ফকিরের আত্মকথা
এই বিশাল ভারতবর্ষের এক কোণে পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার বেলডাঙ্গা থানার অন্তর্গত কাপাসডাঙ্গা গ্রামে এক ভিজে স্যাঁতসেঁতে গলিতে হাজরা পরিবারে দারিদ্র্যের ব্যথা নিয়ে ১৩৬৪ সালের কার্তিক মাসের ২৩ তারিখে ভোর ৩-১৫ মিনিটে জন্মগ্রহণ করেছিলাম। বাবার নাম অক্ষয়নাথ হাজরা, মায়ের নাম লক্ষ্মীবালা হাজরা। জন্ম থেকেই অভাব আর অনটনের মধ্যে দুঃখকে বরণ করে নিয়ে, কখনও খেয়ে কখনও না খেয়ে কেটেছে ছেলেবেলার দিনগুলি। চার বছর বয়সে হাতে খড়ি নিয়েই শুরু হয় গ্রামে প্রাইমারি স্কুল জীবন। প্রতি বছর ক্লাস উত্তীর্ণ হয়ে এগিয়ে চললাম অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত। এরই ফাঁকে পেলাম পাঁচ/ছ’জন ভাই-বোন। ছোট ভাই বোনদের সঙ্গে পেয়ে যেন অভাবের দড়ি আরও গলায় ফাঁসির মত টুঁটি টিপে ধরেছিল। তাই তো সংসারের প্রয়োজনে বিড়ি শ্রমিকের কাজ শুরু করি। তারপর এভাবে কেটে চলল আঠেরো বছরের জীবন।
উনিশে পা দিতেই বাবা মায়ের মনে আকাঙ্ক্ষা জাগলো বউমায়ের মুখ দেখবার। এ জন্যই মায়ের দূর সম্পর্কের দাদার মেয়ের সঙ্গে আমার প্রথম বিবাহ হল। খুবই অল্পবয়স্ক মেয়ে। আঠারো মাস সংসার-ধর্ম পালন করে ন’মাস গর্ভবতী অবস্থায় একলেম্শিয়া রোগে বহরমপুর সদর মাতৃসদন হাসপাতালে সে মারা যায়। এর পর শ্রাদ্ধক্রিয়া সেরে মনের উপর এক ব্যথাভরা চাপ পড়ল। সারাক্ষণ উদাস আর সাথিহারা জীবন নিয়ে পূর্বস্মৃতিভার বুকে নিয়ে এক ত্যাগের ভাব মনে উদয় হল। রাতদিন শুধু রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াতাম। হঠাৎ একদিন বিকালবেলায় দেখা আমাদের গ্রামেই বাড়ি উস্তাদ জাফরউদ্দিনের সঙ্গে যিনি নকসবন্দিয়া তরিকায় মুরিদ হয়ে কালবী জিকিরে যথেষ্ট মশগুল থাকতেন। লেখাপড়া তাঁর জীবনে তেমন ছায়া ফেলতে পারেনি। তবে আক্ষরিক জ্ঞান বা ঐশ্বরিক চিন্তাভাবনার সঙ্গে বহু কিতাব কোরান হাদিস বা হিন্দু শাস্ত্র বিষয়ক বহু বই তিনি অবসর সময়ে পড়ে নিজে বহু জ্ঞানের অধিকারী হয়েছিলেন। এই সব আধ্যাত্মিক চিন্তা ভাবনার সঙ্গে নিজে আধ্যাত্মিক গান ও গজল রচনা করতেন। কিন্তু তাঁর চিন্তাধারা বিশ্বময় প্রকাশ করার তেমন কোনও মাধ্যম হয়তো পাচ্ছিলেন না। তাই হঠাৎ আমাকে ডেকে বললেন ‘যতীন সন্ধ্যার পর আমার বাড়ি আসবি, তোর সঙ্গে আমার অনেক কথা আছে।’
যদিও ওঁর কথা আমার মনোমতো হচ্ছে না তবু ‘আসবো’ বলে বাড়ি ফিরে গেলাম। গ্রাম সম্পর্কে আমরা ওঁকে দাদু বলতাম। সন্ধ্যাবেলায় একটু ভেবে ওঁর সঙ্গে গেলাম দেখা করতে। গিয়ে দেখি উনি নামাজ পড়া শেষ করে তখন জায়নামাজে বসে ছবি তেলাওত করছেন। আমাকে দেখে বললেন, ‘তুই এসেছিস? আমি তোকে নিয়েই ভাবছি। আয় বোস। তোর ভালর জন্যেই তোকে ডেকেছি। রাতদিন রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াস, সংসারের কোনও কাজকর্মও করিস না তোর বাবা বলছিল। রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ালে মনে শান্তি আসবে কোথা থেকে? মন তো লাগামবিহীন ঘোড়া, আলগা পেলেই অন্যদিকে ছুটিয়ে নিয়ে চলে যাবে। শোন্ আমি তোর জন্যে একটা চিন্তাভাবনা করেছি, আর একটা কিছু করতেই হবে তোকে।’
আমি বললাম, ‘বল আমায় কি করতে হবে।’
উনি বললেন, ‘বহুদিনের চিন্তা ভাবনা আমি তোর মাধ্যমে প্রকাশ করতে চাই।’
আমি বললাম, ‘আমায় কি করতে হবে বল।’
উনি বললেন, ‘তোকে গান শিখতে হবে।’
আমি হাসতে লাগলাম, বললাম, ‘আমার গলা দিয়ে জোরে কথা বের হয় না, আর আমি করব গান?’
উনি বললেন, ‘আমি জানি তোর দাদু গান বাজনা করতেন, তোর ঠাকুমার গলার আওয়াজ কম ছিল না, তোর বাবার গলার তেজ মন্দ নয়, বংশ অনুযায়ী তোরও গান হবে।’
উনি তো বলছেন আর আমি বসে বসে হাসছি। কারণ আমার মনে হত মানুষের সামনে দাঁড়িয়ে মুখ খুলে গান করা বড় লজ্জার ব্যাপার। এটা আমার পক্ষে কোনও মতেই সম্ভব নয়।
দাদু বললেন, ‘তোর কোনও কথাই আমি শুনব না, তোকে প্রত্যেক সন্ধ্যায় আমার কাছে আসতেই হবে। তোকে প্রতিদিন নতুন নতুন গল্প শোনাব।’ গল্প শোনার আগ্রহ আমার ছোটবেলা থেকেই। তাই গল্পশোনার আগ্রহে প্রতিদিন সন্ধ্যার পর ওঁর বাড়ি যেতে শুরু করলাম। দাদু গল্প বলা ছাড়াও আধ্যাত্মিক বিভিন্ন আলোচনা করতেন। ওই সব আলোচনা শুনে মনে আমারও আগ্রহ বাড়তে লাগল। হঠাৎ একদিন দেখি একটি লাউ-এর খোলে চামড়া দিয়ে ছেয়ে বাঁশের ছড় বেঁধে একতারা বেঁধে রেখে দিয়েছেন। আমি একতারা দেখে হাসতে হাসতে বললাম, ‘এটা কি হবে?’ উনি বললেন, ‘তোকে শিখতে হবে।’ উনি নিজে বাজিয়ে আমায় শেখাতে লাগলেন। কয়েকদিন পর দেখছি একজনের কাছ থেকে উনি একটা ডুগি চেয়ে রেখেছেন। বললেন, ‘ডানহাতে একতারা আর বাম হাতে ডুগি অভ্যাস করতে হবে।’ ধীরে ধীরে ওই ভাবেই অভ্যাস করতে এবং শিখতে লাগলাম। ঘরের মধ্যে দাদুর কাছে বসে আস্তে আস্তে দু’-একখানা গানও শিখতে লাগলাম। সব গান ওঁর রচনা নয়, নিজে যেগুলো লিখতেন সেগুলিও দিতেন। আমি ওঁর দেওয়া প্রতিটি গানই খাতায় লিখে নিতাম। ওঁর লেখা ও অন্য মহাজনদের লেখা গানে আমার খাতা ভারী হয়ে উঠল। উনি নিজে ভাল বাজাতে জানতেন না তাই পাড়া বা গ্রামে যাঁরা একটু ভাল বাজাতে জানতেন তাঁদের অনুরোধ করতেন আমায় শেখানোর জন্য। ডুগি একতারা বাজাতে গিয়ে বসে বসে হাসতাম। একহাতে একতারা হয়তো বাজত কিন্তু অন্যহাতে ডুগি বাজাতে চাইত না। আর দাদু বলতেন, ‘তোর কোনও কথাই আমি শুনতে চাই না। তোকে শিখতেই হবে।’ তাই সকাল সন্ধ্যায় যখন মন চাইত নির্জনে ওই যন্ত্র বাজানো অভ্যেস করতে লাগলাম। তারপর পাড়াতে এর ওর বাড়ি গিয়ে বসে বসে ২/৪টে গান গাইতাম। কেউ এক কাপ চা দিত, আবার কেউ দু’-একটি বিস্কুটও সঙ্গে দিত। সকলে গান শুনে উৎসাহ যোগাত এবং সহযোগিতাও করত। আবার কেউ কেউ হিংসেও করত। কেউ পেছনে কিছু বললে দাদুকে এসে বলতাম। উনি বলতেন, ‘যারা হিংসে করবে তারা পিছনে পড়ে থাকবে। তুই অনেকদূর এগিয়ে যাবি, তোকে কেউ রুখতে পারবে না।’
দাদুর মুখে এই আশীর্বাদ শুনে মনে সবসময়ই আনন্দের স্রোতধারা বইত। এইভাবে গানের রেওয়াজ চালিয়ে যেতে লাগলাম। প্রতিদিন সন্ধ্যায় গান গাইতে বসতাম আর প্রতিটি গান গেয়ে তার অর্থ জেনে নিতাম। একদিন পাশের গ্রামে হিন্দু পল্লিতে গেলাম গান গাইতে। অন্যদেশ থেকে এসেছেন একজন বাউল শিল্পী। তাঁর সঙ্গে পাল্লাগান গাইতে কেউ বলছে, ‘যতীন তোমার ভাল হচ্ছে, কিন্তু ওঁর গানের পাশে উত্তর হচ্ছে না।’
আমি খুবই চেষ্টা করে অল্প শেখা বিদ্যা নিয়ে লড়াই করলাম তবে বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব আমার জানা নাই। অন্ধকার বোধ করলাম। মনে মনে ছটফট করতে করতে একটি গানের অর্থই বুঝলাম না, তার উত্তর দেব কী! প্রশ্ন-গান/ ‘না-পাকে পাক হয় কেমনে। জন্ম বীজ যার না-পাক কয় মৌলবী গণে’—। বাড়ি এসে ওই কথাগুলি দাদুকে বললাম। উনি হাসতে হাসতে বললেন, ‘প্রশ্ন খুব চমৎকার করেছে, তবে এর জবাব আমি বলি তুই শোন্— থালাতে ভাত হাতে তুলে মুখে দিয়ে খায়। কিন্তু খাওয়ার পর হাত মুখ থালা ধুতে হয় কারণ এগুলো এঁটো হয়ে গেছে, ভাত পবিত্র জিনিস—তাই ওতে কোনও না-পাক জিনিস নেই। তবে বাউল গান শিখতে হলে বাউল গোঁসাই ধরে শিক্ষামন্ত্র নিতে হয়। তোকে আমার এক বন্ধুর কাছে যেতে হবে যার বাড়ি নওপুকুরিয়া গ্রামে। আমি ওকে তোর জন্যে বলছি, বৈষ্ণব তত্ত্ব আমার জানা নেই। শিক্ষাগুরু বাদে যে-কাজ চোদ্দো বছর লাগে আর গুরু ধরে ওই কাজ করলে চোদ্দো দিনের মধ্যে কর্মশিক্ষা হয়ে যায়।’ দাদুর মুখে এই সমস্ত কথা শুনে মনে এক নতুন আগ্রহ বেড়ে গেল।
এক সন্ধ্যায় নওপুকুরিয়ার গোঁসাই মদনদাস বৈরাগ্যের বাড়ি গিয়ে হাজির হলাম। পাতলা ছিপছিপে লম্বা একজন মানুষ। মাথায় পাকা চুল বড় বড়, সামনে ঝুঁটি বাঁধা, মুখে দাড়িগোঁফে ভরতি। বগলে একটি সিদ্ধের ঝোলা, কয়েকজন ভক্ত নিয়ে গাঁজা খাচ্ছে। গিয়ে সামনে দাঁড়াতেই বললেন, ‘নিশ্চয়ই তোর নাম যতীন হাজরা? আয় বোস।’ মাটির একটি চারচালাঘর, চারদিকে বারান্দা নামানো। পাশে বসতেই বললেন, ‘তোকে জাফর পাঠিয়েছে?’ আমি বললাম, ‘হ্যাঁ’। আবার বললেন, ‘বল, তুই কী জানতে চাস?’ আমি বললাম, ‘আমি একজন বাউলগানের শিল্পী হতে চাই। শিল্পী হতে গেলে যে সমস্ত তত্ত্ব জানা বা শেখার দরকার তা আপনাকে সব দিতে হবে।’ উনি বললেন, ‘বিয়ে করেছ?’ ‘হ্যাঁ, তবে সে বউ নেই, মারা গেছে।’ ‘তোর শিক্ষা তো হবে না’—উনি বললেন, আরও বললেন, ‘বাউল তত্ত্ব শিখতে গেলে স্বামী স্ত্রী যুগলে মন্ত্র নিয়ে হাতে-কলমে কর্ম সাধতে হবে, কারণ আশ্রয়বিহীন সাধনা সম্ভব নয়, নিজ আশ্রয়ে রসের আলাপন, রসের কর্ম নীরসে হয় না, স্বামী-স্ত্রী যুগলে রসের কর্ম করে বাউল জগতকে জানতে হয়।’
তাই প্রত্যহ জানার কৌতূহলে সন্ধ্যায় যাওয়া শুরু করলাম। দেখতাম ওখানে যে সমস্ত ছেলে বা মানুষ যেত সকলেই প্রায় গাঁজা খেত। আর আমি গিয়ে ওদের পাশে বসে নানা গল্প করতাম। কিন্তু নিজে নেশা ভাং করতাম না বলে দূরে গিয়ে বসে থাকতাম। তাই নিজেকে শুধু পরপর বা একা লাগত। ভাবলাম এদের সঙ্গে কেমন করে কী ভাবে মেশা যায়। বাড়ি গিয়ে ওস্তাদ জাফরউদ্দিন মানে আমার প্রথম গানের গুরুদেবকে বললাম, ‘দাদু ওখানে যাচ্ছি বটে ওরা কেউ কোনও পাত্তা দিচ্ছে না। এভাবে ঘুরলে আমার জানতে বহুদিন সময় লেগে যাবে।’
উনি বললেন, ‘শিক্ষার প্রয়োজনে ঘর ঘাঁটিতে লাঠি হাতে ঘাট পাহারা দিতে হয়। জানার তাগিদে মুচির ঢাক বয়ে দিতে হয়। যেখানে গিয়েছিস ওই সমাজে মিশতে না পারলে কোনও কাজ উদ্ধার হবে না। প্রয়োজন হলে তোকেও ওদের সঙ্গে গাঁজা খেতে হবে।’ দাদুর নির্দেশ পেয়ে পরদিন গেলাম গোঁসাই-এর আখড়াতে। গোঁসাই বাবার পাশে বসে দু’-একটা কথা শুনতে বা বলতে বলতে বললাম, ‘বাবা আমাকেও না হয় কলকেটি দেন, খেয়ে দেখি কেমন লাগে।’ সকলে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বলেছিল, ‘অভ্যাস যখন নেই তখন অসুবিধা হবে।’ আমি বলেছিলাম, ‘দু’-এক টান করে খেতে খেতে অভ্যাস হয়ে যাবে আপনিই।’ যাই হোক গোঁসাই-এর হাত থেকে প্রথম কলকে নিয়ে দু’টান দিতেই মনে হয়েছিল যেন বুকের মধ্যে আগুন প্রবেশ করে ফুসফুসটা পুড়ে গেল। এর পরেও কয়েক টান দিয়ে, সন্ধ্যার পরে হেঁটে, পাশের গাঁয়েই তো বাড়ি—রাস্তায় হোঁচট খেয়ে দু’-তিনবার পড়ে গিয়েছিলাম। মাথাটা ঘুরছিল, গা পাক দিয়ে বমি শুরু হয়েছিল। বাড়ি গিয়ে ভয়ে বাবা মাকে কিছু বলতে পারিনি। বিছানায় শুয়ে অনেক রাত পর্যন্ত কেঁদেছিলাম। বারবারই মনে হচ্ছিল শিক্ষার জন্যে আমি কী করতে চলেছি। গাঁজা খারাপ জিনিস জেনেও আমাকে তাই খেতে হল। হোক। যেভাবেই হোক আর যত কষ্টই হোক আমি বাউল তত্ত্ব শিখব জানব। এইভাবে প্রত্যেকদিন যেতে লাগলাম। গিয়ে আমিও এক একদিন এক পুরিয়া গাঁজার দাম দিয়ে দিতাম। এইভাবে আমি ওদের সঙ্গে রোজ গাঁজা খেতে লাগলাম। যখন কেউ থাকত না তখন কোনও বাউল গান গেয়ে বাবাকে শুনিয়ে, সেই গানের অর্থ ব্যাকরণ করে বুঝে নিতাম। আস্তে আস্তে বাবার কাছে আমি বেশ প্রিয় হয়ে উঠলাম। আশ্রমে বসে মাঝে মাঝে ডুগি একতারা নিয়ে গিয়ে গোঁসাইকে গান শোনাতাম। বাবা কোনও ভক্তের বাড়ি গেলে আমায় সঙ্গে নিয়ে যেতেন। একদিন গঙ্গা পার হয়ে ওঁর মেয়ের বাড়ি যাব বলে দু’জনে বেরিয়েছি, গঙ্গার ঘাটে নৌকোয় চাপতে গিয়ে গোঁসাই বললেন,—‘তোর গলায় কোনও মালা নেই?’ আমি বললাম, ‘মালা মানেই তো সাইনবোর্ড ঝোলানো। দোকানে মাল নেই, আর শুধু শুধু সাইনবোর্ড টাঙিয়ে লাভ কি?’ উনি বললেন, ‘আমার ঝোলাতে এই মালাটি আছে তুই গলায় পর।’ আমি বলেছিলাম, ‘একদিনকার জন্য গলায় দেব না, যদি চিরদিনকার মতো আমাকে আমার বলে স্বীকৃতি দেন এবং নিজের হাতে মালাটি গলায় পরিয়ে দেন তা হলে আমি ওই মালা গলায় পরব।’ উনি হাসতে হাসতে বললেন, ‘বেশ তা-ই হবে, আজ থেকে তুই আমার ছেলে। আয়, আমি নিজের হাতে তোর গলায় মালা পরিয়ে দিই’ এই বলে নিজের হাতে সেই তুলসী কাঠের মালা আমার গলায় পরিয়ে দিলেন। গোঁসাই বাবার কাছে প্রত্যহই আসা যাওয়া করতাম। উনি বলতেন, ‘বৈষ্ণব প্রকৃতি, রাধারানী হচ্ছেন প্রকৃত বৈষ্ণব। তোর ঘরে যে রাধা আছে ওর সেবা না করলে সুধা পাবি কোথা থেকে? ওকে ভক্তি দিবি একটু হাত বুলিয়ে কাজ হাসিল করতে হবে।’ গোঁসাই বাবার এই বাণী মনে মনে মেনে নিয়ে আমি ভাবলাম বাউল গান বা তত্ত্ব শিখতে হলে বিয়ে আমাকে অবশ্যই করতে হবে। বাড়িতে গিয়ে রাত্রে বাবা বললেন, ‘বেশ তো অনেকদিন কেটে গেল। আমি একটি মেয়ের সন্ধান পেয়েছি, যদি তুমি রাজি হও তা হলে আমি বিয়ের ব্যবস্থা করব বা আজই মেয়ে দেখতে যাব।’ শুনে যদিও মন চাইছে তবু পুরনো স্মৃতি আবার মনকে তাড়াতে লাগল, মনে হল বিয়ে তো মানুষের একবার। বারবার বিয়ে মানেই ব্যাবসা। আমি কি ব্যাবসা জুড়লাম নাকি? মনের মধ্যে বাবার ওই কথা শুনে রাগ হল। কাউকে কোনও কথা না বলে সকাল বেলায় ডুগি একতারা গাঁজা সিদ্ধের ঝোলা কাঁধে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। রাস্তায় বেরিয়ে মনে হচ্ছে কোথায় যাই। সঙ্গে মাত্র বারো টাকা! বেলডাঙা স্টেশনে টিকিট কেটে ট্রেনে চেপে দেবগ্রাম স্টেশনে নেমে একজন পরিচিত শিল্পী নইমুদ্দিনের বাড়ি হাটগাছা গ্রামে গিয়ে উঠলাম। আমাকে দেখে ওরা স্বামী-স্ত্রীতে বলল, ‘হঠাৎ এভাবে আসার কারণ কি?’ আমি বললাম ‘মানসিকভাবে আমি সুস্থ নই, মনের অবস্থা ভাল না থাকায় আমি বাড়ি থেকে চলে এসেছি।’ ওরা আমাকে বাড়ি ফিরে যাবার জন্য বারবার পীড়াপীড়ি করতে লাগল। ওদের কোনও কথা না বলে আমি রাত্রিটা কোনওরকমে থেকে সকালে খুব ভোরে উঠে কাটোয়া ঘাট পার হয়ে কাটোয়া স্টেশনে ছোটলাইন প্ল্যাটফর্মে গিয়ে বসে দেখছি আমার পকেটে ২ টাকা ১০ পয়সা সম্বল। বেলা গড়িয়ে গেছে, পেটে ভীষণ খিদে লেগেছে। চায়ের দোকানে একটি পাউরুটি-চা খেয়ে পকেট শেষ হয়ে গেল। সন্ধ্যায় আর খিদে সহ্য হয় না। ভাবছি জীবনে কখনও কোনওদিন কারও কাছে হাত পাতিনি। ভিখারির মতো কেমন করে খাবার চেয়ে খাব। কিন্তু পেটের মধ্যে এমন যন্ত্রণা করছে যে আর সহ্য হচ্ছে না। বসে বসে খিদের জ্বালায় কাঁদতে লাগলাম। সারাদিনের মধ্যে মাত্র একটি পাউরুটি আর এক কাপ চা পেটে পড়েছে। কাঁদতে কাঁদতে কাউকে কোনও কথা বলতেও লজ্জা করছে। হঠাৎ দেখি ছোট লাইনে ট্রেন এসে লাগল। সবাই গাড়িতে উঠছে, আমিও উঠলাম গিয়ে গাড়িতে। যে-বগির মধ্যে উঠেছি, সেই বগিতে দেখছি কতকগুলো ঘোষ ছানা দিতে এসেছিল কাটোয়া বাজারে। ওরা আমাকে দেখে বলল, ‘দাদা কোথায় যাবেন?’ আমি বললাম, ‘কোথায় যাবো আমি নিজেই জানি না।’ ওরা বলল, ‘একটা গান শোনাবেন?’ আমি বললাম, ‘ভীষণ খিদে পেয়েছে। বলছেন যখন গাইছি।’ আমি পর পর পাঁচখানা গান গেয়ে শোনালাম। ওরা এর ওর কাছ থেকে আমাকে সাত টাকা তুলে দিল। টাকাটা নিতেই এত আনন্দ লেগেছিল তা লিখে বর্ণনা করা যায় না। পেটে খিদে আর হাতে এল পয়সা। ওরা কীর্নাহার লাভপুর নেমে গেল। এর পর গাড়ির অন্য বগিতে গিয়ে কেউ না বলতেই নিজে দাঁড়িয়ে দু’খানা গান করলাম। দেখছি গান শুনতে শুনতে কেউ কেউ হাত বাড়িয়ে চার আনা আট আনা আমার হাতে দিতে লাগল। গাড়িতে বসে মিষ্টি দুটি খেয়ে জল খেলাম। তারপর দেখছি গাড়ি গিয়ে আমোদপুর স্টেশনে লেগে গেল, কেউ বলছে গাড়ি ওখানেই শেষ এর ওদিকে আর যাবে না। রাত্রিবেলাতে গাড়ি থেকে নেমে একটি হোটেলে গিয়ে দু’প্লেট ভাত খেয়ে টাকা দিয়ে বাইরে এসে দাঁড়িয়ে দু’চোখ গড়িয়ে জল পড়তে লাগল। বারবার মনে হচ্ছিল জীবনে কোনওদিন কারও কাছে কিছু চেয়ে খাইনি আর আজ আমাকে পেটের জ্বালায় গান গেয়ে ভিক্ষে করে খেতে হল? ঈশ্বর কি আমার ভাগ্যে এই লিখেছিলেন? আর যদি ভাগ্যে লেখা নেই তা হলে আমাকে ভিক্ষা করতে হল কেন? যাক যতই হোক আমি বাড়ি ফিরে যাব না। ঘুরে দেখব এই দেশটা কেমন। তাই ওখানেই ওই স্টেশনে রাত্রিটা কাটিয়ে সকালে বড় লাইনে গিয়ে ট্রেনে চাপলাম। গাড়ি চলল বর্ধমান, ব্যান্ডেল হয়ে হাওড়া। গাড়ির প্রতিটি বগিতে উঠি আর কেউ বললে বা না-বললেও ২/১ খানা গান গাইতে লাগলাম। বেশ কিছু পয়সা পেতে লাগলাম।
খিদের সময় কোনও হোটেলে খেতাম, কোনও টিউবওয়েলে স্নান করতাম আর স্টেশনে পড়ে মেঝেতেই ঘুমিয়ে পড়তাম। বিভিন্ন স্টেশনে নেমে কোনও মন্দির বা কোনও পির মাজার অথবা পুরনো রাজবাড়ির নাম শুনলেই দেখে আসতাম। তারকেশ্বর মন্দির, হাওড়া পুলের নীচে হিন্দুস্থানিদের মন্দির, ফুল মার্কেটের পাশে গঙ্গার ধার—এ ছাড়াও নবদ্বীপধাম অথবা নামী মন্দির যেখানে শুনেছি সেগুলোও দর্শন করে আসতাম। এই ভাবে সাত মাস ট্রেনে ঘুরে ঘুরে একদিন ব্যান্ডেল স্টেশনে শুয়ে সকালে হাতের দিকে তাকিয়ে চমকে উঠেছি। দেখছি সারা হাত মশায় খেয়ে ঝাঁঝরা করে দিয়েছে। দেখে মনটা দমে গেল। তাড়াতাড়ি উঠে গিয়ে পানের দোকানে আয়নায় দেখছি মুখের চেহারা বিবর্ণ হয়ে গেছে, মনে হচ্ছে মুখে হাম বেরিয়েছে। মুখের ও দেহের অবস্থা দেখে মন খারাপ হয়ে গেল। গাড়িতে ক্রমাগত গান করে করে বুকে গলায় ব্যথা, নিজের কণ্ঠস্বর অপরিচিত লাগে। এভাবে ঘুরে বেড়ালে আমাকে অকালে ধ্বংস হয়ে যেতে হবে, রাস্তায় বেওয়ারিশ কুকুর বেড়ালের মতো মরে থাকতে হবে। না এটা আমার করা ঠিক হচ্ছে না। আমাকে বাড়ি যেতেই হবে।
বাড়ির পথে রওনা হবার জন্যে তৈরি হলাম নিজে। মুখ ধুয়ে দোকানে চা খেয়ে—একমুখ চুল দাড়ি, পায়ে টায়ারের চটি, গায়ে ছেঁড়া পাঞ্জাবি, পরনে মার্কিন থান—জরাজীর্ণ শরীরে বাড়ি ঢুকলাম। সমস্ত গ্রাম ভেঙে পড়ল আমায় দেখতে। বাবা মা সবাই আমার চেহারার অবস্থা দেখে কাঁদতে লাগল—ছোট ভাই বোনেরাও কাঁদছে। এই সাত মাস কত যে কষ্ট, কত না হোটেলে খেয়ে বেড়ালাম। স্নান সেরে মায়ের দেওয়া ভাত খেতে বসে পিছনের কথাগুলি মনে পড়ছিল। কারণ গত সাত মাসের মধ্যে একদিন বোলপুর স্টেশনে বিশ্রাম ঘরে মেঝেতে খালি গায়ে শুয়ে আছি, ডুগি একতারা বুকের পাশে হাতে চাপ দিয়ে রেখেছি। মশার কামড়ে ঘুম আসছে না, রাত্রি তখন প্রায় পৌনে বারোটা। এমন সময়ে দেখছি একজন খাটো চেহারার লোক, মাথায় উসকো খুসকো চুল, পরনে বিশ্রী ছেঁড়া লুঙ্গি, গায়ে একটা ছেঁড়া কালো হাওয়াই শার্ট—আমার পাশে বসে আমার হাত ধরে টানছে আর বলছে,—‘আরে এখানে শুয়ে আছিস, আমি তোকে খুঁজে পাচ্ছি না। ওঠ এতক্ষণ বোধ হয় সকলের খাওয়া হয়ে গেল। চল ওঠ দেরি করলে হবে না।’ আমি অবাক হয়ে ওই লোকটির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘আমায় কোথায় যেতে হবে, আর তুমিই বা কে? তোমাকে তো আমি চিনতে পারছি না!’ ওই লোকটি বলল, ‘আরে চিনাজানা পরে হবে তুই তাড়াতাড়ি ওঠ।’ আমি উঠে বসে বলছি, ‘আরে হাত ছাড়ো কি ব্যাপারটা বল।’ ও বলল, ‘এই খ্যাপা তুই বুঝতে পারছিস না, আরে ও পাড়ার বাজারে বাবুদের বাড়ি, মানে ওরা বিরাট বড়লোক, ওদের বাড়িতে আজ বিয়ে। বহু লোকজন খাওয়ান দাওয়ান হচ্ছে। একটু আগে গিয়ে বসতে পারলেই পেট পুরে দুটো খাওয়া যাবে।’ আমি ওর কথাটা শুনে বললাম, ‘বিনা নিমন্ত্রণে গুরুর বাড়ি খাওয়াও নিষেধ বলে জানি। আমি বিনা নিয়ন্ত্রণে ভদ্রলোকের বাড়ি খেতে যাব কী করে? বলা নেই কওয়া নেই আর ওদের বাড়ি গিয়ে খেতে বসব? তুমি যাও আমি ঘণ্টা দেড়েক আগে হোটেল থেকে খেয়ে এসেছি, আমি যাব না।’ আমার কথা শুনে— হাত ছেড়ে দিয়ে রেগে বলল, ‘তুই বড়লোকের ব্যাটা তো, তোর মেলা টাকা, তাই তুই হোটেলে খেতে গেছিস। ওঃ ওঁকে নেমন্তন্ন করতে হবে। আবে আমাদের নেমন্তন্ন দুনিয়া জুড়ে, তুই থাক, তোকে খেতে হবে না, আমি একাই যাই।’ ওই লোকটি চলে গেল।
রাতে খাওয়া সেরে বাবাকে বললাম, ‘আমার বিয়ের দরকার হয়ে পড়েছে, তুমি মেয়ে দেখ। আমি বিয়ে করব; তবে শর্ত এই, যে-মেয়েকে দেখবে তাকে বা তার বাবা-মাকে বলবে, আমার ছেলে বাউল গান করে। যদি তারা মেনে নেয় বা আমার শিল্পী জীবনের পথে বাধা না দেয় তা হলে আমি তাকে গ্রহণ করব। যদি পরে চলার পথে বাধাসৃষ্টি করে তা হলে তাকে ত্যাগ করে চলে যাব।’ বাবা আমার কথা শুনে পরদিন খুব সকালে মাকে সঙ্গে নিয়ে আমার জন্যে মেয়ে দেখতে বেরিয়ে গেলেন। আমি একটু রাত হলে ওস্তাদ দাদুর সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। আমার গলার স্বর শুনে উনি উঠে বসে দাদিকে দরোজা খুলতে বললেন। আমাকে দেখেই উনি বলে উঠলেন, ‘কতদূর গিয়েছিলি?’ আমি সেখানে যা করেছি সমস্ত কথা খুলে বিস্তারিত বললাম। উনি শুনে হেসে বললেন, ‘তোকে যা শিক্ষা দিয়েছিলাম তা অত দূর পর্যন্তই প্রচার হল। ওরে মানুষ হতে গেলে বা মানুষের সন্ধান পেতে হলে, এই মানুষের মধ্যেই অনুসন্ধান করতে হয়। পালঙ্ক বা ঐশ্বর্য সুখের মধ্যে পরম পুরুষকে পাওয়া যায় না। জীবনটাকে কষ্টের মধ্যে ডুবিয়ে ধুয়ে নিলেই সোনালি রং ফুটে উঠবে। বিশ্বের মাঝে প্রতিষ্ঠা হতে হলে চাই অক্লান্ত পরিশ্রম। যতই ঘুরবি ততই অভিজ্ঞতা সঞ্চয় হবে। আর চলমান জীবনের সমস্ত অভিজ্ঞতাই একদিন তোর কাজে লাগবে।’ এরপর দাদুকে বললাম, ‘দাদু আমার নূরতত্ত্ব গান নেই, গান কোথায় পাবো? উনি বললেন, ‘নূরতত্ত্ব গান আমার অনেক লেখা ছিল, কিন্তু সে গান এখন আমার একটিও নেই। তবে তোর শিক্ষার জন্য, আমি কাল একজন জ্ঞানী উস্তাদকে আসতে খবর দিব। আমার পরিচিত এবং বড় শিক্ষিত মানুষ। শব্দফকিরি গানের জাহাজ বলা যায়। তুই তার কাছে যে-কোনও গান নিতে বা শিখতে চাইলেই পাবি। তিনি দয়া করে যদি দেন তা হলে, কেউ তোর হাতে আর হাত দিতে পারবে না।’ তারপর দিন সন্ধ্যায় দাদু আমাকে ডেকে পাঠাল। আমি গিয়ে দেখি ওরা তিনজনে বসে, মানে আমার উস্তাদ দাদু, আরও পাড়ার একজন, ছাড়া অল্পবয়স্ক পাতলা স্বাভাবিক চেহারার অতি ভদ্র নম্র ভাবের একজন শান্ত মানুষ, পরনে লুঙ্গি, গায়ে পাঞ্জাবি, পায়ে একজোড়া দামি চটি। দেখে মনে হয়েছিল ও-পাড়ায় হয় তো বিয়ে হয়েছে, অষ্টমঙ্গলা চলছে, তাই এ-পাড়াতে হয়তো বেড়াতে এসেছে। আমি সামনে দাঁড়াতেই ওস্তাদ বললেন, ‘আয় বোস্। এই লোকের জন্যেই তোকে বলেছিলাম, এঁর নাম ডাঃ একরামূল হক, বাড়ি রামেশ্বরপুর গ্রামে, পাশে বোস্, কি বলে শোন্।’ উনি মানে ডাঃ একরামূল হক আমাকে প্রথমে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তোমার নাম কি?’ আমি বললাম ‘যতীন হাজরা’, ‘লেখাপড়া কতদূর জান? মানে পড়াশোনা কতদূর করেছ?’ আমি বললাম, ‘৮/৯ ক্লাস পড়েছি।’ তারপর বললেন, ‘তোমার সম্পর্কে সব কিছুই শুনলাম। এখন তোমার কণ্ঠে একখানা গান আমি শুনব।’ আমি বললাম, ‘একটু পরেই ও-পাড়াতে গান গাইতে যাব, ওখানে গেলেই ভাল হয়।’ উনি বললেন, ‘চল আমি তোমার গান শুনে তারপর বাড়ি যাব।’ এরপর ও পাড়ায় গান গাইতে গেলাম, ওখানে গ্রামের আরও দু’-চারজন ফকিরি গান করল। শুধু শিক্ষার জন্য চললাম গান করতে। গানের আসর চলছে, আমার সঙ্গে ও-পাড়ার ফকিরদের পাল্লাগানের ফাঁকে উনি উঠে বা আরও অনেকে অনুরোধ করায় উনি হাউড়ে গোঁসাই-এর চারখানা গান পরিবেশন করলেন। উনি ইতিপূর্বে এখানে শিল্পী হিসাবে সকলের কাছে পরিচিত ছিলেন। গানের সুর ও গায়নভঙ্গির নতুনত্বে সকলের তারিফ পেলেন। গানের শেষে উনি বললেন, ‘তুমি আগামী বুধবার আমার বাড়ি যাবে।’ আমি নির্দিষ্ট দিনে ওঁর বাড়ি গেলে ওঁর বিভিন্ন আলোচনা ভাব ভাষা বা প্রতিটি গানের ছন্দ অপূর্ব লাগল। এদিন থেকে প্রত্যেক বুধবার সকালে স্নান সেরে ওঁর বাড়ি যাওয়া আসা করতে লাগলাম। ওঁর খাতায় বিভিন্ন মহাজনের লেখা গান, অথবা নিজের রচনা গান খাতায় সারাদিন বসে বসে লিখতাম। প্রতিটি গানের কলির অর্থ ওঁকে প্রশ্ন করে জেনে নিতাম। ওঁর অফুরন্ত জ্ঞানভাণ্ডার আমায় বিস্মিত ও বিমুগ্ধ করত। ওঁর আধ্যাত্মিক জ্ঞানের গভীরতা আমায় এতদূর বিস্মিত করেছিল যে আমি অকপটে স্বীকার করতে বাধ্য, ওঁর সান্নিধ্যে না এলে বা গুরু হিসেবে ওঁকে না পেলে আমার শিল্পীজীবনে কোনও পূর্ণতাই আসত না। বহু সুকঠিন বিষয় ওঁর অসামান্য বিশ্লেষণী শক্তিতে আমার মনের দরজা সহজেই উন্মোচিত হত। এক নতুন জগৎ আমার চোখের সামনে খুলে গেল। ওঁর সহজ করে বোঝানোর গুণে সব কিছু বুঝতে লাগলাম। একদিন একটি গ্রামে গান করতে গেলে ‘নবুওত’ ‘বিলাওত’ প্রসঙ্গে পাল্লা দিল। আমি কোনও রকমে জবাবদিহি করে, গান গেয়ে ওঁর বাড়ি গিয়ে উঠলাম। কারণ আসরে পাল্লা চলাকালীন বিচারকমণ্ডলী আমার বা পাল্লাদার শিল্পীর গান বিচার করে আমার হার রায় দিল, এতে মনে অসম্ভব ধাক্কা লাগল, ঠিক করলাম আর গান করব না। ডুগি একতারা ভেঙে ফেলে দেব ঠিক করলাম, বাড়ি না এসে ডাঃ একরামুল হকের বাড়ির পথে পা বাড়ালাম। ওঁর কাছে গিয়ে সব ঘটনা অকপটে জানিয়ে গান আর কখনও না-করার সিদ্ধান্তও তাঁকে জানালাম। আমার মতে— এত ভাল করে গান করা সত্ত্বেও ইচ্ছা করে অপমান করার জন্যে— এই রায় দিয়েছে। উনি সব শুনে গম্ভীর হয়ে গেলেন। তারপর ধীরে ধীরে খুব দৃঢ়তার সঙ্গে বললেন, ‘ওরা ঠিকই করেছে। সম্মুখ সমরে এবার এর উপযুক্ত জবাব দেবার জন্য নিজেকে আরও দৃঢ়তার সঙ্গে প্রস্তুত কর। আজ থেকে তোমাকে আরও গভীরভাবে এই তত্ত্ব, এই গান শিখতে হবে। মনের মধ্যে যে রাগ জমেছে ভাল করে শিক্ষা নিয়ে ওই শিল্পীকে কোনও একটি আসরে ফেলে দাঁত ভাঙা জবাব দিতে হবে।’
মনের ঝোঁক জেদ আরও বেড়ে গেল। দিনরাত শুধু গানই আমার ধ্যান, গানই আমার সাধনা। ন’মাস পরে ওই শিল্পীকে আমাদের গ্রামের এক আসরে পেলাম। এর সঙ্গে সারারাত্রি পাল্লা গান করে প্রশ্নের পর প্রশ্ন রেখে বুঝিয়ে দিলাম অন্যায় বিচার করে বড় হওয়া যায় না।
এদিকে বাবা-মা আমার কথা অনুযায়ী একটি ১২/১৩ বছরের মেয়ের সঙ্গে আমার বিয়ের সম্বন্ধ আনলেন। মেয়েটি দেখতে সুশ্রী, আমাদের পরিবারের সব কথাই খুলে বলেছেন বাবা। বিয়ের দিন ধার্য হল। দু’দিন পরে দু’জন মানুষ আমাদের বাড়ি এলেন আমাকে দেখতে সন্ধ্যার সময় নানান কথা চলছে, দেনাপাওনা কিছুই নেই, শুধু একটি লালপাড় শাড়ি পরিয়ে বিয়ে হবে ঠিক হল। ৩০/৩৫ জন বরযাত্রী যাবে—এ কথাও হল। সবশেষে মেয়ের দাদা আমার একতারা হাতে নিয়ে পরপর দু’খানা বাউল গান গেয়ে শোনালেন এবং জানালেন উনি গান করেন। শুনে মনে খুব আনন্দ ও উৎসাহ জাগল। ভাবলাম মেয়ের দাদা যখন বাউল গান গাইল— নিশ্চয়ই কোনও বাধা বা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে না এরা। এর পর আটদিন পর চুলদাড়ি কেটে ধুতি পাঞ্জাবি পরে টোপর মাথায় দিয়ে বিয়ে করে আনলাম। নতুন বউ ঘরে এনে ফুলশয্যার রাতে বললাম, ‘আজ থেকে তুমি আমার স্ত্রী— সামনে আমাদের যে দিনগুলি— শুধু খাওয়া শোওয়া নিয়ে আমরা জীবন কাটাব না, আমি বাউল রসের কর্ম তোমাকে নিয়ে করতে চাই। সে কর্ম যতই জঘন্য হোক তোমার মুখ থেকে “না” শুনতে চাই না। এতে তোমার অভিমত কী?’ আমার স্ত্রী বলেছিল, ‘আমি এতকাল বাবামায়ের ছিলাম, ওরা আমাকে চিরদিন রাখতে পারল না, তাই তোমার হাতে তুলে দিয়েছে। আমি তোমার। তুমি যে কর্ম বলবে বা করবে আমার মুখ থেকে “না” শব্দ কোনওদিন উচ্চারণ হবে না, সে যতই কঠিন হোক।’ স্ত্রীর মুখে এই কথা শুনে মনে খুব আনন্দ হয়েছিল উৎসাহ পেয়েছিলাম। তাই গোঁসাই-এর শিক্ষা দেওয়া কর্ম নিজে স্বামী স্ত্রীতে হাতে-কলমে শুরু করলাম। ত্রুটি মনে হলেই গোঁসাইকে গিয়ে প্রশ্ন করতাম বা সঠিক যোগের হিসাব নির্ণয় করে নিতাম। এইভাবে কেটে যেতে লাগল— দ্বিতীয় মিলন জীবনের বৈষ্ণব কর্মজীবন। মনে মনে চিন্তা করলাম হাউড়ে গোঁসাই-এর একখানি গানে বলেছে সংসার করব কিন্তু সৃষ্টির পথ অবরুদ্ধ রাখব (‘হাউড়ে বলে রাখব না আর বংশে দিতে বাতি’)। এই চিন্তা ধারা নিয়ে জীবনের পাঁচটি বছর অতিক্রান্ত হল।
এবার এক নতুন সমস্যা দেখা দিল। দীর্ঘদিন গান গেয়ে বাইরে কাটানোর পর বাড়ি ফিরে এলে স্ত্রী কান্নাকাটি শুরু করল। আমি গ্রাম গ্রামান্তরে গান গেয়ে ফিরি। কিন্তু স্ত্রী ঘরে একা বড় শূন্যতার মধ্যে থাকে। একদিন বলেই ফেলল ‘তুমি বিভিন্ন গ্রামে গান করে বেড়াবা আর আমি একা ঘরে চুপ করে শুয়ে পড়ে থাকব— এটা হয় না। যদি একটি ছেলেমেয়ে না হয়— তা হলে একা থাকব কী করে? সন্তানহীন বাড়ি বড় বেমানান।’ বাবা-মাও একই কথা বারবার বলতে লাগলেন। সংসারের এই হাল দেখে এবং সকলের কথা শুনে গোঁসাই-এর যোগের হিসাব করে একটি শুভ যোগ দেখে বীজবপন করলাম এবং নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে শুভক্ষণে জন্ম নিল একটি মেয়ে। বাড়িতে সকলের ইচ্ছা একটি পুত্র সন্তান হোক, আমিও ছেলেই হবে বলেছিলাম মুখে, কিন্তু গোঁসাইয়ের ছক অনুযায়ী মেয়ের যোগে বীজ বপন করলাম—অথচ মুখে স্ত্রীকে একথা না জানিয়ে ছেলেই হবে জানালাম। এই দ্বিচারিতার কারণ হল—বংশবৃদ্ধি চাইনি আমি—অথচ সংসার ও স্ত্রী সন্তান চায়— তাই মুখে পুত্র হবে বললেও কার্যত একটি কন্যা-সন্তানেরই জন্ম দিলাম। ভেবে দেখলাম— মেয়েটি বড় হলে বিবাহ দিলে গোত্রান্তরিত হবে—আমার বংশবৃদ্ধি হবে না। তা ছাড়া পুত্র জন্মালে বংশবৃদ্ধি যেমন হবে তেমন সে যে আমার কর্ম করবে এমন কোনও কথা নেই।
এই ঘটনার বেশ কিছুদিন পরে হঠাৎ একদিন ডাঃ একরামূল হক মানে আমার ওস্তাদ, আমার বাড়ি এলেন এবং জানালেন আগামী ১৪ই চৈত্র বর্ধমান জেলার কেতুগ্রাম থানার আনখোলা গ্রামে আমাকে গান গাইতে যেতে হবে পির সাহেবের বাড়ি। আমি এর আগে বৈরাগ্যতলা, অগ্রদ্বীপ ধাম, পাথরচাপুড়ি, কল্যাণী ঘোষপাড়া সতীমায়ের মেলা— প্রভৃতি বিভিন্ন মেলায় গান করেছি— যে সব সাধু-বৈষ্ণব দর্শন করেছি তাঁদের প্রত্যেককে একটি প্রশ্ন করেছি। কিন্তু কেউই আমার প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেননি। প্রশ্নটি হল— ‘আয়না লাগে নিজের মুখ দেখতে গেলে—আয়না ছাড়া নিজের মুখ দেখার উপায় কি?’ আরেকটি প্রশ্নও করি— ‘সেটি হল বাড়িতে বসে রেডিওর সুইচ টিপলে নির্দিষ্ট নম্বরে আকাশবাণী কলকাতার কথা বা গান, খবর শোনা যায় বিনা তারে। আমি থাকব বাড়িতে আর গুরুদেব থাকবেন তার নিজের বাড়িতে, বিনা তারে তাঁর সঙ্গে কথোপকথন হবে কি ভাবে? আপনারা কেউ কি পারবেন আমাকে এই তথ্য বা তত্ত্ব বুঝিয়ে দিতে বা কথোপকথন করতে?’ কোনও গুরুবৈষ্ণব বলতে পারেননি যে তিনি পারবেন। তাই আমার দীক্ষা মন্ত্রও সে পর্যন্ত নেওয়া হয়নি। তাই বর্ধমান জেলায় যখন গান করতে গেলাম ডাঃ একরামূলের সঙ্গে, তখন পিরবাবার বাড়িতে উর্স্ উপলক্ষে বিভিন্ন গান পরিবেশন করে শোনালাম। গান শেষে সকাল বেলায় পিরবাবার সামনে গিয়ে বসলাম বিদায় নেবার জন্যে। অপূর্ব জ্যোতির্ময় পুরুষ। দর্শনেই প্রত্যয় হয় তাঁর সাধক সত্তা। সুডৌল দোহারা লম্বাদর্শনধারী মানুষ। মনে পড়ে গেল আমার গোঁসাই বাবার কথা, গোঁসাই বলতেন, ‘গুরু গুরু সর্বলোকে কয় আর গুরু দর্শন হওয়ামাত্রই কৃষ্ণপ্রাপ্তি হয়।’ যে গুরুর মুখচন্দ্রিমার মধ্যে কৃষ্ণের জ্যোতির্ময় আভা উজ্জ্বল প্রতিভা ভেসে ওঠে, সেই গুরু স্বয়ং গোবিন্দ। তাই পিরবাবার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে এদিক ওদিক চাইতে থাকলাম। পিরবাবা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘কি গো আমার এখানে কোন অসুবিধা হল না তো?’ আমি বললাম ‘না’। উনি বললেন, ‘গান কোথায় শিখেছ?’ আমি বললাম ‘বাল্যগুরু জাফরউদ্দিনের কাছে, আমার বাড়ির কাছেই একই গ্রামের মানুষ। আর এখন গুরু হলেন ডাঃ একরামূল হক।’ একরামূল হক পাশেই দাঁড়িয়ে আছেন নত মস্তকে। তারপর পিরবাবা আমার দিকে হাত বাড়িয়ে কিছু টাকা দিতে এলেন। আমি বললাম, ‘টাকা পয়সা আমি আপনার কাছ থেকে কিছু নেব না।’ উনি স্মিত হেসে বললেন, ‘কি নেবে?’ আমি বললাম, ‘আয়না লাগে নিজের চেহারা দেখতে হলে। আয়না ছাড়া নিজের চেহারা দেখা যায় কি ভাবে? তা ছাড়া আপনি থাকবেন আনখোলায় আর আমি থাকব কাপাসডাঙ্গায়, বিনা তারে আপনার সঙ্গে কথাবার্তা হবে কি ভাবে? এই কর্ম বা পদ্ধতি আপনাকে দিতে হবে।’ আমার কথা শুনে উনি হেসে বললেন, ‘হ্যাঁ দেবো আমি। ঐ জন্যেই বসে আছি। আর ঐ কর্তব্য ঠিকঠাক পালনের জন্যেই এনায়েতপুর গ্রাম, মেদিনীপুর জেলার খোদা নেওয়াজ সামসুল আউলিয়ার দরবার থেকে মাথায় পাগড়ি নিয়ে বসে আছি। এই তথ্য তত্ত্ব জানানোই আমার কাজ। তবে এসব জানতে হলে তোমাকে আমার কাছে বায়েত করতে হবে। আর আমার কাছে দীক্ষামন্ত্র নিলে তোমার জাত যাবে, তোমার সমাজ তোমাকে ত্যাগ করবে। বাবা-মা এঁরা কেউই তোমাকে মেনে নেবেন না। তাই আমার ইচ্ছা এই যে বাড়ি গিয়ে বাবা-মা-কে জিজ্ঞাসা করে অনুমতি নিয়ে আসলে তবেই তোমায় আমি দীক্ষা মন্ত্র দেব।’
তাঁর নির্দেশমতো আমি বাবা-মায়ের কাছে সব কথা খুলে বললাম, একজন শিল্পীর পক্ষে জাতধর্ম মেনে সত্যিকারের শিল্পী হওয়া যায় না। শিল্পীকে তার সিদ্ধির স্তরে পৌঁছুতে হলে জাতের গণ্ডির মধ্যে নিজেকে বদ্ধ করে রাখলে সকলের জন্যে গান কীভাবে উঠে আসবে আমার শিল্পী চেতনায়? বাবা-মা বুঝলেন আমার বেদনা ও সমস্যা। তাঁরা আমাকে আমার বিবেক অনুযায়ী চলার নির্দেশ ও পরামর্শ দিলেন। বংশের বড় ছেলে বলে আমার করণীয় কর্তব্যের কথাও মনে রাখতে পরামর্শ দিলেন। দু’-চারদিন দারুণ ভাবনার মধ্যে কাটিয়ে অবশেষে সব সংকোচ, সংস্কার ও ক্ষুদ্রতার গণ্ডি থেকে নিজেকে মুক্ত করে অথচ বংশ মর্যাদার পক্ষে হানিকর এমন কোনও কাজ না করার শপথ নিয়ে পিরবাবার শরণাপন্ন হবার সংকল্পে অটল হলাম। আটমাস পর ওই পিরবাবা বেলডাঙা থানার রামেশ্বরপুর গ্রামে উর্স্ উপলক্ষে এলেন। পিরবাবার নাম হল— জমানায়ে আয়েফবিল্লা হজরত শাহ,, সুফি খাজা জয়নাল আবেদিন আল চিশতি (রহঃ)। উনি এলে ওঁর ভক্তদের কাছে খবর পেয়ে গানের সূত্র ধরেই ওঁর কাছে গেলাম। সন্ধ্যায় গান শেষ হল। রাত তিনটের সময় আমার দ্বিতীয় ওস্তাদ ডাঃ একরামূল হক আমাকে ডেকে নিয়ে গেলেন ওঁর কাছে। সামনে বসে সানুনয়ে বললাম, ‘বাবা আপনার কাছে দীক্ষা নিতে চাই।’ উনি আমার মুখের দিকে চেয়ে আবার বললেন, ‘সমাজ সংসার মেনে নেবে তো?’ আমি বললাম, ‘সমাজ আমি মানি না— বাবা-মায়ের আশীর্বাদ নিয়ে আপনার কাছে এসেছি। যত কঠিন ও দুঃসাধ্য হোক না কেন আমি আপনার নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করব। সব কিছু শেখার জন্যে— জানার জন্যে আমি যে-কোনও কঠিন কাজ করতে প্রস্তুত।’ উনি তখন আমাকে হাত মুখ ধুয়ে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হয়ে শুদ্ধ কাপড় পরে ওঁর সামনে বসার নির্দেশ দিলেন। ওঁর নির্দেশমতো হাত মুখ ধুয়ে এসে ওঁর সামনে বসলাম। ‘তোমার সমাজ যদি ত্যাগ করেও আমি তোমায় ত্যাগ করব না—তবে তোমায় কিছু পরীক্ষা দিতে হবে। একলব্যকে যেমন দ্রোণাচার্য পরীক্ষা করে নিয়েছিলেন আমিও তোমায় পরীক্ষা করে নেব।’ আমি বললাম, ‘যদি আপনি নিতে পারেন তবে আমিও দেবার জন্যে প্রস্তুত থাকব সদাই।’ এর পর হাতে হাত রেখে দীক্ষামন্ত্র পড়ে দীক্ষা নিলাম।
এরপর থেকে যাওয়া আসা শুরু হল ওঁর দরবারে, সেখানে গিয়ে নানান প্রশ্ন রাখতাম আধ্যাত্মিক জগৎ নিয়ে এবং ‘এলাম মারফৎ’ তথ্য তত্ত্ব সম্পর্কে জানতাম। একদিন গিয়ে বললাম, ‘বাবা আমার খাতার গান মুখস্থ হয় না।’ উনি বললেন, ‘ওগো তোমাকে আর খুব একটা খাতা খুঁজতে হবে না। কারণ আমার এই দেহ-খাতার দিকে লক্ষ রাখো। প্রয়োজনে আমি আসরে গান পৌঁছে দিব।’ সেই থেকে তেমন আর খাতাপত্র পড়ি না, আসরে গান করতে উঠলেই গুরুদেবকে স্মরণ করি তখন প্রতিটি গানের প্রশ্নের উত্তর আপনিই মনের মধ্যে বা চোখের সামনে ভেসে ওঠে। মঞ্চে উঠে অথবা ওঠার আগে বর্তমান পরিস্থিতিকে নিয়ে কোনও গান গাওয়ার প্রয়োজন দর্শক তথা কর্তৃপক্ষ বললে ঠিক সেই মুহূর্তে গুরুদেবকে স্মরণ করলে আমি দেখেছি আপনিই সেই গান প্রসঙ্গে নানা ছন্দভাষা মনে উদয় হয়ে যায়।
একদিন এক বিয়ে সংক্রান্ত ব্যাপারে ঘর বর দেখতে গিয়েছিলাম। ওখানে যা খেয়েছিলাম বা ওরা যা খাইয়েছিল আমি যথেষ্ট বেছে বা দেখেশুনে খেলাম। বাড়ি এসে রাতে কিছু না খেয়ে শুয়ে পড়লাম। রাত্রি দেড়টা নাগাদ স্বপ্ন দেখলাম একটি কড়াইয়ে কে যেন আগুনকে জ্বাল দিয়ে জলের মতো তরল করল। তারপর দুজনে ধরে যেন আমার গায়ে ঢেলে দিল। সঙ্গে সঙ্গে বিকট যন্ত্রণায় আমি যেন ছটফট করতে লাগলাম। ভয়ংকর চিৎকার করে উঠতেই দেখছি আমার স্ত্রী আমাকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরে বলছে, ‘কি হল? তুমি অমন করছ কেন?’ আমি চেতন হয়ে মানে ঘুম ভেঙে দেখছি সারা শরীরে ধুলো লেগে, আর সারা শরীর লঙ্কাবাটা দিলে যেমন জ্বালা করে তেমনি জ্বলছে আর সারা শরীরে অসংখ্য ছুঁচ কে যেন ফুটিয়ে দিচ্ছে। জ্বলনে ছটফট করতে করতে কাঁদতে লাগলাম। আমার বাবা-মাও চিৎকার শুনে ঘুম থেকে উঠে আমার অবস্থা দেখে বারবার জিজ্ঞাসা করতে লাগলেন কী হয়েছে? আমি বললাম, ‘কি হয়েছে জানিনে কিন্তু সারা শরীর হু হু করে জ্বলছে আর কাঁটার মতো কি যেন বিঁধছে।’ ওঁরা খুব অবাক হলেন এবং দুশ্চিন্তায় অস্থির হয়ে পড়লেন। সারাটা রাত এই অসহ্য কষ্টের অনুভূতি নিয়ে কাটল। সকালে একজন কবিরাজের কাছে গেলাম। উনি হাত চালিয়ে বললেন ‘জ্বালাবাণের ওষুধ খাইয়ে তোমার সারা শরীর জ্বালিয়ে দিয়েছে।’ ওখান থেকে অন্য একজন ওস্তাদের কাছে গেলাম। ওই একই কথা বললেন, নানা ওষুধ খেলাম, অনেক ঝাড়ফুঁক করালাম, ডাক্তারি ওষুধও খেলাম, কিন্তু আমার শরীরের জ্বালা কেউ প্রশমিত করতে পারলেন না। তিনদিন তিনরাত্রি কষ্ট পাওয়ার পর কোথাও যখন জ্বালার উপশম হল না— তখন নিরুপায় হয়ে আনাখোলা জয়নাল বাবার দরবার শরীফে আমার দীক্ষা গুরুদেবের বাড়ি বিকাল চারটায় সময় গিয়ে পৌঁছুলাম। বাবা বারান্দায় বসে আছেন। গিয়ে প্রণাম করতেই উনি বললেন, ‘কি গো খুব কষ্ট হল আসতে। জ্বলন একটু হয়েছে, ভয় নেই গো, গুরু যার-সাহারা তার আবার ভয় কি? আমি তোমার সঙ্গেই আছি। চলার পথে একটু বিস্মরণ হলেই একটু জ্বলন সইতেই হয়। যাও তোমার মায়ের কাছে কিছু খেয়ে এসো তারপর বসবে।’ আমি মায়ের কাছে গিয়ে প্রণাম সেরে চা-মুড়ি খেয়ে এসে বাবার পায়ের নীচে বসলাম। কিন্তু আমার শরীরের জ্বালা এবং কাঁটাবেঁধার অনুভূতির কথা তখনও বাবাকে কিছু বলিনি বা বলার সুযোগ হয়নি। কয়েকজন শিষ্য চারপাশে বসে আছেন। আমি ভাবছি আমার শল্পীরের কষ্টের কথা বাবাকে কীভাবেই বা জানাব? সন্ধ্যা নেমে এল। বাবা বললেন, ‘কেউ সেজরা শরীফ পাঠ করো।’ একজন মুরিদ উঠে দাঁড়িয়ে সেজরা শরীফ পাঠ করলেন। কিছুক্ষণ পর বাবা বললেন, ‘যতীন দু’-একটি গান গেয়ে শোনাও।’ আমি বললাম, ‘বাবা শরীরের অবস্থা ভাল নয়।’ উনি বললেন, ‘সেই জন্যেই গান করতে বলছি গো। গাও, তুমি গাইবে আর আমি শুনব। ওগো গুরুদেবকে আর গুণকীর্তন শোনাতে যন্ত্র লাগে না।’ যন্ত্র ছাড়াই আমি পরপর পাঁচখানা গান গেয়ে শোনালাম। উনি নিশ্চুপ হয়ে আমার গান শুনে বললেন, ‘যতীন একটু তেল নিয়ে এসো, আমার পায়ে দিয়ে দাও। শরীরটা ভীষণ জ্বালা পোড়া করছে।’ আমি মনে মনে অবাক হয়ে ভাবছি বাবা তো কোনওদিন কাউকে পায়ে তেল ডলে দিতে বলেন এমন শুনিনি, অথচ আজ উনি ও-কথা বলছেন কেন? উঠে গিয়ে মায়ের কাছ থেকে তেলের বাটি নিয়ে এসে নিজে হাতে ওঁর দু’পায়ে তেল মালিশ করে দিতে দিতে কখন যেন বসে বসেই ঘুমিয়ে পড়েছি, চমকে উঠে বাবা বললেন, ‘শরীরটা বড় ক্লান্ত, যাও মায়ের খাওয়ার ডাক পড়েছে।’ আমি আমার কথাটা বলার জন্য ইতস্তত করছি। উনি ‘যাও তোমার মা ডাকছেন, খেয়ে এসো’ বললেন। আমি কোনও কথা না বলে উঠে মায়ের দেওয়া ভাত খেয়ে এসে পায়ের কাছে বসে দেখছি কেউ নেই, বাবা একা। ভাবলাম এই সুযোগ। বললাম, ‘বাবা আমার দেহের অবস্থা খুব খারাপ। এক আত্মীয়ের বাড়ি গিয়েছিলাম— তারা আমায় “জ্বালাবাণের” ওষুধ খাইয়ে দিয়েছে। আজ তিন দিন তিন রাত্রি দু’চোখে ঘুম নেই। সারা শরীর জ্বলে গেল।’ উনি শুনে হেসে বললেন, ‘তোমাকে তারা ওষুধ খাইয়েছে, আর তুমি এসে তোমার গুরুর বাড়ি মায়ের হাতে ভাত খেয়েছ। যাও সমান সমান হয়ে গেল। চুপচাপ শুয়ে পড় গিয়ে। সকালে উঠে একগ্লাস জল-পড়া করে দেব, তুমি খেয়ে নেবে, সব ভাল হয়ে যাবে। যাও তোমার গুরু সাহারা কোনও ভয় নেই।’ আমি উঠে গিয়ে শুয়ে পড়লাম সেই ঘরের মধ্যে। সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়লাম— ঘুম ভাঙল সকালবেলায় একজন পিরভায়ের ডাকে। উঠে দেখি বাবা কলের কাছে দাঁড়িয়ে, কাছে যেতেই বাবা এক গ্লাস জল ফুঁকে দিয়ে আমার হাতে দিলেন। আমি জলটা এক নিশ্বাসে চুমুক দিলাম। তারপর শরীরটা অদ্ভুত ঠান্ডা হয়ে এল, সেই তীব্র জ্বালা, কাঁটা-বেঁধা সবই উধাও। শরীর একেবারে ঝরঝরে হয়ে গেল। বাবা বললেন, ‘আর কোনও অসুবিধে নেই তুমি সোজা বাড়ি চলে যাও। বাড়ির সবাই দুশ্চিন্তা করছে।’ আমি সুস্থ দেহমন নিয়ে বাড়ি ফিরে এলাম।
তখন সংসার জীবনে বিড়ির ব্যাবসা করতাম। শ্রমিক ছিল তেরো জন। নদিয়া জেলার পলশুড়া, বারুইপাড়া গ্রামে বিভিন্ন দোকানে হকারি করে মাল দিয়ে বেড়াতাম সপ্তাহে দু’দিন। আর যে-কোনও সময়ে কোনও গ্রাম থেকে গানের বায়না পেলে ব্যবসায়ে না গিয়ে গান করতে যেতাম। কারণ যেদিন থেকে গানের দিকে নজর দিলাম তখন থেকে গানই আমার কাছে এত প্রিয় হয়ে উঠল যে গান গাইতে কেউ নিষেধ করলে বা আমার গানের বিরোধিতা করলে মাথায় যন্ত্রণা শুরু হত। সে যতই প্রিয় হোক না কেন মুখের সামনে তাকে অপমান করতে দ্বিধা কসুর করতাম না। এখনও পর্যন্ত গানের জগৎ সম্পর্কে কেউ কটাক্ষ করলে এতই ক্ষুব্ধ হই যে ভাষায় প্রকাশ করতে পারি না। কয়েকদিন আগে একজন মৌলবি এসে বলল, ‘দাদা আপনার মুখে দাড়ি ঠিক আছে কিন্তু গোঁফ যা রেখেছেন সামনের ক’টা ছেঁটে ছোট করে রাখলে ভাল হয়।’ মৌলবির প্রশ্নের জবাবে বিরক্ত হয়ে বললাম, ‘আপনার ওই পর্যন্ত শিক্ষা হয়েছে, তবে ওই শিক্ষাতে ওই তত্ত্ব বুঝতে পারবেন না, প্রাইমারি স্কুলের ছাত্রকে কলেজের শিক্ষা বললেও বুঝতে পারবে না। কারণ তার মাথায় তেমন বোঝার মতো মগজ তৈরি হয়নি।’
সাম্প্রতিক কালে সরকারের আনুকূল্যে সার্বিক সাক্ষরতার কাজ শুরু হয়েছে। বাড়ির সামনে পঞ্চায়েত মিটিং এর আয়োজন সকাল থেকে চলছে। একটা প্রাইমারি স্কুল চত্বরে এটা হচ্ছে। হঠাৎ সেক্রেটারি সাহেব এসে বললেন, ‘যতীন, আজ আমাদের এখানে মুর্শিদাবাদ জেলা তথ্য ও সংস্কৃতি আধিকারিক দপ্তর থেকে বিভিন্ন সাক্ষরতা ভিত্তিক নাটক, বাউলগান পরিবেশন করা হবে। তুমিও তো বাউল গান করো— মঞ্চে ২/৪ খানা গান গাইলে হত না।’ আমি বললাম, ‘সাক্ষরতার গান কেমন হবে আমার তো তেমন কোনও গান জানা নেই।’ উনি বললেন, ‘মানুষকে লেখাপড়া শেখার জন্যে উদ্বুদ্ধ করা, অর্থাৎ উৎসাহ জোগানো— এমন কিছু গান তোমায় গাইতে হবে।’ বাড়ি গিয়ে বসে কলম ধরে পরপর চারখানা গান লিখলাম। তারপর সন্ধ্যায় মঞ্চে গিয়ে সকলের সামনে দাঁড়িয়ে ওই গান গাইতে লাগলাম। লক্ষ করে দেখেছি, মুর্শিদাবাদ জেলা তথ্য সংস্কৃতি আধিকারিক আমার মুখের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন। গান শেষে মঞ্চ থেকে নেমে আসতেই উনি বললেন, ‘তুমি এত সুন্দর গান করতে পারো, তা আমাদের সঙ্গে আগে থেকে যোগাযোগ করনি কেন?’ আমি বললাম, ‘কারও কাছে তেলিয়ে বলাটা আমি পছন্দ করি না। দুটো গান শিখে বিভিন্ন অফিসে ধরনা দিয়ে বলে বেড়াব আমি একজন শিল্পী আমাকে প্রোগ্রাম দিন, ডাকুন গোছের কথা বলে বেড়ানো আমার পেশা নয়, আমি গরিব হতে পারি তবে ভিখিরি নই। গাছের বিচার ফলে। আমি যে কী শিল্পী কেমন শিল্পী সেটা বিচার হবে আমার গানে বা জ্ঞানে। গুরুদেব দয়া করে যে শিক্ষা দিয়েছেন, যা শিখিয়েছেন, ঝোলার মধ্যে পুরে নিয়ে ঘুরে বেড়াব, নিশ্চয় জ্ঞানীর বাজার কোথাও না কোথাও মিলবে সেখানে নিশ্চয়ই আমি মর্যাদা পাব।’ তারপর মদনমোহনবাবু বললেন, ‘আগামীকাল মির্জাপুর গ্রামে অনুষ্ঠান হবে, তুমি সন্ধ্যায় তোমার যন্ত্রসঙ্গীসহ গিয়ে অনুষ্ঠানে যোগ দেবে।’ আমার শুনে মনে বড়ই আনন্দ হল। পরদিন মির্জাপুর যাবার জন্য তৈরি হচ্ছি আর আকাশে মেঘ ঘনিয়ে আসছে। সঙ্গীরা আকাশের দিকে তাকিয়ে বলছে এই মেঘ মাথায় নিয়ে কীভাবে রওনা হবে? আমি তাদের সংশয় দেখে বললাম, ‘জীবনে প্রথম সরকারি বাবুরা ডেকেছেন, যত কষ্ট বা বাধা আসুক না কেন আমরা যাবই। নিশ্চয়ই গুরুদেবের আশীর্বাদ আমার সঙ্গে থাকবে সর্বদা, তাঁর আশীর্বাদ আমার মাথায় ছাতার মতো আচ্ছাদিত হয়ে আমার রক্ষা করবে— দেখো বৃষ্টি হবে না।’ সবাই আমরা নির্বিঘ্নে মির্জাপুর পৌঁছুলাম। মদনমোহনবাবু বরুণবাবু আমাদের দেখে সন্তুষ্ট হয়ে প্রথমেই আসরে আমাদের গান গাইবার সুযোগ দিলেন। গুরুদেবকে স্মরণ করে মঞ্চে উঠতেই মির্জাপুরের মানুষ বিশেষ করে মুসলিম পল্লিতে আমার নাম ডাক আছে ইসলামি গান করার জন্য— আমাকে দেখে বা যাওয়া দেখে আরও বেশি জনসমাগম হল সেদিন। গান পরপর সাত আটখানা গাইলাম। গানের সবাই খুব প্রশংসা করল। গানের শেষে ভাল মিষ্টি পাউরুটি খাওয়াল। রাতে বাড়ি ফিরে এলাম। বাড়ি ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে তুমুল বৃষ্টি শুরু হল। ওই প্রথম মদনমোহনবাবুর সঙ্গে আমার পরিচয় হল। এর কিছুদিন পর আমার বাড়িতে চিঠি এল একটি। সেই চিঠিতে জানলাম ফারাক্কার অর্জুনপুর হাইস্কুলে বাউল ফকির রাজ্যসম্মেলন হবে। দু’জনকে ডেকেছে। চিঠিটা নিয়ে গিয়ে ওস্তাদ জাফরউদ্দিন ও গোঁসাই মদনদাস বৈরাগ্য ও ডাঃ একরামূল হককে দেখালাম। ওঁরা দেখে খুব খুশি হলেন এবং আশীর্বাদ করলেন। ওঁদের ও বাবা মায়ের আশীর্বাদ নিয়ে চললাম আমরা অর্জনপুর হাইস্কুলের সম্মেলনে। গিয়ে দেখলাম অজস্র নামী দামি শিল্পীর জমায়েত। এঁদের মধ্যে আমি কীই বা গাইব এই সব নানা চিন্তা করছি। বাউলের পোশাক তৈরি করানো হয়েছিল। প্রথম দিন সকালে পোশাক পরে নগর পরিভ্রমণ করে রেললাইনের পাশে একটি বাগানে মঞ্চে জমায়েত হলাম এবং প্রথম দিন একটি গান পরিবেশন করার জন্যে নাম লিখে দিলাম, বৈকাল তিনটে থেকে রাত্রি এগারোটা পর্যন্ত বসে থেকে একটি গান করারও সুযোগ হল না। তখন শেষে স্কুলে ফিরে এসে পোশাক খুলে খেয়ে শুয়ে পড়লাম। দ্বিতীয় দিন আবার বিকালে, তিনটার সময়ে পোশাক পরে মঞ্চের পাশে হাজির হলাম, দেখছি প্রতিটি শিল্পী একখানা করে গান পরিবেশন করার সুযোগ পাচ্ছে। আমি ওইদিন রাত্রি এগারোটা পর্যন্ত বসে থেকে একটিও গান করার সুযোগ পেলাম না। রাতে স্কুলে এসে পোশাক খুলে খেতে যেতে আর মন চাইছে না। বারবারই মনে হচ্ছিল সেই কাপাসডাঙা থেকে এই অর্জুনপুর সম্মেলনে এসে একটি গান গাওয়ারও কি সুযোগ হবে না? বাড়ি ফিরে গিয়ে যখন গুরুদেব জিজ্ঞাসা করবেন, কোন গানটা গাইলাম, আমি কি জবাব দেব? এখানে কি শুধু খেতে আর পয়সা নিতে এসেছি? নিজেকে নানা প্রশ্নে ক্ষতবিক্ষত করতে থাকলাম। মনে হল— না এভাবে তো চলতে পারে না। এইভাবে তৃতীয় দিন এল এদিনও পোশাক পরে মঞ্চের পাশে আবার এসে দাঁড়ালাম, নিজের নাম লিখিয়ে ডাকের অপেক্ষায় রইলাম। এই দিনই শেষ দিন— তাই অধীর আগ্রহে ও উৎকণ্ঠায় সময় পার হতে লাগল। তারপর রাত্রি আটটার কাছাকাছি আমি অধৈর্য হয়ে বরুণবাবুর কাছে গিয়ে বললাম, ‘একটি গানও গাইবার সুযোগ পেলাম না— এই ক’দিনে— গানই যদি না গাইব তা হলে কেন এখানে এসে তিনদিন হত্যে দিয়ে পড়ে আছি? কেন আসতে বললেন এখানে?’ উনি বললেন, ‘তুমি এখনও গাইতে পাওনি?’ আমি বললাম, ‘সুযোগ কোথায়? আপনারা তো নামী দামি বেতার ও দূরদর্শন শিল্পী নিয়েই মহাব্যস্ত।’ উনি বললেন, ‘যাও আমি তোমার নাম প্রচার করছি, যাও মঞ্চে যাও।’ আমি বললাম, ‘আমি একা কি করে যাব— আমার সঙ্গে আরও তিনজন শিল্পী এসেছেন— আমার সঙ্গে তাঁদের নামও প্রচার করুন। সঙ্গত করার জন্য এই তিনজন শিল্পী ছাড়া গান তো শ্রীহীন হবে। কেউ বাঁশি বাজাবে— কেউ হারমোনিয়াম কেউ তবলা বাজাবে— তবেই অখণ্ড গানের মেজাজ ফুটবে।’ উনি চারজনের নামই প্রচার করলেন। সঙ্গে সঙ্গে আমরা মঞ্চে উঠে গেলাম। মঞ্চে উঠে সঙ্গের তিনজনকে আগে গান করে নিতে বললাম। ওদের তিনখানা গান শেষ হবার পর আমি বসে বসে ভাবছি— এই মঞ্চে বিভিন্ন নামী দামি শিল্পীরা তো সাক্ষরতা, সম্প্রদায়-সম্প্রীতির গান গেয়ে গেছেন— আমি কী গানই বা গাইব। মনে মনে গুরুদেবদের স্মরণ করে ভাবছি— এখন দর্শকবৃন্দ যা আছেন বিশেষ করে শতকরা সত্তর ভাগই মুসলমান— তা হলে ইসলামিয়া গান পরিবেশন করে দেখি না কেমন সাড়া জাগে। এই ভেবে মঞ্চে উঠে মাইক্রোফোন টেনে নিয়ে বলেছিলাম, ‘উপস্থিত সুধী শ্রদ্ধেয় দর্শকবৃন্দ ও আমার শিল্পীবন্ধুগণ— প্রথমে আপনাদের সকলকে আমার প্রণাম, নমস্কার ও স্নেহময় আশীর্বাদ জানিয়ে দু’-একটি কথা বলি। আমি কোনও বেতার-দূরদর্শন বা বিদেশ ভ্রমণকারী শিল্পী নই। এই গ্রামের মাঠে ঘাটে পল্লিতে ঘুরে বেড়ান একজন নগণ্য শিল্পী। গানের ভাষার সুর, তাল অবশ্যই ভুল হতে পারে, তাই সকলের কাছে প্রার্থনা, অধম মনে করে আমাকে ক্ষমা করে দেবেন। —এই বলে এই গান শুরু করলাম, ‘নবীকে চেনা হল না/ যারে বলি নবী নবী, তাহার তত্ত্ব পেলাম না।’ গানখানি আমি তো মঞ্চে গাইছি এবং নাচছি— এর ফাঁকে লক্ষ করে দেখছি দর্শকবৃন্দের অনেকে মাথায় চাদর গামছা বেঁধে আমার তালে তালে ওরাও নাচছে। গেটের কাছে আট/ দশজন মানুষ দাঁড়িয়ে— ওরা সবাই সমস্বরে বলছে ‘থামাথামি নেই চালিয়ে যান।’ গান শেষ হতে না হতে ফারাক্কার এম. এল. এ হাসানুজ্জামান সাহেব মঞ্চের নীচে সামনে এসে বলছেন, ‘যতীনদা আপনি চালিয়ে যান।’ গেটের সামনে লোকের ভিড় দেখে প্রথমে ভয় হয়েছিল— ভাবছিলাম হয় তো গানে কোনও ভুলচুক হয়েছে আমার ঝামেলা করবে ওরা। পরে বুঝলাম আমার গানে খুশি হয়ে ওরা আমাকে উৎসাহ দিচ্ছে। আমিও উদ্দীপ্ত হয়ে আর একখানা গান ধরলাম। এ গান রজ্জব দেওয়ানের লেখা ‘তারে ধরতে কয়জন পারে, তারে চিনতে কয়জন পারে/ পঞ্চরসে রাখাল বেশে ফুটল আবদুল্লার ঘরে/ ধরতে কয়জন পারে চিনতে কয়জন পারে।’ দ্বিতীয় গানটা শেষ করে মঞ্চ থেকে নেমে যেতে চাইলাম। গেটের কাছে যারা দাঁড়িয়েছিল তারা বাধা দিল। আরও অনেক শিল্পী গাইতে বাকি ছিল তাই সবাই বাধা দেওয়া সত্ত্বেও নেমে এলাম। দর্শক-বৃন্দকে সান্ত্বনা দেবার জন্য বরুণবাবু বললেন, ‘অনেক শিল্পী এখনও গাইবার জন্যে অপেক্ষা করছেন তাঁদের গান হয়ে গেলে যতীন হাজরা আবার মঞ্চে উঠে গান করবেন।’ আমি মঞ্চ থেকে নেমে আসতেই বরুণবাবু আমায় বললেন, ‘তুমি এক্ষুনি স্কুলে গিয়ে শুয়ে পড়। যাবার সময় ওদের বলে যাও একটু পরেই ফিরে আসবে।’ যাই হোক প্রায় চোরের মতো চুপি চুপি লুকিয়ে স্কুলে পালিয়ে গেলাম। পরদিন সকালে অনুষ্ঠান সেরে বিদায় নিয়ে বাড়ি ফিরে আসার সময় অনেক লোক আমার ঠিকানা লিখে নিয়েছিল। মঞ্চ থেকে গান গেয়ে নেমে এসে একটু ভোরের দিকে আমি যে ঘরে থাকতাম ওই ঘরের এক পাশে আর একজন শিল্পীবন্ধু ছিলেন। ওঁর পরিচয় আমার তেমন কিছু জানা হয়নি। তবে একবার জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ‘আপনার বাড়ি কোথায়?’ উনি বললেন, ‘আমার বাড়ি উত্তর দিনাজপুর জেলার রায়গঞ্জে নেমে সুভাষগঞ্জ গ্রাম।’ ঠিক ভোরবেলায় উনি আমায় এসে বললেন, ‘দাদা আপনার সঙ্গে কথা আছে, আমার এখানে আসুন।’ আমি উঠে ওঁর বিছানার পাশে বসলাম। দেখতে ভারী সুদর্শন মানুষ। মাথায় বড় বড় চুল উপর থেকে যেন কোঁচকানো, কাজলকালো দুটি আয়ত দীর্ঘ চোখ গায়ের রং কৃষ্ণের মতো কালো। একবাক্যে শ্রীকৃষ্ণ বললে ভুল হবে না। অতি শান্ত নম্র ধীর ভাব মনের মধ্যে কোনও অহংকার আছে বলে মনে হল না, তবে গর্ব আছে। পাশে এসে বললাম, ‘বলুন কি বলবেন?’ উনি আমার নাম জিজ্ঞাসা করলেন— তারপর ঠিকানা। আমি আমার নাম ঠিকানা বলতেই উনি একটি খাতা বের করে লিখে নিলেন। তারপর একটি কার্ড বের করে পথ নির্দেশ লিখে আমার হাতে দিয়ে বললেন, ‘আপনি পয়লা বৈশাখ আমার বাড়ি আসুন পথ খরচা ও সাম্মানিক দক্ষিণা অবশ্যই দেওয়া হবে।’ কার্ডে লেখা ছিল ওঁর নাম : তরণীসেন মহান্ত।
আমি আমন্ত্রণপত্রটি হাতে নিয়ে বাড়ি এসে প্রথমে আমার প্রথম গুরু জাফরউদ্দিন সাহেবকে দেখালাম। উনি দেখে হাসতে হাসতে বললেন, ‘তোকে বলেছিলাম না, তুই অনেকদূর যাবি। আমার আশীর্বাদ বিফলে যাবে না, জিন্দেগীভর তেমন কিছু করতে না পারলেও আল্লার জিকির আমি কোনও দিন কাজ করিনি। তিনার এই আত্মবিশ্বাস আমার মনের জোর বাড়িয়ে তুলত।’ কার্ডখানি নিয়ে চললাম আমার দ্বিতীয় গুরুদেব ডাঃ একরামুল হকের কাছে। উনি আমাকে আশীর্বাদ করে বললেন, ‘নিশ্চয়ই তুমি জয়ী হবে এবং সুসম্মান বহন করে আনবে।’ সকলের আশীর্বাদ নিয়ে সেই অচেনা জেলায় চললাম। রাস্তা অনুযায়ী সকালে বেরিয়ে খুঁজে খুঁজে গিয়ে পৌঁছুলাম উত্তর দিনাজপুর জেলার সুভাষগঞ্জ গ্রামে। সবই যেন অচেনা অপরিচিত। একা একা নির্বোধের মতো খানিকটা অসহায়ের মতো অফিসে দেখা করে নাম লিখে দিলাম। তারপরে একজন আমায় সঙ্গে নিয়ে একটা বড় চাঁচমহল ঘরে থাকা শোবার জায়গা দেখিয়ে দিল। আমি বিছানা পেতে বিশ্রাম করতে লাগলাম, আর উৎকণ্ঠিতভাবে আসরের ডাকের অপেক্ষায় সময় গুনতে লাগলাম। কিছুক্ষণ পর তরণীদার সঙ্গে সাক্ষাৎ হল। উনি বললেন, ‘আজ আপনার আসর দিচ্ছি না, আজ বিশ্রাম করুন। আগামীকাল, বৈকাল ৪-৬টার সময় মনসুর ফকিরের সঙ্গে আপনাকে মঞ্চে পাঠাব।’ মনসুর ফকিরের নামও জানা নেই, ভাবনা শুরু হল। উনি আমাকে কেমনভাবে সঙ্গে নেবেন, কি ধরনের শিল্পী, কি গান গাইবেন, আমি ওঁর পাশে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে গান গাইতে পারব কিনা— এই সব সাত-পাঁচ ভেবে অস্থির হলাম। তারপর বিকেল ৪ টের আগেই মঞ্চে উঠে বসলাম, সঙ্গে মনসুর ফকির নিজেই মঞ্চে উঠে দাঁড়িয়ে গান শুরু করলেন। আমি নীচে বসে থাকলাম। উনি পরপর সাতখানা গান করে বসলেন। শেষ গান গাইলেন, ‘পারে কে যাবি নবীর নৌকাতে আয়/ রূপকাষ্ঠের নৌকাখানি নাই ডোবার ভয়।’ লালন ফকিরের গানখানি গেয়ে বসলেন। আমার মনে হল আমাকে উনি পরীক্ষা করার জন্য এই গানখানি গাইলেন। আমি ঘড়িতে দেখছি ১ ঘণ্টা ১০ মিনিট সময় কেটে গিয়েছে। তারপর তরণীদার ইঙ্গিতে মঞ্চে গান গাইতে উঠলাম। মনসুরের গানের পরিপ্রেক্ষিতে প্রথম গান আরম্ভ করলাম : ‘যারে বলি নবী নবী তাহার তত্ত্ব পেলাম না/ নূর নবীকে চিনলে পরে চিনা যায় পরুয়ারে/ সারুয়ারে বলেছে বেনা নূর নবীজির আইন ধরে চলেছিল চার ইয়ারে/ শেযেতে কুরনি শহরে আলির সঙ্গে হয় জানা/’ এরপর মনসুর আর নিজে না উঠে ওঁর এক সঙ্গীকে গান করতে মঞ্চে পাঠালেন। একটি গান আমার গানের পরিপ্রেক্ষিতে গাইলেন, তবে আমার গানের জবাব হল না বলে আমার মনে হল। আমি পরে দ্বিতীয় গান নবীস্তুতিই গাইলাম। সে গানের যে জবাব হওয়া দরকার সেটাও হল না। এই চার পাঁচখানা গান গাইবার পর সময়ও শেষ। ওরা সকলেই উঠে মঞ্চ থেকে নেমে চলে গেল। আমি আমার ডুগি একতারা নিয়ে গুছিয়ে উঠে দাঁড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে কে যেন পেছন থেকে আমারে দু’হাতে জড়িয়ে ধরল। পিছন ফিরেই দেখে তরণীসেন মহান্ত আমায় জড়িয়ে ধরে বিশাল গর্ব ও আনন্দভরা মুখে মাইক্রোফনের সামনে আমাকে নিয়ে এগিয়ে গিয়ে বললেন, ‘ইনিই সেই যতীন হাজরা, যাঁকে আমি অর্জুনপুর হাইস্কুলে রাজ্য বাউল ফকির সম্মেলনে গিয়ে পশ্চিমবঙ্গে একজন সুদক্ষ সুকণ্ঠ প্রকৃত জাত-ফকির বলে শনাক্ত করে আমন্ত্রণ জানিয়ে এসেছিলাম। এখনকার কমিটি হয়তো এঁর সংগীত প্রতিভা সম্যক উপলব্ধি করতে না পেরে এঁকে প্রথমত ফকির শিল্পী বলে মনে করছিলেন না। ইনিই সেই যতীন হাজরা— যাঁকে মঞ্চে না ওঠালে তাঁর জাত চেনা যায় না। যতীনদা অপূর্ব হয়েছে আপনার আসর। কমিটি তথা দর্শকবৃন্দ সকলেই ধন্য।’ আমি মনে মনে আমার গুরুদেবদের প্রণাম জানালাম। আজ এখানে পৌঁছে দিয়েছেন তো তাঁরাই। তাঁদের আশীর্বাদ ও প্রেরণাই আমার পরম পাথেয়। ওই অনুষ্ঠান শেষে চারদিন পর বাড়ি ফিরলাম এবং ওখানকার সমস্ত খবর গুরুদেবদের জানাতেই ওঁরা যে কী খুশি হলেন— তা বর্ণনা করা আমার ভাষাতীত। কিছু দিন পর মুর্শিদাবাদ জেলা তথ্য সংস্কৃতি দপ্তরের আধিকারিক বাড়িতে একটি চিঠি পাঠিয়েছেন। উনি— মদনমোহন দাস মহাশয় জানিয়েছেন কলকাতায় রবীন্দ্রসদনে সর্বভারতীয় লোকসংস্কৃতির অনুষ্ঠান হবে। বিভিন্ন রাজ্যের শিল্পী সমন্বয়ে এই অনুষ্ঠান হবে। শিল্পীদের সল্টলেক স্টেডিয়ামে থাকার ব্যবস্থা। পরদিন বেলডাঙা স্টেশন থেকে তিনজন শিল্পী সঙ্গীকে নিয়ে ট্রেনে চেপে বসলাম। যথাসময়ে শিয়ালদা স্টেশনে নেমে অনেক রাতে অটো রিকশায় সল্টলেক স্টেডিয়ামে পৌঁছুলাম। সম্পূর্ণ অচেনা জায়গায় একমাত্র মদনবাবুর চিঠিই ভরসা। চিঠিটা এক ভদ্রলোককে দেখাতেই উনি আমাদের ভিতরে অফিসে নিয়ে গেলেন এবং পরিচয় করিয়ে দিলেন। এমন পরিবেশে নিজেকে দেখে কেমন যেন অভিভূত হয়ে গেলাম। নিজেরই আজান্তে চোখে জল ভরে এল, গুরুদেবের গভীর আশীর্বাদ ও শিক্ষা ছাড়া এই জায়গায় কি আমি পৌঁছুতে পারতাম! তারপর দুপুরে খাওয়া সেরে বিকেল তিনটের মধ্যে পোশাক পরে প্রস্তুত হয়ে বিভিন্ন শিল্পীর সঙ্গে লাক্সারি বাসে চেপে রিমঝিম বৃষ্টির মধ্যে দিয়ে আমরা রবীন্দ্রসদনে পৌঁছে গেলাম। দেখলাম বিশাল মঞ্চ, প্রথমেই আমাদের সম্প্রদায় সম্প্রীতির উপর ভিত্তি করে গান পরিবেশন করতে নির্দেশ দিলেন। মঞ্চে উঠে প্রথমেই এই গানটি গাইলাম : ‘শোন গো বিশ্ববাসীগণ মানুষ হইয়া করো সবে মানুষের পূজন/ এই ভারতবর্ষ মোদের কাছে শান্তিনিকেতন।’ গানখানি করে মঞ্চ থেমে নেমে আসতেই দেখতে পেলাম, লম্বা দোহারা শরীর বাউল পোশাকে সজিত একজন বাউল শিল্পী, দেখে যেন চেনা মনে হচ্ছে। আমাকে দেখে উনি বললেন, ‘কোথায় বাড়ি তোর?’ আমি বললাম, ‘মুর্শিদাবাদ জেলার বেলডাঙ্গা থানা, আমার নাম যতীন হাজরা।’ উনি আমাকে বললেন, ‘আমাকে চিনিস না? আমার নাম প্রহ্লাদ ব্রহ্মচারী। আমাকে টি. ভি-তে দেখতে পাস না? আমি বাড়ি ছিলাম না— কাল আমেরিকা থেকে বাড়ি ফিরেছি। এরা বলল তাই না এসে পরলাম না।’ মনে ভাবলাম এত সাধের জৌলুস-এর একখানা গান না শুনে যাব না এখান থেকে। আমার পরে একঘণ্টা ধরে কবিগান হল, তারপর যথাক্রমে নেপালি গান, গুজরাটি গান, সাঁওতালি গান হল। ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের শিল্পীদের রেকর্ডকৃত গানের সঙ্গে নাচ দেখলাম। শেষে ওই শিল্পী মানে প্রহ্লাদ ব্রহ্মচারী মঞ্চে উঠলেন। বেশ আগ্রহ নিয়ে মঞ্চের পাশে দাঁড়ালাম। উনি দু’পাশে তিনজন করে ছ’জন যন্ত্রী বসালেন তারপর মাঝখানে বসে একখানি গান শুরু করলেন। লালনের অতি বিখ্যাত গান ‘সব লোকে কয় লালন কী জাত সংসারে/ লালন বলে জাতের কি রূপ দেখলাম না এই নজরে।’ একটি অতি পরিচিত সাধারণ সুরে গানটি গাইতে দেখে মনে মনে ভাবলাম ইনিই আমেরিকা-রাশিয়া-জাপান ঘুরে বেড়াচ্ছেন এবং ছ’জন যন্ত্ৰী সংগত করছেন, আর আমাকে ডেকেছেন দু’জন শিল্পী ও একজন যন্ত্রী নিয়ে। এতে নিজে বাজিয়ে কি গাইব? আর তার মর্যাদা কে দেবে? যাই হোক অনুষ্ঠান শেষে আবার বাসে করে সল্টলেক স্টেডিয়ামে নিয়ে এলেন। তারপর ওঁরা বললেন, ‘লালগোলা যাবার ট্রেন ১০-৫৫ মিনিটে। আপনি কি ওই গাড়িতে যেতে চান?’ আমি জানালাম আর কোনও অনুষ্ঠান না থাকলে বাড়িই যাব। তাড়াতাড়ি খাওয়া দাওয়া সেরে প্রস্তুত হয়ে বের হওয়ার মুখে আমার হাতে ওঁরা ২৭০.০০ টাকা দিলেন। আমি কেমন অভিভূত হয়ে গেলাম। গ্রামের সামান্য মানুষ— এতগুলো মানুষের সামনে গান করেই নিজেকে ধন্য মনে করেছিলাম।
এরপর বেশ কিছুদিন পর ওই একই বছরে আমার দীক্ষা গুরুদেব খাজা জয়নাল বাবার উর্স্ উৎসব। ১৪ই চৈত্র উৎসবে গেলাম। ওঁর শিষ্য সংখ্যা প্রায় সত্তর হাজার। উনি উৎসব মঞ্চে বসে বিভিন্ন শিষ্যদের ডাক দিচ্ছেন আর প্রেমিক শিষ্যদের হাতে একখানি করে লোহার চিমটি দান করছেন। কাটোয়ার একটি মেয়ের হাতে একটি ত্রিশূল দান করলেন। হিন্দুদের জন্য ত্রিশূল দেবার পর মঞ্চ থেকে উনি আমাকে ডাকলেন। প্রথম ডাকে সাড়া না দিলেও দ্বিতীয় তৃতীয় ডাকে সাড়া দিতেই হল। আমার আশংকাই সত্যি হল। আমি উঠে দাঁড়াতেই একটি লোহার ত্রিশূল হাতে নিয়ে বললেন, ‘ধর।’ দু’হাতে ধরে আছেন। আমি রাগতভাবে বললাম, ‘ওই লোহার ত্রিশূল বইতে আমি আসিনি, ওই ত্রিশূল আমার প্রয়োজন নেই।’ উনি বললেন, ‘তুমি কি নিতে এসেছ?’ আমি বললাম, ‘আমি ত্রিশূলওয়ালার সন্ধানে এসেছি।’ উনি বললেন, ‘তুমি কি ত্রিশূলওয়ালার সন্ধান আজও পাওনি? ত্রিশুলওয়ালাকে কি দেখনি তুমি?’ যখন উনি ওই কথাগুলি বলছেন তখন ওঁর দ্বিদল পদ্মে, মাকাকে মাহানুদায় এক অপূর্ব জ্যোতি ফুটে উঠেছে। রূপের কিরণ এতই তাজাল্লি ফুটে উঠেছিল তা লিখে বর্ণনা করা যায় না। আমি তখন স্বচক্ষে রূপের কিরণ প্রত্যক্ষ করে অভিভূত হয়ে কি বলব ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না। উনি আবারও বললেন, ‘তুমি স্বয়ং মহাদেবকে কি খুঁজে পাচ্ছ না?’ আমি দেখে বলতে বাধ্য হলাম, ‘হ্যাঁ, দেখতে পাচ্ছি।’ ‘তা হলে তোমার সেই ত্রিশূলওয়ালা তাঁর হাতের ত্রিশূল তোমায় দান করছেন, তুমি ধর।’ আমি দু’হাত বাড়িয়ে দিলাম, উনি আমার হাতে একখানি লোহার ত্রিশূল তুলে দিলেন। সারা শরীর আমার থরথর করে কাঁপতে লাগল, বুকের ভিতর যেন বহুদিনের জমাট কান্না দরজা ভেঙে বেরিয়ে আসতে চাইছে। আমার ভিতরটা যেন নিঃশব্দ চিৎকারে চৌচির হয়ে যেতে চাইছে। অথচ দু’চোখে এক ফোঁটাও জল নেই। যেন প্রবল তাপে শুকিয়ে মরুভূমি হয়ে গেছে। সে এক অবর্ণনীয় অনুভূতি বুকে নিয়ে ত্রিশূল ওঁর পায়ের কাছে রেখে আভূমি প্রণাম করে আবার ত্রিশূল হাতে টলতে টলতে ভূতগ্রস্ত এক মানুষের মতো স্খলিত চরণে মঞ্চ থেকে নিষ্ক্রান্ত হলাম। হঠাৎ দেখি আমার গানের দ্বিতীয় গুরু ডাঃ একরামূল হক আমার পাশে এসে জড়িয়ে ধরে বলছেন, ‘তোমার কি হয়েছে? অমন করছ কেন? আমি তোমার পাশে আছি তো। গুরুদেব তোমার পরিশ্রমের পুরস্কার দিয়েছেন এ তো পরম গৌরব ও গর্বের। তোমার অর্জনের প্রমাণপত্র দিয়েছেন। তুমি গুরুদেবের কাছে দীক্ষা নিয়ে তাঁর কর্ম তুমি করেছ। তাই তিনি সন্তুষ্ট হয়ে তোমাকে একটি জায়গায় পৌঁছে দিলেন।’ আমি বললাম, ‘আমি এ নিয়ে বাড়ি যাব না, আমি তো দেখেছি ত্রিশূল চিমটি নিয়ে সকলে রাস্তায় রাস্তায় উদাসী হয়ে ভিখারির মতো ঘুরে বেড়ায়।’ আমার জানা চিমটি দু’রকম একটি লোহার অপরটি চামড়ার। চামড়ার বলতে গোল স্ত্রীদ্বারের আকৃতি ও কিছুটা ত্রিশূলের মতো। তা হলে ত্রিশূল নিয়ে বেড়াতে হলে আর সংসার ধর্ম করতে পারব না। সবাই আমাকে ভণ্ড বলবে, কারণ হাতে ত্রিশূল মাথায় চুল মুখে দাড়ি। এদিকে সন্ধে হলে বউ-এর কাছে যাওয়া বা স্ত্রীসংসর্গ করা সম্ভব নয়। এতে মানসিক চাপ তৈরি হয়। এই ধরনের বিপরীত আচরণ করা আমার পক্ষে অসম্ভব বলে মনে হল। ডাক্তারবাবু বললেন, ‘তুমি নিয়ে গিয়ে রাখো তো, পরে বাবার সঙ্গে আলোচনা করে তোমায় বলছ— তোমায় কি করতে হবে।’ এরপর সকালবেলায় খাজা বাবা ডাক দিলেন, সামনে পায়ের কাছে বসতেই উনি একটি লাল সুতির কাপড় আমার মাথায় পাগড়িস্বরূপ বেঁধে দিয়ে বললেন, ‘তোমার গুরুদেব যা দিয়েছেন তুমি তার ভক্তি রাখবে এবং এখন সংসারধর্ম পালন করবে। যখন প্রয়োজন মনে করব তখন তোমায় সংসার থেকে তুলে নিয়ে নির্দিষ্ট কর্মের মধ্যে পাঠাব।’ আমি দরবার থেকে ত্রিশূল হাতে না নিয়ে চলে আসব মনস্থির করলাম। দেখছি আমার গানের দ্বিতীয় গুরুদেব ডাঃ একরামূল হক ত্রিশূলটা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন, বললেন, ‘ধর, নিয়ে চল।’ তারপর বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে উনি নিজে হাতে বহন করে বেলডাঙ্গা পর্যন্ত নিয়ে এসে আমার দিয়ে বললেন, ‘তুমি সোজা বাড়ি গিয়ে একটা পরিষ্কার জায়গায় রেখে দাও এবং প্রত্যহ এতে তেল জল দেবে ও একে ভক্তি করবে।’
মাথায় পাগড়ি ও ত্রিশূল আজও পবিত্র জায়গায় রেখে দিয়ে ভক্তি করে চলেছি। পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জায়গায় আমার দীক্ষা গুরুদেব উর্স্ উৎসব করতে যেতেন আমরাও সঙ্গে যেতাম। সেই প্যান্ডেলে আমাকে সেজরা শরীফ পাঠ, ইসলামিক গজল, নাত ও ফকিরি, মারফতি, আধ্যাত্মিক গান করার নির্দেশ করলে আমি পরিবেশন করতাম। ইনি আমাকে একটি কাজ করতে নির্দেশ দিলেন। কাজটি হল : রাত্রে একা নিরালায় নিভৃতে বসে সেজরা শরীফ পাঠ এবং স্মরণের মাধ্যমে দর্শন জিকির প্রতি শ্বাস-প্রশ্বাসে গুরু বর্জক সামনে ভাসিয়ে আপনাকে মিশে ফানা হয়ে যাওয়া এবং দেখতে হবে বা দেখা যাবে (আমিই গুরু গুরুই আমি)। এই বিশ্বব্যাপী আমাকে ছড়িয়ে দেওয়া বা আমিই ছড়িয়ে যাওয়া।
আমি বিভিন্ন মেলায় গিয়েছি যেমন বৈরাগ্যতলার মেলা, পাথরচাপুড়ির মেলা, কল্যাণী ঘোষপাড়ার সতীমায়ের মেলা, অগ্রদ্বীপধামের মেলা এবং বিভিন্ন পির মাজার বা পির সাহেবের দরবার। তবে আমার সমস্ত দেহ সত্তার আড়ালে বসে একটি অমোঘ শক্তি কাজ করে। সেটি হল পরম করুণাময়, আরাধ্য জামানায়ে আরেফ বিল্লা হজরত শাহ সুফি খাজা জয়নাল আবেদিন আল চিশতি (রহঃ)। বিভিন্ন গ্রামে বাউল মেলায় ইসলামিয়া গান পরিবেশন করার জন্য আমন্ত্রিত হয়ে থাকি। ওখানকার মানুষ আমার নামে প্রচারপত্র ছাপলে আমার পদবি বা নানা বিশেষণ দেন— যতীন হাজরা ফকির ইসলামিয়া তত্ত্ববিশারদ অথবা ইসলাম তত্ত্বের জাহাজ…ইত্যাদি। আমার নামের পাশে কোন বিশেষণ সাজাচ্ছে এটা আমার কাছে গর্ব বা অহংকারের কথা নয়। কিন্তু ওইসব বিশেষণের উপযুক্ত কাজ করে প্রমাণ করতে পারব কিনা— অথবা এই মর্যাদা বহন যাতে করতে পারি সেই চিন্তাতেই আকুল হয়ে উঠি। বিভিন্ন বাউল মেলাতে গান করতে গেলে মুসলিম শ্রোতারা নানা ইসলামিয়া প্রশ্ন করেন এবং সব প্রশ্নগুলির সন্তোষজনক উত্তর আমি দিতে চেষ্টা করি। বাল্যকাল থেকে যে শিক্ষাগুলি আয়ত্ত করেছি সেগুলি সুন্দরভাবে প্রয়োগ করতে পেরে ভাল লাগে। বাংলাদেশের একজন হাফেজ সাহেবের মাধ্যমে কোরান শরীফ বাংলা উচ্চারণ, বাংলা ব্যাখ্যা, তর্জমা করা আনিয়ে নিলাম। এটির তর্জমাকারী মৌলানা মাজাহারউদ্দিন সাহেব। আমি হিন্দু মুসলমান জানি না— আমি জানি আমি একজন শিল্পী। জানা বা শিক্ষার তাগিদে গানের মর্মভেদ করতে আমাকে প্রয়োজনীয় শাস্ত্র বা তত্ত্ব জানতেই হবে। মোটকথা এই মানুষের মধ্যে ঘুরে বেড়ালে ছোট-বড় কালো-ধলো হাড়ি-মুচি, মেথর-ব্রাহ্মণ, উঁচু-নিচু বিভেদ দেখা যায়। কিন্তু একটি বিমানে চেপে শূন্য আকাশের বুকে ভেসে বেড়ানোর সময় উপর থেকে নীচের মানুষগুলোকে ছোট ছোট দেখায়— যত উপরে ওঠা যায় নীচের দৃশ্যাবলি ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয় এবং বহু উপরে উঠলে একটা সময়ে নীচের দূরের সবকিছুই অস্পষ্ট, ঝাপসা কুয়াশাচ্ছন্ন ও একাকার মনে হয়। মানুষের ক্ষেত্রেও তাই। গুরু নির্দেশিত পথপরিক্রমায় যিনি সিদ্ধ, তাঁর দৃষ্টি বিমানবিহারীর মতোই সমদৃষ্টি সম্পন্ন হয়ে যায়। তখন জাতি ধর্ম বর্ণ কুসংস্কারের ধোঁয়া ছায়া মানুষের দৃষ্টিকে আর আবিল ও অস্পষ্ট রাখে না। ‘মান’ ও ‘হুঁস’ সম্পন্ন ব্যক্তিই তো মানুষ। মান-মর্যাদা-বিবেক চালিত হয়ে পশুশক্তি থেকে জ্ঞান ও প্রেমের জগতে উঠতে পারলে মনুষ্যত্ব জাগে পরিপূর্ণরূপে। প্রেমের জগৎটি অবশ্য আর একটু এগোনো। বাহির জগতের কর্মচিন্তা সামাজিকতা এগুলি বেঁচে থাকার মাপকাঠি মাত্র। কিন্তু অন্তরে ভালবাসা যার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছে তার দর্শন বা মিলন না হওয়া পর্যন্ত কুরে কুরে খায়। তাই তো প্রেম করো তুমি তোমার প্রভুর সঙ্গে যিনি প্রেম আস্বাদন করার জন্য জগৎ সৃষ্টি করেছেন। এই নিখিল বিশ্বসৃষ্টির মধ্যে দিয়েই স্রষ্টা নিজেকে আস্বাদন করতে চেয়েছেন। যে প্রেমের চূড়ান্ত পর্যায় মিলন — চোখের জল ফেল এইভাবে—-সে জল অন্য কেউ যেন না দেখে। তোমার চোখের জল অন্য কেউ দেখলে মাঝখানে দেওয়াল সৃষ্টি হবে। নিরালা নিভৃতে গোপনে চুরি করে প্রভুকে স্মরণ করে ভক্তির মাধ্যমে সেজদায় অবনত হয়ে চোখের জল ছেড়ে দাও। ভেসে যাক তোমার জায়নামাজ, ভিজে যাক তোমার আসন, অন্তরের কান্নার সুর যেন অন্য কারও কানে না পৌঁছয়। জেনে রেখো তোমার প্রভু দরজা খুলে অধীর আগ্রহে কান পেতে বসে আছে। সারাদিন শুধু কর্মের মাধ্যমে দিন কাটিয়ে দিয়ো না। অন্তরের গোপন চিলেকোঠায় সেই ছবিকে বসিয়ে রাখো, যে ছবি গুরুদীক্ষার সময় তোমায় দেখিয়ে ছিল, ওই ছবিই চিরসত্য, চির অম্লান, চলমান জীবনের পথ এবং পরপারের কান্ডারি। পিরের সঙ্গে প্রেম করে যে জ্ঞান গরিমা দয়া করে দান করেছেন সময় সংকীর্ণতার মধ্যে তার কিঞ্চিৎমাত্র ইশারা দিলাম।
শিল্পী জীবনে কত সুখ দুঃখের স্বাদ যে নিতে হয় তা শিল্পী না হলে বোঝা যায় না, বিশেষ করে আমাদের এই নিম্নবিত্ত ঘরে। মনে পড়ছে তিন বছর আগে রেজিনগর থানার অন্তর্গত গোপালপুর গ্রামে গান করতে যাব বলে কথা দিয়ে পঞ্চাশ টাকা অগ্রিম বায়না নিয়েছিলাম। নির্দিষ্ট দিনে কালীপুজো মণ্ডপে গান। বিকেলে গান। বিকেলে গান করতে যাব, আর ঠিক দুপুরবেলায় আমার একটিই বাচ্চা— হঠাৎ কৃমির বিকারে বিষ খাওয়া রোগীর মতো ঝিঁকতে লাগল। সঙ্গে সঙ্গে ভ্যান রিকশা করে বেলডাঙ্গা হাসপাতালে নিয়ে গেলাম, তখনও ঝাঁকানি চলছে। ডাক্তারবাবু কতকগুলো ইঞ্জেকশন লিখে দিয়ে বললেন, ‘সত্বর কিনে আনুন— তবে বাঁচবে কিনা জানি না।’ ঈশ্বরের নাম গুরুর কথা বারবার স্মরণ করছি শিশুর শিয়রে বসে। বার বার উচ্চারণ করি— ‘গুরুদেব তুমিই এই সন্তান দিয়েছ, রাখা বা নেওয়া তোমার ইচ্ছা।’ স্বামী-স্ত্রী হাসপাতালের নীচে বসে কাঁদছি। বিকাল ৫টাতেও অজ্ঞান অবস্থায় বিছানায় শুয়ে। এমন সময় আমার তিন সংগতকারী এসে হাজির গোপালপুর অনুষ্ঠান করতে যাবার জন্যে। আমি সমস্ত ঘটনা ওদের জানিয়ে বললাম, ‘গিয়ে ওদের বুঝিয়ে বল আমার এই বিপদের কথা। বাচ্চা একটু সুস্থ বোধ করলেই আমি চলে যাব।’ ওরা গোপালপুর গিয়ে সব জানালে তারা কোনও কথা বিশ্বাস না করে মিথ্যা বলে দোষারোপ করে বলেছে, ‘গান গাইতে পারবে না তাই ভয়ে এল না।’ অপমানিত যন্ত্রীরা অন্ধকার রাতে তিন মাইল হেঁটে রেজিনগর স্টেশনে ট্রেন ধরে আমার কাছে রাত আড়াইটের সময় এসে বলল, ‘কাকা তোমার সন্তান বেঁচে আছে কিনা আমরা জানতে চাইছি না, তোমাকে এখুনি আমাদের সঙ্গে যেতে হবে। সমস্ত যন্ত্র আটক করেছে, তুমি চল।’ ওদের কথা শুনতে শুনতে আমার জগৎসংসার টলে উঠল— সন্তান মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে হাসপাতালের বিছানায়। বুকের মধ্যে অপমান ক্ষোভ বেদনা তীব্র শোক সব তালগোল পাকিয়ে গেল। আমি আজও সেই তীব্র যন্ত্রণার কথা ভুলতে পারি না। মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করা শিশু— আর তার অসহায় পিতামাতার আর্তকান্না হাসপাতাল চত্বরের রাতের বাতাসকে যেন স্তব্ধ করে দিয়েছিল। বিশ্বচরাচরে আমাদের কেউ নেই সেই মুহূর্তে। শোকে পাগল স্ত্রীকে হাসপাতালে একা রেখে অসহায়ভাবে ওদের সঙ্গে রওনা হলাম। আমার শিশুকে ইশ্বরের হাতে রেখে পা বাড়ালাম। স্ত্রীকে বললাম, ‘যদি আমি আমার গুরুর সঙ্গে প্রেম করে থাকি— তবে তার বিনিময়ে বলতে পারি— এই অল্প বয়সে আমায় শোক সইতে হবে না। আমি হলফ করে বলতে পারি— এমন কোনও পাপ বা অন্যায় আমি করিনি যাতে আমার শিশুকে হারাতে হবে।’ স্ত্রীকে বললাম, ‘তুমি এখানে বসে বসে গুরুদেবকে স্মরণ করো, আমি চললাম গোপালপুর গান করতে।’ অসহায় কান্নায় ভেঙে পড়া স্ত্রীকে একা রেখে চোখের জল মুছে গোপালপুরের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। জীবন যে কী সেদিনের মতো কি আর বুঝেছি? সারা পথ কাঁদতে কাঁদতে এগিয়ে শ্রান্ত পায়ে বহুদূরের রেজিনগরে নেমে আরও হেঁটে গোপালপুর পৌঁছুলাম। ওখানকার লোকগুলো আমায় দেখে নিজেদের মধ্যে বলা কওয়া করতে লাগল, ‘বিপদ-আপদ কিছুই নয়— ভাঁওতা— আসবে না বলে ডুব মেরেছিল।’ কোনও কথায় কান না দিয়ে সোজা গিয়ে জানালাম মঞ্চের শিল্পীকে নামিয়ে দিন— আমি এখুনি গান করব— বলে পোশাক পরে মঞ্চে গিয়ে দাঁড়ালাম। কিন্তু কী গান গাইব? কোনও গানই মনে পড়ছে না। বারবার মনের দরজায় আছাড় খাচ্ছে শুধু আমার একমাত্র মৃত্যুপথযাত্রী সন্তানের মুখ! গাইব কি? হঠাৎ কে যেন নাড়িয়ে দিল— সব ঝেড়ে ফেলে নিজেকে বলি ‘তুমি শিল্পী ওঠো, জাগো, গাও। জনতা অপেক্ষা করছে অধীর আগ্রহে।’ নিজেকে সংবৃত করে গুরুবন্দনা শুরু করলাম। পরবর্তী শিল্পী যাঁর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে আমার তিনি গত সন্ধ্যায় এখানে এসে আমায় না দেখে মন্তব্য করেছেন ‘আমার সঙ্গে গাইতে পারবে না বলে নিজে আর আসেনি এদের পাঠিয়ে দিয়েছে।’ এক শিল্পীর অন্য শিল্পী সম্পর্কে যথোচিত না জেনে মন্তব্য করা যে কত মর্মান্তিক— সেদিন তা উপলব্ধি করলাম। মর্মাহত ভারাক্রান্ত চিত্তে একখানা গান মঞ্চে গেয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘আজকের এই গানে কী পালা হবে? এবং আমার ভূমিকা কি থাকবে?’ দর্শকদের মধ্যে একজন বলল, রাধা ও বৃন্দে পালা। তুমি বৃন্দে আর উনি রাধা। আমি বৃন্দের ভূমিকায় গান গাইতে শুরু করলাম। পাঁচ ঘণ্টা গান করার পর মিলনের গান করে আসর শেষ করে পোশাক খুলেই তখনই বললাম, ‘আমার কাজ আশা করি শেষ করতে পেরেছি, এবার টাকা পয়সা যা প্রাপ্য তাড়াতাড়ি মিটিয়ে দিন আমি চলে যাব।’ ওরা খাবার জন্যে বলায় আমি জানালাম, ‘মুমূর্ষ সন্তান আমার হাসপাতালে পড়ে আছে। স্ত্রী একা কি করছে জানি না।’ নিজে বা যন্ত্রীরা কেউই না খেয়ে বেলডাঙা হাসপাতালে পৌঁছেই খবর নিতে, উপর থেকেই আমার স্ত্রী বলল ‘ভাল আছে। ভোর থেকে ঘুম ভেঙেই সে বাবাকে দেখার জন্যে কাঁদছে।’ আমি মনে মনে আমার গুরুদেবকে বললাম, ‘ধন্য খাজা সত্যই তুমি প্রণম্য, তোমার চরণে শতকোটি প্রণাম।’ আত্মজীবনী লিখতে বলেছেন। এই ক্ষুদ্র শিল্পীজীবনে এত ঘটনা দুর্ঘটনার ঘনঘটা, এত লৌকিক অলৌকিক ঘটনার ঘনঘটা, এত সুখ-দুঃখে দোলাদুলি যে এমন একশত খানা খাতা আর টানা দু’বছরেও বোধহয় সে লেখা শেষ হবার নয়। এই আঠারো উনিশ বছরের শিল্পী জীবনে দেখা-শোনা-জানার অভিজ্ঞতায় জীবনের থলি উপচে পড়েছে, কাকে রেখে কাকে ছাড়ি! আত্মকথা বলতে লিখতে ইচ্ছেই করে না। জীবনের ভাবনাগুলো ভাবগুলো কলমের ডগায় সে ভাবে আসে কই? আর ঘটনার ঘনঘটা সুখদুঃখের মধ্যেই কি সেই অচিন পাখিটাকে ধরা যায়? কি জানি! একজন ফকির উদাস থাকে তার প্রভুর পানে চেয়ে, কারণ হাদিস শরীফে বলেছেন— আল্লা ফারুকওয়ালা ফারুক সিন্নি অর্থাৎ আল্লা বলছেন : আমি ফকিরের ভেদ ফকির আমার ভেদ। এস্কে দিওয়ানা হয়ে প্রেমিক যখন তার প্রভুর দর্শনের পর ফানা ফিল্লাতে দাখেল হয়ে যায় আর দুই থাকে না। সম্পূর্ণ একাকার হয়ে যায়। মনে হয়, এই পার্থিব জীবনের কি ইতিহাস লিখব? যদি অনন্তকালের ইতিহাস লিখতে পারতাম তবেই লেখাটা সার্থক হত। সাধন কর্ম কলমের ডগায় লেখার চৌহদ্দিতে আসে না। রাতের অন্ধকারে ঘরে শুয়ে মানুষ যখন নিদ্রায় অভিভূত হয়ে থাকে আমি তখন আঁধার রাতে একাকী গুরুদেবের দেওয়া কাজ করে যাই। শ্বাস প্রশ্বাসের মাধ্যমে দম নিতে নিতে যে ছবি ভেসে আসে সে একান্তই নিজস্ব ও গোপন।