2 of 2

৫৪. পক্ষপাত সকল সময় মঙ্গলময় নয়

পক্ষপাত সকল সময় মঙ্গলময় নয়

চিকিৎসা শাস্ত্রে ‘কসমেটিক স্টিচ নামে এক ধরনের স্টিচ আছে। অস্ত্রোপচারের পর রোগীর চামড়ায় এই স্টিচ বা সেলাই দেওয়া হয়। এই সেলাইয়ের ধরন এমন যে চামড়ার বাইরে একেবারেই সুই না ফুটিয়ে ভেতরের দিক থেকে সুইয়ের ফোড় দিয়ে সেলাই সারা হয়। এর ফলে সেলাই শুকিয়ে আসলে দেখতে এমন দাঁড়ায়, ওখানে যে আদৌ অস্ত্রোপচার হয়েছে, ধারালো ব্লেডে যে জায়গাটি কখনও কাটা হয়েছে এ মনেই হয় না।

আমাদের দেশে দু’ ধরনের চামড়া সেলাইয়ের ব্যবস্থা আছে। গরু ঘোড়ার চামড়া নয়, মানুষের শরীরের চামড়া। এই চামড়া সাধারণত চার ফোঁড়ে সেলাই করা হয়, সে সেলাইয়ের দাগ—যদি দশটি সেলাই পড়ে তবে দশ দুই-এ কুড়ি সুতোর দাগ ফুটে ওঠে এবং মানুষ বাকি জীবন তা বহন করতে বাধ্য হয়। আর অন্য সেলাইটিকে বলা হয় কসমেটিক স্টিচ। সেটির দাগ একেবারেই যে নেই, তা নয়। খুঁজে দেখলে দেখা যাবে একটি সরু সুতোর ছায়া। সেলাই যত দীর্ঘই হোক, বারো সেলাই কি আঠারো সেলাই, তবু ওই এক সুতোরই ছায়া। অবশ্যই কসমেটিক স্টিচ অত্যন্ত উন্নতমানের সেলাই। উন্নত দেশে এর চেয়েও উন্নতমানের সেলাই-এর চর্চা চলে। আমাদের দেশে চার ফোড়ের সেলাই-এর চল বেশি, কসমেটিক সেলাই খুব কম ব্যবহার হয়। তবে ব্যবহার হয় নির্দিষ্টি কিছু ক্ষেত্রে, মেয়েদের ক্ষেত্রে, বিশেষ করে অবিবাহিত। অবিবাহিত মেয়ের শরীরে  সকল রকম অস্ত্রোপচারের পর কসমেটিক স্টিচ দেওয়া হয়। অথচ বিবাহিত, অবিবাহিত কোনও ছেলের বেলায় এই সেলাই দেওয়া হয় না। কসমেটিক সেলাই দেওয়ার কোনও অনুরোধ মেয়েরা না করলেও শল্য চিকিৎসকরা আপন উৎসাহে মেয়েদের এই বিশেষ আন্তরিকতা দেখিয়ে থাকেন।

পাশাপাশি দু’ টেবিলে ষোল-সতেরো বছরের একটি মেয়ে এবং একটি ছেলের অ্যাপেনডিসেকটমি অপারেশন হচ্ছিল। মেয়েটির জন্য কসমেটিক স্টিচ এবং ছেলেটির জন্য চার ফোড়ের সেলাই দেওয়া হল, সেলাইয়ের এই পার্থক্যের কারণ জানতে চাইলে চিকিৎসক বললেন—মেয়ের বিয়ে নামক ঘটনাকে সুগম করবার জন্য এই দাগহীন সেলাই-এর ব্যবস্থা। শরীরে কোনও দাগ বা ক্রটি থাকলে ছেলেদের কোনও অসুবিধে নেই। অসুবিধে মেয়েদের। বিয়ের বেলায় মেয়ের শরীর খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কিন্তু ছেলের নয়। মেয়ের শরীর নিখুঁত না হলে বিয়ের বাজারে মেয়ের দাম পড়ে যায়। ছেলের যেহেতু এ জাতীয় কোনও সমস্যা নেই, শল্য চিকিৎসকরাও ছেলের ব্যাপারে এই সেলাই আদৌ প্রয়োজন মনে করেন না।

শরীরকে মেয়েদের মূল সম্পদ বলে ভাবা হয়। তাই বাল্যবেলা থেকে মেয়েদের চুলের যত্ন ও ত্বকের যত্নের ব্যাপারে এত বেশি জ্ঞানদান করা হয় যে, মেয়েরা বিদ্যা নয়, বুদ্ধি নয়, কেবল । শরীরকে প্রধান এবং একমাত্র বিবেচনা করে। তাই ত্বক ও চুলের সৌন্দর্য রক্ষার জন্য প্রসাধন সামগ্রীতে যেমন বাজার ছেয়ে গেছে, মোড়ে মোড়ে বিউটি পারলারেরও তেমন হিড়িক লেগেছে। সেদিন নিউমার্কেটের এক বইয়ের দোকানিকে জিজ্ঞেস করেছিলাম—বিক্রি কেমন হয়। দোকানি বলল, আমরা কি আর স্নো পাউডার বিক্রি করি যে বিক্রি ভাল হবে?

ছেলের ত্বক রুক্ষ হলে, চুল উড়োখুড়ো হলে তেমন কিছু যায় আসে না। কিন্তু মেয়ের বেলায় এই উদাসিনতায় আপত্তি ওঠে। মেয়েদের শরীরকে ঘষে মেজে পরিষ্কার রাখতে হয়। চোখে কাজল, গালে পাউডার, ঠোঁটে লিপস্টিক, নখে নেলপলিশ লাগাতে হয়, কানে, নাকে, গলায়, পায়ে, কব্জিতে অলঙ্কার পরতে হয়। মেয়েদের শরীর এবং একমাত্র শরীরকেই প্রধান সম্পদ বলে ঘোষণা করা হয়। শরীর যাদের প্রধান এবং একমাত্র, তারা কালো কুৎসিত হলে, কদাকার হলে, যত বিদূষীই হোক, যত গুণবতীই হোক বিয়ে এগোয় না। আর শরীর যার ভাল, মুখ যার সুন্দর, শরীরের কাঠামো যার দৃষ্টিনন্দন, তার বিবেক বুদ্ধির তোয়াক্কা কেউ করে না, বয়সে পৌঁছার আগেই তার বিয়ের ধুম শুরু হয়। যেহেতু বিয়েকেই মেয়েদের একমাত্র গন্তব্য বলে ভাবা হয় তাই সুপাত্রে মেয়ে সমপিত হলে মেয়ে এবং মেয়ের অভিভাবকবৃন্দ মেয়ের জন্মের পর যে শ্বাস প্রায় রোধ করে থাকে, সেই শ্বাস যথাসম্ভব উন্মুক্ত করে।

শল্য চিকিৎসকরা কেবল মেয়েদের বেলায় কসমেটিক স্টিচের নিয়মটি রক্ষা করেন বলে সম্ভবত মেয়েরা খুব উল্লসিত হয়। আসলে বিষয়টি কোনও সচেতন মেয়ের কাছে গ্রহণযোগ্য হবার কথা নয়। যেহেতু কসমেটিক স্টিচ উন্নততর সেলাই, এই উন্নত চিকিৎসা থেকে কেন পুরুষ রোগীদের বঞ্চিত করা হয়? যদি এই সেলাই প্রয়োগ করা হয়—তবে নারী পুরুষ সকল রোগীর । ক্ষেত্রে একই সেলাই, চিকিৎসার একই পদ্ধতি প্রয়োগ করা হোক।

পক্ষপাত কি সকল সময় মঙ্গলময়? পক্ষপাত সকল সময়ই কি কল্যাণকর? এই পক্ষপাত কি আমি নারী বলে আমাকে সমর্থন করতে হবে যেহেতু এই পক্ষপাত বিশেষ এক শ্রেণী কর্তৃক নারীর প্রতিই বিশেষ পক্ষপাত? নারীর প্রতি এই সহানুভূতিকে আমি কখনও সমর্থন করি না, নারীর প্রতি বিশেষ এই আচারকে আমি অনাচার না ভেবে পারি না।

আপাত এই অতিযত্ন আসলে কোনও যত্ন নয়। আপাত এই অতি আদর আসলে কোনও আদর নয়। আপাত এই অতি শুশ্ৰুষা আসলে কোনও শুশ্ৰুষা নয়। নারীর প্রতি এই অতির আতিশয্যই খুলে দেয় নারীর পতনের সকল দরজা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *