নারীর সবচেয়ে বড় শত্রু দ্বিধা এবং ভয়
আমি কোনও দল করি না, আমি একা। আমার কোনও সংগঠন নেই, সংস্থা নেই, সমিতি নেই, পরিষদ নেই, আমি যা লিখি নিজ দায়িত্বে লিখি। একা লিখি। আমার পেছনে বিশাল কোনও পেশীশক্তি নেই, যা আমাকে সমূহ বিপদ থেকে রক্ষা করবে। আমি কোনও স্তাবক পুষি না।
এই ব্ৰহ্মাণ্ডে একটি বিন্দুর মত আমি একা। আমার মত এত একা, আর যারা লেখেন, তারা নন। আমি একজন নারীবাদী পুরুষকে জানি, তিনি তার সংস্থা থেকে নারীর জন্য কল্যাণকর প্রচারপত্র প্রকাশ করেন। কল্যাণকর যে কোনও কিছুকে আমিও সমর্থন করি। কিন্তু সেই সংস্থাই যখন নারীর কল্যাণকামী অন্য শক্তিকে প্রতিরোধ করে তখন সংস্থাটির কল্যাণ কামনা নিয়ে আমার বড় সংশয় হয়। আমি বিশ্বাস করতে বাধ্য হই তিনি বা তার সংস্থা আসলে নারীর নয়, নিজেদের কল্যাণ কামনা করেন। নিজেদের খ্যাতি এবং বিত্তের বাইরে আর যা কিছু তা নেহাত লোক-দেখানো ছাড়া কিছু নয়।
আমাকে রোধ করতে, আমাকে নিশ্চিহ্ন করতে চায় এমন শক্তির অভাব এদেশে নেই। জামাত-শিবির সরকারের কাছে আমার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি করছে। ওরা করবেই, এ নিয়ে আমি বিস্মিত নই, কারণ ধর্মসংক্রান্ত অমূলক ও অযৌক্তিক কথার প্রতিবাদ আমি করি, আর যেহেতু ওরা ধর্মকে ওদের নিজস্ব সম্পত্তি বলে মনে করে—ওরা আজ শাস্তি, কাল ফাসি’, আমি যতদিন বেঁচে থাকি, আমার জন্য দাবি তুলবেই। এ নিয়ে আমি সামান্যও বিস্মিত নই। কিন্তু প্রগতির পক্ষের কথিত শক্তি যখন নামে এবং বেনামে আমাকে আক্রমণ করে, এদের কদাকার এবং হিংস্র চেহারা আমার কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে—আমি বিস্মিত হই, বিস্মিত হই এবং বিস্মিত হই।
আমি সামান্য একজন লেখক মাত্র। সমাজের পীড়িত, নিগৃহীত, দলিত, দংশিত নারীর জন, লিখি। নরম কথায় এ যাবৎ কিছু হয়নি বলে আমি কড়া কথা বলি। নিন্দুকেরা এর নাম দিয়েছে পুরুষ-বিদ্বেষ। এদেশে আমার প্রশংসা যদি একজন করে, নিন্দা করবে একশ জন। এই আকটমুখ, মূঢ় ও নির্বোধের দেশে আমি বেশি প্রশংসা আশাও করি না। আমার অসংখ্য নিন্দুকের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নারীবাদী নামধারী সাম্রাজ্যবাদী সংস্থা, মার্কিন মদতপুষ্ট অগণন পেশী-শক্তি।
হোক, হবে না কেন, আমি তো একা, একা একজন মানুষকে চূর্ণ করতে সময় এবং শক্তির তেমন অপচয় হয় না। একা একজন মানুষকে গালি ছুড়তে কারও কোনও ভয় হয় না, কারণ সে তো কোনও দলের নয়, সংগঠনের সদস্য নয়, আঘাতের প্রতিক্রিয়ায় কোনও প্রতিঘাতের আশঙ্কা নেই। একা একজন মানুষের কুৎসা রটালে সেই কুৎসা যখন প্রবল ধাবিত হয়, কোনও বিরুদ্ধ বাতাস থাকে না তাকে ফেরাবার। একা একজন মানুষের কণ্ঠনালী চেপে ধরতে তেমন দুঃসাহসেরও দরকার হয় না।
মানুষের নিয়মই বোধহয় এই যে মানুষ অসংখ্যের অনুগত হয়, বিশাল-এর বাধ্য হয়। মানুষের নিয়মই বোধহয় এই যে মানুষ নিজেকে এত দুর্বল ভাবে যে একটি সবলের কাছে সে সমর্পিত হয়, আশ্রিত হয় একটি ‘ছত্রছায়ায়’।
আমি একা। একা বলে আজ আমার অহঙ্কার হয়। আমি কোনও দল বা সংঘের ভাড়াটে লেখক নই। আমি কোনও পেশী বা স্তাবক পুষি না, পোষা সংখ্যাধিক্য, আমাকে মোহিত করে না। আমি একা। একা একটি শক্তি হয়ে দাঁড়িয়ে আছি, তাবৎ নিন্দার মুখে থুথু দিয়ে অশুভ সকল শক্তির বিরুদ্ধে আমি দাঁড়িয়েছি। যেন কারও কাধে ভর দিয়ে নয়, এমন একাই একটি তুমুল শক্তি দাঁড়াতে পারে—এমন দাঁড়াতে পারে বিড়ম্বিত, বিপন্ন, দুর্গত, নিরাশ্রয় নারী।
নারীর সবচেয়ে বড় শত্রু দ্বিধা এবং ভয়। তার পায়ে পরানো আছে দ্বিধার শেকল, তার মস্তিষ্কে পিঁড়ি পাতা আছে ভয়ের। দ্বিধা এইজন্য যে, কে না জানি তার নিন্দা করে। নারী দ্বিধার চাকুতে নিজেকে শত টুকরো করে। নারী ভয়ে নীল হয়। এই নীল হওয়াকে লোকে মুগ্ধ চোখে দেখে, নানান ব্যাখ্যা করে তার নীলাভ সৌন্দর্যের । আহা নারী, ভয়ের কামড় থেকে গা বাঁচিয়ে একবার সে কেন এমন দাঁড়ায় না, এমন ঋজু এবং উদ্ধত? পরাশ্রয়ী লতার মত নয়, একটি বৃক্ষের মত? যার আছে একটি শক্তিমান শেকড়? নারী একাই তো হয়ে উঠতে পারে অসংখ্য। একাই তো হয়ে উঠতে পারে বিপুল এবং বিস্তৃত।