পুরুলিয়ার ‘সাধু’ গান
পুরুলিয়ায় বাউল গান অনুসন্ধান করতে গেলে আমার আশ্চর্য অভিজ্ঞতা হয়। সেখানকার স্থায়ী বাসিন্দাদের মধ্যে গান বিষয়ে যাঁরা অভিজ্ঞ বা উৎসাহী তাঁরা আমাকে নিরুৎসাহ করেন এই বলে যে, ‘এ-অঞ্চলে বাউল নাই, সবই ঝুমুর।’ পুরুলিয়া শহরে প্রখ্যাত ঝুমুর গায়ক কুচিল মুখোপাধ্যায় আধুনিক কালের মানুষ। একটি উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ইংরাজি পড়ান। তাঁকে বাউল গান বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলে সরাসরি জানিয়ে দেন, পুরুলিয়ার বাউল গানের কোনও ধারার কথা তাঁর জানা নেই। বড়জোর দু’-চারজন বাউল গায়ক থাকলেও থাকতে পারেন কিন্তু তাঁদের গানে কোনও মৌলিকতা বা স্থানিক বিশেষত্ব নেই।
এর পরবর্তী খোঁজখবরে শলাবৎ মাহাতোর কথা জানা গেল। তিনি পুরুলিয়ার সবচেয়ে বিখ্যাত লোকায়ত ঝুমুরশিল্পী, প্রবীণ ও প্রতিভাসম্পন্ন গায়ক। ঝুমুর গায়নের জন্য তিনি রাজ্য সরকারের ‘লোকসংস্কৃতি ও আদিবাসী সংস্কৃতি কেন্দ্র’-র পক্ষ থেকে লালন পুরস্কার পেয়েছেন। জানা গেল প্রধানত ঝুমুর গায়ক হলেও এখন বাউল গানও করেন। রাজ্য সংগীত একাডেমি প্রকাশিত ঝুমুর গানের সংকলনে বিস্ময়করভাবে কিছু মুদ্রিত বাউল গান পাওয়া গেছে। পুরুলিয়ার প্রবীণ মানুষ, রাজনৈতিক নেতা ও সাংস্কৃতিক কর্মী নকুল মাহাতো আমাকে জানান, পুরুলিয়ায় অনেক বাউল আছেন। তাদের পাওয়া যাবে ভেতরদিকের গ্রামে।
হয়তো কেন, নিশ্চয়ই বাউলরা আছেন, কিন্তু তাঁদের নাম-যশ বা পরিচিতি নেই। তাত্ত্বিক গুরুত্ব, গুরুপাট, আখড়া বা আশ্রম, শিষ্যমণ্ডলী তেমন উল্লেখযোগ্য কিছু নেই। থাকলে এতদিনে বাংলার বাউল গানের আসরে তাঁদের প্রতিনিধিত্বের চেহারা দেখা যেত।
এরপর খোঁজখবরের টানে পুরুলিয়া বেশ ক’বার যেতে যেতে পুরুলিয়া শহরের সাহিত্য ও সংস্কৃতিমনস্ক লেখক অজিত মিত্রের কাছে আমাকে নিয়ে গেলেন অধ্যাপক বন্ধু শ্যামাপ্রসাদ বসু। অজিত মিত্র আমাকে প্রথম পুরুলিয়ার ‘সাধু’ গানের খবর দেন এবং তাঁর সিদ্ধান্ত যে, পুরুলিয়ায় বাউল গানের শুন্যস্থান সাধুগানেই পূর্ণ হয়েছে। এ প্রসঙ্গে তাঁকে আমি অনুরোধ করি, সাধুগান সম্পর্কে তাঁর মতামত ও একটি প্রতিবেদন আমাকে লিখে পাঠাতে। ১৯৯৭ সালের ৩০ জুলাই তিনি ‘পুরুলিয়ার সাধুগান’ শিরোনামে যে লেখাটি আমাকে ডাকযোগে পাঠান, এখানে তার থেকে মূল কথাগুলি তাঁর ভাষাতেই উদ্ধৃত হচ্ছে। এই লেখা পড়লে একটা কথা স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে বাউল গানের প্রভাব বহুমাত্রিক আর বহুদূর বিস্তৃত। অঞ্চল ভেদে এর ভাব, বাণী ও আঙ্গিকের ভিন্নতর চেহারা পাওয়া যেতে পারে। তার জন্য আর একটু নিবিড় অনুসন্ধান এবং ভূমিপুত্রদের সহযোগিতার দরকার। অজিত মিত্রের রচনার সারাৎসার এইরকম।
পশ্চিম সীমান্ত রাঢ়ের অন্তর্গত পুরুলিয়া জেলায় বাউল সংগীতের প্রচলন খুবই কম। যা ইতস্তত ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে তাও প্রতিবেশী জেলা থেকে আমদানি করা। কিন্তু একথা অস্বীকার করবার উপায় নেই, ঐতিহ্যময়ী লোকসংস্কৃতির পীঠস্থান পুরুলিয়া জেলায় প্রচলিত ‘সাধু গান’ এবং ‘নির্গুণ ঝুমুর’ সংগীতের সঙ্গে বাউল গানের নিকট আত্মীয়তা সহজেই ধরা পড়ে। বাউল সংগীতের ক্ষেত্র বহু বিস্তৃত। সহজ সাধনের কথা তার উপজীব্য বিষয়। প্রধান উদ্দেশ্য সহজিয়া মত প্রচার। পুরুলিয়া জেলায় প্রচলিত সাধুগানের উদ্দেশ্যও অনুরূপ। নিঃসংকোচে বলতে পারি এই দুই ভিন্ন সম্প্রদায় একই ভিত্তিভূমির উপর প্রতিষ্ঠিত। উভয়ের মধ্যে গঠন প্রণালী ও বর্ণনায় সামঞ্জস্য দেখা গেলেও বাউল গানের সুর এবং নৃত্যে সাধুগন এবং নির্গুণ ঝুমুরের সঙ্গে একটা সুস্পষ্ট ভেদরেখা লক্ষ করা যায়। উভয় গানের গঠন-শৈলী বিচার বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় বাউল গানে প্রথমেই ধুয়া থাকে। আবার বহুক্ষেত্রে বাউল সংগীতের দ্বিতীয় চরণে ধুয়া এবং গানের শেষাংশে তার পুনরুক্তি ঘটে। কখনও দুই চরণ বা তদতিরিক্ত চরণের পরে এমন একটি চরণ রচিত হয় যার শেষাক্ষরের সঙ্গে ধুয়ার শেষাক্ষরের মিল থাকে এবং সেই চরণটি গাওয়ার পরই ধুয়া গাওয়ার রীতি সুবিদিত। সাধুগান এবং নির্গুণ ঝুমুরের অধিকাংশই একই প্রণালীতে রচিত হওয়ার ফলে বাউল গানের সঙ্গে একটা অলিখিত সাযুজ্য লক্ষ করার বিষয়। রচনা কৌশলে উভয়ের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠতর। উভয়ের মধ্যে হেঁয়ালি বা সান্ধ্যভাষার প্রয়োগ লক্ষণীয়।
সাধুগান এবং নির্গুণ ঝুমুরের মধ্যে একদিকে যেমন অতিশয়োক্তি, বিপরীতোক্তি এবং রূপকের ছড়াছড়ি, অন্যদিকে তেমনি দেহ ও মনকে সাধারণ পার্থিব রূপে কল্পনা করে কোনও এক অজানা সাধন জগতের ইঙ্গিত বহন করে। বাউল গানেও তার ব্যতিক্রম নেই। ভাব ও তত্ত্বের দিক থেকে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় বাউল সংগীত, সাধুগান ও নির্গুণ ঝুমুর একই খাতে প্রবাহিত।
বাউল সংগীতের বর্ণনীয় বিষয় বহু বিস্তৃত। সামাজিক, দৈহিক, আধ্যাত্মিক, লৌকিক, পারলৌকিক নানা বিষয় নিয়ে যেমন রচিত, অনুরূপভাবে সাধুগান এবং নির্গুণ ঝুমুরের গতিপ্রকৃতিও বহুমুখী। উভয় সম্প্রদায়ের রচয়িতা কল্পনার জগতে বিচরণ না করে চক্ষুকর্ণের দ্বারা উপভোগ্য পার্থিব বিষয়ের উপর গান রচনা করেন। কোথাও কল্পনার বিলাসিতা নেই। স্থূলভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় বাউল সংগীতের বর্ণনীয় বিষয় প্রধানত তিন প্রকার : দেহতত্ত্ব, সহজসাধন এবং বৈরাগ্য। এই তিনটি মুখ্য বিষয় সাধুগান এবং নির্গুণ ঝুমুরের মধ্যেও বর্তমান।
এই সম-ভাবনার নৈকট্যের উৎসমুখ কিন্তু একটিই। বাউল সংগীত, সাধুগানের প্রচলন যেকালে হয়েছিল তখন অধুনা বৃহত্তর বাংলার অস্তিত্ব ছিল না। পুণ্ড্র, রাঢ়, দক্ষিণ রাঢ়, সুহ্ম, বরেন্দ্র প্রভৃতি বিভিন্ন জনপদে বাংলাদেশ বিভক্ত ছিল। সুবে বাংলার উদ্ভব পরবর্তীকালে আকবরের সময়। এই বিভিন্ন জনপদগুলির মধ্যে পারস্পরিক স্বাতন্ত্র্য থাকা সত্ত্বেও একই সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের তান্তর্গত ছিল। খ্রিস্টীয় অষ্টম শতকে বৌদ্ধাচার্য লুইপাদ এই বিস্তীর্ণ অঞ্চলে প্রথম সহজধর্ম প্রচার করেন। লুইপাদ রাঢ়দেশের মানুষ। সুতরাং সিদ্ধাচার্য লুই এবং লুইপন্থীদের একদা বিচরণক্ষেত্র ছিল রাঢ় এবং পশ্চিম রাঢ়ের অন্তর্গত পুরুলিয়া জেলার বিস্তৃত অঞ্চল। সুতরাং বলতে পারি বাউল এবং সাধু উভয় সম্প্রদায়ই লুইপন্থী প্রচারিত সহজসাধন দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল। এই সহজসাধনাই উভয় সম্প্রদায়ের উৎসমুখ।
কালক্রমে সহজিয়া সম্প্রদায় পাঁচ ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে, তার মধ্যে বাউল সম্প্রদায় অন্যতম। এই পাঁচ ভাগের উপভাগ হল পুরুলিয়ার সাধু সম্প্রদায়। একই উৎসমুখ থেকে নির্গত হলেও নানা বিবর্তনে পরিবেশ ও কালের প্রভাবে উভয়ের মধ্যে একটি সূক্ষ্ম ভেদরেখা পরিলক্ষিত হয়। সুরে ছন্দে পার্থক্য প্রকট হয়ে ওঠে।
রমেশচন্দ্র বসু ১৩৩৩ সালের মাঘ মাসে প্রকাশিত ‘প্রবাসী’-র চতুর্থ সংখ্যায় ‘বঙ্গভাষায় বৌদ্ধস্মৃতি’ প্রবন্ধে যে অভিমত ব্যক্ত করেন তার থেকে আমরা নিঃসন্দেহ যে সাধুবাচক বাউল সম্প্রদায়ের একটি অংশ পুরুলিয়া জেলার অন্তর্গত বাঘমুণ্ডি থানায় আস্তানা গাড়ে এবং বাউল সংগীতের প্রচলন করে।
পুরুলিয়ার সাধুগানে সহজিয়া মতবাদের লক্ষণ সুস্পষ্ট। সাধুগানগুলিকে মুখ্যত কয়েকটি শ্রেণিতে বিভক্ত করা যায়। যথা— ১) আত্মদেহে ব্রহ্মাণ্ড দর্শন ২) গুরুভক্তি ৩) দেহতত্ত্ব ৪) বৈরাগ্য ৫) চৈতন্যলাভ ৬) বিবিধ সাধন : শৃঙ্গার সাধন, নায়িকা সাধন, কায়া সাধন।
সাধুপন্থীরা তাঁদের মতবাদ সমাজের সকল শ্রেণির মানুষের বোধগম্য করার জন্য স্বভাবতই লোকসংগীতের সুর আশ্রয় করেন। ফলে সমাজে সাধারণত নিম্নশ্রেণির মানুষ বলে যারা অভিহিত এবং আর্যসংস্কৃতি যাদের মধ্যে আজও প্রভাব বিস্তার করেনি তারা সাধুগানের মাধ্যমে সহজিয়া সাধন পদ্ধতিতে আকৃষ্ট হয়। সাধুগানের দুটি নমুনা দেওয়া গেল।
১.শুন সজনী রে সে আগুন জ্বলে দিবারজনী
নীচেতে চুল্হা আছে তাতে হাঁড়ি বস্যা আছে
সে আগুন জ্বলে দিবারজনী ॥ ধ্রু॥
বত্রিশটি চুল্হা আছেচুল্হার আঁচ কাছে কাছে
বিনা আগুনের গুণে রাঁধে রাঁধুনী ॥ ধ্রু॥
চারজন জ্বাল দিছেদুইজন চাল ফেলে
একজনাই ভাত ঢালে ঢালনী ॥ ধ্রু॥
জীবের এ চুল্হার মাঝেরবি শশি দুই আছে
বরজুদাসের দুটি ছাঁদনী ॥ ধ্রু॥
২. শুনো সাধু— ইত সাধু শুনে চমৎকার হে।
সুতাতে চলিল হাথি
সেই হাথি বেড়ি মাতোয়ার হে ॥ ধ্রু॥
সিংহ চলি যায়
মাছিতে ধরে খায়
তাও মাছির মা হল আহার হে ॥ ধ্রু॥
নাই মাতা নাই পিতা
বিনা মাতায় জুড়ে নাতা
বরজুদাস কী জানে তাহার হে ॥ ধ্রু॥