২.৭ ফকিরদের সঙ্গে দ্বিরালাপ

ফকিরদের সঙ্গে দ্বিরালাপ

বাউলদের ব্যক্তিগত জীবনের কথা এতদিনে আমরা ইতস্তত কিছু কিছু লেখায় জানতে পারছি। বাউলরা তাঁদের জীবনের বলয় থেকে এখন অনেকটা বেরিয়ে আসছেন। রহস্যের ঘেরাটোপ কিংবা গুরুর নিষেধ ছিন্ন করার প্রবণতা তাঁদের এসেছে এই জন্য যে, প্রচারমাধ্যম তাঁদের আমজনতার মুখোমুখি করে দিচ্ছে। দেশে, বিশেষত বিদেশে তাঁদের গান গাইতে হচ্ছে, মেলা মচ্ছবে সাংবাদিক ও সংগীতানুরাগী ব্যক্তিরা তাঁদের বহুরকম প্রশ্ন করছেন। পত্র-পত্রিকায় তাঁদের ইন্টারভিউ এখন দুর্লভ নয়। তাঁদের নিজেদের গুহ্য সাধন কথা বাইরে বলা নিষিদ্ধ কিন্তু ব্যক্তিজীবনের খুঁটিনাটি অভিজ্ঞতা, গানের স্বীকৃতি, উপেক্ষা বা সমাদর, দারিদ্র্য ও অত্যাচারের বিবরণ দেওয়ার কোনও নিষেধ নেই। তাদের সম্পর্কে বেশ কিছু উলটোপালটা মন্তব্য নিন্দা কিংবা ভুল তথ্য তাঁদের বিচলিত করে। তাই কেউ কেউ আজকাল তাঁদের বক্তব্য জানাতে এগিয়ে আসছেন। সনাতন দাস বাউল তো দু’খানা চটি বই লিখে বসেছেন। পূর্ণদাসও বেশ মুখর ব্যক্তিত্ব। বহু ধরনের সমাবেশ হয় আজকাল, সেমিনার ধরনের, তাতে বাউলদের মঞ্চে ডাকা হয় নিজেদের সুখদুঃখ, হতাশা, বেদনা কিংবা অভাব অভিযোগ চাহিদার কথা জানাতে। তাঁরা সেসব ব্যক্ত করতে শুরু করেছেন।

কিন্তু ফকিরদের কথা আমরা এখনও বিস্তারে জানতে চাইনি। তাঁরা তো স্বভাবকুণ্ঠ এবং সংখ্যালঘু। দীন ভিখারির মতো দরিদ্র জীবনযাপনের ব্রত নিয়েছেন স্বেচ্ছায়। কিন্তু তাঁদের নীরবতাও অনেকটা বাঙ্ময়। এখানে দু’জন ফকিরের আত্মবিবৃতি প্রকাশ করা হচ্ছে তাঁদের মুখের জবানিতে। সেই সঙ্গে থাকছে আমার মন্তব্য বা টিপ্পনী।

গোলাম শাহ-র কথা—১

আমার নাম গোলাম শাহ। পিতার নাম জানেব শাহ। মাতা রফিয়া। যেখানে থাকি সেই পাড়াটার নাম ঘুড়িষা-ইসাপুর। ফকিরপাড়াও বলে। ইসাপুর-ফকিরপাড়া। বাংলা ১৩৫০ সনে ভাদ্রমাসে আমার জন্ম। এখানে প্রায় কুড়ি বছর বাস করছি। আগে লাভপুর থানার শাসপুরে থাকতাম। আমার ওটা জন্মস্থান। চারপুরুষ ওখানে আমাদের বাস। বিয়ে হবার পর থেকে আমি এখানে বাস করছি। এখানে আমার শ্বশুরবাড়ি। শ্বশুরবাড়ি বলেই ঘুড়িষায় বাস করছি— এ ছাড়া অন্য কোনও কারণ নাই। আমাদের শাহ বংশ— বংশ পরম্পরায় ফকির। আমি বংশগত ফকির নিজের ইচ্ছাতেই ফকিরি পথে এসেছি। ফকির মহম্মদ শাহকে (কেষ্টপুর, বর্ধমান) গুরু ধরে উনার কাছ থেকে কিছু তত্ত্ব জ্ঞান নিয়েছি। তখন আমার বয়স চোদ্দো-পনেরো বছর। তখন থেকে আমি গানবাজনা করছি। বাচ্চা বয়সে বারো বছর বাংলাদেশে কেটেছে। বাংলাদেশে খয়রা গ্রামে আমার মামার বাড়ি। যখন থেকে ফকির হলাম—তখন থেকেই ফকিরিটাই আমরা সাধনা। এ ছাড়া আমি আর কিছু করি না। গান-বাজনা করি—প্রতিমাসে আমার কুড়ি থেকে পঁচিশটা প্রোগ্রাম হয়। প্রায় জেলাতেই প্রোগ্রাম করি।

আমার মন্তব্য

গোলাম শাহ ফকির এখন বছর সাতান্নর একজন মানুষ। শরীর স্বাস্থ্য মজবুত, নইলে বিভিন্ন জেলায় ঘুরে ঘুরে মাসে কুড়ি পঁচিশটা অনুষ্ঠান করা সম্ভব হত না। জন্মসূত্রে ফকির তিনি এবং বাঙালি। চারপুরুষের হিসেব ধরলে শ’ দেড়েক বছরের উত্তরাধিকার সাব্যস্ত হয়। বর্ধমানে গিয়ে ফকিরি মতে দীক্ষা নিয়েছেন, কিছু তত্ত্বজ্ঞানও অর্জন করেছেন কমবয়সে কিন্তু সাধক ফকির নন— প্রধানত গায়ক। সেটাই জীবিকা। চোদ্দো-পনেরো বছর থেকে স্বেচ্ছায় এ পথে রয়েছেন। ঠিক অনিকেত মানুষ নন। বাস্তুবাড়ি-মামার বাড়ি-শ্বশুরবাড়ি ঘিরে বেশ তৃপ্ত মানুষ।

গোলাম শাহ-র কথা—২

আমার তিন ছেলে, চার মেয়ে। দুই ছেলে গান করে, অন্যরা ঘরেই থাকে। ছেলে তিনটি বড়। বাকিরা ছোট। আমার স্ত্রীও বায়েদ। মহম্মদ শাহের ছেলে সাদব শাহের কাছে বায়েদ হয়েছেন। আমার ছেলেরাও সাদব শাহের কাছে বায়েদ হয়েছে। আমার স্ত্রী আমার সাধনসঙ্গিনী।

আমাদের বিয়েতে ফকিরের ঘর থেকে মেয়ে আনতে হবে, মেয়েও দিতে হবে ফকিরের ঘরে। এখন অবশ্য অন্য ঘরেও বিয়ে হচ্ছে। কিন্তু হওয়াটা ঠিক নয়। আমাদের মধ্যে এখনও এমন হয়নি।

আমার বিয়ে দুটি। দুই স্ত্রীই এখানে থাকেন। পরিবার-পরিকল্পনা বা জন্মনিয়ন্ত্রণ— এগুলো আমাদের নাই। আমরা মেনেও চলি না। ওই পরিবার পরিকল্পনা— এটা গুরুর কাছে আছে। ওই জিনিস যদি গুরুর কাছে জানা যায়— তা হলে আপনা-আপনি বন্ধ করে দেওয়া যায়। গুরুর কাছে চাইলে তিনি এটা কর্মের মাধ্যমে দেবেন।

আমার মন্তব্য

ফকিরদের পরিবার বেশির ভাগ অতিপ্রজ, এটাই দেখেছি। তাঁদের সীমাহীন দারিদ্র-দুর্গতির সেটাই কারণ। কিন্তু সেজন্যে তাঁদের খুব একটা গ্লানি বা দুঃখ দেখিনি। গোলাম শাহ-র স্ত্রীও ফকিরিতন্ত্রে মন্ত্র দীক্ষা ও ক্রিয়াকরণের অংশী। দুই সন্তানেরও ফকিরি দীক্ষা হয়েছে। কায়াসাধনে গোলাম ফকির দাম্পত্য বৃত্তের মধ্যে সুখী। হয়তো বীরভূমে ফকিরদের সঙ্গে সাধারণ মুসলমানদের বিয়ে শাদি তাঁর দেখার অভিজ্ঞতা নেই। অন্য জেলাতেও এমন বিয়ে ভালই চালু আছে। তবে নদে-মুর্শিদাবাদের অনেক ফকির বেশ ভাল গৃহস্থ, জমিজিরেত আছে। পরিবার পরিকল্পনা বা জন্মনিয়ন্ত্রণে এখন সচেতনতা আমি লক্ষ করেছি। গোলাম শাহর গুরুনির্ভরতা খুব বেশি। অন্যত্র এতটা দেখিনি।

গোলাম শাহ-র কথা—৩

আমি ক্লাস সিক্স পর্যন্ত পড়েছি। তারপর আর পড়াশোনা করিনি— গান-বাজনাতে গেলাম। …ছেলেমেয়েরা পড়ে—তারা ইস্কুলে যাচ্ছে। এই বর্তমান পড়াশোনা, এই সমাজব্যবস্থা— এ তো মানতেই হবে। এই পড়াশোনা ভাল—খারাপ বলা যায় না। এই শিক্ষা বহিরঙ্গ, যেটা পির-মুর্শিদের শিক্ষা—সেটা অন্তরঙ্গ।

সম্পত্তি আমার কিছুই ছিল না— এখনও কিছুই নাই। ভিটে নাই, জমিজমাও নাই। আমার গানটাই হল আসল। গান থেকেই আমার আয়।

সরকারি সাহায্য আমি কিছু পাইনি। তবে যখন সরকারি প্রোগ্রাম করি তখন আমাকে টাকাপয়সা দেয়। সরকারের কাছ থেকে বছরে তিন-চারটে ডাক পাই। তখন টাকা-পয়সা ভালই পাই। এ বিষয়ে সরকারের বিরুদ্ধে কোনও ক্ষোভ নাই।

আমার মন্তব্য

বাউল ফকিরদের লেখাপড়ার দিকটি সারা বাংলাতেই বেশ দুর্বল। তবে লক্ষ করেছি সকলেই প্রায় সাক্ষর। গোলাম শাহ লেখাপড়াকে বহিরঙ্গ ভেবে মুর্শিদের শিক্ষাধারাকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন সেটি তাঁর পক্ষে সংগত। জমিজমা নেই তার জন্যে খেদও নেই। যথার্থ ফকিরি দৃষ্টিকোণ এটা। সরকারি অনুষ্ঠানে ডাক পান অর্থ পান, তাতেই তুষ্ট। ফকিররা স্বভাবত স্বল্পে তুষ্ট।

গোলাম শাহ-র কথা—৪

আমার জীবিকা বলতে গান। আমি মাধুকরী করি না। আমার জীবনের প্রথম শেখা গান লালন শাহ ফকিরের গান। লালন শাহ ফকিরের গান শিখি একজন বাংলাদেশের লোকের কাছে। তার নাম হারেম শাহ। তারপর মহম্মদ শাহের কাছে দীক্ষা নিই— মহম্মদ শাহের কাছে কিছু গান শিখি। তারপর আমি বিভিন্ন গান শিখেছি। বিভিন্ন গান গাই। মানুষ-তত্ত্বের গান গাইতে আমার ভাল লাগে। আমার সবচেয়ে প্রিয় গান, যেটা বারবার গাইতে ইচ্ছে করে, সেটা হল—

মানুষ মানুষ বলে সবে মানুষ বড় মানুষ তবে

মনের মানুষ আছে খামুস হৃদয় মাঝে গোপনভাবে।

যন্ত্র বলতে— গানের সঙ্গে আমার নাল বাজে, বেহালা বাজে। ডুবকি খঞ্জনি বাজে। চিমটেও ব্যবহার করি। জীবনে প্রথমে ছিল দোতারা। যন্ত্রসংগীতে আমার একজন ওস্তাদ ছিলেন—তিনি আমাকে বেহালা বাজাতে শিখিয়েছিলেন। তার নাম মহম্মদ শাহ। শাসপুরের কাছে মীরবান গ্রামে বাড়ি।

আমার মন্তব্য

গোলাম শাহ প্রধানত গায়ক। সে বিষয়ে তাঁর অনুরাগ ও অনুশীলন প্রগাঢ়। লক্ষণীয় যে লালনগীতি তিনি বাংলাদেশ-সূত্রে শিখেছেন, কারণ আঞ্চলিকভাবে বীরভূমে ওই গানের বেশি চল নেই। এটাও দেখবার যে, গোলাম ফকির নিজে ফকিরিপন্থায় থাকলেও শুধু ফকিরি গান করেন না। অন্য গানও করেন— এন্টারটেনার। তাঁর প্রিয় গানটি বিশুদ্ধ ফকিরি গান নয়। ফকিরি গানের অনুষঙ্গে যেসব যন্ত্রবাদ্যের কথা তিনি বলেছেন তার মধ্যে নাল ও চিমটে ব্যবহার খুব টিপিকাল—ফকিরদের পক্ষে। তবে গোলাম শাহ ও তাঁর সন্তানদের গানের সঙ্গে বেহালাবাদন একটা ঘরানার মতো। গানের ব্যাপারে তিনি খুব সতর্ক ও সচেতন, যন্ত্র শিখেছেন ভালভাবে। তাঁর গানের গুরু ও ধর্মগুরু একজন, যন্ত্রবাদ্যের গুরু আরেকজন।

গোলাম শাহ-র কথা—৫

ফকির-বাউলরা মাথায় চুল রাখেন— এঁরা চুলটা কোনওমতে কাটতে চান না। আমি চুল কেটে ছোট করে দিই। তেল-টেলের বহুরকম অসুবিধা হয়—তাই কেটে দিই। কিন্তু কাটাটা নিয়ম নয়— রাখাটাই নিয়ম। চুল রাখাটা ধর্মের অঙ্গ বলা যায় না। কারণ ধর্ম জিনিসটা আলাদা। ধর্ম চুলে দাড়িতে টুপিতে নাই। লোকে জানে—ফকির বাউল এরা উদাসী, এদের চুল-দাড়ি এসব থাকে। ফকির-বাউলেরা অত লক্ষ করেন না, চুল-দাড়ি বাড়ছে বাড়ুক— থাকছে থাকুক।

পোশাকের ব্যাপারে ফকিররা কেউ পরেন ধুতি-পাঞ্জাবি, কেউ লুঙ্গি, কেউ আবার বিভিন্নরকম কামিজ জামা শার্ট পরেন। পোশাকে রংও থাকে। মাথায় কেউ পাড় বাঁধে, কেউ আবার টুপিও লাগায়। আমি ধুতি পাঞ্জাবি পরি। খাওয়া-দাওয়া কন্ট্রোল হল আলাদা জিনিস— সেটা সাধক-মানুষ করতে পারেন। আমরা সামান্য মানুষ— আমি করতে পারব না।

ফকির-বাউলদের যে বিন্দু-সাধনা আছে—সে সাধনা আমার নাই। সে সাধনা করতে হলে গুরুর কাছে জানতে হবে সেই কর্মটা জানলে পরে তবে করা যাবে।

আমার মন্তব্য

গোলাম শাহ উদারপন্থী বিবেচক মানুষ। ধর্ম সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা আছে বলে গোঁড়ামি নেই। সর্বকেশ রক্ষা ব্যাপারটি প্রথাহিসাবে মানতে রাজি নন। ‘ধর্ম চুল দাড়িতে টুপিতে নাই’ চমৎকার উপলব্ধি। বাস্তববাদী মানুষ, তেল টেলের খরচ বেশি, তাই চুল কাটেন। জাঁকালো পোশাক না পরে স্রেফ ধুতি পাঞ্জাবি। খেতে ভালবাসেন। সাধক তো নন, অতএব তাতে নিয়ন্ত্রণের দায় নেই। বিন্দু-সাধনার দীক্ষা নেননি—সম্ভবত আগ্রহও নেই। মানুষটি অকপট।

গোলাম শাহ-র কথা—৬

ফকিরি সাধনার গুরুত্ব কথা হল—তারা আল্লাকে পাওয়ার জন্য সাধনা করে। একমাত্র আল্লা-ওলীর পথটাকে তারা ধরে রাখে। এই সাধনায় দমের কাজ আছে, দমের নামাজ আছে, দমের জিকির আছে। আমার সাধনায় দমের জিকির আছে। জিকিরটা সবসময় হবে না। আসনে বসে সেটা করতে হবে।

ফকিরি সাধনার মূল তত্ত্ব হল— ঈশ্বরপ্রাপ্তি আর মানুষকে ভালবাসা। এ ছাড়া আর কিছু সাধনা নাই। মানুষকে ভালবাসতে হবে আর ঈশ্বরের জপতপ, আল্লার জপতপ করতে হবে। এজন্য কিছু ক্রিয়াকরণ আছে। যেমন—এবম্‌, গাম, গিল— এগুলো চিনতে হবে গুরুর কাছে। তারপর মুশাহারা, মুরাকাবা— এসব গুরু দেখিয়ে দেবে। তখন আসন করে ওই মূল তত্ত্বটাকে কায়েম করতে হবে। এগুলো সব দমের কাজ— দম ছাড়া তো হবে না। আসনের মাধ্যমে দমের কাজ হবে, তার মাধ্যমে জিকির। আইনাল জিকির, হককেল জিকির, এলমি জিকির— এমন বিভিন্ন জিকিরের নাম আছে।

আমাদের ফকিরি মতে মানুষ যেরূপ সেইরূপে ঈশ্বরকে দেখতে পাওয়া যায়। মানুষের রূপে। ঈশ্বরকে কেউ বলছে নিরাকার, আবার কেউ বলছে আকার। ফকিররা বলছে— আকার। আকার না থাকলে তো জীব সৃষ্টি হত না। গাছের সঙ্গে গাছই গেছে, মানুষের সঙ্গে মানুষ গেছে, পানির সঙ্গে পানি। এই ঈশ্বর, যাকে আল্লা বলছি— তিনি সমস্ত বিশ্বের মধ্যে মিশে আছেন।

ফকিররা মানুষের ভজন-সাধনটা বেশি করে— কেননা মানুষ হল মূল্যবান জিনিস। মানুষের কাছে সব কিছু আছে। কেউ যদি ঈশ্বরকে পায় তো মানুষই পাবে। তাই নিজেকে চিনলে আল্লাকে চেনা যাবে— নিজেকে না-চিনলে মক্কা মদিনা কাশী বৃন্দাবন গয়া করলে ঈশ্বরকে পাওয়া যাবে না।…তাই মানুষের সন্ধান হলে পরে আল্লার সন্ধান পাওয়া যায়— আর নিত্য নিজের মধ্যে আল্লাকে পাওয়া যায়। এর জন্য মুর্শিদ ধরতে হবে—মুর্শিদ ছাড়া হবে না।

আমার মন্তব্য

গোলাম শাহ ফকিরিতত্ত্ব সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা রাখেন এবং তিনি আচরণবাদী। সেই আচরণ আয়ত্ত করেছেন মুর্শিদ ধরে। তার ক্রিয়াকরণকে বলেছেন দমের জিকির— অর্থাৎ শ্বাসনিয়ন্ত্রণের এক বিশেষ পদ্ধতির সাহায্যে ঈশ্বরের ধ্যান। সে সম্পর্কে তাঁর তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক দুটি জ্ঞানই আছে। তিনি ভাববাদী নন— সাকার আল্লার রূপ বিষয়ে সচেতন ও বিশ্বাসী। ‘আকার না থাকলে জীবসৃষ্টি হত না’ এমন মন্তব্য সচরাচর শোনা যায় না। তবে আল্লাকে পেতে হবে মানুষের রূপে এটা ফকিরদের সার কথা। তীর্থ করলে আল্লা মেলে না, তাঁকে পেতে হবে মানুষের মধ্যে এ ধরনের কথা প্রচুর শোনা যায়— গোলাম তা আরও একবার আউড়েছেন মাত্র। সাধক হিসাবে তাঁর ভাবনার তেমন কোনও মৌলিকতা চোখে পড়ে না।

গোলাম শাহ-র কথা—৭

মানুষ কোনটা? হাত-পা-চোখ-নাক কান থাকলেই কি মানুষ? আমরা কি মানুষ? না। মানুষ আলাদা। মানুষের কর্মক্ষেত্রে মানুষকে চেনা যায়। ইসলাম শাস্ত্রে বলে— বিবেক-বুদ্ধি-বিচার, এই তিনটে যে অন্তরে রাখতে পারে সে মানুষ।

নবির মধ্যে মারফতিটাও ছিল। শরিয়ত আর মারফতে তফাত একটাই—অন্য কিছু নয়। শরিয়তে দেখার ও বাহ্যিক, আর মারফতে গোপন। নামাজ দমে পড়তে হয়, জিকির করতে হয়— এগুলো মারফতের কাজ। দমের সাধনা না করলে আল্লাকে পাওয়া যাবে না।

ফকিরি সাধনার পথে বহু লোকে বাধা দেবে। ভাল কাজে তো বাধা আছেই। আমিও বাইরে থেকে বাধা পেয়েছি, পরিবার থেকে বাধা পেয়েছি। যখন জানত না, তখন আমার পরিবারও বাধা দিয়েছে। যখন জানতে পারল যে এই পথ খারাপ নয়— তারপর আর কোনও বাধা নাই।

গোঁড়া মুসলমান বা মৌলবিরা এসব জিনিসের কিছু জানে না। তারা নিজেকে বড় ভাবে— যে আমার উপর আর কেউ নাই। …ভাবে— এরা কিছুই না, কিছু জানে না, ব্যোমভোলার মতো ঘুরে বেড়ায়, চিমটে বাজায় আর গাঁজা খায়। এদের কী দাম আছে? কে কি জানে সে সম্পর্কে লালন ফকির বলেছেন:

কুতর্ক কুস্বভাবী তাদের ঘরে নেয় না নবী

ভেদের ঘরে মেরে চাবি শরার মতে চালায়।

যারা নবির কাছে কুতর্ক, সুস্বভাব নিয়ে গেছে, নবি তাদের বলেছেন— তুমিই বড় জানলেওয়ালা বাবা, তুমি মক্তব-মাদ্রাসায় চলে যাও। আর যারা নতি স্বীকার করেছে, তাদের তিনি ভেদ খুলে দিয়েছেন। যাও বাবা, তুমি মাল নিয়ে যাও। …তবে ফকিররা মৌলানা-মৌলবিদের আসল কথাটাকে স্বীকার করে না। ওরা যেমন ফকিরদের পছন্দ করে না, তেমনি ফকিররাও বলে—ওরা কিছু জানে না, ওদের কাছে কিছু নাই। তবে ওরা কিছু না জানলেও ওদের পছন্দ করতে হয়; কেননা ওদের ক্ষমতা বেশি, দল বেশি।

আমার মন্তব্য

এতক্ষণে গোলাম শাহ মূল কথায় এসে পড়লেন। ফকিরদের পথ আর গোঁড়া মুসলমানদের পথ একেবারে আলাদা। মুসলমানদের কুতার্কিক বা কুস্বভাবী বলাটা হয়তো কিছুটা প্রান্তীয় মন্তব্য। তবে ভেদের (রহস্যের) ঘরে চাবি মেরে নবি তাঁদের শরিয়তি মতের বাহ্য করণকারণে পরিচালিত করেন আর আত্মসমর্পিত শান্ত ফকিরদের তিনি বুঝিয়ে দেন মূল রহস্যের জ্ঞান (মারেফত) এই তত্ত্ব বহুদিনের বিশ্বাসী ফকিরি তত্ব। বলতে গেলে এটাই তাঁদের দাঁড়াবার জায়গা। কিন্তু মুসলমানদের ক্ষমতা বেশি, দল বেশি বলে, ফকিররা তাদের বাধ্য হয়ে পছন্দ করে এ হল নির্মম সামাজিক সত্য। কারণ ফকিরদের মুসলমান মহল্লায় বসবাস করতে হয়। তাদের রীতিমতো বহু সময় অন্তত লোকদেখানো ভাবে পালন করতে হয়।

কিন্তু গোলাম শাহ-র একটা মন্তব্যে খটকা লাগে। তিনি জন্মসূত্রে ফকির এবং ফকির পরিবারেই বিয়ে করেছেন, তা হলে ফকিরি সাধনায় বাধা আসবে কেন? বাইরের বাধা হতেই পারে কিন্তু আত্মজনরা এমনকী স্ত্রী কেন প্রথমে বাধা দিয়েছিলেন?

গোলাম শাহ-র কথা—৮

আমাদের ওপর কোনও অত্যাচার হয়নি। এ ধরনের অত্যাহার হলে প্রতিবাদ কী করব? এতো সহ্যের রাস্তা। হজরত মহম্মদকেও অনেকে ঢিল মেরেছে, ফকিরদেরও যদি কেউ মারে, ঢিল ছোড়ে— সহ্য করতেই হবে।

ফকির হয়েছি বলে আমার মনে কোনও আপশোস নাই। কোনও প্রতিবন্ধকতাও নাই। প্রতিবন্ধকতা করতে হলে আমাদের বোঝাতে হবে। আমরা জোর গলায় বলি— যদি পারো আমাদের বোঝাও, না হলে আমাদের কাছে তুমি বোঝো।

আমার টাকাপয়সা নাই, সম্পত্তি নাই— আর আমি এসব চাইও না। ওসব পেতে আমার কখনও মন হয় না— অন্য কারও হয় কিনা জানি না। আমি যা আছি খুবই ভাল আছি— ওসব সম্পত্তিঅলা লোকেদের থেকেও ভাল আছি।

আমার মন্তব্য

গোলাম শাহ ফকিরের আত্মতুষ্টি বেশ তারিফ করার মতো। টাকাপয়সা সম্পত্তি তিনি চান না, এমন মনোভাব সংসারী মানুষের পক্ষে স্বাভাবিক নয়— তার মানে তিনি মনেপ্রাণে ফকির। এ প্রসঙ্গে অনিবার্যভাবে বাউলদের কথা মনে আসে। তাদের মধ্যে ঘুরে দেখেছি, অন্তত এখন। বয়স্ক বাউলদের মধ্যেও খুব অতৃপ্তি, খুব প্রতিষ্ঠাকামিতা, খুব প্রচারপ্রবণতা কয়েকজন ব্যতিক্রম। এই বহিরঙ্গ জগতের প্রতি সাম্প্রতিক আকর্ষণ বহুরকম সুযোগ সুবিধার সূত্রে তৈরি হচ্ছে। তার মধ্যে সবচেয়ে বড় ঘটনা হল শহরে বাউলদের গানের সমাদর ও ব্যাপক চাহিদা। প্রচার-মাধ্যম খুব তৎপর বাউলদের তুলে ধরতে। ফকিরদের ক্ষেত্রে এমন ঘটেনি, তাই তাঁদের মধ্যে এখনও সহজ সরল জীবনবোধ অবিচল আছে।

গোলাম শাহ মানুষটি আসলে গান পাগল এবং মধ্যপন্থী স্বভাবের। উচ্চাশা যেমন নেই তেমনই কোনও বিরোধী ভূমিকাতেও যেতে রাজি নন। কখনও তাঁর বা তাঁর চেনাজানা বীরভূমের ফকিরদের ওপর অত্যাচার হয়নি বলে প্রতিবন্ধকতার আসল চেহারা তাঁর দেখা নেই! সেটা নিয়ত দেখছেন গত দু’-তিন দশক ধরে নদিয়া-মুর্শিদাবাদের ফকিররা। সামাজিক বয়কট, শারীরিক নিগ্রহ এবং ধর্মীয় উৎপীড়ন তাঁদের মরিয়া করে তুলেছে। তাঁরা সংঘবদ্ধ হয়ে প্রতিবাদের ঝড় তুলেছেন। মহম্মদকে ঢিল ছুড়েছিল তিনি সয়েছিলেন, তাই এখন যদি কেউ ফকিরকে মারে তবে সইতে হবে— গোলাম শাহ-র এই সহনশীলতা এখনকার দিনে অচল। তাসলে বীরভূমের ফকিররা পরস্পর বিচ্ছিন্ন, দরিদ্র ও অলস প্রকৃতির। অনেক সন্তানসন্ততি আর দুই পত্নী নিয়ে ভিটেমাটিহীন চাহিদাহীন এমন ফকির আমাদের সমাজের একটা স্ববিরোধ আর বৈপরীত্যের চেহারা ফুটিয়ে তুলছেন নিজের অজান্তে। হেমাঙ্গ বিশ্বাস লক্ষ করেছিলেন, লোকায়ত বাউল মতবাদে বিভিন্ন পশ্চাদমুখী ধর্মীয় মিশ্রণ। তার ফলে বাউল ফকিররা শ্রমজগৎ থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে আত্মকেন্দ্রিক দর্শনের মধ্যে নিমজ্জিত করতে চেয়েছিলেন। উৎপাদনকারী শ্রমজীবন থেকে সম্পূর্ণ বিশ্লিষ্ট ফকিরদের আত্মরতি তাঁকে ব্যথিত করেছিল।

গোলাম শাহ একজন টিপিকাল ফকির। ধনমান তো নয়ই, এমনকী ‘একটুকু বাসা করেছিনু আশা’-ও তার মধ্যে নেই। আশ্চর্য।

মহম্মদ জালাল শাহ-র কথা—১

আমার নাম মহম্মদ জালাল শাহ। পিতার নাম মহম্মদ নায়েব শাহ। জন্ম দুবরাজপুরের ফকিরডাঙায়। বয়স এখন ১৪০৭ সালে বিয়াল্লিশ বছর।

আলম বাবা ডেকেছিলেন— তাই আমাদের পূর্বপুরুষরা এই স্থান বেছে নিয়েছিলেন। আমার দাদু, মানে বাবার বাবা, এখানে প্রথম আসেন। দাদুর নাম মহম্মদ দায়েম শাহ। আমার দাদুর বাবার নাম ছিল মহম্মদ ভ্রমর শাহ। থাকতেন বর্ধমানের চুরুলিয়ায়। আমার দাদুর জন্মমাটি চুরুলিয়া। তারপরে তিনি এখানে চলে আসেন। আমাদের বংশটা ফকিরের বংশ। ফকিরের সঙ্গে ঘোরা আর বাবাদের সেবাই আমাদের কাজ। বংশের ধারা অনুযায়ী আমি ফকির হয়েছি। ছেলেবেলা থেকেই আমার মনে এই ভাবনা ছিল। এই শিক্ষাদীক্ষার দিক দিয়ে আমি বাবার কাছে বায়েদ হয়েছি। ফকিরি সাধনা আর গানবাজনা করি।

আমার মন্তব্য

ফকিরদের স্বভাবের মধ্যে স্থায়ী বাস্তু এবং সেখানে বরাবর থাকার বাসনা কম থাকে। এর কারণ তাঁদের কোনও জমিজিরেত বা চাষবাস বড় একটা থাকে না। মাটি-জমি-ফসল মানুষের একটা বড় বন্ধন। দায়েম শাহ খুব বড় মাপের ফকির ছিলেন, ভ্রমর শাহ-র সন্তান। কিন্তু বর্ধমানের অন্তর্গত চুরুলিয়া গ্রাম থেকে দায়েম শাহ চলে এলেন দুবরাজপুরে আলম শাহ নামে এক উচ্চস্তরের ফকিরের আহ্বানে। তাঁকে ধরে এখন ফকিরডাঙায় চার পুরুষের ভিটে। কিন্তু ঠিক ভিটে নয়, কারণ জমিটা তো আলমবাবার। তাঁর সমাধিও ওখানে।

জালাল শাহ-র ক্ষেত্রে যেটা নতুনত্ব তা হল পিতার কাছেই ফকিরি দীক্ষা। পিতা থেকে পুত্র এমন ক্রমে ফকিরি দীক্ষা হয়ে থাকে। বাউলদের ক্ষেত্রে হয় না। তাদের তো প্রধানত জন্মরোধের সাধনা। শিষ্যই সন্তানের মতো। তাই শিষ্যসেবক না বলে শিষ্যশাবক বলেন অনেকে।

জালাল শাহ-র কথা—২

ফকিরি সাধনা একটা অন্য জগৎ। ওই ফকিরি জগতে থেকে তাকে পাওয়া যায়। তাকে পেতে গেলে কিছু ধ্যান-জ্ঞান, নাম-চর্চা আর ক্রিয়াকরণ করতে হয়। সে সাধনা নিরিবিলি জায়গায় হয়। যে খুঁজে নেবার নিরিবিলি জায়গা সে ঠিক খুঁজে নেবে।

ফকিরি মত বলে— সর্বজনের কাছে যাও। ফকিরি মত মানেই সর্বমত। এই মতটা ইসলাম ধর্মের মধ্যেই আছে।

ফকিরি মত হচ্ছে— আমরা নির্জনে আল্লাকে পেতে চাই, আর সেটা পেয়ে আলোকারী করতে চাই। কিছু জানা হল, কিছু মানুষে জানল, কিছু বাতনে থাকল— এইটা হচ্ছে আলোকারী। মৌলানা-মৌলবিরা সবসময়ে বলছে জাহির, আর আমরা চাইছি বাতন। আমাদের কিছু বাতনের দরকার, উনাদের জাহেরের দরকার।

ফকিরি সাধনার মূল কথা— নিজেকে চিনতে হবে, না-চিনলে কিছু হবে না। নিজের ভেতরটাকে আগে সাফ করতে হবে, তবে বাইরের সবকিছু সাফ দেখা যাবে। আমার ভেতরটা যদি সাফ না থাকে, ময়লা থাকে, তা হলে আমি সব ময়লা দেখব।

আর নূরের সাধনা হচ্ছে— আলোকারী। সেটা গোপন— বলতে নিষেধ আছে।

আমার মন্তব্য

ফকিরি জগৎ সম্পর্কে জালাল শাহ-র মন্তব্য পড়ে বোঝা কঠিন যে, এসব অনুভব তাঁর নিজের অভিজ্ঞতালব্ধ না অন্যের মুখে শোনা। ‘তাকে পাওয়া যায়’ বা ‘তাকে পেতে গেলে’ বলতে উপাস্য বা আল্লাকে বোঝানো হচ্ছে ঠিকই কিন্তু ‘ধ্যান-জ্ঞান, নাম-চর্চা’ কথাগুলি ধূসর। ফকিরি সাধনায় নাম-চর্চা ব্যাপারটা কী? এমন কথা আমরা আগে শুনিনি।

ফকিরি মত বলেছে সর্বজনের কাছে যাও, এমন কথায় কোনও বিরোধ নেই কিন্তু ‘এই মতটা ইসলাম ধর্মের মধ্যেই আছে’ মন্তব্য বিভ্রান্তিকর। ইসলামে এমন কথা কোথায় আছে?

‘আলোকারী’ শব্দটি বেশ নতুন, অন্য কোনও ফকিরের কাছে আগে শুনিনি। নূরের সাধনাও আলোকারী কি করে হবে? তার কিছু প্রকাশ্য কিছু গোপন কে বলেছে? এক কথায় বলা যায় চল্লিশোত্তর বয়সের জালাল শাহ সাধক হিসাবে খুব একটা অগ্রসর নন বলে মনে হয়। তাঁর কথাগুলি সাজানো এবং পুনরুক্তিতে ভরা।

জালাল শাহ-র কথা—৩

আমার জীবিকা গান। এ ছাড়া কিছু দেখাশোনা করি— অর্থাৎ কিছু কিছু ব্যাধির চিকিৎসা করি। আর কিছু করি না। লেখাপড়া হয়নি। অভাবের সংসার ছিল— বাবা পড়াতে পারেননি। কিছুদিন ইস্কুলে গিয়েছিলাম, কিছু হয়েছিল— কিন্তু সেটা খেয়ে ফেলেছি। আমার ছেলেমেয়েরা এখন সবাই ইস্কুলে যায়।

বর্তমানে আমার ছয় মেয়ে। এক ছেলে। দুটি ছেলে মারা গেছে। ছেলে এখনও ফকিরি লাইনে আসার মতো হয়নি। দুই মেয়ের বিয়ে দিয়েছি। …আমার স্ত্রীও ফকির বংশ। উনি বায়েদ হননি। আগে শাহ না হলে শাহের ঘরে মেয়ে যেত না, মেয়েও আসত না। তবে এখন ফকির সম্প্রদায়ের বাইরেও মেয়ের বিয়ে হচ্ছে। আমার বিয়ে একটাই।

আমার স্ত্রী বায়েদ না হয়েও ফকিরি সাধনায় আছেন। গোপনে কিছু বায়েদ আছে। গোপনে যদি মারফত পাওয়া যায়, তা হলে গোপনে বায়েদও পাওয়া যায়।

আমরা জন্মনিয়ন্ত্রণ ব্যবহার করি না। সেটা কিছু লোকের জন্য আছে। ফকিরি মতে জন্ম নিয়ন্ত্রণ মানছে না।

আমার মন্তব্য

একজন অসহায় মানুষের সংলাপ কি এখানে শোনা গেল? অভাবের সংসারে বাবার সামর্থ্য ছিল না সন্তানকে পড়ানোর, লেখাপড়া হয়নি। অথচ জালাল শাহ মাত্র চল্লিশ বছর বয়সের মধ্যে আটটি সন্তানের জনক হয়েছেন, যার মধ্যে দু’জন অকাল প্রয়াত, বলা উচিত শিশু মৃত্যু। জন্মনিয়ন্ত্রণ তাঁদের ফকিরি মতে গ্রহণীয় নয়। অথচ মানুষটি বেশ আত্মসুখী।

গানের জীবিকা ছাড়াও জালাল ফকির কিছু টোটকা চিকিৎসা করেন। বিশুদ্ধ ফকির তাঁকে বলা যায় না। সংসারী মানুষের মতো তাঁর আত্মোপলব্ধি।

জালাল শাহ-র কথা—৪

বাস্তুভিটা ছাড়া আমার কোনও জমি-জায়গা নাই। বাবার স্থান থেকে কুড়িয়ে-বাড়িয়ে যা পাই তা থেকে সংসার চলে। এ ছাড়া গান-বাজনা করি, তাগা-তাবিজ করি— এ থেকেও কিছু চলে আসে। এইভাবে মোটামুটি কোনওরকমভাবে চলে। এ ছাড়া আর কোনও রোজগার নাই কিন্তু আমি ফকিরই থাকতে চাই— অন্য কিছু করার কথা কখনও মনে আসে না। সরকারের সাহায্য কখনও পাইনি। বাবা থাকতে আগে সরকারি অনুষ্ঠানে গান করতে গেছি। এখন যাওয়া হয় না বাইরে। এরকম ডাক অনেকদিন আসেনি। সরকারি সাহায্য কখনও চাইনি, আশা করিনি।

আমার জীবনে প্রথম শেখা গান—‘বন্ধুর বাড়ি হতে রে মন/আইছি অনেকদিন গো আমি’ দায়েম শাহ ফকিরের লেখা। এই গানটা সবসময় গাইতে ইচ্ছা করে। আমার নিজের গানও আছে দু’-একটা।

আমার মন্তব্য

জালাল শাহ একেবারে রিক্ত ফকির। ফকিরডাঙার দায়েম শা-র যে আস্তানা ছিল তার দাতা সম্ভবত তাঁর মুর্শেদ আলমবাবা। সেই আস্তানাই জালাল-কথিত বাস্তুভিটা। আলম বাবা আর দায়েম শা-র সমাধি মুখোমুখি আছে ফকিরডাঙায়। ভারী শান্ত ও নিস্তব্ধ স্থান, দেখলে মনে ভক্তিভাব জাগে। জায়গাটা সম্পর্কে সাধারণ মানুষের খানিকটা শ্রদ্ধা ও সম্ভ্রম আছে, তাই অনেকে মানসিক করে, টাকাপয়সা দেয়। এ ছাড়া এই আশ্রমের গা বেয়ে, আক্ষরিক অর্থে ছুঁয়ে, দিনেরাতে ক’জোড়া অন্ডাল-সাঁইথিয়া ট্রেন চলে। তার যাত্রীরা টাকাপয়সা ছুড়ে দেয় জানলা দরজা দিয়ে। ফকির বাড়ির মেয়েরা ট্রেন চলে গেলেই ‘কুড়িয়ে বাড়িয়ে’ সেগুলো জড়ো করে। তাই দিয়ে চলে ফকিরের সংসার। এর বাইরে গানবাজনা করে আর তাগা-তাবিজ দিয়ে ক’ পয়সা আর হয়?

‘কিন্তু আমি ফকিরই থাকতে চাই’—এরপরও এমন ঘোষণা বোঝায় যে, জালাল অন্তরে বাইরে ঘোরতর ফকির। কেউ কেউ কি বলবেন, পলায়নবাদী? না, এদের সম্পর্কে সরকারি বদান্যতা আশা করা যায় না। পরিচিতি নেই, প্রচার নেই—সরকার জানবেই বা কী করে? সরকারি ডাক আসেনি বহুদিন, জালাল আশাও করেন না, উদ্যমও নেই। গোলাম শা-র মতো জালাল নানা জায়গায় প্রোগ্রাম করেন না তাই লোকে তাঁকে চেনে কম। তবে জালাল একদিক থেকে এগিয়ে আছেন—তিনি নিজে গান লিখে সেই গানে সুর বসিয়ে গাইতে পারেন। তাঁর গান ও গায়ন সংরক্ষিত হলে ভাল হয়।

জালাল শাহ-র কথা—৫

ফকিরি সাধনার রাস্তায় ভেতর বা বাইরে থেকে বা নিজের মন থেকেও কখনও কোনও বাধা পাইনি। বাধা দেবার মতো তেমন কেউ কেউ আছে— কিন্তু আমি তেমন কাউকে দেখিনি, বা আমার কাছে এসে দাঁড়াতে পারে না।

শুয়োরকে মৌলানা মৌলবিরা হারাম বলবে— আমরা হারাম বলব না। আমি খাই না; ঠিক আছে, কিন্তু হারাম বলাটা ঠিক নয়। শুয়োরকেও সেই তো সৃষ্টি করেছে, তাকে ঘৃণা করা ঠিক নয়।

আমরা গান-বাজনা করি। কেউ হয়তো ডেকে নিয়ে গেল, বলল— কালীমন্দিরে গান করতে হবে। তা হলে করতে হবে। এইবারে আল্লা-হরি দুটিকেই মিশিয়ে বলতে হবে। ফকির-মস্তান হচ্ছে—সর্ববিরাজী। সব জায়গায় যেতে পারে, যেখানে ইচ্ছা সেখানে যেতে পারে। কিন্তু মৌলবিরা সেখানে যাবে না।

আমার মন্তব্য

জালাল শাহ তাঁর ফকিরি সাধনায় ভেতরে বাইরে কোনও বাধা পাননি, কারণ তাঁরা বংশগতভাবে ফকির। নিজের মধ্যে বাধা পাননি কারণ জন্মেই তো আলম বাবা আর দায়েম শা-র মাজারের ছত্রচ্ছায়ায় রয়েছেন। তেমন বিদ্যালাভ ঘটেনি, জমিজমা নেই— কণ্ঠে সুর ছিল, পিতার কাছে একটু-আধটু শিখে চালিয়ে যাচ্ছেন। খুব বড় মাপের পারফরমার নন গোলাম শা-র মতো। তাঁর বিরুদ্ধাচরণ কে করতে যাবে? কেনই বা? তা ছাড়া দুবরাজপুর প্রধানত হিন্দু জনবসতির স্থান। একজন দু’জন ফকির সেখানে সমাজস্রোতের অংশ। দেখাই যাচ্ছে, কালীমন্দিরে গান করার আহ্বান তাঁর কাছে এসেছে বা আসে।

আসলে জালাল শা-র মনের মধ্যে অনাবিল ঔদার্য রয়েছে, যেটা আবহমান কালের ফকিরি ধারা। আল্লা আর হরিকে মেলাতে তাঁর অসুবিধা হয় না। আল্লাকে মহান স্রষ্টা বলে মানেন বলে, মানুষ আর শুয়োরকে হালাল হারাম ভেদ করেন না। সবচেয়ে সার কথা, যেটা তাঁর মনে হয়েছে, ফকিররা সর্ববিরাজী। তাঁদের চলমানতা এক মহৎ গুণ এবং সব কিছু গ্রহণ করার আগ্রহ। মোল্লা মৌলবিরা অনেকটা বদ্ধ জীব— শাস্ত্ৰবন্ধনে, মসজিদ এবং শরিয়তি আচার মার্গে।

জালাল শাহর কথা—৬

ফকির আর বাউল বেশি দূরের নয়। গান-বাজনা ও কিছু মনোভাব নিয়ে বাউল ফকির কাছাকাছি আসে। কৃষ্ণতত্ত্ব ও মুর্শিদতত্ত্ব—মূল একটাই। তারপর এটাকে ভাগ করে নেওয়া হয়েছে। সাধু-সন্তদের মতো সাধনায় ফকিরদেরও বাহ্যজ্ঞানশূন্য দশা হয়।

গান গাওয়ার সময় সাদা ধুতি লুঙ্গির মতো পরি, সাদা পাঞ্জাবি পরি, গলায় একটা গামছা থাকে। সেটা রঙিন হতে পারে, আবার সাদাও হতে পারে। মাথায় হয়তো একটা পাড় বেঁধে নিলাম। গায়ে আলখাল্লাও পরে নিতে পারি।

গানের সঙ্গে বেহালা, ডুবকি, দোতারা, গাবগুবি, করতাল, চিমটে ব্যবহার করি। আরও কিছু যন্ত্র হলে ভাল হয়, যেমন—ঢোল, হারমোনিয়াম।

চুল রাখাটা আমাদের ধর্ম। হাতে যে লাঠি (‘আসা’) থাকে, সেটা হল হাতের সম্বল। যখন যেখানে গেলাম, বসলাম—হাতে একটা আসা থাকল। ফকিরদের ব্যবহৃত জিনিসের মধ্যে কিস্তি, লোটাকম্বল, ঝোলা, ‘আসা’ সবই থাকবে।

আমার মন্তব্য

জালাল শাহ ফকির হলেও কোনওভাবে তাত্ত্বিক নন। বেশির ভাগই শোনা কথা বলেন। আজহার খাঁ কিংবা আবু তাহেরের মতো তাত্ত্বিক ও চিন্তাশীল ফকিরদের সঙ্গ করেছি বলে এটা বুঝতে পারি। শাস্ত্র ও শরিয়তের বিরুদ্ধতা করতে গেলে পঠন পাঠন দরকার। তার জন্য ঘরগৃহস্থী দরকার। চাই শান্ত আত্মমগ্ন অবকাশ। চাই আরও দু’-একজন তাত্ত্বিক ও বিরুদ্ধপক্ষ। ব্যক্তিজীবনে আবু তাহের ও আজহার খাঁকে বহুবার আলেম বা মোল্লাদের সঙ্গে ‘বাহাস’ করে মোকাবিলা করতে হয়েছে। জালাল শাহ এঁদের তুলনায় অনেক অনুজ ও অর্বাচীন। তাই কৃষ্ণতত্ত্ব ও মুর্শিদতত্ত্ব মূলে এক এ ধরনের মন্তব্য জেনে বুঝে করা নয়, মুখের কথা। বেশ শুনতে লাগে। ফকির ও বাউল বেশিদূরের নয় হয়তো, কিন্তু কারণটা অন্তত জালাল শাহ বর্গের ফকিরদের অধিগম্য হওয়ার কথা নয়।

জালাল সব অর্থেই পরম্পরাগত টিপিকাল পথের ফকির। গানের সহযোগী বাদ্য-আয়োজন কিংবা গান গাওয়ার সময়কার পোশাক-পরিচ্ছদে কোনও মৌলিকতা নেই। ব্যবহার্য সামগ্রীও ধারাগত— সেই কিস্তি, ঝোলা, আসা। চুল রাখাটা ফকিরদের ‘ধর্ম’ নয়, যেমন ভেবেছেন জালাল, এটাও বহুদিনের অভ্যস্ত বিষয়।

জালাল শাহ-র কথা—৭

বাউলদের মতো ফকিররা চারচন্দ্রে সাধনা করে না। খায় না। ফকিররা ওকে কন্ট্রোল করতে পারে। প্রস্রাব পায়খানা ফকিররা ছ’দিন-সাতদিন পর্যন্ত কন্ট্রোল করতে পারে। সাধনায় বসেছি। যতক্ষণ সাধনা শেষ না-হচ্ছে উঠছি না, ততক্ষণ ওকে কন্ট্রোল করা যাবে।…খাওয়া বন্ধ থাকে—হয়তো খালি জলই খেলাম, বা চা হল তো খেয়ে নিলাম। হাল্কা রাখতে হবে খাবার, তা হলে ওগুলো সব কন্ট্রোল থাকবে। ফকিরদের কাছে এই খাওয়া-দাওয়া কন্ট্রোল করাটা কোনও ব্যাপার নয়। আগে আমি গাঁজা-টাজা খুব খেতাম—পনেরো ভরি, যোলো ভরি গাঁজা খেতাম—এখন খাই না, মনও চায় না।

ফকিরি সাধনায় যুগল-সাধনাও আছে, আবার নির্জনে সাধনাও আছে।.…ফকিরদের দমের সাধনা যেমন আছে, বস্তুসাধনাও আছে।…আমরা জিকিরটাকেই বেশি গুরুত্ব দিই—জিকির করা মানেই শ্বাসকে কন্ট্রোল করা। দমের জিকির সব সময়েই হচ্ছে। দমে জিকিরের মানেই হচ্ছে— সে দমে আসে, দমে যায়। এই দমের তো কোনও ভরসা নাই। … নিশ্বাসকে বিশ্বাস নাই। নিশ্বাসকে আজও পর্যন্ত কেউ ধরে রাখতে পারল না।— বহুত জপ-তপ তপস্যা করেও।

আল্লাকে সম্পূর্ণ জানাও যাবে না। শেষ নাই। যুগে যুগে সাধকেরা আসবেন—তারা আরও জানাবেন—শেষ হবে না। শেষ যেদিন হবে—সেদিন তো রোজ কেয়ামত হবে।

আমার মন্তব্য

ফকিররা চারচন্দ্রের সাধনা করেন না, খবরটি ঠিক নয়। আমি এমন অনেক ফকির দেখেছি। মজার কথা যে, জালাল নিজেই পরে বলেছেন ফকিরদের ‘বস্তুসাধনাও আছে’। বস্তু শব্দের তাৎপর্য আমরা জানি। সেটাই তো রসরতির সাধনা।

তবে খাদ্য সংযম বা প্রস্রাব দমন যে ফকিরি সাধনার বিশেষ লক্ষণ তা আমরা জানি। দমে জিকিরের পদ্ধতি এঁদের সাধারণ করণকৌশল। ফকিরের গাঁজা বিষয়ে তীব্র আসক্তি ও পরবর্তী অনীহা বিষয়টি বেশ চমকপ্রদ স্বীকারোক্তি।

জালাল শাহ-র বাচনিক কৌশল খুব সুন্দর ও সুবিন্যস্ত। ‘নিশ্বাসকে বিশ্বাস নাই’ বাক্যবন্ধটি চমৎকার। ‘আল্লাকে সম্পূর্ণ জানা যাবে না’ ফকিরদের পরম উপলব্ধি। আবু তাহের ফকির আমাকে বলেছিলেন, ‘তাঁকে জানা যায় না, এই জানাটাই সবচেয়ে বড় জানা।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *