সূর্য আর শিশির
বাংলার বাউলদের নিয়ে প্রথম সদর্থক রচনা ও অনুকুল মত-মন্তব্য পাওয়া গিয়েছিল রবীন্দ্রনাথের লেখায়। তাঁর মন একই সঙ্গে দেশজ প্রসঙ্গ আর আন্তর্জাতিক সংরাগে সাড়া দিতে পারত। রবীন্দ্রনাথ তাঁর গানের নিজস্ব নির্মাণে তথা বন্দিশে ভারতীয় রাগ সংগীত ও প্রতীচীর গানের ধারার সঙ্গে আনুপাতিক মিশ্রণ ঘটিয়েছিলেন লোকগান ও দেশজ কীর্তনের। তাঁর বিশিষ্ট মনের গঠনে একাধিক উপাদান মিশেছিল। তাই বিশ্ববোধের সঙ্গে লোকায়নের সহবাস তাঁর চৈতন্যে ছিল নিতান্ত স্বাভাবিক। আপন হতে বাহির হয়ে বাইরে দাঁড়ানো ছিল তাঁর ঘোষিত অনুজ্ঞা, কেননা বিশ্বাস ছিল একমাত্র তাতেই বুকের মধ্যে। বিশ্বলোকের জাগবে সাড়া—অথচ আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে সৃষ্টি করার আততি ছিল প্রবল। সারা জীবনের যে-ধ্রুবপদ বাঁধতে চেয়েছিলেন, বিশ্বতানের ছন্দে তার মধ্যে একতারার মান্যতাও ছিল সুসংগতভাবে। তাই আপন প্রতিভার বিপুল কিরণে ভুবন আলোকিত করার পরেও তাঁর মন স্পর্শ করতে চাইত শিশিরবিন্দুর অন্তর্গত আকুতিকে। এই দিক থেকে ভাবলে স্পষ্টতর হবে তাঁর আন্তর সত্য, যা মালা হতে খসে পড়া ফুলের একটি দল-এ লগ্ন হতে চাইত কিংবা ধূলিতে অবলীন ভ্রষ্ট ফুলের ধন্যতাকে বুঝতে চাইত। সেই সত্যবোধ আমাদের জানাতে চেয়েছিল, যার জন্ম ধূলিতলে তার অন্তর হতে পারে। নিরঞ্জন অকলঙ্ক। জেনেছিলেন যেখানে থাকে সবার অধম দীনের থেকেও দীন সেইখানেই ঘটে প্রার্থিতের পদপাত।
তা হলে আশ্চর্যের কী আছে যখন দেখি নিরুপাধি অমানী বাউলদের তিনিই প্রথম শ্রদ্ধা। আর ভালবাসার সঙ্গে হাজির করলেন বিশ্বমঞ্চে? বাউলদের অন্তরতম সত্যের অনুভব তাঁকে এতটাই উদ্বেল করেছিল যে তাদের রচনা সংগ্রহ ও প্রকাশে তিনি হয়েছিলেন কুণ্ঠাহীন। ঐতিহ্যের পথে চলমান এই মুক্ত সাধকদের চর্যা আর তাঁর সত্যানুসন্ধান মিশে গিয়েছিল এক বিন্দুতে। তারপরে নানা রূপান্তরের বাঁকে রবীন্দ্রজীবন ও রচনাবলি এগিয়ে গেছে বিচিত্রগামিতার সাগর সংগমে। কিন্তু তাঁর প্রদর্শিত দিশা নিয়ে বাউলদের জীবন ও গানকে পরবর্তী প্রজন্ম যে যথাযথ মান ও মর্যাদায় সম্পূর্ণভাবে উদ্ঘাটন বা বিশ্লেষণ করতে পেরেছেন তা মনে হয় না।
উদ্ঘাটন ও বিশ্লেষণের এই অক্ষমতার কারণ কি? সবচেয়ে বড় কারণ বাউলদের সঙ্গে ‘ভদ্রলোক’দের অপরিচয় ও অবস্থানগত লক্ষযোজন ফাঁক। গ্রামিক জীবনের সঙ্গে স্বাভাবিক মুক্ত ছন্দে গাঁথা বাউল ফকিরদের স্বরূপ ও অন্তৰ্জীবন ভদ্ৰশ্রেণির নাগরিক অনুসন্ধানের সূত্রে কীভাবে সঠিক উন্মোচিত হতে পারে? তা ছাড়া তারা তো স্বভাবত ও আচরণগতভাবে সমাজে একটা সূক্ষ্ম আড়াল রচনা করতে চায়। চেষ্টিত অন্তরাল সৃষ্টি করে যুগল সাধনায় গড়ে তোলে এক রহস্যময় ও গোপ্য কায়াবিশ্ব। রবীন্দ্রনাথকে এই জায়গায় এসে আধুনিক জিজ্ঞাসুদের মতো প্রতিহত হতে হয়নি—কারণ তিনি বাউলদের নিয়ে কোনও সরেজমিন সন্ধান করেননি। আধুনিক সমাজবিজ্ঞানের ধারায় বা সমাজ-নৃতত্ত্বের বিদ্যাচর্চার অনুক্রমে তাদের বুঝতে চাননি। তাদের প্রচ্ছন্ন গোষ্ঠীজীবন, একক অথচ সংহত সমাজ, যা একই সঙ্গে মরমি অথচ প্রতিবাদী, তাকে তিনি অনুধাবন করতে পারেননি। বাউলগানকে তাই তাঁর মনে হয়েছিল একক মানুষের আন্তরিক উচ্চারণ বলে।
তাঁর পরবর্তী কালের সন্ধানীদের বীক্ষায় বাউল চর্চা কঠিনতর হয়ে পড়েছে—অর্থাৎ রবীন্দ্রপরবর্তী অনুসন্ধানীদের পক্ষে বাউল গান কোনও ভাবময় উচ্ছ্বাসমাত্র নয়। অনেকটাই তা যাপনগত বাস্তব আর মুক্তমনের নর-নারীর যুগল সাধনাজাত অনুভবের স্ফুরণে ইহবাদী। এ গানে আছে আচরণগত বিশ্বাসের সত্য, যা পরিপার্শ্বের প্রতিকূলতায় টলে না বরং উচ্চবর্ণ ও সাম্প্রদায়িক ধর্মের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করতে পারে। সেইদিক থেকে বাউল ও ফকিররা একক অথচ নিঃসঙ্গ নয়। তার বিশ্বাসের ভিত্তিতে আছে প্রেমানুভূতির অস্মিতা, গুরুর বাক্যে নিষ্ঠা এবং বহুদিনের পরম্পরাজাত পথ। তাদের পথচলা সে তো আজকে নয়, সে আজকে নয়। বেদান্ত, সাংখ্য, তন্ত্র, সিদ্ধযোগী আর সহজিয়াসেবিত সমৃদ্ধ ও নিজস্ব এক লোকপথ তার সামনে মেলা রয়েছে। সেই পথকে যে খুঁজে পায়, তাকে আর সামাজিক সমুন্নতির আড়াআড়ি পথটি খুঁজতে হয় না—তার আকর্ষণ ও কুহক তাকে টানে না। সে হয়ে ওঠে সামাজিকতামুক্ত মানুষ, লজ্জা-ঘৃণা-ভয়ের ঊর্ধ্বে উঠে সে ‘existing order of things’-এর পরিমণ্ডল ভেঙে এগিয়ে চলে অন্তরের পাঠ নিয়ে।
আধুনিক বীক্ষায় লোকায়ত সংস্কৃতি সেইজন্য অনুধাবন করা কঠিন। সেই সংস্কৃতি প্রথমত অন্তর্গুপ্ত ও আত্মময়— কিছুটা বা অস্পষ্ট ও অপরিচিত—গ্রামে গ্রামে সুদূরবর্তী। তারা তো আমাদের কাছে আসবার প্রয়োজন বোধ করে না, তাই আমাদের যেতে হয় তাদের কাছে, সেই অভিযাত্রা আমাদেরই আত্মানুসন্ধানের স্বার্থে, শিকড়ের খোঁজে। গবেষকের তথ্যসন্ধানের চেয়ে মরমির অন্তর্দৃষ্টি তার মূল পাথেয়।
পথিকৃৎ রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ক্ষিতিমোহন, মনসুরউদ্দিন, উপেন্দ্রনাথ বা অন্য সব সংগ্রাহকদের মাত্রার তফাত অনেকটা। বাউল গান হঠাৎই এসে পড়েছিল রবীন্দ্র মানসে, স্বচ্ছ দর্পণের মতো তাঁর সমুৎসুক মনে তা সঙ্গে সঙ্গে ছায়াসন্নিপাত করেছিল। তার অকৃত্রিমতা ও অন্তঃসঞ্চারী ভাবলোক তাঁর চেতনায় অনুরণন তুলেছিল, তিনি তাদের স্বপক্ষে কলম তুলে নিয়েছিলেন। চিহ্নিত করেছিলেন তাদের উচ্চারণের মৌলিকতা। কিন্তু এর পরের ধাপে তিনি যাননি। জানতে চাননি তাদের জীবন পরিবেশ, গুরূপদেশের গূঢ়তা, প্রতিবাদী সত্তার স্বরূপ কিংবা ক্ষুৎকাতর দৈনন্দিনের বার্তা। বাউল গান থেকে চুইয়েপড়া অমৃতলোকের বার্তাতে তাঁর পিপাসার্ত মন ভরেছে। তাঁর পরবর্তী সন্ধানীদের সামনের পথ কিন্তু ছিল উপলকীর্ণ। তাদের পদে পদে প্রতিহত হতে হয়েছে নানা দ্বান্দ্বিক সমস্যায়। কে বাউল, কে বৈষ্ণব, কে সহজিয়া? বাউলপস্থা আর ফকিরিপন্থার তফাত কোনখানে? এইসব মগ্ন অন্তর্দীপ্ত সাধক গানের শব্দসংকেতে যা বলেছেন তার প্রকৃত ‘text’ কী? নানা অঞ্চলে ছড়ানো ছিটোনো বাউল আর ফকিরদের মধ্যে বিশ্বাস আর গানে কি প্রচুর পার্থক্য নেই? বাউল গানের সংগীতিক ছাঁদ বা সুরকাঠামোর আঞ্চলিক পরিমণ্ডল কি বেশ আলাদা নয়? যে যৌন-যৌগিক সাধনা গুরুনির্দেশিত, সেই গুরুতে গুরুতে কতখানি ভেদ আছে, তা বুঝতে গেলে ব্যাপক পরিভ্রমণ জরুরি নয় কি? সবচেয়ে বড় কথা, এই বর্গের গান সহজপ্রাপ্য নয়। যা সহজপ্রাপ্য তাতেও কোথাও কোথাও ভেজাল আছে।
ভেজাল প্রসঙ্গটি গুরুত্বপূর্ণ। একটা সময় ছিল যখন গ্রাম সমাজের প্রান্তিক মানুষরূপে বাউল ফকিররা বেঁচেবর্তে থাকত মাধুকরী করে। নিজেদের আখড়ায় নিজেদের মতে সাধনভজন করত, গান গাইত। গ্রামসমাজ তাদের সমাদরও করত না, ঘৃণাও করত না। তারা কৃষিজীবী ছিল না, জমিজিরেতে তাদের কোনও আগ্রহ ছিল না। তাই কোনওরকম সংঘাত সংগ্রামে তাদের অংশ ছিল না। শান্ত, ভক্তিমান, উচ্চাশাহীন এমন মানুষদের কেই বা শত্রু হবে? কিন্তু পট পালটে গেল গত তিন দশকে। এ বর্গের রহস্যমাখানো গান হঠাৎ হয়ে উঠল ভোগ্যপণ্য, বিশেষত শহরবাসী মধ্যবিত্তদের। তারা এসব গানে খুঁজে পেল সমাজসত্যের দ্যোতনা আর উচ্চবর্গের শোষণ দমনের প্রচ্ছন্ন ইতিহাস। লালন আর দুদ্দু শাহ-র গানে, পাঞ্জু শাহ বা হাসন রজার বাণীময়তায়, রশীদ-জালাল-দীন শরৎ-যাদুবিন্দুর উচ্চারণে খুঁজে পেল মধ্যবিত্ত ভাবনার সঙ্গে সমঞ্জস নানা সারকথা। জাতপাতবিরোধী বাউল গানের টেক্সট রাজনীতিসচেতন মানুষের পক্ষে ব্রহ্মাস্ত্র হয়ে উঠল। ক্রমে এ পথেই ঢুকে গেল সদ্যতনকালের ভেজাল গীতিকার। বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে তারা লালন কিংবা অন্যের ভণিতার আড়ালে চালিয়ে দিল ব্যক্তি বা দলের ফরমান। লালনের নামে বহুপ্রচারিত এমন একটি গান এইরকম :
এমন সমাজ কবে গো সৃজন হবে
সেদিন হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খ্রিস্টান
জাতি গোত্র নাহি রবে।
শোনায়ে লোভের বুলি
নেবে না কাঁধের ঝুলি
ইতর আতরাফ বলি
দূরে ঠেলে না দেবে।
আমীর ফকির হয়ে একঠাঁই
সবার পাওনা খাবে সবাই
আশরাফ বলিয়া রেহাই
ভবে কেউ নাহি পাবে।
ধর্ম কুল গোত্র জাতির
তুলবে না গো কেহ জিগির
কেঁদে বলে লালন ফকির
কে মোরে দেখায়ে দেবে।
লালনের নামের আড়ালে কোনও আধুনিক সাম্যবাদীর স্বপ্নাদ্য রচনা এ-গান তাতে সন্দেহ নেই—উদ্দেশ্যও স্পষ্ট। হিন্দুমুসলমানবৌদ্ধখ্রিস্টান সকলকে নিয়েই গানের শরীর গড়ে উঠেছে, ভাবা হয়নি যে লালনের সময়ে (আঠারো-উনিশ শতকের সন্ধিকালে) জাতিভাবনার এত বিস্তার ছিল না, অন্তত প্রত্যন্ত গ্রামে। মুসলমানের বর্ণভেদ প্রসঙ্গে আশরাফ-আতরাফ বিভাজন লালনের কালে পল্লিগ্রামে থাকা কি সম্ভব? আর আমির ফকির সবাই যে যার পাওনা পাবে এমন সাম্যচিন্তা তো অভিনব, তবে স্বপ্নহিসাবে সুন্দর। লালনের শত শত গান যাঁদের নাড়াচাড়া করবার সুযোগ হয়েছে তাঁরা মানবেন যে এত দুর্বল রচনাশৈলী ও এমন খেলো অন্ত্যমিল (রবে, দেবে, পাবে, দেবে) লালন-গীতির কোথাও থাকতে পারে না। সবচেয়ে কাঁচা কাজ হয়েছে ‘কেঁদে বলে লালন ফকির’ পদটি লেখা। লালন তাঁর কোনও পদে কখনও ‘লালন ফকির’ শব্দটি লেখেননি। তা ছাড়া সিরাজ সাঁইয়ের নাম নেই কেন? এত সব খুঁত বিচারের পরে আরও দুটি তথ্য বিচার্য থাকে। দুই বাংলার কোনও মান্য লালনগীতি সংকলনে এ-গানটি নেই এবং কোনও পরম্পরাগত গানের আসরে সাধক বা প্রখ্যাত গায়ক বাউল-ফকিরের কণ্ঠে গানটি কেউ শোনেননি। তা হলে?
এখনকার গবেষকদের মধ্যে যাঁরা বাউল ফকিরদের আখড়া বা আস্তানায় গিয়ে সরাসরি যোগাযোগ করেন তাদের সঙ্গে, সমাজ-অর্থনীতিগত অবস্থান বুঝতে চান, এমনকী দু’-চার দিন বসবাসও করেন তাদের দরিদ্র জীবনের শরিক হয়ে, তাঁদের বিচিত্র সব অভিজ্ঞতা হয়। অভিজ্ঞতার তারতম্য ঘটে বেশ বড়রকম। দুটি ব্যক্তিক উদাহরণ দিতে পারি। বীরভূমনিবাসী আদিত্য মুখোপাধ্যায় বহুদিন ধরে গ্রামে গ্রামান্তরে ঘুরে বাউল সঙ্গ করেছে, কেঁদুলির মেলাতেও সে সাম্বৎসরিক যাত্রী। তার ব্যক্তিগত ধারণা যে বেশ ক’জন গায়ক-বাউল (অন্তত বীরভূমের) বিদেশি-বিদেশিনীর পাল্লায় পড়ে নষ্ট ভ্রষ্ট হয়ে গেছে। তাদের গানের ভাব এবং কণ্ঠ সম্পদ ম্লান হয়ে যাচ্ছে, তারা গ্রস্ত হয়ে পড়ছে শ্বেতাঙ্গিনীদের দেহগত কামনায় ও অর্থলালসায়। বিদেশ যাত্রার মোহে তারা বিবাহিতা স্ত্রীদের ত্যাগ করছে বা উপেক্ষা করছে। আদিত্য এমনতর অনেক বাউলের নামধাম জানিয়ে শেষমেষ ক্ষোভ প্রকাশ করেছে।
বর্তমানের বাউলরা অবশ্য পূর্ণদাসের সম্মান ও প্রচার-প্রতিপত্তির দৌলতে ভারতীয় সংস্কৃতিকে ক্রমশই বিকিয়ে বেড়াচ্ছেন বিদেশের বাজারে। সাহেব-মেম এবং এদেশীয় শিক্ষিত দালালরা চিবিয়ে যেমন খাচ্ছেন বাউলের মাথাটা, তেমনি একইভাবে ভারতীয় সংস্কৃতিকে দেউলিয়া করে ছাড়ছেন বিদেশের চোখে। গরীব বাউলদের বা গায়কদের দোষ দেব না ততখানি। কারণ ক্ষুধার্তের কাছে ভাতের থালা অনেক মূল্যবান। সুতরাং বাউল হলেও যে মানুষ, তার গাড়ি-বাড়ির লালসা থাকতে দোষ কোথায়?
আদিত্য-র বাউল সমীক্ষার দৃষ্টিকোণের বিরুদ্ধতা করে গবেষক শক্তিনাথ ঝা বলেছেন সম্পূর্ণ উলটো কথা। তাঁর অভিজ্ঞতা ও অবলোকনও উপেক্ষা করা যায় না। তাঁর ধারণা:
বাউলদের জীবনযাপন প্রণালী, মানুষকে আপন করার পদ্ধতি, বাদ্যযন্ত্রগুলি, বেশ, গানের তাল ও পরিবেশন রীতি বিশিষ্ট। এগুলি এক শ্রেণীর বিদেশী শিল্পী ও গবেষকদের আকর্ষণ করে। দরিদ্র বিদেশী পর্যটকরা রাঢ়ের বাউলদের ঘরে অল্প টাকায় থাকে এবং প্রতিদানে নিজেদের দেশে বাউলদের আশ্রয় ও সামান্য উপার্জনের ব্যবস্থা করে দেয়। বাউলদের গানবাজনা শেখেন অনেকে। এগুলি আত্মীকরণ করেন অনেকে। (নীরবতার) এক লোকনাট্যের সন্ধান পান বাউলদের মধ্যে অনেকে।… ভারতীয় অধ্যাত্মসাধনার প্রতীক হিসাবে ওরিয়েন্টালিজমের সূত্রেও এক শ্রেণীর নারী ও পুরুষ বাউলদের প্রতি আকর্ষণ অনুভব করেন।
এবারে শোনা যেতে পারে লিয়াকত আলির অভিজ্ঞতা। সে যে শুধু সন্ধানী বিদেশিনীদের সঙ্গ করেছে তাই নয়, হয়েছে তাদের ভ্রমণসঙ্গী ও বন্ধু। বাউল অনুরাগী বহু বিদেশি যুবতী ও যুবককে সে জানে। তার ভাষ্য হল:
সিরিয়া কায়ারমা মেয়েটি কবি। ভীড় হট্টগোল গান বাজনায় সে উজ্জ্বল অংশ নেয়। সময়ে আবার একেবারে নির্জনে থাকে। বিশ্বনাথ দাস বাউলের বাড়ি তার বন্ধুদের স্থায়ী ঠিকানা। সে ওখানে থাকলেও আবার শুধু আলাদাভাবে একা থাকার জন্য শান্তিনিকেতনে নিয়েছে এক ভাড়াঘর।…বাউলরাও এর ঘরটার কথা জেনে গেছিল। ফলে কেউ না কেউ এসে যেত। চলত গানবাজনা ও ফুর্তি।
সিরিয়া কায়ারমার বিবরণ পড়লে অবশ্য তাকে কোনওভাবে শক্তিনাথ ঝা-কথিত ‘দরিদ্র বিদেশী পর্যটক’ পর্যায়ে ফেলা যায় না। তার অর্থবিত্ত এতটাই যে লিয়াকতকে নিয়ে প্রয়াগ, বৃন্দাবন, হরিদ্বার, হৃষিকেশ, দিল্লি, আগ্রা, ঘুরিয়ে আজমীর শরীফ গেছে। সর্বত্র থেকেছে হোটেলে। লিয়াকত বুঝতে পারে:
সবাই শুধু শুধু ঘুরতে আসে না। যেমন জনির সেক্সোফোনে বাউল গানের সুর বাজানো শিখে নিতে আসা। পিটারও এসেছিল একই উদ্দেশ্যে বেহালা নিয়ে।… বাউলের গুপ্ত সাধনার প্রতি বিদেশিনীদের সেরকম আগ্রহ আছে বলে মনে হয় না। যদি থাকত তবে তারা বাউল গায়কদের পিছু পিছু না ঘুরে সেই গোপন ক্রিয়া জানে বলে যারা খ্যাত সেই বাউল সাধুদের সঙ্গে ঘুরত। কিন্তু কার্যত কোন বিদেশিকেই কোন সাধুকে আশ্রয় করে ঘুরতে বা থাকতে দেখিনি। আসলে তারা গুহ্য সাধনা নয়, গায়ক বাউলদের গান ভাব নৃত্য ও আনন্দমত্ততাকেই ভালবেসেছে। তবে রুচি ও প্রকৃতি অনুযায়ী— এক এক বিদেশিনী এক এক বাউলকে বেছে নেয় মাত্র।
আদিত্য, শক্তিনাথ আর লিয়াকত তিনজনই দক্ষ সংগ্রাহক ও বাউলপ্রেমী— অভিজ্ঞতাও ঈর্ষাজনক। কিন্তু দেখা যাচ্ছে সাম্প্রতিক কালের অর্থাৎ গত কয়েক দশকের বাউল ও বিদেশিনীর প্রসঙ্গ তাঁরা একেকভাবে দেখেছেন। এখনকার বাউল-ফকিরদের নিয়ে তথ্যভিত্তিক সরেজমিন অনুসন্ধানের এটি এমন সংকট যা কখনও প্রাক্তন গবেষকদের ভোগ করতে হয়নি। তার প্রধান কারণ, তাঁদের কালে এত রকম এবং এত বিচিত্র চরিত্রের সন্ধানী ছিলেন না। অভিজ্ঞতার বলয়ও নানা জেলায় বিস্তৃত ছিল না। এখন সারাবছরে বহুরকম মেলা, মচ্ছব, দিবসী বা সাধুগুরু সেবার অনুষ্ঠান হয়। তার হদিশ এবং বহুক্ষেত্রে নিমন্ত্রণ এসে যায় আমাদের কাছে। বাউল ফকিররাই তার হদিশ দেয়। এইভাবে হয়তো সোনামুখি থেকে খয়েরবুনি, সেখান থেকে নবাসন, আমরা একেক আখড়ায় সাধুসঙ্গের উৎসবে হাজির হই। ফাল্গুনে ঘোষপাড়া, চৈত্রে অগ্রদ্বীপ, শেষচৈত্রে পাথরচাপুড়ি, জ্যৈষ্ঠে আড়ংঘাটা এই ক্রমে এসে যায় বাৎসরিক মেলা ও সেই সুবাদে একত্রে থেকে বাউল ফকিরদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার সুযোগে তারা একে একে খুলে ফেলে তাদের নিষেধের বেড়া। নিশীথের নিভৃতে বলতে থাকে নিজেদের কথা, নানা নারীসঙ্গিনীর সঙ্গে সাধনার কথা, এমনকী দুঃখ দারিদ্র্যের কথা, ব্যক্তিগত সমস্যার কথা। কেউ কেউ সংযত থাকে আত্মভাষণে, অনেকে হয়ে ওঠে গদগদভাষী। অনেক লঘুচিত্ত প্রচার-পিয়াসী যুবক বাউল, বেশ বুঝতে পারি, অনেক কথা বলে ফেলে বানিয়ে বানিয়ে। এখন আবার সেইসঙ্গে যুক্ত হয়েছে নারীসাধিকা, বাউল গায়িকা আর পেশাদার নানা গীতিকার। বাউল নয় যারা তারাও এখন বাউল গায়, বাউলতত্ত্ব আওড়ায়।
আরেকটা সমস্যা এই যে, ‘বাউল’ কথাটা এখন হয়ে দাঁড়িয়েছে এক Generic সংজ্ঞা। সবাই আসতে চাইছে বা বিবেচিত হচ্ছে বাউল বলে। যথার্থ বাউল কে, কী তার জীবনাচরণ, তার করণকারণ, কী তার অঙ্গবাস, সে সব কে নির্ণয় করছে? একটু ঘনিষ্ঠ বিচারে হয়তো দেখা যাবে কেউ কর্তাভজা, কেউ পাটুলি স্রোতের সহজিয়া, কেউ জাতবৈষ্ণব, কেউ সাহেবধনী, কেউ মতুয়াপন্থী, কেউ যোগী— কিন্তু সকলেই ঢুকে গেছে বাউলের সর্বজনীন পরিচয়ের গৌরবে— কারণ বাউলদের গ্রহণীয়তা সমাজে আজকাল খুব ব্যাপক। কুষ্টিয়া অঞ্চলের ফকিররা সাদা আলখাল্লা ও তহবন্দ পরে, বাবরি রাখে, কিন্তু নিজেদের বলে বাউল। আবার পশ্চিমবঙ্গের ঝুঁটি বাঁধা গেরুয়াধারীরাও বাউল। শক্তিনাথ ঝা একটু রসান দিয়ে জানিয়েছেন:
শান্তিনিকেতনকেন্দ্রিক বীরভূমে ভদ্রলোক এবং বিদেশীদের কাছে বাউল খুব আকর্ষণীয় ও সম্মানীয় বলে বিবেচিত হয়। তাই এ অঞ্চলে চট্টোপাধ্যায়, মুখোপাধ্যায়, সৈয়দ, অধ্যাপক, শিক্ষক বহুজন বাউল বলে পরিচয় দিয়ে বিদেশী এবং ভদ্রলোকদের চোখে পড়তে চায়। এখানে বাউল হিন্দু এবং বিশিষ্ট সাজে সজ্জিত। মুসলমান গায়কেরা এখানে ফকির।…আর এ অঞ্চলের জাত-বৈষ্ণব গায়কদের ধারণা যে তারাই যথার্থ বাউল। অন্যেরা অন্যায়ভাবে বাউল সাজছে।
তাঁর পরিবেশিত আরেকটা সংবাদ বেশ মজার। লিখছেন,
জনৈক ডোম সম্প্রদায়ভুক্ত বোলপুরের গায়ক জার্মানীতে গান করতে গেলে, সুরীপাড়ানিবাসী বিশ্বনাথ দাসের পুত্র গায়ক আনন্দ দাস মন্তব্য করেন, ‘আমরা তিন চার পুরুষ ধরে আসল বাউল, ওরা হালের সাজা বাউল।’
সাজা বাউল এবং শিক্ষিত শ্রেণির রচিত বাউল গান বাংলায় অবশ্য বহুকাল ধরে আছে। লালনের মতো যথার্থ বাউল যখন জীবিত ছিলেন তখনই কাঙাল হরিনাথ ফিকিরচাঁদি ঢঙে বাউল গান লিখে এক বিশেষ সাংগীতিক মোড়কে সেগুলি সাজিয়ে গাইতেন এবং দল বেঁধে গেয়ে বেড়াতেন বহু জায়গায়। সেই ঐতিহ্য এখনও আছে। বাউল সাধনা করেন না, গানেও তত্ত্ব নেই, অথচ হালকা চালের অনেক গান লিখে বেশ নাম করেছেন এমন অনেক শিক্ষিত মধ্যবিত্তের বাউল গান আমার সংগ্রহে আছে।
কিন্তু এটাও বিশেষভাবে লক্ষ করবার বিষয় যে, সমগ্র পশ্চিমবঙ্গে জেলাওয়ারি সমীক্ষা করলে মোটামুটি কয়েকটি অঞ্চলে বাউলদের স্বাভাবিক বংশানুক্রমিক হালহদিশ মেলে— কোনও কোনও জেলায় বাউল পাওয়া দুর্লভ। যেমন জলপাইগুড়ি, দার্জিলিং, দিনাজপুরের অনেকটা। হাওড়া, দক্ষিণবঙ্গ, হুগলি ও উত্তর চব্বিশ পরগনায় বাউল সাধক প্রায় নেই, কিছু পেশাদার গায়কের সন্ধান মেলে। মেদিনীপুর ও পুরুলিয়ায় যাকে বলে বাউল ঐতিহ্য বা পরম্পরাগত শ্রেণি, তা নেই। বিচ্ছিন্ন কিছু সাধক বা গায়ক রয়েছেন। তবে বাউল সম্মেলনে বা সরকারি বদান্যতার গন্ধ পেলে অনেকে এসে পড়েন। জেলা তথ্য সংস্কৃতি দপ্তরে নিজের নাম পঞ্জিভুক্ত করবার ব্যাপারে তাঁদের উৎসাহ ও সক্রিয়তা দর্শনীয়। পেশাদার ঝুমুরশিল্পী আমাকে বাউল বলে পরিচয় দিতে কুণ্ঠিত হননি। মেদিনীপুরের একজন গণসংগীতশিল্পী তাঁর লেখা বাউল গান আমাকে পাঠিয়েছেন। সে গানগুলি তিনি গেয়ে থাকেন। শ্রোতারাও তারিফ করেন।
বাউল গানের অনুসন্ধানে গিয়ে পুরুলিয়ায় ‘সাধুগান’ নামের একরকম গান পেয়েছি যা ভাবের দিক থেকে শান্তরসাশ্রিত ও নির্বেদমূলক। বাউলগানের কোনও কোনও পর্যায়ের সঙ্গে সাধুগানের বেশ কিছু মিল পাওয়া যায়। দেহতত্ত্ব, সহজসাধনা ও বৈরাগ্য—বাউল গানের এমনতর বিষয়গুলি সাধুগানের উপজীব্য। আসলে বাউল ফকিরদের গানের সীমানা নির্ধারণ কোনওভাবেই প্রশাসনিক জেলাসীমার নিরিখে করা যায় না। বরং অঞ্চল নির্ধারণ সহজতর। যেমন ধরা যাক রাঢ়বঙ্গ। বীরভূম-বর্ধমান-মুর্শিদাবাদ ঘিরে প্রসারিত বাউলদের সবচেয়ে সম্পন্ন অঞ্চল, ফকিরদেরও। পশ্চিম সীমান্ত রাঢ়ের বাঁকুড়া জেলার বহু অঞ্চল বাউলদের বসবাসে সমৃদ্ধ, কিন্তু এ অঞ্চলে আচরণবাদী বা গায়ক ফকির প্রায় নেই। নদিয়া-কুষ্টিয়া-পাবনা-যশোহরে বহুদিনের ঐতিহ্যগত এক বাউলফকির পরম্পরা ছিল, আজও আছে। মুর্শিদাবাদ আর নদিয়ার গ্রামাঞ্চলে হিন্দুমুসলমান সমাজসাম্য বিস্ময়কর রকম সজীব। সরেজমিন সমীক্ষায় দেখা যায়, এই অঞ্চলে হিন্দু মুসলমানের ভাবের লেনদেন খুব বেশি— বাউল ও ফকিরের মর্মমিলন উদাহরণীয়। গানরচনার সজীব ধারা এখানে এখনও বহমান, অতীতদিনের বহু বিখ্যাত গীতিকারও এই ভূমিখণ্ডের সন্তান। সাধক বাউল ও ফকির এখনও নদিয়া-মুর্শিদাবাদে সবচেয়ে বেশি। গায়কদের মধ্যে তত্ত্বজ্ঞদের সংখ্যা এ অঞ্চলে লক্ষণীয়। নদিয়া জেলার ক্ষেত্রে আলাদাভাবে দেখা যাবে, খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত কিছু মানুষ বাউলবিশ্বাসেও স্পন্দিত। তাঁদের গানে অন্য এক সমাজ-সত্যের চেহারা ফুটে ওঠে— জেগে ওঠে উদার ও অনাবিল গ্রাম্য লোকায়তের স্বস্তিকর প্রতিবেশ। মুর্শিদাবাদেই সম্ভবত সবচেয়ে বেশিসংখ্যক বাউলফকির আছেন এবং তাঁদের অস্তিত্বের সংকট সবচেয়ে তীব্র। প্রধানত জনবিন্যাসের কারণে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতার চাপে এ-অঞ্চলের মারফতি ফকিরদের তিন দশক ধরে নির্যাতিত হতে হচ্ছে মৌলবাদীদের হৃদয়হীন অনুশাসনে। নদিয়া বা বীরভূমেও মৌলবাদীদের চাপা অসন্তোষ আছে কিন্তু জনবিন্যাসের কারণেই সম্ভবত তার উৎকট প্রকাশ নেই। উত্তরবঙ্গের চিত্র এ সবের তুলনায় অনেকটা অন্যরকম। মালদহ জেলায় বাউলদের সন্ধান মিলেছে তবে উল্লেখযোগ্য নয়। উত্তরবঙ্গের ব্যাপক জনপদে দেশবিভাগের আগে বাউল ফকিরদের যে চলমানতা ছিল তা এখন বহুলাংশে ক্ষীণ। পাবনা-রংপুর-দিনাজপুর ঘিরে প্রধানত লালনপন্থীদের ব্যাপক বসবাস ছিল। দেশবিভাগের অমোঘ আঘাতে সেই জনপদ এখন বিপন্ন ও বিচ্ছিন্ন। কিন্তু বাস্তুহারা বেশ কিছু সাধক ও গায়ক এ পারে চলে এসে প্রথম কিছুদিন নীরব ও বিভ্রান্ত ছিলেন। দিনাজপুর, রায়গঞ্জ, কোচবিহার প্রভৃতি অঞ্চলে এ বর্গের গান ও গায়কসমাজ কোনওদিন ছিল না, ফলে গড়ে উঠেনি বাউল গানের মরমি শ্রোতৃসমাজ। তারপর গত দুই দশকের নিরন্তর প্রয়াসে এখন উত্তরবঙ্গেও পাওয়া যাচ্ছে প্রচুর গীতিকার ও গায়ক এবং সারারাত ধরে গান শোনার বিপুল শ্রোতার সমাবেশ। লক্ষ করা যায়, উত্তরবঙ্গের বাউলবর্গের গান মূলত বিচারমূলক তত্ত্বগর্ভ। হালকা গান বা বাজনা-গানের শিল্পী সেখানে দুর্লভ। চটকদারি পরিবেশনরীতি বা উৎকট বেশবাস সেখানে প্রচলিত নেই। গানের পরিবেশ অনেকটা শুদ্ধ ও শান্ত, ভক্তিনম্র। বাউলদের মধ্যে মঞ্চে ওঠার বা বিদেশযাত্রার তেমন কোনও ত্বরা নেই, সুযোগও নেই, তাই নিজেদের মধ্যে লড়াই কম। প্রত্যন্ত জেলাবাসী উপেক্ষিত উত্তরবঙ্গব্যাপী বাউলদের ব্যাপারে এ-দিককার মধ্যবিত্ত গবেষক ও পত্রপত্রিকার উৎসাহ কই? তাঁদের সম্পর্কে তাই কোনও প্রতিবেদন পাওয়া কঠিন।
ফকিরদের সম্পর্কে প্রকৃত আঞ্চলিক অনুসন্ধান সবে শুরু হয়েছে। আজকালকার নানা ধরনের লোকায়ত গানের আসরে আর মেলায় কিছু কিছু ফকিরি গান শোনা যাচ্ছে। গড়ে উঠছে ফকিরি গানের গায়কবাদক। তাদের কখনও বিদেশে নিয়ে যাবার কথা ভাবা হয়নি, কারণ তাদের গ্ল্যামার নেই। প্রধানত ভিক্ষাজীবী কিছু ফকিরকে আমরা দেখতে অভ্যস্ত, গায়কহিসাবে তাদের মান খুব উঁচু নয়। আসরে সাধারণত তারা লালনের গান গায়, কিন্তু তাত্ত্বিক অর্থে ও গায়নরীতিতে লালনগীতি প্রধানত বাউল ঐতিহ্যবাহী, তাই ফকিরি গানের নামে লালনের গান শোনানো বেশ স্ববিরোধী। অথচ রাঢ়বাংলায় বেশ কিছু উচ্চস্তরের ফকির আছেন এবং মৌলিক ভাবনার ফকিরি গান দুষ্প্রাপ্য নয়। সে সব গানের সংগ্রহ কাজ কয়েক বছর হল চলছে। এ ভাবেই পাওয়া গেছে কবু শা-র গান, মহম্মদ শা-র গান এবং দায়েম শা-র গান— তিনজনেই বীরভূম জেলার। সে জেলার পাথরচাপুড়ির দাতা বাবার মেলায় বাংলার বহুরকম ফকির আসেন, গানের আসর বসে। মুর্শিদাবাদ আর নদিয়াতে বেশ ক’জন ফকিরি গানের গায়ক রয়েছেন। ঘুড়িষা-ইসাপুরের গোলাম শাহ গায়করূপে খুব জনপ্রিয়। তিনি নিজেই কবুল করেছেন মাসে কুড়ি-পঁচিশটা প্রোগ্রাম করেন, হাজার পাঁচেক টাকা মাসিক রোজগার— তাতে খুব ভালই চলে যায়। তবে সকল গায়কের এমন সচ্ছলতা নেই। আজকাল মহিলা মুসলিম গায়িকারাও ফকিরি গানে চলে আসছেন পেশাদারি চালে। ফকিরি সাধনা মূলত ভাবের সাধনা, তাতে জপধ্যান জিকিরের কাজ, দমের ক্রিয়াকরণ প্রধান। প্রকৃত ফকিররা তেমন ভ্রমণশীল নন, যে-যার ডেরাতেই ডুবে থাকেন নিবিষ্ট হয়ে। দু’-একজন সাজানো ফকির গায়ক দেখেছি, বিশেষত বর্ধমান জেলায়। পরনে ঝকমকে সিল্কের চুস্ত্ ও শেরওয়ানি, ভেলভেটের জ্যাকেট, মাথায় জরির-কাজ করা বাঁকানো তাজ। গানে অবশ্য কোনও গভীরতা নেই।
বাউল বলতে ‘বীরভূমের বাউল’ শব্দবন্ধটি কিংবদন্তির মতো প্রসিদ্ধ। এই প্রসিদ্ধির একটা বড় কারণ স্থান-মাহাত্ম্য— একদিকে জয়দেব-কেঁদুলির মেলা, আরেকদিকে শান্তিনিকেতনের পৌষমেলা। আরেকটি কারণ ব্যক্তিমাহাত্ম্য— যার মলে নবনীদাস আর তার প্রখ্যাত পুত্র পূর্ণদাস। জয়দেবের পৌষ সংক্রান্তির মেলা, অন্তত আমার অভিজ্ঞতায়, সবচেয়ে বৃহৎ পরিসরের মেলা, যেখানে বহুকাল ধরে বহু বাউল সাধক ও গায়ক সম্প্রদায় আসছেন। এখানে বাউলের আসরে গান শোনেননি এমন মধ্যবিত্ত বাঙালি খুব কম। এমনকী কলকাতা ও অন্যান্য বড় শহর থেকে প্রচুর বাউল রসিক ও ছাত্রছাত্রী জয়দেবে যান— লেখক, শিল্পী, অভিনেতা, বাস্তুকার, অধ্যাপক ও সাংবাদিকদের পক্ষে কেঁদুলি বাৎসরিক মুখবদলের পীঠস্থান। অবাধ গঞ্জিকাসেবন এবং গানের আসরের আকর্ষণ অনেককে টানে ঠিকই কিন্তু খাঁটি বাউল গানের এ এক নির্ভরযোগ্য সত্র। সাহেব-মেমদের মেলায় ইতিউতি দেখা যায়। মধ্যরাতে বাউলের সঙ্গে নৃত্যরতা ঊর্ধ্ববাহু বিদেশিনী দৃশ্যহিসাবে অভিনব সন্দেহ কী! কিন্তু তবু বলবার কথা থাকে কিছু। মনোহরদাস, ত্রিভঙ্গ খ্যাপা, নিতাই খ্যাপা, রাধেশ্যাম থেকে এমন কোন বাউল বা প্রসিদ্ধ সাধক ছিলেন যাঁরা কেঁদুলি আসেননি! নবনীদাস বাউলও এখানে আসতেন। বহুদিন এখানে থেকে প্রয়াত হয়েছেন সুধীরবাবা। এখনও স্থায়ীভাবে থাকেন অনেকে। কেঁদুলির সুনাম এতটাই পরিব্যাপ্ত যে, সারা ভারতের বহুতর উপাসক সম্প্রদায়ের সাধক এখানে এসে ধন্য হন। বাংলার বাউলের প্রচার, প্রসার ও প্রতিষ্ঠাভূমি হিসাবে কেঁদুলি সবচেয়ে সজীব কেন্দ্র। ঘটনাচক্রে রবীন্দ্র পরিমণ্ডল ও শান্তিনিকেতন কেঁদুলির অনতিদূরে। প্রসিদ্ধির সেটাও একটা উৎস।
রবীন্দ্রনাথ সম্ভবত কখনও জয়দেব-কেঁদুলি যাননি, কিন্তু ক্ষিতিমোহন, প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়, নন্দলাল বসু, রামকিঙ্কর ও শান্তিদেব ছিলেন বহুবারের যাত্রী। সেকালে বাস ছিল না, তাঁরা গোরুর গাড়িতে যেতেন। বীরভূমের বাউলদের প্রসিদ্ধি অর্জনে রবীন্দ্র পরিকরদের উৎসাহ-উদ্দীপনা বড় ভূমিকা নিয়েছে। বরাবরই শান্তিনিকেতনের আশ্রমে বাউলৱা হন স্বাগত। সেই নবনীদাসের আমল থেকে শান্তিনিকেতনের গুণী আশ্রমিকবৃন্দ আর গুণগ্রাহী ছাত্রছাত্রীরা বাউলদের পরিপোষণ করেছেন। কলাভবনের অধ্যাপক ও ছাত্রছাত্রীরা এঁকেছেন প্রচুর বাউল প্রতিকৃতি। বাংলার বাউলদের আজকের যে-প্রবল জনাদর তার মূলে অনেক কারণ আছে— অন্যতম একটি কারণ বঙ্গীয় শিল্পীদের আঁকা গত আট দশকব্যাপী বাউল চিত্রকলা। নন্দলাল, রামকিঙ্কর, সত্যেন বন্দ্যোপাধ্যায়, সুধীর খাস্তগীর, সোমনাথ হোর থেকে কলাভবনের নবীনতম শিল্পী এঁকে চলেছেন বাউলের স্কেচ ও পোর্ট্রেট। কলাভবনের ছাত্র বীরভূমের প্যাটেলনগরের পঙ্কজ বন্দ্যোপাধ্যায় সারাজীবন ধরে শত শত বাউল চিত্র এঁকেছেন, যাতে বাউলজীবনের বিচিত্র রূপাবলি ধরা আছে। আকাশের দিকে একতারা তুলে ধরে বিচিত্ৰবেশী নৃত্যপর ভাবোন্মাদ এই গায়ক সম্প্রদায় আমাদের রূপের তাপসদের কতটা উদ্বেল করেছে তার বিন্যস্ত দৃশ্যকল্প বিশ্বভারতীকেন্দ্রিক শিল্পীদের চিত্র রচনায় পাওয়া যায়। বঙ্গ সংস্কৃতিতে ও বাংলাগানে বাউলদের চিরকালীন অবদানের মতো শিল্পীদের আঁকা বাউল চিত্রাবলিও আমাদের ভিসুয়াল ঈসথেটিকসের গৌরবময় অর্জন।
বাউল আর শান্তিনিকেতন এক সুদীর্ঘ যুগলবন্দী এবং তার সূচনা রবীন্দ্রনাথ থেকে। বোলপুরের আশেপাশে বাউলদের পাড়া আছে। নবনীদাস প্রায়ই আসতেন গুরুদেবকে গান শোনাতে, কিছুদিন সেখানে বসবাসও করেছিলেন, কিন্তু কোথাও স্থিতু হওয়া তাঁর স্বভাবে ছিল না। তাঁর সময় থেকে শান্তিনিকেতনের কলাভবন আর সংগীত ভবনে আজও বাউলরা আসেন অধ্যাপক ও ছাত্রছাত্রীদের গান শোনাতে— স্থানটি তাঁদের প্রিয়, কারণ রবীন্দ্রনাথ তাঁদের সম্মাননীয়।
রবীন্দ্রনাথের আন্তরিক উৎসাহ ছিল পৌষমেলাকে ঘিরে গড়ে তোলা গ্রামীণ সংস্কৃতির উজ্জীবন। প্রথম থেকেই সেখানে বাউলদের যাতায়াত ছিল। এখন তো সেখানকার বাউলের আসর এলিটিস্টদের সগর্ব উপস্থিতি ও শ্রোতারূপে অংশগ্রহণে খ্যাত ও প্রচলে পরিণত। পৌষমেলার মঞ্চে উঠে গান করতে পারা যে-কোনও বাউলের জীবনের বহুলালিত স্বপ্ন। পৌষমেলাতে এদেশের প্রচার মাধ্যম সবচেয়ে সক্রিয় দেখেছি। ভিডিও ক্যামেরা সর্বদা সচল সেখানে, দূরদর্শনের নানা চ্যানেল কলকাতা তথা বঙ্গবাসীদের সামনে উদ্ঘাটিত করে শান্তিনিকেতনের মঞ্চে বাউলগান ও নাচের রঙ্গ। এতসব ঘটনার যোগফল হল ‘বীরভূমের বাউল’ নামক কিংবদন্তির জন্ম ও বিকাশ।
তার জনপ্রিয়তা বেড়েই চলেছে। কিন্তু সেখানকার গানের আসর পরিচালিত হয় বড়ই অবিন্যস্তভাবে। তবু পৌযমেলার মঞ্চ বাউলদের কাছে কতটা গর্বগৌরবের তা বোঝা যায় সনাতনদাস বাউলের মতো খ্যাতিমান প্রবীণতম শিল্পীর জবানিতে। তিনি স্বীকার করেন শান্তিনিকেতনই তাঁর স্বীকৃতি আর প্রতিষ্ঠার উৎস। সেখানে যাবার আগে সনাতনদাস বাউলকে,
কেউ চিনত না। এটাই তো বড় কথা। শান্তিনিকেতনে তো আমি বাংলা ’৫৮ সালে যাই;
৫৮-৫৯ সালে অ্যাটেণ্ড করি। দু’বছর হেঁটেই গিয়েছিলাম।
শান্তিদেব ঘোষ একবার বঙ্গসংস্কৃতিতে পাঠালেন। বললেন, সনাতন তোমাকে আরও লোক চিনতে পারবে; কলকাতায় যাও, বঙ্গ সংস্কৃতি সম্মেলনে গান করগা। তো সেই পরপর কয়েকবারই বঙ্গ সংস্কৃতিতে আমি যোগদান করি। শান্তিবাবু আমার অনেক সাহায্য করেছেন। একবার বেনারসে পাঠিয়েছিলেন বঙ্গীয় সমাজে। এবং লণ্ডনের থেকে যখন খবর এলো যে, আমরা বাউল সংগীতের দল আনতে চাই— ওই শান্তিনিকেতনেই প্রথম খবর আসে। তো, আপনারাই নির্বাচন করে দেন যে, বাউল গান— সত্যিকার বাউল গান এবং নাচ কে ভালো পারে, এই সেই লোক।
শান্তিনিকেতন থেকে কণিকা ব্যানার্জি, শান্তিদেব ঘোষ এঁরা আমাকে ডাকলেন, যে, খাঁটি বাউল গান গাইতে হবে লণ্ডনে— সনাতন, তুমি পারবে? তা যদি আপনারা যোগাযোগ ঠিকমতো করতে পারেন, আমি যেতে পারি। এটা হল চুরাশি। তার আগে ঘুরে আসে পুণ্য আরও সব লোকজন নিয়ে।
লম্বা উদ্ধৃতি ব্যবহার করলাম এটা বোঝাতে যে এদেশের বাউলের উত্থানে, এমনকী সনাতনদাসের মতো গুণী শিল্পী, সাধক ও পারফরমারকেও অপেক্ষা করতে হয়েছিল শিক্ষিত মধ্যবিত্ত এলিটদের সহায়তা পাবার জন্য। সেই সঙ্গে সংযোগ যথারীতি শান্তিনিকেতনের। তার আগে তাঁকে কেউ চিনত না। প্রথমে শান্তিনিকেতন, সেখান থেকে কলকাতার ভদ্রলোকদের সান্নিধ্য ও সমাদর, অবশেষে লন্ডনের খ্যাতিস্বর্গ! আরোহণের এই ক্রমিক বিন্যাসে গ্রামীণ বাউল গিয়ে পড়েন বিশ্বপরিচিতির বৃহৎ বৃত্তে। বাঁকুড়ার খয়েরবুনি আশ্রমের প্রত্যন্ত অবস্থান তাঁকে কি প্রার্থিত যশ ও ভাগ্য এনে দিত? একেই বলে স্থান-মাহাত্ম্য ও রবীন্দ্রমহিমার সদাব্রত। অথচ অজানা অচেনা এই সনাতনদাস এককালে পায়ে হেঁটে সেখানে পৌঁছেছেন।
কিন্তু অনেকেই তো যেতে পারেননি— নিতান্ত ভৌগোলিক দূরত্বই তার কারণ। আর একটা কারণ লোকায়ত মানুষের সংকুচিত স্বভাব। নইলে উত্তরবঙ্গের বাউল বলহরি দাস তত্ত্বজ্ঞ বা গায়ক হিসাবে কম কীসে? মুর্শিদাবাদ-নদিয়ার প্রচুর ভাল গায়ক আছেন, তাঁদের হয়তো পৌষমেলা যাওয়া হয়ে ওঠেনি কোনওদিন। এখানে একটা কথা বলে রাখা উচিত, এত যে বীরভূমের বাউলের খ্যাতি ও প্রতিপত্তি, তাদের মধ্যে বড় মাপের বাউলতাত্ত্বিক কই? গত দুই দশকে অন্তত আমি তেমন কাউকে দেখিনি— আগে নিতাই খ্যাপা ছিলেন। এখন এই মুহূর্তে আমার দেখা যেসব উচ্চমার্গের বাউল তাত্ত্বিকের কথা মনে পড়ছে, তাদের মধ্যে সনাতনদাসের আদিবাস্তু খুলনা জেলায়, বলহরি দাসের জন্ম কর্ম উত্তরবঙ্গের পাবনায়, আজহার খাঁ ফকিরের বাড়ি নদিয়া জেলার গোরভাঙায়, আর নবাসনের হরিপদ গোঁসাই আদতে বরিশালের মানুষ। তা হলে বীরভূম নিয়ে এত হইচই কেন? তার কারণ মিডিয়ার প্রচার, কেঁদুলির জনসমাবেশের অতিরেক, শান্তিনিকেতনের পূত স্পর্শ। এদেশে একবার কোনও কিছু রটে গেলে তা হয়ে ওঠে চিরস্থায়ী। আমার বিচারে মুর্শিদাবাদ জেলা বাউল ফকিরদের বৈচিত্র্যে, গুরুত্বে এবং চলমানতায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, যাকে বলে ‘living tra-dition’ তার সবচেয়ে উজ্জ্বলন্ত নমুনা, কিন্তু তবু তার খ্যাতি নেই লোকসমাজে বা মধ্যবিত্ত শিক্ষিত মানসে। কারণ জেলাটি কলকাতা থেকে অনেক দূরে, ইসলামি ঐতিহ্যের কারণে হিন্দু এলিটিস্টদের পক্ষে খুব রোচক নয় এবং সেখানকার গায়করা পূর্ণদাসের মতো বিদেশ দাপিয়ে আন্তর্জাতিক জয়জয়কার লাভ করেননি।
গত বেশ কয়েক বছর ধরে সমগ্র পশ্চিমবঙ্গের বাউল ফকিরদের বর্তমান অবস্থা এবং সামগ্রিক অবস্থানের সঠিক খোঁজখবর করতে গিয়ে ঘুরেছি নানা জেলার বহু রকমের জনপদ— শহর ও গ্রাম, নগরতলি। আলাদা করে একাধিকবার প্রবীণ সাধকদের সঙ্গে কথা বলেছি, প্রথমত তাঁদের ডেরায় পরে মেলা মচ্ছবে, তারও পরে শিষ্যের বাড়ি। অভিজ্ঞতায় দেখেছি, অনুসন্ধানী গবেষকদেরও এসব সাধুগুরু নানাভাবে পরীক্ষা করে নিয়ে তবে ভেতরের কথা বলেন, সেই বিচারে আমাকেও যেন অর্জন করতে হয়েছে শিষ্যের মতো গুরু-নির্ভরতা ও প্রশ্নহীন আনুগত্য।
তবে এটা ঠিক যে, তিন চার দশকে সবকিছু খুব পালটে গেছে। সত্তরের দশকে যখন কিছু না জেনে, স্রেফ ব্যক্তিগত কৌতূহলে, উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরতাম গ্রামে গ্রামান্তে, তখন খুঁজে পেয়েছি যে পরিমাণ দরদি গায়ক ও আমগ্ন সাধক তা ক্রমশ কমে এসেছে। গ্রামের একেবারে ভেতরে কোনও গুরুপাটে গুরুপূর্ণিমা বা বৈশাখী পূর্ণিমা বা কোনও দিবসী উপলক্ষে আন্তরিক ভক্তসমাবেশ, শান্ত শুদ্ধ গানের আসর যতটা সহজে ও অন্তর্লগ্ন হয়ে উপভোগ করেছি, এখন সেখানে এসে গেছে জনতা ও কোলাহল। এসে গেছে অদীক্ষিত হঠকারী শ্রোতা আর শব্দদূষণের নিনাদ। আর-একটা উৎপাত হয়েছে গ্রামীণ মেলায় শহুরে মানুষের গাদাগাদি ভিড়। তিন দশকের মধ্যে চোখের সামনে বদলে গেল অগ্রদ্বীপ কিংবা ঘোষপাড়ার সুন্দর সুবিন্যস্ত মেলা। সারাদিন ধরে টু-হুইলার, টেম্পো, ট্রাক, ভ্যান, ম্যাটাডোর আর মোটর চেপে এসে পড়ছে অজস্র বিচিত্র রুচির মানুষ— নারীপুরুষ, এমনকী অর্ধশিক্ষিত গ্রামিক সমাজের লুম্পেনরাও। গানের আসরে বা আখড়ায় চলছে জেনারেটরের কর্ণভেদী আওয়াজ এবং তাকে ছাপিয়ে দুনে চৌদুনে তীব্র তালে সাউন্ড সিসটেমের পারদ উপরে তুলে বাউলের গান চলছে মাইকে। সে গানে কোনও নিবেদন নেই, ভক্তিনম্র চিত্তের প্রশান্তি নেই। আছে একজন গায়কের সঙ্গে আরেকজনের পাল্লাদারি, তবে তা গানের তত্ত্ব নিয়ে নয়, গানের পরিবেশনগত চমৎকৃতি ও লম্ফঝম্ফে।
গান পরিবেশনের এই সর্বাধুনিক জাঁকজমক শ্রোতাদের চাহিদাতেই ঘটেছে। ভাল গায়কও এখন অসহায়। শ্রোতারা গানের ফরমাশ করছে, মঞ্চে উঠে গিয়ে বাউলের জামায় এঁটে দিচ্ছে দশ, পঞ্চাশ এমনকী একশো টাকার নোট। সঙ্গে সঙ্গে আসরের উদ্যোক্তারা কর্ডলেস মাইকে উচ্চ কণ্ঠে ঘোষণা করছেন এই মহান সমঝদারি ও দানের গৌরব বার্তা। যেসব বাউল তত সুকণ্ঠ নন, অথচ ভাবগ্রাহী, গানের তত্ত্বের টানে ভেতর থেকে তুলে আনতে পারেন গহন গভীর অঞ্জলি, তাঁরা এসব উচ্চকিত আসরে কেমন যেন হতভম্ব মূক হয়ে পড়েন। আমার মতো বাউল আসরের বহুদর্শী শ্রোতার মন তখন আকুল হয়ে স্মৃতি হাঁটকায়। মনে পড়ে যায়, হয়তো শেওড়াতলায় অম্বউবাচীর মেলায় উপর্ঝরণ বৃষ্টির মধ্যে সারারাত শুনছি সামিয়েল আর জহরালির পাল্লাদারি গান, তত্ত্বের পর তত্ত্ব আসছে, শ্রোতারা উদ্দীপ্ত, খাড়া হয়ে বসছেন। কিংবা নসরৎপুরে চাঁদনি রাতে জাত-বৈষ্ণবের ভিটেয় সারারাত শুনছি সাধন বাউল আর ইয়ুসুফ ফকিরের গান। নিরাভরণ আসর, আকাশের চাঁদোয়া টাঙানো, খেজুরপাতার ঢালাও তালাই পেতে সমুৎসুক বিশ-পঁচিশজন শ্রোতা। কোনও উচ্চ মঞ্চ নেই, শ্রোতা আর গায়ক একই সমতলে। গানের ভাব শুধু উচ্চ থেকে উচ্চস্তরে উঠে যাচ্ছে। ঊর্ধ্বায়িত হচ্ছে শ্রোতাদের চেতনালোক।