ধর্মের শৃঙ্খল থেকে বেরিয়ে না এলে নারীর মুক্তি অসম্ভব
সভ্যতার শুরু থেকে সমাজ ও ধর্ম মানুষকে পরিচালিত করেছে, আর সমাজ ও ধর্মের পরিচালক হিসেবে যুগে যুগে পুরুষরাই কর্তৃত্ব করেছে। সমাজ ও রাষ্ট্র তো বটেই, নারীকে সবচেয়ে বেশি অমর্যাদা করেছে ধর্ম। কোনও ধর্মের আশ্রয়ে নারীর ওপর অত্যাচার যখন অসহনীয় হয়ে ওঠে, তখন কিছুটা সহনীয় করে বিধিনিষেধ আরোপ করবার জন্য নতুন ধর্মের আহ্বান আসে। বৌদ্ধ ধর্মের শুরুতে নির্যাতনের হাত থেকে বাঁচবার তাগিদে লক্ষ লক্ষ নারী ভিক্ষুণী সংঘে আশ্রয় নিয়েছিল। জার্মান সমাজবিজ্ঞানী আগুস্ট বেবেল তার উওম্যান ইন দ্য পাস্ট, প্রেজেন্ট অ্যান্ড ফিউচার গ্রন্থে লিখেছেন–খ্রিস্টধর্মের আবির্ভাব হলে অন্য সব দুর্ভাগাদের মত নারীরাও তাদের দুরবস্থা থেকে পরিত্রাণের জন্য এই ধর্মের প্রতি খুব আগ্রহী ও অনুরক্ত হয়ে পড়ল। কিন্তু খ্রিস্টধর্ম নারীর জীবন থেকে দুর্দশা দূর করতে পারেনি। এই ধর্ম নারীকে পুরুষের বশবর্তী হয়ে থাকতে বাধ্য করল। ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল বলেছেন– ‘জেসাস ক্রাইস্ট নারীর অধিকার বলতে কিছু দেননি। দাসীবৃত্তি ছাড়া নারীর আর কোনও কাজই সমাজে ও ধর্মে নির্দেশিত হয়নি।‘
সামাজিক ও ধর্মীয় রীতিনীতির অত্যাচারে বহু নারী ধর্মান্তরিত হয়েছে। হিন্দু ধর্ম থেকে ব্রাহ্ম ধর্ম গ্রহণ করেছে। ইসলাম ধর্মে শিশু হত্যা নিষিদ্ধ, স্ত্রীর মোহরানা, খোরপোষ বাধ্যতামূলক হওয়ায় অনেকেই এই ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছে। কিন্তু কোনও ধর্মই নারীকে মানুষের সন্মান দেয়নি।
বিজ্ঞানের যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে এবং ভ্রণের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশের পদ্ধতি সম্পর্কে সম্পূর্ণ জ্ঞান অর্জন করেও আমরা মানুষের অস্থি থেকে মানুষের উৎপত্তি বিষয়ক বিশ্বাস নিমূল করতে পারি না। ধর্ম নারীকে বিনিময় পণ্য হিসেবে, দামি সামগ্ৰী হিসেবে, মূল্যবান দাসী হিসেবে চিহ্নিত করেছে। ধর্মগ্রন্থে লেখা—‘দুনিয়ার সব কিছু ভোগের সামগ্ৰী আর দুনিয়ার । সর্বোত্তম সামগ্রী হচ্ছে নেক চরিত্রের স্ত্রী।‘
মেডিকেল জুরিসপ্রুডেন্স বলে—কোনও পুরুষ যদি অনুমতি নিয়েও পনেরো বছরের কম বয়সের কোনও নারীর (সে স্ত্রীও হতে পারে) অথবা অনুমতি ছাড়া পনেরো বছরের বেশি বয়সের । কোনও নারীর অথবা অনুমতি ছাড়া নিজ স্ত্রীর যোনিমুখ তার যৌনাঙ্গ দ্বারা স্পর্শমাত্র করে, তবেই ধর্ষণ সংঘটিত হয় এবং ধর্ষণ আইনত একটি অপরাধ। কিন্তু তিরমিজি হাদিস শরীফে স্পষ্ট লেখা আছে ‘যদি কোনও ব্যক্তি সঙ্গম করার ইচ্ছায় স্ত্রীকে আহ্বান করে তবে সে যেন তৎক্ষণাৎ তার নিকট উপস্থিত হয়—যদিও সে উনানের উপর (রন্ধনের কাজে লিপ্ত) থাকে।‘ এক্ষেত্রে স্ত্রীর অনুমতি কোনও বিচার্য বিষয় নয়। মুসলিম হাদিস শরীফে লেখা—‘যখন কোনও ব্যক্তি নিজের স্ত্রীকে তার শয্যার দিকে আহ্বান করে, তাতে সে অস্বীকার করার জন্য যদি স্বামী রাগান্বিত অবস্থায় রাত কাটায় তবে প্রভাত না হওয়া পর্যন্ত ফেরেশতাগণ সেই স্ত্রী লোকের প্রতি অভিসম্পাত করে।‘ নারী কত ঘৃণ্য হলে, কত নিকৃষ্ট হলে এই বাক্য উচ্চারিত হতে পারে যে, যে স্ত্রী লজ্জাহীনতার কাজ করে তাকে আপন বিছানা থেকে পৃথক করে দাও এবং এইরূপ স্ত্রীকে সাধারণভাবে কিছু মারপিট কর।’ (তিরমিজি)
ধর্ম নারীকে দাসত্বের শৃঙ্খলে বেঁধেছে, ধর্ম নারীকে পুরুষের ভোগের সামগ্ৰী ছাড়া মানুষ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি তাই ‘যদি স্বামী স্ত্রীকে আদেশ করে, তবে সে জরদ পর্বত থেকে কালো পর্বতের দিকে এবং কালো পর্বত থেকে সাদা পর্বতের দিকে ধাবিত হোক, তথাপি স্বামীর আদেশ প্রতিপালন করা তার কর্তব্য।‘ (আহমদ)
আমাদের দেশে নামাজ, রোজা, ধর্মোৎসব ইত্যাদি বেশ ঘটা করে পালন করা হয়, কিন্তু ধর্মগ্রন্থ এবং নানা ধর্মীয় পুস্তক সম্পর্কে বিশদ কোনও আলোচনা হয় না। হওয়া উচিত। ধর্মচর্চা সঠিকভাবে হলেই দেশসুদ্ধ ধর্মব্যবসার প্রসার যেমন কমবে, তেমনি ধর্মীয় কুসংসারাচ্ছন্ন মানুষের সংখ্যাও হ্রাস পাবে।
নারী তো মানুষ নয়। ‘নারী শস্যক্ষেত্ৰ। তোমরা তোমাদের ইচ্ছেমত সেই শস্যক্ষেত্রে চাষাবাদ কর।‘ সূরা বাকারার ২২৩ আয়াত থেকে এই অনুমতি পেয়ে হযরত মুহম্মদ (সাঃ) বলেছিলেন–‘স্বামী স্ত্রী যদি উটের পিঠের উপর একই হাওদায় ভ্রমণ করতে থাকে আর সেই অবস্থায় যদি স্বামী তার সঙ্গে সঙ্গম করার ইচ্ছে প্রকাশ করে তাতেও স্ত্রীর কোনরূপ আপত্তি করা চলবে না। স্বামীর বিনা অনুমতিতে নফল রোজা রাখা স্ত্রীর পক্ষে জায়েজ নয় এবং স্বামীর বিনা অনুমতিতে স্বামীর বাড়ি থেকে কোথাও যাওয়া বা কোনও জিনিস কাউকে দেওয়া সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। যদি কেউ এ নির্দেশ অমান্য করে তবে ফেরেশতাগণ তার প্রতি অভিসম্পাত বর্ষণ করে।
নারী একটি মাংসপিণ্ড মাত্র, যে মাংসপিণ্ড নিয়ে পুরুষ খেলা করে, এবং তার খেলার আনন্দের জন্য মাংসপিণ্ডটিকে নানা রকম আকার ধারণ করতে হয়। নারী কতটা নিরেট মাংসপিণ্ড হলে হযরত আলী (রাঃ) বলতে পারেন যদি কোনও স্ত্রীলোক নিজের একটি স্তনের দ্বারা কাবাব ও অপর স্তনের দ্বারা কালিয়া প্রস্তুত করে স্বামীর সম্মুখে উপস্থিত করে, স্বামী যদি তাতেও তার প্রতি সন্তুষ্ট না হয়, তবে সেই স্ত্রীলোক যতই পুণ্যবতী হোক না কেন, সে দোজখে নিক্ষিপ্ত হবে।’
বিংশ শতাব্দীর শেষ প্রান্তে এসে রূপ কানোয়ারকে চিতার আগুনে নিক্ষেপ করে আমাদের পুরুষেরা সতীদাহের মজা লুটেছে। স্বামীর পদতলে স্ত্রীর বেহেস্ত জাতীয় তসবিহ জপে সমাজ, ধর্ম ও রাষ্ট্র দ্বারা অত্যাচারিত নির্যাতিত নারীদের মনে রাখতে হয় ধর্মের পবিত্র বাণী—‘আমি যদি কোনও ব্যক্তির ওপর কারও জন্য সিজদা করার আদেশ প্রদান করতাম, তবে প্রত্যেক স্ত্রী লোককে আদেশ করতাম যে সে যেন তার স্বামীকে সিজদা করে। যেহেতু আল্লাহ তায়ালা স্ত্রী লোকদের উপর স্বামীর হক নির্ধারিত করে দিয়েছেন।‘ (আবু দাউদ)
সতেরো দশক থেকে পৃথিবীতে নারী আন্দোলনের শুরু। ইউরোপ আমেরিকায় সেই আন্দোলন কিছুটা সফল হলেও এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকায় সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে যে হারে নারী নির্যাতিত হচ্ছে তাতে পুরো সমাজব্যবস্থা, রাষ্ট্রীয় কাঠামো পরিবর্তন ছাড়া যেমন নারীর মুক্তি নেই, তেমনি ধর্মের শৃঙ্খল থেকে বেরিয়ে আসা ছাড়াও নারীর মুক্তি অসম্ভব।