২.৬ বাউল-ফকিরি গানের সুর প্রসঙ্গে আলাপচারি

বাউল-ফকিরি গানের সুর প্রসঙ্গে আলাপচারি

দিনেন্দ্র চৌধুরী গান পাগল মানুষ। নানা বর্গের সংগীত গায়নে তিনি দক্ষ এবং বড় মাপের পারফরমার। আধুনিক বাংলা গান সম্পর্কে তাঁর উৎসাহ প্রবল। নিজে গান লেখেন, সুর করেন। গান নিয়ে মাঝে মাঝে ভাবনা উদ্রেককারী নিবন্ধ লেখেন। ভাল ট্রেনার এবং তাঁর পরিচালনায় অনেক রেকর্ড বেরিয়েছে। তাঁর বেশ ক’টি বই আছে, গবেষণা আছে, একথা দীর্ঘদিন জানি বলেই একদিন তাঁর সঙ্গে বসেছিলাম বাংলা বাউল গানের সুর ও সুরের গঠন সম্পর্কে আলোচনা করতে। জানতাম যে তাঁর বক্তব্য হবে মৌলিক ও প্রণিধানযোগ্য, তাই সঙ্গে ছিল টেপরেকর্ডার। আমার প্রশ্ন আর দিনেন্দ্র চৌধুরীর জবাব নিয়ে সেই আলাপচারি এখানে লিখিত আকারে ছেপে দেওয়া গেল গানবাজনায় উৎসাহীজনের জন্য। টেপরেকর্ডবদ্ধ এই আলাপচারির লিখিত রূপে তিনি পরে প্রয়োজনীয় পরিমার্জন ও সংযোজন করেছেন। নীচে সেটি অবিকল মুদ্রিত হল।

প্রথমে দিনেন্দ্র চৌধুরী একটা গানের মুখ শোনালেন:

মানুষ তারে চিনলা নে

নবরঙ্গ দেহের মাঝে বিরাজ করে কে…

প্রশ্ন: এটা কোন্ অঞ্চলের গান?

উত্তর: এটা পূর্ববঙ্গের সিলেট অঞ্চলের বৈষ্ণব-বাউল। সুর কিন্তু ভাটিয়ালি। সিলেট মানে বিরাট অঞ্চল। এদিককার রাঢ়ীয় আর নবদ্বীপী দু-রকম বৈষ্ণব ভাবাশ্রয়ী গান আছে— ওদিকে নবদ্বীপভাবাশ্রয়ী বাউল গেছে। ভাটিয়ালি সুরেই বাউল গাওয়া হয়।

প্রশ্ন: এদের সঙ্গে হাসন রজার গানের পার্থক্য কী?

উত্তর: হাসন রজা তো বৈরাগ্যমূলক গান গাইতেন। সুর নিজস্ব, কিন্তু ভাটিয়ালি সুর-শৈলীর বাইরে নয়—

যেমন—

মাটির পিঞ্জিরার মাঝে / শুয়া বন্দী রইলা রে

কান্দে হাসন রাজার / মন ময়নায় রে।

ওঁর নাম ছিল হাসন রজা চৌধুরী। ওখানে স্থানীয়ভাবে সবাই হাসান রাজা বলে।

সম্ভ্রান্তবংশীয় মুসলমান জমিদার। রজার সঙ্গে রাজার যোগসূত্র নেই কিন্তু।

প্রশ্ন: আপনার কি মনে হয় বাংলার বাউল গানের কোনও নির্দিষ্ট সুর আছে?

উত্তর: না। তত্ত্বমূলক গানের কোনও নির্দিষ্ট সুর নেই। পুজোপার্বণের কিছু গান আছে যেগুলো পালটায় না। বছরের নির্দিষ্ট দিনে গাওয়া হয়— নিয়মিত চর্চা হয় না বলে মডিফিকেশন হয় না, চেঞ্জ হয় না। কিন্তু বাউল গানের সুরে ও ধাঁচে অনেক পরিবর্তন এসেছে। যেমন আজকাল লালন ফকিরের গান সুর দিয়ে আমরা গাইছি— মিসলিঙ্কড হয়ে গেছে তো। এতে কোনও অপরাধ আছে বলে মনে করি না। যদি যোগ্য লোক তাঁদের অঞ্চলের প্রতিনিধিত্ব করতে পারেন— কুষ্টিয়া, রাজশাহী অঞ্চল বা মধ্যবঙ্গের ওই অঞ্চলের সুর সম্পর্কে যদি তাঁর দখল থাকে, তিনি যদি লালনের গানে সুর করেন— মেনে নেওয়া যাবে। এবং সেটা যদি কমিউনিকেট করে, সকলের মনের সঙ্গে তার বক্তব্যটা অর্থবহ হয়ে ওঠে— তা হলে করা যেতে পারে। আমরা যেমন কবীরের গান, মীরাবাঈয়ের গান সুর দিয়ে গাই—নইলে তো হারিয়ে যাবে।

প্রশ্ন: পূর্ববঙ্গে ‘বাউলা’ গান বলতে কী বোঝায়?

উত্তর: পূর্ববঙ্গে অন্য সব তত্ত্বের সঙ্গে দেহতত্ত্বও থাকে। বাউলা মানে ছন্নছাড়া লোকেরাই এ গান গায় না। ত্রিনাথের আসরে সংসারী লোকেরাই গাইছে। বাউলা মানে বৈচিত্র্য। বৈচিত্র্যমূলক গানের আসরকেই বাউলা বলা হয়ে থাকে। বাউল থেকে বাউলা নয়। বাউল বলে স্বতন্ত্র কোনও গান আছে কিনা জানা নেই।

প্রশ্ন: বেশ তো, একটা নমুনা দিন:

উত্তর: শুনুন, ত্রিনাথের গান—

ও গাঞ্জার চিরল চিরল পাত

গাঞ্জা খাইয়া মগ্ন হইয়া নাচে ভোলানাথ—

নাচে ভোলানাথ গো নাচে ভোলানাথ।

আনন্দ গগনে নাচে মগনে

ত্ৰিন্নাথ ত্ৰিন্নাথ বইলা মারো একটান

ও সিদ্ধি মারো একটান।

তিন কলকি সাজাইয়ে

শবিনা লাগাইয়া

টিক্কায় আগুন দিয়া মারো একটান।

প্রশ্ন: বাঃ। এ গানের সঙ্গে গম্ভীরা গানের তো বেশ মিল রয়েছে।

উত্তর: হ্যাঁ। শিব সম্পর্কে গান। কিন্তু ত্রিনাথ মানে ত্রিভুবনেশ্বর। ব্রহ্মা-বিষ্ণু-শিবের রূপকল্প নয়।

প্রশ্ন: বাউলা সুরে দেহতত্ত্বের গান আছে?

উত্তর: দেহতত্ত্বের গান সব সুরেই আছে। বাউলা সুরে কোনও গানে নয়, বাউল সুরে আছে। দেহতত্ত্ব, মনঃশিক্ষা ও বাউলের সুরে বিশেষ প্রভেদ নেই। আঞ্চলিক সুরেই গাওয়া হয়ে থাকে সব গান।

প্রশ্ন: সে রকম একটা নমুনা যদি দেন—

উত্তর:ঘুমে রইলে কপালপোড়া

কামনদীতে ডুবল রে ভারা—

ও তুই দিন থাকিতে খুঁজলে পাবি

অন্ধকারে যাবি মারা।

গানটির পর্যায় হল ‘আখেরি চেতন’, সুরে তা ভাটিয়ালি।

প্রশ্ন: গানের যে বেসিক নোট— চার সুর ছয় সুর বলে, তার সম্পর্কে আপনার কী মত?

উত্তর: খুব প্রাচীন গানে স্বর কম লাগত। এখনকার গানে অনেক স্বর লেগে যাচ্ছে। লোকসংগীতের মধ্যেও বেসিক নোটই লাগে। একদম সোজাসুজি তো গায় না। সুতরাং কিছু কাজকর্ম এসেই যায়। সুরের বিষয়ে গ্রাম্য গায়কদের সচেতন প্রয়াস থাকে না। প্রচলিত ছকে ও নিজস্বতায় কিছুটা বিবর্তিত হয় মাত্র। যেহেতু ব্যাকরণ নেই।

প্রশ্ন: এ রকম সুরের গান একটা শোনান।

উত্তর: দেখুন, চারটি স্বর লেগেছে। এ হল সূর্যব্রত অনুষ্ঠানের ‘নৌকাবিলাস’ পর্যায়ের গান—

পার কইরা দেওরে মাঝি মথুরাতে যাই

মথুরাতে গিয়ে যদি কানাইর দেখা পাই।

মধ্য গাঙ্গে নিয়া কৃষ্ণ নাওয়ে দিল লাছা

চমকিল রাধার পরান ভাঙল নাওয়ের পাছা।

প্রশ্ন: একটু সরগম করে গান—

উত্তর: র, ম, প, ধ, — এই চারটি স্বরে তিন চরণে নিবদ্ধ গান এটা—

| ধ — ধ | ধ ম — |প –প | ম র —|

| পা র্‌ ক | রি য়া ০ | দে ও রে | মা ঝি o |

| র র ম | ম প — | ম — — | — — — |

| ম থু ০ | রা তে ০ | যা ০ ০ | ০ ০ ই |

| র ম — | র ম — | প ধ — | প ম — |

| ম থু ০ | রা তে ০ | গি য়া ০ | য দি ০ |

| ধ ধ —| ধ ধ — | প ধ — | প ম — |

| কা নাই র্‌ | দে খা ০ | পা ০ ০ | ০ ০ ই|

প্রশ্ন: এ গানের সুরের বেসিস কী?

উত্তর: এটা রাঢ়ীয় অঙ্গের। ঝুমুর, টুসু, ভাদুর সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের বাউলের মিল নেই, মূলত ভৈরবী ঠাটে নিবদ্ধ।

প্রশ্ন: পূর্ণদাস বাউল তো এই সুরেই গান করেন তাই না?

উত্তর: হ্যাঁ, এরই একটু রকমফের আর কী। পূর্ণদাস বাউলের কণ্ঠে রাঢ়বঙ্গের বাউল মনোহারিত্বে অতুলনীয়। তাঁর প্রয়াসেই বাউল গান আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে প্রসারিত।

প্রশ্ন: ফকিরি গান তো অনেক শুনেছেন, তার সঙ্গে বাউল গানের পার্থক্য পেয়েছেন?

উত্তর: ফকিরি তো আলাদা সাধনা। আলাদা সাধনা বলে আনুষ্ঠানিক স্তরে কিছু পার্থক্য আছেই। ওটা মুসলমানদের। ফকিরি গান অবশ্য দু’রকমের আছে। মূলত সুফিবাদসম্পন্ন ফকিরি, কারণ ইসলামের মরমিতত্ত্ব তো প্রকাশ করেছেন সুফিরাই। আর সব মারিফতিই হল মুর্শিদা, কিন্তু সব মুর্শিদাই মারিফতি নয়। কারণ মুর্শিদকে স্মরণে রেখে যে গান হচ্ছে তাই মুর্শিদা। আবার মারিফত হল একজনের মাধ্যমে বা নির্দেশে যেতে হয়। যেহেতু সাধনাটিতে গোপনতা আছে। তাই তত্ত্বাদি আয়ত্ত করতে মুর্শিদই হল অবলম্বন।

প্রশ্ন: আচ্ছা, এ সব গানে সুরের পার্থক্য কেমন?

উত্তর: তত্ত্বমূলক গানে কোনও সুরের পার্থক্য নেই— যে-কোনও সুরেই গাওয়া যায়। পূর্ববাংলায় দশ রকম সুরে গাওয়া হয়। যেহেতু একটা শৈলী আছে তার বাইরে ওরা যেতে পারে না। যেমন এপার বাংলা ওপার বাংলা দু’দেশেই চলে— ‘আমি কোথায় পাব তারে’… সেই সুরে…শুনুন—

চিননি মন তারে তুমি চিননি মন তারে

যেজন তোমার দিল্‌পিঞ্জরে দিবানিশি বিরাজ করে।

যখন আল্লা পরওয়ারে সৃষ্টি করলেন আদমরে

আব আতস বাতাস দিয়ে খাক্‌-এ মিলন করে।

হুকুম করলেন তবে রুহু যাও কল্পপুরে

তখন আন্ধারিয়া ঘর দেখিয়া কাঁদছে রুহু কাতর স্বরে।

প্রশ্ন: আশ্চর্য তো! এ সুর কোথায় পেয়েছেন?

উত্তর: আমাদের সিলেটে।

প্রশ্ন: এখনও প্রচলিত?

উত্তর: এখনও প্রচলিত। আসলে এমন কিছু সুর আছে যা দুই বাংলাতেই চলে। যেমন প্রভাতী পর্যায়ের গান পূর্ব বাংলায় ভাটিয়ালি শৈলী থেকে অন্য দিকে চলে গেছে। ধরা যাক, ‘বৃন্দাবনবিলাসিনী রাই আমাদের’— এটা এ বাংলার। হয়তো নবদ্বীপ বা কৃষ্ণনগর থেকে বা বটতলা প্রকাশনীর কারণে ওই বাংলায় যেতে পেরেছে। কিছু লোক শুনে গিয়ে বৈষ্ণব ভাবকে প্রচার করেছে। লোকের মুখে বা গায়কের মুখে প্রচারের মোটিভের ফলেও গিয়ে থাকতে পারে। গানের তো হাত-পা নেই। তবু বিচরণশীল— oral transmission-ই রাস্তা। যেমন ধরুন শুকসারি দ্বন্দ্বের গান—

শুকসারি বলে উঠলো কিশোরী

যামিনী অবসান।

কোকিলায় ঘন ঘন কুহুরবে মধুকরে

মধু করে পান।

রতি রস রঙ্গে রসরাজ সঙ্গে

নিশি পোহাইল প্রেম তরঙ্গে

এই তো সমাধান—

ঘরে গুরুকুল জাগিল সকল

মাধব কর পয়ান।

ব্যাপারটা ভাবতে গেলে মনে হয়, পূর্ববাংলায় প্রভাতী গান একটু বাঁক নিয়েছে। এই concept রবীন্দ্রনাথে এসেছে ‘কেন যামিনী না যেতে জাগালে না / বেলা হল মরি লাজে’— বৈষ্ণবপদের প্রতিফলনে উন্নত সংস্কৃতির স্বাক্ষর বলা যায়।

প্রশ্ন: বেশ। এবারে জানতে চাই মুর্শিদা গানটা কেমন?

উত্তর: মুর্শিদকে উদ্দেশ্য করে গান। অনেক রকম গান আছে এ জাতীয়। চট্টগ্রামে মাইজভাণ্ডারী বলে একটা জায়গা আছে। সুফি সাধকরা চট্টগ্রামের পথেই তো এসেছেন। এঁরা খুবই উন্নত মানের সাধক। তাই পারসিক সুরের সঙ্গে স্থানীয় সুরের মিশ্রণ ঘটা বিচিত্র নয়। যেমন,

মাইজভাণ্ডারের ভাবের রসিক

বেশ সুখে আছে—

সোনার ময়ূর মুর্শিদ বাবা

তাল ফেলে নাচে॥

ভাব ধরাইল কোন্‌ ভাবিনী

না জানি কেমন কামিনী

নাম ধরিলে মাণিক জ্বলে

হৃদি মন্দিরের নীচে॥

প্রশ্ন: ‘আমায় ডুবাইলি রে ভাসাইলি রে’ গানটার সঙ্গে ক্ষীণ মিল আছে নাকি, সুরে?

উত্তর: না না। দ্রুত ছন্দ বলে তালের মিল আছে— চতুর্মাত্রিক: কাহার্‌বা। তাল: মধ্য লয়।

যেমন—

আটকুঠুরি নয় দরজা কোন্‌খানে নাই তালা

ঘর খানি হয় তিনতালা—

ঘরের নয় দরজায় নয় জন দ্বারী সদাই তারা ঘুরিফিরি।

ছয় ডাকাতে জানলে পরে

তখন করবে চুরি।

ঘরের মণিকোঠায় দিয়া চাবি

ও তুই মনের সুখে নিদ্রা যাবি—

সেই ডাকাতের ভয় রবে না

সুখে থাকবি মন কালা।

প্রশ্ন: এই গানটা কি ঢাকা থেকে পাওয়া?

উত্তর: হ্যাঁ— আবদুল লতিফের রচনা। তিনি বিখ্যাত লোককবিরূপে পরিচিত।

প্রশ্ন: বিভিন্ন অঞ্চলে বাউল গানে বিভিন্ন সুর হয়েছে—এর কারণ কী?

উত্তর: ভৌগোলিক পার্থক্যের জন্যে। পরম্পরা একটা তৈরি হয়ে যায়— তারপর একটু-আধটু মডিফিকেশন হয়, তবে মূল সুর একই থাকে।

প্রশ্ন: ফিকিরচাঁদের গানের ধাঁচা কেমন?

উত্তর: হ্যাঁ, খুব বেসিক সুর— বাউল গানে ইনফ্লুয়েন্স তৈরি করেছেন উনি। যেমন ধরুন ফিকিরচাঁদি গান:

বসায়ে রসের মেলা সখের খেলা

দিন দুইচার খেললে ভালো

মেলাতে দেখে চোখে ম্যালা লোকে

কেবা কী উপদেশ পেলো॥

গানটি ঝাঁতি তালে নিবদ্ধ। পূর্ববাংলায় বলে ‘ছব্‌কি’। আট মাত্রা অথচ একটা করে মাত্রা ছেড়ে অফবিটে গাওয়ার জন্যে ত্রিমাত্রিক বলে ভুল হতে পারে। ঝাঁতি কীর্তনে ব্যবহৃত তাল। এঁরা এটিকে ছয় মাত্রাযুক্ত ত্রিমাত্রিক বলেন। বোল: ।-ধিতা কি। ধিৎ তা কি।*

______________

* দিনেন্দ্র চৌধুরী ২০০৮ সালে প্রয়াত হয়েছেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *