এ কথা আমি বিশ্বাস করি না যে রুদ্র নেই। রুদ্র মিঠেখালির চিংড়ি খামারে নেই, মোংলা বন্দরে নেই, রাজাবাজারে নেই, বিকেলে অসীম সাহার প্রেস, সন্ধ্যায় রামপুরার সঙ্গীত পরিষদ–কোথাও রুদ্র নেই। আমি বিশ্বাস করি না রুদ্র আর মঞ্চে উঠবে না, কবিতা পড়বে না। কাঁধে কালো ব্যাগ নিয়ে রুদ্র আর হাঁটবে না, রুদ্র আর কথা বলবে না, হাসবে না, কবিতা পরিষদ–সাংস্কৃতিক জোট নিয়ে ভাববে না, নতুন কোনো সংগঠন গড়বে না। এ আমার বিশ্বাস হয় না রুদ্র নেই, একুশের মেলায় নেই, চায়ের স্টলের আড্ডায় নেই, বাকুশায় নেই, সাকুরায় নেই।
রুদ্রকে আমি আমার সতেরো বছর বয়স থেকে চিনি। সেই সতেরো বছর বয়স থেকে রুদ্র আমার সমস্ত চেতনা জুড়ে ছিল। আমাকে যে মানুষ অল্প অল্প করে জীবন চিনিয়েছে, জগৎ চিনিয়েছে–সে রুদ্র। আমাকে যে মানুষ একটি একটি অক্ষর জড়ো করে কবিতা শিখিয়েছে–সে রুদ্র। করতলে আঙুলের স্পর্শ রেখে রুদ্র আমাকে প্রথম বলেছে–ভালোবাসি। বলেছে–আমরা জ্বলাবো আলো কৃষ্ণপক্ষ পৃথিবীর তীরে, জীবনে জীবন ঘষে অপরূপ হৃদয়ের আলো।
রুদ্র আমাকে স্বপ্ন দেখতে শিখিয়েছে। যে আমি কেবল নদীই দেখেছি, সেই আমাকে উথল সমুদ্র যেমন দেখিয়েছে, ঘোলা জলাশয়ও কিছু কম দেখায়নি। রদ্র আমাকে পূর্ণিমা দেখিয়েছে জানি, অমাবস্যাও কিছু কম নয়। রুদ্রর হাত ধরে আমি খোলা মাঠে হাওয়ায় হাওয়ায় নেচেছি, গহন অরণ্যে হেঁটেছি আর আঠারো, উনিশ, বিশ, একুশ করে বয়স পেরিয়েছি।
আমি এক অমল তরুণী, রুদ্রর উদোম উদগ্র জীবনে এসে স্তম্ভিত দাঁড়িয়েছিলাম। যে কবিকে আমি নিখাদ ভালোবাসি, যে প্রাণবান যুবককে ভালোবেসে আমি সমাজ সংসার তুচ্ছ করেছি, হৃদয়ের দুকূল ছাওয়া স্বপ্ন নিয়ে যাকে প্রথম স্পর্শ করেছি–তাকে আমি অনিয়ন্ত্রিত জীবন থেকে শেষ অব্দি ফেরাতে পারিনি; নিরন্তর স্খলন থেকে, স্বেচ্ছাচার থেকে, অবাধ অসুখ থেকে আমি তাকে ফেরাতে পারিনি। তার প্রতি ভালোবাসা যেমন ছিল আমার, প্রচন্ড ক্ষোভও ছিল তাই। আর রুদ্র সেই মানুষ, সেই প্রখর প্রশস্ত মানুষ, যে একই সঙ্গে আমার আবেগ এবং উষ্মা, আমার ভালোবাসা এবং ঘৃণা ধারণ করবার ক্ষমতা রেখেছে। রুদ্রকে আমি খুব কাছ থেকে দেখেছি, দূর থেকেও। রদ্র সেই মানুষ, রুদ্রই সেই মানুষ, যে কোনো দূরত্ব থেকে তাকে ভালোবাসা যায়।
যৌথ জীবন আমরা যাপন করতে পারিনি, কিন্তু যত দূরেই থাকি, আমরা পরস্পরের কল্যাণকামী ছিলাম। রুদ্রর সামান্য স্খলন আমি একদিন মেনে নেইনি, রুদ্রর দু’-চারটে অন্যায়ের সঙ্গে আমি আপোস করিনি–পরে সময়ের স্রোতে ভেসে আরো জীবন ছেনে, জীবন ঘেটে আমি দেখেছি রুদ্র অনেকের চেয়ে অনেক বড় ছিল হৃদয়ে, বিশ্বাসে। রুদ্রর ঔদার্য, রুদ্রর প্রাণময়তা, রুদ্রর অকৃত্রিমতার সামনে যে কারুকে দাঁড় করানো যায় না।
রুদ্রর পায়ের আঙুলে একবার বার্জার্স ডিজিজ হয়েছিল। ডাক্তার বলেছিলেন পা’টাকে বাঁচাতে হলে সিগারেট ছাড়তে হবে। পা এবং সিগারেটের যে কোনো একটিকে ডাক্তার বেছে নিতে বলেছিলেন। রুদ্র সিগারেট বেছে নিয়েছিল। জীবন নিয়ে রুদ্র যতই হেলাফেলা করুক, কবিতা নিয়ে করেনি, কবিতায় সে সুস্থ ছিল, নিষ্ঠ ছিল, স্বপ্নময় ছিল। পাকস্থলীতে ক্ষত নিয়েও সে খাওয়ায় অনিয়ম করতো। কোনো অসুখই রুদ্রকে বশে রাখতে পারেনি, রুদ্র উড়েছে, ঘুরেছে, নেশায় মেতেছে। এই বয়সে রক্তচাপ সাধারণত বাড়ে না, রদ্রর বেড়েছে, তবু সবচেয়ে বিস্ময় এই যে, কোনো রোগই রুদ্রকে রুগ্ন করেনি, রুদ্র সকল অসুস্থতা আড়াল করে অমলিন হেসেছে।
কাগজে এখন লেখালেখি হচ্ছে রুদ্র সত্তর দশকের অন্যতম প্রধান কবি, স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে রুদ্রর ভূমিকা এক ছিল সেই ছিল, রুদ্র আপসহীন ছিল, জাতীয় কবিতা পরিষদ ও সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সে প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিল। হ্যাঁ ছিল, রুদ্র কত কিছুই ছিল। রুদ্রর কবিতা শুনলে লোকে হাততালি দেয়, অগ্রজ কবিরা বাহবা দেয়, কিন্তু কেউ খবর নেয়নি__এই ঢাকা শহরে রুদ্রর অর্থ উপার্জনের কোনো পথ ছিল না, কোনো কাজ জোটেনি রুদ্রর, পত্রিকা অফিসগুলোয় কিছু একটা কাজের জন্য রুদ্র ঘুরেছে, কেউ তাকে কাজ দেয়নি। চিত্রনাট্য লিখতে দেবে বলে এ শহরের এক বিত্তবান কবি রুদ্রকে আশা দিয়েছিল, সেও প্রতারণা করেছে। জীবিকার তাড়ায় রুদ্রকে ঢাকার বাইরে যেতে হতো, রুদ্রর এই অনুপস্থিতির সুযোগে কবিতা পরিষদে থেকে, জোট থেকে রুদ্রকে ওরা প্রায় তাড়িয়ে দিয়েছে। এই সেদিনও কবিতা পরিষদের তলবি সভা ডাকতে সকলের ঘরে ঘরে গিয়ে রুদ্র অনুরোধ করেছে, কেউ তার আহবানে সাড়া দেয়নি। চারদিকে সকলেই ব্যস্ত, কেবল রুদ্রই ছিল পৃথক একটি মানুষ, তারই ছিল কেবল না ফুরনো দীর্ঘ অবসর। শিল্পের, সাহিত্যের অনেকে ইচ্ছে করলেই পারতো রুদ্রকে কোনো একটা কাজ দিতে, দেয়নি, এই প্রচন্ড ব্যক্তিত্বশালী যুবকটি মানুষের দ্বারে দ্বারে গিয়ে নম্র হয়েছে, কেউ তাকে সামান্য আশ্রয় দেয়নি। কেবল অসীম সাহা দিয়েছিল, নীলক্ষেতে তার টেবিলের বাঁপাশে রুদ্রকে একটি চেয়ার দিয়েছিল বসবার জন্য। রুদ্র সকাল, দুপুর, বিকেল ঐ একটি চেয়ারে নিমগ্ন বসে জীবন পার করতো।
রুদ্র তার কাব্যসমগ্র বের করবার জন্য গত দু মাস বড় ব্যাকুল ছিল। শুনে আমি বারবার বলেছি–সমগ্র তো মরবার পর বের হয়। তুমি শ্রেষ্ঠ করো, নির্বাচিত করো, রাজনৈতিক কবিতা করো। না, রুদ্রর ঐ এক জেদ, সে সমগ্র করবে। হ্যাঁ, রুদ্র সত্তর দশকের শ্রেষ্ঠ কবি, তার কবিতা মঞ্চে, ক্যাসেটে চমৎকার আবৃত্তি হয়, কিন্তু এ অব্দি রুদ্র তার কোনো বইয়ের সুষ্ঠু পরিবেশনা দেখেনি এবং কোনো রয়ালটিও পায়নি। আমাকে বলেছিল, তুমি বিদ্যাপ্রকাশ’কে একবার বলো। আমি বলেছিলাম। রুদ্র একদিন সেই প্রকাশককে নিমন্ত্রণও করলো। খাওয়া-দাওয়া হাসি আড্ডা শেষে রুদ্র বিনীত প্রস্তাব করলো কাব্যসমগ্র প্রকাশের, কাগজ কলমে হিসেব নিকেশ করে এও বুঝিয়ে দিল যে প্রকাশকের অর্থনাশ হবে না। প্রকাশক তবু মৌন ছিলেন। আমি জানি, এই অভিমানী কবিটি, যে কোথাও কোনো সহযোগিতা পায়নি সে ভেতরে ভেতরে তখন কি চূর্ণ হয়েছিল। রুদ্র কি তার তীব্র ইচ্ছেকে পূর্ণতা দেবার জন্যই মরে গেল? মরে গিয়ে তাবৎ পুস্তক প্রকাশককে ‘সমগ্র’ করবার সুযোগ করে দিল?
অসীমদার কাছে রুদ্রর অসুখের খবর পেয়ে আমি হলিফ্যামিলির দুশ’ একত্রিশ নম্বর কেবিনে রুদ্রকে দেখতে গিয়েছি। অসুখ তেমন নয়, শতকরা তিরিশজন যে অসুখে ভোগে, পাকস্থলীতে না খাওয়ার ক্ষত। রুদ্রর খুব নিকটে বসে আমি বলেছি, রুদ্রর চুলে কপালে হাত বুলিয়ে দিয়ে আমি ব্লেছি–ভেবো না, তুমি খুব শিগগির সেরে উঠবে। শুনে রুদ্র বলেছে–কি জানি এ যাত্রাই শেষ যাত্রা কিনা। আমি হেসেছিলাম। আমি তখনো হেসেছিলাম যখন একুশে জুন সকালে ক্যারোলিন রাইট আমাকে টেলিফোনে বললো, কে একজন তাকে জানিয়েছে যে রুদ্র মারা গেছে। ক্যারোলিনকে আমি খুব স্পষ্ট করে বলেছি–ক্যারোলিন, যে তোমাকে বলেছে ভুল বলেছে, রুদ্রর অসুখ মরে যাবার অসুখ নয়। আমি তাকে সেদিন মাত্র দেখে এলাম। তবু টেলিফোন রেখে হলিফ্যামিলিতে তক্ষুণি গিয়েছি, দু’শ একত্রিশ খালি, রোগী গত রাতে সুস্থ হয়ে ঘরে ফিরে গেছে। ঘরে ফিরে যাওয়া সুস্থ মানুষটিকে দেখতে গিয়ে দেখি ঘর ভর্তি মানুষ, লেবানের ঘ্রাণ, রুদ্র চোখ বুজে শুয়ে আছে, রুদ্রর সারা শরীর সাদা কাপড়ে ঢাকা। আমি দূর থেকে দেখলাম আমার সেই সতেরো বছর বয়স থেকে বড় গভীর করে চেনা তার চুল, চোখ, চোখের ভুরু, তার ঠোঁট, চিবুক, চিবুকের গাঢ় ভাঁজ। আমার এই এত চেনা মানুষটিকে, সকলের এত চেনা কবিটিকে কেউ আর ‘রুদ্র’ নামে ডাকছিল না, সকলেই তাকে ‘লাশ’ বলে ডাকছিল। লাশ ওঠাও, লাশ নামাও।
সকল অসুখ অতিক্রম করে এসে রুদ্র তার নিভৃত রক্তচাপ–যে রক্তচাপ তার হৃদপিন্ডে আঘাত হানবার জন্য ক্রমশ বেগবান হচ্ছিল, তাকে শেষ অব্দি ঠেকাতে পারেনি। তবু এ একেবারেই অবিশ্বাস্য যে কামাল, নিশাত, জাফর, ইকতিয়ার, আজগর, শামীম, সালাউদ্দিন, রেজা সকলেই থাকবে–কেবল রুদ্র থাকবে না। প্রতি বছর জাতীয় কবিতা উৎসব হবে, রুদ্র থাকবে না, একুশের মেলা হবে–ধুম আড্ডা হবে–রুদ্র থাকবে না। এ কি আশ্চর্য নয় যে রুদ্র আর শাহবাগে আসবে না, ‘ইত্যাদি’তে না, রামপুরায় না! রুদ্র নিশ্চয়ই আসবে, হঠাৎ একদিন ফিরে আসবে। টি.এস.সি-তে দাঁড়িয়ে চা খাবে, লাইব্রেরির মাঠে বসে আড্ডা দেবে, বিকেলে অসীমদার প্রেসে সকলকে অবাক করে দিয়ে রুদ্র বলবে, বাড়ি গিয়েছিলাম, এই এলাম। রুদ্র তবু ফিরে আসুক। এক বছর, দু’ বছর, পাঁচ বছর, দশ বছর পর হলেও রুদ্র ফিরে আসুক। রুদ্র তার অসুস্থতার মত মৃত্যকেও অতিক্রম করে সত্যিকার ফিরে আসুক। কাঁধে কালো ব্যাগ, রুদ্র হেঁটে যাক মঞ্চের দিকে, সম্মিলিত মানুষের দিকে, কবিদের তুমুল আড্ডায় রুদ্র তার তাবৎ মৃত্যকে আড়াল করে দুর্বিনীত হেসে উঠুক।