ময়মনসিংহ আমার গোপন ভালবাসার নাম
আমার শহরের নাম ময়মনসিংহ। ময়মনসিংহ আমার শৈশবের নাম, উদাম কৈশোরের নাম। আমি যখন সারাদিনের ক্লান্তি শেষে ঘরে ফিরি, একটি মেট্রোপলিটন সিটির যানজট, ভিড় অতিক্রম করে আমি যখন একলা আমি—কেউ নেই কথা বলবার, কেউ নেই পাশে বসবার, তখন আমার বুকের মধ্য থেকে একজন খুব নরম করে আমাকে ডাকে, বলে—ঘুমোও। আমি জানি কে আমাকে ডাকে, বড় চিনি তাকে, তার দীর্ঘ একটি নদী চিনি, তার পথ চিনি, তার ঘরদুয়োর চিনি, তার কাশবন, তার বৃক্ষ, তার সবটা আকাশ আমি চিনি। সে আমার ময়মনসিংহ। ওই এক টুকরো শহর, ওই শহর কেন এত প্রিয় আমার; ছ’মাস কি বছর পেরোয় আমি শহরটির মুখ দেখি না। অথচ প্রতিরাতে ওই শহর আমাকে ডেকে বলে—লক্ষ্মী মেয়ে ঘুমোও। ওই শহর আমার ঘুম ভাঙায়। আমি ব্যস্ততার জন্য আদ্যন্ত তৈরি হয়ে উঠি।
ময়মনসিংহ আমার গোপন ভালবাসার নাম। ওখানের ধুলো কাদায় গড়িয়ে আমি দৈর্ঘ্যে বেড়েছি, ওখানের জল হাওয়ায় ঘুরে আমি মননে বেড়েছি। ময়মনসিংহ আমাকে ভেতরে বাইরে মানুষ করেছে। আমাকে মানুষ করেছে আরও একজন, সে আমার বাবা। আমার বাবার সঙ্গে আমি জানি না কত সহস্ৰ বছর আমার কথা হয় না। শুনেছি বাবার আগের সেই দাপট নেই, আগের মত জুতোর হুঙ্কার তুলে সারা শহর হেঁটে বেড়ান না, বাজারের সবচেয়ে বড় রুই মাছটি এনে উঠোনে ফেলেন না, বাবা আগের মত আমন অহঙ্কার করে বলেন না—এর পেটিগুলো সব ভাজা হবে, সবচেয়ে বড় পেটিটা দেবে আমার বড় মেয়েকে। বাবা কি এখন জানেন তার বড় মেয়ে রুই মাছের গন্ধ ভুলে গেছে, স্বাদ ভুলে গেছে!
ছোটবেলায়, যখন ধীরে ধীরে ‘মেয়ে’ হয়ে উঠব বলে জানি, চারদিক থেকে আমনই হয়ত শিখছিলাম, মা একদিন আমাকে কোনও এক বাড়ি নিয়ে কান ফুটো করে আনলেন। দেখে বাবা রেগে আগুন হয়ে সারা বাড়ি চিৎকার করলেন। মা’র ওপর সে কি তুফান গেল ক’দিন। বাবার সোজাসাপটা কথা—আমার মেয়ে লেখাপড়া করবে। তার অত সাজগোজের দরকার নেই। আমার কানের ফুটো অব্যবহারে ধীরে ধীরে বুজে গেল। আমিও তো বড় মেয়ে হতে চেয়েছিলাম। স্কুলের মেয়েরা হাত দোলালে হাত ভরা কাচের চুড়ি রিন রিন করে বাজে। লাল সবুজ নীল—কত রঙের চুড়ি। স্কুলের মাঠে চুড়ি নিয়ে এক বেদেনী বসত। স্কুল ছুটি হলে মেয়েরা চুড়ি কিনতে ভিড় জমাত। একদিন আমারও ইচ্ছে হল চুড়ি কিনি, একদিন আমারও বড় ইচ্ছে হল রিন রিন করে হাত দোলাই, দু’হাত ভরে চুড়ি পরে সেদিন বাড়ি গেলাম। বাবা অফিস থেকে এসেই আমাকে কাছে ডাকেন, রোজ ক্লাসে কী কী পড়ানো হল তার হিসেব নেন। সেদিন কাছে যেতেই আমি টুং টাং বেজে উঠলাম। বাবা খাচ্ছিলেন, খাবার রেখে উঠোনে গেলেন, উঠোন থেকে বড় এক পাথর নিয়ে এলেন। আমাকে বললেন–হাতে কী ওগুলো?
বললাম–সবাই পরে।
বাবা জ্বলে উঠলেন, বললেন–হাত রাখ টেবিলে। হাত রাখলাম। বাবা পাথর মেরে দু’ ডজন চুড়ি টুকরো টুকরো করে ভেঙে দিলেন। বললেন—ফের যেন এসব পরতে দেখি না, সাবধান।
সেই না পরতে পরতে না পরাটাই অভ্যেসে দাঁড়িয়ে গেছে। এখন পরলেও বাবা আর ভাঙতে আসেন না, তবু পরি না। কেমন অস্বস্তি লাগে, যেন অকারণ বাড়তি একটি জিনিস গায়ে চাপিয়েছি, ভার ভার লাগে, খুলে ফেলি।
ঠোঁটে কখনও লিপস্টিক লাগাতে দিতেন না। যখন একটু একটু করে কৈশোর পেরোচ্ছি, বড় খালা বোনদের দেখে সাজতে ইচ্ছে হত, ঠোঁটে একটু লিপস্টিক দিলে বাবা হাতের তালু দিয়ে বা সামনে কাপড় রুমাল যা-ই পেতেন তা দিয়ে মুছে দিতেন। বলতেন—এসব রঙ লাগিয়েছিস কেন? ফের মুখে কোনও রঙ দেখলে আস্ত রাখব না বলে দিচ্ছি।
আমার সেই ভয়ঙ্কর প্রতাপশালী বাবা, যাকে দেখে বাড়ির যেখানেই থাকি দৌড়ে গিয়ে পড়বার টেবিলে বসেছি, সামনে যে বই-ই পেয়েছি ভূগোল হোক পাটিগণিত হোক সশব্দে পড়েছি। যে বাবা আমাকে চোখে কাজল লাগাতে, ঠোঁটে লিপস্টিক লাগাতে দিতেন না, যে বাবা আমাকে কানে দুল পরতে, হাতে চুড়ি পরতে দিতেন না—সেই বাবার দিকে মনে মনে কত রাগ করেছি ছোটবেলায়।
মেয়েরা যে কোনও পরবে-উৎসবে সেজেগুজে হেঁটে যেত। আমি সাদামাঠা একটি জামা পরে জানালায় দাঁড়িয়ে থাকতাম। কী যে দুঃখ হত নিজের জন্য।
আসলে আমি তখন বুঝিনি বাবা আমাকে কী অমূল্য জিনিস আমার চেতনার ভেতর প্রবেশ করিয়েছিলেন। বড় হবার পর সোনাদানা হীরে আমার কাছে অনেক এসেছে, আমি সব নিয়ে হেলাফেলা করেছি। আমার কাছে একটি সুতোর মূল্য যেমন, এক তোলা হীরের মূল্যও তেমন, আমি কোনও ধাতব অলঙ্কারকে আজও ভালবাসতে পারিনি। বাবা আমাকে ওই তুচ্ছতিতুচ্ছের মোহ থেকে মুক্ত করেছিলেন। বাবা কি এখন জানেন—তিনিই আমাকে মানুষ করেছেন সবচেয়ে বেশি!
বলতেন–পড়াশুনা কর। জ্ঞানের চেয়ে মূল্যবান পৃথিবীতে আর কিছু নেই। আমি খেলতে শিখিনি আমি নাচতে শিখিনি, আমি বেড়াতে শিখিনি, আমি রাঁধতে শিখিনি, আমি কেবল পড়তে শিখেছি। বাবা আমাকে পড়াতে পড়াতে এমনই পড়বার অভ্যেস করালেন যে না পড়লে আমার অস্থিরতা বেড়ে যায়, রাতে ঘুম হয় না। বাবা কি আমার মন্দ করেছেন কিছু?
এই যে এত ময়মনসিংহ ভালবাসি, এই যে আমার শহর আমার শহর বলে উষ্ণ হয়ে উঠি মধ্যরাতে, এই যে এক আশ্চর্য ভালবাসা আমাকে ডেকে বলে–লক্ষ্মী মেয়ে ঘুমোও ! সে কি বাবার কারণে নয়? ওই শহরে আমার একজন বাবা বাস করেন বলে শহরটি এত প্রিয় হয়ে উঠেছে আমার। ওই শহর জানে আমার মানুষ হবার গল্প। ওই শহর জানে আমার বাবার প্রচণ্ড ব্যক্তিত্বের গল্প। ওই শহর জানে ওই শহর থেকে আমার হঠাৎ হারিয়ে যাবার গল্প। ওই শহরই কেবল জানে একজন ভালবাসার বাবা বাস করেন বলে ওই শহরটিকে বুকে নিয়ে এই দূর পরবাসে প্রতি রাতে আমি ঘুমোতে যাই।
আমার বাবা কি জানেন আমার এই ঘুম এবং ঘুম থেকে জেগে ওঠার গল্প?