অনৈসলামিক কার্যকলাপ প্রতিরোধ কমিটি
নারায়ণগঞ্জের ‘অনৈসলামিক কার্যকলাপ প্রতিরোধ কমিটি’ বেশ একটা কাণ্ড করছে বটে। তারা পতিতাদের উচ্ছেদ চাইছে। ‘উচ্ছেদ’ অর্থ যদি উৎপাটন বুঝি, উন্মূলন বা বিনাশ বুঝি তবে আমিও মিছিলে নামব, আমি শ্লোগান দেব, আমিও অনৈসলামিক কার্যকলাপ কমিটির অন্যতম সদস্য হব। কিন্তু এই উচ্ছেদ অর্থ যদি স্থানচ্যুতি হয়, যদি এক স্থান থেকে একই রকম আরেক স্থানে নিতে হয় তবে আমি প্রতিরোধ কমিটির সকল কার্যকলাপ সবলে রোধ করতে চাই।
‘পতিতা’ শব্দের অর্থ ভ্ৰষ্টা, কুলটা ও কুচরিত্রা এবং ‘পতিত’ শব্দের অর্থ ভ্ৰষ্ট, স্থলিত, অধোগত, পাপী ও কুচরিত্র। দেশে ‘পতিতা’র চেয়ে ‘পতিত’র সংখ্যা কম নয় বরং বহুগুণে বেশি। অথচ পতিতাদের চিহ্নিত করবার ব্যবস্থা আছে, যেমন নির্দিষ্ট একটি বাড়ির মধ্যে তাদের জড়ো করা হয়। আর পুরুষ পতিতরা থাকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে, তাদের পতিত হিসেবে চিহ্নিত করবার কোনও ব্যবস্থা নেই। গোয়ালের গরুর নামও গরু, ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মাঠ-ঘাটের গরুর নামও গরু। সুতরাং সমাজে বাস করে বলে এবং খাতায় নাম রেজিস্ট্রি হয়নি বলে ‘পতিত’রা যে ‘পতিত’ নয়, তা নয়; ‘পতিত’ পতিতই। আমরা কেবল তাদের পতিত বলে ডাকি না। কারণ ডাকবার চল নেই।
চল তো অনেক কিছুরই থাকে না। আগে তো মেয়েদের লেখাপড়া করবারই চল ছিল না, এখন চল হয়েছে। আচলেরও প্রচলিত হতে দেরি হয় না। দেশে লক্ষ লক্ষ পতিত রেখে পতিত শব্দটিই যোগ্য পুরুষের জন্য প্রচলিত হচ্ছে না, (যেমন পতিতা শব্দটি নারীর বেলায় প্রচলিত) এ কি কম দুঃখ! ‘পতিত’ কোথায় নেই? অফিসে, আদালতে, খবরের কাগজে, জাহাজে, লঞ্চে, কলে-কারখানায়—কোথায় নেই?
সর্বত্র বিরাজমান ‘পতিত’ পুরুষদের ‘পতিত’ বলবার রীতি শুরু হোক আজ থেকে। ‘পতিত’দের চিহ্নিতকরণ এসময় খুব জরুরী। কারণ ‘পতিত’রা নির্মুল না হলে ‘পতিত’ জন্মাবেই। মূলত ‘পতিত’র স্বার্থেই ‘পতিতা’র প্রয়োজন হয়।
‘পতিত’রা সমাজে ঘোরাফেরা করে। তারা তাদেরই স্বার্থে পতিতা পল্লীগুলো বাঁচিয়ে রাখে। আর দোষ হয় কেবল পতিতার, পতিত’র নয়। অনৈসলামিক কার্যকলাপ প্রতিরোধ কমিটি পতিতা উচ্ছেদ চাইছেন, পতিতারা তা হতে দিচ্ছে না। সরকার যদি পতিতাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা না করেন, তবে পতিতরা এই পতিতাদের এক স্থান থেকে আরেক স্থানেই কেবল সরাবে, স্থানান্তর ছাড়া কোনও উৎপাটন বা বিনাশ ঘটবে না। তাই উদ্যোগী হতে হবে সরকারকে। সরকার যদি পতিত না হন, উদ্যোগী হবেন। উদ্যোগী হবেন পতিতাদের সামাজিক পুনর্বাসনে। আর এই প্রতিরোধ কমিটিকে কেবল অনৈসলামিক নামেই সন্তুষ্ট হওয়া উচিত নয়। ‘অমানবিক কার্যকলাপ প্রতিরোধ কমিটি’ নামেও মিছিলে নামতে হবে।
সামাজিক পতিত-পুরুষেরা চিরকালই পতিতা উচ্ছেদ বা পুনর্বাসনের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সরকার শিশু-পতিতা উদ্ধারের মহত্ত্ব দেখিয়েই উচ্ছেদ অভিযান স্তিমিত করে। কেউই পতিতা-প্রথার উৎপাটন, উন্মলন বা বিনাশ চায় না। নারায়ণগঞ্জে গাড়ি পুড়েছে, পুলিশ আহত, উচ্ছেদ কমিটির সদস্যরা গ্রেফতার হচ্ছে—শেষ অবধি হবে কি? পতিতা প্রথার বিলুপ্তির জন্য আন্দোলন কতদূর অগ্রসর হবে?
জানি, খবর বেরোবে—আন্দোলন থিতিয়ে আসছে। প্রতিরোধ কমিটি তাদের দাবি তুলে নিয়ে প্রশাসনের সঙ্গে আপস করেছে। প্রশাসন যদি পতিতাবৃত্তি টিকিয়ে রাখতে চায়, তবে পতিতাদের এবং কোনও প্রতিরোধ কমিটির কি শক্তি আছে ‘পতিতা’ নিমূলের?
কেউ কেউ যুক্তি দেখায়—পতিতাবৃত্তি না থাকলে সমাজে অনাচার বাড়বে, অপহরণ বাড়বে, ধর্ষণ বাড়বে। এগুলো হচ্ছে শিশুকে ঘুম পাড়াবার জন্য মামদো ভূতের ভয় দেখাবার মত। পতিতা ব্যবস্থা আছে বলে কি দেশে সন্ত্রাস নেই? অবাধ ধর্ষণ নেই, অনাচার নেই, অপহরণ নেই?
মামদো ভূতের দেশে আমরা আর মামদো ভূতের ভয়ে কাতর হতে চাই না। সামাজিক নিগ্রহের শিকার ওইসব মেয়েদের–আমি ওদের পতিতা বলতে চাই না, কারণ পতিতা শব্দের অর্থ ভ্ৰষ্টা, কুলটা ও কুচরিত্রা—আমি এই শব্দগুলোর একটিকেও ওদের জন্য যোগ্য মনে করি না, আমি ওদের নারী বলতে চাই, এবং ‘মানুষ’ বলতে চাই। আমি ওদের জানাতে চাই আমার সর্বোত্তম শ্রদ্ধা।