দর্জির স্পর্শ
বড় হবার পর, একটি মেয়ে যতই রেডিমেড পোশাক পরুক না কেন, দর্জির কাছে মাঝেমধ্যে তাকে যেতে হয়, হয়ত কিছু কাপড় কেনা হল অথবা কেউ দিয়ে গেল—সেই কাপড় নিয়ে ঘরে সেলাই মেশিন না থাকলে দর্জি অবধি যেতেই হয়। আর যারা রেডিমেড তেমন পছন্দ করে না, তারা সচরাচর যায়ই, আবার শাড়ি পরতে অভ্যস্ত মেয়েরাও শাড়ির ব্লাউজ পিস নিয়ে সেলাইয়ের জন্য দর্জির দোকানে যায়। সব মেয়েরই কিছু না কিছু দর্জি-অভিজ্ঞতা আছে। দর্জি মাপ নেয়, মাপ লেখে, কাপড়ের কোণা কেটে স্লিপে স্টেপল করে। দর্জি কিন্তু আরও কিছু করে।
দর্জি আরও যা করে তা শুধু মেয়েরাই জানে, মেয়ের একথা কারুকে বলে না, কারণ এ বড় লজ্জার কথা, এ কোনও বলবার কথা নয়। দর্জি একটু আড়ালে বা নিভৃতে দাঁড়িয়ে একটি ফিতে দিয়ে হাতের মাপ, গলার মাপ, কোমরের মাপ, নিতম্বের মাপ এবং বুকের মাপ নেয়। এই মাপ দিতে গিয়ে মেয়েরা একটি সমস্যার প্রায়ই মুখোমুখি হয়, তা হল বুকের মাপ নিতে গিয়ে পুরুষ দর্জিরা মেয়ের বুকে অশোভন কিছু করে; ফিতে দিয়ে মাপ নিতে গেলে শরীরে আঙুল স্পর্শ করবার কথা নয়, কিন্তু খুব কম দর্জিই এই স্পর্শ করা থেকে নিজেকে বিরত রাখে। দর্জির কাছে কাপড় তৈরি করে অথচ এই স্পর্শ এবং চাপের যন্ত্রণা ভোগ করেনি—এমন মেয়ে খুব কমই আছে এদেশে।
পুরুষের নানা রকম বিকৃতি আছে, এটিও একরকম বিকৃতি। দিনে ত্রিশটি জামা বা ব্লাউজের মাপ রাখতে গিয়ে সে ত্রিশটি স্তন স্পর্শ করবার সৌভাগ্য অর্জন করে—পুরুষেরা এই সংখ্যাধিক্যকে সৌভাগ্য বলেই মনে করে। নিজেদের বিকৃত আঙুলকেই সুখের বাহক বলে জানে।
পুরুষের লজ্জা নেই, সে একটি অবৈধ এবং অভব্য কাজ অবলীলায় করে যায়, এ দেখে লজ্জা হয় উল্টে নারীরই। সে লজ্জায় লাল হয়, সে অপমানে নীল হয়, সে ক্ষোভে বেগুনি হয়। মেয়েদের কেবল মুখের রঙ বদলই হয়, এই নানা বর্ণ নিয়ে তার নির্বাক প্রস্থান ছাড়া অন্য কিছু সাধারণত ঘটে না। অথচ দোষী ব্যক্তিই মনে মনে তুড়ি বাজিয়ে হেসে ওঠে।
সেদিন এক দোকানে কিছু কেনাকেটা করতে গিয়ে দেখি পাশের দর্জির দোকানে হঠাৎ কোলাহল হচ্ছে ভিড় সরিয়ে দেখি একটি পচিশ ছাব্বিশ বছরের মেয়ে দর্জির নাক বরাবর কাটা ঘুসি দিয়েছে। দর্জি চুপ, মেয়েটি বলছে কেন মেরেছি সে আমাকে নয়, তাকেই জিজ্ঞাসা করুন। মেয়েটি যে কাপড়ের জন্য মাপ দিচ্ছিল, সেটি উঠিয়ে নিয়ে চলে গেল। না, কাপড় কাটায় বা সেলাইয়ে কোনও ক্রটি হয়নি, মেয়েটি প্রথম বানাতে এসেছে জামা। সে মাপ দিচ্ছিল শরীরের, দর্জি বুকের মাপ নিতে গেলেই ঘুসিটি এসে দর্জিকে হকচকিয়ে দেয়। আমি মেয়েটিকে মনে মনে সাব্বাস বলেছি।
মেয়েদের বলছি, এটি বড়সড় কোনও সমস্যা নয় হয়ত, কিন্তু এটি সমস্যা। এইসব স্পর্শে শরীরের কোনও ক্ষয় হয় না। কিন্তু এই অবাঞ্ছিত স্পর্শ বা চাপ আপনি গ্রহণ করবেন কেন? আপনি প্রতিবাদ করুন, মুখের প্রতিবাদে কেবল লোকই জড়ো হয়, এতকাল যা হয়ে এসেছে—তাতে লাভ কিছু হয় না। আপনি জুতসই আঘাত করুন, তাতে মানুষ জানবে মেয়েরাও আঘাত করতে জানে, মেয়েরা চড়, লাথি, ঘুসি ইত্যাদিও ছুড়তে জানে, যে কাজগুলো কেবল ছেলেদের জন্যই ছিল বাধা। এগুলো জায়গা মত ছুঁড়তে শিখলে নানারকম অবাঞ্ছিত স্পর্শ চাপ, ঢিল, থুথু, ধাক্কা ইত্যাদির মীমাংসা হবে। সমাজ আপনা-আপনি বদলে যায় না, একে বদলাতে হলে এখন নিজেদেরও এরকম এগিয়ে আসতে হবে। যে কোনও অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে শিখতে হবে। এ হয়ত ক্ষুদ্র এক অন্যায়, অনেকে বলবে কত বড় বড় অন্যায় হচ্ছে দেশে, নির্যাতন হচ্ছে, আগে সেসব সামলাও–বড় অন্যায় দূর হলে ছোট অন্যায়ের সাধ্য আছে থাকে?
না, কোনও অন্যায়কে ভদ্রতা করে এড়িয়ে যাওয়া, অথবা অপরাধীকে লজ্জিত হতে না দিয়ে নিজে লজ্জা পাওয়া, অথবা সকল নির্যাতনের জন্য মনে মনে সমাজ ব্যবস্থাকে দোষ দিয়ে মাথা নিচু করে সরে যাওয়া মেয়েদের জন্য আর উচিত নয়। মেয়েরা এখন ঘুরে দাঁড়াতে শিখুক, গায়ে কোনও ঢিল বা অশ্লীল উক্তি যদি কেউ ছুঁড়ে দেয়, যা অহরহই ছুঁড়ে দিচ্ছে, যে কোনও বয়সের মেয়ের দিকে যে কোনও বয়সের পুরুষ—মেয়েরা যেন ঘুরে দাঁড়ায়, অবিনীত, ধৃষ্ট এবং উদ্ধত। মেয়েরা এখন ছোবল দিতে শিখুক।
ঘুরে দাঁড়াবার অভ্যেস মেয়েদের নেই। তারা পথ-চলতি সকল বিপদ বাড়ি অবধি বহন করে নিয়ে যায়, সকল কিছুর জন্য নিজেকে অথবা নিয়তিকে দোষী করে এবং কাঁদে। মেয়েদের সকল ক্ষোভ মেয়েরা কেঁদে গলিয়ে ফেলে। ক্ষোভগুলোকে জমাট বেঁধে বেঁধে বিস্ফোরণে রূপ নিতে দেয় না। অথচ এখন বিস্ফোরণ দরকার। কোনও বিস্ফোরণ ছাড়া টনক নড়বে না কারু। এখন সকলের ভোতা চেতনায় লক্ষ্যভেদী ঢিল ছুড়তে হবে—আর এ দায়িত্ব যত বেশি মেয়েদের, তত আর কারুর নয়।