2 of 2

৭০. নবীনকুমারের নিদ্ৰা ভঙ্গ

পরদিন সকালে নবীনকুমারের নিদ্ৰা ভঙ্গ হলো অনেক দেরিতে।

সরোজিনী ইচ্ছে করেই তাকে জাগায় নি। বারবার এসে স্বামীকে দেখে গেছে। দু একবার শিয়রের কাছে বসে সন্তপণে হাত রেখেছে স্বামীর মাথায়। দেখে দেখে আর আশ মেটে না। নবীনকুমারের শয়ন ভঙ্গিটি কেমন যেন করুণ ধরনের। তেজী, অহংকারী মানুষটি ঘুমের মধ্যে একেবারে অন্যরকম। হাত দুটি বুকের কাছে গুটোনো, হাঁটুর কাছে পা ভাঁজ করা, তার এক কাত হওয়া দীর্ঘ শরীরটি এই সময় ক্ষুদ্র দেখায়। যেন জননীর ক্ৰোড়ের কাছে শুয়ে আছে শিশু।

ঠিক আটটার তোপ পড়ার মধ্যেই সরোজিনী প্রতিদিন স্নান সেরে নিয়ে পুজায় বসে যায়। এমনই অভ্যেস হয়ে গেছে যে পরিপূর্ণ দিন শুরু হবার আগেই স্নান না করলে তার গা কিট কিট করে। আজ সেই নিয়মের ব্যত্যয় হলো। অনেক দিন পর তার শয্যায় তার স্বামী নিজে থেকে এসে শয়ন করেছেন, সারা রাত সরোজিনী ঘুমোতেই পারে নি। এর পর জেগে উঠে নবীনকুমারের কী মর্জি হবে, হঠাৎ কী চেয়ে বসবে, তার জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া গত্যন্তর নেই।

পালঙ্কের পাশে একটি ছোট মোড়া টেনে নিয়ে বসে রইলো সরোজিনী। ঘুমন্ত মৃদু নিঃশ্বাসের সঙ্গে সঙ্গে নবীনকুমারের বক্ষস্পন্দন দেখছে সে। কাল রাতে নবীনকুমারের অস্বাভাবিক ব্যাকুলতা দেখে সরোজিনী ভয় পেয়েছিল, বুঝি আবার কোনো নতুন ব্যাধিতে আক্রান্ত হলো তার স্বামী। আজ সে ভয় ভেঙে গেছে। অনভিজ্ঞ চক্ষেও নবীনকুমারের নিদ্রামাখা মুখখানি দেখলে কোনো রোগব্যাধির আশঙ্কা জাগে না। নবীনকুমারের চক্ষের পাতা দুটি মাঝে মাঝে কম্পিত হচ্ছে, অর্থাৎ সে স্বপ্ন দেখছে। তার ললাট ঈষৎ কুঞ্চিত।

এক একবার নবীনকুমার পাশ ফিরতেই সরোজিনী চমকিত হয়ে উঠে দাঁড়াচ্ছে। পালঙ্কের একেবারে কিনারায় এসে পড়লেও সে স্বামীকে সরিয়ে দিতে সাহস পায় না। স্বামীর মেজাজকে সে ভয় পায়। হঠাৎ জাগিয়ে দেওয়া যদি তিনি পছন্দ না করেন।

সরোজিনীর অঙ্গে যৌবন একটু তাড়াতাড়ি এসেছে এবং যেন বেশী করেই এসেছে। সবে বিংশতি বর্ষে পা দিয়েছে সে, এর মধ্যেই বেশ ভারভাত্তিক চেহারা, মুখখানি প্রায় গোলাকার হয়ে এসেছে। সে খেতে খুব ভালোবাসে, আর ভালোবাসে ঘুম। পছন্দমত আহার, বিশেষত নানারকম ঝাল, ব্যঞ্জন আর আচার তার খুবই প্রিয়, তারপর নিশ্চিন্তে ঘুম, জীবনে এর চেয়ে শান্তির আর কী আছে! স্বামীসঙ্গ বিশেষ পায় না বলে সরোজিনী সম্প্রীতি করে নিয়েছে আলস্যের সঙ্গে, আলস্য তার অতি বিশ্বাসযোগ্য সঙ্গিনী, সে মনের দ্বার বন্ধ করে রাখে, কোনো ক্ষোভ জমতে দেয় না। সকালবেলা ঘণ্টাখানেক পুজোআচ্চা করা ছাড়া সারাদিন তার আর কোনো কাজ নেই।

নবীনকুমার ঘুমের মধ্যে বলে উঠলো, অকৈতব…

সরোজিনী ব্যগ্র হয়ে উঠে এসে শোনবার চেষ্টা করলো। ঘুমেলা জড়ানো কণ্ঠস্বর এমনিতেই দুর্বোধ্য হয়, তার ওপরে ঐ শব্দটি সরোজিনীর একেবারেই অপরিচিত। সে বিস্মিত মুখখানি ঝুঁকিয়ে রইলো স্বামীর বুকের কাছে!

তারপর পাশ ফেরা থেকে চিৎ হয়ে চোখ মেললো। সরোজিনীর মুখখানা অত কাছে দেখে সে জিজ্ঞেস করলো, কে?

—আমি! আমি সরোজ।

নবীনকুমার আবার চক্ষু মুদে বললো, অত সহজ নয়…যে কোনো একটা পথ…।

নিদ্রা আর জাগরণের মধ্যকার সীমারেখাঁটি নবীনকুমার এখনো পুরোপুরি অতিক্রম করেনি, দু একবার চোখ মেলেছে, আবার চোখ বন্ধ করে বিড়বিড় করছে। আপন মনে।

একটু পরেই সে আবার চোখ চেয়ে বললো, সরোজ, এক গেলাস জল দেবে? বড্ড তেষ্টা পেয়েছে।

উঠে বসে, বড় রূপোর গেলাসের ভর্তি জল প্ৰায় এক নিঃশ্বাসে নিঃশেষ করে সে বললো, আমি বুঝি তোমার খাটে এসে শুয়েচিলুম কাল? তুমি কখন উটোচো?

সরোজিনী যে ঐ শয্যায় আর স্থান নেয়নি, সারারাত ভূঁয়ে বসে কাটিয়েছে, সে কথা আর জানালো না।

সামান্য হেসে নবীনকুমার বললো, আজ তোমায় বেশ খাসা দেকাচ্ছে, সরোজ। কালীঘাটের পটের বউয়ের মতন গাবিলা-গোবলা…।

সরোজিনী লজ্জা পেয়ে হাসলো। তার স্বামীর মুখে তার রূপের প্রশংসা। এ কথার কী উত্তর দিতে হয়, তা অবশ্য সরোজিনী জানে না।

—আচ্ছা সরোজ, আমি যদি বিলেতে গিয়ে রামমোহন কিংবা দ্বারকানাথ ঠাকুরের মতন মরে যাই, তা হলে কেমন হয় বলো তো? সাহেবরা আমার কবরের ওপর দিয়ে হেঁটে চলে বেড়াবে আর তার দরুণ এ দেশে আমার অনেক সুনাম হবে।

সরোজিনীর চক্ষু দুটি বিস্ফারিত হলো।

–হ্যাঁ, তুমি বিশ্বাস পাচ্ছো না? ওদেশে মড়া পোড়াবার নিয়ম নেই, মুসলমান আর খ্রীস্টানদের মতন হিন্দু মল্লেও মাটি চাপা দেয়। আমি স্বপন দেকলুম, রামমোহনের কবরের ওপর কতকগুলোন চ্যাঙ্গড়া-চেঙ্গড়ি সাহেব মেম ধেই ধেই করে নাচচে। তারপরই দেকি যে, রামমোহনেরই কবর বটে, কিন্তু চ্যাঙ্গড়া-চেঙ্গড়িরা সাহেব মেম নয়। আমাদেরই এখেনকার হিন্দু কলেজে পড়া ছেলে আর তাদের বেটার হাফ। তারা গান গাইচে, গান্ড সেইভ দি কুইন

অকস্মাৎ কথা থামিয়ে পালঙ্ক থেকে নামবার জন্য পা বাড়ালো নবীনকুমার। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আড়মোড়া ভাঙলো, তারপর সরোজিনীর গাল টিপে দিয়ে বললো, তুমি বড় ভালো, সরোজ। ঐ যে কতায় বলে না, বোবার শত্ৰু নেই।

–আপনার স্নানের জল গরম কত্তে বলবো?

—বাঃ, এই তো কতা ফুটেচে। এবার বলে, আপনার জন্য ভিজে ছোলা আর গুড় এনে দেবো? তার চেয়ে আজ অন্য কিচু করা যাক বরং। ধরো, আজ আমি দাঁতন কলুম না, মুখ ধুলুম না, তুমি আমার হয়ে মুখ ধুয়ে নিলে। কিংবা ধরো, আজ আমি খেলুম না, তুমি আমার হয়ে খেয়ে নিলে। আমি আজ আর ঘুমোলুম না, তুমি আমার হয়ে ডবল ঘুমিয়ে নিলে…কী, পারবে না?

—আমি মুখ্যু বলে আপনি আমায় এইসব কতা বলচেন?

—না, না, না, কে বলেচে তুমি মুখুঢ়। ইগনোরেন্স ইজ রিস। তুমি তো সুখী। লেকা পড়া করে যে, অতি অসুখী হয় সে। আহা, তোমার কোলে আজও একটা ছেলে দিতে পালুম না।

–ও কতা বলবেন না। আমাদের এখুনো ঢের সময় রয়েছে…আমার ন মাসীমা…

—তোমার ঢের সময় আচে বটে, কিন্তু আমার কি আচে? আমি যে কাজের মানুষ, ব্যস্ত মানুষ, টুক করে কোন সময় সব কাজ ফুরিয়ে যাবে। একটা গান আচে জানো? অকাজের কাজী অকুলে ড়ুবালে তরী, দিন না ফুরালো, না ফুরালো বিভোবরী। হাঃ হাঃ হাঃ…আজ সকালবেলা আমার মনটা বড় হাল্কা লাগচে, অথচ রাত ভোর কত বিদঘুটে স্বপন দেকলুম। আমার আর একটা স্বপ্ন শুনবে? গাদাগুচ্চের লোক আমায় মিথ্যেবাদী বলে গঞ্জনা দিচ্চে, আঙুল দেকিয়ে দুয়ো দিচ্চে আমাকে…কিন্তু কোন মিথ্যের কাজ করিচি, বলে তো? লোকগুলোনই বা কে, জায়গাটাই বা কোতায়…তাই কিচুই চিনলুম নাকে। ও হ্যাঁ, আর একটা জিনিস মনে পড়েচে, কাল রাতে ঠিক আমার মায়ের মতন…

 

এই সময় সরো, ও সরো বলে ডাকতে ডাকতে কুসুমকুমারী এসে দাঁড়ালো সেই কক্ষের দ্বারের সামনে। নবীনকুমারকে দেখে সে হঠাৎ থমকে গেল। কুসুমকুমারী অতি প্ৰাতে জেগে উঠে রোজ সারা বাড়ির তদারকি করে। নবীনকুমার ও সরোজিনীর শয়নকক্ষ পৃথক হয়ে যাওয়ার পর সে যখন তখন সরোজিনীর ঘরে আসতে দ্বিধা বোধ করে না।

স্নান সারা হয়ে গেছে কুসুমকুমারীর, চুল পিঠের ওপর খোলা। পরনে একটি হলুদ বর্ণ শাড়ী। সরোজিনীর চেয়ে সে বয়সে কিছু বড় এবং নানারকম অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে এলেও তার মুখমণ্ডলে এখনো বালিকা-ভাবটি লেগে আছে। তার চোখের নীলবৰ্ণ মণি দুটি থেকে যেন আলো ঠিকরে পড়ে।

অপ্ৰস্তুত ভাবটি কাটিয়ে উঠে কুসুমকুমারী বললো, আজ সকালে আমাদের কী সৌভাগ্য! লক্ষ্মী-জনাৰ্দনকে অনেকদিন পর একসঙ্গে দেকলুম। তাই ভোরবেলা উঠেই বাতাসে বসন্তকালের গন্ধ পাচ্চিলুম যেন!

নবীনকুমার চুপ করে রইলো।

কুসুমকুমারী এবার সরাসরি নবীনকুমারের দিকে চেয়ে বললো, আমাদের সরো কোনোদিন যা ভোলে না, আজ আপনি ওকে সেই ঠাকুরের পুজো পর্যন্ত ভুলিয়ে দিয়েচেন। আপনার জন্য। ওর ঠাকুর-দেবতা সব তুচ্ছ হয়ে গেল।

কুসুমকুমারীর এই রঙ্গ-সুরের কথার উপযুক্ত কোনো উত্তরই দিল না নবীনকুমার। সে শুষ্কভাবে বললো, ভালো আচেন, বৌঠান?

তারপর তার পাশ কাটিয়ে নবীনকুমার বেরিয়ে গেল সেই ঘর থেকে।

উপযাচিকর মতন নবীনকুমারের সঙ্গে ভাব করতে চেয়েও প্রত্যাখ্যাত হয়ে কুসুমকুমারীর মুখে একটা ম্লান ছায়া পড়ল। তখনই তাঁর মনে হল, তার স্বামীকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে এ বাড়ি ছেড়ে চলে গেলে কেমন হয়? নবীনকুমার যদি তাকে এতই অপছন্দ করে, তবে আর এর ছত্রছায়ায় থাকার প্রয়োজন কোথায়?

কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই নিজেকে সে সামলে নিল। সরোজিনীকে সে কিছু বুঝতে দিতে চায় না। এখনই, ও বেচারির তো কোনো দোষ নেই। আবার মুখখানি সহাস্য করে সে সরোজিনীর বাহু ছুঁয়ে বললো, কী হয়েচে রে, সরোজ? মুখখানা বেজার কেন?

সরোজিনী কুসুমকুমারীকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো। সে কিছুই বুঝতে পারে না বলে মাঝে মাঝে তার মধ্যে এক ধরনের তীব্ৰ, বন্য দুঃখ জেগে ওঠে।

 

প্রতি সকালেই নানা ধরনের মানুষ জন অপেক্ষা করে থাকে নবীনকুমারের জন্য। সে কারুর সঙ্গেই দেখা করলো না। গতকাল রাত্রির সম্পূর্ণ দৃশ্যটি তার মাথায় বারংবার ফিরে ফিরে আসচে। চন্দ্রনাথের গৃহের সেই অজ্ঞাতনামা যুবতীটি। অবিকল তার জননীর মতন। অথচ দুলাল কোনো সাদৃশ্য পর্যন্ত লক্ষ্য করলো না। নবীনকুমারের তো চোখের ভুল নয়। তার শৈশবে সে বিম্ববতীকে ঐ রকম রূপেই দেখেছে। বিম্ববতীর একখানি অয়েল পেইণ্টিংও নেই এ গৃহে। বিদ্যাসাগর মশাই তাঁর জননীর অয়েল পেইণ্টিং করবার পর নবীনকুমারও জিদ ধরেছিল সেই সাহেব শিল্পীকে দিয়ে তার মায়ের একখানি ছবি গড়াবে। বিম্ববতী কিছুতেই রাজি হলেন না। কোনো পরপুরুষের সামনেই তিনি তাঁর অবগুণ্ঠন খুলবেন না, কোনো সাহেব তো দূরস্থান!

চন্দ্রনাথ তাকে অপমান করে দিল, তবু চন্দ্রনাথের বাড়িই তার মন টানছে। নবীনকুমার হরিদ্বার যাবার চিন্তা বিসর্জন দিয়ে আবার সে ফৌজদারি বালাখানার দিকেই যাবে বলে মনস্থ করলো। তার আগে সে ভাবতে চেষ্টা করলো যে, তার মাতৃকুলে কেউ কোথাও আছে কিনা। সে তার মায়ের মুখে অনেকবার শুনেছে যে বিম্ববতী বিবাহের পর একবারও পিত্ৰালয়ে যান নি। এখন কি না। রাণী ভিকটোরিয়ার আমল, তাই একালের মেয়েরা অনেক সুবিধে পেয়েছে, ইচ্ছে হলে বাপের বাড়ি যেতে পারে। কিন্তু কোম্পানির আমলের শেষাশেষি অবধিও নারীদের এত সুযোগ ছিল না।

নবীনকুমার জ্ঞান হবার পর থেকেই জানে, তার মামাবাড়ি বলে কিছু নেই। তার মাতামহ ও মাতামহীর ততদিনে দেহান্ত ঘটেছে, আর কোনো পুত্র-কন্যা নেই তাদের। এতদিন পর অবিকল বিম্ববতীর মত চেহারার এক যুবতী কোথা থেকে এসে উদয় হলো তবে?

আহারাদি না করেই দুলালকে সঙ্গে নিয়ে গৃহ থেকে নিৰ্গত হলো নবীনকুমার। সহিসকে সে ফৌজদারি বালাখানার দিকে যাওয়ার হুকুম করায় দুলাল রীতিমতন অবাক।। ও রকম একটা বাড়িতে বার বার কেন সেধে সেধে যেতে চান ছোটবাবু? আবার কিসের মধ্যে তিনি জড়িয়ে পড়তে চলেছেন?

কিন্তু চন্দ্রনাথের বাসাবাড়ির কাছে এসে ওরা সম্পূর্ণ অন্য রকম দৃশ্য দেখলো।

সে স্থান একেবারে ভিড়ে ভিড়াক্কার। তার মধ্য থেকে দেখা যাচ্ছে ধোঁয়ার কুণ্ডলী। কাছাকাছি কোম্পানির বাগানের পুকুর থেকে বড় বড় মাটির জালায় করে জল বয়ে আনছে অনেক লোক। কিছু লোক অনর্থক চিৎকার চাঁচামেচি করছে।

গাড়ি থেকে তড়াক করে নেমে নবীনকুমার জিজ্ঞেস করলো, কোন বাড়িটা রে, দুলাল?

—মনে তো হচ্ছে সেই বাড়িই, ছোটবাবু?

—যে করে হোক আমাদের ভেতরে যেতে হবে। তুই ব্যবস্থা কর!

কিন্তু অত মানুষের ভিড় ঠেলে এগোয় কার সাধ্য। সঠিক কী যে হয়েছে, তাও জানার উপায় নেই, গুজবে কান পাতা দায়। কেউ বলছে, শেষ রাতে এক দল দুৰ্বত্ত এসে পুরো মহল্লাটা জ্বালিয়ে দিতে গিয়েছিল। কেউ বললো, ভূত ধরার ওঝাকে ভূতে এসে শাস্তি দিয়ে গেছে। কেউ বললো, পাঁচজন লোক জীবন্ত দগ্ধ হয়েছে, কেউ বললো, পনেরো জন। কেউ বললো সর্বাঙ্গ জ্বলন্ত অবস্থায় একজন রমণীকে ছাদ থেকে ঝাঁপাতে দেখা গেছে, কেউ বললো, তিনটি আধ-ঝলসানো স্ত্রীলোককে চিকিৎসালয়ে পাঠানো হলো এইমাত্র।

একটি কথা শুধু পরিষ্কার জানা গেল, এই অগ্নিকাণ্ড কোনো আকস্মিক দুর্ঘটনা-প্রসূত নয়, একদল হামলাকারী এসে চন্দ্রনাথের বাড়িটিতে চড়াও হয়ে তারপর অগ্নিসংযোগ করে দিয়েছে।

কারণটি অনুমান করতেও নবীনকুমারের অসুবিধে হয় না। গত রাত্রে কোন অভিযান থেকে চন্দ্রনাথ রক্তাক্ত—আহত হয়ে ফিরেছিল, তা সে কিছুতেই জানাতে চায়নি। কিন্তু বোঝাই যায় সে ঐ রমণীটিকে কেন্দ্র করেই সে কোনো সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েছিল। সে সবলে ওকে কেড়ে এনেছে। সেই প্রতিপক্ষই পরে কোনোক্রমে চন্দ্রনাথের গৃহের সন্ধান পেয়ে প্রতিশোধ নিতে এসেছিল।

 

চন্দ্রনাথদের পরিণামের কথা চিন্তা করতেই নবীনকুমারের বক্ষঃস্পন্দন যেন থেমে যেতে চাইলো। দুৰ্বত্তরা কতজন এসেছিল, তা জানিবার উপায় নেই, তবে যে-কজনই আসুক, তাদের প্রতিরোধ করবে: কে? চন্দ্রনাথ গুরুতর রকমের অসুস্থ, তার আর অঙ্গুলি উত্তোলনেরও ক্ষমতা নেই, সঙ্গে এক অবলা নারী এবং সুলতান নামের ঐ ছোঁকরাটি। অস্ত্ৰধারী একটি মাত্র ব্যক্তিই ওদের পর্যুদস্ত করতে পারে।

বাড়িতে ওরা অগ্নিসংযোগ করলো কেন? নিশ্চয়ই রমণীটিকে ওরা পুনরায় হরণ করে তারপর চন্দ্রনাথ ও সুলতানকে জীবন্ত দগ্ধ করতে চেয়েছে। চন্দ্রনাথ ভালো করে না জেনেশুনে কোনো দারুণ হিংস্র পশুর গুহায় পা দিয়েছিল। এরকম কিছুর আশঙ্কা করেই সে কাল নবীনকুমারকে অনুরোধ করেছিল রমণীটিকে অন্যত্র আশ্রয় দেবার জন্য।

দুলাল অনেক চেষ্টা করেও জনতা ভেদ করে পারলো না পথ করতে। এখানকার পাঁচ মিশেলি। মানুষজন কেউ নবীনকুমারকে দেখে চেনেনি। কিন্তু নবীনকুমার একেবারে অস্থির হয়ে উঠেছে।

ঘটনার গুরুত্ব অনুযায়ী কয়েকজন সেপাই-হাবিলদার ছাড়াও দুজন ইংরেজ অফিসারও এসেছে। নবীনকুমার সেই অফিসারদ্বয়ের সামনে এসে ইংরেজিতে আত্মপরিচয় দিয়ে বললো, মহাশয়, ঐ গৃহের বাসিন্দারা আমার পূর্ব পরিচিত। উহাদের ভাগ্যে কী-ঘটিয়াছে তাহা আমি অবিলম্বে জানিতে চাই।

অপেক্ষাকৃত বর্ষীয়ান ইংরেজটি বললো, ওয়েল, বাবু, তোমাকে আর কী বলিব! এই সমস্ত হুজুগ পরায়ণ নেটিভরা আকরণে ভিড় জমাইয়া আমাদের উদ্ধারকার্যে বিঘ্ন ঘটাইতেছে। উহারা সুশৃঙ্খল রূপে দূরে দাঁড়াইলে আমাদের কার্যে অনেক সুবিধা হইত। এইসব নেটিভরা কোনো সাহায্যে লাগিবার বদলে শুধু বাধারই সৃষ্টি করে। ইহাদের দূরে সরাইবার কোনো উপায় বাৎলাইত পারো?

নবীনকুমার বললো, আপনারা হুংকার দিউন। তাহা হইলেই ব্যাঘ্রের হুংকারে মেষপালের মতন সকলে দূরে পলাইবে।

সাহেব বললো, আমরা অকারণে হুংকার খরচ করি না। তাহার বদলে নেটিভ পুলিসদের লেলাইয়া দিয়া গুটি কতক লোককে লাঠির বাড়ি খাওয়াইলে কাজ হইতে পারে মনে হয়।

ততদূরও যেতে হলো না, সাহেব দুজন খোলা পিস্তল হাতে নিয়ে এগিয়ে যেতেই লোকদের মধ্যে একটা হুড়োহুড়ি পড়ে গেল, কয়েকজন ছিটুকে পড়লো মাটিতে, কয়েকজন ছুটে গেল তাদেরও ওপর দিয়ে, বিকট স্বরে চিৎকার শুরু করলো অনেকে।

নবীনকুমার সাহেব দুজনের পিছু পিছু চলে এলো অনেকখানি। অগ্নিকাণ্ড এমনই ভয়াবহ হয়েছিল যে চন্দ্রনাথের ভূতপূর্ব দ্বিতল বাসা বাড়িটি এখন একটি কঙ্কাল মাত্র। চটের বস্তা মাথায় দিয়ে কয়েকজন উদ্ধারকমী ধ্বংসস্তুপের মধ্যে সন্ধান করে এলো করুকে পাওয়া যায় কিনা। একটি মাত্র মৃতদেহই তারা দেখতে পেয়েছে। ইট-কাঠের জঞ্জাল যতদূর সম্ভব সরিয়ে তন্নতন্ন করে খুঁজেও আর কারুকে পাওয়া গেল না।

সাহেব দুজন নবীনকুমারকে ডেকে নিয়ে গেল মৃতদেহটি সনাক্ত করবার জন্য। এসব দৃশ্য সে একেবারেই সহ্য করতে পারে না। কিন্তু এখন উপায় নেই, সে নিজেই সাহেবদের কাছে ধরা দিয়েছে।

মৃতদেহটির দিকে এক লহমার জন্য তাকিয়েই নবীনকুমার করুণ বিস্ময়ের সঙ্গে বললো, এ কে? একে তো আমি চিনি না!

লোকটি মধ্যবয়েসী, বলবান, ওপরের ঠোঁটের খানিক অংশ কাটা, মাথার চুল পুড়ে গেছে, শরীরটাও কাঠ কয়লার মতন, এমন কোনো লোককে আগে এ বাড়িতে দেখে নি নবীনকুমার। গত রাত্রে সে চলে যাবার আগে পর্যন্ত এই ব্যক্তি এখানে ছিল না।

ব্যাপারটা যেন জতুগৃহদাহের একটি ক্ষুদ্র সংস্করণের মতন। চন্দ্রনাথ তার সঙ্গের রমণীটি কিংবা সুলতানের চিহ্নমাত্র নেই কোথাও, যে-ভাবেই হোক তারা পলায়ন করতে সক্ষম হয়েছে। আর তাদের পরিবর্তে পুড়ে মরেছে। একজন অজ্ঞাত-পরিচয় মানুষ।

খানিক বাদে অকুস্থল থেকে দূরে চলে আসার পর গাড়িতে উঠে গিয়ে নবীনকুমার চিন্তিতভাবে জিজ্ঞেস করলো, ওরা কোতায় গেল বল তো, দুলাল।

দুলাল কোনো উত্তর দিতে পারলো না।

নবীনকুমার একটুক্ষণ চুপ করে রইলো। তার চোয়াল কঠিন হয়ে এলো। সে আবার বললো, তুই লোক জোগাড় কর। যত টাকা লাগে লাগুক, ওদের খুঁজে বার করতেই হবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *