2 of 2

৫১. বৃষ্টি হয়ে গেছে এক পশলা

একটু আগে জোর বৃষ্টি হয়ে গেছে এক পশলা। চিৎপুরের রাস্তা একেবারে কাদায় মাখামাখি। পথের দুপাশের পগারের থকথকে কাদায় নতুন জল মিশেছে বলে সৌদা গন্ধ উঠে আসছে। ভন ভন করছে নীল ড়ুমো মাছি। এরই মধ্যে বাজার করতে বেরিয়েছেন বাবুরা, গোড়ালি উঁচু করে বকের মতন পা ফেলে ফেলে চলেছেন, তাঁদের পিছু পিছু ধামা মাথায় করে সঙ্গে চলেছে বাড়ির ভৃত্য বা দাসী। হৌসের বাবুরা আপিসের দেরি হয়ে গেল বলে ছুটছে পড়ি মারি করে, তাদের অনেকেরই জুতো জোড়া বগলদাবা এবং ধুতি তুলে ধরেছে উরু পর্যন্ত। ছ্যাকরাগুলোর আষ্টেপৃষ্টে ভিড়, কেউ কেউ মাথাতেও চেপে বসেছে।

এই সকালবেলাতেও দু চারটি মাতাল ও গাঁজাখোর ঢলঢলি করছে। পথের এখানে ওখানে। পাহারাওয়ালা মাঝে মাঝেই গাড়ি-ঘোড়া সামলানোর কর্ম ছেড়ে বলে, বাগবাজারে গাঁজার আড্ডা, গুলীর কোন্নগরে, বটতলায় মদের আড্ডা, চণ্ডুর বৌবাজারে। কিন্তু একথাও পুরোনো হয়ে গেছে, এখন সবরকম নেশাই ছড়িয়ে পড়েছে। শহরের সর্বত্র। নটার তোপ পড়তেই এক মাতালবাবু এমন ভাবে আঁতকে উঠলেন যে এক লাফ দিতেই কাদার ওপর ডিগবাজি দিলেন দুবার। তারপর আর তাঁর পদদ্বয়ের ওপর কোনো কর্তৃত্ব রইল না। এই অবস্থায় কোনো পাল্কী বা কেরাঞ্চী গাড়ি তাঁকে নেবে। না, কারণ এখন তেজীর সময়, খদ্দেরের অভাব নেই। মাতালবাবু এক নগদা ঝাঁকামুটেকে ধরলেন তাঁকে মাথায় করে নিয়ে যাবার জন্য। তা সে ঝাঁকামুটেও গলা কামড়ে বলে কি না, পুঙ্গির বাই, আমারে মুদ্দোফরাস পাইচেন?

এ সময় খরিদ্দার সমাগমের সম্ভাবনা কম বলে বারাঙ্গনারা বারান্দায় দাঁড়িয়ে পথের রঙ্গ দেখে। মাঝে মধ্যে তারা ওপর থেকে নানারকম মন্তব্যও ছুঁড়ে দেয়। এক কেরাঞ্চী গাড়িতে উঠে বসেছেন দুই বাবাজী, একজনের উন্দরটি জয়ঢাকের মতন, আর মুখখানি তেলো হাঁড়ি। কামানো মস্তকে চৈতন ফক্কা। অন্য বাবাজীর চেহারাটি ফড়িং-এর মতন পলাকা। হাতে একটি শামুকের ডিবে যেন জন্ম ইস্তক সাঁটা, তিনি এতইনস্যি নেন যে তাঁর লালাও খয়েরি রঙের। এই দুই বিসদৃশ চেহারার গোঁসাইগাড়িতে চাপার ফলে সে গাড়ি আর নড়তে চায় না, গাড়োয়ান জিবে টক টক শব্দ করে চাবুক মাথার ওপর ঘোরালেও ঘোড়া নড়ে না এক পা। সেই দৃশ্যে পথের লোক বেশ কৌতুক পেয়ে গেল। নিকটবর্তী বারান্দা থেকে এক বারাঙ্গনা বললো, ওরে, ঐ এক গোঁসাই-ই তো এক গাড়ি! মিনসে যেন কুণ্ডুকৰ্ণ। আরেকটা তো ঔয়ার দাঁত খোঁটার খড়কে কাটি! এক চীনেবাদামওয়ালা বললো, ওরে গাড়োয়ান, একদিকে এক ধূম্রলোচন, আর একদিকে এক চিমসে সওয়ারি! আগে পাষাণ ভেঙে নে, তবে তো গাড়ি চলবে! অমনি ওপর থেকে সেই বারাঙ্গনাটি বললো, ওরে ঐ রোগা মিনসেটার গলায় গোটা কতক পাতার বেঁদে দে, তবে তো পাষাণ ভাঙা! আমোদখোর জনতা হো-হো-হে করে হেসে উঠলো। গাড়ির মধ্যে তটস্থ বিপুলকায় বাবাজী বললেন, ভায়া, শহরের স্ত্রীলোকগুলি কি ব্যাপিকা দেখচে। প্রভো, তোমার ইচ্ছা! অন্য বাবাজী বললেন, জন্ম ইস্তক ওঁয়ারা কোনো উপদেশ পঞি নাঞি, ঔয়াদের রামা রঞ্জিকা পাঠ দেওঞা উচিত! এক মাতাল তার মধ্যে গলা বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো, কী বল্লে? কী বল্লে? আবার বলো।

বিশিষ্ট মার্জিত শিক্ষিত সুসভ্য দুই বাবু পাশ দিয়ে ধীর পায়ে হেঁটে যেতে যেতে এই দৃশ্য দেখে এবং একজন অপরজনকে বললেন, হোয়াট ডিগ্রেডেশন! এই কান্ট্রি দিন দিন গোয়িং টু হেল!

একটু দূরে এক কালীমন্দিরের সামনে পাঠার মাংস বিক্রয় হচ্ছে। ভাগ ভাগা করে সাজানো, এগুলি প্রসাদী মাংস তাই খদ্দেরের টান বেশী। দামও একটু বেশী। যারা কিনতে পারে না তারা বলে, এখন শহরের দেবতারা পর্যন্ত রোজগেরে! মাংসের ব্যবসা কচ্চে। ইদানীং মাংস খাওয়ার একটা জোর হুজুগ উঠেছে, ওতে নাকি সাহেবদের মতন স্বাস্থ্যু হয়, চামড়ায় জেল্পা লাগে। সেইজন্য পাঠার মাংস বেশ দুস্তপ্রাপ্য। মাতাল, বেনে ও বেশ্যারাই আগেভাগে বেশী দামে মাংস কিনে নিয়ে যায়। তাই পাঠার মাংসেও ভেজাল চলছে কখনো কখনো শোনা যায়। কুকুর-বিড়ালও বাদ যায় না। ভাবগতিক এখন এমন হয়েছে যে জলচরের মধ্যে শুধু নৌকো, খোচরের মধ্যে ঘুড়ি আর চতুষ্পদের মধ্যে শুধু খাট এখন খাওয়া নাই!

পথের মোড়ে মোড়ে বড় বড় লাল-কালো অক্ষরে ছাপা ইস্তাহার লটকানো। হাওড়া থেকে এলাহাবাদ পর্যন্ত রেলওয়ে খুলচে, দেশ ভ্রমণের অপূর্ব সুযোগ! অপূর্ব সুযোগ! অল্প খরচে এবং দিন সংক্ষেপে বারাণসীধাম এবং ত্ৰিবেণীতীর্থে স্নানের জন্য অনেকেই এখন ব্যস্ত। আরমানি ঘাট সর্বদা লোকে লোকরণ্য।

হঠাৎ একটা হই হই রই রই শোরগোল শোনা গেল। পথের সব লোক উৰ্ধৰ্বমুখী হয়ে চেয়ে রইলো আকাশের দিকে। গৃহস্থবাড়ির বুড়ো-বুড়ী ছেলে-মেয়ে সবাই দুপদাপ করে উঠে গেল ছাদে। আকাশে আশ্চর্য দৃশ্য, শূন্যে ভাসছে মানুষ। সাহেব জাতি যে কত খেলাই জানে, আকাশেও মানুষ ওড়ে! প্রায় ফি বছরই ফরাসীদেশের এক সাহেব এসে এই মানুষ ওড়ার কেরামতি দেখায়। কেল্লার মাঠে হাজার হাজার মানুষ চাঁদা দিয়ে সেই মানুষ ওড়া দেখতে যায়। তলায় যন্ত্র বসানো এক পেল্লায় কাপড়ের গোল্লা, সাহেবরা তাকে বলে বেলুন, আর দেশী লোকেরা বলে ফানুস। সেই ফানুসে এক সাহেব উঠে বসার পর দড়ি কেটে দেওয়া হয়, অমনি ফানুস দুলতে দুলতে ওপরে ওঠে। উঠতে থাকে তো উঠতেই থাকে, গগনবিহারী সাহেব শূন্য থেকে হাত নাড়ে। আবার ইচ্ছে মতন নেমেও আসতে পারে সেই ফানুস।

একদল লোক আঙুল তুলে বলতে লাগলো, ওই, ওই ওই! যারা দেখতে পায়নি তারা বলতে লাগলো, কই, কই, কই? কেউ বললো, দ্যাক, দ্যাক একটা শকুন ঐ ফানুসাঁটার কাচে যাচ্ছে, এবার টুসো মারবে।

পথের গাড়ি ঘোড়া সব বন্ধ, সকলেই দেখতে লাগলো। সেই ফানুসের লীলা। অত উঁচুতে সাহেবটিকে মনে হচ্ছে যেন রথের মেলার পুতুল। ফানুসটি দুলতে দুলতে এক একবার একদিকে সরে যায়, অমনি সবাই হে-হে করে ওঠে। একটু পরেই বৃষ্টি নামতেই সকলে দুদ্দাড় করে ছুটলো। ফানুসটি আর দেখা গেল না। কেউ বললো, সাহেব ছাতা নিয়েচেন তো? কেউ বললো, সাহেব এখন চাঁদের ওপর বসে একটু বিশ্রাম কচ্চেন।

আরমানি ঘাটে রেলের টার্মিনাস। টিকিটের কাউন্টারগুলির সামনে মানুষের ভিড়ের অন্ত নেই, মনে হয় যেন একদল লোক বাড়ি থেকে এখানে এসেছে শুধু নিজেদের মধ্যে ঠ্যালাঠেলি করবার জন্যে। রেলের চাপরাসীরা বেত হাতে নিয়ে মাঝে মাঝে সপাসপ পেটাচ্ছে তাদের। ভাগ্যবান যারা কোনোক্রমে টিকিট কাটতে পারে তারাও টাকা দিয়ে খুচরো ফেরত পায় না। আবেদন নিবেদনও নিষ্ফল বুকিং ক্লার্ক মহাশয় তখন আপন মনে গুনগুনিয়ে গান করেন, মদন আগুন জ্বলচে দ্বিগুণ কল্লে কী গুণ ঐ বিদেশী! খুচরো ফিরতের দাবিতে কেউ যদি তর্জন গর্জন করে তখন রেল-পুলিস ও জমাদাররা তাদের কণ্ঠে অর্ধচন্দ্ৰ দিয়ে বিদায় করে। দেশী লোকদের ফাস্ট ক্লাস ভ্রমণের অধিকার নেই বলে ফাস্ট ক্লাস কাউন্টার জনবিরল ও নিঃশব্দ। দু-চারটি সাহেব মেম সেখান থেকে সকৌতুকে থার্ড ক্লাসের এই ভূতের নৃত্য দেখেন।

ঘাটে স্টিম ফেরি দাঁড়িয়ে ফোঁস ফোঁস করে, লোকের ভিড়ে কুমড়ো-গাদাগাদি হলে সেগুলি টুনুনান্টিং টুনুনাণ্টাং ঘণ্টা বাজিয়ে ছেড়ে দেয়। গঙ্গার ওপারে দাঁড়িয়ে থাকে ট্রেন। কেউ কেউ বলে সাহেবরা ব্ল্যাকহোল ট্রাজেডির প্রতিশোধ নেবার উদ্দেশ্যেই রেল লাইন খুলেছে। কাঁকড়ার গর্তে যেমনভাবে ডিম থাকে। সেইভাবে মানুষ পোরা হয়। থার্ড ক্লাসে, তারপরও স্টেশন মাস্টার ও গার্ড এসে উঁকি দিয়ে দেখে যান এখনো নিশ্বাস ফেলার জায়গা আছে কি না, তা হলে আরও কিছু যাত্রী ঠুসে দেওয়া হবে।

আরমানি ঘাটের ভিড় থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে রয়েছে এক সুঠাম সবল চেহারার যুবাপুরুষ, পরনে নীল রঙের কোট প্যাণ্টলুন, মাথায় একটা শোলার হাট, মুখের রেখা সুগম্ভীর। আর একজন ধুতি-বেনিয়ান পরা অভিজাত চেহারার ব্যক্তি সেকেণ্ড ক্লাস কাউন্টার থেকে ফেরার পথে হঠাৎ থমকে দাঁড়ালো, তারপর এগিয়ে এসে বললো, তুমি-আপনাকে চেনা চেনা মনে হচ্ছে। মশায়ের নামটা জানতে পারি?

হ্যাটকোটধারী যুবকটি ভাবলেশহীন মুখে বললো, আই ডোনটু থিংক আই মেট ইউ বিফোর!

ধুতি-ভদ্রলোকটি বললো, তা হলে কি আমার ভুল হলো! তবে আপনাকে দেকেই আমার বুকের মধ্যে ধক করে উঠলো কেন?

হ্যাট-কোট আর কোনো উত্তর দিল না।

—মশায়ের নামটি যদি জানতে পারি।

–তার কোনো প্রয়োজন আছে কি?

ধুতি-বেনিয়ান যেন দারুণ একটা সমস্যায় পড়ে গেছে। চেনা চেনা মনে হচ্ছে, অথচ নাম মনে পড়ছে না। হ্যাট-কোটের ব্যবহার বেশ রূঢ়, কোনো সাহায্য পাবার আশা নেই। বিড় বিড় করে ধুতি-বেনিয়ান স্টিম-ফেরীর দিকে এগিয়ে গেল। তারপর আবার ঘুরে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বললো, ও মনে পড়েচে, মনে পড়েচে! তুমি তো চন্দ্রনাথ!

হ্যাটকোট ততক্ষণে চলতে শুরু করেছে। ধুতি-বেনিয়ান দৌড়ে এসে তাকে ধরে বললো, তুমি নিশ্চয় চন্দ্ৰনাথ! আমি এবার ঠিক ধরিচি।

হ্যাটকোট ফিরে দাঁড়িয়ে আরও কর্কশভাবে বললো, সো হোয়াট?

অপর ব্যক্তিটি তার হাত চেপে ধরে বললো, ভাই চন্দ্ৰনাথ, আমায় চিনতে পাচ্চো না? আমি তো তোমাকেই খুঁজচিলুম। আমার নাম রতনমণি, বাগবাজারের রতনমণি রায়। আমি জানি, তুমি আমায় দেকে রাগ করবে, কিন্তু তোমাকে আমার বিশেষ প্রয়োজন।

মাথা থেকে টুপিটি খুলে চন্দ্ৰনাথ বললো, আমি মনে করি না, আমার সঙ্গে কাহারো কোনো প্ৰয়োজন থাকতে পারে!

—চন্দ্রনাথ, আমরা হিন্দু কলেজে এক কেলাসে পড়তুম।

না।

–জানি, তুমি কি বলতে চাও। তুমি ভর্তি হবার পর আমরা সবাই কেলাস ছেড়ে দিইচিলুম, তবু দু-চারদিন এক সঙ্গে বসিচি। তোমাকে আমার মনে আচে, আমাকে তোমার মনে নেই?

সাহেবী পরিচ্ছদে ভূষিত এই চন্দ্রনাথ আমাদের পূর্ব পরিচিত। সে হীরা-বুলবুলের পুত্র। একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে রতনমণির মুখের ওপর স্থির দৃষ্টি ফেলে তাকিয়ে রইলো। সে কিছুই বিস্মৃত হয় না, তার স্মৃতিশক্তি আয়নার মধ্যে অসংখ্য প্রকোষ্ঠের মতন, রতনমণিকে সে দেখা মাত্র চিনতে পেরেছে। কিন্তু সে কারুকেই চিনতে চায় না।

—তুমি কোতায় যাচ্ছে, চন্দ্রনাথ? টিকিট কেটেচো? চলো, আমরা এক সঙ্গেই যাই। আমি তোমার সঙ্গে থার্ড ক্লাসেই যাবো না হয়।

—আমি কোথাও যাচ্চি না। আমি কলকাতায় ফিরচি।

—অ্যাঁ, তুমি যাচ্চো না? তোমাকে এখেনে দেকে ভাবল্লুম-তুমি কালকেতা থেকে কোথাও যাচ্চো?

–না!

—তোমার এমন ধড়াচুড়ো, প্রথমে ভাবল্লুম বুঝি সাহেব—তোমাকে আমার বিশেষ দরকার।

—এ কথাটা দুতিনবার শুনলুম। কিন্তু কী দরকার তা এখনো বুজলুম না।

–তোমার কাচে আমি ক্ষমা চাইবো।

–আপনার ফেরী ছেড়ে যাচ্চে।

—যাক গে, চুলোয় যাক ফেরী। না হয় আজ যাবোই না, শ্ৰীরামপুরে আমার দিদির শ্বশুরবাড়ি, ভাগনেটার বিয়ের কথাবার্তা পাকা হয়েছে, সেইজন্যই একবার…তা না হয় কাল যাবো। তোমাকে দেকে আমার বুক থেকে যেন একটা পাষাণভার নেবে গেল। এতদিন এমন একটা বুকচাপা কষ্ট ছেল…

—আপনি কী বলচেন, কিচুই বুজতে পাচ্চি না।

—ভাই, অল্প বয়েসে কী নির্বোধ ছিলুম, জ্ঞান বুদ্ধি কিচুই ছেল না, তোমার ওপর অবিচার করিচি। পরে যখুন উপলব্ধি হয়েচে, তখন থেকে আমার বুকের মধ্যে অনুতাপানল ধিকিধিক জ্বলচে।

—আমার এখনো বিশ্বাস, আপনি ভুল কচ্চেন, আপনি আমাকে অন্য মানুষ ভেবেচেন।

—আপনি? তুমি-তুই বলে ডাকো আমায়। আমরা সহপাঠী-হায় কী মুখ, কী মুর্থ আমরা, তোমার জন্মবৃত্তান্তের সাত কাহিন তুলে আমরা তোমার সঙ্গে পড়তে চাইনি…তুমি জীবনে উন্নতি করেচো দেকে বড় খুশী হলুম।

-এবার যাই।

—কোতায় যাবে তুমি। একবার পেয়িচি, তোমায় আর ছাড়চিনি। তোমায় তো আসল কতটাই বলা হয়নি।

—আমি শোনার জন্য প্ৰস্তুত।

–এখেনে? এই পাঁচপেঁচি ভিড়ের মধ্যে? চলো, আমরা কোনোখানে গিয়ে বসি। অনেকক্ষণ ধরে মনের কতা কই।

—আপনার সঙ্গে মনের কথা কইবার মতন সখ্য আমার ছিল বলে তো মনে পড়ে না।

—সেই কতাই তো বলচি। তেমন সখ্য হলো না সেটা তো আমারই দুর্ভাগ্য। কিংবা দুর্ভাগ্যই বা বলচি কেন, আমারই সম্পূর্ণ নিজস্ব দোষ। যে পাপ আমি করিচি…

-আমাকে সত্যিই এবারে যেতে হবে।

—যাবে মানে? তুমি আমায় ক্ষমা করেচো কিনা না জেনেই আমি তোমায় ছাড়বো ভেবোচো?

–ক্ষমা?

–চন্দ্রনাথ, আমিই সেই মহাপাতক। তোমার মনে আচে কি না জানি না, আমিই মনে করিয়ে দিচ্চি-সেই যে একদিন সন্ধেবেলা বাগবাজারে আমাদের বাড়িতে-কিসের যেন নেমন্তন্ন ছেল-হাঁ, মনে পড়েচে, আমার ছোট বোনের বিয়ে–বাইরে কাঙালী ভোজন হচ্চিল-আহা-হা ভাবলেও এখন বুক ফেটে যায়-তুমি আমার সতীর্থ হয়ে কিনা কাঙালীদের মধ্যে বসেচিলে-আমার কি উচিত ছেল না তোমার হাত ধরে তোমায় ভেতরে নিয়ে গিয়ে পঙক্তিভোজে বসানো-তা না করে আমি কী করিচি! আমার ছোটকাকাকে ডেকে বলিচি, ছোটকাকা, এই সেই বেশ্যার ছেলেটা আমাদের কলেজের নাম ডোবাচে-তোমাকে মারতে মারতে হটিয়ে দেওয়া হলো-তোমার মনে আচে?

চন্দ্রনাথ চুপ করে রইলো। জীবনের এইসব ঘটনা কেউ কি কখনো ভুলতে পারে?

রতনমণি বললো, তখন ভেবেচিলুম, কতই যেন বাহাদুরীর কাজ করলুম…তারপর তিন চার বচর পরে একদিন…তখন আমি আরও অনেক পড়াশুনো করিচি, অনেক শাস্ত্ৰ পাঠ করিচি, দর্শন নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করিচি…হঠাৎই একদিন মনে হলো, আমি কতখানি অমানুষের মতন ব্যবহার করিচি তোমার সঙ্গে। তোমাকে কতখানি দাগ দিইচি!

রতনমণির চক্ষু দিয়ে টপ টপ করে জল পড়তে লাগলো। চন্দ্রনাথ তা সত্ত্বেও কোনো প্ৰতি-উত্তর দিল না, একদৃষ্টি চেয়ে রইলো রতনমণির দিকে।

পকেট থেকে রুমাল বার করে চক্ষু মুছে রতনমণি আবার বললো, আজ আমার প্রায়শ্চিত্ত হলো। চলো, তুমি কোতায় যাবে, তোমার সব কতা শুনবো।

চন্দ্ৰনাথ কোথায় যাবে তা সে নিজেই জানে না। চার বৎসর পর সে ফিরলে কলকাতায়। শ্মশানে মাতৃমুখ দেখে সেই যে ছুট দিয়েছিল, তারপর তার জীবনের অনেক পরিবর্তন ঘটে গেছে। এ শহরে আর কোনদিন সে আসবে না ভেবেছিল। হঠাৎ এক সময়ে এক সাহেবের নেকনজরে পড়ে যায়। তার ইংরিজিজ্ঞান দেখে মুগ্ধ হয়ে সাহেবটি তাকে বর্ধমান রেল স্টেশনে একটা চাকরি দিয়েছে। নিতান্ত উদ্দেশ্যহীনভাবেই তার এবার কলকাতায় হঠাৎ আসা।

রতনমণি চন্দ্রনাথের কোনো আপত্তিই শুনলো না। প্ৰায় জোর করেই তাকে টানতে টানতে নিয়ে এলো রাস্তায়, তারপর একটা পালকি ডেকে তাকে নিয়ে চললো নিজের বাড়িতে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *