১.৬ ফানা থেকে বাকা

ফানা থেকে বাকা

সচরাচর বাউল-ফকির কথাদুটি আমরা শব্দদ্বৈতের মতো হাইফেনবদ্ধ করে উচ্চারণ করি, লিখি, কিন্তু তাদের কি এক বলে ভাবি? সাধারণ মানুষের কাছে, গবেষকদের কাছে গানের রসিকদের কাছে বাউল যে-পরিমাণ সমাদৃত, ফকিররা কি তার এক-দশমাংশ মনোযোগ পেয়েছে কোনওদিন? আজকাল চল হয়েছে বাউল গানের পাশে কোথাও কোথাও ফকিরি গানের আসর। সরকার ফকিরদের দিকে নজর দিচ্ছেন গত দু’-এক দশক—সেটা শুভলক্ষণ। শান্তিনিকেতনের পৌষমেলায় বাউল আর ফকিরদের আলাদা দুই আস্তানা, আলাদা অনুষ্ঠান—সেটা নিন্দার্হ। নদিয়া-মুর্শিদাবাদের বাউল আর ফকিররা মৌলবাদীদের হাতে অত্যাচারিত ও নিগৃহীত হতে হতে শেষ পর্যন্ত রুখে দাঁড়াতে সম্মিলিত হয়েছেন, তাঁদের সংগঠনের নাম ‘বাউল-ফকির সংঘ’— এই প্রয়াস অভিনন্দনীয়। কিন্তু একটু নজর করলে নানা ভাঁজ চোখে পড়ে। দৃশ্যতই বোঝা যায়, সমাজে বাউলদের যে মান্যতা ফকিরদের তা নেই। আমাদের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত সভা-সমিতি সম্মেলনে আমরা বাউলদের ডাকি, ফকিরদের নয়। বেশ ক’জন বাউল গান গেয়ে সম্পদশালী হয়েছেন, গাড়িবাড়ি করেছেন এতে কোনও অলীক বার্তা নয়, কিন্তু ফকিরদের আজ পর্যন্ত কোনও সামাজিক বা অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠার খবর আমার কাছে নেই। বিদেশে গত তিন দশক যাঁরা বাউলদের নিয়ে যাচ্ছেন ও মঞ্চে নাচাচ্ছেন গাওয়াচ্ছেন, লিখছেন গালভরা হ্যান্ডআউট তাঁদের অনুষ্ঠানপত্ৰীতে, তাঁদের বিন্দুমাত্র উৎসাহ বা আবেগ নেই ফকিরদের বিষয়ে। প্রতিবছর বীরভূমের পাথরচাপুড়িতে ‘দাতা বাবার’ নামে যে বার্ষিক জমায়েত হয় ফকিরদের, সেখানে বাবুসম্প্রদায় কিংবা ছাত্রছাত্রী গবেষকদের বড় একটা দেখা যায় না। ফকিরদের নিয়ে দূরদর্শন প্রতিবেদন কিংবা ডকুমেন্টারি ফিল্ম ততটা হয়নি। তাঁদের গানের ক্যাসেট যদি বা হয়ে থাকে তবে তার প্রচার বা সমাদর হয়নি। ফকিরদের মধ্যে থেকে কোনও পূর্ণদাস বা পবনদাসেরা এখনও উঠে আসেননি, যাঁরা আন্তর্জাতিক গানের বিশ্বে দাপাবেন। প্রকৃত ফকিরদের নিয়ে আজ পর্যন্ত সবিস্তারে প্রকৃত বাংলা ছোটগল্প লেখা হয়েছে কি সন্দেহ, সফল উপন্যাস তো অসম্ভব। অথচ বাউলদের নিয়ে অনেক লেখা রয়েছে কথা সাহিত্যে। ফকিরিগানের সংকলনও করেননি কেউ। তবে রাজ্য সংগীত আকাডেমির পক্ষে কঙ্কন ভট্টাচার্য ফকিরি গান টেপরেকর্ডারে ধরেছেন, গ্রামে গ্রামে ঘুরে, সেটা জানি। ‘লোকসংস্কৃতি ও আদিবাসী সংস্কৃতি কেন্দ্র’ ফকিরি গানে উৎসাহ দিচ্ছেন— এগুলি ব্যতিক্রম। আরেকটি উজ্জ্বল ব্যতিক্রমী উদাহরণ দুবরাজপুরের ফকিরডাঙার ‘অচিনপাখি’, সংস্থা, যাঁরা তাঁদের পত্রিকায় ফকিরিগান ছেপে চলেছেন এবং বেশ ক’বছর ‘অচিনপাখি’ নামে গরিব ছাত্রদের সঙ্গে ফকিরদের সন্তানদের প্রাথমিক বিদ্যাচর্চার পরিবেশ গড়েছেন।

কিন্তু সাধারণভাবে পশ্চিমবঙ্গে ফকিররা পড়ে আছে সমাজের একটেরে। উপেক্ষিত, অনাদৃত। অসহনীয় দারিদ্র্য আর অনপনেয় অশিক্ষা তাদের জন্ম জন্মান্তরের বিধিলিপি। হিন্দু সমাজ বাউলদের দেখে, ফকিরদের উপেক্ষা করে। মুসলমান সমাজ ফকিরদের ঘৃণা করে, কারণ তারা বেনামাজি, রোজা রাখে না, গান করে প্রকাশ্যে (যা নাকি ইসলামে নিষিদ্ধ) এবং ধর্মনেতাদের মান্য করে না। কিন্তু অনীহার আসল কারণ অন্য। ফকিররা মুসলমান শরিয়তি নির্দেশ না মেনে বেরিয়ে গেছে নিজেদের পথে, খুব একটা গ্রাহ্যও করে না মূল স্রোতকে। ধর্মের বাহ্য আচারে তাদের আস্থা নেই। লোকদেখানো আন্দাজি পথ তাদের অপছন্দ। তারা আত্মমগ্ন উদাসীন ও আত্মতৃপ্ত।

আমাদের প্রতিদিনের জীবনে ফকিরদের নিয়ে যে কোনও ভাবনা নেই, করণীয় কর্তব্য নেই, পরিকল্পনা নেই তার মূলে কিন্তু ফকিরদের অদ্ভুত জীবনশৈলী। তাদের তো কিছুমাত্র ভোগসুখ বা ভালভাবে বাঁচার বাসনা নেই। উপাস্যকে তারা অন্তরে চায় বলে পার্থিব কিছু চায় না, অথচ বৈরাগীও নয়। অনেকেই জন্মনিয়ন্ত্রণে অবিশ্বাসী, বেশ ক’টি সন্তান সন্ততি নিয়ে চালাঘরে খেয়ে না-খেয়ে বেঁচেবর্তে থাকে। চাহিদা নেই, প্রতিষ্ঠাকামী নয়, ঘরে বিদ্যুৎ নেই, আসবাব নেই, আদবকায়দা নেই। অথচ আশ্চর্য সেবাপরায়ণ এবং অতিথিসৎকারে সদা সতর্ক। বিনীত, অকৃত্রিম, অনভিজাত ও অনাড়ম্বর। সবকিছু ত্যাগ করে তবে তো ফকির হওয়া যায়। ওরা নিজেরাই বলে ফকিরের কোনও ফিকির নেই। বাউল-ফকির উভয়েরই অবশ্যমান্য লালন শাহ একটা গানে বলেছেন :

ফেরেব ছেড়ে কর ফকিরি।

আসল ফকিরি মতে

বাহ্য আলাপ নাইগো তাতে।

‘ফেরেব’ শব্দটার অর্থ বোঝা যাবে ‘ফেরেব্বাজ’ কথাটির অনুষঙ্গে, অর্থাৎ প্রতারক, মিথ্যাবাদী, ধান্দাবাজ। এইসব ত্যাগ করে তবে ফকিরি ধর্ম পাওয়া যাবে। আসল ফকিরি মতে বাহ্য আলাপ থাকে না, অর্থাৎ তার সবটাই অন্তর্জগতের ব্যাপার, ধ্যানময় ও নীরবতালব্ধ। এমনতর, উচ্চাকাঙ্ক্ষাহীন ফকিরিপথও খুব নিষ্কন্টক নয়— কারণ চারপাশে বহুতর প্রতিকূল ও প্ররোচনা। লালন তাই বলতেন :

ফকিরি করবি খ্যাপা কোন্ রাগে।

হিন্দু মুসলমান দুইজন দুই ভাগে ॥

আছে বেহেস্তের আশায় মোমিনগণ

হিন্দুদিগের স্বর্গের মন ॥

ফকিরি সাধনায় এটাই বড় বিঘ্ন। সমাজের হিন্দু মুসলমানে মিলমিশ নেই, দুইজন দু’ভাগে বিভাজিত। তবে তাদের দু’জনেরই লক্ষ্য এক, ঐহিক নয়— পারত্রিক। ধর্মনিষ্ঠা মোমিন মুসলমান চায় বেহেস্ত, হিন্দুরা চায় স্বর্গ। ফকির এর কোনওটাই কামনা করে না। সে চায় আত্মস্থ হতে। জপ ধ্যান জিকির তার কাম্য। কাম্য আল্লা। তাই তাঁর ধ্যানে সে ‘ফানা’ হতে চায়। হতে চায় দিওয়ানা। তার কাছে পার্থিব সবকিছু ম্লান, তাৎপর্যহীন, অসার। সেইজন্য প্রকৃত ফকির কোনওদিন আলোকিত মঞ্চে উঠে বৃত্তাকারে নাচবে না বাউলদের মতো, সাজবে না বর্ণময় চোখধাঁধানো বস্ত্রে, অলংকারে। আনন্দলহরী, ক্যাসিও, ডুগি তবলা, আড় বাঁশি, সারিন্দা, কিছুই তার লাগে না। বড়জোর একতারা বা দোতারা, ক্কচিৎ বেহালা। কিছু না থাকলে থালা বাজিয়ে চলে তাদের গান, চিমটেয় রাখে তাল। ‘ভোলামন’ বলে চেঁচিয়ে ওঠে না— মোটকথা কোনও ব্যাপারে তাদের ফিকিরি বা বাহ্য কিছু আড়ম্বর নেই।

ফকিররা জীবনবিমুখ বৈরাগী নয়, গেরুয়া পরে না। দীনবেশে একেবারে রাজভিখারি। এই জন্যই তাদের কথা কেউ জানল না— কেউ সমাদর করল না। তারাও সেটা চায়নি। সবার অধম হয়ে দীনাতিদীন হয়ে খোলামেলা নিসর্গের মধ্যে তাদের উপাস্যসন্ধান। তাদের কোনও পাঠ্যবই নেই, পাঠ্য হল ‘দেলকেতাব’— আত্মপাঠ। শরীরের মধ্যেই নাকি মসজিদ। সেখানে সর্বদাই চলছে দায়েমি নামাজ। রোজা মানে কায়মনোবাক্যের সংযম— সেতো রোজকার কাজ— সর্বদাই রোজা। হজ বা তীর্থে তাদের মতি নেই।

আমার গবেষণা-সহকারী দুবরাজপুরের সাতকেন্দুরির লিয়াকত আলিকে ভার দিয়েছিলাম বীরভূমের ফকিরদের সম্পর্কে পায়ে হেঁটে খোঁজ নিতে। লিয়াকতের নিজের বাড়ির খুব কাছে ফকিরডাঙা। সেখানে দায়েম শা ফকিরের সাধনার স্থান ও সমাধি। দায়েম শা-র সন্তানরা ওখানেই থাকেন। একবার সেখানে গিয়ে ফকিরি আস্তানা চাক্ষুষ দেখে এসেছি বছর দশেক আগে। লিয়াকতই নিয়ে গিয়েছিল। সেখানে মহম্মদ জালাল শাহ-র কণ্ঠে শুনেছিলাম দায়েম শাহ-র গান— সংগ্রহ করেছিলাম তার বেশ ক’টি। পরে লিয়াকত ঘনিষ্ঠ হয়ে পড়ে ওই ফকির পরিবারের সঙ্গে এবং আপ্ত ইচ্ছায় জালাল শাহ-র ছোটমেয়েকে বিয়ে করেছে। ব্যাপারটা খুব অভিনব, কারণ সাধারণত ফকিরদের সঙ্গেই ফকিরদের মেয়ের বিয়ে হয়। স্বাভাবিক সাংসারিকতাময় আমাদের যে জীবন, যাতে থাকে কিছুটা ভোগবিলাস, সাজাগোজা, ঘরগোছানো, সঞ্চয়স্পৃহা‌, দেখনদারি, আসবাব ও সম্পদ, সেতো ফকিরদের থাকে না। সেই বাড়ির মেয়ে কী করে এসে খাপ খাওয়াবে নিম্ন মধ্যবিত্ত সংসারের বাঁধা ছকে?

মেয়েটিকে লিয়াকতের মনে ধরেছিল বলেই বিয়ে করেছে নিশ্চয়। তবু কিছু মজা থাকে সবসময় তার মধ্যে। স্বভাব বাউন্ডুলে লিয়াকত। শিক্ষিত যুবক সে, আধুনিকমনস্ক। জাতিবর্ণভেদ বোঝে না। চমৎকার কবিতা লেখে। বাউলদের সঙ্গে চরম ঘনিষ্ঠতা। ইচ্ছে হলে প্রচণ্ড গাঁজা টানে। তাকে জিজ্ঞাসা করলাম : ‘লিয়াকত, তুমি একজন ফকিরের মেয়ে বিয়ে করলে কেন?’ লিয়াকতের চোখে কৌতুকহাস্যের ছটা খেলে গেল। বলল, ‘ফকিরের মেয়ে তো? কোনও ডিমান্ড নেই। কিছু চাইবে না। হা হা হা।’

আসলে ফকিরের সঙ্গেই ফকিরের মেয়ের বিয়ে হয়েছে। ভাবতে গেলে লিয়াকত মর্মে মর্মে পাকা ফকির। তারও কোনও চাহিদা নেই এই জীবনের কাছে। কিন্তু বিয়েটা একদিক থেকে জোড়কলমী। মুসলমান বংশের ছেলের সঙ্গে ফকির কন্যার বিয়ে। লিয়াকত অবশ্য জন্মেই মুসলমান, কিছুই মানে না। তবে মরমি মানবতাবাদী। তার শ্বশুরবংশটি বেশ। সেটা বলার মতো।

মহম্মদ ভ্রমর শাহ-র বাড়ি ছিল বর্ধমান জেলার চুরুলিয়ায়। জাত ফকির। তাঁর সন্তান দায়েম শাহ। আলমবাবা নামে এক ফকির দায়েমকে শিষ্য করে ডেকে নেন দুবরাজপুরের এই আলমডাঙায়। এখন সেটাই মুখে মুখে ফকিরডাঙা। দায়েম শাহ ছিলেন মগ্ন সাধক ও গীতিকার। ফকিরডাঙার শান্ত নির্জন গাছতলায় আলমবাবা আর দায়েম শাহ-র সমাধি দেখলে মনে তৃপ্তি আসে। আখড়ার গা বেয়ে চলে গেছে রেললাইন। দিনে যত আপ-ডাউন ট্রেন যায় ভক্তযাত্রীরা সমাধি তাক করে পয়সা ছোড়ে। খুব জাগ্রত থান হয়ে উঠেছে লোকবিশ্বাসে। কতজন মানসা করে।

দায়েম শাহ-র ছেলে জালাল শাহ। পেশা ফকিরি গান। ঘুরে বেড়ান গলায় গান নিয়ে। লিয়াকত এই ফকির বাড়িতে বিয়ে করে একটা নতুন ঢেউ তুলেছে। সে দেখল এদের হতদরিদ্র জীবনে কোনও অভিলাষ বা পার্থিব বাসনা নেই, শিক্ষাও নেই এক ফোঁটা। এখানে সে কয়েকজন হৃদয়বান বন্ধুর সাহায্য ও সহযোগে ‘অচিনপাখি’ বিদ্যালয় খুলেছে। ফকিরদের সন্ধানে এসে লিয়াকতকে আবিষ্কার ও তার বন্ধুতা অর্জন আমার জীবনের একটা বড় অভিজ্ঞতা। আর একটা সত্য এই যে, বাউলদের জানতে বুঝতে তাদের ডেরায় না গেলেও চলে কিন্তু ফকিরদের জানতে গেলে তাদের আস্তানায় যেতেই হবে।

বলা বাহুল্য, ফকিরদের হালহকিকত আমার চেয়ে লিয়াকত অনেক বেশি জানে, তবু সে বীরভূমের শাসপুরে আমিন শাহ ফকিরের সন্ধানে গিয়ে থ হয়ে যায়, কারণ তাকে দেখে একজন ফকির বলে মসজিদে নিয়ে যেতে। লিয়াকতের বিস্ময় মসজিদ শুনে। ফকিরদের মসজিদ হয় নাকি? কিংবা ফকিররাও কি তবে মসজিদে যায়? আসলে আলম শাহ বাড়ি ছিলেন না। আসবেন, এসে পড়বেন, সন্ধের আগে। ফকিরের বউ অচেনা অজানা লিয়াকতকে বলে, ‘চিন্তা নেই। ভাত খান, আরাম করুন— আজ থাকুন। কাল যাবেন।’

একেবারে খাঁটি ফকির পরিবারের অভ্যর্থনা, সেবাকুশল সত্তার উন্মোচন। অজ্ঞাতকুলশীলকে ভয় কীসের? চুরি ডাকাতি? বাড়িতে সামগ্রী বলতে কিছুই তো নেই। বেচারি লিয়াকত দুবরাজপুরের সাতকেন্দুরি থেকে বেরিয়ে তিন ঘণ্টা বাসে করে এসে, তারপরে শাসপুর পৌঁছেছে। একেবারে রুদ্ধশ্বাস অবস্থা। আমিন শাও নেই, অগত্যা থাকতেই হবে। কিন্তু মসজিদে নিয়ে যেতে বলছে কেন? তার অস্বস্তি লাগে। মসজিদের দিকে সে ঘেঁষে না। লিয়াকত ভাবল।

কাকে বোঝাব— মসজিদ মানে মিনার খিলান ও গম্বুজের আঙ্গিক অপরূপ সৌধ। যার ভিতরে থাকেন মৌলবি ও নামাজি মানুষজন। আমি নামাজি নই, আবার মৌলবিদের সঙ্গ ভাল লাগে না বলে দূরে থাকি।… বলতেই হচ্ছে আজ পর্যন্ত কোনও মৌলবি হাফিজকারী আলেম অর্থাৎ কোনও প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মীয় মুখপাত্রের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব হয়নি বা প্রগাঢ় আত্মিক সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি। বরং মৌলবিনা-মানা বেনামাজি (বাহ্যিকভাবে) ফকিরদের সঙ্গেই আমার প্রাণের টান, নাড়ির নিবিড় একাত্মতা। এমনকি আনুগত্যও।

লিয়াকত মাঝে মাঝে নিজে নিজে গেয়ে ওঠে আপন মনে :

মুরশিদ যার সখা তার কীসের ভাবনা?

যার হৃদয়মাঝে কাবা নয়নে মদিনা।

তার লেখা কবিতায় আছে আরেকটু ভেতরের কথা। যেমন :

মন্দির মসজিদের নামে ইটপাথরের খাঁচা নয়।

সহজ বংশীধ্বনির মতো—

নীড়ের থেকে নীড়

‘আয়না মহল’ যেখানে গড়ে উঠল

লালনের নৃত্য অপরূপ একতারা উঁচানো হাত ধরে।

অনেকদিন আগে জালাল শা ফকির তাকে বলেছিলেন মৌলবিদের সঙ্গে কেন ফকিরদের কোনওদিন মিলমিশ হয় না। জালালের বক্তব্য :

মৌলবি আলেম হাফিজকারীদের সঙ্গে ফকিরদের কোনওদিন মিল হবে না। চিরদিন বিরোধ আছে এবং কিয়ামত (মহাপ্রলয়ের দিন) পর্যন্ত থাকবে। আসলে কি, ওরা কোরআনের হাড়মাংস নিয়ে টানাটানি করে, আর আমরা ফকিররা আছি মগজ নিয়ে। একসঙ্গে ওঠা বসা সম্ভব?

এতসবের পরেও তাকে কিনা যেতে বলছে মসজিদে? লিয়াকত শ্লথ পায়ে এগোয়। পথ দেখাচ্ছে এক কিশোর। মৌলবি বা আলেমদের সঙ্গে ফকিরদের আরেকটা গুরুতর, অমিলের কথা লিয়াকতের চোখে পড়েছে। সে তাই উল্লেখ করেছেল:

মুলসমানত্বের নামে উর্দু— আংশিক হিন্দিরও— ভাষা-সংস্কৃতির ছাপ মৌলবির কথাবার্তা, পোষাক ও আচরণে যতখানি সুস্পষ্ট, তার কণামাত্রও বাংলা বা বাঙালির নয়। এখানেও ফকিরের অবস্থান সম্পূর্ণ বিপরীত। উর্দু-হিন্দি পরিত্যাগ করে এরা বাংলা ভাষাতেই রচনা করেছে গান, গাইছেও বাংলাতে। সাধনতত্ত্বের ভাবকে প্রকাশ করতে এরা আরবি ফারসি কখনও বা উর্দু শব্দ ও ভাবধারাকে আত্মীকরণ করে বাংলার ভাবধারা ও ঐতিহ্যের সঙ্গে মিলিয়ে নিয়ে বাঙালির নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতিকে আরও ব্যাপক, প্রসারিত ও প্রকাশক্ষম করে তুলেছে। মৌলবিদের মতো বাঙালি জাতিসত্তাকে উপেক্ষা করেনি, বরং সুহৃদ ও বন্ধু হয়ে উঠেছে। বাঙালির সাংস্কৃতিক আত্মপরিচয়ের প্রশ্নে ফকিরের উদার, মানবিক ও সমন্বয়বাদী ভূমিকাকে যে গোঁড়া ও পরগাছা মৌলবিরা হিন্দুয়ানীর ছাপ বলে অপব্যাখা করবে এবং শুদ্ধকরণের নামে খড়গহস্ত হয়ে সাধারণ মুসলমানদের লেলিয়ে দেবে তাতে আশ্চর্য কি?

এবারে কিশোরটি ছোট্ট একটা মাটির ঘরের সামনে লিয়াকতকে এনে খাদিমকে খুঁজতে লাগল। লিয়াকতের আবার ধন্ধ লাগে। মসজিদে তো খাদিম থাকেন না, খাদিম হলেন পিরের মাজারের সেবাইত। তবে? তালা খুলে ছেলেটা মাটির ঘরে ঢুকল। পেছনে লিয়াকত। দেখল,

ভিতরটা নিকানো, পরিচ্ছন্ন। এক কোণে জলের কলসি, পাশে গ্লাস। অন্য কোণে খেজুরপাতার দু’-তিনটে তালাই। দেওয়ালে ঝোলানো লণ্ঠন। তাকে কয়েকটা বই ও খাতা। … মেঝের উপর একটা তালাই বিছিয়ে ছেলেটি বসতে বলল। একটা ধাঁধার মধ্যে ভাবছি— মসজিদ বলে এ আমি কোথায় এলাম? এমন সময় একজন ঘরে ঢুকলেন। ছোটখাটো সাধারণ চেহারা, লুঙ্গির মতো করে পরা ধুতি, গায়ে গেঞ্জি। বললেন, ‘আমিই খাদিম।’

‘আমাকে মসজিদে নিয়ে যেতে বলল একটা লোক। আমি তো ঘাবড়ে গিয়েছিলাম’। খাদিম আমার দিকে চোখ ফেরালে বললাম, ‘যাক ছেলেটি সে কথা না শুনে আমাকে এখানে এনে ভালই করেছে।’

‘ছেলেটি আপনাকে মসজিদেই এনেছে। এটাই মসজিদ। এটা ফকিরের মসজিদ। আমরা ও মসজিদে যাই না।’

খাদিম ব্যাখ্যা করলেন, ‘মসজিদ কি? এবাদতখানা তো? আকার-প্রকার তো গৌণ। এটাই আমাদের এবাদতখানা।’

বিস্মিত হতবাক লিয়াকতকে খাদিম শোনালেন ফকিরিয়ানার সবচেয়ে সরল সত্য। খুব গরিব, রিকশাঅলা, ফেরিঅলা, জন-মজুর, ভিক্ষাজীবী গায়ক— যাদের জমি নেই, আছে সামান্য ভিটে, তারা ঘরে ঘরে চাল পয়সা জমিয়ে বহুদিনের চেষ্টায় গড়েছে এই মসজিদ। কারোর সাহায্য নেয়নি। ফকিরদের তৈরি ফকিরদের জন্য মসজিদ। লিয়াকত ঘুরে ঘুরে ফকিরদের অনেক গান সংগ্রহ করেছে সেটা বড় কথা নয়, তার চোখ দিয়ে সে চিনিয়েছে ফকিরিতন্ত্র সেটাই তার সবচেয়ে বড় কাজ। ওই যে একবার একজন আমাকে বলেছিল, ‘বাইরে বাইরে যতটা বোঝার তোমার বোঝা হয়ে গেছে। বাকিটা বুঝতে গেলে তোমাকে দীক্ষা নিয়ে শরীরে আচরণ করতে হবে।’ আশ্চর্য যে একবার পাথরচাপুড়ির মেলায় এক ফকির লিয়াকতকে হুবহু একই কথা বলেছিলেন। সে আমার মতোই ফকিরিপন্থার ভেদ বা রহস্য বুঝতে চেয়েছিল, আর আমি চেয়েছিলাম বাউলতত্ত্ব জানতে, এটুকুই যা তফাত। লিয়াকত লিখছে:

আভাসে ইঙ্গিতে ফকির এমন দু’ একটা কথা বলেছিলেন, আমার পক্ষে বোঝা অসম্ভব হয়ে উঠেছিল ঠিক কি বলছেন। একটু তফাতে চুপচাপ বসে অন্য একজন ফকির কথাগুলো শুনছিল। বেশ বয়স্ক, চুলদাড়ি সব শাদা। হতাশ হয়ে যখন উঠে চলে যাচ্ছি, বুড়ো ফকির আমাকে ডাকল। …কিছুক্ষণ অন্তর্ভেদী চোখে আমাকে দেখে বলল, ‘শোনো বাবা, ফকির-বাউলের সঙ্গ করো সেটা কথাতেই টের পাচ্ছি। ভাল। তবে কি জানো, ভেতরের খবর সবাই জানে না, জানলেও দেবে না। দেওয়ার নির্দেশ নেই। বাইরে থেকে যা জানার অনেকটাই জেনেছ— এরপর যদি জানতে চাও ফকির-বাউলের পেছন পেছন ঘুরে আর লাভ হবে না। গুরু ধর। মুরশীদ ছাড়া কোনোভাবে আসল ভেদ পাবে না।’

দুজনেরই আমাদের একই অভিজ্ঞতা হল কেন? কারণ, একটা জায়গায় বাউল-ফকিররা মিলেমিশে গেছে। সেটা তাদের সাধনার ক্ষেত্রে। বাউলদের খানিকটা বাহ্য খানিকটা গোপ্য। ফকিরদের খানিকটা জাহির খানিকটা বাতুন। অর্থাৎ আধেক প্রকাশ্য আধেক গোপন।

কথাটা হয়তো ভুলই বলা হল— ব্যাপারটা ঠিক আধাআধি নয়। অনুপাত হবে চার ভাগের একভাগ প্রকাশ্য, তিন ভাগ গোপন। এই গোপনকে জানতে গুরু লাগে, দেহ লাগে, নারী চাই, চাই আত্মসংযম। কিন্তু দুনিয়াদারি তো আছে— বেঁচে বর্তে থাকার নানা কৌশল। বাউলদের এই দুনিয়াদারি বেশ দৃষ্টিনন্দন। আলখাল্লা, পাগড়ি, কোমরবন্ধ— একহাতে একতারা কোমরে বাঁধা বাঁয়া। পায়ে ঘুঙুর, শরীর ভরা নৃত্যনাট্য। তাকে জানতে গেলে এই নাট্যকে ভেদ করতে হবে। ক’জন পারে? সবাই তো গানে মজে যায়। ঢলে পড়ে আত্মহারা গায়ন শুনে। কেউ কেউ তাদের গানের নাম দিয়েছে শব্দ গান। সত্যিই তো শব্দের ছটা। তার দীপ্তিতেই শ্রোতারা মুগ্ধ, বিবশা গানের ভেতরে লুকিয়ে রাখা সত্যকে ক’জন বোঝে? সেই যে একজন আমাকে শুনিয়েছিল :

পানি থেকে বরফ হয়

বরফের মধ্যে পানি রয়—

বরফ কিন্তু পানি নয়

পানি কিন্তু বরফ নয়।

এতো শব্দের খেলা নয়, হেঁয়ালিও নয়। জীবাত্মা আর পরমাত্মার তত্ত্ব, পিতা আর সন্তানের তত্ত্ব, এমনকী গুরু আর শিষ্যের তত্ত্ব।

অবশ্য কবুল করতে হবে, ফকিরিতন্ত্র বুঝে ওঠা বেশ কঠিন। তারা বেশবাসে নাচেগানে মেলা মচ্ছবে কাউকে আকর্ষণ করতে চায় না। তারা দীনবেশে খেটে খাওয়া মানুষের মধ্যে দিব্যি মিশে আছে। কাউকে আহ্বান করছে না। মাইক লাগিয়ে জয়দেব মেলার বাউল আখড়ার মতো আসর জমানোর চেষ্টা করছে না। একেবারে জনস্রোতে মিশে আছে কিন্তু গভীরভাবে আত্মস্থ ও আত্মপ্রচ্ছন্ন। ওই যে শাসপুরের রিকশাঅলা, সবজিঅলা, জনমজুর, ফেরিঅলারা নিজেদের ক্ষুকাতর দৈনন্দিন থেকে অতিকষ্টে চাল আর পয়সা বাঁচিয়ে, তিলে তিলে সঞ্চয় করে, একটা চালাঘরের ইবাদতখানা বানিয়েছে তার অন্তমূল্য অপরিসীম। তার জন্য তাদের গর্বের শেষ নেই। মিনার নেই, গম্বুজ নেই, কাবাব তসবির নেই, বোররাখ ঘোড়ার ছবি নেই, আছে খেজুর পাতার তালাই, হাতপাখা, লণ্ঠন আর পানীয় জল কিন্তু সগর্বে বলছে ‘এটাই মসজিদ।’

তার মানে তারা অনুক্ত উচ্চারণে বলছে ‘ওটা মসজিদ নয়’ অর্থাৎ ওই যে মিনার-খিলান-গম্বুজ শোভিত বহু দূর থেকে শোভমান সাম্প্রদায়িক মসজিদ, ওটা একটা দেখনদারি জিনিস, দুনিয়াদারির উচ্চারিত ঘোষিত অংশ। ওইখান থেকে রোজ মাইকের নিনাদে মোয়াজ্জিনের আজান বেজে ওঠে। তাতে বলা হয়, ‘ওহে ইমানদার মুসলমান, তোমরা চেতন হও, আল্লার আরাধনার সময় হয়েছে।’

ফকিররা অবাক হয়ে বলবে, আল্লাকে ডাকার আবার সময়-অসময় কি? সে তো সর্বদা চলছে। তার জন্য অত ডাকাডাকির কী আছে? শাসপুরেও লিয়াকতের নতুনতর একটা অভিজ্ঞতা হয়েছিল। সেদিন ওই চালাঘরের মসজিদেই তার দিনটা কেটে গিয়ে সন্ধে নেমে এসেছিল। অতখানি প্রশস্ত সুযোগ হাতছাড়া করেনি সে, আলাপ-আলোচনা করেছে, বেশ কিছু ফকিরি গান টুকে নিয়েছে। তার বেশির ভাগই মহম্মদ শাহ-র রচনা। মন দিয়ে বহুক্ষণ ধরে শুনেছে ফকিরিগান মুরিদদের কণ্ঠে। তারপর রাত নটা নাগাদ তার ওপর নির্দেশ হল মসজিদ থেকে বেরিয়ে কবর চত্বরে বসার। ফকিরতন্ত্রের মুরিদ বা বায়েদ এমন ক’জন আর লিয়াকত বাইরে এসে বসল। লক্ষ করল, দরজা বন্ধ করে মসজিদের অভ্যন্তরে শুরু হল গুরুনির্দেশিত ক্রিয়াকরণ ও জপজিকির ধ্যান। এতক্ষণকার চেনা কয়েকজন সহৃদয় মানুষের সঙ্গে তার একটা আড়াল তৈরি হয়ে গেল। একরকম দূরবর্তিতা এসে গেল। আধঘণ্টা পরে আবার তাদের ডাক এল ঘরে যাবার। তার সবকিছু জানার জন্য কৌতূহল ছিল কিন্তু বায়েদ না হলে তারা কিছু জানাবে না।

তার চেয়েও বড় প্রশ্ন, জানালেও লিয়াকত বুঝত কি? আমাদের বিষয়সর্বস্ব ভোগী ও প্রদর্শনকামী জীবনের অবস্থানে থেকে কী করে স্বেচ্ছারিক্ত অথচ ভাবসম্পদে ধনী, ফকিরদের মর্মকথা আর ইবাদতের গহন পথে পৌঁছব আমরা? তবে কি আমাদের মতো পুথিপড়া পণ্ডিতদের ফকির-গবেষণা ও নিবন্ধ রচনা নিষ্ফল? লিয়াকত একেবারে এইখানে ঘা মেরে প্রশ্ন তুলেছে :

বাস্তবিকই আমি তো তেমন কিছুই জানি না। প্রশ্ন হয়, এই যে বাইরে থেকে এদের নিয়ে এতো গবেষণা, লেখালেখি ও পুস্তক প্রকাশ, নানাদিক থেকে সেগুলি অত্যন্ত মূল্যবান হওয়া সত্ত্বেও কোথাও এক বিশাল ফাঁকি থেকে যাচ্ছে। একটা হল ফকিরিতত্ত্ব ও তাকে আয়ত্ত করার প্রয়োগসংক্রান্ত ক্রিয়াকরণ বিষয়ে জ্ঞানের সীমাবদ্ধতার কথা। অন্যদিকে এটাই ফকিরদের যাবতীয় জীবনবোধ, দৃষ্টিভঙ্গি ও চালচলনের মূলে—এ কথাও অস্বীকার করা যাবে না। ভিন্ন ও প্রায় বিপরীত জায়গায় অবস্থানকারী কোনো ব্যক্তির (গবেষকের) পক্ষে এগুলো যথার্থভাবে বোঝা ও মূল্যায়ন করা প্রায় অসম্ভব।

এ জন্যই কি পণ্ডিতদের টীকাভাষ্য পুস্তককে ফকিররা গুরুত্ব দিতে চায়ই না, উল্টে বিরোধিতা করে? এমনকি শাস্ত্রকেও তারা গুরুত্ব দিতে নারাজ।

লিয়াকতের এ-জাতীয় অনুভব ও অনুধাবনে অনেক সংগত কথাই উঠেছে কিন্তু তার সঙ্গে আরও দুয়েকটা কথা আমরা তুলতে পারি।

প্রথমেই বলা দরকার ফকিরিপন্থা কোনও ধর্ম নয়, বরং একটি বিশ্বাস এবং সেই বিশ্বাসের পথে সভাবে থেকে জীবনাচরণ। সেই জায়গাটায় কিন্তু কোনও সংশয় বা তর্ক নেই— একেবারে সবল আর দ্বিধাহীন উচ্চারণ। স্পষ্ট করেই বলা— এটাই মসজিদ, এটাই ইবাদতখানা, এটাই সঠিক পথ এবং ওরা ভ্রান্ত, ওরা অন্ধ, ওরা আচার-সর্বস্ব। ওদের মূলেই গন্ডগোল। স্ববিরোধিতা ও অধার্মিক হালচাল পদে পদে। লিয়াকত চমৎকার এক উদাহরণ দিয়েছে।

ঈদে বা বকরীদে প্রায় সব মুসলমান যায় ঈদগায়ে নামাজ পড়তে। তাদের সঙ্গে যায়। অনেক ছোট ছেলেমেয়ে। নামাজের সময় তারা মাঠের বাইরে থাকে। নতুন রঙচঙে পোষাকে শিশুবালকদের এই অনামাজী আনন্দউজ্জ্বল সমাবেশও উৎসবের এক উপরী পাওনা। এটা হলে ভাল ছিল। কিন্তু ব্যাপারটা তা নয়। এই শিশু-বালকদের অনেককে বড়দের খুলে রাখা জুতো-চপ্পল আগলানোর ভার দেওয়া হয়, যাতে চুরি হয়ে যায়। পয়সার বিনিময়ে তারা অচেনা লোকেরও চটি-জুতো আগলায়। এখানে পাঁচওয়াক্ত নামাজ পড়ুক না পড়ুক, ঐ পবিত্র দিনটাতে ঈদগায়ে উপস্থিত হয় সকল নামাজী। এই নামাজীরাও তাদের মধ্যে ঢুকে থাকা চোর সম্বন্ধে নিঃসন্দেহ। ঐ পবিত্র দিন, ঐ পবিত্র নামাজ পাঠ, অন্তত সাময়িকভাবে হলেও মানুষের ভিতরের আবর্জনাকে পরিষ্কার করা দূরে থাক ধামাচাপা দিতে পারেনি। শরিয়তের বাহ্য আচরণ পালনে যে মানুষের চারিত্রিক ত্রুটিগুলি দূর হয়ে যায় না, এর থেকে বড় প্রমাণ আর কি হতে পারে? ফকিরেরা তাই বলে—যতই পড়ো লোকদেখানো শরার নামাজ, মারফতি চেতনা ছাড়া না হবে তোমাদের নামাজ, না হবে তোমরা মানুষ। মারফত-ই আত্মপরিচয়, যা না পেলে যতই পড়ো সে শুধু কাগজ আর কালি— জীবন সম্পর্কে যথার্থ জ্ঞান হবে না।

এসব তাদের চাপা কথা নয়, প্রকাশ্য। এ কথা তারা বলে, বলছে চিরকাল। অগ্রাহ্য করছে শরিয়তের অনুশাসন, যাচ্ছে না মসজিদে, রাখছে না রোজা। বিবাহ দিচ্ছে নিজেদের মধ্যে, কবর দিচ্ছে নিজের জমিতে। এতে গোঁড়া মুসলমানদের ক্রোধ হওয়া অবশ্যম্ভাবী। তার ফলে ফকিরদের একতারা ভেঙে, দাড়িগোঁফ কেটে, বাড়িঘর জ্বালিয়ে, সমাজে একঘরে করে এমনকী শারীরিকভাবে নিগ্রহ করে, তাদের গ্রাম্যবাস্তু থেকে তাড়াতে চায়।

আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, পশ্চিমবঙ্গে বাউলরা অতটা বিপন্ন নয়, যদিও তারা ফকিরদের বিপন্নতায় মথিত ও সমব্যথী। বাউলরা কেন নিগ্ৰহমুক্ত তার একটাই কারণ—তাদের মধ্যে প্রতিবাদী অংশ ততটা নেই।

ফকিরিপন্থার সুচনাই হয়েছে একরকম দ্রোহ বা প্রতিবাদ থেকে। একে বলা যেতে পারে গূঢ় অন্তর্দোহ এবং তা ইসলামি শরিয়তি নির্দেশের বিরুদ্ধে। ফকিরদের এই অন্তর্দ্রোহের ভিত্তি খুঁজে পাওয়া যেতে পারে সুফিদের সাধনায়। ইসলামের বাহ্য আচারের বিরুদ্ধে সুফিরাই প্রথম অন্তর্দীপ্ত ও আত্মস্থ হবার আহ্বান জানায় শুষ্ক শাস্ত্রগ্রন্থের নির্দেশ একদিকে, আরেকদিকে তাদের সজীব অনুভবেদ্য গহন জীবনের আমন্ত্রণ। উপাস্যকে তারা পেতে চায় প্রেমে, তাই ডাকাডাকি হাঁকাহাঁকি, লোকদেখানো নামাজ রোজা জাকাত ও হজ তাদের কাছে গৌণ। ধর্মনেতাদের অনুশাসনের চেয়ে আত্মার নির্দেশ সুফিদের কাছে অনেক বড়। বিজ্ঞজনের ধারণা :

ঈশ্বরের সহিত মিলনাভিসারী সাধককে সুফীরা বলেন ‘পর্যটক’ এবং মানবের ঈশ্বরলাভের প্রচেষ্টাকে বলা হয় ‘পর্যটন’। পর্যটক হইবার জন্য গুরুর (‘শেখ’ বা ‘পীর’) নিকট হইতে সুফীসাধনমার্গের নিগূঢ়তত্ত্ব শিক্ষা করিতে হইবে। তাঁহার যোগ্যতায় গুরু সন্তুষ্ট হইলে তাঁহাকে দীক্ষিত করিবেন এবং তালি দেওয়া পোশাক (বৈরাগ্য ও দারিদ্র্যের চিহ্ন) দিবেন।

ধর্মসাধনাকে যখন বলা হয় পর্যটন এবং সাধক যেখানে পর্যটক, সেখানে অনুক্ত কথাটি হল এই ভ্রমণ আসলে খাড়াখাড়ি বা ঊর্ধ্বগ। নিজের শরীর-মন-সত্তাকে উত্তরণের পথে নিয়ে যেতে গেলে পার্থিবভাবে ভারমুক্ত হতে হবে— অর্থাৎ বিষয়বৈভব সাজসজ্জা ত্যাগ করা দরকার। সেইজন্য গুরু শিষ্যকে দেবেন সরল অঙ্গবাস, যাতে কোনও জেল্লা নেই, দৃশ্যতও যা বৈরাগ্যসূচক। নানা টুকরো কাপড়ের তালি, অনেকের মতে, ঔদার্যের ব্যঞ্জনা। নানা মত নানা পথের উদার সমীকরণ করে এই সুফিপন্থা গড়ে উঠেছে।

এসবই অনুমানের কথা। সুফি কথাটা নাকি এসেছে ‘স্বূফ’ থেকে। শব্দটি আরবি, অর্থ হল পশম। তার মানে এদেশে প্রথম যখন সুফিরা এসেছিলেন তখন তাদের পরনে থাকত পশমের জোব্বা। তারপরে গ্রীষ্মপ্রধান ভারতে পশমের বিকল্পে এসে গেছে তালিদেওয়া সুতি আলখাল্লা। সুফি-সন্ত-বাউলদের নিয়ে নিবিড় গবেষণা করে রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় মন্তব্য করেছেন :

পশমের পোশাক-পরা লোকজনরা ইসলামের প্রাথমিক যুগে বিলাসিতাহীন, অনাড়ম্বর এবং অনাসক্ত জীবনের প্রতীক ছিলেন। দ্বিতীয় খলিফা হজরত ওমর নিজেও এই পশমি পোশাক বা জোব্বা পরতেন। আদর্শ খালিফাদের পর যখন ইসলামে আড়ম্বর, বিলাসিতা এবং ইহলৌকিক আসক্তি বাড়তে থাকল, তখন একদল মানুষ ব্যক্তিগত আচার-আচরণের মাধ্যমে সেই প্রবণতার বিরুদ্ধে পালটা আদর্শ হয়ে দাঁড়ালেন। সরব হয়ে নয়, নিরুচ্চারভাবেই এই সংখ্যালঘু মানুষজন বিশাল এক জাতির সামনে তাদের আড়ম্বরপূর্ণ, বিলাসপ্রিয়, ভোগাসক্ত জীবনের বিপরীত মেরুতে নম্র প্রতিবাদ হয়ে রইলেন নির্জন সাহসে৷ এঁরাই তখন ‘সুফি’ বা পশমের জামা-পরা লোক হিসেবে পরিচিত হয়ে গেলেন।

মন্তব্যটি বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়, সুফিবাদ ইসলামের ঠিক উপজাত নয়, বরং সমান্তরাল বিশ্বাস।

কিন্তু এসব তত্ত্ব বা তথ্য বিশদে জানতে গেলে বা তার অন্তর্বিশ্লেষণ করতে হলে প্রথমে ইসলাম সম্পর্কে খানিকটা ধারণা গড়ে নেওয়া দরকার। জানা যাচ্ছে:

‘ইসলাম’ মূলে এক আরবি শব্দ, যার মানে শান্তি আর আত্মসমর্পণ। আত্মসমর্পণ কার কাছে? একটা বিশ্বাসের কাছে। যে-বিশ্বাসের উচ্চারণ হল, আল্লা অদ্বিতীয় এবং তাঁর সব নির্দেশ সম্পর্কে প্রশ্নাতীতভাবে অনুগত থাকা। এই আত্মসমর্পণের যে প্রশান্তি সেটাই ইসলাম শব্দের লক্ষ্য। তাই যারা আত্মসমর্পণকারী তারাই ‘মুসলমান’। অর্থাৎ মুসলমান এই আরবি শব্দের মানে আত্মসমর্পণকারী।

এবারে বোঝা দরকার ইসলাম ধর্মের ভিত্তিতে আছে কতকগুলি ‘আকিদা’ বা বিশ্বাস। মুসলমান হতে গেলে কতকগুলি বাক্য মুখে বলতে হয়, অন্তর দিয়ে সেই বাক্যে বিশ্বাস করতে হয় এবং সেই বিশ্বাসের বশে আচরণ করতে হয়—একেই বলে ‘কলেমা’। কলেমার পাঁচটি ভাগ, তার প্রথম ভাগকে বলে ‘কলেমা তৈয়ব’। কলেমার এই প্রথম পাঠের আরবি শব্দবন্ধের বাংলা বয়ান হল আল্লা ছাড়া কোনও উপাস্য নেই এবং মহম্মদ তাঁর প্রেরিত রসুল। রসুল মানে দূত। আল্লার পবিত্র বাণী রসুলের দ্বারাই প্রচারিত।

ইমানদার মুসলমানদের পক্ষে বেশ ক’টি কৃত্য বা করণীয় কাজ আছে, তা ‘ফরজ’ অর্থাৎ অবশ্যপালনীয়। প্রথম কৃত্যকে বলে ‘কলেমা’, দ্বিতীয়টি ‘নামাজ’, তৃতীয় ‘রোজা’, চতুর্থ ‘জাকাত’ এবং পঞ্চম হল ‘হজ’। এই পাঁচটি অবশ্য পালনীয় কাজকে বলে ‘পঞ্চবেনা’ অর্থাৎ ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভ। কলেমায় আস্থা বা বিশ্বাসস্থাপন ব্যাপারটা আগে বলা হয়েছে। ‘নামাজ’ হল ভোর থেকে রাতের প্রথম ভাগ পর্যন্ত নির্দিষ্ট সময়ে দিনে পাঁচবার মসজিদে বা ঘরে বা যে যেখানে আছে সেখানে নামাজ পড়া। তার কতকগুলি বাঁধা নিয়ম ও কসরত আছে, সেগুলি শিখে নিতে হয়। শুক্রবার দুপুরে মসজিদে গিয়ে জুম্মার নামাজ বিশেষভাবে করণীয়। ‘রোজা’ হল সূর্যোদয়ের আগে থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত উপবাস— একমাস ব্যাপী— যা চান্দ্রমাসের গণনা করে নির্দিষ্ট হয়। ‘জাকাত’ মানে দান। ধর্মাচারী মুসলমান তার উদ্বৃত্ত রোজগারের চল্লিশ ভাগের একভাগ দান করে। ‘হজ’ হল ধার্মিক মুসলমানের তীর্থযাত্রা, জীবনে অন্তত একবার, বছরের নির্দিষ্ট একটা সময়ে যেতে হয় মক্কা শরীফের উদ্দেশে।

এ সমস্তই ইসলামের ব্যাবহারিক আচরণবিধি, যার নিয়ন্ত্রণ থাকে ধর্মীয় মোল্লামৌলবিদের শক্ত হাতে। প্রকৃত ইমানদার মুসলমান এই পঞ্চকৃত্য পালন করে অন্তরে শান্তি পান কিন্তু বিচারশীল ও ভাবুক মুসলমানদের মধ্যে অনেকে এ সব কৃত্যের মধ্যে ‘কলেমা’ ছাড়া অন্যগুলিকে নিতান্ত বাহ্যিক কিংবা লোকদেখানো বলে মনে করেন; বিশেষত ফকিরি পন্থার অনুগামীরা এ ধরনের বাহ্য আচরণকে প্রতিবাদ শুধু নয়, খানিকটা উপহাস করেন। যেমন লালন বলেছেন :

পাঁচরোক্ত নামাজ পড়ে

শরা ধরে কে পায় তারে?

এখানে ‘শরা’ মানে শরিয়ত। ফকিরেরা শরিয়ত মানেন না তাই গোঁড়া মুসলমানরা তাঁদের বলেন ‘বেশরা’। আল্লা অদ্বিতীয় ও একমাত্র উপাস্য কলেমার এই বিশ্বাস না মেনে ফকিররা গুরু বা মুর্শেদকেও মানেন। এমনকী বলেন ‘যে হি মুরশেদ সে হি খোদা।’ এতো মারাত্মক কথা। আল্লার শরিক আছে একথা ঘোর অনৈসলামিক। ইসলাম বিশ্বাস করে আল্লা লা-শরিক, তাঁর শরিক নেই। ফকিররা সেটা না মেনে গুরুকে আল্লার শরিক করেন বলে মোল্লারা তাঁদের বলেন ‘শের্ক বা মুশরিক’— বলেন ‘বেদ্বীন’ অর্থাৎ ধর্মহীন।

এমনতর সওয়াল-জবাব, তর্ক কূটতর্ক নিয়ে পরে ভাবা যাবে, তার আগে জেনে নেওয়া দরকার, ইমানদার মুসলমানদের সমান্তরালে যে সুফিবাদ গড়ে উঠেছিল তাদের ধর্মকর্ম আচার বিশ্বাস কী ধরনের ছিল। ইসলামের ক্রিয়াকরণের বাস্তবতা ও বাধ্যতা অনেক ভাবসাধকের ভাল লাগেনি। অদৃশ্য উপাস্যের সঙ্গে অন্তরের ঘনিষ্ঠতা অর্জনের আবেগে সুফিরা ধ্যানের পথ নিতে চাইলেন। রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাষায়,

তার পক্ষে একমাত্র শরিয়ত (কলিমহ্‌, নামাজ, রুযহ্‌, হূজ, যকাত্‌) মেনে খাঁটি মুসলমান হিসাবে ধর্মীয় পরিচয়ের নির্দিষ্ট কোনো বাতাবরণে থাকলেই চলে না, তার চাই মর্মের সাধন অর্থাৎ ‘ত্বরিক্কত’।…শরিয়তের পঞ্চাঙ্গ কর্মের মতোই সুফিরাও তরিকতের ত্রিবিধ কর্ম সম্পাদনে ব্রতী হয়। ‘জিক্‌র্‌’ অর্থাৎ জপ, ‘রাবিতা’ অর্থাৎ সংযোগসূত্র এবং ‘মুরাক্কিবহ্‌’ অর্থাৎ সতত জপ করার সঙ্গে সংসার অনাসক্ত মনকে শুদ্ধ করে রাবিতা অর্থাৎ সংযোগসূত্র বা গুরুর মাধ্যমে বিশুদ্ধ মনে শান্ত হয়ে আল্লার ধ্যান অর্থাৎ মুরাক্কিবহ্‌ করে আলোকময় পরমে (নূর) নিজেকে বিলীন করতে অহং লোপ হলো সবিশেষ জরুরি। অহং লুপ্ত ‘ফনা ফিল্‌লাহ্’ অবস্থাও শেষ নয়, সেই অবস্থার ভেতর শাশ্বত হয়ে থাকা অর্থাৎ ‘বক্কা বিল্‌লাহ্‌’ হল শেষ পরিণতি।

নানারকম আরবি শব্দের ঝংকারে পাঠকদের অস্বস্তি লাগতে পারে। তাই ওই সব শব্দের লোকায়ন ঘটে যেসব সরল শব্দ তৈরি হয়েছে সেগুলি ব্যবহার করলে সুবিধা হবে। প্রথমে বুঝে নেওয়া যাক সাধনার চারটি পথ— শরিয়ত, তরিকত, হকিকত ও মারফত। শরিয়ত মানে যা শরাসম্মত। ধার্মিক মুসলমানরা দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় যেসব বিধান মেনে চলেন সেগুলি ‘কোরান’ ও ‘হাদিস’ থেকে পাওয়া। এ ধরনের বিধানগুলিকে একত্রে বলে ‘শরিয়ত’। ‘তরিকত’ মানে যা বিভিন্ন তরিকা বা মার্গসম্মত। ‘হকিকত’ অর্থে যা হক (ন্যায়) সম্মত। আর ‘মারফত’ বা মারিফত হল অধ্যাত্ম জ্ঞানের পথ। সুফিরা নেন তরিকতের মার্গ। এ পন্থায় জিকির সহযোগে মুরাকিবা বা সতত সাধনার সাহায্যে পরম প্ৰেয়র সঙ্গে অভেদ হওয়ার প্রয়াস পান সাধক। এই প্রয়াসে ‘ফানা’ বা অহং লুপ্ত হওয়াই চরম নয়, শেষ কথা হল ‘বাকা’ অর্থাৎ ফানায় চিরন্তন হয়ে যাওয়া।

পর্যালোচনা করে এটা বোঝা গেল যে, সুফিরা ভাবসাধক ও আত্মস্থ। ইসলামের নানা কর্মকাণ্ড ও আকিদা-র বাড়াবাড়ির চেয়ে তাঁরা নিভৃত নির্জনে একক ধ্যানে ও অনুভবে একীভূত হতে চান এবং সেই একীভূত অবস্থাতেই থেকে যেতে চান বরাবরের জন্য। দিব্যোম্মাদ সুফিরা অন্তঃস্পন্দে এতটা নির্ভরশীল যে ভাবাবিষ্ট হয়ে গান গেয়ে ওঠেন, যখন তখন। সেই গানকে বলে ‘সামা’। অথচ শুদ্ধতাবাদী ইসলামে গান গাওয়া নিষিদ্ধ। সুফিদের দর্শন আর আচরণ থেকে বোঝা যায় তাঁরা ঠিক ইসলাম বিরোধী নন। কিন্তু শরার নির্দেশে অনন্যশরণ নন। সুফিবাদকে কেউ কেউ ‘Interpretation of Islam’ বলেছেন কেউ বলেছেন ‘parallel faith’। আসলে সুফিবাদ ইসলামের এক ভিন্ন দিশা, যা মুক্তমনা ও বিচারশীল মুসলমানদের ভাবাশ্রয় দিয়েছে বহুদিন ধরে। বলা বাহুল্য এদেশে ফকিরি মত গড়ে উঠেছে বহুলাংশে সুফিবাদের অনুপ্রেরণায়।

এ ধরনের আলোচনায় সব সময়ে একটা সরলীকরণের ঝোঁক এসে যায়। যেমন কত সহজে বলে ফেলা গেল ইসলাম মূলত কর্মবাদী আর সুফিরা ভাবমার্গের সাধক। মন্তব্যের মধ্যে বেশ ফাঁক থেকে গেল নাকি? বহু নৈষ্ঠিক মুসলমানকে দেখেছি নামাজ রোজা পালন করে আত্মতৃপ্ত ও শান্ত। তবে এটা ঠিক যে ইসলামের ভিত্তিমূলে আছে শাস্ত্রের অনুশাসন ও আচরণবাদের বাধ্যতা। নামাজ পড়তেই হবে, বছরে অন্তত ঈদের দিনে রোজা রাখা উচিত, এমনতর অনুজ্ঞা সকলের পক্ষে রোচক না হতেই পারে। যাঁরা এসব মানেন না, তাঁদের ধর্মনেতারা ভয় দেখান— দোজখের ভয়। সমাজে নিন্দামন্দ রটে। কিন্তু অদৃশ্য এক ঈশ্বরের কাছে আত্মসমর্পণ করতে কারুর যদি অন্তর না মানে? পশ্চিমদিকে তাকিয়ে এক কাতারে দাঁড়িয়ে সমবায়ী ধর্মাচরণে কেউ যদি অনীহ হন? আল্লার রূপ চেহারা নেই, তাই সাধারণ মানুষ যদি তার বন্দনা না করে প্রত্যক্ষ বাস্তব দেহধারী সদাচারী ও বান্ধব মুর্শেদের কাছে অবনত হন, যদি তাঁকে ‘সেজদা’ (প্রণতি) দেন তবে মৌলবিরা খুশি হন না— কিন্তু মানুষটির তো আত্মপ্রসাদ ঘটতে পারে। কুবির গোঁসাইয়ের একটা পদে আছে :

নামাজ পড় যত মোমিন মুসলমানে—

আল্লাজি সদর হন না দিদার দেন না

সেজদা কর কার সামনে?

মোমিন মানে ধর্মনিষ্ঠ, সদর মানে প্রকাশ্য, দিদার মানে দর্শন, সেজদা মানে প্রণিপাত। সরল অর্থ এই দাঁড়াল : হে ধর্মনিষ্ঠ মুসলমানগণ, তোমরা নামাজ পড়ছ কিন্তু তোমাদের উপাস্য আল্লা তো নিজেকে প্রকাশ করেন না, দেখা দেন না, তা হলে প্রণতি কর কাকে?

প্রসঙ্গত মনে পড়ল, একবার নদিয়া জেলার হাঁসপুকুর গ্রামে আবু তাহের ফকির নামে এক তাত্ত্বিকের ডেরায় সারাদিন ছিলাম। সেখানে তাঁর এক ফকির শিষ্য জলিলের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। সে মুসলমান হয়েও শরিয়ত ছেড়ে মারফতি ফকির হয়েছিল। আবু তাহেরের বায়েদ (শিষ্য) জলিল একজন সাধারণ অশিক্ষিত কৃষিজীবী। কেন ইসলাম ছেড়ে সে ফকিরি পথ নিয়েছে জানতে চাইলে সে খুব স্পষ্ট ভাষায় আমাকে বলেছিল, ‘বাবু, আন্দাজি ধর্মে আমার পেট ভরলো না। তার চেয়ে সামনে এই যে খাড়া রয়েছেন গুরু বর্জোক, আমার সুখে দুখে সর্বদা আছেন, কত ভালবাসেন, কাছে এলে শান্তি পাই, দুদণ্ড বসি, দুয়েকটা ভালো কথা উপদেশ শুনি— এই আমার ভালো।’

আন্দাজি ধর্ম কথাটা বেশ দ্যোতক। বর্জোক অর্থে ‘বরজখ’ অর্থাৎ উপাস্য আর উপাসকের মধ্যেকার ব্যক্তি যিনি। সাধারণ মানুষের ধর্মোপলব্ধি ও ধর্মধারণার সারল্য জলিলের বাক্যে সুন্দর ফুটে উঠেছিল। এ যেমন সরল সত্য তেমনই কৌশলী বিবরণ এবারে দেব। বহরমপুরে একটি মুসলিম যুবার কাছে গণসংগীত শুনছিলাম। তাকে হঠাৎ প্রশ্ন করলাম, ‘তুমি মুসলমান?’ সে আমাকে অবাক করে উত্তর দিল, ‘ক্লাস নাইন পর্যন্ত ছিলাম। তারপরে আর আচার-আচরণ পালন করি না। তেমন বিশ্বাসের জোর নেই। জাত ধর্ম বর্ণ এসব মানি না তো।’ না, তার কোনও অসুবিধা হয় না। গা ঢাকা দিয়ে থাকে মোল্লাদের দৃষ্টির আড়ালে। এরপরে সে নিজের থেকে বলল, ‘তবে ঈদের নামাজের দিন বেশ লুকোচুরি চলে! শুনবেন মজা? আমার বাড়ি হল গ্রামে, কান্দিতে। ভোরে উঠে বহরমপুর থেকে পালাই। ভাই বেরাদাররা প্রশ্ন করে, “ঈদের নামাজ পড়বে না?” তাদের বলি, “গাঁয়ে গিয়ে পড়ব সেইজন্যে যাচ্ছি।” তারা নিশ্চিন্ত হয়। এরপর কান্দিতে পৌঁছলে বয়োজ্যষ্ঠরা জিজ্ঞেস করেন, “বাপ, নামাজ পড়বে না?” আমি বলি, “সে তো সকালেই পড়ে এসেছি বহরমপুরের বড় মসজিদে।” তাঁরাও নিশ্চিন্ত হন। আসলে কি জানেন আমাদের ধর্ম খুব কড়া। সকলে নজরদারি রাখে। কিন্তু আমি ফাঁক দিয়ে পালাই। বুঝলেন তো?’

এমন স্পষ্ট কথা না-বোঝার মতো কি? সাধারণ মানুষ, কি হিন্দু কি মুসলমান, চায় নিজের মতো করে বাঁচতে। হ্যাঁ, তাদের ধর্মভয় আছে, স্বৰ্গনরকের অস্পষ্ট ধারণাও আছে, তবু মানুষ সুযোগ সুবিধা পেলে ফাঁকি দেয়, এটা মানুষের মজ্জাগত স্বভাব। সমাজবদ্ধ জীবনযাপনে এমনি মানুষকে নানা বাধাবন্ধ নিষেধ আর অনুশাসন মেনে চলতে হয়, কত লড়াই কত প্রতিবন্ধ, তাকে পেরিয়ে খুঁজে নিতে হয় আনন্দের রসদ, রঙ্গ ব্যঙ্গ কৌতুক। ধর্মের বিধান যদি তার মধ্যে এসে আরও এক প্রতিকূলতা গড়ে তোলে— স্বচ্ছন্দ জীবনপ্রবাহের মধ্যে মন্ত্র, শাস্ত্র, মন্দির, মসজিদ, পুরোহিত, মোল্লা এসে পড়ে, আসে ধর্মের আচারগত বাধ্যতা তবে ভেতর ভেতর একটা দ্রোহ আসে। প্রতিবাদের এক ক্ষীণ সাহস জাগে। তারপরে কোথাও সেই দ্রোহের সমর্থন পেলে জলিলের মতো ইসলামের আচারকৃত্যে সংশয়ী মানুষ ঢুকে পড়ে সেখানে। তা ছাড়া গরিব খেটে খাওয়া মানুষ তার প্রত্যক্ষ প্রতিদিনের জীবনে দেহগত অনুভব আর ইহগত অস্তিত্বকে বেশ বুঝতে পারে— তাতে কোনও আন্দাজি বিষয় নেই, কল্পনাও লাগে না। তার জায়গায় অদৃশ্য ঈশ্বরানুভূতি, তার উপাসনার নানা নটিখটি, মসজিদে যাবার বাধ্যতা, কঠোর শ্রমকিণাঙ্ক দিনপাতের মধ্যে সারাদিন নির্জলা রোজা রাখা ভাববিলাসিতা কিংবা অর্থবানদের ব্যাপার বলে মনে হতে পারে। এই রকম ভাবনা থেকেই একজন লোককবি লিখেছিলেন : ‘নামাজ আমার হইল না আদায়/ নামাজ আমি পড়তে পারলাম না বিষম খান্নাতের দায়।’ খান্নাত মানে অভাব।

ইত্যবসরে ফকির গুরুরা তাদের আশ্রয় দেন। বোঝান, শরিয়তকে অতিক্রম করে মারফত পৌঁছতে হবে। তাতে বেহেস্ত না মিললেও ইহজীবনে সুখ শান্তি পরিতৃপ্তি মিলবে। আল্লাকে ধরো গুরু বর্জোকের প্রদর্শিত সরল অনুভবের পথে। রোজা বা দেহসংযমের চেয়ে আত্মসংযম অনেক জরুরি। দম আর শ্বাসের কাজ গুরুর কাছে বুঝে নিয়ে কায়াসাধন করে সন্তানের জন্মরোধ কর। ঊর্ধ্বরেতা হও। সন্তান মানেই শরিক। শরিক মানেই তোমার ব্যক্তিগত শান্তি স্বস্তির অবসান। অভাব, দারিদ্র্য, কান্না, অসুখ, শোক, তাপ, দুঃখ। এরপরে আছে মুর্শেদের বলা দারুণ সব যুক্তির প্যাঁচ। তারা রঙ্গ করে বলেন, ‘আরে বোকা শোন, সারাদিন উপোসী থেকে রাতে খেয়ে যদি আল্লাকে পাওয়া যায় তবে মানুষের চেয়ে অনেক আগে বাদুড়রা বেহেস্তে যাবে, তাই না?’ ‘আর হজ? সেকি গরিবের জন্যে? কতদূরের পথ, কত টাকার ব্যাপার। ওসব বড়লোক শরীফ আদমিদের ব্যাপার স্যাপার। কেন গরিব কি আল্লাকে পাবে না? সবখানেই তো আল্লা, তবে মক্কা যেতে হবে কেন? আল্লা গরিবেরও। এই দেহই মক্কা। এই দেহ-মক্কাতেই নিয়েত বাঁধ্‌। মুর্শেদকে ধর্‌।’ এই সব বলে মুর্শেদ গান ধরেন কিংবা কোনও শিষ্যকে দিয়ে গাওয়ান :

এই দেহ মিথ্যে নয় মন

এই দেহেই আছে আছে রতন।

এমন গান শুনলে কার না মন ভিজবে? শিষ্য তখন গুরুকে জিজ্ঞেস করে, এই গান করা ‘না-জায়েজ’ বলেন মোল্লা-কাজিরা। অথচ গান করতে, গান শুনতে খুব মিষ্টি লাগে, মন ভরে যায়। গান গাওয়া কি হারাম?

গুরু তখন দুদ্দু শাহ-র লেখা একখানা মোক্ষম গান শোনান। তাতে বলা হচ্ছে :

গান করিলে যদি অপরাধ হয়

কোরান মজিদ কেন ভিন্ন এলহানে গায়?

আরবি পাৰ্শি সকল ভাষায়

গজন মর্সিয়া সিদ্ধ হয়।

বেহেস্তের সুর নাজায়েজ নয়

দুনিয়ায় কেন হারাম হয়?

এমনতর যুক্তির কাছে মোল্লাদের অনুশাসন কেমন করে দাঁড়াবে? আরবি পারশি ভাষায় লেখা গজল বা মর্সিয়া গান যদি এত সমাদর পায় গুণীসমাজে, শ্রোতাদের ভাল লাগে, তবে বাংলা ভাষার গানে দোষ কোথায়? তার চেয়েও বড় কথা, স্বর্গে গান যদি নিষেধ না হয় তবে মর্ত্যে কেন তা অপবিত্র বা নিষিদ্ধ হবে? কাজেই গান করো প্রাণ ভরে। নামাজ রোজা জাকাতের পণ্ডশ্রম না করে গানে গানে তাঁকে ডাকো। লালন বলেছেন :

শুনতে নাই আন্দাজি কথা

বর্তমানে জানো হেথা।

হেথা মানে সুখদুঃখে ভরা আমাদের বড় প্রিয় এই মর্ত্য পৃথিবী। যাতে আমরা বর্ত রয়েছি। এবারে গুরু একটু একটু করে মুরিদকে বোঝাবেন—

আছে আদি মক্কা এই মানবদেহে।

তারপরে বলবেন :

মানুষ-মক্কা মুরশিদ পদে।

এসবই লালনের বাণী, ফকিরের মধ্যে সেরা ফকির। সেই লালন আরও এক পা এগিয়ে যা বলেছেন তার তাৎপর্য অপরিসীম। বলেছেন :

পড়গে নামাজ ভেদ বুঝে সুঝে—

বরজখ নিরিখ না হলে ঠিক

নামাজ আরও মিছে।

ভেদ মানে রহস্য। নামাজের মূল রহস্য মসজিদে ওঠাবসা নয়, মানবদেহই মসজিদ। গুরু বরজখের কাছে নিরিখ ঠিক না করে যে বাহ্য-নামাজ তা মিথ্যা, ভ্রান্তিপূর্ণ। এইবারে এইখানে লিয়াকতের সংগ্রহ করা চমৎকার গানখানি শোনা যেতে পারে। শাসপুরের সেই মেটে চালাঘরের নিরাভরণ ফকিরি মসজিদে জালাল শাহ আর তালেব শাহ দ্বৈত কণ্ঠে গেয়েছিলেন:

আল্লা কি মসজিদ বানাইলেন দুনিয়ার ভিতরে

তিন গম্বুজ তিনটি সিঁড়ি ভিতরে তার খোদার ঘড়ি

রেখেছে নয় দরজা ছয়জনা মৌলবী ফিরে

আল্লা কি মসজিদ…

খাঁটি দেহতত্ত্বের গান। শরীরের নয় দরজার (দুই চোখ, দুই নাসারন্ধ্র, দুই কান, মুখবিবর, পায়ু ও উপস্থ) প্রসঙ্গ এদেশের দেহবাদীদের খুব পুরনো কথা, কিন্তু ছয়জন মৌলবি বলতে যে শরীরের ছয় রিপু (কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ, মাৎসর্য) বোঝানো হয়েছে যেটা রীতিমতো ব্যঙ্গমূলক। এ হল ফকিরদের তরফ থেকে মোল্লাতন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ উম্মা ও জেহাদ। এর ভাঁজে বলার কথাটা হল শরীরের ভেতরকার রিপুদের যেমন দমন বা পরিত্যাগ করতে হবে, তেমনই মৌলবিদেরও। এরপরে গানের শেষের কথা হল :

দেহের মসজিদে নামাজ পড়লে রত্ন মিলে—

সেই মসজিদের মতল্লি হয়ে

থাকো তাহার মসজিদ আগলে।

‘দেহ-মসজিদ’ ‘দেহ-মক্কা’ ‘দেল-কেতাব’ এসব উচ্চারণ ফকিররা পরপর গেঁথে দেন। এই পরম রত্নময় দেহকে রক্ষা করতে হবে, থাকতে হবে আগলে। মুর্শেদের সেটাই নির্দেশ।

শরিয়তনিষ্ঠ মুসলমানদের যে-পাঁচরোক্ত নামাজ পড়তে হয়, ফকিরদের নামাজ সে ব্যাপারে ভিন্ন নির্দেশ দেয়। লালনের গানে বলা হয়েছে :

পড় রে দায়েমি নামাজ এ দিন হল আখেরি।

মাশুক রূপ হৃদয় রেখে

দেখ আশক বাতি জ্বেলে

কিবা সকাল কিবা বিকাল

দায়েমির নেই অবধারি।

এ হল ভাবের নামাজ, শ্বাস নিয়ন্ত্রণের শরীরী সাধনায় সর্বক্ষণ অন্তরে চলবে ‘দায়েমি’ নামাজ, তার সকাল বা বিকাল কেন, কোনও কালাকালই নেই। উপাস্যের প্রেমময় রূপ হৃদয়ে প্রস্ফুট রেখে, প্রেমের প্রদীপ জ্বেলে নিরন্তর সাধনাই প্রকৃত নামাজ। শরিয়তি নামাজ হল বাহ্য ও পোশাকি।

ফকিরি পন্থায় নানা যুক্তি-বুদ্ধির কৌশল দেখা যায়, সমন্বয় ও উদারতার কথাও থাকে, প্রত্যক্ষ প্রতিবাদ না থাকতেও পারে, থাকে প্রচ্ছন্ন নির্দেশ। যেমন একটা গানে বলা হচ্ছে :

মুরশিদ ভজনা বিনে ও জীবের উপায় নাই—

রোজা নামাজ হজ্জ জাকাত মানা কিছু নাই

মুরশিদ ভজনা বিনে জীবের আর গতিক নাই।

এখানে স্পষ্টই বলা আছে, রোজা নামাজ হজ জাকাত এসব ইসলামি বাহ্যাচার করার কোনও নিষেধ নেই ফকির হয়ে গেলে। কিন্তু মুরশিদ ভজনা করতেই হবে, সেটা আবশ্যিক। ভেতরে যে কথাটা প্রচ্ছন্ন রয়ে গেল তা সূক্ষ্ম ও দ্যোতনাময়— অর্থাৎ মুরশিদ ভজনা করলে তিনি বুঝিয়ে দেবেন ইসলামের পঞ্চবেনা কতটাই ভ্রান্ত, কতটাই বাঁধা গতের একঘেয়েমি। সেটা বুঝলে শিষ্য নিজে নিজেই ওই বাহ্যপথ ত্যাগ করবে।

বাহ্য ছেড়ে অন্তরের দিকে মানুষের অভিযাত্রা খুব নতুন কথা নয়, অন্তত এদেশে। সেই কোন মধ্যযুগের সন্তরা, সেই কবীর-দাদূ-রজ্জবরা মানুষের মধ্যে জাগাতে চেয়েছিলেন আন্তরধর্মকে। সাম্প্রদায়িক ভেদ-বুদ্ধি, জীববলি বা কোরবানি, অসার শাস্ত্রনির্দেশ, পাথরের দেবতা আর মন্দির-মসজিদের বিপরীতে তাঁরা চেয়েছিলেন আত্মবোধন ও মুক্তমনের স্বাধীনতা। মানবতার যথার্থ লক্ষ্য তো সেটাই। তার সঙ্গে পরে যুক্ত হয় সুফিদের রহস্যভাবনা, ধ্যান-জপ-অনুভবের একান্ত আত্মস্থ জগৎ। সেই আত্মস্থতা অর্জনের সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধক হল দেহ। দেহ মানে কামনাবাসনাবদ্ধ অস্তিত্ব, লোভে মোহে বন্দিসত্তা, আলস্যপ্রবণ, বিরামপ্রয়াসী, ভোগী আর ইহজগতের দাস। অথচ এই দেহকে ঘিরেই কায়াবাদীদের সাধনা। সুফিরা যে নিরন্তর জিকির আর মুরাকাবার সাহায্যে স্থিত হতে চান ‘ফানা’ স্তরে এবং তাকেই শাশ্বত করে হতে চান ‘বাকা’, তার জন্যে দেহের নিয়ন্ত্রণ দরকার। অর্জন করতে হয় দেহের ওপর মনের কর্তৃত্ব। সুফিসাধনায় সে রকম কিছু তরিকা আছে। দুটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা জানাই।

খুব ছোটবেলায় আমাদের শহরে বড় রাস্তার ধারে ধুলোয় বসে থাকত এক পাগল। সবাই তাকে পাগল বলেই জানত। কারণ লোকটি ছিল বাহ্যজ্ঞানহীন, নির্লিপ্ত স্বভাবের। একটা ছেঁড়া কাপড় আর জীর্ণ ফতুয়া পরে একমুখ দাড়ি গোঁফ নিয়ে সে দিনরাত বসে থাকত পথে। রোদে জলে ঝড়ে নির্বিকার। পুরো গ্রীষ্ম আর বর্ষা চলে গেল তার শরীরের ওপর দিয়ে। মানুষটি নির্বাক ও আত্মমগ্ন। পরে একদিন কোথায় উধাও হয়ে গেল। কোথা থেকে এসে কোথায়ই বা গেল কেউ জানল না। জানতে চেয়েছিলও কি? উন্মাদের নিজস্ব পাঠক্রমে আমাদের মতো মানুষের, উন্নতিকামী জীবের কীইবা কৌতূহল থাকতে পারে?

পরে, প্রায় চল্লিশ বছর পরে, বিশেষ এক সূত্রে জানতে পারলাম লোকটা পাগল ছিল না (যা সবাই ভেবেছিল) বা ব্রিটিশের গোয়েন্দা (কেউ কেউ বলত), ছিল সুফিপন্থার সাধক। তার মুর্শেদ তাকে শরীর চেতনা থেকে মুক্ত হবার জন্য ওই ভীষণ কষ্টকর তরিকা দিয়েছিলেন। পরে কলকাতার সেই মুর্শেদ তাকে নির্দেশ দেন মানুষ-টানা রিকশা চালাতে। সেই কষ্টও অতিক্রম করার পর তাঁর ভাবসাধনা ও জপধ্যানের অধিকার এসেছিল এবং শেষ পর্যন্ত তিনি হয়ে ওঠেন কাদেরিয়া খান্দানের নাম করা পির ফকির। পার্ক সার্কাসের কবরখানায় রেললাইনের ধারে তাঁর ঐশী সমাধিতে এখনও ভক্ত সমাগম হয়।

এই সিদ্ধ সাধককে আমি দেখেছি আবার দেখিনি। চাক্ষুষ তো দেখেছি ছেলেবেলায়, স্কুল যাবার পথে। সত্যদৃষ্টি ছিল না, ভেবেছি উন্মাদ। আসলে দিব্যোম্মাদ, কিন্তু তা বোঝার বয়স হয়নি, কেউ বলেওনি। তাঁর মুখাবয়বটি পর্যন্ত মনে করতে পারি না, কিন্তু তাঁর সেই স্থির বসে-থাকা মূর্তিটি মনে আছে। নিশ্চয়ই আত্মস্থ। অন্তরে চলছিল অনুভবের সংলাপ তাঁর মাশুকের সঙ্গে। এসব কথা আমি জানতে পারি তাঁর মুরিদ নূর শাহ-র কাছে। পুরো নাম নূর শাহ বাবা। উর্দুভাষী ভিন্ন প্রদেশী মানুষ। সুফিসাধনার টানে এসেছিলেন তাঁর মুর্শেদ রজা শাহ বাবার চরণাশ্রয়ে।

নূর শাহ বাবাকে যখন দেখেছি তখন তাঁর বয়স সত্তরের কোঠায়, আমার চল্লিশ। অধ্যাপনা করি আর গ্রাম গ্রামান্তে খুঁজে বেড়াই বাউলবৈরাগী উদাসীনদের। ফকিরি পন্থার কিছুই জানি না। নূর শাহ বাবার সঙ্গে আমার-দেখা বাউলবৈরাগীদের কোনও মিল খুঁজে পেলাম না। মানুষটির মুখমণ্ডল সৌম্য ও প্রশান্ত। চোখ দুটি সুদূরসন্ধানী। সত্তরেও খাড়া নির্মেদ শরীর। একমুখ সাদা দাড়ি। মাথা পরিপাটি করে কামানো। পরনে সাদা ফতুয়া আর সাদা তহবন্দ, গলায় পাথরের মালা, হাতে তসবি বা জপমালা।

আমাদের শহরের এক ধনী মাড়বার নন্দন জীবনের অনেকটা অংশ ভোগসুখ আর ব্যাবসাবাণিজ্য করে কাটিয়ে হঠাৎ হয়ে পড়েন উদাসীন বৈরাগী স্বভাবের তাঁর অন্ত্য জীবনে। বরাবরই ভজন ও খেয়াল গাইতেন, শিখেছিলেন গুরুর কাছে নাড়া বেঁধে। বাড়িতে গৃহদেবতা গোপাল বিগ্রহকে ঘিরে মহাসমারোহে রাস ও ঝুলন উৎসব হত। কোন সূত্রে কার প্ররোচনায় কে জানে, তিনি হঠাৎ পার্ক সার্কাসে তিলজলায় গিয়ে নূর শাহ বাবার কাছে রহস্যনিমীল সুফিপন্থায় দীক্ষা নেন সস্ত্রীক এবং সাধনায় মগ্ন হয়ে পড়েন গভীর উৎসাহে। তাঁর বাড়িতেই আমি প্রথম নূর শাহ-র মতো উন্নত মার্গের সুফিসাধক দেখার সৌভাগ্য অর্জন করি। সৌভাগ্য, কেননা অত উচ্চস্তরের সুফি মুর্শেদ সকলকে দেখা দেন না, তাঁদের আস্তানায় প্রবেশাধিকার অর্জন তো অসম্ভব। ওই মাড়বার শিষ্যের বাড়িতে তিনি ক’দিন ছিলেন এবং সেই উপলক্ষে একসন্ধ্যায় বসেছিল কাওয়ালি গানের আসর। আসর বসেছিল সন্ধ্যা সাতটা নাগাদ, শেষ হয়েছিল ভোর ছটায়। মনে আছে, তখন গ্রীষ্মকাল। আসরে আমি আমন্ত্রিত ছিলাম আরও ক’জন ভাগ্যবানের সঙ্গে।

সত্যি বলতে, আমি কখনও কাদেরিয়া সুফি খান্দানের হালচাল জানিনি, দেখিনি তাদের সমাবেশ। যখন গেলাম তখন সন্ধ্যা ছুঁই ছুঁই বিকাল। গৃহস্বামীর প্রশস্ত প্রাঙ্গণে প্যান্ডেল বাঁধা হয়েছিল। একটু উঁচু মঞ্চে গানের আসরের বন্দোবস্ত। প্রাঙ্গণের সর্বত্র শতরঞ্চি পাতা শ্রোতাদের জন্য। মাঝখানে একটি প্রশস্ত গালিচায় শ্বেতশুভ্র চাদর পাতা, ফকির বাবার বসার জন্য। বসবার জায়গায় দু’পাশে ও পিছনে মোট তিনটে তাকিয়া, মুর্শেদ হেলান দেবেন প্রয়োজনে। সমস্ত পরিবেশ শান্ত, অদৃশ্য গন্ধ ধূপ ভেসে বেড়াচ্ছে বাতাসে। খুবই সীমায়িত সংখ্যক শ্রোতা, সাকুল্যে বিশজন হয়তো। তার মধ্যে টানা মোটর গাড়িতে এসেছেন জন পনেরো ভক্ত, তাঁরা দৃশ্যত মুসলমান এবং বেশ ধনী বলে মনে হল। অন্তত আটজন কাওয়ালি গায়ক এসেছেন যন্ত্রীদের নিয়ে। সকলেই চোস্ত উর্দুতে কথা বলছেন। জানা গেল নূর শাহ বিকাল থেকে আছেন ঠাকুর ঘরে। সেখানে উঁকি মেরে দেখলাম তিনি চাদরের ঘোমটা টেনে একেবারে নিঃসাড়ভাবে ধ্যানস্থ, এ-জগতেই যেন নেই। সামনে তাঁর গুরু রজা শাহ বাবার ফোটো। অসামান্য শান্ত পরিবেশ।

ওদিকে মাঝে মাঝে ছোট গেলাসে শরবত আর চা এসে যাচ্ছে। কেউ অসহিষ্ণু নন, নিচুস্বরে কথালাপ চলছে। দু’জন কাওয়াল যন্ত্র বেঁধে মঞ্চে প্রস্তুত, বাবা এলেই গান শুরু হবে। সন্ধ্যা উতরে যাবার একটু পরে হঠাৎ ঠাকুর ঘরের দরজা খুলে নুর শাহ এসে তাঁর নির্দিষ্ট আসনে বসলেন। কোনও কথা নয়, শুধু প্রসন্ন চোখে সবাইকে দেখলেন, ঠোঁটে ফুটল একটু হাসি। একজন ভক্ত টাটকা আনকোরা একশো টাকা, পঞ্চাশ-বিশ-দশ টাকার নোট তাঁর সামনে রেখে গেলেন। দেখে মনে হল অন্তত হাজার পাঁচেক টাকা। ভাবলাম, একি ফকিরের নজরানা? মন একটু একটু বিরূপ হচ্ছিল। ভাবছিলাম যত সব বড়লোকী কাণ্ড, ধর্মের নামে বিলাস৷ পরে, সারারাত ধরে বিস্ময় পরিকীর্ণ চোখে দেখব ওই পাঁচ হাজার টাকাই বাবা দান করে দেবেন কাওয়ালদের গানের সমজদারি করে। একে বলে কদরদানি। খুব ভাবের গানে গায়কের চেতনা যখন ঊর্ধ্বস্তরে উঠে যাবে, সকলে বিবশ হয়ে পড়বেন সুরের জাদুতে, সেই মায়াময় অপরূপ ক্ষণে নূর শাহ বাবা দশ বিশ পঞ্চাশ একশো টাকা যেমন মনে হবে তুলবেন। একজন ভক্ত এসে সেই টাকা নিয়ে শিল্পীকে দেবেন। শিল্পী জানাবেন আভূমি কৃতার্থ কুর্নিশ।

যেন একটা অত্যাশ্চর্য অমা নিশিথিনী— পরিপূর্ণ, উদ্‌বেল অথচ সংযত। চারদিকে শুধু সুরের গুঞ্জরন, তাতে শুদ্ধতম স্বরক্ষেপণের কৌশলে মন বিবাগী হতে চাইছিল। গান তো নয়, যেন অপার্থিব অনুভবের মায়াবী উৎসারণ। উর্দুভাষায় রচিত বাণী একটু আড়াল টানছিল ঠিকই কিন্তু সেসব গান ঠিক অর্থবোধের বাধ্যতায় সীমাবদ্ধ নয়, অনেক ব্যাপ্ত আর সম্ভ্রান্ত। গায়ক যেন সেই গানের বেদনায় নিজের আকুতিকে নিংড়ে দিচ্ছিলেন। তাঁদের মুখাবয়বে সে কী আততি, সে কী সমর্পণ! কাওয়ালি গানের ভক্তিমার্গ এই একবারের মতো আমার জীবনে অনর্গলিত হয়ে কোন অজানা ঐশী মায়ায় ভরে দিয়েছিল কিছুক্ষণ।

কিন্তু আমি ভাবছিলাম অন্য একটা কথা— দেখছিলাম স্থির নির্বিকল্প মুর্শেদের মূর্তি। যেন তিলোকের ওপারে, গানের সুরের আসনখানি ডিঙিয়ে, বাবার চৈত্যপুরুষ (Psychic Being) পর্যটন করছিল অন্য কোনখানে। সুফি সাধনার লব্জে পর্যটন আর পর্যটকের প্রসঙ্গ আগেই বলেছি। লিখতে গিয়ে মনে পড়ল অনন্ত দাসের একটা পদ :

মন চলো যাই ভ্রমণে—

কৃষ্ণ-অনুরাগের বাগানে।

চমৎকার ভাবনার বুনোট। কৃষ্ণ-অনুরাগ রূপ একটা পুষ্পবিকশিত সৌরভময় বাগান যেন সাধকের মনের মধ্যে তৈরি হয়ে আছে। সেইখানে চলে যেতে ইচ্ছে পরিভ্রমণে। সেই স্থান বড় মধুর বড় হৃদয়হরা, কাওয়ালির আসরে নূর শাহ বাবার শরীরটা স্থির উপবিষ্ট কিন্তু তাঁর মন আনন্দিত ভ্রমণে নিরত। সেই গভীর চলা আমাদের কাছে একেবারে অদৃশ্য, গোপন।

ভাবছিলাম নিজের কথাও। কী চঞ্চল মন, কিছুতেই কি সুরের পদ্মে বসতে পারছে আমার প্রাণভ্রমর? পারছে না। শুধু এটা দেখছি, ওটা দেখছি। দেখছি কাওয়ালি শিল্পীদের বিচিত্র রঙিন কারুকাজ করা অঙ্গবাস। তাদের মাশুকে নিবিষ্ট চোখের কোণে সলাজ নিবেদন— তাও দেখছি। শুধু গান আমাকে নিয়ে যেতে পারছে না কোনও শান্ত ভ্রমণের উৎসমুখে। কী অস্থির আর অপটু আমার শরীর। একজায়গায় স্থির হয়ে বসার অভ্যাস নেই, কেবলই ঠাঁইবদল করছি, অস্বস্তি সারা শরীরে। মাঝে মাঝে যাচ্ছি প্রকৃতির ডাকে। মাঝে। মাঝে চা খেয়ে ঘুম তাড়াচ্ছি। বুঝতে পারছি এই স্থূল দেহের কী পরাক্রম। আমি দেহগতভাবে কত অসহায়, মনের নিয়ন্ত্রণ কত অসম্ভব।

অথচ ওই সামনে-বসা নূর শাহ বাবা, শান্ত অচঞ্চল জাগর স্থির। শরীরের তিনপাশে আরামে ঠেস দেবার তাকিয়া কিন্তু একবারও এলাচ্ছে না সত্তরোর্ধ্ব কাঠামো। সেই বিকেল থেকে ছিলেন ঠাকুরঘরে ধ্যানস্থ, সেখান থেকে সটান আসরে এসে উপবেশন। প্রকৃতির ডাক তো অনেক দূর, কোনও বাহ্যাচারই নেই। হাতের ওঠাপড়া কিংবা বসার ছাঁদ একটুও বদলাচ্ছে না। শুধু টাকা দেবার সময় যা একটু নড়াচড়া। চা পানের প্রশ্নই নেই— কোন অলৌকিক স্বর্গীয় মদে যেন নেশাতুর। কেবল স্থিরদৃষ্টি, অন্বেষী ও অন্তর্গূঢ়। এই তা হলে ‘রাবিতা’— উপাস্য আর উপাসকের মধ্যে আন্তঃসংযোগ। এই কি তবে সুফিসাধনার চরম বা পরম স্তর ‘ফানা’? উনি কি চিরন্তন প্রেমবন্ধনে বাঁধা পড়ে পরম প্রেয়র সঙ্গে সেতুসম্ভব সম্পর্কে গড়ে তুলে একেবারে ‘বাকা’ হয়ে গেছেন। চলছে অশ্রুত অনুচ্চারিত সংলাপ?

তখন মধ্যযাম— পৃথিবীর সবচেয়ে মায়াবী প্রহর। এ সময়েই নাকি জীবনের গভীর অনুভব জেগে ওঠে সাধকদের মনে ও মননে। দু’জন করে কাওয়ালি গায়ক মঞ্চে আসছে তারপর টানা ঘণ্টাদুয়েক গেয়ে নূর বাবাকে সেলাম দিয়ে নেমে যাচ্ছে। যেন তাঁকে শোনানোর জন্যই তাদের গানের শিক্ষা। গুরুর কদরদান তাদের জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জন। তারা তৃপ্ত।

এইভাবে একাদিক্রমে গানের পর গান শুনতে শুনতে ভোর হয়ে গেল। ভৈরোঁ রাগে বিলম্বিত ছন্দে গান ধরলেন গৃহস্বামী। সে গান দ্ব্যর্থমূলক শব্দবহুল কাওয়ালি নয়, ধ্বনিময় ধ্রুপদ। সমাসন্ন ভোরের অরুণছটার মাঝে সুরের সুরধুনী অপার্থিব আবহ সৃষ্টি করলেও তাতে নিশীথ রাতের প্রাণ ছিল না। গানের মাঝখানে নূর শাহ উঠে আবার চলে গেলেন ঠাকুরঘরে। আসর শেষ হল। অনন্য এক অভিজ্ঞতার তাপ বুকে নিয়ে যখন বাড়ি ফিরছি তখন শরীরে কোনও গ্লানি নেই কারণ মন যে কানায় কানায় ভরা।

পরদিন বিকেলে শুভ্রসুন্দর দীপ্তি উজ্জ্বল সেই সুফিসাধকের কাছে বসে শুনতে পেলাম নানারকম কথা। রজা শাহ বাবার বৃত্তান্ত। নূর শাহ বাবার কত কি অনুভূতি। উত্তরপ্রদেশের জাতক, পাকা গমের মতো বর্ণোজ্জ্বল সেই বৃদ্ধ ভাঙা বাংলায় আমার প্রশ্নের জবাব দিচ্ছিলেন শান্ত স্বরে, প্রসন্ন প্রশ্রয়ের হাসি মুখে ছিল। তারপর কত বছর কেটে গেছে। তাঁর মাড়বার শিষ্য কর্কটরোগে আক্রান্ত হয়েও কোনও ওষুধ খাননি, শুধু বাবার দেওয়া মাটি খেতেন। তাঁর প্রতি অকলঙ্ক বিশ্বাস রেখে প্রয়াত হলেন। এখনও পার্ক সার্কাস স্টেশন সংলগ্ন কবরখানার দিকে নজর গেলে নূর শাহ বাবার স্মৃতির প্রতি বন্দেগি জানাই। ভাবি, কী আশ্চর্যভাবে সুফিসাধনার সবচেয়ে দুর্লভ দৃশ্য দেখেছি। বাহ্যদশা কাটিয়ে অন্তর্দীপ্ত ধ্যানতন্ময়তায় লব্ধ ‘মুরাক্কিবহ্‌’ তারপরে ক্রমশ ‘ফনা ফিল্‌লাহ্‌’ পেরিয়ে ‘বক্কা বিল্‌লাহ্‌’-তে স্থিতি।

সুফি সাধনার এই ঝলক দর্শনের স্মৃতি এখানে উঠে এল এটা বোঝাতে যে ইসলামের নামাজ রোজা হজ জাকাতের ব্যবহারিক পৌনঃপুনিকতার স্থানে সুফিতত্ত্ব কী ভাবে অন্তঃশীল অনুভবের সঙ্গে জীবনকে মিশিয়ে দিতে পারে। নিজের অস্তিত্বকে করে তোলে মহীয়ান। ফকিরিতন্ত্র— সুফিতত্ত্ব থেকেই সম্ভবত আত্মতত্ত্ব উদ্‌বোধনে ব্রতী হয়েছে। লালনের ভাষায় ‘আত্মতত্ত্ব যে জেনেছে/ দিব্যজ্ঞানী সে হয়েছে।’ এই আত্মতত্ত্বে অধিকার এলে শরার কেতাব খসে পড়ে, কায়েম হয় ‘দেল-কেতাব’ বা আত্ম-নির্দেশ। ফকিরদের স্বরূপ তথা ফকিরিয়ানা বুঝতে গেলে ইসলাম বুঝতে হবে প্রথমে, তারপরে অনুধাবন করতে হবে সুফিতত্ত্ব। এতক্ষণ সেই প্রয়াস নেওয়া গেল। এবারে ফকিরি পন্থার কথা।

বহুকাল আগে, সেই ১৮৯৮ সালে মৌলবি আবদুল ওয়ালী তাঁর ইংরাজি গদ্যে লেখা নিবন্ধে (‘On some curious Tenets and Practices of a certain class of Fakirs of Bengal’) একটা পদাংশ ব্যবহার করেছিলেন। তাতে বলা হয়েছে:

আউলে ফকির আল্লাহ্‌ বাউলে মুহাম্মদ

দরবিশ আদম সফী এই তক হদ।

তিন মত এক সাত করিয়া যে আলী

প্রকাশ করিয়া দিল সইমত বলি ॥

এ ধরনের পদ ব্যাখ্যা করবেন যথাযথভাবে সেরকম মননশীল পণ্ডিত বা সাধক পাওয়া কঠিন। একজন লোকায়ত সাধকের কাছে এই পদটি আউড়ে ওয়ালীসাহেব ব্যাখ্যান চেয়েছিলেন। তিনি মোটামুটি যা বলেছিলেন তা হল আউলদের মধ্যে আল্লা আছেন ফকিররূপে, বাউলদের মধ্যে মহম্মদ রসুল আর আদম তনের মধ্যে রয়েছেন দরবেশ। এই তিন মতের সমন্বয়ই হল সাঁইমতে। আমাদের লালন সাঁই সেইজন্য এতবড় মান্যতা পান। তাঁর মধ্যে ফকির-বাউল-দরবেশ সব কিছুর মিলন।

এ সব ব্যাখ্যা শুনে যাওয়া ছাড়া উপায় কী? নিতান্ত মনগড়া কিংবা গোঁজামিল ভাষ্য যদি ভাবি তাতেও দোষ নেই। একালের শিক্ষিত পণ্ডিতদের মধ্যে আরবি-পারশি লজ জানা গৌতম ভদ্র খুব সতর্ক বিশ্লেষক এবং তথ্যের ভাণ্ডারী। তাঁর লেখা থেকে কিছু ইঙ্গিত আমরা নিতে পারি ফকির বা দরবেশ প্রসঙ্গে। তিনি মনে করেন,

দরবেশের প্রতিশব্দ রূপে নানাভাবে নানা শব্দ এসেছে। ফকির, কলন্দর, আজাদি বা মিসকিন। কোনটা আরবি, কোনটা বা ফারসি।… দরবেশিয়ানায় ব্যাখ্যায় আছে, ‘ফকিরিয়ানা, গরিবিয়ানা, দরবেশিয়ানা গুজরান ইয়া মেজাজ।’ ফকির, গরিব, মিসকিন ইত্যাদি শব্দের মধ্যে দারিদ্র, নিঃসম্বলতা, নিঃস্ব অবস্থাও বোঝায়। সেটা যে আদৌ আধ্যাত্মিক তা কিছু নয়। গরিব গুর্বোর সাধারণ প্রতিশব্দ ফকির। কিছু না থাকা যত্রতত্র ঘুরে বেড়ানোই যেন এদের চিহ্ন, আস্তানা তো মানুষকে আটকে দেবে।

তলিয়ে ভাবলে মনে হতে পারে ফকিরিয়ানার দুটো চেহারা। একটা হল দীন দরিদ্র নিঃসম্বল নিঃস্ব মানুষ। আরেকটা হল একরকম ত্যাগব্রতী প্রবণতা, স্বেচ্ছায় মেনে নেওয়া দরিদ্র ঠাঁইনাড়া জীবন। এক্ষেত্রে বোঝা দরকার, জীবনকে গ্রহণ করবার দুটো ছক আছে— হয় দীনদারি না হয় দুনিয়াদারি। দুনিয়াদারি হল ভোগসুখ সহায় সম্পদ সম্পত্তি কর্তৃত্ব এবং তার পরিণামে অনিবার্য দুঃখ শোক বেদনা। আর দীনদারি মানেই বাহ্য উপভোগের সম্পদ আহরণের পথ ছেড়ে স্বেচ্ছায় দরিদ্র নিরুপাধি জীবনকে মেনে নেওয়া। ব্যাপারটা বোঝাতে একটা গানের সাহায্য নিতে পারি, গানটা আগে একবার উদ্ধৃত হয়েছে। তাতে বলা হচ্ছে :

আমি দালান কোঠা ত্যাজ্য করি

গাছতলা করেছি সার।

ধুতি চাদর ত্যাজ্য করি ডোরকৌপীন করেছি সার।

অর্থাৎ মানুষটা সর্বাংশে ত্যাগী নয় কিন্তু ভোগের পথ থেকে স্বেচ্ছায় সরে এসেছে, জীবনের আয়োজনকে খানিকটা খর্ব করে নিচ্ছে। দালান কোঠাতে থাকাই যায়, ছিলামও সেখানে, কিন্ত এখন সার করেছি বৃক্ষতল। সভ্যসজ্জা আভরণ ছেড়ে ডোরকৌপীনে নিজেকে বেঁধেছি। এর ইঙ্গিত বেশ পরিষ্কার। অনিকেত যোগজীবনে বৃক্ষতলই আশ্রয়, ডোর কৌপীন দেহসংযমের প্রতীক। আমাদের প্রাচীন চিত্রকলায় দরবেশ বা ফকিরদের যে ছবি পাই তাতে হয় তাঁদের ভ্রাম্যমাণ রূপ, না হয় বৃক্ষতলে বসে উপদেশরত রূপে দেখা যায়। সর্বত্রই তাঁদের দীনবেশ।

মানুষের পক্ষে এই রাজভিখারি হবার বিকল্প কারুর কারুর জীবনে আসে। গৌতম ভদ্র সুন্দর লিখেছেন :

বাদশাহি ও দরবেশি দুই পৃথক জীবনযাত্রা, আচরণবিধি। এরা আলাদা কোন সম্প্রদায় নন। লোকেরা বাদশাহি পথে যেতে পারে, আবার ইচ্ছা করলে দরবেশি পথও বেছে নিতে পারে। ব্যক্তি বিশেষে বাদশাহও দরবেশ হন, দরবেশেরও বাদশাহ হতে কোন বাধা নেই।

কিন্তু বাস্তবে আমরা কী দেখছি? নদিয়া-মুর্শিদাবাদ-বীরভূম-বর্ধমানে আমি গত কয়েক দশকে অনেক ফকিরের সঙ্গ করেছি। লিখিত সাহিত্যেও ফকির চরিত্রের সন্ধান মেলে। জলধর সেন লিখেছেন কেমন করে কাঙাল হরিনাথ ফিকিরচাঁদ ফকির নাম নিয়ে গান রচনা করলেন তার বৃত্তান্ত। লিখছেন :

সেদিন প্রাতঃকালে লালন ফকির নামক একজন ফকির কাঙালের সহিত সাক্ষাৎ করিতে আসিয়াছিলেন।… তাঁহার এক অমোঘ অস্ত্র ছিল— তাহা বাউলের গান।… সেই লালন ফকির কাঙালের কুটিরে, সেইদিন আসিয়াছিলেন এবং কয়েকটি গান করিয়াছিলেন।

প্রাতঃকালে যখন গান হয়, তখন আমরাও উপস্থিত ছিলাম, গানও শুনিয়াছিলাম : কিন্তু আমরা যে সে গানের মর্ম ধরিতে পারিয়াছিলাম তাহা বলিতে পারি না। …বাউলের গান তখন তেমন প্রচলিত হয় নাই; ক্কচিৎ কখনও দুই একজন ফকির বা দরবেশের মুখে এক আধটা দেহতত্ত্বের গান আমরা শুনিয়াছি।

উনিশ শতকীয় এই অকপট জবানি থেকে দুয়েকটা সাময়িক তথ্য ও বিচার উঠে এসেছে। জলধর সেন লালন শাহকে একজন ফকির বলে চিহ্নিত করেছেন অথচ তাঁর কণ্ঠে শুনেছেন বাউল গান। এরপরের মন্তব্য হল বাউল গান তাঁর দুর্বোধ্য লেগেছে এবং বাউল গান তখন লোকসমাজে তত প্রচলিত ছিল না। বরং ফকির দরবেশদের (বলা বাহুল্য তারা স্বভাব ভ্রাম্যমাণ) মুখে এক-আধটা দেহতত্ত্বের গান শোনার অভিজ্ঞতা ছিল। এই ভাষ্য খুব মূল্যবান, কারণ এর থেকে বোঝা যাচ্ছে ফকিরি গান অনেক আগে থেকে প্রচলিত ছিল, বাউল গানের ধারা তার পরের। ফকির আর দরবেশ যে দুটি আলাদা সম্প্রদায় তাও বোঝা যায়।

লালনের সেদিনকার গান অবশ্য জলধর সেন কিংবা অক্ষয়কুমার মৈত্রের মতো শিক্ষিত মধ্যবিত্তের মনে খুব নতুন করে অনুপ্রেরণা জাগায় এবং তার ফলে তাঁরা এক ধরনের নির্বেদমূলক গান লিখে বসেন বাউলগানের ধাঁচায়। গান লেখা হলে তাতে ভণিতা দেন ‘ফিকিরচাঁদ ফকির’। পরে সেই গানে কোনও চলতি সুরু কাঠামো লাগিয়ে হরিনাথকে শোনান। হরিনাথ তাতে উৎসাহিত হয়ে নিজেও গাইতে গাইতে শেষে নৃত্যপর হলেন। এবারে তাঁর নবজন্ম হল। তিনি লিখতে শুরু করলেন একরকম পারমার্থিক ভাবনার গান, গানের পর গান, গড়ে উঠল গানের দল, ফিকিরচাঁদি গানের ঢং, তার সুরে সারাদেশ পরিপ্লাবিত হল।

কাঙাল হরিনাথের গানে ফিকিরচাঁদ ফকির ভণিতাটি সমারূঢ়। এটা তাঁর নিজের উদ্ভাবন নয়। তাঁর বান্ধববর্গ এই ভণিতার নির্মাতা। কেমন অনায়াসে জলধর সেন লিখেছেন, ‘আমাদের ত ধর্মভাব ছিল না, কোনও “ফিকিরে” সময় কাটানোই আমাদের উদ্দেশ্য।’ সেই ফিকির অবশ্য কাঙালের বেশ মনঃপূত হয়ে গেল। ১২৯৩-১৩০০ সালের মধ্যে ১২ পৃষ্ঠা করে ‘কাঙাল-ফিকিরচাঁদ ফকিরের গীতাবলী’ ১৬ খণ্ডে প্রকাশিত হয়।

ফকিরদের আলোচনায় নানা ধরনের তথ্য আর বৃত্তান্ত ব্যবহার করে বোঝাতে চাইছি কী কারণে কে জানে ফকির সাজতে অনেকে চেয়েছেন ইতরভদ্র দু’-তরফেই। ফকির নামে আত্মপরিচয় দিতে অনেকে চেয়েছেন। গ্রাম বাংলার গত দেড় শতক ধরে ফকির নামে বহুজনকে পাওয়া গেছে হিন্দু মুসলমানদের মধ্যে। অনেক গীতিকার বা মহাজন ফকিররূপে পরিচয় দিয়েছেন নিজের। রবীন্দ্রনাটকে দাদাঠাকুর মঞ্চে এসেছেন ফকিরবেশে। কিন্তু। কোনও অনিবারণীয় কারণে ফকিরদের অনুষঙ্গে মুসলমান পরিবেশের একটা ছাপ থেকে যায়। অর্থাৎ অনেকে মনে করেন শরিয়তের পথ ছেড়ে যাঁরা মারফতির পথে এসেছেন তাঁরাই বুঝি ফকির। কিন্তু হিন্দু ফকিরও বহু আছেন। ফকিরিয়ানা একটা Life style বা জীবনপ্রবণতা বলাই ভাল।

কিন্তু মুসলমানদের সঙ্গে ফকিরদের প্রত্যক্ষ যুযুধান সম্পর্ক বহুদিন ধরে রয়ে গেছে। একটা সময়ে ফকিরদের বাউলদের অন্তর্ভুক্ত যে ভাবা হত তার প্রমাণ রেয়াজউদ্দিনের বই ‘বাউল ধ্বংস ফৎওয়া’ থেকে পরিস্ফুট। উত্তরবঙ্গে একসময়ে বাউলখেদা আন্দোলন হয়েছিল। কিন্তু তাঁরা কি বাউল ছিলেন না মারফত পন্থার ফকির ছিলেন?

বাংলাদেশের গবেষক হাবিবুর রহমান পূর্ব ও নিম্নবঙ্গে বাউল সংগীতাঞ্চলের রূপরেখা এঁকেছেন সরেজমিন ঘুরে। তাঁর সিদ্ধান্ত :

সমগ্র কুষ্টিয়া, যশোর, খুলনা (সুন্দরবনাঞ্চল অর্থাৎ রামপাল, সরোনখোলা, মোরেলগঞ্জ, পাইকগাছা, দাকোপ ও শ্যামনগর থানা ব্যতীত), ঢাকা, টাঙ্গাইল (মধুপুর থানা ব্যতীত), ময়মনসিংহের জামালপুর মহকুমা (শ্রীবর্দী, ঝাড়িয়াগীতি, নাক্‌লা দেওয়ানগঞ্জ, শেরপুর ও নলিতাবাড়ি ব্যতীত) ও সদর দক্ষিণ মহকুমা এবং সিলেট জেলার সদর মহকুমা (জয়ন্তিয়া ও গোরাইন ঘাট ব্যতীত), মৌলভীবাজার মহকুমা ও সুনামগঞ্জ মহকুমার ছাতক, জগন্নাথপুর সুনামগঞ্জ থানা এবং হবিগঞ্জ মহকুমার সদর, চুনারুঘাট, বাহুবল ও নবীনগঞ্জ থানা নিয়ে বাউল সংগীতাঞ্চল রূপায়িত হয়েছে।

এই বিশাল বিস্তীর্ণ জনপদ আজকের বাংলাদেশে এমন প্রশাসনিক বিভাজনে শনাক্ত করা যাবে না, কারণ বহু জেলা ও উপজেলায় এখনকার নববিন্যাসের অন্য চেহারা। তবে এসব অঞ্চলে লোকায়ত জীবন এখনও অনেকটা আছে। তবে বাউল গানের বদলে ‘বাউল্যা’ বা ‘বাউলিয়া’ গান, কিংবা ‘ফকিরালি’ গান সংজ্ঞাই এদিকে বেশি প্রচলিত। সিলেটের মানুষ খালেদ চৌধুরী, নির্মলেন্দু চৌধুরী ও দিনেন্দ্র চৌধুরীর সঙ্গে আলাপচারিতে জেনেছি তাঁদের শৈশব কৈশোরে তাঁরা যেসব গান শুনেছেন শিখেছেন তা হয়তো ততটা বাউলবর্গীয় নয়। বরং ফকিরালি গান তাঁদের অধিকতর চেনা। মারিফতি ফকিরদের গান তাঁদের স্মৃতিতে এখনও সজীব।

হাবিবুর রহমান একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন মুসলমান কট্টরবাদীদের সঙ্গে মারফতি ফকিরদের দ্বন্দ্ব প্রসঙ্গে। তাঁর ধারণা :

ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় পদে তদানীন্তন নিম্ন বাংলায় (যশোহর-বরিশাল-ফরিদপুর) ওয়াহাবী ও ফারায়েজী আন্দোলনের উদ্ভব ঘটে। এ আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য ছিল মুসলমান সমাজ থেকে শের্ক ও বেদাতী দূর করা। এদের অভিযানের ফলে অনেকে গান-বাজনা ছেড়ে দেয়। কেউবা পালিয়ে প্রত্যন্ত অঞ্চলে আশ্রয় নেয়। ঢাকা জেলার মানিকগঞ্জ মহকুমার সাটুরিয়া থানা এমনিতর একটি পলাতক বাউলদের মূল কেন্দ্র হিসেবে গড়ে ওঠে।

এ রকম কোনও পলাতক বাউল বা ফকিরকেন্দ্র পশ্চিমবঙ্গে গড়ে ওঠেনি, কারণ এখানকার মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে সে সময় তেমনতর উগ্রপন্থী সংগঠন ছিল না। কিন্তু নিম্নবঙ্গে উত্তরবঙ্গে ও পূর্ববঙ্গের বিস্তৃত অংশে ধর্মোন্মাদ কট্টর ইসলামি জনসমাজ বিশেষত মোল্লাতন্ত্র বাউল ও মারফতি ফকিরদের বিতাড়নে ও চিত্তশুদ্ধিতে সক্রিয় ছিল। তার ফলে ওই বঙ্গে যা ঘটেছিল তা হাবিবুর রহমানের মন্তব্যে আমরা জানতে পারি। তাঁর সিদ্ধান্ত :

বাউল সাধনা মূলত দেশজ ও সুফীতত্ত্বের সমন্বিত সাধনা। কিন্তু ফারায়েজী ওয়াহাবী আন্দোলনের ফলে বাউলের সাধনসংগীতে দেশীয় তত্ত্বের বিয়োজন ঘটে। এ গানে হেদায়েতি (হিদায়েত শব্দটির অর্থ সঠিক পথে পরিচালিত বা নির্দেশিত হওয়া) বিষয়ক ভাব ও সুফীতত্ত্বের অবতারণা করা হয়। বস্তুতপক্ষে এই সময় থেকেই বাউল গানের বিচার শাখার সূচনা হয়। বাউলের মধ্যে সাধন-ভজনে মৌলিক বিষয়ে প্রশ্ন উত্থাপিত হলে সেগুলোর সুচারু ব্যাখ্যারই অপর নাম বিচার গান। ঢাকা জেলা ও এর সন্নিহিত অঞ্চলে বাউল গান ‘বিচার গান’ নামে পরিচিত। অন্যদিকে টাঙ্গাইল ও ময়মনসিংহের পশ্চিমাঞ্চলে ও জাতীয় গান ‘ফকিরালী’ এবং পূর্ব সিলেটে ‘বাউলা’ গান নামে পরিচিত। কুষ্টিয়া যশোহর ও খুলনা জেলায় ও গান ‘ভাব’ ‘ধুয়া’ ও ‘শব্দগান’ নামে বহুল পরিচিত।

হাবিবুর রহমানের মন্তব্য পুরোপুরি গ্রহণযোগ্য নয়, তথ্যের ভ্রান্তিও আছে, কিন্তু একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন আছে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণে। হেদায়েতি প্রয়াসে বাংলার মৌল বাউল গানের দেশজ ভাব ঝরে গিয়ে গড়ে উঠেছে বিচার গানের নতুনত্ব এমন সিদ্ধান্ত অন্য কারুর লেখায় পাইনি। তা যদি হয়ে থাকে তবে বুঝতে হবে একদল বাউল পালিয়েছিল, আরেকদলের গানের অন্তঃশরীরে ধর্মব্যবসায়ীরা পরিবর্তন এনেছিলেন, যাকে বলে Thematic variation। তা কেন হবে? গানকে অনৈসলামিক বিবেচনা করলে তাকে সমূলে উৎপাটন করাই স্বাভাবিক। কারণ এখনকার দিনে মুর্শিদাবাদে বাউল ফকিরদের সঙ্গে কট্টর ধর্মান্ধ মুসলমানদের যে বিরোধ তা হল গান গাওয়া নিয়েই। গান করাই তাঁদের মতে গোনাহ্‌ বা পাপ। তারপরে আসে গানের বিষয়গত বিরূপতা। একতারা বা অন্য বাদ্যযন্ত্র ভেঙে দেওয়া আসলে গানের বিরুদ্ধেই লড়াই। নদিয়ার গোরভাঙার মনসুর ফকির আমাকে বলেছে, ‘এই যে দেখছেন বাড়ির বাইরে আমরা এই ঘরখানা বানিয়েছি, সন্ধেবেলা ওখানে আমরা গান গাই। ওরা বলেছে গান বন্ধ কর। অবিশ্যি আমরা সেকথা মানিনি। গান চলছে।’

কিন্তু বিচার গানের উদ্ভব মারফতি ফকিরদের নিজেদের প্রয়োজনেই হয়েছে। ফকিরি পথ সর্বদাই বিচারশীল। প্রতিপক্ষের সঙ্গে তাদের ‘বাহাস্‌’ বা বিতর্ক চলে, নিজেদের মধ্যেও সর্বদা চলে গানে গানে তত্ত্ব তালাশ। শরিয়তি বড় না মারফতি বড়? আল্লা না নবি? নবি কে মুর্শেদ কে? ভজে পাই কি পেয়ে ভজি? এ ধরনের তর্কমুখর তত্ত্ব ও প্রতিতত্ত্বের বুনোট, উত্তর-প্রত্যুত্তরের আসর সর্বদাই আছে গায়ক সম্প্রদায়ে। সে সব বিষয়ে প্রত্যেক বড় গায়কই সচেষ্ট ও সচেতন। তাঁদের শিক্ষাদীক্ষাও ব্যাপক। গানের সঞ্চয় ঈর্ষণীয়। ভাল বিচার গানের সভা শ্রোতাদের শিক্ষিত হবার পক্ষে অনবদ্য পাঠশালা।

কিন্তু এই প্রসঙ্গে একটা গুরুতর কথা সেরে নিতে হবে। আমাদের সমাজ কাঠামো এমন যে, কোনও গ্রামে মুসলমান সমাজে ঘৃণিত ও অবমানিত হয়েও ফকিরদের থাকতে হয় তাদের মধ্যেই। মুসলমান পরিবারের নানা প্রথা প্রকরণ উৎসবে অংশ নিতে হয়। ছেলেমেয়েদের আরবি নাম রাখতে হয়। বিয়েশাদিও ফকিরের সন্তানের কোনও হিন্দুর ঘরে হবার নয়। এ নিয়ে সমস্যাও হয়। একটা সংকটের কথা মনে পড়ছে। পরানপুরের এনায়েতউল্লা ফকিরি মতে আছেন। তাঁর পিতা পাঁচরুল্লা বিশ্বাসও ওই মার্গে ছিলেন। বেশ কিছু জমিজমা আছে, সমাজের মান্যমান ব্যক্তি। তাঁর সাধনার মার্গ হল ফকিরি, কিন্তু তাই বলে তিনি দীনহীন ফকির তো নন। দালানকোঠা ত্যাজ্য করে গাছতলাও সার করেননি জীবনে। দিব্যি বড় দোতলা বাড়ি, ধানের মরাই, জেনারেটর। গ্রামের আলেম মুসলমানদের সঙ্গে তাঁর প্রণয়ও নেই বিরোধও নেই। মানুষটি মধ্যশিক্ষিত এবং মুর্শিদাবাদে কোথাও বাউলফকিরদের নিগ্রহ হলে তিনি সেখানে হাজির হন, প্রতিবাদী ভূমিকা নেন।

সাধারণত আমরা ভেবে দেখি না, কিন্তু প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায় দেখেছি ফকিরদেরও শ্রেণিগত থাক আছে। বীরভূমের গ্রামে যেসব ফকির পরিবার দেখেছি তারা মরা গরিব, যদিও সেই গরিবিয়ানায় তাদের কোনও গ্লানি নেই। পাথরচাপুড়ির মেলায় প্রচুর ফকির দেখেছি, একেবারে কপর্দকশূন্য ভিক্ষাজীবী। এরকম রিক্ত দরিদ্র ফকির পরিবারের সন্তানদের ফকির পরিবারেই বিয়ে হয়। আবার গ্রামের মধ্যে কিছু অবস্থাপন্ন ফকির দেখেছি যাঁদের সহায় সম্পদ আছে। যেমন হাঁসপুকুরের আবু তাহের, গোরভাঙার আজহার খাঁ, পরানপুরের এনায়েতউল্লাও তেমনই। তাঁর মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন মুসলমান পরিবারে, কারণ অর্থনৈতিক অবস্থার দিক থেকে তারা সমান সমান। মেয়েকে কষ্ট দেবে না।

আশ্চর্য যে ফকিরদের মত ও পথ আলাদা কিন্তু সম্ভ্রান্ত ফকিরদের সামাজিক ওঠাবসা সেই শরিয়তি মুসলমানদের সঙ্গেই। অবশ্য গ্রামবাংলায় শহরের মতো অত শ্রেণিভেদ নেই, থাকার কোনও বাস্তবতা নেই। তাই কোনও কোনও মুসলমান পরিবার ফকির পরিবারের সঙ্গে ছেলের বিয়ে দেন। ফকিরবাড়ির ছেলেকে পাত্র হিসাবে মুসলমান শ্বশুর খুব পছন্দ করেন। কারণ? কারণটা আবু তাহের ফকির হেসে হেসে বলেছিলেন : ‘কারণ ফকিরদের ছেলেমেয়েরা খুব শান্ত প্রকৃতির হয়। ফকিরের ছেলে মদ মাংস ছোঁয় না, নেশাভাং নেই, ঠান্ডা স্বভাবের। শান্তিপ্রিয়, তাই কখনও বিবিকে তালাক দেবে না এই ভরসায় আলেম মুসলমানরাও মেয়েকে ফকিরবাড়িতে বউ করে পাঠায়, খুব আগ্রহ তাতে।’

এনায়েতউল্লার অভিজ্ঞতা বিপরীত। তাঁর সুদর্শনা ফরসা মেয়েটিকে যে মুসলমান বাড়ি বিয়ে দিয়েছিলেন সেখান থেকে ফেরত এনেছেন। কারণ তারা গোমাংস খায়। ফকিররা বড় একটা মাংসই খান না, বেশির ভাগ নিরামিষাশী, বড়জোর মাছ চলে। এনায়েত ফকিরের মেয়েকে তার শ্বশুরবাড়িতে শুধু গোমাংস খেতে বাধ্য করা নয়, হুকুম করেছে সেই মাংস বেঁধে পরিবেশন করতে হবে। মেয়েটিকে বাধ্য করা যায়নি। ফিরিয়ে আনা হয়েছে। ভেবে দেখতে গেলে এও কিন্তু একরকম সামাজিক অত্যাচার। অন্য মোড়কে এটা হল ফকিরদের ওপর মৌলবাদীদের সামাজিক নির্যাতন। আখড়া ভেঙে দেবার হুমকি, একতারা কেড়ে নেওয়া, বা গান গাইতে না দেওয়ার সঙ্গে জোর করে গোমাংস খাওয়ার অত্যাচারে তফাত কতটা?

এককথায় বলা চলে, শরাওয়ালাদের সঙ্গে বেশরা ফকিরদের নীতিগত লড়াই বহুদিনের এবং তাতে দৈহিক শক্তি ও সামাজিক প্রতিপত্তির ব্যবহার চলে আসছে নানাভাবে ও নানামাত্রায়। একটা কথা সচরাচর মনে থাকে না যে, শরিয়তিই হোক মারফতিই হোক, আমাদের এই বাংলায় বেশির ভাগ মুসলমানই ধর্মান্তরিত। কেউ দুই পুরুষ কেউ তিন পুরুষ আগে ছিল হিন্দুধর্মের আওতায়, তাঁদের মধ্যে একটা বড় অংশ আবার নিম্নবর্গের গ্রামিক হিন্দু। তার ফলে গ্রামীণ সংস্কৃতির বহু আচার ব্যবহার ও কুসংস্কার তাঁদের মধ্যে রয়ে গেছে। তাই তাঁরা যখন ইসলাম ধর্মে চলে এলেন তখন কলেমা তৈয়বের প্রথম নির্দেশ বা বিশ্বাস ‘আল্লা একমাত্র উপাস্য’ একথাটা সর্বাংশে মান্য করতেন না। লা-শরিক আল্লার উপাসনার পাশে তাঁরা ‘বুৎপরোস্তি’ বা পৌত্তলিকতা এবং ‘পিরপরোস্তি’ বা পিরমুর্শেদের আরাধনাও করতেন। সাধারণ মানুষ তাঁরা, গ্রাম্য ও অশিক্ষিত— তাই নানা গ্রাম্যদেবতা, শীতলা-ষষ্ঠী-লক্ষ্মীপুজো ইত্যাদিতে বিশ্বাস রাখতেন। দেওয়ালি, হোলি, ভাইদ্বিতীয়া, লক্ষ্মীবার, নবান্ন মানায় ছিলেন উৎসাহী। শরিয়তিরা এসব বরদাস্ত করতেন না অর্থাৎ আল্লার সঙ্গে অন্য শরিকের উপাসনা। গাল দিতেন তাঁদের ‘মুশরিক’ বলে। তাতে কি তাঁদের নিবৃত্ত করা যেত? তাঁরা তাঁদের অন্ধবিশ্বাসে দরগাতলায় সিন্নি মানত করতেন, পিরের কাছে কবচ তাবিজ ধারণ করতেন, সন্তান কামনায় গাছে বাঁধতেন ঢেলা। ইতিমধ্যে গ্রামে গ্রামে পিররা ছড়িয়ে পড়েছিলেন। তাঁদের প্রত্যক্ষ প্রভাবের কাছে অদৃশ্য আল্লার উদ্দেশে কলেমা পাঠ অনেক নিষ্প্রভ লাগত। ইসলামিয়ায় দাখিল হলেও ইসলামি রীতিকৃত্য অনেকে জানতেনই না। রফিউদ্দিন আমেদের বই থেকে জানা যায় :

Despite the reformists’ eloquent claims, the rural Muslims continued with their older way of life to a marked degree. A late-nineteenth-century observer was appalled at the ‘pauparism, lethargy and negligence’ of the average Bengali Muslim in matters of their own faith that he went so far as to describe them as a ‘sect’ which observed ‘none of the ceremonies of its faith, which worships at the shrines of a rival religion and tenaciously adheres to practices which were denounced as the foulest abominations by its founder’. Not one in ten could reportedly recite the simple Kalimah, or creed, considered indispensible for every Muslim.

প্রতিবেদনে যে-চিত্র ফুটে উঠেছে তা মুসলমান ধর্মনিষ্ঠদের পক্ষে বেদনাদায়ক কিন্তু বাস্তব। ইসলামি রাতিকৃত্য তথা বাত্যাচার পালনে তথা নামাজ-রোজায় সাধারণ মুসলমানের আলস্য ও অবহেলা তখনও ছিল, এখনও আছে। প্রতি দশজন মুসলমানের একজনও কলেমা আবৃত্তি করতে পারত না এ তথ্য পরিতাপজনক কিন্তু সত্য। কিন্তু কেন পারত না? ব্যাপারটি মনস্তাত্ত্বিক—কারণ কোনও ধর্মান্তরিত মানুষই সদ্য সদ্য তার পুরনো ধৰ্মাভ্যাস ও আচরণ ভুলতে পারে কি? একদিকে তার লৌকিকজীবন ও তার বিশ্বাস-সংস্কার, আরেকদিকে আনকোরা নতুন ইসলামিয়ার অজানা নির্দেশিকা— সে কোনদিকে যাবে? তা ছাড়া সংসারের বিপদে আপদে, সন্তানের আকস্মিক রোগ বালাইয়ে যে পিরফকির আর দরগাতলায় হত্যে দিতে অভ্যস্ত, দেবদেবীর নাম নিয়ে বুকে সাহস পায়, সে কেন এসব রাতারাতি বাতিল করে অদৃশ্য আল্লাতে শরণ নেবে? প্রকৃতপক্ষে এই যে লোকায়ত গ্রামীণ ইসলাম ধর্ম এ যেন এক মিশ্র বিশ্বাস, না-হিন্দু না-মুসলমান।

এই জায়গাটাই ফকিরিয়ানার উৎস। অপ্রত্যক্ষ আল্লার বদলে মুর্শেদ, শরিয়তের আচার মার্গের বদলে মারিফতের ভাবমার্গ, নামাজের বদলে গান, মসজিদের বদলে নিজদেহ, কোরানের বদলে দেলকেতাব। এর পাশে সমাজে আরেকটা চোখে-আঙুল-দিয়ে-দেখানো ভেদবাদ ছিল। যাকে বলা চলে মুসলমানের জাতিভেদ। বাউল ফকিরদের নিয়ে যাঁরা প্রত্যক্ষ গবেষণা করেছেন তাদের অনুধাবন এইরকম যে,

ক) এরা মূলত এক ছোটখাটো ধর্মগোষ্ঠী এবং গোষ্ঠীসংগঠনের মূলে রয়েছে স্পষ্ট প্রতিবাদী মনোভঙ্গি। এই প্রতিবাদ গড়ে উঠেছে জাতিভেদ থেকে। সমাজে অপমানিত ও লাঞ্ছিত হয়ে তারা নিজেরাই এক ক্ষুদ্র সমাজ গড়ে নিয়েছে। তার মানে হিন্দু আর মুসলমানদের বৃহত্তর সমাজ কাঠামোর ভেতর ভেতর রয়ে গিয়েছিল বর্ণবৈষম্য, তারই প্রত্যক্ষ প্রতিক্রিয়ায় ক্ষুদ্র গোষ্ঠীতন্ত্রের সূচনা। অভিজাত মুসলমান আর নবাব বাদশাদের প্ররোচনায় সেখ সৈয়দ মোঘল পাঠানরা মুসলমান সমাজের সর্বোচ্চ স্তরে ও বর্ণে স্থাপিত হন অন্যপক্ষে এ দেশের অগণিত ধর্মান্তরিত মুসলিম নিম্নশ্রেণিভুক্ত হয়ে পড়েন।

খ) তত্ত্বগতভাবে অবশ্য ইসলামে জাতিবর্ণভেদ থাকার কথা নয়, তবে বাস্তবে অন্তত গ্রামিক সমাজস্তরে শ্রেণিভেদ প্রত্যক্ষ। সেই ভেদের চেহারায় ধরা পড়ে যে ‘আশরাফ’ বলতে উচ্চবর্ণ আর ‘আতরাফ’ বলতে নিম্নবর্ণ বোঝায়। আশরাফ বা শরীফ আদমি তাঁরাই যাঁরা আরব, পারসিক ও আফগান খানদান থেকে ভারতে এসে স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে উঠেছিলেন অথবা উচ্চবর্ণের হিন্দু সমাজ থেকে ধর্মান্তরিত হয়েছিলেন। তাঁদের আভিজাত্য ও কৌলীন্য বেশি। আর এদেশের ধর্মান্তরিত মুসলিমরা যেন খানিকটা হেয়, ভদ্রেতর বর্গের। তাদের নাম আতরাফ বা আজলফ। এই আতরফের মধ্যে আরও যারা নিচুস্তরের (যেমন জোলা, নিকিরি, কাহার, নলুয়া বা বেদে) তাদের নাম ‘অর্জল’ বা ‘রাজিল’।

তথ্যত দেখা গেছে আশরাফ-আতরাফে তেমন সামাজিক লেনদেন ছিল না এবং বিবাহ সম্পর্ক হয়নি। আতরাফদের সঙ্গে অর্জলদেরও সম্পর্ক স্বাভাবিক ছিল না।

গ) স্বভাবত এসে পড়ে সামাজিক সুযোগ সুবিধা ও অর্থনৈতিক ছকের কথা। বোঝাই যাচ্ছে আশরাফরা ছিলেন সুবিধাভোগী জমিদার ও উচ্চ পদাধিকারী। আতরাফরা খেটে খাওয়া মানুষ। অর্জলরা একেবারে গতরজীবী।

আশরাফদের মধ্যে আবার চিত্তাকর্ষক শ্রেণিভেদের বৃত্তান্ত পাওয়া গেছে। যেমন সৈয়দরা সবচেয়ে মান্য বা উঁচু থাকের যেহেতু তাঁরা মহম্মদ কন্যা (‘Prophet’s daughter’) ফতিমার বংশধারার। সৈয়দদের পরে সেখ, মোঘল ও পাঠান। মুসলমান শাসনাধীন ধর্মান্তরিত দেশি মুসলমানদের কোনও উচ্চপদে নিয়োগ করা হত না। ইলতুৎমিস তাঁর প্রশাসন থেকে তিরিশজনকে খারিজ করে দিয়েছিলেন তাঁরা জন্মসূত্রে ভারতীয় ছিলেন বলে। এ ব্যাপারে একটি মজার তথ্য পাওয়া যায় ইমতিয়াজ আমেদের বই থেকে। জানা যাচ্ছে :

নিজামুল মুল্‌ক্‌ জুনাইদির সুপারিশে সম্রাট ইলতুৎমিস যখন জামাল মারজাককে নিয়োগ করলেন কনৌজের এক উচ্চপদে তখন তাতে আপত্তি জানালেন আজিজ বাহ্‌রুজ নামে এক উচ্চ আমলা, কারণ জামাল নিম্নবর্ণজাত। সঙ্গে সঙ্গে ইলতুৎমিস সেই নিয়োগ তো বাতিল করলেনই উপরন্তু নিজামুলের বংশ বৃত্তান্ত নিয়ে তদন্ত করতে আদেশ দিলেন। তদন্তে ফাঁস হল নিজামুল জাতে জোলা, সঙ্গে সঙ্গে বরখাস্ত হলেন।

এসব বিবরণ থেকে প্রতিভাত হচ্ছে একসময় মুসলমান সমাজে শ্রেণিঘৃণা কী পর্যায়ের ও কত হিংস্র ছিল। মুসলমান সমাজ নিয়ে যাঁরা গবেষণা করেছেন তাঁদের বই থেকে এমন তথ্য উঠে এসেছে স্বাধীনতার আগে কলকাতার উচ্চশিক্ষিত ধনী মুসলমানরা বাংলা বলতেন না। তাঁরা ছিলেন উর্দুভাষায় স্বচ্ছন্দ।

শাহ ফকিরদের নিয়ে দীর্ঘদিনের গবেষণা করে নৃতাত্ত্বিক রণজিৎকুমার ভট্টাচার্য তথ্যপূর্ণ প্রবন্ধে বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত করেছেন :

They, however, feel that they are regarded low by the high status Muslims, because the common Muslims have no ability to appreciate their deep phi-losophy of life and consider them not much above the class of ordinary beg-gars.

এমন ধরনের তথ্যের মধ্যে ইতিহাসের ও সমাজের কিছু সার কথা আমরা খুঁজে পাই এবং রবীন্দ্রনাথের গানের ভাষায় বলতে ইচ্ছে করে : এরে ভিখারি সাজায়ে কী রঙ্গ তুমি করিলে।

উচ্চবর্গের মানুষ ও অভিজাত জীবন একটা সত্য কখনই বোঝে না যে, মানুষের মনের শক্তি অদম্য এবং তার ভিতরে প্রতিবাদের বহুরকম ভাষা ও কৌশল আছে। যে সময় মুসলিম সমাজ তার পবিত্র ধর্ম ও শুদ্ধ জীবনদর্শনের উচ্চ মাচায় বসে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষদের ভাবছিল ভিখারি, গরিব ও নিম্নস্তরের জীব—তখন তাদের শোষিত সত্তা পরম অভিমানে চাইছিল মুক্তি ও মানবাধিকারের মর্যাদা। লক্ষ করা যাচ্ছে লালন ফকির তাঁর জীবন সায়াহ্নে কুষ্টিয়ার অন্তর্গত ছেঁউড়িয়ায় এসে বাঁধলেন তাঁর আস্তানা। ওই গরিব মহল্লায় থাকতেন মোমিন কারিগর সম্প্রদায়, তাঁত বোনা ছিল তাঁদের জীবিকা। পরিচয়ে আতরাফ কিংবা অর্জল। তাঁদের মধ্যেখানে বাস করে তিনি গানে লিখলেন, ‘লালন বলে জাতের কী রূপ দেখলাম না নজরে।’ তাঁর গান সব কিছুকে ছাপিয়ে ঘোষণা করল অপরাজেয় মনুষ্যত্বের জয়। জাতিবর্ণহীন শ্রেণিহীন মানুষ। তাঁর ফকিরিপন্থায় দলে দলে নির্জিত অপমানিত শোষিত মানুষ এসে যোগ দিলেন। শোনা গেল প্রতিবাদের এক নতুন ভাষা লালনশিষ্য দুদ্দু শাহ-র গানে। ব্যঙ্গ করে তিনি লিখলেন :

এ দেশে জাত বাখানো সৈয়দ কাজী দেখিরে ভাই

যেমন বঙ্গদেশের ব্রাহ্মণ সবাই।

ব্রাহ্মণের দেখাদেখি

কাজী খোন্দকার পদবী রাখি

শরীফি কওলায় ফাঁকি দিয়ে সর্বদাই।

জোলা কলু জমাদার যারা

ইতর জাতি বানায় তারা

এই কি ইসলামের শরা

করিস তার বড়াই?

গানের মধ্যে যুক্তিজালের ঠাস বুনোট। মারফতি ফকিরদের পক্ষ নিয়ে দুদ্দু শাহ-র মর্মান্তিক প্রশ্ন : ওহে সব শরাওয়ালা ইসলামি ধর্মধ্বজী, ব্রাহ্মণদের দেখাদেখি মুসলমান সমাজে যে উচ্চনীচ ইতরভদ্র ভেদাভেদ আমদানি করেছ তা কি শরিয়ত সঙ্গত? তারপরের প্রশ্নটি সাংঘাতিক, সেটা রয়েছে আরেক গানে :

এ দেশের মুসলমানে বড়াই করে

আমরা বাদশাই জাতির খান্দান রে।

সহস্র বৎসর পূর্বে ভাই

মুসলমানের গন্ধ দেখি নাই

যত অনার্য শূদ্র ওরাই

ধর্ম ভারত হয় রে।

এ একেবারে মূল ধরে টান। এদেশে হাজার বছর আগে মুসলমান ছিল না। দেশের আদি ভূমিপুত্র অনার্য আর শূদ্ররাই। ফকিররা তাদেরই অনুযাত্র। ব্রাহ্মণরাও যে বহিরাগত তার ইঙ্গিত অবশ্য নেই। তবে সব লোকায়ত ধর্মই নিজেকে বেদবিধিছাড়া বলে ঘোষণা করে।

ফকির পন্থার উদ্ভবে সুফিতত্ত্বের প্রেরণা থাকতে পারে এমন কথা প্রায় সকলেই বলেছেন। কিন্তু ফকিররা যে আচার-আচরণে ততটা ইসলামনিষ্ঠ নন তার কারণ কি শুধুই প্রতিবাদ বা জাতিভেদ জাত অবিচার? ভেবে দেখা দরকার নেই কি যে, একেবারে অজ গাঁয়ে অশিক্ষিত খেটে খাওয়া মানুষের নিম্নস্তরে শরিয়তের নীতি নির্দেশ কতটা পৌঁছানো সম্ভব এবং কাদের দ্বারা? পক্ষান্তরে এ তথ্য জানা যায় যে, সুফিপন্থীরা ও সাধকরা পদব্রজে ঘুরে বেড়াতেন সর্বত্র। তাঁদের বাণী ও উপদেশ অনেক ব্যাপ্ত ছিল। ফকির, দরবেশ, মিসকিনরা তো স্বভাবেই ভ্রাম্যমাণ। তাঁদের জমিজমা ছিল না, তাই জমির টানে কোথাও স্থায়ী বাস্তু স্থাপনের নেশায় ছিলেন উদাসীন। ভিক্ষাজীবী, তাই সাধারণ মানুষের অন্দরমহল পর্যন্ত তাঁদের যাতায়াত ছিল। সেই সঙ্গে রোগ আরোগ্যের নানা টোটকা জড়িবুটি থাকত ঝোলায়। জাদু শক্তির একটা আলাদা জোর বরাবর আছে অনুন্নত সমাজে। আবদুল ওয়ালী লিখেছেন উনিশ শতকের গ্রাম্য ফকিরদের বিষয়ে যে, এরা পাকা চিকিৎসক। সাধারণ চিকিৎসকের কেরামতি যেখানে কূল পায় না সেখানে এরা রোগ সারিয়ে তোলে। আর এই বিদ্যাকে কাজে লাগিয়েই এরা শিষ্যের সংখ্যা বৃদ্ধি করে। ধরা যাক, কোনও ফকিরের এক শিষ্য দেখল, কোনও মানুষ কঠিন রোগে ভুগছে। সেই শিষ্য তখন রোগগ্রস্ত ব্যক্তিকে কিছু উপদেশ এবং সম্ভবত জড়িবুটিও দেয়। সঙ্গে সঙ্গে তাকে গান ও প্রার্থনা করতেও শেখানো হয়। রোগী সুস্থ বোধ করতে শুরু করলে তার ভক্তি ও বিশ্বাস বেড়ে যায়। তখন গুরু বা মুখ্য ফকিরকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। ‘সাধুসেবা’ দেওয়া হয়। রোগীর সাধ্য অনুযায়ী কিছু লোককে আপ্যায়িত করা হয়। এইভাবে শিষ্যের সংখ্যা বাড়ানো হয়।

লালন ফকির এমন রোগ সারানোর নিদান বাতলাননি কোনওদিন কিন্তু ঘোড়ায় চড়ে ঘুরে বেড়াতেন বহু জায়গায়। তাঁর নাকি বিশ হাজার শিষ্য বা বায়েদ ছিল। হতেই পারে, কারণ তিনি ছিলেন দিব্যজ্ঞানী ও উচ্চস্তরের ভাবসাধক গায়ক। তিনি যে ভাল গাইতে পারতেন এবং বাইরে গিয়ে গাইতেন নিজের লেখা গান তার লিখিত প্রমাণ রয়েছে জলধর সেনের জবানিতে। গানের শক্তি অপরিসীম, তাই তাঁর গানেই যে বহু মানুষ বশ হয়েছিলেন তাতে সন্দেহ নেই। বাউল ফকিররা তাঁর সময় থেকে আজ পর্যন্ত এই গানের চাবি দিয়ে কেবলই খুলে চলেছেন মানুষের মনের তালা। কোরানের আয়াতের আরবি ভাষার চেয়ে বাংলা গানের বাণী অনেক সরাসরি ও অন্তরস্পন্দী।

এ ছাড়া আহমদ শরীফের বিশ্লেষণ থেকে বোঝা যায় কেন গ্রাম সমাজের মানুষ আগেকার দিনে ব্যবহারিক ইসলামের চেয়ে ফকিরি মতের দিকে ঝুঁকেছিল। তার হিসেব অনুসারে দেখা যায় ১৮৭১ সাল নাগাদ অর্থাৎ উনিশ শতকের শেষদিকে উভয়বঙ্গে শতকরা বত্রিশজন মুসলমান ছিলেন। এঁদের এবং

এঁদের বৌদ্ধ-ব্রাহ্মণ্য সমাজভুক্ত জ্ঞাতিদেরও কোনো লেখাপড়ার অধিকার ও ঐতিহ্য ছিল না। সুনির্দিষ্ট বৃত্তিজীবীতে বিভক্ত ও বিন্যস্ত সমাজে পেশান্তরের সুযোগ-সুবিধেও ছিল বিরল, তাই বৌদ্ধ-হিন্দু-মুসলিম সমাজে বৃত্তি ও অর্থসম্পদগত দুঃস্থতার দুরবস্থার এবং আর্থ-সামাজিক অবস্থানগত পরিবর্তন ছিল দুর্লক্ষ্য।

সমাজ প্রগতির সবচেয়ে বড় লক্ষণ হল জ্ঞানচর্চা আর বিদ্যালাভের অধিকার তথা পারিপার্শ্বিক সুযোগ। নবাবি শাসনে ও ব্রিটিশ রাজের আমলে গ্রামের মানুষের সে সুযোগ ও অধিকার ছিল না এবং সবচেয়ে যেটা ক্ষতিকর সেই সমাজে বৃত্তিত্যাগ বা জাতিবৃত্তি ছেড়ে অন্যতর জীবিকার জীবনে যাবার বিকল্প ছিল না। ভাগ্যবাদী সব মানুষ অন্ধ শাস্ত্রশাসনের দাপটে আর কুসংস্কারের তামসে আবদ্ধ ছিল। তাই বাঙালি হিন্দু মুসলমান বা অন্য ধর্মীদের আর্থিক দুরবস্থা ও সমাজ অবস্থানের কোনও ফেরফার হত না। এর মধ্যে যুক্তিতর্কের অবকাশ, শাস্ত্র-কোরান-পুরাণ ব্যাখ্যানের মতো মুক্ত মনন অর্জন, প্রতিবাদী চেতনা গড়ে উঠতে পারে কি? সাধারণ মানুষ তাই উদরপূর্তি আর অন্ধকার জীবনকেই মেনে নিত। কেবল, শরীফের তথ্য অনুযায়ী,

কেনা-বেচা, জমি-জমা সংক্রান্ত হিসেব নিকেশের প্রয়োজনবোধে এবং কোরআন পড়ার ও নামাজ-রোজা সম্বন্ধীয় আবশ্যিক নীতি-নিয়ম-রীতি-পদ্ধতি জানার-জানানোর গরজ-চেতনা বশে কেউ কেউ সন্তানকে বিদ্যালয়ে মক্তবে পাঠশালায় পাঠান। এমন লোক হয়তো ছিল হাজারে একজন।

হাজারে একজন যেত পাঠার্থী হয়ে এবং সেই পাঠ তার অর্ধাংশের কাছে থেকে যেত অসম্পূর্ণ। কারণ দু’-চার পাঁচ ক্রোশ অন্তর হয়তো ছিল একটি বিদ্যালয়, মক্তব আরও কম। গ্রামে শিক্ষকই বা কই? আর ছিল সীমাহীন দারিদ্র্য। কাঙাল হরিনাথের মতো মেধাবী ছাত্র ‘পান্তাভাত, জামীরের পাতা আর লবণ’ খেয়ে পাঠশালাতেই পাঠ সাঙ্গ করতে বাধ্য হন সেকালে। আহমদ শরীফ আরেকটা জরুরি মন্তব্য করে বলেছেন:

কলকাতার, মুর্শিদাবাদের এবং অন্যত্র নিবসিত উর্দুভাষী শিক্ষিত অভিজাত মুসলিমরাই নিজেদের বাংলার মুসলিম বলে আত্মপরিচয় দিয়েছেন প্রমাণ দেওয়ান খান বাহাদুর ফজলে রচিত গ্রন্থ (Origin of the Mussalmans of Bengal 1895) এবং নবাব আবদুল লতিফের লিখিত উক্তি। লতিফ বাংলাভাষী দেশজ মুসলিমদের ‘ছোটোলোক’ মুসলিম বলেই জানতেন।

শুধু আশরাফ-আতরাফ ভেদ নয়, অর্থনৈতিক তারতম্য, বৃত্তিবদ্ধতা, অশিক্ষা এবং ভাষাগত ব্যবধানও উনিশ শতকের শেষ দশকে প্রকট হয়ে উঠছিল। ভদ্রলোক-ছোটলোক বিন্যাস ব্যাপারটি চুড়ান্তভাবে ইসলামবিরোধী। এই পরিবেশ ও পরিস্থিতিতে ফকিররা এগিয়ে এসে গ্রামীণ জনতাকে দীক্ষিত করতে শুরু করলেন মানবিক মন্ত্রে ও সুবোধ্য বাংলা গানের জাদুস্পর্শে। ফকিররা নিজেদের মুসলমান বলেই পরিচয় দিতেন এবং জনসমাজে মিশে গিয়ে ক্রমে ক্রমে তাদের মারফতি তত্ত্বে শিক্ষিত ও মুর্শেদ-ভক্তে পরিণত করতেন। শরিয়ত-তরিকত-হরিকত সব পথের কথা বলেও শেষ আশ্রয় যে মারফত তা বোঝাতেন। লৌকিক ঢঙে গ্রাম্য ভাষায় বোঝাতেন শরিয়ত হল গাছ আর মারফত ফল। ফল পেতে গেলে তো গাছে উঠতেই হবে। কিন্তু ওই পর্যন্তই, এবারে বলো তো গাছ খাব না ফল খাব? এসব লোক লৌকিক প্রত্যক্ষ ব্যাপক প্রচারের পাশে মোল্লা মৌলবিদের সংখ্যা আর কত ছিল সেই ব্রিটিশ রাজত্বে? তা ছাড়া আহমদ শরীফের যুক্তিতে,

কোরআন-হাদিস অনুগ বিশুদ্ধ ইসলাম বিশ্বাসে ও আচরণে মানা সম্ভবও ছিল না দুটি কারণে। প্রথমত, শাস্ত্র ছিল আরবি ভাষায় লিখিত, বিদেশীর বিভাষা আয়ত্ত করা বিদ্যালয়-বিরল সেই যুগে ক্বচিৎ কারুর পক্ষে সম্ভব ছিল, আলিম মৌলবী আজও সর্বত্র শত শত মেলে না। দ্বিতীয়ত, স্থানিক কালিক ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক যে পরিবেশে মানুষ আশৈশব লালিত হয়, তার প্রভাব এড়াতে পারে না। শাস্ত্রীয় গোত্রীয় ও স্থানীয় ঐতিহ্যের আচারের, সংস্কারের মিশ্র ও সমন্বিত প্রভাবেই মানুষের মন-মনন-আচার-আচরণ নিয়মিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়। ফলে বাঙালির ধর্ম সাধারণভাবে বিশুদ্ধ ‘ইসলাম’ নয়,—মুসলমান ধর্ম যাতে রয়েছে যুগপৎ শরীয়ত ও মারফত, কোরআন-হাদিসের পাশে পির-দরবেশ-দরগাহ, মন্ত্র, মাদুলি, তাবিজ, দোয়া, ঝাড়-ফুঁক-তুক-তাক।

এতক্ষণে আমরা স্থিত হতে পারলাম খাঁটি বাঙালি মুসলমানদের মন আর মর্জির চেহারায়। বাঙালি জাতি হিসেবেও মিশ্র, ধর্মবোধেও মিশ্র। এদেশে বিশুদ্ধ ‘ইসলাম’ ধর্ম যেমন নেই, বিশুদ্ধ ‘হিন্দু’ ধর্মও কি আছে? তাতে বৌদ্ধতান্ত্রিক-যোগীদের সংযোগ আছে। বৈদিক সংরাগ যেমন আছে, তেমনি আছে বেদবিরোধী চেতনা। সেই সঙ্গে বৈষ্ণব অনুষঙ্গও উপেক্ষণীয় নয়। ফকিরি মতেও সহজিয়া বৈষ্ণব সাধনার ধারা মিশে গেছে। এমনকী বাঙালি চিত্ত এমনই উদার ও সমন্বয়ী যে বাংলা ভাষায় মুসলমান গীতিকাররা লিখেছেন বৈষ্ণব পদ ও শাক্তগীতি। তার জন্য আলেম মোল্লারা কোনওদিন তাঁদের, এমনকী ধর্মান্ধ মধ্যযুগেও, কোতল করেননি বা ‘মুশরেক’ বলে গান দেননি। ফকিরদের ক্ষেত্রে তবে কেন এত নিপীড়ন ও হুমকি? কেন এত আখড়া জ্বালানো আর একতারা ভাঙা! তার কারণ তারা দরিদ্র ও অসংঘবদ্ধ, তাদের পেছনে নেই উদার মধ্যবিত্তের সমর্থন ও রাজশক্তির আনুকূল্য। তারা শুধু নির্জন একক।

উনিশ শতকের শেষ দশকে লালন ফকিরের প্রয়াণ ঘটলেও ফকিরিপন্থার অবসান ঘটেনি, বরং দ্বিগুণ তেজে গানে গানে তা বাংলার গ্রামে গ্রামান্তরে ছড়িয়ে পড়েছিল। পাঞ্জু শাহ, দুদ্দু শাহ, জালাল, রশিদ, হাসন রজা থেকে শুরু করে ফুলবাসউদ্দিন, নসরুদ্দিন, শীতলাং শাহ হয়ে বিশ শতকের প্রথম দু’দশক ফকিরি গানে সমাচ্ছন্ন ছিল। সেই বাড়বৃদ্ধি দেখেই ১৯২৫ সালে রেয়াজউদ্দিন রংপুর থেকে ‘বাউল ধ্বংস ফৎওয়া’ প্রকাশ করে ইসলাম রক্ষণের জিগির তুলেছিলেন। বইটির নাম ‘বাউল ধ্বংস ফৎওয়া’, কিন্তু আক্রমণের লক্ষ্য ফকিররা, কারণ সেসময় বাউল ও ফকিররা ছিল সমার্থক। বইটির উদ্দেশ্যই ছিল ফকিরিপন্থার উচ্ছেদ। কারণ, এই ফকিররা,

ভিতরে অমোছলমান, বাহিরে মোছলমানী নামে নাম, মোছলমান মহল্যায় বাস, মোছলমান কন্যাগণের সহিত বিবাহসাদী ও মোছলমানের সকলপ্রকার সামাজিকতায় ভুক্ত। এই অপরিচিত অপ্রকাশ্যভাবে ইহাদের মোছলমানের সহিত মেলামেশার ফলে দলে-দলে অশিক্ষিত মোছলমান ইহাদের ধোকাবাজী বুঝিতে না পারিয়া সনাতন এছলাম ধৰ্ম্মকে ও পবিত্র কোরআনকে ত্যাগ করতঃ কাফের মোরতেদ হইয়া যাইতেছে।

রেয়াজউদ্দিনের মতো হাজী মৌলবিদের দুশ্চিন্তা ও উত্তেজনার সঠিক কারণটা এবার বোঝা গেল। দলে দলে ধর্মত্যাগের ঘটনা কট্টর ধর্মনিষ্ঠদের পক্ষে অসহনীয় হয়ে ওঠা স্বাভাবিক। সেইসঙ্গে মনে রাখা দরকার যে বেশরা ফকিররাও খুব দুর্বল ছিল না সেসময়। খবরে দেখা যাচ্ছে আফজল আলী নামে একজন শরিয়তবাদী মুসলিম নেতা বেশরাদের ভয়ে গ্রাম ত্যাগ করে ভিন গাঁয়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন। ‘তবু পীর রুস্তম শাহের নামে আধা মুসলমানদের পুরো মুসলমানে রূপান্তরিত করার আশা ছাড়েননি।’

এই সংবাদ থেকে আরেকটা সত্য প্রকাশিত হচ্ছে: সমাজে আধা মুসলমান আর পুরো মুসলমান একসঙ্গে সহাবস্থান করত এবং আধা মুসলমানরা ফকিরপন্থার সূত্রে পির উপাসনায় উৎসাহী ছিল। এই পিরবাদ ইসলামের সমান্তরাল শক্তি ছিল। যারা পিরকে ভজনা করত তারা আল্লার কালাম বা কলেমায় বিশ্বাসী ছিল না। ইসলামিয়ায় সামিল হবার চেয়ে তাদের বেশি ব্যগ্রতা ছিল পিরের মুরিদ হবার। এটাও সত্য যে ইসলামি রীতিকৃত্যের খুঁটিনাটি সবাই জানতও না।

যাই হোক, সমাজে ফকিরদের পরাক্রম ও সংখ্যাধিক্য মৌলবাদীদের আশঙ্কিত করেছিল। তাঁরা ফকিরদের ‘ইসলামবিরোধী, শরিয়তবিরোধী, বেশরাহ, বিভ্রান্ত ও পথভ্রষ্ট’ বলেই ক্ষান্ত হননি, তাদের ‘শৃগালের ন্যায় বিতাড়িত করা উচিত’ বলে রায় দিয়েছেন। ‘জবাবে ইবলিস’ বইতে ফকিরদের সম্পর্কে কঠোরতম ব্যঙ্গ করে বলা হয়েছিল:

ইহারা… কখনও শতচ্ছিন্ন কাপড় আলখেল্লা পরিয়া চিমটে হাতে ঘুরিয়া বেড়ায়; কখনও দেখা যায় মারেফতীর নামে ইসলামের কুট সমালোচনামূলক গান গাহিয়া বেড়ায়; আবার মন্ত্রপূত করিয়া মলমূত্রেরও সৎ ব্যবহার করিতে দেখা যায়। কখনও লোক দেখাইবার জন্য নামাজ রোজা করিয়া থাকে, আবার একতারা ডুগী তবলা বাজাইয়া গান গাহিয়া পাড়ায় পাড়ায় ভিক্ষা করিয়া বেড়ায় এবং যৌন নিয়ন্ত্রণের কোন বালাই নাই।

অভিযোগের তালিকা ক্রমশ বাড়ছে। ইসলামের সমালোচনার গান মানে বিচারমূলক বিশুদ্ধ মারফতি ফকিরি গান, সেইসঙ্গে চারিচন্দ্রের সাধনা ও যৌন স্বাধীনতা—সবই আক্রমণের লক্ষ্য। ফকিরদের কাজকর্মকে ‘কুফরী’ (আল্লাকে অস্বীকৃতি) বলা হয়েছে। ইসলামের সঙ্গে ফকিররা ‘ফিৎনা’ বা ঝগড়াঝাঁটিতে লিপ্ত বলা হয়েছে। তারা ‘মুতখোর’ ‘নাপাক’ (অপবিত্র) আল্লার ‘লানৎ’ বা অভিশাপ তাদের শিরোধার্য এবং তাদের কার্যকলাপ ‘ছিরাতে মুস্তাকিম’ অর্থাৎ সহজ রাস্তা থেকে স্খলিত। তারা গোপনতায় (‘বাতুনী’) বিশ্বাসী বলে সন্দেহজনক ব্যক্তি।

ইসলাম মৌলবাদের চোখে দেখলে মারফতি ফকিরদের আর দোষের অন্ত থাকে না। কিন্তু ইসলামকে একেবারে অবিকল্প অনড় বলে যে চিরকাল ভাবা হয়েছে বা সবাই চোখ বুজে মান্য করেছে তাও নয়। প্রশ্ন, প্রতিপ্রশ্ন, বিচার, মতভেদ বরাবর চলছে এবং সেটাই প্রাণের লক্ষণ। প্রাচীন প্রথা ও অনুশাসন অন্ধভাবে অনুসরণ কবেই বা মানুষ করেছে? তাই ইসলামের বহুতর ওঠাপড়ার গূঢ় পাঠ নেওয়া দরকার। তাতে দেখা যাবে মুসলমানরা মূলত ইমানদার বা বিশ্বাসী। কীসে বিশ্বাসী? তাঁদের ধর্মের আকরগ্রন্থ কোরান ও হাদিসে বিশ্বাসী।

প্রথমদিকে ইসলামে খুব একটা মতভেদ ছিল না, আচরণে ছিল দ্বিধাহীন সাম্য। কিন্তু কালক্রমে শরিয়তের বিধান আর কোরান-হাদিসের ব্যাখ্যান ও ভাষ্য নিয়ে মতভেদ দেখা দিলে গড়ে ওঠে কিছু কিছু গোষ্ঠী বা ‘মজহাব’। প্রথম বিভাজন ঘটে শিয়া আর সুন্নিপন্থীদের। মুসলমানদের মধ্যে সুনিরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। সারা বিশ্বে একমাত্র ইরানে শিয়ারা সুন্নিদের চেয়ে সংখ্যায় বেশি। সুন্নিদের মধ্যে, অন্তত বাংলায়, চারটি মজহাব। হানাফি, সাফি, হামবিলি ও মালেকি। এর বাইরে আছে আহলে হাদিস বা ফরাজি সম্প্রদায়, যারা হল লা-মজহাব বা কোনও মজহাবভুক্ত নয়। তারা শুধু কোরান ও হাদিসে বিশ্বাসী এবং কঠোরভাবে।

কোরান ও হাদিস ছাড়াও ইসলামে আরও দুটি নির্দেশিকা আছে, যা অনেকটা অন্যরকম। তার একটা হল ‘ইজমা ই উম্মত’ অর্থাৎ মহাজনদের দেখানো পথ, আরেকটা হল ‘কিয়াস’ অর্থাৎ ব্যক্তিগত অনুভব বা চিন্তাভাবনা। একজন মুসলিমের জীবনে কোনও গুরুতর সমস্যা এলে সে প্রথমে কোরানের নির্দেশ দেখবে, তাতে সমাধান না হলে দেখবে হাদিস কী বলছে। হাদিসেও যদি হদিশ না মেলে তখন ইজমা বা কিয়াস সমাধানসূত্র দিতে পারবে। এতে বোঝা যায় শরিয়ত মুসলমানদের ব্যক্তিগত বিচার বিশ্লেষণ ও মহাজনপন্থাকে বর্জন করতে বলেনি। তা হলে ফকিররা কী দোষ করলেন? তাঁরা মারেফতপন্থী অর্থাৎ শরিয়তের বহিরঙ্গ নির্দেশকে গুরুত্ব দেন না। তাঁদের একটা কথা হল আল্লার অনুভব হতে পারে ‘সিনা’-য় অর্থাৎ হৃদয় দিয়ে, ‘সফিনা’-য় অর্থাৎ শাস্ত্রগ্রন্থ মাধ্যমে নয়। তাই অন্তরঙ্গ অনুশীলনই মারেফত। ‘সাধারণ প্রথাগত শাস্ত্রীয় পথে মানসিক শান্তি, আত্মগত জ্ঞানলাভ, আত্ম-উৎসর্গ ও আত্ম-সংযম সম্ভব নয়।’ তাই শরিয়তকে পেরিয়ে তবে মারেফতে পৌঁছতে হয়। মারেফত মানে প্রকৃত জ্ঞান, যার নির্দেশ জাহেরি কোরানে নেই, আছে অতি গোপনে। সেটা জানতে হয় মুর্শেদের কাছে দীক্ষা নিয়ে। সেই জ্ঞান শাস্ত্রপথে আসেনি, চলে আসছে বহুকাল থেকে সিনায় সিনায়। মারফতি ফকিরদের আলেমরা সহ্য করতে পারেন না, তার কারণ, মারফতিরা শরিয়তকে চরম বা পরম বলে মানেন না— আরও এগোতে চান আত্মদীপনের গহন পথে। সেই দীপন বা দর্শন তো মানুষকে দেখানো যায় না, উপলব্ধি করতে হয়। ব্যাপারটির সূক্ষ্ম ব্যঞ্জনা লালন চমৎকার বুঝিয়েছেন,

শরিয়ত আর মারফত যেমন

দুগ্ধেতে মিশানো মাখন।

মাখন তুললে দুগ্ধ তখন

ঘোল বলে তা জানে সবাই।

শরিয়তের মধ্যেই অন্তঃশীল হয়ে আছে মারেফত, যেমন দুধের মধ্যে মাখন। কিন্তু মাখন তুলে নিলে দুধ যেমন মূল্যহীন ঘোলে পরিণত হয় তেমনই মারফতি তত্ত্বে নিষ্ণাত হলে শরিয়ত হয়ে পড়ে নগণ্য।

মুর্শিদাবাদের এক ফকির আমাকে তাঁদের গোপন সাধনা সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘আমাদের ধর্ম স্যার, চোরের ধর্ম। কেন জানেন? সমাজের মধ্যে গ্রামের মধ্যেই চোর বাস করে, সকলের সঙ্গে মেলামেশা করে, কিন্তু লক্ষ্য থাকে চুরিদারির দিকে।’

—চুরিদারি কি?

—এই যেমন দোকানদারি, ব্যাবসাদারি, তেমনই কবিওয়ালাদের গাঁয়ে বলে, ‘লোকটা কবিদারি করে বেড়ায়।’ চুরির জীবিকা যার তার হল চুরিদারি। এই যেমন আমরা ফকিরি করি গোপনে, বাইরে সামাজিক ওঠাবসা, এমনকী মাঝে মাঝে কাতারে দাঁড়িয়ে নামাজ পড়ি মসজিদে। কেউ কেউ সন্দেহ করে, যেমন চোরকে করে। এই দেখুন আমার চেহারা। কিছু বুঝছেন?

সত্যিই কোনও বাহ্যচিহ্ন নেই। দিব্যি সোনালি ফ্রেমের চশমা, ফিটফাট টেরিকটনের পাঞ্জাবি আর সাদা লুঙ্গি, হাতে ঘড়ি। গানের আসরে নাকি গায়ক, আবার দক্ষ তবলিয়া। জমিজিরেত আছে। এইট পাশ। অন্তর্গোপন একটা হাসি হেসে বললেন, ‘আমাদের হল বাতেনি কাজ, মানে গোপ্ত—ব্যক্ত নয়। লালনের গানে আছে “শরিয়তের দলিল হইল মারফত বাতনে রইল”। তার মানে শরিয়ত দেখতে পাবেন, আমাদেরটা দেখতে পাবেন না। নাঃ, এ ব্যাপারে লালনের গানটা আপনাকে শুনিয়েই দিই, শোনেন।’

‘হোক, হোক—ফকির সাহেবের গান হোক’ সবাই মুখিয়ে উঠল। জায়গাটা হল জিয়াগঞ্জের ফুলতলার একটা চায়ের দোকান। দু’জনেই বসে আছি বহরমপুরের বাস ধরব বলে। কথায় কথায় আলাপ তার থেকে গোপ্ত ফকির নিজেই নিজেকে জাহির করতে চাইলেন গানের মধ্যে দিয়ে। এটাই হয়। ফকিররা তো ভীষণ গানপাগল। গানই যেন তাদের মরমের বাণী, যুক্তির শান দেওয়া, দ্যোতনাময়। বললাম, ‘সবাই আপনাকে ফকির সাহেব বলল যে? সেকথাটা তা হলে বাতনে নেই, জাহির হয়ে গেছে?’

‘বিলক্ষণ’, ভদ্রবেশধারী ফকির হেসে বললেন, ‘এসব দিকে অনেক ফকিরি গানের আসরে আমার গান শুনেছে তো ওরা। চেনে, বুঝলেন?’

—শুনেছি মুর্শিদাবাদে ফকিরদের মারে, একতারা কেড়ে নেয়, চুল কেটে দেয়?

—হ্যাঁ, দেয়। তবে অঞ্চলবিশেষে। সময় সময় ঘটে উত্তেজনা। মারপিট করে বই কী। তবে এদিকে ওসব নেই। এদিককার মুসলমানরা শান্তিপ্রিয়। তা ছাড়া আসলে গান-পাগল। গানের আসরে আবার শরিয়তি মারফতি কীসের? নাকি বলো হে তোমরা?

‘ন্যায্য কথা। গান হল গান—ধর্ম হল ধর্ম—আলাদা ব্যাপার।’ জনতার একজন বলে, ‘নিন, ওসব ভ্যানতারা রাখুন। ফকির মানুষ, ধরা পড়ে গেছেন যখন, গান একটা দুটো গাইতে হবে বই কী।’

—আর বাস এসে গেলে?

—সে পরের বাসে যাবেন। কেন বাড়িতে বিবি কি দানাপানি নিয়ে বসে আছেন? অপেক্ষা করে হেদিয়ে পড়ছেন নাকি গো ফকির সাহেব?

‘না। এবারে হেরে গেলাম। গিন্নি বিবি তুলে কথা? তা হলে শোনো বাবাসকল।’ বাবাসকল লালনের গানের তাৎপর্য কতটা বুঝলেন তা জানি না। আমাদের কথার পুরনো ধরতাই নিয়ে গোপ্ত ফকির একটা মুড়ির ক্যানেস্তারা টিনে তাল রেখে গাইলেন সেই মোক্ষম গানখানা, যার অন্তরা হল:

চোরে যেমন চুরি করে

ধরে ফেললে দোষে পড়ে

মারুফতি সেই প্রকারে

চোরা মালের তেজারতি।

সেইজন্যেতে কর গোপন

অনুমানে বুঝলাম এখন

লালন বলে এসব যেমন

মেয়েলোকের উপপতি।

সোনালি ফ্রেমের আড়ালে আমার দিকে ঝিলকিয়ে উঠল গায়কের দুষ্ট চোখের চাহনি। তারপরে গান চলতেই থাকল, বাস এল, গায়ককে শ্রোতারা ছাড়ল না, কিন্তু আমি বাসের জানলার ধারের নিরালা সিটে বসে, যেতে যেতে, গানটার প্রকাশ ক্ষমতার গভীরতা ভাবতে লাগলাম। গানের মধ্যে দিয়ে লালন মারফতি তত্ত্বের সারকথাটাই যেন বলে দিয়েছেন।

সত্যিই তো চোরের ধর্ম। আর চোরাই সামগ্রী যেমন গোপনে রেখে দিতে হয় লুকিয়ে, তেমনই দেহের কন্দরে লুকানো থাকে মারফতি সাধনা, তার চাবিকাঠি থাকে গুরু-মুর্শেদের হাতে। একেই তাই বুঝি গানে বলে, ‘আমার ঘরের চাবি পরের হাতে?’ লালনের উপমার উজ্জ্বলতাও কত দীপ্র। তন্ত্রের গোপ্য সাধনার বিষয়ে বলা হয়েছে ‘ইয়ন্তু শাম্ভবী বিদ্যা গোপ্যা কুলবধূরিব’—এই গুহ্য বিদ্যা কুলবধূর মতো গোপন রাখতে হবে। লালন আরও নিগঢ় ইঙ্গিতে বলছেন, স্ত্রীলোক যেমন উপপতিকে প্রচ্ছন্ন করে রাখে মনের গহনে, অথচ বৈধ স্বামীর সঙ্গে সংসার করে, মারফতি সাধনাও তেমনই প্রচ্ছন্ন কিন্তু বাইরে শরিয়তি মুখোশ। কুলবধূর উপমা যেন অনেকটা পরিবার আর সমাজকে ঘিরে কিন্তু স্ত্রীলোকের উপপতি নিতান্ত ব্যক্তিগত সম্পর্কের আত্যন্তিকতা বোঝায়। উপপতি শব্দের সঙ্গে দেহগত ইঙ্গিত ও গোপন যৌনতার প্রশ্রয় আছে।

গানটা আগে শুনেছি কিন্তু এমন করে ভাবিনি। ভাবিনি, কারণ মারফতি আসলে তত্ত্বগান, তাই ভাঁজ খুলতে সময় লাগে, বয়স লাগে, বারবার শোনার অভিজ্ঞতা লাগে, তবে খোলে রহস্যের দরজা। এই ভদ্রবেশী ফকির যেমন একটুখানি ফাঁক করে দিলেন দরজা। মনে পড়ল আরেক ফকিরের কাছে শুনেছিলাম মারিফত মানে জ্ঞান। কীসের জ্ঞান? আল্লাকে প্রত্যক্ষ জেনে যে উপাসনা সেই সচেতনতাই হল প্রকৃত জ্ঞান। সুফিরা একেই বলেন, ‘আইনুল একিন।’ ‘মারিফতের কিস্তি’ বলে একটা বইতে লেখা আছে: শরিয়ত-তরিকত-হকিকত এই তিনধারার যে সাধনা তাতে হৃদয় মন থাকে কাচের মতো স্বচ্ছ, কোনও ছাপ বা প্রতিফলন পড়ে না। কিন্তু মারফতি পথে গুরুর নির্দেশ অন্তরে যেন পারা লাগিয়ে দেয় তখন মূল তত্ত্ব বা সত্যদর্শন তাতে ধরা পড়ে। মন তখন আর কাচ থাকে না, হয়ে ওঠে আয়না। লালন তাঁর খাঁচার পাখির গানে ‘আয়না-মহলের’ কথা বলেছেন। মারফতি গান সেই আয়না মহলের গুপ্ত স্বরলিপি।

ফকিরদের মধ্যে গান রচনার ঝোঁক কম। তাদের নিজেদের জীবনযাত্রার নানা সমস্যা, দারিদ্র্য ও ভিক্ষাজীবিতার চাপে গান লেখার মতো শান্ত আত্মস্থ অবকাশ কম থাকে। মুর্শিদাবাদ জেলা এদিক থেকে বেশ ব্যতিক্রমী। সেখানে আলেপ সর্দার, বাহার কিংবা নৈমুদ্দিনের মতো সজীব মনের রচয়িতাদের গানে যেমন ভাব তেমনই ভাষার বাঁধুনি। নদিয়ার আজহার খাঁ ফকিরের লেখা প্রচুর গান আছে। বীরভূমে বেশ কিছু ফকিরি গান পাওয়া গেছে যা সাম্প্রতিক কালের রচনা। কবু শাহ নামে এক গায়ক ফকিরের কণ্ঠ থেকে তেমন কিছু গান সরাসরি যন্ত্রে তুলে নিয়েছেন রাজ্য সংগীত একাডেমির গবেষক কঙ্কন ভট্টাচার্য। তাঁর সংগ্রহ থেকে কয়েকটি গান এখানে উদ্ধৃত করবার বিশেষ প্রয়োজন। তা থেকে বীরভূমের হালের ফকিরি গান সম্পর্কে খানিকটা ধারণা হবে। প্রথমে যে গানটি উদাহরণীয় তার বাণী:

পীর সালাম করি তব চরণে

আমি অবোধ শিশু রেখো যতনে।

একে একে করি সালাম যত পীর আস্থানে ॥

তারপরে করি সালাম আমি একিন মনে—

পাথরচাপুড়ির দাতা বাবা সেলাম তেনার চরণে

আজমীরের খাজা বাবা সেলাম তেনার চরণে

লাভপুরের ফুল্লরা মা সেলাম তেনার চরণে

বরঘাটের শামীদবাবা সেলাম তেনার চরণে

দুবরাজপুরের মামা-ভাগ্নে সেলাম তেনার চরণে

তারাপীঠের তারা মা সেলাম তেনার চরণে।

এঁকে খাটি ফকিরি গান বলা যাবে না—কিন্তু পথে ঘাটে গ্রামে হাটে ফকিররা এমন গান গায়। গানের মধ্যে ধর্মীয় উদারতা এবং হিন্দু মুসলমান ভেদরেখা মুছে বন্দনীয়দের প্রতি বন্দনা ধাবিত হয়েছে। ভুগোল বা নিজস্ব পরিবেষ্টনীর বেড়া ডিঙিয়ে এ-গান এক নিশ্বাসে উচ্চারণ করে স্থানীয় পাথরচাপুড়ির দাতাবাবা আর আজমীর শরীফের খাজা মইনুদ্দিন চিস্তিয়ার মহত্ত্ব। বীরভূমের চারটি স্মরণীয় ও অর্চনীয় স্থান গানে জায়গা করে নিয়েছে— লাভপুরের ফুল্লরা, বরঘাটের শামীদফকিরের থান, দুবরাজপুরের মামা-ভাগ্নে পাহাড় এবং তারাপীঠের তারা মা-র মন্দির। এ ধরনের গান যে-ফকির প্রকাশ্যে গেয়ে বেড়ায় তার জনাদর দেখার মতো। সাধারণ খেটে-খাওয়া মানুষ, হাটের মানুষ দোকানদার ও গৃহস্থ এমন গান শুনতে ভালবাসে, ডেকে ডেকে শুনতে চায়।

এর পাশে সম্পূর্ণ অন্যরকম একটা গান পাওয়া যাচ্ছে যার গীতিকারের নাম নেই কিন্তু গানের মধ্যে শরিয়তি সাধনার প্রসঙ্গ এসেছে। ইসলামে ‘নেকি’ (পবিত্র) আর ‘বদি’ (নোংরা) বলে দুটি কথা আছে। বদিকে বর্জন করার পরামর্শ দিয়ে বলা হচ্ছে:

ধুয়ে ফেল্‌গা মনের বদি

আল্লার সনে ভাই মিশবি যদি।

আল্লার সঙ্গে মিশে যাবার ইচ্ছা ঠিক শরিয়ত সংগত বাসনা হতে পারে না—ভাবনার মধ্যে মারেফতের ছাপ খুব স্পষ্ট। এরপরে বলা হচ্ছে:

পাঁচ কলমা নামাজের গুঁড়ো

রোজা রাখো নামাজ পড়ো

দিলেতে সবুর করো

একল তিরিশ ভাই মানো যদি।

এখানে তিরিশের উল্লেখ আসছে শরিয়তের তিরিশ পারা কোরানের জাহির অংশ। ফকিরদের বিশ্বাস আছে বাকি দশপারা বাতুনের প্রতি। গানের শেষটুকু বেশ মজার:

যেমন বান্দা বেহেস্তে যাবে

মেওয়া ফল ঝুঁকে পড়বে—

‘খাও খাও’ বলে বান্দার মুখে এসে লাগবে

খাওয়ার ইচ্ছা ভাই থাকে যদি।

ফকিরদের স্বর্গকামনা নেই, মানবদেহেই বেহেস্ত তাদের। কিন্তু নেকবান্দারা যখন স্বর্গে যাবে তখন স্বর্গীয় প্রাপ্তিফল বা মোক্ষ তাদের দিকে ঝুঁকে পড়বে। কিন্তু তখন কি সেই প্রাপ্তিফলের প্রতি আসক্তি থাকবে? এ হল ফকিরের সন্দিহান প্রশ্ন। একেবারে খাটি ফকিরিগান এবারে:

কেউ ছিল না বে-নমুনা

কুদরতে হয় তাহার আসন

বিষ্ণুরূপে ভাসিলেন আমার সাঁই নিরঞ্জন।

উঠিল একটা প্রেমধারা

তার উপরে বিম্বু খাড়া

আমি শুনতে পাইলাম আগাগোড়া।

ভাসিতে ভাসিতে বিম্বু তুফানের উপরে

ভাসিতে ভাসিতে লাগিল কুহুতরে

আল্লা নবী একাসনে যুক্তি করে মনে মনে

করিল রে জাহের বাতুন।

জাহের-বাতুনের উৎস কল্পনায় ভাবালুতাটুকু কী চমৎকার। এরপরের অংশ আরও মর্মগ্রাহী:

আগেকার বিম্বু বলিতেছিল লাইলাহা ইল্লাললাহ

পেছকার বিম্বু বলিতেছিল মহম্মদ রসুলুল্লাহ

দীনের নবীকে রাখো স্মরণ।

এইরকম ফকিরিগান কিংবা এর চেয়ে একটু উচ্চ ভাবের গান যাতে ভেদ (রহস্য)-য়ের কথা থাকে, তা বুঝতে গেলে ফকিরদের সঙ্গ করতে হয়। বাউল গানে খানিকটা সুবোধ্যতা থাকলেও ফকিরিগান বিচার বিশ্লেষণ সাপেক্ষ।

তাই ফকিরদের কথা ফকিরদের কাছ থেকে শোনাই ভাল। তাঁদের সঙ্গে মৌলানা মৌলবিদের কী নিয়ে এত ধুন্ধুমার সেটা জানতে চাইলে তাঁরা যা বলবেন, সকলে প্রায় একই কথা বলবেন, তা এইরকম। বাচনিক ভঙ্গিতে বললে দাঁড়ায় এইরকম যে,

দেখুন, ফকিরি মত ইসলামের আগে থেকে ছিল। ধরুন, আল্লা যখন বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি করলেন সেই ইস্তক ফকিরি চলছে। তবে একটা হিসেবের ব্যাপার আছে। মোল্লা মৌলবিরা বলছেন, সাধারণ কোরানের হল তিরিশটা পারা, আর ফকিররা বলছেন চল্লিশটা। দশ পারার তফাৎ হচ্ছে। এই দশ পারা তো লিখিত নেই, সেটা রয়ে গেছে ফকিরদের কাছে বাতুন বা গোপন হয়ে। মুসলমানরা ঐ জাহির হওয়া তিরিশ পারা নিয়ে বাহ্য আচার আচরণে রয়েছেন। আমরা সেটা বর্জন করে গোপন দশপারা নিয়ে কাজ কারবার করি মুর্শিদের বায়েত হয়ে। এতেই ওঁদের যত রাগ।

আবার দেখুন মূল কোরানে আছে নব্বই পারা। তার তিরিশ পারা আলেমদের, দশ পারা হল ফকিরদের, হল গিয়ে চল্লিশ পারা। বাকি পঞ্চাশ পারার মধ্যে বিশ আছে আরশে, বিশ আছে কুরশে, আর কবরস্থানে আছে দশ। এই হল সাকুল্যে নব্বই পারা। এখন কথা হল নব্বই পারা কোরানের মধ্যে নব্বই হাজার কথা আছে। তার তিরিশ হাজার জাহির আর ষাট হাজার হল গিয়ে বাতুন। এবারে শুনুন গান কি বলছে। বলছে:

মারফতি বিচার কর বসিয়ে শরীয়তের কোলে—

ষাইট হাজার গোপনের কথা নিষেধ করেছে রসুলে।

ফকিরের এই বাচনিক ভাষ্য তথা কথকতার তোড়ে পাঠকরা ভেসে যাবেন, তাই মাঝখানে থেকে আমাদের দুয়েকটা কথা বলতে হবে। নইলে সব গুলিয়ে যেতে পারে। মনে রাখতে হবে, ইসলাম বিশ্বাসে বলা হচ্ছে আল্লার রসুল মহম্মদের সঙ্গে মেহরাজে (শুন্যের এক কল্পিত উচ্চস্তর) আল্লার কিছু গূঢ় কথা হয়েছিল। সেই গূঢ় কথার মধ্যে তিরিশ হাজার কথা প্রকাশ্য। বাকি ষাট হাজার কথা রসুল গোপন রেখেছিলেন। সেটাই নাকি ফকিররা পেয়ে গেছেন সিনায় সিনায়। এখানে আবার কূটকচালি কথা আছে একটা। লালন কূট প্রশ্ন তুলেছেন:

মেয়ারাজের কথা শুধাব কারে

আদমতন আর নিরূপ খোদা

নিরাকারে মিলে কী করে?

এখানে আদমতন মানে মানবদেহধারী মহম্মদ রসুল। তাঁর সঙ্গে নিরূপ নিরাকার খোদার দেখা বা মিলন কী করে হতে পারে? লালন অব্যক্ত ইঙ্গিতে বলতে চান আল্লা নিরাকার নন, তাঁকে দেখা যায়। এ তো ভয়ংকর ইসলামবিরোধী উচ্চারণ। কিন্তু লালনকে প্রতিহত করা কঠিন। তাঁর দৃঢ় প্রত্যয় হল:

খোদা প্রাপ্তি মূল সাধনা

রসুল বিনা কেউ জানে না।

জাহের বাতিন উপাসনা

রসুল দ্বারায় প্রকাশিলে।

লালন একেবারে মূল তত্ত্বটা বলে দিলেন এই চার পঙ্‌ক্তিতে। অর্থাৎ, কিবা মোল্লা মৌলবি, কিবা ফকির দরবেশ, খোদাপ্রাপ্তি হল সকলেরই মূল লক্ষ্য। সাধনা মারফত সেই প্রাপ্তির পথ রসুলই জানেন শুধু। সেই পথ দু’রকমের— জাহের আর বাতুন। রসুলের দ্বারাই সেই দুই পথ বাতলেছেন খোদ আল্লা।

কথাটা মেনে নিলে গোলমাল মিটে যায়। ফকিরদের এটা মানতে আপত্তি নেই, কারণ কথাটা তাদেরই, কিন্তু নৈষ্ঠিক মুসলমান এমন কথা মানবে কেন? তাঁদের মনের যে ক’টি অটল বিশ্বাস বা ‘আকীদা’ আছে তার মধ্যে একটাকে বলে ‘ঈমানে মোফাছ্ছল’। তাতে বলা হয়: আমি আল্লাকে, তাঁর ফেরেস্তাগণকে, তাঁর প্রেরিত যাবতীয় কিতাব, তাঁর প্রেরিত সমস্ত পয়গম্বরকে মান্য করি।

এই আকিদা বা বিশ্বাসের খেলাপ করা চলে না কোনও ইমানদার মুসলিমের পক্ষে। তার নিজেরই তো বিশ্বাস যে আল্লার প্রেরিত কিতাব (অর্থাৎ কোরান) পবিত্র ও প্রশ্নাতীত ও মান্য। তবে সে কেতাবের বাইরে গোপন নির্দেশ মানবে কেন? দশ পারা বাতুনী নির্দেশের যাট হাজার কথা তার পক্ষে বর্জনীয় শুধু নয়, অবিশ্বাস্য ও ধিক্কারযোগ্য। কিন্তু ফকিরদের জোর ওই জায়গাতেই। তাদের গানে বলা হচ্ছে:

নবীহজে মে’রাজে যেদিন যায়

সেদিন খোদার সাথে আশকেতে কত কথা হয়।

সেদিন নব্বই হাজার কালাম হল

খোদা তিনরকমের হুকুম দিন—

দলিলে প্রমাণ হল মিথ্যা কথা নয়।

কতেক ছিনায় কতক ছপিনায়

আবার কতেক গায়েব রয়।

এই পর্যন্ত পড়লে বোঝা যায় মেহরাজে নবির সঙ্গে খোদার কথাবার্তায় ফকিরদের সংশয় নেই। তবে তাদের ধারণা যে, খোদা সেদিন যে নব্বই হাজার কালাম দিয়েছিলেন তার তিনরকম বিলিব্যবস্থা হয়েছিল। যথা ‘সিনা’ বা হৃদয়ে হৃদয়ে সঞ্চারিত, ‘সফিনা’ বা গ্রন্থে নির্দেশিত এবং ‘গায়েবি’ বা অদৃশ্য উধাও। এবারে শোনা যাক হিসেব নিকেশ। সেটা হল:

পহেলা কালাম তিরিশ হাজার তুমি জারি করবে

উম্মতের পর—

করে খবরদারি হুঁশিয়ারি যেন বেতরিক না হয়।

আর তিরিশ হাজার বলি তবে তুমি ব্যক্তিবিশেষে জানাবে

ছিনার ভেদ না জানিলে মিথ্যা সাধন হয়।

আর তিরিশ হাজার বাকি রইল খোদা ফুরকানে তা রেখে দিল

ভেদাভেদ কেউ না পেল এহি দুনিয়ায়—

বাহার কইছে নাচার পীর পয়গম্বর তারাও ভেদ না পায়।

এই পদ বাহার ফকিরের রচনা— যাঁর ভাবনায় একটা নতুন কথা জানা গেল যে খোদার প্রথম তিরিশ হাজার কালাম প্রচারের জন্য নির্দিষ্ট। পরবর্তী তিরিশ হাজার ব্যক্তিবিশেষের মাধ্যমে বিকশিত হবে তবে হৃদয়ের গূঢ় গুপ্ত রহস্য না জানলে তার ব্যঞ্জনা ব্যর্থ হয়ে যাবে। শেষ তিরিশ হাজার বাণী খোদা স্বতন্ত্র করে রেখে দিয়েছেন বলে এই পৃথিবীর কেউ তার রহস্য ভেদ করতে পারেনি, এমনকী পির পয়গম্বররাও নয়।

এ ধরনের কথাবার্তা বা ধ্যানধারণা ফকিরদের সঙ্গে মিশলে নিয়তই জানা যায় এবং এ ব্যাপারে ফকিরে ফকিরে কিছু মতভেদও দেখেছি। তার কারণ যে যেমন মুর্শেদের কাছে দীক্ষিত সে তেমন ভাবনা ধারণা নিয়ে থাকে। তবে এটা দেখেছি যে, কোনও কোনও, উপলক্ষে যখন ফকিররা সমবেত হন কোথাও, তখন নানা বিষয় নিয়ে আলাপ আলোচনা তর্কবিতর্ক হয়। সেই প্রসঙ্গে লাগসই গান গেয়ে থাকেন তাঁরা। কোরানের নানা আয়াত তাঁরা আওড়ান ও ব্যাখ্যা করেন কিন্তু সেই ভাষ্য শরিয়তি ভাষ্যের সঙ্গে নাও মিলতে পারে। তবে সব মিলিয়ে এটা বোঝা যায় যে ম্লান পোশাক আর অতি সাধারণ জাঁকজমকহীন জীবনযাপনের অন্তরালে ফকিরদের অন্তর্জীবন এতটাই উদ্দীপ্ত ও শান্ত যে বাইরের বাসনাময় আহ্বান তাঁদের টানে না।

তার মানে তাঁরা একটা অন্তরের সত্য পেয়ে গেছেন, একটা স্থির প্রত্যয়, যার জন্য তাঁদের মধ্যে অটল বিশ্বাসের বনিয়াদ গড়ে উঠেছে। বীরভূমের ফকিরডাঙা থেকে দায়েম শা-র যে ক’টি ফকিরি গান আমি সংগ্রহ করেছিলাম এখানে তার থেকে একটা উদ্ধৃত করছি ফকিরদের সেই দ্বিধাহীন বিশ্বাসের বনিয়াদটা স্পষ্ট করে বোঝাতে। এ ধরনের গানে বাউল গান রচনার দক্ষতা, অন্ত্যমিলের বয়ন ও ধ্বনিসাম্য ততটা নেই, কিন্তু বলার কথাটা স্বচ্ছ। যেমন:

ও তুমি দেল-হুজুর না চিনলে পরে

তোমার নামাজ হবে কী করে?

দেল-হুজুরে পড়ো নামাজ আপনার মোকাম চিনে।

ওরে ভুলে যাবি ইশ্‌কের জ্বালা

উঠবে নূর তাজেল্লা

খ্যাপা সামনে দেখবি আল্লাতালা

ঠিক রাখো দুনয়নে।

একেবারে অবিন্যস্ত রচনা। আঙ্গিক শিথিলতা আর মিলের চমৎকৃতিহীনতা রীতিমতো শোচনীয় কিন্তু এর মধ্যে জ্বলজ্বল করছে দায়েম শা-র বিশ্বাসের গভীর উচ্চারণ। ‘দেল-হুজুর’ শব্দটাই অভিনব, যার অর্থ আত্মস্থ সত্তার নির্দেশ। সেই নির্দেশে আপনার ‘মোকাম’ অর্থাৎ অবস্থান জেনে নিয়ে তবে নামাজ পড়তে হবে অবিরত। তাতেই সামনে বিভাসিত হবে শুভ্রজ্যোতি ‘নুর’ এবং প্রত্যক্ষ দেখা দেবেন আল্লাতালা। গানের পরবর্তী এক অন্তরা অংশে দায়েম বলেছেন আরও গুহ্য কথা। যেমন:

বে-আকারে সিজ্‌দা দিলে

খ্যাপা সেই সিজ্‌দা কি হয় দলিলে?

আকার ধরে দাওরে সিজ্‌দা

বসে থাকো এক ধ্যানে।

এখানে দ্বিধাহীন সাকার উপাসনার কথা রয়েছে। আল্লার সাকার রূপকেই ‘সিজ্‌দা’ বা প্রণতি দিতে হবে। বেআকারে সিজ্‌দা কায়েম হয় না। কিন্তু তার আগে, সবচেয়ে আগে, নিজের মোকাম ধরতে হবে। লালন তাঁর গানে বলেছিলেন: ‘নিজ মোকাম ধরো বহু দুরে নাই’— নিজের মধ্যেই আছে আত্মোপলব্ধির পথ। শুধু বর্হিবৃত্তি ত্যাগ করলেই সেই পথের দিশা মেলে। নিরাকার সাধনায় যে আল্লা পাওয়া যায় না সেকথা দায়েমের আগে লালন বলে গেছেন, তবে অনেক কবিত্বে উপমায় ব্যঞ্জনায় সমৃদ্ধ করে। তাঁর গানের ব্যক্ততা:

নৌকা ঠিক নয় বিনা পারায়

নিরাকারে মন কি দাঁড়ায়?

লালন মিছে ঘুরে বেড়ায়

অধর ধরতে চায় বর্জখ বিনে।

অসামান্য উচ্চারণ ও ভাবের বিন্যাস অথচ যুক্তির সমবায়ে। বলার কথা হল, নৌকা যদি ঘাটে বাঁধা থাকে তবে তার সার্থকতা কোথায়? পারাপারই তো তার কাজ, তার ধর্ম। সেই পারাপারে চাই মাঝি বা কাণ্ডারি। বেঁধে রাখা নৌকার মতো উদ্দেশ্যহীন হল নিরাকার সাধনা, তার সঙ্গে মনের যোগ থাকে না। অতএব দেহনৌকা বাইতে হবে সাকার মুর্শেদকে মাঝি করে। অধরাকে ধরার এই হল বাস্তব পদ্ধতি।

মুর্শেদকে ধরে কায়া সাধনাই ফকিরি-পস্থার সার কথা, আর সবই এ-মতে বহির্বৃত্তি বলে পরিত্যাজ্য। নসরুদ্দিন ফকিরের রচনায় বলা হচ্ছে:

মালা জপে পাঁচবেলা

কে কোথায় পেয়েছে আল্লা?

মক্কা ও মদিনা গেলে

কই তাহার ঠিকানা মিলে?

হাজীগণকে শুধাইলে

সেথা হয় মানুষের মেলা।

যেয়ে দেখি জুম্মাখানা

তথায় গিয়ে খোঁজ পেলাম না

মানুষে খায় মানুষের খানা

আল্লা খায় না একতোলা।

মালা জপের উপাসনা আর হজের নিরর্থকতা গানটির উপজীব্য। তাতে আল্লাকে পাওয়া যায় না। মাফেরত হাজীদের কাছে জানা যায়, হজ মানে মানুষের মেলা, মানুষের জন্য মানুষের তৈরি খানাপিনার আয়োজন। তার একদানাও আল্লার ভোগে লাগে না। লালন অবশ্য মানব সমাগমের গভীরার্থ অন্যভাবে ভেবেছিলেন। তাঁর বচন: ‘কাশী কিংবা মক্কায় যাওরে মন/দেখতে পাবে মানুষের বদন’। অর্থাৎ অলৌকিক ভাবসাধনা নয়, তীর্থব্রতের চেয়েও অনেক বড় মানবতন্ত্র— মানুষতত্ব।

কিন্তু নসরুদ্দিনের যে-ফকিরি গান আমরা পড়ছিলাম, তার পরবর্তী অংশের কথা হল:

খোদার তৈয়ারি ঘরে।

খুঁজলে পরে মিলতে পারে—

ঘর বানায়ে তার ভিতরে।

বসে আছে সেই মৌলা।

ফকিরদের কথা, মানুষের তৈরি মক্কার কাবা-ঘরে তাঁকে পাওয়া যায় না। তাঁর তৈরি যে মানবদেহ তার গভীর অভ্যন্তরে নিজের ঘরটি বানিয়ে তাতে বসে আছেন স্রষ্টা। এখানে স্রষ্টা অর্থে সৃষ্টিবিন্দু— বীর্য। হজরত আলী নামে এক অজানা ফকিরের গানে চকিত এক পঙ্‌ক্তি পেয়েছিলাম: ‘দেহতে মক্কা গোপন সব জানাজানি’। হঠাৎ শুনে স্ববিরোধী মনে হয় কিন্তু ঠিকই তো এই সত্য যে, দেহ-মক্কা এক অর্থে গোপন, আরেক বিচারে জানা। ফকিরদের রহস্যময় কল্পনা স্রষ্টা আল্লা আর সৃষ্ট আদমের দেহ নিয়ে কত রঙ্গ, কত বস্তুবিবরণ বানায়। যেমন মজিদ নামে ফকিরের গানে পাই:

আদমের কালেবের মাঝে

পার্ক এলাহির বারামখানা।

দেহের পিঞ্জরের মাঝে

কী আজব কারখানা।

মানুষের দেহের মধ্যে পবিত্র আল্লার নিবাস। সেই দেহকে জানলে চিনলে, সেই দেহকে সঠিকভাবে নির্ণয় করতে পারলে আরও কত অগোচর রহস্য জানা যায়। জানা যায় এমনতর বিচিত্র সংবাদ যে,

নাভীর মধ্যে মক্কা শরীফ

কইরাছে ঠিকানা—

নাভীর উপর বয়তুল মুকাদ্দাম

কালিজাতে থানা—

দেলের ভিতর রাখিয়াছে

সোনার মদিনা।

তবে তো দেহ-তীর্থ ভ্রমণ সর্বতীর্থসার। এ ধরনের কথা ও কল্পনা গড়পড়তা ভাবনায় পাওয়া সম্ভব নয়। ইসলামি ধর্ম বিশ্বাস আর আকিদার অন্য পিঠে এই কল্পজগৎ। যেমন মধুর কল্পনায় চিত্তগ্রাহী তেমনই রহস্যসুন্দর। বাহার ফকিরের ছোট একটি মারফতি গানে জগতের অন্তর্গোপন কত সংবাদ পর্যষিত হয়ে আছে, যখন পড়ি,

যেভাবে সাঁই-এ মিশে রয় খোদা

ছিনায় ছিনায় ঘুরে বেড়ায় ছপিনায় জুদা!

গোড়াতেই বলে দেওয়া হল, ফকিরদের মৌল প্রতীতি যে, সত্য পেতে হবে হৃদয় দিয়ে, সফিনা বা শাস্ত্রগ্রন্থের সঙ্গে হৃদয়ের সম্পর্ক বিরোধী ও ব্যবধান রচনাকারী। একমাত্র হৃদয় সংযোগে বোঝা যায় সাঁইয়ের মধ্যে সূক্ষ্মভাবে নিহিত হয়ে আছেন খোদা। যেমন দুধের মধ্যে ননী, ননীর মধ্যে ঘৃত। পরপর সাংসারিক বাস্তবের হাতে হাতে করা অভিজ্ঞতা উঠে আসছে—ভাবনার কোনও ধূসরতা নেই। বাহার এই ইঙ্গিতটুকু দিয়েই ক্ষান্ত হন না। মরমি শ্রোতাদের তুলনার ছটায় ভরিয়ে দিয়ে বলে যান:

আসমানে সূর্যদেব আছে

তার জ্যোতি লাগে কাছে

হায়রে তেমনি ভাবে আল্লা

মানুষে সর্বদা।

যাকে ভাবছি সুদূরের সামগ্রী, অধরা ও অপ্রাপণীয়— তার তাপ যেমন দেহলগ্ন হয়ে যায়, ঠিক তেমনই করে আল্লা সুদূর তবু মানুষের সঙ্গে উষ্ণ সাহচর্যে অস্তিত্ববান। তাকিয়ে দেখলে চোখে কি পড়ে না এই সত্য যে,

মিশে রয় গাছে বীজে

হায়রে ফুলে মিশে বাস রয়েছে

ফলে মিশে সুধা।

যুক্তির ক্রম ক্রমশ অনুভবের গভীরে যাচ্ছে— দৃশ্য থেকে ভাবে। আমরা বুঝে নিই গাছে যেমন বীজ থাকে গোপন হয়ে, কিংবা বীজেরই অভীপ্সা গাছ, তেমনই অচ্ছেদ্য ফুল আর তার সৌগন্ধ, ফলের অন্তঃশায়ী মাধুর্যের স্বাদ। এর পরের কথাটা অনুক্ত কিন্তু প্রকাশ্য— অর্থাৎ, মানুষের মধ্যে খোদা, সৃষ্টির মধ্যে স্রষ্টা। তাঁকে কেন তবে খুঁজব মন্দিরে-মসজিদে, শাস্ত্রে, শাস্ত্রী-মোল্লায়, কাশী-মক্কায় কিংবা রোজা-উপবাসে? ফকিরিয়ানার শেষ কথা হল গোপনীয়তা। জাহির নয় বাতুন। তাকে তালাশ করতে হবে অতলতার গোপনে। কারণ—

গোপন রয়েছে খোদা তাকে চিনিনি।

কাম গোপন প্রেম গোপন লীলা নিত্য সবই গোপন

আরসে আল্লা গোপন নীরের নিশানী।

জলেতে মীন গোপন ঝিনুকে মুক্তা গোপন

ফুলেতে গন্ধ গোপন আপে রব্বানী।

আদমে আহাদ গোপন মীমেতে নূর গোপন

কোরানে কলমা গোপন আপে গোপনী।

নামাজে মারুফত গোপন ষাট হাজার কলমা গোপন…

গভীর চলাকে গোপন রেখে ফকিরবা রয়ে গেছেন যুগে যুগে তাঁদের অচলপ্রতিষ্ঠ বিশ্বাসে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *