2 of 2

৭০. বহুবিবাহ

বহুবিবাহ

আজ থেকে একশ বিশ-পঁচিশ বছর আগের কথা। এই উপমহাদেশের পুরুষ মানুষেরা সত্তর-আশিটি করে বিয়ে করত। শাস্ত্র তাদের এ ব্যাপারে কেবল ইন্ধনই জুগিয়েছে, সেই সঙ্গে বাহবা দিয়েছে সমাজ। কেবল একজন রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। আজকাল কোনও নারী যদি এমন রুখে দাঁড়ায়, তবে সকলেই এক বাক্যে তাকে পুরুষ-বিদ্বেষী আখ্যা দেবে—কিন্তু একশ একুশ-বাইশ বছর আগে যে মানুষ যাবতীয় শাস্ত্রীয় ও ধর্মীয় অনাচারের বিরুদ্ধে ভীষণ এক কাণ্ড ঘটিয়েছিলেন, সৌভাগ্য যে তিনি একজন পুরুষ ছিলেন। তাই যত তাকে শাস্ত্রদ্রোহী, ধর্মদ্বেষী, নাস্তিক ও নরাধম বলে ডাকা হোক, ‘পুরুষ-বিদ্বেষী’ বলে কেউ ডাকেনি। যদিও তিনি বলেছিলেন, ‘স্ত্রীজাতি অপেক্ষাকৃত দুর্বল ও সামাজিক নিয়মদোষে পুরুষজাতির নিতান্ত অধীন। এই দুর্বলতা ও অধীনতা নিবন্ধন, তাহারা পুরুষজাতির নিকট অবনত ও অপদস্থ হইয়া কালহরণ করিতেছেন। প্রভূতাপন্ন প্রবল পুরুষজাতি, যদৃচ্ছাপ্রবৃত্ত হইয়া, অত্যাচার ও অন্যায়াচরণ করিয়া থাকেন, তাহারা নিতান্ত নিরুপায় হইয়া, সেই সমস্ত সহ্য করিয়া জীবনযাত্রা সমাধান করেন। পৃথিবীর প্রায় সর্ব প্রদেশেই স্ত্রী জাতির ঈদৃশী অবস্থা। কিন্তু, এই হতভাগ্য দেশে, পুরুষজাতির নৃশংসতা, স্বার্থপরতা, অবিশৃশ্যকারিতা প্রভৃতি দোষের আতিশয্যবশত, স্ত্রীজাতির যে অবস্থা ঘটিয়াছে, তাহ অন্যত্র কুত্ৰাপি লক্ষিত হয় না। অক্ৰত্য পুরুষজাতি, কতিপয় অতিগর্হিত প্রথার নিতান্ত বশবর্তী হইয়া, হতভাগা স্ত্রীজাতিকে অশেষবিধ যাতনা প্রদান করিয়া আসিতেছেন।‘

মূলত বিধবা-বিবাহ নিষিদ্ধ ও ‘বহুবিবাহ’ প্রথাকেই ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ‘অতিগর্হিত’, ‘অতিজঘন্য’ ও ‘অতিনৃশংস’ বলে অভিযুক্ত করেছেন। হিন্দু ধর্মের সর্বত্র বাল্যবিবাহ ও বহু বিবাহের পক্ষে নানারকম আদেশ ও উপদেশ বর্ণিত, যেমন, কাশ্যপ বলেছেন—যে কন্যা অবিবাহিত অবস্থায় পিতৃগৃহে রজঃস্বলা হয়, তাহার পিতা ভূণহত্যা পাপে লিপ্ত হন। সেই কন্যাকে বৃষলী বলে। যে জ্ঞানহীন ব্রাহ্মণ সেই কন্যার পাণিগ্রহণ করে, সে অশ্রাদ্ধেয় (যাহাকে শ্রাদ্ধে নিমন্ত্ৰণ করিয়া ভোজন করাইলে শ্রাদ্ধ পণ্ড হয়) ও অপাঙক্তেয় (যাহার সহিত এক পঙক্তিতে বসিয়া ভোজন করিতে নাই) ও বৃষলীপতি (উদ্ধাহতত্ত্ব)।

যমসংহিতায় এও বলা হয়েছে—কন্যাকে অবিবাহিত অবস্থায় রজঃস্বলা দেখিলে মাতা, পিতা, জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা এই তিনজন নরকগামী হয়। যে ব্রাহ্মণ, অজ্ঞানাদ্ধ হইয়া, সেই কন্যাকে বিবাহ করে, সে অসম্ভাষ্য (যাহার সহিত সম্ভাষণ করিলে পাতক জন্মে), অপাঙক্তেয় ও বৃষলীপতি।

জীমূতবাহন প্রণীত দায়ভাগ-এ আছে—‘স্তনপ্রকাশের পূর্বেই কন্যা দান করিবেক। যদি কন্যা বিবাহের পূর্বে ঋতুমতী হয়, দাতা ও গ্রহীতা উভয়ে নরকগামী হয়, এবং পিতা, পিতামহ, প্রপিতামহ বিষ্ঠায় জন্মগ্রহণ করেন। অতএব ঋতুদর্শনের পূর্বেই কন্যা দান করিবেক।‘

যদিও অবিবাহিত অবস্থায় কন্যার ঋতুদর্শন ও ঋতুমতী কন্যার পাণিগ্রহণ, শাস্ত্র অনুসারে, ঘোরতর পাতকজনক, তবু, এ কথা সত্য যে, ঋতুদর্শনের আগে বিবাহ অর্থাৎ বাল্য-বিবাহ এখন আইনত নিষিদ্ধ। অর্থাৎ ধর্ম দ্বারা মানুষ পরিচালিত নয়, ধর্মই মানুষ দ্বারা পরিচালিত। বহুবিবাহরোধের ক্ষেত্রেও নানা রকম আপত্তি উঠেছিল। যেমন অনেকে বলতেন বহুবিবাহ শাস্ত্রানুমত ও ধর্মানুগত ব্যাপার। এই প্রথা নিবারিত হলে, শাস্ত্রের অবমাননা ও ধর্মলোপ ঘটবে। কুলীন ব্রাহ্মণদের জাতিপাত ও ভঙ্গ কুলীনদের সর্বনাশ হবে। এক ব্যক্তি অনেক বিবাহ করতে না পারলে তাদের কৌলিন্য মর্যাদার সমূলে উচ্ছেদ ঘটবে। কায়স্থজাতির আদ্যরসের ব্যাঘাত ঘটবে ইত্যাদি।

‘যে ব্যক্তি তিন বিবাহ করিয়া চতুর্থ বিবাহ না করে, সে সাত কুল পাতিত করে, তাহার ভূণহত্যা প্রায়শ্চিত্ত করা আবশ্যক’ (উদ্বাহতত্ত্ব) অথবা ‘ধর্মকর্মোপযোগী ব্যক্তিদের এক ভাৰ্য স্বীকার করা কর্তব্য, কিন্তু উপযাচিত হইয়া কেহ কন্যা প্রদানেচ্ছ হইলে অথবা রতিবিষয়ক সাতিশয় অনুরাগ থাকিলে তাহারা অনেক ভাৰ্যাও গ্রহণ করিবেন’–শাস্ত্রের এই প্রশ্রয় পেয়ে সমাজের প্রসিদ্ধ কুলীনেরা নিদ্বিধায় বহুবিবাহ প্রথার সযত্ন চর্চা করছিলেন। কিন্তু সকল নীতি ও নিয়মের, সকল বিধি ও বিধানের মোড় ঘুরিয়ে দিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। যেহেতু, এদেশের অনেকে শাস্ত্রের ব্যবস্থা উল্লম্বন করে চলেন না, তাদের যাবতীয় ব্যবহার শাস্ত্রীয় বিধি ও শাস্ত্রীয় নিষেধ অনুসারে নিয়মিত—তাই স্ববিরোধী শাস্ত্রের এ কথাগুলো বিদ্যাসাগর কৌশলে উল্লেখ করেছেন– যে পরিবারে স্ত্রীলোকদিগকে সমাদরে রাখে, দেবতারা সেই পরিবারের প্রতি প্রসন্ন থাকেন। আর যে পরিবারের স্ত্রীলোকদিগের সমাদর নাই, তথায় যজ্ঞদানাদি সকল ক্রিয়া বিফল হয়, যে পরিবারে স্ত্রীলোকেরা মনোদুঃখ না পায়, সে পরিবারের সতত সুখ সমৃদ্ধি বৃদ্ধি হয়। স্ত্রীলোক অনাদৃত হইয়া যে সমস্ত পরিবারকে অভিশাপ দেয়, সেই সকল পরিবার, অভিচারগ্রস্তের ন্যায়, সর্বপ্রকারে উৎসন্ন হয়। (মনুসংহিতা) এবং যদি প্রথম বিবাহিত স্ত্রী শ্রতিবিহিত ও স্মৃতিবিহিত অগ্নিসাধ্য ধর্মকার্য নির্বাহের উপযোগিনী ও পুত্রপৌত্ৰাদি সন্তানশালিনী হয়, তাহা হইলে অন্য স্ত্রী বিবাহ করিবেক না। অন্যতরের অভাবে অর্থাৎ ধর্মকার্য অথবা পুত্ৰলাভ সম্পন্ন না হইলে, অগ্ন্যাধনের পূর্বে বিবাহ করিবেক। (আপস্তম্ব ধর্মসূত্র)

এছাড়া শাস্ত্রের নানা ফাঁকফোকর আবিষ্কার করে বিদ্যাসাগর বহুবিবাহ রোধের ব্যাপারে উৎসাহী ও উদ্যোগী করেছিলেন বারানস, বর্ধমান, নবদ্বীপ প্রভৃতির রাজা, দেশের অন্যান্য ভূম্যধিকারিগণ ও বহুসংখ্যক সাধারণ মানুষকে। বিরুদ্ধাচরণ যাঁরা করেছিলেন তাঁরা মূলত ধর্মশাস্ত্র ব্যবসায়ী, তাঁরাই শাস্ত্রে অবমাননা ও ধর্মলোপের আশঙ্কা করেছিলেন। তাঁরাই হিতকর কাজের প্রতিপক্ষ হয়ে সর্বাগ্রে দাঁড়িয়েছিলেন।

সে সময় বহুবিবাহ নিষেধক যে বিলটির খসড়া প্রস্তুত হয়েছিল, সেটি এরকম—‘Whereas the institution of marriage among Hindus has become subject to great abuses, which are alike repugnant to the principles of Hindu Law and the feelings of the people generally; and whereas the practice of unlimited polygamy has led to the perpetration of revolting crimes; and whereas it is expedient to make Legislative provision for the prevention of those abuse and Crimes, alike at variance with some policy, justice and morality; it is a enacted as follows—
No marriage, contracted by any male person of the Hindu religion, Who has a Wife alive…’

ইসলাম ধর্মে পুরুষের জন্য চারটি পর্যন্ত বিয়ে করবার নিয়ম প্রচলিত। মহানবী হযরত মুহম্মদ (সাঃ) চৌদ্দটি বিয়ে করেছিলেন। মহানবীর আদর্শ ইসলাম ধর্মমতাবলম্বীদের অনুপ্রাণিত করে।

কিন্তু যে অন্ধকার যুগে, যে বর্বরতা, যুদ্ধ-বিগ্রহ ও ব্যভিচারের যুগে হযরত মুহম্মদ বহুবিবাহ ব্যবহারে বাধ্য হয়েছিলেন, তা উল্লেখ করে এ যুগের বিজ্ঞ বুদ্ধিজীবিগণ বহুবিবাহ রোধকল্পে অনায়াসে উদ্যোগী হতে পারেন। মানবতার পক্ষে যে কোনও আইন তৈরি করতে প্রায় দেড়শ বছর আগে একদিন মানুষ এগিয়ে এসেছিল, আজ কেন এগোবে না? ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর যখন শাস্ত্রবিরোধী বিধবা-বিবাহের কথা বলেছিলেন–শাস্ত্রবিরোধী বহুবিবাহ রোধের পক্ষে অনেকে যুক্তি দেখিয়েছিলেন তখন বিপক্ষের শক্তি (শ্রীযুক্ত তারানাথ তর্কবাচস্পতি, ক্ষেত্রপাল স্মৃতিরত্ন, গঙ্গাধর রায়, কবিরাজ কবিরত্ন উল্লেখযোগ্য) প্রচণ্ড হলেও পক্ষের শক্তি নেহাত কম ছিল না।

এখন, এই একবিংশ শতাব্দীর দরজায় দাঁড়িয়ে আমরা প্ৰণম্য ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মৃত্যুশতবার্ষিকীতে কেন এই বিলটি উত্থাপন করছি না, যে –No marriage, contracted by any male person of the Muslim religion, who has a wife alive। আমরা কেন আমাদের পক্ষের শক্তি একত্রিত করছি না বিদ্যাসাগরের মত, কেন আমরা কেবল স্মরণ করছি, দীক্ষা নিচ্ছি না? এ আমাদের ‘অতিজঘন্য’ চাতুর্য নয়?

ধর্মের যুগোপযুক্ত, বিজ্ঞানোপযোগী ব্যাখ্যা দাড় করাতে এখন পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষার জাগোধ্যাত্মিক পণ্ডিতেরা নিরলস পরিশ্রম করছেন। এই পরিশ্রম একেবারেই নিরর্থক হবে, যদি না বহুবিবাহের মত একটি ঘৃণাকর, অনর্থকর ও অধর্মকর ব্যবহারকে উচ্ছেদ করা যায়। এবং আমরা বিদ্যাসাগরের কৃপায় স্ত্রী শিক্ষা প্রাপ্ত (ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর স্ত্রী শিক্ষার প্রচলন এবং প্রসার করেছিলেন) নারীরা একটি ‘অতিগর্হিত’, ‘অতিজঘন্য’ ও ‘অতিনৃশংস’ একটি প্রথাকে (যে প্রথাকে বিদ্যাসাগর হিন্দু সমাজ থেকে বিতাড়িত করেছিলেন) বাঁচিয়ে রাখি, তবে আমরাই বা আমাদের ক্ষমা করব কোন যুক্তিতে?

বহু বিবাহ প্রথার নষ্ট শেকড় সমাজের রন্ধে রন্ধে বিস্তারিত, মুসলমান ধর্মাবলম্বী নারীরা পুরুষের নৃশংসতা, স্বার্থপরতা, বিলাসিতা ও অবিমূশ্যকারিতার শিকার। ঘরে ঘরে বহু বিবাহের অনাচার ও উচ্ছঙ্খলতা নারীকে ‘ভোগ্যবস্তু হিসেবে নিরূপণ করছে এবং মানুষ’ হিসেবে নারীর মর্যাদা তিলার্ধও অবশিষ্ট রাখছে না। স্ত্রীর অনুমতি নিয়ে দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ বিয়ে করবার যে উদার আইনটি প্রচলিত, তা নেহাত আইনের নামে ফাজলামো ছাড়া কিছু নয়। যে পরিবারে পুরুষই সর্বময় কর্তা হিসেবে বিবেচিত, সেখানে পুরুষের কোনও ইচ্ছেকে ‘অনুমতি’ না দেবার ক্ষমতা বা কণ্ঠস্বর কোনও নারী অর্জন করে না।

এই সময় চলুন, আমরা আমাদের ব্যাপারে সচেতন হই, উচ্চকণ্ঠ হই, এবং এরকম সংগঠিত হই যে আমাদের সম্মিলিত প্রস্তাবকে রাষ্ট্র যদি আইনসিদ্ধ না করে তবে এই রাষ্ট্রকেও আমরা ছেড়ে কথা কইব না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *