নারী দায়মুক্ত হোক
আমি একবার এক লোকের কাছ টাকা ধার করেছিলাম। টাকা ধার করবার অভ্যেস আমার একেবারেই নেই। এরকম দিন গেছে দুবেলা না খেয়ে কাটিয়েছি, দারিদ্র্যের একেবারে তল অবধি পৌঁছেও নিজেকে আমি অনড় রেখেছি—এ আমার এক ধরনের অহঙ্কার। তবু নিতান্ত বাধ্য হয়ে একবার আমি টাকা ধার করেছিলাম। লোকটি আমাকে বোন বলে ডাকতেন। সম্পর্কটি, আমি মনে করি যথাসম্ভব মার্জিত ও নির্বিঘ্ন।
শর্ত ছিল সাতদিন পর টাকা ক’টি আমি ফেরত দেব। অথচ আশ্চর্য সেই লোকটি পরদিনই আমাকে ফোন করলেন। ফোন কিন্তু টাকার জন্য করেননি। জিজ্ঞেস করলাম টাকা কি আপনার আজই দরকার? আমার পক্ষে আজ দেওয়া কিন্তু সম্ভব নয়। আমি যে তারিখের কথা বলেছি, অবশ্যই সেই তারিখে দেব। এর পরদিন লোকটি আমার অফিসে এলেন। অফিসে তাকে দেখে আমি অবাক হলাম। বললাম টাকা কিন্তু ওই তারিখের আগে আমি দিতে পারছি না ভাই। লোকটি হেসে বললেন–না, না তাতে কোনও অসুবিধে নেই। এরও পরদিন লোকটি আমার বাড়ি এলেন। জিজ্ঞেস করলাম কী ব্যাপার। লোকটি হাসলেন–না তিনি টাকার জন্যে আসেননি। এই পথ দিয়েই যাচ্ছিলেন, তো ভাবলেন যে দেখে যাই। এই দেখে যাওয়ার ব্যাপারটি পরদিনও ঘটল এবং এর পরদিনও ।
এদিকে সাতদিনের আগে টাকা দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। এবং লোকটির এই যাতায়াতও আমার পক্ষে ক্রমেই অসহনীয় হয়ে উঠল। আমি একটি ব্যাপার তখন স্পষ্ট করে বুঝলাম—দায়বদ্ধতা আমার কণ্ঠস্বরকে এত স্নান করে রেখেছে যে লোকটিকে আমি ইচ্ছে করলেও ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার কথা স্পষ্ট করে বলতে পারছি না। দায়বদ্ধতা আমার মেরুদণ্ডকে এত দুর্বল করে রেখেছে যে আমি ইচ্ছে করলেই ঘাড় শক্ত করে দাঁড়াতে পারছি না। এই সাতদিন, যে সাতদিন আমি টাকা ক’টি লোকটিকে ফেরত দিতে না পেরেছি—ঘরে বাইরে এক অসুস্থ আবহাওয়ায় আমাকে নিঃশ্বাস নিতে হয়েছে, অনিচ্ছার সঙ্গে আমাকে আপস করতে হয়েছে। লোকটি ঘন ঘন আমার বাড়ি এসেছেন। না, টাকা নিতে নয়, লোকটি অযথাই এসেছেন। এসেছেন, চা খেয়েছেন, দু-চারটে সাদাসিধে কথা বলে চলেও গিয়েছেন। লোকটি সম্ভবত এরকমই চেয়েছিলেন যে এই দায় থেকে যেন আমি সহসা মুক্ত না হই এবং কখনোই যদি এই মুক্তিটি আমার না ঘটত আমি এখন স্পষ্ট বুঝি যে লোকটি তাতে মোটেও অসন্তুষ্ট হতেন না।
যে কোনও দায় মানুষকে শেষ অবধি কতদূর নিয়ে যায় বা যেতে পারে সে আমি কেবল অনুভব করতে পারি। কিছু টাকার জন্যে আমি দায়বদ্ধ ছিলাম, তাও মাত্র সাতদিন। এই সাতদিনে আমি হাড়েমজ্জায় টের পেয়েছি দায় জিনিসটি কী মারাত্মক পরিণতির দিকে মানুষকে ক্রমশ এগিয়ে নেয়। আর যারা জীবনের দায়বদ্ধতায় ভোগে? আমি জানি, আমি খুব গভীর করে জানি, অনেকেই এই দায়বদ্ধতায় ভোগে, বিশেষ করে মেয়েরা। খাদ্যের দায়, বস্ত্রের দায়, বাসস্থানের দায় নেই এমন মেয়ে ক’জন আছে। এ সংসারে? সম্পর্ক যত ঘনিষ্ঠই হোক, দায় তাতে কিছুমাত্র তরল হয় না। দায় দায়ই। যেহেতু অর্থনৈতিক ও সামাজিক কোনও স্বাধীনতা মেয়েদের নেই–তাই জীবনযাপনের তুচ্ছাতিতুচ্ছ উপকরণের জন্যও তারা দায়বদ্ধ হয়, কেউ পিতার কাছে, কেউ স্বামীর কাছে, কেউ পুত্রের কাছে। এই পিতা, স্বামী ও পুত্রকে মেয়েদের বিভিন্ন বয়সে মেয়েরা সহায় বলে জানে।
যদি দায় না থাকে কিছুর? যদি যাবতীয় দায় থেকে নারী একবার মুক্ত হতে পারে? যে মুক্তি নারীর জন্য অবশ্য প্রয়োজন। তবে কি শক্তি হবে কারও, নারীর পথ রোধ করে কখনও দাঁড়ায়, তবে কি শক্তি হবে কারও নারীকে সোনার শেকলে বাঁধে?
নারী সকল দায় থেকে মুক্ত হোক। এই দায়ই নারীর মানুষ হবার একমাত্র অন্তরায়। নানা দায়ে নারীকে জড়িয়ে অমানুষ করে রাখা সমাজের দীর্ঘকালের সংঘবদ্ধ চক্রান্ত। নারী দায়মুক্ত হোক।
নারী একবার নিজেকেই নিজের সহায় বলে জানুক। যদি জাল ছিঁড়তে হয়, নারী জাল ছিঁছুক। যদি বদ্ধঘরের খিল ভেঙে টুকরো করতে হয়, নারী তাই করুক। লোকে তাকে থুতু দেবে, লোকে তাকে চরিত্রহীন বলে গাল দেবে। তাতে কী? লোকের কথায় কী এসে যায়। এই লোকের মুখেই থুতু দেবার অভ্যেস করুক নারী। এই লোকের মুখেই চুনকালি মাখবার অভ্যেস করুক নারী।
আমরা অভ্যেস করি না বলেই পারি না। শিশুকে দাঁড়াবার, দৌড়েবার অভ্যেস করানো হয় বলেই শিশু দাঁড়ায়, দৌড়োয়। নারী তো একপ্রকার শিশুই, যাকে কেবল গায়ে-গতরে ছাড়া আর কিছুতেই বাড়তে দেওয়া হয় না। এই প্রতবন্ধি নারীরা পরিপূর্ণ হয়ে উঠুক বোধ ও প্রজ্ঞার পুরুষ্ট্র বিকাশে। নারী একবার নিজেকেই নিজের সহায় বলে মানুক।