2 of 2

৫৯. ভাগ্যবানের বউ মরে, আর অভাগার গরু মরে

ভাগ্যবানের বউ মরে, আর অভাগার গরু মরে

১. রোগ নিরূপণের জন্য আলট্রাসনোগ্রাফি এখন বেশ জনপ্রিয় একটি পদ্ধতি। ধরা যাক পেট ফুলে উঠেছে, পেটে চাকা, ব্যথা ইত্যাদি যে কোনও উপসর্গ নিয়ে রোগী কোনও চিকিৎসকের শরণাপন্ন হল, তখন নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে যদি কিছু অনুমান করা না যায়, অথবা অনুমান করা গেলেও যদি সামান্যও দ্বিধা থাকে তবে সোজা আলট্রাসনোগ্রাম।

আলট্রাসনোগ্রামই বলে দেবে পেটে সরল টিউমার না ক্যানসার, বলে দেবে এর অবস্থান, গঠন, আকার আকৃতি, স্বভাব চরিত্র সকলই। আগে এ সুবিধাটি এদেশে ছিল না, বেশ ক’বছর থেকে আলট্রাসনোগ্রামের সুবিধে পাওয়াতে চিকিৎসা ব্যবস্থাও বেশ অগ্রসর হচ্ছে।

গর্ভে ভ্রূণোদগম হলে আলট্রাসনোগ্রামে ভ্রূণের আকার প্রকার সন্তরণ সকলই প্রত্যক্ষ হয়। এবং বিজ্ঞানের কাছে কৃতজ্ঞ হতে হয় আরও এইজন্য যে, ষোলো সপ্তাহের পর ভ্রূণের লিঙ্গ নির্ধারণ করবার ক্ষমতাও সে রাখে। কিন্তু সেই কৃতজ্ঞতা শেষ অবধি কোথায় দাঁড়ায়—যদি শুনতে হয় ভ্রূণের লিঙ্গ নির্ধারণের এই চমৎকার সুযোগের অপব্যবহার করছে মানুষ, যদি দেখতে হয় ভূণ মেয়ে হলে গর্ভপাত করানো হচ্ছে!

হ্যাঁ, ভারতে অগণন গর্ভপাত হচ্ছে, আলট্রাসনোগ্রামের সুবিধে মানুষ এভাবেই নিচ্ছে যে, কোনও মেয়েকে তারা জন্মাতে দিচ্ছে না। মেয়ে-জন্ম রোধের সুবিধে পাওয়ায় আলট্রাসনোগ্রাম প্রতিবেশী ভারতে এখন অত্যন্ত জনপ্রিয় নির্ণায়ক। আমাদের দেশে এই জন্ম রোধের মহামারি শুরু হতে খুব একটা দেরি হবে বলে আমার মনে হয় না। কারণ মানুষ কোনও কন্যা জন্ম কামনা করে না। অধিক পুত্র জন্মের পর কন্যা জন্মে হয়ত কেউ বিরক্ত হয় না। কিন্তু কেউ সজ্ঞানে, স্বেচ্ছায় কন্যা জন্মের রোধ ছাড়া ফুরণ চায় না।

মানুষ এখন সুখ ও স্বপ্নের জলে নিশিদিন সাতার কাটতে পারে। কন্যা জন্মের কোনও দুঃসহ লজ্জা, যন্ত্রণা, অতুষ্টি, অসন্তোষ, সঙ্কট, দুর্ভোগ পোহাতে হবে না কোনও বধূকে। আহা কি আনন্দ। গর্ভবতী নারীরা এখন উল্লাসে নৃত্য করুন। অনাকাঙ্ক্ষিত সন্তান রোধের ব্যবস্থা নিন। আরবের লোকেরা যখন গুহায় বাস করত, কন্যা জন্মালে তারা জ্যান্ত পুঁতে ফেলত। আর এ হচ্ছে গর্ভের জ্যান্ত কন্যাকে গর্ভেই হত্যা করা। আমরা দিব্যি দালান-কোঠায় বাস করি, গুহায় নয়, লেখাপড়া শেখা সভ্য মানুষ আমরা, এই আমরাই এখন গর্ভহত্যায় মেতেছি।

আর কেনই বা মাতব না, সতীদাহর আগুন মাত্র কদিন হল নিভেছে, পোড়া দাগ কি তার নেই অন্তরে এবং সংস্কারে? পণপ্রথার আগুন, নির্যাতনের আগুন, ধর্মের নানা বিধি ও বিধানের আগুন—কোন আগুনে নারী পোড়ে না? সতীদাহ না হয় নিভেছে, কিন্তু এই ধর্মদাহ এবং সমাজদাহর আগুনে কে সাধ করে পুড়তে আনে আত্মজাকে।

২. ‘ভাগ্যবানের বউ মরে, আর অভাগার গরু মরে’—প্রবাদটি প্রবাদ হিসেবে পুরনো, কিন্তু এখনও, এই একবিংশ শতাব্দীর শুরুতেও কিছুমাত্র বেমানান নয়। বউ গেলে বউ পাওয়া যায়, গরু গেলে গরু পাওয়া যায় না, নতুন গরু পেতে গেলে গাটের কিছু পয়সা যায়, আর ঘরে বউ এলে গাঁটে কিছু পয়সা নতুন করে আসে। এ ক্ষেত্রে বউকে হেলাফেলা করা গেলেও গরুকে করা যায় না। যে কোনও বউ বা নারীর চেয়ে গরুকে মূল্যবান বলে ভাবা হয়। সম্প্রতি এদেশের এক মেয়ে এবং ভারতের ছয় গরুর বিনিময় হচ্ছে চোরা পথে। খবরটি শুনে অনেকে আঁতকে উঠেছেন। ছি ছি করেছেন। আমি কিন্তু উল্টো খুব অবাক হয়েছি। কারণ একটি মাত্র মেয়ের বিনিময়ে ছয় গরু পাওয়ার দুর্লভ সৌভাগ্যকে আমি ঈর্ষা না করে পারিনি। এ তো অভাবনীয় অভিবাদ্য একটি ব্যাপার, যে এক মেয়ের বদলে ছয় গরু পাচ্ছে সে অধিক লাভবান নিশ্চয়ই।

ভারতের বিশাল ছয়টি গরু বাংলাদেশের একটি কৃষকায় মেয়ের তুলনায় অধিক আকর্ষণীয়, অধিক উৎপাদনীয় এবং নিঃসন্দেহে অধিক মূল্যবান। আমার মনে হয় মেয়ে নিয়ে ওরা বরং ঠকেই যাচ্ছে। মেয়ে মানুষের যেখানে দু পয়সা মূল্য নেই, সেখানে ছয় গরু দিয়ে তাকে যারা সম্মান জানাল, আমি তাদের, সেই চোরাচালানিদের কাছে কৃতজ্ঞ।

মেয়েমানুষের দাম ভদ্র সমাজ দেয় না, তারা গর্ভেই মেয়েদের হত্যা করে, সেক্ষেত্রে চোরাচালানিরা মাত্র একটি—তাও দীনহীন অকুলে ভাসা মেয়ের বিনিময়ে আস্ত ছয়টি গরু দিয়ে দিচ্ছে। সেই মেয়েকে ওরা দেহব্যবসায় খাটাবে; এই তো! ওরা ওখানে মেয়েদের অভদ্র বানাবে, আর ভদ্রলোকেরা যেমন ইচ্ছে ওদের ব্যবহার করবে। এ আর এমন কি জিনিস, সমাজের ভদ্রমেয়েরা কি ব্যবহৃত হচ্ছে না ভদ্রলোকদের খেয়াল খুশিমত ! এ আর নতুন কি প্রতারণা, এ আর নতুন কি বিভ্রম, এ আর এমন কি নতুন জগত। আমাদের ভদ্রমেয়েরা তো বিনে পয়সায় ৰিক্রি হয়, আর সমাজছাড়াগুলোর জন্য কম হলেও ছ’-সাতটা গরু তো যাচ্ছে। ভালই তো, এ যাত্রায় যদি নারীর মূল্য কিছুটা বাড়ে।

৩. আমার বড় কাঁদতে ইচ্ছে করে। আমার একবার খুব কাঁদতে ইচ্ছে করে। জগতের সকল নারীকে বলছি, আসুন আমরা আমাদের জন্য একবার কাঁদি। আমাদের জন্য একবার আমরা কাঁদি। একবার চলুন চিৎকার করে কাঁদি আমরা, ধুলোয় গড়িয়ে কাঁদি। আমরা তো এক-একটা নির্বাক পাথর, আমরা কেবল তাকিয়ে তাকিয়ে খেলা দেখছি। আমাদের নিয়ে মানুষ মজাদার খেলা খেলছে, আমরা কেউ রা শব্দ করছি না! আমাদের জন্মের জন্য, আমাদের এঘর থেকে ওঘর, এদেশ থেকে ওদেশ চালানের জন্য একবার আমরা খুব কাঁদি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *