বাউল গানের নানাবর্গ
কয়েক শতাব্দী ধরে বাউল গান লেখা হচ্ছে, তার সবগুলি ছাপার অক্ষরে বেরোয়নি। বেরোনো সম্ভবও নয়, কারণ সারাদেশ ঘুরে এত বড় সম্পদ সংগ্রহ করবে কে? তা ছাড়া খোঁজ করলে দেখা যাবে অনেক বাউল গানের কোনও লিখিত রূপ নেই, রয়ে গেছে নানা বাউলের স্মৃতি ও শ্রুতি পরম্পরায়। সেই কারণে কোনও বাউল গীতি সংকলনই পূর্ণাঙ্গ নয়। বরং কোনও একজন গীতিকারের গান সংগ্রহ করা সহজতর এবং অনেকটা নির্ভরযোগ্য। এইভাবে সংকলিত হয়েছে লালনগীতি, পাঞ্জু শাহের গান, জালালগীতি, দীন শরতের পদ, দুদ্দু শাহ-র পদাবলি, হাসন রজার গান, আর্জান শাহ-র পদ, নসরুদ্দিন ও ফুলবাসউদ্দিনের গান অথচ সংকলিত হয়নি কুবির গোঁসাইয়ের বা যাদুবিন্দুর রচনা, রাধেশ্যাম দাসের অনন্য গীতাবলি।
বাউল গান রচনার ধারা এখনও সজীব। পশ্চিমবঙ্গে নানা পল্লিতে নামা-অনামা ব্যক্তি বাউল গান লিখে চলেছেন, তাঁদের শিষ্যরা সেসব গান গাইছেনও নানা আসরে। সনাতনদাসের মতো শিল্পী নিজের লেখা গান নিজেই গাইছেন। আবার এমনও দেখা যাচ্ছে যে, কিছু কিছু শিক্ষিত ব্যক্তি, মূলত বাউল গানের ভাবে রসে স্নাত হয়ে, গান লিখছেন, জুগিয়ে দিচ্ছেন চেনা বাউলের হাতে, গাইবার জন্য। সেগুলিও ঐতিহ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাচ্ছে।
গত কয়েক বছরে পশ্চিমবাংলার নানা প্রান্তে ঘুরতে ঘুরতে শত শত গান সংগ্রহ করেছি। তার থেকে বেছে, বিচার করে, ২০টি গান এখানে সংকলিত হল। এ গানগুলির অধিকাংশ আনকোরা— কিছু ঐতিহ্যবাহী। গানগুলি নির্বাচনে বিষয়গত বৈচিত্র্য ও প্রকাশগত অভিনবত্বের উপর ঝোঁক পড়েছে। কত আশ্চর্য বিষয় নিয়ে যে এঁরা ভাবছেন, এখানে তার একটা ‘থিমেটিক ভেরিয়েশন’ যাকে ইংরিজিতে বলে, তা পাওয়া যাবে। প্রবীণতম জীবিত বাউল থেকে নবীনতম বাউলের রচনাসম্ভার এখানে বিন্যস্ত হল। বাউল জীবন, বাউল তত্ত্ব, শব্দ গান, উক্তি-প্রত্যুক্তিমুলক রচনা, বাস্তব জীবন সমস্যা, সমাজ পরিবর্তনের সংলাপ, প্রতীচ্যদর্শনের অভিঘাত, বাউল গানের বিকৃতি—এমনতর নানা বিচিত্র ভাবনার তরঙ্গ এসে লেগেছে এসব গানের অন্তস্তলে। পাঠকদের সামনে আধুনিক বাউলের বিচিত্র আত্ম-প্রতিকৃতি হাজির করাই এই সংকলনের লক্ষ্য।
এর বাইরে আরও যে শত শত বাউল গান সংগৃহীত হয়েছে তা ধরা আছে টেপ-এ এবং লিখিত আকারে। ভবিষ্যতে কখনও সেগুলি সংকলিত হতে পারে।
ঐতিহ্যবাহী বাউল গান
অনন্ত দাস
ওগো সুখের ধান ভানা
ধনী এমন ব্যবসা ছেড়ো না—
কর কৃষ্ণ প্রেমের ভানা-কুটা কষ্ট তোমার থাকবে না।
তোমার দেহ-ঢেঁকশালে অনুরাগের ঢেঁকি বসালে
ভজন-সাধন পাড়ুই দুটো দুদিকে দিলে
আবার নিষ্ঠা-আঁসকল লাগালে
চেঁকি চলবে ও যে টলবে না—
ওগো সুখের ধান ভানা।
রাগ ও বৈধী দুজন ভানুনী তাদের নাম কৃষ্ণমোহিনী
তাদের একজন সদ্গোপের মেয়ে একজন তেলেনি
তারা ধান ভানে ভাল জানে ভাল
তাদের গায়ে সোনার গহনা।
ঘরে বৃদ্ধা শ্রদ্ধা সেকেলে গিন্নি
শুদ্ধমতি শুতি কুলো-চালুনি
এবার কামকামনা ঝেড়ে ঝুড়ে
তুষ-কুঁড়ো চেলে নাও না।
রাগ-বিবেকের মুষল আঘাতে
বাসনা-তুষ যাবে ছেড়ে পাড় দিতে দিতে—
চাল উঠবে ঘেঁটে বিকার কেটে
ঠিক যেন মিছরিদানা।
শ্রীগুরু-মহাজনের ধান তাতে হবে রে সাবধান
ষোলআনা বজায় রেখে করবে সমাধান
তুমি লাভালাভে কাল কাটাবে
আসল যেন ভেঙ্গ না।
গোঁসাই বলে অনন্ত তুই ধান ভান্তে জানিস না
ও তোর ঘটবে যন্ত্রণা—
পাপ-ঢেঁকি তোর মাথা নাড়ে গর্তে পড়ে না।
দেখিস যেন বেহুঁশারে হাতে ঢেঁকি ফেলিস না।
পুরনো বাউল তত্ত্বপান
রাধেশ্যাম দাস
দেখলাম এক রমণী প্রেম পাগলিনী আছে জগতে
সে হয়ে উন্মত্ত লয়ে প্রেমতত্ত্ব ফিরছে পথে পথে।
স্বামীর সহ হয়নি শুভমিলন
কেমন করে কী প্রকারে জানবে প্রেম কেমন—
হয় সেই যুবতী গর্ভবতী বিনা পতি সঙ্গমেতে।
ধন্য রমণী কেমনে জানি প্রসব করে তিন সন্তান
দুইটি গৃহবাসী একটি উদাসী করতে পিতার সন্ধান—
সেই রমণী হয়ে জননী মজে পুত্রের প্রেমেতে।
ত্রিজগতের কর্তা যিনি আদি বিধাতা
তিনজনকে তিন কর্ম দিয়ে করলেন তিন কর্তা—
কেউ সৃষ্টিকর্তা কেউ পালনপিতা
কেউ প্রলয়কর্তা শেষেতে।
অজ নামে সন্তান যিনি তিনি সৃষ্টি করে
ক্ষীরোদ সাঁই নামে সন্তান পালন করে সবারে—
অপর সন্তান করেন সমাধান মহাকাল নামেতে।
দাস রাধাশ্যাম বাতুলের মতো কহে সৃষ্টিতত্ত্ব
জীবের অসম্ভব কিন্তু শাস্ত্রসঙ্গত—
আমার যত কিছু প্রকাশিত গুরুর চরণ কৃপাতে।
জগৎ প্রসবিনী যে জননী সেই মহামায়া
হয়েছে প্রেম-পাগলিনী স্বামীর সঙ্গ না পাইয়া।
পরমপুরুষ আদি যিনি তাঁর যে তিন শক্তি
তিন শক্তির মধ্যে প্রধান যে সেই মায়াশক্তি—
তিনি আদ্যাশক্তি ভগবতী।
নামটি অভয়া।
ইচ্ছাময় সেই পরমপুরুষ স্বয়ং ভগবান
তাঁর ইচ্ছাতে প্রসবে মা তাঁর তিনটি সন্তান—
সৃষ্টি স্থিতি প্রলয়ের বিধান
তিনকে দিলেন বিচারিয়া।
ঐ মহাশক্তি রমণীর প্রতি হয় দৈববাণী
তিনের মধ্যে চিনে লহ কে হয় তব স্বামী—
শ্রীজগৎপতি পিতা ও আমি
তুমি দেখ মা ভাবিয়া।
ব্রহ্মা বিষ্ণু শিব তিনকে ডেকে বলেন মা সতী
তিনজনের মধ্যে একজন হও মম পতি—
শিব বলেন মা শক্তি একশো আটবার যদি
ত্যাগ কর মা কায়া।
গোঁসাই গুরুষ্টাদ মহাশক্তিমান সর্বতত্ত্ব অবগত
কৃপা করি জানিয়েছেন তায় মায়েরই তত্ত্ব—
রাধাশ্যাম কয় চাই না অর্থ
মা চাই তব পদছায়া।
অজ্ঞাত রচয়িতার মরমি পদ
ওরে মন জানব তুমি কেমন গড়নদার
কেমন স্বর্ণকার—
ওরে গড়ে দে তুই উপাসনার সোনার অলংকার।
নিষ্ঠা-নিক্তিতে ধরে
সোনা জমা নে ওজন করে
দেনাপাওনা যোলোআনা সূক্ষ্মের উপরে—
ছেড়ে খুঁটিনাটি ময়লা মাটি গলিয়ে খাঁটি কর এবার।
আগে জ্বালো বিবেক-হুতাশন
ষড়রিপু-কয়লা তাতে কর রে ক্ষেপণ—
তাতে সাধুসঙ্গ-সুবাতাস দে
আঁচ হবে তোর চমৎকার।
আমি নিষেধ করে দিতেছি দোহাই
যেন অসৎসঙ্গ-তামাদস্তা খাদ দিও না ভাই—
গলিয়ে আঁচে ভাবের ছাঁচে ঢেলে তারে করবি তার।
সোনা কি অমনি গলে শুধু অনলে
তাতে দে অনুরাগ-সোহাগার ভাগ যতনে ফেলে—
গড়ে দে আমার চমৎকার কৃষ্ণভক্তি-রত্নহার।
ব্রজের ভাব সুনির্মল
তাতে কেটে দে ডায়মল—
গোপী-ভাবের ঝালা দিলে করবে রে ঝলমল।
দিয়ে শুদ্ধরতি গাঁথলে মোতি
হবে অতি সুবাহার।
শব্দ গান
খ্যাপাচাঁদ বাউল
পব বিনে জগতে কে আপন।
পরের জন্য যার প্রাণ কাঁদে
সেই তো জানে পরের মন।
যেমন লোহা-কাঠ সংগ্রহ করি
সমুদ্রেতে ভাসায় তরী
তার কে হয় কার আপন।
তরী একবার ভাসে একবার ডোবে
তবু না ছাড়ে প্রেমের বাঁধন।
যেমন মেয়েরা যায় পরের বাড়ি
পরকে লয় আপন করি
হয় মহামিলন—
তারা একবার হাসে একবার কাঁদে
না ছাড়ে প্রেমের বাঁধন।
খ্যাপা বলে পর আপনার করা
হতে হবে জীয়ন্তে মরা
হয়েছিল চণ্ডীদাস একজন—
তারা একমরণে দুজন ম’ল
এমনি তাদের প্রেমের মিলন।
বাউল তত্ত্বগান
রাধেশ্যাম দাস
তারে দেখতে যদি পাই
চিত্তের অন্ধকার সন্ধ মেটাই।
শুনেছি যা শুনব না তা
বর্তমানে দেখানো চাই।
না দেখে আপন নয়নে
ভজিব বল কেমনে
বর্তমান দেখায় যে জনে
তাহার চরণে বিকাই।
বাহিরে সে অন্ধকারে
চন্দ্র সূর্য হরণ করে
যে মনের আঁধার ঘুচাইতে পারে—
সেই দীক্ষাগুরু গোঁসাই।
ভুলব না আর সোনা বলে
শোনা কথা সবাই বলে
শোনা কথায় তরী খুলে
হাঁটু জলে পাইনে থাই।
বহু মন সাধনার ফলে
গুরুচাদের কৃপা বলে
রাধেশ্যাম কয় দেখতে পেলে
সোনাতে বাসনা নাই।
বাস্তবগন্ধী বাউল গান
অজ্ঞাত
হরি তোমায় ডাকবার আমার
সময় হল কই?
আমি ঐ ভাবনায় সদা রই।
ভোরের বেলা মনে করি করব তোমার স্তব
ক্ষুধার লাগি খোকা উঠে লাগায় কলরব—
আবার ঐ গোলমালে গিন্নি জেগে
তার চাঁদবদনে ফোটায় খই।
মনে করি গঙ্গাজলে করব তোমার স্তুতি
কলসি কাঁখে সারি সারি উদয় যুবতী—
আমি তাদের দেখে তোমায় ভুলে
অমনি আত্মহারা হই।
যখন আমি বসি ভোজনে
একক ক্ৰমে পঞ্চগ্রাস দিই গো বদনে
তখন পাওনাদারের সাড়া পেয়ে
শুক্তানিতে মাখাই দই।
যখন আমি মালা নিয়ে জপেতে বসি
তখন লম্বা হাতে বাজার ফর্দ উদয় প্রেয়সী
ঘরে চাল বাড়ন্ত লক্ষ্মীকান্ত
অমনি মালা ঝোলা সই।
উত্তরবঙ্গের তরজা বাউল গীতি
তরণী সেন মহান্ত
শিষ্যের প্রশ্ন
গুরু তুমি তত্ত্ববেত্তা শুধাই তোমারে
লীলা একি নিত্য দেখি বল গো আমারে।
আগে হল লীলাখেলা পাছে জন্ম তার
দেখে শুনে মাথা ঘোরে কাণ্ড চমৎকার।
আগুন (অঘ্রান) মাসে রাসলীলা হয় ফাগুন মাসে দোল
শ্রাবণ মাসে ঝুলন যাত্রা দেশে কলরোল।
তারপরে ভাদরে জন্মে কৃষ্ণ করে লীলা
তরণী কয় লীলাময়ের এ কীসের অছিলা।
গুরুর উত্তর
মত্ত হয়ে তত্ত্ব কর এ দেহের ভিতরে
লীলা ছেড়ে তত্ত্বে পাবে দেহ অভ্যন্তরে।
জীব মত্ত রয় রাসলীলাতে শেষে খণ্ডরতি
কর্ষণে আনন্দ সত্তা রাসে হয় আহুতি।
দোল অর্থ আবীরের খেলা শেষে ফাগুন মাস
রক্তে মাখা গর্ভের শিশু চার মাসে প্রকাশ।
শ্রাবণ মাসে ন’মাস শিশুর ঝুলনেতে ঝোলা।
মাতৃগর্ভ ঝুলে পড়ে শিশু মারে দোলা।
ভাদরে তাই দশমাস হলে হয় জন্মাষ্টমী
তরণী কয় কী বলব আর এই বুঝেছি আমি।
শিক্ষিত নাগরিকের বাউল রচনা
বঙ্কিমচন্দ্র দত্ত
শুধুই রূপসজ্জায় কি মানুষ করা যায়?
মানুষ আছে এই দেহ-ঘটে
নাইক পটে—
নাইরে মন্দির মসজিদ গির্জায়।
সেই মানুষের করণ নয় সাধারণ
সেই যে অগ্নি-পারার মিলন করণ
এ ভবে তা’ জানেরে কয়জন
যে জন জানে তাহার ধর গে চরণ
নইলে তারে পাবি নারে সুনিশ্চয়।
তুই মাথায় বাঁধলি লাল পাগুড়ি
স্কন্ধে ঝুলাস লাল উত্তরী
বাঁধলি কোমরপটি ঊর্ধ্বঝুঁটি
হাতে গোপীচন্দ্র শোভা পায়।
মন রে সময় থাকতে ছাড় এই খেলা
সাধুসঙ্গ করিস্ না হেলা
এবার বহিরঙ্গ দূরে ফেলা
অন্তরঙ্গ ভাবের কর আশ্রয়।
গোঁসাই বলে ওরে বঙ্কা
তোর থাকবে না রে কোনো শঙ্কা
তুই পারে যাবি মেরে ডঙ্কা
একবার ধর না গিয়ে সাধুর পায়।
প্রবীণ বাউলের রচনা
সনাতনদাস বাউল
খ্যাপারে ঢাকা শহর যাবি কী করে
ও তুই ঢাকা খুলে দেখলে পরে যাবে রে মাথা ঘুরে।
এবারঢাকার কথা শোন তরে বলি
ঢাকার ভিতর আছে ঢাকা তিপ্পান্ন গলি—
আছে ঢাকার ভিতর গন্ধকালী বলি খাবার তরে।
ঢাকায় চারদিকে আছে দেখ ঝুরকুণ্ডারি বন
অপ্রকটে আছে সেথা মদনমোহন—
সেথাডাকিনীটা দিবানিশি আছে বসে হাঁ করে।
খ্যাপা বলেসনাতন রে
সেথা বেহুশারে গেলে পরে
বাপ-বেটায় মরে—
আবার ঠাকুর গেল মরে
বাগাতে সে না পেরে।
শিক্ষিতজনের জনপ্রিয় বাউল রচনা
আশানন্দন চট্টরাজ
আমি মরছি খুঁজে সেই দোকানের
সহজ ঠিকানা—
যেথা আল্লা-হরি-রাম-কালী-গড্
এক থালাতে খায় খানা।
যেথা ভক্তি-যোগের আগুন জ্বেলে
গোরা রামকৃষ্ণ কড়াই ঠেলে
আর মহম্মদ জিন যিশু ছাঁকে
প্রেম-রসে মিহিদানা।
আমি মরছি খুঁজে সেই ঠিকানা।
যেথা জ্ঞান-ছানাতে কর্ম-চিনি
বুদ্ধ নানক মাখে
আমি দয়ার সাথে ক্ষমার সাথে
ধর্মবড়া থাকে।
যা পয়সা দিলে যায় না পাওয়া
আর বিন কড়িতে যায় গো খাওয়া—
যেথা আসল মালিক চেনার হদিস
জপ ধ্যানেতে যায় জানা—
আমি করছি খুঁজে সেই দোকানের
সহজ ঠিকানা।
প্রবীণ বাউলের আধুনিক রচনা
হরিপদ গোঁসাই
যাস নারে তুই হুরার পুকুর পার।
সেই পুকুরের জলের পারে
মাছরাঙায় মানুষ মারে
দেখলে জীবের জ্ঞান থাকে না আর।
পুকুর সারে তিনকানি
বস্যাতে লাল পানি
ডুলি দিলে বহে একটি দ্বার—
সেই পুকুরে পাগলা ভোলা
সিনান করে তিনবেলা
ব্রহ্মা বিষ্ণু না পাইল আর।
পুকুরের পারে অমাবস্যায়
চন্দ্র ওঠে কোন্ ভরসায়
পূর্ণিমার দিন থাকে অন্ধকার—
সেই চন্দ্র দর্শন করিলে
কোটি জন্মের ফল ফলে
ভবের পরে আসবে না সে আর।
ভেবে হরিপদ বলে
চন্দ্রগ্রহণের কালে
মুক্তিস্নানে যেয়ে পুকুর পার—
দুই জনে এক আত্মা হয়ে
স্নান করলে সেই পুকুরে
জন্ম মৃত্যু না হইবে আর।
দরবেশের আত্মদর্শনের গান
কালাচাঁদ দরবেশ
বাংলার বাউল সুরসাগরে যেজন ডুবেছে
তিনিই সাগর সেঁচে মাণিক তুলে
বাউল রত্ন হইয়েছে।
এমন রত্নই কোহিনুর মণি
তত্ত্ব সম্রাট পরশমণি
সুর ব্রহ্মা স্বরূপিনী তার কণ্ঠে সদা হয়েছে।
ধন্য বাউল লোকশিক্ষক
সমাজের হয় প্রতিরক্ষক
মুখপাত্র খাঁটি পরীক্ষক
সাধক বাউল হয়েছে।
দরবেশ রাধাচন্দ্র নিলেন কষে
কালাচাঁদকে ভালবেসে
তত্ত্ববস্তু দিলেন শেষে প্যারিসে প্রমাণ রয়েছে।
বাউল দরবেশীর স্বর্গভূমি
বাংলাই বাউলের রাজধানী
বিশ্ববাসী হইল ধনী
তারা বাউলের পরশ পেয়েছে।
আধুনিক বাউল গান
শঙ্কর চক্রবর্তী
বাউল গান নষ্ট করল বৈতাল বাউলে—
ডিস্কো আর পল্লীগীতি করছে বাউলের ক্ষতি
পূর্ব মহাজনের পদ ভুলে।
পুঁচকে কিছু ছেলেছোকরা।
পিতামাতার কুলাঙ্গার—
বাউলের ভাবভঙ্গি নিয়ে
খমকেতে দেয় টংকার।
জানে না বাউলের ভাষা ভিটাবাড়ির জংলা চাষা।
তাই তো বাউলের দশা মাথা মুড়ে ঘোল ঢালে।
পোষাক চাঙ্গা করে রাঙ্গা হাতে নিয়ে একতারা
প্যান্ট ছেড়ে কাপড় পরে বাউল মঞ্চে হয় খাড়া—
খমকে বাজায়ে খ্যামটা
বিধবার সঙ্গে প্রেমটা
অন্ধকারে মাতালে।
মুকুন্দদাস লালনের গান
সিরাজ সাঁই পাঞ্জুর আখ্যান
বল্লভের সেই মধুর তান
গিয়েছে বাউল আজ ভুলে।
খগেন সাধু কয় ফুকারি সমাজে বাউল খুব দরকারি
রঘু আয় তাড়াতাড়ি শঙ্করকে সঙ্গে করে—
আমরা তিন মিলে গানের বাউলে
কলঙ্ক ফেলি তুলে।
বাউলের প্রতীচ্য দর্শন
হরিপদ গোঁসাই
এসে দেখি আমি এই প্যারিস শহরে
দেখছি রঙ্গবিরঙ্গে অনেক মানুষ
সকলকে নেয় আপন করে।
দেখি তাদের এমনই ব্যবহার
নাহি তাদের কেহ আপন পর—
হিংসা নিন্দা নাই অন্তরে
চুম্বন খায় সবাই সবাইকে ধরে।
পুরুষ নারীর নাই কোনো বাধা
এদের অন্তরগুলি বড়ই সাদা
এরা প্রেমে মত্ত সকল সময়
কী ঘরে কী বাহিরে।
তাদের লীলা খেলা বলব কী
যেমন বস্তুহারা ব্রজবালা হয় উলঙ্গী
উত্তম প্রেমে মত্ত তারা
রয়েছে নেশার ঘোরে।
হরিপদ কয় সত্যকথা
তোমরা মা জননী স্বর্গের দেবতা
তোমরা ইন্দ্রপুরী ত্যাজ্য করে
এসেছ এই প্যারিস শহরে।
অন্ধ প্রতিবন্ধী বাউলের রচনা
রথীন হালদার
আমি বিহগের গান শুনেছি বিজনে
নীলাকাশ চোখে দেখিনি—
আমি কুসুম গন্ধ পেয়েছি কাননে
গোলাপের শোভা দেখিনি।
আমার দু’চোখে আঁধার কখনও
আলোর ঠিকানা পাবে না—
অন্তর যদি কাঁদে প্রিয়া বলে
জানি তুমি কাছে রবে না
হৃদয়ের মাঝে পরম যতনে
মোর ছবি কেহ আঁকেনি।
শুনেছি শুধুই রামধনু নয়
সাতটি রঙেতে রাঙানো
তোমার দু’চোখে সাগরের নীল
কুন্তলে মেঘ ছড়ানো—
গানের ভুবনে আহত বলাকা
মেলেনিকো পাখা সুদূরে।
বিরহ ব্যথার অশ্রু মালিকা
পারিনিকো দিতে প্রিয়ারে
বেদনার সুরে মোর স্বরলিপি
হায় আজও কেউ লেখেনি।