মুক্তিযুদ্ধ নারীকে কী দিয়েছে
আমি চোখ বন্ধ করে ছিলাম। গা হাত পা ঢিলে করে ঘুমের মত পড়ে ছিলাম বিছানায়। একটি টর্চের আলো আমার মুখের ওপর পড়ল প্রথম, আলো ও মুখের ওপর রেখেই ওরা নিজেদের মধ্যে কথা বলল—কী কথা বলল আমি বুঝতে পারিনি, ওদের ভাষা ছিল উর্দু।
আমি তখন জানি না ওরা বাড়ির সদর দরজার কাছে একটি নারকেল গাছের সঙ্গে আমার বাবাকে পিঠমোড়া করে বেঁধে রেখেছে। আমি তখনও জানি না আমার মা বাড়ির উঠোন পেরিয়ে চলে গেছেন অন্য আশ্রয়ে। ওরা এসেছে এই দুঃসংবাদ আমার কাছে আগে পৌঁছেনি। আমি কেবল বারান্দা ধরে হেঁটে আসা চার জোড়া বুটের শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম এবং ভিন্ন ভাষার কথোপকথন আমাকে—যদিও আমার বয়স অল্প, এইটুকু বুঝিয়ে দিল—ভীষণ এক দুর্ঘটনা ঘটছে আজ। আজ আমাদের বড় দুঃসময়। আমার বয়স অল্প বলেই আমাকে উঠোনের অন্ধকার পেরিয়ে পাড়া-পড়শির ঘরে উঠতে হয়নি। অচেতন পড়ে থাকতে হয়েছে দক্ষিণের ঘরের একটি পুরনো পালঙ্কে। বুটের শব্দ এক সময় আমার ঘরে এসে থামল। পাশে আমার ছোট বোন ঘুমোচ্ছিল। শব্দগুলো ঘরের মধ্যে পুরো চক্কর দিয়ে আমার শিয়রের কাছে এল। আমি সেই প্রথম অভিনয় করলাম ঘুমের, যেন ঘুমিয়ে আছি, আমি কিছু শুনছি না, আমি কিছু দেখছি না, আপনারা যা ইচ্ছে তাই করুন, ঘুমের মানুষকে জাগাবেন না। ওরা আমার মুখে টর্চ ফেলল, আলো পড়লে চোখ কেঁপে ওঠে, আমার কেপেছিল কি না জানি না।
ওরা আলোর নিচে কী দেখছিল—আমার বয়স? বয়স পছন্দ হয়নি বলে ওরা ঘুরিয়ে নিল আলো, পাশের বিছানায় ছিল রেহেলে রাখা খোলা কোরান শরীফ, কোরান শরীফের ওপর মা’র হাতের দুটো অনন্ত বালা। ওরা মা’র অনন্ত বালা নিল, ঘরের আলমারি খুলে আমাদের সোনা রুপা যা পেল, নিল। ওরা কথা বলছিল, হাসছিল, আমার মাঝে মধ্যে মনে হয় ওরা আমার বয়সের জন্য নিশ্চয় দুঃখ করছিল। বয়স কেন আমার আরও খানিকটা বেশি হল না!
আমি স্থবির পড়ে ছিলাম বিছানায়। ওদের ক্রুর হাসি, ওদের বিদঘুটে ভাষা, ওদের ভয়ঙ্কর বুট আমাকে আশ্চর্য স্থবিরতা দিয়েছিল, আমি এখনও শীতল এক সাপ দেখি আমার শরীর বেয়ে উঠছে। আমার যদি আরও খানিকটা বয়স বেশি হত ! ওই একটি অন্ধকার ঘরে, ওই একটি ভয়ার্ত শ্বাস স্তব্ধ করা রাতে আমার যদি বয়স হত পনেরো ষোল সতেরো আঠারো উনিশ ।
ওরকম বয়স ছিল না-কি কারও? ছিল। ওরকম বয়সের কারও বাড়িতে মধ্যরাতে অতর্কিতে আক্রমণ কি হয়নি? তা-ও হয়েছে। তুলে নিয়ে গেছে ওরা অগণন তরুণীকে। ওদের বিকৃত লালসার শিকার আমার খালা, আমার পড়শি বোন, আমার চেনা, অল্পচেনা, অচেনা আত্মীয় অনাত্মীয়। এ কথা নতুন নয়। সকলেই জানে। জানে একাত্তরে এদেশের নারীর উপর পাকিস্তানি বর্বর সৈন্যদের অবাধ ধর্ষণের খবর। জানে, কেবল জানেই, আর কিছু নয়।
এত বড় একটি যুদ্ধ ঘটে গেল দেশে। এত হত্যা, গণহত্যা, এত লুঠ, ধর্ষণ ঘটল—তবু ধর্ষণের সংজ্ঞা বদলাল না। একটি ধ্বংসস্তুপের ওপর দাঁড়িয়ে মানুষ যখন নিঃস্ব, পঙ্গু, সর্বস্বাস্ত, স্বজন হারানোর বেদনায় নীল—সেই মানুষই তখন ধর্ষিতার দিকে পুরনো চোখে তাকাল, পুরনো আঙুলই তুলল। হায়, মুখ বাঙালি! হায় দুর্ভাগা, দুশ্চরিত্র, দুর্গত বাঙালি!
যে দেশে এমন এক মুক্তিযুদ্ধ ঘটে, যে মুক্তিযুদ্ধে এমন অবাধ নরহত্যা হয়, অবাধ নারী-ধর্ষণ হয়—সে দেশে ধর্ষণের সংজ্ঞা কেন নতুন কিছু হয় না? সে দেশে ধর্ষণ কেন বুট ও বেয়নেটের অত্যাচারের মত এক ধরনের অত্যাচার বলে বিবেচিত হয় না? কেন ধর্ষিতাদের জন্য সামাজিক স্বীকৃতির অভাব হয়? কেন ধর্ষণ গ্রহণীয় হয় না আর দশটা অত্যাচার যেমন সমাজে গ্রহণীয়?
মুক্তিযুদ্ধ যদি আমাদের নতুন একটি বোধের জন্ম না দিতে পারে, তবে কী পেরেছে দিতে—যা নিয়ে আমরা বিজয় দিবসের উৎসব করি, স্বাধীনতা দিবসের আনন্দে আলোকসজ্জায় মেতে উঠি, চেতনার ভেতরে গাঢ় এক অন্ধকার রেখে এই আলোকসজ্জা আমাদের সামান্যও কি আলোকিত করে?
একটি যুদ্ধই পারে যুদ্ধের সকল ক্ষতি মেনে নেবার সাহস ও শক্তি জোগাতে। একটি যুদ্ধই পারে যুদ্ধের সকল ভাঙন জয় করে জয়ের পতাকা ওড়াতে। আমরা পতাকা উড়িয়েছি ঠিকই, আমরা দেশ থেকে উটকে বর্বরদের দূর করেছি ঠিকই কিন্তু সমাজের নষ্ট ও নোংরা সংস্কার দূর করতে পারিনি—যে সংস্কার একাত্তরের কোনও অত্যাচারিত তরুণীকে ক্ষমা করেনি এবং দীর্ঘ কুড়ি বছর পর এখনও তাদের ক্ষমা করবার ক্ষমতা অর্জন করেনি।
আবার একটি মুক্তিযুদ্ধের অপেক্ষা করতে হবে—আবার অপেক্ষা করতে হবে দেশজোড়া তুমুল তাণ্ডবের–আবার আমাদের অপেক্ষা করতে হবে অগণন মৃত্যুর। আর কত মৃত্যু, কত ভাঙন, কত ধর্ষণ এদেশে ঘটলে ধর্ষিতারা মুখ তুলে দাঁড়াতে পারবে সমাজের কাঠগড়ায় এবং ঘৃণায় উচ্চারণ করতে পারবে অসভ্য পুরুষের নাম! এক যুদ্ধে আমরা মন ও মানসিকতার উত্তরণ ঘটাতে পারিনি, এক যুদ্ধে আমরা অর্জন করতে পারিনি সত্য ও সুন্দরের পক্ষে যাবার সামান্যও দুঃসাহস। আর কত যুদ্ধের দরকার এদেশে? আর কত মৃত্যুর?
বছর ঘুরে এদেশে বিজয়ের উৎসব হয়। আনন্দে নেচে ওঠে পুরো দেশ, দুঃসহ দুঃশাসনে ক্লিষ্ট তৃতীয় বিশ্বের এক হতভাগ্য দেশ। ডিসেম্বরের ষোল তারিখের প্রতিটি শীতার্ত সকালে খোলা বারান্দায় দাঁড়িয়ে আমি নগরীর উৎসব দেখি আর আমার সারা শরীরে হেঁটে যায় শীতল একটি সাপ। চোখ বুজলেই টের পাই শরীরে টর্চের আলো। ওরা আমার বয়স মাপছে। নগরীর এই অশ্লীল উৎসবের প্রতি ঘৃণায় আমার দুচোখ ফেটে কান্না নামে। কে আছে আমার এবং আমার মত অগণন নারীর কান্না থামায়? আছে কোনও আইন এবং সংস্কার এদেশে? মুক্তিযুদ্ধ অনেককে অনেক কিছু দিয়েছে, নারীকে দিয়েছে কী?