১.৫ সাধনসঙ্গিনীর রহস্যলোক

সাধনসঙ্গিনীর রহস্যলোক

ঘোর জষ্টিমাসে বসে আড়ংঘাটায় যুগলকিশোরের মেলা। লোকে চলতি কথায় বলে ‘যুগলের মেলা’। আর পাঁচটা বাংলা মেলার সঙ্গে খুব একটা তফাত নেই। ওই খেলনা, হাঁড়িকুড়ি, নাগরদোলা, বাঁশি, সার্কাস আর বড় বড় মিষ্টির দোকান। না, কেঁদুলির মেলার মতো নগরজীবনের ততটা স্পর্শ পড়েনি তাই ওয়াইন শপ এখনও গজায়নি। অবশ্য মেলার আশেপাশে, লুকোছাপা করে ধেনো বা চোলাই যে চলে না তা হলফ করে বলতে পারব না। তবে যুগলের মেলায় যেটা বড় আকর্ষণ সেটা সন্ধের পরে বাউলগানের আসর, চলে অনেক রাত অবধি। আড়ংঘাটায় আশেপাশে বেশ ক’জন বাউল আছে। দু’দশক আগে খুব নাম ছিল সুধাময় দাস বাউলের। চমৎকার মানুষ, চমৎকার গাইত। তারপরে যা হয়, গাঁজার টানে গেঁজিয়ে যাওয়া। গান গাইতে বিদেশ গিয়েছিল— সাহেবমেমরা তাকে মাথায় তুলে মাটিতে আছড়ে ফেলেছে। গাঁজার বদলে হাসিস খেয়ে অবস্থা তুরীয়— গানের গলা ভেঙে গেছে, স্বাস্থ্য গেছে চুপসে। সাহেবি ট্রাউজার আর দান করা জাম্পার পরা সুধাময় এখন এক ট্রাজিক চরিত্র।

তবু তার কাছে আমি কৃতজ্ঞ, কারণ বছর পঁচিশ আগে, যুগলের মেলাতে তার আখড়ায় আমি একরাতের আশ্রয় ও আহারের সুযোগ পেয়েছিলাম। তখনও বাউলদের জীবনে তত পাকাপোক্ত হইনি। বেশ খানিকটা রোমান্টিক ধারণা নিয়ে গড়পড়তা শিক্ষিতদের মতো তাদের নিয়ে স্বপ্ন দেখি। ভাবি, আহা কী মুক্ত বাউলজীবন, কী উদার মানবিকতার স্ফুরণ! মনের মানুষের তত্ত্বে একেবারে আপ্লুত যাকে বলে। খাঁচার ভিতরে অচিন পাখির আনাগোনার রূপক আমাকে রবীন্দ্রনাথের মতোই আচ্ছন্ন করে রেখেছে। তখনও জানি না ‘সবার উপরে মানুষ সত্য’ এই চণ্ডীদাসীয় উচ্চারণের মানুষ কথার অর্থ হিউম্যানিটি বা হিউম্যানিজম আদৌ নয়— মানুষ শব্দের আসলে একটা যৌন-যোগাত্মক ইঙ্গিত আছে। তখনও কবীরের লেখা দোঁহা ও বীজক তেমন করে পড়িনি অর্থাৎ ‘টেক্সট’ রূপে। তাই লালন শাহের গানে ‘ছুন্নৎ দিলে হয় মুসলমান/ নারীর তবে কী হয় বিধান’ পড়ে লালনের মৌলিকতায় তো ডগমগ হয়ে আছি, পরে আবিষ্কার করি— আরে, এতো কবীরের একটি বীজকের আক্ষরিক অনুবাদ!

বাউলজীবন নিয়ে যারাই কাজ করে তাদেরই এমন দ্বিস্তরের অভিজ্ঞতা হয়— মোহ ও মোহভঙ্গ, তারপরে গড়ে ওঠে এক স্পষ্ট নবচেতনা, যা একটা বলিষ্ঠ প্রত্যয়ভূমিতে দাঁড় করিয়ে দেয়। বাউল বলে নয়, ফকিরি দরবেশি সহজিয়া ইত্যাদি বর্গের গুহ্য সাধনায় সবসময় যেমন দ্ব্যর্থ থাকে তেমনই তাদের ভেতর-বাইরের দুটো জীবন থাকে। বাইরে ভারী কোমল ও মরমি কিন্তু সাধনার ক্ষেত্রে খুব নির্মম ও নির্বিকার তারা। দেহগত সব সাধনারই এই এক তরিকা। শরীরটা বশ করতে হয়, তার জন্য দেহ নিয়ে চরম সাধনা করতে হয় এবং সেইসঙ্গে মনের সংযম আনতে হয় চূড়ান্ত পর্যায়ের। তাদের গানে বেশ সাদাসাপটা বলা হচ্ছে বড় কঠিন কথা ও প্রত্যাদেশ: ‘কামে থেকে হও নিষ্কামী।’ ক’জন পারে?

যুগলের মেলার কথা বলতে বলতে যুগলসাধনার কথা চলে এল এবং সেই সুবাদেই সুধাময় দাসের আখড়ার প্রসঙ্গ মনে পড়ল। সেবার তার আখড়ায় বসে আছি। দুপুরে খিচুড়িভোজন করে একটু গা এলিয়ে নিয়েছি। বিকেল-সন্ধের মুখোমুখি বসে গেছে বাউলের আসর। আখড়ার সর্বত্র মিনতি নামে একটি মেয়ে বেশ চোখ টানে। মিষ্টি দেখতে লম্বা ছেঁয়ালো চেহারা। সর্বদা ছোটাছুটি করে সবাইকে দেখাশোনা করছে। আমাকেই বার কয়েক লাল চা খাইয়েছে। বুঝতে অসুবিধে হয়নি, বৈরাগ্যের আখড়ার সবদিক এই নারী সামলে রাখে। সেবাযত্নে খরদৃষ্টি। সুধাময় তো ব্যাপক গঞ্জিকা সেবন করে দিব্যোন্মাদ, বসে বসে শুধু হাসছে। বাউল গায়করা আসরে আসছে, গেয়ে চলে যাচ্ছে। তাদের চা-মুড়ি তেলেভাজা খাওয়ানো, তাদের বসানো, দু-দণ্ড কথা বলা, রঙ্গ-রসের যোগান, কুশল নেওয়া সবই ওই মিনতি। গায়ের রং পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, স্বেদ মাখানো হাস্যময়ী মুখশ্রী, সেবাদাসী। বেশ ভাল মধ্যবিত্ত বাড়িতে মানানসই বউ হতে পারত, মাথায় করে রাখত সংসার। সবরকম ঝকমারি সামলেসুমলে আবার দু’-তিনটে সন্তান পালন করত হাসিমুখে। স্নেহ মমতা তার চোখে ঝরে পড়ছে। কিন্তু আপাতত সুধার কব্জায়। তার গানেই মজেছে সন্দেহ কি?

সুধাময় দাসবৈরাগ্যের সেবাদাসী মিনতি দাসী— বেশ তো চমৎকার লোকায়ত জীবনের ফ্রেমে বাঁধানো এক তেলচকচকে আলেখ্য। মিনতিকে তো ফুসলে আনেনি সুধা। সে নিজেই এসেছে, মেনে নিয়েছে এই সুখদুঃখের দৈনন্দিন। গান শিখেছে গুরুর কাছে, শিখেছে দেহতত্ত্বের খুঁটিনাটি। কোনও সংশয় সন্দেহ নেই, ফেলে-আসা পিত্রালয়ের জন্যে দরদ বা মা-ভাই-বোনের স্নেহনীড়ের স্মৃতি তাকে উন্মনা করে কিনা কে জানে? বেশ তো গুনগুন করছে নিরন্তর কাজের ফাঁকফোকরে। গাইছে:

ঘুচিয়ে মলামাটি

হয়েছি পরিপাটি

করিনে নটিখটি—

এবার খাঁটি পথে দাঁড়িয়েছি।

সাংসারিকতার ময়লামাটি নাকি তাকে আর স্পর্শ করে না— গৃহীজীবনের ‘নটিখটি’ অর্থাৎ তুচ্ছ ব্যাপারে নাক গলানোর প্রবৃত্তি তার আর নেই। পরিপাটি হয়ে মিনতি দাসী এবার খাঁটি পথে দাঁড়িয়েছে। খাঁটি পথ? এটাই যে খাঁটিপথ জানল কী করে? এই বিবাহবিহীন একত্র থাকা, এই সন্তানহীন যুগলজীবন, ভবিষ্যৎ স্বপ্নহীন, বর্তমান অনিশ্চিত, এটাই খাঁটি? সামাজিক সম্মান নেই, আর্থিক স্বাধীনতা নেই, রোজকার অন্ন নেই, তবু এটাই খাঁটি পথ?

মিনতির চলে আসাটা খাঁটি, বৈরাগীর প্রতি টানটা প্রবলভাবে খাঁটি, এই দেহসাধনার কবোষ্ণ তাপ সেটাও খাঁটি, কিন্তু তার জীবনসঙ্গীটি কি সৎ ও মিনতিনিষ্ঠ? না। সেটা এতক্ষণে আমি যেমন জেনে নিয়েছি এর-ওর কাছ থেকে, তেমনই আন্দাজই করতে পারি মিনতিও জেনেশুনে আগুনে ঝাঁপ দিয়েছে। সবাই জানে, সুধাময় দাস মোটেই একনিষ্ঠ নয়। দু’-চারজন এমন ধরনের মিনতি তার কাছে এসেছে আবার চলে গেছে। মানুষটা বাউন্ডুলে, গ্যাঁজালে কিন্তু ভারী সুন্দর গান গায়, বড় চমৎকার দরদি ভাষায় কথা বলে। তত্ত্বগানের আসরে সে যেন বাচস্পতি। পুরাণ কোরান কণ্ঠস্থ। তার সঙ্গে গানে পাল্লা দেবে এমন কেউ নেই নদে-মুর্শিদাবাদ-বর্ধমানে। ইউসুফ ফকিরও হার মানে।

প্রশ্ন উঠতে পারে, এত কথায় আমার দরকার কী? সত্যিই কিছু এসে যায় না, অন্তত ওদের, যারা দিব্যি মেনে নিয়েছে অনিশ্চিত বাউল জীবনের ধূসর ভবিষ্যৎ। ধূসর তো নয়, সমুজ্জ্বল— অন্তত নিজেদের বোধে। ওরা বেশ আছে ওদের মতে, বাধাবন্ধন নেই, আসাযাওয়া দু’দিকেই দরজা খোলা। খুব আনন্দ করতে পারে। ভক্ত বা সমাগত সবাইকে সেবা দেয় হৃষ্ট মনে। স্বার্থবোধ নেই, কেরিয়ার নেই, সন্দেহবাই নেই। এগুলো সবই আমাদের শিক্ষিত মধ্যবিত্তদের একচেটিয়া।

পুরুষশাসিত সমাজের কর্তৃত্বপরায়ণতা কতটা আছে বাউল সমাজে? এখানে অধীনতার তাৎপর্য কতদূর? নারীবাদের তত্ত্ব প্রয়োগ করলে আমাদের সমাজ-আদলের মতো এখানেও কী দেখা যাবে পুরুষের সদম্ভ স্বাধিকার? যৌন নিগ্রহ বা যৌন আধিপত্য এখানে কতটা? এসব প্রশ্ন এখন আমার মনে আর তত ওঠে না, কিন্তু দু’দশক আগে উঠত। যুগলের মেলায় যখন গিয়েছিলাম তখন এসব জিজ্ঞাসায় আমি ভারাতুর ছিলাম। সামনে বেশি উদাহরণ ছিল না, বাউল জীবন তখনও দেখিনি সানুপুঙ্ক্ষে। তাই মিনতিকে দেখে যাচ্ছিলাম অনেকটাই সাগ্রহে, পদে পদে। ভাবছিলাম কোন উৎস থেকে মিনতি পাচ্ছে এত উৎসারিত স্বতঃস্ফূর্ত আনন্দের রসদ? সেকি কাম? দেহগত কামনার পরিপূর্তি? না প্রেম?

আখড়ায় চোখ মেলে দেখবারও কত কি থাকে। ধরা যাক, প্রথমেই ভূমিশয্যা। উঁচুনিচু মাটির ওপরে পুরু করে খড় বিছানো, তার ওপরে শতরঞ্চি বা পাটি। তার ওপরে আমার জন্যে বিশেষভাবে পাতা হয়েছে একটা বড় কাঁথা— বহু যত্নে বহু দিন ধরে চলেছে তার সীবনকর্ম। একেবারে সাদামাটা কাঁথা নয়, তার চারপাশে রঙিন সুতোর বর্ডার। হাতি হাঁস ময়ুরের মূর্তি আঁকা। এ প্রতীকগুলোরও আলাদা মানে আছে সে কি জানতাম? মিনতিই বুঝিয়ে বলেছিল: ‘হাতি মানে মত্ত মাতঙ্গ, যাকে বলে কামনা।’

—আর ময়ূর?

—ময়ূর মানে স্ত্রীলোক। পেছনে কলাপ মেলা রূপ— চোখ ধাঁধানো। ময়ূরের রং হল নীল, চোখটা লাল। নীল মানে ঈর্ষা, লাল মানে কামনা। নারীর অন্তরে থাকে ঈর্ষা, চোখে থাকে কামনা।

কামনার কথা জিজ্ঞেস করা উচিত নয়, তাই নিরীহ প্রশ্নটা করতে পারি, ‘তোমাদের অন্তরে কি ঈর্ষা থাকে নাকি? এত যে সেবা করছ, মানুষকে ভালবাসছ, কোথায় ঈর্ষা?’

‘ঈর্ষা কি চোখে দেখা যায়?’ মিনতি রহস্যের হাসি হেসে বলেছিল, ‘ঈর্ষা আছে আমার অন্তরভরা। গোঁসাই কত বকে, তবু ঈর্ষা কি মরে?’

—কাকে ঈর্ষা তোমার? কেন?

—ঈর্ষা হিংসা মেয়েমানুষের তো মেয়েমানুষের ওপরই থাকে। আমারও তাই আছে। গোঁসাইয়ের চোখ দ্যাখেননি তো? ভেতরে ভেতরে আরও সেবাদাসী খোঁজে। পেয়েও যায়। আমাদের এই লাইন ভাল নয়। ওই যে কাঁথাখানায় বসেছেন তার কোণে কার নাম লেখা? আসমানী দাসী। সে ছিল আমার সতীন। তাকে বিদেয় করে গোঁসাই চরণে স্থান দিয়েছেন আমাকে। সে নেই কিন্তু তার করা কাঁথাটা রয়ে গেছে।

কথার টানে মিনতি এক বিচিত্র জগতে এনে ফেলেছে। চোখ খুলে যাচ্ছে। এবারে আর প্রশ্ন করি না, বুঝতে পারি হাঁস মানে কী। হাঁস মানে সাধক— নির্বিকার পরমহংস।

এ বড় বিচিত্র জগৎ— আশ্চর্য বিশ্বাসের জগৎ। জলের ছুঁচ আর পবনের সুতো দিয়ে দিয়ে নাকি মানবদেহ গড়া। আপাতত অত ভাবালুতার প্রয়োজন নেই। আখড়ায় পাতা রয়েছে আসমানী দাসীর হাতে বানানো চিত্রবিচিত্র কাঁথা, প্রতীক প্রতিমায় দ্যোতনাময় কিন্তু আসমানী কোথাও নেই। সে কী নিজেই চলে গেছে না গোঁসাই তাকে তাড়িয়েছে? নাকি ঈর্ষাকাতর মিনতির আরেকটা রূপ আছে সেবাব্রতর আড়ালে? এখন সে কাজের ফাঁকে ফাঁকে গুনগুন করে গান গাইছে মধুরকণ্ঠে সেই হয়তো তীব্র কাংস্য চিৎকারে কলহ করতে পারে। এটা ঠিক যে লোকায়ত জীবনের নানান রূপ নানা ছন্দ।

হঠাৎ আমার চোখের সামনে থেকে আখড়ার সমস্ত উৎসব আনন্দগানের আবহ সরে গেল। জেগে উঠল এক অসহায় নারীর অদেখা চেহারা— আসমানী দাসী। নামটা শুনলে মনে হয় বুঝিবা মুসলমান ঘরের মেয়ে। সম্ভবত তা নয়, কারণ গাঁ-ঘরে নারীর কতরকম নাম থাকে। যাকে আসমানী শুনে ভাবছি মুসলমান সে হতেই পারে হিন্দু, আবার খোদ মুসলমান বাড়িতে মেয়ের নাম শুনেছি গোপালিবালা। তাই এসব থেকে কিছু বোঝায় না। আমার কাছে অনেক বেশি করে জেগে উঠছে এক নারীর নিষ্ক্রমণ বার্তা। যে চলে গেছে কিন্তু রেখে গেছে তার হাতে তৈরি কাঁথা। সে-কাঁথায় আসমানী ফোঁড় তুলে এঁকে গেছে গুরুর শেখানো চিত্রমালা— হাতি-হংস-ময়ূর। অথচ সেই চিত্রণের তাৎপর্যে সে আর নেই। মত্ত কামনা, উদ্যত ঈর্ষা আর তার মধ্যে শমশান্ত সাধকের জগৎ আজ তার কাছে ধ্বস্ত, ভ্রান্ত ও অতীত।

এতদিন পরে আসমানী বা মিনতির কথা লিখতে গিয়ে মনে পড়ল হাটগোবিন্দপুরে সাধন বৈরাগ্যের আশ্রমে মাকি কাজুমির মুখ। নাদনঘাট থেকে বর্ধমান যাবার পথে বাসরাস্তায় পড়ে হাটগোবিন্দপুর। বাস থেকে নেমে মানুষজনকে জিজ্ঞেস করতেই দেখিয়ে দিল নিশানা। মিনিট দশেক হেঁটে সোজা সরান ধরে পৌঁছে গেলাম সাধনদাসের আশ্রমে। চোখ জুড়িয়ে যায় আশ্রমের শ্রী আর সমৃদ্ধি দেখলো একেবারে ঝকমকে তকতকে। প্রচুর গাছ— আম জাম কাঁঠাল কদম্ব ছাতিম। উঠোন গোবর লেপে মোছা। এক পাশে গন্ধরাজ আরেক পাশে টগরের ঝাড়। সারিবাঁধা চিনে গোলাপ। সুন্দরের আসন বিছানো এমন সচ্ছল স্বচ্ছন্দ আশ্রমের মধ্যমণি এক ছবির মতো জাপানি মেয়ে, মাকি কাজুমি। রোগা একহারা চেহারা কিন্তু লাবণ্যে ভরা। গায়ের রং সাদাটে, চোখদুটো জাপানিদের যেমন হয় ছোট কিন্তু শান্ত। পাতলা ঠোঁট। পরনে ধবধবে সাদা শাড়ি ব্লাউজ, শীতকাল বলেই বোধহয় পায়ে সাদা মোজা কিন্তু স্লিপার নেই। মেটে দাওয়ায় জন পাঁচেক ভক্ত হাপুসহুপুস করে গরম জাউভাত খাচ্ছে। পরিবেশন করছে মাকি, জননীর স্নেহ দিয়ে। এতদিনে তার বাংলা উচ্চারণে জড়তা তত নেই। স্পষ্ট বলছে, ‘আর দুটো ভাত নেবে?’

‘না, মা। আর নয়।’ পরিতৃপ্ত জবাব তাদের। মা? ভাবতে গেলে আশ্চর্য লাগে বই কী। চিত্ৰশোভাময় জাপানের এক উচ্চশিক্ষিতা মেয়ে এখানে এই হাটগোবিন্দপুরে এসে হয়ে বসেছে অন্নপূর্ণা আশ্রমজননী। সন্তান নেই, শিষ্যসেবকরাই সন্তানের মতো। মাকির ক্ষুদ্র কিন্তু প্রসন্ন চোখে প্রকৃত স্নেহের বাতি জ্বলছে। কবে বুঝি পনেরো বছর আগে সাধনদাস জাপানে গিয়েছিল গান গাইতে। মাকি চলে এসেছে তার সঙ্গে। অশনে বসনে ভাষায় ও ধর্মে কোনও মিলই নেই। তবু চলে আসা প্রাণের টানে। সে টান বড় অন্তরের।

ভক্তদের অন্নসেবা দিয়ে মাকি আমার কাছে এসে নত হয়ে বলল, ‘প্রণাম।’ দাওয়ায় একটা কাঠের চেয়ার দিয়ে বলল, ‘বসুন। একটু চা সেবা করবেন তো?’

সম্মতি জানাতেই সে চলে গেল রান্নাঘরে আর আমার চোখ চলে গেল উঠোন পেরিয়ে একটু দূরে কলতলায়, যেখানে উঁচু বাঁশের বাতায় শুকোচ্ছে মাকির গেরুয়া, শাড়ি জামা ও শায়া। গড়পড়তা বাউলবাড়িতে এই দৃশ্য দেখতে আমি অভ্যস্ত কিন্তু এখানে দৃশ্যটি অপার্থিব হয়ে উঠেছে এক বিদেশিনীর আত্মউৎসর্জনের তাপে। সে তার জাপানি জীবনযাত্রার ছকটাই বদলে ফেলেছে হাটগোবিন্দপুরে এসে, সাধনদাসের সাধনসঙ্গিনী হয়ে। মনে পড়ল, ‘আমি বিদেশিনী হইয়া/ বসন রাঙাইয়া/ যাব গো তোমার সঙ্গে’ গানের আক্ষরিক রূপ। এক্ষেত্রে অবশ্য বিদেশিনী এখন হয়েছে আমারই ভাষায় কথা বলা স্বদেশিনী। টিউবওয়েলের পাশে একটেরে ছোট বেড়া দিয়ে ঘেরা স্নান-ঘরে ভোরের স্নান সেরে এই জাপানি নারী ফুল তুলে রাধামাধব বিগ্রহের পাট সেরেছে। ভক্তদের সেবা দিয়ে এবারে অতিথি আপ্যায়ন।

চা আর বিস্কুট নিয়ে মাকি এসে আমাকে দিয়ে সামনের মেটে দাওয়ায় বসল। সারা গায়ে খুব সুন্দর করে শাড়ি জড়ানো। ঘোমটা নেই, তাই চোখে পড়ল তার কানের দুটো ঝুলন্ত দুল। কোনও ডিজাইন নেই, শুধু ‘ওঁ’ লেখা। অপরূপ শোভাময় দৃশ্য। বিদেশিনীর কানে ঝুলছে দুটি ওঙ্কার। পরিচয় আগে থেকেই ছিল কাজেই এবার কুশলবার্তা নেওয়া।

—সাধনদাসকে দেখছিনে যে! নেই নাকি?

—একটা আসরে গেছেন কাল, ধাত্রীগ্রামে। টেলিফোন করেছেন একটু আগে। আপনি আসবেন খবর দিয়েছেন। রওনা হয়ে গেছেন গাড়িতে— এখনি এসে পড়বেন। দাদা, দুপুরে অন্নসেবা নেবেন তো?

পশ্চিমবঙ্গের বেশির ভাগ বাউল আখড়ার এমন শ্ৰীমন্ত রূপ নেই। বাড়িতে টেলিফোন, কোথাও যেতে ভাড়া করা মোটর। আশ্রমে বেশ ক’টা চালাঘর। একটা নতুন ঘরের পত্তনি হয়েছে তাতে দুজন ভক্ত নতুন বিচুলির ছাউনি দিচ্ছে। সেদিকে তাকাতে মাকি বলল, ‘গোঁসাই ওখানে একটা নতুন ভজনকুটির করছেন। পুরনোটায় উঁই লেগেছে। ওটা ভেঙে ফেলা হবে।’

কেমন চমৎকার জাপানি মেয়ের সঙ্গে আমার ঘর গেরস্থালির কথা হচ্ছে। কত বাউল ঈর্ষা মিশিয়ে আমাকে বলেছে, সাধনদাসের মতো ভাগ্য ক’জনের হয়? ভাল গাইতে পারে। ফাংশনে ডাক আসে। অনেক শিষ্যশাবক। সেবাদাসী মাঝে মাঝে দেশে গিয়ে টাকা আনে।

অচিরে সাধনের গাড়ি ঢোকে অঙ্গনে। সাঙ্গোপাঙ্গ বাজনদারদের নিয়ে সশিষ্য সাধনদাস প্রবেশ করে উঠোনে। সপ্রতিভভাবে বলে, ‘আরে সুধীরদা, এসে গেছেন? বাঃ।’

পাকা প্রোফেশনাল। কথায় বার্তায় সাবলীল। একটু পরে সবাই মিলে বসা হল আরেকটা ঘরের প্রশস্ত দাওয়ায়। প্রথমে গাঁজা তৈরি করে শিষ্য দিল গুরুকে। বিশাল ক’টা টান দিয়ে কলকে চলে গেল শিয্যদের হাতে হাতে। তারপরে হল দুয়েকটা গান। নিমীলিত চোখে সাধনদাস গান গাইলেন ভারী সুন্দর— আত্মনিবেদনে গভীর ও উদাত্ত। এবারে মাকি কাজুমির পালা। একতারা আর বাঁয়া নিয়ে তার গানের ধরতাই: ‘সত্য বলো সুপথে চলো।’ জাপানি মেয়ে বাংলা ভাষায় গাইছে লালনের গান। মাকি যেন সাধনের জীবনে এক অপরূপ অর্জন। তাদের মিলনে গানের সুরের আসনখানি পাতা।

আমার মনে এ প্রশ্ন না উঠেই পারে না যে কোনটা সত্য কোনটাই বা সুপথ। মাকি গায় ‘সত্য বলো সুপথে চলো,’ ওদিকে মিনতি গেয়েছিল ‘এবারে খাঁটিপথে দাঁড়িয়েছি’— এখানেই দ্বন্দ্ব। যেটাকে এরা সুপথ বা খাঁটিপথ বলে সেই বাউলজীবনের ন্যায়নীতিসত্য কেমনতর? সে তো আমাদের স্বাভাবিক সমাজমূল্যবোধের সঙ্গে মেলে না। দিল বা হৃদয় নিয়ে যাদের গানে এত কথা, তাদের হৃদয়হীনতা এতভাবে দেখি যে মনে কষ্ট হয়। অথচ সে কষ্টের কী মূল্য?

বাউলেরা নিজেদের বলে ‘পথবৈরাগী’, সংসারের নিয়ম তাই তাদের ক্ষেত্রে চলে না। এই পথের নিয়মে আসমানী যায়, মিনতি আসে…কাজুমিরাও আসে… কিন্তু থাকে কি? থাকতেও পারে, চলে যেতেও পারে। দুদিকেই দরজা খোলা বাউল বিশ্বে। তাই এই জাপানি সাধিকার স্বনির্বাচিত জীবনে প্রত্যাবর্তনের পথ খোলা আছে। কিন্তু তার ভাবজগতে এতদিন যে-তরঙ্গ উঠেছিল, যা তাকে নিয়ে এসেছে এত দূরে, এমন সুদূর সাধনায়, তা কি সে ভুলে যাবে? এই তার কপালের চন্দনরেখা, কানের দুলের ওঙ্কার, গেরুয়াবাস, নম্রবিনতস্বর, তার শিষ্যসেবা, অন্নপূর্ণারূপ সে মুছে ফেলবে একেবারে? সবচেয়ে যেটা বড়, তার দেহবাদী সাধনার দিনগুলি, তার গুরু সান্নিধ্য? তার গলার চিকন গান? ভেবে দেখতে গেলে মাকির গান তো কেবল কণ্ঠবাদন নয়, নয় কতকগুলো বাংলা শব্দের উচ্চারণ, এর প্রত্যেকটার ভাব তাকে যে বুঝতে হয়েছে। সে বোঝা বড় কঠিন, কতদিনের আয়াসসাধ্য। এমন গায়নের অন্তঃস্পন্দ, একতারায় চম্পক অঙ্গুলির সঞ্চালন, স্বরক্ষেপের মাধুর্য, বাঁয়ায় তাল রাখা অথচ নিজেকে ভাবনিবিষ্ট রাখার কৌশল— এতগুলি অর্জন বহু শ্রমে সিদ্ধ। তার সামনে ছিল অনেকগুলো লড়াই। বিদেশিনী হয়েও ভিনদেশি লোকায়তের মর্মোদ্ধার, খাঁটি বাউলসঙ্গিনী হওয়া, হয়ে ওঠা খরদৃষ্টি আশ্রমজননী, তারপরে গানের শিক্ষা, সুরের দীক্ষা এবং সবচেয়ে যেটা কঠিন— সাধনদাসের সমকক্ষ হয়ে তার গীতসঙ্গিনী হওয়া। সাধনদাস বাউল গানের একজন ভাল পারফরমার, গান তার জীবিকা। তাই তার গানে পারফেকশানের প্রশ্ন আছে, আসরে গানের তত্ত্ব বুঝে তাকে গান বাছতে হয়, তার চর্চা করতে বহু ভাবনা ও বিচার লাগে। এই পথটা— সাধনদাসের এই গতিপথটা তাকে বুঝতে হয়েছে, নিজেকে গড়ে নিতে হয়েছে।

আসরে সেটাই দেখছিলাম মুগ্ধ হয়ে। ‘সত্য বলো সুপথে চলো’ দিয়ে মাকি শুরু করেছিল ঠিকই কিন্তু তারপর সাধনদাস তাকে এক একটা গানের নির্দেশ দিচ্ছিল আর মাকি গাইছিল, আমার টেপে সেগুলো ধরা পড়ছিল। ‘এটা গাও’ ‘ওটা গাও’ সাধনের নির্দেশ মেনে উদ্দিষ্ট গানটা মাকি গেয়ে দিচ্ছিল সাবলীল দক্ষতায়। একবারও তো খাতা দেখেনি, তবে? সেসব গানের ভাবে কি সে নিমজ্জিত হয়ে গিয়েছিল? এসব গান তার স্মৃতিধার্য বিষয়, এতদিনে তার জীবনের বিশ্বাসের অঙ্গ হয়ে উঠেছে নিশ্চয়। মাকির নিবিষ্ট তন্ময়তা আমাকে চমৎকৃত করছিল। এ তো আর কাজকর্মের ফাঁকে মিনতি দাসীর গুনগুনানি নয়। শান্তিদেব ঘোষের মতো মানুষ এই জায়গাটায় ভুল করেছিলেন। জাপানি বলে, বিদেশিনী বলে, মাকি কাজুমিকে তিনি শান্তিনিকেতনের বাউলমঞ্চে উঠতে দেননি, গাইতে দেননি। ভেবেছেন বাউল গান গাইতে হলে গিমিক চলবে না, হতে হবে সেই জীবনযাপনের শরিক। মাকি তো কোনও অর্থেই পোশাকি গায়িকা নয়? তা হলে গানে এমন ভাবের পরম্পরা রাখতে পারত কি? শান্তিদেব মাকিকে দেখেছেন খণ্ডরূপে, ভেবেছেন সাজা গায়িকা। আমি দেখছি তার অখণ্ডরূপ, একজীবন থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন আরেকজীবনে মিলে যাওয়ার রূপান্তর।

এইখানে এসে একটা বড় খটকা লাগে আমার মনে। বাউলজীবনে যারা আসে, গুরুর কাছে নির্দেশ নিয়ে সাধনভজন করে, তাদের জীবন আসলে রূপান্তরিত জীবন। মূল সমাজস্রোতের যে অংশে তার জন্ম সেই গ্রামসমাজে মাহিষ্য বা বাগদি, কুর্মি, কাহার, ডোম, দুলে বা হাড়ি যে-বর্গেই তার জন্ম হয়ে থাকুক সেই পরিবেশে ও নীতিবেষ্টনীতে সে বাঁধা থাকেনি। বেরিয়ে এসেছে বাউল সমাজের আঙিনায়। এখানে সামাজিক নিয়মনীতির প্রহরা নেই, সমাজপতি নেই, সমাজের কোনও প্রত্যাশা নেই তাকে ঘিরে। গ্রামেরই একটা অংশে তারা থাকে, গ্রামে বা আশপাশের গ্রামে তারা গান গেয়ে মাধুকরী করে। বৃহত্তর গ্রাম্যসমাজবোধ ও তার জীবনদৃষ্টি বাউলফকির বৈরাগীদের উপেক্ষা বা ঘৃণা করে না। গৃহস্থ বাড়ির শ্রী ও স্বাচ্ছন্দ্যের একটা অচ্ছেদ্য অংশ হল এই বোধ যে বাড়িতে বাউলবৈরাগী ফকিরমিসকিন এলে তাদের চালজল সেবা, আনাজপাতি ফল দেওয়া উচিত, তাতে গৃহীজীবনের কল্যাণ। তাদের সঙ্গে খানিক আলাপচারি করলে কিছু জ্ঞান হয়, সে জ্ঞান সংসারজীবন দিতে পারে না। বাউলবৈরাগীর বলা কথায় সবসময় যে দিব্যজ্ঞানের অতলতা থাকে তা নয় কিন্তু তাদের বাক্যবিন্যাসে একটা মোহিনী শক্তি থাকে, একটা অব্যক্ত ব্যঞ্জনার আভাস থাকে। তাদের মতো করে কথা বলার নেশা কোনও কোনও পল্লিবাসীর জেগে ওঠে। যেমন ধরা যাক নদিয়া জেলার সম্পন্ন গ্রামে এক বাউলফকির সম্মেলনে গিয়েছিলাম সেবার। মধ্যরাতে যখন গানের আসর ভাঙল তখন প্রখর শীত, মাঘ মাস। এক চাষির অঙ্গনে বসে গরম গরম খিচুড়ি খেয়ে শীত খানিকটা কাটল। এবারে আমরা যাব কোথায়, শোব কীভাবে? এই নিষ্ঠুর শীতের রাতে? সম্মেলনের এক উদ্যোক্তা আমাদের চার-পাঁচজনকে পায়ে পায়ে নিয়ে চললেন গ্রামপ্রান্তের একটা বাড়িতে। গাঢ় অন্ধকারে সব কিছু ঠাওর হচ্ছিল না, তবে একটা বাড়ির সামনে পৌঁছলে কেউ দরজা খুলে দিল। লণ্ঠনের আলোয় দেখলাম, বাড়ির বারমহলের একটা বড় ঘরের মেঝেয় লম্বা করে বিছানা পাতা, মশারি টাঙানো। শীতে তখন আমরা জড়তাপ্রাপ্ত তাই কোনওরকমে দাওয়ায় পা ধুয়ে, গামছায় পা মুছে, বিছানায় ঢুকে নাক পর্যন্ত লেপ টেনে নিলাম। সারাদিনের শ্রান্তি ক্লান্তি, ওই তীব্র শীত আর খিচুড়ি ভক্ষণের উদরতৃপ্তি আমাদের ঘুম এনে দিল অচিরে।

একটানে ঘুমিয়ে বেশ ভোরে উঠে পড়া আমার স্বভাব। ঘুম ভাঙতে দেখি ঘরের কারুরই নিদ্রাভঙ্গের কোনও আশু সম্ভাবনা নেই, তাই দরজা খুলে বাইরে বেরোলাম। সামনেই গ্রামের অপরিসর কাঁচা পথ, অদূরে একটি পুকুর ও বনঝোপ। পুকুরে গিয়ে মুখেচোখে জল দিয়ে, একটা কচার ডাল ভেঙে দাঁত মাজতে মাজতে বাড়িটার দিকে ফিরে চাইলাম: চকমেলানো বিশাল তিনতলা এক বাড়ি, অ্যালা রঙের। তার মানে আমাদের গৃহস্বামী একজন সম্পন্ন গৃহস্থ। বাড়ির দরজায় ‘এলাহি ভরসা’ দেখে বোঝা গেল মানুষটি ধর্মপ্রাণ মুসলিম। অথচ তাঁর বাড়িতে যাদের রাত্রিবাসের ব্যবস্থা বাউলফকিররা করেছে তারা আমার মতো ধর্মনির্লিপ্ত মানবতাবাদী। এতে কোনও বিস্ময় নেই, বিরোধও নেই। গ্রামের মারফতি ফকিররা একটা গানের আসর বসিয়েছে, তাদের দীন বাসস্থান অতিথিসেবার উপযুক্ত নয়। কিছু মান্যমান শিক্ষিত মানুষ এসেছেন আমাদের গাঁয়ে, হলেই বা আমি ধর্মনিষ্ঠ শরিয়তবাদী মুসলমান কিভু সেবাধর্ম তো ইসলামে ‘ফরজ’ মানে কর্তব্য, কাজেই দিয়েছি ঘরখানা খুলে। থাকুন মেহমানরা— এক রাতের ব্যাপার তো। হ্যাঁ ফকিরদের সঙ্গে আমাদের পথের মিল নেই, ওরা বেনামাজি, কিন্তু শান্ত ও উদার। আর সবচেয়ে বড় কথা, খুব সুন্দর ভাবের গান গায়— গৃহস্বামীর এটাই হল মনের কথা।

পুকুর থেকে ফিরে এবারে ঠাওর হল যে বাড়ির সিমেন্টের রোয়াকে এক বৃদ্ধ বসে আছেন। সাদা লুঙ্গি সাদা পিরান সাদা দাড়ি, হাতে তসবিমালা। ভোরের ফজরের নামাজ সাঙ্গ করে এসে বসে আছেন পূৰ্বাস্য হয়ে। গায়ে দামি শাল। স্বভাবতই তাঁকে গৃহস্বামী ভেবে বললাম, ‘এ বাড়ি আপনার?’

হেসে বললেন, ‘না না, এ বাড়ি পাক আল্লার।’

লজ্জিত হয়ে বললাম, ‘সে তো একশোবার। তবু সামাজিকভাবে এ বাড়িতে তো আপনারই দখল। নাকি?’

‘হ্যাঁ, লোকে তো তাই বলে’— বলে মানুষটা উদাসভঙ্গিতে খানিকটা বসে রইলেন। পরে বললেন, ‘কী ঘর বানাইলাম আমি শূন্যের মাঝার।’

বোঝা গেল গৃহস্বামী সম্পন্ন ও বিত্তশালী কিন্তু ভূয়োদর্শী। ফকির দরবেশদের তাঁর বাড়ি আনাগোনা আছে, তাই এমনভাবে হাসন রজার গান এসে পড়ল। এসে পড়ল বাউলফকিরদের জাদুভাষা— হ্যাঁ, লোকে বলে বটে এ বাড়ি নাকি আমার! এরপরে বলবেন হয়তো, ধুস। ক’দিনের আর এই দুনিয়াদারি কীসের বা মালিকানা! এ দেহের মালিক মোক্তারন, আমি তার পরহেজগার বই তো নই।

গ্রামসমাজে এই এক অলক্ষ দান বাউলফকিরদের— তারা মহতের গান শুনিয়ে আর বৈরাগী জীবনের আদর্শে গৃহীমানুষকে উদাসীন করে দেয়। তাই বহুগ্রামে দেখেছি বাড়িতে ভিক্ষাজীবী বাউল বা বোষ্টমবোষ্টমী এলে তাদের সমাদর করে বসায়, তাদের কাছে অনেক কিছু জানার থাকে অন্দরের নারীসমাজের। দেহের কথা, ব্যাধি-নিরাময়ের পদ্ধতি, যৌনতা… কত কী। সবচেয়ে যেটা বড় আকর্ষণ তা হল অন্দরের মধ্যে বাহিরের স্রোতাবর্তকে টেনে আনা, পথের মানুষটার কাছে কতরকম খবর থাকে, কত রঙ্গকথা, কত রহস্যময় গান। এও কি কম বিস্ময় যে এদের বিয়েই হয়নি অথচ কেমন সুন্দরভাবে বেঁচে আছে… বাধাবন্ধন নেই, সন্তান নেই, মুক্ত। অথচ অজস্র বাধাবাঁধনে জটিল কিন্তু মোহময় জীবনকে, সংসারজীবনকে কি নিতে পারত না এরা? নিতে তো পারতই এমনকী সেই জীবনেই তো এরা ছিল। সংসারলতার বন্ধন ছিন্ন করে এরা স্বেচ্ছায় সানন্দে এসেছে দেহতত্ত্বের গুহ্য লতাসাধনায়।

এরা তাই রূপান্তরিত মানুষ— সুধাময় কিংবা সাধন, মিনতি কিংবা মাকি কাজুমি। এদের মধ্যে মাকি বিদেশি বলে তার রূপান্তরক্রিয়া ঘটেছে একটু বেশি সময় ধরে, মিনতির অত সময় লাগেনি, তার কারণ তার যে দেশজ অভিজ্ঞতার ধারা রয়েছে। দুজনেই বাউলসঙ্গিনী ও সেবাদাসী, দুজনেই ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবে না। দুজনেই বর্তমানের সুখ আর আনন্দকে অঞ্জলি ভরে পান করছে। এদের সারা শরীরে আমি আনন্দের হিল্লোল দেখি, মনের মধ্যে গভীর তৃপ্তির স্বস্তি। ‘সত্য বলো সুপথে চলো’ মাকি যখন গাইছিল তখন সেটা আর লালনের গান ছিল না, হয়ে উঠছিল এক জাপানি মেয়ের রূপান্তরিত জীবনভাষ্য। ‘সত্য বলো সুপথে চলো’— কথাটা কি নিজের কাছে নিজের অঙ্গীকার? নাকি বর্তমান জীবনের থেকে, তার ক্লিন্নতা থেকে মুক্তির আর্তি? এ প্রশ্নের উত্তর আছে আরেকটা গানে ‘গুরু আমায় নাও গো সুপথে’। এটাই চরম কথা। সাধিকা বা সঙ্গিনী কখনই প্রকৃতপথ জানে না— জানে গুরু। এইখানে গুরুর আধিপত্য এসে যাচ্ছে। সাধনদাস না দিলে মাকির পাবার কিছু নেই। সাধনদাসও তো একজন রূপান্তরিত মানুষ। যে সমাজ পরিবেশে তার জন্ম আর বেড়ে ওঠা, তার কোনওদিকেই বাউল হবার মতো প্ররোচনা ছিল না। সে বাউলের সন্তান নয়, গানও তেমন জানত না। কেন সে বাউল হল? কীসের লোভে? আজকে হাটগোবিন্দপুরে তার যে স্বচ্ছন্দ শান্তিকল্যাণ ভরা আশ্রম তার উত্তরাধিকার সে পেয়েছে গুরুর কাছ থেকে। সাধনভজনের একাগ্রতা, গানের তত্ত্বজ্ঞান ও গায়ন, গুরুসেবা দিয়ে সে অর্জন করেছে এখানকার অধিকার। গুরুর নামেই তার আশ্রম, প্রাঙ্গণের মুখে সেই সাইনবোর্ড দেখা যায়। আজ মোটর চড়া বা টেলিফোন রাখা সাধনদাসকে দেখে বোঝা যাবে না সে কতখানি রূপান্তরিত। যতখানি পূর্ণতা ও গায়ন-ব্যক্তিত্ব পেলে বিদেশি নারীর মন জয় করা যায় সেটা সে আয়ত্ত করেছে। মাকি তার কাছে ধরা দিয়ে সফল ভাবছে নিজেকে। গুরুকে তার ধ্যানজীবনের সুপথের কান্ডারি করেছে। সাধনদাসের এই ব্যক্তিত্ব একটু ব্যতিক্রমী তাতে সন্দেহ নেই, কারণ সচরাচর আমরা উলটোটা দেখি। দেখি বাউল আর বিদেশিনীর যে জোট তাতে বাউলের তরফে হ্যাংলামি বেশি। আমাদের অভাব ও দারিদ্র্যের দেশে বাউলের চালাঘরে যদি একজন মেমসাহেব এসে উদয় হয় তবে সে হল ভাঙাঘরে চাঁদের উদয়। তখন সেই বিদেশিনীর কৃপাধন্য বাউলকে দেখে সমাজের সবাই ঈর্ষাবোধ করে। বাউলের মধ্যে জাগে এক ধন্যতার বোধ।

অথচ এই জোটের সংগঠনে বাউলের কতটুকুই বা ভূমিকা? মেমসাহেবকে তো সে নির্বাচন করতে পারে না, মেমসাহেবই তাকে নির্বাচন করে। তার সঙ্গী হবার জন্য সে দু’পায়ে খাড়া। তার সুবাদে বাউল যেতে পারে বিদেশেও। তীব্র আলোকচ্ছটায় উদ্‌ভাসিত বিদেশি মঞ্চে গেরুয়াপরা কালোকোলো নিরক্ষর মানুষটি নেচে নেচে ‘ভোলামন’ বলে গান গায়। রঙ্গপ্রিয় তরলমতি বিদেশি শ্রোতারা বাউলগানের ডুবকির তালে তালে নাচে, ভিডিও ছবি তোলে। যেন উন্মাদ হয়ে যায় প্রাচ্যদেশের অজানা গানের গর্বে তাদের প্রতীচ্য জীবনের যান্ত্রিক মন।

সোনামুখির বাউল সুধন্যদাস এ ব্যাপারে আমাকে তার অভিজ্ঞতা বলেছিল এইরকম ভাষায় যে, ‘আমেরিকা, ফ্রান্স আর জার্মানিতে আমি গান গেয়েছি। না, আমি একা নই, বাঁকুড়ার এক নামকরা বাউল, আপনাকে তার নাম করব না, জনদশেকের দল বেঁধে গিয়েছিল। আমাকেও নিয়েছিল দলে, কারণ আমার গানের গলা তেজি, তা ছাড়া অনেকরকম বাউলগান আমি জানি।’

—অনেক টাকা রোজকার করলে?

—না। যতটা ওরা দিয়েছিল তার হিসেবটা তো ওই বাউল নেতা আমাদের বলেনি। শুধু কথা হয়েছিল পনেরো দিনের প্রোগ্রাম আর দশ হাজার নগদ টাকা।

—সেটা পেয়েছিলে তো?

—না। দিয়েছিল শেষ পর্যন্ত আট হাজার। দু’হাজার নিয়ে নিয়েছিল। কি করব? বিদেশ বিভুঁই, কাউকে চিনি না, ভাষা জানি না, অসহায়। তারপর ধরুন চটে গেলে ভবিষ্যতে আর দলে নেবে না। আমি তো সাধক বাউল নই, গায়ক, বলতে পারেন সাজা বাউল। গৃহী মানুষ। তিনটে কন্যা সন্তান। তাদের বিয়ে দিতে হবে, তাই টাকা চাই। গরিব মানুষ আমি, জাতে দুর্লভ মানে দুলে। পরের জমিতে মুনিশ খাটি দৈনিক তিরিশ টাকা রোজে। আট হাজার টাকা কখনও দেখেছি একসঙ্গে?

—ওখানে কী রকম সমাদর পেলে?

—খুব সমাদর, বলতে পারেন পাগলের মতো ওদের উচ্ছ্বাস আর নাচানাচি। সত্যি বলতে কি দাদা, সমাদর আমার এখানেও খুব। সারারাত গাইলেও গ্রামের শ্রোতারা শুনে যাবে, সাধুবাদ দেবে, তবে ওই পর্যন্তই। গরিব মানুষ তারা, শুষ্ক সমাদর তাই। দেবে যে কিছু পাবে কোথায়? তা ছাড়া সারাবছর তো তারাই দিচ্ছে, মাধুকরীর অন্নসেবা। কিন্তু বিদেশে অন্য ব্যাপার। গান শেষ হলে ওরা মঞ্চে উঠে পাগলের মতো চুমো খায়। হ্যাঁ, মেয়েরাও। সে কি অস্বস্তি দাদা— আমাদের তো অব্যেস নেই, লজ্জা করে।

—আর কী হয়?

—কাঁধে ক্যামেরা ঝুলিয়ে দেয়, গায়ের সোয়েটার বা কোর্ট খুলে পরিয়ে দেয়, হাতে ধরিয়ে দেয় দামি টেপরেকর্ডার। আরও কত কী উপহার দেয়— শার্টের কাপড়, প্যান্টপিস, ঘড়ি। সেগুলো নিয়ে আমি কি করব? রাখব কোথায়? তাই গাঁয়ে এসে বেচে দিয়ে হাজার পাঁচেক টাকা পেয়েছিলাম। তারপরের ঘটনা বড় দুঃখের।

—কী রকম?

—ধরুন তা হাজার পনেরো টাকা জমা রেখেছিলাম সোনামুখির গ্রামীণ ব্যাঙ্কে। বড় খুকির বিয়ে ঠিক করে ফেললাম ওই টাকার ভরসায়। ছেলে দেখা হল, পাকা কথা হল, বিয়ের দিন ধার্য হল। সবই দেখুন ওই গুরুর কৃপা, ওই দেখুন আমার গানের গুরু ত্রিলোকেশ্বর বাউল ছবিতে রয়েছেন। এখন তো দেহ নেই, অপ্রকট, তাঁর কাছে এই সামান্য দুলের ছেলে গান শিখেছিলাম। লাঙলটানা আর কাস্তেধরা দু’হাত আমার, তাঁর কৃপায় সেই হাতে উঠেছে দোতারা। গুরুর কৃপায় সুধন্যদাসের মতো দোতারা এ দিগরে কে আর বাজাতে পারে? অথচ সেই কাজ প্রথমে কত কঠিন ছিল।

—কেন?

—গোড়াতেই কি দোতারা দাদা? প্রথমে দশ-এগারো বছর বয়সে টিনের কৌটোতে বাঁশের ফালি বেঁধে, তাতে মাছধরা সুতোর তার বানিয়ে তৈরি করেছিলাম খমক। আগে সেই খমক বাজিয়েই গাইতাম। পরে, অনেক পরে, শুশুনিয়া পাহাড়ের নীচের গাঁ কাটিগড়ে ওস্তাদের কাছে দোতারা শিক্ষা। দোতারার সুরে গান শুনে বশ হলেন গুরু ত্রিলোকেশ্বর গোঁসাই। তার থেকে এত নাম, যশ, মান— বিদেশ যাওয়া, টাকা রোজগার— প-নে-রো-হা-জা-র। কিন্তু শেষমেশ সইল না।

—কী হল?

—মেয়ের বিয়ের সাতদিন আগে সোনামুখি গিয়ে ব্যাঙ্ক থেকে টাকাটা তুললাম। খরচপাতি, গয়নার দাম, ঘর সারানি এসব করতে হবে তো। কিন্তু সেই রাতেই বাড়িতে ডাকাত পড়ল। সর্বস্ব নিয়ে গেল দাদা। রাগে দুঃখে আমি বাস্তুগ্রাম ছেড়ে দিয়ে সোনামুখিতে ঘর বানিয়েছি। আর ও-মুখো হই না।

—কেন? গাঁয়ের কী দোষ?

—গাঁয়ের মানুষই তো ডাকাতি করেছিল। ঈর্ষা, হিংসা। ওই যে বিদেশ গিয়ে নামযশ খুব হয়েছিল— সেটা সইল না মানুষের। অথচ আমরা প্রায়ই গাই ‘ভজো ভজো মানুষ ভগবান।’ মানুষের যা সব রূপ দেখলাম এ জীবনে।

বাউল ফকিরদরবেশদের চেতনায় মানুষ একটা বহুদ্যোতনাময় কনসেপ্ট, তার আবার দেহতত্ত্বগত প্রতীকী অর্থও আছে। ‘ভজো ভজো মানুষ ভগবান’ আর ‘মানুষরত্ন সযত্ন করলে না’ এই দুই উচ্চারণে মানুষ শব্দের গুহ্য অর্থ একেবারে আলাদা— অবশ্য এতসব গোপ্য তত্ত্ব সুধন্যদাসের মতো গায়ক বাউলের জানার কথা নয়। একথা বুঝবেন খয়েরবুনি আশ্রমের সনাতন দাস। প্রয়োজনে মানুষতত্ত্ব বুঝিয়ে দেবেন গান গেয়ে— নিত্য খ্যাপার সেই গান:

মানুষেতে মানুষ আছে

মানুষ নাচায় মানুষই নাচে।

মানুষ যায় মানুষের কাছে

মানুষ হইতে।

মানুষ মানুষ বলতে বলতে রূপান্তরিত মানুষের কথা আবার এসে গেল। সাধনদাসের মতো সাধকদের জীবন রূপান্তরিত আর সুধন্যদাসের জীবন সন্তাপ ও মর্ত্য কান্নায় আচ্ছন্ন। জমির কাজে মুনিশের তিরিশ টাকার রোজ থেকে নিছক গান গেয়ে থোক পনেরো হাজার টাকা পাওয়ার যে অলীক আর্থিক উত্তরণ তা শেষ পর্যন্ত ধোপে টেকে না কারণ বস্তু তো সঞ্চয়যোগ্য নয়, তা ক্ষয়িষ্ণু। উত্তরণ চাই ভাবের দিকে খাড়াখাড়ি। তার জন্য প্রয়োজন আত্মসংবরণ ও কাম মুক্তি।

সাধনদাসের আশ্রম, সেখানকার শ্রী ও স্বাচ্ছন্দ্য, তার বিদেশিনী সঙ্গিনী দেখে মনে হতে পারে বোধহয় এসবই ভোগবাদ এবং পুরুষতান্ত্রিক সমাজ কাঠামোর অন্যতর রূপ। তা কিন্তু নয়। আশ্রম তার গুরুর দান, গান তার প্রযত্নলব্ধ, মাকি তার অর্জন। পঁচিশ বছর আগে সুধাময় দাসের আড়ংঘাটার আখড়ার এমন পূর্ণাঙ্গ শান্তি ও উজ্জ্বলতা দেখিনি। বরং দেখেছিলাম এক অদ্ভুত দৃশ্য। সন্ধের পর পবনদাসের গানের সঙ্গে নাচতে নাচতে মিনতি হঠাৎ পেট চেপে ধরে শুয়ে পড়ল আর কাটা পাঁঠার মতো ছটফট করতে লাগল। সুধাময় তাতে ভ্রূক্ষেপও করল না, গানও থামল না। ছুটে গিয়ে ক’জন শিষ্য আর মহিলা টেনে তুলল মিনতিকে। সে তখন অর্ধচেতন। খানিকটা সুস্থ হলে জানা গেল তার পেটে গুরুতর পেপটিক আলসার। খাওয়াদাওয়া থেকে সব কিছুতেই তার অনেক নিষেধাজ্ঞা আছে ডাক্তারের। কিন্তু কে তাকে দেখবে? অন্তত বৈরাগীর সে দরদ নেই। মিনতি তাই একদিন আসমানীর মতো বিদায় নিতে বাধ্য হবে।

এর সম্পূর্ণ বিপরীত একটা ঘটনা এবং দুটো আশ্চর্য চরিত্রের কথা মনে পড়ছে। সেবার পিরনিবাসে গিয়েছিলাম প্রতিবন্ধী কল্যাণ কেন্দ্রে। কেন্দ্র মানে একটা দুটো হল ঘর, বেশ খানিকটা জমি যাতে রয়েছে সবজিবাগান আর টিউবওয়েল, এই সংগঠনে রবিবার রবিবার ডাক্তার আসেন। প্রতিবন্ধীদের চিকিৎসা হয়। এরা দৈহিক প্রতিবন্ধী। কেউ অন্ধ, কেউ খোঁড়া, কেউ বিকলাঙ্গ। প্রতিবন্ধী কল্যাণ সমিতির এই কেন্দ্রীয় সমাবেশে আমার আসার কারণ হল সরেজমিনে প্রতিবন্ধী লোকশিল্পীদের সঙ্গে পরিচয় করা। তাদের মধ্যে অনেকে নাকি বাউল গান গেয়ে সংসার চালায়। ট্রেনে বা বাসে, বাসস্ট্যান্ডে, মেলামচ্ছবে তারা গায়। আজকাল সরকারি অনুষ্ঠানে বা লোকসংস্কৃতি উৎসবে প্রতিবন্ধী বাউল শিল্পীদের ডাক পড়ে— কিছু অর্থপ্রাপ্তি ঘটে। এরা গায়ক বাউল বটে তবে জীবনাচরণে কেউ বাউল নয়। কোনও সাধু বা গোঁসাই গুরুর কাছে দীক্ষা শিক্ষা হয়ে থাকতেও পারে, নাও পারে। গেরুয়া পোশাক আছে এক সেট। অনুষ্ঠানের আগে সেটা পরে নেয়। যেসব গান গায় তার তত্ত্ব জানে না। গোষ্ঠগোপাল, পূর্ণদাস বাউল, পরীক্ষিৎ বালার হিটগান গাইতে পারে। কেউ শিখেছে দু’-চারখানা ভবা পাগলার গান। কেউ একতারা বাজিয়ে গায়, কেউ হারমোনিয়াম। সহশিল্পীর হাতে থাকে খমক বা খঞ্জনি। এরা করুণাভিক্ষু, অসহায় ও বিনীত। নিজেদের জোরে বাঁচতে পারে না।

কিন্তু ‘প্রতিবন্ধী বাউল’ শব্দবন্ধটি ভারী অস্বস্তিকর, কারণ বাউল তো সচলতার প্রতীক— সে সাধনা মুক্ত ও স্বয়ম্বশ, তাতে কোনও প্রতিবন্ধ নেই, সাংসারিকতা নেই, সংস্কার নেই। তবু অনুষ্ঠানের ঘোষক বলেন: ‘এবারে গান গাইবেন প্রতিবন্ধী বাউল উদ্ধবদাস।’

উদ্ধবদাস বাউলের গান সত্যিই ভাল লাগল। সুন্দর সুমিষ্ট কণ্ঠ, স্পষ্ট উচ্চারণ, গায়নপদ্ধতিতে নিজস্বতা আছে। গানের শেষে তার বসার জায়গাটায় হাত ধরে নিয়ে গেল যে-মেয়েটি সে সম্ভবত তার স্ত্রী, সে-ই তাকে খানিকক্ষণ আগে অতি যত্নে মঞ্চে এনে হার্মোনিয়ামের সামনে বসিয়ে দিয়েছিল। গানের শেষে উদ্ধব যখন বসল তখন মেয়েটি জননীর মমতায় তার ঘাম মুছে দিল শাড়ির আঁচলে, জল খেতে দিল এক গেলাস। সস্তা সিনথেটিক শাড়ি পরা, কপালে সিঁদুর আর হাতে দু’গাছি পলার চুড়ি, একটা নোয়া। মেয়েটির নাম পাপিয়া। সে মিনতি বা মাকি কাজুমি গোত্রের নয়, গানও জানে না। কথায় কথায় জানা গেল উদ্ধবদাসের পদবি ‘বালা’, জাতে নমঃশূদ্র, উদ্বাস্তু পরিবারের সন্তান, এখনকার নিবাস উত্তর চব্বিশ পরগনার গাড়াপোঁতায়। মাতৃপিতৃহীন, কিশোর বয়স থেকেই গান গেয়ে চলে। বনগাঁ স্টেশনে গান গাইত। স্টেশন চত্বরেই আলাপ এই পাপিয়ার সঙ্গে। পাপিয়া দাসবৈরাগ্য, জাতি-বৈষ্ণব। তার বাবা সম্পন্ন গৃহস্থ, জোতজমি প্রচুর, দাদা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। পাপিয়া নিজেও মাধ্যমিক পাশ। উচ্চ মাধ্যমিক পড়তে ট্রেনে করে বনগাঁ আসত। উদ্ধবের সঙ্গে প্ল্যাটফর্মে আলাপ, ভাললাগা ও বিয়ে।

শুনতে যত সোজা কাজটি তত সোজা হয়নি। অন্ধ গায়ক তায় নমঃশূদ্র, সহায়সম্বলহীন উদ্ধবের সঙ্গে সচ্ছল গেরস্থ বাড়ির মাধ্যমিক পাশ বৈষ্ণববংশের মেয়ে পাপিয়ার কি স্বাভাবিক বিয়ে হতে পারে? পাপিয়া বলল, ‘দাদা প্রচণ্ড মেরেছে। বাবা-মা ঘরে বন্ধ করে রেখেছে, এই মানুষটার ওপরেও শাসানি মারধর করেছে কেউ কেউ। কলেজে আসতাম সঙ্গে একজন না একজন থাকত পাহারা দিত। তবু শেষ পর্যন্ত পারল কি?’

—কী করলে?

—একদিন পালিয়ে এলাম সোজা। রানাঘাটে গিয়ে দু’জনে রেজিস্ট্রি বিয়ে করলাম। দু’-চার গাছা গয়না যা ছিল তাই বিক্রি করে গাড়াপোঁতায় একটা টিনের চালার ঘর করেছি। একটু স্নানের ঘর, পায়খানা, টিউকল। চলে যায় দাদা, সুখে দুঃখে। মানুষটা গান গেয়ে কিছু রোজকার করে হাটে বাজারে। আমি ক’টা মেয়েকে পড়াই, অবসরে ঠোঙা বানাই। না, বাপদাদারা সম্বন্ধ রাখেনি। তাদের মুখ পুড়িয়েছি তো, মানে মর্যাদায় লেগেছে।

আশ্চর্য এমন নবীন দম্পতির দিকে মুগ্ধ বিস্ময়ে চেয়ে থাকি। নবীন দম্পতি বই কী। একজনের বয়েস যদি বছর পঁচিশ হয়, আরেকজনের কুড়ি-বাইশ। দু-বছর ঘরসংসার করছে, সন্তান আসেনি এখনও। স্বাভাবিক বুদ্ধিবিবেচনা থেকে মনে হল উদ্ধবদাসের গান শুনেই নিশ্চয় পাপিয়া আকর্ষণ বোধ করেছে— এমন সিদ্ধান্ত করার কারণ পূর্ব অভিজ্ঞতা। মিনতি বা মাকি বলে নয়, দেখেছি বেশির ভাগ বাউলের সঙ্গিনী জুটে যায় গানের মোহে, কেউ কেউ আসে যৌন আকর্ষণে। পাপিয়ার ক্ষেত্রে কোনটি? নিরপেক্ষ বিচারে বলতেই হয় উদ্ধবের গান ভাল, তবে পাগল করা আবেদন নয় তার। উদ্ধবকে দেখতে একেবারে সাধারণ। বেশ কালো, বেঁটে, জন্মান্ধ। সাধারণত পথে ঘাটে ট্রেনে বাসে কিংবা স্টেশনচত্বরে যেসব অন্ধকে গান গাইতে দেখি তাদের সঙ্গিনী বা স্ত্রীরাও হয় অন্ধ। পাপিয়ার মতো চক্ষুষ্মতীর পক্ষে অন্ধ গায়ককে বিয়ে করা, ভালবেসে, বেশ কঠিন কর্ম। সেকথা ভেবেই জিজ্ঞেস করি, ‘উদ্ধবের গান শুনেই কি তোমার তাকে ভাল লেগেছিল?’

—না তো। একদিন ট্রেন থেকে নামতেই এল ঝেঁপে বৃষ্টি। ছুটে গিয়ে দাঁড়ালাম প্ল্যাটফর্মের সেই জায়গাটায় যেখানে ও বসে গান গাইত। কোনওদিন তেমন করে ওর গান শুনিনি আলাদাভাবে। ওই গান কানে আসে এইরকম আর কী। কিন্তু সেদিন ব্যাপারটা হল অন্যরকম। বৃষ্টির ছাটে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যাচ্ছে, কোনওদিকে যে সরে বসবে ঠাওর করতে পারছে না, ভাবলাম, আহা রে কত অসহায়!

উদ্ধব ফুট কেটে বলল, ‘আসলে দাদা ওর মনটা খুব নরম তো… নইলে ভাবুন আমার মতো পথের ভিখিরিকে ভালবাসে? কী আছে আমার? বাপ-মা নেই, চালচুলো নেই, এমনকী চক্ষু হেন রত্নও নেই…’

পাপিয়া সজোরে উদ্ধবের মুখ চেপে ধরে বলে, ‘চুপ চুপ। সব আছে তোমার। আমি আছি না?’

উদ্ধবের অন্ধচোখে জল পড়ে আর পাপিয়া সুন্দর করে হাসে— সেই হাসি অবশ্য উদ্ধব দেখতে পায় না, তবে বুঝতে পারে নিশ্চয়। তার নীরব কান্না থামে। আর আমি দেখি কী সুন্দর মর্তমানবী। সস্তা সিনথেটিক শাড়ির উদ্ভাসে রিক্ত গহনার শূন্যতা সত্ত্বেও সিঁথির সিঁদুরে রক্তিম যৌবনশ্রী— অথচ কোথাও এক চিলতে ত্যাগের অহংকার নেই, রয়েছে উৎসর্জনের পুণ্য। উচ্চশিক্ষার মোহ ছেড়েছে, ফেলে এসেছে বিত্তবাসনা, সম্পন্ন পিতৃগৃহের আওতা, সচ্ছল দাম্পত্যের ভবিষ্যৎ স্বপ্ন।

এদের কি বলা যাবে বাউলের চরণদাসী? কোনও ভাবেই না। অন্যোন্য সম্পর্কের চিরবন্ধনে বাঁধা প্রকৃত মানবমানবী। অন্তরের দৃষ্টিপ্রদীপের আলোয় মেয়েটি বরণ করেছে ছেলেটিকে। প্রতিবন্ধী বাউল কে বলবে একে? হাত ধরেছে চিরন্তনী নারী। সামান্য অন্নপানের পরিতৃপ্ত সংসার। টিনের চালার ছোট মাথা গোঁজার আস্তানা, একটা টিউকল, দুটো একটা পেঁপে বা কলা গাছ। উদ্ধব মাঝে মাঝে গান বানায় মুখে মুখে,পাপিয়া একটা খাতায় লিখে রাখে যত্ন করে। আহামরি গান কিছু নয়, তবু তো সৃষ্টি। তাতে আছে চলমান জীবনের বেঁচেবর্তে থাকার চিহ্ন। পিরনিবাসের প্রতিবন্ধী কল্যাণকেন্দ্রে না এলে আমার জীবনের একটা বড় স্বপ্ন দেখা অচরিতার্থ থেকে যেত। নারীর কত বড় শক্তি।

এমন যে নারীর কল্যাণময়ী রূপ তার ব্যতিক্রমও কি দেখিনি? মনে পড়ে অগ্রদ্বীপের মেলায় সম্বৎসর তমালতলায় জাঁকিয়ে বসে মীরা মোহান্ত-র আখড়া। এককালের গৌরবর্ণা রূপসী মীরা এখন আসর পরিচালিকার ভূমিকায়— একেবারে নিখুঁত মা-গোঁসাই। উনিশ শতকে কলকাতার সংস্কারান্ধ তিমিরাচ্ছন্ন অন্তঃপুরে মীরার মতো মধ্যবয়সিনী মা-গোঁসাইরা যেতেন। লোকশিক্ষা দিতেন, অক্ষরজ্ঞান শেখাতেন নিরক্ষর অন্দরবাসিনীদের। শোনাতেন কীর্তন ও দেহতত্ত্বের গান। লোকচিকিৎসা, জড়িবুটিতে ছিলেন ওস্তাদ। মীরা যেন অবিকল সেই মা-গোঁসাইয়ের স্থির প্রতিমা। মাঝে মাঝেই মেটেরির স্থায়ী আখড়া ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে শিষ্যদের বাড়ি হেথাহোথা। কুশল নেওয়া, ধর্ম কথা বলা, গান শোনানো অথচ গুরুদক্ষিণা আদায় করতেও তৎপর, সতর্কচক্ষু।

সারা বছর আখড়া চালানো, চালডাল সবজির জোগান বজায় রাখা, শিষ্যদের সানুপুঙ্খ খবর নেওয়া ও তা মনে রাখা সবই মীরার সহজ ভজনার মতো। তমালতলায় সে যখন বাঁধানো শানে গালিচা পেতে বসে আসর পরিচালনা করে সে দেখবার মতো। একেবারে যেন জন্মনেত্রী। কে কোথায় বসবে, কাকে বেশি আপ্যায়ন করতে হবে, কাকে চা দিতে হবে, কাকে পান, সবই তার খেয়াল থাকে। পদ্মাসন করে বসে আছে, গেরুয়া বসন, নাকে রসকলি। আয়ত দুটি শান্ত চোখ এককালে বিদ্যুৎপ্রভ ছিল— তখন অনেক বাউল বৈষ্ণব পাক খেয়েছে ঘূর্ণিঝড়ে। এখনও হ্যাজাকের আলোয় স্পষ্ট দেখি মীরার চোখের অগ্নিকোণে পরিতৃপ্তির ঝিলিক, ঠোঁটের ফাঁকে কর্তৃত্বের অদৃশ্য সফল হাসি৷ শিষ্যরা ভৃত্যের মতো নির্দেশ নিচ্ছে আর পালন করে কৃতার্থ বোধ করছে। মীরা নির্দেশ দিচ্ছে কোন শিল্পীর পর কোন শিল্পী আসরে উঠে কর্ডলেস মাইকটা হাতে নেবে। গানের আগে তারা মীরাকে কুর্নিশ করে। দেখবার মতো।

এই অনুষঙ্গে মনে পড়বেই কালিদাসীকে। সত্তর পেরোনো বৃদ্ধা গায়িকা—বাউলতত্ত্ব জানে। সারাবছর এ মেলা থেকে সে মেলা। একটা ঝকমকে র-সিল্কের সাইডব্যাগ বানিয়েছে কালিদাসী—মোটামুটি হোল্ডঅল। চলেছে জেলা তথ্য অফিসে, লোকসংস্কৃতি পর্ষদে, বিধায়ক বা পঞ্চায়েত সভাপতির দরবারে। ‘গানের সুযোগ করে দাও গো বাবাসকল, পেনশন দেবার ব্যবস্থা করো, গান করতে এলে রাহাখরচ বাড়াও। খাব কী?’ যেমন তেমন যখন তখন বেশ ক’টা তত্ত্বগান গেয়ে দিতে পারে। কেউ নেই, নিঃসম্বল। সত্যি সত্যি শেষ পারানির কড়ি তার কণ্ঠের গান। কিন্তু সে গানের সমাদর কি থাকতে পারে বরাবর?

পশ্চিমবঙ্গ লোকসংস্কৃতি ও আদিবাসী সংস্কৃতি কেন্দ্র-র উদ্যোগে বসেছিল বাউল সম্মেলন ও সেমিনার গুসকরার এক কলেজে। বাউলদের সান্নিধ্যে কাটল দু’রাত দু’দিন। একদিন সকালে ঘরোয়া আলোচনা চক্রে আলোচ্য বিষয় ছিল: ‘বাউল গানের ভবিষ্যৎ’। নানাজনে উঠে নানা কথা বলছেন। আমরা বিশেষজ্ঞরা ফুট কাটছি, গোঁজামিল বহুরকমের আশ্বাস দিচ্ছি। হঠাৎ বর্ধমানের এক বাউল গায়িকা, খানিকটা বর্ষীয়সী, বলে উঠলেন, ‘বাউল গানের ভবিষ্যৎ কী হবে তা নিয়ে ভেবে কী হবে? বলুন তো আপনারা, আমার কী হবে?’

—কেন? কেন?

—আগে যারা গান শুনত, আদর করত, টাকা পয়সা দিত, তারা তো কই আর ডাকে না। তা হলে কি আমি শুকিয়ে মরে যাব?

আমরা চুপচাপ। এক যুবক বাউল নীরবতা ভেঙে বলল, ‘দিদি… ফুলে যখন মধু থাকে তখন ভ্রমর আসে। মধু শুকোলে কি ভ্রমর আসবে? সেটা আপনার ভাবা ভুল।’

ফুলের ওপর ভ্রমর বসে আছে এমন ধরনের লোকচিত্র আঁকতে পারেন নবাসনের হরিপদ গোঁসাই। তাঁর আশি-পেরোনো নির্মেদ চেহারা একহারা, শ্মশ্রুগুম্ফজটাজুট মূর্তি। আপনমনে বসে বসে বাউলতত্ত্বের ছবি আঁকছিলেন। পদ্মের মৃণাল, জলস্তর আর সবুজ লতাপাতা। জিজ্ঞেস করলাম : ‘এসব কী আঁকছেন?’

‘মানুষের জন্মবৃত্তান্ত। জননীগর্ভের মধ্যেকার অবস্থা।’ খাতা বোঝাই চিত্রমালা—নিজের ভাবনাচিন্তা দিয়েই আঁকেন, কেউ শেখায়নি। ছবি আঁকতে আঁকতে গুনগুন করেন:

সে দেশের যত নদনদী

ঊর্ধ্বদিকে জলস্রোতে বহে নিরবধি—

আবার জলের নিচে আকাশ বাতাস

তাতে মানুষ বাস করতেছে।

দীন শরতের লেখা দেহতত্ত্বের গান। হরিপদ গোঁসাইয়ের নাম অনেক শুনেছি, এই প্রথম দেখছি। ভাল হঠযোগ, প্রাণায়ামে দক্ষ বাউল। শুনেছি প্যারিসে যান যুবক যুবতীদের যোগ শেখাতে। তারাও আসে শীতকালে এই নবাসনে। বাড়িঘরদোর বেশ আধুনিক ধাঁচের, স্যানিটারি পায়খানা, পাতকুয়া আর টিউবওয়েল। ফরাসি ভক্তভক্তাদের জন্য, তাদেরই বদান্যতায় তৈরি। গোছানো মানুষ। হাসতে হাসতে দেখালেন নানা রাজপুরুষের সঙ্গে তাঁর ফোটোর অ্যালবাম। তারপরে চমকে দিলেন প্যারিস থেকে প্রকাশিত একটা সিডি রেকর্ড বার করে। হরিপদ গোঁসাই আর নির্মলা গোসাইয়ের কণ্ঠে বাউলগান, তাঁদের রঙিন ছবি। ইনলে কার্ডে লেখা Inde : Chants D’initiation Das Bauls Du Bengale.

হরিপদ-র প্রসন্ন হাসি দেখে বুঝলাম মানুষটা সবাইকে মেরে বেরিয়ে গেছেন—কোথায় লাগে সুবলদাস বা সাধনদাস? এবারে আশ্রমবিহারিণী নির্মলা মা-কে দেখি। সবাই নির্মলাকে মা-ই বলে। আট বছর পেরোনো একটু পৃথুল চেহারা, পান খেয়ে দাঁত কালো, গেরুয়া বসন, পাকা চুল। সিডির কভারে তাঁর ছবিটা উত্তরচল্লিশ বয়সের। তখনও চেহারায় কটাক্ষে খানিকটা রং ছিল, এখন একেবারে সদানন্দ হাস্যময়ী। হরিপদ বেশ প্রত্যয় নিয়ে বললেন, ‘নির্মলা সেবাদাসী নয়, সাধনসঙ্গিনী। কুড়ি বছরে দুই মেয়ে নিয়ে বিধবা হয়েছিল। মেয়েদের বিয়ে দিয়েছি, তার পরে ওকে আশ্রমে এনে সাধনভজন আর গান শিখিয়েছি।’

—আপনাদের সন্তান নেই?

—বাউল সাধনায় কি সন্তান জন্ম দেয়? দেয় না। গানে তাই বলছে : ‘শরিক কোরোনা না রে মন/ করি বারণ।’ আমাদের ঊর্ধ্বযোগ। শেখা কি সহজ? এই নির্মলা আমার কাছে কত মারধর খেয়েছে। জিজ্ঞেস করুন।

জিজ্ঞেস করতে হয় না। নির্মলা নিজেই উজিয়ে বলে, ‘কী মার যে মেরেছে গোঁসাই— চড়চাপড় লাথি পর্যন্ত খেয়েছি। রাগ অভিমান কত করেছি। গোঁসাই কত ভালবেসে রাগ ভাঙিয়েছে, পায়ে ধরেছে। এখন তো আমরা বুড়োবুড়ি, তবে সাধনায় আছি। শিষ্যসেবক অনেক। গোঁসাই যায় শিষ্যদের বাড়ি। আমি যেতে পারিনে, কোমরে বাত, তা ছাড়া এই আশ্রমের দেখাশোনা কে করবে?’

আশ্রমটা বেশ বড় করেই ফেঁদেছে এরা। প্রশস্ত উঠোনের চারপাশে আট-দশখানা ঘর। গোরু আছে তিনটে। হলস্টিন গাই। তার জন্য খড়ের আয়োজন। একপাশে ধানের মরাই। উঠোনে গাঁয়ের বোষ্টম ভক্তরা দিনান্তে সন্ধ্যাকীর্তন গাইছে। বাড়ির কাজকর্ম করছে জনাকয় শিষ্যসেবক, বউ-ঝি। হরিপদ গর্বিত গলায় বলেন, ‘আমি বরিশালের মানুষ, এসে পড়েছি নবাসনে। এখানে একবার গান করতে এসে বাঁধা পড়ে গেছি। গাঁয়ের লোকজনই আশ্রমের জমি দিয়েছে। বেটারা সব সন্ধেবেলা তাড়ি খেয়ে পড়ে থাকত, নইলে ঝগড়া কাজিয়া করত। এখন সায়ংসন্ধ্যা নামগান করে। দু’-চারজন বাউল গান গায়। আমাকে বলে বাবা, নির্মলাকে মা।’

‘প্যারিস থেকে যারা আসে তারা কী বলে?’ আমি জানতে চাই।

‘তারাও বাবা বলে, মা বলে, এই দেখুন ফোটো।’ দেখলাম দুই স্বর্ণকেশী ফরাসিনী হরিপদ-র গালে গাল ঠেকিয়ে ছবি তুলেছে। ‘মিশেল আর জেনিপা… আমাদের দুই মেয়ে।’

নির্মলা বলেন, ‘জেনিপা বেশি দুষ্ট… মিশেল খুব শান্ত।’

পৃথিবীতে যত আশ্চর্য জিনিস দেখেছি তার মধ্যে একটা হল হরিপদ-নির্মলার ফরাসি সন্তানদের আলেখ্য। ওরা যোগ শিখতে আসে। হরিপদ বলেন, ‘ওদের খুব সাদা সহজ ভাববেন না। আমাকে ওরা টেস্ট করে তবে বাবা বলে মেনেছে।’

—তাই নাকি? কী রকম?

প্রথমবার যেবার প্যারিসে যাই, তিরিশ বছর আগে, তখন যোগ শেখাতে যেতাম। একদল ছেলেমেয়ে যোগ শিখত, তা ধরুন জন পনেরো। খুব দুষ্ট। একদিন গাড়ি করে নিয়ে যাচ্ছে আমাকে। তিনটে গাড়ি। হঠাৎ একটা নদী দেখে বলে স্নান করবে। সবাই হুড়মুড় করে নেমে পড়ল। সবাই জামাকাপড় খুলে ফেলল। বুঝুন কাণ্ড। একেবারে বেবাক নাঙ্গা। আমাকেই নিয়ে নিল সঙ্গে। জাপটে ধরল জলের মধ্যে। আমি কুম্ভক করে থাকলাম। দেখেশুনে ওরা হার মেনে বলল, ‘বাবা তুমি কঠিন লোক।’ আমি বললাম, ‘আমি যে সাধক।’

হরিপদ শুধু সাধক নয়, তাত্ত্বিক ও যোগী, চিত্রকরও। ছোটখাটো টোটকা চিকিৎসাতেও যশ আছে। তবে সব অর্থে দরদি বাউলপ্রেমিক, তাদের অভিভাবকও বটে। বিপদে আপদে বাউলদের পাশে দাঁড়ান, টাকা পয়সা দেন। মা নির্মলা বললেন, ‘বাউলদের মধ্যে বড্ড ব্যাধি বাবা। সংযম নেই। ইতরপনা বেশি। পুরুষের রোগ এসে যায় মেয়েদের মধ্যে। তখন এই নির্মলা মা ভরসা। গোঁসাই চিকিৎসা করেন আর আমি করি সেবা। ভাল কথা, আপনাকে একটা মজার জিনিস দেখাই।’

নির্মলা দ্রুত ঘরে ঢোকেন। না জানি আরও কী দেখাবেন। সিডি দিয়ে শুরু হয়েছে, ফরাসি শিষ্যশিষ্যাদের ফোটো দেখেছি। এবারে নির্মলা এলেন একতাড়া কাগজ নিয়ে। তাতে রয়েছে অপটু সই কিংবা নিরক্ষরের টিপছাপ, ওপরে মুচলেকা।

‘এসব কী জানেন?’ নির্মলা বিশদ করে বোঝেন, ‘এসব হল ব্যভিচারী ভণ্ড কিংবা বজ্জাত বাউলদের মুচলেকা। সাধনার নামে যারা মেয়েদের নষ্ট করে। এখানে এনে আমি তাদের নাকে খৎ দেওয়াই আর মুচলেকা লিখে নিই। নির্মলা মা-কে সবাই ভয় করে বুঝলেন।’

নির্মলা মা এককালে নাকি খুব ভাল গাইত আর নাচত। তার নাচে প্যারিস মজেছে এককালে। সিডির কভারে নির্মলার যে গানরত চেহারার রঙিন ফোটো রয়েছে তার সঙ্গে এখনকার চেহারার মিল পাওয়া শক্ত। এবারে তাই নাচ নয়, শুধু গান শুনলাম। আশ্রম থেকে বিদায় নেবার সময় নির্মলাকে মনে হল বটগাছের মতো। চারদিকে ডালপালা মেলে তৈরি করেছে স্বস্তি ও সান্ত্বনার একটা আশ্রয় ও আত্মতা। তার সন্তানকুল দেশেবিদেশে ছড়ানো। চলে আসবার আগে বললেন, ‘রামনবমীতে বসে সোনামুখির উৎসব আর বাউল মেলা। তিনদিন পর এটা ভেঙে এখানে নবাসনে চলে আসে সব বাউল। তখন আসবেন। ভালমন্দ সবরকম বাউল দেখাব। তাদের সেবাদাসীদের দেখবেন।’

পরে নির্মলা মা-র সূত্রে খবর পাই গৌরবাবার। সিউড়ি থেকে মহম্মদবাজার হয়ে তার আস্তানায় যেতে হয়। একদিন সকালে সঙ্গীসাথিদের নিয়ে চলে গেলাম। গরিব গ্রাম, বিশেষত্বহীন, চাষিদের বাস। খোঁজ নিয়ে গৌরবাবাকে পাওয়া গেল তার ঘরে। সবাই বলল এটা একটা সৌভাগ্য, কারণ গৌরবাবা বড্ড ঠাঁইনাড়া স্বভাবের।

‘আসুন আসুন’—গৌরবাবার আহ্বান বড় আন্তরিক, কিন্তু চেহারাটার সঙ্গে বাবা কথাটা মেলে না। বড়জোর পঁয়ত্রিশ বয়স। সুঠাম সুগঠিত শরীর, বলশালী। কাঁচা দাড়িগোঁফ, বাবরি চুল। খালি গায় সাদা খাটো অধোবাস। মুখে প্রত্যয়ের হাসি। এবারে দেখা গেল তার সাধনসঙ্গিনীকে। গৌরবাবার মাথায় মাথায় চেহারা, খাড়া পিনদ্ধ শরীর। সাদা সস্তা জামা আর থান পরনে। চোখেমুখে সাধিকাভাব একেবারে নেই। গাঁয়ের নিচুঘরের নিরক্ষর মেয়ে। ডাঁটো চেহারার খাটুয়ে দেহ। গৌরবাবা একে নির্ঘাত সাধনার জন্য এনেছে। এ গান বাজনা জানে না, ভাবভঙ্গিও তেমন মোহিনীমার্কা নয়। চোখের কোণে বিদ্যুৎ নেই। হাসিটা সরল।

গৌরবাবার দাওয়ায় বসেছিল জনচারেক মানুষ মুগ্ধ দৃষ্টিতে। গৌর বললেন, ‘এদের বাড়ি হল আপনাদের নদে জেলার তামাঘাটায়। নাম শুনেছেন? এরা আমার ভক্ত শিষ্য। আমাকে নিতে এসেছে দল বেঁধে। তামাঘাটা চেনেন? সেই ধর্মদা পেরিয়ে, নদী পার হয়ে। এই সুবল রমেশ তোমরা তামাঘাটার গল্প বলো বাবুকে।’

—হ্যাঁ গল্পই বটে। বাবু তামাঘাটা খুব অধম জায়গা ছিল। গরিবদের গ্রাম। কোনওরকমে কৃষিকার্য করে চলত। ফসল ভাল হয় না ওদিকে, জমির স্বভাব খারাপ। তো আমাদের বাপ পিতেমো সহায় সম্পত্তি বিশেষ করতে পারেনি, হাতের কাজও কেউ জানত না, তাই গরিবানা ঘোচেনি, লেখাপড়া শেখেনি, দিগরে একটা প্রাইমারি বিদ্যালয়ও ছিল না।

সুবল এই পর্যন্ত বলার পর রমেশ বলতে লাগল, ‘এবারে ধরুন সেই সেবার নকশাল আমলে নবদ্বীপে খুব কাটাকাটি খুনজখম হচ্ছিল। নবদ্বীপের বসাক পরিবার ছিল বাস্তুহারা তাঁতি। তাদের ছিল পঞ্চাশটা তাঁত। প্রচুর টাকাপয়সা করেছিল। নকশালরা তাদের নোটিস দিল, চাইল দু’লাখ টাকা। বলতে পারেন একরকম প্রাণের ভয়ে বা তাঁত বাঁচাতে বসাকরা চলে আসেন তামাঘাটায়, দুটো পরিবার। তখন আমরা সবে জন্মেছি।’

—তামাঘাটা কেন?

—কেউ তাদের বুদ্ধি দিয়েছিল। অসার জায়গা, দুর্গম আর মানুষজন কম। তা ধর্মদা থেকে দু’ ক্রোশ হেঁটে নদী, সেই নদী পেরিয়ে জলা জমি ধরে এক ক্রোশ মাঠ ভেঙে তবে তামাঘাটা! বসাকরা গোরুর গাড়িতে তাঁত চড়িয়ে চলে এল নবদ্বীপের বাড়িতে তালা লাগিয়ে। বেশি নয় পাঁচটা তাঁত এনেছিল। ধরুন, তা থেকেই তামাঘাটার ভাগ্য ফিরে গেল। একেবারে গুরুর কৃপা, অলৌকিক।

—তাই নাকি? কী হল?

—তামাঘাটার চাষারা শিখে গেল তাঁতের কাজ। বসাকরা ছিল শিল্পী, ভাল টাঙ্গাইল শাড়ি বানাত। তামাঘাটায় তারা কমপয়সায় মজুর পেয়ে গেল। রমরমা ব্যাবসা। তারপর দেশকালের অবস্থা শান্ত হলে বসাকরা নবদ্বীপ ফিরে গেছে, তাঁত ক’টা বেচে দিয়েছে আমাদের। এখন ধরুন তামাঘাটায় চল্লিশ পঞ্চাশ ঘর আমরা তাঁত বুনি। লোন নিয়ে ঘরে ঘরে তাঁত বসেছে। মহাজনরা দাদন দেয়। বসাকরা আরেকটা কাজ করে গেছে। নিজেরা সায়ংসন্ধ্যা হরিনাম করত, আমাদেরও বোষ্টম বানিয়ে গেছে। তামাঘাটায় এখন চার চারটে সংকীর্তনের দল। আর শাড়ির ব্যাবসা করে খুব সচ্ছল অবস্থা। তাই গ্রামে ইস্কুল বসেছে। তামাঘাটার বুটি শাড়ি আর জামদানির এখন খুব নাম। চাষের বদলে এখন তাঁতি, গলায় কণ্ঠিধারী বোষ্টম।

আত্মগর্বের হাসি হেসে গৌরবাবা বললেন, ‘এখন রমেশরা মাকু চালায় আর দেহতত্ত্বের গান গায় : “অতি সাবধানে ঘুরাই প্রেমের নাটা”। তঁতের বুনন দিয়ে দেহের কথা বলা হচ্ছে গানে। আমারই শিক্ষা।’

‘কিন্তু তোমার বাড়ি বীরভূমের এত ভেতর দিককার গাঁয়ে। তোমাকে এরা পেল কোথায়? হদিশ দিল কে?’— আমি জানতে চাই।

—হ্যাঁ! সেটা এক ঘটনা। রমেশরা বর্ধমানের সমুদ্রগড়ে যায় প্রতি হাটে শাড়ি বেচতে গুরুবারে। সেখানে সুফল জানা আমার শিষ্য। বছর দুই আগে সেবার সুফলের বাড়ি গেছি আমি। রাতে গানের আসরে ওরা এল। তারপরে আলাপ, গুরুবরণ, ক্রমে দীক্ষাশিক্ষা। তামাঘাটায় এখন আমার একচেটিয়া শিষ্যসামন্ত। পঁচিশ ঘর। এই তো সামনের মাসের পুণ্যিমায় ওদের গায়ে অন্নমচ্ছব, চলে আসুন। গান শুনবেন। হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমি তো যাবই। কী তুমিও যাবে তো?

সুবল রমেশরা সমস্বরে বলে উঠল, ‘গুরুমা না গেলে হয়?’

গুরুমা? এতক্ষণে তার নামটা জেনেছি: সাধনাবালা। একে কোথা থেকে জোটালো গৌরবাবা? আমার সঙ্গী উৎপল বলল, ‘আপনাকে পরে বলব।’

সাধনা এক ধামা মুড়ি আর এক কেটলি চা আনল। রমেশরা কাপে ঢেলে চা দিল। বাটি করে মুড়ি। আমাদের সঙ্গে মিষ্টি ছিল এক প্যাকেট, সেটা খোলা হল। গৌরবাবা একমুঠো মুড়ি কপালে ঠেকিয়ে বলল, ‘জয় গুরু।’ সাধনাও বলল, ‘জয় গুরু।’

এবারে গৌরবাবা আর সাধনাকে পাশে বসানো হল, তাদের ফোটো তোলা হবে। তাতে সাধনার ঘোর আপত্তি আর লজ্জা। মনে ভাবলাম, এ তো আর হরিপদ-নির্মলা নয় যে সিডি কভারে রঙিন ফোটোর জন্য একতারা উঁচিয়ে পোজ দেবে। সাধনদাস-মাকি কাজুমির মতো অকুণ্ঠিত স্টেজ পারফরমারও নয়। এ একেবারে গ্রাম্য সাধক— অকুলীন ও জড়তাগ্রস্ত। অবশ্য খুবই আন্তরিক তাদের ব্যবহার। খুবই বিনীত। গৌরবাবা বলেই ফেলল, ‘আমাদের বাড়িতে অন্নসেবা নিতে আপনার কষ্ট হবে। সাধনা ভাল রাঁধতে জানে না। জাতে রুইদাস, যাকে বলে মুচি।’ কথায় বলে, ‘মুচি হয়ে শুচি হয় যদি হরি ভজে।’

হরিভজনের উদার সমন্বয়বাদ দিয়েই মহাপ্রভু সব জাতকে এক করতে চেয়েছিলেন— খানিকটা পেরেছিলেনও। এখন অবশ্য বৈষ্ণব ধর্মে অতটা উদারতা নেই, জাতপাত আছে। উচ্চবর্গ ব্রাহ্মণ কায়স্থরা গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মকে কবজা করেছে। নিম্নবর্গের বৈষ্ণব ভক্ত বলতে বোঝায় সহজিয়া আর জাত-বৈষ্ণব। তামাঘাটায় যে বসাকরা গিয়েছিল তারা সহজিয়া। গৌরবাবা জাত-বৈষ্ণব, তবে এখন বাউলপথে আছে। সাধনাবালা হয়তো রুইদাসী বোষ্টম বা চামার বোষ্টম। সত্যিই সে রান্নাবান্নার রকমসকম তেমন জানে না, বরং দেহতত্ত্বের করণকারণ অনেকটা জানে, সেইজন্য গৌর ওকে আশ্রয় দিয়েছে।

কে যে কাকে আশ্রয় দিয়েছে বলা কঠিন অবশ্য, বিশেষত নিম্নবর্গের গৌণধর্মে। নামাশ্রয়ের পর গুরু দেন মন্ত্রাশয়। শিষ্য সবশেষে পায় রূপাশয়ের সাধনপন্থা, যাকে বলে ‘দমের কাজ’ অর্থাৎ দেহগত সাধনা। তাকে কামে থেকে হতে হয় নিষ্কামী, বিন্দুসাধনের কঠিন ব্রতে লাগে ‘রূপ’ মানে নারী। যে সে নারী নয়, লক্ষণযুক্ত, শান্ত ও প্রেমময়ী। সাধনাবালা নিশ্চয়ই সে ব্যাপারে নির্ভরযোগ্য। গৌরবাবা তাকে সামাজিক আশ্রয় দিয়েছে না সাধনাবালার কাছে অনুগত হয়ে আছে সে রূপাশ্রয়ের তাগিদে, কে জানে?

চা-মুড়ি খেয়ে তামাঘাটার শিষ্যরা গেল গুরুপাটের রান্নাবান্নার আহার্য কিনতে, আমার সঙ্গীরা বার হল গ্রাম পরিক্রমায়। এবারে আমি মুখোমুখি বসলাম বাউল দম্পতির। সাধনা বলল, ‘বসলে চলবে? কাজ আছে না?’

গৌর সাবলীলভাবে তার নারীসঙ্গীর উরুতে থাপ্পড় মেরে বলল, ‘আরে বোসসা বোসো। জানেন বাবু এত ভালবেসেও এই মেয়েটার মন পেলাম না। সর্বদা পালাই পালাই করছে। দাঁড়ে বসে না মোটে। অথচ ওকে দেখে আগের শক্তিটা চলে গেল।’

সাধনা বলল, ‘চলে গেল কেন? আমি কি তাড়িয়েছি?’

‘ওইটেই তো গোলমাল। তোমরা পরস্পরকে ভাবলে সতীন। আরে ওসব সতীন টতীন সংসার-ধর্মে হয়, বাউলের আবার সংসার কোথায়? তোমরা হলে আমাদের শক্তি। আমার তো ইচ্ছে যে তিনজন শক্তি নিয়ে সাধনা করে সিদ্ধ হব।’

এ যে একেবারে অন্য জগতের সংলাপ! ভাবলাম গোপ্য সাধনার গভীর নির্জন পথে আমি অনেকটাই গেছি কিন্তু তার নানা বাঁক তো দেখিনি। এখানে যেমন এসে পড়েছি একেবারে নিম্নবর্ণের বাউলসাধনার জাদুবাস্তবে। গৌরবাবা হরিপদ গোঁসাইয়ের মতো প্যারিস যায় না, তার কাছে আসে না মিশেল বা জেনিপা। সাধনদাসের কাছে মাকি এসেছে জাপান থেকে সেটা এখানে অকল্পনীয়। কিন্তু গৌরবাবাই কি কম চমকপ্রদ? রূপাশ্রয়ের সংকল্প নিয়ে নিম্নবর্ণ থেকে টেনে আনছে কায়াসাধনার সঙ্গিনী। মানুষটা তার সাধনপথের জন্য কি খুব স্বার্থপর? তিনজন সঙ্গিনী চাই তার অথচ তারা তিনজন থাকবে মিলেমিশে? তাদের মধ্যে কলহবিবাদ হবে না? তারা তো সাধিকা নয় কেউ, পুরুষের সাধনার নিমিত্তমাত্র, কিন্তু তারা কি মনহীন যন্ত্র? কেন তারা পরস্পরকে সইবে?

গৌরবাবাকে বললাম, ‘তিনজন শক্তি নিয়ে সাধনা করা যায়? তন্ত্রে শুনেছি চক্ৰসাধনায় বসে সাধক ও সাধিকারা। বাউলমতেও এমন আছে?’

—আছে। আমার তো তবু তিনশক্তির সাধনা। আমার গুরু করেছিলেন এগারোজন নারী নিয়ে সাধনা। সিদ্ধ হয়েছিলেন। আর আমি অধম, একজনকেই বশ করতে পারলাম কই?

এতক্ষণ পরে আত্মগর্বী লৌকিক সাধকের আননে ফুটে উঠল স্নান অসহায়তা। কায়াবাদী সাধনপথে প্রকৃতিশক্তির এমন জোর আগে দেখিনি। হীন বংশে জন্ম কিন্তু যৌবনগরবে দৃপ্ত সাধনাবালার সাধারণ বেশবাস আর কৃষ্ণকান্ত চেহারায় ফুটে আছে চমৎকার নির্লিপ্ত না কি বিজয়িনীর অভিমান? গৌর বলে, ‘ক’মাস ধরে কেবলই শাসানি দেচ্ছে “চলে যাব চলে যাব।” কেন গো চলে যাবে? থাকো না।’

সাধনা অবহেলে বলল, ‘কতদিন আছি বলো তো? চারটে জয়দেব হয়ে গেছে।’

এবারে আমার চমকের পালা। বছর গোনার এমন ভাষা আমার জানা ছিল না। জয়দেব কেঁদুলির পৌষ সংক্রান্তির মেলায় একত্রে যাওয়া এদের বছরের একক। সেই হিসেবে গৌর আর সাধনাবালা চার বছরের জুটি। এবার তাতে ভাঙন লেগেছে। কিন্তু কেন চলে যাবে? গৌর বলল, ‘সেটা ওকেই জিজ্ঞেস করুন বাবু। আমি দেখি একটু ওধার পানে যাই।’

জীবনের এক অবিশ্বাস্য কিংবা অপূর্বকল্পিত এই অভিজ্ঞতা সন্দেহ কি? আমার মতো একজন নাগরিক বুদ্ধিজীবী বসে আছি নিম্নবর্ণের রুইদাসীর সামনে। তার জীবন আর আমার জীবন একেবারে আলাদা, সমান্তরাল রেখা যেন, কোনওদিন মিলতে পারে না। প্রায়ান্ধকার মাটির দাওয়া, ওপরে খড়ের ছাউনি, দরিদ্র বাউলের আস্তানা। সাধনাবালা বসে আছে লজ্জানত মুখে। বললাম, ‘কেন থাকবে না তুমি? মানুষটা কি খারাপ? অত্যাচার করে?’

মুখর প্রতিবাদে মাথা ঝাঁকিয়ে সেই নারী বলল, ‘না না। মানুষটা খুব ভাল। বড় দরদি। ভালবাসার কাঙাল। কিন্তু ও আমাকে কোনওদিন সন্তান দেবে না, খুব নিষ্ঠুর। তাতে নাকি ওর ভজন সাধন নষ্ট হয়ে যাবে।’

আশ্রম থেকে দিনান্তে সিউড়ি ফেরার পথে উৎপলের কাছে জেনেছিলাম সাধনাবালার কাহিনি। বক্রেশ্বরে ট্যুরিস্ট লজের আশেপাশে ছিল সাধনার ঘর। তার কেউ নেই। লজের পাশে অন্ধকার বালিয়াড়িতে কুপি জ্বেলে সে খদ্দের ধরত। গৌর তাকে উদ্ধার করে এনেছে। সেই পথবেশ্যা হয়েছে তামাঘাটার গুরুমা। তবু মন ভরেনি। সন্তানবতী হয়ে ভরন্ত জীবনের স্বপ্ন এখন তার চোখে। কিন্তু তা পূরণ হবার নয়।

গৌরবাবাকে শেষ দেখি পরের বছরে। পোস্টকার্ড পাঠিয়েছিল, সমুদ্রগড়ে সে গণেশ প্রামাণিকের বাড়ি আসছে একটা দিবসী উৎসবে। বাউলগানের আসর বসবে। টেপরেকর্ডার নিয়ে গেলে অনেক গান তুলতে পাব। গেলাম বেলাবেলি। শিষ্যবাড়ির দোতলায় বসে আছে গৌর— প্রসন্ন চোখ, হাসি মুখ। বললাম, ‘সাধনা তোমার কাছে আছে এখনো, তাকে তো দেখছিনে।’

—ওই তো ওই কোণে বসে আছে, মেয়েদের মধ্যে। শিষ্যবাড়ির মেয়ে বউদের মধ্যে বসে আছে সাধনা। চোখাচোখি হল, ম্লান হাসল। তার কোলে একটা দু’-তিন বছরের ডাগর ছেলে, জাপটে ধরে আছে তৃষিত বুকের মধ্যে। না, এ তার নিজের সন্তান নয়, শিষ্যবাড়িরই কারুর সন্তান। গৌরবাবা তাকে সন্তান দিলে বাউলধর্মে পতন ঘটবে। আর সে যদি গৌরকে ছেড়ে সত্যিই চলে যায়? কোথায় যাবে? সেই বক্রেশ্বরে কুপি ধরে খদ্দের খোঁজার জীবন না আরেক বাউলের সাধনপথের উপচার হওয়া?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *