নবীনকুমারের মতন বড় মানুষের সন্তান, বিশেষত সম্পত্তির অধিকারী স্বাবলম্বী যুবকের পক্ষে বেশীদিন একা থাকা সম্ভব নয়। সান্ধ্য অভিযানে সে আর কতদিন একা এক ঘুরবে! তা ছাড়া অনেকে তাকে দেখেই চিনতে পারে। বাইশ বৎসর বয়েসেই সে এই নগরীর প্রধান ব্যক্তিদের মধ্যে অগ্রগণ্য, অনেক সভা সমিতিতে তাকে দেওয়া হয় সম্মানিত আসন।
তার খ্যাতির কারণ দুরকম। সুধীজন ও বিদ্বজনমণ্ডলী তাকে চিনেছে ধনীদের মধ্যে একজন ব্যতিক্রম হিসেবে। অতুল সম্পদের অধিকারী হয়েও সে বিলাসিতায়, অমিতাচারে গা ভাসায় নি, ইংরেজ শাসক গোষ্ঠীর করুণা পাবার জন্যও তেমন লালায়িত হতে দেখা যায়নি, আবার ধর্ম সংস্কারের নামেও উন্মত্ত হয়নি। প্রায় কৈশোর বয়সে বিপুল আড়ম্বরের সঙ্গে সে নিজগৃহে নাটক অভিনয়ের আয়োজন করেছিল, স্বয়ং নায়ক সেজে সুনামও পেয়েছিল যথেষ্ট, কিন্তু থিয়েটারকেই জীবনের পরাকাষ্ঠী মনে না করে সেই মোহ সে বর্জন করেছে অচিরেই। ক্রমশই বৃহত্তর কাজের প্রতি তার আগ্রহ। সমাজ হিতকারী যে-কোনো অনুষ্ঠানে সে অংশগ্রহণ করতে এগিয়ে আসে।
বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির সদ্য গড়ে ওঠা মধ্যবিত্ত শ্রেণী তাকে চিনেছে সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষক এবং ভিন্ন স্বাদের সাহিত্য রচনাকারী হিসেবে। মহাভারত অনুবাদের মতন বিরাট কর্মযাঞ্জের হোতা এই যুবকটির প্রতি তাদের সশ্রদ্ধ বিস্ময় ও কৌতূহল। খণ্ড খণ্ড বাংলা মহাভারত সে বিনামূল্যে বিতরণ করছে তো বটেই, তা ছাড়া সম্প্রতি সে সংবাদপত্রে ঘোষণা করেছে যে, ভারতবর্ষের যে-কোনো প্ৰান্ত থেকে যে-কেউ এই গ্ৰন্থ চাইলেই পাবে, এবং সেজন্য কারুকে ডাকমাশুলও প্রেরণ করতে হবে না, সে ব্যয়ও সে নিজেই বহন করবে। যত দূরে ডাক যায়, ততই মাশুল বাড়ে, তা হোক, কন্যাকুমারী থেকে পেশোয়ার পর্যন্ত যে-কোনো স্থানে সে মহাভারত পৌঁছে দিতে প্ৰস্তুত।
অশিক্ষিত সাধারণ মানুষ তাকে চিনেছে দাতা হিসেবে। শুধু যে নীল দর্পণের মামলায় জরিমানার এক সহস্র মুদ্রা সে তৎক্ষণাৎ ঝনাৎ করে ফেলে দিয়েছিল তাই নয়, ওরকম সহস্ৰ মুদ্রা সে যখন তখন দান করে। প্ৰকৃত-অভাবী, সৎ-দরিদ্র এবং জুয়াচোরদের মধ্যেও রাটিত হয়ে গেছে যে জোঁড়াসাঁকোর সিংহবাড়ির ছোটবাবুর কাছে যে-কোনো ছুতোনাতায় কিছু চাইলেই রিক্ত হাতে ফিরতে হয় না। কত বিচিত্র কারণ দেখিয়ে যে লোকে তার কাছে দান চাইতে আসে তার আর ইয়ত্তা নেই। মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র থেকে শুরু করে কন্যাদায়গ্ৰস্ত ব্ৰাহ্মণরা তো তার কাছ থেকে সত্য মিথ্যা কারণ দেখিয়ে অর্থ সাহায্য নিয়ে যায় বটেই, এছাড়া পত্রপত্রিকার সম্পাদক, বিধবাবিবাহের উমেদার ও ইস্কুল খোলার উৎসাহী ব্যক্তিরাও তার কাছে নিয়মিত আসে। নবীনকুমারের আত্মগরিমা প্রবল হলেও নিছক দানের অহংকারেই দান করে না সে। সে অর্থ জিনিসটাকে যেন খোলামকুচির মতন জ্ঞান করে। তার এত অর্থ আছে, অথচ অন্য অনেকের নেই, এই চিন্তা তাকে স্বস্তি দেয় না।
এক প্ৰাতঃকালে বাবু প্ৰসন্নকুমার ঠাকুরের কাছ থেকে এক দূত এলো তার কাছে। কী বৃত্তান্ত? দূতটি জানালো যে ইংলণ্ডের ল্যাঙ্কাশায়ার অঞ্চলে সম্প্রতি দারুণ দুৰ্ভিক্ষ দেখা দিয়েছে। সেখানকার অনাহার প্ৰপীড়িত ব্রিটিশ প্রজাদের সাহায্যকল্পে কলকাতার গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ একটি ফাণ্ড গঠনে উদ্যোগ নিয়েছেন। সেই কারণেই তাঁরা বাবু নবীনকুমার সিংহের কাছ থেকে সাহায্য চান।
প্রস্তাবটি শুনে হা-হা করে অট্টহাস করে উঠলো নবীনকুমার। নব-দূবদিলের মতন তার কচি গুফে হাত বুলিয়ে সে বললো, বটে, বটে! এদেশের মানুষের সব দুঃখ-দারিদ্র্য ঘুচে গ্যাচে, এখন আমাদের সাহায্য কত্তে হবে ইংলণ্ডের সাহেব দুঃখীদের জন্য, আঁ? তাই না?
দূতটি ঠিক বুঝতে পারলো না নবীনকুমারের বিদ্রূপ। সে বললো, আজ্ঞে, রাজা প্রতাপচন্দ্ৰ সিংহ, রানী স্বৰ্ণময়ী, বাবু হরলাল শীল, আমাদের কর্তাবাবু, এয়ারা সক্কলে এর মধ্যেই এক হাজার টাকা করে দিয়েচেন।
ওষ্ঠের কোণে হাস্যটি মজুত রেখে নবীনকুমার বললো, তা হলে তো আমাকেও হাজার টাকা দিতে হয়, কী বলো? নইলে মান থাকবে না! তা আমাদের পয়সায় ল্যাঙ্কাশায়ারের সাহেবরা তা হলে কিচুদিন খাক গরু-শোর! আমরা দান কচ্ছি শুনে তারা দু হাত তুলে আশীর্বাদ কর্বে তো? নাকি ড্যাম-সোয়াইন-নিগার বলে গালাগালি কর্বে? এশ্চো যখন, নিয়ে যাও টাকা। ওরে দুলাল—
এই নবীনকুমারের দানের ধরন!
অর্থীদের মধ্যে অনেকে নবীনকুমারের সঙ্গ ছাড়তে চায় না। বারবার নানান কারণ দেখিয়ে অর্থ আদায় করতে চক্ষুলজ্জায় আটকায়, তার চেয়ে বাবুর সঙ্গে নিত্যপ্রহর থাকতে পারলেই কিছু না কিছু পাওয়া যায়। বড় মানুষের হাত ঝাড়লেই দু পাঁচ শো! তা ছাড়া, নবীনকুমারের মোসাহেবের পদ খালি আছে দেখে সেই পদ দখল করার জন্য অনেকের মধ্যে হুড়োহুড়ি পড়ে গেছে। এতবড় একজন ধনীর সন্তানের মোসাহেব থাকবে না, এ কী হয়!
নবীনকুমার পোক-মাকড়ের মতন এদের ঝেড়ে ফেলতে চায়, তবু ছিনে জোঁকের মতন দু একজন রয়ে যায়। সকালবেলা বৈঠকখানায় অনেক মানুষের ভিড়ের মধ্যে এরা ঘাপটি মেরে লুকিয়ে থাকে।
এক সন্ধ্যায় রামবাগানের সেই গৃহটিতে সুবালার ঘরে যাবে বলে নবীনকুমার সিঁড়ি দিয়ে উঠছে, এমন সময় ওপর থেকে নামতে নামতে এক ব্যক্তি তাকে দেখে থমকে দাঁড়ালো। তারপর জিভ কেটে বললো, আরেঃ! ছোটবাবু যে? আপনি এখেনে? এখেনকার যে-মাগীকে আপনার পছন্দ, আমাদের হুকুম কৰ্বেন, আমরা তাকে আপনার বাগান বাড়িতে পৌঁচে দেবো! এরকম পল্লীতে আপনার মতন মানুষের একলা একলা আনাগোনা কি উচিত হয়?
নবীনকুমার এই লোকটিকে কোনদিন দেখেনি। তবু ঐ লোকটি তাকে চিনেছে দেখে সে বিস্মিত হলো। সে জিজ্ঞেস করলো, আপনি কে?
লোকটি বিনয়ে সারা শরীর কুঁকড়ে বললো, আজ্ঞে আমি আপনার দাসানুদাস।
নবীনকুমার ভাবলো, সারা শহরে তার এত দাসানুদাস ছড়িয়ে আছে, অথচ সে নিজেই তাদের চেনে না, এ তে বড় আশ্চর্য! এই লোকটি ধুতি ও বেনিয়ান পরা, নাকের নিচে পুরুষ্ট গুফ, মাথায় তেল চকচকে চুল দুদিকে পাট করা, ভদ্রমানুষের মতন চেহারা, এ কেন তার দাসানুদাস হতে যাবে? দীর্ঘকায় এই লোকটির সঙ্গে অনেকটা যেন রাইমোহন ঘোষালের মিল আছে। কিন্তু রাইমোহনের চেয়ে এর বয়েস অনেক কম। রাইমোহন তো বৃদ্ধ হয়ে কোথায় হারিয়ে গেছে।
লোকটি হাত জোড় করে বললো, আপনি কষ্ট করে আসবেন কেন? কোনটিকে চাই একবার বলুন, এখুনি আপনার গাড়িতে তুলে দিচ্চি, আপনাদের সেবা করাই তো আমাদের কাজ!
লোকটিকে অগ্রাহ্য করে ওপরে উঠে এলো নবীনকুমার। তখুনি মনে মনে সংকল্প গ্ৰহণ করলো, এভাবে সুবালার কাছে আর আসা হবে না।
সুবালার ঘরে উপস্থিত হয়ে সিঁড়িতে-দেখা লোকটির বর্ণনা দিয়ে নবীনকুমার জিজ্ঞেস করলো, ঐ লোকটি কে বলতে পারো?
সুবালা বললো, ও তো এখেনকার দালাল গো। ঐ মিনিসেই তো আমায় এখেনে এনে তুলেচে!
নবীনকুমার ঈষৎ ক্রুদ্ধ ভাবে প্রশ্ন করলো, ও তোমায়। এখেনে এনেচে? কী করে?
সুবালা হাসতে হাসতে বললো, তুমি বড্ড ছেলেমানুষ, তুমি কিচুই জানো না। আমি হাড়কাটার গলিতে ছিলুম, কিন্তু আমি কি সেখেনে থাকার যুগ্য? নিজের মুকে বলতে নেই, তবু আমায় দেকতে পটের বিবিটির মতন নয় কে? হি-হি-হি-হি।
আজও সুবালা নেশা করেছে এরই মধ্যে। সম্ভবত সে সারাদিন ধরেই একটু একটু নেশার দ্রব্য পান করে। সুস্থ, স্বচ্ছ চোখে সে বোধহয় এই পৃথিবীকে আর দেখতে চায় না।
সে বললো, হাড়কাটার গলিতে তো থাকে শস্তার মেয়েমানুষরা। আমার দেওর নাগরটি যখন আমায় ফেলে পিঠটান দিলে, তখন আমিও এপথে নোমলুম, ঐ সস্তার কারবার, দু টাকা এক টাকার খদ্দের সব! এই সব দালালরা আড়কাঠি লাগায়, নিজেরাও পাড়ায় পাড়ায় ঘোরে, সুন্দরপানা, ভালো গা-গতরের মেয়েমানুষ দোকলে ভালো পাড়ায় নিয়ে আসে। ঐ রামখেলাওনই তো আমায়। এখেনে এনে, এইসব আসবাবপত্তর নিজের গাঁটের টাকা দিয়ে কিনে আমায় এ ঘরে বসিয়েচে। আমার রোজগারের আদেক ও পায়!
নবীনকুমার অস্ফুটভাবে বললো, ওর নাম রামখিলাওন?
—সব্বাই তো তাই বলে। ওর কতা শুনে বোজবার উপায়টি নেই যে ও হিন্দুস্থানী! ভারি সেয়ানা লোকটা!
—ঐ রকম লোক আমায় চিনলো কী করে?
—তোমার এমন কেষ্টঠাকুরের মতন রূপ, যে একবার দেকবে, সে-ই মনে রাকবে!
—তোমার আর এখানে থাকা হবে না!
কয়েকদিনের মধ্যেই মৌলা-আলীতে একটি বাসা ভাড়া করে সেখানে সে নিয়ে গেল সুবালাকে। এজন্য রামখেলাওন দালালকে খেসারৎ দিতে হলো সাত শো টাকা। সুবালার জন্য নবীনকুমার পৃথক বাসা ভাড়া করার সঙ্গে সঙ্গেই প্ৰায়, বাতাসে আগুনের মতন ছড়িয়ে পড়লো সে সংবাদ। অনেকেই নিশ্চিন্ত হলো এ খবর শুনে। যাক, ছোঁকরা। তবে এতদিন পর বাজারে মেয়েমানুষকে রক্ষিতা করেছে। এতদিন নবীনকুমারকে অনেকেই ঠিক বুঝতে পারছিল না। ছোঁকরা শুধু দান-ধ্যান বদন্যতা করবে, মহৎ ব্যাপার নিয়ে মগ্ন থাকবে। আর মদ-মেয়েমানুষ করবে না, এ কি হয়?
নবীনকুমার অবশ্য সুবালার অঙ্গ স্পর্শ করেনি একদিনও। দৈবাৎ সুবালার সঙ্গে দেখা হবার পর, সুবালার পূর্ব পরিচয় জেনে তার কাছে সে নিয়মিত আসা শুরু করেছিল একটা বিস্ময় বোধ নিয়ে। বয়সের তুলনায় নবীনকুমার যতই ভারিক্কী ভাব দেখাক, তার ভিতরের শিশুটি যাবে কোথায়? সে প্রথম প্রথম বিশ্বাসই করতে পারেনি যে হালসীবাগানের বিখ্যাত মিত্র পরিবারের এক বধু এরকম বাজারে বারবনিতা হয়েছে। হালসীবাগানের নীলাম্বর মিত্রের বংশ তো অনেকটা নবীনকুমারদের বংশের মতনই মর্যাদাসম্পন্ন। তা হলে কি তাদের পরিবারের কোনো রমণীও কি কার্যকারণের যোগাযোগে এরকম বার-নারী হয়ে যেতে পারতো?
নবীনকুমারের ধারণা ছিল, কলকাতার পণ্যা স্ত্রীলোকেরা প্রায় সকলেই পশ্চিম দেশীয়। শুধু তার একার নয়, এরকম ধারণা অনেকেরই। নিজের সমাজের রমণীরাও যে জীবিকার জন্য এই আদিম পেশা গ্রহণ করে, তা পুরুষরা স্বীকার করতে চায় না। সেই জন্য অন্য সমাজের ওপর দায় চাপিয়ে নিশ্চিন্ত থাকে এবং ভোগেও কোনো গ্রানি থাকে না। এইসব স্ত্রীলোকরাও নিজেদের কদর বাড়াবার জন্য পশ্চিমা বলে পরিচয় দেয় নিজেদের। হয়তো মুর্শিদাবাদ থেকে আগত কোনো সাধারণ পাঁচপেঁচি ঘরের বউ, সে-ও তালতলায় ঘর ভাড়া নেবার পর বাবুদের বলে, মুই লকনৌ থেকে এয়েচি গো, খোদ লকনৌ থেকে। লাচ জানি। দেকবে?
সুবালাকে বারবার জেরা করে নবীনকুমার নিশ্চিন্ত হয়েছে যে এই রমণীটি সত্যিই বিখ্যাত নীলাম্বর মিত্রের এককালের পুত্রবধূ। এর বিবাহে নবীনকুমার নিমন্ত্রণ খেয়ে এসেছিল। সেই কারণেই সুবালার শরীর ভোগ করার প্রবৃত্তি হয়নি কোনোদিন তার। সেই বিবাহ সভার সন্ধ্যাটির কথা স্মরণ করলেই তার শরীর শিহরিত হয়ে ওঠে। কত গণ্যমান্য ব্যক্তি উপস্থিত ছিলেন সেদিন, বিধবাবিবাহের মতন একটি মহৎ ব্যাপারে অংশ গ্ৰহণ করে তাঁরা নিশ্চয়ই শ্লাঘা বোধ করেছিলেন। কিন্তু সেই মেয়েটির ভবিষ্যৎ জীবন সম্পর্কে কারুরই কোনো দায়িত্ব নেই। আর নীলাম্বর মিত্তির নিজে? ক্ষয় রোগী পুত্রের সঙ্গে এক বিধবা কন্যার বিবাহ দিয়ে সমাজের কাছ থেকে বাহবা নিলেন, আর পুত্রের মৃত্যুর পরই নির্লজ্জভাবে বিদায় করে দিলেন সেই পুত্রবধূকে? নীলাম্বর না বাগাড়ম্বর?
নবীনকুমারের ইচ্ছে হয় নীলাম্বর মিত্তিরকে একদিন ঘাড় ধরে টেনে আনে সুবালার কাছে। কিন্তু তা সম্ভব নয়, নীলাম্বর মিত্তিরের প্রতিষ্ঠাও যথেষ্ট। প্ৰতিশোধ নেবার জন্য হাত নিশপিশ করে নবীনকুমারের। তারপর তার মনে পড়ে, প্রতিশোধ নেবার একটি মোক্ষম অস্ত্ৰ তো তার হাতেই আছে। আবার সে লিখতে শুরু করে হুতোম প্যাঁচার নক্সা। এই সব বাগাড়ম্বর মিত্তিরদের প্রকৃত স্বরূপ উদঘাটিত করে দেবে সে, দেশবাসী এদের চিনুক।
নবীনকুমার না চাইলেও সুবালা প্রায়ই নানারকম ছলাকলা দেখিয়ে নবীনকুমারকে আকৃষ্ট করার চেষ্টা করে। নেশাটি বেশ জমে ওঠার পর তার শরীর কোন পুরুষের শরীর চায়। নবীনকুমার চেষ্টা করেও সুবালার নেশার অভ্যেস ছাড়াতে পারে নি। মমস্তিক সত্যটি হচ্ছে এই যে ভদ্র পরিবারের কন্যা, উচ্চ পরিবারের বধূ সুবালা, কিছু লেখাপড়াও শিখেছে, বইপত্র পাঠ করেছে। যথেষ্ট, তবু মাত্র দুতিন বছরের মধ্যেই সে একেবারে ঝানু বেশ্যা হয়ে গেছে। বাধ্য হয়েই হোক, অন্য যে-কোনো কারণেই হোক, একবার এই পেশা গ্ৰহণ করার পর সবাই অন্যান্যদের চেয়ে যোগ্যতার পেশাধারিণী হতে চায়। এটাই নিয়ম। সুবালা জানে তার আর ফেরার পথ নেই, পতিতা রমণী হয়েই যদি থাকতে হয়। সারা জীবন, তা হলে সে অযোগ্য পতিত হবে কেন?
নেশা তুঙ্গে উঠলে সে নবীনকুমারকে নিজের বক্ষে আহ্বান করে প্রতিদিন। প্রত্যাখ্যাত হবার পর সে রাগে জ্বলে ওঠে, নবীনকুমারকে নিয়ে নিষ্ঠুর কৌতুক করে, তার পুরুষত্ব সম্পর্কে সন্দেহ জানায়। এমনকি নবীনকুমারের গায়ে জিনিসপত্র ছুঁড়ে মারে। স্ফরিতাধরা হয়ে সে বলে, তুমি আমায় দয়া দেকাচো? কে চায় তোমার দয়া? ভারী এলেন আমার দয়াল ঠাকুর রে! আমার রূপ-যৌবন আচে, আমি কারোকে পরোয়া করি না! ভাত ছড়ালে কাকের অভাব কী? তোমার মতন অনেক বড় মানুষের ছেলে এখনো আমার পা চাটতে আসবে!
নবীনকুমার চায় সুবালাকে সুস্থ-স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে। কিন্তু প্রচুর অর্থব্যয় করেও যে একজন পতিতা রমণীকে সমাজে ফিরিয়ে আনা যায় না, এ সত্য তাকে ধীরে ধীরে উপলব্ধি করতে হলো। যদিও এ সত্যটিকে সে মানতে চায় না। তবে কি কৃষ্ণকমলই ঠিক বলেছিল?
সবচেয়ে সহজ ছিল সুবালাকে কোনো তীর্থস্থানে পাঠিয়ে দেওয়া। হিন্দুদের সব তীর্থস্থানগুলিই ঘিরে আছে বড় বড় পতিতাপল্লী। সুবালা যদি সে-রকম কোনো তীর্থে গিয়ে আলাদা বাড়ি ভাড়া করে থাকে এবং স্বেচ্ছায় ধর্মকর্ম নিয়ে জীবন কাটায়, তা হলে তার পূর্ব-জীবন নিয়ে কেউ কোনো প্রশ্ন করবে না। কিন্তু সুবালার একেবারেই ঈশ্বরের ওপর ভক্তি নেই, তীর্থস্থানের নাম শুনলেই যেন তপ্ত কটাহে বেগুনভাজার মতন চিড়বিড় করে! ঝাঁঝালো গলায় বলে, কেন আমি পালাবো? কেন? সবাই আমায় মাংস বেচে টাকা কর্বো, এখেনেই পায়ের ওপর পা তুলে গ্যাট হয়ে বসে থাকবো।
এই সুবালা নবীনকুমারের জীবনের একটা পর্ব। অন্য কেউ সাধারণত এইরকম সমস্যায় স্বেচ্ছায় এতখানি জড়িয়ে পড়ে না। অন্য কোনো ভদ্র সজ্জন সুবালার মতন কোনো রমণীর সন্ধান পেলে দুঃখিত হতেন ঠিকই, কিন্তু মেয়েটি যখন বেশ্য হয়েই গেছে তখন আর কী করা যাবে, এই ভেবে এড়িয়ে যেতেন নিশ্চিত। বড়জোর, অহো আমাদের সমাজের সর্বাঙ্গে কত দুষ্ট ক্ষত এই বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলতেন।
কিন্তু নবীনকুমার সে ধাতুর নয়। যে উদ্যম নিয়ে সে পরিদর্শক পত্রিকা চালাতে চেয়েছিল, প্রায়ই সেই উদ্যম নিয়েই সুবালাকে সুস্থ জীবনে ফিরিয়ে আনতে চায়। মৌলা-আলীর ভাড়াবাড়িটির সদরে সে দুজন চৌবে দ্বারবান বসিয়েছে, সুবালার জন্য নিযুক্ত করেছে দুটি বয়স্ক দাসী। তার আহার, সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের কোনো ত্রুটি রাখে নি। এর ফলে নবীনকুমারের খ্যাতির সৌরভ আরও ছড়িয়ে পড়ছে অবশ্য। লোকে বলাবলি করছে, মহাভারতের নাম করে অত টাকা খর্চা কচ্চেন উনি, আর মেয়েমানুষের জন্য দুদশ টাকা ওড়াবেন না, এ কী হয়! হাত খুলুক, হাত খুলুক, তাতে আরও দু দশটা মাতালের প্রতিপালন হবে।
নবীনকুমারের গৃহেও এই ব্যাপার জানাজানি হয়েছে। সরোজিনী নিভৃতে কাঁদে। গঙ্গানারায়ণ আভাসে-ইঙ্গিতে দু একবার তার কনিষ্টকে নিবৃত্ত করবার চেষ্টা করেছে, কিন্তু নবীনকুমার কান দেয় নি।
মহাভারতের কাজে তিন চার দিন ব্যস্ত থাকে, তারপর এক একদিন সে যায় সুবালার কাছে। গাড়ি থেকে নেমেই সে ওপরের দিকে তাকিয়ে দেখে, দ্বিতলের কোনো গবাক্ষের গরাদি ধরে সুবালা উৎসুক নয়নে তাকিয়ে আছে পথের দিকে। এ যেন বিলাতি কাহিনীর কোনো নায়িকা তার প্রেমিকের প্রত্যাশায় উৎসুক চক্ষে প্রতীক্ষ্ণমানা। কিন্তু এ দেশ বিলাত নয়, এ দেশে কোনো ভদ্র পরিবারের কন্যা অমন জানালার ধারে দাঁড়িয়ে পথচারীদের শরীর দেখায় না। বারবনিতাদেরই এমন করা সাজে।
নবীনকুমারের দীর্ঘশ্বাস পড়ে। অনেক চেষ্টা করেও সে সুবালার এই অভ্যেসটি ছাড়াতে পারছে না। পরীক্ষণেই মনে পড়ে, এ তো সুবালাকে খাঁচায় বন্দী করে রাখা, এমন ভাবেই বা কতদিন চলবে? এরই মধ্যে এক মধ্যরাত্রে কয়েকজন মাতাল হল্লা করে এ বাড়ির মধ্যে জোর করে ঢুকতে চেয়েছিল, দ্বারবানদের সঙ্গে তাদের লাঠালাঠি হয়েছে।
-নবীনকুমারকে দেখতে পেয়েই দ্বিতল থেকে লজ্জাহীনার মতন সুবালা তাকে ডেকে ওঠে। এও ঠিক খাঁচার পাখির ডাকের মতন।
একজন কারুর সঙ্গে পরামর্শ করা দরকার। কিন্তু সে-রকম কে আছে? হরিশ চলে গিয়ে নবীনকুমার একেবারে বন্ধুহীন হয়ে পড়েছে। অনেক ভেবে সে আবার কৃষ্ণকমলকেই খুঁজে বার করলো।
সব শুনে কৃষ্ণকমল কাষ্ঠ হাসি দিয়ে বললো, মেয়েটি দেখতে কেমন? রূপসীই বললে তো? তা বেশ্য যখন হয়েই গিয়েছে, তখন আর তাকে টানাটানি করে কী লাভ? রসিক পঞ্চজন এরকম একটি রূপসী বেশ্যা থেকে বঞ্চিত হবে কেন?
কৃষ্ণকমলের মুখে এরকম সাধারণ ব্যক্তিদের মতন উত্তর শুনে নবীনকুমার ভুরু কুঞ্চিত করে তাকিয়ে রইলো।
কৃষ্ণকমল আবার বললো, এ সমাজে বেশ্যরও প্রয়োজন রয়েছে। তুমি যদি ভোগ করতে না চাও, আটকে রাখবে কেন, রসিকদের জন্য ছেড়ে দাও! মাঝে মাঝে ভদ্রঘর থেকে সাপ্লাই না এলে সুন্দরী রূপসী বারবনিতার ডিমাণ্ড মেটানো যাবে কী করে? চেষ্টা করেও ওকে তুমি বেশীদিন ধরে রাখতে পারবে না।
নবীনকুমার এবার বাঁকা সুরে বললো, তোমার প্রয়োজন আচে নাকি? তুমি তা হলে ওকে একবার দেকে আসতে পারো
কৃষ্ণকমল বললো, না, ভাই, আমার প্রয়োজন আমি অন্যভাবে মিটিয়ে নিয়েছি। শোনো, নবীন, এ সমাজে যুবতী নারীর পতি বিনে গতি নেই। বিধবা হলে এ বাড়ি ও বাড়ির লাথি-ঝ্যাটা খাবে, নয়তো বাজারে গিয়ে নাম লেখাবে। এই তো নিয়তি। তোমার গুরু বিদ্যাসাগর যতই চেষ্টা করুন কিছুতেই কিছু হবে না। দু দশটা বিধবার বিবাহ দিলেই কি তিনি মানুষের মন পাল্টাতে পারবেন? যে জাতি যত বেশীদিন পরাধীন, সে জাতি নৈতিক ভাবে তত বেশী রুগণ।
নবীনকুমার বললো, তা হলে তুমি বলচো, বিবাহ দেওয়া ছাড়া এ মেয়েটির আর কোনো উপায় নেই।
কৃষ্ণকমল বললো, বেশ্যার বিবাহ দেবে, তুমি তো কম নও হে! এ মেয়েটির বিবাহ হবে তার মানে তৃতীয়বার, এমন কথা তোমার গুরুও স্বপ্নে স্থান দেননি! শোনো, তুমি টাকার জোর খাঁটিয়ে কোনো লোকের সঙ্গে জোর করে ওর বিবাহ দিয়ে দিতে পারো, কিন্তু তা কতক্ষণ টিকবে? তুমি নিজে বিবাহ করবে না নিশ্চিত, কারণ তুমি ডবল বিবাহের ঘোর বিরোধী!
নবীনকুমার নিরাশ হয়ে উঠে দাঁড়াতেই কৃষ্ণকমল মুচ্কি হেসে বললো, একটা কথার উত্তর দাও তো? ভদ্রঘরের একজন বধূ ভাগ্য বিড়ম্বনায় বেশ্যা হয়েচে, সেইজন্যই তুমি এত উতলা হয়েচো, তাই না? আর ছোটলোকের ঘরের কত মা-বাউ যে পেটের দায়ে ঘরের বার হয়ে এসে বেশ্যাবৃত্তি করে, তাদের জন্য নিশ্চয়ই তোমার কোনো মাথা ব্যথা নেই। পথে-ঘাটে যারা হাজারে হাজারে ঘুরে বেড়ায়, তাদের দেখোনি কখনো? এই তো তোমাদের দেশোদ্ধার!
কৃষ্ণকমলের কথাই ঠিক হলো। কিছুদিনের মধ্যেই এক সন্ধ্যায় নবীনকুমার মৌলা-আলীতে গিয়ে শুনলো যে পাখি উড়ে গেছে। সুবালা নিজেই পলায়ন করেছে না অপর কোনো পুরুষ তাকে হরণ করে নিয়ে গেছে, তা অবশ্য বোঝা গেল না। দ্বারবানদ্বয়কে তর্জন গর্জন করায় তারা স্বীকার করলে বটে যে কয়েকদিন ধরে এক সুদৰ্শন বাবু এ বাড়ির সামনে দিয়ে অনেকবার যাতায়াত করেছে।
নবীনকুমার বিশেষ আশ্চর্য হলো না। গত এক মাস ধরে সুবালা তার জীবন বিষময় করে তুলেছিল, দেখা হলেই তাকে নপুংসক বলে গালিগালাজ করতো। পুরুষের সাহচর্যহীন তথাকথিত সুস্থজীবনে সুবালা ফিরে যেতে চায় না। সুবালার অনুসন্ধান করে আর কোনো লাভ নেই বলে নবীনকুমার মৌলা-আলীর বাড়িটির পাট তুলে দিল শীঘ্রই।
সুবালা-পর্বটি নবীনকুমারের জীবনে সংক্ষিপ্ত হলেও বেশ একটি বড় দাগ রেখে গেল।