চতুর্দিক থেকে ভরিয়ে দিয়েছে, সুখ যেন আর ধরে না তার শরীরে। হাটখোলার দত্ত বাড়িতে সে যখন বালিকা বয়েসে বধু হয়ে গিয়েছিল, তখন উন্মাদ স্বামীকে দেখে সে ভেবেছিল, তার ভবিষ্যৎ একেবারে নিঃস্ব হয়ে গেছে, কিন্তু আবার তার জীবনে যে এমন পরিপূর্ণতা আসবে সে স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি। তার স্বামী গঙ্গানারায়ণ একেবারে দেবতার মতন মানুষ, জন্ম-জন্মান্তর তপস্যা করেও কটা মেয়ে এমন স্বামী পায়!
শুধু একটি ব্যাপারে কুসুমকুমারীর মনে একটু অস্বস্তি রয়েছে। তার দেবর নবীনকুমার তার সঙ্গে কথা বলতে চায় না। এই মানুষটিকে সে কত কম বয়েস থেকে চেনে, তার মিতেনীর স্বামী ছিল, এখন একমাত্র দেবর, তার সঙ্গে সে কত গল্প করবে ভেবেছিল। বিষয় সম্পত্তির দেখাশুনো সব গঙ্গানারায়ণকেই করতে হয় বলে সে সারাদিন খুব ব্যস্ত থাকে, কিন্তু নবীনকুমারের বাড়ি থেকে বহির্গত হবার কোনো নির্দিষ্ট সময় নেই। পরিদর্শক যে-কয়েক মাস চলেছিল তখন নবীনকুমার নিশ্বাস ফেলারও সময় পেত না। তারপর থেকে তার আর কোনো কাজে উৎসাহ নেই। মহাভারত অনুবাদের কাজটি এখনো সে চালিয়ে যাচ্ছে বটে, কিন্তু কখনো কখনো তিন চার দিন সে নিজ কক্ষ থেকে বাইরেই আসে না। তিন চার মাস সে কঠিন পীড়ায় শয্যাশায়ী ছিল, এখন সেরে উঠেও সে অনেকটা নিরুদ্যম হয়ে আছে।
নবীনকুমার কুসুমকুমারীকে দেখলেই এড়িয়ে যেতে চেষ্টা করে। দু একটি শুষ্ক ভদ্রতার বাক্য বলে সে স্থান থেকে চলে যায়। কেন যে তার ব্যবহার এরকম আড়ষ্ট, সে কথা বুঝতেই পারে না কুসুমকুমারী। সে বিধবা হবার পর নবীনকুমারই যে তার দ্বিতীয় বিবাহের সবিশেষ উদ্যোগ নিয়েছিল, তাও তো সে জানে। অথচ এখন তার প্রতি এত অনীহা! কুসুমকুমারী আশা করেছিল এ বাড়ি কত জমজমাট হবে, কত সমারোহ। তার বিবাহের আগেই সে এ বাড়িতে এসে দেখে গেছে দুটি নাটকের অভিনয়, সে কি অপূর্ব সুন্দর ব্যাপার! বিদ্যোৎসাহিনী সভার অধিবেশনে এখানে কত সব খ্যাতনামা ব্যক্তিদের সমাবেশের কথা সে শুনেছে। এ সব কিছুতেই কুসুমকুমারীর খুব আগ্রহ। অথচ সে এ বাড়ির বধূ হয়ে আসবার পর সেই সবকিছুই যেন বন্ধ হয়ে গেছে।
নবীনকুমারের ব্যবহারে কোনো ত্রুটি থাকলে সে অভিযোগ জানাতে পারতো গঙ্গানারায়ণের কাছে বা স্বয়ং নবীনকুমারের কাছেই। কিন্তু তা তো নয়। নবীনকুমারের ব্যবহারে বিনয় বা সম্ভ্রমের কোনো ঘাটতি থাকে না। কিন্তু এত বিনয় বা সম্ভ্রমই বা কেন? নবীনকুমারের চেয়ে সে বয়েসে প্রায় পাঁচ বছরের ছোট, তবু নবীনকুমার তার সঙ্গে আপনি আজ্ঞে বলে কথা বলে। অথচ এই মানুষই এক সময় তার নাম দিয়েছিল বনজ্যোৎস্না। এই পরিবারে কি এমন নিয়ম যে, বয়সের তফাত যাই থাক সম্পর্কে গুরুজন হলেই আর কারুর সঙ্গে হাসি-তামাশা করা নিষিদ্ধ? কুসুমকুমারীর বাপের বাড়িতে তো এরকম কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। তার সেজদাদার স্ত্রী আর তার নদাদা প্ৰায় সমান বয়েসী, তারা তো সব সময় খুনসুটি করে। সেজদাদার স্ত্রী সকলের সঙ্গেই খেলার সময় খেলুড়ি হতো।
বিকেলের দিকে বৃষ্টি কিছু ধরে গিয়ে আবহাওয়া থমথমে হয়ে গেল। আকাশ কৃষ্ণবর্ণ ধারণ করেই রইলো এবং ওপরের দিকে তাকালেই মনে হয় আকাশ অনেক নিচে নেমে এসেছে। কেমন যেন অস্বাভাবিক অবস্থা, খুব ঘন ঘন চমকে উঠছে বিদ্যুৎ, কিন্তু বজপাতের কোনো শব্দ নেই। এই সব ঘনঘোর দিনগুলিতে একা থাকতে বড় মন উতলা লাগে কুসুমকুমারীর। এত কাল সে বৃহৎ পরিবারে কাটিয়ে এসেছে, তার পিত্ৰালয়ে আত্মীয়স্বজন মিলিয়ে পঞ্চাশের বেশী নারী পুরুষ থাকে। সেই তুলনায় যেন খাঁ খাঁ করে জোড়াসাঁকোর সিংহদের এত বড় প্রাসাদ।
কার সঙ্গেই বা গল্প করে সময় কাটাবে কুসুমকুমারী। এক তো ঐ সরোজিনী, কিন্তু সে যেন কিছুদিন ধরে কেমন মন-মরা হয়ে গেছে। কুসুমকুমারী অনেক চেষ্টা করেও ওকে প্ৰফুল্ল করতে পারেনি। তা ছাড়া সরোজিনীর বুদ্ধি যে তেমন প্রখর নয়, তা বুঝতে পারা গেছে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে।
সন্ধের পর খুব মিহিন বৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গে আবার বইতে লাগলো জোর বাতাস। ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে লাগলো বাতাসের বেগ, সমুদ্র-গর্জনের মতন অবিরাম শব্দ বাইরে, দরজা-জানলা সব বন্ধ করা হলেও মনে হতে লাগলো। সারা বাড়িটা যেন কাঁপছে। ঘরের সব দরজা-জানলা বন্ধ রাখা একটুও পছন্দ নয় কুসুমকুমারীর, কিন্তু এখন আর খোলার উপায় নেই, চতুর্দিকে দুমদাম শব্দ হচ্ছে, কী সব যেন ভাঙছে।
প্রকৃতি আজ ক্রুদ্ধ খেলায় মেতেছে, কিন্তু তা দেখতে পাচ্ছে না বলেই কুসুমকুমারীর আরও বেশী ছটফটানি। বন্ধ ঘরে সে একা বসে থাকেই বা কী করে? বই পড়ায় আর মন বসে না। গঙ্গানারায়ণ কখন ফিরবে কে জানে।
একজন দাসী এসে খবর দিল, তাদের বাড়ির পিছনের বাগানে কয়েকটি গাছ উপড়ে পড়েছে, কারা নাকি বলছে গঙ্গার বান ওপরে উঠে এসে ভাসিয়ে দিয়েছে কেল্লার মাঠ। আর একটু পরে খবর পাওয়া গেল দাস-দাসীদের গোলপাতার ঘরের ছাউনিগুলো আকাশে উড়ে যে কোথায় চলে গেছে, আর দেখাই গেল না। আরও একটু রাতে খবর এলো, পাঘুরিয়ার ঠাকুরদের বাড়ির একটি অংশ সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছে। এবং ঝড়ের তাণ্ডব বৃদ্ধিই পাচ্ছে ক্রমশ।
বাপের বাড়ি থেকে আনা দুই দাসীর সঙ্গে তাস নিয়ে বিন্তি খেলে সময় কাটাচ্ছিল কুসুমকুমারী, রাত্রি দশটা বেজে গেলে তার বক্ষের ভিতরকার ঝড়ের আন্দোলন বাইরের ঝড়কেও ছাড়িয়ে গেল। গঙ্গানারায়ণ ফিরলো না এখনো! এমন দুর্যোগের রাতে পথে বোধ হয়। আর একটিও মানুষ নেই, গঙ্গানারায়ণ। তবে কোথায় গেল!
কুসুমকুমারী অসহায় বোধ করে। কাকে গিয়ে বলবে, কে ব্যবস্থা নেবে? কৰ্মচারীদের খবর পাঠাতে পারে, কিন্তু কৰ্মচারীরা কতটা কী করতে পারে? এরই মধ্যে একটি বন্ধ জানলা খুলে গেল ঝড়ের ধাক্কায়, ঝনঝন ঝনঝনি শব্দে ভেঙে পড়লো কাচ, প্রবল বাতাসে লণ্ডভণ্ড হয়ে গেল সব কিছু। অতি কষ্টে সেই জানলা আবার বন্ধ করা হলো, তারই মধ্যে বাইরের ঝড়ের দিকে তাকিয়ে ছমছম করে উঠলো সকলের শরীর। আস্তে আস্তো গাছ উড়ে যাচ্ছে আকাশ দিয়ে!
কুসুমকুমারী আর পারলো না, বারান্দার অন্য প্রান্তে ছুটে গিয়ে সরোজিনীর ঘরে ধাক্কা দিয়ে বললো, ও সরোজ, খোল, খোল!
সরোজিনী দরজা খুলে উদভ্ৰান্ত কুসুমকুমারীকে দেখে বললো, ও দিদি, আমারও বড় ভয় কচ্চে! আজ বুঝি পৃথিবী রসাতলে যাবে!
—ছোটবাবু কোতায়? বাড়িতে আচেন?
–হ্যাঁ আচেন। সারাদিনই তো শুয়ে রয়েচোন!
—একবার ডাক তাকে। আমার বুঝি সর্বনাশ হয়ে গ্যালো!
ভীতি-বিহ্বল মুখে আড়ষ্টভাবে দাঁড়িয়ে রইলো সরোজিনী। নবীনকুমার সম্প্রতি স্বগৃহে বসেই একাকী মদ্যপান করতে শুরু করেছে। সে সময় নিজের ঘরেই সে আবদ্ধ থাকে, কারও সঙ্গে দেখা করে না। সরোজিনী কথা বলতে গেলে ধমক খায়। রাত্রির এই সময়েসে আর সম্পূর্ণ প্রকৃতিস্থ থাকে না।
—দাঁড়িয়ে রইলি কেন, সরোজ? উনি যে এখনো ফেরেননি!
–ও মা, সে কি সর্বনাশের কতা!
—আমি আর কাকে বলবো, কোতায় যাবো? ছোটবাবুকে একবার ডাক।
এই সময় ডাকলে উনি যে বড় রাগ করেন, কুসুমকুমারী আর এক মুহূর্ত সময়ক্ষেপ করতে চায় না। সরোজিনীর সঙ্গে কথা বলে কোনো লাভ নেই। বুঝে সে নিজেই দৌড়ে গিয়ে নবীনকুমারের ঘরের বন্ধ দরজায় দুম দুম করে আঘাত করতে লাগলো।
ভেতর থেকে নবীনকুমার ক্রুদ্ধ স্বরে বললো, কে? দূর হয়ে যা!
–ছোটবাবু…একবার খুলুন…মহা বিপদ…
দরজা খুলে নবীনকুমার আরও জোর ধমক দিতে যাচ্ছিল, কুসুমকুমারীকে দেখে দৃষ্টির উষ্মা মুছে ফেললো। তারপর সসম্ভ্রমে প্রশ্ন করলো, এ কি, বউঠান, আপনি-এত রাতে?
—আমার-আপনার দাদা এখনো ফেরেননি-বাইরে এই কাণ্ড চলচে—
—কী হয়েচে বাইরে?
—আপনি টের পাননি কী সাংঘাতিক ঝড়-আজই বুঝি প্ৰলয়…
—আপনি শান্ত হোন, বউঠান। এত ভয়ের কী আচে! দাদা কোতায় গ্যাচেন!
–জানি না।
নবীনকুমার কয়েক মুহূর্ত চিন্তা করলো, যেন সে বুঝতে চায় গঙ্গানারায়ণ কোথায় যেতে পারে। তারপর ডান পাশে সরে গিয়ে একটা জানলা খুলতেই ঝড়ের আচমকা ধাক্কা লাগলো তার গায়ে। তবু সে জানলাটা বন্ধ করে দিয়ে এসে বেশ শান্ত ভাবে বললো, হ্যাঁ, বেশ জোরেই ঝড় হচ্চে বটে!
তারপর সে গলা চড়িয়ে ডাকলো, দুলাল? দিবাকর! ওরে কে কোতায় আচিস! সহি-কোচোয়ানদের বল গাড়ি যুততে, আমি বেরুবো।
কুসুমকুমারীর সারা শরীর কম্পিত হচ্ছে, অতি কষ্টে সে রোধ করে আছে উদগত অশ্রু। সরোজিনীর মুখখানি সম্পূর্ণ বিবৰ্ণ।
নারী দুজনের উপস্থিতি গণ্য না করে নবীনকুমার ফিরে গিয়ে তারপালঙ্কের পাশের টেবিলের ওপর থেকে ব্র্যাণ্ডির বোতল তুলে নিয়ে গলায় ঢাললো খানিকটা। বাঁ হাতের তালুর উল্টো পিঠ দিয়ে ওষ্ঠ মুছে সে খুঁজতে লাগলো তার ছড়িটা। সেটা পেয়ে এবং হাতে নিয়ে সে দ্বারের কাছে এসে বললো, আপনার ভয় নেই, বউঠান, আমি যাচ্চি, দাদামণিকে ঠিক খুঁজে নিয়ে আসবো!
সরোজিনী এবার প্রায় কঁকিয়ে বলে উঠলো, আপনি-এ খুন বাইরে যাবেন? বাড়ি ভেঙে পড়চে, গাচ উল্টে যাচ্চে-।
সে কথার উত্তর দেবার কোনো প্রয়োজনই বোধ করলো না নবীনকুমার। ততক্ষণে দুলাল এসে বারান্দায় সিঁড়ির কোণায় দাঁড়িয়েছে। তার দিকে তাকিয়ে বললো, গাড়ি বার হয়েচে?
—ছোটবাবু, বাইরে যে মহাকাণ্ড! এক পা হাঁটা যায় না!
—হুঁ! চল, দেরি করিস না!
সরোজিনী কুসুমকুমারীর হাত চেপে ধরে বললো, ও দিদি!
ততক্ষণে কুসুমকুমারীও বুঝতে পেরেছে।
স্বামীর জন্য দুশ্চিন্তায় হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে সে তার দেবরকে পাঠাচ্ছে বিপদের মধ্যে! তার নিজের যদি সর্বনাশ হয়ে গিয়েও থাকে, তার ওপর সে আবার সরোজিনীরও সর্বনাশ করতে চলেছে! এমন কি দুলাল পর্যন্ত ভয় পাচ্ছে বাইরে যেতে।
সে বলে উঠলো, না, না, আপনি যাবেন না…যাবেন না-লোকজনরা যদি পারে একটু এগিয়ে দেখুক।
নবীনকুমার কোনো উত্তর না দিয়ে এগিয়ে গেল সিঁড়ির দিকে। সরোজিনী আর কুসুমকুমারী এক সঙ্গে ছুটে গেল তাকে আটকাতে।
—যাবেন না। আমার মাথার দিব্যি…আপনার পায়ে পড়ি…
দেখা গেল নারীদের মস্তিষ্ক সম্পর্কে কোনো আগ্রহ নেই নবীনকুমারের, বরং সে দুলালের মাথা লক্ষ্য করে মারবার জন্য ছড়িটা তুলে বললো, হাঁ করে দাঁড়িয়ে আচিস যে? চল!
শত কাকুতি-মিনতি উপেক্ষা করে বেরিয়ে গেল নবীনকুমার। দিবাকর ঘাপটি মেরে লুকিয়ে রইলো কোথাও, দুলাল এবং আরও দুজন ভৃত্য গেল তার সঙ্গে। জুড়ি গাড়ি নেবার কোনো উপায় নেই সত্যিই। পথকে আর পথ বলে চেনাই যায় না। একে তো ঘুরাঘুটি অন্ধকার, শব্দহীন বিদ্যুৎ ঝলকে ক্ষণিকের জন্য দেখা যায়। সারা পথে ছড়িয়ে আছে অসংখ্য গাছের ডালপালা। খড়, খাপড়া, বাঁশ, ইটকাঠি। তার মধ্য দিয়েই নবীনকুমার এগোতে লাগলো, দুলাল ঠিক তার সামনে।
অবশ্য বেশী বুকি নিতে হলো না ওদের। অতি কষ্টে খানিক পথ এগোবার পর ওরা শুনতে পেল মানুষের কণ্ঠ। গঙ্গানারায়ণই ফিরচে কয়েক জনের সঙ্গে। একটা কাজে গঙ্গানারায়ণ গিয়েছিল দক্ষিণেশ্বরে, দুর্যোগে আটকা পড়ে যায়। তবু দুঃসাহস নিয়ে সে ফিরতে শুরু করেছিল, এক স্থলে তার জুড়ি গাড়ি উল্টে যায়। ঘোড়া দুটিই মারা গেছে, কোচোয়ান গুরুতর আহত, সৌভাগ্যবশত গঙ্গানারায়ণের কোনো আঘাত লাগেনি।
বাড়ি ফিরে এসে প্রায় সমস্ত রাতই জেগে থাকতে হলো সকলকে। এই প্রাসাদের একটি অংশও হুড়মুড় করে ভেঙে পড়েছে এক সময়। বাইরে গেলে নিস্তার নেই, ঘরের মধ্যে বসে থাকতেও প্রতি মুহূর্তে বিপদের আশঙ্কা। সত্যিই বুঝি প্ৰলয় শুরু হয়েছে, এই রাতটিই বুঝি পৃথিবীর শেষ রাত্ৰি।