2 of 2

৫২. চন্দ্রনাথ কলকাতা শহরে ফিরে এসেছে

চন্দ্রনাথ কলকাতা শহরে ফিরে এসেছে নতুন মানুষ হয়ে। এখন সে উত্তম পরিচ্ছদে ভূষিত, তার শারীরিক শক্তির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অর্থবল। রেলওয়েতে কয়েক বৎসর চাকুরি করে সে বেশ কিছু অর্থ সঞ্চিত করতে পেরেছে। সে মিতব্যয়ী, মিতাহারী এবং কোনোরকম নেশা ভাং করার অভ্যেস তার নেই, তা ছাড়া এই চাকুরিতে উপরি রোজগার হয় অনেকটা বিনা আয়াসেই।। আকৃতিতেও সে প্রকৃত রূপবান, তার দিকে যে-কেউ একবার দৃষ্টিপাত করলেই দ্বিতীয়বার তাকাবে। এমন দীর্ঘকায় পুরুষ বঙ্গবাসীদের মধ্যে কচিৎ দেখা যায়, গাত্রবৰ্ণ গৌর, শুধু তার ওষ্ঠের রেখায় যেন ঈষৎ বাঁকা ভাব পরিস্ফুট।

রতনমণি জোর করে চন্দ্রনাথকে টেনে নিয়ে এলো স্বগৃহে এবং এমন আদর যত্ন করতে লাগলো, যেন কোনো গুরুঠাকুর এসেছেন। বাগবাজারে তাদের প্রকাণ্ড তিনিমহলা বাড়ি, বাইরের দিকের এক অংশে আছে সুসজ্জিত অতিথিশালা, সেখানে স্থান দেওয়া হলো চন্দ্রনাথকে। কিন্তু এত খাতিরের আদিখ্যেতায় দুদিনেই অস্থির হয়ে উঠলো চন্দ্ৰনাথ তা ছাড়া রতনমণি যতই ভাবোচ্ছাস দেখাক কিছুতেই তাতে চন্দ্রনাথের হৃদয়ে সাড়া জাগে না।

কিছুদিন আগে এ বাড়িতে রতনমণির বিধবা ভগিনী কুসুমকুমারীর পুনর্বিবাহ অনুষ্ঠিত হয়েছে, সে উৎসবের রেশ এখনো যায় নি, দূর-দূর থেকে আগত আত্মীয়স্বজনে ভবন পরিপূর্ণ। বাড়িতে এত ভিড় বলেই রতনমণি চন্দ্রনাথের কাছে এসে নিভৃতি খোঁজে। তার গল্পের আর শেষ নেই।

তাদের বাড়িতে এই বিধবা বিবাহ যে কতখানি গর্বের ব্যাপার সে কথা বারবার সবিস্তারে শোনায় রতনমণি। আত্মীয়দের মধ্যে অনেকেই এর বিরোধিতা করেছিল প্ৰথমে। কিন্তু রতনমণির পিতা কৃষ্ণনাথ পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছিলেন যে এই বিবাহে যারা আসবে না। তাদের সঙ্গে ইহজীবনে তিনি আর কোনো সম্পর্ক রাখবেন না। তখন প্ৰায় সকলেই আমতা আমতা করে মত পরিবর্তন করেছে। যে বনস্পতির ছায়ায় তাদের আশ্রয়, সেই বনস্পতির গাত্রে কুঠারাঘাত করতে তাদের সাহসে কুলোয় নি। বিবাহের দিন গোলমালের আশঙ্কায় প্রায় একশত পুলিস নিযুক্ত করা হয়েছিল প্রহরায়, শেষ পর্যন্ত কিছুই হয়নি। অবশ্য। আর কত গণ্যমান্য মানুষ এসেছিলেন, তাঁদের নাম বলে শেষ করা যায় না।

এই বিবাহের ফলে রতনমণির বুকে অনেকখানি ভরসা জেগেছে। কিছুদিন ধরেই সে একটি বাসনা পরিপোষণ করছিল, সে ব্ৰাহ্মধর্মে দীক্ষা নিতে চায়। এ বাড়িতে এ পর্যন্ত কেউ ব্রাহ্ম হয়নি। তবে রতনমণির পিতা যখন কন্যার পুনর্বিবাহ দেবার মতন উদার হয়েছেম তখন এক পুত্রের ধর্মান্তর গ্রহণেও হয়তো আপত্তি করবেন না।

রতনমণি বললো, চন্দ্রনাথ, তুমি ব্ৰাহ্ম হবে? চলো, তোমাতে আমাতে একদিন দেবেন্দ্ৰবাবুর কাছে যাই।

চন্দ্ৰনাথ দাঁড়িয়ে আছে লোহার শিক বসানো গবাক্ষের ধারে। এখান থেকে এ বাড়ির সদর দেউড়ি স্পষ্ট দেখা যায়। ঐ দেউড়ির বাইরে সে একদিন কাঙালী পংক্তির মধ্যে খাওয়ার আশায় বসেছিল, তাকে মারতে মারতে তাড়িয়ে দেওয়া হয়। এখনও প্রত্যেকদিনই ওখানে কাঙালীরা এসে আশায় আশায় বসে থাকে, সেদিকে তাকালেই চন্দ্রনাথের মনে হয়, সেও যেন কৈশোরের শরীর নিয়ে ওদের মধ্যে রয়েচে।

মুখ ফিরিয়ে সে অন্যমনস্কভাবে বললো, ব্ৰাহ্ম? কেন?

রতনমণি বললো, তুমি ব্ৰাহ্মধর্ম সম্পর্কে কিছু জানো না? বেশ তো আমি তোমায় খানকতক বই পড়তে দেবো। ভাই, আমি এই নবধর্মের মধ্যে সংস্কারমুক্ত পবিত্রতার সন্ধান পেয়েচি। একেশ্বরবাদী হওয়া ছাড়া এই অনড় স্থবির হিন্দুধর্মের কোনো মুক্তি নেইকো। এত জাতপাত ছোঁয়াছুয়ি। এত অবিচার…

চন্দ্ৰনাথ বললো, বর্ধমানে আমি এতদিন একা একা থেকিচি, সেই সময় পড়িচি অনেক বই, ব্ৰাহ্মধর্ম সম্পর্কে আমার কিচু জানতে বাকি নেই। শুধু একটা বিষয় জানতে পারিনি বা বুঝতে পারিনি, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরমশায় ব্ৰাহ্মধর্ম প্রচার করে হিন্দু ধর্মের কুসংস্কার ঘোচাতে চাইচেন বেশ কতা, কিন্তু তিনি কি তাঁর পাল্কী বোহারা কিংবা বাড়ির চাকর-বাকিরদের ঐ ধর্মে দীক্ষা দিয়েচেন?

রতনমণি খাঁটি বিস্ময়ের সঙ্গে জিজ্ঞেস করলেন, চাকরদের দীক্ষা দেবেন? কেন?

—কেন, চাকররা বুঝি হিন্দু নয়? তাদের মুক্তির দরকার নেই?

—তুমি কী বলচো, মাথামুণ্ডু, ছাই বুজতেই পাচ্চি নি! চাকররা দীক্ষা নেবে? তারপর পাঁচজন ভদ্দরলোকের সঙ্গে এক সাথে প্রার্থনায় বসবে? হো-হো-হে! কেউ দীক্ষা দিতে চাইলেই বা সে ব্যাটাদের সাহস হবে কেন? তারা রাজিই হবে না!

-আফ্রিকা থেকে যে-সব নিগ্রোদের আমেরিকায় ক্রীতদাস হিসেবে নেওয়া হয়েচে, তারাও কিন্তু খ্ৰীষ্টধর্মে দীক্ষা পেয়েচে। সেখনে প্রভু-ভৃত্য সব এক ধর্মের। তোমাদের বুঝি আলাদা।

—তুমি যা বলচো, এবার বুজিচি, হ্যাঁ, একদিন সারা দেশের সকলেই ব্ৰাহ্ম হবে, কিন্তু তার আগে, দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের আগে দলে আনা হোক, আগে ভালো করে দানা বাঁধুক!

—আমি দীক্ষা নিতে চাইলে আমায় দেওয়া হবে?

—কেন হবে না? তোমার মতন শিক্ষিত, বুদ্ধিমান মানুষকে আমাদের মধ্যে পেলে…

-সেখেনে আমায় নিশ্চয়ই আত্মপরিচয় দিতে হবে? আমি বলবো, আমার জননী ছিলেন বেশ্যা, আমার পিতা কে তা আমি জানি না।

—এ হে হে, ওসব থাক। তুমি ওসব আগবাড়িয়ে বলতে যাবে কেন?

—অর্থাৎ আমাকে মিথ্যে পরিচয় দিতে বলচো! অথচ বইপত্তর পড়ে দেকিচি, ব্ৰাহ্মদের জীবনে মিথ্যার কোনো স্থান নেই, তাঁরা সত্যের উপাসক। আমি জানি, তোমাদের এই সব সংস্কার আন্দোলন শুধু সমাজের উচ্চবর্ণ বামুন কায়েতদের জন্য। আর আছে বণিকশ্রেণী। একালে জমিদারদের চেয়ে বণিকরাই বেশী শক্তিমান। তারা অভিজাত সাজবার জন্য পুরোনো জমিদারি কিনে নিচে আর সমাজের চূড়ায় ওঠবার জন্য দু হাতে টাকা ছড়িয়ে দয়ালু। পরোপকারী আর সমাজ সংস্কারক সাজচে।

—তুমি এত রেগে যাচ্চো কেন?

—তোমাদের বিদ্যেসাগর মশাইয়ের কাছেও গিয়ে আমি একটা কথা জেনে আসবো। বিদ্যায় বুদ্ধিতে আমি অন্য অনেকের চেয়েই খাটো নই। কিন্তু আমি যদি বিধবা বিবাহ কত্তে চাই, তিনি আমার বিয়ে দিতে রাজি হবেন? তিনি নিজে উপস্থিত থেকে আমার বিয়ে দেবেন? মন্ত্রপাঠের সময় যখন আমার পূর্বপুরুষদের নাম জিজ্ঞেস করা হবে, আমি পরিষ্কার বলবো, আমি জারজ, আমার কোনো পিতৃপরিচয় নেই।

—চন্দ্রনাথ, ঐ জ্বালা তুমি আর বুকে পুষে রেক না। ওসব পুরোনো কতা ভুলে যাও!

—আমি কিচুই ভুলবো না! আর জীবনে কখনো মিথ্যে কতা বলবো না বলে শপথ নিয়েচি!

—কিন্তু সৰ্ব্বক্ষণ বুকের মধ্যে এরকম রাগ বইলে তুমি তো জীবনে কিচুই কত্তে পারবে না। জীবনে ভালো ভালো দিকগুলোন উপভোগ কত্তে গেলে মনটাকে নির্মল রাখতে হয়।

—যে মানুষ অন্যায় ও অবিচারের প্রতিকার করতে চায়, তার ক্ৰোধী ও জেদী থাকাই উচিত। দেকো, তোমাদের এই সমাজটার একদিন আমি ঘাড় মটকাবো!

-হা-হা-হা-হা-হা।

—হাসচো, হাসো। শোনো, তোমাদের এই ব্ৰাহ্মধর্ম কিংবা বিধবা বিবাহটিবাহ এসবই অতি ছেদো ব্যাপার। মুষ্টিমেয় লোকের হুজুক। মানুষের মধ্যে কোনো উচ্চ নীচ শ্রেণী থাকবে না, সব মানুষ সমান হবে, সমান অধিকারের সুযোগ পাবে, এই কতাটা প্রচার করাই এখন প্রকৃত ধর্ম।

—সব মানুষ সমান হবে? এইসব আজগুবী কতা তোমার মাতায় ঢুকলো কী করে? হাতের পাঁচটা আঙুল কখনো সমান হয়? হাতের পাঁচটা আঙুল সমান হলে সে হাতে যেমন কোনো কাজ চলে না, তেমনি সব মানুষ সমান হলে তখুন। আর সমাজও চলবে না! তা হলে কেউ আর প্রজা থাকবে না, সবাই রাজা হতে চাইবে!

—কেউ রাজাও হবে না, কেউ প্ৰজাও থাকবে না। গুণ অনুসারে যে-যার নিজের কাজ করবে। আসল কতা হলো, সকলে সমান অধিকার পাবে। চণ্ডীদাস নামে এক কবির নাম শুনেচে? তিনি গেয়েচিলেন, শুনহ মানুষ ভাই, সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই।

—ও, তিনি তো বোষ্টম ছেলেন না? তা তুমি বোষ্টমদের দলে ভিড়তে পারো অবশ্য। ওরা শুনিচি জন্ম পরিচয়ের ধার ধারে না। যার তার সঙ্গে কণ্ঠী বদল কল্পেই ওদের বে হয়ে যায়। ওদের খুব মজা।

—অর্থাৎ তুমি ওদের বিদ্রূপ কচ্চো। ওরা জাতের বিচার মানে না, বংশ পরিচয় তোয়াক্কা করে না বলেই তোমাদের চক্ষে ওরা বিদ্রূপের পাত্র। তুমি আমাকে এ বাড়িতে ডেকে এনোচো শুধু তোমার আত্মশ্লাঘায় সুড়সুড়ি লাগাতে, আমাকে সম্মান করতে নয়! সে আমি প্রথমেই বুঝিচি। আই নো ইয়োর টাইপ। আই হ্যাভ সীন এনাফ অফ দিস কাইণ্ড অফ হিপোক্রিসি।

এর অল্প পরেই চন্দ্রনাথ নিজের জিনিসপত্র গুছিয়ে রতনমণির গৃহ থেকে নিষ্ক্রান্ত হলো। তারপর একটি কেরাঞ্চি গাড়িতে অনেকক্ষণ ঘুরে শেষ পর্যন্ত একটা বাসা ভাড়া পেল বৈঠকখানা অঞ্চলে। বর্ধমান ছেড়ে কলকাতায় আসবার সময় তার মাথায় কোনো পরিকল্পনা ছিল না, ভেবেছিল দু-চারদিন ঘুরে চলে যাবে। এখন সে ঠিক করলো, এখানে বেশ কিছুদিন থাকবে। রেলের চাকুরিতে ইতিমধ্যেই সে মনে মনে ইস্তফা দিয়ে ফেলেচে।

সন্ধ্যাকালে বাড়ির দরজায় তালা লাগিয়ে সে বেরিয়ে পড়লো পথে। গাড়ি ধরলো না, পদব্ৰজেই ঘুরতে লাগলো। উদ্দেশ্যহীনভাবে।

কলুটোলার কাছে অনেক দোকানপাট এই সময়েও খোলা থাকে। প্রত্যেক দোকানের বাইরে দাউ দাউ করে জ্বলছে মশাল। খরিদ্দারদের ভিড়ে স্থানটি রমরম করে। এক দোকান থেকে চন্দ্রনাথ একটি মজবুত ছড়ি কিনলো, তার ইংরেজি-আনা পোশাকের সঙ্গে মিলিয়ে। তার গাত্রবৰ্ণ ও পোশাকের সামঞ্জস্যের জন্য অনেকে তাকে সাহেব মনে করে। দেশীয় লোকরাই এমন ভুল করবে, সাহেবরা নয়। অবশ্য ট্যাস ফিরিঙ্গি হিসেবে সে নিজেকে চালিয়ে দিতে পারে স্বচ্ছন্দেই। ছড়িতে ভর দিয়ে সে অলস পদক্ষেপে হাঁটতে লাগলো।

মনের গতি অনেক সময় মানুষ নিজেই বুঝতে পারে না। চরণের গতির সঙ্গে মনের গতি মিলে যায়, তবু মানুষ অবাক হয়। এক সময় চন্দ্রনাথ সত্যিই বিস্মিত হলো দেখে যে কখন অজান্তে সে শ্মশানের ধারে পৌঁছে গেছে। এইখান থেকেই একদিন এক দৌড়ে সে কলকাতা ছেড়ে চলে গিয়েছিল; সেইজন্যই এই একই স্থানে তাকে কে যেন টেনে এনেছে।

শ্মশানের পরগাছাদের নিয়ে চন্দ্রনাথ এখানে যে একটি দল গড়েছিল, সেরকম যে দুজন চণ্ডালকে চন্দ্রনাথ এখানে দেখে গিয়েছিল, তাদের মধ্যে একজন এখনো আছে, অন্যজনের বদলি নতুন লোক এসেছে। পুরোনো চণ্ডালটি কি চিনতে পারবে যে এই নীল রঙের কোট-প্যান্টালুন ও মাথায় হ্যাট পরা মানুষটিই এককালের সেই চাঁদু, যে এখানে নেংটি পরে ডাণ্ডা হাতে নিয়ে হৈ-হৈ রৈ-রৈ করে বেড়াতো? চন্দ্রনাথ অবশ্য চণ্ডালটিকে দেখা মাত্র চিনতে পেরেছে। সে কিছুই ভোলে না, জ্ঞান-উন্মেষের পর থেকে তার জীবনের সমস্ত ঘটনাই তার মনে আছে।

সব মিলিয়ে শ্মশানের দৃশ্য ঠিক একইরকম রয়েছে মনে হয়। পর পর তিনটি চিতা জ্বলছে, একদিকে জমিয়ে তাড়ি ও গাঁজা খাচ্ছে শ্মশান-বন্ধুরা, আর এদিকে ওদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আছে শোকে মুহ্যমান আত্মীয়স্বজন। মাংসপোড়ার গন্ধ চন্দ্রনাথের খুব পরিচিত লাগে। কতদিন সে এখানে চিতার পোড়া কাঠ দিয়ে দাঁত মেজেছে।

চন্দ্রনাথ এসে গঙ্গার ঘাটের কাছে দাঁড়ালো। নদীটি যেন তাকে চিনতে পেরেছে, নদী মুখ ফুটে কোনো সম্ভাষণ জানায় না, তবু বোঝা যায়। অন্ধকারের মধ্যে চন্দ্রনাথ নামতে লাগলো সিঁড়ি দিয়ে। একেবারে শেষ ধাপে খালি গা, ধুতি মালকোচা মেরে পর একটি তেরো-চোদ্দ বছরের কিশোর দাঁড়িয়ে আছে জলের দিকে একদৃষ্টি চেয়ে।–

চন্দ্রনাথ আমূল চমকে উঠলো। এ যেন তারই প্রতিরূপ। গৃহত্যাগ করে একদিন ঠিক এই বয়সে, এই রকম অবস্থাতেই সে শ্মশানের প্রান্তে ঘাটের কাছে দাঁড়িয়ে ছিল না? চন্দ্রনাথের বিভ্রম হলো, যেন মনে হলো সত্যিই সে নিজেই এভাবে দাঁড়িয়ে আছে, আবার দ্বিতীয়বার তার জীবন শুরু হচ্ছে।

সে জিজ্ঞেস করলো, এই, তুমি কে?

ছেলেটি মুখ ফেরালো। তার দু চোখে শুকনো জলের রেখা। বোধ হয় সে তার পিতা বা মাতাকে দাহ করতে এসেছে। চন্দ্রনাথের বুকটা মুচড়ে উঠলো। সে প্রায় তার হাত রাখতে গেল ছেলেটির কাঁধে। যদিও পুরোনো অভিজ্ঞতায় চন্দ্রনাথ জানে, শ্মশানে কারুকে সান্ত্বনা জানাতে নেই। এখানে কান্নাতেই চিত্তশুদ্ধি হয়। তা ছাড়া কী সান্ত্বনাই বা সে দেবে!

কাছাকাছি একজন অচেনা মানুষকে দেখে ছেলেটি নিজেকে সামলে নিয়ে ওপরে উঠে গেল। চন্দ্রনাথ নিচু হয়ে গঙ্গা থেকে এক আজলা জল তুলে নিয়ে মাথা থেকে টুপী খুলে সেখানে সেই জল ছোঁয়ালে। চন্দ্রনাথের এ পৃথিবীতে প্রিয় বস্তু কিছুই নেই, তবু একথা ঠিক, একদিন সে এই নদীকে ভালোবেসেছিল।

অন্ধকারে প্রবহমানা নদীর দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো চন্দ্রনাথ। এক সময় তাকে ঘিরে ধরলো শ্মশানের নন্দী ভৃঙ্গীরা। চন্দ্রনাথ সচকিত হয়ে ফিরে তাকালো। তারপরই সজোরে হোসে উঠলো। হা-হা করে। সত্যিই তো কিছু বদলায় না। এক সময় এরকম অন্ধকারে কোনো শাঁসালো-মালদার চেহারার লোককে একা দেখলে সেও তার দলবল নিয়ে তাকে ঘিরে ধরতে না? লোকটার সব কিছু কেড়েকুড়ে সর্বস্বান্ত করে ছাড়তো। এখন এই ছেলের দলও তাকে সেইরকম কোনো লোক ভেবেছে। হাতের ছড়িটা তুলে সে অনেকটা সমোহেই বললো, যাঃ! যাঃ! অন্য জায়গায় যা।

চন্দ্ৰনাথ এর পর চলে এলো বউবাজারে। এ পথেও রাত্ৰি যত বেশী হয়, তত লোকজন জাগে। ফেরিওয়ালারা ঘন ঘন বেলফুল হেঁকে যায়, সেই সঙ্গে তপসে মাছ, গুলাবি রেউড়ি আর ধূপধুনো। দুদিক থেকে আসা দুই ল্যাণ্ডো বা ফিটন গাড়ির ঘোড়া পাশাপাশি গ্ৰীবা বাঁকিয়ে ফ-র-র শব্দে কিছু বাক্য বিনিময় করে। এই সব কিছু ছাপিয়ে যায় মাতালের হল্লা।

যে বাড়িতে হীরা বুলবুল থাকতো, যেখানে চন্দ্রনাথ জন্মেছে, সেই বাড়িটির রঙ পালটানো হয়েছে, আগে ছিল ফিকে নীল, এখন হলুদ। মেরামতির কাজও কিছু হয়েছে মনে হয়। সব ঘরে আলো, সব ঘরে ঘুঙুর-তবলার শব্দ এবং কলকণ্ঠ। হীরা বুলবুলের সব চিহ্ন হারিয়ে গেছে। এখান থেকে, তবু জীবন তার নিজের নিয়মে চলেছে।

ছড়িতে ভর দিয়ে সেই বাড়ির অদূরে পথের ওপর দাঁড়িয়ে রইলো চন্দ্রনাথ। তার বক্ষে কোনো স্মৃতির উদ্বেলতা নেই, বরং ক্রমশ পুঞ্জীভূত হচ্ছে ক্ৰোধ। এই গৃহটিকে সে যেন সহ্য করতে পারছে না ফেলতে চায়, পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাক এই পাপ-পুরী।

কয়েকটি দালালশ্রেণীর লোক ঘোরাঘুরি করছে বাইরে। চন্দ্রনাথকে বাড়িটির দিকে একদৃষ্টি চেয়ে থাকতে দেখে তারা তাকে কোনো লোভী ইদুস পিদুস জাতীয় ফিরিঙ্গি মনে করলো। একজন কাছে এসে বললো, কম কম সার, প্ৰেটি গার্ল, হিন্দু গার্ল, মুসলমান গার্ল, চীপ রেট সার—।

চন্দ্রনাথ কিছু বলবার আগেই হুড়মুড়িয়ে একটা ল্যাণ্ডো গাড়ি এসে পড়লো প্ৰায় তার গায়ের ওপর, ঘোড়াটি শূন্যে সামনে দু পা উচ্চে তুলে চি হি-হিঁ-হি করে উঠলো। ল্যাণ্ডো থেকে নামলো স্থূলকায় এক বাবু। বাঁ হাতের কজিতে গোড়ের মালা জড়ানো, চক্ষু দুটি জবাফুলের মতন লাল। গাড়ি থেকে নেমেই বাবুট বেসামাল অবস্থায় ঘুরে গেলেন এক পাক, তাঁর ধুতিটি দুলতে লাগলো ঘাগরার মতন। তিনি জড়িত কণ্ঠে বললেন, ওরে কে আচিস, ধননা আমায়।

সামনে চন্দ্রনাথকে দেখে তিনি তার কাঁধটাই খামচে ধরলেন এক হাতে। চন্দ্ৰনাথ সঙ্গে সঙ্গে এক বাঁকুনি দিয়ে ছাড়িয়ে নিল নিজেকে। তার মধ্যেই এক দালাল এসে তাঁকে ধরে ফেলেছে।

বাবুটা বক্রচোখে চন্দ্রনাথের দিকে তাকিয়ে বললেন, এ হুমন্দো মদ্দোটা ক্যা র‍্যা? রাস্তার মদ্যিখানে ধম্মের ষাঁড়ের মতন খাড়িয়ে আচে কেন?

দালাল বলল, চলুন, চলুন, আমি ধচ্চি!

বাবুটি বললেন, চা, আমায় নিয়ে চ, আজ বিমলি খালি আচে তো? যিদিনকেই আসি সিদিনেই শালী ঐ যেদো মল্লিকের সঙ্গে-ঐ তো ওর ঘরে লীল লণ্ঠন জ্বলচে।

এই বাবুটিকে চন্দ্রনাথ কোনোদিন আগে দেখেনি, এর প্রতি তার বিশেষভাবে ক্রুদ্ধ হবার কোনো কারণ নেই, তবু যেন দপ করে তার সারা শরীরে আগুন ধরে গেল। লোকটি যে ঘরটির দিকে আঙুল তুলে দেখালোঁ, ঐটাই ছিল তার জননী হীরা বুলবুলের শয়নকক্ষ।

হাতের ছড়িটা তুলে চন্দ্রনাথ বাবুটিকে সপাং সপাং করে প্রাণপণে পিটিয়ে যেতে লাগলো পাগলের মত।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *