১.৩ গোপ্য সাধনার ত্রিবেণী

গোপ্য সাধনার ত্রিবেণী

পঞ্চাশ বছর আগে রাঢ় বাংলার রূপকার তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর প্রসিদ্ধ ‘রাইকমল’ উপন্যাসের গোড়ায় লিখেছিলেন:

পশ্চিমে জয়দেব-কেন্দুলি হইতে কাটোয়ার অজয় ও গঙ্গার সঙ্গম-স্থল পর্যন্ত ‘কানু বিনে গীত নাই’। অতি প্রাচীন বৈষ্ণবের দেশ।… এ অঞ্চলে সুন্দরীরা নয়ন-ফাঁদে শ্যাম শুকপাখি ধরিয়া হৃদয়পিঞ্জরে প্রেমের শিকল দিয়া বাঁধিয়া রাখিতে তখন হইতে জানিত।

লাকে কপালে তিলক কাটিত, গলায় তুলসীকাঠের মালা ধারণ করিত; আজও সে তিলক-মালা তাহাদের আছে। পুরুষেরা শিখা রাখিত। এখন নানা ধরণের খোঁপা বাঁধার রেওয়াজ হইয়াছে, কিন্তু স্নানের পর এখনও মেয়েরা দিনান্তে একবারও অন্তত চূড়া করিয়া চুল বাঁধে। …হলুদমণি পাখি—বাংলাদেশের অন্যত্র তাহারা ‘গৃহস্থের খোকা হোক’ বলিয়া ডাকে, এখানে আসিয়া তাহারা সে ডাক ভুলিয়া যায়— ‘কৃষ্ণ কোথা গো’ বলিয়া ডাকে।

চাষির গ্রামে সদ্‌গোপেরাই প্রধান, নবশাখার অন্যান্য জাতিও আছে। সকলেই মালা তিলক ধারণ করে, হাতজোড় করিয়া কথা বলে, প্রভু বলিয়া সম্বোধন করে। ভিখারিরা ‘রাধে-কৃষ্ণ’ বলিয়া দুয়ারে আসিয়া দাঁড়ায়; বৈষ্ণবেরা খোল করতাল লইয়া আসে; বৈষ্ণব বৈষ্ণবীরা একতারা খঞ্জনী লইয়া গান গায়; বাউলেরা একা আসে একতারা বাজাইয়া।

এই বর্ণনার পর উপন্যাস যত এগোয় আমরা তার কাহিনির পথ ধরে চলে আসি এক স্নিগ্ধ বৈষ্ণবীয় আখড়ায়, হরিদাস মহান্তের গড়ে-তোলা কুঞ্জে। সেখানে থাকে দুটি প্রাণী— মা আর মেয়ে, কামিনী ও কমলিনী। কী করে যেন তাদের জীবনে এসে যায় বৃদ্ধ বাউল রসিকদাস। কমলের নাম দেয় সে ‘রাইকমল’। শেষদিকে বাউল আর বৈষ্ণবী, দুই ভিন্ন সম্প্রদায়ী অসমবয়সি তারা, নিজেদের মালাচন্দনে বাঁধে। এইখানে এসে আমরা আখ্যান অংশ ত্যাগ করে স্বচ্ছ চোখে রাঢ়ের বহুদিনের সমাজ-ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখতে পাব, এই ভূমিখণ্ডে বৈষ্ণব আর বাউলে খুব আড়াআড়ি নেই, যেন অজয় আর গঙ্গার মিলে যাওয়া। তাই বৈষ্ণব-তীর্থ কেঁদুলিতে বাউলদের সবচেয়ে বড় সমাবেশ। তাতে কোনও বেসুর বাজেনি, কোনওদিন। বাজেনি যে, তার কারণ, এ প্রান্তের বাউল ও বৈষ্ণবদের বেশির ভাগই উচ্চবর্গের বা উচ্চবর্ণের নয়। বৈষ্ণব মানেও সর্বদা নৈষ্ঠিক গৌড়ীয় বৈষ্ণব নন, বরং জাতি-বৈষ্ণব বা সহজিয়া। সকলেই প্রধানত কায়াবাদী। দেহ-বৃন্দাবনেই তাদের আরোপ সাধনা। অনুমানের পথে নয়, তাদের সাধনার নাম ‘বর্তমান’। এই দেহভাণ্ডেই তাদের সবকিছু। তাই দেহের কিছুই ঘৃণ্য বা বর্জ্য নয়।

নজর করলে আরেকটা জিনিস দেখা যাবে। বর্ধমান-বীরভূম-বাঁকুড়ায় প্রতি বছর নির্দিষ্ট দিনে যে সব বিখ্যাত বাউল সমাবেশ হয়ে থাকে তার মূলে রয়েছে সহজিয়া বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের উদ্যম ও উদ্যোগ। কেঁদুলির কথা তো আগেই বলেছি তা ছাড়া বাঁকুড়া সোনামুখির বাউল সমাবেশ (রামনবমী) হয় মনোহর খ্যাপার প্রসিদ্ধিতে। মনোহর ছিলেন সাধু বৈষ্ণব। বর্ধমানের অগ্রদ্বীপে ঘোষঠাকুরের শ্রাদ্ধে কৃষ্ণমূর্তি গোপীনাথ শ্রাদ্ধ করেন কাছা পরে। পুরোপুরি বৈষ্ণবীয় উৎসব, কিন্তু বাউলদের বেশ রমরমা। বীরভূমের কোটাসুরে একশো বছর ধরে ভাদ্র মাসে সাধুসেবা চলছে। এতে প্রধান ভূমিকা বাউলদের। অথচ আশ্রমটি নারায়ণচাঁদ গোঁসাইয়ের সাধনসঙ্গিনী খ্যাপা মা-র নামেই প্রসিদ্ধ। আগে এর তত্ত্বাবধান করতেন মতিদয়াল গোঁসাই, তারপর মনোহরদাস মহান্ত। নামের ধরন দেখেই বোঝা যাচ্ছে এঁদের জাতি-বৈষ্ণবের পরম্পরা, তবে গৃহী নন— আখড়াধারী। এমনই বহু উদাহরণ দেওয়া যায়— যেমন বেনালীপুরের মেলা, রামকেলীর সমাবেশ, দধিয়া বোরেগীতলার মেলা। বীরভূমের বাউলদের নিয়ে অনেকদিন সরেজমিন কাজ করেছেন আদিত্য মুখোপাধ্যায়। তাঁর ধারণা:

বেশির ভাগ বাউলই নিজেকে বৈষ্ণব বলে পরিচয় দেন এ আমার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা। আসলে ‘রূপ’— ‘রাগ’ হয়ে বাউল পৌঁছায় ‘ভাবে’। বাউলের বিভিন্ন শুদ্ধ আচরণগুলিই তাকে ক্রমশ বৈষ্ণব করে তোলে।

বাউলের শুদ্ধ আচরণ? শুনেই মনে পড়ল ১৮৯৬ সালে পণ্ডিত যোগেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য তাঁর ‘Hindu Castes and Sects’ বইতে মন্তব্য করেছিলেন:

The Bauls are low class men, and make it a point to appear as dirty as possible… Aristrocratic Brahminism can only punish them by keeping them excluded from the pale of humanity.

কিন্তু এ মন্তব্য তো উনিশ শতকের শেষ দশকের একজন নৈষ্ঠিক ব্রাহ্মণের। আধুনিক কালের ব্রাহ্মণ যুবা আদিত্য মুখোপাধ্যায় মনে করছেন অন্য কথা। তিনি বলছেন:

বিষয়টি গুলিয়ে যাবার মতোই। প্রায় প্রত্যেক সাধু-বাউলের কাছে শুনেছি, তাঁরা বৈষ্ণব বাউল। ‘বাউল বোষ্টম’ কথাটিও এতই প্রচলিত যে এদের ভিন্নত্ব ধরা পড়ে না। আবার বাউলের সাধন সঙ্গিনীকে সব সময়েই ‘বোষ্টমী’ বা ‘বৈষ্ণবী’-ই বলা হয়।

এ যেমন সত্যি তেমনি এটাও ঘটনা যে ‘আউল বাউল’ বলে একটা কথা চালু আছে, ‘বাউল-ফকির’ কথাটাও খুব সচল। লালন কী ছিলেন— বাউল না ফকির?

উনিশ শতকে বাউল আর ফকিরদের বহুক্ষেত্রে সমার্থক বলে মনে করেছেন অনেকে, অন্তত সেকালের পণ্ডিত ও গবেষকরা। তাঁরা কেউই অবশ্য এই দীনহীন সম্প্রদায় সম্পর্কে প্রসন্ন ছিলেন না। তার কারণ তাঁদের উচ্চবর্ণের অহমিকা একদিকে, আরেকদিকে নিম্নবর্গের এই কায়াসাধকদের গোপন ও গুহ্য আচরণবাদ। কেবল বাউল বা ফকিরিতন্ত্র নয়, জাতবৈষ্ণব-কর্তাভজা-সহজিয়া স্রোত, এমন সমস্ত ধারা যা গৌণধর্মীদের আশ্রয় ও আশ্বাস দিয়েছিল তা তাঁদের মনঃপূত হয়নি। সনাতন ভাবনাচিন্তা বা দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের আচরিত ধর্মের বাইরে যারা যায় তাদের খ্যাতিবিত্ত জোটার তো কথা নয়। তাদের জোটে নিন্দা ও বিদ্রূপ। তারা হয়ে ওঠে উচ্চশ্রেণির পক্ষে সন্দেহজনক আর শত্রুবিশেষ। তাই তাদের দমন-পীড়ন-ধ্বংস সাধন হয়ে ওঠে আশু কর্তব্য। ব্যাপারটি একপক্ষীয়— কারণ শাস্ত্র-মন্দির-মন্ত্র-মসজিদ-পুরোহিত-মোল্লা সেইদিকে। তারা নগরবাসী, ও শিক্ষিত, মসীজীবী লেখকরাও তাদের পক্ষে। পত্রপত্রিকা, ধর্মপ্রতিষ্ঠান ও মুদ্রণযন্ত্র তাদের সহায়। অন্যপক্ষে গ্রামে-বাস করা বিচ্ছিন্ন ও অসংগঠিত বাউল ফকিরদের অস্ত্র বলতে কণ্ঠের গান আর অন্তরের তীব্র বিশ্বাস। সেই জায়গাটায় অবশ্য তাদের খুব জোর। কোনও অনুমানাত্মক কিছুকে তারা মানে না। তাদের মতে শাস্ত্ৰ-পুরাণ-দেবমূর্তি-মন্ত্র-তীর্থ-উপবাস এসব আসলে ‘অনুমান’। সত্য হচ্ছে ‘বর্তমান’, এই নরনারীর দেহ ও দেহধর্ম, এই ইহজগৎ আর কামনাবাসনা, স্বপ্ন ও মুক্তিপিপাসা। এর পরতে পরতে রয়েছে রহস্য ও মরমিয়া বিশ্ব। খোদা বা ঈশ্বর আছেন মানব জীবনের শরিক হয়ে, তাই মানুষ ধরে সাধনা করতে হবে। তাদের গানে বলা হচ্ছে:

মানুষ হয়ে মানুষ জানো

মানুষ হয়ে মানুষ চেনো

মানুষ হয়ে মানুষ মানো

মানুষ রতনধন।

করো সেই মানুষের অন্বেষণ॥

এই মানুষতত্ত্ব যার সত্য হয়ে যায় মনের মধ্যে, সে কেন অন্য তত্ত্ব মানবে? সে কেন গ্রস্ত হবে সাবেক স্বর্গ-নরক ধারণায়? তাই তার প্রতিপ্রশ্ন:

আল্লার বাড়ি যদি মাটির দুনিয়া হয়

তবে মানুষ মরে কোন্ বেহেস্তে যায়?

বেহেস্ত বা স্বর্গপ্রাপ্তি যদি কাঙ্ক্ষণীয় না হয় তবে এসব লৌকিক সাধকদের একমুখী লক্ষ্য মানুষের মুক্তি। সে মুক্তি মানে মোক্ষপদ প্রাপ্তি নয়— অজ্ঞানতা, কুসংস্কার থেকে মুক্তি। মাটির ঢিপি ও কাঠের মূর্তি পুজো, অপদেবতা বা উপদেবতায় বিশ্বাস, দরগাতলায় হত্যে দেওয়া বা কবচতাবিজ ধারণ সবেরই বিরুদ্ধাচরণ করা এদের ব্রত। বিচারশীল আর তর্কপ্রবণ বাউলফকিররা বহুলাংশেই গুরুবাদী, কারণ গুরুই কায়াসাধনার পথ ও পদ্ধতি বাতলে দেন। কিন্তু এমন যে অত্যাজ্য গুরু, তাঁকেও অভ্রান্ত না ভেবে বলা হয়েছে:

যাহা দেখিনি নিজ নয়নে

বিশ্বাস করি না গুরুর বচনে।

এত যুক্তিতর্কবিচার সংকুল পন্থা গরিষ্ঠসংখ্যক মানুষের কাছে সমাদৃত হবার কথা নয়। কিন্তু মনের মানুষের সন্ধানে নিরত এমন গভীর নির্জন পথ নিঃসঙ্গ সাধকের প্রাণের প্রদীপে আলোকিত। সে নির্ভয় ও ধর্মনির্লিপ্ত— স্রোতের বিরুদ্ধে তার অবগাহন। প্রয়োজনে সে প্রতিবাদী, কিন্তু তার আয়ুধ লাঠি নয়, একতারা। তার বিশ্বাস, ‘এই মানুষে সেই মানুষ আছে।’

কিন্তু বিশ্বাসের এত বলিষ্ঠ অবিচল পথের পদাতিকদের সংখ্যাবৃদ্ধি তো সনাতনবাদীদের পক্ষে স্বস্তির হতে পারে না। তাই তাঁদের প্রশ্ন:

কী জন্য প্রবীণ মতে বিরত হইয়া।

অভিনব মতে রত কী সুখ দেখিয়া॥

স্বর্গের সোপান কি এ মতে গাঁথা আছে।

দড়বড়ি চলি যাবে শ্রীহরির কাছে॥

না জানি কী লাগি সবে ভ্রান্ত হায় মতি।

নবপথে পদার্পণ কেন এ দুর্মতি॥

দ্বন্দ্ব এটাই অর্থাৎ প্রবীণ মত আর নতুন মত। ‘পাষণ্ডীদলন’-এর লেখক রামলাল শর্মা তাঁর নিরীহ পয়ারে যে প্রশ্ন তুলেছেন তা তার একার নয়। অক্ষয়কুমার দত্ত, যোগেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য, রেয়াজউদ্দিন আহমদ, দাশরথি রায় এমনকী বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী ও শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসেরও এই এক প্রশ্ন। পুরনো পথ ছেড়ে অভিনব এই পথে কেন? কীসের জন্য? এ পথে কি স্বর্গ বা শ্রীহরির পাদপদ্মপ্রাপ্তি দ্রুততর হবে? মুশকিল যে স্বর্গ বা হরি কোনওটাই এদের অন্বিষ্ট নয়। এদের লক্ষ্য মানব, মানবসত্য।

ঈশ্বরলাভ আর স্বর্গপ্রাপ্তির আকাঙ্ক্ষা গায়ে গায়ে লেগে থাকে। যুক্তিবাদী লালন শাহ মারাত্মক প্রশ্ন তুলেছেন এ প্রসঙ্গে। বলছেন:

মলে ঈশ্বরপ্রাপ্ত হবে কেন বলে?

মলে হয় ঈশ্বরপ্রাপ্ত সাধু অসাধু সকলে

তবে কেন এত জপতপ এত করে জলেস্থলে?

সকলেরই তো লক্ষ্য ঈশ্বরপ্রাপ্তি, সাধু অসাধু সকলেই তো পাবে ঈশ্বর, হলে আর কেন এত জপতপ এত কৃচ্ছ্রসাধন? তারপরের জিজ্ঞাসা:

যে পঞ্চে পঞ্চভূত হয়

মলে তা যদি তাতেই মিশায়—

তবে ঈশ্বর-অংশ ঈশ্বরে যায়

স্বর্গ-নরক কার মেলে?

একেবারে তাত্ত্বিক প্রতিপ্রশ্ন। পঞ্চভূত থেকে আমাদের সৃষ্টি আবার পঞ্চভূতেই বিলয়, তা হলে কোন সে উদ্বৃত্ত অংশ যা স্বর্গে বা নরকে যাবে? এ জাতীয় তত্ত্ব ও দ্বান্দ্বিকতার বিন্যাস থেকে বোঝা যায় নিম্নবর্গজাত বাউলফকিররা খুব হেলাফেলার, অবজ্ঞার বা ঘৃণার বিষয় নয়, অনুধাবনের বিষয়।

এদেশে বাউল একটি তত্ত্ব হিসাবে গৃহীত হয়েছে, ধর্মহিসাবে নয়। এরা একই সঙ্গে বৈদিক কর্ম কাণ্ড এবং ব্রাহ্মণ্য আচার আচরণের বিরোধী। এদের ভাবনা ধারণা গঠনে বৈষ্ণবীয় রাগানুগা সাধনা ও পরকিয়া মৈথুনকেন্দ্রিক কায়াবাদ আছে। বেশ কিছুটা প্রতিবাদী ইসলামি স্পর্শ এবং অনেকটা সুফিবাদের সংক্রাম আছে। বৌদ্ধ শূন্যবাদ ও নাথপন্থের কিছু কিছু সংরাগও লক্ষণীয়। এককথায় বাউল ভাবনায় এক উদার ও সমন্বয়বাদী মানবচেতনা কাজ করেছে, যার নেতৃত্বে শাস্ত্র বা মন্ত্র নেই— আছে গান আর গুরুর নির্দেশ। গানগুলি দ্যোতনাময় ও গূঢ়, তাকে ভেদ করতে হয় সাধনায়। এক কথায় বাউলরা হল ভোগমোক্ষবাদী, সমাজছুট কিন্তু সমাজবিচ্ছিন্ন নয়। সামাজিক দায়দায়িত্ব তারা নিতে চায় না কিন্তু সমাজের শোষিত নিম্নবর্গের শ্রমজীবী অংশ থেকে যেহেতু তাদের আবির্ভাব তাই অত্যাজ্যভাবে তাদের গানে রয়ে যায় নানা সামাজিক স্মৃতি ও সংস্কার, রূপক ও প্রতীক। তাদের গানের ভাবে-বর্ণনায়-সুরে মাটির স্পর্শ খুব প্রকট। কেউ কেউ মনে করেন বাউল সাধনায় পর্যুষিত হয়ে আছে বাংলার ধর্ম, বাঙালির ধর্ম ও তার চিরার্জিত মানসজীবন। ‘দেশীভাবে ও বিদেশীপ্রভাবে এর উদ্ভব,’ এমন কথা বলেছেন কেউ— সেক্ষেত্রে বিদেশি বলতে ইসলাম ও সুফিপ্রভাবের কথাই ব্যঞ্জিত। ‘সমাজের উপরতলার লোকের ধর্ম হলে এই মতবাদ যে কেবল বাঙালির জীবন ও ভাগ্য নিয়ন্ত্রিত করতো তা নয়, দুনিয়ার মানুষের কাছে উদার মানসিকতার জন্য বাঙালিকে শ্রদ্ধেয়ও করে তুলতো’— আহমদ শরীফের মতো প্রাজ্ঞজনের এ হেন মন্তব্যে ভাবাবেগ যতটা স্ববিরোধও ততটা। কায়াবাদী যৌনযৌগিক কোনও গোপ্য সাধনরীতি কি উপরতলার লোকের চর্চার বিষয় হতে পারে? এ কি কোনওভাবে বহুজনের আচরণীয়?

আহমদ শরীফ অবশ্য বাউলতত্ত্ব বিষয়ে এমন মন্তব্য করেছিলেন বহুদিন আগে, ১৯৬৩ সালে। তারপরে মন্তব্যটি হয়তো তিনি পুনর্বিবেচনা করে থাকবেন। তবে অপেক্ষাকৃত পরে, ১৯৮৮ সালে, তিনি ‘ফুলবাসউদ্দীন ও নসরুদ্দীনের পদাবলী’ সংকলনের মুখবন্ধে যে মতামত দিয়েছেন তা বিশেষভাবে অনুধাবনযোগ্য। বলেছেন,

‘Materialism spiritualism’-এর দ্বন্দ্বে যখন দুনিয়ার মানুষের মন অস্থির ও অসুস্থ, যখন নৈতিক ও সামাজিক মূল্যবোধ বিপর্যস্ত, যখন পৃথিবীর কল্যাণকামী চিত্ত অবক্ষয়ের নিরূপ যন্ত্রণায় কাতর, মানসদ্বন্দ্বে বিক্ষত মানুষ যখন স্বস্তির নিদান লাভের আগ্রহে উন্মুখ ও উৎকণ্ঠ, বিমূঢ় শিল্পীরা ও মনীষীরা যখন দিশাহারা, তখন এই অধ্যাত্মবাদনির্ভর নিশ্চিত মনের অবিচল প্রসন্ন-প্রশান্তি আমাদের ভাবিয়ে তুলবেই। বাউল গান আমাদের ক্ষণে ক্ষণে স্মরণ করিয়ে দেয় জীবনের জড় রয়েছে গভীরে, গতি হচ্ছে অনন্তে আর সম্ভাবনা আছে বিপুল। অবশ্য স্বীকার করতেই হবে এ মরমীতত্ত্ব ও অধ্যাত্মবাদ আধুনিক যন্ত্র ও প্রযুক্তিনির্ভর ইহজাগতিক সুস্থ ও স্বস্থ জীবনবিরোধী ও উপযোগবিহীন।

এ একেবারে আধুনিক মনের বিশ্লেষণ, তবে নিরপেক্ষভাবে এমন প্রশ্ন কি উঠবে না যে, যা সুস্থ ও স্বস্থ ইহজাগতিক জীবনবিরোধী ও উপযোগবিহীন, তা নিয়ে আলোচনার প্রয়োজন কোথায়? সেই প্রশ্ন, অনিবার্যভাবে, তবু ওঠে। কারণ আমাদের সাম্প্রতিক মধ্যবিত্তমন বাউল গান শ্রবণ ও চর্চায় খুব উৎসাহী। সত্যিকথা বলতে কি এই মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রোতা ও ভোক্তাদের খুশি করবার জন্যই বাউল তার সাজসজ্জাকে জাঁকালো করেছে, গানের পরিবেশনে এনেছে পারফরমারের মঞ্চদাপানো গিমিক ও ভাবভঙ্গি, যন্ত্রানুষঙ্গে ঘটিয়েছে অতিরেক। যে যুবকটি বর্ধমান বা নদিয়ার গ্রামে চাষবাস করে কিংবা ঘরামির বৃত্তিধারী, সে সন্ধ্যাবেলায় বাউলের আসরে যেন বিদূষক— বিনোদন করাই তখন তার ধর্ম। হালফিল বাউলের এই দ্বিচারিতা সমাজের একটা ব্যাধির মতো বেড়ে চলেছে। তাদের অনেকের জীবনে কোনও মগ্নতা বা প্রশান্তি নেই— বিমূঢ়তার আততি তার চোখে মুখে ছাপ ফেলে।

এই আততির কারণ দু’রকম। প্রথমত, বাউল এতদিন অভ্যস্ত ছিল গ্রামীণ জনপদ ও সেই জনমণ্ডলীকে গান শোনাতে, তাতে কোনও বিরোধ ছিল না কারণ সে-গান তো সেই জীবনেরই ফসল। গানের বক্তব্য, প্রতীক, বর্ণনা এমনকী সুরের একঘেয়েমি তাদের মেনে-নেওয়া। এখন নগরায়ণের তুমুল কলরোলের মধ্যে বাউলকে হতে হচ্ছে নাগরিক গায়ক, বুঝতে হচ্ছে নাগরিক মানুষের সদা পরিবর্তনশীল হালকা পলকা রুচিবোধ। এটাই দ্বিতীয় সমস্যা। যেহেতু গ্রামীণ রুচি ও প্রত্যাশার কাঠামো অনেকটা অনড় তাই সেখানে বাউল গায়ক স্বচ্ছন্দ ও সাবলীল কিন্তু নগরের মঞ্চে সে আড়ষ্ট বেপথু। কী যে সে গাইবে, কতটা রংবাজি তাতে দরকার তার নির্ধারক এক অশিক্ষিত শ্রোতার দল— যারা কোনও গূঢ় গভীর ভাবের গান শুনতে আসেনি, দেখতে এসেছে একটা গানের ধরন, যা গড়নে ‘ফোকো-মডার্ন’। তাদের কারুর কারুর আত্মাভিমান এইরকম যে এই গানের সমাদর বা পরিপোষণ মানে একরকম শিকড়ের সন্ধান ও ঐতিহ্যের পরিচর্যা। বাংলাদেশের গবেষক আহমদ মিনহাজ ভেবেছেন, সমকালের রাজনীতির ঘূর্ণি, মূল্যব্যবস্থার ব্যাপক ওঠানামা, আকাশ-সংস্কৃতির প্রসার-প্রতিষ্ঠা, নীতি-আদর্শের ক্রমস্খলন, সাম্যের পতন, ভক্তির প্রাবল্য ও নাস্তিকের ঔদ্ধত্য, তারও চেয়ে ভয়াবহ ব্যাধি, মধ্যবিত্তের অপরচুনিস্ট হওয়ার Self centered হওয়ার অসুস্থ মানসিকতা থেকে একদল বিবেকী ও সংবেদি মানুষ নিষ্ক্রান্ত হতে চাইছেন। কোনও বাঁধা ছকে তাঁদের আর আঁটছে না, তাঁরা কিছুটা ভাবুক বা স্বপ্নবাদী হতে চান, ইতিহাসকে দেখতে চান জীবনের দর্পণে। মিনহাজের ভাষায়:

আমাদের অনুভূতিতে আজ তাই দোলা লেগেছে, ইতিহাস তার পরিচিত ভঙ্গি বদলে নতুন আদলে ধরা দিতে চাচ্ছে; নিছক অধ্যাত্মবাদ, বস্তুবাদ-এর কোনওটিই নয়, দুইয়ের প্রাসঙ্গিক ও যুগোপযোগী মিলনের আকাঙ্ক্ষাই আজ বড়ো হয়ে উঠেছে। বাউল গান শুধু গান নয়, বাউল গানের ইতিহাসের পাতায় মুখর সাধকদের অন্তর্গূঢ় বাণী হিসাবে শুধু নয়, ইতিহাসের নতুন পথনির্দেশনারূপে আমাদের অনেকের চেতনায় প্রতিভাত হচ্ছে। আমরা গ্রহণ করতে চাচ্ছি এর মানবিকতা এর আধ্যাত্মিকতা এবং এর বস্তুবাদিতাও। মানে করলে দাঁড়ায়, আমরা পুনরায় শিকড়াভিমুখী, পুনরায় আশ্রয়প্রত্যাশী; আমাদের অভিগমন ঐ সব লুপ্তপ্রায় চিহ্ন ও অভিজ্ঞতার কাছে, সেখানে আমাদের অনুপ্রেরণা বাউলের গান, আর অবলম্বন লালন, হাসন, শাহনূর, শীতলাং, ভবানন্দ, ভবা পাগল, পাগলা কানাই, রাধারমণ, আরকুম শাহ, দুর্বিন শাহ, মহিন শাহ, শেখ ভানু, আব্দুল করিম, এমনি শত শত নাম, নামহীন জানা-অজানা মানুষের পরিমণ্ডলে চর্চিত জীবনদর্শন, এক ঋদ্ধ ইহ-আধ্যাত্মিকতা।

নব্য বাঙালির এমন শিকড়সন্ধান ও আশ্রয়প্রত্যাশার অধুনাতন প্রয়াস হয়তো সত্য ও আন্তরিক কিন্তু সেই শুশ্রূষা কি শুধু প্রাক্তনদের লেখা গানেই মিটে যাবে? নতুন গীতিকারদের লেখা গান খুঁজব না আমরা? খুঁজে যদি পাই তবে সেই গান কি অনিকেত আমাদের দিশা দেবে? কী করে দেবে— যখন এখনকার বাউল গীতিকাররাও আরেক অর্থে বিভ্রান্ত ও বিব্রত? যখন চটকদারি কথাবার্তা, বানানো প্রহেলিকা তাঁদেরও আচ্ছন্ন করছে— ‘সত্য বলো সুপথে চলো’ এমন লালনবাণী যখন উপেক্ষিত অবহেলিত, তখন?

আহমদ মিনহাজ অবশ্য বোঝেন অধুনাতনের বাউল-সমস্যা। গত কয়েক দশক এবং বিশেষ করে গত দশ বছর পশ্চিমবঙ্গের বাউল-ফকির অধ্যুষিত গ্রামদেশে ঘুরে আমি যা বুঝেছি, বাংলাদেশে বাস করে মিনহাজ তার থেকে অনুভবের খুব একটা দূরত্বে নেই। তাই তিনি লেখেন:

এ যুগ বাউল হবার উপযোগী নয়। জীবনধারণের সমস্যা এত কঠিন হয়ে গেছে, বাউলরাই আজকাল বাউল হতে চান না। গ্রামগুলোতে অভাব দিন দিন বাড়ছে, নগুরে বাবুয়ানা ঢুকে পড়ছে, কে আর গভীর মন নিয়ে বাউলের গান শুনবে, বাউলকে গ্রাসাচ্ছাদনের সুরাহাটুকু করে দেবে। এখনো যারা বাউল আছেন তারা আগের মতো গুহ্য শাস্ত্রের চর্চা করেন না, জীবনের রূঢ় বাস্তবকে প্রকাশ করেন গানে; বলেন মানুষের অভাবের কথা, দারিদ্র্যের কথা, লোক সংস্কৃতির সমৃদ্ধ চিহ্নগুলো হারিয়ে যাওয়ার বেদনা প্রকাশ পায় তাদের গানে।

এরকম অনেক গান আমি সংগ্রহ করেছি আবার নানা সংকলনেও বাউলদের লেখা এমন কিছু কিছু গান রয়েছে যাতে ধরা আছে বিগতদিনের জন্য চাপা কান্না— হারিয়ে-যাওয়া সম্মিলিত গ্রমিক যাপনের স্মৃতির জন্য দীর্ঘশ্বাস। এমন গানগুলির মধ্যে সবচেয়ে যেটি মর্মস্পর্শী বলে মনে হয়েছে আমার, এখানে উদ্ধৃত করছি—

আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম

গ্রামের নওজোয়ান হিন্দু-মুসলমান

মিলিয়া বাউলা গান ঘাঁটু গান গাইতাম।

বর্ষা যখন হইত গাজীর গান আইত

রঙ্গে ঢঙ্গে গাইত আনন্দ পাইতাম।

বাউলা গান ঘাঁটু গান আনন্দেরই তুফান

গাইয়া সারিগান নাও দৌড়াইতাম—

আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম।

হিন্দু বাড়িন্‌ত যাত্রাগান হইত

নিমন্ত্রণ দিত আমরা যাইতাম।

মনে ভাবনা সেদিন কি পাব না

ছিল বাসনা সুখি হইতাম…

বাংলাদেশের বাউল গীতিকার আবদুল করিম এমন একখানি সমাজসম্পৃক্ত গান লিখলেন কেন? সমাজের পটপরিবর্তন, লোক সংস্কৃতির থাকা-না থাকা, হিন্দু-মুসলমান সাম্য— এসব নিয়ে বাউলের ভাবনা কেন? ভাবনা এইজন্য যে তার নিজের পথ নির্ধারিত ও স্পষ্ট কিন্তু সেই পথের চারপাশের যে-সমাজ, যে-মানব পরিবেশ তা নিয়েও তার ভাবনা— সেখান থেকেই তার উদ্ভব। তার জন্মের তো কোনও অ-লৌকিক উৎস নেই। স্বদেশ আর স্বসমাজের ভাষাই তার ভাষা— সেই ভাষায় লেখা গান তার স্বভাষীরই সমাদরের বিষয়। সমাজ তাকে তেমন মান দেয়নি, তার জীবনযাপনের ক্লিষ্টতায় দরদ দেখায়নি, সমাজের মূলস্রোতে বাউলের স্থান নেই, সে গ্রামের একটেরে পড়ে থাকে, প্রান্তিক বর্গের মানুষ, তবু সেই সমাজই তার শিক্ষক, সমাজই তার উপমা-প্রতীক-রূপক রচনার চাক্ষুষ উৎস৷ যাদুবিন্দু গোঁসাইয়ের একটা বাউল গানে একজন একক মানুষের দুঃখভারনত জীবনের ছবি আছে—

যে ভাবেতে রাখেন গোঁসাই

সেইভাবেই থাকি

আমি অধিক আর বলব কি!

কখনও দুগ্ধ ছানা মাখন ক্ষীর নবনী

কখনও জোটে না ফেন আমানি

কখনও আ-লবণে কচুর শাক ভখি—

‘Life is either a feast or a fast’ দর্শনে বিশ্বাসী এই একক মানুষটি সত্যিই কি একক না সমষ্টির ব্যথাবেদনার শরিক? গীতিকারের কি কোনও অভিযোগ আছে ব্যক্তি বা সমাজের বিরুদ্ধে? ‘গোঁসাই’ কে? উত্তরের খোঁজে গানের পরবর্তী অংশ পড়তে পারি—

তুমি খাও তুমি খিলাও

তুমি দাও তুমি বিলাও

তৈয়ারি ঘর পেলে তুমি পালাও

তোমার ভাবভঙ্গি বোঝা ঠকঠকি।

গুরু দুখ দিতেও তুমি সখ দিতেও তুমি

কুনাম গুনাম সুনাম বদনাম সবই তোমারই

ও কুলআলম্‌ তোমারই ও কুদরতবিহারী।

তুমি কৃষ্ণ তুমি কালী তুমি দিলবারি॥

কহিছে বিন্দুযাদু তুমি চোর তুমি সাধু

তুমি এই মুসলমান এই হিঁদু…

সাব্লিমেশনই এ গানের সারকথা। গুরুই সেই পথে তাকে টেনেছে। সে একলা পথিক কিন্তু একক নয়— তার সঙ্গী জ্বলন্ত বিশ্বাস ও স্থির প্রত্যয়। সমাজ থেকে ছিন্ন হয়ে সে সমাজকে দেখায় সমন্বয়ের স্বপ্ন।

অবশ্য এতসব বিচিত্র দৃষ্টিকোণ একদিনে অর্জিত হয়নি। প্রথমদিকে গৌণধর্মীদের আমরা ঘৃণা ও বিরুদ্ধতা ছাড়া কিছুই দিইনি— পরে দৃষ্টিভঙ্গি কিছুটা দ্রব ও অনুকম্পায়ী হয়েছে। পরিবর্তনের কারণ বোঝা কঠিন নয়। সবচেয়ে বড় কারণ এটাই যে, আঠারো ও উনিশ শতাব্দীর টানাপোড়েনের কালে বাঙালি হিন্দুসমাজে ধর্মচিন্তার যে আলোড়ন ঘটেছিল তার অনেকটা নাগরিক মধ্যবিত্ত জীবনের সীমায় অবরুদ্ধ ছিল। ঔপনিবেশিক ভাঙা গড়ায় ধনী অভিজাত, শিক্ষিত মধ্যবিত্ত ও গৃহস্থ ভদ্রলোক— এই ত্রিস্তর সমাজকাঠামোয় ধর্মধারণা নানা মাত্রা ও রূপ নিয়েছিল। শিক্ষার আলোয় পাশ্চাত্যের জ্ঞানবিজ্ঞান এদেশের মননে নতুন চেতনার বিকিরণ করে, ফলে ধর্মকে দেখা হতে থাকে নানা চোখে। একদিকে রামমোহন, দেবেন্দ্রনাথ, অক্ষয়কুমার, কেশবচন্দ্র— অন্যদিকে রামকৃষ্ণ পরমহংস, বিজয়কৃষ্ণ ধর্মের জ্ঞান কর্ম ও ভক্তিমার্গের বহু দিক উন্মোচন করেন। কারুর শস্ত্র ছিল জ্ঞান ও যুক্তি, কারুর শরণাগতি ও ভাবোদ্বেল প্রশান্তি। এ ছাড়া সাকার-নিরাকারের প্রশ্ন ছিল। ঐতিহ্যবোধ, শাস্ত্রজ্ঞান, গুরুর গুরুত্ব, শাস্ত্রের শ্রেষ্ঠত্ব, একেশ্বরবাদ, আত্মার অস্তিত্বে বিশ্বাস ও পরলোকতত্ত্ব— এতসব বিচিত্র ও বিরোধী সংঘাতে সংশয়ে দুলছিল তখনকার নাগরিক মধ্যবিত্ত বাঙালির সমাজকাঠামো। আমাদের পাঠক্রম ও উচ্চতর শিক্ষাপদ্ধতি বাঙালির এই মানস-সংঘর্ষের ইতিহাসকে বড় করে দেখিয়ে আসছে বলে সমাজের অন্য দিকটা অজানা রয়ে গেছে। তাই আমরা জানতে চাইনি মোগল সাম্রাজ্যের পতনের পরে নবাবি শাসনের ব্যর্থতার দায় কেমন করে বাংলার গ্রামসমাজকে জীর্ণ করেছিল। আর সেই জীর্ণতার ফাঁকে ফোকরে ঢুকে জেঁকে বসেছিল জাতিভেদ, বর্ণদ্বেষ, অন্ধবিশ্বাস, কুসংস্কার ও পুরোহিত বা মোল্লাতন্ত্র। ব্রাহ্মণ্য সমাজের একনায়কত্বজাত কঠোর বর্ণব্যবস্থা আর মুসলমান শরিয়তি নীতির কট্টর আচরণ থেকে পিঠ বাঁচাতে গড়ে উঠেছিল নানা ধরনের গৌণধর্ম, যার মূলে ছিল শোষিত হিন্দু-মুসলমানের যুক্ত চৈতন্য ও সমন্বয়স্বপ্ন।

ইংরেজের বিদ্যালয়ে ইতিহাসের পাঠ নিয়ে আমাদের ইতিহাসবোধ গড়ে উঠেছিল বলে সেকালের বাঙালি বুদ্ধিজীবী ও ধর্মনেতারা বুঝতে পারেননি বাংলার গৌণধর্মের অন্তর্লীন শক্তি আর মানবমুখিনতাকে। চোখে পড়েনি মধ্যযুগের কবীর নানক-দাদু-রজ্জবের সন্ত পরম্পরার ঐহিক বাণীর সঙ্গে বাউলদের চিন্তার সমকত্ব। রবীন্দ্রনাথের অনুভবেই প্রথম ধরা পড়ে গৌণধর্মীদের মহিমা ও সেই একলা-পথ-চলার গরিমা। তিনিই প্রথম বলেন,

বড়ই দুঃখের বিষয় যে আমরা দেশে থাকিয়াও দেশের বিষয় কিছুই জানি না।… বস্তুত আমাদের এইরূপ অজ্ঞতা স্বদেশের প্রতি আমাদের অনুরাগকে বড়ই সংকীর্ণ করিয়া ফেলে।

বাঙালি ছাত্রছাত্রীদের তিনি চোখ ফেরাতে চেয়েছিলেন, ‘দেশের দিকে— চারিদিকে— দেশের মাটির দিকে।’ ‘সমস্ত ভারতবর্ষের মধ্যে যে সমস্ত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ধর্মমত প্রচলিত, অজ্ঞাতে ও অলক্ষিতে যে সকল শক্তি সমাজের মধ্যে’ কাজ করছে তাকে জানতে চেয়েছিলেন। বুঝেছিলেন ‘সমাজের একান্ত আত্ম সংকোচনের অচৈতন্যের মধ্যেও… আত্ম প্রসারণের উদ্‌বোধন চেষ্টা’ রয়েছে নিম্নবর্গাশ্রিত আমাদের গৌণধর্ম সংগঠনের অভ্যন্তরে। সেটাই তার ভারতীয়ত্বের সবচেয়ে বড় প্রতীক।

এখন ছবিটা অনেকটাই বদলে গেছে। বাউল নয় শুধু, সব রকমের নিম্নবর্গের নবচেতনার কথা এখন শিক্ষিত বাঙালি জানতে উৎসুক। সাব-অলটার্ন দৃষ্টিকোণ থেকে ইতিহাসতত্ত্বের যে-নবব্যাখ্যান আর বয়ান তৈরি হচ্ছে আজকাল তার রসদ পাওয়া যাচ্ছে গৌণধর্মীদের আচার আচরণে, বিশ্বাসে ও গানে। উচ্চবর্ণের ও বর্গের ধর্মচেতনার প্রতিবাদ ও সহকারিতা, এই দ্ব্যণুক সম্পর্কের টানাপোড়েন সবচেয়ে স্পষ্টভাবে স্পন্দমান এ রকমের ঊন-ধর্মবোধে। প্রতিবাদের দিকটি সম্পূর্ণ অবারিত ও গানে গানে অভিব্যক্ত। লালন ও দুদ্দু শাহ-র গান এ প্রসঙ্গে সবচেয়ে উদাহরণীয়। সহকারিতার দিকটি একটু ধূসর, তাই সহসা চোখে পড়ে না। কিন্তু লক্ষ করলে অনুধাবন করা যায়, সাম্প্রদায়িক মূর্তিকে ভাঙতে গিয়ে তার বদলে তারা গুরুমূর্তিকে প্রতিষ্ঠা করে বসে, শাস্ত্রের অস্বীকৃতি পরিণতি পায় গুরুবচনের অলঙ্ঘনীয়তায়। সবরকম অধীনতার বন্ধনপাশ ছিন্ন করতে চায় যে-লোকধৰ্ম তা বন্দি হয়ে পড়ে গুহ্য রহস্যময়তায়। বাউলের আসক্তিহীনতা বারবার অপ্রমাণিত হয় তাদের নারীসঙ্গের অতিরেকে। একস্তরের বাউলের উদগ্র যশোপিপাসা আর প্রচারপ্রবণতা ধ্বস্ত করে দেয় তাদের পরম্পরাগত আত্মস্থ ধ্যানতন্ময়তাকে। কেউ কেউ গৃহস্থসুলভ ভোগবাদে স্পৃষ্ট হয়ে পড়ে। অথচ বাউলজীবন আর বাউলগান, নানা বিকৃতিসত্ত্বেও আজ ব্যাপক জনাদরে সচল। আশ্চর্য যে, বাউলের প্রতীক-প্রতিমা একতারা আজ বুদ্ধিজীবীদের গৃহসজ্জার উপাদান!

বাংলাদেশের সদ্যপ্রয়াত মনীষী আহমদ শরীফ দেড়দশক আগে কিছুটা বিস্ময়মুগ্ধ চিত্তে চমকিত হয়ে লিখেছেন:

ইদানীং বাউল মত ও গান আমাদের চেতনায় গুরুত্ব পাচ্ছে। কেবল তাই নয়, নানা কারণে এসব আমাদের ভাবিয়ে তুলেছে। সম্প্রতি প্রাতিষ্ঠানিক প্রচেষ্টায় বিপুলসংখ্যক গান সংগৃহীত হয়েছে। সাড়ে তিনশ বছর ধরে দেশের জন-সমাজের এক অংশ এমনি নিষ্ঠার সঙ্গে যে জীবন-চর্চার এ বিপুল আয়োজনে এতদূর এগিয়ে গেছে, সে সম্পর্কে আমরা অবহিত ছিলাম না। লোকচক্ষুর অন্তরালে লোকান্তরে প্রসারিত জীবন বোধের পরিচয়বাহী এই কাকলিকুঞ্জে প্রবেশ করে, এই সুর-সমুদ্রে অবগাহন করে বিস্ময় মানি।… বিস্ময়মুগ্ধ চিত্তে ভাবছি,— এ নিয়ে আমরা কি করব।… দেশের প্রাকৃতজন যখন ফলপ্রসূ চাষে নিরত, তখন শিক্ষিতগণ নিষ্ফল উদ্যান রচনায় ব্যস্ত। বাউল মত যদি আদ্যিকালের ইতিকথা হত, তা হলে পরিহার-যোগ্য ঐতিহ্য মনে করতাম। কিন্তু আজকের মানুষের এক অংশের জীবন দর্শনের প্রতি এমনি উদাসীন থাকা দায়িত্ববোধের অভাবই জ্ঞাপন করবে।

না, এমন দায়িত্ব বোধের অভাবের পরিচয় আমরা দিইনি। আমরা গত এক দশকে প্রচুর বাউল ও ফকিরি গান গোলাজাত করেছি। তার বিষয়গত বিন্যাস, শ্রেণিকরণ, তার অন্তঃস্থ ইতিহাসের দ্যোতনা, তার প্রতিবাদ ও সমন্বয় বার্তা আমরা পেয়েছি। তৈরি হয়েছে উপেক্ষিত এই ব্রাত্য সমাজের সঙ্গে আমাদের মধ্যবিত্তীয় সতর্ক সমাজের সংলাপের ক্ষেত্র। আবার অতিকৃতিও চলছে নাকি? ক্ষুধার্ত বাউল গায়কদের নিয়ে বিদেশ-বিপণনের ব্যাবসাও আজ আর প্রচ্ছন্ন নেই।

সমাজবিজ্ঞানী পার্থ চট্টোপাধ্যায় একটু রসান দিয়ে মন্তব্য করেছেন: ‘the Baul, of course, having been granted cultural benediction in the twentieth by its elevation to the status of an export item in the Festival of India circuit.’

এই রপ্তানি-যোগ্যতার কারণ বাউলদের বহুবর্ণিল পোশাক, গুপিযন্ত্র, মাথার ধম্মিল্ল ও নাচের চমৎকার ভঙ্গি। একেবারে নিখুঁত শো-পিস। অনুষ্ঠান জমাতে অদ্বিতীয়, গঞ্জিকাপ্রিয় এই খ্যাপা বাউলরা বিদেশের মুক্ত সমাজে ও যৌনস্বাধীন যুবমানসে সাড়া তুলেছে। বাউল গানের তারসপ্তকের স্বর-গ্রাম অনেককে টানে। মুক্ত নির্বাধ জীবনযাপন, নারীসঙ্গিনী গ্রহণ-বর্জনের স্বতশ্চল স্বাধীনতা, ইতিউতি সর্বত্র ঘোরাফেরা, সংস্কারহীন খাদ্যাভ্যাস বাউলদের সর্বজনগ্রহণীয় করে তুলেছে। তবে পট পাল্টাচ্ছে। বাউল বিশেষজ্ঞ অমিত গুপ্ত লক্ষ করেছেন:

মূলত তত্ত্বভিত্তিক হলেও বাউল গানের… সুর ছন্দ, অর্থ ও ব্যঞ্জনায় শুধু রস বিস্তারই নেই অন্য আবেদনও আছে। বুদ্ধিজীবী এবং শ্রমজীবী সবার কাছেই বাউল গান গ্রহণীয়। বাউল গানের ক্ষেত্র ও পরিসর সমাজের পটভূমিতে তাই এত বিস্তৃত।

ভূমিহীন এই সম্প্রদায়ের মূলজীবিকা ছিল মাধুকরী। সারাদিন গ্রামে ঘুরে ঘুরে গান গেয়ে যা উপার্জন করত তা দিয়েই তাদের গ্রাসাচ্ছাদন হত। এদের ঘর বাড়িও ছিলো না। আখড়া বা সাময়িক আস্তানা গড়ে এখানে-ওখানে বসবাস করত। আজকের চিত্রটা ভিন্ন।… জীবিকা হিসাবে বাউল বেছে নিয়েছে গানকে। প্রভাব ফেলেছে। রেডিও, টেলিভিশন, সিনেমা। বিদেশের হাতছানিও বাউলকে প্রভাবান্বিত করেছে।… কৃষিজীবীদের পৃষ্ঠপোষকতার স্থান আজ ধীরে ধীরে চলে যাচ্ছে বুদ্ধিজীবীদের হাতে, বাউলদের ক্ষেত্রে। বাউলদের সাধন-জীবনের মূল্যের চেয়ে অনেক বেশী মূল্যায়ন হয়েছে বাউল গান ক্ষ্যাপা জীবনের নির্যাস, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক শিল্প পণ্য-ক্রেতাদের কাছে।

এখনকার বাউল তথা বাউলজীবন বিষয়ে আধুনিক যুবক-যুবতীদের অনেকে বেশ উৎসাহী। বীরভূমের নানা বাউল সমাবেশে, বিশেষত কেঁদুলির মেলায়, নবীন বয়সের ছেলেমেয়েদের ভিড় চোখে পড়ার মতো। তার সবটাই লোকদেখানি বা অগভীর নয়। বাউলগানের ভেতরকার একটা অনতিব্যক্ত উচ্চারণের ধরন এখনকার কবিদের খুব টানে। বাউলদের অবাধ জীবনযাপনের মুক্তছন্দ, তাদের ছকভাঙার দুঃসাহস, সমাজবন্ধনের প্রতিবাদী স্বাধীন ঘোরাফেরা অনেককে আকর্ষণ করেছে। যেমন সাতকেঁদুরির তরুণ কবি লিয়াকত আলি। এক সময় ছিলেন উদাম বিস্ফোরক রাজনীতিক ঢেউয়ের শীর্ষে। জেল থেকে ফিরে সংস্কার-মুক্ত প্রতিবাদী মনটাকে কোনও রাজনৈতিক মতাদর্শে তেমনভাবে আর রাখতে পারছিলেন না লিয়াকত। সেই সময় বীরভূমের নানা বাউলদের ঠেকে ঘুরে পেয়ে যান চমৎকার এক মানসিক আশ্রয় ও মানবিক আস্থার উৎস। লিয়াকত নিজে বাউল নন, কিন্তু সেই স্রোতোধারার স্বচ্ছ জলে স্নান করে শুদ্ধ। বাউলদের সম্পর্কে তাঁর পর্যবেক্ষণে তাই একটা অন্য বিবেচনা ধরা পড়েছে। লিয়াকত লিখেছেন:

নারী পুরুষের সম্পর্ক একটাই সেটা যৌনসম্পর্ক। এটাই প্রাকৃতিক সম্পর্ক। যা প্রাকৃতিক তাই ধর্ম, তাই সত্য, এর ভালমন্দ ন্যায় অন্যায় হয় না। মানুষ ছাড়া অন্যান্য প্রাণীর নারীপুরুষের সম্পর্ক একরকম। একমাত্র মানুষই নারী ও পুরুষের এক ধর্মীয় ও সামাজিক সম্পর্ক স্বীকার করে নিয়েছে। যেহেতু ধর্মীয় ও সামাজিক সম্পর্ক প্রাকৃতিক নয়— মানুষের বানানো— সেহেতু এর ভুলভ্রান্তি সম্ভব।… বাউলরা এই সত্যটা জানে। আর জানে বলেই তারাই হচ্ছে গুটিকয় সেই মানুষ যারা প্রায় নারী পুরুষের তথাকথিত ধর্মীয় ও সামাজিক সম্পর্ককে অস্বীকার করে বেঁচে আছে। একটা সাধনসঙ্গী নিয়ে কোন বাউল গোটা জীবন কাটায়। আবার অনেকেই দেখা যায় জীবনের বিভিন্ন সময় ভিন্ন ভিন্ন সাধনসঙ্গীর সঙ্গে। কখন যে কার সঙ্গে থাকবে কি পুরুষ কি নারী কেউই জানে না। নতুন কাউকে ভাল লাগলে পুরানোকে ছেড়ে যাওয়াই রীতি। কখনও বা নতুনকে ছেড়ে পুরানোর কাছে ফিরে যাওয়া। যে যখন যার সঙ্গে থাকে, সে-ই তার সুখ দুঃখ ও সাধনার সাথী। যখন থাকে না ভুলে যায় পরস্পরের কথা। স্থায়ী ভাবে ঘর সংসার বলে এদের কিছু নেই। আছে মাথা গোঁজার অস্থায়ী আশ্রয়। যৌথভাবে থাকার সময়ও কেউ কারও উপর তেমন নির্ভরশীল হয়, না, উভয়েই ভিক্ষা করে, উভয়েই খায়। আর এ ভাবে যতদিন বেঁচে থাকে, আকাঙ্ক্ষিত মানুষের সঙ্গসুখ নিয়ে বাঁচে।

এখানে বলে নেওয়া ভাল যে বাউলের কাছে সঙ্গসুখ কথাটা মূল্যবান! তাদের সম্পর্কে মরমি মানুষদের বাউলরা বলে রসিক সুজন। যদিও বাউলদের একান্ত গুহ্য একটা দেহসাধনার ব্যাপার আছে তবু সেটাকে প্রচ্ছন্ন রেখে তারা সকলের সঙ্গে মিশতে পারে। কেননা ঈশ্বরপ্রেম বা জীবে দয়ার বদলে বাউলের মানুষের সম্পর্কে রুচি বেশি। লিয়াকত আলি ঠিকই লক্ষ করেছেন যে দেহসাধনার ব্যাপারেও—

বাউল নিজের অস্তিত্বের প্রকৃতি কি বুঝে তার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে সম্পূর্ণ নিজস্ব ও স্বতন্ত্র এক পথিক। ‘অন্যে ভালো কি খারাপ ভাববে এই আশঙ্কাতে আমরা ঠিক যা করতে চাই কখনো করতে পারি না। এবং এই না পারতে না পারতে একসময় আমরা নিজে নিজের মতো না হয়ে অন্যের মতো হয়ে যাই। লাজ লজ্জা ভয়ের নিকুচি করে বাউল ছাড়া আর কে অন্যের মতো না হয়ে নিজের মতো হয়, হতে পারে? মানুষের কাছে এর চেয়ে মূল্যবান আর কিছু আছে!’ এখানেও বাউল সার্থক। এখানেও তাদের তুলনা নেই।

বাউলদের সম্পর্কে লিয়াকতের যে পক্ষপাত তা নিশ্চয়ই তাঁর একার নয়। আমাদের মধ্যে যারা একটু সমাজছুট, মুক্ত স্বভাবের বা স্বচ্ছ চোখে জীবনকে নীতির ঊর্ধ্বে দেখতে আগ্রহী, বাউল জীবন তাদের রোচক হতে বাধ্য। শুধু বাউল কেন বাংলা চৈতন্যপরবর্তী অনেকগুলি গৌণ ধর্মে এই জীবনধর্মিতা ও মানবমুখিনতা আছে। কর্তাভজা, সাহেবধনী, বলরামী, লালনশাহী, সহজিয়া বৈষ্ণব— এ সব নানা ধারাপ্রবাহে বয়ে চলেছে মানবচেতনার বেগবান স্রোতস্বিনী। বেগবান কিন্তু বহুক্ষেত্রে অন্তঃশীল, গোপন ও গূঢ়। একদিক থেকে ভাবলে এই সব কায়াবাদীরা আসলে ডি-ক্লাসড, শ্রেণিবর্ণহীন। ইহজীবন ও দেহজীবনের দ্বন্দ্বে-ছন্দে তাদের অনুরাগী দোলাচল। একটা অস্ফুট রহস্যের হাতছানি, অন্বিষ্টের জন্য এক মমতাময় আততি তাদের ছন্নছাড়া মন্ত্রহীন ব্রাত্যজীবনের দিকে অমোঘ টানে টেনেছে। অস্পষ্ট পরলোক নয়— বর্তমান জীবনযাপন, অস্বচ্ছ ঈশ্বর নন— প্রত্যক্ষ নরনারী, পূণ্যব্রত উপবাস তীর্থ মন্দির নয়— দৃঢ় সম্মিলিত সুস্থযৌনতার স্বীকৃতি, তাদের লক্ষ্য।

কিন্তু বাউলদের নিয়ে গত এক শতক বাঙালির ভাবালুতার শেষ নেই। ১৮৯০ সালের লালন শাহ-র প্রয়াণের পর তাঁকে নিয়ে বাউলপক্ষীয় ও বাউলবিরোধী দুটি দলই সক্রিয় হয়ে ওঠে। কলকাতার উচ্চমহলে ও বাংলার শিক্ষিতসমাজে বিশেষত ঠাকুরবাড়ির প্রয়াসে এবং রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিগত উদ্যমে ছাপার অক্ষরে লালনের গান ও তার মর্মরস প্রচারিত হয়। শুরু হয়ে যায় বাউল গান সংগ্রহ ও সংকলনের নানামুখী উদ্যম। গড়ে ওঠে কয়েকটি শখের বাউলের দল। ক্রমে ক্রমে নানা গৌণধর্ম ও সম্প্রদায় একই সঙ্গে ‘বাউল’ এই সাধারণ (Generic) ও বিশেষ (Specific) সংজ্ঞায় আবদ্ধ হয়ে যায়। বাউল সুর বলে একটা অলীক অনির্ণীত ধরন বাংলা গানে চেপে বসে। আজ সময় এসেছে তথ্য ও যুক্তি অবলম্বন করে ইতিহাসের পথে বাংলার বাউলদের স্বরূপসন্ধান। সে কাজ বেশ কঠিন।

কঠিন এইজন্য যে, বাউলদের সম্পর্কে আমাদের কৌতুহল নানা অলীক ধারণা ও অনুমানাত্মক সংজ্ঞার জন্ম দিয়েছে। মধ্যযুগের একটি বাংলা কাব্যে ‘বাউল’ শব্দটি ব্যবহৃত হতে দেখে অনেক পণ্ডিত অনুমান করে বসেছেন যে বাউল ধর্ম সুপ্রাচীন। কিন্তু বাউল কি কোনও ধর্ম? মূলে সেই কথাটারই এখনও মীমাংসা হয়ে ওঠেনি। বাউল কি একটা মৌলিক শব্দ না নিষ্পন্ন শব্দ? এ প্রশ্ন ওঠে এই কারণে যে অনেকে মনে করেন বাউল কথাটা ‘বাতুল’ থেকে এসেছে। বাতুল মানে পাগল। অন্য একদল মনে করছেন বাউল এসেছে ‘ব্যাকুল’ শব্দ থেকে, কেননা বাউলরা আত্মানুসন্ধানে ব্যাকুল। ক্ষিতিমোহন সেনের মতো বাউলবিশেষজ্ঞ মনে করছেন: তাঁহারা মুক্ত পুরুষ, তাই সমাজের কোনো বাঁধন মানেন নাই। তবে সমাজ তাঁহাদের ছাডিবে কেন? তখন তাঁহারা বলিয়াছেন, “আমরা পাগল আমাদের কথা ছাড়িয়া দাও। পাগলের তো কোনো দায়িত্ব নাই।” বাউলের অর্থ বায়ুগ্রস্ত, অর্থাৎ পাগল।’

এই কথাটার ধরতাই মেনে একজন লিখলেন বায়ু + ল = বাউল। আরেকজন বললেন, হিন্দি ‘বাউর’ বাংলায় হয়েছে বাউল। চৈতন্যচরিতামৃত গ্রন্থে ‘ঈশ্বরপ্রেমে মাতাল, বাস্তবজ্ঞান বর্জিত, উদাসীন ভক্ত’, এই অর্থে নাকি বাউল শব্দ একাধিক স্থানে ব্যবহৃত হয়েছে, বলেছেন অধ্যাপক অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়। আরবি-পারশি ভাষায় পণ্ডিত হরেন্দ্রচন্দ্র পাল মনে করছেন ‘আউলওয়লী’ শব্দ থেকে আউল-বাউল শব্দের জন্ম। গীতিকার দুদ্দু শাহ গানে বলেছেন: ‘যে খোঁজে মানুষে খোদা সেই তো বাউল।’ একজন বলেছেন আরবিতে ‘বা’ মানে আত্ম, ‘উল’ মানে সন্ধানী, অর্থাৎ বাউল মানে আত্মানুসন্ধানী।

এসব আধুনিক কালের পণ্ডিতি কচকচি ছেড়ে উনিশশতকীয় পণ্ডিতদের বইয়ের পাতা ওলটালে দেখা যাবে, তাঁরা বাউল শব্দের উৎপত্তির চেয়ে তাদের আচার-আচরণ সম্পর্কে নানা অদ্ভুত মন্তব্য বা ধারণা রেখে গেছেন। যেমন অক্ষয়কুমার দত্ত তাঁর ‘ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায়’ বইতে বাউলদের সম্পর্কে এতদূর লিখেছেন যে, ‘শুনিতে পাই ইহারা নরবধ করে না; মানুষের মৃতদেহ পাইলে ভক্ষণ করিয়া থাকে।’ পণ্ডিত যোগেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য লিখেছেন, বাউল— ‘a mad man, A class of beggars who pretend to be mad on account of religious fervour, and try to uphold their pretention by their fantastic dress, dirty habits and queer philosophy of their songs.’ বসিরহাটের কাজি মৌলবী কেরামতউল্লা ও গোলাম কিবরিয়া ‘উচিত কথা’ বইতে আরেক নতুন তথ্য যোগ করে বলেছেন, বাউলদের মতে আসল ফকিরি-তত্ত্ব চারটি, যেমন—

আউলে ফকির আল্লাহ বাউলে মোহম্মদ

দরবেশ আদম ছফি এই তক হদ।

তিনশত একসাত করিয়া যে আলি

প্রকাশ করিয়া দিল সাঁই মত বলি।

এই পদ্যাংশ থেকে আউল, বাউল, দরবেশ, সাঁই— চারটি ধারার খবর মেলে। যাঁরা এক সময় অখণ্ড বাংলায় বাউল-বিরোধী আন্দোলন করেছিলেন সেই শরিয়তবাদী আলেম মুসলমানরা আউল-বাউল-সাঁই-দরবেশ সকলকেই কচুকাটা করেছেন। কারণ বিশ শতকের সূচনায় উত্তরবঙ্গে বিশেষ করে মুসলমানদের মধ্যে বহু লোক এসব মরমি ও কায়াবাদী সাধনার পথে চলে যাচ্ছিলেন। বাধ্য হয়ে রংপুর জেলার বাঙালিপুরের মৌলবী রেয়াজউদ্দিন আহমদ ‘বাউল ধ্বংস ফৎওয়া’ অর্থাৎ ‘বাউল মত ধ্বংস বা রদকারী ফৎওয়া’ জারি করে হুঁশিয়ারি দেন:

বাউল বা ন্যাড়াদের আচার ব্যবহার সম্বন্ধে বঙ্গের অধিকাংশ লোকেই অবগত আছেন; তাহাদের দ্বারা মোছলমান সমাজের যে ভীষণ ক্ষতি হইতেছে, তাহা কাহারও অবিদিত নাই। দীর্ঘকাল হইতে বাউল ন্যাড়াগণ মোছলমানের চক্ষে ধূলি দিয়া তাহাদের ঘৃণিত আচার ব্যবহার গুপ্তভাবে করিয়া মোছলমান সমাজের মেরুদণ্ডকে ক্ষয় করিয়া আসিতেছে। ইহারা ভিতরে অমোছলমান, বাহিরে মোছলমানী নামে নাম, মোছলমান মহল্যায় বাস, মোছলমান কন্যাগণের সহিত বিবাহসাদী ও মোছলমানের সকল প্রকার সামাজিকতায় ভুক্ত। এই অপরিচিত অপ্রকাশ্যভাবে ইহাদের মোছলমানের সহিত মেলামেশার ফলে দলে দলে অশিক্ষিত মোছলমান ইহাদের ধোকাবাজী বুঝিতে না পারিয়া সনাতন এছলাম ধর্মকে ও পবিত্র কোরাণকে ত্যাগ করতঃ কাফের মোরতেদ হইয়া যাইতেছে।… এখনও কি তুমি বাউল ফকিরদিগকে মোছলমান বলিয়া জানিবে? এই কি তোমার এছলামী ঈমান ও মোছলমানী প্রাণের টান? তোমার বেখবরী ও হেশ্‌কারী হেতু তোমার অধীনস্থ কোন মোছলমান যদ্যপি বাউল মত গ্রহণ করিয়া পবিত্র এছলাম হইতে খারিজ হয় সেজন্য কি তুমি খোদা ও রছুলের নিকট দায়ী নহ?

এখানে বাউলদের গায়ে গায়ে জড়িয়ে আছে ‘ফকির’ শব্দ। শরিয়ত-সন্দিহান মুসলমানরা যখন মারফতি পথ বেছে নেয় তখন তাদের ফকির বলে। একসময় তাদের বাউলদের সঙ্গে এক উচ্চারণে শনাক্ত করা হয়েছে। খুব একটা বিতর্কের ঝুঁকি না নিয়ে আমরা বরং বলি যে বীরভূমের বাউল বা রাঢ়ের বাউলদের সঙ্গে উত্তর ও মধ্যবঙ্গের ফকিরদের অনেক ফারাক। দুজনের সামাজিক ভূমিকা কি আজ এক রকমের? পায়ে হেঁটে খোলাচোখে দেখেছি রাঢ়খণ্ডে বাউলরা জনজীবনের স্বাভাবিক ও অচ্ছেদ্য অংশ। তারা ভিক্ষা পায়, বৈষ্ণব সমাবেশে সাদর আহ্বান পায়; গান গাইতে প্রতীচ্যে যায়, তাদের প্রভূত মান্যতা। তুলনায় নদিয়া-মুর্শিদাবাদের বাউল ফকিররা অনেক নিম্নবর্গে, সামাজিক হীনতা নিয়ে দারিদ্র্যে দুঃখে বেঁচে আছে। কিন্তু কণ্ঠে তাদের গানের জোয়ার। সিউড়ির কাছে সাম্বৎসরিক পাথরচাপুড়ির মেলায় ফকিরদের মর্মন্তুদ দারিদ্র্য ও গীতিমুখরতা একই সঙ্গে দেখা যায়।

আমি বোঝাতে চাইছি, বাংলার বাউল বলতে কোনও স্পষ্ট ও নির্দিষ্ট ধারণা করে নেওয়া জটিল কাজ। তাদের স্বরূপ স্বভাব ও ক্রিয়াকরণ যেন নানা কাপড়ের টুকরোয় বানানো দরবেশি পোশাকের মতো বিচিত্র ও বর্ণিল। নানা ধারা মিলে মিশে বাউল ধরন গড়ে উঠেছে। আজ তাকে প্রত্যক্ষ সংজ্ঞার সীমায় বাঁধা ঠিক হবে না। মধ্যপন্থী ও বিবেচক পণ্ডিতরা তাই সিদ্ধান্ত করেছেন যে মধ্যযুগীয় বাংলায় নানা রকম লোকায়ত ও শাস্ত্রবিরোধী ধ্যানধারণা বাউল মতের পরিবর্ধন ও প্রসাধনে সাহায্য করেছে। বৌদ্ধ সহজিয়া, বৈষ্ণব সহজিয়া, নাথপন্থ, তন্ত্র ও সুফিবাদ মিলে মিশে এক অদৃশ্য দ্রবণে জন্মেছে বাউল ফকিরদের রূপময় জগৎ। আত্মার চেয়ে দেহ, জাতিবর্ণ দ্রোহ, মন্দির মসজিদের চেয়ে গুরুর নির্দেশ, শাস্ত্রের চেয়ে আত্ম-অনুজ্ঞা— এই দেশে তো নতুন নয়। হয়তো সেই লোকায়তিক পরম্পরার এক সমৃদ্ধ উদ্ভাস বাংলার বাউল। সাধারণভাবে ক্রিয়াকরণ, গানের অন্তর্জগৎ বা আচরণ থেকে বাউলদের সকলে চিনে নিতে পারেন। কিন্তু তাঁরা আত্মসাবধানী, সন্ধ্যাভাষী, ইঙ্গিতগ্রাহী। আপন মর্মকে তাঁরা ধর্মের ক্রিয়াপরতায় বোঝাতে চান না। তবে তাঁদের বহির্বাস খুব ইঙ্গিতধর্মী ও সুনির্দিষ্ট। কর্তাভজা-সাহেবধনী-বলরামীদের কোনও নির্দিষ্ট পোশাক নেই। বৈষ্ণব সহজিয়ারা সাধারণত সাদা পোশাক পরেন। কিন্তু বাউলদের একটা নির্দিষ্ট বহিরাবয়ব আছে। বেশ কিছুকাল আগেকার একটা বর্ণনা থেকে বাউলদের বিবরণ উদ্ধৃত করছি—

কেশ বিন্যাস দেখিলেই বিলক্ষণ চিনা যায়। পরিধানে গেরুয়াবসন, হস্তে লৌহবালা, বগলে দীর্ঘ চিমটা, গলে পাথুরিয়া মালা, আর একটা হুঁকাতে লম্বা নল লাগানো, তাহাতে এক কলিকা গাঁজা সাজিয়া, জয় বোবুম বোবুম গুরু সত্য বলিয়া চক্ষু দুইটি মুদ্রিত করিয়া, সেই গাঁজায় দোম দিতে থাকে।

অক্ষয়কুমার দত্ত তাঁর ‘ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায়’ বইতে একশো বছর আগেকার বাউলদের বর্ণনা দিয়ে গেছেন এই রকম—

এই সম্প্রদায়ীরা তিলক ও মালা ধারণ করে এবং ওই মালার মধ্যে স্ফটীক, প্রবাল, পদ্মবীজ, রুদ্রাক্ষ প্রভৃতি অন্যান্য ও বিনিবেশিত করিয়া রাখে। ডোর কৌপিন ও বহির্বাস ধারণ করে এবং গায়ে খেলকা পিরাণ অথবা আলখাল্লা দিয়া ঝুলি, লাঠি ও কিস্তি সঙ্গে লইয়া ভিক্ষা করিতে যায়।… ক্ষৌরি হয় না, শ্মশ্রু ও ওষ্ঠলোম প্রভৃতি সমুদয় কেশ রাখিয়া দেয় এবং মস্তকের কেশ উন্নত করিয়া একটি ধম্মিল বাঁধিয়া রাখে।

অক্ষয়কুমারের এই বর্ণনায় একটা বড় ফাঁক থেকে গেছে। বলা হয়নি যে এসবের সঙ্গে থাকে বাউলদের অচ্ছেদ্যসঙ্গী একতারা ও ডুগি, খমক, সারিন্দা বা দোতারা। কেউ কেউ গলায় কণ্ঠি পরেন, কেউ করেন তিলকসেবা। সেই সঙ্গে থাকে নারীসঙ্গী এবং কণ্ঠে ভাবের গান, যার বাণীতে-কূট রহস্যের অতল ব্যঞ্জনা। বাংলা গানের সুদীর্ঘ ও সমৃদ্ধ ধারাবাহিকতায় বাউলরা এক ধরনের গান সংযোজন করে চলেছেন, যা এই সম্প্রদায় লুপ্ত হয়ে গেলেও থেকে যাবে। কিন্তু বাউলদের পরিচয় একটু অন্য দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা জরুরি। প্রথমে তাঁদের বহির্বাস প্রসঙ্গে লক্ষ করা যেতে পারে।

বাউল ফকিরদের জীবনের সঙ্গে বহুদিন সংসর্গকারী সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ ১৯৮৭ সালে আমাকে এক ব্যক্তিগত চিঠি লেখেন যাতে তাঁর কতকগুলি নিজস্ব পর্যবেক্ষণ এখানে প্রাসঙ্গিক বলে প্রকাশ করছি। সিরাজ লিখেছিলেন: ‘যে বাউলমেলায় তেরাত্তির কাটিয়েছিলাম তাদের অনেকের পরনে গায়ে হলদেটে লাল, কারুর বা স্রেফ গৈরিক, কারুর তালিমারা (সংখ্যাও নাকি ওদের রহস্যময় সংখ্যাবাচক), কারুর সাদা এবং কারুর কালো পোশাক ছিল। পূর্ণদাস প্রমুখ শৌখিন শহুরে বাউলের যে পোশাক তা একান্তভাবে সুফি পোশাক, বৈরাগ্যের প্রতীক গৈরিক, এই Cliche-টি নিছক কবিকল্পনা, সম্ভবত রবীন্দ্রনাথ-সূত্রে এর প্রাদুর্ভাব। হিন্দু সাধুর পরনে সেলাই-করা পোশাকের আগমন এ যুগে বলেই মনে হয়। কারণ হিন্দুশাস্ত্রে সেলাই করা পোশাক নিষিদ্ধ ছিল। লক্ষ করবেন দর্জি শব্দের কোনও বিকল্প শব্দ ভারতীয় প্রাচীন ভাষায় নেই। সীবনকার অর্বাচীন কৃত্রিম শব্দ।’

বাউলদের ব্যাপারে দ্বিতীয় যে-চিন্তাভাবনা বহু মানুষের মনে তাঁদের সম্পর্কে কৌতূহল অথবা ঘৃণা টেনে এনেছে সেটা ‘চারিচন্দ্রভেদ’ অর্থাৎ মল মূত্র রজ বীর্য পান। বাউল তো শুধু নয়, আমাদের কায়াবাদী সাধকদের অনেকে ‘দুইচাঁদ’ (মলমূত্র) বা চার চাঁদের চর্চা করেন। এ তো বহু শত বছরের ধারা। এককালে বাউলদের ‘মুতখেকো’ বলা হয়েছে। তাঁদের এই বিচিত্র সাধনাকে ‘কদর্য’ ‘বীভৎস’ ‘জঘন্য’ এইসব নিদাত্মক বিশেষণে ঘৃণা করা হয়েছে। এ সম্পর্কে শেষ কথা বলা কঠিন। সভ্যরুচি ও উন্নত জীবনবোধ দিয়ে সব কিছুর মীমাংসা করা যায় কি? বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত ‘বাউলদের যৌনজীবন ও জন্মনিয়ন্ত্রণ’ বলে একটা রচনা থেকে এখানে উদ্ধার করছি। বলা হচ্ছে:

একটি সত্য এই যে মানুষের শরীরে দুটি চেতক এন্টিজেন আছে যা শরীরের প্রতিরোধ পদ্ধতির (Immunological system) অন্তর্ভুক্ত নয়। এই দুটি হল চোখের জলের জলীয় পদার্থ বা অশ্রু এবং বীর্য। আমাদের চোখের জলীয় অংশ বা শুক্রের অংশ কোনক্রমে রক্তে মিললে বিশেষ এন্টিবডি উৎপন্ন করতে পারে। সম্ভবত ঐ বীর্যপানরত পুরুষ নিজের বীর্যদ্বারাই শরীরে এন্টিবডি উৎপন্ন করবে এবং তাতে শুক্রাণুর উৎপাদন অবশ্যই অল্প হবে। তাই দেখা যায়, বাউলদের সন্তান সংখ্যা অত্যন্ত অল্প। তবে স্মরণযোগ্য, নারী কখনও এই বীর্যপান করে না।

বাউল মতের আন্তঃশরীরে যৌন যোগাচারের লক্ষণ যেমন স্পষ্ট তেমনই শ্বাসের নিয়ন্ত্রণ খুব গুরুত্ব পেয়ে এসেছে। উভয়ক্ষেত্রেই গুরুর ভূমিকা অত্যন্ত জরুরি। এই দুই দিক বিবেচনা করলে বাউল মতে সহজিয়া বৈষ্ণব ও সুফিতত্ত্বের প্রভাব চোখে না পড়ে পারে না। গুরুর নির্দেশে যোগক্রিয়া ও মৈথুন বাউলবর্গের লোকধর্ম সম্প্রদায়কে বিশিষ্টতা দিয়েছে। এই প্রক্রিয়ার সফল প্রয়োগের ফলে খাঁটি বাউলদের সন্তান জন্মায় না। অনেক বাউলধারা আছে যেখানে গুরুর শিষ্যরাই পরম্পরা বজায় রাখেন। সন্তান-পরম্পরার চেয়ে শিষ্য-পরম্পরা তাই বাউলদের কোনও কোনও স্রোতে প্রাধান্য পায়। বাউলরা বিশ্বাস করেন, দেহভাণ্ডে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের প্রতিরূপ রয়েছে এবং আত্মা কোনও অলৌকিক বস্তু নয়, তার উপলব্ধি ও উপস্থিতি দেহেই লভ্য। সেইজন্যই বাউলগান প্রধানত দেহতত্ত্বের গান। নিজের দেহকে জানা, তাকে নিয়ন্ত্রণ করা, তার মধ্যে দিয়ে আনন্দস্বরূপের আস্বাদন— এসবই বাউলের লক্ষ্য। তারই নানা ইঙ্গিত ও দ্যোতনা রয়ে গেছে কয়েক শতকের বাংলা গানে। ভাবের দিক থেকে তাই বাউল গান নানা মাত্রায় বাংলা গানকে সমৃদ্ধ করেছে। লালশশী, লালন, পাঞ্জু শাহ, হাউড়ে গোঁসাই, কুবির, যাদুবিন্দু, জালাল, দীন শরৎ, রশীদ, দুদ্দু, রাধারমণ, ফুলবাসউদ্দিন, দুর্বিন শাহ, পদ্মলোচন, শীতলাং শাহ, হাসন রজা থেকে আজ পর্যন্ত প্রবাহিত বাউলবর্গের গান আমাদের সগর্ব অর্জন। এঁদের সবাই হয়তো পরম অর্থে বাউল নন, কিন্তু বাউলদের কাছে শ্রদ্ধেয় ও গ্রহণীয়। আরেকটা সত্য হল, বাঙালির সামাজিক ইতিহাসে বাউলদের আচরণ ও চারচন্দ্র নিয়ে তর্ক বা মতান্তর থাকলেও বাউল গান নিয়ে কোনও তর্ক ওঠেনি। নিম্নবর্গ থেকে উচ্চবর্গ পর্যন্ত বাউলগানের স্বতঃস্ফূর্ত চলাচল চলছে প্রায় শতবর্ষ ধরে। রবীন্দ্রনাথ নিজেও বাউল গানের ভাবমুল্যে ও ছন্দে আকৃষ্ট হয়েছিলেন এবং দেশবাসীকে প্রথম সচেতন করেছিলেন বাউলগানের নিজস্বতা ও গুরুত্ব সম্পর্কে। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময়ে তিনি যে সব অভিনব স্বদেশি গান লেখেন তার সুরকাঠামোয় বাউল গানের স্পন্দ ও উদ্দীপনা অত্যাশ্চর্য নৈপুণ্যে ব্যবহার করেন। পরে তাঁর গানে বাউল গানের অন্তর্জগতের গভীর বাণী ছাপ ফেলেছে। তাঁর কোনও কোনও রচনাকে তিনি এমনকী ‘রবীন্দ্রবাউলের রচনা’ বলে মেনে নিয়েছেন। কিন্তু তাঁর নাটকে বাউল চরিত্র সর্বদাই একক, তার নারীসঙ্গিনী নেই। অথচ বাউলের সাধনা সর্বদাই যুগলের রসরতি।

এই প্রসঙ্গে একটা বিতর্কযোগ্য প্রসঙ্গ সেরে নেওয়া যেতে পারে। ববীন্দ্রনাথের প্রণোদনায় ক্ষিতিমোহন সেন মধ্যযুগের সত্তসাধকদের সাধনার স্বরূপ সন্ধানে ব্যাপৃত হন এবং সেই সূত্রে বাংলা বাউলদেব লুপ্তস্রোতের কিছু পরিচয় ব্যক্ত করেন লেখালেখি করে। ১৯৪৯ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের লীলা বক্তৃতায় তিনি বিষয়রূপে বেছে নেন ‘বাংলার বাউল।’ তাঁর লেখায় পূর্ব ও উত্তরবঙ্গের বহু অজানা বাউলের খবর মেলে। যেমন কুষ্টিয়ার পাঁচু ফকির, রাজবাড়ির মেছেলচাঁদ, ঢাকা জেলার শাহনাল, ধামরাই টাঙাইলের পাগলচাঁদ। তার মতে: ‘বাংলা ভাষার আরম্ভ হইতেই বাউলের পরিচয় মেলে। তবে গুরু পরম্পরা একবার খোঁজ করিয়া (১৮৯৮ সাল) ১২/১৩ পুরুষ পর্যন্ত কোন মতে পাইয়াছিলাম।’ ক্ষিতিমোহন জানিয়েছেন তিনি কাশীতে প্রথম বাউল দেখেন নিতাইকে, পরে ঢাকা জেলার রাজবাড়িতে পরিচয় হয় দাশু বাউলের সঙ্গে। দাশুর আখড়ায় পরিচয় ঘটে দুর্লভ ও বল্লভের সঙ্গে ‘তাঁহাদের কাছেই আমি বড় বড় দুইটি বাউলধারা ও বহু বাউল গানের সন্ধান পাই।’ যাই হোক ক্ষিতিমোহন সেন তাঁর ভাষণে মদন, ঈশান যুগী, গঙ্গারাম, বিশা ভূঁইমালি, জগাকৈবর্ত প্রমুখের হালহদিশ দেন। তাঁদের গানের নমুনা পেশ করেন। এঁদের বাউল পদাবলি পড়ে রবীন্দ্রনাথ আকৃষ্ট হয়ে ক্ষিতিমোহনকে বলেন— ‘এমন সহজ এমন গভীর, এমন সোজাসুজি সত্য এত অল্পকথায় এমন অপূর্বভাবে প্রকাশ করিবার শক্তি আমাদেরও নাই। আমার তো ইঁহাদের রচনা দেখিয়া রীতিমতো হিংসা হয়।’

রবীন্দ্রনাথের ঈর্ষাযোগ্য এমন বাউলপদ পরে কয়েকটি রবীন্দ্র বক্তৃতায় ও রচনায় উদ্ধৃত হয়েছে। বাকি সংগ্রহ যা ক্ষিতিমোহনের ছিল তা তিনি প্রকাশ করতে চাননি। চারু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘বঙ্গবীণা’-য় ক্ষিতিমোহন সংগৃহীত ন’খানি বাউলগান সম্পূর্ণ মুদ্রিত হয়েছিল। বাংলার বাউলদের সম্পর্কে সবচেয়ে বিস্তারিত ও সুবৃহৎ বইটি যার লেখা সেই উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য নির্দ্বিধায় ঘোষণা করেছেন যে ক্ষিতিমোহন সংগৃহীত গানগুলি নির্ভরযোগ্য বাউল গান নয়, তাঁর কথিত বাউলদের অস্তিত্ব ও বিবরণ সন্দেহজনক। উপেন্দ্রনাথের প্রশ্ন ও মন্তব্য একটু তুলে দিচ্ছি— ‘বাংলার এ কোন্‌ অবাস্তব বাউলদের কথা তিনি আমাদিগকে শুনাইতেছেন? ইঁহারা কাহারা? কোথায় ইঁহাদের বাড়ি? ইঁহাদের কি কখনও বাংলায় আবির্ভাব ঘটিয়াছিল?’

এমন মারাত্মক প্রশ্নবাণ নিক্ষেপ করে সবশেযে উপেন্দ্রনাথ দুটি সিদ্ধান্তে এসেছেন। প্রথমত, ‘ক্ষিতিমোহন বাবর গান কয়টি সারা বাংলায় প্রাপ্ত বাউল গান হইতে সম্পূর্ণ ভিন্ন পর্যায়ের।’ দ্বিতীয়ত, ‘বাংলার বাউলদের যে সাধন তত্ত্ব ও সাধন পদ্ধতির কথা ক্ষিতিমোহনবাবু তাঁহার দুইটি প্রবন্ধে বলিয়াছেন, তাহা বাংলায় বর্তমানে যে বাউলদের দেখিতেছি ও যাহাদের গান পাইতেছি, তাহাদের সম্বন্ধে ঠিক খাটে না।… বাংলার বাউলদের সম্বন্ধে এই মতবাদগুলি তিনি কোথায় পাইলেন?’ অভিযোগ দুটি গুরুতর। সেই সঙ্গে ক্ষিতিমোহন সংগৃহীত গানগুলির বাণী বিষয়ে উপেন্দ্রনাথের মন্তব্য: ‘বাংলা সাহিত্যের সহিত যাঁহারা পরিচিত, তাঁহারা একবার পড়িলেই বুঝিতে পারিবেন যে এই গানগুলির মধ্যে যথেষ্ট “আধুনিক হস্তক্ষেপ” আছে এবং ইহা পল্লীর অশিক্ষিত বা সাবেকী ধরণের অশিক্ষিত বাউলদের রচনা নয়।’ সাধারণ পাঠকদের অবগতির জন্য উপেন্দ্রনাথের সন্দেহসংকুল কয়েকটি মন্তব্য উদ্ধৃত করছি—

১) ‘নিঠুর গরজী, তুই কি মানসমুকুল ভাজবি আগুনে।’ (উপেন্দ্রনাথের মতে মানসমুকুল এই সমাসবদ্ধ অলংকার সৃষ্টি আধুনিক রচনারীতি। তেমনই সন্দেহজনক, গানের অন্তর্গত ‘যুগযুগান্তে’ এবং বেদনা না লিখে ‘বেদন’ শব্দের ব্যবহার)

২) ‘হৃদয়কমল চলতেছে ফুটে কত যুগ ধরি। তাতে তুমিও বাঁধা আমিও বাঁধা উপায় কি করি।’—এ গানের দার্শনিকতার সঙ্গে বাংলার বাউল ধর্মের কোনও যোগ নেই, এ রচনাভঙ্গিও সম্পূর্ণ আধুনিক কালের— অভিযোগ উপেন্দ্রনাথের।

৩) ‘তারে অরুণ এসে দিল দোলা রাতের শয়নে’— (‘লাইনটি নিতান্ত অতি আধুনিক গন্ধী’)।

৪) ‘আমার ডুবলো নয়ুন রসের তিমিরে/ কমল যে তার গুটালো দল আঁধারের তীরে। উপেন্দ্রনাথের মন্তব্য: ‘এইরূপ বাক-চাতুর্য ও কল্পনা আধুনিক কালের কবিদের রচনা ছাড়া বর্তমানে বাউলদের গানে মিলে না, তাহা এই পনেরো-ষোল বছর ধরিয়া প্রায় দেড় সহস্র বাউলগান সংগ্রহ ও পর্যালোচনার অভিজ্ঞতার ফলে বুঝিতে পারিতেছি।’

এমন স্পর্শকাতর প্রসঙ্গ এবং ভয়ানক অভিযোগ সম্পর্কে আমরা নিজস্ব কোনও মতামত বা নতুন বিতর্ক তুলব না। কেবল ‘বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত’ তৃতীয় খণ্ডে ব্যক্ত অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের বক্তব্য পেশ করব। তিনি বলছেন:

এই গানগুলির প্রামাণিকতা সম্বন্ধে ডঃ ভট্টাচার্যের সংশয় নিশ্চয় সুধীজনের চিন্তা উদ্রেক করিবে… অবশ্য অবিশেষজ্ঞ হইয়াও বলিতে বাধা নাই যে, উল্লিখিত চার ও পাঁচ সংখ্যক গান (‘আমি মজেছি মনে/ না জানি মন মজল কিসে আনন্দে কি মরণে’ এবং ‘আমার ডুবলো নয়ন রসের তিমিরে’) দুইটির ভাব ভাষা ও প্রকাশভঙ্গিমা আধুনিকমনা সুশিক্ষিত ব্যক্তির রচনা বলিয়া মনে হইতেছে।

অনির্ণীত এবং অমীমাংসিত এক সমস্যা বাংলার বাউল গানের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। এর থেকে সন্দেহ না জেগে পারে না যে, বাউল গান বলে বিপুলাকার সংকলনবদ্ধ যে অজস্র গান আমরা হাতে পেয়েছি তার সব প্রামাণিক ও খাঁটি বাউলের রচনা তো? কথাটা ওঠে আরও এজন্য যে, উনিশ শতকে ‘সখের বাউল’ নামে একাধিক বাউল বা বাউলের দল প্রচুর গান লিখে গেয়ে বেড়াতেন। তার সবচেয়ে সফল নমুনা মেলে কাঙাল হরিনাথ বা ফিকিরচাঁদের গানে। বাউল না হয়েও তিনি উৎকৃষ্ট বাউল গান লিখেছেন। বাংলার বাউলগানের ধারা এ সব গানেও সম্পন্ন ও সমৃদ্ধ হচ্ছে। কিন্তু প্রকৃত বাউল গান— সাধনা-লব্ধ ও পরম্পরাজাত ক্রমশ নকলের ভিড়ে হারিয়ে যাচ্ছে।

‘বাংলার বাউল’ কথা দুটি যতটা উত্তেজক ও আকর্ষণময়, তেমনই অতল আর সমস্যাবহুল। বাউল কে, বাউল কী, বাউল কোথা থেকে, কবে থেকে, এ সব প্রশ্ন যদি বা মেটে তারপরে নতুন প্রশ্নের জট তৈরি হয়। আঠারো উনিশ শতক থেকে দীপ্যমান বাংলার বাউল বিশ শতকের রসিক ও বুদ্ধিজীবীদের আগ্রহ ও গবেষণার বিষয় হয়ে উঠেছে। এককালে ভদ্রলোকশ্রেণি তাদের ঘৃণার চোখে দেখেছেন, নৈষ্ঠিক মুসলমানরা ফতোয়া জারি করেছেন ধ্বংসের, তবু তারা নানা লোকায়ত বর্গের ধারার সঙ্গে গা ঢেলে দিয়ে অবিনাশী উদ্ভিদের মতো বেঁচে বর্তে আছে। একেবারে হালফিল, দু’-এক দশক, বাংলার বাউল সারাদেশে ও বিদেশে অভূতপূর্ব মান্যতা পাচ্ছে। এরা যতটা বাউল সাধক তার চেয়ে বড় গায়ক। যেমন পূর্ণদাস, পবনদাস বা আরও অনেকে। ব্যঙ্গ করে এদের বাংলার বা ভারতের সাংস্কৃতিক রপ্তানিযোগ্য বলেছেন কেউ কেউ। সেই অত্যুক্তি না হয় আমরা গায়ে নাই-বা মাখলাম, কিন্তু বাংলার বাউল নিজের মোপেডে ঘুরবেন, সঙ্গে বিদেশিনী, দৃশ্যটি বেশ অভিনব। অভিনব, কেননা আবহমান বাউলের সাধনা তো মগ্নতার, আত্মগোপনের। তাঁরা ভিক্ষাজীবী, আখড়াধারী বা গরিব গৃহী। বাউলরা বরাবর নিজেদের মধ্যে গুটিয়ে থেকে কায়সাধনা ও গান গেয়ে এসেছেন। বাসাছাড়া পাখির মতো বন্ধনহীন তাঁদের জীবনে পথ চলাতেই সমধিক আনন্দ। আর ছিল কতই মেলা— কেঁদুলি, রামকেলী, দধিয়া বৈরেগীতলা, পাথরচাপুড়ি, সোনামুখি, কোটাসুর, অগ্রদ্বীপ, ঘোষপাড়া। ওদিকে মানভূমের খাতরা, কুষ্টিয়ার ছেঁউড়ে, রাজশাহীর খেতুরী বা প্রেমতলী। এসব মেলায় সারা দেশের বাউলরা এসে মিলতেন, গান হত সারারাত— তত্ত্বগান, ভাবগান, ফকিরি গান, শব্দগান। আবার মনঃশিক্ষা বা আখেরিচেতনের গান, ‘দৈন্যতা’র গান, দেহতত্ত্ব। ছিল কেন, এখনও সবই আছে তবে মর্যাদাবান হয়ে নেই। মেলার আসরে রসিকের চেয়ে দর্শক বেশি, তত্ত্বজ্ঞের চেয়ে গবেষক বেশি, একতারার চেয়ে ক্যামেরা বেশি। ১৯৫৪ সালে প্রকাশিত ‘বাংলার বাউল’ বইয়ে ক্ষিতিমোহন সেন লিখেছিলেন:

এই সব স্থানের খবর পাইয়া বহু ‘গবেষণা’ করনেওয়ালা ডক্টরেটপ্রার্থী বিদ্বজ্জনের সেখানে ভীষণ সমাগম ঘটে।… কেঁদুলির নিত্যানন্দ দাস তো একদিন আমাকে বলেন বাবা, বৎসরান্তে এখানে আসিতাম। কিন্তু তোমাদের পিস্তলের মতো পেন্সিল ওঁচানো দেখিয়া স্থানটা ছাড়িতে হইল।

এখন দৃশ্যটা আরও ঘোরতর। কেবল পেন্সিল-ওঁচানো গবেষক নয়, নাগরিক ফোটোগ্রাফারের ফ্ল্যাসবাল্বের ঝলক, টেপরেকর্ডারের আমদানি, ভিডিও রেকর্ডিং ও কর্ণভেদী মাইক সবই দেখা যাবে। অমিত গুপ্ত তাঁর ‘বাংলার লোকজীবনে বাউল’ বইতে হালের রাঢ় খণ্ডের বাউলদের নাম সাকিনের পরিচয় রেখেছেন। তাঁর সংগৃহীত একটা সদ্যকালের গান হল ‘কৃষ্ণ নামের মিষ্টি চুরুট/ মুখে রাখো সর্বক্ষণ।’ এই একটা গানের বাণী ধরে আমরা হালফিলের বাউল জগতে (বিশেষত রাঢ়ের) ঢুকে পড়তে পারি। আদিত্য মুখোপাধ্যায় তাঁর ‘ধর্ম ও সংস্কৃতির আলোকে বাউল’ বইয়ে এমনতর কৃষ্ণনামের মিষ্টি চুরুট খাওয়া বাউলদের বিবরণ দিয়েছেন।

তিনি জানাচ্ছেন গৌরখ্যাপা বিদেশ ঘুরে এসে বাড়ি করেছেন, মোটর সাইকেল চেপে ঘুরছেন। হাতে বিদেশিনীর দেওয়া সোনার হাতঘড়ি। পবনদাসের গানের শুরু ট্রেনের কামরায়, ১৯৮৮ সালে তিনি ‘বিদেশিনী মিমলু সেনের সঙ্গে প্যারিসে। সাধক জীবন তাঁর শেষ।’ লাভপুরের ধনডাঙার কার্তিক দাস, শৈশবে গ্রাম্য যাত্রাগানে বিখ্যাত ছিলেন। এখন ‘ডিস্ক ক্যাসেট বিদেশ সব হয়ে গেছে।’ কৃষ্ণবাহাদুর থাপার জন্ম নেপালে, থাকেন পানাগড়ে। ১৯৬০ সালে সেনাবাহিনী থেকে ফিরে স্ত্রী আর পাঁচ বছরের ছেলেকে নিয়ে কেঁদুলি মেলায় আসেন এবং মনোহর খ্যাপার আখড়ায় গান শুনে মজে যান। তারপরেই কণ্ঠে নেন বাউল গান। ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, জাপান, কানাডা, ফ্রান্স ঘোরা বাউল কৃষ্ণবাহাদুর এখন প্রয়াত। ‘বিশ্বনাথ বাউলের বড় ছেলে আনন্দও এক বিদেশিনীর (৪৩-এর বেশি বয়সের জার্মান মহিলা কেরিন) প্রেমে হাবুডুবু খেয়ে পুনরায় ফিরে এসেছে ঘরে।’ বাংলার বাউল বলতে কি এঁদের প্রসঙ্গকে গণনায় আনতে হবে?

শেষ পর্যন্ত বাউল কি তবে একটা মনগড়া মিথ? একটা আশ্চর্য জীবনযাপনের ধরন? বিদেশের বিজ্ঞাপনে বলা হচ্ছে বাউল— ‘Child of Transcultural Studies’। সে ‘Sings and dances mad songs of ecstacy’। ব্যাপারটা প্রকৃতপক্ষে কি তাই? আমাদের অবশ্য ভিন্নতর অভিজ্ঞতা আছে। বলবার কথা সেটাও। রাঢ়ের বাউলদের অর্থ কীর্তি সচ্ছলতার বাইরেও তো একটা বৃহৎ বঙ্গ আছে। বর্ধমানের একটা অংশ, নদিয়া আর মুর্শিদাবাদ জুড়ে সাধক বাউলদের অভাব কই? তাঁরা বিদেশেও যান না, সিন্ধু পারের সুন্দরীরা তাঁদের সাধনভ্রষ্টও করেন না। অখণ্ড নদিয়ার খণ্ডিত অংশ, যা আজ বাংলাদেশ, তা তো বাউল গানের স্বচ্ছ স্রোতেবেগে প্রাণবান। সীমান্ত পেরিয়ে তার কিছু সুবাস আজও পাই। বাউলদের তো কোনও দেশগত বেড়া নেই। তাই এ বাংলার বাউল আসরে ও মেলায়, ও-বাংলার বাউলদের কত গান আমরা শুনি। তবে সে গানের ধরন ধারণ আলাদা। নৃত্যবিরল ভাবময় সেসব বাউল গান একটু অন্য ধাঁচের, হয়তো সুর কাঠামোটাও একটু স্বতন্ত্র।

এইখানে একটু খোলামেলা কথা বলতেই হবে। কলম-ওঁচানো গবেষকবৃন্দ যতই না কেন নিন্দিত হন তবু বাউলদের নিয়ে কাজের কাজ তো তাঁরাই কিছু কিছু করেছেন, করে চলেছেন। এদেশের রাষ্ট্রব্যবস্থা, ধর্মপ্রতিষ্ঠান বা সমাজসেবী সংস্থা বাউলদের জন্য তেমন কিছু করেছেন বলে তো শুনিনি।

এটাও মনে রাখতে হবে, বাউল সুর বলে স্পষ্ট, নির্দিষ্ট কোনও কাঠামো নেই। অঞ্চল ভেদে তা আলাদা। বাউলদের সম্পর্কেও এ কথাটা বলা চলে। অঞ্চল ভেদে তাদের ধরনধারণ জীবন প্রণালী আলাদা। সেইজন্যই রাঢ়ের বাউলদের সঙ্গে কুষ্টিয়ার বাউলদের খুব গভীর মিল খোঁজা নিরর্থক। আবার রাঢ়ের বাউলদের ঘনিষ্ঠ যেমন সহজিয়া বৈষ্ণবরা, নদিয়া মুর্শিদাবাদে তেমনই বাউলদের গায়ে গায়ে রয়েছে ফকিররা। বাউল আসলে তবে কি এক সমাধানহীন দ্বৈত? তার জীবনের কবোষ্ণ তাপ, তার পোশাকের মণ্ডন-ধর্ম, তার গানের উদার মানবিকতা, তার বন্ধনহীন পথচলা— এক অলক্ষ্য অন্বিষ্টর মতো। বাংলার বাউল যেন এক মগ্ন স্রোত, তার চোরা টানে প্রতিদিন আমাদের অবশ্যম্ভারী অবগাহন চলছে।

কিন্তু সেই অবগাহনের মধ্যে রয়ে যাচ্ছে ফাঁক ও ফাঁকি। এটা ততদিন ছিল না যতদিন বাউল ফকিররা তাদের নিজেদের পরিবেষ্টনীর মধ্যে থাকতে পেত, নিজেদের মতো আত্মমগ্ন সাধনার পথে। সত্তর-আশির দশক থেকে হঠাৎ শহরবাসী মধ্যবিত্ত এ-বর্গের গান সম্পর্কে এবং বেশি করে এদের জীবনধারা সম্পর্কে উৎসাহী হয়ে ওঠে। তার সবটাই হুজুগ বা গিমিক নয়। আসলে নাগরিক জীবন ও তার বিনোদনের উপকরণগুলি কৃত্রিম আর ক্লান্তিকর হয়ে উঠছিল ক্রমশ— বাংলা গানও একটা পুনরাবৃত্তির ছকে ঢুকে পড়েছিল। কাজেই একটা নতুন স্বাদ আর পরিবর্তন সবাই চাইছিলেন। আমাদের সাবেক ইতিহাসতত্ত্বের ধারণা ও ইতিহাস চর্চাও খুঁজছিল এক নতুন পথরেখা— তাই লুপ্ত অথবা ক্ষীণ গৌণধর্মগুলির শিকড়সন্ধানে ব্রতী হতে চাইলেন অনেক ইতিহাসসন্ধানী। জেগে উঠল শত জল ঝরনার ধ্বনি।

সেইসঙ্গে এই সময়খণ্ডে একটা নতুন জিনিস হল— বাউলদের বিদেশে নিয়ে গিয়ে গান শোনাতে আগ্রহী হলেন কেউ কেউ। তাঁরা আমেরিকাবাসী বাঙালি। বলা বাহুল্য তাঁদের উদ্দেশ্য নিশ্চয়ই ছিল না সেদেশে ভারতীয় অধ্যাত্মবাদ বা বৈরাগ্যবাণী প্রচার করা। পূর্ণদাস ও অন্যান্য ক’জনের গানে বিদেশে কিন্তু একটা ভুল বার্তা পৌঁছে গেল। শতবর্ষ আগে শিকাগোয় স্বামী বিবেকানন্দ যে-বেশ ধারণ করে তাদের মাতিয়েছিলেন, সেই গেরুয়া আলখাল্লা লুঙ্গি পাগড়ি ও কোমরবন্ধধারী বাংলার বাউল তাদের তারসপ্তকের উচ্চনিনাদে ও বৃত্তাকার নাচে কোনও কোনও বিদেশির মন মজাল। তারা এবার ঘন ঘন দেখতে চাইল বাউলদের— হঠাৎ বাউল-অনুরাগী বিদেশিদের সংখ্যা বেড়ে গেল। সাধন-সর্বস্ব একটি সম্প্রদায়কে হতে হল পারফরমার।

দেখা যাচ্ছে, বাউলদের জীবনযাপনের ধরন এবং বাউল গান অনেককেই টেনেছে, কিন্তু অন্তরঙ্গতা ও নিবিড় পর্যবেক্ষণ থেকে সাম্প্রতিককালে কিছু কিছু অন্য স্বরও ফুটে উঠেছে। বাউলদের সম্পর্কে এমন কিছু ভাল ও মন্দ মন্তব্য কয়েকজনের রচনা থেকে উদ্ধৃত করব, তার থেকে তাদের হাল চাল কিছু জানা যাবে। প্রথমে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মন্তব্য:

একসময় বাউলগান সম্পর্কে আমার খুব আগ্রহ জেগেছিল। কোথাও কোনো বাউলের গান শুনলেই টুকে রাখতাম।… বারবার ছুটে গেছি কেঁদুলির মেলায়, শীতের মধ্যে সারা রাত জেগে বসে থেকেছি অজয় নদীর ধারে ছোট ছোট আখড়ায়। খুবই দুঃখের কথা, কয়েক বছরের মধ্যেই আমি বাউল গান সম্পর্কে গোপনে গোপনে হতাশ হয়ে পড়ি।… মন দিয়ে বারবার শুনলে, বাউল গানেও একঘেয়েমি এসে যায়। তিন চার রকমের বেশী সুর বৈচিত্র্য নেই। গানের মাঝে মাঝে ‘ও ভোলামন’ বলে একটি দমফাটানো তান আসলে শ্রোতাদের চমকে দেবার একটা কায়দা মাত্র। শুধু গান শোনার আনন্দের জন্যই একসঙ্গে তিন চারটের বেশী বাউল গান শোনা যায় না, তখন হাই ওঠে, কিংবা ফ্যাসানের বশবর্তী হয়ে কৃত্রিম বাহবা দিতে হয়। সাহেবরা প্রকাশ্যে গাঁজা খেতে শুরু করার পর এদেশের ভদ্রসমাজের অনেক ছেলেমেয়েদের মধ্যেও গাঁজা টানার চলন হয়েছে। সাহেবদের পরবর্তী শিকার ঐ বাউলরা। দলে দলে বাউলদের আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, ইংলণ্ড সফর শুরু হয়ে গেল। সাহেবদের দেশ ঘুরে আসার আগে ও পরে একই বাউল গান শুনে দেখেছি, অনেক তফাৎ। তার গায়ে যেন আঠেরো ঘা।

আসলে বাউল গানের কাছে আমাদের খুব বেশী প্রত্যাশা করাটাই ভুল। বাউল গান বাউল গানেরই মতন। আমরা তার থেকে আংশিক আনন্দ পেতে পারি মাত্র। তার বেশী কিছু নয়। সমস্ত পৃথিবীর সভ্যতাই নগরকেন্দ্রিক। আমরা আর ইচ্ছে করলেই গ্রামীণ হয়ে যেতে পারিনা। স্বতঃস্ফূর্ত গানের প্রতি আমাদের অন্তরীণ বাসনা আছে বলেই আমরা বাউল গান বা লোকসঙ্গীতের কাছে গেছি বারবার। কিন্তু মন্দিরের সিঁড়িতে বসা একান্ত বাউলের গান বা ভেসে যাওয়া নৌকোয় মাঝির গান শোনবার সৌভাগ্য আমাদের দু’ একবারই হয়। বারবার পেতে গেলে সব কিছুর মধ্যেই একটা সাজানো ব্যাপার এসে পড়ে। মঞ্চে ওঠবার আগে বাউল প্যান্ট শার্ট ছেড়ে পরে নেয় গেরুয়া পোশাক, শ্রোতাদের দাবিতে মজার গান হিসেবে পরিবেশন করে এইরকম গান: ‘এঁড়ে গরু বেড়া ভেঙে খেজুর গাছে চড়েছে।’

অতি উৎসাহে বাউল বা লোকসঙ্গীত শিল্পীকে আমরা সরিয়ে আনি তার জীবনচর্যা থেকে। তার ফলে স্বতঃস্ফূর্ততা নষ্ট হয়ে যায়। ক্রমশ সেও আমাদের কৃত্রিমদ্রব্য সরবরাহ করতে থাকে।

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের এই বাস্তব বিশ্লেষণের মধ্যে যেমন সমাজ সত্য আছে তেমনই আর্টের সত্য আছে। বাউলকে যদি তার নিজস্ব সাধন ভজনের জগতে না থাকতে দিই, বারেবারে তাদের টেনে আনি আলোকোজ্জ্বল শহুরে মঞ্চে, আমাদের বিনোদনের কারণে, তবে তারা সাজগোজ কৃত্রিম গায়ন আর চটকদার ভাবভঙ্গিতে গ্রস্ত হবে তাতে সন্দেহ কি? বাউলরা তো কোনওদিন আত্মবিজ্ঞাপনে অভ্যস্ত ছিল না— থাকত আপন আপন ভজন কুটিরে, ঘুরত পথে প্রান্তরে, মেলা মচ্ছবের সম্মিলনে। গানকে জানত তত্ত্ব বলে। তার ছিল তিনটে পর্যায়— আত্মতত্ত্ব, গুরুতত্ত্ব আর দেহতত্ত্ব। এ ছাড়া ছিল দৈন্য ও মনঃশিক্ষার গান। কোথায় গেল সেইসব আত্মগুপ্ত ঠাঁইনাড়া স্বভাবের বাউল সাধক? নবনীদাসের কথা মনে পড়ে। জন্মেছিলেন একশো বছরেরও আগে বীরভূম জেলার গুনুর ভুমরি গাঁয়ে। পিতামহ অনন্ত গোঁসাই। পিতা অক্রূর গোঁসাই। সামান্য লেখাপড়া শিখে দশ বছরে মন্ত্র দীক্ষা চাঁদপুরের খেপি মায়ের কাছে। তারপরে বৈরাগ্য দীক্ষা নারায়ণ গোঁসাইয়ের কাছে। এবারে শুরু হল একসঙ্গে সংসার আর গানের জীবন, ভ্রাম্যমাণ সত্তার পরিক্রমণ। স্ত্রী ব্রজবালা আর বোন ফুরুবালা। একে একে সন্তান হল অন্নপূর্ণা-রাধারানী-পূৰ্ণদাস লক্ষ্মণদাস-চক্রধর।

কিন্তু মানুষটা সংসারী ছিলেন না। গান গেয়ে বেড়াতেন গাঁয়ে গাঁয়ে আর মাঠে মাঠে বাউল তত্ত্ব নিয়ে গানের পাল্লাদারি হত বোন ফুরুবালার সঙ্গে। নবনীদাসের দীক্ষিত শিষ্য ছিল মাত্র দুজন— হরিদাস মহান্ত আর ক্ষুদিরাম দাস। সুদর্শন হরিদাস পরে বিয়ে করেন ফুরুবালাকে, নবনীর সেটা পছন্দ হয়নি। সে যাই হোক, সারাজীবনই নবনী খ্যাপা ঠাঁই বদলেছেন। বিয়ের আগে ছিলেন জয়পুর গ্রামে, সেখানে থেকে উঠে আসেন বসোয়া-বিষ্ণুপুরে। বেশ কিছুকাল ছিলেন নানুরে। পরে ক্রমান্বয়ে বাস্তু গড়েছেন ও ভেঙেছেন— উবরুন্দি চিৎগাঁ, রায়ান-বেলুটি, সিন্দূর, ফতেপুর, কুলেড়া হয়ে পারুলডাঙা, সবশেষে সিউড়ির কেন্দুয়া পল্লিতে এসে দেহ রাখেন। ভবঘুরে স্বভাবের উদাসীন এই সাধকের গান ও জীবনচর্যায় মুগ্ধ ছিলেন রবীন্দ্রনাথ কিন্তু শান্তিনিকেতনে তাঁকে ধরে রাখতে পারেননি। তাঁর গলায় অসামান্য বাউল গান শহরবাসী কোনওদিন শোনবার সুযোগই হয়তো পেত না; যদি না ঘটনাচক্রে সিউড়ির ডাক্তার কালীগতি বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে পরিচিত হতেন নবনীদাস। গুণগ্রাহী চিকিৎসক কেবল যে তাঁর শরীরের দেখভাল করেছিলেন তাই নয়, তাঁর উদ্যমে নবনী ও পূর্ণ রেডিয়োতে গান করেন, অংশ নেন কলকাতার বঙ্গ সংস্কৃতি সম্মেলনে। বলতে গেলে পঞ্চাশের দশকে সেই প্রথম কলকাতার রসিকদের খাঁটি বাউল গান শোনা। মনে আছে আজও নবনীদাসের সেই মগ্ন গায়ন ও দীন বেশভূষা। তখন গেরুয়ার এত বিলাসিতা আসেনি বাউল সমাজে, ছিল সাদা ধুতির লুঙ্গি আর সাদা মার্কিনের ফতুয়া। এই বর্গের সব সাধক বাউলই এখন দেহ রেখেছেন। তাঁদের নাম ও রূপ অবশ্য অনেকের স্মৃতিতে এখনও ধরা আছে, যেমন ধরা যাক— ত্রিভঙ্গ খ্যাপা, রাধেশ্যাম দাস, চিন্তামণি দাসী, রূপদাসী, হরিদাস গোঁসাই, মনোহর গোঁসাই। গাঁয়ের পর গাঁ পায়ে হেঁটে পার হতেন, কাঁধে কাঁথার ঝোলা নিয়ে। নগ্ন পা, নগ্ন গা। অঙ্গে শুধু ডোর কৌপীন আর তহবন্দ। মাথায় চুড়ো করে বাঁধা চুল, সর্বকেশধারী বৈরাগী। মাধুকরী ছিল একমাত্র ব্রত। প্রসন্ন আনন, শান্ত স্বভাব, স্বল্পভাষী কিন্তু উৎফুল্ল।

পশ্চিমবঙ্গের নানা জেলা ঘুরে বাউল-ফকিরদের হালহকিকত জানতে গিয়ে আমি দু’রকম অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছি। বেশির ভাগ বাউলই অর্ধশিক্ষিত বা অশিক্ষিত, মোটামুটি চলে যায় গান গেয়ে, মাধুকরী করে, অবরে সবরে কারুর কারুর ডাক আসে সরকারপোষিত অনুষ্ঠানে, কিছু অর্থলাভ ঘটে। আর আছে কিছু সুযোগসন্ধানী বাউল, তৎপর ও চৌকস, ভাল গায়, ভাল কথা বলে। আলাপ হলেই একটা নাম ঠিকানা লেখা (অবশ্যই ইংরিজি অক্ষরে) কার্ড ধরিয়ে দেয়, তাতে গেরুয়া রঙের প্রিন্টে একতারা ছাপা আছে লোগো হিসেবে। এই একতারা একটা শো পিস, এর নানা সাইজ। আমি বর্ধমানের তথ্য দপ্তরে এক বাউলের ছবি তুলেছি, যার পরনে র-সিল্কের আলখাল্লা এবং হাতে দশ-বারো ইঞ্চির একটা ঝকঝকে পালিশ করা মিনি একতারা— ওটার কাজ অলংকারের। হয়তো পিন পিন করে একটু বাজে কিন্তু আসরের নানা বাজনার জগঝম্পে সেই ক্ষীণ ধ্বনির কীইবা মূল্য! তবে হ্যাঁ, ভারী দেখনদারি আর বাউলের নানা অঙ্গভঙ্গির সহায়ক যন্ত্র।

প্রশ্ন উঠেছে এখানেই— পরিবর্তমান দেশকালে, প্রতিযোগিতামূলক বাউল গানের বিশ্বে বাউল কি নবনীদাস বা রাধেশ্যামদের মতো সরলসিধে ভাবনিষ্ঠ সাধক থাকবে, না দেখনদারি ঝলমলে পোশাক পরে নেমে পড়বে অন্যকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে যেতে? এই তো সেবার কেঁদুলির মেলায় গিজগিজ করা মানুষের ভিড়ে সবাইকে সচকিত করে একটা লাল মোপেডে চড়ে আবির্ভূত হলেন বিশ্বনাথ দাস। ঝাঁকড়া চুল, আজানুলুণ্ঠিত লাল সিল্কের আলখাল্লা, পিঠে বাঁধা বন্দুকের মতো গেরুয়ামোড়া ছুঁচালো একতারা, যেন বাদ্যযন্ত্র নয় শস্ত্র। তার এহেন পোশাক পরিচ্ছদ বা ঔজ্জ্বল্য বিষয়ে প্রশ্ন করতে সে কোনও দ্বিধা না রেখেই বলল, ‘চিরকালই কি খালিপায়ে খালিপেটে বাউল কষ্ট করবে? এখন অবস্থা ফিরেছে। গান গেয়ে টাকা আসছে, বিদেশ যাচ্ছি আমরা, মান মর্যাদা পাচ্ছি। এ সব মেলা মচ্ছবে তাই একটু দেখাচ্ছি। এর ফলে অনেক বায়না হবে, অনেক আসরে গান করার ডাক আসবে। রোজগার হবে। তা না করে আখড়ায় ধুনি জ্বেলে বসে, গাঁজায় দম দিয়ে ভোম মেরে বসে থেকে কী লাভ?’

এ একেবারে বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গি, পাকা প্রফেশনাল। আদিত্য মুখোপাধ্যায় এদের সম্পর্কে হতাশ হয়ে কিছুটা ভগ্নহৃদয়ে লিখেছেন:

‘বাউল’ শব্দটি উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গেই মনের ক্যানভাসে একটি উদাসী মানুষের ছবি ভেসে ওঠে— গেরুয়া পোষাক, ধম্মিল্ল করে বাঁধা চুল, বগলে গাবগুবি বা আনন্দ-লহরীর চোরা সুর। কিন্তু যতদিন যায়, বাউলের পোষাকও বদল হয়। কেঁদুলীর মেলায় গেলে এ সত্যটি সুন্দর ধরা পড়ে। পবন দাস এখন জিন্‌স্‌ ব্যবহার করে বেশি, নিতাই দাস প্যান্ট-সার্ট পরে, নক্ষত্র দাস, বিপদতারণ দাস, কার্তিক দাস সবাই সাধারণ মানুষজনের মতোই থাকেন। গৌর আর সে গৌর নেই, বিশ্বনাথ দাস মারুতি কেনার নেশায় মগ্ন, আনন্দ দাস ভারতে গান গাইতে পছন্দ করে না।… আবার একজন বিদেশিনীর সঙ্গ না করলে এই সময়ের বাউলের মনও ভরে না, পকেটও ভরে না, সঠিক অর্থে বাউল জীবন বৃথা হয়ে যায়।

এই পর্যন্ত পড়ে আমাদের দু’-একটি মন্তব্য করতেই হয়। প্রথমত, বীরভূমের বাউলরাই তো একমাত্র বাউল নয়, সারাদেশে নানাভাবে নানা সাধন ক্ষেত্রে ছড়িয়ে আছে বাউল— তাদের সবাই এমন প্রদর্শনকামী বা লোভাতুর নয়। নদিয়া-মুর্শিদাবাদ-বর্ধমান-মেদিনীপুর বা বাঁকুড়ায় প্রচুর বাউল দেখা যায়, যারা সৎজীবনযাপনে আত্মসুখী, দরিদ্র ও ভক্তপ্রাণ। মোপেড বা মারুতি তো দূরের কথা, তাদের অনেকের একটা সাইকেলও নেই, গান গেয়ে উদয়াস্ত টহলদারি করছে, তবু পেট ভরে কই? সেই কবেকার কুবির গোঁসাই মনের দুঃখে লিখেছিলেন:

মুষ্টিভিক্ষে করে আমি খেতে পাইনে

উদর পুরে।

ঘরে ঘরে ঘুরব কত

ভূত খাটুনি খাটব কত?

এখনও গড়পড়তা বাউল-ফকিরদের এটাই ভবিতব্য, তবে তারা বেশির ভাগই অভিযোগহীন, স্বভাবে শান্ত। কেমন তাদের আস্তানা? অনুপম দত্ত বর্ণনা দিয়েছেন এইরকম:

আশ্রমটি অজয় বাঁধের ধার ঘেঁষে ছোট একটি দোচালা ঘর। একফালি বারান্দা। সামনের খানিকটা জায়গা ঘিরে ঢোল কলমীর বেড়া। এখানে তার বৈষ্ণবী গাঁয়ে গাঁয়ে মাধুকরী করে বাউলের সংসার চালায়।… বাউলের সংসারে সামান্য সচ্ছলতাটুকু নেই। তার ঘর-জোড়া সস্তা কাঠের তক্তায় ছেঁড়া কাঁথা, তুলো-ফেটে বেরুনো বালিশ। ঘরের কোণে হাঁড়ি কলসীর আবর্জনার ভেতরে মশাদের গুহাবাস, ছারপোকা আর আরশোলার জন্মঘর।

বাউলদের তুলনায় ফকিরদের অবস্থা আরও করুণ, শোচনীয়— অবশ্য খাঁটি ফকিরিয়ানার সেটাই তো শর্ত। বীরভূমের শাসপুরে আমিন শা ফকিরের খোঁজে গিয়েছিল লিয়াকত আলি। ফকির তখনও ফেরেননি। তাই অপেক্ষাতুর লিয়াকত দেখছেন:

আমিনের বউ মাঝবয়সী, রঙ বেশ ফরসা। তবে পরণের মোটা রঙিন ফুলছাপ সস্তা শাড়িটি খুব ময়লা। উঠোনে, খোলা আকাশের নীচে, রোদ্দুরের মধ্যে, মাটির উনুনে কালো তোবড়ানো হাঁড়িতে ভাত রান্না হচ্ছে। পাতার জ্বালে আগুনের চেয়ে ধোঁয়াই বেশি। উঠোনের ওদিকে মাটির বাড়ি, অবশ্য ওটিকে যদি আদৌ বাড়ি বলা যায়। বাড়িটি জরাজীর্ণ ও বিধ্বস্ত— কোনরকমে খাড়া হয়ে আছে। খড়ের চাল পচে ধ্বসে গেছে। ঠাঁই ঠাঁই খড়ও নেই। উঠোনে ও বাড়ির দাওয়ায় নানান জিনিস বিশৃঙ্খলভাবে পড়ে আছে। বাড়ির মধ্যে মুরগী চরছে, ন্যাংটো শিশু ঘুরছে। আধন্যাংটো একটি বালক কোমরের পেছনে কাস্তে গোঁজা, মাথায় করে একবোঝা ঘাস নিয়ে এসে দাওয়ার ওপর ধপ্‌ করে ফেলল। উঠোনে এপাশে অন্য কারোর বাড়ির পেছন দিক। তারই ছাচের নীচে ছায়ায় খেজুরপাতার তালাই বিছিয়ে আমাকে বসতে দিয়েছেন। বউটি। পরক্ষণেই এনে দিয়েছেন খাবার জল।

এ ধরনের দীনহীন ও শ্রীহীন বসত বাড়ি যে সবার তা নয়। করিমপুরের কাছে গোরভাঙায় আজহার ফকির ছিলেন সম্পন্ন গৃহস্থ। জোতজমি, পাকাবাড়ি, গ্রামজোড়া মান্যতা। ছেলেরাও ফকিরি মতে রয়েছে। ছোট ছেলে মনসুর ফকির এখন গান গেয়ে বেশ নাম করেছে। তবে আজহার ছিলেন তাত্ত্বিক সংসারজীবী ও গীতিকার, মনসুর শুধুই গায়ক। বাড়ির দাওয়ায় বসেছে গানের আসর। আমাদের চোখ চলে গেল গায়কের ঝাঁকড়া চুলের ওপাশে দাওয়ার কোণে— সেখানে রয়েছে একটা তাগড়াই রাজদূত মোটর সাইকেল।

কিংবা ধরা যাক, বর্ধমানের হাট গোবিন্দপুরে সাধন দাসের কুটির। শ্রীময়, শান্ত ও সচ্ছল। দৈন্যের কোনও ছাপ নেই। দিব্যি মোরাম বিছানো রাস্তা, চমৎকার সব খড়ে ছাওয়া ভজনকুটির। বিন্যস্ত গাছগাছালি, ফলফুলের বাগান। একটা নতুন ঘর গাঁথছে সাধনের শিষ্যরা গতরে খেটে। সাধনদাস পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন পোশাকের সফিস্টিকেটেড মানুষ। জাপানি সাধনসঙ্গিনী মাকি কাজুমি অঙ্গন আলো করে আছে।

এইখানে স্পর্শকাতর বিদেশিনী প্রসঙ্গটি একটু ভেবে দেখা দরকার। সব বাউলরাই যে বিদেশিনী মেমদের নিয়ে আছেন তা নয়। হয়তো সাকুল্যে জন দশ-পনেরো বাউলের কপালে নেকনজর জুটেছে মেমদের তাতেই বদনাম রটেছে সকলের নামে। এখানে একথাটা তো বুঝতে হবে এই শ্বেতাঙ্গিনী বিদেশিনীরা কেউই মহীয়সী নারী নয়— কেউই আসেনি ভারত উদ্ধারে। তারা কেউ মার্গারেট নোবল বা মীরা রিশার নয়, তারা পশ্চিমি বণিক সভ্যতায় দিগভ্রষ্ট রমণী। অর্ধশিক্ষিত কিংবা নেশাগ্রস্ত, কামুক কিংবা বখে যাওয়া। সামান্য দুয়েকজন জিজ্ঞাসু ও গবেষক। তবে এটা ঠিক যে তাদের কল্যাণেই বাউলদের বিদেশি সংযোগ ও ডলার রোজগার এ প্রসঙ্গে আমি একবার লিখেছিলাম :

একদল গায়ক-বাউলের দেশেবিদেশে সাম্প্রতিক বিপুল জনপ্রিয়তার প্রসঙ্গও উল্লেখ করা উচিত। এঁরা অনেকেই জীবনাচরণে ও সাধনায় বাউল নন, কিন্তু বাউল গানকে পণ্য করে, বাউলের পোষাক পরে, বিদেশী মঞ্চ দাপিয়ে বিপুল ডলার রোজগার করছেন।… গত দু’দশক ধরে সাজানো বাউলরা বিদেশী শ্রোতাদের জনপ্রিয়তা লাভের আশায় দেশজ গানকে ভাবে ও সুরে যতটা চটকদার বিনোদনধর্মী করে তুলেছেন, তার তরঙ্গ আমাদের পল্লী প্রান্তের গায়ককেও দিনে দিনে আকৃষ্ট করছে ও বিভ্রান্ত করছে।

এ-বক্তব্যের বিপরীতে বাউলরসিক অরুণ নাগ একটি নিবন্ধে মন্তব্য করেছেন :

সত্যি কথা বলতে কি বিদেশীদের মনোরঞ্জনের ব্যাপারটা একটু বাড়াবাড়ি। বিদেশীদের কতজন চটুল গান উপভোগ করার মতো বাংলা বোঝে? সুর বা লয় ইমপ্রোভাইজেশনের ক্ষমতাই বা গড়পড়তা কজন বাউলের থাকে? ‘গুরু কি মাছ ধরেছ বঁড়শি দিয়া’ বা ‘ও জামাই দরজা খোলো’— জাতীয় গান দেশী শহর-গ্রাম নির্বিশেষে এক ধরনের নিম্নরুচির শ্রোতার মনোরঞ্জন করে এবং যথেষ্ট জনপ্রিয়। ভারতীয় মার্গ সঙ্গীতের দিকপালরা বাউলদের থেকে অনেক বেশী বিদেশ যান, ডলার রোজগার করেনও অনেক বেশী, তাদের বেলায় কিন্তু বিদেশ-ডলার নালিশ শোনা যায় না। তারা বিদেশে আলাপ অংশ সংক্ষিপ্ত করে, তবলার সঙ্গে সওয়াল-জবাব বাড়িয়ে পরিবেশনকে আকর্ষণীয় করেন। অথচ কেউ বলেন না রবিশঙ্কর, আলি আকবর, বিলায়েতের পাল্লায় পড়ে ভারতীয় মার্গ সঙ্গীত গোল্লায় যাচ্ছে, তরুণ শিল্পী প্রভাবিত হচ্ছে পরম্পরার পথ ছাড়তে।… অনিকেত বৈরাগী ধূলিধূসরিত পায়ে একতারা বাজিয়ে গান গেয়ে হেঁটে যাচ্ছে গ্রামের পথে, এমন একটি ধারণা, ভাবমূর্তি মনে প্রোথিত থাকলে তার সঙ্গে সত্যিই মেলানো শক্ত জেট-মার্গী, ডলারপ্রেমী আধুনিক বাউলকে, যিনি নাইকি পায়ে, মারুতি চড়ে, গান গাইতে আসেন। রবিশঙ্করদের এমন ইমেজ কোনোকালে ছিল না বলেই কোনো আপত্তিও ওঠে না। গণ্ডগোল এখানেই।

প্রতিযুক্তি খাড়া করতে গিয়ে অরুণ নাগ নিজেও খানিকটা বিপাকে পড়েছেন। তাঁর বিবেচনায় আসা উচিত ছিল যে, (১) মার্গ সংগীত ও বাউল গান এক পঙ্‌ক্তিতে উদাহরণযোগ্য নয়, (২) রবিশঙ্করবর্গীয় উচ্চাঙ্গ শিল্পী ও গ্রামের অশিক্ষিত বাউল গায়ক শ্রেণিগতভাবেও একেবারে আলাদা, (৩) বাউল এক ধরনের জীবনাচরণ ও লৌকিক সাধনামার্গ, তাকে শহুরে মঞ্চে তোলার কথা নয়, (৪) বাউল গান ও মার্গসংগীতের দেশি শ্রোতারা একেবারে ভিন্ন বর্গের। সবচেয়ে বড় কথা, বাউল গানে পরিবেশনগত বিকৃতি এলে আমাদের লোকসমাজে তার প্রভাব অনিবার্য এবং সেটা দেশের পক্ষে ক্ষতিকর। রবিশঙ্কর আলি আকবর বিলায়েতরা বিদেশে পরিবেশনে যে চটক দেখান (সওয়াল-জবাব) এদেশে তো তা দেখান না, কাজেই তরুণ শিল্পীর পরম্পরাভ্রষ্ট হবার কথা আসছে কোথা থেকে? অরুণ নাগ আর একটা ব্যাপার গুলিয়ে ফেলেছেন! কণ্ঠসংগীত শিল্পী বাউলের সঙ্গে যন্ত্রসংগীত শিল্পীদের তুলনা এনে ফেলেছেন। জেট-মার্গী ডলার প্রেমী আধুনিক বাউল গায়ক নাইকি জুতো পরছেন, মারুতি চড়ছেন, এ-ইমেজ কোনওদিন ছিল না যেমন, আজও নেই। তাই যে দু’-একজন প্রদর্শনকামী ভ্রষ্ট বাউল বিদেশে বাহবা পেয়ে এদেশের মঞ্চেও সেই কৌশলে গান প্রদর্শন করেন, প্রকৃত বাউল গানের রসিকরা তাদের এড়িয়ে চলেন কিন্তু তাতে ধ্বংস বা বিকৃতি ঠেকানো যায় না। কারণ তরুণ গায়ক সম্প্রদায় সত্যিই তাতে প্রভাবিত হন এবং তাদের যন্ত্র-গানের দাপট, লম্বা ঝুলের বিচিত্রিত পাঞ্জাবি, চাপা প্যান্ট এবং কর্ডলেস মাইক নিয়ে চিল চিৎকার এখন বাউল গান বলে চালানো হচ্ছে। ক্রমশ তাদের আসব পানের অতিরেক ও নারী আসঙ্গ যুবসমাজে ছড়িয়ে পড়ছে। অথচ এদের দেখলে বাউল সমাজের প্রকৃত চিত্রটি বোঝা যাবে না। তারা চিরদরিদ্র ও উপেক্ষিত। আমাদের দেশের গড়পড়তা বাউলদের সম্পর্কে শিক্ষিত নগরবাসীদের ধারণা খুবই ধোঁয়াটে বা প্রান্তীয়। বিশেষত তাদের যাপনরীতি ও জীবন সংগ্রাম সম্পর্কে আমরা মূলত অজ্ঞ ও নির্লিপ্ত। তাদের সামাজিক অবস্থানগত বিপন্নতা, দৈনন্দিন অপমান ও সংকটের খবর শহুরে বাঙালির ভাবনা-বলয়ের মধ্যে নেই। তারা আমাদের বিনোদন মঞ্চের উপকরণ কিন্তু তাদের দারিদ্র ও ক্লেশ নিয়ে আমরা উদাসীন। তাই মুর্শিদাবাদের গ্রামে গ্রামে বছরের পর বছর ধরে নিরন্তর বাউল ফকির নিগ্রহ আমাদের দূরদর্শনের খাসখবরেও আসে না।

এদেশে বসে অবশ্য আমরা জানতে পারি না বিদেশে ঠিক কোন পর্যায়ের বাউলরা যান এবং মঞ্চে কী গান করেন। খোঁজ করলে দেখা যাবে পূর্ণদাস, প্রহ্লাদদাস বা পবনদাসরা যেমন ঘন ঘন যান, ততটা হয়তো লক্ষ্মণদাস বা সমীর রায়রা যান না— সবই আসলে যোগাযোগ বা স্পনসরের ব্যাপার, যার কপালে যেমন জোটে। ঘটনাচক্রে সনাতনদাসের মতো গুণী বাউলেরও ডাক আসে। যেমন একবার এসেছিল ফ্রান্স থেকে। সনাতনদাসের খয়েরবুনি গাঁয়ের আশ্রম থেকে ফরাসি ভাষায় লেখা ফ্রান্সের একটা অনুষ্ঠানপত্র সংগ্রহ করেছিলাম। সেটার অংশ বিশেষ অনুবাদ করলে আমরা যে-সংবাদ পাই তা অনুধাবনযোগ্য। সনাতনদাস সম্পর্কে সে দেশের পক্ষে পরিচিতি হল :

Sanatan Das Baul, born in 1923, not attracted by the commercial circuit, has preserved an authenticity linked with his rural mood of life. Coming from Bangladesh, he lives in the village of Khayerbuni (district Bankura). He interpretes Bhatiali, (song of the rivers) by playing on the ektara (stringed lute) on the dotara (lute with 4 strings). He is accompanied by his two sons Viswanath and Basudev, who also play on the gubgubi. He celebrates the awakening of the soul.

বাংলার প্রখ্যাত বাউল ফ্রান্সে গিয়ে একতারা বা দোতারা বাজিয়ে ভাটিয়ালি গাইছেন, এমত সংবাদ কৌতুককর না প্রহসনাত্মক? তাঁর গানের বিষয় ‘Cruel Ganga’ এবং পুরো গানটি অনুষ্ঠানপত্ৰীতে ছাপা রয়েছে এবং তার ‘text’-এ কুত্রাপি বাউলতত্ত্ব নেই। সেটি এক নিছক ভাটিয়ালি। কৌতুকের এখানেই শেষ নয়, সনাতনের সহশিল্পী কার্তিকদাস বাউলের পরিচিতিও চমৎকার। বলা হয়েছে :

Kartikdas Baul belongs to the ‘topsil’ caste, linked with agriculture. An old member of ‘jatra’. a popular musical theatre of Bengal, seduced by the ways of the Baul at the age of 15, he became a disciple of Sanatandas Baul. Today at the age of 35, he lives with his family in the village of Dhandanga (Birbhum district). He specially invokes the Ganga and its cruelty, to the accompaniment of his gub-gubi.

অদৃষ্টের এমনই পরিহাস যে বাংলার বাউল গাবগুবি বাজিয়ে বিদেশে গেয়েছেন ভাটিয়ালি।

সে যাই হোক, বিদেশে বাউল গান কথাটা শুনলেই উর্বাহু হয়ে ভাবমগ্ন স্বার কিছু নেই— অনুপুঙ্খ অনেক বিচিত্র বার্তা উঠতে পারে। তার আর এক রকমফের এবারে পরিবেশন করা যেতে পারে।

রান্ডি নিকলসন নামের এক বিদেশিনীর হঠাৎ ভাল লেগে যায় সমীর রায় নামের গায়ক যুবাকে। কেঁদুলির মেলায় সে আতিপাতি করে খুঁজতে থাকে সমীরকে। লিয়াকত তাকে যোগাযোগ করে দেয় সমীরের সঙ্গে। সমীর প্রসঙ্গে লিয়াকতের মুদ্রিত মন্তব্য :

সমীর ব্যক্তিগতভাবে আমার খুব পরিচিত। গানবাজনার জগতে বেশীদিন আসেনি। গানটা গায় মোটামুটি ভাল। কিন্তু নাচটা ওর একেবারে বাউল নাচ নয়।… পরের বছরই সমীর বিদেশ চলে গেল। অভাবিত এই ঘটনা ওর জীবনে দারুণ প্রভাব ফেলে। প্রচণ্ড শ্রমে আগের থেকে গলাটিকে তো ভাল করেই, নাচটিকেও মোটামুটি ঠিক করে নেয়। ওকে পছন্দের কারণ হিসাবে রাণ্ডি নিকলসন যা বলে তা আরো অদ্ভুত। ছেলেমেয়ে বাবা ভাই কেউ বাউল নয়, পরিবারটাও সাবেকি মধ্যবিত্ত, আর পাঁচটা পরিবারের মতো। শুধু সমীর বাউল। বাউল পরিবারের ট্রাডিশনাল বাউলের চেয়ে নাকি এ রকম বাউলই তার কাছে কৌতুহলজনক। তাই সমীরকে তার পছন্দ।

রান্ডির পছন্দসই সমীর তো বিদেশ পৌছল এবং আসরে আসরে পরিবেশন করল বাংলার নিজস্ব লোকায়ত বাউল গান। এবারে শোনা যাক তার কনফেশন :

অনেকে বিদ্রূপ করে আমাকে বলে, আমি বাউলের ছেলে নই, উটকো এসে জুটেছি।… কথাটা ঠিকই। কখনো বলি না আমি বাউল। কিন্তু যারা বাউল তাদের মধ্যে এমনও আছে, তারা কি তুচ্ছ ও উদ্ভট জীব স্বপ্নেও তা ভাবতে পারবেন না। ইউরোপে গেছি, আছি এক জায়গায়, আমাদের দেশের একটা কালচারকে তুলে ধরছি। ভাবতে পারেন এমনই বাউল আমরা, একজনের গান চলাকালীন আমরা তার অন্য সহযোগীরা বাজনা গোলমাল করে দিচ্ছি।… আমি এতে ভীষণ হতাশ হয়ে যাই এবং এত মানসিক যন্ত্রণা অনুভব করি যে ফ্রান্সে কোপেনহেগেনে নির্ধারিত প্রোগ্রাম বাতিল করে দেশে ফিরে চলে আসি। তাহলে বুঝুন, এরাই বাউল।

সমীরের আত্মবিবৃতিতে অনেক ভাজ আছে, যার দ্যোতনা বহুমাত্রিক। যেমন তাঁর একটা বৈদেশিক অভিজ্ঞতা এইরকম :

একবার গান করছি। প্রোগ্রাম শেষ। হঠাৎ দেখি সঙ্গীরা কেউ নেই। আমি একা পাশেই লেক। ওদের খুঁজতে সেদিকে গিয়ে দেখি, গুচ্ছের মেয়ে, সব টিনএজার। ওদের দেখতে পেয়ে আমার সঙ্গী একজন বলল, ‘ওরে সমীর আয় আয়, শালা দেশে আর ফিরে যাব না।’ ওরা এমন হতেই পারে, ওদের ওটাই জীবন, কিন্তু আমরা বাউলরা, আমরা আমাদের মতো কই? একী হলাম, একী তুলে ধরছি— এখন বল, ইউরোপ ভাসবে না আমরাই ভেসে যাব?

সমীরের কনফেশনে এক ধরনের মধ্যবিত্ত মূল্যবোধ কাজ করছে। এখনকার সুযোগসন্ধানী অশিক্ষিত যৌনকাতর বাউলযুবাদের সঙ্গে বিদেশে সে নিজেকে, নিজের বিবেক ও কাণ্ডজ্ঞানকে মেলাতে পারেনি তার কারণ তার একটা সংস্কৃতিগত বোধ আছে, খানিকটা শিক্ষা আছে। এইখানটায় একটা বড় তফাত গড়ে উঠেছে। গানের কণ্ঠটি ভাল, পরিবেশনভঙ্গি সপ্রতিভ এবং বোলচাল কায়দা কানুনে অভ্যস্ত হতে পারলে এখন খুব সহজে একজন বিশ-পঁচিশ বছরের নিম্নবর্গসম্ভত যুবক বাউল গানের মঞ্চে উঠে পড়ছে। ধীরে ধীরে পরিচিতি ঘটছে আসরে আসরে, ডাক আসছে এখানে ওখানে। মন্দমতি কম বয়সি হুল্লোরবাজ শ্রোতারা তাকে হুকুম করছে যৌনইঙ্গিতপূর্ণ হালকা গান গাইতে। শিক্ষা নেই, বোধ নেই, রুচি নেই, পরম্পরা নেই— লক্ষ্য কেবল অন্যকে দাবিয়ে এগিয়ে যাওয়া, গানের আসরে আগে-ওঠার তদ্বির। এদের চাপে আর দাপটে সব আসরে দেখেছি কুঁকড়ে থাকে একদল নিরীহ গায়ক, বসে থাকে একটেরে। যখন গাইবার ডাক আসে তখন কেমন যেন ঘাবড়ে যায়। দীক্ষিত বাউল তো হঠাৎ মঞ্চে উঠে জনমনোরঞ্জনী গান গাইতে পারে না, তার একটা শিক্ষাক্রম আছে, গুরুর বাচনিক নির্দেশিকা। তাই গুরুবন্দনা দিয়ে তার গান সূচনার রীতি মানতে হয়, পরে একটা তত্ত্বের পথে এগোতে হয়। বেশির ভাগ গানের মঞ্চ তো আসলে বিনোদনমূলক ও তাৎক্ষণিক উত্তেজনার আকর, তাই আসর মাত করে কণ্ঠকেরামতি ও বাজনাসর্বস্ব গায়কের দল। তারাই জনপ্রিয়।

তাদের বেশ কিছু টেকনিক বা কায়দাকৌশল আছে। প্রচুর গাঁজা টানে আর শিবনেত্র হয়ে কথা বলে। প্রচারের দিকটা সবচেয়ে খেয়াল রাখে। এমন কেন করে? বুঝতে অসুবিধে নেই যে এটা তাদের জীবন নয়, জীবিকা— এবং জীবিকার কঠিন পথে হাঁটতে হলে, টিকতে হলে, নিজেকে আলাদাভাবে তুলে ধরতে হবেই। হতে হবে বিশিষ্ট— তার গানের ও গায়নের মান যেমনই হোক, কালক্রমে সে হয়ে উঠতে চায় পরীক্ষিৎ বালা, সনজিৎ মণ্ডলের মতো সফল ক্যাসেটশিল্পী। তাদের মডেল পূর্ণদাস বা গোষ্ঠগোপাল। মেলা মহোৎসবে যখন সে যায় তখন টাকা দিয়ে ভাড়া করে একজন দক্ষ ক্যাসিওবাদককে ও তালবাদ্যকারীকে। প্রথমে তারা দশ মিনিট ধরে বাজনা-গানের উত্তেজনাকর পরিবেশ তৈরি করে, তারপরে অবতীর্ণ হয় নবীন গায়ক। এসব দেখেশুনে রাধাময় দাস একটা গান বেঁধেছেন, সেটা এইরকম :

দেশ ভরেছে বাবু বাউলে

তারা জামা জোড়া পরছে এখন

ডোর কৌপীন খুলে ফেলে—

দ্যাখো বাবু বাউলে।

কোথায় গেল সে আংরাখা

কোথায় গেল মালা

কোথায় গেল পায়ের নূপুর

কোথায় গেল ঝোলা।

তারা ঘুরছে এখন পার্কে লেকে

রেডিও নিয়ে বগলে।

বটের বাউল কোথায় পাব

বট ভেঙেছে ঝড়ে

সাধনা নাই শখে সবাই

বেতারে গান করে।

রাধাময় কয় যা আছে তা

ক্যামনে রাখি আগুলে।

শেষ পঙ্‌ক্তির আর্তিটুকু সত্য ও মর্মন্তুদ— যা আছে, এখনও যা আছে, তা কেমন করে আগলে রাখা যাবে?

আসলে তো জীবনচর্যাটাই বদলে গেছে চলে গেছে— ধ্যান ও অন্তর্বীক্ষণের গভীর নির্জন প্রহর। রাধাময় দাসদের মতো বিচিত্র সাধকদের সন্ধান কে আর দেবে? তাই তার কথা একটু বলি।

বর্ধমানের অন্তর্গত খাসপুরে রশীদ ডাক্তারের যে পুত্রসন্তান জন্মায় ১৯৩০ সালে তার নাম রাখা হয় কাজী নুরুল ইসলাম। বীরভূমের খুজুটিপাড়ায় কাটে নুরুলের ছাত্রজীবন। পরে কবি কুমুদরঞ্জন মল্লিকের সান্নিধ্যে জেগে ওঠে সৃজন প্রতিভা নিজের লেখক নাম নেন কুমুদকিঙ্কর। তারপরে বর্ধমান শহরে সংক্ষিপ্ত বসবাসকালে তিনি জড়িয়ে পড়েন সুভাষপন্থী রাজনীতিতে—পরে তাতে বীতশ্রদ্ধ হয়ে চলে আসেন সেই পুরনো খুজুটিপাড়ায়। সেখানে আলাপ ও ভাবসম্পর্ক গড়ে ওঠে সেখানকার সরকারি হাসপাতালের নার্স আশালতার সঙ্গে। এই আশালতা একজন ব্রাহ্মণকন্যা। বীরভূমের কুণ্ডলা গ্রামের তারকনাথ মুখোপাধ্যায় তার পিতা। বিয়ে হয় সিউড়ির ধ্বজাধারী চট্টরাজের সঙ্গে। আঠারো বছর বয়সেই ঘটে আশালতার বৈধব্য এবং সেইসঙ্গে পিতৃবিয়োগ। এরপরে সেবিকাবৃত্তি ও খুজুটিপাড়ায় নুরুলের সঙ্গে প্রণয়। ইত্যবসরে নুরুল ইসলাম পেয়ে গেছেন ভাব-জগতের দিশা। তাই সংসার, সমাজ ও ধর্মের বন্ধন কাটিয়ে মুর্শিদাবাদের রাধার ঘাটে নিতাই খ্যাপার কাছে তার আশ্রমে নেন মন্ত্ৰীক্ষা ও সন্ন্যাস। নুরুল ইসলামের নতুন নাম হয় রাধাময় গোস্বামী। আশালতাকে ধর্ম ও সাধনসঙ্গিনী করে কেন্দুলিতে আশ্রম গড়েন রাধাময়। ১৯৮৯ সালে সেখানেই তার প্রয়াণ ঘটেছে। এমন বিচিত্র জীবনকাহিনি কত যে আমার সংগ্রহে আছে!

যেমন ধরা যাক, মাস কয়েক আগে হঠাৎ লোকমুখে খবর পেলাম বলহরি দাস দেহ রেখেছেন। এতবড় এই দেশে এটা কী আর এমন খবর? কিন্তু আমার কাছে অনেকটাই। বছর তিনেক আগে উত্তরবঙ্গের রায়গঞ্জের অন্তর্গত সুভাষগঞ্জে তরণীসেন মহান্ত-র আস্তানায় বলহরিকে প্রথম দেখি। তখনই বেশ বৃদ্ধ।

বলহরিকে যখন দেখি তখন তিনি আশি ছুঁই ছুঁই বয়সের। ধবধবে ফরসা পাঞ্জাবি ও ধুতি-লুঙ্গি পরনে। গলায় একগাদা মালা— স্ফটিক-প্রবাল-পদ্মবীজ ও রুদ্রাক্ষের। সুদর্শন, চমৎকার নম্ৰ কণ্ঠস্বর। মানুষটি রসিক। বললেন, ‘কারুর নাম বলহরি শুনেছেন? আসলে বাবা-মা জন্মকালেই আমার স্বরূপ তত্ত্ব বুঝে খরচের খাতায় নাম তুলে দিয়েছিলেন। নইলে শ্মশানযাত্রায় যে বুককাপানো হুংকার তোলে মানুষ সেই বলহরি নাম দেবেন কেন? তা আমিও হয়ে গেলাম জ্যান্তে-মরা অর্থাৎ বাউল। কিন্তু সে তো অনেক পরে, যৌবন পেরিয়ে… তার আগে খুব মজার লাইফ আমার।’

বলহরি দাসের ‘লাইফ’ জানার আগে এটা কবুল করা দরকার যে, বীরভূম-বাঁকুড়া-মুর্শিদাবাদ-বর্ধমানে যেসব গেরুয়াধারী বাউল দেখি বলহরি সে-গোত্রের নন। তার বহির্বাস শ্বেতশুভ্র, কারণ তিনি উত্তরবঙ্গের বাউল। উত্তরবঙ্গের বাউল কথাটা স্বরিরোধী কারণ ওই অঞ্চলে স্বাধীনতার আগে এবং বেশ কিছুকাল পরেও কোনও বাউল-ট্রাডিশন ছিল না। জলপাইগুড়ি, রায়গঞ্জ, কোচবিহার, মালদহ, পশ্চিম দিনাজপুর, শিলিগুড়ি, দার্জিলিং এসব জায়গায় বাউল আখড়া, বাউল গান, বাউল সাধনা খুঁজে পাওয়া কঠিন। অঞ্চলের জনবিন্যাসে মিশ্র সংস্কৃতির ভূমিপুত্রদের সঙ্গে মিশে আছে ওপার বাংলার উদ্বাস্তুরা— তাদের জীবনে বাউল সংস্কৃতি তেমন ছিল না, যদিও লালন সমকালে অর্থাৎ দুশো বছর বা তার আগে কুষ্টিয়া-পাবনা-রাজশাহী-রংপুর ধরে বাউলদের একটা ধারা ছিল। কিন্তু মৌলবাদী আলেম মুসলমানরা এ অঞ্চলে বাউলখেদা আন্দোলনে দুর্বার ছিল। হয়তো সেই কারণে আত্মগোপনকারী বাউলরা ছড়িয়ে গেছে নানাদিকে।

দেশত্যাগী যেসব বাউল এখন উত্তরবঙ্গে বা বিশেষ করে পশ্চিম দিনাজপুরে বেশ নাম করা তাদের কয়েকজনের নাম ও জন্মস্থানের পরিচয় দিলে বোঝা যাবে ওই অঞ্চলের বাউলদের পরিচয়। বলহরি দাসের জন্ম রাজশাহীর নওগাঁ মহকুমার মান্দা থানার ঘাটকৈর গ্রামে। নৃপেন্দ্রনাথ বা খেড় ঘোষ জন্মেছেন নওগাঁ মহকুমার বদলগাছি থানার রথপাড়া গ্রামে, তরণীসেন মহান্ত-র জন্ম পাবনা জেলার অষ্ট মুনিষাগ্রামে, গোবিন্দদাসের জন্ম বগুড়া জেলায় গোবিন্দপুর গ্রামে, বিনয় মহন্ত জন্মেছেন উত্তর করিঞ্জির মাকৈল গ্রামে, ধীরেন মোহন্ত জন্মেছেন রংপুর জেলার বদরগঞ্জে। এঁরা এবং এঁদের মতোই বেশ কিছু উদ্বাস্তু মানুষ গত এক দুই দশকে গড়ে তুলেছেন উত্তরবঙ্গের বাউলসমাজ। এঁদের একটা বড় বাৎসরিক সমাবেশ (সূচনা ১৯৮৯) হয় রায়গঞ্জের সুভাষগঞ্জে ১লা বৈশাখ তারিখে প্রধানত তরণীসেন মহান্তর উদ্‌যোগে। পশ্চিমবঙ্গ সরকার সেখানে একটা স্থায়ীমঞ্চ গড়ে দিয়েছেন। বলহরি সেই মঞ্চের ভেতরদিকে একটা প্রকোষ্ঠে বসে কথা বলছিলেন। তার কথা বলবার আগে জানা দরকার যে উত্তরবঙ্গের বাউলরা সংযত স্বভাবের ভক্তপ্রাণ ব্যক্তি। কেউই গেরুয়া পরেন না, সকলেই শুভ্রতার অনুরাগী। মাথায় চুড়া করে ধম্মিল্ল বাঁধেন না, নৃত্যের পরম্পরা নেই বলা যায়। এঁরা প্রধানত সংসারী ও শান্ত। গানের চটকের চেয়ে গানের তত্ত্ব বিষয়ে বেশি আগ্রহী, তাই আসরে প্রশ্নোত্তরমূলক (যেমন ‘গুরু-শিষ্য,’ ‘শরিয়ত-মারফত’, ‘ভক্ত-ভগবান’) গানের পাল্লাদারি খুব জনপ্রিয়। এঁরা কেউ বিদেশ যাননি বা সাহেব মেমদের পাল্লায় পড়েননি। বাড়ি গাড়ির বা প্যান্ট শার্টের দেখনদারি নেই। হাতে বড়জোর একটা হাতঘড়ি। এবারে শোনা যাক বলহরি-বৃত্তান্ত।

১৩২০ বাংলা সনের ১৩ই পৌষ জন্মেছিলেন বলহরি ঘাটকৈর গ্রামে। বাবা শ্রীকান্ত দাস, মা শরৎসুন্দরী। ছোটবেলা থেকে গানপাগল আর মিষ্টিগলা। তবে শৈশবেই পিতৃহারা, তাই মাতৃস্নেহে পালিত। মায়ের সঙ্গে সর্বদা মেয়ে সেজে থাকতেন এবং তার ফলে স্বভাবে আচরণে মেয়েলিপনা এসে যায়। নারীসাজ তাঁর এত স্বাভাবিক ও নিখুঁত ছিল যে একবার জমিদার নরেন্দ্রনাথ সাহাচৌধুরীর সঙ্গে কলকাতা ভ্রমণে এলে পুরুষরা ট্রামে তাঁকে লেডিজ সিট ছেড়ে দেন।

বলহরি বললেন, ‘মেয়ে সেজে থাকতাম, গান গাইতাম, তাই যাত্রাদলে ডাক এল— একচেটিয়া ফিমেল পার্ট— খুব লোকপ্রিয় ছিলাম। দেশভাগের বছরে পাবনা জেলার সুজানগর থানার শ্যামগঞ্জের হাটে আমাকে নিয়ে তো রায়ট বাধার জোগাড়। হাটে বছিরুদ্দিন মিঞা নামে এক ধনী মুসলিম আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে বলল, “হিন্দুরা সব চলে যাচ্ছে, আমি এ মেয়েডারে ছাড়ুম না।” যাকে বলে “বলপূর্বক নারীহরণ” বুঝলেন? তারপরে চারদিকে রটে গেল, সাগরকান্দী থানায় খবর গেল হাট থেকে হিন্দুরমণী নিয়ে যাচ্ছে বছির মিঞা। পুলিশ এসে বন্দুকে ফাঁকা আওয়াজ তুলে লোকজন সরিয়ে ঘিরে ধরে। ব্যাপার দেখে সাগরকান্দীর ননী পোদ্দার হেসে বলে, “আরে বছির তুই কাকে নিয়েছিস? এ তো আমাদের বলহরি— ঐ যে গান গায়।” আমি কিন্তু রা কাড়িনি বুঝলেন, ভাবছিলাম দেখা যাক রগড় কদ্দুর গড়ায়।’ বলহরি একটু থেমে রসান দিয়ে বললেন, ‘এ ঘটনার আগে আমি আরেকবার অপহৃত হই। সেবার সরাসরি যাত্রার আসর থেকে আয়ুব খানের খানসেনা আমাকে সখীর সাজপরা অবস্থায় ধরে তাদের ব্যারাকে নিয়ে গিয়ে তোলে। তারপরে বুঝতেই পারছেন, ব্যাটাদের সেকি আফশোস।’

এমন আদ্যন্ত রসিক মানুষটি কিন্তু শেষ পর্যন্ত হয়ে গেলেন বৈরাগ্যপন্থী। ঘর সংসার করেননি। লালন শাহর প্রশিষ্য মহম্মদ কুতুব আলির কাছে বলহরি নেন তত্ত্ব জ্ঞানের দীক্ষা শিক্ষা। তবে কায়াসাধন করেননি। গানে গানে মাতিয়ে দিয়ে গেছেন দুই বাংলা অর্থাৎ সীমান্তের এপার আর ওপারের উত্তরবঙ্গ। না, ফরাক্কার এপারে অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গের গাঙ্গেয় সমভূমি তার বিচরণস্থল ছিল না। পশ্চিম ও পূর্ব দিনাজপুরে ছিল এবং এখনও আছে অনেক শিষ্য, প্রধানত গানের। সীমান্তে তার ছাড়পত্র লাগত না। গানের সুরের আসন পেতেছিলেন ভক্তদের প্রাণে। এ অঞ্চলের সকল গায়ক তাকে ‘বাউল সম্রাট’ শিরোপা দিয়েছিল। ছিলেন তত্ত্বজ্ঞানী ও রসিক। আশি ছুঁই ছুঁই বয়সে, আমার অনুরোধে, বলহরি একহাতে একতারা নিয়ে কোমরে আরেক হাত রেখে যে-আশ্চর্য নাচ নেচেছিলেন লালনের গানের সঙ্গে, তাতে একটা অন্য নাচের ঘরানার ছাপ ছিল। তাঁর মৃত্যুতে নিঃসন্দেহে উত্তরবাংলার বাউল গানের পরিমণ্ডল বিষণ্ণ ও কিছুটা রিক্ত হয়ে গেছে।

বলহরি ছিলেন জন্মসূত্রে নিম্নবর্গের নমঃশূদ্র। একথা ভাবতে গিয়ে মনে পড়ল যে এখনকার পশ্চিমবঙ্গের যত গায়ক বা গায়িকা বাউল গান গেয়ে বেঁচে আছেন ও সংসার চালাচ্ছেন তাদের একটা বড় অংশ নিম্নবর্গ থেকে আসা। ভদ্ররকম জীবিকা জোটেনি তাদের— কায়িক শ্রমে আছে কুণ্ঠা বা আলস্য। অগত্যা বাউলের আসর তাঁদের দিশা দিয়েছে। বেশি গান হয়তো সঞ্চয়ে নেই, নেই তেমন গানের শিক্ষা, কিন্তু আছে উদ্যম ও মরিয়া লড়াই।

অন্য সব পথ বা জীবিকা ছেড়ে কেন যে এরা বাউলের মার্গে আসে তার কারণ এক একজনের কাছে এক এক রকম, তবে অনেকে আসে গানের নেশায়। যেমন ধরা যাক কার্তিকের কথা। মাঠে চাষ করা, মাছ-ধরা, মুনিশ-খাটা এক শ্রমজীবী ঘরের ছেলে সে, হঠাৎ কীভাবে খমক, খঞ্জনি, একতারা, ডুবকি আর দোতারার সুর তাকে উদ্‌ভ্রান্ত করেছিল কে জানে। তার আড়ষ্ট হাতের খমক বাজনা আর অপটু গলার গান শুনে তবু তাকে ভরসা দিয়েছিল বন্ধুরা, বাড়ির লোকজন— ভাইবোন, বাবা-মা। শেষমেশ বাগদি ঘরের কার্তিক হয়ে গেছে বাউল। মাধবদাস বাউলের কাছে দীক্ষা— বাউল পথের আর বাউল গানের। কিন্তু গুরুর সঙ্গে আড়াআড়ি ঘটে গেল। কারণ গুরুর আশ্রমে আশ্রিত একটি মেয়ের সঙ্গে তার প্রণয়। দুজনে একসঙ্গে পালাতে গিয়ে ধরা পড়ে গেল গুরুর কাছে। গুরু তাকে তাড়িয়ে দিলেন। আশ্রমচ্যুত, নিরাশ্রয়, অন্ন নেই— সে এক কঠিন সময় গেছে কার্তিকের। এদিকে দুর্জয় মনের টান দুজনের— আসঙ্গ পিপাসা। অদম্য সেই টানে আবার যোগাযোগ, আবার পলায়ন। এবার দুজনকে আশ্রয় দিলেন জীবন গোঁসাই। তাঁর কাছে হল বাউল মতে কায়া সাধনার শিক্ষা। মেয়েটি হল সাধনসঙ্গিনী।

কাহিনিটি যত সরলরৈখিক, জীবন তত বক্র। কাজেই কার্তিকের কঠিন আত্মসংকটের দিনগুলো পেরোনোর কথা এ-আখ্যানে উহ্য থাকল। দুজনের দুখের কুটির, দিন গুজরান, মাধুকরী, গান গেয়ে গেয়ে গলা চিরে যাওয়া, সাধনসঙ্গিনীর ভিক্ষাবৃত্তি, আবার সন্তান পালন ও ক্ষুন্নিবৃত্তি— এমনতর দিনযাপন গড়পড়তা বাংলার বাউলের জীবনে নির্মম সত্য। এর কোথাও বিদেশভ্রমণ, ডলার উপার্জন, লালসা কিংবা ভোগবাদের স্পর্শমাত্র নেই। অথচ এরাই এখনকার বাউলের গরিষ্ঠ অংশ। মেলা মচ্ছবে এরাই সকল অতিথিকে সেবা দেয়, শুশ্রুষা দেয়, ভালবাসে। জন্ম এদের প্রধানত হীন বা অচ্ছুৎ বংশে— হাড়ি, ডোম, বাগদি, দুলে বা রাজবংশী এরা, অনেকে ‘অর্জল’ পর্যায়ের মুসলমান অর্থাৎ নিকিরি বা জোলা বা নলুয়া— শরিয়তি খানদানে তারা অস্পৃশ্য— বেশরিফ।

এমনই একজন অন্তেবাসী বাউল আমাকে সমাদর করে চিঠি লিখে নেমন্তন্ন করেছিল জয়দেব কেঁদুলির মেলায়। পরে সেই বেণীমাধব দাস আর তার ‘ফকির বাউল আখড়া’য় আমি অনেক ভদ্রসন্তানকে নিঃসংকোচে নিয়ে গেছি। আখড়ার মধ্যমণি হয়ে একটা বড় কাঠের ধুনি জ্বালিয়ে বসে আছে বেণীমাধব। প্রসন্ন চোখমুখ, সেবাপরায়ণ মন, কৃষ্ণকান্ত দেহ। আখড়ায় যে আসছে, একটানা গান শুনছে, ঘড়ি ঘড়ি হাতে এসে যাচ্ছে ধূমায়িত চা। পরে সকলেই পাবে অন্নসেবা— অবশ্য মাটিতে বসে, সকলে সবজাতিবর্ণ মিলে সেই সেবা— অজস্র স্বেচ্ছাব্রতী কর্মী নিরলস খেটে যাচ্ছে পরিবেশন ও রান্নার কাজে। অথচ বেণীমাধব তো কোনও সম্ভ্রান্ত মহান্ত নয়— চেয়েচিন্তে ধারকর্জ করে সে চাল ডাল গুড় সবজি এনেছে। আখড়ার মধ্যে ছোট ছোট খুপরি করে আয়োজন করেছে অতিথিদের বিশ্রামের, মেয়েদের আব্রুর। তার ছেলেবেলার স্মৃতি বলতে গ্রাম-নদী-দারিদ্র্য। ছাড়াছাড়াভাবে লেখাপড়া শিখে তৃতীয় শ্রেণিতে উঠে ইস্তফা, তার মধ্যেই আটবার স্কুল বদল— এ-আত্মীয় ও-আত্মীয় বাড়ির কৃপায় যেটুকু যেমন আশ্রয় জুটেছিল। তারপরে দরিদ্র সংসারে অবশ্যম্ভাবী শিশুশ্রমিকের হরেক বৃত্তি নেওয়া— চায়ের দোকানে বয়, সবজি বিক্রি, সাইকেল সারাই, হকারি। মাঝে মাঝে বাবার সঙ্গে পায়ে হেঁটে আশপাশের গ্রামে ভিক্ষাবৃত্তি। পরে একা একা, খঞ্জনি বাজিয়ে।

এবারে বেণীমাধব হিসেব করে দেখল গাঁয়ে গাঁয়ে পায়ে হেঁটে ‘হরে কৃষ্ণ হরে রাম’ নামগান শোনালে গেরস্থরা তেমন একটা উপুড়হস্ত করে না, তাই অন্য গান চাই, অন্তত রোজগার বাড়াতে গেলে। গান তো অনেকই জানা ছিল তার কিন্তু যন্ত্র? যন্ত্র কেনার পয়সা কই? থাকার মধ্যে ওই সেই সাবেক খঞ্জনি জোড়া। হঠাৎ একজন একটা গুপিযন্ত্র হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল বাজাতে। মজার কথা হল যে দিল যন্ত্রটা সে নিজে সেটা বাজাতে জানত না। বেণীমাধব কিন্তু স্বল্পায়াসেই বাজাতে পারল। আর তাকে দেখে কে?

এভাবেই বেণীমাধব হয়ে গেল বাউল গানের গায়ক। তার বংশে প্রথম একজন গানের এই নতুন জীবিকাধারী হয়ে উঠল। তারপরে একদিন একজন প্রবীণ বাউল বেণীকে নিয়ে গেল ‘নিরাময়’ নামের যক্ষ্মা হাসপাতালে। ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে রুগি আর নার্সদের গান শোনানো, সে এক অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতা। অনেক পয়সা হত কিন্তু ভাগের সময় দেখা যেত কম। কী ব্যাপার? সেই বুড়ো বাউল থলির মুখটা নিচু করে পয়সা নিয়ে নিত অদ্ভুত কায়দায়। সন্দেহ হত কিন্তু বেণী ভয়ে কিছু বলতে পারত না, যদি সে তাকে সব জায়গায় না নিয়ে যায়। বেণীকে কে আর চেনে? কেই বা গাইতে দেবে? একদিন রাগে দুঃখে শূন্য থলেতে হাত পুরে বেণী টের পায় থলের মধ্যে আটটা খোপ, তার চারটেয় এমন কৌশল যে উপুড় করলেও পয়সা পড়বে না। প্রবঞ্চিত বেণী খেপে উঠে চেঁচায়, লোকটা ধরা পড়ে রেগে যায়। তাকে মারে লাথি চড় ঘুসি। জীবনে বলতে গেলে এই প্রথম বাইরের লোকের হাতে মার খাওয়া। খুব কান্না কাঁদল বেণীমাধব। অভিজ্ঞতা এমন করেই তাকে বড় করে তুলল দিনে দিনে। কিন্তু যাবে কোথায় সে? একা একা তো সর্বত্র গান করার সুযোগ ঘটে না, দলে থাকতে হবে। কোনও একটা বাউলের দলে।

কিন্তু সে সময়ে অর্থাৎ বেণীমাধবের কৈশোরে এত তো বাউলের দল ছিল না, ছিল না তার এখনকার মতো জনাদর। বীরভূমে তার চেনা পরিধির মধ্যে ছিল মাত্র দুটো দল। একটা নবনীদাসের আরেকটা স্থানীয় পঞ্চরত্নের দল। তাতে সদস্য ছিল গঙ্গাধর দাস, নারায়ণ দাস এরা। গানটা বেণী ভালই গাইত। গঙ্গাধরের মনে ধরে গেল, তাকে নিয়ে নিল দলে। পারিশ্রমিক একরাতে দু’ টাকা। অনেকে গান শুনে ব্যক্তি-শিল্পীকে আলাদা পয়সা দিত, দলের নিয়ম ছিল সে পয়সা যার যার তার তার। কিন্তু বেণীকে তা দেওয়া হত না— অন্যেরা নিয়ে নিত। বঞ্চনা ও অত্যাচারের এতেই শেষ নয়। স্রেফ দলে টিকে থাকার জন্যে বড়দের তোয়াজ করা, ফাইফরমাশ খাটা বা গা-হাত-পা টিপে দেওয়া। তার অন্যথা হলেই মার। কেঁদে লাভ নেই, ক্ষোভ চেপে রাখতেই হবে। কারণ দলে তো কেউ তাকে ধরে রাখেনি। অথচ দলে তাকে থাকতেই হবে, নইলে তার নাম-যশ ছড়াবে কী করে? খ্যাতি ও প্রতিষ্ঠা লাভের দুর্দম খিদে তখন বেণীমাধবের। নিজের একটা আলাদা পরিচিতি চাই-ই চাই, অতএব চোখ বুজে শাসন শোষণ মেনে নিয়ে কেটে গেছে তার কৈশোর কাল।

তারপরে যৌবন সূচনাতেই তার সুনাম ছড়িয়ে গেছে, পঞ্চরত্ন দল ছেড়ে সে গড়ে তুলেছে বেণীমাধবের দল। স্বাধীন আর স্বয়ম্বশ। আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। এখন সে কেঁদুলি মেলার আখড়াধারী। অতিথি, দুঃস্থ, ক্ষুধার্ত ব্যক্তি এবং মান্যমানদেরও সে এখন সেবা দিতে পারে।

বাউলদের নিয়ে বা তাদের তত্ত্ব ও জীবনদর্শন নিয়ে যারা ইতিহাস ধরে জানতে চায় তাদের চোখে না পড়ে পারে না যে প্রথমদিকে বাউল ও ফকির এই দুই সাধনপন্থা বা আচার আচরণ ক্রিয়াকরণ বিষয়ে কোনও স্বতন্ত্র দৃষ্টিকোণ ছিল না। ১৮৪৬ সালে ইন্ডোলজি চর্চাকারী এইচ. এইচ. উইলসন সাহেব গৌণধর্মী সাধকদের বিবরণে বাউলদের কথা এনেছিলেন। অক্ষয়কুমার দত্ত ১৮৭০ ও ১৮৮৩ সালে লেখা তাঁর দুটি বইতে প্রায় উইলসনের ধারণার প্রতিধ্বনি করে গেছেন। বাউলদের ধর্মাচরণ ও জীবনযাপন সম্পর্কে এঁদের ধারণা ছিল কিছুটা ভ্রান্ত, অস্পষ্ট অথচ বিরুদ্ধ। ১৮৯৬ সালে ব্রাহ্মণ পণ্ডিত যোগেন্দ্রনাথ বিদ্যাভূষণ তো বাউলদের সম্পর্কে যথেচ্ছ কটুক্তি করেছেন। ১৮৯৮ সালে মৌলবি আবদুল ওয়ালি তাঁর একটি দীর্ঘ নিবন্ধে মুসলমান ফকির ও হিন্দু বৈরাগী বলে বিভাজন করেছেন— লালনকে (মৃত্যু ১৮৯০) তিনি ফকিরদের দলভুক্ত করেছেন। এঁদের লেখালেখির সমসময়ে নগেন্দ্রনাথ বসু তাঁর ‘বিশ্বকোষ’-এ ‘বাতুল’ থেকে ‘বাউল’ এমন মত প্রতিষ্ঠা করে মন্তব্য করেছেন।

বাতুলের ন্যায় এই সম্প্রদায়ের মানুষ লোকেরা ছিন্ন বস্ত্রখণ্ড সংযোজিত করিয়া পরিধান করিয়া থাকে। ভজনগীত কালে নৃত্য ও বেশভূষা নিরীক্ষণ করিলে ইহাদিগকে বাতুল বলিয়াই অনুমিত হয়। বাতুল হইতে ইহাদের বাউল নাম হইয়াছে।

এর মধ্যে মধ্যে লালন শাহ ফকিরের তিরোধান ঘটেছে এবং সারা মধ্যবঙ্গ জুড়ে তাঁর ব্যাপক অনুসারীদের খবর মিলছে হাজারে হাজারে। ১৮৯০ সালে তাঁর প্রয়াণ সংবাদসহ ৩১ অক্টোবর ‘হিতকরী’ পত্রিকা কুষ্টিয়া থেকে যে প্রতিবেদন-প্রবন্ধ প্রকাশ করে, তাতে লেখা হয়েছে:

তিনি ধৰ্ম্মজীবনে বিলক্ষণ উন্নত ছিলেন…নিজে লেখাপড়া জানিতেন না; কিন্তু তাঁহার রচিত অসংখ্য গান শুনিলে তাহাকে পরম পণ্ডিত বলিয়া বোধ হয়।…সকল ধৰ্ম্মের লোকই তাঁহাকে আপন বলিয়া জানিত।

এই প্রথম একজন মধ্যবিত্ত শিক্ষিত ভদ্রলোক লালনের জীবনপ্রণালী ও গান সম্পর্কে শিষ্ট এমনকী প্রশংসাযুক্ত উক্তি করলেন। দেখা যাচ্ছে ১৮৯০ সাল নাগাদ বাউল-ফকিররা ততটা অপাঙ্‌ক্তেয় নেই বা নিন্দাযোগ্য হয়নি। লালনের সমসময় এবং তিরোধানের পর মধ্যশিক্ষিত গ্রামবাসীশ্রেণি শখের বাউলের দল গড়ে এক ধরনের ভাবমূলক এবং নির্বেদচিন্তার গান গাইতে শুরু করেছিলেন। প্রধানত কাঙাল হরিনাথের রচিত ও অন্যান্যদের সেই গান কলকাতা ও ঢাকাতেও জনপ্রিয় হয়েছে। সেইসব ভাববহুল গানের ধাঁচে আকৃষ্ট হয়ে অনেক নগরবাসী ভদ্রলোক বাউল গান লিখতে থাকেন, যার সেরা নমুনা মেলে কবি বিহারীলালের ‘বাউল বিংশতি’-তে।

কিন্তু বাউলদের গান রচনা তাঁদের জীবনের একটা প্রকাশপিপাসু বাসনার সৃজন হলেও আসল সাধনা তাদের দেহতত্ত্বগত করণকৌশল, যা গোপ্য ও গুরুকেন্দ্রিক। সমাজের ধর্মধারণা ও আচরণের সাত্ত্বিক মূল স্রোতের প্রতিবাদী বা বিরুদ্ধবাদী এই সাধকরা এমন সব বিশ্বাসের কথা বলতে থাকলেন যা উচ্চবর্গের সমাজ ও ধর্মবোধকে প্রত্যক্ষভাবে আঘাত করতে লাগল। শ্রীরামকৃষ্ণ এই সাধনাকে স্পষ্ট ভাষায় নিন্দা করলেন। ব্রহ্মবাদী সম্প্রদায়ের ভাল লাগেনি এমন ইহকেন্দ্রিক দেহসর্বস্ব সাধনাকে। বিশেষত বাউল ফকিররা অনুমানবাদে মোটেই বিশ্বাসী ছিল না, পূর্ব ও পরজন্মে ছিল সন্দিহান, মন্দির মসজিদের ছিল বিরোধী।

ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়; বাউল ফকিরদের মতো অন্যান্য গৌণধর্মীদের, বৃহত্তর হিন্দুসমাজ উনিশ শতকে বৈশ তুচ্ছতাচ্ছিল্য ও নিন্দা করেই ক্ষান্ত হয়েছে— প্রত্যক্ষ সংগ্রামে নামেনি। এই প্রতিবাদ প্রতিরোধ ও বাউল উৎসাদনে নেমেছিল মুসলমান সমাজের কট্টর অংশ। শরিয়তি অনুশাসন থেকে বেরিয়ে এসে দলে দলে বহু সাধারণ অশিক্ষিত মুসলিম বাউল ফকির হতে থাকে। ওহাবী, ফরায়জি ও আহলে হাদিস আন্দোলন এবং সংরক্ষণশীল মুসলিম মানসের বিরুদ্ধাচরণে বাউলরা বিপন্ন হয়। তাদের ওপর দৈহিক অত্যাচার ও সামাজিক বয়কট চলতে থাকে। এ সবের বিশদ নমুনা পাওয়া যায় ১৯২৫ সালে প্রকাশিত ‘বাউল ধ্বংস ফৎওয়া’ বইতে। এই পক্ষের দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে উঠেছিল ইসলাম ত্যাগীদের দুরাচার— এবং অজ্ঞ গ্রামবাসী মুসলমান শ্রেণির মধ্যে তাদের দুর্বার অনুপ্রবেশের আশঙ্কা। ফৎওয়ায় বলা হয়েছিল:

মোছলমানের মধ্য হইতে একদল লোক বাহির হইয়াছে, যাহারা, ‘বাতেনী দোরবেশ ফকীর’ বলিয়া দাবী করে। উহাদের প্রকাশ্য নাম ‘বাউল’ বা ‘ন্যাড়ার ফকীর’।

লক্ষণীয় যে ধর্মত্যাগীদের একই সঙ্গে বাউল ও ফকির বলা হয়েছে। পরবর্তীকালেও নানা রচনায় দেখা গেছে বাউল আর ফকিরদের সমার্থক বলে মনে করা হয়েছে। বাউলবিরোধী আন্দোলনের প্রধান লক্ষ্য লালন শাহ ফকির ও তার অনুসারী লালনপন্থীরা। ধর্মপ্রাণ শরিয়তনিষ্ঠ মুসলিম মানসে বাউলদের সম্পর্কে ঘৃণা ও বিদ্বেষ উৎপাদনের জন্য ফৎওয়ায় নানা অলীক অভিযোগ পেশ করা হয়েছিল। যেমন:

তাহারা মোছলমানের দোরবেশ, আলি, শাহ্‌, ফকিরের পরিচয়ে মোছলমান সমাজে মিলিয়া মিশিয়া, তাহাদের কন্যা ও ভগ্নিকে বিবাহ করতঃ গুপ্ত শক্তভাবে পর্দ্দায় থাকিয়া নানারূপে ছলে, বলে ও কৌশলপূৰ্ব্বক পবিত্র কোরআন ও এছলামকে ধ্বংস করার মানসে, বিষম থোকার জাল ফেলিয়া, মোছলমান সমাজকে জর্জ্জরিত ও মূর্খ মোছলমানকে ধর্ম্মভ্রষ্ট করিতেছে। আবার হিন্দুজাতির বৈরাগী সাজিয়া, কামাখ্যা, নবদ্বীপ, কাশী, বৃন্দাবন, কান্তজী প্রভৃতি হিন্দু তীর্থস্থানে তীর্থ ও দেবদেবীর পূজা করিয়াও থাকে।

এ-বিবরণ পড়লে বোঝা যায়, অভিযোগ মূলত ভেকধারীদের সম্পর্কে। একদিকে তারা দরবেশ-অলি-ফকির সেজে মুসলমান সমাজে ধ্বংসের বীজ পুঁতছে, আরেকদিকে হিন্দু বৈরাগী সেজে তীর্থ ও ভজনপূজন করছে। তার মানে এরা ঠিক ধর্মাচারী নয়— ভণ্ড, মেকি ও প্রতারক। কিন্তু অভিযোগ কেবল এইটুকু বা এত সামান্য নয়। বলা হয়েছে:

তাহারা হায়াজ নেফাজের রক্ত, বীৰ্য্য, মল, মূত্র, গর্ভপাত শিশুর মাংস, গাঁজা, ভাঙ্গ, মদ ইত্যাদি নাপাক জিনিস ভক্ষণে রিপুদমন করে। স্ত্রী যোনি ও অগ্নিকে ছেজদা করে। দলে দলে স্ত্রীপুরুষ একত্র উলঙ্গ হইয়া নাচিয়া গাহিয়া কাম-রিপু দমন হইয়াছে কিনা তাহার পরীক্ষা এবং তাহাতে যে বীর্যপাত হয়, তাহা ময়দার সহিত মিশাইয়া রুটি প্রস্তুত করতঃ ‘প্রেমভাজা’ নামক উপাদেয় (?) মারফতী খানা খায়। তাহারা পরস্পর পরস্পরের স্ত্রীকে ব্যবহার করিয়া হিংসা রিপু দমন করে ও স্ত্রী-পুরুষ মিলিত হইয়া খমক, খঞ্জরী, জুড়ি বাজাইয়া দেহ-তত্ত্ব ফকীরি গান করতঃ ভিক্ষা করিয়া বেড়ায়।

এতসব অভিযোগমালা পেশ করে এদের ধ্বংসের ফৎওয়া জারি করে কট্টরপন্থীরা বসে থাকেনি নিশ্চয়ই। বস্তুত ব্যাপকভাবে বাউলখ্যাদা আন্দোলন, শারীরিক নির্যাতন, গান-বাজনার প্রত্যক্ষ বিরোধিতা চলেছে এবং তার ফলে একদল বাউল ফকির নিবৃত্ত হয়েছে, একদল পালিয়েছে, আরেকদল আত্মগোপন করে ছড়িয়ে পড়েছে নানা গ্রামে। কিন্তু ইতিমধ্যে দেশের হাওয়া বদলেছে। প্রধানত কলকাতার ঠাকুর পরিবার তাঁদের শিলাইদহ-কুষ্টিয়া ও পাবনা-সাজাদপুরে জমিদার পরিচালনা সূত্রে প্রত্যক্ষ সংস্পর্শে আসেন ওই অঞ্চলের বাউলদের। তাদের ধর্মকর্ম বা আচরণবাদ নয়, ঠাকুৱরা আকৃষ্ট হন তাদের গানের ভাবে ও সুরে। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রনাথ ছিলেন বাউলদের সম্পর্কে অনুকম্পায়ী ও গুণগ্রাহী। লালন ও গগন হরকরার গানে তাঁরা বিমুগ্ধ হয়ে পড়েছিলেন। তাঁদের ভাগিনেয়ী সরলা দেবীও সংগ্রহ করেছিলেন অন্য অনেক বর্গের লোকায়ত গান। তাঁদের উদ্যমে তৈরি হতে থাকল বাউল গানের স্বরলিপি, তার লক্ষ্য নিশ্চয়ই প্রচার। ‘বীণাবাদিনী’ পত্রিকায় ইন্দিরা দেবীচৌধুরাণী লালনগীতির স্বরলিপি প্রকাশ করলেন। রবীন্দ্রনাথ ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় ছাপলেন মোট কুড়িটি লালনগীতি, কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়া আখড়া থেকে এনে, ১৩২২ সালের আশ্বিন থেকে মাঘ সংখ্যায়, চার কিস্তিতে। তার আগেই ১৩১৪ সালে ‘প্রবাসী’-তে প্রকাশিত রবীন্দ্রনাথের ‘গোরা’ উপন্যাসে লালনের একটি (‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি’) গান উদ্ধত হয়েছে, ‘জীবনস্মৃতি’-তে (১৩১৯) উল্লিখিত হয়েছে বাউল গানের মাহাত্ম ও অসামান্যতা।

একথা আজ সবাই মানেন যে, সম্ভবত রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে লালন শাহ-র দেখা সাক্ষাৎ হয়নি, কিন্তু লালন শিষ্যদের সঙ্গে তাঁর কথাবার্তা হত, বাউলপস্থা নিয়ে তার কৌতুহল ছিল, বাউল গানের সুর কাঠামো তাঁর সাংগীতিক মানসে স্থায়ী ছাপ রেখেছিল। ১৯২২ সালে শ্রীনিকেতনের কালীমোহন ঘোষকে এক চিঠিতে লিখেছিলেন,

তুমি তো দেখেছ শিলাইদহতে লালন শাহ ফকিরের শিষ্যগণের সহিত ঘণ্টার পর ঘণ্টা আমার কিরূপ আলাপ জমত। তারা গরীব। পোষাক-পরিচ্ছদ নাই। দেখলে বোঝবার জো নাই তারা কত মহৎ। কিন্তু কত গভীর বিষয় কত সহজভাবে তারা বলতে পারত।

একেই বলে দৃষ্টিভঙ্গির তফাত। উইলসন, অক্ষয়কুমার, যোগেন্দ্রনাথ, শ্রীরামকৃষ্ণ, নগেন্দ্রনাথ ও ‘বাউল ধ্বংস ফৎওয়া’র সংকলক রেয়াজউদ্দিন আহমদের বিরূপ ও বিদ্বিষ্ট মনোভাবের তুলনায় রবীন্দ্রনাথ কত মরমি ও অনুভূতিপ্রবণ। দরিদ্র বাউলদের মধ্যে তিনি খুঁজে পেয়েছিলেন মহত্ত্ব ও গভীরতা। লালনের গানের অনুলিপি সংগ্রহ করে এনে যত্ন করে পড়েছিলেন, সেই খাতা এখনও শান্তিনিকেতনে রক্ষিত আছে।

কিন্তু এখানেই শেষ নয়। ১৯২৫ সালে কলকাতার ভারতীয় দর্শন মহাসভায় রবীন্দ্রনাথ যে লিখিত ভাষণ পাঠ করেন তাতে বাউল দর্শনের এক ভাববাদী ব্যাখ্যা উপস্থাপিত হয়। তাঁর অনুভবে মনে হয়েছিল গ্রাম বাংলার নিরক্ষর গীতিকারের লেখা বাউল গানের তত্ত্ব আর প্রাচীন বৈদিক ঋষির রচনায় এক চমৎকার ভাবসাযুজ্য আছে আনন্দময়তায়। বাউলের রচনা আর শেলির কবিতায় তিনি পেয়েছিলেন একই সংরাগ যেন। পরে, রবীন্দ্রনাথের গানের সংগঠনে বাউল সুরকাঠামোর এমনকী কয়েকটি ক্ষেত্রে বাউল গানের ভাবাত্মক প্রকাশভঙ্গির নিজস্ব ভাষা স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। সন্দেহ নেই, বাংলার বাউলকে তিনি জাতে তুলেছেন এবং হয়তো খানিকটা আদর্শায়িত করে।

দেখতে দেখতে এমন দাঁড়াল যেন বাউল ও লালন সমার্থক। ব্যাপারটা চমৎকার বিশ্লেষণ করে বুঝিয়ে দিয়েছেন রমাকান্ত চক্রবর্তী। তাঁর মতে,

একথা জোর দিয়েই বলা যায় যে, জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির এবং বিশেষভাবে রবীন্দ্রনাথের অন্বেষণ এবং সুদৃঢ় পৃষ্ঠপোষকতা না থাকলে, মধ্যবঙ্গীয় বুদ্ধিজীবীদের প্রচার সত্ত্বেও, হিন্দু-পুনরুত্থানবাদের ধ্যানে তারকাচক্ষু বাঙ্গালি হিন্দু ভদ্রলোকেরা লালনকে দেখতেই পেতেন না। জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি থেকে উৎসারিত জোরাল প্রচার বাউল গানকে এবং লালনকে অমরত্ব দান করল।

শুধু লালন নয়, রবীন্দ্রনাথ পছন্দ করতেন গগনের গান, সাধক গোঁসাইগোপালকে এবং তাঁর কথাবার্তা হত সর্বক্ষেপী বোষ্টুমির সঙ্গে। এ সবই শিলাইদহ-কুষ্টিয়া পরিমণ্ডলের ব্যাপার। পরে ক্ষিতিমোহন সেনের প্ররোচনায় অন্য ধরনের কিছু বাউল গানের আস্বাদ পান এবং তা নিজের লেখায় নানাভাবে উদ্ধৃত করেন। হাসন রজার গানও তাঁর প্রিয় ছিল। বাংলার বাউল ও বাউল গান বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের কতকগুলি মন্তব্য বা ভাষ্য আমরা লক্ষ করতে পারি, তার থেকে বোঝা যাবে কেন তাঁর বাউল গানের প্রতি পক্ষপাত জন্মেছিল। পর্যায়ক্রমে তিনি লিখেছেন:

১. আমার অনেক গানেই আমি বাউলের সুর গ্রহণ করেছি এবং অনেক গানে অন্য রাগরাগিণীর সঙ্গে আমার জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে বাউল সুরের মিলন ঘটেছে। এর থেকে বোঝা যাবে বাউলের সুর ও বাণী কোন এক সময়ে আমার মনের মধ্যে সহজ হয়ে মিশে গেছে।

২. ‘অন্তরতর যদয়ামাত্মা’ উপনিষদের এই বাণী এদের মুখে যখন ’মনের মানুষ’ বলে শুনলুম, আমার মনে বড়ো বিস্ময় লেগেছিল। এর অনেককাল পরে ক্ষিতিমোহন সেন মহাশয়ের অমূল্য সঞ্চয়ের থেকে এমন বাউলের গান শুনেছি, ভাষার সরলতায়, ভাবের গভীরতায়, সুরের দরদে যার তুলনা মেলে না— তাতে যেমন জ্ঞানের তত্ত্ব তেমনি কাব্য রচনা, তেমনি ভক্তির রস মিশেছে। লোকসাহিত্যে এমন অপূর্বতা আর কোথাও পাওয়া যায় বলে বিশ্বাস করি না।

দুটি মন্তব্যেই বাউলের গানের ভাব-ভাষা-সুর ও সারল্যের মধ্যে গভীরতার কথা আছে, বাউলের জীবনাচরণ বা প্রতিবাদী চেতনার কথা নেই। উপনিষদীয় ভাবনার সঙ্গে তিনি ‘মনের মানুষ’ তত্ত্বের সমীকরণ করতে চেয়েছেন, যদিও ‘মনের মানুষ’ আসলে এক কায়াসাধনের কনসেপ্ট—তা কি তিনি জানতেন না? ক্ষিতিমোহনের সংগৃহীত গানে ভাষার সরলতা ও ভাবের গভীরতা না হয় বোঝা গেল কিন্তু তার ‘সুরের দরদ’ তিনি কীভাবে অনুসন্ধান করলেন? ওই গানের গায়নপদ্ধতি ও সুরকাঠামো কি ক্ষিতিবাবুর আয়ত্ত ছিল? তিনি কি্‌ বাউল গান গাইতেন? এমন খবর অন্তত আমাদের জানা নেই।

বাংলার বাউল গান বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের উচ্ছ্বাস ও আসক্তির কারণ অনুসন্ধানে রবীন্দ্রনাথের আরও দুটি মন্তব্য আমরা পরীক্ষা করতে পারি। তাতে দেখা যাবে এ-জাতীয় গানের অন্যতর সমাজ-তাৎপর্য তার চোখে পড়েছে অথচ বুঝেছেন তার একঘেয়েমিও। যেমন:

৩. আমাদের দেশে যারা নিজেদের শিক্ষিত বলেন তাঁরা প্রয়োজনের তাড়নায় হিন্দু-মুসলমানের মিলনের নানা কৌশল খুঁজে বেড়াচ্ছেন। অন্য দেশের ঐতিহাসিক স্কুলে তাঁদের শিক্ষা। কিন্তু, আমাদের দেশের ইতিহাস আজ পর্যন্ত, প্রয়োজনের মধ্যে নয়, পরন্তু মানুষের অন্তরতর গভীর সত্যের মধ্যে মিলনের সাধনাকে বহন করে এসেছে। বাউল-সাহিত্যে বাউল সম্প্রদায়ের এই সাধনা দেখি— এ জিনিস হিন্দু-মুসলমান উভয়েরই; একত্র হয়েছে অথচ কেউ কাউকে আঘাত করেনি। এই মিলনে সভাসমিতির প্রতিষ্ঠা হয়নি; এই মিলনে গান জেগেছে, সেই গানের ভাষা ও সুর অশিক্ষিত মাধুর্যে সরস। এই গানের ভাষায় ও সুরে হিন্দু-মুসলমানের কণ্ঠ মিলেছে, কোরান পুরাণে ঝগড়া বাধেনি।

৪. অধিকাংশ আধুনিক বাউল গানের অমূল্যতা চলে গেছে, তা চলতি হাটের সস্তাদামের জিনিস হয়ে পথে পথে বিকোচ্ছে। তা অনেক স্থলে বাঁধি বোলের পুনরাবৃত্তি এবং হাস্যকর উপমা তুলনার দ্বারা আকীর্ণ— তার অনেকগুলোই মৃত্যুভয়ের শাসনে মানুষকে বৈরাগীদলে টানবার প্রচারকগিরি।— এর উপায় নেই, খাটি জিনিসের পরিমাণ বেশি হওয়া অসম্ভব।…এইজন্যে সাধারণত যে-সব বাউলের গান যেখানে-সেখানে পাওয়া যায়, কী সাধনার কী সাহিত্যের দিক থেকে তার দাম বেশী নয়।

মন্তব্যগুলি নেওয়া হয়েছে ১৯২৭ সালে ‘হারামণি’র রবীন্দ্রলিখিত ভূমিকা থেকে। এসব মন্তব্যে তার বাউলগান সম্পর্কে প্রত্যাশা, প্রাপ্তি, উচ্ছ্বাস ও হতাশা সবই আছে। কিন্তু যেটা বিশেষ লক্ষণীয় তা হল, রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবনের শেষ দুটি দশকে বাউল গান সম্পর্কে উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছেন। লালনের কুড়িটি গান তিনি ১৯১৫ সালে ‘প্রবাসী’-তে মুদ্রণ করলেন অথচ পরে আর একটাও লালনগীতির প্রকাশে উদ্যম নিলেন না। তথ্যত দেখা যাচ্ছে, তাঁর কাছে লালনের গানের অন্তত তিনটি খাতা ছিল এবং তা যে তিনি সযত্নে পড়েছিলেন তার প্রমাণ রয়েছে তার স্বহস্তে লেখা পাঠশুদ্ধিতে। রমাকান্ত চক্রবর্তী সংগত প্রশ্ন তুলেছেন:

লালন-গীতাবলি রবীন্দ্রনাথ কেন প্রকাশ করলেন না? তার কারণ কি এই যে, লালনের গানের প্রযৌক্তিক শব্দের অর্থ জেনে তিনি আর তা ছাপাবার জন্য চেষ্টা করেননি? তার কারণ কি এই যে, কিছু কিছু উন্নত ‘ভাব’-এর অন্তরালে বাউলদের বিচিত্র যৌন-জীবন তার অজ্ঞাত ছিল না? তার কারণ কি এই যে, যে-‘চারিচন্দ্রভেদ’ বাউল সাধনার ভিত্তিস্বরূপ, তার বিবরণও তাঁর অজ্ঞাত ছিল না?

অবশ্য রমাকান্ত চক্রবর্তী প্রশ্ন তুলে ক্ষান্ত হননি, সিদ্ধান্তেও এসেছেন। তাঁর মনে হয়েছে,

একথা বলাই সঙ্গত যে, সমাজের ও ধর্মের যে অসামান্য গুরুত্ব উনিশ শতকের শেষের দিকে দেশাভিমানী বাঙ্গালি বুদ্ধিজীবিগণ অনুভব করেছেন, সেই অনুভবই দেশাভিমানী রবীন্দ্রনাথের বাউল-প্রেমে সর্বদা অভিব্যক্ত হয়েছিল। দেশী-সংস্কৃতির এই বিশেষ উপাদানকে রবীন্দ্রনাথ অবহেলা করতেন না।

এবারে একটু অন্যদিকে তাকানো যাক। ১৮৯০ সালে লালন শাহ প্রয়াত হন। তাঁর সঙ্গে জ্যোতিরিন্দ্রনাথের সাক্ষাৎ পরিচয় ছিল। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ শিলাইদহের বোটে প্রবৃদ্ধ লালনকে বসিয়ে পোর্ট্রেট এঁকেছিলেন। শোনা যায় সত্যেন্দ্রনাথের স্ত্রী জ্ঞানদানন্দিনী শুনেছিলেন লালনের কণ্ঠে গান। রবীন্দ্রনাথ এঁদের সূত্রেই লালন ও তাঁর গান প্রসঙ্গ শুনেছিলেন। ১৮৯০ সালের পর তিনি লালশিষ্যদের সংস্পর্শে আসেন এবং তাদের কাছে লালনের গানের নমুনা শোনেন এমন অনুমান অসংগত নয়। লালনের শিষ্যরা জমিদার রবীন্দ্রনাথের ওপর ভরসা রাখতেন, যার প্রমাণ রয়েছে লালনের শিষ্য মনিরুদ্দিন শাহ ফকিরের লেখা একটি আবেদনপত্রে। ‘মহামহিম মহিমার্ণব শ্রীযুক্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জমিদার মহাশয় সমীপেষু’ বলে সম্বোধন করে আবেদন করা হয়েছে তাদের গুরুর ছেঁউড়িয়া আশ্রমের ভগ্নদশা থেকে উদ্ধার করে তাকে পাকা ইমারতে পরিণত করবার। এসবই রবীন্দ্রনাথের বাউলপ্রেমের স্পষ্ট প্রমাণ। কিন্তু দেখা যাচ্ছে বিশ শতকের প্রথম দশকের পরে তিনি বাউল সম্পর্কে বেশ ভাবাত্মক মনোভঙ্গিতে গ্রস্ত হয়ে পড়েছেন, এর মূলে হয়তো ক্ষিতিমোহন সেনের সঙ্গ-সান্নিধ্য কিছুটা দায়ী। ক্ষিতিমোহন ১৯০৮ সালে শান্তিনিকেতনে যোগ দেন এবং রবীন্দ্র-সঙ্গে ছিলেন ১৯৪১ সাল পর্যন্ত একটানা। তিনি রবীন্দ্রনাথকে বাউল পরম্পরা বিষয়ে বহু তথ্য ও তত্ত্বজ্ঞানে সমৃদ্ধ করেন এবং গুরুদেবকে দেন বেশ ক’টি সংগৃহীত গান। সেই গানগুলি স্পষ্টতই লালনঘরানা বা কায়াবাণী বাউল পরম্পরার গান থেকে একেবারে আলাদা, কিছুটা সফিস্টিকেটেডও বটে। এই নতুন গানের ভাবে রসে রবীন্দ্রনাথ মজে যান। ক্ষিতিমোহন মধ্যযুগের সতসাধকদের সম্পর্কে একজন বিশেষজ্ঞ ছিলেন এবং ‘বাংলার বাউল’ নামে ১৯৪৯ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি ভাষণ দেন, পরে সেটি বই হয়ে বেরোয়। এ-বই থেকে আমরা পাই তাঁর এমত ভাষ্য যে,

গ্রন্থাশয়ী পণ্ডিতের দল ঠিক বাউলিয়া ভাব ও মর্ম ধরিতেও পারেন নাই এবং পরিচয়ও দিতে পারেন নাই। যাঁহারা নিগ্রন্থ তাঁহাদের পরিচয় গ্রন্থে কেমন করিয়া মিলিবে?

তিনি অবশ্য বাউল সাধনা সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করে গেছেন এই বলে যে,

ইহাদের দেহ-সাধনায় চারিচন্দ্রের ভেদ অতি গোপনীয় ব্যাপার এবং তাহা অতি বীভৎস। …চারিচন্দ্রের ভেদ হইল তন্ত্র ও যোগশাস্ত্রের দাসত্ব। তাহাতে অনুরাগ পথের কি আছে?

এইখানে আমরা একটা স্ববিরোধ না দেখে পারি না। বাউলদের দেহ সাধনা তাঁর মতে বীভৎস অথচ তাদের গান অত্যন্ত ভাবগভীর ও অন্তরস্পন্দী কি করে হতে পারে?

সম্প্রতি প্রণতি মুখোপাধ্যায় একটি জীবনীগ্রন্থ প্রকাশ করেছেন ক্ষিতিমোহন প্রসঙ্গে। তাতে মন্তব্য করেছেন: ‘ক্ষিতিমোহন তন্ত্র ও যোগশাস্ত্র মতে যে বাউলরা কায়াসাধন করেন তাঁদের চেয়ে উচ্চতর ভাবের বাউল সাধকদেরই পরিচয় তাঁর গ্রন্থে দিয়েছেন, রবীন্দ্রনাথও তাঁদেরই কথা বিশ্বজন সভায় জানিয়েছিলেন তাঁর অক্সফোর্ডের বক্তৃতায়।’

অক্সফোর্ডে রবীন্দ্রনাথ যে-হিবার্ট লেকচার দেন তাতে প্রধানত উদ্ধৃতি দেন ক্ষিতিমোহন প্রদত্ত বাউল গানের। সেইসব গানে কায়াবাদীদের চেয়ে উচ্চতর ভাবের বাউল সাধকদের কথা প্রণতি মুখোপাধ্যায় তুলেছেন, কিন্তু তাঁরা কারা? আমাদের চেনা বঙ্গদেশে কি তাঁরা কোনওদিন ছিলেন বা গান লিখেছিলেন? তাঁরা কোথায় চলে গেছেন? মহম্মদ মনসুরউদ্দিন, উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য এবং অন্যান্য বহুতর বাউলগান সংগ্রাহকদের চোখে সেসব গান ধরা পড়ল না কেন? কেন ক্ষিতিমোহন সংগৃহীত গানে আধুনিক হস্তাবলেপের আশঙ্কার প্রশ্ন উঠল? প্রণতি নিজেই জানিয়েছেন ক্ষিতিমোহন সম্পর্কে:

তাঁর দেওয়া তথ্য থেকে জানা যায় আর তিনি নিজে বাউলবাণী বার করেননি, যদিও তা সাজিয়ে লিখে রেখেছিলেন। প্রায় চল্লিশ বছর অর্থাৎ বলা চলে ১৯০৯-১৯১০ সাল থেকে এগুলি নিজের কাছেই রেখে নিজেই আলোচনা করেছেন, যার জন্য তাঁর এই সংগ্রহ। বন্ধুবান্ধবদেরও দেখিয়েছেন, এর থেকেই রবীন্দ্রনাথ ও চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়কে কখনো দিয়েছেন। মনে প্রশ্ন জাগে, এই সাজিয়ে রাখা বাউল গান সংগ্রহের পাণ্ডুলিপি কোথায় গেল?

‘কোথায় গেল’ এ-প্রশ্ন বেশি করে ওঠে এইজন্য যে, ১৯০৮ সালে শান্তিনিকেতনে তিনি স্থায়ীভাবে এসে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত আমৃত্যু আশ্রমিক আবহেই ছিলেন—বড়জোর ‘গুরুপল্লী’র বাসা ছেড়ে নিজের বানানো বাড়িতে উঠে গেছেন। সদাসঙ্গিনী পত্নী কিরণবালা, পুত্র কঙ্কর সেন, কন্যা অমিতা— ক্ষিতিমোহনের তিন উত্তরাধিকারীর কাছে প্রণতি এই পাণ্ডুলিপির হদিশ পাননি।

কিন্তু ক্ষিতিমোহনের সাক্ষ্যে দেখা যাচ্ছে, তাঁর সংগৃহীত বাউলগান থেকে ১৫টি গান তিনি চারু বন্দ্যোপাধ্যায়কে দিয়েছিলেন ছাপতে এবং সেগুলি বেরোয় ‘বঙ্গবীণা’ বইতে। রবীন্দ্রনাথ এই পনেরোটি গান থেকেই প্রয়োজনীয় উদ্ধৃতি দিয়েছেন। সন্দেহ হয়, তাঁর জীবনের একটি পর্বে, অন্তত বাউল-ভাবনার দিক থেকে রবীন্দ্রনাথ ক্ষিতিবাবুর দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। তিনিই কি রবীন্দ্রনাথকে কায়াবাদী চারচন্দ্র সাধনকারী বাউলদের বিষয়ে অবহিত করে তাঁর উৎসাহ নিবৃত্ত করেন? দেখা যাচ্ছে ‘বাউল-পরিচয়’ প্রবন্ধে ক্ষিতিমোহন লিখেছেন:

সহজভাবে বাউল সম্বন্ধীয় যে-কয়খানা পুঁথি পাওয়া যায়, তাহাতে সাচ্চা বাউল-ভাবের পরিচয় মেলে না। আসল বাউল তো পুঁথির ধারই ধারে না। যাঁহারা আধা বৈষ্ণব আধা বাউল, কি আধা তান্ত্রিক আধা বাউল, তাঁহারাই নিজেদের পরিচয় খানিকটা বৈষ্ণব ও তান্ত্রিকভাবে Compromise-এর মত, দিতে চাহিয়াছেন। কিন্তু যথার্থ সে নির্ভীক শক্তি বা রচনার গভীরতা গ্রন্থী বাউলদের নাই। সহজ নামে তাঁহারা যে সস্তা ইন্দ্রিয়-উপভোগের পন্থা খুলিয়াছেন, তাহা বাস্তবিকপক্ষে কোনো সাধনার ভিত্তি হইতে পারে না। চর্যাচর্যবিনিশ্চয় প্রভৃতি গ্রন্থও তান্ত্রিক ভাবের গ্রন্থী বাউলের শ্রেণীর সঞ্চয়।

এই মন্তব্য খুব গুরুত্বপূর্ণ ও দ্যোতনাবহুল এবং সেইসঙ্গে ব্রাহ্ম ক্ষিতিমোহন সেনের সহজিয়া সাধনা তথা বাউলধারা সম্পর্কিত ধারণার স্পষ্ট প্রতিবেদন।

মন্তব্যটি বিশ্লেষণ করলে ক্ষিতিমোহনের মনের যে-রূপ ফুটে ওঠে তাতে বোঝা যায় চর্যাগীতি থেকে উৎসারিত বাংলা গীতি পদাবলির ধারাকে তিনি শনাক্ত করতে চান তন্ত্রসম্পৃক্ত কায়াবাদী বলে। সহজিয়া পদকে ও পন্থাকে তিনি সরাসরি অভিযোগ করেছেন ইন্দ্রিয়-উপভোগের নামান্তর বলে। তবে তিনি যথার্থভাবে বলেছেন যে সাধারণভাবে বাংলার বাউল গানে ‘আধা বাউল আধা বৈষ্ণব’ বা ‘আধা তান্ত্রিক আধা বাউল’ পন্থার সমন্বয় ঘটেছে। একথা বলে তিনি বাউল গানের মূল স্রোত থেকে তাঁর সংগৃহীত পনেরোটি পদের স্বাতন্ত্র্য ও কৌলীন্য প্রতিষ্ঠা করেছেন। অর্থাৎ সেসব পদে উচ্চভাব ও গভীরতা আছে, কায়াবাদী সাধনার সঙ্গে ওই পদকারদের সম্পৃত্তি নেই, সহজধারার ইন্দ্রিয়-উপভোগের সরণি থেকে এ গান স্বতন্ত্র পথযাত্রী। এমন ধারণা ও মন্তব্য করার পেছনে ক্ষিতিমোহনের উদ্দেশ্য যাই থাক, একথা স্পষ্ট যে শান্তিনিকেতনে বসবাসকালে সহজিয়া তথা ‘আধা বৈষ্ণব আধা বাউল’ ধারার গান ও গায়কদের তিনি ভাল করে জেনেছিলেন। প্রণতি মুখোপাধ্যায়ের বই থেকে একটি উদ্ধৃতি দেওয়া যায়। ১৯১২ সালে—

পৌষ সংক্রান্তির দিনে কেন্দুলির জয়দেবের মেলায় গিয়ে ভরা-মনে ফিরলেন, বাউল ও বাউল গানের প্রবল আকর্ষণে এমন কতবারই গেছেন। নিতান্ত অল্প বয়সেই তিনি এ মেলায় আসতেন নিতাই বাউলের সঙ্গে, তখন শান্তিনিকেতনের সঙ্গে কোনো সম্পর্কই ছিল না। এখানে এসেও প্রথম প্রথম কাউকে না জানিয়ে একা চলে যেতেন। তারপর জানাজানি হল, বন্ধু-সহকর্মীরা সঙ্গী হতে লাগলেন। তাঁর ভয় ছিল পাছে কেউ বাউলদের প্রশ্ন করে বিরক্ত করেন।

এখন সমস্যা হয়েছে আমাদের মতো জিজ্ঞাসু ও তথ্য অনুসন্ধানীদের, যারা ক্ষিতিমোহন বা উপেন্দ্রনাথের অনেক পরে সরেজমিন কাজে নেমেছি। একটা কথা স্পষ্ট যে, ক্ষিতিমোহন বহুদিন ধরে এবং বহু জায়গায় ঘুরে মরমি ভাবসাধকদের সঙ্গ করেছেন, তাঁর শাস্ত্রজ্ঞানও ব্যাপক ও গভীর। তুলনায় উপেন্দ্রনাথ অনেক পরে ব্রতী হয়েছেন তাঁর সন্ধান ও সংগ্রহ কাজে, তাঁর অনুসন্ধানের ক্ষেত্রও অনেক সীমায়িত। তবে উপেন্দ্রনাথ বেশ জোরালোভাবে আমাদের কায়াবাদী বাউল সাধকদের হয়ে সওয়াল করেছেন— ধরতে চেয়েছেন তাদের গোপন ও গুহ্য সাধনার ধারা তথা দর্শনকে। বাউলদের চারচন্দ্রভেদ বা মলমূত্ররজবীর্যপান তাঁর ততটা গর্হিত বা ঘৃণাৰ্হ বলে মনে হয়নি—ক্ষিতিমোহন সে বিষয়ে একেবারে বিপরীতমুখী। কাজেই ক্ষিতিমোহনকে উদ্ভাবন করতে হয়েছে এক নতুন লজ— কায়াবাদীদের বিপরীতে তিনি প্রতিষ্ঠা দিতে চেয়েছেন উচ্চতর ভাবের বাউল সাধকদের। কিন্তু খুব সংগত যুক্তিতে ও স্থানিক কারণে তিনি তাঁদের খুঁজে পাননি রাঢ়বঙ্গে বা কেঁদুলির মেলায়। লালনশাহী পন্থা সম্পর্কে তাঁর উৎসাহ থাকার কথা নয়, যিনি স্বচ্ছ ভাষায় লিখেছিলেন ‘ধরো রে অধরচাঁদে অধরে অধর দিয়ে’। কাজেই অবিভক্ত বাংলায় ঠাকুর পরিবারের জমিদারিভুক্ত কুষ্টিয়া পরিমণ্ডলে তিনি যাননি, উৎসাহ পাননি লালনবাণী প্রচারে। অথচ এখন নানা ঘটনাচক্রে লালন শাহের গান ও তত্ত্ব দুই বাংলার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য হয়ে উঠেছে। লালনবাণী এখন বুদ্ধিজীবীদের দিশা দিচ্ছে এবং লালনগীতির সুরকাঠামো নিয়ে কৌতুহল বেড়েই চলেছে। তথ্য থেকে জানা যায়, ১৮৯০ থেকে ১৯৯১ পর্যন্ত একশো বছরে লালন সম্বন্ধে বই লিখেছেন ৪৪ জন, প্রবন্ধ লিখেছেন ১৫০ জন।

এহেন লালনের গান রবীন্দ্রনাথের মনোযোগ আকর্ষণ করেছিল উনিশ শতকের শেষ দশকে। সে গানের ভাবরস ও সুরমাধুর্য তাকে টেনেও ছিল, অথচ পরে সেই লালন সম্পর্কে আর যেন তেমন উচ্ছ্বাস ছিল না। যেটুকু ভাবোচ্ছ্বাস তিনি প্রকাশ করেছেন তা লালনের দেহ খাঁচার অচিন পাখির রহস্য নিয়ে। ‘মাঝে মাঝে বদ্ধ খাঁচার মধ্যে আসিয়া অচিন পাখী বন্ধনহীন অচেনার কথা বলিয়া যায়; মন তাহাকে চিরন্তন করিয়া ধরিয়া রাখিতে চায় কিন্তু পারে না’— তাঁর উপভোগ ছিল লালনের এই অসামান্য অনুভবের জন্য ও প্রকাশভঙ্গির কারণে। বাউল গানের ‘mystic transcendentalism’ তাঁর পক্ষে রোচক লেগেছিল, কিন্তু বাউলদের প্রতিবাদী মনন, আত্মবেদন ও নির্যাতিত অবস্থান বিষয়ে তিনি কলম ধরেননি। পরিণত বয়সে ১৯০৬ সালে ‘পত্রপুট’ কাব্যের ১৫ সংখ্যক কবিতায় তিনি লিখেছিলেন:.

কদিন দেখেছি ওদের সাধককে

একলা প্রভাতের রৌদ্রে সেই পদ্মানদীর ধারে,

যে নদীর নেই কোনো দ্বিধা

পাকা দেউলের পুরাতন ভিত ভেঙে ফেলতে।

দেখেছি একতারা-হাতে চলেছে গানের ধারা বেয়ে

মনের মানুষকে সন্ধান করবার

গভীর নির্জন পথে।

যৌবনে পদ্মাতীরে দেখা একক বাউলের এই নিঃসঙ্গ সন্ধান নির্জন পথে, তাঁর পক্ষে একটি ভাবময় চিত্রকল্প হয়ে উঠেছে। বাউলকে তিনি একলা সাধকরূপে দেখতে চান— ‘মনের মানুষ’-ও তাঁর বিবেচনায় এক অন্তরগ্রাহ্য তত্ত্ব। কিন্তু প্রকৃত প্রস্তাবে বাউল সাধনা যুগলের সাধনা এবং দেহতত্ত্বের জটিল পথক্রমায় তার চলাচল। মনের মানুষ তাদের বিশ্বাসে কোনও ভাব বা অনুভব নয়, তা নিতান্ত এক বস্তু, যা উপলব্ধি করতে হয় নরনারীর দেহসংগমে এবং গুরুনির্দেশিত করণকৌশলে।

‘ওদের সাধক’ উচ্চারণে কবি যাঁদের কথা বলেছেন তাঁদের পরিচিতি দিতে গিয়ে তাঁর বাচন:

ওরা অন্ত্যজ, ওরা মন্ত্রবর্জিত।

দেবালয়ের মন্দিরদ্বারে

পূজা-ব্যবসায়ী ওদের ঠেকিয়ে রাখে।

বাউলদের হয়তো অন্ত্যজবর্গে শ্রেণিভুক্ত করা যেতেও পারে, অন্তত গভীরার্থে, ওরা মন্ত্রহীন কেননা মন্ত্রে ওদের বিশ্বাস নেই—প্রশ্নটি তাই কিন্তু অধিকারঘটিত নয়। দেবালয়, দেবতা, বিগ্রহ পূজা বা পুরোহিত কিছুই ওদের কাম্য নয় তাই পূজা ব্যবসায়ীদের দ্বারা নিরুদ্ধ হবার প্রশ্ন ওঠে কি? এর পরের রবীন্দ্রবাণী আরও ভ্রমাত্মক। বলেছেন:

ওরা দেবতাকে খুঁজে বেড়ায় তাঁর আপন স্থানে।

অথচ শুধু বাউল কেন কোনও লোকায়ত সাধকই দেবতাকে খোঁজে না, খোঁজে মানুষ।

গোপ্য সাধনার ত্রিবেণী

পঞ্চাশ বছর আগে রাঢ় বাংলার রূপকার তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর প্রসিদ্ধ ‘রাইকমল’ উপন্যাসের গোড়ায় লিখেছিলেন:

পশ্চিমে জয়দেব-কেন্দুলি হইতে কাটোয়ার অজয় ও গঙ্গার সঙ্গম-স্থল পর্যন্ত ‘কানু বিনে গীত নাই’। অতি প্রাচীন বৈষ্ণবের দেশ।… এ অঞ্চলে সুন্দরীরা নয়ন-ফাঁদে শ্যাম শুকপাখি ধরিয়া হৃদয়পিঞ্জরে প্রেমের শিকল দিয়া বাঁধিয়া রাখিতে তখন হইতে জানিত।

লাকে কপালে তিলক কাটিত, গলায় তুলসীকাঠের মালা ধারণ করিত; আজও সে তিলক-মালা তাহাদের আছে। পুরুষেরা শিখা রাখিত। এখন নানা ধরণের খোঁপা বাঁধার রেওয়াজ হইয়াছে, কিন্তু স্নানের পর এখনও মেয়েরা দিনান্তে একবারও অন্তত চূড়া করিয়া চুল বাঁধে। …হলুদমণি পাখি—বাংলাদেশের অন্যত্র তাহারা ‘গৃহস্থের খোকা হোক’ বলিয়া ডাকে, এখানে আসিয়া তাহারা সে ডাক ভুলিয়া যায়— ‘কৃষ্ণ কোথা গো’ বলিয়া ডাকে।

চাষির গ্রামে সদ্‌গোপেরাই প্রধান, নবশাখার অন্যান্য জাতিও আছে। সকলেই মালা তিলক ধারণ করে, হাতজোড় করিয়া কথা বলে, প্রভু বলিয়া সম্বোধন করে। ভিখারিরা ‘রাধে-কৃষ্ণ’ বলিয়া দুয়ারে আসিয়া দাঁড়ায়; বৈষ্ণবেরা খোল করতাল লইয়া আসে; বৈষ্ণব বৈষ্ণবীরা একতারা খঞ্জনী লইয়া গান গায়; বাউলেরা একা আসে একতারা বাজাইয়া।

এই বর্ণনার পর উপন্যাস যত এগোয় আমরা তার কাহিনির পথ ধরে চলে আসি এক স্নিগ্ধ বৈষ্ণবীয় আখড়ায়, হরিদাস মহান্তের গড়ে-তোলা কুঞ্জে। সেখানে থাকে দুটি প্রাণী— মা আর মেয়ে, কামিনী ও কমলিনী। কী করে যেন তাদের জীবনে এসে যায় বৃদ্ধ বাউল রসিকদাস। কমলের নাম দেয় সে ‘রাইকমল’। শেষদিকে বাউল আর বৈষ্ণবী, দুই ভিন্ন সম্প্রদায়ী অসমবয়সি তারা, নিজেদের মালাচন্দনে বাঁধে। এইখানে এসে আমরা আখ্যান অংশ ত্যাগ করে স্বচ্ছ চোখে রাঢ়ের বহুদিনের সমাজ-ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখতে পাব, এই ভূমিখণ্ডে বৈষ্ণব আর বাউলে খুব আড়াআড়ি নেই, যেন অজয় আর গঙ্গার মিলে যাওয়া। তাই বৈষ্ণব-তীর্থ কেঁদুলিতে বাউলদের সবচেয়ে বড় সমাবেশ। তাতে কোনও বেসুর বাজেনি, কোনওদিন। বাজেনি যে, তার কারণ, এ প্রান্তের বাউল ও বৈষ্ণবদের বেশির ভাগই উচ্চবর্গের বা উচ্চবর্ণের নয়। বৈষ্ণব মানেও সর্বদা নৈষ্ঠিক গৌড়ীয় বৈষ্ণব নন, বরং জাতি-বৈষ্ণব বা সহজিয়া। সকলেই প্রধানত কায়াবাদী। দেহ-বৃন্দাবনেই তাদের আরোপ সাধনা। অনুমানের পথে নয়, তাদের সাধনার নাম ‘বর্তমান’। এই দেহভাণ্ডেই তাদের সবকিছু। তাই দেহের কিছুই ঘৃণ্য বা বর্জ্য নয়।

নজর করলে আরেকটা জিনিস দেখা যাবে। বর্ধমান-বীরভূম-বাঁকুড়ায় প্রতি বছর নির্দিষ্ট দিনে যে সব বিখ্যাত বাউল সমাবেশ হয়ে থাকে তার মূলে রয়েছে সহজিয়া বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের উদ্যম ও উদ্যোগ। কেঁদুলির কথা তো আগেই বলেছি তা ছাড়া বাঁকুড়া সোনামুখির বাউল সমাবেশ (রামনবমী) হয় মনোহর খ্যাপার প্রসিদ্ধিতে। মনোহর ছিলেন সাধু বৈষ্ণব। বর্ধমানের অগ্রদ্বীপে ঘোষঠাকুরের শ্রাদ্ধে কৃষ্ণমূর্তি গোপীনাথ শ্রাদ্ধ করেন কাছা পরে। পুরোপুরি বৈষ্ণবীয় উৎসব, কিন্তু বাউলদের বেশ রমরমা। বীরভূমের কোটাসুরে একশো বছর ধরে ভাদ্র মাসে সাধুসেবা চলছে। এতে প্রধান ভূমিকা বাউলদের। অথচ আশ্রমটি নারায়ণচাঁদ গোঁসাইয়ের সাধনসঙ্গিনী খ্যাপা মা-র নামেই প্রসিদ্ধ। আগে এর তত্ত্বাবধান করতেন মতিদয়াল গোঁসাই, তারপর মনোহরদাস মহান্ত। নামের ধরন দেখেই বোঝা যাচ্ছে এঁদের জাতি-বৈষ্ণবের পরম্পরা, তবে গৃহী নন— আখড়াধারী। এমনই বহু উদাহরণ দেওয়া যায়— যেমন বেনালীপুরের মেলা, রামকেলীর সমাবেশ, দধিয়া বোরেগীতলার মেলা। বীরভূমের বাউলদের নিয়ে অনেকদিন সরেজমিন কাজ করেছেন আদিত্য মুখোপাধ্যায়। তাঁর ধারণা:

বেশির ভাগ বাউলই নিজেকে বৈষ্ণব বলে পরিচয় দেন এ আমার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা। আসলে ‘রূপ’— ‘রাগ’ হয়ে বাউল পৌঁছায় ‘ভাবে’। বাউলের বিভিন্ন শুদ্ধ আচরণগুলিই তাকে ক্রমশ বৈষ্ণব করে তোলে।

বাউলের শুদ্ধ আচরণ? শুনেই মনে পড়ল ১৮৯৬ সালে পণ্ডিত যোগেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য তাঁর ‘Hindu Castes and Sects’ বইতে মন্তব্য করেছিলেন:

The Bauls are low class men, and make it a point to appear as dirty as possible… Aristrocratic Brahminism can only punish them by keeping them excluded from the pale of humanity.

কিন্তু এ মন্তব্য তো উনিশ শতকের শেষ দশকের একজন নৈষ্ঠিক ব্রাহ্মণের। আধুনিক কালের ব্রাহ্মণ যুবা আদিত্য মুখোপাধ্যায় মনে করছেন অন্য কথা। তিনি বলছেন:

বিষয়টি গুলিয়ে যাবার মতোই। প্রায় প্রত্যেক সাধু-বাউলের কাছে শুনেছি, তাঁরা বৈষ্ণব বাউল। ‘বাউল বোষ্টম’ কথাটিও এতই প্রচলিত যে এদের ভিন্নত্ব ধরা পড়ে না। আবার বাউলের সাধন সঙ্গিনীকে সব সময়েই ‘বোষ্টমী’ বা ‘বৈষ্ণবী’-ই বলা হয়।

এ যেমন সত্যি তেমনি এটাও ঘটনা যে ‘আউল বাউল’ বলে একটা কথা চালু আছে, ‘বাউল-ফকির’ কথাটাও খুব সচল। লালন কী ছিলেন— বাউল না ফকির?

উনিশ শতকে বাউল আর ফকিরদের বহুক্ষেত্রে সমার্থক বলে মনে করেছেন অনেকে, অন্তত সেকালের পণ্ডিত ও গবেষকরা। তাঁরা কেউই অবশ্য এই দীনহীন সম্প্রদায় সম্পর্কে প্রসন্ন ছিলেন না। তার কারণ তাঁদের উচ্চবর্ণের অহমিকা একদিকে, আরেকদিকে নিম্নবর্গের এই কায়াসাধকদের গোপন ও গুহ্য আচরণবাদ। কেবল বাউল বা ফকিরিতন্ত্র নয়, জাতবৈষ্ণব-কর্তাভজা-সহজিয়া স্রোত, এমন সমস্ত ধারা যা গৌণধর্মীদের আশ্রয় ও আশ্বাস দিয়েছিল তা তাঁদের মনঃপূত হয়নি। সনাতন ভাবনাচিন্তা বা দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের আচরিত ধর্মের বাইরে যারা যায় তাদের খ্যাতিবিত্ত জোটার তো কথা নয়। তাদের জোটে নিন্দা ও বিদ্রূপ। তারা হয়ে ওঠে উচ্চশ্রেণির পক্ষে সন্দেহজনক আর শত্রুবিশেষ। তাই তাদের দমন-পীড়ন-ধ্বংস সাধন হয়ে ওঠে আশু কর্তব্য। ব্যাপারটি একপক্ষীয়— কারণ শাস্ত্র-মন্দির-মন্ত্র-মসজিদ-পুরোহিত-মোল্লা সেইদিকে। তারা নগরবাসী, ও শিক্ষিত, মসীজীবী লেখকরাও তাদের পক্ষে। পত্রপত্রিকা, ধর্মপ্রতিষ্ঠান ও মুদ্রণযন্ত্র তাদের সহায়। অন্যপক্ষে গ্রামে-বাস করা বিচ্ছিন্ন ও অসংগঠিত বাউল ফকিরদের অস্ত্র বলতে কণ্ঠের গান আর অন্তরের তীব্র বিশ্বাস। সেই জায়গাটায় অবশ্য তাদের খুব জোর। কোনও অনুমানাত্মক কিছুকে তারা মানে না। তাদের মতে শাস্ত্ৰ-পুরাণ-দেবমূর্তি-মন্ত্র-তীর্থ-উপবাস এসব আসলে ‘অনুমান’। সত্য হচ্ছে ‘বর্তমান’, এই নরনারীর দেহ ও দেহধর্ম, এই ইহজগৎ আর কামনাবাসনা, স্বপ্ন ও মুক্তিপিপাসা। এর পরতে পরতে রয়েছে রহস্য ও মরমিয়া বিশ্ব। খোদা বা ঈশ্বর আছেন মানব জীবনের শরিক হয়ে, তাই মানুষ ধরে সাধনা করতে হবে। তাদের গানে বলা হচ্ছে:

মানুষ হয়ে মানুষ জানো

মানুষ হয়ে মানুষ চেনো

মানুষ হয়ে মানুষ মানো

মানুষ রতনধন।

করো সেই মানুষের অন্বেষণ॥

এই মানুষতত্ত্ব যার সত্য হয়ে যায় মনের মধ্যে, সে কেন অন্য তত্ত্ব মানবে? সে কেন গ্রস্ত হবে সাবেক স্বর্গ-নরক ধারণায়? তাই তার প্রতিপ্রশ্ন:

আল্লার বাড়ি যদি মাটির দুনিয়া হয়

তবে মানুষ মরে কোন্ বেহেস্তে যায়?

বেহেস্ত বা স্বর্গপ্রাপ্তি যদি কাঙ্ক্ষণীয় না হয় তবে এসব লৌকিক সাধকদের একমুখী লক্ষ্য মানুষের মুক্তি। সে মুক্তি মানে মোক্ষপদ প্রাপ্তি নয়— অজ্ঞানতা, কুসংস্কার থেকে মুক্তি। মাটির ঢিপি ও কাঠের মূর্তি পুজো, অপদেবতা বা উপদেবতায় বিশ্বাস, দরগাতলায় হত্যে দেওয়া বা কবচতাবিজ ধারণ সবেরই বিরুদ্ধাচরণ করা এদের ব্রত। বিচারশীল আর তর্কপ্রবণ বাউলফকিররা বহুলাংশেই গুরুবাদী, কারণ গুরুই কায়াসাধনার পথ ও পদ্ধতি বাতলে দেন। কিন্তু এমন যে অত্যাজ্য গুরু, তাঁকেও অভ্রান্ত না ভেবে বলা হয়েছে:

যাহা দেখিনি নিজ নয়নে

বিশ্বাস করি না গুরুর বচনে।

এত যুক্তিতর্কবিচার সংকুল পন্থা গরিষ্ঠসংখ্যক মানুষের কাছে সমাদৃত হবার কথা নয়। কিন্তু মনের মানুষের সন্ধানে নিরত এমন গভীর নির্জন পথ নিঃসঙ্গ সাধকের প্রাণের প্রদীপে আলোকিত। সে নির্ভয় ও ধর্মনির্লিপ্ত— স্রোতের বিরুদ্ধে তার অবগাহন। প্রয়োজনে সে প্রতিবাদী, কিন্তু তার আয়ুধ লাঠি নয়, একতারা। তার বিশ্বাস, ‘এই মানুষে সেই মানুষ আছে।’

কিন্তু বিশ্বাসের এত বলিষ্ঠ অবিচল পথের পদাতিকদের সংখ্যাবৃদ্ধি তো সনাতনবাদীদের পক্ষে স্বস্তির হতে পারে না। তাই তাঁদের প্রশ্ন:

কী জন্য প্রবীণ মতে বিরত হইয়া।

অভিনব মতে রত কী সুখ দেখিয়া॥

স্বর্গের সোপান কি এ মতে গাঁথা আছে।

দড়বড়ি চলি যাবে শ্রীহরির কাছে॥

না জানি কী লাগি সবে ভ্রান্ত হায় মতি।

নবপথে পদার্পণ কেন এ দুর্মতি॥

দ্বন্দ্ব এটাই অর্থাৎ প্রবীণ মত আর নতুন মত। ‘পাষণ্ডীদলন’-এর লেখক রামলাল শর্মা তাঁর নিরীহ পয়ারে যে প্রশ্ন তুলেছেন তা তার একার নয়। অক্ষয়কুমার দত্ত, যোগেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য, রেয়াজউদ্দিন আহমদ, দাশরথি রায় এমনকী বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী ও শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসেরও এই এক প্রশ্ন। পুরনো পথ ছেড়ে অভিনব এই পথে কেন? কীসের জন্য? এ পথে কি স্বর্গ বা শ্রীহরির পাদপদ্মপ্রাপ্তি দ্রুততর হবে? মুশকিল যে স্বর্গ বা হরি কোনওটাই এদের অন্বিষ্ট নয়। এদের লক্ষ্য মানব, মানবসত্য।

ঈশ্বরলাভ আর স্বর্গপ্রাপ্তির আকাঙ্ক্ষা গায়ে গায়ে লেগে থাকে। যুক্তিবাদী লালন শাহ মারাত্মক প্রশ্ন তুলেছেন এ প্রসঙ্গে। বলছেন:

মলে ঈশ্বরপ্রাপ্ত হবে কেন বলে?

মলে হয় ঈশ্বরপ্রাপ্ত সাধু অসাধু সকলে

তবে কেন এত জপতপ এত করে জলেস্থলে?

সকলেরই তো লক্ষ্য ঈশ্বরপ্রাপ্তি, সাধু অসাধু সকলেই তো পাবে ঈশ্বর, হলে আর কেন এত জপতপ এত কৃচ্ছ্রসাধন? তারপরের জিজ্ঞাসা:

যে পঞ্চে পঞ্চভূত হয়

মলে তা যদি তাতেই মিশায়—

তবে ঈশ্বর-অংশ ঈশ্বরে যায়

স্বর্গ-নরক কার মেলে?

একেবারে তাত্ত্বিক প্রতিপ্রশ্ন। পঞ্চভূত থেকে আমাদের সৃষ্টি আবার পঞ্চভূতেই বিলয়, তা হলে কোন সে উদ্বৃত্ত অংশ যা স্বর্গে বা নরকে যাবে? এ জাতীয় তত্ত্ব ও দ্বান্দ্বিকতার বিন্যাস থেকে বোঝা যায় নিম্নবর্গজাত বাউলফকিররা খুব হেলাফেলার, অবজ্ঞার বা ঘৃণার বিষয় নয়, অনুধাবনের বিষয়।

এদেশে বাউল একটি তত্ত্ব হিসাবে গৃহীত হয়েছে, ধর্মহিসাবে নয়। এরা একই সঙ্গে বৈদিক কর্ম কাণ্ড এবং ব্রাহ্মণ্য আচার আচরণের বিরোধী। এদের ভাবনা ধারণা গঠনে বৈষ্ণবীয় রাগানুগা সাধনা ও পরকিয়া মৈথুনকেন্দ্রিক কায়াবাদ আছে। বেশ কিছুটা প্রতিবাদী ইসলামি স্পর্শ এবং অনেকটা সুফিবাদের সংক্রাম আছে। বৌদ্ধ শূন্যবাদ ও নাথপন্থের কিছু কিছু সংরাগও লক্ষণীয়। এককথায় বাউল ভাবনায় এক উদার ও সমন্বয়বাদী মানবচেতনা কাজ করেছে, যার নেতৃত্বে শাস্ত্র বা মন্ত্র নেই— আছে গান আর গুরুর নির্দেশ। গানগুলি দ্যোতনাময় ও গূঢ়, তাকে ভেদ করতে হয় সাধনায়। এক কথায় বাউলরা হল ভোগমোক্ষবাদী, সমাজছুট কিন্তু সমাজবিচ্ছিন্ন নয়। সামাজিক দায়দায়িত্ব তারা নিতে চায় না কিন্তু সমাজের শোষিত নিম্নবর্গের শ্রমজীবী অংশ থেকে যেহেতু তাদের আবির্ভাব তাই অত্যাজ্যভাবে তাদের গানে রয়ে যায় নানা সামাজিক স্মৃতি ও সংস্কার, রূপক ও প্রতীক। তাদের গানের ভাবে-বর্ণনায়-সুরে মাটির স্পর্শ খুব প্রকট। কেউ কেউ মনে করেন বাউল সাধনায় পর্যুষিত হয়ে আছে বাংলার ধর্ম, বাঙালির ধর্ম ও তার চিরার্জিত মানসজীবন। ‘দেশীভাবে ও বিদেশীপ্রভাবে এর উদ্ভব,’ এমন কথা বলেছেন কেউ— সেক্ষেত্রে বিদেশি বলতে ইসলাম ও সুফিপ্রভাবের কথাই ব্যঞ্জিত। ‘সমাজের উপরতলার লোকের ধর্ম হলে এই মতবাদ যে কেবল বাঙালির জীবন ও ভাগ্য নিয়ন্ত্রিত করতো তা নয়, দুনিয়ার মানুষের কাছে উদার মানসিকতার জন্য বাঙালিকে শ্রদ্ধেয়ও করে তুলতো’— আহমদ শরীফের মতো প্রাজ্ঞজনের এ হেন মন্তব্যে ভাবাবেগ যতটা স্ববিরোধও ততটা। কায়াবাদী যৌনযৌগিক কোনও গোপ্য সাধনরীতি কি উপরতলার লোকের চর্চার বিষয় হতে পারে? এ কি কোনওভাবে বহুজনের আচরণীয়?

আহমদ শরীফ অবশ্য বাউলতত্ত্ব বিষয়ে এমন মন্তব্য করেছিলেন বহুদিন আগে, ১৯৬৩ সালে। তারপরে মন্তব্যটি হয়তো তিনি পুনর্বিবেচনা করে থাকবেন। তবে অপেক্ষাকৃত পরে, ১৯৮৮ সালে, তিনি ‘ফুলবাসউদ্দীন ও নসরুদ্দীনের পদাবলী’ সংকলনের মুখবন্ধে যে মতামত দিয়েছেন তা বিশেষভাবে অনুধাবনযোগ্য। বলেছেন,

‘Materialism spiritualism’-এর দ্বন্দ্বে যখন দুনিয়ার মানুষের মন অস্থির ও অসুস্থ, যখন নৈতিক ও সামাজিক মূল্যবোধ বিপর্যস্ত, যখন পৃথিবীর কল্যাণকামী চিত্ত অবক্ষয়ের নিরূপ যন্ত্রণায় কাতর, মানসদ্বন্দ্বে বিক্ষত মানুষ যখন স্বস্তির নিদান লাভের আগ্রহে উন্মুখ ও উৎকণ্ঠ, বিমূঢ় শিল্পীরা ও মনীষীরা যখন দিশাহারা, তখন এই অধ্যাত্মবাদনির্ভর নিশ্চিত মনের অবিচল প্রসন্ন-প্রশান্তি আমাদের ভাবিয়ে তুলবেই। বাউল গান আমাদের ক্ষণে ক্ষণে স্মরণ করিয়ে দেয় জীবনের জড় রয়েছে গভীরে, গতি হচ্ছে অনন্তে আর সম্ভাবনা আছে বিপুল। অবশ্য স্বীকার করতেই হবে এ মরমীতত্ত্ব ও অধ্যাত্মবাদ আধুনিক যন্ত্র ও প্রযুক্তিনির্ভর ইহজাগতিক সুস্থ ও স্বস্থ জীবনবিরোধী ও উপযোগবিহীন।

এ একেবারে আধুনিক মনের বিশ্লেষণ, তবে নিরপেক্ষভাবে এমন প্রশ্ন কি উঠবে না যে, যা সুস্থ ও স্বস্থ ইহজাগতিক জীবনবিরোধী ও উপযোগবিহীন, তা নিয়ে আলোচনার প্রয়োজন কোথায়? সেই প্রশ্ন, অনিবার্যভাবে, তবু ওঠে। কারণ আমাদের সাম্প্রতিক মধ্যবিত্তমন বাউল গান শ্রবণ ও চর্চায় খুব উৎসাহী। সত্যিকথা বলতে কি এই মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রোতা ও ভোক্তাদের খুশি করবার জন্যই বাউল তার সাজসজ্জাকে জাঁকালো করেছে, গানের পরিবেশনে এনেছে পারফরমারের মঞ্চদাপানো গিমিক ও ভাবভঙ্গি, যন্ত্রানুষঙ্গে ঘটিয়েছে অতিরেক। যে যুবকটি বর্ধমান বা নদিয়ার গ্রামে চাষবাস করে কিংবা ঘরামির বৃত্তিধারী, সে সন্ধ্যাবেলায় বাউলের আসরে যেন বিদূষক— বিনোদন করাই তখন তার ধর্ম। হালফিল বাউলের এই দ্বিচারিতা সমাজের একটা ব্যাধির মতো বেড়ে চলেছে। তাদের অনেকের জীবনে কোনও মগ্নতা বা প্রশান্তি নেই— বিমূঢ়তার আততি তার চোখে মুখে ছাপ ফেলে।

এই আততির কারণ দু’রকম। প্রথমত, বাউল এতদিন অভ্যস্ত ছিল গ্রামীণ জনপদ ও সেই জনমণ্ডলীকে গান শোনাতে, তাতে কোনও বিরোধ ছিল না কারণ সে-গান তো সেই জীবনেরই ফসল। গানের বক্তব্য, প্রতীক, বর্ণনা এমনকী সুরের একঘেয়েমি তাদের মেনে-নেওয়া। এখন নগরায়ণের তুমুল কলরোলের মধ্যে বাউলকে হতে হচ্ছে নাগরিক গায়ক, বুঝতে হচ্ছে নাগরিক মানুষের সদা পরিবর্তনশীল হালকা পলকা রুচিবোধ। এটাই দ্বিতীয় সমস্যা। যেহেতু গ্রামীণ রুচি ও প্রত্যাশার কাঠামো অনেকটা অনড় তাই সেখানে বাউল গায়ক স্বচ্ছন্দ ও সাবলীল কিন্তু নগরের মঞ্চে সে আড়ষ্ট বেপথু। কী যে সে গাইবে, কতটা রংবাজি তাতে দরকার তার নির্ধারক এক অশিক্ষিত শ্রোতার দল— যারা কোনও গূঢ় গভীর ভাবের গান শুনতে আসেনি, দেখতে এসেছে একটা গানের ধরন, যা গড়নে ‘ফোকো-মডার্ন’। তাদের কারুর কারুর আত্মাভিমান এইরকম যে এই গানের সমাদর বা পরিপোষণ মানে একরকম শিকড়ের সন্ধান ও ঐতিহ্যের পরিচর্যা। বাংলাদেশের গবেষক আহমদ মিনহাজ ভেবেছেন, সমকালের রাজনীতির ঘূর্ণি, মূল্যব্যবস্থার ব্যাপক ওঠানামা, আকাশ-সংস্কৃতির প্রসার-প্রতিষ্ঠা, নীতি-আদর্শের ক্রমস্খলন, সাম্যের পতন, ভক্তির প্রাবল্য ও নাস্তিকের ঔদ্ধত্য, তারও চেয়ে ভয়াবহ ব্যাধি, মধ্যবিত্তের অপরচুনিস্ট হওয়ার Self centered হওয়ার অসুস্থ মানসিকতা থেকে একদল বিবেকী ও সংবেদি মানুষ নিষ্ক্রান্ত হতে চাইছেন। কোনও বাঁধা ছকে তাঁদের আর আঁটছে না, তাঁরা কিছুটা ভাবুক বা স্বপ্নবাদী হতে চান, ইতিহাসকে দেখতে চান জীবনের দর্পণে। মিনহাজের ভাষায়:

আমাদের অনুভূতিতে আজ তাই দোলা লেগেছে, ইতিহাস তার পরিচিত ভঙ্গি বদলে নতুন আদলে ধরা দিতে চাচ্ছে; নিছক অধ্যাত্মবাদ, বস্তুবাদ-এর কোনওটিই নয়, দুইয়ের প্রাসঙ্গিক ও যুগোপযোগী মিলনের আকাঙ্ক্ষাই আজ বড়ো হয়ে উঠেছে। বাউল গান শুধু গান নয়, বাউল গানের ইতিহাসের পাতায় মুখর সাধকদের অন্তর্গূঢ় বাণী হিসাবে শুধু নয়, ইতিহাসের নতুন পথনির্দেশনারূপে আমাদের অনেকের চেতনায় প্রতিভাত হচ্ছে। আমরা গ্রহণ করতে চাচ্ছি এর মানবিকতা এর আধ্যাত্মিকতা এবং এর বস্তুবাদিতাও। মানে করলে দাঁড়ায়, আমরা পুনরায় শিকড়াভিমুখী, পুনরায় আশ্রয়প্রত্যাশী; আমাদের অভিগমন ঐ সব লুপ্তপ্রায় চিহ্ন ও অভিজ্ঞতার কাছে, সেখানে আমাদের অনুপ্রেরণা বাউলের গান, আর অবলম্বন লালন, হাসন, শাহনূর, শীতলাং, ভবানন্দ, ভবা পাগল, পাগলা কানাই, রাধারমণ, আরকুম শাহ, দুর্বিন শাহ, মহিন শাহ, শেখ ভানু, আব্দুল করিম, এমনি শত শত নাম, নামহীন জানা-অজানা মানুষের পরিমণ্ডলে চর্চিত জীবনদর্শন, এক ঋদ্ধ ইহ-আধ্যাত্মিকতা।

নব্য বাঙালির এমন শিকড়সন্ধান ও আশ্রয়প্রত্যাশার অধুনাতন প্রয়াস হয়তো সত্য ও আন্তরিক কিন্তু সেই শুশ্রূষা কি শুধু প্রাক্তনদের লেখা গানেই মিটে যাবে? নতুন গীতিকারদের লেখা গান খুঁজব না আমরা? খুঁজে যদি পাই তবে সেই গান কি অনিকেত আমাদের দিশা দেবে? কী করে দেবে— যখন এখনকার বাউল গীতিকাররাও আরেক অর্থে বিভ্রান্ত ও বিব্রত? যখন চটকদারি কথাবার্তা, বানানো প্রহেলিকা তাঁদেরও আচ্ছন্ন করছে— ‘সত্য বলো সুপথে চলো’ এমন লালনবাণী যখন উপেক্ষিত অবহেলিত, তখন?

আহমদ মিনহাজ অবশ্য বোঝেন অধুনাতনের বাউল-সমস্যা। গত কয়েক দশক এবং বিশেষ করে গত দশ বছর পশ্চিমবঙ্গের বাউল-ফকির অধ্যুষিত গ্রামদেশে ঘুরে আমি যা বুঝেছি, বাংলাদেশে বাস করে মিনহাজ তার থেকে অনুভবের খুব একটা দূরত্বে নেই। তাই তিনি লেখেন:

এ যুগ বাউল হবার উপযোগী নয়। জীবনধারণের সমস্যা এত কঠিন হয়ে গেছে, বাউলরাই আজকাল বাউল হতে চান না। গ্রামগুলোতে অভাব দিন দিন বাড়ছে, নগুরে বাবুয়ানা ঢুকে পড়ছে, কে আর গভীর মন নিয়ে বাউলের গান শুনবে, বাউলকে গ্রাসাচ্ছাদনের সুরাহাটুকু করে দেবে। এখনো যারা বাউল আছেন তারা আগের মতো গুহ্য শাস্ত্রের চর্চা করেন না, জীবনের রূঢ় বাস্তবকে প্রকাশ করেন গানে; বলেন মানুষের অভাবের কথা, দারিদ্র্যের কথা, লোক সংস্কৃতির সমৃদ্ধ চিহ্নগুলো হারিয়ে যাওয়ার বেদনা প্রকাশ পায় তাদের গানে।

এরকম অনেক গান আমি সংগ্রহ করেছি আবার নানা সংকলনেও বাউলদের লেখা এমন কিছু কিছু গান রয়েছে যাতে ধরা আছে বিগতদিনের জন্য চাপা কান্না— হারিয়ে-যাওয়া সম্মিলিত গ্রমিক যাপনের স্মৃতির জন্য দীর্ঘশ্বাস। এমন গানগুলির মধ্যে সবচেয়ে যেটি মর্মস্পর্শী বলে মনে হয়েছে আমার, এখানে উদ্ধৃত করছি—

আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম

গ্রামের নওজোয়ান হিন্দু-মুসলমান

মিলিয়া বাউলা গান ঘাঁটু গান গাইতাম।

বর্ষা যখন হইত গাজীর গান আইত

রঙ্গে ঢঙ্গে গাইত আনন্দ পাইতাম।

বাউলা গান ঘাঁটু গান আনন্দেরই তুফান

গাইয়া সারিগান নাও দৌড়াইতাম—

আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম।

হিন্দু বাড়িন্‌ত যাত্রাগান হইত

নিমন্ত্রণ দিত আমরা যাইতাম।

মনে ভাবনা সেদিন কি পাব না

ছিল বাসনা সুখি হইতাম…

বাংলাদেশের বাউল গীতিকার আবদুল করিম এমন একখানি সমাজসম্পৃক্ত গান লিখলেন কেন? সমাজের পটপরিবর্তন, লোক সংস্কৃতির থাকা-না থাকা, হিন্দু-মুসলমান সাম্য— এসব নিয়ে বাউলের ভাবনা কেন? ভাবনা এইজন্য যে তার নিজের পথ নির্ধারিত ও স্পষ্ট কিন্তু সেই পথের চারপাশের যে-সমাজ, যে-মানব পরিবেশ তা নিয়েও তার ভাবনা— সেখান থেকেই তার উদ্ভব। তার জন্মের তো কোনও অ-লৌকিক উৎস নেই। স্বদেশ আর স্বসমাজের ভাষাই তার ভাষা— সেই ভাষায় লেখা গান তার স্বভাষীরই সমাদরের বিষয়। সমাজ তাকে তেমন মান দেয়নি, তার জীবনযাপনের ক্লিষ্টতায় দরদ দেখায়নি, সমাজের মূলস্রোতে বাউলের স্থান নেই, সে গ্রামের একটেরে পড়ে থাকে, প্রান্তিক বর্গের মানুষ, তবু সেই সমাজই তার শিক্ষক, সমাজই তার উপমা-প্রতীক-রূপক রচনার চাক্ষুষ উৎস৷ যাদুবিন্দু গোঁসাইয়ের একটা বাউল গানে একজন একক মানুষের দুঃখভারনত জীবনের ছবি আছে—

যে ভাবেতে রাখেন গোঁসাই

সেইভাবেই থাকি

আমি অধিক আর বলব কি!

কখনও দুগ্ধ ছানা মাখন ক্ষীর নবনী

কখনও জোটে না ফেন আমানি

কখনও আ-লবণে কচুর শাক ভখি—

‘Life is either a feast or a fast’ দর্শনে বিশ্বাসী এই একক মানুষটি সত্যিই কি একক না সমষ্টির ব্যথাবেদনার শরিক? গীতিকারের কি কোনও অভিযোগ আছে ব্যক্তি বা সমাজের বিরুদ্ধে? ‘গোঁসাই’ কে? উত্তরের খোঁজে গানের পরবর্তী অংশ পড়তে পারি—

তুমি খাও তুমি খিলাও

তুমি দাও তুমি বিলাও

তৈয়ারি ঘর পেলে তুমি পালাও

তোমার ভাবভঙ্গি বোঝা ঠকঠকি।

গুরু দুখ দিতেও তুমি সখ দিতেও তুমি

কুনাম গুনাম সুনাম বদনাম সবই তোমারই

ও কুলআলম্‌ তোমারই ও কুদরতবিহারী।

তুমি কৃষ্ণ তুমি কালী তুমি দিলবারি॥

কহিছে বিন্দুযাদু তুমি চোর তুমি সাধু

তুমি এই মুসলমান এই হিঁদু…

সাব্লিমেশনই এ গানের সারকথা। গুরুই সেই পথে তাকে টেনেছে। সে একলা পথিক কিন্তু একক নয়— তার সঙ্গী জ্বলন্ত বিশ্বাস ও স্থির প্রত্যয়। সমাজ থেকে ছিন্ন হয়ে সে সমাজকে দেখায় সমন্বয়ের স্বপ্ন।

অবশ্য এতসব বিচিত্র দৃষ্টিকোণ একদিনে অর্জিত হয়নি। প্রথমদিকে গৌণধর্মীদের আমরা ঘৃণা ও বিরুদ্ধতা ছাড়া কিছুই দিইনি— পরে দৃষ্টিভঙ্গি কিছুটা দ্রব ও অনুকম্পায়ী হয়েছে। পরিবর্তনের কারণ বোঝা কঠিন নয়। সবচেয়ে বড় কারণ এটাই যে, আঠারো ও উনিশ শতাব্দীর টানাপোড়েনের কালে বাঙালি হিন্দুসমাজে ধর্মচিন্তার যে আলোড়ন ঘটেছিল তার অনেকটা নাগরিক মধ্যবিত্ত জীবনের সীমায় অবরুদ্ধ ছিল। ঔপনিবেশিক ভাঙা গড়ায় ধনী অভিজাত, শিক্ষিত মধ্যবিত্ত ও গৃহস্থ ভদ্রলোক— এই ত্রিস্তর সমাজকাঠামোয় ধর্মধারণা নানা মাত্রা ও রূপ নিয়েছিল। শিক্ষার আলোয় পাশ্চাত্যের জ্ঞানবিজ্ঞান এদেশের মননে নতুন চেতনার বিকিরণ করে, ফলে ধর্মকে দেখা হতে থাকে নানা চোখে। একদিকে রামমোহন, দেবেন্দ্রনাথ, অক্ষয়কুমার, কেশবচন্দ্র— অন্যদিকে রামকৃষ্ণ পরমহংস, বিজয়কৃষ্ণ ধর্মের জ্ঞান কর্ম ও ভক্তিমার্গের বহু দিক উন্মোচন করেন। কারুর শস্ত্র ছিল জ্ঞান ও যুক্তি, কারুর শরণাগতি ও ভাবোদ্বেল প্রশান্তি। এ ছাড়া সাকার-নিরাকারের প্রশ্ন ছিল। ঐতিহ্যবোধ, শাস্ত্রজ্ঞান, গুরুর গুরুত্ব, শাস্ত্রের শ্রেষ্ঠত্ব, একেশ্বরবাদ, আত্মার অস্তিত্বে বিশ্বাস ও পরলোকতত্ত্ব— এতসব বিচিত্র ও বিরোধী সংঘাতে সংশয়ে দুলছিল তখনকার নাগরিক মধ্যবিত্ত বাঙালির সমাজকাঠামো। আমাদের পাঠক্রম ও উচ্চতর শিক্ষাপদ্ধতি বাঙালির এই মানস-সংঘর্ষের ইতিহাসকে বড় করে দেখিয়ে আসছে বলে সমাজের অন্য দিকটা অজানা রয়ে গেছে। তাই আমরা জানতে চাইনি মোগল সাম্রাজ্যের পতনের পরে নবাবি শাসনের ব্যর্থতার দায় কেমন করে বাংলার গ্রামসমাজকে জীর্ণ করেছিল। আর সেই জীর্ণতার ফাঁকে ফোকরে ঢুকে জেঁকে বসেছিল জাতিভেদ, বর্ণদ্বেষ, অন্ধবিশ্বাস, কুসংস্কার ও পুরোহিত বা মোল্লাতন্ত্র। ব্রাহ্মণ্য সমাজের একনায়কত্বজাত কঠোর বর্ণব্যবস্থা আর মুসলমান শরিয়তি নীতির কট্টর আচরণ থেকে পিঠ বাঁচাতে গড়ে উঠেছিল নানা ধরনের গৌণধর্ম, যার মূলে ছিল শোষিত হিন্দু-মুসলমানের যুক্ত চৈতন্য ও সমন্বয়স্বপ্ন।

ইংরেজের বিদ্যালয়ে ইতিহাসের পাঠ নিয়ে আমাদের ইতিহাসবোধ গড়ে উঠেছিল বলে সেকালের বাঙালি বুদ্ধিজীবী ও ধর্মনেতারা বুঝতে পারেননি বাংলার গৌণধর্মের অন্তর্লীন শক্তি আর মানবমুখিনতাকে। চোখে পড়েনি মধ্যযুগের কবীর নানক-দাদু-রজ্জবের সন্ত পরম্পরার ঐহিক বাণীর সঙ্গে বাউলদের চিন্তার সমকত্ব। রবীন্দ্রনাথের অনুভবেই প্রথম ধরা পড়ে গৌণধর্মীদের মহিমা ও সেই একলা-পথ-চলার গরিমা। তিনিই প্রথম বলেন,

বড়ই দুঃখের বিষয় যে আমরা দেশে থাকিয়াও দেশের বিষয় কিছুই জানি না।… বস্তুত আমাদের এইরূপ অজ্ঞতা স্বদেশের প্রতি আমাদের অনুরাগকে বড়ই সংকীর্ণ করিয়া ফেলে।

বাঙালি ছাত্রছাত্রীদের তিনি চোখ ফেরাতে চেয়েছিলেন, ‘দেশের দিকে— চারিদিকে— দেশের মাটির দিকে।’ ‘সমস্ত ভারতবর্ষের মধ্যে যে সমস্ত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ধর্মমত প্রচলিত, অজ্ঞাতে ও অলক্ষিতে যে সকল শক্তি সমাজের মধ্যে’ কাজ করছে তাকে জানতে চেয়েছিলেন। বুঝেছিলেন ‘সমাজের একান্ত আত্ম সংকোচনের অচৈতন্যের মধ্যেও… আত্ম প্রসারণের উদ্‌বোধন চেষ্টা’ রয়েছে নিম্নবর্গাশ্রিত আমাদের গৌণধর্ম সংগঠনের অভ্যন্তরে। সেটাই তার ভারতীয়ত্বের সবচেয়ে বড় প্রতীক।

এখন ছবিটা অনেকটাই বদলে গেছে। বাউল নয় শুধু, সব রকমের নিম্নবর্গের নবচেতনার কথা এখন শিক্ষিত বাঙালি জানতে উৎসুক। সাব-অলটার্ন দৃষ্টিকোণ থেকে ইতিহাসতত্ত্বের যে-নবব্যাখ্যান আর বয়ান তৈরি হচ্ছে আজকাল তার রসদ পাওয়া যাচ্ছে গৌণধর্মীদের আচার আচরণে, বিশ্বাসে ও গানে। উচ্চবর্ণের ও বর্গের ধর্মচেতনার প্রতিবাদ ও সহকারিতা, এই দ্ব্যণুক সম্পর্কের টানাপোড়েন সবচেয়ে স্পষ্টভাবে স্পন্দমান এ রকমের ঊন-ধর্মবোধে। প্রতিবাদের দিকটি সম্পূর্ণ অবারিত ও গানে গানে অভিব্যক্ত। লালন ও দুদ্দু শাহ-র গান এ প্রসঙ্গে সবচেয়ে উদাহরণীয়। সহকারিতার দিকটি একটু ধূসর, তাই সহসা চোখে পড়ে না। কিন্তু লক্ষ করলে অনুধাবন করা যায়, সাম্প্রদায়িক মূর্তিকে ভাঙতে গিয়ে তার বদলে তারা গুরুমূর্তিকে প্রতিষ্ঠা করে বসে, শাস্ত্রের অস্বীকৃতি পরিণতি পায় গুরুবচনের অলঙ্ঘনীয়তায়। সবরকম অধীনতার বন্ধনপাশ ছিন্ন করতে চায় যে-লোকধৰ্ম তা বন্দি হয়ে পড়ে গুহ্য রহস্যময়তায়। বাউলের আসক্তিহীনতা বারবার অপ্রমাণিত হয় তাদের নারীসঙ্গের অতিরেকে। একস্তরের বাউলের উদগ্র যশোপিপাসা আর প্রচারপ্রবণতা ধ্বস্ত করে দেয় তাদের পরম্পরাগত আত্মস্থ ধ্যানতন্ময়তাকে। কেউ কেউ গৃহস্থসুলভ ভোগবাদে স্পৃষ্ট হয়ে পড়ে। অথচ বাউলজীবন আর বাউলগান, নানা বিকৃতিসত্ত্বেও আজ ব্যাপক জনাদরে সচল। আশ্চর্য যে, বাউলের প্রতীক-প্রতিমা একতারা আজ বুদ্ধিজীবীদের গৃহসজ্জার উপাদান!

বাংলাদেশের সদ্যপ্রয়াত মনীষী আহমদ শরীফ দেড়দশক আগে কিছুটা বিস্ময়মুগ্ধ চিত্তে চমকিত হয়ে লিখেছেন:

ইদানীং বাউল মত ও গান আমাদের চেতনায় গুরুত্ব পাচ্ছে। কেবল তাই নয়, নানা কারণে এসব আমাদের ভাবিয়ে তুলেছে। সম্প্রতি প্রাতিষ্ঠানিক প্রচেষ্টায় বিপুলসংখ্যক গান সংগৃহীত হয়েছে। সাড়ে তিনশ বছর ধরে দেশের জন-সমাজের এক অংশ এমনি নিষ্ঠার সঙ্গে যে জীবন-চর্চার এ বিপুল আয়োজনে এতদূর এগিয়ে গেছে, সে সম্পর্কে আমরা অবহিত ছিলাম না। লোকচক্ষুর অন্তরালে লোকান্তরে প্রসারিত জীবন বোধের পরিচয়বাহী এই কাকলিকুঞ্জে প্রবেশ করে, এই সুর-সমুদ্রে অবগাহন করে বিস্ময় মানি।… বিস্ময়মুগ্ধ চিত্তে ভাবছি,— এ নিয়ে আমরা কি করব।… দেশের প্রাকৃতজন যখন ফলপ্রসূ চাষে নিরত, তখন শিক্ষিতগণ নিষ্ফল উদ্যান রচনায় ব্যস্ত। বাউল মত যদি আদ্যিকালের ইতিকথা হত, তা হলে পরিহার-যোগ্য ঐতিহ্য মনে করতাম। কিন্তু আজকের মানুষের এক অংশের জীবন দর্শনের প্রতি এমনি উদাসীন থাকা দায়িত্ববোধের অভাবই জ্ঞাপন করবে।

না, এমন দায়িত্ব বোধের অভাবের পরিচয় আমরা দিইনি। আমরা গত এক দশকে প্রচুর বাউল ও ফকিরি গান গোলাজাত করেছি। তার বিষয়গত বিন্যাস, শ্রেণিকরণ, তার অন্তঃস্থ ইতিহাসের দ্যোতনা, তার প্রতিবাদ ও সমন্বয় বার্তা আমরা পেয়েছি। তৈরি হয়েছে উপেক্ষিত এই ব্রাত্য সমাজের সঙ্গে আমাদের মধ্যবিত্তীয় সতর্ক সমাজের সংলাপের ক্ষেত্র। আবার অতিকৃতিও চলছে নাকি? ক্ষুধার্ত বাউল গায়কদের নিয়ে বিদেশ-বিপণনের ব্যাবসাও আজ আর প্রচ্ছন্ন নেই।

সমাজবিজ্ঞানী পার্থ চট্টোপাধ্যায় একটু রসান দিয়ে মন্তব্য করেছেন: ‘the Baul, of course, having been granted cultural benediction in the twentieth by its elevation to the status of an export item in the Festival of India circuit.’

এই রপ্তানি-যোগ্যতার কারণ বাউলদের বহুবর্ণিল পোশাক, গুপিযন্ত্র, মাথার ধম্মিল্ল ও নাচের চমৎকার ভঙ্গি। একেবারে নিখুঁত শো-পিস। অনুষ্ঠান জমাতে অদ্বিতীয়, গঞ্জিকাপ্রিয় এই খ্যাপা বাউলরা বিদেশের মুক্ত সমাজে ও যৌনস্বাধীন যুবমানসে সাড়া তুলেছে। বাউল গানের তারসপ্তকের স্বর-গ্রাম অনেককে টানে। মুক্ত নির্বাধ জীবনযাপন, নারীসঙ্গিনী গ্রহণ-বর্জনের স্বতশ্চল স্বাধীনতা, ইতিউতি সর্বত্র ঘোরাফেরা, সংস্কারহীন খাদ্যাভ্যাস বাউলদের সর্বজনগ্রহণীয় করে তুলেছে। তবে পট পাল্টাচ্ছে। বাউল বিশেষজ্ঞ অমিত গুপ্ত লক্ষ করেছেন:

মূলত তত্ত্বভিত্তিক হলেও বাউল গানের… সুর ছন্দ, অর্থ ও ব্যঞ্জনায় শুধু রস বিস্তারই নেই অন্য আবেদনও আছে। বুদ্ধিজীবী এবং শ্রমজীবী সবার কাছেই বাউল গান গ্রহণীয়। বাউল গানের ক্ষেত্র ও পরিসর সমাজের পটভূমিতে তাই এত বিস্তৃত।

ভূমিহীন এই সম্প্রদায়ের মূলজীবিকা ছিল মাধুকরী। সারাদিন গ্রামে ঘুরে ঘুরে গান গেয়ে যা উপার্জন করত তা দিয়েই তাদের গ্রাসাচ্ছাদন হত। এদের ঘর বাড়িও ছিলো না। আখড়া বা সাময়িক আস্তানা গড়ে এখানে-ওখানে বসবাস করত। আজকের চিত্রটা ভিন্ন।… জীবিকা হিসাবে বাউল বেছে নিয়েছে গানকে। প্রভাব ফেলেছে। রেডিও, টেলিভিশন, সিনেমা। বিদেশের হাতছানিও বাউলকে প্রভাবান্বিত করেছে।… কৃষিজীবীদের পৃষ্ঠপোষকতার স্থান আজ ধীরে ধীরে চলে যাচ্ছে বুদ্ধিজীবীদের হাতে, বাউলদের ক্ষেত্রে। বাউলদের সাধন-জীবনের মূল্যের চেয়ে অনেক বেশী মূল্যায়ন হয়েছে বাউল গান ক্ষ্যাপা জীবনের নির্যাস, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক শিল্প পণ্য-ক্রেতাদের কাছে।

এখনকার বাউল তথা বাউলজীবন বিষয়ে আধুনিক যুবক-যুবতীদের অনেকে বেশ উৎসাহী। বীরভূমের নানা বাউল সমাবেশে, বিশেষত কেঁদুলির মেলায়, নবীন বয়সের ছেলেমেয়েদের ভিড় চোখে পড়ার মতো। তার সবটাই লোকদেখানি বা অগভীর নয়। বাউলগানের ভেতরকার একটা অনতিব্যক্ত উচ্চারণের ধরন এখনকার কবিদের খুব টানে। বাউলদের অবাধ জীবনযাপনের মুক্তছন্দ, তাদের ছকভাঙার দুঃসাহস, সমাজবন্ধনের প্রতিবাদী স্বাধীন ঘোরাফেরা অনেককে আকর্ষণ করেছে। যেমন সাতকেঁদুরির তরুণ কবি লিয়াকত আলি। এক সময় ছিলেন উদাম বিস্ফোরক রাজনীতিক ঢেউয়ের শীর্ষে। জেল থেকে ফিরে সংস্কার-মুক্ত প্রতিবাদী মনটাকে কোনও রাজনৈতিক মতাদর্শে তেমনভাবে আর রাখতে পারছিলেন না লিয়াকত। সেই সময় বীরভূমের নানা বাউলদের ঠেকে ঘুরে পেয়ে যান চমৎকার এক মানসিক আশ্রয় ও মানবিক আস্থার উৎস। লিয়াকত নিজে বাউল নন, কিন্তু সেই স্রোতোধারার স্বচ্ছ জলে স্নান করে শুদ্ধ। বাউলদের সম্পর্কে তাঁর পর্যবেক্ষণে তাই একটা অন্য বিবেচনা ধরা পড়েছে। লিয়াকত লিখেছেন:

নারী পুরুষের সম্পর্ক একটাই সেটা যৌনসম্পর্ক। এটাই প্রাকৃতিক সম্পর্ক। যা প্রাকৃতিক তাই ধর্ম, তাই সত্য, এর ভালমন্দ ন্যায় অন্যায় হয় না। মানুষ ছাড়া অন্যান্য প্রাণীর নারীপুরুষের সম্পর্ক একরকম। একমাত্র মানুষই নারী ও পুরুষের এক ধর্মীয় ও সামাজিক সম্পর্ক স্বীকার করে নিয়েছে। যেহেতু ধর্মীয় ও সামাজিক সম্পর্ক প্রাকৃতিক নয়— মানুষের বানানো— সেহেতু এর ভুলভ্রান্তি সম্ভব।… বাউলরা এই সত্যটা জানে। আর জানে বলেই তারাই হচ্ছে গুটিকয় সেই মানুষ যারা প্রায় নারী পুরুষের তথাকথিত ধর্মীয় ও সামাজিক সম্পর্ককে অস্বীকার করে বেঁচে আছে। একটা সাধনসঙ্গী নিয়ে কোন বাউল গোটা জীবন কাটায়। আবার অনেকেই দেখা যায় জীবনের বিভিন্ন সময় ভিন্ন ভিন্ন সাধনসঙ্গীর সঙ্গে। কখন যে কার সঙ্গে থাকবে কি পুরুষ কি নারী কেউই জানে না। নতুন কাউকে ভাল লাগলে পুরানোকে ছেড়ে যাওয়াই রীতি। কখনও বা নতুনকে ছেড়ে পুরানোর কাছে ফিরে যাওয়া। যে যখন যার সঙ্গে থাকে, সে-ই তার সুখ দুঃখ ও সাধনার সাথী। যখন থাকে না ভুলে যায় পরস্পরের কথা। স্থায়ী ভাবে ঘর সংসার বলে এদের কিছু নেই। আছে মাথা গোঁজার অস্থায়ী আশ্রয়। যৌথভাবে থাকার সময়ও কেউ কারও উপর তেমন নির্ভরশীল হয়, না, উভয়েই ভিক্ষা করে, উভয়েই খায়। আর এ ভাবে যতদিন বেঁচে থাকে, আকাঙ্ক্ষিত মানুষের সঙ্গসুখ নিয়ে বাঁচে।

এখানে বলে নেওয়া ভাল যে বাউলের কাছে সঙ্গসুখ কথাটা মূল্যবান! তাদের সম্পর্কে মরমি মানুষদের বাউলরা বলে রসিক সুজন। যদিও বাউলদের একান্ত গুহ্য একটা দেহসাধনার ব্যাপার আছে তবু সেটাকে প্রচ্ছন্ন রেখে তারা সকলের সঙ্গে মিশতে পারে। কেননা ঈশ্বরপ্রেম বা জীবে দয়ার বদলে বাউলের মানুষের সম্পর্কে রুচি বেশি। লিয়াকত আলি ঠিকই লক্ষ করেছেন যে দেহসাধনার ব্যাপারেও—

বাউল নিজের অস্তিত্বের প্রকৃতি কি বুঝে তার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে সম্পূর্ণ নিজস্ব ও স্বতন্ত্র এক পথিক। ‘অন্যে ভালো কি খারাপ ভাববে এই আশঙ্কাতে আমরা ঠিক যা করতে চাই কখনো করতে পারি না। এবং এই না পারতে না পারতে একসময় আমরা নিজে নিজের মতো না হয়ে অন্যের মতো হয়ে যাই। লাজ লজ্জা ভয়ের নিকুচি করে বাউল ছাড়া আর কে অন্যের মতো না হয়ে নিজের মতো হয়, হতে পারে? মানুষের কাছে এর চেয়ে মূল্যবান আর কিছু আছে!’ এখানেও বাউল সার্থক। এখানেও তাদের তুলনা নেই।

বাউলদের সম্পর্কে লিয়াকতের যে পক্ষপাত তা নিশ্চয়ই তাঁর একার নয়। আমাদের মধ্যে যারা একটু সমাজছুট, মুক্ত স্বভাবের বা স্বচ্ছ চোখে জীবনকে নীতির ঊর্ধ্বে দেখতে আগ্রহী, বাউল জীবন তাদের রোচক হতে বাধ্য। শুধু বাউল কেন বাংলা চৈতন্যপরবর্তী অনেকগুলি গৌণ ধর্মে এই জীবনধর্মিতা ও মানবমুখিনতা আছে। কর্তাভজা, সাহেবধনী, বলরামী, লালনশাহী, সহজিয়া বৈষ্ণব— এ সব নানা ধারাপ্রবাহে বয়ে চলেছে মানবচেতনার বেগবান স্রোতস্বিনী। বেগবান কিন্তু বহুক্ষেত্রে অন্তঃশীল, গোপন ও গূঢ়। একদিক থেকে ভাবলে এই সব কায়াবাদীরা আসলে ডি-ক্লাসড, শ্রেণিবর্ণহীন। ইহজীবন ও দেহজীবনের দ্বন্দ্বে-ছন্দে তাদের অনুরাগী দোলাচল। একটা অস্ফুট রহস্যের হাতছানি, অন্বিষ্টের জন্য এক মমতাময় আততি তাদের ছন্নছাড়া মন্ত্রহীন ব্রাত্যজীবনের দিকে অমোঘ টানে টেনেছে। অস্পষ্ট পরলোক নয়— বর্তমান জীবনযাপন, অস্বচ্ছ ঈশ্বর নন— প্রত্যক্ষ নরনারী, পূণ্যব্রত উপবাস তীর্থ মন্দির নয়— দৃঢ় সম্মিলিত সুস্থযৌনতার স্বীকৃতি, তাদের লক্ষ্য।

কিন্তু বাউলদের নিয়ে গত এক শতক বাঙালির ভাবালুতার শেষ নেই। ১৮৯০ সালের লালন শাহ-র প্রয়াণের পর তাঁকে নিয়ে বাউলপক্ষীয় ও বাউলবিরোধী দুটি দলই সক্রিয় হয়ে ওঠে। কলকাতার উচ্চমহলে ও বাংলার শিক্ষিতসমাজে বিশেষত ঠাকুরবাড়ির প্রয়াসে এবং রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিগত উদ্যমে ছাপার অক্ষরে লালনের গান ও তার মর্মরস প্রচারিত হয়। শুরু হয়ে যায় বাউল গান সংগ্রহ ও সংকলনের নানামুখী উদ্যম। গড়ে ওঠে কয়েকটি শখের বাউলের দল। ক্রমে ক্রমে নানা গৌণধর্ম ও সম্প্রদায় একই সঙ্গে ‘বাউল’ এই সাধারণ (Generic) ও বিশেষ (Specific) সংজ্ঞায় আবদ্ধ হয়ে যায়। বাউল সুর বলে একটা অলীক অনির্ণীত ধরন বাংলা গানে চেপে বসে। আজ সময় এসেছে তথ্য ও যুক্তি অবলম্বন করে ইতিহাসের পথে বাংলার বাউলদের স্বরূপসন্ধান। সে কাজ বেশ কঠিন।

কঠিন এইজন্য যে, বাউলদের সম্পর্কে আমাদের কৌতুহল নানা অলীক ধারণা ও অনুমানাত্মক সংজ্ঞার জন্ম দিয়েছে। মধ্যযুগের একটি বাংলা কাব্যে ‘বাউল’ শব্দটি ব্যবহৃত হতে দেখে অনেক পণ্ডিত অনুমান করে বসেছেন যে বাউল ধর্ম সুপ্রাচীন। কিন্তু বাউল কি কোনও ধর্ম? মূলে সেই কথাটারই এখনও মীমাংসা হয়ে ওঠেনি। বাউল কি একটা মৌলিক শব্দ না নিষ্পন্ন শব্দ? এ প্রশ্ন ওঠে এই কারণে যে অনেকে মনে করেন বাউল কথাটা ‘বাতুল’ থেকে এসেছে। বাতুল মানে পাগল। অন্য একদল মনে করছেন বাউল এসেছে ‘ব্যাকুল’ শব্দ থেকে, কেননা বাউলরা আত্মানুসন্ধানে ব্যাকুল। ক্ষিতিমোহন সেনের মতো বাউলবিশেষজ্ঞ মনে করছেন: তাঁহারা মুক্ত পুরুষ, তাই সমাজের কোনো বাঁধন মানেন নাই। তবে সমাজ তাঁহাদের ছাডিবে কেন? তখন তাঁহারা বলিয়াছেন, “আমরা পাগল আমাদের কথা ছাড়িয়া দাও। পাগলের তো কোনো দায়িত্ব নাই।” বাউলের অর্থ বায়ুগ্রস্ত, অর্থাৎ পাগল।’

এই কথাটার ধরতাই মেনে একজন লিখলেন বায়ু + ল = বাউল। আরেকজন বললেন, হিন্দি ‘বাউর’ বাংলায় হয়েছে বাউল। চৈতন্যচরিতামৃত গ্রন্থে ‘ঈশ্বরপ্রেমে মাতাল, বাস্তবজ্ঞান বর্জিত, উদাসীন ভক্ত’, এই অর্থে নাকি বাউল শব্দ একাধিক স্থানে ব্যবহৃত হয়েছে, বলেছেন অধ্যাপক অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়। আরবি-পারশি ভাষায় পণ্ডিত হরেন্দ্রচন্দ্র পাল মনে করছেন ‘আউলওয়লী’ শব্দ থেকে আউল-বাউল শব্দের জন্ম। গীতিকার দুদ্দু শাহ গানে বলেছেন: ‘যে খোঁজে মানুষে খোদা সেই তো বাউল।’ একজন বলেছেন আরবিতে ‘বা’ মানে আত্ম, ‘উল’ মানে সন্ধানী, অর্থাৎ বাউল মানে আত্মানুসন্ধানী।

এসব আধুনিক কালের পণ্ডিতি কচকচি ছেড়ে উনিশশতকীয় পণ্ডিতদের বইয়ের পাতা ওলটালে দেখা যাবে, তাঁরা বাউল শব্দের উৎপত্তির চেয়ে তাদের আচার-আচরণ সম্পর্কে নানা অদ্ভুত মন্তব্য বা ধারণা রেখে গেছেন। যেমন অক্ষয়কুমার দত্ত তাঁর ‘ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায়’ বইতে বাউলদের সম্পর্কে এতদূর লিখেছেন যে, ‘শুনিতে পাই ইহারা নরবধ করে না; মানুষের মৃতদেহ পাইলে ভক্ষণ করিয়া থাকে।’ পণ্ডিত যোগেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য লিখেছেন, বাউল— ‘a mad man, A class of beggars who pretend to be mad on account of religious fervour, and try to uphold their pretention by their fantastic dress, dirty habits and queer philosophy of their songs.’ বসিরহাটের কাজি মৌলবী কেরামতউল্লা ও গোলাম কিবরিয়া ‘উচিত কথা’ বইতে আরেক নতুন তথ্য যোগ করে বলেছেন, বাউলদের মতে আসল ফকিরি-তত্ত্ব চারটি, যেমন—

আউলে ফকির আল্লাহ বাউলে মোহম্মদ

দরবেশ আদম ছফি এই তক হদ।

তিনশত একসাত করিয়া যে আলি

প্রকাশ করিয়া দিল সাঁই মত বলি।

এই পদ্যাংশ থেকে আউল, বাউল, দরবেশ, সাঁই— চারটি ধারার খবর মেলে। যাঁরা এক সময় অখণ্ড বাংলায় বাউল-বিরোধী আন্দোলন করেছিলেন সেই শরিয়তবাদী আলেম মুসলমানরা আউল-বাউল-সাঁই-দরবেশ সকলকেই কচুকাটা করেছেন। কারণ বিশ শতকের সূচনায় উত্তরবঙ্গে বিশেষ করে মুসলমানদের মধ্যে বহু লোক এসব মরমি ও কায়াবাদী সাধনার পথে চলে যাচ্ছিলেন। বাধ্য হয়ে রংপুর জেলার বাঙালিপুরের মৌলবী রেয়াজউদ্দিন আহমদ ‘বাউল ধ্বংস ফৎওয়া’ অর্থাৎ ‘বাউল মত ধ্বংস বা রদকারী ফৎওয়া’ জারি করে হুঁশিয়ারি দেন:

বাউল বা ন্যাড়াদের আচার ব্যবহার সম্বন্ধে বঙ্গের অধিকাংশ লোকেই অবগত আছেন; তাহাদের দ্বারা মোছলমান সমাজের যে ভীষণ ক্ষতি হইতেছে, তাহা কাহারও অবিদিত নাই। দীর্ঘকাল হইতে বাউল ন্যাড়াগণ মোছলমানের চক্ষে ধূলি দিয়া তাহাদের ঘৃণিত আচার ব্যবহার গুপ্তভাবে করিয়া মোছলমান সমাজের মেরুদণ্ডকে ক্ষয় করিয়া আসিতেছে। ইহারা ভিতরে অমোছলমান, বাহিরে মোছলমানী নামে নাম, মোছলমান মহল্যায় বাস, মোছলমান কন্যাগণের সহিত বিবাহসাদী ও মোছলমানের সকল প্রকার সামাজিকতায় ভুক্ত। এই অপরিচিত অপ্রকাশ্যভাবে ইহাদের মোছলমানের সহিত মেলামেশার ফলে দলে দলে অশিক্ষিত মোছলমান ইহাদের ধোকাবাজী বুঝিতে না পারিয়া সনাতন এছলাম ধর্মকে ও পবিত্র কোরাণকে ত্যাগ করতঃ কাফের মোরতেদ হইয়া যাইতেছে।… এখনও কি তুমি বাউল ফকিরদিগকে মোছলমান বলিয়া জানিবে? এই কি তোমার এছলামী ঈমান ও মোছলমানী প্রাণের টান? তোমার বেখবরী ও হেশ্‌কারী হেতু তোমার অধীনস্থ কোন মোছলমান যদ্যপি বাউল মত গ্রহণ করিয়া পবিত্র এছলাম হইতে খারিজ হয় সেজন্য কি তুমি খোদা ও রছুলের নিকট দায়ী নহ?

এখানে বাউলদের গায়ে গায়ে জড়িয়ে আছে ‘ফকির’ শব্দ। শরিয়ত-সন্দিহান মুসলমানরা যখন মারফতি পথ বেছে নেয় তখন তাদের ফকির বলে। একসময় তাদের বাউলদের সঙ্গে এক উচ্চারণে শনাক্ত করা হয়েছে। খুব একটা বিতর্কের ঝুঁকি না নিয়ে আমরা বরং বলি যে বীরভূমের বাউল বা রাঢ়ের বাউলদের সঙ্গে উত্তর ও মধ্যবঙ্গের ফকিরদের অনেক ফারাক। দুজনের সামাজিক ভূমিকা কি আজ এক রকমের? পায়ে হেঁটে খোলাচোখে দেখেছি রাঢ়খণ্ডে বাউলরা জনজীবনের স্বাভাবিক ও অচ্ছেদ্য অংশ। তারা ভিক্ষা পায়, বৈষ্ণব সমাবেশে সাদর আহ্বান পায়; গান গাইতে প্রতীচ্যে যায়, তাদের প্রভূত মান্যতা। তুলনায় নদিয়া-মুর্শিদাবাদের বাউল ফকিররা অনেক নিম্নবর্গে, সামাজিক হীনতা নিয়ে দারিদ্র্যে দুঃখে বেঁচে আছে। কিন্তু কণ্ঠে তাদের গানের জোয়ার। সিউড়ির কাছে সাম্বৎসরিক পাথরচাপুড়ির মেলায় ফকিরদের মর্মন্তুদ দারিদ্র্য ও গীতিমুখরতা একই সঙ্গে দেখা যায়।

আমি বোঝাতে চাইছি, বাংলার বাউল বলতে কোনও স্পষ্ট ও নির্দিষ্ট ধারণা করে নেওয়া জটিল কাজ। তাদের স্বরূপ স্বভাব ও ক্রিয়াকরণ যেন নানা কাপড়ের টুকরোয় বানানো দরবেশি পোশাকের মতো বিচিত্র ও বর্ণিল। নানা ধারা মিলে মিশে বাউল ধরন গড়ে উঠেছে। আজ তাকে প্রত্যক্ষ সংজ্ঞার সীমায় বাঁধা ঠিক হবে না। মধ্যপন্থী ও বিবেচক পণ্ডিতরা তাই সিদ্ধান্ত করেছেন যে মধ্যযুগীয় বাংলায় নানা রকম লোকায়ত ও শাস্ত্রবিরোধী ধ্যানধারণা বাউল মতের পরিবর্ধন ও প্রসাধনে সাহায্য করেছে। বৌদ্ধ সহজিয়া, বৈষ্ণব সহজিয়া, নাথপন্থ, তন্ত্র ও সুফিবাদ মিলে মিশে এক অদৃশ্য দ্রবণে জন্মেছে বাউল ফকিরদের রূপময় জগৎ। আত্মার চেয়ে দেহ, জাতিবর্ণ দ্রোহ, মন্দির মসজিদের চেয়ে গুরুর নির্দেশ, শাস্ত্রের চেয়ে আত্ম-অনুজ্ঞা— এই দেশে তো নতুন নয়। হয়তো সেই লোকায়তিক পরম্পরার এক সমৃদ্ধ উদ্ভাস বাংলার বাউল। সাধারণভাবে ক্রিয়াকরণ, গানের অন্তর্জগৎ বা আচরণ থেকে বাউলদের সকলে চিনে নিতে পারেন। কিন্তু তাঁরা আত্মসাবধানী, সন্ধ্যাভাষী, ইঙ্গিতগ্রাহী। আপন মর্মকে তাঁরা ধর্মের ক্রিয়াপরতায় বোঝাতে চান না। তবে তাঁদের বহির্বাস খুব ইঙ্গিতধর্মী ও সুনির্দিষ্ট। কর্তাভজা-সাহেবধনী-বলরামীদের কোনও নির্দিষ্ট পোশাক নেই। বৈষ্ণব সহজিয়ারা সাধারণত সাদা পোশাক পরেন। কিন্তু বাউলদের একটা নির্দিষ্ট বহিরাবয়ব আছে। বেশ কিছুকাল আগেকার একটা বর্ণনা থেকে বাউলদের বিবরণ উদ্ধৃত করছি—

কেশ বিন্যাস দেখিলেই বিলক্ষণ চিনা যায়। পরিধানে গেরুয়াবসন, হস্তে লৌহবালা, বগলে দীর্ঘ চিমটা, গলে পাথুরিয়া মালা, আর একটা হুঁকাতে লম্বা নল লাগানো, তাহাতে এক কলিকা গাঁজা সাজিয়া, জয় বোবুম বোবুম গুরু সত্য বলিয়া চক্ষু দুইটি মুদ্রিত করিয়া, সেই গাঁজায় দোম দিতে থাকে।

অক্ষয়কুমার দত্ত তাঁর ‘ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায়’ বইতে একশো বছর আগেকার বাউলদের বর্ণনা দিয়ে গেছেন এই রকম—

এই সম্প্রদায়ীরা তিলক ও মালা ধারণ করে এবং ওই মালার মধ্যে স্ফটীক, প্রবাল, পদ্মবীজ, রুদ্রাক্ষ প্রভৃতি অন্যান্য ও বিনিবেশিত করিয়া রাখে। ডোর কৌপিন ও বহির্বাস ধারণ করে এবং গায়ে খেলকা পিরাণ অথবা আলখাল্লা দিয়া ঝুলি, লাঠি ও কিস্তি সঙ্গে লইয়া ভিক্ষা করিতে যায়।… ক্ষৌরি হয় না, শ্মশ্রু ও ওষ্ঠলোম প্রভৃতি সমুদয় কেশ রাখিয়া দেয় এবং মস্তকের কেশ উন্নত করিয়া একটি ধম্মিল বাঁধিয়া রাখে।

অক্ষয়কুমারের এই বর্ণনায় একটা বড় ফাঁক থেকে গেছে। বলা হয়নি যে এসবের সঙ্গে থাকে বাউলদের অচ্ছেদ্যসঙ্গী একতারা ও ডুগি, খমক, সারিন্দা বা দোতারা। কেউ কেউ গলায় কণ্ঠি পরেন, কেউ করেন তিলকসেবা। সেই সঙ্গে থাকে নারীসঙ্গী এবং কণ্ঠে ভাবের গান, যার বাণীতে-কূট রহস্যের অতল ব্যঞ্জনা। বাংলা গানের সুদীর্ঘ ও সমৃদ্ধ ধারাবাহিকতায় বাউলরা এক ধরনের গান সংযোজন করে চলেছেন, যা এই সম্প্রদায় লুপ্ত হয়ে গেলেও থেকে যাবে। কিন্তু বাউলদের পরিচয় একটু অন্য দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা জরুরি। প্রথমে তাঁদের বহির্বাস প্রসঙ্গে লক্ষ করা যেতে পারে।

বাউল ফকিরদের জীবনের সঙ্গে বহুদিন সংসর্গকারী সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ ১৯৮৭ সালে আমাকে এক ব্যক্তিগত চিঠি লেখেন যাতে তাঁর কতকগুলি নিজস্ব পর্যবেক্ষণ এখানে প্রাসঙ্গিক বলে প্রকাশ করছি। সিরাজ লিখেছিলেন: ‘যে বাউলমেলায় তেরাত্তির কাটিয়েছিলাম তাদের অনেকের পরনে গায়ে হলদেটে লাল, কারুর বা স্রেফ গৈরিক, কারুর তালিমারা (সংখ্যাও নাকি ওদের রহস্যময় সংখ্যাবাচক), কারুর সাদা এবং কারুর কালো পোশাক ছিল। পূর্ণদাস প্রমুখ শৌখিন শহুরে বাউলের যে পোশাক তা একান্তভাবে সুফি পোশাক, বৈরাগ্যের প্রতীক গৈরিক, এই Cliche-টি নিছক কবিকল্পনা, সম্ভবত রবীন্দ্রনাথ-সূত্রে এর প্রাদুর্ভাব। হিন্দু সাধুর পরনে সেলাই-করা পোশাকের আগমন এ যুগে বলেই মনে হয়। কারণ হিন্দুশাস্ত্রে সেলাই করা পোশাক নিষিদ্ধ ছিল। লক্ষ করবেন দর্জি শব্দের কোনও বিকল্প শব্দ ভারতীয় প্রাচীন ভাষায় নেই। সীবনকার অর্বাচীন কৃত্রিম শব্দ।’

বাউলদের ব্যাপারে দ্বিতীয় যে-চিন্তাভাবনা বহু মানুষের মনে তাঁদের সম্পর্কে কৌতূহল অথবা ঘৃণা টেনে এনেছে সেটা ‘চারিচন্দ্রভেদ’ অর্থাৎ মল মূত্র রজ বীর্য পান। বাউল তো শুধু নয়, আমাদের কায়াবাদী সাধকদের অনেকে ‘দুইচাঁদ’ (মলমূত্র) বা চার চাঁদের চর্চা করেন। এ তো বহু শত বছরের ধারা। এককালে বাউলদের ‘মুতখেকো’ বলা হয়েছে। তাঁদের এই বিচিত্র সাধনাকে ‘কদর্য’ ‘বীভৎস’ ‘জঘন্য’ এইসব নিদাত্মক বিশেষণে ঘৃণা করা হয়েছে। এ সম্পর্কে শেষ কথা বলা কঠিন। সভ্যরুচি ও উন্নত জীবনবোধ দিয়ে সব কিছুর মীমাংসা করা যায় কি? বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত ‘বাউলদের যৌনজীবন ও জন্মনিয়ন্ত্রণ’ বলে একটা রচনা থেকে এখানে উদ্ধার করছি। বলা হচ্ছে:

একটি সত্য এই যে মানুষের শরীরে দুটি চেতক এন্টিজেন আছে যা শরীরের প্রতিরোধ পদ্ধতির (Immunological system) অন্তর্ভুক্ত নয়। এই দুটি হল চোখের জলের জলীয় পদার্থ বা অশ্রু এবং বীর্য। আমাদের চোখের জলীয় অংশ বা শুক্রের অংশ কোনক্রমে রক্তে মিললে বিশেষ এন্টিবডি উৎপন্ন করতে পারে। সম্ভবত ঐ বীর্যপানরত পুরুষ নিজের বীর্যদ্বারাই শরীরে এন্টিবডি উৎপন্ন করবে এবং তাতে শুক্রাণুর উৎপাদন অবশ্যই অল্প হবে। তাই দেখা যায়, বাউলদের সন্তান সংখ্যা অত্যন্ত অল্প। তবে স্মরণযোগ্য, নারী কখনও এই বীর্যপান করে না।

বাউল মতের আন্তঃশরীরে যৌন যোগাচারের লক্ষণ যেমন স্পষ্ট তেমনই শ্বাসের নিয়ন্ত্রণ খুব গুরুত্ব পেয়ে এসেছে। উভয়ক্ষেত্রেই গুরুর ভূমিকা অত্যন্ত জরুরি। এই দুই দিক বিবেচনা করলে বাউল মতে সহজিয়া বৈষ্ণব ও সুফিতত্ত্বের প্রভাব চোখে না পড়ে পারে না। গুরুর নির্দেশে যোগক্রিয়া ও মৈথুন বাউলবর্গের লোকধর্ম সম্প্রদায়কে বিশিষ্টতা দিয়েছে। এই প্রক্রিয়ার সফল প্রয়োগের ফলে খাঁটি বাউলদের সন্তান জন্মায় না। অনেক বাউলধারা আছে যেখানে গুরুর শিষ্যরাই পরম্পরা বজায় রাখেন। সন্তান-পরম্পরার চেয়ে শিষ্য-পরম্পরা তাই বাউলদের কোনও কোনও স্রোতে প্রাধান্য পায়। বাউলরা বিশ্বাস করেন, দেহভাণ্ডে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের প্রতিরূপ রয়েছে এবং আত্মা কোনও অলৌকিক বস্তু নয়, তার উপলব্ধি ও উপস্থিতি দেহেই লভ্য। সেইজন্যই বাউলগান প্রধানত দেহতত্ত্বের গান। নিজের দেহকে জানা, তাকে নিয়ন্ত্রণ করা, তার মধ্যে দিয়ে আনন্দস্বরূপের আস্বাদন— এসবই বাউলের লক্ষ্য। তারই নানা ইঙ্গিত ও দ্যোতনা রয়ে গেছে কয়েক শতকের বাংলা গানে। ভাবের দিক থেকে তাই বাউল গান নানা মাত্রায় বাংলা গানকে সমৃদ্ধ করেছে। লালশশী, লালন, পাঞ্জু শাহ, হাউড়ে গোঁসাই, কুবির, যাদুবিন্দু, জালাল, দীন শরৎ, রশীদ, দুদ্দু, রাধারমণ, ফুলবাসউদ্দিন, দুর্বিন শাহ, পদ্মলোচন, শীতলাং শাহ, হাসন রজা থেকে আজ পর্যন্ত প্রবাহিত বাউলবর্গের গান আমাদের সগর্ব অর্জন। এঁদের সবাই হয়তো পরম অর্থে বাউল নন, কিন্তু বাউলদের কাছে শ্রদ্ধেয় ও গ্রহণীয়। আরেকটা সত্য হল, বাঙালির সামাজিক ইতিহাসে বাউলদের আচরণ ও চারচন্দ্র নিয়ে তর্ক বা মতান্তর থাকলেও বাউল গান নিয়ে কোনও তর্ক ওঠেনি। নিম্নবর্গ থেকে উচ্চবর্গ পর্যন্ত বাউলগানের স্বতঃস্ফূর্ত চলাচল চলছে প্রায় শতবর্ষ ধরে। রবীন্দ্রনাথ নিজেও বাউল গানের ভাবমুল্যে ও ছন্দে আকৃষ্ট হয়েছিলেন এবং দেশবাসীকে প্রথম সচেতন করেছিলেন বাউলগানের নিজস্বতা ও গুরুত্ব সম্পর্কে। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময়ে তিনি যে সব অভিনব স্বদেশি গান লেখেন তার সুরকাঠামোয় বাউল গানের স্পন্দ ও উদ্দীপনা অত্যাশ্চর্য নৈপুণ্যে ব্যবহার করেন। পরে তাঁর গানে বাউল গানের অন্তর্জগতের গভীর বাণী ছাপ ফেলেছে। তাঁর কোনও কোনও রচনাকে তিনি এমনকী ‘রবীন্দ্রবাউলের রচনা’ বলে মেনে নিয়েছেন। কিন্তু তাঁর নাটকে বাউল চরিত্র সর্বদাই একক, তার নারীসঙ্গিনী নেই। অথচ বাউলের সাধনা সর্বদাই যুগলের রসরতি।

এই প্রসঙ্গে একটা বিতর্কযোগ্য প্রসঙ্গ সেরে নেওয়া যেতে পারে। ববীন্দ্রনাথের প্রণোদনায় ক্ষিতিমোহন সেন মধ্যযুগের সত্তসাধকদের সাধনার স্বরূপ সন্ধানে ব্যাপৃত হন এবং সেই সূত্রে বাংলা বাউলদেব লুপ্তস্রোতের কিছু পরিচয় ব্যক্ত করেন লেখালেখি করে। ১৯৪৯ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের লীলা বক্তৃতায় তিনি বিষয়রূপে বেছে নেন ‘বাংলার বাউল।’ তাঁর লেখায় পূর্ব ও উত্তরবঙ্গের বহু অজানা বাউলের খবর মেলে। যেমন কুষ্টিয়ার পাঁচু ফকির, রাজবাড়ির মেছেলচাঁদ, ঢাকা জেলার শাহনাল, ধামরাই টাঙাইলের পাগলচাঁদ। তার মতে: ‘বাংলা ভাষার আরম্ভ হইতেই বাউলের পরিচয় মেলে। তবে গুরু পরম্পরা একবার খোঁজ করিয়া (১৮৯৮ সাল) ১২/১৩ পুরুষ পর্যন্ত কোন মতে পাইয়াছিলাম।’ ক্ষিতিমোহন জানিয়েছেন তিনি কাশীতে প্রথম বাউল দেখেন নিতাইকে, পরে ঢাকা জেলার রাজবাড়িতে পরিচয় হয় দাশু বাউলের সঙ্গে। দাশুর আখড়ায় পরিচয় ঘটে দুর্লভ ও বল্লভের সঙ্গে ‘তাঁহাদের কাছেই আমি বড় বড় দুইটি বাউলধারা ও বহু বাউল গানের সন্ধান পাই।’ যাই হোক ক্ষিতিমোহন সেন তাঁর ভাষণে মদন, ঈশান যুগী, গঙ্গারাম, বিশা ভূঁইমালি, জগাকৈবর্ত প্রমুখের হালহদিশ দেন। তাঁদের গানের নমুনা পেশ করেন। এঁদের বাউল পদাবলি পড়ে রবীন্দ্রনাথ আকৃষ্ট হয়ে ক্ষিতিমোহনকে বলেন— ‘এমন সহজ এমন গভীর, এমন সোজাসুজি সত্য এত অল্পকথায় এমন অপূর্বভাবে প্রকাশ করিবার শক্তি আমাদেরও নাই। আমার তো ইঁহাদের রচনা দেখিয়া রীতিমতো হিংসা হয়।’

রবীন্দ্রনাথের ঈর্ষাযোগ্য এমন বাউলপদ পরে কয়েকটি রবীন্দ্র বক্তৃতায় ও রচনায় উদ্ধৃত হয়েছে। বাকি সংগ্রহ যা ক্ষিতিমোহনের ছিল তা তিনি প্রকাশ করতে চাননি। চারু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘বঙ্গবীণা’-য় ক্ষিতিমোহন সংগৃহীত ন’খানি বাউলগান সম্পূর্ণ মুদ্রিত হয়েছিল। বাংলার বাউলদের সম্পর্কে সবচেয়ে বিস্তারিত ও সুবৃহৎ বইটি যার লেখা সেই উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য নির্দ্বিধায় ঘোষণা করেছেন যে ক্ষিতিমোহন সংগৃহীত গানগুলি নির্ভরযোগ্য বাউল গান নয়, তাঁর কথিত বাউলদের অস্তিত্ব ও বিবরণ সন্দেহজনক। উপেন্দ্রনাথের প্রশ্ন ও মন্তব্য একটু তুলে দিচ্ছি— ‘বাংলার এ কোন্‌ অবাস্তব বাউলদের কথা তিনি আমাদিগকে শুনাইতেছেন? ইঁহারা কাহারা? কোথায় ইঁহাদের বাড়ি? ইঁহাদের কি কখনও বাংলায় আবির্ভাব ঘটিয়াছিল?’

এমন মারাত্মক প্রশ্নবাণ নিক্ষেপ করে সবশেযে উপেন্দ্রনাথ দুটি সিদ্ধান্তে এসেছেন। প্রথমত, ‘ক্ষিতিমোহন বাবর গান কয়টি সারা বাংলায় প্রাপ্ত বাউল গান হইতে সম্পূর্ণ ভিন্ন পর্যায়ের।’ দ্বিতীয়ত, ‘বাংলার বাউলদের যে সাধন তত্ত্ব ও সাধন পদ্ধতির কথা ক্ষিতিমোহনবাবু তাঁহার দুইটি প্রবন্ধে বলিয়াছেন, তাহা বাংলায় বর্তমানে যে বাউলদের দেখিতেছি ও যাহাদের গান পাইতেছি, তাহাদের সম্বন্ধে ঠিক খাটে না।… বাংলার বাউলদের সম্বন্ধে এই মতবাদগুলি তিনি কোথায় পাইলেন?’ অভিযোগ দুটি গুরুতর। সেই সঙ্গে ক্ষিতিমোহন সংগৃহীত গানগুলির বাণী বিষয়ে উপেন্দ্রনাথের মন্তব্য: ‘বাংলা সাহিত্যের সহিত যাঁহারা পরিচিত, তাঁহারা একবার পড়িলেই বুঝিতে পারিবেন যে এই গানগুলির মধ্যে যথেষ্ট “আধুনিক হস্তক্ষেপ” আছে এবং ইহা পল্লীর অশিক্ষিত বা সাবেকী ধরণের অশিক্ষিত বাউলদের রচনা নয়।’ সাধারণ পাঠকদের অবগতির জন্য উপেন্দ্রনাথের সন্দেহসংকুল কয়েকটি মন্তব্য উদ্ধৃত করছি—

১) ‘নিঠুর গরজী, তুই কি মানসমুকুল ভাজবি আগুনে।’ (উপেন্দ্রনাথের মতে মানসমুকুল এই সমাসবদ্ধ অলংকার সৃষ্টি আধুনিক রচনারীতি। তেমনই সন্দেহজনক, গানের অন্তর্গত ‘যুগযুগান্তে’ এবং বেদনা না লিখে ‘বেদন’ শব্দের ব্যবহার)

২) ‘হৃদয়কমল চলতেছে ফুটে কত যুগ ধরি। তাতে তুমিও বাঁধা আমিও বাঁধা উপায় কি করি।’—এ গানের দার্শনিকতার সঙ্গে বাংলার বাউল ধর্মের কোনও যোগ নেই, এ রচনাভঙ্গিও সম্পূর্ণ আধুনিক কালের— অভিযোগ উপেন্দ্রনাথের।

৩) ‘তারে অরুণ এসে দিল দোলা রাতের শয়নে’— (‘লাইনটি নিতান্ত অতি আধুনিক গন্ধী’)।

৪) ‘আমার ডুবলো নয়ুন রসের তিমিরে/ কমল যে তার গুটালো দল আঁধারের তীরে। উপেন্দ্রনাথের মন্তব্য: ‘এইরূপ বাক-চাতুর্য ও কল্পনা আধুনিক কালের কবিদের রচনা ছাড়া বর্তমানে বাউলদের গানে মিলে না, তাহা এই পনেরো-ষোল বছর ধরিয়া প্রায় দেড় সহস্র বাউলগান সংগ্রহ ও পর্যালোচনার অভিজ্ঞতার ফলে বুঝিতে পারিতেছি।’

এমন স্পর্শকাতর প্রসঙ্গ এবং ভয়ানক অভিযোগ সম্পর্কে আমরা নিজস্ব কোনও মতামত বা নতুন বিতর্ক তুলব না। কেবল ‘বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত’ তৃতীয় খণ্ডে ব্যক্ত অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের বক্তব্য পেশ করব। তিনি বলছেন:

এই গানগুলির প্রামাণিকতা সম্বন্ধে ডঃ ভট্টাচার্যের সংশয় নিশ্চয় সুধীজনের চিন্তা উদ্রেক করিবে… অবশ্য অবিশেষজ্ঞ হইয়াও বলিতে বাধা নাই যে, উল্লিখিত চার ও পাঁচ সংখ্যক গান (‘আমি মজেছি মনে/ না জানি মন মজল কিসে আনন্দে কি মরণে’ এবং ‘আমার ডুবলো নয়ন রসের তিমিরে’) দুইটির ভাব ভাষা ও প্রকাশভঙ্গিমা আধুনিকমনা সুশিক্ষিত ব্যক্তির রচনা বলিয়া মনে হইতেছে।

অনির্ণীত এবং অমীমাংসিত এক সমস্যা বাংলার বাউল গানের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। এর থেকে সন্দেহ না জেগে পারে না যে, বাউল গান বলে বিপুলাকার সংকলনবদ্ধ যে অজস্র গান আমরা হাতে পেয়েছি তার সব প্রামাণিক ও খাঁটি বাউলের রচনা তো? কথাটা ওঠে আরও এজন্য যে, উনিশ শতকে ‘সখের বাউল’ নামে একাধিক বাউল বা বাউলের দল প্রচুর গান লিখে গেয়ে বেড়াতেন। তার সবচেয়ে সফল নমুনা মেলে কাঙাল হরিনাথ বা ফিকিরচাঁদের গানে। বাউল না হয়েও তিনি উৎকৃষ্ট বাউল গান লিখেছেন। বাংলার বাউলগানের ধারা এ সব গানেও সম্পন্ন ও সমৃদ্ধ হচ্ছে। কিন্তু প্রকৃত বাউল গান— সাধনা-লব্ধ ও পরম্পরাজাত ক্রমশ নকলের ভিড়ে হারিয়ে যাচ্ছে।

‘বাংলার বাউল’ কথা দুটি যতটা উত্তেজক ও আকর্ষণময়, তেমনই অতল আর সমস্যাবহুল। বাউল কে, বাউল কী, বাউল কোথা থেকে, কবে থেকে, এ সব প্রশ্ন যদি বা মেটে তারপরে নতুন প্রশ্নের জট তৈরি হয়। আঠারো উনিশ শতক থেকে দীপ্যমান বাংলার বাউল বিশ শতকের রসিক ও বুদ্ধিজীবীদের আগ্রহ ও গবেষণার বিষয় হয়ে উঠেছে। এককালে ভদ্রলোকশ্রেণি তাদের ঘৃণার চোখে দেখেছেন, নৈষ্ঠিক মুসলমানরা ফতোয়া জারি করেছেন ধ্বংসের, তবু তারা নানা লোকায়ত বর্গের ধারার সঙ্গে গা ঢেলে দিয়ে অবিনাশী উদ্ভিদের মতো বেঁচে বর্তে আছে। একেবারে হালফিল, দু’-এক দশক, বাংলার বাউল সারাদেশে ও বিদেশে অভূতপূর্ব মান্যতা পাচ্ছে। এরা যতটা বাউল সাধক তার চেয়ে বড় গায়ক। যেমন পূর্ণদাস, পবনদাস বা আরও অনেকে। ব্যঙ্গ করে এদের বাংলার বা ভারতের সাংস্কৃতিক রপ্তানিযোগ্য বলেছেন কেউ কেউ। সেই অত্যুক্তি না হয় আমরা গায়ে নাই-বা মাখলাম, কিন্তু বাংলার বাউল নিজের মোপেডে ঘুরবেন, সঙ্গে বিদেশিনী, দৃশ্যটি বেশ অভিনব। অভিনব, কেননা আবহমান বাউলের সাধনা তো মগ্নতার, আত্মগোপনের। তাঁরা ভিক্ষাজীবী, আখড়াধারী বা গরিব গৃহী। বাউলরা বরাবর নিজেদের মধ্যে গুটিয়ে থেকে কায়সাধনা ও গান গেয়ে এসেছেন। বাসাছাড়া পাখির মতো বন্ধনহীন তাঁদের জীবনে পথ চলাতেই সমধিক আনন্দ। আর ছিল কতই মেলা— কেঁদুলি, রামকেলী, দধিয়া বৈরেগীতলা, পাথরচাপুড়ি, সোনামুখি, কোটাসুর, অগ্রদ্বীপ, ঘোষপাড়া। ওদিকে মানভূমের খাতরা, কুষ্টিয়ার ছেঁউড়ে, রাজশাহীর খেতুরী বা প্রেমতলী। এসব মেলায় সারা দেশের বাউলরা এসে মিলতেন, গান হত সারারাত— তত্ত্বগান, ভাবগান, ফকিরি গান, শব্দগান। আবার মনঃশিক্ষা বা আখেরিচেতনের গান, ‘দৈন্যতা’র গান, দেহতত্ত্ব। ছিল কেন, এখনও সবই আছে তবে মর্যাদাবান হয়ে নেই। মেলার আসরে রসিকের চেয়ে দর্শক বেশি, তত্ত্বজ্ঞের চেয়ে গবেষক বেশি, একতারার চেয়ে ক্যামেরা বেশি। ১৯৫৪ সালে প্রকাশিত ‘বাংলার বাউল’ বইয়ে ক্ষিতিমোহন সেন লিখেছিলেন:

এই সব স্থানের খবর পাইয়া বহু ‘গবেষণা’ করনেওয়ালা ডক্টরেটপ্রার্থী বিদ্বজ্জনের সেখানে ভীষণ সমাগম ঘটে।… কেঁদুলির নিত্যানন্দ দাস তো একদিন আমাকে বলেন বাবা, বৎসরান্তে এখানে আসিতাম। কিন্তু তোমাদের পিস্তলের মতো পেন্সিল ওঁচানো দেখিয়া স্থানটা ছাড়িতে হইল।

এখন দৃশ্যটা আরও ঘোরতর। কেবল পেন্সিল-ওঁচানো গবেষক নয়, নাগরিক ফোটোগ্রাফারের ফ্ল্যাসবাল্বের ঝলক, টেপরেকর্ডারের আমদানি, ভিডিও রেকর্ডিং ও কর্ণভেদী মাইক সবই দেখা যাবে। অমিত গুপ্ত তাঁর ‘বাংলার লোকজীবনে বাউল’ বইতে হালের রাঢ় খণ্ডের বাউলদের নাম সাকিনের পরিচয় রেখেছেন। তাঁর সংগৃহীত একটা সদ্যকালের গান হল ‘কৃষ্ণ নামের মিষ্টি চুরুট/ মুখে রাখো সর্বক্ষণ।’ এই একটা গানের বাণী ধরে আমরা হালফিলের বাউল জগতে (বিশেষত রাঢ়ের) ঢুকে পড়তে পারি। আদিত্য মুখোপাধ্যায় তাঁর ‘ধর্ম ও সংস্কৃতির আলোকে বাউল’ বইয়ে এমনতর কৃষ্ণনামের মিষ্টি চুরুট খাওয়া বাউলদের বিবরণ দিয়েছেন।

তিনি জানাচ্ছেন গৌরখ্যাপা বিদেশ ঘুরে এসে বাড়ি করেছেন, মোটর সাইকেল চেপে ঘুরছেন। হাতে বিদেশিনীর দেওয়া সোনার হাতঘড়ি। পবনদাসের গানের শুরু ট্রেনের কামরায়, ১৯৮৮ সালে তিনি ‘বিদেশিনী মিমলু সেনের সঙ্গে প্যারিসে। সাধক জীবন তাঁর শেষ।’ লাভপুরের ধনডাঙার কার্তিক দাস, শৈশবে গ্রাম্য যাত্রাগানে বিখ্যাত ছিলেন। এখন ‘ডিস্ক ক্যাসেট বিদেশ সব হয়ে গেছে।’ কৃষ্ণবাহাদুর থাপার জন্ম নেপালে, থাকেন পানাগড়ে। ১৯৬০ সালে সেনাবাহিনী থেকে ফিরে স্ত্রী আর পাঁচ বছরের ছেলেকে নিয়ে কেঁদুলি মেলায় আসেন এবং মনোহর খ্যাপার আখড়ায় গান শুনে মজে যান। তারপরেই কণ্ঠে নেন বাউল গান। ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, জাপান, কানাডা, ফ্রান্স ঘোরা বাউল কৃষ্ণবাহাদুর এখন প্রয়াত। ‘বিশ্বনাথ বাউলের বড় ছেলে আনন্দও এক বিদেশিনীর (৪৩-এর বেশি বয়সের জার্মান মহিলা কেরিন) প্রেমে হাবুডুবু খেয়ে পুনরায় ফিরে এসেছে ঘরে।’ বাংলার বাউল বলতে কি এঁদের প্রসঙ্গকে গণনায় আনতে হবে?

শেষ পর্যন্ত বাউল কি তবে একটা মনগড়া মিথ? একটা আশ্চর্য জীবনযাপনের ধরন? বিদেশের বিজ্ঞাপনে বলা হচ্ছে বাউল— ‘Child of Transcultural Studies’। সে ‘Sings and dances mad songs of ecstacy’। ব্যাপারটা প্রকৃতপক্ষে কি তাই? আমাদের অবশ্য ভিন্নতর অভিজ্ঞতা আছে। বলবার কথা সেটাও। রাঢ়ের বাউলদের অর্থ কীর্তি সচ্ছলতার বাইরেও তো একটা বৃহৎ বঙ্গ আছে। বর্ধমানের একটা অংশ, নদিয়া আর মুর্শিদাবাদ জুড়ে সাধক বাউলদের অভাব কই? তাঁরা বিদেশেও যান না, সিন্ধু পারের সুন্দরীরা তাঁদের সাধনভ্রষ্টও করেন না। অখণ্ড নদিয়ার খণ্ডিত অংশ, যা আজ বাংলাদেশ, তা তো বাউল গানের স্বচ্ছ স্রোতেবেগে প্রাণবান। সীমান্ত পেরিয়ে তার কিছু সুবাস আজও পাই। বাউলদের তো কোনও দেশগত বেড়া নেই। তাই এ বাংলার বাউল আসরে ও মেলায়, ও-বাংলার বাউলদের কত গান আমরা শুনি। তবে সে গানের ধরন ধারণ আলাদা। নৃত্যবিরল ভাবময় সেসব বাউল গান একটু অন্য ধাঁচের, হয়তো সুর কাঠামোটাও একটু স্বতন্ত্র।

এইখানে একটু খোলামেলা কথা বলতেই হবে। কলম-ওঁচানো গবেষকবৃন্দ যতই না কেন নিন্দিত হন তবু বাউলদের নিয়ে কাজের কাজ তো তাঁরাই কিছু কিছু করেছেন, করে চলেছেন। এদেশের রাষ্ট্রব্যবস্থা, ধর্মপ্রতিষ্ঠান বা সমাজসেবী সংস্থা বাউলদের জন্য তেমন কিছু করেছেন বলে তো শুনিনি।

এটাও মনে রাখতে হবে, বাউল সুর বলে স্পষ্ট, নির্দিষ্ট কোনও কাঠামো নেই। অঞ্চল ভেদে তা আলাদা। বাউলদের সম্পর্কেও এ কথাটা বলা চলে। অঞ্চল ভেদে তাদের ধরনধারণ জীবন প্রণালী আলাদা। সেইজন্যই রাঢ়ের বাউলদের সঙ্গে কুষ্টিয়ার বাউলদের খুব গভীর মিল খোঁজা নিরর্থক। আবার রাঢ়ের বাউলদের ঘনিষ্ঠ যেমন সহজিয়া বৈষ্ণবরা, নদিয়া মুর্শিদাবাদে তেমনই বাউলদের গায়ে গায়ে রয়েছে ফকিররা। বাউল আসলে তবে কি এক সমাধানহীন দ্বৈত? তার জীবনের কবোষ্ণ তাপ, তার পোশাকের মণ্ডন-ধর্ম, তার গানের উদার মানবিকতা, তার বন্ধনহীন পথচলা— এক অলক্ষ্য অন্বিষ্টর মতো। বাংলার বাউল যেন এক মগ্ন স্রোত, তার চোরা টানে প্রতিদিন আমাদের অবশ্যম্ভারী অবগাহন চলছে।

কিন্তু সেই অবগাহনের মধ্যে রয়ে যাচ্ছে ফাঁক ও ফাঁকি। এটা ততদিন ছিল না যতদিন বাউল ফকিররা তাদের নিজেদের পরিবেষ্টনীর মধ্যে থাকতে পেত, নিজেদের মতো আত্মমগ্ন সাধনার পথে। সত্তর-আশির দশক থেকে হঠাৎ শহরবাসী মধ্যবিত্ত এ-বর্গের গান সম্পর্কে এবং বেশি করে এদের জীবনধারা সম্পর্কে উৎসাহী হয়ে ওঠে। তার সবটাই হুজুগ বা গিমিক নয়। আসলে নাগরিক জীবন ও তার বিনোদনের উপকরণগুলি কৃত্রিম আর ক্লান্তিকর হয়ে উঠছিল ক্রমশ— বাংলা গানও একটা পুনরাবৃত্তির ছকে ঢুকে পড়েছিল। কাজেই একটা নতুন স্বাদ আর পরিবর্তন সবাই চাইছিলেন। আমাদের সাবেক ইতিহাসতত্ত্বের ধারণা ও ইতিহাস চর্চাও খুঁজছিল এক নতুন পথরেখা— তাই লুপ্ত অথবা ক্ষীণ গৌণধর্মগুলির শিকড়সন্ধানে ব্রতী হতে চাইলেন অনেক ইতিহাসসন্ধানী। জেগে উঠল শত জল ঝরনার ধ্বনি।

সেইসঙ্গে এই সময়খণ্ডে একটা নতুন জিনিস হল— বাউলদের বিদেশে নিয়ে গিয়ে গান শোনাতে আগ্রহী হলেন কেউ কেউ। তাঁরা আমেরিকাবাসী বাঙালি। বলা বাহুল্য তাঁদের উদ্দেশ্য নিশ্চয়ই ছিল না সেদেশে ভারতীয় অধ্যাত্মবাদ বা বৈরাগ্যবাণী প্রচার করা। পূর্ণদাস ও অন্যান্য ক’জনের গানে বিদেশে কিন্তু একটা ভুল বার্তা পৌঁছে গেল। শতবর্ষ আগে শিকাগোয় স্বামী বিবেকানন্দ যে-বেশ ধারণ করে তাদের মাতিয়েছিলেন, সেই গেরুয়া আলখাল্লা লুঙ্গি পাগড়ি ও কোমরবন্ধধারী বাংলার বাউল তাদের তারসপ্তকের উচ্চনিনাদে ও বৃত্তাকার নাচে কোনও কোনও বিদেশির মন মজাল। তারা এবার ঘন ঘন দেখতে চাইল বাউলদের— হঠাৎ বাউল-অনুরাগী বিদেশিদের সংখ্যা বেড়ে গেল। সাধন-সর্বস্ব একটি সম্প্রদায়কে হতে হল পারফরমার।

দেখা যাচ্ছে, বাউলদের জীবনযাপনের ধরন এবং বাউল গান অনেককেই টেনেছে, কিন্তু অন্তরঙ্গতা ও নিবিড় পর্যবেক্ষণ থেকে সাম্প্রতিককালে কিছু কিছু অন্য স্বরও ফুটে উঠেছে। বাউলদের সম্পর্কে এমন কিছু ভাল ও মন্দ মন্তব্য কয়েকজনের রচনা থেকে উদ্ধৃত করব, তার থেকে তাদের হাল চাল কিছু জানা যাবে। প্রথমে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মন্তব্য:

একসময় বাউলগান সম্পর্কে আমার খুব আগ্রহ জেগেছিল। কোথাও কোনো বাউলের গান শুনলেই টুকে রাখতাম।… বারবার ছুটে গেছি কেঁদুলির মেলায়, শীতের মধ্যে সারা রাত জেগে বসে থেকেছি অজয় নদীর ধারে ছোট ছোট আখড়ায়। খুবই দুঃখের কথা, কয়েক বছরের মধ্যেই আমি বাউল গান সম্পর্কে গোপনে গোপনে হতাশ হয়ে পড়ি।… মন দিয়ে বারবার শুনলে, বাউল গানেও একঘেয়েমি এসে যায়। তিন চার রকমের বেশী সুর বৈচিত্র্য নেই। গানের মাঝে মাঝে ‘ও ভোলামন’ বলে একটি দমফাটানো তান আসলে শ্রোতাদের চমকে দেবার একটা কায়দা মাত্র। শুধু গান শোনার আনন্দের জন্যই একসঙ্গে তিন চারটের বেশী বাউল গান শোনা যায় না, তখন হাই ওঠে, কিংবা ফ্যাসানের বশবর্তী হয়ে কৃত্রিম বাহবা দিতে হয়। সাহেবরা প্রকাশ্যে গাঁজা খেতে শুরু করার পর এদেশের ভদ্রসমাজের অনেক ছেলেমেয়েদের মধ্যেও গাঁজা টানার চলন হয়েছে। সাহেবদের পরবর্তী শিকার ঐ বাউলরা। দলে দলে বাউলদের আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, ইংলণ্ড সফর শুরু হয়ে গেল। সাহেবদের দেশ ঘুরে আসার আগে ও পরে একই বাউল গান শুনে দেখেছি, অনেক তফাৎ। তার গায়ে যেন আঠেরো ঘা।

আসলে বাউল গানের কাছে আমাদের খুব বেশী প্রত্যাশা করাটাই ভুল। বাউল গান বাউল গানেরই মতন। আমরা তার থেকে আংশিক আনন্দ পেতে পারি মাত্র। তার বেশী কিছু নয়। সমস্ত পৃথিবীর সভ্যতাই নগরকেন্দ্রিক। আমরা আর ইচ্ছে করলেই গ্রামীণ হয়ে যেতে পারিনা। স্বতঃস্ফূর্ত গানের প্রতি আমাদের অন্তরীণ বাসনা আছে বলেই আমরা বাউল গান বা লোকসঙ্গীতের কাছে গেছি বারবার। কিন্তু মন্দিরের সিঁড়িতে বসা একান্ত বাউলের গান বা ভেসে যাওয়া নৌকোয় মাঝির গান শোনবার সৌভাগ্য আমাদের দু’ একবারই হয়। বারবার পেতে গেলে সব কিছুর মধ্যেই একটা সাজানো ব্যাপার এসে পড়ে। মঞ্চে ওঠবার আগে বাউল প্যান্ট শার্ট ছেড়ে পরে নেয় গেরুয়া পোশাক, শ্রোতাদের দাবিতে মজার গান হিসেবে পরিবেশন করে এইরকম গান: ‘এঁড়ে গরু বেড়া ভেঙে খেজুর গাছে চড়েছে।’

অতি উৎসাহে বাউল বা লোকসঙ্গীত শিল্পীকে আমরা সরিয়ে আনি তার জীবনচর্যা থেকে। তার ফলে স্বতঃস্ফূর্ততা নষ্ট হয়ে যায়। ক্রমশ সেও আমাদের কৃত্রিমদ্রব্য সরবরাহ করতে থাকে।

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের এই বাস্তব বিশ্লেষণের মধ্যে যেমন সমাজ সত্য আছে তেমনই আর্টের সত্য আছে। বাউলকে যদি তার নিজস্ব সাধন ভজনের জগতে না থাকতে দিই, বারেবারে তাদের টেনে আনি আলোকোজ্জ্বল শহুরে মঞ্চে, আমাদের বিনোদনের কারণে, তবে তারা সাজগোজ কৃত্রিম গায়ন আর চটকদার ভাবভঙ্গিতে গ্রস্ত হবে তাতে সন্দেহ কি? বাউলরা তো কোনওদিন আত্মবিজ্ঞাপনে অভ্যস্ত ছিল না— থাকত আপন আপন ভজন কুটিরে, ঘুরত পথে প্রান্তরে, মেলা মচ্ছবের সম্মিলনে। গানকে জানত তত্ত্ব বলে। তার ছিল তিনটে পর্যায়— আত্মতত্ত্ব, গুরুতত্ত্ব আর দেহতত্ত্ব। এ ছাড়া ছিল দৈন্য ও মনঃশিক্ষার গান। কোথায় গেল সেইসব আত্মগুপ্ত ঠাঁইনাড়া স্বভাবের বাউল সাধক? নবনীদাসের কথা মনে পড়ে। জন্মেছিলেন একশো বছরেরও আগে বীরভূম জেলার গুনুর ভুমরি গাঁয়ে। পিতামহ অনন্ত গোঁসাই। পিতা অক্রূর গোঁসাই। সামান্য লেখাপড়া শিখে দশ বছরে মন্ত্র দীক্ষা চাঁদপুরের খেপি মায়ের কাছে। তারপরে বৈরাগ্য দীক্ষা নারায়ণ গোঁসাইয়ের কাছে। এবারে শুরু হল একসঙ্গে সংসার আর গানের জীবন, ভ্রাম্যমাণ সত্তার পরিক্রমণ। স্ত্রী ব্রজবালা আর বোন ফুরুবালা। একে একে সন্তান হল অন্নপূর্ণা-রাধারানী-পূৰ্ণদাস লক্ষ্মণদাস-চক্রধর।

কিন্তু মানুষটা সংসারী ছিলেন না। গান গেয়ে বেড়াতেন গাঁয়ে গাঁয়ে আর মাঠে মাঠে বাউল তত্ত্ব নিয়ে গানের পাল্লাদারি হত বোন ফুরুবালার সঙ্গে। নবনীদাসের দীক্ষিত শিষ্য ছিল মাত্র দুজন— হরিদাস মহান্ত আর ক্ষুদিরাম দাস। সুদর্শন হরিদাস পরে বিয়ে করেন ফুরুবালাকে, নবনীর সেটা পছন্দ হয়নি। সে যাই হোক, সারাজীবনই নবনী খ্যাপা ঠাঁই বদলেছেন। বিয়ের আগে ছিলেন জয়পুর গ্রামে, সেখানে থেকে উঠে আসেন বসোয়া-বিষ্ণুপুরে। বেশ কিছুকাল ছিলেন নানুরে। পরে ক্রমান্বয়ে বাস্তু গড়েছেন ও ভেঙেছেন— উবরুন্দি চিৎগাঁ, রায়ান-বেলুটি, সিন্দূর, ফতেপুর, কুলেড়া হয়ে পারুলডাঙা, সবশেষে সিউড়ির কেন্দুয়া পল্লিতে এসে দেহ রাখেন। ভবঘুরে স্বভাবের উদাসীন এই সাধকের গান ও জীবনচর্যায় মুগ্ধ ছিলেন রবীন্দ্রনাথ কিন্তু শান্তিনিকেতনে তাঁকে ধরে রাখতে পারেননি। তাঁর গলায় অসামান্য বাউল গান শহরবাসী কোনওদিন শোনবার সুযোগই হয়তো পেত না; যদি না ঘটনাচক্রে সিউড়ির ডাক্তার কালীগতি বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে পরিচিত হতেন নবনীদাস। গুণগ্রাহী চিকিৎসক কেবল যে তাঁর শরীরের দেখভাল করেছিলেন তাই নয়, তাঁর উদ্যমে নবনী ও পূর্ণ রেডিয়োতে গান করেন, অংশ নেন কলকাতার বঙ্গ সংস্কৃতি সম্মেলনে। বলতে গেলে পঞ্চাশের দশকে সেই প্রথম কলকাতার রসিকদের খাঁটি বাউল গান শোনা। মনে আছে আজও নবনীদাসের সেই মগ্ন গায়ন ও দীন বেশভূষা। তখন গেরুয়ার এত বিলাসিতা আসেনি বাউল সমাজে, ছিল সাদা ধুতির লুঙ্গি আর সাদা মার্কিনের ফতুয়া। এই বর্গের সব সাধক বাউলই এখন দেহ রেখেছেন। তাঁদের নাম ও রূপ অবশ্য অনেকের স্মৃতিতে এখনও ধরা আছে, যেমন ধরা যাক— ত্রিভঙ্গ খ্যাপা, রাধেশ্যাম দাস, চিন্তামণি দাসী, রূপদাসী, হরিদাস গোঁসাই, মনোহর গোঁসাই। গাঁয়ের পর গাঁ পায়ে হেঁটে পার হতেন, কাঁধে কাঁথার ঝোলা নিয়ে। নগ্ন পা, নগ্ন গা। অঙ্গে শুধু ডোর কৌপীন আর তহবন্দ। মাথায় চুড়ো করে বাঁধা চুল, সর্বকেশধারী বৈরাগী। মাধুকরী ছিল একমাত্র ব্রত। প্রসন্ন আনন, শান্ত স্বভাব, স্বল্পভাষী কিন্তু উৎফুল্ল।

পশ্চিমবঙ্গের নানা জেলা ঘুরে বাউল-ফকিরদের হালহকিকত জানতে গিয়ে আমি দু’রকম অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছি। বেশির ভাগ বাউলই অর্ধশিক্ষিত বা অশিক্ষিত, মোটামুটি চলে যায় গান গেয়ে, মাধুকরী করে, অবরে সবরে কারুর কারুর ডাক আসে সরকারপোষিত অনুষ্ঠানে, কিছু অর্থলাভ ঘটে। আর আছে কিছু সুযোগসন্ধানী বাউল, তৎপর ও চৌকস, ভাল গায়, ভাল কথা বলে। আলাপ হলেই একটা নাম ঠিকানা লেখা (অবশ্যই ইংরিজি অক্ষরে) কার্ড ধরিয়ে দেয়, তাতে গেরুয়া রঙের প্রিন্টে একতারা ছাপা আছে লোগো হিসেবে। এই একতারা একটা শো পিস, এর নানা সাইজ। আমি বর্ধমানের তথ্য দপ্তরে এক বাউলের ছবি তুলেছি, যার পরনে র-সিল্কের আলখাল্লা এবং হাতে দশ-বারো ইঞ্চির একটা ঝকঝকে পালিশ করা মিনি একতারা— ওটার কাজ অলংকারের। হয়তো পিন পিন করে একটু বাজে কিন্তু আসরের নানা বাজনার জগঝম্পে সেই ক্ষীণ ধ্বনির কীইবা মূল্য! তবে হ্যাঁ, ভারী দেখনদারি আর বাউলের নানা অঙ্গভঙ্গির সহায়ক যন্ত্র।

প্রশ্ন উঠেছে এখানেই— পরিবর্তমান দেশকালে, প্রতিযোগিতামূলক বাউল গানের বিশ্বে বাউল কি নবনীদাস বা রাধেশ্যামদের মতো সরলসিধে ভাবনিষ্ঠ সাধক থাকবে, না দেখনদারি ঝলমলে পোশাক পরে নেমে পড়বে অন্যকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে যেতে? এই তো সেবার কেঁদুলির মেলায় গিজগিজ করা মানুষের ভিড়ে সবাইকে সচকিত করে একটা লাল মোপেডে চড়ে আবির্ভূত হলেন বিশ্বনাথ দাস। ঝাঁকড়া চুল, আজানুলুণ্ঠিত লাল সিল্কের আলখাল্লা, পিঠে বাঁধা বন্দুকের মতো গেরুয়ামোড়া ছুঁচালো একতারা, যেন বাদ্যযন্ত্র নয় শস্ত্র। তার এহেন পোশাক পরিচ্ছদ বা ঔজ্জ্বল্য বিষয়ে প্রশ্ন করতে সে কোনও দ্বিধা না রেখেই বলল, ‘চিরকালই কি খালিপায়ে খালিপেটে বাউল কষ্ট করবে? এখন অবস্থা ফিরেছে। গান গেয়ে টাকা আসছে, বিদেশ যাচ্ছি আমরা, মান মর্যাদা পাচ্ছি। এ সব মেলা মচ্ছবে তাই একটু দেখাচ্ছি। এর ফলে অনেক বায়না হবে, অনেক আসরে গান করার ডাক আসবে। রোজগার হবে। তা না করে আখড়ায় ধুনি জ্বেলে বসে, গাঁজায় দম দিয়ে ভোম মেরে বসে থেকে কী লাভ?’

এ একেবারে বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গি, পাকা প্রফেশনাল। আদিত্য মুখোপাধ্যায় এদের সম্পর্কে হতাশ হয়ে কিছুটা ভগ্নহৃদয়ে লিখেছেন:

‘বাউল’ শব্দটি উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গেই মনের ক্যানভাসে একটি উদাসী মানুষের ছবি ভেসে ওঠে— গেরুয়া পোষাক, ধম্মিল্ল করে বাঁধা চুল, বগলে গাবগুবি বা আনন্দ-লহরীর চোরা সুর। কিন্তু যতদিন যায়, বাউলের পোষাকও বদল হয়। কেঁদুলীর মেলায় গেলে এ সত্যটি সুন্দর ধরা পড়ে। পবন দাস এখন জিন্‌স্‌ ব্যবহার করে বেশি, নিতাই দাস প্যান্ট-সার্ট পরে, নক্ষত্র দাস, বিপদতারণ দাস, কার্তিক দাস সবাই সাধারণ মানুষজনের মতোই থাকেন। গৌর আর সে গৌর নেই, বিশ্বনাথ দাস মারুতি কেনার নেশায় মগ্ন, আনন্দ দাস ভারতে গান গাইতে পছন্দ করে না।… আবার একজন বিদেশিনীর সঙ্গ না করলে এই সময়ের বাউলের মনও ভরে না, পকেটও ভরে না, সঠিক অর্থে বাউল জীবন বৃথা হয়ে যায়।

এই পর্যন্ত পড়ে আমাদের দু’-একটি মন্তব্য করতেই হয়। প্রথমত, বীরভূমের বাউলরাই তো একমাত্র বাউল নয়, সারাদেশে নানাভাবে নানা সাধন ক্ষেত্রে ছড়িয়ে আছে বাউল— তাদের সবাই এমন প্রদর্শনকামী বা লোভাতুর নয়। নদিয়া-মুর্শিদাবাদ-বর্ধমান-মেদিনীপুর বা বাঁকুড়ায় প্রচুর বাউল দেখা যায়, যারা সৎজীবনযাপনে আত্মসুখী, দরিদ্র ও ভক্তপ্রাণ। মোপেড বা মারুতি তো দূরের কথা, তাদের অনেকের একটা সাইকেলও নেই, গান গেয়ে উদয়াস্ত টহলদারি করছে, তবু পেট ভরে কই? সেই কবেকার কুবির গোঁসাই মনের দুঃখে লিখেছিলেন:

মুষ্টিভিক্ষে করে আমি খেতে পাইনে

উদর পুরে।

ঘরে ঘরে ঘুরব কত

ভূত খাটুনি খাটব কত?

এখনও গড়পড়তা বাউল-ফকিরদের এটাই ভবিতব্য, তবে তারা বেশির ভাগই অভিযোগহীন, স্বভাবে শান্ত। কেমন তাদের আস্তানা? অনুপম দত্ত বর্ণনা দিয়েছেন এইরকম:

আশ্রমটি অজয় বাঁধের ধার ঘেঁষে ছোট একটি দোচালা ঘর। একফালি বারান্দা। সামনের খানিকটা জায়গা ঘিরে ঢোল কলমীর বেড়া। এখানে তার বৈষ্ণবী গাঁয়ে গাঁয়ে মাধুকরী করে বাউলের সংসার চালায়।… বাউলের সংসারে সামান্য সচ্ছলতাটুকু নেই। তার ঘর-জোড়া সস্তা কাঠের তক্তায় ছেঁড়া কাঁথা, তুলো-ফেটে বেরুনো বালিশ। ঘরের কোণে হাঁড়ি কলসীর আবর্জনার ভেতরে মশাদের গুহাবাস, ছারপোকা আর আরশোলার জন্মঘর।

বাউলদের তুলনায় ফকিরদের অবস্থা আরও করুণ, শোচনীয়— অবশ্য খাঁটি ফকিরিয়ানার সেটাই তো শর্ত। বীরভূমের শাসপুরে আমিন শা ফকিরের খোঁজে গিয়েছিল লিয়াকত আলি। ফকির তখনও ফেরেননি। তাই অপেক্ষাতুর লিয়াকত দেখছেন:

আমিনের বউ মাঝবয়সী, রঙ বেশ ফরসা। তবে পরণের মোটা রঙিন ফুলছাপ সস্তা শাড়িটি খুব ময়লা। উঠোনে, খোলা আকাশের নীচে, রোদ্দুরের মধ্যে, মাটির উনুনে কালো তোবড়ানো হাঁড়িতে ভাত রান্না হচ্ছে। পাতার জ্বালে আগুনের চেয়ে ধোঁয়াই বেশি। উঠোনের ওদিকে মাটির বাড়ি, অবশ্য ওটিকে যদি আদৌ বাড়ি বলা যায়। বাড়িটি জরাজীর্ণ ও বিধ্বস্ত— কোনরকমে খাড়া হয়ে আছে। খড়ের চাল পচে ধ্বসে গেছে। ঠাঁই ঠাঁই খড়ও নেই। উঠোনে ও বাড়ির দাওয়ায় নানান জিনিস বিশৃঙ্খলভাবে পড়ে আছে। বাড়ির মধ্যে মুরগী চরছে, ন্যাংটো শিশু ঘুরছে। আধন্যাংটো একটি বালক কোমরের পেছনে কাস্তে গোঁজা, মাথায় করে একবোঝা ঘাস নিয়ে এসে দাওয়ার ওপর ধপ্‌ করে ফেলল। উঠোনে এপাশে অন্য কারোর বাড়ির পেছন দিক। তারই ছাচের নীচে ছায়ায় খেজুরপাতার তালাই বিছিয়ে আমাকে বসতে দিয়েছেন। বউটি। পরক্ষণেই এনে দিয়েছেন খাবার জল।

এ ধরনের দীনহীন ও শ্রীহীন বসত বাড়ি যে সবার তা নয়। করিমপুরের কাছে গোরভাঙায় আজহার ফকির ছিলেন সম্পন্ন গৃহস্থ। জোতজমি, পাকাবাড়ি, গ্রামজোড়া মান্যতা। ছেলেরাও ফকিরি মতে রয়েছে। ছোট ছেলে মনসুর ফকির এখন গান গেয়ে বেশ নাম করেছে। তবে আজহার ছিলেন তাত্ত্বিক সংসারজীবী ও গীতিকার, মনসুর শুধুই গায়ক। বাড়ির দাওয়ায় বসেছে গানের আসর। আমাদের চোখ চলে গেল গায়কের ঝাঁকড়া চুলের ওপাশে দাওয়ার কোণে— সেখানে রয়েছে একটা তাগড়াই রাজদূত মোটর সাইকেল।

কিংবা ধরা যাক, বর্ধমানের হাট গোবিন্দপুরে সাধন দাসের কুটির। শ্রীময়, শান্ত ও সচ্ছল। দৈন্যের কোনও ছাপ নেই। দিব্যি মোরাম বিছানো রাস্তা, চমৎকার সব খড়ে ছাওয়া ভজনকুটির। বিন্যস্ত গাছগাছালি, ফলফুলের বাগান। একটা নতুন ঘর গাঁথছে সাধনের শিষ্যরা গতরে খেটে। সাধনদাস পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন পোশাকের সফিস্টিকেটেড মানুষ। জাপানি সাধনসঙ্গিনী মাকি কাজুমি অঙ্গন আলো করে আছে।

এইখানে স্পর্শকাতর বিদেশিনী প্রসঙ্গটি একটু ভেবে দেখা দরকার। সব বাউলরাই যে বিদেশিনী মেমদের নিয়ে আছেন তা নয়। হয়তো সাকুল্যে জন দশ-পনেরো বাউলের কপালে নেকনজর জুটেছে মেমদের তাতেই বদনাম রটেছে সকলের নামে। এখানে একথাটা তো বুঝতে হবে এই শ্বেতাঙ্গিনী বিদেশিনীরা কেউই মহীয়সী নারী নয়— কেউই আসেনি ভারত উদ্ধারে। তারা কেউ মার্গারেট নোবল বা মীরা রিশার নয়, তারা পশ্চিমি বণিক সভ্যতায় দিগভ্রষ্ট রমণী। অর্ধশিক্ষিত কিংবা নেশাগ্রস্ত, কামুক কিংবা বখে যাওয়া। সামান্য দুয়েকজন জিজ্ঞাসু ও গবেষক। তবে এটা ঠিক যে তাদের কল্যাণেই বাউলদের বিদেশি সংযোগ ও ডলার রোজগার এ প্রসঙ্গে আমি একবার লিখেছিলাম :

একদল গায়ক-বাউলের দেশেবিদেশে সাম্প্রতিক বিপুল জনপ্রিয়তার প্রসঙ্গও উল্লেখ করা উচিত। এঁরা অনেকেই জীবনাচরণে ও সাধনায় বাউল নন, কিন্তু বাউল গানকে পণ্য করে, বাউলের পোষাক পরে, বিদেশী মঞ্চ দাপিয়ে বিপুল ডলার রোজগার করছেন।… গত দু’দশক ধরে সাজানো বাউলরা বিদেশী শ্রোতাদের জনপ্রিয়তা লাভের আশায় দেশজ গানকে ভাবে ও সুরে যতটা চটকদার বিনোদনধর্মী করে তুলেছেন, তার তরঙ্গ আমাদের পল্লী প্রান্তের গায়ককেও দিনে দিনে আকৃষ্ট করছে ও বিভ্রান্ত করছে।

এ-বক্তব্যের বিপরীতে বাউলরসিক অরুণ নাগ একটি নিবন্ধে মন্তব্য করেছেন :

সত্যি কথা বলতে কি বিদেশীদের মনোরঞ্জনের ব্যাপারটা একটু বাড়াবাড়ি। বিদেশীদের কতজন চটুল গান উপভোগ করার মতো বাংলা বোঝে? সুর বা লয় ইমপ্রোভাইজেশনের ক্ষমতাই বা গড়পড়তা কজন বাউলের থাকে? ‘গুরু কি মাছ ধরেছ বঁড়শি দিয়া’ বা ‘ও জামাই দরজা খোলো’— জাতীয় গান দেশী শহর-গ্রাম নির্বিশেষে এক ধরনের নিম্নরুচির শ্রোতার মনোরঞ্জন করে এবং যথেষ্ট জনপ্রিয়। ভারতীয় মার্গ সঙ্গীতের দিকপালরা বাউলদের থেকে অনেক বেশী বিদেশ যান, ডলার রোজগার করেনও অনেক বেশী, তাদের বেলায় কিন্তু বিদেশ-ডলার নালিশ শোনা যায় না। তারা বিদেশে আলাপ অংশ সংক্ষিপ্ত করে, তবলার সঙ্গে সওয়াল-জবাব বাড়িয়ে পরিবেশনকে আকর্ষণীয় করেন। অথচ কেউ বলেন না রবিশঙ্কর, আলি আকবর, বিলায়েতের পাল্লায় পড়ে ভারতীয় মার্গ সঙ্গীত গোল্লায় যাচ্ছে, তরুণ শিল্পী প্রভাবিত হচ্ছে পরম্পরার পথ ছাড়তে।… অনিকেত বৈরাগী ধূলিধূসরিত পায়ে একতারা বাজিয়ে গান গেয়ে হেঁটে যাচ্ছে গ্রামের পথে, এমন একটি ধারণা, ভাবমূর্তি মনে প্রোথিত থাকলে তার সঙ্গে সত্যিই মেলানো শক্ত জেট-মার্গী, ডলারপ্রেমী আধুনিক বাউলকে, যিনি নাইকি পায়ে, মারুতি চড়ে, গান গাইতে আসেন। রবিশঙ্করদের এমন ইমেজ কোনোকালে ছিল না বলেই কোনো আপত্তিও ওঠে না। গণ্ডগোল এখানেই।

প্রতিযুক্তি খাড়া করতে গিয়ে অরুণ নাগ নিজেও খানিকটা বিপাকে পড়েছেন। তাঁর বিবেচনায় আসা উচিত ছিল যে, (১) মার্গ সংগীত ও বাউল গান এক পঙ্‌ক্তিতে উদাহরণযোগ্য নয়, (২) রবিশঙ্করবর্গীয় উচ্চাঙ্গ শিল্পী ও গ্রামের অশিক্ষিত বাউল গায়ক শ্রেণিগতভাবেও একেবারে আলাদা, (৩) বাউল এক ধরনের জীবনাচরণ ও লৌকিক সাধনামার্গ, তাকে শহুরে মঞ্চে তোলার কথা নয়, (৪) বাউল গান ও মার্গসংগীতের দেশি শ্রোতারা একেবারে ভিন্ন বর্গের। সবচেয়ে বড় কথা, বাউল গানে পরিবেশনগত বিকৃতি এলে আমাদের লোকসমাজে তার প্রভাব অনিবার্য এবং সেটা দেশের পক্ষে ক্ষতিকর। রবিশঙ্কর আলি আকবর বিলায়েতরা বিদেশে পরিবেশনে যে চটক দেখান (সওয়াল-জবাব) এদেশে তো তা দেখান না, কাজেই তরুণ শিল্পীর পরম্পরাভ্রষ্ট হবার কথা আসছে কোথা থেকে? অরুণ নাগ আর একটা ব্যাপার গুলিয়ে ফেলেছেন! কণ্ঠসংগীত শিল্পী বাউলের সঙ্গে যন্ত্রসংগীত শিল্পীদের তুলনা এনে ফেলেছেন। জেট-মার্গী ডলার প্রেমী আধুনিক বাউল গায়ক নাইকি জুতো পরছেন, মারুতি চড়ছেন, এ-ইমেজ কোনওদিন ছিল না যেমন, আজও নেই। তাই যে দু’-একজন প্রদর্শনকামী ভ্রষ্ট বাউল বিদেশে বাহবা পেয়ে এদেশের মঞ্চেও সেই কৌশলে গান প্রদর্শন করেন, প্রকৃত বাউল গানের রসিকরা তাদের এড়িয়ে চলেন কিন্তু তাতে ধ্বংস বা বিকৃতি ঠেকানো যায় না। কারণ তরুণ গায়ক সম্প্রদায় সত্যিই তাতে প্রভাবিত হন এবং তাদের যন্ত্র-গানের দাপট, লম্বা ঝুলের বিচিত্রিত পাঞ্জাবি, চাপা প্যান্ট এবং কর্ডলেস মাইক নিয়ে চিল চিৎকার এখন বাউল গান বলে চালানো হচ্ছে। ক্রমশ তাদের আসব পানের অতিরেক ও নারী আসঙ্গ যুবসমাজে ছড়িয়ে পড়ছে। অথচ এদের দেখলে বাউল সমাজের প্রকৃত চিত্রটি বোঝা যাবে না। তারা চিরদরিদ্র ও উপেক্ষিত। আমাদের দেশের গড়পড়তা বাউলদের সম্পর্কে শিক্ষিত নগরবাসীদের ধারণা খুবই ধোঁয়াটে বা প্রান্তীয়। বিশেষত তাদের যাপনরীতি ও জীবন সংগ্রাম সম্পর্কে আমরা মূলত অজ্ঞ ও নির্লিপ্ত। তাদের সামাজিক অবস্থানগত বিপন্নতা, দৈনন্দিন অপমান ও সংকটের খবর শহুরে বাঙালির ভাবনা-বলয়ের মধ্যে নেই। তারা আমাদের বিনোদন মঞ্চের উপকরণ কিন্তু তাদের দারিদ্র ও ক্লেশ নিয়ে আমরা উদাসীন। তাই মুর্শিদাবাদের গ্রামে গ্রামে বছরের পর বছর ধরে নিরন্তর বাউল ফকির নিগ্রহ আমাদের দূরদর্শনের খাসখবরেও আসে না।

এদেশে বসে অবশ্য আমরা জানতে পারি না বিদেশে ঠিক কোন পর্যায়ের বাউলরা যান এবং মঞ্চে কী গান করেন। খোঁজ করলে দেখা যাবে পূর্ণদাস, প্রহ্লাদদাস বা পবনদাসরা যেমন ঘন ঘন যান, ততটা হয়তো লক্ষ্মণদাস বা সমীর রায়রা যান না— সবই আসলে যোগাযোগ বা স্পনসরের ব্যাপার, যার কপালে যেমন জোটে। ঘটনাচক্রে সনাতনদাসের মতো গুণী বাউলেরও ডাক আসে। যেমন একবার এসেছিল ফ্রান্স থেকে। সনাতনদাসের খয়েরবুনি গাঁয়ের আশ্রম থেকে ফরাসি ভাষায় লেখা ফ্রান্সের একটা অনুষ্ঠানপত্র সংগ্রহ করেছিলাম। সেটার অংশ বিশেষ অনুবাদ করলে আমরা যে-সংবাদ পাই তা অনুধাবনযোগ্য। সনাতনদাস সম্পর্কে সে দেশের পক্ষে পরিচিতি হল :

Sanatan Das Baul, born in 1923, not attracted by the commercial circuit, has preserved an authenticity linked with his rural mood of life. Coming from Bangladesh, he lives in the village of Khayerbuni (district Bankura). He interpretes Bhatiali, (song of the rivers) by playing on the ektara (stringed lute) on the dotara (lute with 4 strings). He is accompanied by his two sons Viswanath and Basudev, who also play on the gubgubi. He celebrates the awakening of the soul.

বাংলার প্রখ্যাত বাউল ফ্রান্সে গিয়ে একতারা বা দোতারা বাজিয়ে ভাটিয়ালি গাইছেন, এমত সংবাদ কৌতুককর না প্রহসনাত্মক? তাঁর গানের বিষয় ‘Cruel Ganga’ এবং পুরো গানটি অনুষ্ঠানপত্ৰীতে ছাপা রয়েছে এবং তার ‘text’-এ কুত্রাপি বাউলতত্ত্ব নেই। সেটি এক নিছক ভাটিয়ালি। কৌতুকের এখানেই শেষ নয়, সনাতনের সহশিল্পী কার্তিকদাস বাউলের পরিচিতিও চমৎকার। বলা হয়েছে :

Kartikdas Baul belongs to the ‘topsil’ caste, linked with agriculture. An old member of ‘jatra’. a popular musical theatre of Bengal, seduced by the ways of the Baul at the age of 15, he became a disciple of Sanatandas Baul. Today at the age of 35, he lives with his family in the village of Dhandanga (Birbhum district). He specially invokes the Ganga and its cruelty, to the accompaniment of his gub-gubi.

অদৃষ্টের এমনই পরিহাস যে বাংলার বাউল গাবগুবি বাজিয়ে বিদেশে গেয়েছেন ভাটিয়ালি।

সে যাই হোক, বিদেশে বাউল গান কথাটা শুনলেই উর্বাহু হয়ে ভাবমগ্ন স্বার কিছু নেই— অনুপুঙ্খ অনেক বিচিত্র বার্তা উঠতে পারে। তার আর এক রকমফের এবারে পরিবেশন করা যেতে পারে।

রান্ডি নিকলসন নামের এক বিদেশিনীর হঠাৎ ভাল লেগে যায় সমীর রায় নামের গায়ক যুবাকে। কেঁদুলির মেলায় সে আতিপাতি করে খুঁজতে থাকে সমীরকে। লিয়াকত তাকে যোগাযোগ করে দেয় সমীরের সঙ্গে। সমীর প্রসঙ্গে লিয়াকতের মুদ্রিত মন্তব্য :

সমীর ব্যক্তিগতভাবে আমার খুব পরিচিত। গানবাজনার জগতে বেশীদিন আসেনি। গানটা গায় মোটামুটি ভাল। কিন্তু নাচটা ওর একেবারে বাউল নাচ নয়।… পরের বছরই সমীর বিদেশ চলে গেল। অভাবিত এই ঘটনা ওর জীবনে দারুণ প্রভাব ফেলে। প্রচণ্ড শ্রমে আগের থেকে গলাটিকে তো ভাল করেই, নাচটিকেও মোটামুটি ঠিক করে নেয়। ওকে পছন্দের কারণ হিসাবে রাণ্ডি নিকলসন যা বলে তা আরো অদ্ভুত। ছেলেমেয়ে বাবা ভাই কেউ বাউল নয়, পরিবারটাও সাবেকি মধ্যবিত্ত, আর পাঁচটা পরিবারের মতো। শুধু সমীর বাউল। বাউল পরিবারের ট্রাডিশনাল বাউলের চেয়ে নাকি এ রকম বাউলই তার কাছে কৌতুহলজনক। তাই সমীরকে তার পছন্দ।

রান্ডির পছন্দসই সমীর তো বিদেশ পৌছল এবং আসরে আসরে পরিবেশন করল বাংলার নিজস্ব লোকায়ত বাউল গান। এবারে শোনা যাক তার কনফেশন :

অনেকে বিদ্রূপ করে আমাকে বলে, আমি বাউলের ছেলে নই, উটকো এসে জুটেছি।… কথাটা ঠিকই। কখনো বলি না আমি বাউল। কিন্তু যারা বাউল তাদের মধ্যে এমনও আছে, তারা কি তুচ্ছ ও উদ্ভট জীব স্বপ্নেও তা ভাবতে পারবেন না। ইউরোপে গেছি, আছি এক জায়গায়, আমাদের দেশের একটা কালচারকে তুলে ধরছি। ভাবতে পারেন এমনই বাউল আমরা, একজনের গান চলাকালীন আমরা তার অন্য সহযোগীরা বাজনা গোলমাল করে দিচ্ছি।… আমি এতে ভীষণ হতাশ হয়ে যাই এবং এত মানসিক যন্ত্রণা অনুভব করি যে ফ্রান্সে কোপেনহেগেনে নির্ধারিত প্রোগ্রাম বাতিল করে দেশে ফিরে চলে আসি। তাহলে বুঝুন, এরাই বাউল।

সমীরের আত্মবিবৃতিতে অনেক ভাজ আছে, যার দ্যোতনা বহুমাত্রিক। যেমন তাঁর একটা বৈদেশিক অভিজ্ঞতা এইরকম :

একবার গান করছি। প্রোগ্রাম শেষ। হঠাৎ দেখি সঙ্গীরা কেউ নেই। আমি একা পাশেই লেক। ওদের খুঁজতে সেদিকে গিয়ে দেখি, গুচ্ছের মেয়ে, সব টিনএজার। ওদের দেখতে পেয়ে আমার সঙ্গী একজন বলল, ‘ওরে সমীর আয় আয়, শালা দেশে আর ফিরে যাব না।’ ওরা এমন হতেই পারে, ওদের ওটাই জীবন, কিন্তু আমরা বাউলরা, আমরা আমাদের মতো কই? একী হলাম, একী তুলে ধরছি— এখন বল, ইউরোপ ভাসবে না আমরাই ভেসে যাব?

সমীরের কনফেশনে এক ধরনের মধ্যবিত্ত মূল্যবোধ কাজ করছে। এখনকার সুযোগসন্ধানী অশিক্ষিত যৌনকাতর বাউলযুবাদের সঙ্গে বিদেশে সে নিজেকে, নিজের বিবেক ও কাণ্ডজ্ঞানকে মেলাতে পারেনি তার কারণ তার একটা সংস্কৃতিগত বোধ আছে, খানিকটা শিক্ষা আছে। এইখানটায় একটা বড় তফাত গড়ে উঠেছে। গানের কণ্ঠটি ভাল, পরিবেশনভঙ্গি সপ্রতিভ এবং বোলচাল কায়দা কানুনে অভ্যস্ত হতে পারলে এখন খুব সহজে একজন বিশ-পঁচিশ বছরের নিম্নবর্গসম্ভত যুবক বাউল গানের মঞ্চে উঠে পড়ছে। ধীরে ধীরে পরিচিতি ঘটছে আসরে আসরে, ডাক আসছে এখানে ওখানে। মন্দমতি কম বয়সি হুল্লোরবাজ শ্রোতারা তাকে হুকুম করছে যৌনইঙ্গিতপূর্ণ হালকা গান গাইতে। শিক্ষা নেই, বোধ নেই, রুচি নেই, পরম্পরা নেই— লক্ষ্য কেবল অন্যকে দাবিয়ে এগিয়ে যাওয়া, গানের আসরে আগে-ওঠার তদ্বির। এদের চাপে আর দাপটে সব আসরে দেখেছি কুঁকড়ে থাকে একদল নিরীহ গায়ক, বসে থাকে একটেরে। যখন গাইবার ডাক আসে তখন কেমন যেন ঘাবড়ে যায়। দীক্ষিত বাউল তো হঠাৎ মঞ্চে উঠে জনমনোরঞ্জনী গান গাইতে পারে না, তার একটা শিক্ষাক্রম আছে, গুরুর বাচনিক নির্দেশিকা। তাই গুরুবন্দনা দিয়ে তার গান সূচনার রীতি মানতে হয়, পরে একটা তত্ত্বের পথে এগোতে হয়। বেশির ভাগ গানের মঞ্চ তো আসলে বিনোদনমূলক ও তাৎক্ষণিক উত্তেজনার আকর, তাই আসর মাত করে কণ্ঠকেরামতি ও বাজনাসর্বস্ব গায়কের দল। তারাই জনপ্রিয়।

তাদের বেশ কিছু টেকনিক বা কায়দাকৌশল আছে। প্রচুর গাঁজা টানে আর শিবনেত্র হয়ে কথা বলে। প্রচারের দিকটা সবচেয়ে খেয়াল রাখে। এমন কেন করে? বুঝতে অসুবিধে নেই যে এটা তাদের জীবন নয়, জীবিকা— এবং জীবিকার কঠিন পথে হাঁটতে হলে, টিকতে হলে, নিজেকে আলাদাভাবে তুলে ধরতে হবেই। হতে হবে বিশিষ্ট— তার গানের ও গায়নের মান যেমনই হোক, কালক্রমে সে হয়ে উঠতে চায় পরীক্ষিৎ বালা, সনজিৎ মণ্ডলের মতো সফল ক্যাসেটশিল্পী। তাদের মডেল পূর্ণদাস বা গোষ্ঠগোপাল। মেলা মহোৎসবে যখন সে যায় তখন টাকা দিয়ে ভাড়া করে একজন দক্ষ ক্যাসিওবাদককে ও তালবাদ্যকারীকে। প্রথমে তারা দশ মিনিট ধরে বাজনা-গানের উত্তেজনাকর পরিবেশ তৈরি করে, তারপরে অবতীর্ণ হয় নবীন গায়ক। এসব দেখেশুনে রাধাময় দাস একটা গান বেঁধেছেন, সেটা এইরকম :

দেশ ভরেছে বাবু বাউলে

তারা জামা জোড়া পরছে এখন

ডোর কৌপীন খুলে ফেলে—

দ্যাখো বাবু বাউলে।

কোথায় গেল সে আংরাখা

কোথায় গেল মালা

কোথায় গেল পায়ের নূপুর

কোথায় গেল ঝোলা।

তারা ঘুরছে এখন পার্কে লেকে

রেডিও নিয়ে বগলে।

বটের বাউল কোথায় পাব

বট ভেঙেছে ঝড়ে

সাধনা নাই শখে সবাই

বেতারে গান করে।

রাধাময় কয় যা আছে তা

ক্যামনে রাখি আগুলে।

শেষ পঙ্‌ক্তির আর্তিটুকু সত্য ও মর্মন্তুদ— যা আছে, এখনও যা আছে, তা কেমন করে আগলে রাখা যাবে?

আসলে তো জীবনচর্যাটাই বদলে গেছে চলে গেছে— ধ্যান ও অন্তর্বীক্ষণের গভীর নির্জন প্রহর। রাধাময় দাসদের মতো বিচিত্র সাধকদের সন্ধান কে আর দেবে? তাই তার কথা একটু বলি।

বর্ধমানের অন্তর্গত খাসপুরে রশীদ ডাক্তারের যে পুত্রসন্তান জন্মায় ১৯৩০ সালে তার নাম রাখা হয় কাজী নুরুল ইসলাম। বীরভূমের খুজুটিপাড়ায় কাটে নুরুলের ছাত্রজীবন। পরে কবি কুমুদরঞ্জন মল্লিকের সান্নিধ্যে জেগে ওঠে সৃজন প্রতিভা নিজের লেখক নাম নেন কুমুদকিঙ্কর। তারপরে বর্ধমান শহরে সংক্ষিপ্ত বসবাসকালে তিনি জড়িয়ে পড়েন সুভাষপন্থী রাজনীতিতে—পরে তাতে বীতশ্রদ্ধ হয়ে চলে আসেন সেই পুরনো খুজুটিপাড়ায়। সেখানে আলাপ ও ভাবসম্পর্ক গড়ে ওঠে সেখানকার সরকারি হাসপাতালের নার্স আশালতার সঙ্গে। এই আশালতা একজন ব্রাহ্মণকন্যা। বীরভূমের কুণ্ডলা গ্রামের তারকনাথ মুখোপাধ্যায় তার পিতা। বিয়ে হয় সিউড়ির ধ্বজাধারী চট্টরাজের সঙ্গে। আঠারো বছর বয়সেই ঘটে আশালতার বৈধব্য এবং সেইসঙ্গে পিতৃবিয়োগ। এরপরে সেবিকাবৃত্তি ও খুজুটিপাড়ায় নুরুলের সঙ্গে প্রণয়। ইত্যবসরে নুরুল ইসলাম পেয়ে গেছেন ভাব-জগতের দিশা। তাই সংসার, সমাজ ও ধর্মের বন্ধন কাটিয়ে মুর্শিদাবাদের রাধার ঘাটে নিতাই খ্যাপার কাছে তার আশ্রমে নেন মন্ত্ৰীক্ষা ও সন্ন্যাস। নুরুল ইসলামের নতুন নাম হয় রাধাময় গোস্বামী। আশালতাকে ধর্ম ও সাধনসঙ্গিনী করে কেন্দুলিতে আশ্রম গড়েন রাধাময়। ১৯৮৯ সালে সেখানেই তার প্রয়াণ ঘটেছে। এমন বিচিত্র জীবনকাহিনি কত যে আমার সংগ্রহে আছে!

যেমন ধরা যাক, মাস কয়েক আগে হঠাৎ লোকমুখে খবর পেলাম বলহরি দাস দেহ রেখেছেন। এতবড় এই দেশে এটা কী আর এমন খবর? কিন্তু আমার কাছে অনেকটাই। বছর তিনেক আগে উত্তরবঙ্গের রায়গঞ্জের অন্তর্গত সুভাষগঞ্জে তরণীসেন মহান্ত-র আস্তানায় বলহরিকে প্রথম দেখি। তখনই বেশ বৃদ্ধ।

বলহরিকে যখন দেখি তখন তিনি আশি ছুঁই ছুঁই বয়সের। ধবধবে ফরসা পাঞ্জাবি ও ধুতি-লুঙ্গি পরনে। গলায় একগাদা মালা— স্ফটিক-প্রবাল-পদ্মবীজ ও রুদ্রাক্ষের। সুদর্শন, চমৎকার নম্ৰ কণ্ঠস্বর। মানুষটি রসিক। বললেন, ‘কারুর নাম বলহরি শুনেছেন? আসলে বাবা-মা জন্মকালেই আমার স্বরূপ তত্ত্ব বুঝে খরচের খাতায় নাম তুলে দিয়েছিলেন। নইলে শ্মশানযাত্রায় যে বুককাপানো হুংকার তোলে মানুষ সেই বলহরি নাম দেবেন কেন? তা আমিও হয়ে গেলাম জ্যান্তে-মরা অর্থাৎ বাউল। কিন্তু সে তো অনেক পরে, যৌবন পেরিয়ে… তার আগে খুব মজার লাইফ আমার।’

বলহরি দাসের ‘লাইফ’ জানার আগে এটা কবুল করা দরকার যে, বীরভূম-বাঁকুড়া-মুর্শিদাবাদ-বর্ধমানে যেসব গেরুয়াধারী বাউল দেখি বলহরি সে-গোত্রের নন। তার বহির্বাস শ্বেতশুভ্র, কারণ তিনি উত্তরবঙ্গের বাউল। উত্তরবঙ্গের বাউল কথাটা স্বরিরোধী কারণ ওই অঞ্চলে স্বাধীনতার আগে এবং বেশ কিছুকাল পরেও কোনও বাউল-ট্রাডিশন ছিল না। জলপাইগুড়ি, রায়গঞ্জ, কোচবিহার, মালদহ, পশ্চিম দিনাজপুর, শিলিগুড়ি, দার্জিলিং এসব জায়গায় বাউল আখড়া, বাউল গান, বাউল সাধনা খুঁজে পাওয়া কঠিন। অঞ্চলের জনবিন্যাসে মিশ্র সংস্কৃতির ভূমিপুত্রদের সঙ্গে মিশে আছে ওপার বাংলার উদ্বাস্তুরা— তাদের জীবনে বাউল সংস্কৃতি তেমন ছিল না, যদিও লালন সমকালে অর্থাৎ দুশো বছর বা তার আগে কুষ্টিয়া-পাবনা-রাজশাহী-রংপুর ধরে বাউলদের একটা ধারা ছিল। কিন্তু মৌলবাদী আলেম মুসলমানরা এ অঞ্চলে বাউলখেদা আন্দোলনে দুর্বার ছিল। হয়তো সেই কারণে আত্মগোপনকারী বাউলরা ছড়িয়ে গেছে নানাদিকে।

দেশত্যাগী যেসব বাউল এখন উত্তরবঙ্গে বা বিশেষ করে পশ্চিম দিনাজপুরে বেশ নাম করা তাদের কয়েকজনের নাম ও জন্মস্থানের পরিচয় দিলে বোঝা যাবে ওই অঞ্চলের বাউলদের পরিচয়। বলহরি দাসের জন্ম রাজশাহীর নওগাঁ মহকুমার মান্দা থানার ঘাটকৈর গ্রামে। নৃপেন্দ্রনাথ বা খেড় ঘোষ জন্মেছেন নওগাঁ মহকুমার বদলগাছি থানার রথপাড়া গ্রামে, তরণীসেন মহান্ত-র জন্ম পাবনা জেলার অষ্ট মুনিষাগ্রামে, গোবিন্দদাসের জন্ম বগুড়া জেলায় গোবিন্দপুর গ্রামে, বিনয় মহন্ত জন্মেছেন উত্তর করিঞ্জির মাকৈল গ্রামে, ধীরেন মোহন্ত জন্মেছেন রংপুর জেলার বদরগঞ্জে। এঁরা এবং এঁদের মতোই বেশ কিছু উদ্বাস্তু মানুষ গত এক দুই দশকে গড়ে তুলেছেন উত্তরবঙ্গের বাউলসমাজ। এঁদের একটা বড় বাৎসরিক সমাবেশ (সূচনা ১৯৮৯) হয় রায়গঞ্জের সুভাষগঞ্জে ১লা বৈশাখ তারিখে প্রধানত তরণীসেন মহান্তর উদ্‌যোগে। পশ্চিমবঙ্গ সরকার সেখানে একটা স্থায়ীমঞ্চ গড়ে দিয়েছেন। বলহরি সেই মঞ্চের ভেতরদিকে একটা প্রকোষ্ঠে বসে কথা বলছিলেন। তার কথা বলবার আগে জানা দরকার যে উত্তরবঙ্গের বাউলরা সংযত স্বভাবের ভক্তপ্রাণ ব্যক্তি। কেউই গেরুয়া পরেন না, সকলেই শুভ্রতার অনুরাগী। মাথায় চুড়া করে ধম্মিল্ল বাঁধেন না, নৃত্যের পরম্পরা নেই বলা যায়। এঁরা প্রধানত সংসারী ও শান্ত। গানের চটকের চেয়ে গানের তত্ত্ব বিষয়ে বেশি আগ্রহী, তাই আসরে প্রশ্নোত্তরমূলক (যেমন ‘গুরু-শিষ্য,’ ‘শরিয়ত-মারফত’, ‘ভক্ত-ভগবান’) গানের পাল্লাদারি খুব জনপ্রিয়। এঁরা কেউ বিদেশ যাননি বা সাহেব মেমদের পাল্লায় পড়েননি। বাড়ি গাড়ির বা প্যান্ট শার্টের দেখনদারি নেই। হাতে বড়জোর একটা হাতঘড়ি। এবারে শোনা যাক বলহরি-বৃত্তান্ত।

১৩২০ বাংলা সনের ১৩ই পৌষ জন্মেছিলেন বলহরি ঘাটকৈর গ্রামে। বাবা শ্রীকান্ত দাস, মা শরৎসুন্দরী। ছোটবেলা থেকে গানপাগল আর মিষ্টিগলা। তবে শৈশবেই পিতৃহারা, তাই মাতৃস্নেহে পালিত। মায়ের সঙ্গে সর্বদা মেয়ে সেজে থাকতেন এবং তার ফলে স্বভাবে আচরণে মেয়েলিপনা এসে যায়। নারীসাজ তাঁর এত স্বাভাবিক ও নিখুঁত ছিল যে একবার জমিদার নরেন্দ্রনাথ সাহাচৌধুরীর সঙ্গে কলকাতা ভ্রমণে এলে পুরুষরা ট্রামে তাঁকে লেডিজ সিট ছেড়ে দেন।

বলহরি বললেন, ‘মেয়ে সেজে থাকতাম, গান গাইতাম, তাই যাত্রাদলে ডাক এল— একচেটিয়া ফিমেল পার্ট— খুব লোকপ্রিয় ছিলাম। দেশভাগের বছরে পাবনা জেলার সুজানগর থানার শ্যামগঞ্জের হাটে আমাকে নিয়ে তো রায়ট বাধার জোগাড়। হাটে বছিরুদ্দিন মিঞা নামে এক ধনী মুসলিম আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে বলল, “হিন্দুরা সব চলে যাচ্ছে, আমি এ মেয়েডারে ছাড়ুম না।” যাকে বলে “বলপূর্বক নারীহরণ” বুঝলেন? তারপরে চারদিকে রটে গেল, সাগরকান্দী থানায় খবর গেল হাট থেকে হিন্দুরমণী নিয়ে যাচ্ছে বছির মিঞা। পুলিশ এসে বন্দুকে ফাঁকা আওয়াজ তুলে লোকজন সরিয়ে ঘিরে ধরে। ব্যাপার দেখে সাগরকান্দীর ননী পোদ্দার হেসে বলে, “আরে বছির তুই কাকে নিয়েছিস? এ তো আমাদের বলহরি— ঐ যে গান গায়।” আমি কিন্তু রা কাড়িনি বুঝলেন, ভাবছিলাম দেখা যাক রগড় কদ্দুর গড়ায়।’ বলহরি একটু থেমে রসান দিয়ে বললেন, ‘এ ঘটনার আগে আমি আরেকবার অপহৃত হই। সেবার সরাসরি যাত্রার আসর থেকে আয়ুব খানের খানসেনা আমাকে সখীর সাজপরা অবস্থায় ধরে তাদের ব্যারাকে নিয়ে গিয়ে তোলে। তারপরে বুঝতেই পারছেন, ব্যাটাদের সেকি আফশোস।’

এমন আদ্যন্ত রসিক মানুষটি কিন্তু শেষ পর্যন্ত হয়ে গেলেন বৈরাগ্যপন্থী। ঘর সংসার করেননি। লালন শাহর প্রশিষ্য মহম্মদ কুতুব আলির কাছে বলহরি নেন তত্ত্ব জ্ঞানের দীক্ষা শিক্ষা। তবে কায়াসাধন করেননি। গানে গানে মাতিয়ে দিয়ে গেছেন দুই বাংলা অর্থাৎ সীমান্তের এপার আর ওপারের উত্তরবঙ্গ। না, ফরাক্কার এপারে অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গের গাঙ্গেয় সমভূমি তার বিচরণস্থল ছিল না। পশ্চিম ও পূর্ব দিনাজপুরে ছিল এবং এখনও আছে অনেক শিষ্য, প্রধানত গানের। সীমান্তে তার ছাড়পত্র লাগত না। গানের সুরের আসন পেতেছিলেন ভক্তদের প্রাণে। এ অঞ্চলের সকল গায়ক তাকে ‘বাউল সম্রাট’ শিরোপা দিয়েছিল। ছিলেন তত্ত্বজ্ঞানী ও রসিক। আশি ছুঁই ছুঁই বয়সে, আমার অনুরোধে, বলহরি একহাতে একতারা নিয়ে কোমরে আরেক হাত রেখে যে-আশ্চর্য নাচ নেচেছিলেন লালনের গানের সঙ্গে, তাতে একটা অন্য নাচের ঘরানার ছাপ ছিল। তাঁর মৃত্যুতে নিঃসন্দেহে উত্তরবাংলার বাউল গানের পরিমণ্ডল বিষণ্ণ ও কিছুটা রিক্ত হয়ে গেছে।

বলহরি ছিলেন জন্মসূত্রে নিম্নবর্গের নমঃশূদ্র। একথা ভাবতে গিয়ে মনে পড়ল যে এখনকার পশ্চিমবঙ্গের যত গায়ক বা গায়িকা বাউল গান গেয়ে বেঁচে আছেন ও সংসার চালাচ্ছেন তাদের একটা বড় অংশ নিম্নবর্গ থেকে আসা। ভদ্ররকম জীবিকা জোটেনি তাদের— কায়িক শ্রমে আছে কুণ্ঠা বা আলস্য। অগত্যা বাউলের আসর তাঁদের দিশা দিয়েছে। বেশি গান হয়তো সঞ্চয়ে নেই, নেই তেমন গানের শিক্ষা, কিন্তু আছে উদ্যম ও মরিয়া লড়াই।

অন্য সব পথ বা জীবিকা ছেড়ে কেন যে এরা বাউলের মার্গে আসে তার কারণ এক একজনের কাছে এক এক রকম, তবে অনেকে আসে গানের নেশায়। যেমন ধরা যাক কার্তিকের কথা। মাঠে চাষ করা, মাছ-ধরা, মুনিশ-খাটা এক শ্রমজীবী ঘরের ছেলে সে, হঠাৎ কীভাবে খমক, খঞ্জনি, একতারা, ডুবকি আর দোতারার সুর তাকে উদ্‌ভ্রান্ত করেছিল কে জানে। তার আড়ষ্ট হাতের খমক বাজনা আর অপটু গলার গান শুনে তবু তাকে ভরসা দিয়েছিল বন্ধুরা, বাড়ির লোকজন— ভাইবোন, বাবা-মা। শেষমেশ বাগদি ঘরের কার্তিক হয়ে গেছে বাউল। মাধবদাস বাউলের কাছে দীক্ষা— বাউল পথের আর বাউল গানের। কিন্তু গুরুর সঙ্গে আড়াআড়ি ঘটে গেল। কারণ গুরুর আশ্রমে আশ্রিত একটি মেয়ের সঙ্গে তার প্রণয়। দুজনে একসঙ্গে পালাতে গিয়ে ধরা পড়ে গেল গুরুর কাছে। গুরু তাকে তাড়িয়ে দিলেন। আশ্রমচ্যুত, নিরাশ্রয়, অন্ন নেই— সে এক কঠিন সময় গেছে কার্তিকের। এদিকে দুর্জয় মনের টান দুজনের— আসঙ্গ পিপাসা। অদম্য সেই টানে আবার যোগাযোগ, আবার পলায়ন। এবার দুজনকে আশ্রয় দিলেন জীবন গোঁসাই। তাঁর কাছে হল বাউল মতে কায়া সাধনার শিক্ষা। মেয়েটি হল সাধনসঙ্গিনী।

কাহিনিটি যত সরলরৈখিক, জীবন তত বক্র। কাজেই কার্তিকের কঠিন আত্মসংকটের দিনগুলো পেরোনোর কথা এ-আখ্যানে উহ্য থাকল। দুজনের দুখের কুটির, দিন গুজরান, মাধুকরী, গান গেয়ে গেয়ে গলা চিরে যাওয়া, সাধনসঙ্গিনীর ভিক্ষাবৃত্তি, আবার সন্তান পালন ও ক্ষুন্নিবৃত্তি— এমনতর দিনযাপন গড়পড়তা বাংলার বাউলের জীবনে নির্মম সত্য। এর কোথাও বিদেশভ্রমণ, ডলার উপার্জন, লালসা কিংবা ভোগবাদের স্পর্শমাত্র নেই। অথচ এরাই এখনকার বাউলের গরিষ্ঠ অংশ। মেলা মচ্ছবে এরাই সকল অতিথিকে সেবা দেয়, শুশ্রুষা দেয়, ভালবাসে। জন্ম এদের প্রধানত হীন বা অচ্ছুৎ বংশে— হাড়ি, ডোম, বাগদি, দুলে বা রাজবংশী এরা, অনেকে ‘অর্জল’ পর্যায়ের মুসলমান অর্থাৎ নিকিরি বা জোলা বা নলুয়া— শরিয়তি খানদানে তারা অস্পৃশ্য— বেশরিফ।

এমনই একজন অন্তেবাসী বাউল আমাকে সমাদর করে চিঠি লিখে নেমন্তন্ন করেছিল জয়দেব কেঁদুলির মেলায়। পরে সেই বেণীমাধব দাস আর তার ‘ফকির বাউল আখড়া’য় আমি অনেক ভদ্রসন্তানকে নিঃসংকোচে নিয়ে গেছি। আখড়ার মধ্যমণি হয়ে একটা বড় কাঠের ধুনি জ্বালিয়ে বসে আছে বেণীমাধব। প্রসন্ন চোখমুখ, সেবাপরায়ণ মন, কৃষ্ণকান্ত দেহ। আখড়ায় যে আসছে, একটানা গান শুনছে, ঘড়ি ঘড়ি হাতে এসে যাচ্ছে ধূমায়িত চা। পরে সকলেই পাবে অন্নসেবা— অবশ্য মাটিতে বসে, সকলে সবজাতিবর্ণ মিলে সেই সেবা— অজস্র স্বেচ্ছাব্রতী কর্মী নিরলস খেটে যাচ্ছে পরিবেশন ও রান্নার কাজে। অথচ বেণীমাধব তো কোনও সম্ভ্রান্ত মহান্ত নয়— চেয়েচিন্তে ধারকর্জ করে সে চাল ডাল গুড় সবজি এনেছে। আখড়ার মধ্যে ছোট ছোট খুপরি করে আয়োজন করেছে অতিথিদের বিশ্রামের, মেয়েদের আব্রুর। তার ছেলেবেলার স্মৃতি বলতে গ্রাম-নদী-দারিদ্র্য। ছাড়াছাড়াভাবে লেখাপড়া শিখে তৃতীয় শ্রেণিতে উঠে ইস্তফা, তার মধ্যেই আটবার স্কুল বদল— এ-আত্মীয় ও-আত্মীয় বাড়ির কৃপায় যেটুকু যেমন আশ্রয় জুটেছিল। তারপরে দরিদ্র সংসারে অবশ্যম্ভাবী শিশুশ্রমিকের হরেক বৃত্তি নেওয়া— চায়ের দোকানে বয়, সবজি বিক্রি, সাইকেল সারাই, হকারি। মাঝে মাঝে বাবার সঙ্গে পায়ে হেঁটে আশপাশের গ্রামে ভিক্ষাবৃত্তি। পরে একা একা, খঞ্জনি বাজিয়ে।

এবারে বেণীমাধব হিসেব করে দেখল গাঁয়ে গাঁয়ে পায়ে হেঁটে ‘হরে কৃষ্ণ হরে রাম’ নামগান শোনালে গেরস্থরা তেমন একটা উপুড়হস্ত করে না, তাই অন্য গান চাই, অন্তত রোজগার বাড়াতে গেলে। গান তো অনেকই জানা ছিল তার কিন্তু যন্ত্র? যন্ত্র কেনার পয়সা কই? থাকার মধ্যে ওই সেই সাবেক খঞ্জনি জোড়া। হঠাৎ একজন একটা গুপিযন্ত্র হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল বাজাতে। মজার কথা হল যে দিল যন্ত্রটা সে নিজে সেটা বাজাতে জানত না। বেণীমাধব কিন্তু স্বল্পায়াসেই বাজাতে পারল। আর তাকে দেখে কে?

এভাবেই বেণীমাধব হয়ে গেল বাউল গানের গায়ক। তার বংশে প্রথম একজন গানের এই নতুন জীবিকাধারী হয়ে উঠল। তারপরে একদিন একজন প্রবীণ বাউল বেণীকে নিয়ে গেল ‘নিরাময়’ নামের যক্ষ্মা হাসপাতালে। ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে রুগি আর নার্সদের গান শোনানো, সে এক অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতা। অনেক পয়সা হত কিন্তু ভাগের সময় দেখা যেত কম। কী ব্যাপার? সেই বুড়ো বাউল থলির মুখটা নিচু করে পয়সা নিয়ে নিত অদ্ভুত কায়দায়। সন্দেহ হত কিন্তু বেণী ভয়ে কিছু বলতে পারত না, যদি সে তাকে সব জায়গায় না নিয়ে যায়। বেণীকে কে আর চেনে? কেই বা গাইতে দেবে? একদিন রাগে দুঃখে শূন্য থলেতে হাত পুরে বেণী টের পায় থলের মধ্যে আটটা খোপ, তার চারটেয় এমন কৌশল যে উপুড় করলেও পয়সা পড়বে না। প্রবঞ্চিত বেণী খেপে উঠে চেঁচায়, লোকটা ধরা পড়ে রেগে যায়। তাকে মারে লাথি চড় ঘুসি। জীবনে বলতে গেলে এই প্রথম বাইরের লোকের হাতে মার খাওয়া। খুব কান্না কাঁদল বেণীমাধব। অভিজ্ঞতা এমন করেই তাকে বড় করে তুলল দিনে দিনে। কিন্তু যাবে কোথায় সে? একা একা তো সর্বত্র গান করার সুযোগ ঘটে না, দলে থাকতে হবে। কোনও একটা বাউলের দলে।

কিন্তু সে সময়ে অর্থাৎ বেণীমাধবের কৈশোরে এত তো বাউলের দল ছিল না, ছিল না তার এখনকার মতো জনাদর। বীরভূমে তার চেনা পরিধির মধ্যে ছিল মাত্র দুটো দল। একটা নবনীদাসের আরেকটা স্থানীয় পঞ্চরত্নের দল। তাতে সদস্য ছিল গঙ্গাধর দাস, নারায়ণ দাস এরা। গানটা বেণী ভালই গাইত। গঙ্গাধরের মনে ধরে গেল, তাকে নিয়ে নিল দলে। পারিশ্রমিক একরাতে দু’ টাকা। অনেকে গান শুনে ব্যক্তি-শিল্পীকে আলাদা পয়সা দিত, দলের নিয়ম ছিল সে পয়সা যার যার তার তার। কিন্তু বেণীকে তা দেওয়া হত না— অন্যেরা নিয়ে নিত। বঞ্চনা ও অত্যাচারের এতেই শেষ নয়। স্রেফ দলে টিকে থাকার জন্যে বড়দের তোয়াজ করা, ফাইফরমাশ খাটা বা গা-হাত-পা টিপে দেওয়া। তার অন্যথা হলেই মার। কেঁদে লাভ নেই, ক্ষোভ চেপে রাখতেই হবে। কারণ দলে তো কেউ তাকে ধরে রাখেনি। অথচ দলে তাকে থাকতেই হবে, নইলে তার নাম-যশ ছড়াবে কী করে? খ্যাতি ও প্রতিষ্ঠা লাভের দুর্দম খিদে তখন বেণীমাধবের। নিজের একটা আলাদা পরিচিতি চাই-ই চাই, অতএব চোখ বুজে শাসন শোষণ মেনে নিয়ে কেটে গেছে তার কৈশোর কাল।

তারপরে যৌবন সূচনাতেই তার সুনাম ছড়িয়ে গেছে, পঞ্চরত্ন দল ছেড়ে সে গড়ে তুলেছে বেণীমাধবের দল। স্বাধীন আর স্বয়ম্বশ। আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। এখন সে কেঁদুলি মেলার আখড়াধারী। অতিথি, দুঃস্থ, ক্ষুধার্ত ব্যক্তি এবং মান্যমানদেরও সে এখন সেবা দিতে পারে।

বাউলদের নিয়ে বা তাদের তত্ত্ব ও জীবনদর্শন নিয়ে যারা ইতিহাস ধরে জানতে চায় তাদের চোখে না পড়ে পারে না যে প্রথমদিকে বাউল ও ফকির এই দুই সাধনপন্থা বা আচার আচরণ ক্রিয়াকরণ বিষয়ে কোনও স্বতন্ত্র দৃষ্টিকোণ ছিল না। ১৮৪৬ সালে ইন্ডোলজি চর্চাকারী এইচ. এইচ. উইলসন সাহেব গৌণধর্মী সাধকদের বিবরণে বাউলদের কথা এনেছিলেন। অক্ষয়কুমার দত্ত ১৮৭০ ও ১৮৮৩ সালে লেখা তাঁর দুটি বইতে প্রায় উইলসনের ধারণার প্রতিধ্বনি করে গেছেন। বাউলদের ধর্মাচরণ ও জীবনযাপন সম্পর্কে এঁদের ধারণা ছিল কিছুটা ভ্রান্ত, অস্পষ্ট অথচ বিরুদ্ধ। ১৮৯৬ সালে ব্রাহ্মণ পণ্ডিত যোগেন্দ্রনাথ বিদ্যাভূষণ তো বাউলদের সম্পর্কে যথেচ্ছ কটুক্তি করেছেন। ১৮৯৮ সালে মৌলবি আবদুল ওয়ালি তাঁর একটি দীর্ঘ নিবন্ধে মুসলমান ফকির ও হিন্দু বৈরাগী বলে বিভাজন করেছেন— লালনকে (মৃত্যু ১৮৯০) তিনি ফকিরদের দলভুক্ত করেছেন। এঁদের লেখালেখির সমসময়ে নগেন্দ্রনাথ বসু তাঁর ‘বিশ্বকোষ’-এ ‘বাতুল’ থেকে ‘বাউল’ এমন মত প্রতিষ্ঠা করে মন্তব্য করেছেন।

বাতুলের ন্যায় এই সম্প্রদায়ের মানুষ লোকেরা ছিন্ন বস্ত্রখণ্ড সংযোজিত করিয়া পরিধান করিয়া থাকে। ভজনগীত কালে নৃত্য ও বেশভূষা নিরীক্ষণ করিলে ইহাদিগকে বাতুল বলিয়াই অনুমিত হয়। বাতুল হইতে ইহাদের বাউল নাম হইয়াছে।

এর মধ্যে মধ্যে লালন শাহ ফকিরের তিরোধান ঘটেছে এবং সারা মধ্যবঙ্গ জুড়ে তাঁর ব্যাপক অনুসারীদের খবর মিলছে হাজারে হাজারে। ১৮৯০ সালে তাঁর প্রয়াণ সংবাদসহ ৩১ অক্টোবর ‘হিতকরী’ পত্রিকা কুষ্টিয়া থেকে যে প্রতিবেদন-প্রবন্ধ প্রকাশ করে, তাতে লেখা হয়েছে:

তিনি ধৰ্ম্মজীবনে বিলক্ষণ উন্নত ছিলেন…নিজে লেখাপড়া জানিতেন না; কিন্তু তাঁহার রচিত অসংখ্য গান শুনিলে তাহাকে পরম পণ্ডিত বলিয়া বোধ হয়।…সকল ধৰ্ম্মের লোকই তাঁহাকে আপন বলিয়া জানিত।

এই প্রথম একজন মধ্যবিত্ত শিক্ষিত ভদ্রলোক লালনের জীবনপ্রণালী ও গান সম্পর্কে শিষ্ট এমনকী প্রশংসাযুক্ত উক্তি করলেন। দেখা যাচ্ছে ১৮৯০ সাল নাগাদ বাউল-ফকিররা ততটা অপাঙ্‌ক্তেয় নেই বা নিন্দাযোগ্য হয়নি। লালনের সমসময় এবং তিরোধানের পর মধ্যশিক্ষিত গ্রামবাসীশ্রেণি শখের বাউলের দল গড়ে এক ধরনের ভাবমূলক এবং নির্বেদচিন্তার গান গাইতে শুরু করেছিলেন। প্রধানত কাঙাল হরিনাথের রচিত ও অন্যান্যদের সেই গান কলকাতা ও ঢাকাতেও জনপ্রিয় হয়েছে। সেইসব ভাববহুল গানের ধাঁচে আকৃষ্ট হয়ে অনেক নগরবাসী ভদ্রলোক বাউল গান লিখতে থাকেন, যার সেরা নমুনা মেলে কবি বিহারীলালের ‘বাউল বিংশতি’-তে।

কিন্তু বাউলদের গান রচনা তাঁদের জীবনের একটা প্রকাশপিপাসু বাসনার সৃজন হলেও আসল সাধনা তাদের দেহতত্ত্বগত করণকৌশল, যা গোপ্য ও গুরুকেন্দ্রিক। সমাজের ধর্মধারণা ও আচরণের সাত্ত্বিক মূল স্রোতের প্রতিবাদী বা বিরুদ্ধবাদী এই সাধকরা এমন সব বিশ্বাসের কথা বলতে থাকলেন যা উচ্চবর্গের সমাজ ও ধর্মবোধকে প্রত্যক্ষভাবে আঘাত করতে লাগল। শ্রীরামকৃষ্ণ এই সাধনাকে স্পষ্ট ভাষায় নিন্দা করলেন। ব্রহ্মবাদী সম্প্রদায়ের ভাল লাগেনি এমন ইহকেন্দ্রিক দেহসর্বস্ব সাধনাকে। বিশেষত বাউল ফকিররা অনুমানবাদে মোটেই বিশ্বাসী ছিল না, পূর্ব ও পরজন্মে ছিল সন্দিহান, মন্দির মসজিদের ছিল বিরোধী।

ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়; বাউল ফকিরদের মতো অন্যান্য গৌণধর্মীদের, বৃহত্তর হিন্দুসমাজ উনিশ শতকে বৈশ তুচ্ছতাচ্ছিল্য ও নিন্দা করেই ক্ষান্ত হয়েছে— প্রত্যক্ষ সংগ্রামে নামেনি। এই প্রতিবাদ প্রতিরোধ ও বাউল উৎসাদনে নেমেছিল মুসলমান সমাজের কট্টর অংশ। শরিয়তি অনুশাসন থেকে বেরিয়ে এসে দলে দলে বহু সাধারণ অশিক্ষিত মুসলিম বাউল ফকির হতে থাকে। ওহাবী, ফরায়জি ও আহলে হাদিস আন্দোলন এবং সংরক্ষণশীল মুসলিম মানসের বিরুদ্ধাচরণে বাউলরা বিপন্ন হয়। তাদের ওপর দৈহিক অত্যাচার ও সামাজিক বয়কট চলতে থাকে। এ সবের বিশদ নমুনা পাওয়া যায় ১৯২৫ সালে প্রকাশিত ‘বাউল ধ্বংস ফৎওয়া’ বইতে। এই পক্ষের দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে উঠেছিল ইসলাম ত্যাগীদের দুরাচার— এবং অজ্ঞ গ্রামবাসী মুসলমান শ্রেণির মধ্যে তাদের দুর্বার অনুপ্রবেশের আশঙ্কা। ফৎওয়ায় বলা হয়েছিল:

মোছলমানের মধ্য হইতে একদল লোক বাহির হইয়াছে, যাহারা, ‘বাতেনী দোরবেশ ফকীর’ বলিয়া দাবী করে। উহাদের প্রকাশ্য নাম ‘বাউল’ বা ‘ন্যাড়ার ফকীর’।

লক্ষণীয় যে ধর্মত্যাগীদের একই সঙ্গে বাউল ও ফকির বলা হয়েছে। পরবর্তীকালেও নানা রচনায় দেখা গেছে বাউল আর ফকিরদের সমার্থক বলে মনে করা হয়েছে। বাউলবিরোধী আন্দোলনের প্রধান লক্ষ্য লালন শাহ ফকির ও তার অনুসারী লালনপন্থীরা। ধর্মপ্রাণ শরিয়তনিষ্ঠ মুসলিম মানসে বাউলদের সম্পর্কে ঘৃণা ও বিদ্বেষ উৎপাদনের জন্য ফৎওয়ায় নানা অলীক অভিযোগ পেশ করা হয়েছিল। যেমন:

তাহারা মোছলমানের দোরবেশ, আলি, শাহ্‌, ফকিরের পরিচয়ে মোছলমান সমাজে মিলিয়া মিশিয়া, তাহাদের কন্যা ও ভগ্নিকে বিবাহ করতঃ গুপ্ত শক্তভাবে পর্দ্দায় থাকিয়া নানারূপে ছলে, বলে ও কৌশলপূৰ্ব্বক পবিত্র কোরআন ও এছলামকে ধ্বংস করার মানসে, বিষম থোকার জাল ফেলিয়া, মোছলমান সমাজকে জর্জ্জরিত ও মূর্খ মোছলমানকে ধর্ম্মভ্রষ্ট করিতেছে। আবার হিন্দুজাতির বৈরাগী সাজিয়া, কামাখ্যা, নবদ্বীপ, কাশী, বৃন্দাবন, কান্তজী প্রভৃতি হিন্দু তীর্থস্থানে তীর্থ ও দেবদেবীর পূজা করিয়াও থাকে।

এ-বিবরণ পড়লে বোঝা যায়, অভিযোগ মূলত ভেকধারীদের সম্পর্কে। একদিকে তারা দরবেশ-অলি-ফকির সেজে মুসলমান সমাজে ধ্বংসের বীজ পুঁতছে, আরেকদিকে হিন্দু বৈরাগী সেজে তীর্থ ও ভজনপূজন করছে। তার মানে এরা ঠিক ধর্মাচারী নয়— ভণ্ড, মেকি ও প্রতারক। কিন্তু অভিযোগ কেবল এইটুকু বা এত সামান্য নয়। বলা হয়েছে:

তাহারা হায়াজ নেফাজের রক্ত, বীৰ্য্য, মল, মূত্র, গর্ভপাত শিশুর মাংস, গাঁজা, ভাঙ্গ, মদ ইত্যাদি নাপাক জিনিস ভক্ষণে রিপুদমন করে। স্ত্রী যোনি ও অগ্নিকে ছেজদা করে। দলে দলে স্ত্রীপুরুষ একত্র উলঙ্গ হইয়া নাচিয়া গাহিয়া কাম-রিপু দমন হইয়াছে কিনা তাহার পরীক্ষা এবং তাহাতে যে বীর্যপাত হয়, তাহা ময়দার সহিত মিশাইয়া রুটি প্রস্তুত করতঃ ‘প্রেমভাজা’ নামক উপাদেয় (?) মারফতী খানা খায়। তাহারা পরস্পর পরস্পরের স্ত্রীকে ব্যবহার করিয়া হিংসা রিপু দমন করে ও স্ত্রী-পুরুষ মিলিত হইয়া খমক, খঞ্জরী, জুড়ি বাজাইয়া দেহ-তত্ত্ব ফকীরি গান করতঃ ভিক্ষা করিয়া বেড়ায়।

এতসব অভিযোগমালা পেশ করে এদের ধ্বংসের ফৎওয়া জারি করে কট্টরপন্থীরা বসে থাকেনি নিশ্চয়ই। বস্তুত ব্যাপকভাবে বাউলখ্যাদা আন্দোলন, শারীরিক নির্যাতন, গান-বাজনার প্রত্যক্ষ বিরোধিতা চলেছে এবং তার ফলে একদল বাউল ফকির নিবৃত্ত হয়েছে, একদল পালিয়েছে, আরেকদল আত্মগোপন করে ছড়িয়ে পড়েছে নানা গ্রামে। কিন্তু ইতিমধ্যে দেশের হাওয়া বদলেছে। প্রধানত কলকাতার ঠাকুর পরিবার তাঁদের শিলাইদহ-কুষ্টিয়া ও পাবনা-সাজাদপুরে জমিদার পরিচালনা সূত্রে প্রত্যক্ষ সংস্পর্শে আসেন ওই অঞ্চলের বাউলদের। তাদের ধর্মকর্ম বা আচরণবাদ নয়, ঠাকুৱরা আকৃষ্ট হন তাদের গানের ভাবে ও সুরে। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রনাথ ছিলেন বাউলদের সম্পর্কে অনুকম্পায়ী ও গুণগ্রাহী। লালন ও গগন হরকরার গানে তাঁরা বিমুগ্ধ হয়ে পড়েছিলেন। তাঁদের ভাগিনেয়ী সরলা দেবীও সংগ্রহ করেছিলেন অন্য অনেক বর্গের লোকায়ত গান। তাঁদের উদ্যমে তৈরি হতে থাকল বাউল গানের স্বরলিপি, তার লক্ষ্য নিশ্চয়ই প্রচার। ‘বীণাবাদিনী’ পত্রিকায় ইন্দিরা দেবীচৌধুরাণী লালনগীতির স্বরলিপি প্রকাশ করলেন। রবীন্দ্রনাথ ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় ছাপলেন মোট কুড়িটি লালনগীতি, কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়া আখড়া থেকে এনে, ১৩২২ সালের আশ্বিন থেকে মাঘ সংখ্যায়, চার কিস্তিতে। তার আগেই ১৩১৪ সালে ‘প্রবাসী’-তে প্রকাশিত রবীন্দ্রনাথের ‘গোরা’ উপন্যাসে লালনের একটি (‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি’) গান উদ্ধত হয়েছে, ‘জীবনস্মৃতি’-তে (১৩১৯) উল্লিখিত হয়েছে বাউল গানের মাহাত্ম ও অসামান্যতা।

একথা আজ সবাই মানেন যে, সম্ভবত রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে লালন শাহ-র দেখা সাক্ষাৎ হয়নি, কিন্তু লালন শিষ্যদের সঙ্গে তাঁর কথাবার্তা হত, বাউলপস্থা নিয়ে তার কৌতুহল ছিল, বাউল গানের সুর কাঠামো তাঁর সাংগীতিক মানসে স্থায়ী ছাপ রেখেছিল। ১৯২২ সালে শ্রীনিকেতনের কালীমোহন ঘোষকে এক চিঠিতে লিখেছিলেন,

তুমি তো দেখেছ শিলাইদহতে লালন শাহ ফকিরের শিষ্যগণের সহিত ঘণ্টার পর ঘণ্টা আমার কিরূপ আলাপ জমত। তারা গরীব। পোষাক-পরিচ্ছদ নাই। দেখলে বোঝবার জো নাই তারা কত মহৎ। কিন্তু কত গভীর বিষয় কত সহজভাবে তারা বলতে পারত।

একেই বলে দৃষ্টিভঙ্গির তফাত। উইলসন, অক্ষয়কুমার, যোগেন্দ্রনাথ, শ্রীরামকৃষ্ণ, নগেন্দ্রনাথ ও ‘বাউল ধ্বংস ফৎওয়া’র সংকলক রেয়াজউদ্দিন আহমদের বিরূপ ও বিদ্বিষ্ট মনোভাবের তুলনায় রবীন্দ্রনাথ কত মরমি ও অনুভূতিপ্রবণ। দরিদ্র বাউলদের মধ্যে তিনি খুঁজে পেয়েছিলেন মহত্ত্ব ও গভীরতা। লালনের গানের অনুলিপি সংগ্রহ করে এনে যত্ন করে পড়েছিলেন, সেই খাতা এখনও শান্তিনিকেতনে রক্ষিত আছে।

কিন্তু এখানেই শেষ নয়। ১৯২৫ সালে কলকাতার ভারতীয় দর্শন মহাসভায় রবীন্দ্রনাথ যে লিখিত ভাষণ পাঠ করেন তাতে বাউল দর্শনের এক ভাববাদী ব্যাখ্যা উপস্থাপিত হয়। তাঁর অনুভবে মনে হয়েছিল গ্রাম বাংলার নিরক্ষর গীতিকারের লেখা বাউল গানের তত্ত্ব আর প্রাচীন বৈদিক ঋষির রচনায় এক চমৎকার ভাবসাযুজ্য আছে আনন্দময়তায়। বাউলের রচনা আর শেলির কবিতায় তিনি পেয়েছিলেন একই সংরাগ যেন। পরে, রবীন্দ্রনাথের গানের সংগঠনে বাউল সুরকাঠামোর এমনকী কয়েকটি ক্ষেত্রে বাউল গানের ভাবাত্মক প্রকাশভঙ্গির নিজস্ব ভাষা স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। সন্দেহ নেই, বাংলার বাউলকে তিনি জাতে তুলেছেন এবং হয়তো খানিকটা আদর্শায়িত করে।

দেখতে দেখতে এমন দাঁড়াল যেন বাউল ও লালন সমার্থক। ব্যাপারটা চমৎকার বিশ্লেষণ করে বুঝিয়ে দিয়েছেন রমাকান্ত চক্রবর্তী। তাঁর মতে,

একথা জোর দিয়েই বলা যায় যে, জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির এবং বিশেষভাবে রবীন্দ্রনাথের অন্বেষণ এবং সুদৃঢ় পৃষ্ঠপোষকতা না থাকলে, মধ্যবঙ্গীয় বুদ্ধিজীবীদের প্রচার সত্ত্বেও, হিন্দু-পুনরুত্থানবাদের ধ্যানে তারকাচক্ষু বাঙ্গালি হিন্দু ভদ্রলোকেরা লালনকে দেখতেই পেতেন না। জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি থেকে উৎসারিত জোরাল প্রচার বাউল গানকে এবং লালনকে অমরত্ব দান করল।

শুধু লালন নয়, রবীন্দ্রনাথ পছন্দ করতেন গগনের গান, সাধক গোঁসাইগোপালকে এবং তাঁর কথাবার্তা হত সর্বক্ষেপী বোষ্টুমির সঙ্গে। এ সবই শিলাইদহ-কুষ্টিয়া পরিমণ্ডলের ব্যাপার। পরে ক্ষিতিমোহন সেনের প্ররোচনায় অন্য ধরনের কিছু বাউল গানের আস্বাদ পান এবং তা নিজের লেখায় নানাভাবে উদ্ধৃত করেন। হাসন রজার গানও তাঁর প্রিয় ছিল। বাংলার বাউল ও বাউল গান বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের কতকগুলি মন্তব্য বা ভাষ্য আমরা লক্ষ করতে পারি, তার থেকে বোঝা যাবে কেন তাঁর বাউল গানের প্রতি পক্ষপাত জন্মেছিল। পর্যায়ক্রমে তিনি লিখেছেন:

১. আমার অনেক গানেই আমি বাউলের সুর গ্রহণ করেছি এবং অনেক গানে অন্য রাগরাগিণীর সঙ্গে আমার জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে বাউল সুরের মিলন ঘটেছে। এর থেকে বোঝা যাবে বাউলের সুর ও বাণী কোন এক সময়ে আমার মনের মধ্যে সহজ হয়ে মিশে গেছে।

২. ‘অন্তরতর যদয়ামাত্মা’ উপনিষদের এই বাণী এদের মুখে যখন ’মনের মানুষ’ বলে শুনলুম, আমার মনে বড়ো বিস্ময় লেগেছিল। এর অনেককাল পরে ক্ষিতিমোহন সেন মহাশয়ের অমূল্য সঞ্চয়ের থেকে এমন বাউলের গান শুনেছি, ভাষার সরলতায়, ভাবের গভীরতায়, সুরের দরদে যার তুলনা মেলে না— তাতে যেমন জ্ঞানের তত্ত্ব তেমনি কাব্য রচনা, তেমনি ভক্তির রস মিশেছে। লোকসাহিত্যে এমন অপূর্বতা আর কোথাও পাওয়া যায় বলে বিশ্বাস করি না।

দুটি মন্তব্যেই বাউলের গানের ভাব-ভাষা-সুর ও সারল্যের মধ্যে গভীরতার কথা আছে, বাউলের জীবনাচরণ বা প্রতিবাদী চেতনার কথা নেই। উপনিষদীয় ভাবনার সঙ্গে তিনি ‘মনের মানুষ’ তত্ত্বের সমীকরণ করতে চেয়েছেন, যদিও ‘মনের মানুষ’ আসলে এক কায়াসাধনের কনসেপ্ট—তা কি তিনি জানতেন না? ক্ষিতিমোহনের সংগৃহীত গানে ভাষার সরলতা ও ভাবের গভীরতা না হয় বোঝা গেল কিন্তু তার ‘সুরের দরদ’ তিনি কীভাবে অনুসন্ধান করলেন? ওই গানের গায়নপদ্ধতি ও সুরকাঠামো কি ক্ষিতিবাবুর আয়ত্ত ছিল? তিনি কি্‌ বাউল গান গাইতেন? এমন খবর অন্তত আমাদের জানা নেই।

বাংলার বাউল গান বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের উচ্ছ্বাস ও আসক্তির কারণ অনুসন্ধানে রবীন্দ্রনাথের আরও দুটি মন্তব্য আমরা পরীক্ষা করতে পারি। তাতে দেখা যাবে এ-জাতীয় গানের অন্যতর সমাজ-তাৎপর্য তার চোখে পড়েছে অথচ বুঝেছেন তার একঘেয়েমিও। যেমন:

৩. আমাদের দেশে যারা নিজেদের শিক্ষিত বলেন তাঁরা প্রয়োজনের তাড়নায় হিন্দু-মুসলমানের মিলনের নানা কৌশল খুঁজে বেড়াচ্ছেন। অন্য দেশের ঐতিহাসিক স্কুলে তাঁদের শিক্ষা। কিন্তু, আমাদের দেশের ইতিহাস আজ পর্যন্ত, প্রয়োজনের মধ্যে নয়, পরন্তু মানুষের অন্তরতর গভীর সত্যের মধ্যে মিলনের সাধনাকে বহন করে এসেছে। বাউল-সাহিত্যে বাউল সম্প্রদায়ের এই সাধনা দেখি— এ জিনিস হিন্দু-মুসলমান উভয়েরই; একত্র হয়েছে অথচ কেউ কাউকে আঘাত করেনি। এই মিলনে সভাসমিতির প্রতিষ্ঠা হয়নি; এই মিলনে গান জেগেছে, সেই গানের ভাষা ও সুর অশিক্ষিত মাধুর্যে সরস। এই গানের ভাষায় ও সুরে হিন্দু-মুসলমানের কণ্ঠ মিলেছে, কোরান পুরাণে ঝগড়া বাধেনি।

৪. অধিকাংশ আধুনিক বাউল গানের অমূল্যতা চলে গেছে, তা চলতি হাটের সস্তাদামের জিনিস হয়ে পথে পথে বিকোচ্ছে। তা অনেক স্থলে বাঁধি বোলের পুনরাবৃত্তি এবং হাস্যকর উপমা তুলনার দ্বারা আকীর্ণ— তার অনেকগুলোই মৃত্যুভয়ের শাসনে মানুষকে বৈরাগীদলে টানবার প্রচারকগিরি।— এর উপায় নেই, খাটি জিনিসের পরিমাণ বেশি হওয়া অসম্ভব।…এইজন্যে সাধারণত যে-সব বাউলের গান যেখানে-সেখানে পাওয়া যায়, কী সাধনার কী সাহিত্যের দিক থেকে তার দাম বেশী নয়।

মন্তব্যগুলি নেওয়া হয়েছে ১৯২৭ সালে ‘হারামণি’র রবীন্দ্রলিখিত ভূমিকা থেকে। এসব মন্তব্যে তার বাউলগান সম্পর্কে প্রত্যাশা, প্রাপ্তি, উচ্ছ্বাস ও হতাশা সবই আছে। কিন্তু যেটা বিশেষ লক্ষণীয় তা হল, রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবনের শেষ দুটি দশকে বাউল গান সম্পর্কে উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছেন। লালনের কুড়িটি গান তিনি ১৯১৫ সালে ‘প্রবাসী’-তে মুদ্রণ করলেন অথচ পরে আর একটাও লালনগীতির প্রকাশে উদ্যম নিলেন না। তথ্যত দেখা যাচ্ছে, তাঁর কাছে লালনের গানের অন্তত তিনটি খাতা ছিল এবং তা যে তিনি সযত্নে পড়েছিলেন তার প্রমাণ রয়েছে তার স্বহস্তে লেখা পাঠশুদ্ধিতে। রমাকান্ত চক্রবর্তী সংগত প্রশ্ন তুলেছেন:

লালন-গীতাবলি রবীন্দ্রনাথ কেন প্রকাশ করলেন না? তার কারণ কি এই যে, লালনের গানের প্রযৌক্তিক শব্দের অর্থ জেনে তিনি আর তা ছাপাবার জন্য চেষ্টা করেননি? তার কারণ কি এই যে, কিছু কিছু উন্নত ‘ভাব’-এর অন্তরালে বাউলদের বিচিত্র যৌন-জীবন তার অজ্ঞাত ছিল না? তার কারণ কি এই যে, যে-‘চারিচন্দ্রভেদ’ বাউল সাধনার ভিত্তিস্বরূপ, তার বিবরণও তাঁর অজ্ঞাত ছিল না?

অবশ্য রমাকান্ত চক্রবর্তী প্রশ্ন তুলে ক্ষান্ত হননি, সিদ্ধান্তেও এসেছেন। তাঁর মনে হয়েছে,

একথা বলাই সঙ্গত যে, সমাজের ও ধর্মের যে অসামান্য গুরুত্ব উনিশ শতকের শেষের দিকে দেশাভিমানী বাঙ্গালি বুদ্ধিজীবিগণ অনুভব করেছেন, সেই অনুভবই দেশাভিমানী রবীন্দ্রনাথের বাউল-প্রেমে সর্বদা অভিব্যক্ত হয়েছিল। দেশী-সংস্কৃতির এই বিশেষ উপাদানকে রবীন্দ্রনাথ অবহেলা করতেন না।

এবারে একটু অন্যদিকে তাকানো যাক। ১৮৯০ সালে লালন শাহ প্রয়াত হন। তাঁর সঙ্গে জ্যোতিরিন্দ্রনাথের সাক্ষাৎ পরিচয় ছিল। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ শিলাইদহের বোটে প্রবৃদ্ধ লালনকে বসিয়ে পোর্ট্রেট এঁকেছিলেন। শোনা যায় সত্যেন্দ্রনাথের স্ত্রী জ্ঞানদানন্দিনী শুনেছিলেন লালনের কণ্ঠে গান। রবীন্দ্রনাথ এঁদের সূত্রেই লালন ও তাঁর গান প্রসঙ্গ শুনেছিলেন। ১৮৯০ সালের পর তিনি লালশিষ্যদের সংস্পর্শে আসেন এবং তাদের কাছে লালনের গানের নমুনা শোনেন এমন অনুমান অসংগত নয়। লালনের শিষ্যরা জমিদার রবীন্দ্রনাথের ওপর ভরসা রাখতেন, যার প্রমাণ রয়েছে লালনের শিষ্য মনিরুদ্দিন শাহ ফকিরের লেখা একটি আবেদনপত্রে। ‘মহামহিম মহিমার্ণব শ্রীযুক্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জমিদার মহাশয় সমীপেষু’ বলে সম্বোধন করে আবেদন করা হয়েছে তাদের গুরুর ছেঁউড়িয়া আশ্রমের ভগ্নদশা থেকে উদ্ধার করে তাকে পাকা ইমারতে পরিণত করবার। এসবই রবীন্দ্রনাথের বাউলপ্রেমের স্পষ্ট প্রমাণ। কিন্তু দেখা যাচ্ছে বিশ শতকের প্রথম দশকের পরে তিনি বাউল সম্পর্কে বেশ ভাবাত্মক মনোভঙ্গিতে গ্রস্ত হয়ে পড়েছেন, এর মূলে হয়তো ক্ষিতিমোহন সেনের সঙ্গ-সান্নিধ্য কিছুটা দায়ী। ক্ষিতিমোহন ১৯০৮ সালে শান্তিনিকেতনে যোগ দেন এবং রবীন্দ্র-সঙ্গে ছিলেন ১৯৪১ সাল পর্যন্ত একটানা। তিনি রবীন্দ্রনাথকে বাউল পরম্পরা বিষয়ে বহু তথ্য ও তত্ত্বজ্ঞানে সমৃদ্ধ করেন এবং গুরুদেবকে দেন বেশ ক’টি সংগৃহীত গান। সেই গানগুলি স্পষ্টতই লালনঘরানা বা কায়াবাণী বাউল পরম্পরার গান থেকে একেবারে আলাদা, কিছুটা সফিস্টিকেটেডও বটে। এই নতুন গানের ভাবে রসে রবীন্দ্রনাথ মজে যান। ক্ষিতিমোহন মধ্যযুগের সতসাধকদের সম্পর্কে একজন বিশেষজ্ঞ ছিলেন এবং ‘বাংলার বাউল’ নামে ১৯৪৯ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি ভাষণ দেন, পরে সেটি বই হয়ে বেরোয়। এ-বই থেকে আমরা পাই তাঁর এমত ভাষ্য যে,

গ্রন্থাশয়ী পণ্ডিতের দল ঠিক বাউলিয়া ভাব ও মর্ম ধরিতেও পারেন নাই এবং পরিচয়ও দিতে পারেন নাই। যাঁহারা নিগ্রন্থ তাঁহাদের পরিচয় গ্রন্থে কেমন করিয়া মিলিবে?

তিনি অবশ্য বাউল সাধনা সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করে গেছেন এই বলে যে,

ইহাদের দেহ-সাধনায় চারিচন্দ্রের ভেদ অতি গোপনীয় ব্যাপার এবং তাহা অতি বীভৎস। …চারিচন্দ্রের ভেদ হইল তন্ত্র ও যোগশাস্ত্রের দাসত্ব। তাহাতে অনুরাগ পথের কি আছে?

এইখানে আমরা একটা স্ববিরোধ না দেখে পারি না। বাউলদের দেহ সাধনা তাঁর মতে বীভৎস অথচ তাদের গান অত্যন্ত ভাবগভীর ও অন্তরস্পন্দী কি করে হতে পারে?

সম্প্রতি প্রণতি মুখোপাধ্যায় একটি জীবনীগ্রন্থ প্রকাশ করেছেন ক্ষিতিমোহন প্রসঙ্গে। তাতে মন্তব্য করেছেন: ‘ক্ষিতিমোহন তন্ত্র ও যোগশাস্ত্র মতে যে বাউলরা কায়াসাধন করেন তাঁদের চেয়ে উচ্চতর ভাবের বাউল সাধকদেরই পরিচয় তাঁর গ্রন্থে দিয়েছেন, রবীন্দ্রনাথও তাঁদেরই কথা বিশ্বজন সভায় জানিয়েছিলেন তাঁর অক্সফোর্ডের বক্তৃতায়।’

অক্সফোর্ডে রবীন্দ্রনাথ যে-হিবার্ট লেকচার দেন তাতে প্রধানত উদ্ধৃতি দেন ক্ষিতিমোহন প্রদত্ত বাউল গানের। সেইসব গানে কায়াবাদীদের চেয়ে উচ্চতর ভাবের বাউল সাধকদের কথা প্রণতি মুখোপাধ্যায় তুলেছেন, কিন্তু তাঁরা কারা? আমাদের চেনা বঙ্গদেশে কি তাঁরা কোনওদিন ছিলেন বা গান লিখেছিলেন? তাঁরা কোথায় চলে গেছেন? মহম্মদ মনসুরউদ্দিন, উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য এবং অন্যান্য বহুতর বাউলগান সংগ্রাহকদের চোখে সেসব গান ধরা পড়ল না কেন? কেন ক্ষিতিমোহন সংগৃহীত গানে আধুনিক হস্তাবলেপের আশঙ্কার প্রশ্ন উঠল? প্রণতি নিজেই জানিয়েছেন ক্ষিতিমোহন সম্পর্কে:

তাঁর দেওয়া তথ্য থেকে জানা যায় আর তিনি নিজে বাউলবাণী বার করেননি, যদিও তা সাজিয়ে লিখে রেখেছিলেন। প্রায় চল্লিশ বছর অর্থাৎ বলা চলে ১৯০৯-১৯১০ সাল থেকে এগুলি নিজের কাছেই রেখে নিজেই আলোচনা করেছেন, যার জন্য তাঁর এই সংগ্রহ। বন্ধুবান্ধবদেরও দেখিয়েছেন, এর থেকেই রবীন্দ্রনাথ ও চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়কে কখনো দিয়েছেন। মনে প্রশ্ন জাগে, এই সাজিয়ে রাখা বাউল গান সংগ্রহের পাণ্ডুলিপি কোথায় গেল?

‘কোথায় গেল’ এ-প্রশ্ন বেশি করে ওঠে এইজন্য যে, ১৯০৮ সালে শান্তিনিকেতনে তিনি স্থায়ীভাবে এসে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত আমৃত্যু আশ্রমিক আবহেই ছিলেন—বড়জোর ‘গুরুপল্লী’র বাসা ছেড়ে নিজের বানানো বাড়িতে উঠে গেছেন। সদাসঙ্গিনী পত্নী কিরণবালা, পুত্র কঙ্কর সেন, কন্যা অমিতা— ক্ষিতিমোহনের তিন উত্তরাধিকারীর কাছে প্রণতি এই পাণ্ডুলিপির হদিশ পাননি।

কিন্তু ক্ষিতিমোহনের সাক্ষ্যে দেখা যাচ্ছে, তাঁর সংগৃহীত বাউলগান থেকে ১৫টি গান তিনি চারু বন্দ্যোপাধ্যায়কে দিয়েছিলেন ছাপতে এবং সেগুলি বেরোয় ‘বঙ্গবীণা’ বইতে। রবীন্দ্রনাথ এই পনেরোটি গান থেকেই প্রয়োজনীয় উদ্ধৃতি দিয়েছেন। সন্দেহ হয়, তাঁর জীবনের একটি পর্বে, অন্তত বাউল-ভাবনার দিক থেকে রবীন্দ্রনাথ ক্ষিতিবাবুর দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। তিনিই কি রবীন্দ্রনাথকে কায়াবাদী চারচন্দ্র সাধনকারী বাউলদের বিষয়ে অবহিত করে তাঁর উৎসাহ নিবৃত্ত করেন? দেখা যাচ্ছে ‘বাউল-পরিচয়’ প্রবন্ধে ক্ষিতিমোহন লিখেছেন:

সহজভাবে বাউল সম্বন্ধীয় যে-কয়খানা পুঁথি পাওয়া যায়, তাহাতে সাচ্চা বাউল-ভাবের পরিচয় মেলে না। আসল বাউল তো পুঁথির ধারই ধারে না। যাঁহারা আধা বৈষ্ণব আধা বাউল, কি আধা তান্ত্রিক আধা বাউল, তাঁহারাই নিজেদের পরিচয় খানিকটা বৈষ্ণব ও তান্ত্রিকভাবে Compromise-এর মত, দিতে চাহিয়াছেন। কিন্তু যথার্থ সে নির্ভীক শক্তি বা রচনার গভীরতা গ্রন্থী বাউলদের নাই। সহজ নামে তাঁহারা যে সস্তা ইন্দ্রিয়-উপভোগের পন্থা খুলিয়াছেন, তাহা বাস্তবিকপক্ষে কোনো সাধনার ভিত্তি হইতে পারে না। চর্যাচর্যবিনিশ্চয় প্রভৃতি গ্রন্থও তান্ত্রিক ভাবের গ্রন্থী বাউলের শ্রেণীর সঞ্চয়।

এই মন্তব্য খুব গুরুত্বপূর্ণ ও দ্যোতনাবহুল এবং সেইসঙ্গে ব্রাহ্ম ক্ষিতিমোহন সেনের সহজিয়া সাধনা তথা বাউলধারা সম্পর্কিত ধারণার স্পষ্ট প্রতিবেদন।

মন্তব্যটি বিশ্লেষণ করলে ক্ষিতিমোহনের মনের যে-রূপ ফুটে ওঠে তাতে বোঝা যায় চর্যাগীতি থেকে উৎসারিত বাংলা গীতি পদাবলির ধারাকে তিনি শনাক্ত করতে চান তন্ত্রসম্পৃক্ত কায়াবাদী বলে। সহজিয়া পদকে ও পন্থাকে তিনি সরাসরি অভিযোগ করেছেন ইন্দ্রিয়-উপভোগের নামান্তর বলে। তবে তিনি যথার্থভাবে বলেছেন যে সাধারণভাবে বাংলার বাউল গানে ‘আধা বাউল আধা বৈষ্ণব’ বা ‘আধা তান্ত্রিক আধা বাউল’ পন্থার সমন্বয় ঘটেছে। একথা বলে তিনি বাউল গানের মূল স্রোত থেকে তাঁর সংগৃহীত পনেরোটি পদের স্বাতন্ত্র্য ও কৌলীন্য প্রতিষ্ঠা করেছেন। অর্থাৎ সেসব পদে উচ্চভাব ও গভীরতা আছে, কায়াবাদী সাধনার সঙ্গে ওই পদকারদের সম্পৃত্তি নেই, সহজধারার ইন্দ্রিয়-উপভোগের সরণি থেকে এ গান স্বতন্ত্র পথযাত্রী। এমন ধারণা ও মন্তব্য করার পেছনে ক্ষিতিমোহনের উদ্দেশ্য যাই থাক, একথা স্পষ্ট যে শান্তিনিকেতনে বসবাসকালে সহজিয়া তথা ‘আধা বৈষ্ণব আধা বাউল’ ধারার গান ও গায়কদের তিনি ভাল করে জেনেছিলেন। প্রণতি মুখোপাধ্যায়ের বই থেকে একটি উদ্ধৃতি দেওয়া যায়। ১৯১২ সালে—

পৌষ সংক্রান্তির দিনে কেন্দুলির জয়দেবের মেলায় গিয়ে ভরা-মনে ফিরলেন, বাউল ও বাউল গানের প্রবল আকর্ষণে এমন কতবারই গেছেন। নিতান্ত অল্প বয়সেই তিনি এ মেলায় আসতেন নিতাই বাউলের সঙ্গে, তখন শান্তিনিকেতনের সঙ্গে কোনো সম্পর্কই ছিল না। এখানে এসেও প্রথম প্রথম কাউকে না জানিয়ে একা চলে যেতেন। তারপর জানাজানি হল, বন্ধু-সহকর্মীরা সঙ্গী হতে লাগলেন। তাঁর ভয় ছিল পাছে কেউ বাউলদের প্রশ্ন করে বিরক্ত করেন।

এখন সমস্যা হয়েছে আমাদের মতো জিজ্ঞাসু ও তথ্য অনুসন্ধানীদের, যারা ক্ষিতিমোহন বা উপেন্দ্রনাথের অনেক পরে সরেজমিন কাজে নেমেছি। একটা কথা স্পষ্ট যে, ক্ষিতিমোহন বহুদিন ধরে এবং বহু জায়গায় ঘুরে মরমি ভাবসাধকদের সঙ্গ করেছেন, তাঁর শাস্ত্রজ্ঞানও ব্যাপক ও গভীর। তুলনায় উপেন্দ্রনাথ অনেক পরে ব্রতী হয়েছেন তাঁর সন্ধান ও সংগ্রহ কাজে, তাঁর অনুসন্ধানের ক্ষেত্রও অনেক সীমায়িত। তবে উপেন্দ্রনাথ বেশ জোরালোভাবে আমাদের কায়াবাদী বাউল সাধকদের হয়ে সওয়াল করেছেন— ধরতে চেয়েছেন তাদের গোপন ও গুহ্য সাধনার ধারা তথা দর্শনকে। বাউলদের চারচন্দ্রভেদ বা মলমূত্ররজবীর্যপান তাঁর ততটা গর্হিত বা ঘৃণাৰ্হ বলে মনে হয়নি—ক্ষিতিমোহন সে বিষয়ে একেবারে বিপরীতমুখী। কাজেই ক্ষিতিমোহনকে উদ্ভাবন করতে হয়েছে এক নতুন লজ— কায়াবাদীদের বিপরীতে তিনি প্রতিষ্ঠা দিতে চেয়েছেন উচ্চতর ভাবের বাউল সাধকদের। কিন্তু খুব সংগত যুক্তিতে ও স্থানিক কারণে তিনি তাঁদের খুঁজে পাননি রাঢ়বঙ্গে বা কেঁদুলির মেলায়। লালনশাহী পন্থা সম্পর্কে তাঁর উৎসাহ থাকার কথা নয়, যিনি স্বচ্ছ ভাষায় লিখেছিলেন ‘ধরো রে অধরচাঁদে অধরে অধর দিয়ে’। কাজেই অবিভক্ত বাংলায় ঠাকুর পরিবারের জমিদারিভুক্ত কুষ্টিয়া পরিমণ্ডলে তিনি যাননি, উৎসাহ পাননি লালনবাণী প্রচারে। অথচ এখন নানা ঘটনাচক্রে লালন শাহের গান ও তত্ত্ব দুই বাংলার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য হয়ে উঠেছে। লালনবাণী এখন বুদ্ধিজীবীদের দিশা দিচ্ছে এবং লালনগীতির সুরকাঠামো নিয়ে কৌতুহল বেড়েই চলেছে। তথ্য থেকে জানা যায়, ১৮৯০ থেকে ১৯৯১ পর্যন্ত একশো বছরে লালন সম্বন্ধে বই লিখেছেন ৪৪ জন, প্রবন্ধ লিখেছেন ১৫০ জন।

এহেন লালনের গান রবীন্দ্রনাথের মনোযোগ আকর্ষণ করেছিল উনিশ শতকের শেষ দশকে। সে গানের ভাবরস ও সুরমাধুর্য তাকে টেনেও ছিল, অথচ পরে সেই লালন সম্পর্কে আর যেন তেমন উচ্ছ্বাস ছিল না। যেটুকু ভাবোচ্ছ্বাস তিনি প্রকাশ করেছেন তা লালনের দেহ খাঁচার অচিন পাখির রহস্য নিয়ে। ‘মাঝে মাঝে বদ্ধ খাঁচার মধ্যে আসিয়া অচিন পাখী বন্ধনহীন অচেনার কথা বলিয়া যায়; মন তাহাকে চিরন্তন করিয়া ধরিয়া রাখিতে চায় কিন্তু পারে না’— তাঁর উপভোগ ছিল লালনের এই অসামান্য অনুভবের জন্য ও প্রকাশভঙ্গির কারণে। বাউল গানের ‘mystic transcendentalism’ তাঁর পক্ষে রোচক লেগেছিল, কিন্তু বাউলদের প্রতিবাদী মনন, আত্মবেদন ও নির্যাতিত অবস্থান বিষয়ে তিনি কলম ধরেননি। পরিণত বয়সে ১৯০৬ সালে ‘পত্রপুট’ কাব্যের ১৫ সংখ্যক কবিতায় তিনি লিখেছিলেন:.

কদিন দেখেছি ওদের সাধককে

একলা প্রভাতের রৌদ্রে সেই পদ্মানদীর ধারে,

যে নদীর নেই কোনো দ্বিধা

পাকা দেউলের পুরাতন ভিত ভেঙে ফেলতে।

দেখেছি একতারা-হাতে চলেছে গানের ধারা বেয়ে

মনের মানুষকে সন্ধান করবার

গভীর নির্জন পথে।

যৌবনে পদ্মাতীরে দেখা একক বাউলের এই নিঃসঙ্গ সন্ধান নির্জন পথে, তাঁর পক্ষে একটি ভাবময় চিত্রকল্প হয়ে উঠেছে। বাউলকে তিনি একলা সাধকরূপে দেখতে চান— ‘মনের মানুষ’-ও তাঁর বিবেচনায় এক অন্তরগ্রাহ্য তত্ত্ব। কিন্তু প্রকৃত প্রস্তাবে বাউল সাধনা যুগলের সাধনা এবং দেহতত্ত্বের জটিল পথক্রমায় তার চলাচল। মনের মানুষ তাদের বিশ্বাসে কোনও ভাব বা অনুভব নয়, তা নিতান্ত এক বস্তু, যা উপলব্ধি করতে হয় নরনারীর দেহসংগমে এবং গুরুনির্দেশিত করণকৌশলে।

‘ওদের সাধক’ উচ্চারণে কবি যাঁদের কথা বলেছেন তাঁদের পরিচিতি দিতে গিয়ে তাঁর বাচন:

ওরা অন্ত্যজ, ওরা মন্ত্রবর্জিত।

দেবালয়ের মন্দিরদ্বারে

পূজা-ব্যবসায়ী ওদের ঠেকিয়ে রাখে।

বাউলদের হয়তো অন্ত্যজবর্গে শ্রেণিভুক্ত করা যেতেও পারে, অন্তত গভীরার্থে, ওরা মন্ত্রহীন কেননা মন্ত্রে ওদের বিশ্বাস নেই—প্রশ্নটি তাই কিন্তু অধিকারঘটিত নয়। দেবালয়, দেবতা, বিগ্রহ পূজা বা পুরোহিত কিছুই ওদের কাম্য নয় তাই পূজা ব্যবসায়ীদের দ্বারা নিরুদ্ধ হবার প্রশ্ন ওঠে কি? এর পরের রবীন্দ্রবাণী আরও ভ্রমাত্মক। বলেছেন:

ওরা দেবতাকে খুঁজে বেড়ায় তাঁর আপন স্থানে।

অথচ শুধু বাউল কেন কোনও লোকায়ত সাধকই দেবতাকে খোঁজে না, খোঁজে মানুষ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *