ইব্রাহিমপুরের প্রাক্তন কুঠিবাড়িটির পাশেই নির্মিত হয়েছে নতুন এক ইমারৎ। পুরোনো কুঠীবাড়িটির ধ্বংসস্তুপ এখনো বিদ্যমান। প্রকৃতির যা নিয়ম, ধ্বংসস্তুপের ওপরেও আবার প্রাণের আবির্ভাব হয়, সেখানে জন্মে গেছে অনেক গাছপালা।
সেদিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে ভুজঙ্গধর বললো, ঐ দ্যাখেন, ঐ ছিল আসল কুঠীবাড়ি, নীলকর সাহেবগো প্যায়দারা এক রাইতে আগুন লাগাইয়া দিছিল। বউ-ছাওয়াল-মাইয়া লইয়া আমি সেই রাইতেই নিরাশ্রয়। তাড়া-খাওয়া ইন্দুরের মতন আমি প্ৰাণের ভয়ে সকলডিরে লইয়া পলাইছি।
নবীনকুমার সেদিকে চেয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো।
ভুজঙ্গধর পুনরায় বললো, আপনে যেখানে খাড়াইয়া আছেন, ঠিক ঐখানেই একদিন আপনের অগ্ৰজ গঙ্গানারায়ণ সিংহ অকস্মাৎ আইসে খাড়াইয়াছিলেন। মুখ ভরতি দাড়ি-গোঁফের জঙ্গল। আমি তেনারে চেনবো ক্যামনে? আমি ঠাওরাইছিলাম বুঝি এ আর এক জাল প্রতাপচন্দ্র। পরে নরসুন্দর ডাকাইয়া ক্ষৌরি করাইতেই তেনার আসল রূপ বাইর হইল…।
নবীনকুমার জিজ্ঞেস করলো, নীলকর সাহেবরা এখন প্রজাদের সঙ্গে কী রকম ব্যবহার করে?
ভুজঙ্গধর বললো, কমু, সব আপনেরে খুইলা কমু। আগে মুখ-হাত ধোন, বিশ্রাম করেন। পাঁচজনে কয় যে আমার ব্ৰাহ্মণীর রান্নার হাত নাকি সরেস, যদি আজ্ঞা হয় তবে আইজ আমার ঘরেই আপনের আহারাদির ব্যবস্থা করি।
নদীকূলে বজরা থেকে নেমে বেশ খানিকটা হেঁটে আসতে হয় এই কুঠীবাড়িতে। ভুজঙ্গধর পালকির ব্যবস্থা করতে চেয়েছিল, কিন্তু নবীনকুমার তাকে নিরস্ত করে পদব্রজেই এসেছে। গ্রামের কোনো প্ৰজাই তাকে চেনে না। অনেকে তার মুণ্ডিত-মস্তক দিব্যাকান্তির দিকে বিস্ময়ভরা নয়নে চেয়ে থেকেছে। কিন্তু জমিদার ভেবে সম্ভ্রমে সামনে লুটিয়ে পড়েনি।
ভূতপূর্ব কুঠীবাড়ির আঙ্গিনা থেকে ভুজঙ্গধর তাকে নিয়ে এলো নতুন গৃহে। তার মধ্যে একটি কক্ষের দ্বারের তালা খুলে ভুজঙ্গধর বললো, এই দ্যাখেন ব্যবস্থার কোনো ত্রুটি রাখি নাই। এ-ঘরের খাট-আলমারি, তোশক বালিশ বিছানা সবই নতুন। জমিদারবাড়ির কেউ যদি কোনোদিন আসেন। সেই লাইগ্যা সাজাইয়া রাখছি। কিন্তু গত ছয় বৎসরের মধ্যে কেউ আসে নাই!
নবীনকুমার কিছুটা বিভ্রান্ত হয়ে গেছে, ভুজঙ্গধরের ঈষৎ বাঁকা সুরের কথায় সে জুতসই উত্তর খুঁজে পাচ্ছে না। এই বিষয়টি নিয়ে সে আগে বিশেষ কোনো চিন্তাই করেনি। বাংলা ও উড়িষ্যার বিভিন্ন অঞ্চলে তাদের জমিদারি আছে, সে এই কথাই শুধু জানে, সেই জমিদারি পরিচালনা বিষয়ে তার কোনো জ্ঞান নেই। প্ৰায় কৈশোর বয়স থেকেই সে নিজস্ব নানান পরিকল্পনায় মত্ত থেকেছে। অর্থের প্রয়োজন হলেই সে তলব করেছে। খাজাঞ্চিকে। এস্টেটের তহবিল থেকে সে চাহিদা মতন পযপ্তি অর্থ না পেলে এক একবার বিক্রয় করেছে কলকাতার এক একটি সম্পত্তি। বিষয়-তদারকির ভার গঙ্গানারায়ণের ওপরে। অবশ্য এক গঙ্গানারায়ণই বা কতদিকে সামলাতে পারবে! কিন্তু সেকথা নবীনকুমার এতদিন ভাবেনি।
দুজন ভৃত্য অবিলম্বে কক্ষটি ঝাড়-পোঁছ করে দেবার পর নবীনকুমার সে-কক্ষে প্রবেশ করলো। সেটি আয়তনে বেশ বড়, আসবাবগুলি রুচিসম্মত, কোনো জমিদারের সাময়িক বসবাসের অনুপযুক্ত নয়। গ্ৰীষ্মে টানা পাখার ব্যবস্থা আছে। পালঙ্ক ছাড়াও রয়েছে একটি আরামকেদারা। ভুজঙ্গধরের অনুরোধে নবীনকুমার সেটিতে বসলো।
ভুজঙ্গধর ভূমিতে আসন গ্ৰহণ করে আবার সেই বিদ্রূপ ও কৌতুক মিশ্রিত সুরে বললো, আমি আপনেগো জমিদারি গ্ৰাস কইরা লইছি বটে, কিন্তু আমারে একেবারে নিমকহারাম কইতে পারবেন না। তাইলে আর জমিদারের লাইগ্যা এমন ঘর সাজাইয়া রাখছি। ক্যান? এই ঘরে কিন্তু আইজ পর্যন্ত কেউ শোয় নাই! আপনার জ্যেষ্ঠভ্রাতা বাবু গঙ্গানারায়ণ সিংহ মশায় অন্তত একবার আসবেন এমন আশা কইরা ছিলাম। তিনি আইলে নিজেও খুব খুশী হইতেন। তিনি প্রজাগো পক্ষ লইয়া নীলকর সাহেবগো বিরুদ্ধে জবর লড়াই দিছিলেন, এবার আইলে তিনি স্বয়ং সেই লড়াইয়ের ফলাফল স্বচইক্ষে দ্যাখতে পারতেন।
নবীনকুমার জিজ্ঞেস করলো, কী হয়েছে ফলাফল?
—যে ম্যাকগ্রেগর সাহেবের নাম শোনলে বাঘে-গরুতে একঘাটে জল খাইতো, এমনকি আমাগো বুকের মইধ্যেও গুড়গুড়াইতো, সেই ম্যাকগ্রেগর সাহেব আত্মহত্যা করছে। ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেটের লেউীর সাথে তার যেন কী সব হইছিল। যাউক সেকথা। সে বেটা পাইছে তার পাপের শাস্তি। তারপর একদিন নীলকুঠাতেও আগুন লাগে। সাহেবরা সব পিঠটান দিছে, এহানে আর নীলকুঠী নাই। আমাগো কুঠী যারা পুড়াইয়া দিছিল, তারা নিজেরাও নিস্তার পায় নাই। এখন আর এই এলাকার জমিতে নীলচাষ হয় না, আবার সোনার ধান ফলে।
—শুনে আমিও খুশী হলুম যে আমার দাদা যে কারণের জন্য প্ৰাণের ঝুঁকি নিয়েছিলেন, তা সার্থক হয়েচে!
—কিন্তু তিনিও শহরে গিয়া অইন্যগো মতন ফুকা জমিদার হইলেন। আর গ্রামে আইলেন না।
—আমার দাদা অনেক রকম কাজ নিয়ে ব্যস্ত। না আসতে পারা তাঁর পক্ষে মোটেই অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু কলকাতা থেকে আমাদের এস্টেটের আর কোনো কেউ কখনো আসেনি বলতে চান? তা হতেই পারে না।
—আইছে, আইছে। গোড়ায় গোড়ায় প্রত্যেক বছরেই একবার দুইবার আমলা-গোমস্তারা আইছে। আমি তাগো হাঁকাইয়া দিছি। ঐ দিবাকরাই তো আইছিল তিনবার। আমি তারে কইছি, যা বেটা, ফের এদিকে আইলে তুর মাথা ফাটাইয়া দিমু!
-আমাদের প্রতিনিধিকে কেন আপনি হাঁকিয়ে দিয়েচেন, তা জানতে পারি কি?
—নিশ্চয় জানতে পারেন। দিছি। আমার খুশী! শোনেন, শোনেন, অমন উত্তেজিত হন ক্যান? স্পষ্ট কথা শোনার অভ্যাস আপনাগো নাই! তাই মাথা গরম হইয়া যায়। শোনেন, আমি যদি হই শিয়াল, তাইলে আপনেগো ঐ আমলা-গোমস্তারা হইলো কুমোইর, অর্থাৎ আপনেরা যারে কন কুমীর। পরের ধনে পোদ্দারি করতে গ্যালেও আমারে তবু খাটতে হয়। আর অরা আইস্যা লুটের বাখরা চায়। আগো হাতে আমি টাকা দিমুক্যান! জমিদার আইলেও না হয় হিস্যা বুজাইয়া দিতাম, অগো হাতে টাকা দিলে সে টাকা আপনেগো এস্টেটের তবিলে জমা পড়বে কইতে চান? কোনোদিন না। অন্তত তিন ভাগের দুই ভাগ অরা নিজেরা হজম করবে! তাই আমি ঠিক করলাম অগো দিমুক্যান, পুরাপুরি আমি নিজেই খাই। আমারও পরিপাক শক্তি কম নয়। দিব্যি হজম হইয়া যায়!
—অর্থাৎ যে-কোনো কৌশলে জমিদারকে ঠকানোই আপনার মূল উদ্দেশ্য।
–তাইলে ছোটবাবু, এই কথার জবাব দ্যান তো! নীলকরের অত্যাচারে আমি যখন বউ, ছাওয়াল, মাইয়া লইয়া নিরাশ্রয় হইছিলাম, তখন জমিদার আমারে দেখছিলেন? জমিদার একবারও কি চিন্তা করছিলেন যে আমি কোথায় থাকুম, কী খামু? আমি মরলাম না বাঁচলাম, হ্যার কেউ খোঁজ নিছে? এই যে কী সাঙ্ঘাতিক আকাইল গ্যাল, গেরামের প্রত্যেকটি ঘরে ঘরে হাহাকার, তখন প্রজাগো একটুও কি সাহায্য করছে জমিদার? সে সব যদি না করে, তবুও আমি জমিদারের গোমস্ত আইলেই তার পা ধোওয়নের জল দিয়া খাতির করুম আর তার হাতে টাকার থলি তুইল্যা দিমু?
–অন্য সব জমিদাররা মহালে নিয়মিত আসে বলতে চান?
—যারা আসে না, তাগো জমিদারি আইজ না হউক কাইল লাটে ওঠবেই। আপনের পিতামহ নিয়মিত আসতেন, আপনের পিতাঠাকুরও যৌবনে আসছেন বেশ কয়েকবার। তারপর আপনার জ্যেষ্ঠভ্রাতারে পাঠাইতেন। তারপর যেই আসা বন্ধ হইল, আপনেগো জমিদারির দশাও জল-শুকনা নদীর মতন হইল। আর বেশী দিন নাই—।
—আমরা যদি এ জমিদারির অংশ বিক্রি করে দিতে চাই?
–তা পারবেন। কিন্তু দাম পাইবেন না! এই ফোঁপরা জমিদারি কেনবে কেডা?
–আপনিই ফোঁপরা করে রেকেচোন, বোঝা যাচ্ছে!
—বোঝা অত সহজ নয়, ছোটবাবু। আগে গোরামের অবস্থা ভালো কইরা নিজের চাইক্ষে দ্যাখেন, তারপর বোঝবেন।
—জমিদারির অবস্থা যে খারাপ হয়ে যাচ্ছে, সে কত আপনি আমাদের চিঠি লিকে ত জানাননি কো!
—আমার বিপদের সময় অন্তত সাতখান পত্র পাঠাইছিলাম আপনেগো কাছে, একখানেরও কোনো জবাব পাই নাই। মানলাম, আপনের জ্যেষ্ঠভ্রাতা তখন জেল খাটতে আছিলেন, কিন্তু আপনেও তখন নিতান্ত অবোধ বালকটি তো না, আপনের কুড়ি—একুইশ বৎসর বয়স, কিন্তু আপনে তখন একটুও নজর দ্যান নাই। আপনে তখন মহাভারত রচনার মতন মহৎ কর্মে ব্যস্ত আছিলেন। আপনে নামইস্য ব্যক্তি, আমি ব্ৰাহ্মণ না হইলে আপনের পায় হাত দিয়া প্ৰণাম করতাম। কিন্তু আপনে জমিদার হিসাবে অপদাৰ্থ। আপনে বিধবা বিবাহের জন্য লক্ষ টাকা ব্যয় করছেন শুনছি, কিন্তু আপনে আমার গ্রামগুলার অনাহারী মানুষগো জইন্যে এক মুঠা অন্নও দ্যান নাই।
—আমি বিধবা বিবাহ প্রচলনের জন্য অর্থ সাহায্য করে ভুল করিচি বলতে চান?
—না। ভুল ক্যান কমু? অতি মহান আদর্শের কাম করছেন। কিন্তু এদিগে যে আপনেগো অবিবেচনার ফলে গোরামের কত গেরস্থ বাড়ির বউ অকালে বিধবা হইল, সে খবর রাখেন নাই।
নবীনকুমারকে নিরুত্তর অবস্থায় গুম হয়ে যেতে দেখে ভুজঙ্গধর উঠে দাঁড়িয়ে কণ্ঠস্বর বদলে বললো, আরে রাম রাম, আমি শুধু বকবকই করতে আছি, আপনের খাওন-দাওনের কোনো ব্যবস্থা হইল না। এহনও-আপনে বিশ্রাম করেন, ছোটবাবু, আমি একটু ভিতরে যাই—।
দিন তিনেক ভুজঙ্গধরের কুঠীবাড়িতে কাটিয়ে দিল নবীনকুমার। লোকটির সঙ্গে দুবেলাই তার কথা কাটাকাটি হয়। ভুজঙ্গধর ইংরেজিতে নিরক্ষর হলেও বাংলা ও সংস্কৃতে যথেষ্ট পড়াশুনো করেছে, এই পরগনার বাইরের জগৎ সম্পর্কেও খবরাখবর রাখে। স্তাবক বা খোসামুদেদের বদলে স্পষ্টবাদীদের নবীনকুমার বরাবরই পছন্দ করে। কিন্তু এই লোকটির কথাবার্তা সে পুরোপুরি সহ্যও করতে পারছে না, আবার অগ্রাহ্য করতেও পারছে না।
একদিন প্ৰাতঃকালে নবীনকুমারের নিদ্ৰাভঙ্গ হলো একটি গান শুনে। অতি সুমিষ্ট সুর, গানের কথাগুলিও সুমধুর। নবীনকুমার ঘুম-জড়িত চক্ষে উঠে এসে দেখলো বাইরের প্রাঙ্গণে দাঁড়িয়ে একজন বৈষ্ণব গায়ক গুপীযন্ত্র বাজিয়ে গান গাইছে, আর সামনে একটি জলচৌকিতে বসে মুগ্ধ ভাবে শুনছে। ভুজঙ্গধর।
নবীনকুমারকে দেখে ভুজঙ্গধর শশব্যাস্তে উঠে এসে জিজ্ঞেস করলো, আপনার নিদ্রার ব্যাঘাত হইল নাকি, ছোটবাবু?
নবীনকুমার বললো, না। ভট্টচাজমশাই, গায়কটিকে এদিকে ডাকুন তো, গানটি ভালো করে শুনি।
গায়কটি নবীনকুমারের পরিচয় আগে থেকেই শুনে থাকবে নিশ্চয়। কাছে এসে ভূমিতে মস্তক ঠেকিয়ে প্ৰণাম জানিয়ে বললো, দণ্ডবৎ, হুজুর। আপনার পিতারে আমি গান শুনাইছি। তিনি গান বড় ভালোবাসতেন।
নবীনকুমার বললো, ঐ গানটি আর একবার গান তো। কতগুলো সব বুঝতে পারিনি। গায়কটি আবার শুরু করলো :
হৃদিবৃন্দাবনে বাস, যদি করা কমলাপতি!
ওহে ভক্তপ্রিয়! আমার ভক্তি হবে রাধা সতী।।
মুক্তি-কামনা আমারি, হবে বৃন্দে গোপনারী,
দেহ হবে নন্দেরপুরী, মোহ হবে মা যশোমতী।।
আমায় ধর ধর জনাৰ্দন! পাপ-ভার গোবর্ধন
কামাদি ছয় কংসচরে ধবংস কর সম্প্রতি।।
বাজায়ে কৃপা-বাঁশরী, মন-ধেনুকে বশ করি,
তিষ্ঠ হৃদিগোষ্ঠে, পুরাও ইষ্ট, এই মিনতি…
নবীনকুমার সহৰ্ষে তারিফ করে বললো, বাঃ, বাঃ,! বড় খাসা বাঁধুনী! এমন সুন্দর রূপক-গান বহুদিন শুনিনি। এ গান কে রচেচে? এ তো রামপ্ৰসাদেরও নয়, তিনি কালীভক্ত, আর এ গান বৈষ্ণবদের।
গায়কটি বললো, আজ্ঞে, এ গান দাসু রায় মশাইয়ের।
নবীনকুমার সবিস্ময়ে বললো, দাসু রায়?
ভুজঙ্গধর বললো, সে কি ছোটবাবু, আপনি দাসু রায়ের নাম শোনেন নাই? বর্ধমান-কাটোয়ার দাসু রায়ের গান বাংলায় কে না শোনছে? আমাগো এই দিকে কাশীমবাজারে গাওনা করতে আইসাই তো তিনি দেহরক্ষা করলেন। সে বোধকরি সেই সেপাই যুদ্ধের বৎসরে।
নবীনকুমার বললো, দাসু রায়ের নাম কেন জানবো না? কিন্তু সে লোকটা তো অতি কুচ্ছিৎকদৰ্য খেউড়ের পাঁচালী গাইত। কতগুলো সব ইতরামিতে ভরা। তার মুখ দিয়ে এমন গান বেইরোচে, বিশ্বাস হয় না।
ভুজঙ্গধর বললো, ঐ তো মজা, পঙ্কেই পদ্ম ফোটে। ডাকাইত রত্নাকরই বাল্মীকি হয়। এ গানও দাসু রায়ের। এমনকি নবদ্বীপের পণ্ডিতরাও দাসু রায়কে সম্মান দিছে শ্যাস পইর্যন্ত। আইচ্ছা, এইডা শুইন্যা কন তো, কার? নেতাই, সেইডা গাও তো, দোষ কারো নয়গো, মা—।
নিতাই আবার ধরল :
দোষ কারো নয় গো, মা
আমি স্বখাত সলিলে ড়ুবে মারি শ্যামা।
ষড়রিপু হলো কোদণ্ড স্বরূপ
পুণ্যক্ষেত্র মাঝে কাটিলাম কূপ
সে কূপ ব্যাপিল, কালরূপ জল কালমনোরমা।
আমার কী হবে তারিণি
ত্ৰিগুণ ধারিনী
বিগুণ করেছি স্বগুণে…
নিতাইয়ের গান মধ্যপথে থামিয়ে দিয়ে ভুজঙ্গধর জিজ্ঞেস করলো, এ গান শুনছেন কখনো ছোটবাবু? কন তো, কার?
নবীনকুমার বললো, এটি শ্যামাসঙ্গীত, অতি উচ্চাঙ্গের। এ গান নিশ্চয়ই রামপ্রসাদ কিংবা কমলাকাস্তের।
ভুজঙ্গধর বললো, হইল না। এই গানও ঐ দাসু রায়েরই। একই মানুষ এই শ্যামাসঙ্গীত আর আগের বৈষ্ণব গান ল্যাখছে।
—আমরা তাকে অশ্লীল পাঁচালীকার হিসেবেই জানি। এই দুটি গানে তো একটাও নোংরা কতা নেই।
—তাহলেই বোঝেন আপনেরা কত কিছু ভুল জানেন শহরে বইস্যা। শোনেন তয় একটা গল্প কথা। এই গানে ঐ যে একখান কথা আছে না, ষড়রিপু হল কোদণ্ড স্বরূপ —ঐ কোদণ্ড শব্দটার ঠিক অর্থ দাস রায় মশায় জানতেন না। তিনি ভাবছিলেন কোদণ্ড মানে কোদাল, তাই সে কোদণ্ড দিয়া কূপ খুঁড়াইছেন। কিন্তু আপনে সংস্কৃত অতি উত্তম জানেন, আপনের জানা আছে নিশ্চয়ই যে কোদণ্ড মানে হইল ধনুক! শুধু ধনুক, তীরও না, সুতরাং কোদণ্ড দিয়া কূপ কাটা যায় না, দাসু রায় মশাই ভুলই করছেন। এই জইন্য এক টোলের পণ্ডিতের ছাত্তররা দাসুরায় মশাইরে উপহাস করছিল। লাখাপড়া তেমন শেখেন নাই দাসু রায়, একটা-আধটা কথার ভুল হইতে পারেই, কিন্তু এমন গান বান্ধতে পারে কয়জন? টোলের ছাত্রগো সেই মস্করার কথা শূইন্যা প্ৰসিদ্ধ পণ্ডিত মহামহোপাধ্যায় রাম শিরোমণি ছাত্রগুলোরে বইক্যা কইছিলেন, দাসু রায় যখন ল্যাখছেন, তখন ওডা হইলো আর্ষ প্রয়োগ! আজি থিকা কোদণ্ডের অর্থ ধনুকও হবে, কোদালও হবে।
নবীনকুমার বললো, বাঃ, বেড়ে গল্পটি তো। দাসু রায়ের যে এসব দিকে এত সম্মান হয়েছিল, তা আমি জানতুম না। তবে গল্প শোনার, চেয়ে গান শোনা ভালো। আরও গান গাইতে বলুন ওকে।
আরও তিন চারখানি গান শুনে উত্তরোত্তর মুগ্ধ হয়ে নবীনকুমার এক সময় বললো, একে আমি কলকাতায় নিয়ে যাবো। এমন চমৎকার এর সুরেলা কণ্ঠস্বর, শহরে গেলে এর যোগ্য সমাদর হবে। এর গান শুনে দাসু রায় সম্পর্কে বিশিষ্ট ব্যক্তিদের ভুল ভাঙবে।
ভুজঙ্গধর বললো, ওকে আপনি কলকাতায় নিয়া যাইবেন?
–হ্যাঁ। আমি যখন ফিরবো, ও আমার সঙ্গেই যাবে।
—বাঃ! অতি উত্তম প্রস্তাব। নিতাইচাঁদের কপাল খুইলা গেল। কী রে, নেতাই, ছোটবাবুর সাথে কইলকাতায় যাবি?
নিতাইচাঁদ গান থামিয়ে হাত জোড় করে দাঁড়িয়ে আছে। লোকটির বয়স অন্তত ষাট হবে। কেশবিরল মস্তক, মুখখানি খুব সরু। তার আকৃতিতে কেমন যেন একটা শালিক পাখির ভাব আছে। গায়ে একটি নামাবলী।
ভুজঙ্গধরের প্রশ্ন শুনে সঙ্গে সঙ্গে সে সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়লো। তারপর বললো, তেমন সৌভাইগ্য কি আমার হবে?
ভুজঙ্গধর বললো, তুই ছোটবাবুর নেকনজরে পইড়া গেছস, তোর আর চিন্তা কি? আইজ যাইতে কইলে আইজই যাবি?
নিতাইচাঁদ বললো, নিশ্চয়। আমার তো পিছুটান নাই। কোনো দিন র্যালগাড়িতে উঠি নাই, বড় শখ একবার র্যালগাড়িতে যাই। আর কইলকাতায় গিয়া একদিন বরফ খামু। বরফের কথা অনেক শুনছি, কোনোকালে চাইক্ষে দেখি নাই, জীবনে যদি এই সাধটা মিটে।
ভুজঙ্গধর হাসতে হাসতে বললো, দ্যাখলেন, দ্যাখলেন ছোটবাবু। ও এক কথায় রাজি। একেবারে এক পায়ে খাড়া। এই নেতাই বোষ্টমরে আমি কতকাল ইস্তক দেখতে আছি, কোনোকালে এই দুই তিনখান গোরামের বায়রায় যায় নাই, আর আইজ্য আপনার কথা শুইন্যা অমনেই কইলকাতায় যাইতে চায়।
নবীনকুমার বললো, আমি কলকাতায় নিয়ে গিয়ে ওর গান সবাইকে শোনাবো। এমন সুকণ্ঠের অধিকারী হয়ে শুধু শুধু গাঁয়ে পড়ে থাকবে কেন?
ভুজঙ্গধর এবার বিচিত্র মুখভঙ্গি করে বললো, গেরাম থিকা সব ভালো ভালো জিনিস। যদি আপনেরা শহরে লইয়া যান। তাইলে আমরা কী লইয়া থাকুম? শহর থিকা কিছু ভালো জিনিস ছিটেফোঁটা গ্রামে পাঠাইতে পারেন না?
নবীনকুমার বললো, এটাই এ যুগের রীতি। ভটচাজমশাই, সুযোগ পেলে সব গুণী জ্ঞানীরা শহরে যাবেই। কারণ শহরে টাকা আছে। টাকাই তো মধু!
—হ। টাকা যে কতবড় মধু, তা আমি জানি। কিন্তু ছোটবাবু, শহরে সেই টাকার যোগান দেয় কে? এইসব গোরামের টাকাই শহরে যায় না? গ্রামই হইল গিয়া দেহ, এই দেহর সব রক্ত যায় শহর নামের মস্তিষ্কে। কি, ভুল কইতাছি? তবে, আপনেরাও এই কথাডা ভোলবেন না যে মানুষের হৃৎপিণ্ডটা থাকে দেহর মইধ্যেই, মস্তিষ্কে না। গ্রামই দ্যাশের প্রাণ।
নবীনকুমার নিজ গাত্র থেকে শালটি খুলে নিতাইচাঁদকে শিরোপা দিল। তারপর তার গুপীযন্ত্রটি নিয়ে পরীক্ষা করতে লাগলো মনোযোগ দিয়ে।
সেইদিন থেকেই নবীনকুমার নিতাইচাঁদের কাছ থেকে সঙ্গীতশিক্ষা নিতে শুরু করলো। তার নিজের কণ্ঠেও বেশ সুর আছে, গান তুলতে পারে সহজে। এই শিল্পকলাটি সম্পর্কে তার মনের মধ্যে একটা তৃষ্ণা রয়ে গেছে অনেক দিন থেকেই। হরিশ মুখুজ্যের সঙ্গে সে মুলুকচাঁদের আখড়ায় যেত প্রধানত নৃত্যগীতের আকর্ষণেই। মনে মনে সে সঙ্কল্প নিয়ে ফেললো, এবার ফিরে গিয়ে সে বাড়িতে নিয়মিত গান বাজনার আসর বসাবে। গ্রামাঞ্চলে ঘুরে ঘুরে আরও ভালো ভালো গায়কের সন্ধান পেলে সে তাদেরও নিয়ে যাবে শহরে।
দিন দুয়েক পরে সে ভুজঙ্গধরের পেড়াপিঁড়িতে একপ্রকার বাধা হয়েই গ্রাম পরিদর্শনে বেরুলো। এবার অবশ্য পদব্ৰজে নয়, পাল্কিতে। সঙ্গে দুলালচন্দ্র এবং অন্য কয়েকজন সহচরও রইলো। ঘোরা হলো প্ৰায় চার-পাঁচটি গ্রাম। মধ্যে মধ্যে পাল্কি নামিয়ে নবীনকুমারকে বিশ্রাম দেওয়া হয়, সেই আসরে গ্রামের কিছু মানুষজনের সঙ্গেও দেখা হয়। অধিকাংশই রুগ্ন, শীৰ্ণ চেহারা। নবীনকুমার বিস্ময় বোধ করে। এখন নীলকর সাহেবদের অত্যাচার আর নেই, তবু গ্রামের মানুষদের এ দশা কেন?
এক স্থানে সম্ভবত আগে থেকেই কোনো ব্যবস্থা করা ছিল। নবীনকুমার একটি বড় আটচালাসমেত কাছারি বাড়িতে এসে পৌঁছেলো মধ্যাহ্নে।
ভুজঙ্গধর জানালো যে এখানেই নবীনকুমার আহার সেরে কয়েক ঘণ্টা জিরিয়ে নেবে। তবে তার আগে স্থানীয় প্রজাদের একবার সাক্ষাৎ দিলে ভালো হয়।
নবীনকুমার কাছারি থেকে আটচালার প্রান্তে এসে দাঁড়াতেই দেখতে পেল, সেখানে জমায়েত হয়েছে প্ৰায় হাজার খানেক মানুষ। ভুজঙ্গধর তাদের উদ্দেশে সাধু বাংলায় বললো, শুন, প্ৰজাগণ। আমাদের পরম পূজ্য জমিদার শ্ৰীল শ্ৰীযুক্ত নবীনকুমার সিংহ মহাশয় তোমাদিগের সম্মুখে উপস্থিত। কাৰ্য্যন্তরে ব্যাপৃত থাকায় তিনি এতদিন আমাদিগের এ অঞ্চলে আসিতে পারেন নাই। তোমরা ইহার অগ্ৰজ বাবু গঙ্গানারায়ণ সিংহ মহাশয়ের পরিচয় এককালে জানিয়াছ। তিনি তোমাদের মঙ্গলের জন্য নিজের রক্তপাত পর্যন্ত করিয়াছিলেন, কারাগারের অন্ধকারে দুঃসহ ক্লেশের সহিত দিন কাটাইয়াছেন। ইনি তাঁহারই সুযোগ্য ভ্রাতা, আমাদের পূজনীয়, মহানুভব ঈশ্বর রামকমল সিংহের পুত্র। এতকাল পরে তিনি এতদঞ্চলে আসিয়া, তোমাদের অবস্থা স্বচক্ষে দেখিয়া এবং পর পর দুই বৎসরের আকালের কথা বিবেচনা করিয়া, তিনি দয়াপূর্বক তোমাদের এই দুই বৎসরের খাজনা মকুব করিয়া দিলেন।
প্ৰজারা প্ৰথমে একেবারে নীরব থেকে মূল সত্যটি হৃদয়ঙ্গম করে চিৎকার-চাঁচামেচিতে একেবারে ফেটে পড়লো।
ভুজঙ্গধর নবীনকুমারের দিকে চেয়ে বললো, হুজুর, এবার আপনি ঘোষণাটি একবার নিজের মুখে উচ্চারণ করুন।
নবীনকুমারের কাছে ঘোষণাটি যেমনই অপ্রত্যাশিত তেমনই অদ্ভুত। সে কড়া গলায় বললো, এই প্রহসনের মানে কী? এখেনকার আদায়-তহশিল আপনি করেন, আমি নামেই শুধু জমিদার। আপনি নিজে মুখে স্বীকার করেচেন যে এখেন থেকে একটা আধলাও আমরা পাই না। তবে আর আমার এ খাজনা মকুব করা না-করায় কী আসে যায়?
ভুজঙ্গধর বললো, ছোটবাবু, আমি আপনেগো টাকা কড়ি দেই বা না দেই সেটা ভেন্ন কথা। সেটা আমার-আপনেগো ব্যাপার। আমি জানি, এই লোকগুলোর এখন খাজনা দেওয়ার ক্ষামতা নাই। আমি হয়তো খাজনার জইন্যে অগো উপর চাপ দিলাম না, কিন্তু খাজনা না দিয়া জমিদারকে ঠকাইলে আগো মনের মইধ্যে একটা পাপের ভাব থাকে। অরা ভাবে, খাজনা না দিলে জমি পয়মন্ত হয় না। সুতরাং, আপনে জমিদার হইয়া যদি নিজের মুখে খাজনা মকুব কইরা দান অরা স্বস্তি পায়।
দু হাত তুলে প্রজাদের উদ্দেশ করে ভুজঙ্গধর আবার বললো, এই চুপ! চুপ! ছোটবাবু কথা কবেন, তোরা মন দিয়া শোন।
সকলে থেমে যেতে নবীনকুমার বললো, তোমাদের খাজনা মকুব।
ভুজঙ্গধর বললো, দুই বৎসরের জন্য।
নবীনকুমার বললো, না। চিরকালের জন্য। আজ থেকে আমার এলাকার সব জমি নিষ্কর হয়ে গেল।
নবীনকুমার এইটুকু বলে থেমে যেতেই এমন কোলাহল শুরু হয়ে গেল যে কান পাতা দুষ্কর। কারুর কোনো কথা বোঝা যায় না। প্ৰজারা অনেকে ভ্যাবাচাকা হয়ে গেছে। জমিদার আছে, অথচ জমির খাজনা লাগবে না, এ আবার কেমন কথা! কয়েকজন লোক অতশত না বুঝেও ছুটে এলো নবীনকুমারের পায়ে পড়ে প্ৰণাম জানাবার জন্য। অবস্থা এমন দাঁড়ালো যে নিরাপত্তার জন্য নবীনকুমারের পক্ষে আর সেখানে দাঁড়িয়ে থাকা চলে না। ভুজঙ্গধর নবীনকুমারকে টেনে নিয়ে এলো কাছারি ঘরের মধ্যে।
এবার নবীনকুমারের মুখে মৃদু হাস্যের রেখা। ভুজঙ্গধরের চোখে স্থির দৃষ্টি রেখে সে কৌতুকের সুরে বললো, কেমন জব্দ করলুম আপনাকে?
ভুজঙ্গধর বিমূঢ় ভাবে বললো, এ আপনে কী কইলেন ছোটবাবু? চিরকালের জইন্য খাজনা মকুব? তাও কখনো হয় না কি? এ তো পোলাপানগো মতন কথা!
নবীনকুমার বললো, আপনি ভেবেচিলেন, আপনি নিজে চিরকাল আমাদের জমিদারির রোজগার হজম করবেন! সে পথ মেরে দিলুম কি না?
ভুজঙ্গধর বললো, কিন্তু সরকারের ঘরে তো আপনাগো বৎসর বৎসর ট্যাকসো জমা দিতে হইবে ঠিকই—যদি কোনো আয় না থাকে, তাইলে…
-সে দেখা যাবেখন!
নবীনকুমারের ঘোষণায় বিরাট এক বিভ্ৰান্তি ও বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হলো। ইব্রাহিমপুর পরগনায় অনেকগুলি গ্রাম, সেইসব গ্রামের অধিবাসীদের মধ্যে কার কার খাজনা মকুব হলো, কার হলো না, তা বোঝাই গেল না! যে-সব প্ৰজা সেদিন উপস্থিত ছিল জমিদারের সামনে, শুধু তারাই কি এই সুবিধে পেল? এর মধ্যে আবার কিছু এলাকা ছিল নীলকরদের কাছে ইজারা দেওয়া, সাহেবরা চলে যাবার পর চাষীরা আপনমনে চাষ করে চলেছে বটে কিন্তু জমি ইজারামুক্ত হয়েছে কি না। তাই বা কে জানে!
নবীনকুমারের পক্ষে আর ইব্রাহিমপুরের কুঠীবাড়িতে টেকাই অসম্ভব হয়ে দাঁড়ালো। দলে দলে লোক ধেয়ে আসছে, তারা প্রত্যেকে নিজের জমির খাজনা বিষয়ে জমিদারের মুখ থেকে আশ্বাসবাণী শুনতে চায়। সে এক অসম্ভব ব্যাপার, নবীনকুমারের স্নানাহার করারও সময় নেই, কারণ এই সব অবোধ মানুষগুলি এক কথা বারবার বুঝিয়ে বললেও বোঝে না। গ্রামে-গঞ্জে ঢাক পিটিয়ে জমিদারের বাত জানাবার জন্য ঘোষক পাঠানো হলো। কুঠীবাড়ি ছেড়ে নবীনকুমার আশ্রয় নিল বজরায়। সেখানেও তাঁর সঙ্গী রইলো ভূজঙ্গাধর।
বজরা ভেসে চললো কোনো নির্দিষ্ট গন্তব্য ছাড়াই। দিনে মাত্র একবার কোনো জনবিরল স্থানে থামে। ভুজঙ্গধরের কাছে প্রায় সর্বক্ষণ সে-গ্রামের জীবনযাত্রার খুঁটিনাটি বিষয় শোনে। এ যাত্রার প্রারম্ভে সে উদ্ধৃদ্ধ হয়েছিল প্রকৃতি প্রেমে, এখন তার আগ্রহ জীবন্ত মানুষ সম্পর্কে। ইতিমধ্যেই নবীনকুমার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে ইব্রাহিমপুর থেকে নবদ্বীপ পর্যন্ত একটানা পাকা সড়ক সে নিজব্যয়ে নির্মাণ করে দেবে। পথের যোগাযোগের অভাবে, গ্ৰাম্য পণ্য মার খায়।
একদিন মধ্যাহ্নে নদীর দক্ষিণ তীরের একটি গ্রামে বহু লোকের বিপন্ন হাহাকার শোনা গেল। মানুষজন ঘর বাড়ি ছেড়ে পালাচ্ছে। নবীনকুমার সেদিকে বজরা ভেড়াতে বলতেই ভুজঙ্গধর নিষেধ করলো। ঐ পারে সুখচরের জমিদারের এলাকা।
ভুজঙ্গধর বললো, আপনের পক্ষে ওখানে পদার্পণ করা মোটেই উচিত হয় না। ঐ দ্যাখেন আর এক লোহামের জমিদার। ওনার নায়েব পাঁচখানা হাতি লইয়া গোরামে আসে। যে-সব দুষ্ট প্রজা খাজনা দেয় না, তাগো বাড়ি হাতির পায়ের গুতায় গুড়াইয়া দ্যায়। সেইজনাই সুখচরের জমিদারের বাড়িতে সব সময় টাকা ঝামর ঝামর করে। সেই টাকায় বাবুরা কইলকাতায় বাঈজী নাচায় আর পায়রা উড়ায়। মন্দিরও বানাইছে দুই তিন খান!
একটু হেসে ভুজঙ্গধর জিজ্ঞেস করে, ছোটবাবু, আপনে কইলকাতায় মন্দির বানান নাই?
নবীনকুমার সে প্রশ্নের উত্তর দেবার প্রয়োজন বোধ না করে অন্যমনস্কভাবে বলে, সরকারের চোকে আমরা এখনো ইব্রাহিমপুরের জমিদার। আপনি আমাদের নায়েব। এখন থেকে আপনি নিয়মিত মাস পাইনে পাবেন। আপনার ওপব অনেক কাজের ভার দেবো। প্রতি দুখানা গাঁ অন্তর ইস্কুল বানাতে হবে, আকালের বিচারে বিনা সুদে চাষীদের বীজ ধান আর খোরাকি ধান দিতে হবে। আর…
ভুজঙ্গধর বললো, কইলকাতায় ফিরা গ্যালেই সব ভুইলা যাবেন জানি। কিংবা, বিধু মুখুঁইজ্যা এখনো বাইচা আছেন না? তিনিই সব ঘুরাইয়া দিবেন।
নবীনকুমারের বজরার হাল ভেঙে পড়ায় মেরামতির জন্য এক স্থানে থামতে হলো। টানা প্রায় পাঁচ দিন বজরায় বসে থেকে হাত পায়েরও খিল ধরে গেছে। নবীনকুমার নেমে একটু ঘোরাঘুরি করতে চায়। স্থানটি ইব্রাহিমপুর সদর থেকে অনেক দূরে, সম্ভবত নবীনকুমারের আগমনবাত এতদূর এসে পৌঁছোয় নি।
ভিনকুড়ি আর ধানকুড়ি নামে পাশাপাশি দুটি গ্রাম। গত কাল এক পশিলা বৃষ্টি হয়ে গেছে বলে গাছপালা আরও বেশী সবুজ। বাতাস খুব সুখপ্রদ। দুলাল ও ভুজঙ্গধর সমভিব্যাহারে নবীনকুমার হাঁটতে হাঁটতে চলে এলো অনেকখানি। তাদের পশ্চাতে ছোট একটি কৌতূহলী দলের ভিড় জমেছে। সেদিকে মন না দিয়ে নবীনকুমার সঙ্গীদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে চলেছে।
একটি তাল গাছের নিচে বহূকাল আগে অগ্নিদগ্ধ এক কুটিরকে ঘিরে আগাছার এক জঙ্গল জন্মে গেছে। সেখান দিয়ে যেতে যেতে অকস্মাৎ মনুষ্যকণ্ঠের ঘাড় ঘড় শব্দ শুনে নবীনকুমার থমকে দাঁডালো।
সেই জঙ্গল ভেদ করে বেরিয়ে এলো একজন। অনেকটা মনুষ্যকৃতি হলেও সে মানুষ না বন্যপ্ৰাণী তা সহজে ধরা যায় না। তার পরণে কোনো সুতির বস্ত্র নেই, কয়েকটি গাছের ডাল তার কোমরের ঘুনসীর সঙ্গে বাঁধা। বুকে মুখে মাটি মাখা। অন্তত পঁচিশ-তিরিশ বছর সে কোনো ক্ষৌরকারের সংস্পর্শে যায় নি। লোকটি এগিয়ে এসে সেই দলটির দিকে স্থির নেত্ৰে তাকিয়ে রইলো।
গ্রামবাসীদের কয়েকজন বলে উঠলো, সাবধান বাবুরা, ওর কাছে যাবেন না।
নবীনকুমার জিজ্ঞেস করলো, কে এই লোকটি?
গ্রামবাসীর জানালো যে, এই লোকটির নাম ত্ৰিলোচন দাস। এক সময় কয়েক বৎসরের খাজনা বাকি পড়ায় জমিদারের লোক-লস্কর এসে ওর বাড়ি পুড়িয়ে দেয়। সব কিছু এখনো সেই অবস্থাতেই আছে।
নবীনকুমার জিজ্ঞেস করলো, এখানে কাঁদের জমিদারি?
ভুজঙ্গধর তাড়াতাড়ি বলে উঠলো যে, এটাও ইব্রাহিমপুরের মধ্যেই বটে, কিন্তু এই ঘটনা তার আমলে নয়। এ ঘটনার কথা সে জানে। ভুজঙ্গধর নায়েবী করছে গত বিশ বৎসর। তার আগেকার নায়েব উদ্ধাবনারায়ণের নাম শুনলে এখনো অনেকে ভয়ে কাঁপে। প্ৰজাদের ঘর বাড়িতে অগ্নি সংযোগ করা ছিল তাঁর শখের ক্রীড়া।
নবীনকুমার বললো, এতকাল ধরে এই বাড়ি সেই অবস্থায় আছে! আপনার আমলেও আপনি কিছু সুবন্দোবস্ত করেন নি?
ভুজঙ্গধর জানালো যে, চেষ্টা করলেও করবার উপায় নেই। ও কারুকে কাছে ঘেঁষতে দেয় না।
গ্রামবাসীরা আরও তথ্য জানালো যে, নায়েবের অত্যাচারে লোকটি স্ত্রী-পুত্র-কন্যাকে নিয়ে দেশ ছেড়ে চলে যায়। অনেক দিন ওর কোনো সংবাদ ছিল না, ওর ভিটে এই পোড়ো অবস্থাতেই ছিল। তারপর বেশ কিছু বছর পর ও এক ফিরে আসে ঘোর উন্মাদ হয়ে। নিজের ভিটেটুকু শুধু চেনে। আর কোনো মানুষ চেনে না।
সবচেয়ে আশ্চর্যের কথা, ও এই ভিটের মাটি কামড়ে কামড়ে খায়। আর কোনো খাদ্য ওকে কেউ গ্ৰহণ করতে দেখেনি কখনো। এমন কি অন্য কেউ কিছু খাদ্য ছুঁড়ে দিলেও ও তা স্পর্শ করে না। শুধু মাটি খেয়েই ও বেঁচে আছে।
এই সময় ত্ৰিলোচন দাস ধীর স্বরে বললো, বাবু, একটু জল দেবেন, চিঁড়ে ভিজায়ে খাবো!
নবীনকুমার বললো, ঐ তো লোকটি জল চাইছে, চিঁড়ে চাইছে!
গ্রামবাসীরা চেঁচিয়ে বলে উঠলো, না, না, শুনবেন না, ওটা ওর কথার কথা। ও খুব সাঙ্ঘাতিক। কাছে যাবেন না। কিন্তু নবীনকুমার সে সব অগ্রাহ্য করে দু এক পা এগিয়ে গিয়ে বললো, হাঁ, তোমাকে চিঁড়ে দোবো, অন্য খাদ্য দেবো, তোমার চিকিৎসা করারো, তুমি যাবে আমাদের সঙ্গে?
ত্ৰিলোচন দাস সঙ্গে সঙ্গে প্রায় ব্যাঘের মতন এক লাফ দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো নবীনকুমারের ওপরে। কেউ কিছু বোঝবার আগেই দেখা গেল, নবীনকুমার ভূতলশায়ী, আর ত্ৰিলোচন তার বক্ষস্থল কামড়ে ধরেছে।
সকলে মিলে হুড়োহুড়ি করে যখন ত্ৰিলোচন দাসকে টেনে তোলা হলো, তখন দেখা গেল তার মুখে নবীনকুমারের পোশাকের একটি টুকরো সমেত এক খাবলা মাংস।
তার প্রভুর এই দশা করেছে দেখে দুলাল ক্ৰোধে অধীর হয়ে তৎক্ষণাৎ লোকটির চুলের মুঠি ধরে ফেলে দিল মাটিতে এবং তারপর তার হাত ও পা সমানে চালাতে লাগলো। অন্যরাও যোগ দিল তার সঙ্গে। অল্পক্ষণের মধ্যেই উন্মাদ ত্ৰিলোচন দাস দুলালের প্রহারে খুন হয়ে গেল।
ভুজঙ্গধরের ক্ৰোড়ে শায়িত নবীনকুমার তখন সংজ্ঞাশূন্য। তার ক্ষতস্থান দিয়ে ভলকে ভলকে রক্ত বেরিয়ে আসছে।