2 of 2

৬৪. সমরেশ বসুর প্রজাপতি

সমরেশ বসুর প্রজাপতি

শারদীয় ‘দেশ’-এ প্রকাশিত সমরেশ বসুর ‘প্রজাপতি’ উপন্যাস নিয়ে একটি মামলা হয়েছিল। ১৯৬৮ সালের দোসরা ফেব্রুয়ারি ‘প্রজাপতি’ উপন্যাসটিকে নিষিদ্ধ করবার অনুরোধ জানিয়ে মামলাটি করেছিলেন অমল মিত্র নামের এক তরুণ অ্যাডভোকেট। প্রজাপতিকে অশ্লীলতার দায়ে অভিযুক্ত করে সরকার পক্ষও তাকে সমর্থন জানিয়েছিল। সমরেশ বসুর পক্ষে প্রথম ও প্রধান সাক্ষী ছিলেন বুদ্ধদেব বসু।

সে বছর ষোলই নভেম্বর ব্যাঙ্কশাল কোর্টে কলকাতার চীফ প্রেসিডেন্সি ম্যাজিষ্ট্রেট কুমারজ্যোতি সেনগুপ্তর আদালতে সাক্ষ্য দিতে এলেন বুদ্ধদেব বসু। কোর্টরুম তখন জ্যাম প্যাক্‌ড। উপস্থিত ছিলেন ‘দেশ’-এর তখনকার সম্পাদক অশোককুমার সরকার, মুদ্রাকর ও প্রকাশক সীতাংশুকুমার দাশগুপ্ত, অভিযুক্ত সমরেশ বসু, সঙ্গে সাগরময় ঘোষ, সন্তোষকুমার ঘোষ, কবি নরেশ গুহ এমন অনেকে। বুদ্ধদেব বসু ‘প্রজাপতি’র অভিযুক্ত অংশগুলো সম্পর্কে বলেন ওখানে তিনি অশ্লীলতার কিছুই পাননি। ১৭৮, ১৭৯, ১৮০, ২০০ পৃষ্ঠার কথিত অশ্লীলতাকে বুদ্ধদেব বসু তুখোড় যুক্তি দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছেন ওগুলো অশ্লীলতা নয়, যদি নরনারীর মিলনের সম্পর্ককে অশ্লীল বলা হয় তবে প্রাচীনকাল থেকে ভারতীয় সাহিত্য ও শিল্পে এই মিলনের কথা অবাধে এসেছে। কেউ তার ওপর কোনও নিষেধবিধি জারি করেনি। মহাভারতে বা কালিদাসের কাব্যে কিংবা কোনারক, খাজুরাহে বা পুরীর মন্দিরে এর দৃষ্টান্ত পাওয়া যাবে। এগুলো মহৎ শিল্পকর্ম হিসেবে স্বীকৃত। বাংলা সাহিত্যে ও ভারতচন্দ্রের বিদ্যাসুন্দর এবং বহু বৈষ্ণব কবিতায় এই সম্পর্কের কথা বেশ খোলখুলিই আছে। মনে রাখতে হবে জয়দেবের গীতগোবিন্দ এবং অন্যান্য বৈষ্ণব পদাবলী আমাদের দেশে ধর্মীয় সাহিত্য হিসেবে স্বীকৃত। যে কারণে সমরেশ বসুর ‘প্রজাপতি’-কে অশ্লীল বলা হয়েছে, বুদ্ধদেব বসু বলেন সেই ধুয়া তুললে তো আগে মহাভারত, বাইবেল এসবই নিষিদ্ধ করে দিতে হবে।

অভিযোগকারী অ্যাডভোকেট জানালেন, ‘প্রাচীন পুরাকীর্তি, মহাকাব্য ও ধর্মগ্রন্থের জন্য আলাদা আইন আছে। সেই আইনে সেগুলো সুরক্ষিত। পুরী, কোনারক, খাজুরাহ, অজন্তা, ইলোরার স্থাপত্য, ভাস্কর্য এবং চিত্রকলা ও ধর্মও ঐতিহাসিক কারণে আইনে সংরক্ষিত। সেই আইনে চিকিৎসাশাস্ত্রের বইয়েরও ঠিক একই রক্ষাকবচ আছে।’

রক্ষাকবচ না থাকলে মহাভারত, রামায়ণ, বাইবেলের মত হাদিস কোরানও নিষিদ্ধ করতে হয়। সব দেশেই একটি আলাদা আইনে পুরাকীর্তি ও ধর্মগ্রন্থ সুরক্ষিত থাকে। অশ্লীলতার দোষ দিলে এর বাইরের নানা কীর্তি ও শিল্পের বিরুদ্ধেই দিতে হয়। রক্ষাকবচ বা সংরক্ষণের আলাদা আইন না থাকলে অশ্লীলতার দোষ এগুলোকেও দেওয়া যেত, যেমন—সিয়ামের রাতে তোমাদের জন্য স্ত্রী-সম্ভোগ বৈধ করা হইয়াছে (সূরা বাকারা আয়াত ১৮৭)। পাদটীকা—প্রথম দিকে রামযানের রাতে ঘুমাইয়া গেলে পর পুনরায় জাগিয়া খাদ্য গ্রহণ এবং স্ত্রী গমনের নিয়ম ছিল না। সাহাবীদের কেহ কেহ এই বিধি কখনও কখনও লঙ্ঘন করিয়া ফেলিতেন ও ইহাতে অনুতপ্ত হইতেন। এই পরিপ্রেক্ষিতে আয়াতটি নাযিল হয়।

‘তোমরা মসজিদে ই’তিকাফরত অবস্থায় তাহদের সহিত সঙ্গত হইও না।‘ (প্রাগুক্ত) লোকে তোমাকে রজঃস্রাব সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করে। বল—‘উহা অশুচি’ । সুতরাং তোমরা রজঃস্রাবকালে স্ত্রী-সঙ্গ বর্জন করিবে; এবং পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন না হওয়া পর্যন্ত স্ত্রী-সঙ্গম করিবে না। সুতরাং তাহারা যখন উত্তমরূপে পরিশুদ্ধ হইবে তখন তাহদের নিকট ঠিক সেইভাবে গমন করিবে যে-ভাবে আল্লাহ তোমাদিগকে আদেশ দিয়াছেন। (সূরা বাকারা আয়াত ২২২)

তোমাদের স্ত্রী তোমাদের শস্যক্ষেত্র। অতএব তোমরা তোমাদের শস্য ক্ষেত্রে যেভাবে ইচ্ছা গমন করিতে পার। (সূরা বাকারা আয়াত ২২৩)

অতঃপর যদি সে তাহাকে তালাক দেয় তবে সে তাহার জন্য বৈধ হইবে না, যে পর্যন্ত সে অন্য স্বামীর সঙ্গে সঙ্গত না হইবে। (সূরা বাকারা আয়াত ২৩০)

নারী, সন্তান, রাশিকৃত স্বর্ণরৌপ্য আর চিহ্নিত অশ্বরাজি, গবাদি পশু এবং খেতখামারের প্রতি আসক্তি মানুষের নিকট মনোরম করা হইয়াছে। এইসব ইহজীবনের ভোগ্যবস্তু। (সূরা আল ইমরান আয়াত ১৪)

সে যখন পূর্ণ যৌবনে উপনীত হইল তখন আমি তাহাকে হিকমত ও জ্ঞান দান করিলাম। এবং এইভাবেই আমি সৎকর্মপরায়ণদিগকে পুরস্কৃত করি। সে যে স্ত্রীলোকের গৃহে ছিল সে তাহা হইতে অসৎকর্ম কামনা করিল এবং দরজাগুলি বন্ধ করিয়া দিল ও বলিল—‘আইস’ (সূরা ফুসুফ আয়াত ২২/২৩)

নগরে কতিপয় নারী বলিল, আযীযের স্ত্রী তাহার যুবক-দাস হইতে অসৎকর্ম কামনা করিতেছে, প্রেম তাহাকে উন্মত্ত করিয়াছে। (সূরা য়ুসুফ আয়াত ৩০)

নারী শয়তানের আকৃতি ধরে নিকটে আসে এবং শয়তানের আকৃতিতে ফিরে যায়। যখন তোমরা কেউ নারী দেখে সুখানুভব কর এবং তোমাদের অন্তরে সে পতিত হয়, তখন সে যেন তার স্ত্রীর দিকে মন আকৃষ্ট করে নেয় এবং তার সঙ্গে সঙ্গম করে। কেননা, তার অন্তরে যা আছে, তা সঙ্গম দ্বারা বিদূরিত হয়ে যাবে। (বোখারি হাদিস)

অতিরিক্ত গরমের দিনে, ভরা পেটে, ঘর্মাক্ত কলেবরে এবং গোসলের পরক্ষণে সঙ্গম করবে না। কারণ এতে সন্তান মুর্খ ও বোকা হতে পারে। (বোখারি হাদিস)

স্বামী তাঁর স্ত্রীকে চারটি কারণে প্রহার করতে পারেন। এর মধ্যে একটি কারণ হচ্ছে সঙ্গমের উদ্দেশ্যে স্বামী যদি স্ত্রীকে আহ্বান করেন এবং স্ত্রী সেই আহানে সাড়া না দেয়। (তিরমিজি হাদিস)

মহানবী (সাঃ) বলেছেন, সোমবারের সহবাসের সন্তান খোদাভক্ত ও কোরানে হাফেজ হয়। মঙ্গলবারের সহবাসের সন্তান মুমিন ও আল্লাহর প্রিয় পাত্র হয়। বৃহস্পতিবার দ্বিপ্রহরের পূর্বে সহবাসের সন্তান বিজ্ঞপণ্ডিত হয়। তার উপর জাদুমন্ত্রের বাণও কার্যকর হবে না। শুক্রবার দ্বিপ্রহের পূর্বে সহবাসের সন্তান হয় অত্যন্ত উত্তম ও সৎ চরিত্রবান। (তিরমিজি)

ধর্মগ্রন্থ কখনও অশ্লীলতার দোষে দূষিত হয় না। এসব সংরক্ষণের আলাদা আইন আছে, রক্ষাকবচ আছে। তাই মহাভারত, রামায়ণ, গীতা, বাইবেল, কোরান, হাদিস সকল ধর্ম এবং ধর্ম-সংক্রান্ত গ্ৰন্থই রক্ষাকবচের গুণে পার পেয়ে যায় এবং আমরা তা মাথায় তুলে রাখি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *