অতিশয় উৎফুল্ল চিত্ত নিয়ে নবীনকুমার প্রতিদিন ভোরে জেগে ওঠে। বস্তুত সন্ধ্যার একটু পরেই তার মনে হয়, কখন আবার প্রত্যুষ আসবে। রাত্রি তার পছন্দ হয় না, বিশেষত এখন অমাবস্যা, চতুর্দিকে দেখা যায় না কিছুই। শীতের ধারালো বাতাসের মধ্যে অন্ধকারে অন্ধের মতন বসে থাকতে কেনই বা তার ভালো লাগবে। সায়াহ্নের পর কিছুক্ষণ সে নিজের কামরায় বসে গ্রন্থপাঠে নিমগ্ন থাকে। তারপর আহার সেরে নিয়ে সে শয্যাগ্ৰহণ করে।
ভোরগুলি সত্যিই বড় মনোরম।
ঘুম ভাঙা মাত্র নবীনকুমার উঠে চলে আসে গবাক্ষের কাছে। বাইরের দিকে তাকালে চক্ষু যেন জুড়িয়ে যায়। মদ্যপান সম্পূর্ণ পরিত্যাগ করার ফলে তার শরীরে কোনো অবসাদ নেই, প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সক্রিয়, মস্তিষ্ক যেন এই ধরণীর রূপ রস গন্ধ শুষে নেবার জন্য উন্মুখ। সব মানুষেরই শরীর এরূপ থাকে, নাকি যারা এক সময় নেশায় অসাড় হয়ে যেত, তারাই শুধু শরীরের এই অসাধারণ ধারণক্ষমতা টের পায়? নবীনকুমারের মনে হয়, সে যেন পুনজীবন পেয়েছে।
আগে মাত্র একবার নবীনকুমার নদীপথে পরিভ্রমণে এসেছে। সেবারে সে এসেছিল গুরুতর অসুস্থতার পর ভগ্ন শরীর নিয়ে, শ্রবণক্ষমতা প্রায় লুপ্ত ছিল। এবার, নবীনকুমার ভাবে, সে এসেছে তার অন্ধত্ব সারাতে। সত্যিই যেন সে নতুন করে দৃষ্টিশক্তি ফিরে পাচ্ছে। এই জগৎ তার কাছে উদ্ভাসিত হচ্ছে নতুন রূপে।
ব্যস্ততা কিছু নেই। নবীনকুমার মাতৃসন্দর্শনে চলেছে বটে, কিন্তু এই নদীমেখলা সবুজ-শ্যামল ভূমিও যে তার মায়ের মতন, নবীনকুমার তা এই প্রথম অনুভব করছে। দেশ নামক আদর্শটির কথা লেখা থাকে ইংরেজী বইতে। ভারতবর্ষে দেশ শব্দটির ব্যবহার আছে বটে, কিন্তু ঐ আদশটি নেই। এখানে শুধু বিভিন্ন রাজা ও রাজত্ব। হিন্দু রাজত্ব, পাঠান রাজত্ব, মুঘল রাজত্ব, এখন যেমন ব্রিটিশ রাজত্ব। শতাব্দীর পর শতাব্দী আসে, রাজত্ব বদলায়, দেশ আপন মনে শুয়ে থাকে, মাঝে মাঝে শুধু পাশ ফেরে। দিগন্তবিস্তৃত শিয়ান সেই দেশ নবীনকুমারের চক্ষে জীবন্ত হয়ে উঠেছে।
ভোর হতেই গায়ে একটি শাল জড়িয়ে নবীনকুমার বজরার ছাদে উঠে এসে একটি কেদারায় পা ছড়িয়ে বসে। তখনও দাঁড়ী-মাঝিরা সকলে প্ৰস্তুত হয়নি। রাত্রে বজরার বহর বাঁধা থাকে কোনো ঘাটের কিনারে, সন্ধ্যায়-সকালে কাছাকাছি কোনো লোকালয় থেকে আনাজ-তৈজসপত্র সংগ্ৰহ করা হয়, তারপর রোদ চড়বার আগেই যাত্রা শুরু।
দুলাল এক ঘটি খেজুররস নিয়ে আসে। কদিন ধরে নবীনকুমার এই খেজুররসের জন্য লোভীর মতন অপেক্ষা করে থাকে। শ্বেতপাথরের গেলাসে ভরতি করে রস ঢেলে দেয় দুলাল, নবীনকুমার হাত বাড়িয়ে সেটা নিয়ে প্রায় এক নিঃশ্বাসে সবটুকু শেষ করে দেয়। দুলাল জিজ্ঞেস করে, ছোটবাবু, আর একটু দিই? নবীনকুমার সাগ্রহে ঘাড় নাড়ে। পর পর তিন গেলাস পান করার পর তার অন্তঃকরণ পর্যন্ত জুড়িয়ে যায়।
খানিক পরে, বেলা বাড়লে দুলাল নিয়ে আসে দু-তিনটি ডাব।
নবীনকুমার এই আর একটি নতুন ব্যাপার আবিষ্কার করেছে। সে যে আগে কখনো খেজুরের রস কিংবা ডাবের জল পান করেনি তা তো নয়। কিন্তু এই যাত্রায় এসে তার মনে হচ্ছে এমন সুন্দর পানীয় আর হয় না। কী আশ্চর্যের ব্যাপার। প্রকৃতি গাছের ডগায় মানুষের জন্য এমন সুস্বাদু পানীয় রেখে দিয়েছেন। ফরাসী দেশের শ্রেষ্ঠ মদ্য-ব্যবসায়ীও কি অবিকল এই পানীয় উৎপন্ন করতে পারবে?
একদিন দুলাল তীরবর্তী কোনো গ্রাম থেকে সদ্য গাছ থেকে কাটা এক ছড়া মৰ্তমান কলা এনেছিল। কলাগুলোর ওপরে তখনো মিহিন সাদা গুড়ো ছড়িয়ে আছে, সবগুলো পাকেনি, কয়েকটা ফেটে ফেটে গেছে। তার থেকে একটি কলা ছিঁড়ে নিয়ে খোসা ছাড়িয়ে এক কামড় দেওয়া মাত্র নবীনকুমার যেন দিব্য আনন্দ পেয়েছিল। তৎক্ষণাৎ তার মনে হয়েছিল, মানুষের কোনো রন্ধনপ্রণালীই তো এমন অপূর্ব খাদ্য প্রস্তুত করতে পারে না। একেবারে ঠিকঠাক মিষ্টি। একটু বেশীও নয়, কমও নয়, শক্তও নয়, নরমও নয়। মনে মনে নবীনকুমার ঘোষণা করেছিল, ঈশ্বর সর্বকালের শ্রেষ্ঠ রাঁধুনী। বিভিন্ন লঙ্কায় তিনি বিভিন্ন রকমের ঝাল দিয়ে রেখেছেন; নিম পাতা, পলতা পাতা, তুলসী পাতায় আবার বেল কিংবা কালো জাম কিংবা হরীতকীতে এমন রস, যার ঠিক বর্ণনা করা যায় না। এত বহু বিচিত্র রকমের রন্ধন আর কার পক্ষে সম্ভব?
তবে, এই বিরাট রন্ধনশালাটি কার, ঈশ্বরের না প্রকৃতির? এ নিয়ে মাঝে মাঝে নবীনকুমারের খটকা লাগে। তবে যাঁরই হোক, তাতে বিশেষ কিছু আসে যায় না। নবীনকুমারের মধ্যে আস্তিকতার গোঁড়ামি যেমন নেই, তেমন সে নাস্তিকতার বিদ্রোহী ধ্বজ তুলে ধরতে চায় না।
সবচেয়ে বড় কথা, ঈশ্বর বা প্রকৃতি যেই হোন, তাঁর সৃষ্টিশালায় রয়েছে কত রকম অপ্রয়োজনের সৌন্দর্য। যে সব ফুল থেকে কোনো দিন ফল হয় না, ফুটে আছে সেই রকম শত-সহস্র নয়ন-সুখ অপূর্ব সুশ্ৰী ফুল।
আগেরবার নবীনকুমার মানুষের কথার শব্দ শোনার জন্য ব্যগ্ৰ অধীর হয়ে থাকতো, এবার যেন সে করছে নীরবতার সাধনা। দুলালের সঙ্গেই শুধু দু-চারটি বাক্যবিনিময় হয়, এ ছাড়া সারা দিনে সে পারতপক্ষে অপর কারু সঙ্গে কথা বলে না। এর মধ্যে একবারও সে তীরের কোনো লোকালয়ে যায় নি। দু-এক জায়গায় তাদের জমিদারির পাশ দিয়ে যেতে হয়েছে, সংবাদ পেয়ে ছুটে এসেছে প্ৰজারা, কিন্তু নবীনকুমার বজরা থামাবার আদেশ দেয়নি। যদি ইচ্ছে হয়, তা হলে ফেরার পথে সে জমিদারি পরিদর্শন করবে।
বজরার বহরে লোকজন অনেক রয়েছে বটে, তবু এর মাঝে থেকেও যে একাকিত্ব, তাতে বোধশক্তি সূচ্যগ্র হয়ে ওঠে। কল্পনা ও স্মৃতি মিলে-মিশে চক্ষের সমুখে অজস্র স্থাণু মুহূর্তের সৃষ্টি করে। এ অনুভূতি সব সময় সুখকর নয়। নদীর দু-পাশের দৃশ্য দেখতে দেখতে তার মধ্যে স্থাপিত হয়ে যায় এক একটি অন্য ছবি। রৌদ্র-ঝলমল বর্তমানের মধ্যে বসে থেকে নবীনকুমার বার বার ফিরে যায় তার ছায়াচ্ছন্ন অতীতে। নিজের জীবনের প্রাক্তন ঘটনাগুলিকে সে যাচাই করে, তাতে কষ্ট বাড়ে বই কমে না। স্লেটের লেখার মতন অতীতটাকে ভিজে ন্যাত দিয়ে একেবারে মুছে ফেলা যায় না বলে সে মাঝে মাঝে নিজের ওপর ক্রুদ্ধ হয়েও ওঠে।
দুটি নারীর মুখ বারবার ফিরে আসে তার মানসপটে। একজন নারীকে সে দেখেছে মাত্র কিছুক্ষণের জন্য, চন্দ্ৰনাথের বাড়িতে, তাও সে বেশির ভাগ সময় অবগুষ্ঠিতাই ছিল। কেন সেই পথ থেকে কুড়িয়ে আনা রমণীকে মনে হলো অবিকল তার মায়ের মতন? নবীনকুমারের সর্বাঙ্গে ঝাঁকুনি লেগেছিল। এমন অভিজ্ঞতা। যার হয় নি। সে এর মর্ম বুঝবে না। পরদিন সকালেই রমণীটি একেবারে অদৃশ্য হয়ে গেল বলেই তো নবীনকুমারের এতখানি যাতনা। যদি তার সঙ্গে আবার দেখা হতো, তার সঠিক পরিচয় জানতো, তা হলে এতদিনে চক্ষু-কর্ণের বিবাদ ভঞ্জন হয়ে যেত।
আর একটি মুখ, সে বড় গোপন, বিষম গোপন। সে মুখ নবীনকুমার কিছুতেই মনে আনতে চায় না। কিছুতেই না। যাতে মন থেকে একেবারে মুছে যায়, সেই জন্য নবীনকুমার তার সংস্রব এড়িয়ে চলে, দেখা হলে বাক্যবিনিময় পর্যন্ত করে না। তবু কেন কল্পনায় ফিরে আসে সেই মুখ!
মানুষের কি দুরকম চিন্তাশক্তি থাকে? নবীনকুমার প্রবল চিন্তাশক্তি দিয়ে যে মুখখানি ভুলে যেতে চায়। তবু সেই মুখ কেন ফিরে আসে? এ তবে কার ইচ্ছাশক্তি? তখন কোনো গ্ৰন্থপাঠেও নবীনকুমার মনোনিবেশ করতে পারে না, প্রকৃতির দিকে চোখ মেললেও কিছু দেখতে পায় না। প্ৰাণপণে কোনো কিছু জোর করে ভুলে যাবার চেষ্টা যে এমন অসাধ্য, এমন যন্ত্রণাদায়ক তা সে আগে জানতো না। মানুষ কোনো কিছু পাবার জন্য সর্ব শক্তি প্রয়োগ করতে পারে। কিন্তু কোনো কিছু থেকে নিজেকে বঞ্চিত করবার জন্য কি তার চেয়েও বেশী শক্তি লাগে?
অনুমারের বজরা বেশী দূর অগ্রসর হয়নি, নকুড় ও দুৰ্যোধনের দলবল তাকে ধরে ফেললো নদীয়ায়।
বিম্ববতীর মৃত্যুসংবাদ নবীনকুমার গ্রহণ করলো খুব শান্তভাবে। যেন সে মনে মনে প্রস্তুত হয়েই ছিল যে মায়ের সঙ্গে তার দেখা হবে না। এ কথাটা তার প্রথম মনে আসে চন্দ্রনাথের গৃহে তার মাতৃমুখী সেই রমণীটিকে দেখে। এই চিন্তাটিকে কুসংস্কারের মতন উড়িয়ে দেবার জন্যই সে হরিদ্বার যাত্রা করতে চেয়েছিল।
গঙ্গানারায়ণের পত্র পাঠ করে সে কিছুক্ষণ বসে রইলো চুপ করে। নবীনকুমারের চক্ষু অশ্রুহীন, কিন্তু দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে দুলাল উচ্চ স্বরে কাঁদছে বালকের মতন। বিম্ববতী তার কাছে ভগবতীতুল্যা। বিম্ববতীর জন্যই তার যা কিছু। বয়স হবার পর সে বুঝতে পেরেছে যে পাছ-মহলের ভৃত্যতন্ত্র থেকে সে যে ওপরতলায় প্রভুপুত্রের সহচর হিসেবে স্থান পেয়েছে, তা শুধু বিম্ববতীর দয়ায়।
দুলালকে কিছুক্ষণ কান্নাকাটির সময় দিল নবীনকুমার।
তারপর মৃদু কণ্ঠে সামনে দণ্ডবৎ হয়ে থাকা নকুড় ও দুর্যোধনকে বললো, দুলালকে ভেতরে ডাক—
দুলাল চক্ষু মুছে ভেতরে এসেও আবার হাউ-হাউ করে কেঁদে ফেলে বললো, ছোটবাবু, ছোটবাবু, কত্তামা চলে গ্যালেন–
নবীনকুমার মুখ তুলে বললো, কাছাকাছি কোনো বড় জায়গায় বজরা ভেড়াতে বল। তারপর পুরুত যোগাড় করতে হবে, আর সব যোগাড়-যন্তর করতে হবে, আমি এই নদীর ধারে মায়ের পারলৌকিক কাজ করবো!
নকুড় হাত জোড় করে বললো, কলকেতায় ফিরে যাবেন না, ছোটবাবু! বড়বাবু অনেক করে বলে দিয়েচেন—
নবীনকুমার বললো, না, এখন আমার ফেরা হবে না। তোরা ফিরে যা—।
অদূরেই রাসপুর নামে একটি গঞ্জ মতন এলাকা। সেখানেই এসে থামলো বজরার বহর। দুলালের খুবই ইচ্ছে এখনই কলকাতার দিকে রওনা হওয়ার, সে প্রস্তাব একবার নবীনকুমারের কাছে তুলে ধমক খেল। নবীনকুমার আগে মায়ের শ্ৰাদ্ধাদি কৃত্য সম্পন্ন করবে, তারপর অন্য কথা।
নদীবক্ষে শালগ্রাম শিলার পূজা এবং পিণ্ডদান ঠিক শাস্ত্রসম্মত নয়। তীরে নামতেই হবে। আবার, অপরের জমিতে বসে নবীনকুমারের মতন জমিদারপুত্র মাতৃদায় থেকে উদ্ধার হবে, এটাও মোটেই ভাল দেখায় না। পুরোহিত ও দুলালের এই মিলিত যুক্তি শুনেও নবীনকুমার নিবৃত্ত হলো না। সে আদেশ দিল যে সেদিনের মধ্যেই কাছাকাছি কোথাও দু-দশ বিঘে জমি সমেত একটি বাড়ি কিনে। ফেলার ব্যবস্থা করা হোক। আগামীকাল সেইখানেই কাজ হবে।
এ আদেশ অমান্য করার সাধ্য দুলালের নেই। তৎক্ষণাৎ সে পাঁচ-সাতজন লোক পাঠিয়ে দিল। জমির সন্ধানে। পুরোহিতের তালিকা অনুযায়ী শ্রাদ্ধের দ্রব্য-সম্ভার সংগ্রহে সে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। এত সব জিনিস রাসপুরে পাওয়া যাবে না। ঘোড়া ভাড়া করে লোক পাঠাতে হবে দূরে দূরান্তরে।
এগারো বিঘে জমি সমেত একটি ছোট বাড়ি পাওয়া গেল আধ ক্রোশের মধ্যেই এবং নদীর ধারে। পরদিন সেখানে সব ব্যবস্থা হলো। ঘোড়সওয়ার পাঠিয়ে নবদ্বীপ থেকে আনানো হল দানের ষোড়শ উপচার। মস্তক মুণ্ডিত করে নদীতে স্নান সেরে নবীনকুমার এসে বসলো যজ্ঞে।
প্রথম দিনে একশোটি ব্ৰাহ্মণের সেবা এবং প্রত্যেককে পিতলের কলস, এক জোড়া ধুতি ও দশটি করে রৌপ্যমুদ্রা দেওয়া হলো। সুখের বিষয়, এ অঞ্চলে ব্ৰাহ্মণের কোনো অভাব নেই। বৃষোৎসর্গও বাদ গেল না।
পরদিন কাঙালীভোজন। সেদিন এলো প্ৰায় দু তিন হাজার লোক। বিনা নিমন্ত্রণে এত গ্রামবাসীকে আসতে দেখে দুলালদের চক্ষু স্থির হবার উপক্ৰম। গ্রামে এত কাঙালী? যাই হোক, ব্যবস্থার ত্রুটি হলো না কোনো। প্রথম পঙক্তিটি বসে গেলে নবীনকুমার নিজের হাতে অন্ন পরিবেশন করলো।
সব কিছু মিটে যাবার পর সন্ধ্যাকালে নবীনকুমার নদীর ধারে একটি অশ্বত্থ বৃক্ষের নিচে বসে বিশ্রাম নিচ্ছে, সে সময় তার চক্ষু থেকে বিমোচিত হলো কয়েক বিন্দু অশ্রু। তার ভিতরের শুষ্কতায় সে নিজেই বিস্মিত হচ্ছিল। যত আড়ম্বরের সঙ্গেই তপণ করা হোক, চোখের জল ছাড়া কি লোকান্তরিত জনক-জননীর পূজা সম্ভব! মনে মনে সে বললো, মা, আমি জানি, আমি যদি তোমায় এক কোটিবারও দুঃখ দিয়ে থাকি, তবু জানি, তুমি তার সবই ক্ষমা করেচো!
শীতের পরিষ্কার আকাশে, নদীর পরপারে বণাঢ্য সূৰ্য্যস্ত হচ্ছে। সেদিকে চেয়ে থাকতে থাকতে নবীনকুমারের মনে হলো, এরকম সূৰ্য্যস্ত প্রতিদিনই হয়, কিন্তু প্ৰতিদিন এ দৃশ্য এক রকম নয়। আছে, অন্য কিছু আছে। যা আমরা শুধু চোখ দিয়ে দেখি, যুক্তি দিয়ে বুঝি, তার আড়ালেও অন্য রকম কিছু আছে। নইলে জীবন বড় এক-রঙা হতো।
একটু পরেই নবীনকুমারের নির্জনতা বিঘ্নিত হলো। নদীর ওপর থেকে একটি বড় নৌকো এসে থামলো এপারে। তার থেকে নেমে একজন মধ্যবয়স্ক লোক নবীনকুমারের সামনে এসে দাঁড়িয়ে দু হাত কপালে ঠেকিয়ে বললো, নমস্কার ছোটবাবু!
নবীনকুমার খানিকটা বিরক্ত, কিছুটা কৌতূহলী হয়ে লোকটির দিকে চাইলো। সে যে একজন বড় জমিদার, তা ইতিমধ্যেই রটে গেছে। সচরাচর গ্রামবাসীরা তার সঙ্গে কথা বলতে এলে ভূমিতে কপাল ঠেকিয়ে আগে প্ৰণাম সেরে নেয়। এই লোকটি তার ব্যতিক্রম। এর কথার মধ্যে খুব একটা বিনয়ের ভাবও নেই, যদিও লোকটি তাকে চেনে। ছোটবাবু বলে সম্বোধন করেছে।
এই ব্যক্তিটির বেশ গোলগাল চকচকে চেহারা। ধুতিটির রং টকটকে লাল, উত্তমাঙ্গে একটি মুগার চাদর জড়ানো। নবীনকুমারের থেকে সামান্য দূরত্ব রেখে মাটিতে বসে পড়ে সে বললো, আমি খবর পাইলাম আজ সকালে। আইস্যা বুঝতে পারছি, অনেক দেরি হয়ে গ্যাছে।
লোকটি নবীনকুমারের মুণ্ডিত মস্তকের দিকে হাতের ইঙ্গিত করলো। অর্থাৎ শ্ৰাদ্ধ-শান্তি যে চুকে গেছে, সেই কথাই সে বলতে চাইছে।
—আপনি কে?
—আপনি না, আমাকে তুমি বলেন। সেইডাই মানানসই হইবে। একেবারে যে তুই-তুকারি দিয়া শুরু করেন নাই এই আমার বাপের ভাইগ্য! অধীনের নাম ভুজঙ্গ শর্মা।
—আমার কাছে কী প্রয়োজনে আসা?
—সে রকম কোনো প্রয়োজন নাই! এইরকম খবর শুনলে আইসতে হয়, সেই আর কি! আসছি আমি ইব্রাহিমপুর থিকা। সেখানে এককালে আপনাগো জমিদারি আছিল, জানেন বোধ হয়?
—ছিল? এখন নেই?
–নাইও কইতে পারেন, আছেও কইতে পারেন!
—অর্থাৎ?
–কাগজে-পত্তরে আইজও আছে, কাজে-কম্মে নাই। যেমন ধরেন, এককালে আমি আপনেগো নায়েব আছিলাম। এখন আমারে আপনেগো নায়েব কইতেও পারেন, নাও কইতে পারেন। আছিও বটে, নাইও বটে।
—আপনি হেঁয়ালি করে কতা বলচেন কেন আমার সঙ্গে? আমি এসব পছন্দ করি না। যদি প্রয়োজনের কোনো কতা থাকে চটপট শেষ করুন, নইলে বিদেয় হোন!
ভুজঙ্গ ভট্টাচাৰ্য আকৰ্ণবিস্তৃত হাসি দিল। ঘাড় ঘুরিয়ে চতুর্দিক দেখে নিয়ে বললো, এ বাড়িখান কার? আরে রাম রাম, রামকমল সিংহের একমাত্র সন্তান, কত্তামার নয়নের দুলাল নবীনকুমার সিংহ কালাশৌচ পালন করতাছেন পরের বাড়িতে? ছিঃ ছি, কী লজ্জা!
নবীনকুমার তীব্র স্বরে বললো, এ বাড়িটি আমার!
—তা ক্যামনে হয়, ছোটবাবু। ইদিকে তো আপনেগো কোনো ভূ-সম্পত্তি নাই! আমারে আপনে ভুল বুঝাইবেন? আমি যে সব জানি!
লোকটির ঔদ্ধত্যে যারপরনাই ক্রুদ্ধ হয়ে উঠলো নবীনকুমার। একে এক্ষুনি ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বিদায় করে দেবার জন্য নবীনকুমার হাঁক দিল, দুলাল! ওরে কে আচিস, দুলালকে ডাক।
ভুজঙ্গ ভট্টাচার্য তৃপ্তির সঙ্গে ঘাড় নেড়ে বললো, হুঁ, ফোঁস শুনলেই জাত চেনা যায়। সিংহের ছাওয়াল সিংহ। রাগ করেন ক্যান, ছোটবাবু! আগে আমার সব কথা শুইন্যা লন।
—আপনার যা বলবার আচে, দুলালকে গিয়ে বলুন। আমার চোখের সমুখ থেকে দূর হয়ে যান!
—দুলাল-টুলালের সঙ্গে কথা কওয়া তো আমার সাজে না! আমি নিজেও যে একজন জমিদার।
—এটা কি আপনার জমিদারি? আমি আপনার জমিদারির মধ্যে বসে আচি?
—না, সে কথা কইতাছি না। আমার না হউক, অপরের জমিদারির মইধ্যে বইস্যা থাকাও আপনার শোভা পায় না। এটা কীর্তিচন্দর রায়গো জমিদারির মইধ্যে পড়ে। আমার জমিদারি এর লগে লগেই। তয়, আমিও আসল জমিদার নয়, নকল। চেহারাখান দ্যাখছেন না, এই কি জমিদারের চেহারা! আমি নকল।
–ফের হেঁয়ালি?
–এবার তয় সাদা কথাই কই। আসলে জমিদারের ব-কলমা দিতে দিতে আমি এখন পেরায় জমিদার হইয়া গেছি। লোকে অবইশ্য এখনো আমারে নায়েববাবুই কয়।
—আপনি ইব্রাহিমপুর পরগনার নায়েব?
—ইব্রাহিমপুরে আপনেগো জমিদারি আছিল, সে কথা আপনে জানেন? খবর রাখেন কিছু?
–কেন জানবো না?
—বৎসর ছয়-সাতের মইধ্যে সেখানে জমিদারবাবুগো একজনারও পায়ের ধূলি পড়ে নাই। তাগাদায় কেউ আসে নাই। কাজে কাজেই আমি এখন সর্বেসবা। ও জমিদারি এখন আমার!
—আমাদের জমিদারি আপনি আত্মসাৎ করেচেন?
—নামে আপনাগোই। কোম্পানির আমলে সেই যে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত কইরা গ্যাছে, তারপর না ব্যাচলে তো কেউ জমিদারি কাঁইড়া নিতে পারে না। তেমন তেমন নায়েব হইলে জমিদারি ফোঁপরা কইরা দিতে পারে। আমিও তাই দিছি।
লোকটির কথা বলার বিচিত্র ধরনে নবীনকুমার আকৃষ্ট না হয়ে পারলো না। নিজের মুখেই স্বীকার করছে যে তাদের একটি পরগনা এই লোকটি ভোগদখল করছে। সে কথা নিজের মুখে জানাতে এসেছে কেন? এ কথা সত্য যে নবীনকুমার তাদের জমিদারির আদায় তহশিলের ব্যাপারে কখনো কোনো আগ্ৰহ দেখায় নি। যখনই প্রয়োজন হয়েছে, সে গঙ্গানারায়ণের কাছ থেকে অর্থ নিয়েছে কিংবা কলকাতার সম্পত্তি বিক্রয় করেছে। ইব্রাহিমপুর পরগনার তা হলে এই অবস্থা!
—এখনো বুঝতে পারলুম না, আপনি আমার কাছে কেন এসেচেন?
—বাতাসের মাথায় খবর রটে। লোকে কইতাছে যে জমিদারের পোলা নবীন সিংহ মায়ের ছোরাদ করতাছেন অইন্যের জাগায়। নদীর ধারে অনাথের মতন বইস্যা আছেন। তাই দৌড়াইয়া আইলাম। ইব্রাহিমপুরে নতুন কুঠিবাড়ি বানাইছি, থাকতে হয় সেখানে আইস্যা থাকেন। চলেন আমার সঙ্গে।
—আপনি আমায় নিতে এসেচেন?
–হ।
—আশ্চর্য। সেখানে গিয়ে যদি আমাদের জমিদারি। আমি আবার দখল করে নিই!
–নিতে ইচ্ছা হয় নিবেন?
—এত বছর ধরে আমাদের ঠকিয়োচেন, টাকা-পয়সা কিছু দ্যান নি, সে জন্য যদি আপনাকে জেলে দিই?
—সেটি পারবার উপায় নাই, ছোটবাবু। কাগজ-পত্তর একেবারে পাক্কা। হিসাব নিতে গেলে দ্যাখবেন আয় কিছুই নাই, বরং ধার দেনা, শুধু ধার দেন। খাজনার দায়ে বাজনা বিকাইবার উপক্ৰম। আমারে ধরতে-ভুঁইতে পারবেন না।
—আপনাকে বরখাস্ত করে নতুন নায়েব নিযুক্ত করতে পারি। সে ক্ষমতা নিশ্চয়ই আমার আচে। নামে যখন আমিই জমিদার?
—তা পারেন, নিশ্চয় পারেন। কিন্তু নূতন নায়েব দুই দিনেই ল্যাজ গুটাইয়া পলাইব, দ্যাখবেন। প্ৰজারা যে সকলেই আমারে মানে।
—অর্থাৎ আপনাকে কিছুতেই হঠানো যাবে না। ও জমিদারি আমাদের যাবেই।
—আপনেরা কইলকেতায় বইস্যা আমোদ-আহ্লাদ করবেন, বছরের পর বছর এদিকে একবার পাও দিবেন না, প্ৰজারা বাঁইচলো না মরলো সে তল্লাশও করবেন না, তাইলে নায়েবরা সেই সুযোগ সব হাতাইব না? কন? সুযোগ পাইছি, আমিও নিছি।
—আপনার নাম ভুজঙ্গ, আপনি দেখচি সত্যিই একটি কাল-ভুজঙ্গ!
—হাঃ হাঃ হাঃ! এডা কী কইলেন, ছোটবাবু? নাম শুইন্যা কি মানুষ চিনা যায়? কাউর বাপ-মায়ে কখনো শখ কইরা সন্তানের নাম ভুজঙ্গ রাখে? ভুজঙ্গ না, ভুজঙ্গ না, আমার আসল নাম ভুজঙ্গধর। ভুজঙ্গ মানে সাপ, আর ভুজঙ্গধর হইলো শিব। আপনে বিদ্বান মানুষ, এডা জানেন নিশ্চয়। তাইলেই দ্যাখেন কত তফাত হইয়া গেল! হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ!
হঠাৎ হাসি থামিয়ে ভুজঙ্গ ভট্টাচাৰ্য বললো, আপনের দাদা কেমন আছেন? তিনি দ্যাবতুল্য মানুষ। তিনি বিবাহ করেছেন শুনিছি। আমারে একখান নিমন্ত্রণপত্র পর্যন্ত পাঠান নাই। এমন কথা ভূ-ভারতে কেউ কোনো দিন শুনেছে যে জমিদারের বিবাহ হয়, আর প্রজারা তো দূরের কথা, নায়েবগো পর্যন্ত নিমন্ত্রণ হয় না? এমন জমিদারের জমিদারি কখনো রক্ষা পায়?
নবীনকুমার চুপ করে রইলো।
এই সময় দুলালকে এদিকে আসতে দেখে ভুজঙ্গ ভট্টাচাৰ্য নিজেই তাকে ডেকে বললো, দিবাকর গোমস্তা কোথায়? সে সঙ্গে আসে নাই? তারে একবার ডাকো, সে আমারে চেনে।
দুলালও তার প্রভুর মত বিস্মিত।
দিবাকর আসে নি শুনে ভুজঙ্গ ভট্টাচাৰ্য অপ্ৰসন্ন স্বরে বললো, সেই জইন্যেই এমন অব্যবস্থা। যত সব পোলাপানের কাণ্ড, জমিদারকে পথের ধুলায় বসাইয়া রাখছে। চলেন, ছোটবাবু, কুঠিবাড়িতে চলেন। আপনার লোকগুলোরে তল্পি-তল্পা গুটাইতে কন। বেশী দূর না, এক বেলার পথ। আরও কিছুক্ষণ ওর সঙ্গে কথা বলবার পর নবীনকুমার ইব্রাহিমপুরে যাওয়াই মনস্থ করলো।