2 of 2

৬৩. রেলওয়ের চাকরি

রেলওয়ের চাকরিতে আর ফিরে গেল না চন্দ্রনাথ। বৈঠকখানার বাসাবাড়ি ছেড়ে সে চিৎপুরে ফৌজদারি বালাখানার পাশে একটি মাঝারি ধরনের গোটা বাড়ি ভাড়া নিয়ে বসলো! হাতে কিছু সঞ্চিত অর্থ আছে, কিন্তু তা দিয়ে সারা জীবন চলবে না, সুতরাং সে গ্রহণ করলে নতুন পেশা।

সে নিজেই একটি পদবী জুড়ে দিয়েছে তার নামের সঙ্গে, বাড়ির সামনে ঝুলিয়ে দিয়েছে একটা সাইন বোর্ড। তাতে ইংরেজি ও বাংলায় এই মর্মে লেখা আছে; অপূর্ব সুযোগ! অপূর্ব সুযোগ! হিমালয়ের সন্ন্যাসীর নিকট হইতে প্ৰাপ্ত দৈব ঔষধ! ভূত-প্ৰেত-পেত্নী, ধনুষ্টংকার, স্বপ্ন-দোষ, চোয়াল-আটক, সাহেব-ভয়, পত্নী-প্রহার ইত্যাদি দুরারোগ্য ব্যাধির প্রত্যক্ষ চিকিৎসা করিয়া থাকি। ফিস মাত্র দুই টাকা। এক পক্ষকালের মধ্যে হাতে হাতে ফল না পাইলে মূল্য ফেরত। সাক্ষাৎকারের সময় সকাল নয়টা হইতে এক ঘটিকা। প্রোঃ চন্দ্ৰনাথ ওঝা।

প্রথম প্রথম খদ্দের তেমন আসে না, লোকে সাইন বোর্ডটি পড়ে, মুচকি হাসে, কেউ কেউ বলে, ওঝাও ইংরেজি শিকেচে, এঃ? কালে কালে কতই দেকবো!

দু একজন ওঝার চেম্বারে উকিঝুঁকি মেরেও বিশেষ রকম কৌতুক ও বিস্ময় বোধ করে। ভূত কিংবা সাপের বিষ-ঝাড়ানো ওঝা কে না দেখেছে, তাদের চেহারা হয় কাপালিকদের মতন, রক্তগম্বর ভূষিত, মাথার চুলে জট। কিন্তু এ যে একেবারে সাহেব-ওঝা! হ্যাট-কোট-প্যাণ্ট পরা, সামনের টেবিলে পা তুলে চেয়ারে বসে ফুক ফুক করে সিগারেট টানে। পায়ে আবার ইংলিশ জুতো!

 

মেডিক্যাল কলেজের প্রসিদ্ধ ছাত্র এবং পরে এম ডি পাশ করা ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকার সম্প্রতি হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসার পক্ষে প্রচার শুরু করায় শহরে নতুন হুজুগ উঠেছে! হেকিমী-কবিরাজি-টোট্‌কা চিকিৎসা ছাড়িয়ে এতদিনে অ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসাতেও অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিল অনেকে। এ আবার কী নতুন জিনিস এলো! শুধু ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকারই নয়, প্ৰসিদ্ধ ধনী অক্রুর দত্তের নাতি রাজা দত্ত-ও এই হোমিওপ্যাথি নিয়ে উঠে পড়ে লেগেছেন, এবং সঙ্গে আছেন কয়েকজন সাহেব! চিনির দানার মতন ছোট ছোট কয়েকটা সাদা রঙের বডি আর জলের মতন স্বচ্ছ, দেখলে মনে হয় জলই তার কয়েকটা ফোঁটা খেলেই সেরে যাবে বড় বড় রোগ? এও আর এক রকমের ভেল্কি নয়?

চন্দ্ৰনাথের সাইন বোর্ড দেখে অনেকে ভাবলো, কোনো ট্যাস ফিরিঙ্গি বোধহয় আর এক রকম ভেল্কি দেখাতে এসেছে।

কালু শেখ নামে একটি মুসলমান কিশোরকে নিজের বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছে চন্দ্রনাথ। ছেলেটি তার কাছে ভিক্ষা চাইতে এসেছিল একদিন। ছেলেটিকে এক নজর দেখেই আকৃষ্ট হয়েছিল চন্দ্রনাথ। ছেলেটির মাথায় চুল নেই, এমনকি ভুরুও নেই। প্রকৃতির বিচিত্র খেয়ালে তার সম্পূর্ণ শরীর কেশহীন, নির্লোম। বাপ-মা হারা ঐ কাল্লুর স্থান ছিল শহরের আস্তাকুঁড়ে, পোকামাকড়ের মতন আবর্জনা খুঁড়ে খেত, তার ঐ বিচিত্র চেহারার জন্য তাকে দেখলেই ঢিল মারতে পল্লীর বালকেরা।

চন্দ্রনাথ তাকে স্বগৃহে স্থান দিয়ে উত্তম খাদ্য খাইয়ে কয়েক দিনেই চাঙ্গা করে তুললে। জীবনে কারুর কাছ থেকে একটিও স্নেহ-বাক্য না শুনলেও ছেলেটি বেশ হাসি-খুশী। চন্দ্রনাথের বেশ ভালো সময় কাটে তার সঙ্গে। কাল্প শেখের নাম বদলে দিয়ে সে বলেছে, শোন, এখন থেকে তোর নাম হলো সুলতান, তুই মনে করবি এই কলকাতা শহরটার তুই-ই মালিক, কারুকে ভয় পাবি না, বুঝলি। এবার বল, হোয়াট ইজ ইয়োর নেম?

ছেলেটি বললো, মাই নেম ইজ কাল্লু শেখ!

—অ্যাই ও! বললুম না, তোর নাম আজ থেকে সুলতান?

—জী সরকার, সুলতান!

—ফের জী সরকার বলছিস? বলবি, ইয়েস স্যার!

—ইয়াস ষাঁড়!

—ওতেই হবে। এবার বল, শশার ইংরিজি কী?

—কুকামবার।

—লাউ কুমড়ো?

—পমকিন!

–চাষা?

—প্লৌমান!

–বাঃ! বাঃ!

মাত্র ছ মাসে এতখানি ইংরেজি শিখে নিয়েছে সে। তাছাড়া সে চন্দ্রনাথের সঙ্গে কুস্তি করে, গঙ্গায় গিয়ে সাঁতার কাটে, অনেক উঁচু উঁচু স্থান থেকে লম্ফ দেয়। চন্দ্রনাথ তাকে এ সব শিক্ষা দেয় বিশেষ উদ্দেশ্যে।

চন্দ্রনাথের প্রথম খরিদ্দার এলো এক আর্মেনিয়ান জুতোর ব্যবসায়ী। কলকাতা শহরে ভূত-প্রেতের উপদ্রব নিত্য লেগে আছে। এই আর্মেনিয়ান সাহেবটি কাশীপুর অঞ্চলে শখ করে একটি বাগান বাড়ি কিনেছিল। গত এক মাস ধরে সে বাড়িতে ভূত লেগেছে। শুধু শোনা কথা নয়, আর্মেনিয়ান সাহেবটি নিজে সেখানে গিয়ে থেকে দেখেছে। যখন তখন ভূতে ঢালা ছোঁড়ে, মাথায় হিসি করে দেয়, দরজা-জানলা বন্ধ থাকলেও কালো বেড়াল হয়ে ঘরে ঢোকে—ইত্যাদি। গ্ৰাম্য ওঝা নিয়োগ করে কোনো কাজ হয়নি, তাই সে এসেছে এই ট্যাস ফিরিঙ্গির কাছে।

পঞ্চাশ টাকার বিনিময়ে চন্দ্রনাথ কাজটি হাতে নিল এবং সাত দিনের মধ্যে সেই কাশীপুরের বাগানবাড়ি ভূত-মুক্ত করে ফেললো। তাতে তার নাম হলো একটু, ক্রমে একটি দুটি করে খরিদ্দার বাড়তে লাগলো।

লোকজন এলে চন্দ্রনাথ নানা রকম রঙ্গ কৌতুক করে। রাজস্থানের এক ব্যবসায়ী এসেছে তার ভাগ্নেকে নিয়ে, ভাগ্নেটির চোয়াল-আটক হয়েছে। মুখখানি হাঁ করা। বন্ধ করতে পারছে না কিছুতেই, চক্ষু দুটি বিস্ফারিত, তিনদিন ধরে এই অবস্থা। রাত্ৰিবেলা বাড়ির বাইরে মাঠে গিয়ে প্রাকৃতিক কার্য সম্পন্ন করার সময় কিছ দেখতে পেয়ে ভয়ে নাকি এ রকম হয়েছে।

সব বিবরণ শুনে চন্দ্রনাথ হাঁক দেয়, সুলতান!

তখনই ঘরের মধ্যে থপথপ করে কী যেন ঢোকে। দেখেই আঁতকে ওঠে ব্যবসায়ী এবং তার ভাগ্নেটি। সারা অঙ্গে আটি মখমলের পোশাক পরা সুলতান হেঁটে আসে দু পায়ে নয়, দুহাতে, পা দুটি ওপরে।

ব্যবসায়ীটি চেঁচিয়ে ওঠে, সীয়া রাম, সীয়া রাম! এ কৌন্‌–?

চন্দ্রনাথ খুব সংক্ষিপ্তভাবে বলে, ভয় পাবার কিছু নেই। ও আমার অ্যাসিস্ট্যাণ্ট!

ভাগ্নেটির অবশ্য এতেও চোয়াল বন্ধ হয়নি।

সুলতানের মুখে কামড়ানো একটি কলম। চন্দ্রনাথ সেটি নিয়ে সাদা কাগজে প্রেসক্রিপশন লেখে, তারপর সুলতানের পায়ের আঙুলের ফাঁকে সেটি গুঁজে দিয়ে বলে, চটপট ওষুধ নিয়ে এসো!

সুলতান নাকি সুরে বলে, ইয়াস ষাঁড়! তারপর একই রকমভাবে থপথপিয়ে চলে যায়।

চন্দ্রনাথ তখন সিগারেট ধরিয়ে বলে, ওকে এনেছি ছিলকি গড়ের একটা হানা বাড়ি থেকে। সব রকম কাজ জানে!

একটু পরেই ঘরের ছাদ থেকে কী যেন একটা মিশমিশে কালো রঙের প্রাণী লাফিয়ে পড়ে একেবারে ভাগ্নেটির ঘাড়ের ওপরে। ব্যবসায়ী এবং তার ভাগ্নে একসঙ্গে চেঁচিয়ে ওঠে, আই বাপ, আই বাপ, মর গ্যয়া, মর গ্যয়া।

হাসতে হাসতে দুদিকে অনবরত মাথা দোলাতে থাকে চন্দ্রনাথ। সুলতানই কালো চাদর জড়িয়ে লাফিয়ে পড়েছে কড়িকাঠ থেকে। কোন কৌশলে সে ওখানে আসে, তা বাইরের কারুর জানবার উপায় নেই।

হাসি থামিয়ে চন্দ্রনাথ বলে, দিন, আমার ফিস দু টাকা।

 

চন্দ্ৰনাথ সবচেয়ে বেশী আমোদ পায় সাহেবভীতি রোগের চিকিৎসা করে। বর্ধমানে চাকরি করার সময় সে দেখেছে যে গ্রাম দেশে এই রোগ খুব প্রবল। কোনো ক্ষুদ্র পল্লী গ্রামে দৈবাৎ কোনো সাহেব উপস্থিত হলে গ্রামবাসীরা ভয় পেয়ে পলায়ন করে তো বটেই, কখনো কখনো দু একজনের ঐ রোগ ধরে যায়। দূর থেকে কোনো সাহেব দেখলেই কিংবা সাহেব শব্দটি উচ্চারিত হলেই তারা ঠকঠক করে কাঁপতে থাকে। এমনকি কোনো দয়ালু, হৃদয়বান সাহেবও তাদের কাছে ঘেঁষতে পারে না। শিশু যুবা বৃদ্ধ সকলেরই এই রোগ হতে পারে।

হয়তো কোনো বর্ধিষ্ণু চাষীর সন্তানের সারা গায়ে খুজলি কিংবা দাঁতের রোগ হয়েছে, শহরে এনে চিকিৎসা করাবার সঙ্গতি আছে সেই চাষীর। কিন্তু সেই চাষীর ছেলের যদি সেইসঙ্গে সাহেব-ভীতি রোগও থাকে, তা হলেই মুশকিল। শহরে এলে একটি দুটি সাহেব চোখে পড়বেই, আর তখনই তার হাত পা ঠকঠকিয়ে কেঁপে মৃগী রোগীর মতন ফেনা বেরুবে মুখ দিয়ে। এমনকি চীনেম্যান দেখলেও ওরা সাহেব ভেবে ভয় পায়। অথচ খুজলি কিংবা দাঁতের রোগ, দুটোরই চিকিৎসা চীনেম্যানরাই খুব ভালো জানে।

চাষীর সঙ্গে এসেছে তার পুত্র, হ্যাট-কোটধারী চন্দ্রনাথকে দেখেই বাবারে, সাহেবরে! বলে সে দাঁতে দাঁতে বাদ্য শুরু করে দেয়।

চন্দ্ৰনাথ তখন তাকে আরও ভয় দেখিয়ে বলে, হাঁ, হামি সাহেব আছি। টুম ডাকু। হামি টুমকে মারিব!

 

চাষীর দিকে তাকিয়ে বলে, ভয় নেই। আধা ঘণ্টার মধ্যে আপনার এই ছেলে সিধে হয়ে যাবে।

ছেলেটির কণ্ঠ পাকড়ে জোর করে ঠেলতে ঠেলতে চন্দ্রনাথ নিয়ে যায় ভিতরে। অন্য একটি ঘরে ঢুকে সমস্ত দরজা জানলা বন্ধ করে দেয়, যাতে কোনো আওয়াজ বাইরে না যায়। একটি কাঠের টুলের ওপর জ্বলছে টেমী, তার পাশেই রাখা রয়েছে একটি হাতখানেক লম্বা কাঠের মুগুর।

চাষী ছেলেটির বয়েস ষোলো-সতেরো, বেশ শক্ত সমর্থ চেহারা, সারা গায়ে খুজলি। ছেলেটিকে সামনে দাঁড় করিয়ে চন্দ্রনাথ আচমকা টেনে এক বিরাশি সিক্কা ধাপ্পড় কষায়। ছেলেটি ছিটকে দেয়ালে পড়ে হাউ মাউ করে কেঁদে ওঠে।

তখন চন্দ্রনাথ হাঁক দেয়, সুলতান!

সেই ঘরেরই একটা কালো পর্দা ঠেলে বেরিয়ে আসে সুলতান। বিচিত্র তার সাজপোশাক! এক একটি রোগের জন্য তার পৃথক পৃথক সাজ আছে। আজ সে পাক্কা সাহেব। বুট জুতো, প্যান্ট-কোট-টুপী। মুখে একটি জ্বলন্ত চুরুট। ছোট্টখাট্টো চেহারার সুলতানকে দেখায় পুতুলের মতন। সে এসেই নাক-মুখ ফুলিয়ে ভয়ানক রাগের ভঙ্গি করে বলে, ড্যাম কুকাম্বার! ড্যাম পামকিনি! ড্যাম! ড্যাম!

তারপরই সে চাষীর ছেলেটির কাছে এসে কাটে এক রাম চিমটি। ছেলেটি বাবারে, মারে, গেলুম রে, ওগো ছোট পিসী তুমি কোহানে গ্যালে গো, বলে ডাক ছেড়ে কাঁদে আর সুলতানের হাত থেকে বাঁচবার জন্য ঘর জুড়ে দৌড়োয়। সুলতান অনবরত ড্যাম, ড্যাম বলতে বলতে তাকে তাড়া করে আর চিমটি কেটে যায়। মাঝে মাঝে সুড়সুড়িও দেয়।

কিছুক্ষণের মধ্যেই ছেলেটি নাজেহাল হতে হতে মরীয়া হয়ে সুলতানকে উল্টে আঘাত করে একটা। সুলতান এর পরে একটা ছোট ছুরি হাতে নিয়ে ছেলেটিকে মারতে উদ্যত হয়ে ভয়ঙ্করভাবে দাঁত কিড়মিড় করে। আত্মরক্ষার শেষ চেষ্টায় ছেলেটি তখন হাতে তুলে নেয় সেই কাঠের মুগুরটি। চন্দ্ৰনাথ গার্ড চেইন দেওয়া ঘড়ি বার করে কোটের পকেট থেকে। সে হিসেব করে দেখেছে, প্ৰায় সবার ক্ষেত্রেই পয়তিরিশ থেকে চল্লিশ মিনিট লাগে। পর্দা ঠেলে বেরিয়ে এসে সে বলে, ব্যাস, ব্যাস, যথেষ্ট হয়েছে।

সুলতানও তখন ছুরি সমেত হাতটি নামিয়ে হি হি করে হেসে বলে, তোমার নাম কী গো? অ ছেলে? আমার নাম সুলতান ছায়েব।

চন্দ্ৰনাথ জিজ্ঞেস করে, আর কোনো দিন সাহেব দেখলে ভয় পাবে? কতায় আচে না, যেমন কুকুর তেমন মুগুর! তুমি শোনোনি!

চন্দ্রনাথের এই চিকিৎসায় সত্যিই কাজ হয়। কচিৎ কদাচিৎ দু একটি রোগী ফিরে আসে পুনরায় চিকিৎসার জন্য।

রাত্রে সুলতান আর চন্দ্রনাথ একত্রে খানাপিনা করে। নানারকম গল্প হয়। তারপর সুলতান ঘুমিয়ে পড়লে চন্দ্ৰনাথ একবার রৌদে বেরোয়। শহরের পথে পথে একা এক টহল দেওয়া তার এক নেশা। তার আর একটি শাখ মাতাল ধরে পেটানো। কু-পল্লীতে গিয়ে ঘোরাঘুরি করে সে, নিশাচর প্ৰমোদসন্ধানীদের সঙ্গে পায়ে পা লাগিয়ে বিবাদ বাধায়, তারপর তাদের বেদম প্ৰহার করে। চন্দ্রনাথের যা শারীরিক শক্তি, তাতে তিন চারজন ব্যক্তিকে সে কাবু করে দিতে পারে খালি হাতেই।

কখনো কখনো চন্দ্রনাথের ডাক না পড়লেও সে নিজেই কোনো ভূতের বাড়িতে গিয়ে উপস্থিত হয়। পাথুরেঘাটায় এক স্যাকরার একমাত্র পুত্রের দম-ফটিকা রোগ হয়েছে। যখন তখন সে গেল গেল রব তুলে চোখ উল্টে দাঁড়াম করে পড়ে যায়। তারপরই সে ওরে বিষ্ট, ওরে বঙ্কা, ওরে জয়হরি প্রভৃতি অচেনা লোকের নাম ধরে ডাকে। স্যাকরাটির যা পয়সা তাতে সে এ শহরের অনেক হঠাৎ নবাবকে আহিরীটোলায় কিনে শালকের বাঁধাঘাটে বিক্রি করে দিতে পারে। ইনি সেই গুপী স্যাকরা, এখন গোপীমোহন স্বর্ণকার হয়েছেন। এক পাথুরেঘাটাতেই তাঁর তিনখানা বৃহৎ অট্টালিকা।

পুত্রের চিকিৎসার জন্য গোপীমোহন ইংরেজি ডাক্তার, বদ্যি হাকিম সবই ডেকেছেন। বাড়ির মেয়েরা কালীঘাটে স্বস্ত্যয়ন, কালভৈরবের স্তব পাঠ ও নানা স্থানের চরণামৃত ও মাদুলীর ব্যবস্থাও চালিয়ে গেছেন, কিন্তু কিছুতেই কিছু হয়নি। এ খুব জবরদস্ত প্ৰেতাত্মার ব্যাপার। গোপীমোহনের পুত্র লক্ষ্মীমোহনের পীড়া দিন দিনই দুরূহ। রূপ নিচ্ছে, এখন তার দম ফেলতে খুবই কষ্ট হয়, কুকুরের মতন জিভ বার করে হাঁপায় এবং অন্য লোকের কণ্ঠে কথা বলে।

এবার আনানো হয়েছে মস্ত বড় এক গুণিনকে। পারিবারিক গুরুঠাকুরের মতন এই গুণিনের সঙ্গে সব সময় অনেক চ্যালা চামুণ্ডা ঘোরে। গোপীমোহন স্যাকরার বসত বাড়িতে একতলায় তিনখানা ঘর নিয়ে ছ-সাত জন চ্যালা সমেত উঠেছেন সেই গুণিন। খুব ধুমধাম করে যাগযজ্ঞ চলছে কয়েকদিন ধরে, তারপর লোকের মুখে মুখে রাটিত হয়ে গেল যে সামনের অমাবস্যার রাতে সেই গুণিন ভূত নামবেন।

 

সন্ধে থেকেই সেদিন গোপীমোহনের বাড়ির সামনে প্রবল ভিড়। দ্বারবান দিয়েও তাদের গতি রোধ করা যাচ্ছে না। চল্লিশ পঞ্চাশজন ঠেলেঠলে ঢুকে পড়েছে একেবারে ভিতর মহলে। বলা বাহুল্য, তাদের মধ্যে রয়েছে চন্দ্ৰনাথ এবং সুলতান। আজ দুজনেরই পরনে ধুতি-কামিজ, সুলতানের মস্তকে আবার পাগড়ি।

বড় একটি হলঘর সম্পূর্ণ অন্ধকার করে বসে আছেন গুণিন, সঙ্গে তাঁর সাকরেদরা। লক্ষ্মীমোহনকে শুইয়ে রাখা হয়েছে এক পাশে কম্বল শয্যায়। ঘরের এক কোণে একটি আসন পাতা এবং তার সামনে অনেকগুলি বাসনে লুচি-মণ্ড সমেত বহুবিধ অন্ন-ব্যঞ্জন। সে সমস্ত খাবার দশটা মানুষে খেয়ে শেষ করতে পারবে না। তা রাখা হয়েছে ভূতের সেবার জন্য।

গ্রাম্য ওঝারা ভূতগ্ৰস্ত ব্যক্তিকে প্রচুর গালমন্দ করে ভূতকে বার করে আনে। এই গুণিন অশ্রাব্য গালিগালাজ শুরু করে দিলেন দর্শকদের উদ্দেশে। কেরেস্তানি ও ব্রাহ্মা-হুজুকের ওপরেই গুণিনের বেশী রাগ, দুপাত ইংরেজি পড়ে যেসব ছোঁকরার দেশে অবিশ্বাসের ঝড় বইয়ে দিয়েছে, তাদের জন্যই আজকাল এইসব রোগ সারে না! এর ফলে কিছু গোলযোগ দেখা দিল, দর্শকরা এতখানি কড়া গালিগালাজ হজম করতে রাজি নয়!

উত্তেজনা যখন চরমে ওঠার মতন অবস্থা, তখন গুণিন হঠাৎ ঘোষণা করলেন, তিনি ভূত নামাবেন না, আর একদণ্ডও এ বাড়িতে থাকবেন না। গোপীমোহন অসহায় ভাবে সকলের কাছে হাত জোড় করে কাকুতি-মিনতি করছে, মশায়রা শান্ত হোন, শান্ত হোন!

শেষ পর্যন্ত রফা হলো, যারা অবিশ্বাসী তাদের চলে যেতে হবে, আর যারা বিশ্বাস করে তারা থাকতে পারে। অবিশ্বাসীদের দৃষিত বাতাসে কোনো শুভ কাজ হয় না। একদল লোক তর্জন গর্জন করতে করতে বেরিয়ে গেল, রয়ে গেল বেশীর ভাগই।

চন্দ্রনাথ এর মধ্যে একবারও টু শব্দ করেনি। সুলতানকে নিয়ে শান্তভাবে বসে আছে এক পাশে। এরপর গুণিন যথারীতি চিৎকার করে দুর্বোধ্য মন্ত্র পড়তে লাগলো, এবং চ্যালারা ধূপ-ধূন্যের ধোঁয়ায় কাঁদিয়ে অস্থির করলো সকলকে। এক সময় হঠাৎ সব শব্দ থেমে যেতেই কিছুক্ষণের জন্য নেমে এলো অদ্ভুত নীরবতা। তারপর প্রথাসিদ্ধ ভূতের মতন নাকি সুরে কে যেন বললে, দূঁর হঁয়ে যাঁও, সঁবাই ঘঁর থেঁকে দূঁর হঁয়ে যাঁও!

গুণিন এবং তাঁর চ্যালারা সমেত সমস্ত দর্শককেই বেরিয়ে যেতে হলো ঘর থেকে, কিন্তু সামনের দরজা ও জানলা দুটি রইলো খোলা। দূর থেকেই যেন দেখা গেল ধোঁয়ায় ভর্তি অন্ধকার ঘরের মধ্যে যেন ঘুরছে একাধিক ছায়ামূর্তি। এবং চক-চকাস, কড়র-মড়র শব্দ হতে বোঝা গেল প্ৰেতাত্মা খাবার খেতে বসেছে। দর্শকদের সকলেরই সর্বাঙ্গে শিহরণ হলো, দু চারজন ভয়ে আর্ত শব্দ করে উঠলো, এক রমণী মুছা গেল।

ভূত শুধু খাদ্যই গ্ৰহণ করছে না, মটর মটু শব্দে তামাকও টানছে। সত্যিই অলৌকিক, রোমাঞ্চকর কাণ্ড!

কয়েক মুহূর্ত পরেই অবশ্য অন্য রকম কাণ্ড শুরু হলো। হঠাৎ ওয়াক ওয়াক শব্দ শুরু হলো। ভূতে বমি করছে। সে কি সাংঘাতিক বমি, যেন ভেদ বমির বাবা, ভোজন-বিলাসী প্রেতের যেন একেবারে শেষ দশা!

হতভম্ব দর্শকদের মধ্য থেকে হো-হো করে হেসে উঠলো চন্দ্রনাথ। অন্যদিকে হুড়োহুড়ি পড়ে গেছে। বাতি জ্বালিয়ে ভৃত্যরা ছুটে এলে দেখা গেল, সেই গুণিন এবং তার দু-তিনজন চ্যালাই মাটিতে গড়াগড়ি দিয়ে বমি করছে। অতি করুণ দৃশ্য।

ব্যাপার আর কিছুই না, অন্ধকার ও ধোঁয়ার সুযোগ নিয়ে চন্দ্রনাথ সুলতানকে পাঠিয়ে অনেকখানি টারমেরিক অ্যাসিড মিশিয়ে দিয়েছে ঐ খাদ্যদ্রব্যে। ঐ অ্যাসিড পেটে গেলে পাঁচ মিনিটের বেশী উদরে কিছু রাখা সম্ভব নয়।

হাসতে হাসতেই সুলতানের কাঁধে হাত দিয়ে চন্দ্রনাথ বললো, এবার চল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *