2 of 2

৬০. আবার বল্গাহীন অসংযম

আবার বল্গাহীন অসংযমের মধ্যে নিজেকে ভাসিয়ে দিয়েছে নবীনকুমার।

কোনো কাজে ব্যর্থতা সে মেনে নিতে পারে না, প্ৰচণ্ড উদ্যম সত্ত্বেও ব্যর্থ হলে বিমৰ্ষতার বদলে তার মনে জেগে ওঠে ক্ৰোধ, আর সেই ক্ৰোধে সে নিজেকেই আঘাত করতে চায় সবচেয়ে বেশী! বঙ্গবাসীদের জন্য সে একটি পরিচ্ছন্ন সুরুচিসম্মত দৈনিক পত্রিকা চালাতে চেয়েছিল, সেজন্য একটুও ব্যয়কুণ্ঠ হয়নি, তবু তার দেশবাসী গ্রহণ করলো না সে পত্রিকা! রসরাজ-এর মতন আদি রসাত্মক খেউড়ে ভরা পত্রিকা চলে আর পরিদর্শক চললো না!

ক্ষুব্ধ নবীনকুমার মনে মনে শপথ করলো, সে আর দেশের মানুষের উপকার করবার জন্য মস্তক ঘর্মাক্ত করবে না!

দুজন পণ্ডিতের মৃত্যু হওয়ায় কিছুদিন মহাভারত অনুবাদের কাজ বন্ধ আছে, অন্য পণ্ডিতের অনুসন্ধান করা হচ্ছে। সুতরাং এখন নবীনকুমারকে বরাহনগরে যেতে হয় না, সারাদিন সে বিছানায় শুয়ে বই পড়ে কিংবা কড়িকাঠ নিরীক্ষণ করে, সন্ধ্যাকালে সে সেজেগুঁজে বাড়ির বার হয়। সঙ্গে কোনো ইয়ারবক্সি কিংবা মোসাহেবও থাকে না, এখন কোনো পরিচিতের সঙ্গও পছন্দ হয় না। নবীনকুমারের। জুড়ি গাড়ির মধ্যে সে একা একা সারা শহর টহল দিয়ে বেড়ায়, কখনো কিছুক্ষণের জন্য থামে বাগবাজারের ঘাটে, ব্র্যাণ্ডির বোতল ওষ্ঠে ঠেকিয়ে গলায় ঢেলে দেয়। সেই তরল গরিল। অনির্দিষ্ট দুঃখ তাকে উতলা করে তোলে। নেশা যত বাড়তে থাকে দুঃখ ততই বাড়ে, একলা গাড়ির মধ্যে বসে সে কাঁদে। এক সময় জড়িত পদে গাড়ি থেকে নেমে নদীর ওপরের প্রশস্ত আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে।

এরকম একা-ভ্ৰমণ বেশী দিন চলে না। একদিন কৃষ্ণকমলের সন্ধানে রামবাগানে চলে এলো সে। কৃষ্ণকমল কথায় কথায় তাকে বিদ্রূপ শেলে বিদ্ধ করে, তবু ঐ লোকটি তাকে টানে। রামবাগানে সেই গৃহটির ত্রিতলে এসে পূর্ব পরিচিত কক্ষটির দ্বারে করাঘাত করে সে একটু অপ্ৰস্তুত হলো। প্রমদাসুন্দরী নামে সেই রমণীটির বদলে দ্বার খুলেছে। অন্য এক রমণী। প্রমদাসুন্দরীর বসন ছিল সাদামাটা, এ স্ত্রীলোকটি গাঢ় নীল রঙের শাড়ী পরে আছে, তাতে চুমকি বসানো, দু চোখে সুমা টানা।

মাপ করবেন, বলে নবীনকুমার পিছন ফিরতেই স্ত্রীলোকটি বললো, একটু দাঁড়ান।

নবীনকুমার আবার ঘুরে দাঁড়াল।

স্ত্রীলোকটি মুগ্ধভাবে নবীনকুমারের দিকে তাকিয়ে বললো, আহা, কী রূপ! এ যেন গিরিগোবর্ধনধারী গোপাল! এ যেন যমুনা পুলিনে বংশীধারী! আহা, কী টানা টানা চোখ, এমন কন্দর্পকান্তি আপনি কে গা?

নবনীকুমার বললো, আমার ভুল হয়ে গ্যাচে, আমি অন্য একজনকে খুঁজতে এয়েচিলুম।

স্ত্রীলোকটি রহস্যময় হাস্য দিয়ে বললো, আপনি যাকে খুঁজচেন, তাকে কোনোদিনই পাবেন নাকো!

—আমি খুঁজচিলুম আমার এক বন্ধুকে। তিনি এখেনে অন্য একজনার কাচে আসতেন।

—এ দুনিয়ায় কেবা বন্ধু, কেবা শত্তুর! তবু এ অধীনার কাচে এক দণ্ড দাঁড়ান, একটু প্ৰাণ ভরে দেকি আপনাকে! আহা কী রূপ, মানুষের এমন রূপ হয়! এমন প্রশস্ত ললাট, উজ্জ্বল দৃষ্টি, তীক্ষ্ণ নাসিকা, নব-দূবদিল-শ্যাম, তুমি যে হৃদয়-রঞ্জন মানভঞ্জন!

নবীনকুমারের মুখমণ্ডল অরুণবৰ্ণ ধারণ করলো। এমনিতেই রমণীদের সামনে সে স্বাভাবিক হতে পারে না। সে যুগপৎ লজ্জিত ও বিস্মিত হলো। কাব্য-সাহিত্যে সে পাঠ করেছে যে পুরুষরাই নারীদের সামনে এমন রূপের স্তুতি করে। আর এখানে এই রমণীই করছে তার রূপ নিয়ে অতিরঞ্জিত প্ৰশংসা! তার বিস্মিত হবার কারণ এই যে, এই স্ত্রীলোকটি কথা বলছে প্ৰায় শুদ্ধ ভাষায়, এমন ভাষা তো কোনো বারবনিতার মুখে শোনা যায় না!

সে মুখ তুলে তাকাতেই রমণীটি যেন তার মনের কথাই পাঠ করে বললো, কী ভাবচো, আমি বাজারে—খনকি নই! ওগো, আমার ঘরে একবার পায়ের ধুলো দেবে?

নবীনকুমার জিজ্ঞেস করলো, আপনি কে?

স্ত্রীলোকটি উৎফুল্ল জ্যোৎস্নার মতন হাসি ছড়ালো সারা মুখে। তারপর বললো, আমায় চিনতে পাচ্ছে না, আমি যে তোমার রাইসোহাগিনী গো!

নবীনকুমার এবার ফিরে যাওয়া মনস্থ করলো। এ স্ত্রীলোকটি বেশ্য ছাড়া কিছুই নয়, নানারকম নকশা জানে। সম্ভবত কোনো যাত্ৰা-পালা শুনে শুনে এই কথাগুলি মুখস্থ করেছে, এসবই ওর খদ্দের ধরার ছিল।

 

নবীনকুমার আবার ফিরতেই হাস্যমুখী তরুণীটির মুখখানি সঙ্গে সঙ্গে আঁধার বর্ণ হয়ে গেল, সে ছলো ছলো কৃষ্ঠে বললো, হাঁগো, আমি কি নরকের কীট যে আমার দিকে অমন ঘৃণার দৃষ্টিতে তাকালে? ঠিক আচে, আমি আজ রাত্তিরে মরে যাবো।

এবার নবীনকুমার স্ত্রীলোকটির কক্ষের চৌকাঠের এদিকে পা দিল। এর বিষয়ে কৌতূহল দমন না করে ফিরে যাওয়া যায় না।

পূর্বেকার আসবাবপত্র সব বদলে গেছে। ঘরের মধ্যে কোঁচ নেই, তার বদলে পুরু জাজিম পাতা, তার ওপরে মখমলের আস্তরণ। দুটি সৃদৃশ্য তাকিয়াও রয়েছে সেখানে। দেয়াল ঘেঁষে দাঁড় করানো একটি নতুন কাচের আলমারি, তার মধ্যে সাজানো সারি সারি কাচের গ্লাস।

জাজিমের ওপরেই বসতে হলো নবীনকুমারকে। তার একটু ভয় ভয় করছে। এভাবে কোনো বারবনিতার ঘরে একলা সে আগে আসেনি। স্ত্রীলোকটির হাবভাবও যেন অদ্ভুত। পাগল নয় তো?

স্ত্রীলোকটি নবীনকুমারের পায়ের কাছে বসে পড়ে বললো, আমার নাম সুবালা। তোমার নাম বলবার দরকারনেইকো, তুমি আমার কেষ্টঠাকুর। তুমি কী ড্রিঙ্ক কর্বে বলে তো! তুমি রম খাও? এ অভাগিনীর কাচে রম ছাড়া তো আর কিচু নেই!

এতক্ষণে নবীনকুমার বুঝতে পারলো, সুবালা নামের স্ত্রীলোকটি বেশ খানিকটা নেশা করে আছে! সেই জন্যই ওর ধরন-ধারণ খানিকটা পাগলিনী, খানিকটা রহস্যময়ীর মতন।

আদর-কাড়া গলায় সুবালা বললো, বুঝিচি, আমায় তোমার একটুও মনে ধরেনি, আমি কালো কুচ্ছিত শ্মশানকালী, তুমি ত্ৰিভঙ্গমুরারি, আমি অষ্টাবক্ৰ…

অর্থাৎ সুবালাও নবীনকুমারের মুখ থেকে রূপস্তুতি শুনতে চায়। কারণ সে কালোও নয়, কুৎসিতও নয়, বেশ রূপসীই সে, মুখখানা ভালো কুমোরের গড়া প্ৰতিমার মতন, শুধু তার কপালের ঠিক মাঝখান দিয়ে তিলকের মতন একটা কাটা দাগ।

নবীনকুমার বললো, আপনারী…তোমার কথা শুনলে মনে হয়, তুমি ভদ্রঘরের মেয়ে। এখেনে কী করে এসোচো?

খিল খিল করে হেসে উঠলো মেয়েটি। হাসতে হাসতে নুয়ে পড়ে কপাল ঠেকে যায় মাটিতে। সেইরকম হাসতে হাসতেই উঠে দাঁড়িয়ে চলে গেল পাশের ঘরে। তিন-চতুথাংশ পূর্ণ একটি রামের বোতল এবং দুটি কাচের গেলাস নিয়ে ফিরে এসে আবার নবীনকুমারের সামনে বসে পড়ে বললো, তোমরা পুরুষমানুষরা সবাই আমাদের কাচে এসে আমাদের হিসটোরি-জিয়োগেরাফি জিজ্ঞেস করো কেন গো? তাতে বুঝি তোমাদের বেশী মজা লাগে? ভদ্রলোকের বাড়ির মেয়ে মজালে বেশী আমোদ হয়?

নবীনকুমার বললো, হিসট্রি? জিয়োগ্রাফি? এসব তুমি জানলে কী করে? তুমি লেকাপড়া শিকোচো?

—বাঃ, শিকিচি না? বেথুনের ইস্কুলে তিন কেলাস পড়িচি! সেই দোষেই তো আমার কপাল পুড়লো।

নবীনকুমার স্তম্ভিত হয়ে গেল। বেথুন স্কুলে পড়া মেয়েদেরও পতিতা বৃত্তি গ্ৰহণ করতে হয়? ফিমেল-উদ্ধারের জন্য নব্য শিক্ষিতদের যে এত উদ্দীপনা, তার পরিণাম এই! সে হাসবে না। কাঁদবে। বুঝতে পারলো না।

সুবালা বললো, শোনো তবে আমার গপ্পো!

দুটি গ্লাসে সে রাম ঢাললো। এই সব গৃহের কোনো পাত্ৰে পানাহার করতে নবীনকুমারের রুচি হয় না। কৃষ্ণকমল একদিন বিদ্রূপ করে বলেছিল, তুমি বড়মানুষের ছেলে, তুমি জুড়ি-গাড়ি না হাঁকিয়ে কোনো দিন কোথাও যাও নি, তুমি আর এ দেশকে কী চিনবে? আমার মতন পায়ে হেঁটে ঘুরে বেড়াতে পারো তো বুঝি! তখন কৃষ্ণকমলের সঙ্গে বেশ কয়েকপদ পদব্ৰজেই কলকাতার অলি-গলি ঘুরেছিল নবীনকুমার। সেই পর্যন্ত সে পারে। কিন্তু বারোয়ারি থালা-গেলাসে মুখ দিতে গেলেই তার বংশ-মর্যাদা ভেতর থেকে ঠেলে ওঠে!

নিচে গাড়িতে তার ব্র্যাণ্ডির বোতল আছে। সেই জন্য নবীনকুমার জিজ্ঞেস করলো, তোমার কোনো নোকর নেই?

সুবালা বললো, আচে একজনা, সে এখন নেই, কেন!

তা হলে আর কী হবে? নবীনকুমারের পক্ষে নিচে নেমে গিয়ে নিজে হাতে করে ব্র্যাণ্ডির বোতল নিয়ে আসা শোভা পায় না। এই স্ত্রীলোকটিকেও বলতে পারে না সে কথা। অগত্যা সে সুবালার দেওয়া গেলাসটি সরিয়ে রেখে সরাসরি রামের বোতল থেকেই এক চুমুক দিল। এই রকম নির্জলা মদ্যপানে সে বেশ অভ্যস্ত, এটা শিখেছে হরিশের কাছ থেকে।

সুবালা মাটির ওপর পা ছড়িয়ে বসে। উরুর ওপর দুটি হাত রেখে বললো, বেথুনে তিন কেলাস। পড়ার পরই আমার বিয়ে হলো। ভালো ঘর, অনেকটা তোমার মতন সোন্দর বর। আমাদের বংশও খারাপ নয়কো, আমার বাবা সদর দেওয়ানির উকিল ছেলেন। আমার স্বোয়ামী প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্তর। কপালে সইলো না। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই তিনি স্বগ্যে গেলেন! আমার শাশুড়ী আমায় বললেন, লক্ষ্মীছাড়া, নেকাপড়া শিকে কপালে বৈধব্য নিয়ে এয়েছিল, আমার ছেলেটাকে খেলো! বাবা নেই, ছোটবেলা থেকেই নেই, আমরা মামার বাড়িতে মানুষ। শাশুড়ী দিলেন গলাধাক্কা, চলে এলুম। মামার বাড়িতে ফের!

—ছেলে প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়ে, তবু সেই ছেলের মা বললে তুমি লেখাপড়া শিকোঁচো বলেই

বিধবা হলে?

—তাই তো বললে। আমি কি ছাই গল্পো বানাতে পারি?

–তখন তোমার বয়েস কত?

–এগারো!

—তোমার মামারা তোমার আবার বিয়ে দিতে পারলেন না?

—শোনোই না! মামাদের পয়সার জোর নেই, তেনারা চিটি লিকলেন বিদ্যেসাগরকে।

—তিনি কিচু ব্যবস্থা করেন নি?

—কর্বেন না কেন? নইলে কি আর এমনি এমনি দয়ারসাগর বিদ্যেসাগর নাম! চটি ফটফটিয়ে একদিন সটাং চলে এলেন আমাদের বাড়িতে। ওমা, কত নাম শুনিচিলুম। বিদ্যেসাগরের, চেহারাখানা দেকে একেবারে ভ্ররমি খাবার জোগাড়। মাতা কামানো সে এক পাল্কী বেহারির হদ্দ। তবে গলার আওয়াজটি শুনলে বোজা যায় যে হ্যাঁ, বীরসিংহের ব্যাটা বটে! তিনি এক মাসের মধ্যে ঠিক করে ফেললেন আমার বিধবা বিয়ে। এবারে বিয়ে হলো আরও বিরাট বংশে, সব্বাই এক ডাকে সে বাড়ির কত্তার নাম জানে। সে বাড়িতে আমি মাইকেল মধুসূদনকে দেকিচি।

—অ্যা! সত্যি?

–হ্যাঁ গো, বলচি, যে আমি মিছেকতা বানাতে জানি না। তা মাইকেল মধুসূদন তখনও পদ্য লেকেন নি। ও বাড়ির কত্তার কাচে আসতেন বীয়র খাবার জন্য। কী বীয়র খেতে পারেন গো তিনি, ছ বোতল সাত বোতল, যত খান ততই মুখ দিয়ে গলাগলিয়ে কতা বেরোয়…

—সেখেনে বিয়ে হবার পর আবার কী বিভ্ৰাট হলো?

—যা হবার তাই হলো! ঐ যে কতায় বলে না, তুমি যাও বঙ্গে, কপাল যায় সঙ্গে। আমার শ্বশুরের কত নাম ডাক, কত দ্যান ধ্যান, গরিব দুঃখীর জন্য মন কাঁদে, কিন্তু এ হতভাগিনীর দুঃখটাই শুধু তিনি বুঝলেন না।

—কী নাম তোমার শ্বশুরের?

—ছিঃ, তা কখনো বলতে আচে? আমি কপাল খুইয়িচি বলে কি ঐ সব মানী লোকের নামে দুর্নাম ছড়াতে পারি? শোনো না, তারপর কী হলো! আমার দ্বিতীয় বিয়ে হলো একজন পোকায় খাওয়া মানুষের সঙ্গে! বিদ্যেসাগর মশাই তো বিয়ে দিয়েই খালাস, তিনি তো পরে আর দেকতে যান না সেই সব বিয়ে হওয়া বিধবার কী দশা হয়!

—এ কী তাঁর পক্ষে সম্ভব?

—না, না, তাঁর নামে দোষ দিচ্চি না। তিনি মহাপুরুষ! সব দোষ আমার নিয়তির। আমার শ্বশুরের ঐ এক ছেলে, তাঁর ছেল ক্ষয়কশ রোগ। সবাই জানতো বেশীদিন বাঁচবে না। শ্বশুরমশাই সে খপর চেপেচুপে তাড়াহুড়ো করে বিয়ে দিয়ে দিলেন। তাই জন্যই তো বিধবার জন্য অত দরদ। আমি মামার বাড়িতে ভাত-ঠ্যালা হয়ে আচি, মামারা কি আর অত খোঁজ খপর নেয়, না বিদ্যেসাগর মশাইয়ের সময় আচে? আমার শ্বশুর ভেবেচিলেন যদি ছেলে মরার আগে কোনোক্রমে একটি বংশধর জন্মায়…। আচ্ছা কেষ্টঠাকুর, সত্যি করে বলো তো, ভগবান বলে কেউ কি সত্যিই আচে?

—ভগবান বলে কেউ থাকলেও তিনি যে তোমার প্রতি দয়া করেননি, বোঝাই যাচ্চে।

—কেন কল্লেন না? আমি কী দোষ করিচি? এই মা কালীর দিব্যি তোমায় বলচি, ক্ষয়কাশ থাক আর যাই থাক, আমার সেই স্বোয়ামীকে আমি মনপ্ৰাণ দিয়ে সেবা করিচি, রক্ত বমি কত্তেন তিনি, আমি নিজের হাতে-মানুষটি খারাপ ছিলেন না, যখন বুকে খুব কষ্ট হতো, আমার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে বলতেন, আহা সুবালা, আমার তো বাঁচার খুব ইচ্ছে…

 

ঝরঝর করে জল পড়তে লাগলো সুবালার দুই চক্ষু দিয়ে। নবীনকুমার রামের বোতলে আর একটি চুমুক দিয়ে বললো, থাক, আর বলতে হবে না।

সুবালা মেয়েটি সত্যিই বড় বিচিত্র। এই সে কাঁদছিল, আবার তক্ষুনি ফিক করে হাসলো। চক্ষে জল শুকোয়নি। অথচ হাস্য মুখে সে বললো, জানো, যেই সে মলো অমনি সবাই আমায় আবার বললো, রাক্কুসী! এই দ্যাকো, আমি রাক্কুসী! হ্যাঁ, আমি তোমায় খেয়ে ফেলতে পারি।

—তুমি মদ খাওয়া কোতায় শিকলে? এখেনে তোমায় কে নিয়ে এলো।

—অতবড় মানী শ্বশুর আমার, তিনি পর্যন্ত বললেন, তাঁর বাড়িতে আমার আর ঠাঁই নেই। যে-মেয়ে দুদুবার স্বামীকে খায় সে রাক্কুসী ছাড়া আর কী? সে অপয়া, তার মুখ দর্শনেও পাপ, তাই না গো?

—তোমার তো কোনো দোষ ছিল না! ক্ষয়কাশ হলে কেউ বাঁচে? ক্ষয়কাশের রুগীর সঙ্গে জেনে শুনে বিয়ে দিয়েছেল–বিদ্যেসাগর মশাই নিশ্চয়ই জানতেন না সে কতা!

—বিয়ে হয়ে যাবার পর তিনি জানলেই বা কী কত্তেন?

—জানলে তিনি তোমার শ্বশুরের সঙ্গে বাক্যালাপ করতেন না কোনো দিন। সে ব্ৰাহ্মণের জেদ আমি জানি!

—তাতেই বা কী আমার স্বগ্য লাভ হতো! তিনি আমার শ্বশুরের ওপর রাগ করে আমার সে বিয়ে পরে ভেঙে দিতে পাত্তেন না! দ্বিতীয়বার বিধবা হবার পর তিনি আবার আমার বিয়ে দিতেন?

-তখন তোমার কত বয়েস?

—তের। পুরুষমানুষ কী বস্তু তখনো জানিনি।

—তোমার শ্বশুর তোমায় রাস্তায় বের করে দিলেন?

—অতবড় মানী লোক, একেবারে কী আর রাস্তায় ফেলবেন? তা হলে লোকে যে তাঁকেই দুষিবে। পাইক দিয়ে আমায় মামাদের বাড়িতে ফেরত পাটিয়ে দিলেন। সেখেনেও একই অবস্থা। মামারা চোক মোটা মোটা করে তাকায়। ভদ্রঘরের মেয়ে মানুষ দু বার বিধবা, এমন কতা কেউ সাত জন্মে শুনেচে! আমি যেন এক সৃষ্টিছাড়া। আমি নিজেই ভাবতুম, আমার ওপরে শনির দৃষ্টি আচে, আমার জীবনে সুখ মানে মরীচিকা। ছিলুম মামাদের বাড়িতে দাসী বাদী হয়ে, মামীরা শত বকুনি দিলেও রা কাড়িনি কোনো দিন, সেজোমামীর এক ভাই কত লোভ দেকিয়েচে, ইতি উতি হাত টেনে ধরেচে, কোনোদিন তার সঙ্গে নষ্ট হইনি, এই মা মনসার দিব্যি তোমায় বলচি। একদিন রাগ করে মেরিচিলুম। তাকে এক থাবড়া! সেই যে বলে না, পায়ের যুগ্য মানুষ নয়, গায়ে হাত দিয়ে কতা কয়!

—শেষ পর্যন্ত সেই মামীর ভাই-ই তোমায় এ… পথে এনেচে?

—মোটেই না। সতেরো বচ্ছর বয়েস পর্যন্ত কোনোদিন কারুকে ঘেঁষতে দিইনি, তখুনো পর্যন্ত ভগবানে বিশ্বাস ছেল-এখন আমার বয়েস উনিশ, কত্ত বড় হয়ে গ্যাচি, না? সত্যি গো এখন উনিশ, আমি মিছে কতা বলি না!

—তোমাকে কে বাড়ির বার কল্লো?

—তোমার এত কৌতূহল কেন গো, কেষ্টঠাকুর? হঠাৎ আজ কোতা থেকে তুমি উদয় হলে, তোমায় দেকে একেবারে চমক খেয়ে গেলুম। ঠিক যেন মন্দিরে বসানো মূর্তিটি!

—তোমাকে মদ খাওয়া কে শেখালো তা বললে না?

—কেউ শেখায়নি তো, আমি নিজে শিখিচি। এ পথে এলে সবাই শিখে যায়। তুমি জিগ্যেস কচ্চো তো কী করে এ পথে এলুম? তোমরাই এনোচো!

—তার মানে? তুমি মামার বাড়িতে থাকতে পারতে না?

—পাত্তুম! লাথি ঝাঁটা খেয়েও সেখেনে পড়ে থাকতুম। কিন্তু কপাল যাবে কোথায়? একদিন আমার মামার বাড়িতে পাল্কী নিয়ে উপস্থিত হলো অনাদিচরণ। সে আমার দ্বিতীয় পক্ষের খুড়তুতো দেওর। হি-হি-হি-হি! পুরুষমানুষেরই শুধু আগে দ্বিতীয় পক্ষ হতো, এখন মেয়েমানুষেরও দ্বিতীয় পক্ষ হয়। সেই অনাদিচরণ এসে আমার শ্বশুর মশায়ের নাম করে বল্লে, তিনি আমায় ডেকে পাটিয়েচোন! বাড়িতে কোনো শুভ কাজ আচে, বাড়ির বৌ সেখেনে উপস্থিত না থাকলে কেমন কেমন দেকায়। মামারা তো এক কতায় রাজি। মনে মনে বললে বোধহয়, আপদ গেল! আর যেন ফিরে না আসে! থান কাপড়ে ঘোমটা টেনে আমি তো উঠে বসলুম পাল্কিতে। সে পাল্কি যখন থামলো, আমি দেকি, ওমা, এ তো হালসীবাগান নয়, এ যে অন্য জায়গা, কী রকম বিচ্ছিরি মতন বাড়ি-এই যাঃ! বলে ফেললুম যে—

নবীনকুমারও চমকে উঠলো। হালসীবাগানে বিধবাবিবাহ? সে তো নীলাম্বর মিত্রের বাড়িতে। কলকাতার পঞ্চম কিংবা ষষ্ঠ বিধবাবিবাহ। নবীনকুমার স্বয়ং উপস্থিত ছিল সে বিবাহে নিমন্ত্রিত হিসেবে। পাত্রকে তার মনে আছে, শিবপ্রসাদ মিত্র, হ্যাঁ, একটু শীর্ণ, দুর্বল চেহারা ছিল বটে। ঘোমটায় ঢাকা নববধূর মুখ সে ভালো করে দেখতেই পায় নি। এই সেই রমণী? নীলাম্বর মিত্র, যিনি প্রতিটি সামাজিক সংস্কারে এগিয়ে আসেন, সব ব্যাপারে মুক্তহস্তে চাঁদা দেন, বিধবাবিবাহ আন্দোলন যখন শুরু হয়, তখন তিনি ছিলেন বিদ্যাসাগরের মস্ত বড় সমর্থক, সেই ব্যক্তিই নিজের পুত্রবধূকে এইভাবে ঠেলে দিয়েছেন? শুধু একটি বংশধর পাবার লোভে নিজের রুগণ সন্তানের সঙ্গে বিবাহ দিয়ে এরকম একটি সুন্দরী, স্বাস্থ্যবতী মেয়ের সর্বনাশ করলেন? এইসব লোকই দেশের মাথা, এরাই ইংরেজি শিক্ষিত, এরাই রিফর্মার!

নবীনকুমার আর শুনছে না। তবু বলেই চলেছে সুবালা।

—তারপর কী হলো জানো, সে মুখপোড়া আমায় নিয়ে তুললো হাড়কাটার একটা বাড়িতে। হাড়কাটা কোতায় জানো তো, যেখোনে হাড়ের বোতাম বানায়, সেই পাড়ায়–সে বাড়িটা বেবুশ্যেদের, আমার মুখ চেপে ধরে একটা ঘরে বন্ধ করে রাকালো…তারপর…সেই অনাদি-রাত্তিরবেলা…আমি একা মেয়েমানুষ কী করে নিজেকে বাঁচাবো…তবু সে কতা কেউ ভেবে দেকলে না, আমায় সবাই এই নরকে ফেলে দিলে…আমার মামারা কিংবা শ্বশুর ঠাকুর একবার খোঁজ নিলে না পর্যন্ত আমার, আমি যে একটা মানুষ, বাঁচলুম না মলুম কেউ তা জানতে চাইলে না গো…

আবার কাঁদতে কাঁদতে সুবালা নবীনকুমারের পায়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তেই সে বিদ্যুৎস্পষ্টের মতন সরে গেল। তারপর বললো, ছুঁয়ো না, আমায় ছুঁয়ো না তুমি!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *