১.২ আয়নামহলের কথা

আয়নামহলের কথা

মাঝে মাঝেই নিমন্ত্রণ আসে বাউল সম্মেলন বা বাউলদের নিয়ে সেমিনারে যোগ দেবার জন্য। হয় কিছু বলতে হবে, নয়তো উদ্‌বোধন করতে হবে, না হয় সেমিনারেরই কোনও অংশ বা কর্মসূচি পরিচালনা করতে হবে। আমি, সম্ভব হলে, অন্য কোনও ঝামেলা না থাকলে, এমন আহ্বান এড়াই না। তার দুটো কারণ। এক, একটা না-জানা জনপদ ও অঞ্চল, সেখানকার মানুষ ও নিসর্গকে জানা যায় ঘনিষ্ঠভাবে একদিন-দু’দিনের উষ্ণ সান্নিধ্যে। দুই, বাউলদের কাছাকাছি থেকে তাদের অনেক বেশি সংসর্গে আসা যায়। বিশেষ যাদের হালহদিশ আগে জানতে পারিনি, আঞ্চলিক বা ভৌগোলিক দূরত্বের কারণে, তাদের ঠিকানা-বিবরণ আমন্ত্রণ পেয়ে যাই। অবশ্য এ-বর্গের মানুষদের সঙ্গে সবচেয়ে ভাল করে ভাবের লেনদেন ও কথালাপ জমে ওঠে পরে, তাদের আস্তানায় কিংবা আখড়ায়। তবে সেখানে পৌঁছে হুট করে চলে আসার চেষ্টা করে লাভ নেই। থাকতে হবে একদিন দু’দিন। তাদের জীবনযাপন, তাদের সংলাপ, খাদ্য আর স্বভাবের সঙ্গে জড়িয়ে পড়তে হবে। তাদের শিষ্য সেবকদের সঙ্গে ভাব করতে হবে। তাদের কাছে শুনতে হবে গুরুর নানা গুণগান, তাঁর মহিমার কত কিছু আখ্যান। গুরু মা-র কাছে বসে তাঁর আঁতের কথা শুনতে হবে। সত্যি মিথ্যে নানা কাহিনি। খুব গম্ভীর হয়ে শুনে যেতে হয়।

আজকাল বাউল গুরুরা নানা পরীক্ষা করেন। যেমন ধরা যাক, বাঁকুড়ার একজন তাত্ত্বিক বাউলের কাছে পৌঁছোলাম, থাকলাম একরাত। তাঁর কাছে পুরনো দেহতত্ত্ব গানের একটা খাতা আছে এ খবর জানতাম। সেটা চাইতে, কপি করে নিতে দেওয়ায় আপত্তি করলেন না, কিন্তু বলে বসলেন, ‘খাতাটা তো কাছে নেই। আছে এক শিষ্যের বাড়ি। বড়াচাঁদঘর গ্রাম চেনেন? আপনাদের নদে’ জেলায়। সেখানে আমার শিষ্য সুবলসখা সরকারের বাড়ি যাব অঘ্রান মাসের সাত তারিখে, মোচ্ছব আছে। সেদিন ব্যস্ত থাকব। আসুন পরের দিন আটই অঘ্রান। নিরিবিলিতে কথা বলা যাবে। গানের খাতাখানও পেয়ে যাবেন। পছন্দমতো গান টুকে নেবেন। তবে সে কাজে দু’দিন থাকতে হবে। অসুবিধে নেই, সুবল বড় গেরস্থ, মস্ত দালানবাড়ি, অঢেল জায়গা। এমনকী আপনাদের সেই ছ্যানিটারি পাইখানাও আছে, তবে কিনা টিউকল।’

উপায় নেই, শুনে যেতে হবে এহেন গুরুবাক্য। জানতে চাই গানের গুহ্য তত্ত্বকথা, সাধনার কথা, কিন্তু শুনে যেতে হয় অনর্গল— শিষ্যের ধনসম্পদ, প্রভাব প্রতিপত্তি, গুরুভক্তি এমনকী শৌচস্থানের আভিজাত্যের প্রসঙ্গ। তাই সই। এবারে একমাস পরে আটই অঘ্রান ভোরের বাসে চড়ে পৌঁছে যাই পলাশি, সেখান থেকে হাঁটা পথে বড়চাঁদঘর। অবশ্য ভ্যান রিকশায় পা ঝুলিয়ে আর ক’জন প্যাসেঞ্জারের সঙ্গে যাওয়া যেত। কিন্তু আমার পায়দল বেশি পছন্দ। পরিবেশটাকে অনুপুঙ্খ দেখা যায়।

অবশেষে বড়চাঁদঘরে পৌঁছই। সুবলসখার বাড়ি কে না চেনে। বিশেষত গতকাল সেই বাড়ির দীয়তাং ভুজ্যতাং মচ্ছবের খিচুড়ি এখনও সব গ্রামবাসীর পেটে রয়েছে। যাকেই জিজ্ঞেস করি হাঁ হাঁ করে নিশানা দেয়। কেউ কেউ সখেদে আগ বাড়িয়ে বলে, ‘দেখুন কপাল, মচ্ছব হয়ে গেল গতকাল, আর আপনি এলেন আজ? কাল এলে দেখতেন এলাহি ব্যাপার। বাউল গান শুনতেন রাতভোর। এখন তারা ঘুমোচ্ছে। এবারে খুব জমেছিল গানের আসর। দশজন গাহক এসেছিল, তার মধ্যে পাঁচজনের একটা দল এসেছিল বাংলাদেশ থেকে। কাল এলেন না?’

আসিনি বলে আমার তেমন খেদ নেই। তারা ভাবল, আমি নিতান্ত বেরসিক। এসব দিবসী মচ্ছবে জাঁকজমক-হইহল্লা খাওয়া-দাওয়াটাই মুখ্য। রাতে গানের আসরটা নৈমিত্তিক, যেমন রাজনৈতিক সভার শেষে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। যাই হোক, সুবলসখার বাড়ির সামনে এসে মনে হল গতকাল যেন একটা ঝড় হয়ে গেছে। এখন সব শান্ত, শ্রান্ত ও নিদ্রারত। খোঁজখবর করতে ভিতরবাড়ি থেকে বিব্রত ও বিনীত সুবলসখা এলেন। মাঝবয়সি মানুষ— কোরা ধুতি, খালি গা, খালি পা, গলায় কঠি। বিব্রত হয়ে বললেন, ‘আসুন আসুন, বসুন। কিন্তু বসবেন বা কোথায়। সব ছত্রখান হয়ে আছে। এই একটা চেয়ার দে।’

কাঁঠাল কাঠের চেয়ারে উপবিষ্ট হলে সুবলসখা হাত কচলে বললেন, ‘ভেবেছিলাম আপনি বোধহয় একটু বেলার দিকে আসবেন। সারারাত জেগে এখন সবাই ঘুমোচ্ছে। একেবারে আতান্তর অবস্থা। আপনাকে কী করে যে একটু সেবা দেব! ওরে কে আছিস, অন্তত একটু মুড়ি-চা দে। দেখুন দিকি, কাকেই বা বলি, সারাদিন সারারাত ভূতখাটুনি খেটে এখন সব ঘুমিয়ে কাদা। উঠবে সেই বারোটা-একটায়। দেখি, আমিই দেখি, গিন্নিকে ডাকি। বাড়িতে মান্যমান অতিথি বলে কথা…’

আমি তাঁকে নিরস্ত করে বলি, ‘ব্যস্ত হবেন না। আমি পলাশি বাসস্টপে নেমে চা খেয়ে নিয়েছি। চা-তেষ্টা নেই, খিদেও পায়নি। আপনার গুরু কোথায়? ঘুমোচ্ছো? আমার তো বলতে গেলে তাঁর কাছেই আসা।’

‘বিলক্ষণ, সে তো জানি’, সুবলসখা দাঁত বের করে বললেন, ‘নইলে কি এই অধম গরিবের বাড়ি আপনার পায়ের ধুলো পড়ে? গুরু গৌরবেই শিষ্যের মান বাড়ে। কিন্তু উনি তো নেই!’

—অ্যাঁ? সেকী? উনি যে আমাকে আজ আসতে বলেছিলেন।

—হ্যাঁ, বলেছিলেন ঠিকই। এসেছেন আপনি। গুরুবাক্য লঙ্ঘন হয়নি। কিন্তু উনি এসেছিলেন সাতদিন আগে। ওঁর কাছে ক’জন দীক্ষাশিক্ষা নিল এবার। ক’দিন থেকে তারপরে গতকাল সকালে মচ্ছব শুরু করে দিয়ে তিনি চলে গেলেন সেই দত্তফুলিয়ায়। তবে হ্যাঁ, আপনার কথা বলে গেছেন। খাতির যত্ন করতেও আলাদা করে হুকুম দিয়ে গেছেন। এখন বিশ্রাম নিন। তারপরে দুপুরে মাছভাত খেয়ে, একটু জিরিয়ে…

—কিন্তু আমাকে আসতে বলে চলে গেলেন? আশ্চর্য তো! একাই চলে গেলেন?

—এটা কী বললেন? তা কি হতে পারে? সুবলসখার মতো শিষ্য তা হতে দিতে পারে? তাঁকে নিতে দত্তফুলিয়ার শিষ্যরা এসেছিল তিনজন। তাঁদের সঙ্গে গেলেন তিনি। বলে গেছেন সেখানে আপনাকে যেতে। সাতদিন থাকবেন সেখানে, মচ্ছব হবে, দীক্ষা হবে। যাবেন তো?

—হুঁ। যেতেই হবে। কালই যাব। ঠিকানা?

—ঠিকানা খুব সোজা। বাসে করে সোজা দত্তফুলিয়া বাজারে নামবেন। তারপরে বলবেন, কাত্তিক মণ্ডলের বাড়ি। বাস যেখানে দাঁড়াবে তার উত্তরদিকে, খুব নিকটে। গাঁয়ের মাথা। সবাই চেনে।

কথা শেষ করে সুবলসখা রহস্যময় হাসি হেসে বললেন, ‘আপনার হয়রানি হল। কিন্তু আসলে গুরু আপনার একটু পরীক্ষে নিলেন। ধৈর্যের পরীক্ষে, আগ্রহের, আন্তরিকতার। বুঝলেন তো?’

বুঝলাম। হালফিলের বাউল-গুরুর নিজের দর বাড়ানোর কেরামতি বুঝলাম আরও পরে, কার্তিক মণ্ডলের বাড়িতে পা রেখে। গুরুঠাকুর দিব্যি বসে আছেন শিষ্যশিষ্যা নিয়ে। পরিতৃপ্ত মুখচ্ছবি। আমাকে দেখে বললেন, ‘আসুন আসুন। কালকে খুব হয়রানি হল তো? আজ আসবেন সে খবর কালরাতে সুবলসখা পাঠিয়েছে। সেইজন্য আজ বেশ ক’জন শিষ্যকে ডেকে পাঠিয়েছি। এসে পড়বে এখুনি সব। আপনাকে দেখতে আসবে।’

—আমাকে দেখতে? কেন?

—আরে, আপনি একজন গবেষক অধ্যাপক। আমাদের নিয়ে কত খোঁজপাতি করছেন। গান জোগাড় করছেন। সেসব ওরা জানবে না?

হঠাৎ কথার মাঝে মুখ ফসকে একজন নির্বোধ শিষ্য বলে বসল, ‘তা ছাড়া ধরেন, আমাদের গুরুঠাকুরই কি কম? তাঁর কাছে আপনাদের মতো মানুষ আসছেন। একবার যাচ্ছেন বড়চাঁদঘর, আবার আসছেন এই দত্তফুলিয়ায়। আমাদের গুরু কত বড় ভাবুন তো? সেটা দেখাতেই আজ শিষ্যদের আনা হচ্ছে। এতে তেনার আরও কত শিষ্য হবে, তাই না বলো?’

সবাই মুখ চাওয়া চাওয়ি করল। কার্তিক মণ্ডল বললেন, ‘এই কেষ্ট, তুই থামবি? এসব কথা তোকে কে বলতে বলেছে? বুঝিস কিছু?’

গুরুদেব নিমেষে সবাইকে হটিয়ে দিয়ে সাগ্রহে আমাকে ডেকে কাছে বসালেন। তারপর প্রসন্ন মুখে বার করলেন গানের খাতা, তাঁর ঝুলি থেকে। তার মানে, ধৈর্য অধ্যবসায়ের পরীক্ষায় আমি এবারে পাশ করলাম। একথা বোধহয় বলার দরকার নেই যে, খাতাখানা তাঁর কাছে বাঁকুড়াতেই ছিল— তবে আমাকে একটু খেলিয়ে নিলেন।

আগেই বলেছি এসব সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতা। আগে এমন দর বাড়ানোও ছিল না, আমার এত ভোগান্তিও হত না। কারণ তখন ব্যাপারটা ছিল সরাসরি। যেমন ধরা যাক, ষাটের শেষে বা সত্তর দশকের গোড়ায় যখন আমি গানের সন্ধানে গ্রামে ঘুরতাম তখন নদিয়ার বৃত্তিহুদায় পেলাম কুবির গোঁসাইয়ের ঢাউস এক গানের খাতা। হাজারের ওপরে গান। গানের যিনি ভাণ্ডারী সেই রামপ্রসাদ ঘোষ সম্পন্ন চাষি গৃহস্থ। খুব আপ্যায়ন করলেন, খাওয়ালেন। এক পুরনো কাঠের সিন্দুক খুলে লাল শালুতে মোড়া গোঁসাইয়ের গানের খাতা বার করে মাথায় ঠেকিয়ে তারপরে আমাকে দিয়ে বললেন, ‘এই খাতায় কুবির গোঁসাইয়ের গান সবই আছে। আমার পিতা দাসানুদাস ঘোষ, তাঁর পিতা রামলাল ঘোষের হাতের লেখায় এটা মূল খাতার নকল। দেড়শো বছর আগেকার পুঁথি।’

খুব আগ্রহ ভরে হাতে নিয়ে পরম আবেগে তাকিয়ে থাকলাম। একটা ইতিহাস যেন সামনে তার পৃষ্ঠা খুলে দেখাল। কুবিরের লেখা পদ ‘ডুব ডুব ডুব রূপসাগরে আমার মন’ দক্ষিণেশ্বরে ভবতারিণীর মন্দিরে বসে গাইতেন ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ। সেই গীতিকারের হাজারো পদ আমার হাতে? আমি উচ্ছ্বসিত হয়ে বলে বসলাম, ‘এই খাতা আমাকে দেবেন তো?’

—না। খাতা তো দেবই না, এমনকী একটা গানও টুকতে দেব না।

—কেন?

—এহ খাতা দেখতে দিয়েছিলাম চাপড়ার ষষ্ঠী ডাক্তারকে। তিনি কখন আমার অজান্তে একখানা গান টুকে নিয়ে আকাশবাণীতে দিয়ে মোটা টাকা পেয়েছিলেন।

—সেকী? কী করে জানলেন? সেটা কোন গান?

—গানটা রেডিয়োতে প্রায় হয়— ‘ডুব ডুব ডুব রূপসাগরে আমার মন’, এই দেখুন আমাদের এই খাতায় রয়েছে ৪৩১ নং গান। দেখেছেন?

আমি কিছুতেই রামপ্রসাদকে বোঝাতে পারলাম না যে গানটা ওই খাতা থেকে টুকে ষষ্ঠী ডাক্তার দেননি আকাশবাণীতে— টাকাও পাননি। গানটা আছে ‘শ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত’-এ ছাপার অক্ষরে। কিছুতেই বোঝানো গেল না অজ পাড়াগাঁর অশিক্ষিত সেই মোড়লকে। খাতা তিনি দিলেন না। পরে কীভাবে সেই খাতা হস্তগত হল, সব গান পড়লাম, যথেচ্ছ টুকে নিলাম, সে কথা স্বতন্ত্র। কিন্তু আপাতত বলতে চাই, আগে ব্যাপারটা ছিল সাদাসাপটা— দেব অথবা দেব না। আর এখন গুরুঠাকুর গোটা কয়েক গান দেবেন বলে আমাকে ঘোরালেন, শিষ্যদের কাছে নিজের গুরুত্ব বাড়িয়ে নিলেন। বাউলদের কাছে কিছু পাওয়া আজকাল বেশ কঠিন হয়ে পড়ছে দিন দিন। তাদের দর এত বেড়ে গেছে।

বাউলদের সেমিনারে গেলে অবশ্য একেবারে উলটো ছবি। সেখানে দলে দলে প্রসাদভিক্ষুর মতো ভিড়। উদ্যোক্তাদের নাকালের একশেষ। সব জায়গায় একই অভিজ্ঞতা। হয়তো কোনও একজন বাউলকে পত্র মারফত নিমন্ত্রণ পাঠানো হল, এসে গেলেন দশজন। তাদের মধ্যে পাঁচজন যন্ত্র বাজাবেন, আর বাকি ক’জন এসেছেন সঙ্গ দিতে— আসলে দু’-তিন দিন ধরে থাকা খাওয়া ফ্রি, এদিকে বেড়ানোও হল। কিন্তু উদ্যোক্তাদের নাভিশ্বাস। একজন গায়ক আর পাঁচজন যন্ত্রীকে দিতে হবে অন্তত পঞ্চাশ টাকা করে, সেই সঙ্গে পাথেয় পঞ্চাশ টাকা, সাকুল্যে একশো। বাজেট বেড়ে গেল অনেক। আবার মঞ্চে উঠে আরেক কাণ্ড। নিমন্ত্রিত গায়ক নিজে না-গেয়ে প্রথমে পাঁচজন যন্ত্রীকে দিয়ে একটা করে বাউল গাওয়াবেন। তার মান যাই হোক। তারপরে নিজে গাইবেন। অনুষ্ঠানের ঘোষক পড়ে যান বিপাকে। সময়সীমা রাখাও হয়ে পড়ে কঠিন।

প্রধান উদ্যোক্তা ভদ্রলোক, হাতে ধরা ছোট ব্রিফকেস, ছোটাছুটি করে কূল পাচ্ছেন না। দরবিগলিত ধারায় ঘামতে ঘামতে আমার সামনে এসে, কোঁচার খুঁটে ঘাম মুছে বললেন, ‘নামেই বাউল সম্মেলন আর কী যেন বলেন আপনারা? হ্যাঁ সেমিনার… সেমিনার। নিকুচি করেছে কাজের।’

—কেন?

—টাকা দিচ্ছে মানে ম্যানেজ করেছি দু’জায়গা থেকে— পূর্বাঞ্চল সংস্কৃতি কেন্দ্র আর দিল্লি মানবসম্পদ উন্নয়ন দপ্তর থেকে। কড়াকান্তি হিসেব রাখতে হচ্ছে, ভাউচারসহ, বুঝলেন?

—অসুবিধে কী?

—আর্টিস্টদের পেমেন্ট করবে EZCC। তার ভাউচারে আর্টিস্টদের সই কিংবা টিপসই লাগবে তো। এখন ধরুন বাউল আর্টিস্ট আসার কথা পঁচিশজন, এসেছে পঁচাত্তরজন। টাকা তো দিয়েছে পঁচিশজনের। বাকি ক’জনের টাকা কোথা থেকে আসবে?

—এত বাউল আছে এ অঞ্চলে?

—না না, সবাই বাউল নাকি? এসে পড়েছে। একসেট গেরুয়া পোশাক আছে, গোটা দশেক গান জানে। ব্যস, তবে আর কী। এখন থাকতে দিতে হবে, গাণ্ডেপিণ্ডে গিলবে পাঁচ-ছ’ বেলা, গাঁজা টানবে। যত্ত সব। মশাই, এর নাম লোকসংস্কৃতি? বাউলগানের উন্নয়ন? ধুস। ঘেন্না ধরে গেল। মানবসম্পদের টাকাই তো এখনও আসেনি। বুঝুন ঠেলা।

কিন্তু তবু এমন সম্মেলন আর সেমিনার বেড়েই চলেছে। আসলে একটা নতুন কিছু কর। যে সময়ে যে হুজুগ ওঠে। অথচ বাউল ফকিরদের ব্যাপারটা একেবারেই হুজুগে ছিল না। আমার দ্বিজপদ মাস্টারমশাইয়ের কথা খুব মনে পড়ে। বাউল ফকিরদের গান খুঁজে বেড়াচ্ছি খবর পেয়ে আমার বাড়ি এলেন গ্রাম থেকে সাইকেল ঠেলে। হাতে ধরিয়ে দিলেন একটা তালিকা— তাতে নদিয়া-মুর্শিদাবাদের সাধক-বাউল আর ফকির-মিসকিনদের নাম, অন্তত পনেরোটা। বললেন, ‘এঁরা যে যে গাঁয়ে থাকেন তার নাম আর পথনির্দেশ দিয়ে দিয়েছি। খুব কষ্ট হবে কোথাও কোথাও যেতে, অনেক হাঁটতে হবে, তবু যাবেন। এসব সাধক তো নিজেদের ডেরা বা আখড়া থেকে কোথাও যান না— আপনাকেই যেতে হবে। অনেক তত্ত্ব পাবেন, যা দশ বছর পরে বলবার মতো কেউ বেঁচে থাকবে না। তাঁরা হয়তো গায়ক নন, কিন্তু শিষ্য গায়কদের দিয়ে এমন এমন শব্দগান শোনাবেন যা কোনও পুঁথিপুস্তকে নেই, শুধু রয়ে গেছে পরম্পরায়, শ্রুতিতে আর গাহক সমাজে।’

মাস্টারমশাইয়ের কথা আজ অক্ষরে অক্ষরে সত্য। যে-বর্গের সাধক গুরু আর ফকিরদের তখন সঙ্গ করেছি এখন তাঁরা বিরল প্রজাতি, না হয় অদৃশ্য। তবে এ কথাটাও ঠিক যে এমন মগ্ন সাধক তৈরি হয়ে ওঠার মতো আড়াল আজ তো আমরাও রাখিনি কোনও পল্লিতে। গ্রামপতনের ধুন্ধুমার কাণ্ডে সব ফৌৎ। সবই আজ বড় প্রকাশ্য। খয়েরবুনি আশ্রম সনাতনদাসের আখড়ায় যাচ্ছি, হঠাৎ পাশ দিয়ে সাঁ করে চলে গেল একটা টু-হুইলার। চালাচ্ছে জিন্স-পরা নব্যযুবা, ব্যাকসিটে এক বাউল। তার কাঁধে সঙিনের মতো উঁচিয়ে রয়েছে গেরুয়া ঘেরাটোপে একখানা দোতারা। তার মানে সন্ধ্যায় দূরান্তে কোথাও বায়না আছে… বাউল ছুটছে খেপমারা শহুরে গান-শিল্পীর মতো। রুজি রোজগার, বাঁচার তাগিদ, জনগণের চাহিদা।

বাউল সম্মেলনে বা সেমিনারে যেসব বাউল যোগ দেয়, তাদের রওনা হতে হয় বেশ সকালে। হেঁটে বাস রাস্তায় আসা, বাসের জন্য প্রতীক্ষা, তারপরে পৌঁছনো জেলা শহরের বাসস্ট্যান্ডে। একটা কোয়ার্টার পাউরুটি, এক প্লেট ঘুগনি আর চা খেয়ে দুপুরের খুন্নিবৃত্তি। এবারে আরেকটা বাস ধরে উদ্দিষ্ট গ্রাম, যেখানে সম্মেলনের মঞ্চ আর বাউলদের থাকার জায়গা। সাধারণত কোনও ইস্কুলবাড়ির শ্রেণিকক্ষ, কিংবা নির্মীয়মাণ কোনও বাড়ির অসমান মেঝে। সেখানেই ঝোলা থেকে কম্বল বার করে ভূমিশয্যা, কিংবা খড়ের ওপর শতরঞ্চি, একটা গেলাস আর করোয়া কিস্তি, একতারা ও ডুবকি, কিংবা আনন্দলহরী। গাঁজার খুচরো সরঞ্জাম। পেটে সর্বগ্রাসী খিদে। তাই প্রথমেই টেবিলের সামনে লাইন দিয়ে সম্মেলনে নিজের নামটি পঞ্জিভুক্ত করে টিফিন আর ভোজের কুপন সংগ্রহ করে দ্রুত খাবার জায়গায় পৌঁছনো এবং অবেলায় খানিকটা ভাত ভাল কুমড়োর ঘ্যাঁট খেয়ে নেওয়া। তারপরে উঃ কী দুর্নিবার ঘুম। পথশ্রম, ক্লান্তি আর উদরপূর্তির নিশ্চন্ততা। গান বাজনা? সে পরে দেখা যাবে।

আমি খুব মমতা নিয়ে এই ক্ষুৎকাতর মানুষগুলিকে দেখি। আমার দেশের অনেকটাই উপেক্ষিত এক সম্প্রদায়। কুচকুচে কালো গায়ের রং। ঝুঁটি বাঁধা চুল এখন এলিয়ে দিয়ে, হয় নিবিড় নিদ্রাচ্ছন্ন, না হয় ম্লান মুখে বসে বসে বিড়ি টানছে। বাগদি, ডোম, দুলে, কুর্মি, কাহার, নমঃশূদ্র জাতের সব নিম্নবর্গীয় মানুষ। আমাদের এনটারটেনার। সারা বছরে কেমন করে তারা বাঁচে, কোথায় থাকে, কী খায়, কী তাদের সংকট কিছুই জানি না। তথ্য অফিসে ঘুরতে হয় তাদের। বিডিও সাহেবকে তৈলদান করতে হয়। যদি একটা প্রোগ্রাম পাওয়া যায়। বাড়িতে হা-অন্ন পরিবেশ, রুগণ্‌ খিন্ন জীবনসঙ্গিনী গেছে মাধুকরী করতে— বাড়িতে কয়েকটা অপোগণ্ড সন্তান।

ভাবতে গেলে কান্না পায়। জমিজিরেত নেই যে ফসল ফলাবে। কেউ কেউ পরের জমিতে মুনিশ খাটে কিংবা গাঁয়ের কারুর মেটে কুঁড়ে ঘর তৈরির সময় জোগাড়ের কাজ করে দু’-দশ টাকা পায়। কেউ ঘরামি, কেউ কীর্তনের পার্টির সঙ্গে খোল বাজায়। তবে ডাক এলে সবচেয়ে আগে বাউল। গোটা কয় পাথুরে মালা আছে সেগুলো গলায় গলিয়ে নেয়, হাতে লোহার বালা, পায়ে টায়ারের চটি। সম্মেলনে যাবার আগের বিকেলে ক্ষৌরি করিয়ে নেয়। গেরুয়া আলখাল্লা আর সস্তার ধুতি লুঙি করে পরা, মাথায় বাবরি কিংবা ঝুঁটি।

সম্মেলনে তাদের নাম পঞ্জিভুক্ত করে এক যুবক। বাঁধানো খাতায় নাম ঠিকানা লেখা হয়। তারপরে বুকে এঁটে দেয় সম্মেলনের ব্যাজ, হাতে দেয় একটা প্লাস্টিকের সস্তা কভার ফাইল। তার মধ্যে একটা ছোট প্যাড, ডট পেন ও ছাপানো কর্মসূচি। ফাইলের গায়ে মুদ্রিত আয়োজক সংস্থার নাম, ঠিকানা, টেলিফোন নম্বর এবং তারিখ। মঞ্চে বসে দেখি দর্শকের আসনে জনপঞ্চাশ বাউল বসে আছেন, তাঁদের চোখে প্রত্যাশা, মনে কৌতূহল। ডেকরেটরের সংকীর্ণ চেয়ারে তাঁদের অস্বস্তি লাগে। এঁরা কেউ চেয়ারে বসার মানুষ তো নন। হাতে ধরা ফাইলটা ভারী বেমানান। নিরক্ষর হয়তো নন কেউ, কিন্তু প্যাড-পেনে সম্পর্ক তৈরি করা খুব কঠিন কাজ তাঁদের পক্ষে। বরং অনেক স্বচ্ছন্দ আনন্দলহরীতে টান মারতে বা দোতারাকে কথা বলাতে। গান গাইতে দিলে তো রক্ষা নেই— গগনবিদারী স্বরে সামনের মাঠ ভরতি হাজার কয় শ্রোতাকে একেবারে ভাসিয়ে দেবেন।

মঞ্চে বসে লোকায়ত জীবন বিষয়ে নির্বোধ ভি. আই. পি-দের ভাষণ শোনা কম শাস্তি নয়। আজকাল আবার নতুন হুজুগ উঠেছে গেরুয়া পোশাক পরে, একতারা দোতারা হাতে নিয়ে, কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে মিছিল করে গ্রাম পরিক্রমা। গ্রামের প্রবেশ মুখে এবং ইতস্তত তোরণ ও পোস্টার। এখানে জাঁক করে বাউলদের সম্মেলন আর সেমিনার হচ্ছে তার জানানদারি। সম্বৎসর যে-মাইকম্যান বড় গাঁয়ের ভিডিও হলের ফিল্ম শো-র ঘোষণা করে ক্যাঁক ক্যাঁক করা কর্কশ আওয়াজে, তারই হাত-মাইকে আজ সম্মেলনের খবর। রাতে হামলে পড়বে পল্লিবাসী তাতে সন্দেহ নেই। গ্রামে প্রত্যক্ষ বিনোদন আর কই? কীর্তন বা কবিগান ক্কচিৎ হয়। যাত্রাপালার দল খুব ভেতরের দিকের গাঁয়ে আসে না। তাই সারাদিন ট্রানজিস্টারে হিন্দি গান বাজে। শহরে সিনেমা দেখে এসে গাঁয়ের দুয়েকটা ছোকরা ‘কুচ কুচ হোতা হায়’ আওড়াচ্ছে। তার মধ্যে বাউল গান? তার আকর্ষণ সাংঘাতিক।

এখানে একটা সত্যি কথা বলা দরকার। যাঁরা বলেই চলেছেন, গ্রাম নষ্ট হয়ে যাচ্ছে অপ-সংস্কৃতির চাপে তাঁরা ঠিক বলছেন না। সব গ্রামই তো শহর-সংলগ্ন নয় এবং এখনও প্রচুর গ্রামে ইলেকট্রিকের পোস্ট যায়নি। তাই টিভি-র প্রভাব কথাটা অমূলক। কালেভদ্রে পুজোপার্বণে চাঁদা তুলে টিভি এনে ব্যাটারিতে ভিডিয়ো শো হয়। ক’জনই বা দেখে। কাজেই বেশির ভাগ গাঁয়েই এখনও শতকরা নব্বই ভাগ মেয়ে মদ্দ বাউল গানের আসরে আসে। বছরের পর বছর শ্রোতা বেড়েই চলেছে। নদিয়ার আসাননগরের কাছে কদমখালিতে ‘লালন মেলা’-য় গত দশ বছরে শ্রোতাদের সংখ্যা এত বেড়েছে যে তিন-তিনটে মঞ্চ করেও সামলানো যাচ্ছে না। তিনরাত গানের বিরাম নেই। লোকায়তের টান হল অমোঘ। যে-কোনও বাউলকে জিজ্ঞেস করলেই জানা যাবে এখন তাদের কত শ্রোতা। ঠিকই যে মাঝে মাঝে শ্রোতারা অসভ্যতাও করে। তবু উৎসাহ প্রবল।

এখন যেটা মূল সমস্যা সেটা হল আমাদের মতো ভদ্রলোকদের হালচাল এবং বাউল ফকিরদের সম্পর্কে প্রকৃত দৃষ্টিকোণ গড়ে তোলার অভাব। সত্যিই তাদের প্রতি আমাদের মমতা আর সহানুভূতি আছে। আমরা জানতে চাই তাদের জীবনধারা, বুঝতে চাই সমস্যা। হয়তো যেতে পারি না তাদের দরিদ্র যাপনের পল্লিপরিবেশে, কিন্তু তাদের আনতে চাই আমাদের বৃত্তে, শুনতে চাই তাদের সংলাপ। তাদের গান এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসেও সমাদর করে শোনে ছাত্রছাত্রীরা— তার পেছনে কিছু অধ্যাপকের আনুকূল্যও থাকে। সরকারি প্রয়াসে নানা জেলার অজানা কিন্তু প্রতিশ্রুতিসম্পন্ন বাউল ও ফকিরদের গান ক্যাসেটবদ্ধ করে নিতান্ত স্বল্পমূল্যে বিক্রি হচ্ছে, যার মূল্য লক্ষ্য প্রচার। গান ও গায়কের প্রচার।

এসব তো খুবই ভাল প্রয়াস, কিন্তু আমরাই মাঝে মাঝে বোকামি করে বসি। যেমন বছর কয়েক আগে বাউলদের নিয়ে একটা সেমিনারে যোগ দিতে গিয়েছিলাম বাংলা আকাদেমি চত্বরে। তার বাইরে স্টেজ বেঁধে গান হবে, দুপুরে আকাদেমির ঠান্ডা ঘরে সেমিনার— আমার অংশ সেখানেই। সময় বৈশাখ, রুদ্র বৈশাখ। অতবড় রবীন্দ্রসদন চত্বর রোদে পুড়ে যাচ্ছে। দুপুর দুটো থেকে চারটে পর্যন্ত আলোচনা— ‘লোকজীবনের সমস্যা: আমাদের কর্তব্য।’ এ বিষয়ে বলব আমরা সুধীজন। সাড়ে বারোটা নাগাদ রোদ্রের ভ্রূকুটি সামলে পৌঁছলাম। কর্তৃপক্ষ দিলেন কোল্ড ড্রিংকস। লোকশিল্পীরা এসে গেছেন। সেদিন রবিবার, তাই আকাদেমির ছুটি। তার বাইরের ছায়াচ্ছন্ন অংশে ডেকরেটরের ব্যবস্থাপনায় বেঞ্চি আর হাইবেঞ্চি পেতে খাওয়ার ব্যবস্থা। টানা বেঞ্চিপাতা। জনা তিরিশ শিল্পীকে খেতে দেওয়া হয়েছে একসঙ্গে। ভাত-ডাল-ভাজা-মাছ-চাটনি। খুব তারিয়ে তারিয়ে খাচ্ছেন তাঁরা। অবশ্য গরমের একটা হলকা রয়েছে কিন্তু তাতে এই গ্রামীণ মানুষদের কী এসে যায়? আমাদেরও খাওয়ার নিমন্ত্রণ ছিল। বেলা একটা বাজে, চনমনে খিদে। বলে বসলাম, ‘আমরাও তো লাইনে বসে যেতে পারি পরের ব্যাচে।’ আমার আগ্রহ ছিল দু’কারণে। এক নম্বর নিশ্চয়ই খিদে, সেটা গৌণ। আসলে ভাবছিলাম এঁদের সবকিছুর ভাগীদার হওয়াই তো উচিত। আলোচনাচক্রের উঁচু মঞ্চে বসে, ব্যবধান টেনে, শুধু বক্তৃতা আর জ্ঞানদান কি শোভন? এঁদের সঙ্গে একসঙ্গে খেলে ওঁরাও তো উৎসাহ পাবেন, ভরসা পাবেন। জীবনের সর্বস্তরেই বিভাজন দেখে ওঁদের নিশ্চয়ই বেশ বিভ্রান্ত লাগে। আমাদের আপ্যায়নেও ফাঁক ধরা পড়ে যায়।

আমার প্রস্তাবে অবশ্য জল ঢেলে দিলেন একজন কর্তাব্যক্তি। হাঁ হাঁ করে উঠে বললেন, ‘উঁহু, তা কী করে হবে? আপনারা হলেন স্পিকার। আপনাদের আলাদা ব্যবস্থা। এই এঁদের নিয়ে গিয়ে লাঞ্চ দিয়ে দাও।’ অচিরে আমাদের একটা ঘরে এনে চেয়ার টেবিলের সামনে বসিয়ে, ক্যাটারারের লোগোচিহ্নিত সাদা বাক্স করে লাঞ্চ প্যাকেট দেওয়া হল। ক্ষুন্ন মনে সেটা উন্মোচন করে পাওয়া গেল একদলা শুকনো ফ্রায়েড রাইস, একটুকরো মুরগির ঝোলবর্জিত নির্মমতা, সকালে-কাটা গাজর-বিট-শসার স্যালাড, প্লাস্টিক মোড়া এক পিস করুণ থ্যাঁতলানো সন্দেশ এবং এসব খাদ্য মুখে তোলার জন্যে এক চিলতে প্লাস্টিক চামচ। কত কষ্টে সেসব গলাধঃকরণ করতে লাগলাম ঘন ঘন জল সংযোগে। সেই মুহূর্তে অন্তত লোকশিল্পীদের খুব ভাগ্যবান মনে হল। ভদ্রলোক ও ইনটেলেকচুয়াল হবার কী বিড়ম্বনা! আলোচনাচক্রে অংশ নেবেন এমন একজন বক্তা আমাকে নিচু স্বরে বললেন, ‘মুরগির পিসটা শুধু দন্তস্ফুট করার অযোগ্য নয়, রীতিমতো দুর্বিনীত। ওর বোধহয় আত্মদানে ততটা উৎসাহ ছিল না। বয়সেও আমাদের কিঞ্চিৎ অগ্রজ, কী বলেন?’

আমি মৃদুহেসে সমর্থন করে বললাম, ‘আহা, আমরাও তো বাইরের ওই ভোজটা খেতে পারতাম। ইস, ওরা কী ভাগ্যবান, পেটপুরে খেলো।’

বক্তা বললেন, ‘উঁহু, ওটা হল লোকখাদ্য। আমাদের কি ওসব খাওয়া শোভা পায়? আমরা হলাম গিয়ে রিসোর্স পার্সন। আমাদের জন্যে তাই স্পেশাল লাঞ্চ প্যাকেট… স্পেশাল অ্যারেঞ্জমেন্ট।’

এর পরের অংশটুকু অবশ্য আরও করুণ। দুটো নয়, আড়াইটে নাগাদ শুরু হল ঠান্ডা ঘরে মহতী আলোচনা চক্র— ‘লোকজীবনের সমস্যা: আমাদের কর্তব্য।’ ভবিযুক্ত হয়ে আমরা মঞ্চে বসলাম। সঞ্চালক শুরু করলেন তাঁর ভাষণ। সেই বৈশাখের খাঁ খাঁ দুপুরে কোন কলকাতাবাসী আর আসবেন শ্রোতা হয়ে? কাজেই চেয়ার ভরা পঞ্চাশজন লোকশিল্পী, দশজন উদ্যোক্তা, পাঁচজন বেকার আর চারজন বক্তা শুরু করলেন আমাদের কর্তব্য বিষয়ে কূট-কচালি বিচার বিবেচনা। প্রথম বক্তা এতটাই তাত্ত্বিক আর পুথিপড়া পণ্ডিত যে লোকজীবনের সংজ্ঞা নিয়ে বিশদে বোঝাতে লাগলেন। লোকশিল্পীরা তাঁদের কর্তব্য সম্পর্কে একটুও দ্বিধা না রেখে নিপাট নিদ্রাতুর হয়ে পড়লেন। একদিকে লোকখাদ্য আরেকদিকে ঠান্ডা ঘর— এই দ্বান্দ্বিক বিন্যাসে আমার সেটাই সবচেয়ে ছন্দোময় মনে হল।

এবারে চিন্তাশীল ব্যক্তিদের মনে হবেই যে, বুদ্ধিজীবী নগরবাসীদের এহেন অবিবেচনার কারণ কী? আমাদের বুদ্ধিশুদ্ধি বা কাণ্ডজ্ঞানের কোনও গুরুতর অভাব বাস্তবজীবনে খুব একটা দেখাই না, অথচ প্রশ্নটা যখন লোক-লোকায়তের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে তখন কেন আমরা বেহিসেবি কাজ করে বসি? পল্লিজীবনের সঙ্গে আমরা যে নিতান্ত অপরিচিত তাও নয়। এই অবিবেচনার সংকট যে কেবল কলকাতার মতো মেট্রোপলিটন শহরেই দেখা যায় তা নয়। নগরতলিতেও এমন ঘটে, ঘটতে পারে। একটা নমুনা দেব।

সেবার বাঁকুড়া শহরের গায়ে কাটজুড়িডাঙায় একটা বাউল মেলা ও আলোচনাচক্র হল দু’দিন ধরে। আমার সেখানে নিমন্ত্রণ ছিল। অনুষ্ঠানের উদ্যোক্তা সেখানকার রাঢ় একাডেমি এবং তার প্রধান উদ্যোক্তা অচিন্ত্য জানা উদ্যমী মানুষ। রাঢ় একাডেমির জন্য স্থানীয় ডাক্তার বি. সি. মাজির কাছ থেকে তিনি খানিকটা জমি সংগ্রহ করেছেন। মূল মঞ্চ সেখানেই করা হয়েছে। সুপ্রসারিত মাঠে আরও দুটি মঞ্চ করা হয়েছে বাউল গানের শত শত শ্রোতাদের বিনোদনের জন্য। ১৯৯৫ সালে রেজিস্ট্রিকৃত এই একাডেমি বহু কর্মকাণ্ডের পরিকল্পনা নিয়েছেন। ভেতরে একটু আধটু দলাদলি ছিল এবং আছে— সেটা কোন সংগঠনেই বা নেই? একাডেমি এবারই প্রথম বাউল সম্মেলন করলেন। তাঁদের লিখিত বক্তব্য:

আগের তুলনায় বাউলের মর্যাদা কিছুটা ভাল। মানুষ এখন বাউলদের অন্য দৃষ্টিতে দেখে। আগে বাউলদের জীবনজীবিকা ছিল ভিক্ষাবৃত্তির উপর নির্ভরশীল। বর্তমানে সেখান থেকে আর্থসামাজিক ব্যবস্থার ফলে সরে এলেও বাউলদের দৈন্য সমাজের লজ্জা। আগে বেশির ভাগ বাউলদের জীবন কাটত আশ্রমবাসী হিসেবে, এখন অনেকে কেন বেশির ভাগ বাউলই গৃহবাসী। দারিদ্র্য তাদের নিত্যসঙ্গী। খেতে-খামারে কঠোর পরিশ্রম করে বাউল সংগীতকে এঁরা বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। মঞ্চে হাজার হাজার মানুষের হৃদয় জয় করে যে পরমপুরুষ সে-ই আবার যখন মাঠে মাটি কাটে তখন কেউ দেখে হয়তো নাক সিঁটকোয়। কাজেই বাউলদের অভাব, অনটন, দারিদ্র্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্য প্রভৃতির সমস্যা খুবই বেদনাদায়ক। এহেন অবস্থায় সরকারি এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের গুরুদায়িত্ব নিতে হবে। বাউলদের সম্মুখে সবচেয়ে বড় বিপদ হল উচ্চ শক্তি পরিচালিত মিডিয়া এবং বাউল সংগীতের উপর শহরের সংগীতের প্রভাব। এক্ষেত্রে সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এবং জনগণকে দায়িত্ব নিতে হবে। সুখের বিষয় সরকার এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এই দৃষ্টিভঙ্গিতে কাজ করে চলেছেন।

কাটজুড়িডাঙায় বাউল সম্মেলনের কর্তৃপক্ষ সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এগিয়ে চলবেন আশা করা যায় তবে তা যেন বাৎসরিক বাউল গানের আসরে পরিণত না হয়। একথা বলার কারণ হল, এখন পশ্চিমবঙ্গে সব জায়গায় যেসব মেলা হচ্ছে বাউলদের নিয়ে, তার প্রধান কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে বিনোদন।

কিন্তু হচ্ছিল সেমিনারের প্রসঙ্গ। বলা যেতে পারে, শুধু বিনোদন কই? সেমিনার কিংবা নামান্তরে আলোচনা চক্র কি অন্য দৃষ্টিকোণ থেকে করা হচ্ছে না? হচ্ছে, তবে কীভাবে হচ্ছে তার প্রমাণ ওই সম্মেলনেই বোঝা গেল। সেদিন মেলার উদ্‌বোধন অনুষ্ঠানের কথা একটু বলা উচিত। উদ্যোক্তাদের ভাষণ, মন্ত্রী মহাশয়ের উৎসাহোদ্দীপক বক্তব্য, বিশিষ্ট অতিথিদের কথার মাঝখানে বলতে বলা হল ডাক্তারবাবুকে, যিনি রাঢ় একাডেমির জমি দান করেছেন। তাঁকে কৃতজ্ঞতা জানালে তিনি বললেন, ‘এখানে জমিটা পড়েছিল, এঁরা চাইলেন দিয়ে দিলাম। অন্য কাউকেও দিতে পারতাম। বাউলরা এখানে এসেছেন। এই জায়গাটা কাজে লেগেছে দেখে ভাল লাগছে। বাউল গান শুনতে ভালবাসি— তবে সব বুঝতে পারি না, কঠিন তত্ত্ব কথা। এঁদের জন্যে কিছু করা উচিত ঠিকই, একাডেমি ভাবছেন কী করা যায়। বাউলদের সমস্যার সমাধান করা দরকার। তাঁদের উৎসাহ দেওয়া দরকার। আমি চিকিৎসক, আমি আর কী করতে পারি? আমার চেম্বারে এলে আমি ওঁদের বিনা পয়সায় চিকিৎসা করে দিতে পারি। তবে এখানে বলতে আপত্তি নেই যে, এতদিন ডাক্তারি করছি, কিন্তু কোনও বাউল কোনওদিন আমার কাছে চিকিৎসার জন্যে আসেননি। ওঁদের বোধহয় রোগজ্বালা নেই। সাধক তো।’

শ্রোতারা হাততালি দিয়ে উল্লাস জানালেন, বাউলরা হাসলেন অপ্রতিভ হাসি— দেখতে পেলাম মঞ্চ থেকে। ভাবলাম, এ ধরনের অসহায় দরিদ্র মানুষদের নিয়ে এমন কথা কি আমরা বরাবর বলে যাব? বাঁকুড়া শহরের প্রসার প্রতিপত্তি সম্পন্ন ধনী চিকিৎসকের কাছে গ্রামের বাউল কি আসতে সাহস পাবে কোনওদিন? আসার কোনও স্বাভাবিক উপায় আছে কী? এলে কি সে বাউলের পোশাক পরে আসবে? নইলে বোঝা যাবে কী করে যে সে বাউল? ব্যস্ত চিকিৎসকের চেম্বারে প্রথমে নাম লেখাতে হয় এক সহকারীর কাছে। দীনবেশী গ্রাম্য অসুস্থ মানুষরা তাদের কাছে কি কখনও সদয় ব্যবহার পেয়ে থাকে? ডাক্তারবাবুর কাছ পর্যন্ত সে তো পৌঁছতেই পারবে না।

আসলে আমাদের বোঝার জায়গাটা একটু গোলমাল হয়ে যাচ্ছে। বাউল যখন একতারা হাতে শ্রোতাদের বিমুগ্ধ করে গান করে তখন সে একজন অন্য মানুষ— আর যখন সে গ্রামিক সমাজের অন্তর্গত থেকে বাস করে তখন সাধারণ গরিব মানুষ। আধিব্যাধিতে কি তারা আক্রান্ত হয় না? হলে কোথায় যায়? প্রথমে সহ্য করে, তারপরে টোটকা কিছু খায়। না হলে সস্তার হোমিওপ্যাথি। নিতান্ত তাতেও নিরাময় না হলে শহরে গিয়ে ফার্মেসির সেলসম্যানকে বলে আন্দাজি ওষুধ নেওয়া। ডাক্তারের ফি কোথায় পাবে? বাউলরা যে গায়— ‘এই মানুষে আছে সেই মানুষ’ — একদিক থেকে একেবারে নির্জলা সত্য। ওই সাধারণ গরিব-গুরবো, সুযোগসুবিধাহীন, অসহায় মানুষটার মধ্যে আছে আরেকটা মানুষ, সেই মানুষটা বাউল গায়। যখন গায় তখন অন্য মানুষ। সমাজে প্রতিষ্ঠা পায়নি, নামযশ নেই, টাকাপয়সা নেই, কিন্তু মঞ্চে যখন তাকে গান গাইতে ডাকা হয় তখন তার পুনর্জন্ম হয়। সে দেখিয়ে দিতে চায় তার আসল সত্তাকে। সেটা তার অর্জিত। ওই নরম অভিমানের জায়গাটায় ঘা দেওয়া উচিত নয়।

সচরাচর শহরে আর মফস্‌সলে যেসব ব্যক্তি বা সংস্থা বাউলমেলা, আলোচনাচক্র বা সেমিনার সংগঠন করেন তাঁদের কেবল দরদ আর সহানুভূতি থাকলেই যথেষ্ট নয়। হতে হবে অনেক বাস্তববাদী এবং মানবিকতা সম্পন্ন। বাউল ফকিরদের জীবন ও কর্মশালা সম্পর্কে সরাসরি অভিজ্ঞতা থাকা জরুরি। তা হলেই একমাত্র বোঝা যাবে, কোন পরিবেশ থেকে তারা কোথায় এসেছে, সম্মেলনে কী তাদের প্রত্যাশা ও চাহিদা, কেন তাদের অতৃপ্তি। একটা কথা তো খুব স্পষ্ট। বহুদিনের প্রত্যাশা নিয়ে কাক-ভোরে রওনা হয়ে, সারা দিনের স্বেদ ঝরিয়ে, ক্লান্ত তবু ক্লান্তিহীন যে-গায়ক মানুষটি মঞ্চে উঠেছে তাকে কি একটামাত্র গান গাইতে দেওয়া সংগত? উদ্যোক্তাদের সময় কম, মাত্র তিন-চার ঘণ্টায় কুড়িজনকে গান গাওয়াতে হবে, তার দায় কি ওই গ্রামীণ শিল্পীর নিতে হবে? গানই তো তার জীবন, তার মোক্ষণ, তার প্রতিবাদ। বিদ্যমান সমাজের মধ্যে বাস করে, শত দুঃখ কষ্টেও, তার গান তাকে বাঁচিয়ে রাখে। সন্ধে থেকে বাউল সাজে সেজে তার সে কী অধীর অপেক্ষা! যে মুখচোরা তার আর ডাক পড়ে না মঞ্চে। অবশেষে যখন ডাক পড়ল তখন রাত দশটা। খিদে তেষ্টায় জর্জরিত, ঘর্মাক্ত, সন্ধেবেলা থেকে অপেক্ষাতুর, কেমন গাইবে সে? অথচ এবারে ভাল না-গাইতে পারলে পরের বার উদ্যোক্তারা ডাকবেন না। সেইজন্য এ জাতীয় সম্মেলনে বাউল-ফকিররা যখন গায়, প্রাণপণে গায়, তখন তাদের দিকে আমি তাকাতে পারি না। তার মনের আন্তরিক ইচ্ছা তো আমি জানি— প্রথমে গাইতে চাইবে গুরুবন্দনা, তার পরে মনঃশিক্ষা, তার পরে দৈন্য, সবশেষে কোনও একটি তত্ত্বগান বা মুর্শিদা গান। কিন্তু তার সময় সুযোগ কই? ঘোষক বলে দিয়েছেন ‘এখন গান করবেন সদানন্দ বাউল। তাঁর গান শেষ হলে রসিকদাস বাউল গাইবেন। তাঁকে তৈরি থাকতে বলা হচ্ছে।’ সদানন্দ মঞ্চে উঠে প্রথমে দেখে মাঠ ভরতি দর্শক শ্রোতা। করুণভাবে চোখ বোলায় সামনের সারির ভি.আই.পি কিংবা সভাধিপতির দিকে— গবেষক আর অধ্যাপকদের দিকে— সাংবাদিকদের দিকে। ভাবে, কাকে গান শোনাতে এসেছে সে? কোন সেই একখানা আশ্চর্য গান তার পরশমণি, যা সবাইকে স্পর্শ করবে?

কাটজুড়িডাঙার সম্মেলনের লিখিত প্রতিবেদনে যা বলা হচ্ছে তার সঙ্গে আমাদের অন্য সমাবেশের অভিজ্ঞতা একইরকম। বলা হচ্ছে:

বাউল শিল্পীর সংখ্যা বেশি হওয়ায় দুটি মঞ্চ করা সত্ত্বেও এক-একজন বাউল শিল্পী একটি বা দুটির বেশি সংগীত পরিবেশন করার সুযোগ পাননি। ফলে তাঁদের একটু ক্ষোভ থেকে যায়। তবে তাঁরা প্রত্যেকেই গান পরিবেশন করে দেখিয়ে দিয়েছেন বাউল গান কাকে বলে।

উদ্যোক্তাদের আত্মতুষ্টি আর শিল্পীদের ক্ষোভ একেবারে সমান্তরাল রেখায় অবস্থিত। কাঠজুড়িডাঙার বাউল মেলাই যে আদর্শ তা বলছি না। তাঁদের উদ্যমকে খাটো করবার কোনও উদ্দেশ্য নেই আমার। কদমখালির লালনমেলায় একই অবিবেচনা কাজ করছে। সেখানে আবার ‘বাংলাদেশ থেকে আগত’ বাউলদের খাতির একটু বেশি—টিভি ও অন্য চ্যানেলের আগন্তুক ক্যামেরাম্যান রিপোর্টারদের তৎপরতা চোখে পড়বার মতো। হঠাৎ উড়ে-এসে-জুড়ে বসা কোনও অধ্যাপক বা মন্ত্রী মহোদয়ের লালনবিষয়ক ভাষণ— যাতে সেই ‘ক্লিশে’ অর্থাৎ জাতপাতহীন মানবতা, হিন্দু মুসলমান সংহতি আর ‘এমন সমাজ কবে সৃজন হবে’ বলে দীর্ঘশ্বাস থাকবেই। তার পরে শুরু হবে বাউল গানের ধারাবাহিক, অপরিকল্পিত, অবাধ, অসংগত বিন্যাসে কিম্ভূত এক জগাখিচুড়ি। দেখা যাবে শুদ্ধ গানের পাশে নাবালক রচনা, কখনও হালকা মস্করার গান, কারুর শুধুই লালনসম্বল পরিবেশন, কেউ গেয়ে দিল হাফ-কীর্তন। কে কোন গান গাইবে, গানের পর্যায়ক্রমিক কিছু নিবেদন করা সম্ভব কি না, এসব উদ্যোক্তাদের মধ্যে কে ভাববে? সন্ধ্যার মধ্যে বৃহৎ জনতার হই-চই, ফেরিঅলার চিৎকার, তেলেভাজা ও জিলিপির দোকানে গ্রামীণ ভিড়, মানুষের বাঁধভাঙা ঢল। তারা একটা অনির্দিষ্ট জিনিস শুনতে এসেছে। বাউলের অবয়ব, পোশাক ও গানভঙ্গিকে তারা অন্বেষণ করছে। গানের একটা ধাঁচ তাদের জানা আছে, সেটা চাইছে। শান্তভাবে নিবেদিত আত্মস্থ বাউলের পরিবেশন তাদের ভাল লাগার কথা নয়— তাই যত রাত বাড়ে ততই গায়নের লাগাম খসে পড়ে। মত্ত তাল আর উদ্দাম নাচের ছন্দে গান পরিবেশন করে নবীন বাউলেরা। আসর জমিয়ে দেয়। প্রবীণ, বিবেচক, ভাবুক গায়করা কিছুটা হতভম্ব ও দিশাহারা হয়ে পড়েন। বাউল গান হয়তো তাঁদের বিশ্বাসে বিনোদনের বিষয়ীভূত নয়— তাঁদের গায়নও অনেক অন্তর্মগ্ন, নবীন কণ্ঠের তেজ বা জাদু তাঁদের না-থাকারই কথা। তাঁরা চাইছিলেন গানের মধ্যে দিয়ে কিছু বলতে—কোনও গভীর বাণী। কে শুনবে?

ইদানীং এ-জাতীয় গণমঞ্চে বা লোকমঞ্চে আরেক উৎপাত শুরু হয়েছে। সাধারণভাবে প্রধান গায়কের সঙ্গে তিন-চারজন সংগতীয়া ওঠে। মঞ্চে, দাঁড়িয়ে বা বসে সংগত করেন। কোনও কোনও দলে দেখা যায় এক বালক বা নবীনকিশোর সঙ্গে এসে মঞ্চে বসে। বাউল পিতা বা গুরু স্নেহবশে তাকে কাছে এনে সস্নেহে বলেন, ‘এই ছোট্ট ছেলেটা এইটুকু বয়সেই চমৎকার বাউল গাইছে— আপনারা শুনুন। দেখুন কণ্ঠে কী ভাব! এখনও হয়তো তত্ত্ব বোঝে না কিন্তু ভাল গায়। আপনারা শ্রোতারা ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে ওঁর গান শুনুন, উৎসাহ দিন।’

তার মানে এক প্রস্ফুটমান পেশাদার শিল্পীর জন্ম হচ্ছে আমাদের সামনে। দেখতে হবে পনেরো মিনিট ধরে বাউলের ক্যারিকেচার। আট-দশ বছরের মানবক, ছোট মাপের আলখাল্লা ও পাগড়ি, কোমরে বেল্ট বাঁধা গেরুয়াবাস, গলায় কাচের মালা, রঙিন কোমরবন্ধ, কপালে আর নাকে স্পষ্ট রসকলি—যেন বাউলের শিশু সংস্করণ। চিকন কণ্ঠে গাবগুবি বাজিয়ে সেও গেয়ে ওঠে অচিন পাখির খাঁচার রহস্য গান। যাকে বলে ছোট মুখে বড় কথা। গণতোষণে কোনও বাধা পড়ে না। একটা গান শেষ হলে জনগণেরা হাততালি দেন বিপুল আবেগে। কোনও অত্যুৎসাহী শ্রোতা মঞ্চে উঠে তার বুকে সেফটি পিন দিয়ে এঁটে দেন তরতাজা দশ টাকার নোট, নিজের কৃতিত্বে নিজেই হাসেন দন্ত বিকশিত করে। নবীনকিশোর দ্বিগুণ উৎসাহে এবারে দ্বিতীয় গানের সঙ্গে তোলপাড় নাচ শুরু করে।

এ ধরনের বাউলবিলাসে সবসময়ে উদ্যোক্তাদের হাতে রাশ থাকে তা নয়। গানের পর গান হতে হতে আসরের মাঝে একফাঁকে চকিতে ঘটে যায় এমনতর শিশু সংস্করণের বাউল-উজ্জীবন-প্রকল্প। অবিবেচনার এও এক রকমফের। আরেক সম্মেলনে দেখেছিলাম বাউলদের বিপন্নতার অন্যতর দৃশ্য। দুপুর-বিকেল ধরে হল সম্মেলনের উদ্‌বোধন আর ভারী মানুষদের ভাষণ। সন্ধে থেকে হবে বাউল গান। মাঝখানে দু’ঘণ্টার অবকাশে কী করা যায়? উদ্যোক্তারা আয়োজন করে দিলেন আলোচনাচক্র বা গ্রুপ ডিসকাশন। তার আলোচ্য বিষয়গুলি হল:

১ ভোগবাদ ব্যতিরেকে বাউল হল অধ্যাত্মবাদের অগ্রদূত।

২. সম্প্রীতি রক্ষায় ও গণশিক্ষা প্রসারে বাউল সংগীত।

৩, অপ-সংস্কৃতির বিরুদ্ধে এবং সুস্থ সংস্কৃতি রক্ষায় বাউল সংগীত।

৪. বর্তমান আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থায় বাউল সংগীত বা বাউল শিল্পীদের অবস্থান।

৫. বাউল সংগীত ও বাউল শিল্পীদের মর্যাদায় সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা।

হঠাৎ এমন সুচিন্তিত তালিকা দেখলে মনে হবে ব্যাপারখানা কি? এ আলোচনা কাদের জন্য? কারাই বা এর অংশগ্রহণকারী? শ্রোতাই বা কে?

না, এ-কোনও চটজলদি এলোমেলো বিষয়-পরিকল্পনা নয়। অনুষ্ঠান সূচিতে আগে থেকে মুদ্রিত ছিল এই আলোচনাচক্র ও তার আলোচকের নাম। কৌতুহল ছিল। দেখতে পেলাম মঞ্চে পাতা হল একটি করে টেবিল, আর তাকে ঘিরে আট-দশটি ফোল্ডিং চেয়ার। মঞ্চ ভরে উঠল পাঁচটি টেবিল আর গোটা পঞ্চাশেক চেয়ারে। এবারে এক-এক চেয়ারে বসলেন এক-একজন বুদ্ধিজীবী আর তাঁকে মাঝখানে রেখে আটজন করে বাউল। একেক ভদ্রলোক একখানা ফাইল খুলে তাঁর সামনের বৃত্তাকারে বসা বাউলদের নিয়ে শুরু করলেন গ্রুপ ডিসকাশন। জনা বিশেক শ্রোতা বা দর্শক নীচে চেয়ারে বসে দৃশ্যটি দেখছেন কিন্তু কিছু শুনতে পাচ্ছেন না। যেন থিয়েটারের মঞ্চে জোনাল অ্যাকটিং, শোনা যাচ্ছে অস্পষ্ট গুজগুজ গুঞ্জন। খানিকক্ষণ দেখেশুনে শ্রোতারা কেটে পড়লেন। আমার কোথাও যাবার ছিল না তাই গুটি গুটি হাজির হলাম মঞ্চে। সে যে কী অবর্ণনীয় বেদনাময় দৃশ্য!

বুদ্ধিজীবী যুবাটি মহা উৎসাহে বাউলদের নানা কূটকচালি প্রশ্ন করছেন আর বাউলরা এ ওর দিকে তাকিয়ে শেষ পর্যন্ত মুখে আঁকছে হতাশার মুদ্রা। গানে যারা মুখর, প্রশ্নোত্তরে তারা একেবারে মূক। আমি একজন বুদ্ধিজীবীকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘আপনার প্রশ্নের উত্তর পাচ্ছেন?’

—তিনি গভীর খেদে বললেন, ‘না। এঁরা তো একটা কথাও বলছেন না।’

—তা হলে উপায়?

—একটা কিছু তো করতেই হবে, দেখি। যাঁরা স্পনসরার তাঁরা গ্রুপ ডিসকাশনের জন্য টাকা ইয়ার মার্ক করে দিয়েছেন যে রিপোর্ট একটা দিতেই হবে।

বুদ্ধিজীবীদের প্রণীত সেই কপোলকল্পিত রিপোর্ট লিখিত আকারে জমা পড়েছে। কিন্তু তাতে ওই বাউলদের কী লাভ হয়েছে? এ সব সম্মেলনকে কে বা কারা প্রকৃত দিশা দেবে?

আগে একেবারে একা একা কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরতাম। খুঁজতে খুঁজতে সন্ধান মিলত একটা কি দুটো গ্রাম্য বাউল বা ফকিরের। গাঁয়ের একটেরে তারা পড়ে থাকত। আশপাশের গাঁ-গঞ্জে মাধুকরী করে, সঙ্গিনীসহ গান গেয়ে সামান্য কিছু পয়সা, চাল ডাল তরকারি পেত। ডেরা বা আখড়ায় এসে তাই ফুটিয়ে দুটো গ্রাসাচ্ছাদন চলত আর ছিল নিভৃত সাধনভজন। উঠোনে থাকত দুয়েকটা শ্বেতটগর বা সন্ধ্যামণি ফুলের গাছ, জুঁই বা মাধবীলতার ঝাড়। হয়তো একটা বেল গাছ বা নারকেল গাছ। চালাঘরের মেটে দেয়ালে মেলা থেকে কেনা শ্রীগৌরাঙ্গের ছবি, আপন গুরুর পায়ের ছাপ আর নানা জায়গা থেকে আনা এটা ওটা ছবি। ভেতরের ঘরের হুকে টাঙানো একতারা, গুপিযন্ত্র—বড়জোর একটা শ্রীখোল। মচ্ছবের দিনে খোলটা লাগে। রোজকার গান ওই একতারা-গুপিযন্ত্রেই হয়ে যায়। ভাত খাওয়ার জন্য আছে দু’খানা অ্যালুমিনিয়ামের থালা, দুটো গ্লাস, করোয়া-কিস্তি। মাঠে ঘাটে স্নান-শৌচ। পরনে নিতান্ত সস্তা সাদা ধুতি লুঙ্গি করে পরা আর মার্কিন কাপড়ের ফতুয়া, সঙ্গিনীর সাদা জামা ও থান শাড়ি। সঙ্গিনীর গলায় কণ্ঠি, হাত রিক্ত— ব্যস, একেবারে নিরাভরণ। বাউলের কণ্ঠে গুনগুন গান, ঊর্ধ্বমুখী চোখ, সদাপ্রসন্ন আনন, বিনীত বচন নম্ব্রস্বরে। আমি কখনও উদ্ধত স্বভাবের লোকায়ত সাধক দেখিনি। তাদের কাছে গেলে প্রথমে চা-মুড়ি সেবার কথা বলবেই, পরে দুপুরে দুটি অন্নসেবার কথাও বলবে। কুণ্ঠা জানাবে তার দীন আয়োজনের জন্য। বলবে, বাবু আমরা গরিব বাউল। একেবারে ফকির। সংসারের ফিকির জানিনে। তবু আপনি কষ্ট করে এসেছেন এই আমার সৌভাগ্য— গুরু কৃপা। আমি অধম, অজ্ঞান —কী বা পাবেন?

এই যে আচরিত বিনয়বচন এ তাদের সাধনার অঙ্গ—গুরু কৃষ্ণ-বৈষ্ণব-গুরুভাই বা অতিথি তাদের বহুমান্য। শিষ্য তাদের সন্তানতুল্য। নিজের কথা উজিয়ে বলা পাপ, গুরুর নিষেধ। তারা উলটে বলে, আপনারা জ্ঞানীগুণী মান্যজন, আমাদের তো জ্ঞানের পথ নয়— আমরা ভাবের রসিক। যা দুয়েকটা কথা জানি বা বলতে পারি সেও মহাজনদের পদ বা মহতের বাণী, গুরুর শেখানো।

কিন্তু গুরু যেটা শেখাননি সেটাও এদের স্ব-অধিকার। ব্যাপারটা হল ঘরে হা-অন্ন কিন্তু তা বাইরে জানান না-দেওয়া। এসে যাবে কিছু দিয়ে যাবে কেউ, এমন বিশ্বাস নিয়ে যাকে বলে আকাশবৃত্তি। উপস্থিত অতিথিকে দেওয়া যাক একটু আখের গুড়ের পানা— গরমে হেঁটে এসেছেন এতটা পথ, শরীরটা ঠান্ডা হোক। সঙ্গিনীকে নির্দেশ, ‘অতিথি দেবতা—ওঁকে একটু বাতাস করো, তারপর দ্যাখো ঘরের কোণে হাঁড়ি পাতিলে দু’মুঠো চাল ঠিকই আছে, একটু ডাল। ফুটিয়ে দাও দুটি। আর ওই তো দেখছি পেঁপে গাছে পুরুষ্টু দুটো পেঁপে। পেড়ে নিয়ে তরকারি করো।’

এমন সহজ সমাধান, এত সরল জীবনদর্শন, আমি কোথায় পাব? শহুরে মানুষ, কেতাকানুনে দুরস্ত। অতিথি আপ্যায়নে নিজের দৈন্য ঢেকে রাখি। বাউলের সঙ্গিনী তার সঙ্গীকে বলে, ‘চালেডালে ঘেঁটে খাওয়াব কী পেঁপের তরকারি রাঁধব সে তো আমার ব্যাপার। কেন, ঘরে কি কাঁঠালবিচি নেই? কুমড়ো বড়ি? ওই তো পুকুর ঘাটে যজ্ঞিডুমুরের গাছ দেখতে পাচ্ছ— পেড়ে আনব খুনি কটা।’

মনে ভাবি, কত আর নিজেকে ঢাকবে মা জননী? বৈরাগিনীর ছদ্মবেশে এতো ঘোর সংসারিণী! অথচ আশ্চর্য বই কী যে এদের সংসার ধর্ম সে-অর্থে নেই, সন্তানও নেই। আজ এখানে কাল ওখানে। বিয়েই হয়নি। কাঁঠালবিচি আর বড়িসঞ্চয়ী এমন যে-গিন্নি সে কিন্তু যে-কোনও দিন ছেড়ে যেতে পারে বাউলকে। মাঠে ঘাটে ঘোরাফেরার ফাঁকে যে-নারী লক্ষ রাখে সিমের ঝোপ বা বেওয়ারিশ যজ্ঞিডুমুরের গাছের ফলন্ত রূপের দিকে সে-ই হঠাৎ উধাও হয়ে যেতে পারে মেলাখেলা থেকে নতুন বাউলনাগরকে নিয়ে। এ যে ভাবের পথ।

তবে উপস্থিত সেই নারী আমার মতো অতিথিকে নিয়ে বেশ মশগুল। কিন্তু কখনও শুনিনি এরা আমাকে আমার জীবন নিয়ে প্রশ্ন করেছে। নিজেদের বর্তমানকে নিয়েই এরা বর্তিয়ে আছে। দারিদ্র্য আর অভাবও এদের বাস্তব। তাই আমার সংগ্রহে এমন একটা গানও আছে যে,

আমার এই পেটের চিন্তে

এমন আর চিন্তে কিছু নাই—

চাউল ফুরাল ডাইল ফুরাল

সদাই গিন্নি বলে তাই।

যখন আমি নামাজ পড়ি

তখন চিন্তা ওঠে ভারী

কীসে চলবে দিনগুজারি

সেজদা দিয়ে ভাবি তাই—

এখানে ‘সেজদা’ শব্দটার মানে প্রণাম। আরবি শব্দ। নামাজের সময়ে মাটিতে কপাল ঠুকে প্রণাম। ধর্মপ্রাণ ‘মুসল্লি’ যাদের বলে তারা সেজদা কপালে কালো দাগ করে ফেলে। এই গানে সেজদা দেবার সেই মগ্ন আত্মহারা ভাবটা যেন নেই। উপাস্যকে সেজদা দিতে গিয়ে এমন আশ্চর্য গানের গীতিকারের মনের চিন্তা; কীসে চলবে তার দিনগুজরান? এরপরে গানের শেষের কথাগুলো আরও সাংঘাতিক। সাধনভজনের উপাদান-উপকরণ নিয়ে সে ঠাট্টা করে বলে।

ও সদা পেটের জ্বালা জপমালা

আমি তসবি মালায় জপি তাই।

এ একেবারে বুভুক্ষু মানুষের লেখা নাঙ্গা গান— এর আর রাখঢাক নেই। পেটের জ্বালা-ই যে-জীবনে হয়ে ওঠে জপমালা সেই জীবনকে আমরা আর কতটুকু জানি?

এদিকে যজ্ঞিডুমুরের সন্ধানী নারী আঁকশি হাতে রওনা হতে গিয়ে ফিরে আসে একমুখ হেসে। বলে, ওই দ্যাখো মাঠপাড়ে আসছে তোমার গুরুভাই শুকচাঁদ।

সবই গুরুর কৃপা—বলে বাউল হাসে— জীব দিয়েছেন যিনি আহার দেবেন তিনি। বাড়িতে অতিথি আর দরজায় শুকচাঁদ, মানে সুখের চাঁদ উঠল আজ, তাও দিনদুপুরে। যাকে বলে দিনদুপুরে চাঁদের উদয়।

জীবন-আস্বাদের এও একটা ধরন। সবকিছুকে শব্দের লজে সুন্দর করে নেওয়া। তাতেই শুকচাঁদ হয়ে উঠল সুখচাঁদ, সেই চাঁদের উদয় কিনা দিনদুপুরে। আসলে ‘দিনদুপুরে চাঁদের উদয়’, ‘দিনদুপুরে জোয়ার আসা’ এসব বয়ানের গোপন দেহতত্ত্বের অন্তর্ভাষ্য আছে, যা সাধকরাই বোঝে, ঠারেঠোরে বোঝায় চাষি শিষ্যদের। বুঝিয়ে বলেই সাবধান করে;

আরে ঐ না নদীর মাসে মাসে

দিনদুপুরে জোয়ার আসে

ড্যাঙ্গাডহর যায় রে ভেসে

বিদ্‌ঘুটে বন্যে এসে।

এবারে সে নিজেই নিচুগলায় মুনিশদের বলবে, ‘কিছু বুঝলে? এ কোন্‌ নদী, কীসের বন্যে?’

প্রশ্ন শুনে মুনিশ বাগালদের কেউ কেউ ভ্যাবলা মেরে থাকে, কেউ বলে, এসব নিগূঢ় ব্যাপার। কেউ বলে, এসব গোপ্ত কথা জানতে গেলে গুরু ধরতে হয়। একজন খ্যা খ্যা করে হেসে বলে উঠল, ‘ধুর, নিগূঢ়টিগূঢ় কিছু নেই, স্ত্রীলোকের মাসিকের কথা বলা হচ্ছে।’

এবারে হাতে ধানের গুছি রইল পড়ে, শুরু হল পাল্লাদাড়ি। ‘বল্‌ দিকিনি বাঁশি বলে কাকে?’ ‘ও খুব সোজা—বাঁশি মানে গাঁজার কলকে’। ‘বল্ দিকিনি বাবার পুকুর কাকে বলে?’ ‘ওটা অশৈল কথা’। এবারে একজন রসিক চাষা বলে, ‘বেশ, একটা ভাল ধাঁধা শোন দিকি—ব্যাঙাচি খায় দুই পুকুরের জল— এবারে বল্‌। ওসব গোপ্তটোপ্ত কিছু নয়, সোজাসাপটা ব্যাপার। কী? পারলিনে তো কেউ? তবে শোন্‌, ব্যাঙাচি মানে বাচ্চা শিশু, তো সে খাচ্ছে মায়ের দুধ— দুই পুকুর কিনা দুটো স্তন।’ চলল এবারে গ্রাম্য ধাঁধা আর প্রবাদ প্রবচনের চর্চা— ধানরোয়া রইল পড়ে। সে হবে’খন রয়ে সয়ে। উপস্থিত পাওয়া গেছে একটা রসের বিষয়। তো এইরকম সব মাঠফসলের আসরে আমার কতদিন কেটে গেছে। মিলেছি ওদের সঙ্গে। গুরু কিংবা মুর্শেদের বাড়িতে আলাপ হয়েছে হয়তো— বলেছে, যাবেন আমাদের গাঁয়ে, জমিতে কাজ করতে করতে কত গান হবে, টুকে নেবেন ইচ্ছেমতো। বাবু, আমরা কি গোষ্ঠগোপাল না পূর্ণদাস যে আপনি বললেন আর আমি গেয়ে দিলাম। ওঁদের এলেম কত, আমরা সব বেএলেম, নাকি বলো গো তোমরা। আমাদের সব কথার পিঠে কথা, গানের জবাবে গান।

একেই আমরা সাহেবি ভাষায় বলি ওরাল ট্রাডিশন। সাতের দশকে দুশ্যন জাভাতিয়েল খোদ ময়মনসিংহে গিয়ে মাঠচাষিদের কাছে সেইসব ব্যালাড শুনেছিলেন যা নাকি পঁচাত্তর বছর আগে গিয়ে আঁকাড়া সংগ্রহ করেছিলেন চন্দ্রকুমার দে। এতগুলো বছর গানের শব্দ কিছুটা পালটে গিয়েছিল অবশ্য। তবু শ্রুতি ও স্মৃতির পরম্পরা বাঁচিয়ে রাখে গানের ধারা, লোক ঐতিহ্য।

সেটারই বড় আকাল ইদানীং, বিশেষত পশ্চিমবঙ্গে। আজকাল বাউল গায়ক বলে দুয়েকজন মানুষ সব আসরে মিলবে, যারা বাউল সাধনার কিছুই জানে না। গলা আছে, গান গায়। নামযশের কে না কাঙাল! গুসকরার বাউল উৎসবে একজন যুবা আমার পাশের চেয়ারে বসে কেবলই উদ্যোক্তাদের তেল দিচ্ছিল, আমার গানটা একটু আগে দিন, তাড়াতাড়ি ফিরব বাড়ি, কাল অফিস।

অফিস? শুনে এবারে অবাক চোখে তাকাই। বছর তিরিশের বেঁটেখাটো মানুষ, পরেছে এক লম্বা ঝুলের ঝিনচাক রঙিন পাঞ্জাবি, ওই একই রঙের চেপা পাজামা। নিজেই পরিচয় দিল সে ব্রাহ্মণ সন্তান, কাজ করে বি. ডি. ও অফিসে। একজন জানালে, শনি রবিবারে তার বাড়িতে বসে গানের স্কুল। নিজে শেখায় নজরুলগীতি। একসেট গেরুয়া রঙের টেরিকটনের বাউলবেশ আছে। বাউলের আসর হচ্ছে শুনলেই হাজির হয়। পটিয়ে পাটিয়ে মঞ্চে ওঠে— তারপরে তারস্বরে চেঁচিয়ে গায়:

আমি আউলও নই বাউলও নই

আমি মানুষের গান গেয়ে যাই।

ছেলেছোকরা শ্রোতারা হাততালি দেয়। সবাই তার নাম দিয়েছে ‘সুপার সেভেন’। এমন নাম কেন জিগ্যেস করলে তারা বললে, মোট চারখানা বাউল গান ও জানে তাই সুপার সেভেন। হেসে ভাবি, তাই তো। সুপার সেভেন ডিস্কে তো চারখানা গানই থাকে।

এদের যেমন লোক-ঐতিহ্য নেই, তেমনই কণ্ঠে নেই লাগসই গানের পরম্পরাগত স্মৃতি। তিরিশ বছর আগেও এমনটা দেখিনি। ওই যে বলছিলাম বাউল পরিবারটির কথা। বাউলানী যাচ্ছিল যজ্ঞডুমুর পাড়তে, এমন সময় গুরুভাই শুকচাঁদকে আসতে দেখে ঘরে ফিরে এল হাসিমুখে। কারণ কী? সেটা বোঝা গেল শুকচাঁদের কাঁধের বস্তা দেখে। একগ্লাস জল চেয়ে নিয়ে, খেয়ে, দুটো বাতাসা চিবিয়ে, প্রথমে পা ধুলো শুকচাঁদ। তাকে ততক্ষণে পাখার বাতাস করতে লেগেছে আখড়ার একমাত্র নারী। সেটা কেড়ে নিয়ে শুকচাঁদ বলে, ‘ঠাকরুন পাখাটা আমাকে দাও—এত সুখ কি বাউলের জীবনে সহ্য হয়? পথবোরেগী মানুষ আমরা। আসছি দু’ক্রোশ পথ হেঁটে। কাঁধে বস্তা, তাতে চাল ডাল আনাজপাতি। পথই বা কই? টাঁড় জমির ফাটল দিয়ে হলকা বেরোচ্ছে—উঁচুনিচু টিপি। এবারে ঠাকরুন বস্তা খোললা, আজাড় কর মালপত্তর। গুরুভাইকে দেখাও। জয় গুরু।’

গুরুভাই হৃষ্টচিত্তে দেখলে চাল ডাল ছাড়াও এক পাত্র ঘি, একছড়া চাঁপা কলা, থোড়, কাঁচকলা, এঁচোড় আর পটল। ক’টা কচি আম, শসা। কচুপাতায় করে অনেকটা কুচোচিংড়ি ও পুঁটি মাছ। দেখে সোচ্ছ্বাসে বললে, ‘কী ভাই পুরো বাগানটাই সাফ করে আনলে?’

শুকচাঁদ বললে, ‘সবই গুরুর কৃপা। গতকাল গিয়েছিলাম গুরুপাটে, হঠাৎ এমনই মন টানল, তাই। গিয়ে দেখি এক নতুন শিষ্য দিবসী করছে, তারই বিরাট মচ্ছব। আজ ভোরে উঠতে মা-গোঁসাই এইসব বস্তায় পুরে দিয়ে বললেন, যাও তোমার সেই আমডাঙার গুরুভাইকে দিয়ে এসো। মচ্ছবের থেকে বাঁচিয়ে রেখেছি এসব।’

—কুচো চিংড়ি আর পুঁটি? এসব টাটকা মাছও কি মচ্ছবের বাসি মাল নাকি?

—আরে না না। পথে আসতে একটা সোঁতার ধারে ক’জন মালো মাছ ধরছিল। তাদের ক’টা গান শোনালাম। খুশি হয়ে বলল, ‘যাচ্ছ কোথায়?’ বললাম, ‘গুরুভাইয়ের আখড়ায়।’ তাই শুনে কচুপাতায় করে মাছ দিয়ে বলল, ‘ভাল গান শোনালে, ক’টা মাছ নিয়ে যাও। ওখানে রেঁধে খেয়ো।’

—জয় গুরু। সবই কপাল— এই হল আকাশবৃত্তি—না চাইতেই জল। নইলে দ্যাখো ভাই কী আতান্তরে পড়েছিলেম। বাড়িতে ভদ্রলোক মান্যমান অতিথি। যজ্ঞিডুমুর, বড়ি, কাঁঠালবিচি আর পেঁপে দিয়ে কোনওরকমে সেবা দেবার কথা হচ্ছিল, আর এখন?

—যজ্ঞিডুমুরের বদলে আস্ত যজ্ঞি, কি বলো? একটা গান মনে পড়ল গো —শোনো— এ হল ফুলবাসউদ্দিনের লেখা পদ—

দেখে তোমার কাজগুলা যায় না দয়াল বলা।

সাঁই দয়াল নামের এমনি গুণ

পান্তা ভাতে মেলে না নুন—

কেউ খায় ঘি মাখন কারো কাঁধে দাও ঝোলা

কেউ সুখ-সাগরে ডুব দিয়া রয়

কারো কেঁদে কেঁদে জনম যায়।

একেই বলে ভাবের পরম্পরায় গানের উঠে আসা। সেটা এখনকার বাউল সমাবেশে তেমন আর হবার জো নেই। এমন লাগসই গান সময় বুঝে তাক করে ক’জন আর গাইতে পারে? ক’জনের মুরোদ আছে? বেশির ভাগ সুপার সেভেন না হলেও বড়জোর একটা লং প্লেইং রেকর্ড।

বাউলদের জীবনধারাও তো আগের চেয়ে অনেকটা পালটে গেছে। আজকাল কোনও কোনও আখড়ার দাওয়ায় দেখেছি মোপেড গাড়ি। কারুর কারুর হাতে ঘড়ি, গায়ে বিদেশি জাম্পার। ঠিকানা চাইলে এগিয়ে দেবে একটা ঝকঝকে কার্ড। তার ওপরদিকে একটা একতারা-আঁকা লোগো। নীচে ইংরিজি হরফে লেখা। অমুকদাস বাউল। সেন্টার ফর যোগ অ্যান্ড মেডিটেশন। ভিলেজ…। ডিস্ট্রিক্ট…। পিন নং…। ফোন…

একেবারে অবিশ্বাস্য নয়। শহুরে ধাপ্পাবাজি, লোকদেখানি, প্রচার বাসনা এখন প্রবল। আগেকার কত কত বাউল আসর দেখেছি শান্ত গৃহাঙ্গনে। বড়জোর একটা ছাউনি বা চাঁদোয়া টাঙানো, সবাই মাটিতে বসে। গান-শোনা মাদুর বা খেজুর পাতার তালাই পেতে। এখন হয় ডেকরেটর ডেকে নানারঙের বাহারি কাপড়ে মঞ্চ বানানো। শ্রোতারা বসবে চেয়ারে। মঞ্চের বা ব্যাকগ্রাউন্ডে থার্মোকল কেটে বাউল উৎসবের জানানদারি ক্যালিগ্রাফিও দেখবার মতো। বাউলের ‘ব’ হরফের পাশে আকারচিহ্নের বদলে বেঁকানো একতারা। এক সম্মেলনে তিনতিনটে মঞ্চ— লোকমঞ্চ গণমঞ্চ মুক্তমঞ্চ। তবু সামাল দেওয়া যায় না, এত গায়ক এত বাউল এবং এত শ্রোতাও। যেন ভোজবাজির মতো রাতারাতি বাউল গানের গায়ক ও শ্রোতাদের বিস্ফোরণ ঘটে গেছে। রায়গঞ্জের কাছে সুভাষগঞ্জের বাউল উৎসব কিংবা নদিয়ার কদমখালির লালনমেলা বা বাঁকুড়ার নবাসনের সমাবেশ— একইরকম বিপুল জনস্রোতের প্রবাহ আর অগণন বাউলের ভিড়। সবাই বাউল, সবাই গেরুয়া, সবাই গায়ক। ব্যাপারস্যাপার দেখে একজন গান বেঁধেছে:

বাউল গানের হতেছে প্রচার—

কত রামাশ্যামা বাউল সেজে

গান গেয়ে নিচ্ছে বাহার।

দেখি একজন বাউল

তার কালো কোঁকড়া চুল

তার ভাঙা হাতে বেঁধে ঘড়ি

মারছে কত গুল।

ও সে নকল সুরে গাইছে বাউল

লোকে বলছে চমৎকার।

বাউল বেতারশিল্পী হলে

ও তার লেজটি যায় ফুলে

লঘুগুরু মানে না আর

আপন মর্ম যায় ভুলে—

আবার হোটেলেতে বসতে পেলে

হয়ে যায় সব একাকার।

এই গানের শব্দ-চিত্রে তবু হালফিলের পুরো ছবিটা ফোটেনি। সেই ছবি অনেকটাই পরিহাসময় হাস্যকর। কিছুটা প্রহসনও বটে। একেবারে দরিদ্রতম বাউলের বাড়ি গিয়ে হয়তো বললাম, ‘একটা ফোটো নেব আপনার।’

—ফোটো তুলবেন? দাঁড়ান আসছি।

ভাবছিলাম একেবারে গ্রামীণ আবহে গরিব বাউলের ছবি নেব একটা, সেটাই তো প্রকৃত ছবি! কিন্তু দশ মিনিট পরে সামনে এসে যে দাঁড়াল তার পরনে ফিটফাট গেরুয়া পোশাক, ইস্তিরি করা, গলায় দুটো মেডেল। একতারাটা ওপরে তুলে সপ্রতিভ পোজ দিয়ে এমন দাঁড়াল যে আমার মেজাজ গেল খিঁচড়ে।

ছবির সাটার টিপতেই ব্যাকুল প্রশ্ন: ‘কুথায় ছাপা হবে গো? আনন্দবাজারে না বর্তমানে?’

একবার একজন বাউল একটা অ্যালবাম খুলে গর্বিত উক্তি করল, ‘এই ফোটোক’টা দেখুন গো। দিল্লির প্রগতি ময়দানে তোলা। আমার পাশে ছোনিয়া গান্ধি, চেনা যাচ্ছে?’

অথচ তিরিশ বছর আগেও এমনটা ছিল না। এখন যেমন দেখি সর্বত্র, কিছু একটা উৎসব বা সম্মেলন হলেই তার অনুষ্ঠানসূচিতে থাকবেই থাকবে বাউল সংগীত। যারা গেরুয়া পরে উপস্থিত হবে তাদের শতকরা সত্তর জনের জীবন ও বিশ্বাসে বাউলের বা-ও নেই। কিন্তু ভাবভঙ্গিটা আছে যোলো আনা। সঙ্গের যন্ত্রানুষঙ্গ খুব চড়া পর্দার। ক্যাসিও, উঁচুভাবে বাঁধা তবলা—একজন দক্ষ হারমোনিয়ামবাদক প্রথমে সুর তুলবে। বাড়বে দুনে চৌদুনে তালের বাহার। জলদ আরও জলদ। এইভাবে দু’-পাঁচ মিনিট বাজনা গানের পরে বাউল গায়ক কর্ডলেসে ‘ভোলামন’ বলে ফুকরে উঠবে। ব্যস, জমে গেল শ্রোতা ও দর্শকরা। হাতে হাতে বেজে উঠল তালির ঝড়। পপ, র‍্যাপ কিংবা ব্ৰেথলেস গানের আসরে এই শ্রোতারাই থাকে। এরাই জীবনমুখী আর ব্র্যান্ড গানকে জাতে তুলেছে। বাউল গানের ক্ষেত্রে এসব শ্রোতার বাড়তি টান গানের বাণীর দুর্বোধ্যতা বা প্রচ্ছন্ন অশালীন ইঙ্গিতের দিকে। কাটজুডিডাঙার বাউল সম্মেলনের তিনদিনের অনুষ্ঠানের প্রতিবেদন পাঠিয়েছেন সম্পাদক। তাতে লেখা আছে:

লোকমঞ্চে শেষের দিকে দু’-চারজন যুবকের অনুরোধে এক শিল্পী অশ্লীল সংগীত পরিবেশন করলে উদ্যোক্তাদের মধ্য থেকে তা থামিয়ে দেওয়া হলে সেই যুবকদের মধ্যে উত্তেজনা ছড়ায় এবং কিছুক্ষণ পরে তা থেমে যায়। উদ্যোক্তাদের পক্ষ থেকে জানানো হয় আমাদের সুস্থ সংস্কৃতির পরিপন্থী কোন বাউল সংগীত পরিবেশন করা চলবে না।

এই প্রতিবেদনকে ব্যতিক্রম ভাবার কোনও কারণ নেই। সব নয়, কিন্তু কিছু কিছু লোকসংস্কৃতির আসর যে-রুচিহীনতা ও ক্ষণ উত্তেজনার মাদকতায় খেপে উঠেছে তা বুঝতে গেলে আসরের গানের বাণীতে কান পাতাই যথেষ্ট। যেমন ধরা যাক:

মায়ের মধ্যে আমার বাবা গিয়েছে

আমার যেতে ইচ্ছে হয়েছে

আমি যাব কোন দ্বার দিয়া?

শুনেই শ্রোতারা হই হই করে উঠবে। যুবক বাউল আর খমকধারী নৃত্য-সঙ্গী ঘুরে ঘুরে নাচতে থাকবে। বাউলের পরনে গেরুয়া আলখাল্লা, তার ওপরে নানা ছিট কাপড়ে কোলাজ করা, দর্জি দিয়ে বানানো, চকচকে জ্যাকেট। গাইতে গাইতে নাচের টানে বাউল যখন দর্শকদের দিকে পেছন ফিরবে তখন দেখা যাবে জ্যাকেটের পিঠে হয়তো লেখা: ‘জয়গুরু’ কিংবা একটা একতারার ছবি। এটা শো-বিজনেসের অঙ্গ। নবাসনের হরিপদ বাউল আমাকে বলেছিলেন:

এটাসিং পেটাসিং ঝুলিটেপা উদাসীন

মাগমরা ধামাপোড়া এই হয় ছয়।

অর্থাৎ এরাই ছয় ক্যাটিগরির ভ্রষ্ট বাউল। এটাসিং মানে যৌনতাসর্বস্ব কামুক, পেটাসিং মানে পেটুক, ঝুলিটেপা হল তারা যারা মাঝে মাঝে ভিক্ষার ঝুলি টিপে পরখ করে কতটা সংগ্রহ হল। উদাসীন মানে আপাত উদাসীনের ভড়ং যাদের মাগমরা বলতে যারা স্ত্রীবিয়োগের ফলে বাউল সেজেছে নতুন সঙ্গিনীর খোঁজে। ধামাপোড়া মানে যাদের কাজই হল ধামা বোঝাই করা বা কালেকশন।

যে-কোনও বাউল সম্মেলনে গেলে আমার স্বভাব হল উৎসব মঞ্চ বা দর্শক আসনে না থেকে চারদিক ঘোরা এবং ঘুরতে ঘুরতে সেইখানে যাওয়া সেই ঘরে, যেখানে রাখা হয়েছে বাউলদের। সেখানে বসে-থাকা গায়কদের সে সময়ে গেরুয়া পোশাক-আশাক আলখাল্লা বা পাগড়ি থাকে না— সাধারণ বেশবাসে সাধারণ চেহারার গ্রামীণ মানুষ তখন তারা। বেশির ভাগই অশিক্ষিত বা স্বল্পশিক্ষিত কিন্তু আমাদের মতো শহুরে জিজ্ঞাসুদের দেখলেই সতর্ক সচেতন হয়ে ওঠে। এদের অনেকে ইন্টারভিউ দিয়ে দিয়ে পাকাপোক্ত। খুব জাঁকিয়ে নিজের নাম, গুরুর নাম, গুরুপাটের ঠিকানা, নিজের বাস্তুবাড়ির নিশানা দেয়। আমি অনেক সময় ইচ্ছে করে এদের নির্বোধের মতো প্রশ্ন করি, ‘আচ্ছা বাউল মানে কী?’

শুনে খানিকক্ষণ গম্ভীর হয়ে থাকবে, তারপরে গাঁজাটানা বিলোলচোখ মেলে উত্তর আসবে: ‘ব কথার অর্থ বায়ুআশ্রিত, উ বলতে যথাতথা আর ল মানে লয়। অর্থাৎ যারা বায়ুযোগে সাধনা করে, সর্বত্র যাতায়াত করে এবং লয় পেয়ে যায় সবার মনে। সকলেই যাদের ভালবাসে।’ এমন বিচিত্র সংজ্ঞা কে যে তাদের শিখিয়েছে কে জানে। নানা জমায়েতে এ-বাঁধিবোল যে কতবার শুনেছি!

শান্তিনিকেতনের পৌষমেলায় দেখা যায় অন্য এক দৃশ্য। সেখানে বাউলরা থাকে একটা চালার তলায়, ফকিররা থাকে একটু তফাতে আরেকটা চালায়। চিরকাল হিন্দুমুসলমানের মধ্যেকার বিভেদরেখা মুছে দিতে যে-রবীন্দ্রনাথ সমন্বয়বাণী প্রচার করে গেছেন তাঁরই প্রতিষ্ঠিত শিক্ষাসত্রে বাউল ও ফকিরদের আলাদা আলাদা ক্যাম্প দেখলে দুঃখ হয়। পৌষ মাসের তীব্র শীতে মেলার মাঠের ছুরির মতো উত্তুরে বাতাসে টেম্পোরির আস্তানায় চটের আবরণে, খড় ও কম্বলের শয্যায় এসব সাধক ও বাউলদের রাত্রিবাস বিশ্বভারতীর সহৃদয় মানবিকতারই প্রকাশ নিশ্চয়ই। যদিও রয়ে গেছে অনতিদূরে নাট্যঘরের বিরাট প্রকোষ্ঠ, যেখানে হাজারের বেশি বাউল ফকির থাকতে পারে স্বচ্ছন্দে ও উষ্ণতায়। কর্তৃপক্ষের অবশ্য সেই কবোষ্ণ অনুভূতিটুকু নেই লোকায়তদের প্রতি। কলকাতা ও বঙ্গের নানা দিক দেশ থেকে আসা পৌষমেলার ভদ্র ও মার্জিত ভদ্রসমাজ (শান্তিনিকেতনের ছাত্রছাত্রীরা তাদের বলে ‘বোটু’, অর্থাৎ বোকা টুরিস্ট) আসরে বসে নিমীলিত নেত্রে বাউল ফকিরের গান শোনেন। কোনও কোনও অত্যুৎসাহী ব্যক্তি ভিডিও তোলেন, দূরদর্শন ও খাসখবরের প্রতিনিধিরা ব্যস্ত হয়ে ঘোরেন। কেউ খোঁজ রাখে না মেলা চত্বরের দক্ষিণে হু হু শীতে সারারাত কেঁপেছে এই গায়কের দল। সকালে লাইন বেঁধে দাড়িয়েছে নাম পঞ্জিভুক্ত করার জন্যে। নইলে খাবার ও জলখাবারের স্লিপ পাবে না, রাহা খরচ ও দক্ষিণা পাবে না। লম্বা লাইনে দাঁড়ানো দীনভিখারি সেই মানুষগুলোকে দেখলে চোখে জল আসবে।

বাউলদের মধ্যে বসে আছেন ছাউনির একটেরে আশি ছুঁই ছুঁই সনাতনদাস বাউল। সরকার তাঁকে বহুমান্য লালন পুরস্কার দিয়েছে, দৃশ্যকলা আকাডেমি দিয়েছে লোকশিল্পীর পুরস্কার। কিন্তু তাতে কী? তিনি তো ভি. আই. পি নন যে রতনকুঠিতে থাকবেন! তাই যেথায় থাকে সবার অধম দীনের হতে দীন সেই তৃণস্তরে তাঁর স্থান নির্দিষ্ট হয়েছে। তিনি অন্যত্র কেনই বা থাকবেন? আউল বাউল সকলের তো একই ব্যবস্থা, একই আহার, একই শৌচস্থান। আমি বললাম, ‘আপনি এখানে? দেখে লজ্জা লাগছে।’

মনে পড়ল সনাতনদাস তাঁর খয়েরবুনি গ্রামের আশ্রমে আমাকে কত সমাদর ও আশ্রয় দিয়েছেন। খাইয়েছেন বেলের শরবত, মণ্ডা। সেই মানুষের এই অনাদর? দোষরোপ করে লাভ নেই, এই হল লোকায়তদের প্রতি আমাদের গড় দৃষ্টিভঙ্গি। সনাতনদাস কিন্তু হেসে বললেন, ‘আমরা তো মাটিরই মানুষ, গলায় মেঠো সুর। মরলে এই মাটিতেই হবে সমাধি। এখানে সবাই সমান বাবা।’

পরানপুরের এনায়েতউল্লা ফকিরের সঙ্গে দেখা। পরানপুরে তাঁর বড় দোতলা বাড়িতে রাত্রিবাস করেছি। এখানে তাঁর ভূমিশয্যা বরাদ্দ। বললাম, ‘এখানে বাউল আর ফকিরদের আলাদা করে রাখা হয়েছে। কেমন লাগছে?’

—বাউল ফকিরের মধ্যেকার ভেদ আমরা চাই ঘোচাতে, এঁরা সেটা বহাল রাখতে চান। জানেন তো আপনি, আমাদের নদে-মুর্শিদাবাদে ‘বাউল-ফকির সংঘ’ আছে। আমরা একজোট হয়ে মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে লড়ি। অথচ এখানে আলাদা আস্তানা আলাদা আসর।

—বাউলদের তুলনায় ফকিরদের অবস্থা বেশ খারাপ, তাই না?

—হ্যাঁ, ফকিররা তো ফিকিরি জানে না। খুব গরিব। সামাজিক সম্মান নেই। শরিয়ত মানে বলে মুসলিম সমাজের সঙ্গে ওঠাবসা নেই, উলটে তাদের হাতে মার খেতে হয়। ঘরদোর পুড়িয়ে দেয়, চুল কামিয়ে দেয়, একতারা ভাঙে। তা ছাড়া ধরুন, ভারত বা পশ্চিমবঙ্গ সরকার বিদেশে তো ফকির পাঠায় না, পাঠায় বাউল। তারা মোটা টাকা আয় করে ফেরে। তাদের নিয়ে তথ্যচিত্র হয়, শিল্পীরা তাদের ছবি আঁকে। ফকিরদের পোশাকটার জেল্লা নেই, এই দেখুন আমার সাদা তহবন্দ সাদা পিরান। আজকাল কেউ কেউ আসরে তাই কালো জোব্বা পরে। কী করবে?

—এখানে যেসব ফকির দেখছি তাদের মধ্যে সাধক ক’জন, গায়কই বা ক’জন? কে এদের ডেকেছে?

এনায়েতউল্লা ম্লান হেসে বললেন, ‘ফকিরি একটা সাধনপন্থা। শরিয়তির বদলে মারুফতি। আমাদের সাধনায় ধ্যানজপ জিকিরের কাজ বড়, গানের দিকটা তত জোরালো নয়। ওটা বাউলদের বেশি।’

—তা হলে এখানে কারা এসেছে? আপনাদের ছাউনিতে অতজন যে আছে তারা কারা?

—বেশির ভাগই চিমটে-বাজানো ভিখিরি। পথে ঘাটে ট্রেনে এরা ভিক্ষে করে। সত্যি কথা বলতে কি, এরা এখানে এসেছে দু’দিন ধরে দু’বেলা খেতে পাবে পেট ভরে, কিছু টাকাও পাবে সেই আশায়। এরা ফকির নয় সবাই, গরিব।

—তা হলে এখানে যে সব শ্রোতা ফকিরি গান শুনছে তারা কী শুনছে? কোন গান? খাঁটি ফকিরি গান তবে কি নেই?

এবারে এনায়েত আমাকে লজ্জায় ফেলেন। খাঁটি ফকিরি খানদান ওঁদের। ফকিরের বাড়িতে থেকে তাঁদের ঘরানার ফকিরি সাধনা স্বচক্ষে দেখেছি। বীরভূমের ফকিরডাঙায় দায়েম শা’র ফকিরি গান সংগ্রহ করেছি, শুনেছি কবু শা’র গান। সেসব গানের জাতই আলাদা। শান্তিনিকেতনে ফকিরি আসরে যাদের গাইতে দেখেছি তারা দীনভিখারি বেশির ভাগ। তাদের গান এখানে দেখছি প্রধানত লালনের, যিনি আসলে বাউল পরম্পরার মানুষ।

এসব বিবরণ লিখতে লিখতে লিয়াকত আলির একটা আত্মস্মৃতি (‘আমার ফকির-সঙ্গ’) মনে এল। এখানে বীরভূম জেলার শাসপুর গাঁয়ের দরিদ্রতম ফকিরদের ১৯৯৯ সালের প্রতিবেদন আছে। তাদের গানের আসরের বিবরণ এই রকম:

(লিয়াকত ফকিরদের জিজ্ঞেস করে,) ‘কীভাবে আপনারা গাইবেন? বাদ্যযন্ত্র কিছু তো দেখছি না।’

‘হ্যাঁ গো হ্যাঁ’ বলে সুলতান দিব্যহাসি হাসে।

এদিকে একজন বেশ তরিবত করে গাঁজা দুলতে থাকে। ছিলিমে ভরার আগেই ফকির নিয়ে আসেন থালির উপর রাখা চায়ের কাপ। জলভরতি মগটা ছিল পাশেই। চা খেয়ে সকলে হাতে জল নেয়। এরপর চলে ছিলিমে দম।

গাঁজা শেষ হতেই ওদের নিজেদের মধ্যে ঘটে গেল ইশারা বিনিময়। জল ফেলে দিয়ে একজন হাতে তুলে নিল মগ। সুলতান নিল থালি। অন্য একজন পকেট থেকে চিরুনি বের করে কাগজ সেঁটে নিয়ে ধরল মুখে। ফকিরের হাতে উঠে এল চিমটে। অতর্কিতে বেজে উঠল থালা মগ চিরুনিবাঁশি ও চিমটে। এবং সেই সঙ্গে সুলতানের গলা— ‘কেউ ফিরে না খালি হাতে খাজা বাবার দরবারে।’

আয়োজনহীন বাদ্যযন্ত্ৰছুট এই যে গানের বেদনা সেখানে হৃদয়ের আর্তিটাই বড়, বাজনা বাদ্যি পোশাক মাইক ক্যাসিও লাগে না।

লিয়াকত চোখ-কান-খোলা মুক্তমনের আধুনিক যুবা। বাউল ফকিরদের সঙ্গ সে বহুভাবে করেছে বহুদিন। ১৯৯৯ সালের বাউল আর ফকিরদের তফাত সে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় এই বলে:

বাউলরা, যাদের দামী গেরুয়া আলখাল্লার উপর তাপ্লিসৌখীন বাহারে মোড়ক। এরা কারা? ঐতিহ্যের দৃঢ় অবস্থান ছেড়ে তাদের নাচ আজ পণ্যদূষিত, আত্মীকরণহীন ধার করা আমদানীর ভেজালে সাধনাচ্ছিন্ন বাণিজ্যিক মজা ও ফুর্তির উপাদানে পর্যবসিত। হরেক বাদ্যযন্ত্র ছাড়া তারা আর গানের কথা ভাবতে পারে না। স্টেজে আসার আগে সাজগোজ করতে তারা যে সময় নেয় তা তো প্রসাধনবাজির চূড়ান্ত। এদের পেছন পেছন বাউলপ্রেমিক নামে হিন্দু মধ্যবিত্তের এক শহুরে বাউণ্ডুলে অংশ, গবেষক, মেম ও বিদেশে পাচার করার জন্য ফড়ে ঘুরছে। কুঁড়ে ঘর থেকে নিজেকে বিকিয়ে দালানে উঠেছে বাউল। পরনে বিদেশী জিনসের প্যান্ট শার্ট, পাছার নীচে মোটর সাইকেল। খবরের কাগজ, রেডিও, টিভি, সরকারী বেসরকারী অনুষ্ঠান সর্বত্র এদের নিয়ে মাতামাতি।

কিন্তু ফকিরেরা যে তিমিরে সেই তিমিরে। তাদের পেছনে কেউ নেই। পার্থিব, আকাঙ্ক্ষা পূরণের লালসাজনিত বাণিজ্যিক আত্মপ্রতিষ্ঠা থেকে দূরে থাকে বলেই সর্বত্রই তারা অবহেলিত, এমনকি মূল্যায়নহীনও। মুসলিম মধ্যবিত্তের রসিক-সাজা বাউণ্ডুলে বখাটে অংশও এদের পেছনে নেই।

… নাচ ও বাদ্যযন্ত্রহীন গানেও যে আমি এত বেজে উঠতে পারি। —দরকার ছিল জানার, নিজেকে এভাবে খুঁজে পাবার।

লিয়াকতের লেখাটা থেকে একটা কথা স্পষ্ট, যে বাংলার সমাজের ফকিররা যেমন উপেক্ষিত ও ব্রাত্য, কলমজীবীদের দরদ ও করুণাও তেমনই পায়নি তারা। প্রদর্শনপটু বাউলদের পাশে তাদের অনাড়ম্বর মগ্ন সাধনা গবেষক ও দূরদর্শীদের হয়তো টানে না। তাদের সাধনায় অবশ্য গানের ততটা প্রাধান্যও নেই। তবে লিয়াকতের বর্ণনা থেকে জানা যাচ্ছে ফকিররাও বাউলদের মতো গাঁজা খায়।

গাঁজা কেন জানি না লৌকিক সাধকদের গ্রাস করে রেখেছে বহুদিন। এতে তাদের নাকি সাধনায় তীব্র একাগ্রতা আনে। হতে পারে, তবে বাউলদের ব্যাপক স্বাস্থ্যহানি এবং গানের গলা নষ্ট হতে আমি অনেক দেখেছি। লালনের গানে গাঁজার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আছে। প্রমথ চৌধুরী ‘আত্মকথা’-য় তাঁর বাল্যে শোনা একটা নেড়ানেড়ির গান উদ্ধৃত করেছেন। গানটি এইরকম:

যদি গৌর চাস কাঁথা নে ধনী।

সকালবেলায় ভিক্ষায় যাবি

ঘরে এসে তেল মাখাবি

আর পেতে দিবি বিছানাখানি।

আর গাঁজায় কলকের আগুন দিবি

দিনরজনী।

গানের বাণী অনুসরণ করলে বোঝা সহজ যে বাউল বা ভেকধারীদের উনিশ শতকে ভদ্ৰশ্রেণিরা কী চোখে দেখতেন। বাউলরা হঠাৎ কীভাবে সমাজে জনপ্রিয় হল তার কারণ অনুসন্ধান আজও হয়নি, তবে এখনকার ছন্নমতি শহুরে যুবাদের গাঁজার প্রতি টান সুবিদিত। তাই কেঁদুলি বা নানা মেলায় বাউলদের আসরে ভদ্রলোকদের সন্তানরা ব্যাপক গাঁজা টানে— এমন দৃশ্য দেখতে আমার চোখ খুব অভ্যস্ত। আজকাল ট্রাউজার ও টপ পরা ছাত্রীদেরও দুয়েকজনকে দেখছি গাঁজায় দম দিতে।

মাঝে মাঝে বাউল ফকিরদের নিজস্ব জমায়েতে গাঁজার বিরুদ্ধে ক্ষোভ ও প্রতিবাদ শুনেছি। তাতে খুব ফল হয়েছে বলে দেখিনি। এখনকার যে-কোনও বাউল মেলায় তাদের সব ক’টি ঠেকে ঢুকলেই ভক করে একটা গন্ধ নাকে লাগে— তীব্র গাঁজার গন্ধ। বাউলের ঝুলিতে ছিলিম বা ‘বাঁশি’ থাকবেই। সেই সঙ্গে গাঁজাপাতা টুকরো করার জন্য ছোট্ট যন্ত্র। আসরে প্রকাশ্যেই গাঁজার সেবা প্রস্তুতি খুব সাধারণ দৃশ্য। তারপরে হাসি হাসি মুখ, নিমীলিত চোখ আর মাঝে মাঝে ‘জয় গুরু’ বলে বেমক্কা হাঁক। বাউলানীদের অবশ্য গাঁজা খেতে বড় একটা দেখা যায় না, তবে মেলার গানের আসরে একটা দুটো পারভার্ট মহিলা থাকেই। হঠাৎ হয়তো সে নাচতে শুরু করল কিংবা এলিয়ে পড়ল বাউলের অঙ্গে। যুগলের রসের খেলা বলে কথা। সবটাই তো সাত্ত্বিক নয়— অনেকটাই কামের পরিতৃপ্তি।

বাংলায় যত মেলা হয় তার মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত কেঁদুলির জয়দেব মেলা। পৌষ সংক্রান্তির দিনে অজয়ের তীরে এ মেলা বহুদিনের। পণ্ডিত ক্ষিতিমোহন সেন তাঁর যৌবনে কাশী থেকে কেঁদুলি এসেছেন। এখন এ-মেলা অনেক পণ্যবাহী ও বাণিজ্যমুখী হয়ে গেছে, সাধক বাউলদের দেখা মেলে কম, তবু নেই নেই করে এখনও নানা বর্গের গৌণ ধর্মের সাধকরা এখনও আসেন। এইরকম একজন সাধুর আখড়ায় চলছিল গাঁজার আসর। ধোঁয়ায় ধোঁয়াকার, সকলে ঊর্ধ্বমুখী শিবনেত্র। তার মধ্যে একজন বুঁদ হয়ে গাঁজা সাজছিল। মানুষটা তখনও গাঁজা সেবন শুরু করেনি, হাবেভাবে বেশ টনকো। তাকে বললাম, ‘গাঁজা নিয়ে গান জানেন? কেউ লিখেছেন?’

প্রসন্ন হেসে লোকটি বলল, ‘একটা পদ আমরা গাই তবে তার ভণিতা পাইনি তাই ঠিক কোন মহতের রচনা বলতে পারব না। গানটা শুনুন:

গাঁজা তোর পাতায় পাতায় রস—

না খেলে যায় না বোঝা

খেলে অপযশ।

সিদ্ধি খাও বাটি বাটি

গাঁজা খেলে শরীর মাটি

মদ যে আরও মজার নেশা

এক গেলাসেই কত রস।

যত ভাবি না না না না

এ গাঁজা তো আর খাব না

ভুল করে তাই ভোলাবাবার

হয়ে গেলি বশ।

গাঁজা তোর পাতায় পাতায় রস॥’

গানের সুর ‘তুমি কাদের কুলের বউ’ মার্কা, খেমটা তালে। শুনেই বোঝা গেল এ গান কোনও মহতের রচনা নয় সেকালের থেটারের গান।

এই একটা বেশ ভাববার দিক— আমাদের মঞ্চ নাটকে আর চলচ্চিত্রে বাউল চরিত্রের বহুল ব্যবহার। এ সব চরিত্র আমদানির প্রধান কারণ অবশ্য দর্শকদের গান শোনানোর সুযোগ সৃষ্টি করা, অর্থাৎ নিছক বিনোদন। তাতে খানিকটা গানের মুখবদল হয়, লৌকিক গানের প্রয়োগক্ষেত্র পেয়ে যান সংগীত পরিচালক। কে না জানে আমাদের বাবু-সংস্কৃতি তথা ভদ্রলোকদের পাতে বাউল বা ফোক টিম্বারের যে-কোনও গান চাটনির মতো জমে যায়। তবে তফাত আছে, আগেকার দিনে এ ধরনের গান ভাল লাগে বলেই সকলে উপভোগ করত এখন তাতে প্রমোটিংয়ের একটা ধুয়ো জারি হয়েছে। বলা হচ্ছে এসব গানে আছে নিম্নবর্গের রুদ্ধবাণী, সমন্বয়বাদ ও সুস্থ প্রতিবাদী চেতনা।

পশ্চিমবঙ্গের নানা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসব বিষয়ে সেমিনার হয়, আমি নিজেই অনেক জায়গায় ওই বিষয়ে বলেছি। আধুনিক ইতিহাসচর্চার পাঠক্রমে লোকায়তদের গান এখন ‘টেক্সট’ হিসেবে সমাদৃত, বিশ্লেষণযোগ্য বিষয়— কিন্তু যারা এই জাতীয় গান রচনা করে, যারা গায়, তাদের আর্থসামাজিক অবস্থান ও অবমানিত অস্তিত্ব সম্পর্কে সরেজমিনে ক’জন উৎসাহী? ক’জন তাদের বিপদে আপদে পাশে আছে? নেই যে, অন্তত ফকিরদের পাশে যে তেমন কেউ নেই, সেটা স্পষ্ট। কারণ ফকিরিগানে বাণিজ্য হয় না, তাদের গানে গিমিক নেই, পোশাকের জেল্লা নেই, ‘কালচারাল এক্সপোর্ট সারকিটে’ চলে না, ফকিররা একদম বলিয়ে কইয়ে নয়, তাদের সঙ্গে মেম সাহেবরা থাকে না, তা হলে?

এইখানে এসে লিয়াকতের অভিজ্ঞতার বয়ান বেশ দিশা দেয় আমাকে। বাউল ফকিরদের নিয়ে শৌখিন মজদুরি করে না লিয়াকত। সত্তরের রাজনীতির কারণে উচ্চশিক্ষার ড্রপ আউট সে বাউল ফকিরদের বন্ধু ও সঙ্গী। তাদের নিয়ে অবিরত লেখে। এমনকী ফকিরডাঙার একজন ফকিরের মেয়েকে বিয়ে করে সে ঘর বেঁধেছে। পদে পদে বউয়ের সঙ্গে তার জীবনদৃষ্টির ফারাক ধরা পড়ে। সেই রকম একটা ঘটনা সে লিখেছে:

ফকিরডাঙায়, আমি যেখানে আছি, ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা ধুলো ময়লার মধ্যে খেলে, গড়াগড়ি খায়। একদিন আমি বউকে, যে কিনা ফকিরের মেয়ে, বলি, ‘ছেলেমেয়েগুলো দিনরাত নোংরায় পড়ে আছে, মানা করতে পারো না?’ বউ বললে, ‘তখন থেকে নোংরা নোংরা করছ— নোংরা কোথায়, ও তো ধুলো।’ আমি অবাক। ধুলোকে নোংরা বলে চিনে এই সভ্যতার জন্ম, যেখানে আমি শিক্ষিত হয়েছি— সেই আমি অবাক। কে ঠিক? আমি না আমার বউ? আর আমি নিজেকে ঠিক বলে দাবি করতে গেলেও মনে হচ্ছে এর মধ্যে কোথাও ফাঁকি থেকে যাচ্ছে।

সংশয়ী লিয়াকতের মন উথালপাতাল হয়, সে এবারে প্রশ্ন তোলে, সংগত প্রশ্ন,

এজন্যই কি পণ্ডিতদের টীকাভাষ্য পুস্তককে ফকিররা গুরুত্ব তো দিতে চায়ই না, উলটে বিরোধিতা করে? এমনকী শাস্ত্রকেও তারা গুরুত্ব দিতে নারাজ। কিন্তু এসব কথা ফকিরেরা নিজে লিখলেই তো ত্রুটিমুক্ত হত, ফাঁকি মুক্ত হত। তাও তারা লিখল না কেন?

মনে হয় গুহ্য জিনিসকে অনেকাংশে গোপন রাখতে চেয়েছিলেন তারা। বিকাশশীল মহা অনন্তকে কোন বিবৃতির ছাঁচে প্রকাশ করার চেষ্টা করেননি তারা, তাতে তত্ত্বের অফুরন্ত সৃষ্টিশীলতার পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। তাই তারা ওপথ মাড়াননি, বলেছেন ‘দিল-কেতাব’ পড়ার কথা। লিখেছেন গান। এমন আভাসে ইঙ্গিতে লিখেছেন যাতে ব্যক্তর থেকে অব্যক্তই বেশি। এমনকী ব্যক্তও হয়েছে অন্তহীন রহস্য মাখানো।

লিয়াকত ফকিরকন্যা বিবাহ করলেও ফকিরিপন্থায় সামিল হয়নি। সে তাদের মরমি, দরদি, সব অর্থেই সে তাদের আত্মীয় কিন্তু তার নিজের জিজ্ঞাসা মেটেনি। তবু সে খুব গভীর বিশ্লেষণে বুঝেছে:

অনধিকারী বলে ফকিরেরা তাদের ভিতরের কথা খুলে না বলুক, তাদের সঙ্গ আমার জীবনের বহু ফাঁকি ঘোচাতে সাহায্য করেছে।

লিয়াকত এরপরে চলে গেছে ফকির-পরিমণ্ডলে দৈনন্দিন জীবনের গভীরে। তাদের প্রাত্যহিক জীবনযাপনের উৎসে। তাদের শৈশব গাথায়। লেখে:

জালাল শা ফকিরকে যত দেখি তত অবাক হই—সম্পত্তি নেই, মাটির ঘর, কারো কাছে হাত পাতেন না। অথচ মানুষের অযাচিত দানেই তার সংসার চলে। আর তাতে ঘুরিয়ে চলে মানুষেরই সেবা। যেখানেই থাকুন তিনি, যেখানেই যান, তার সঙ্গে পাঁচ-দশজন লোক জুটবেই; তিনি যা খান, তারাও তাই খাবে। যদি উপস্থিত সকলকে খাওয়ানোর পয়সা না থাকে, যত খিদে পাক, নিজে একা কিছুতেই খাবেন না। কাউকে খাওয়াতেও বলবেন না। নিজে থেকে যদি কেউ খাওয়ায়, সে কথা ভিন্ন। এরপর আছে দিনরাতের যে-কোনও সময়ে, এমনকী গভীর রাতেও, ভক্তদের নিয়ে বাড়ি ফেরা।…

ছেলেমেয়েদের প্রতি তার প্রাণাধিক ভালবাসা। অথচ ছেলেমেয়েগুলো ডানপিটে, কিছুটা জংলি এবং স্বাধীন। নিজেদের ইচ্ছামতো বেড়ে উঠেছে। এত ছোট বয়স থেকে এত হস্তক্ষেপহীন স্বাধীনতা ভোগ করার সুযোগ আর কোথাও কোনও ছেলেমেয়ে পায় কিনা জানা নেই। নিজেদের মধ্যে হুটোপুটি মারামারিও লেগে আছে।… অথচ প্রতিটি ছেলেমেয়ের ভেতরটা অদ্ভুত নির্মল। মানুষের প্রতি মমত্ববোধ ও ভালবাসায় শিশুরাও যে কতখানি এগিয়ে এদের না দেখলে বোঝা যাবে না। একটু বড়রা দিনরাত মানুষকে জল এনে দিচ্ছে, চা এনে দিচ্ছে, ধুচ্ছে এঁটো কাপ গেলাস থালা— জাত-পাতের প্রশ্ন নেই, চেনা-অচেনার প্রশ্ন নেই, অর্থবান-ভেদাভেদ নেই— সবার, সবারই।…সঞ্চয় নেই— সঞ্চয় না থাকার উদ্বেগও নেই।

লিয়াকত লক্ষ করে আশ্চর্য হচ্ছে, এদের মধ্যে হা-অন্ন ভাবটা একেবারে নেই। নেই লোভলালসা ধান্দাবাজি। দুয়েক বেলা উপোস এদের দমাতে পারে না, কিন্তু অতিথি আপ্যায়নে অত্যন্ত সজাগ। লিয়াকত বোঝে:

শিষ্টাচার ভালবাসা ও সেবার এমন আচরিত প্রাত্যহিক সজাগ দৃষ্টান্ত জীবনে খুব একটা দেখিনি। মনে প্রাণে আমিও তো এই জীবন চাই। বিত্তের দাসত্বে মানসিকভাবে ডুবে থাকলে ব্যক্তি, সমাজ ও সভ্যতার যে কী হীন আপোষমুখী আত্মকেন্দ্রিক চেহারা হয়— তা চারপাশে প্রত্যহ দেখছি। এই ফকিরের সৎ বেদনাপ্রশ্নের কাছে বিস্মিত ও শ্ৰদ্ধানত আমার অবস্থান কোথায়? আমার জ্ঞানবুদ্ধিশিক্ষা, হায়, আমারই আকাঙ্ক্ষার সততাকে দমন করার কাজে লিপ্ত থেকে আমাকে বোঝাচ্ছে— যতই কাঙ্ক্ষিত হোক, ওই নিরক্ষর ফকিরের পথে অতটা হেঁটো না, মরে যাবো। না, ফকিরের ফাঁকি-ঘোচানো জীবন দৃষ্টান্তের আহ্বানে এগিয়ে গিয়ে উদ্ধার হবার যে ততখানি সামর্থ্য আমার নেই এই লজ্জায় আমার মাথা নিষ্কৃতিহীন হেঁট হয়ে আছে।

বিবেকী মানুষের অর্ন্তবাষ্পবহুল এমনতর প্রতিবেদনে আমাদের মুখোমুখি করে দেয় সামাজিক দ্বন্দ্বের অনপনেয় দ্বিচারী বিন্যাসে। ফকিরিজীবন শৈশব থেকেই মুক্ত ও হস্তক্ষেপহীন, অথচ তারা সেবাধর্মে উৎসুক। তারা সঞ্চয়হীন কিন্তু প্রত্যাশা নেই উন্নত জীবনযাপনের ভোগরাগে। বিত্তের দাসত্ব, পুঁজির বিকাশ, আমাদের আপোষমুখী ও আত্মকেন্দ্রিক করে তুলছে, গড়ে তুলছে শ্রেণিবৈষম্য— কোথাও উৎসর্জন নেই, আত্মদানের দীক্ষা নেই। তা হলে কী করে বুঝব আমরা প্রকৃত ফকিরদের, তাদের জীবনবিশ্বাসের গানকে? সেসব গান শুধু সংগ্রহ ও সংকলন করলেই হবে না, খুঁজতে হবে সেই বনিয়াদ যা ফকিরদের জীবনসত্যে গ্রথিত। তা ততটা সুরময়, চটকদার না হতেই পারে।

লিয়াকতের অভিজ্ঞতা ও ব্যাখ্যান থেকে আরেকটা কথা স্পষ্ট হল যে, মেলামচ্ছবে সচরাচর যেসব ফকির দেখি তারা উদাহরণীয় ফকির নয়। তারা বেশির ভাগ ক্ষুৎকাতর ভিখারি, চিমটে-বাজানো গানঅলা। খাঁটি ফকিররা থাকেন তাদের অন্তর্জীবনের গুপ্ত ছকে। ‘সদা থাকো আনন্দে’ যেন তাদের আদর্শ। তবে এমন ফকিরি জীবন বিরল হয়ে আসছে। উৎসবমুখী মধ্যবিত্ত সমাজ তাদের আয়োজিত সম্মেলন ও জমায়েতে প্রায়ই ডেকে আনে বাউল ফকিরদের। এই আহ্বান তাদের সার্বিক সমাজস্রোতের অন্তর্গত করার জন্য নয়, নিজেদেরই দরদি প্রতিমা গড়তে। মঞ্চে তাদের লড়িয়ে দিচ্ছেন। লজ্জাহীন স্কুল শ্রোতাদের বিনোদন করতে না পারলে ভবিষ্যৎ নেই জেনে মরিয়া তালবাদ্যে ও বসনবিন্যাসে বাধ্যত সতর্ক যারা, তারাই কি প্রকৃত বাউল ফকির? তথ্যচিত্রে কেন শুধু তাদের অবয়ব ধরে রাখছি আমরা? গত তিন দশক ধরে আমি দেখে যাচ্ছি মূল বাউল ফকির জীবনের অন্তস্তলীয় পচন এবং মেকি প্রদর্শনকামীদের উত্থান। আমরাই তাদের কানে বিকৃতিমন্ত্র দিচ্ছি। ফলে তারা শিখে নিচ্ছে আমাদেরই স্বার্থভাষা ও প্রচারের শস্ত্র।

এর দুটো নমুনা তো চোখের সামনে দেখেছি এবং এখনও দেখছি। পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি কলকাতার বঙ্গ সংস্কৃতি সম্মেলনে প্রথম গান গাইতে দেখি নবনীদাস বাউলকে। রোদে-পোড়া তামাটে বিশেষত্বহীন চেহারা। অঙ্গে ময়লা সাদা পোশাক। তার ক’বছর পরে কলকাতার নিজাম প্যালেসে গৌরকান্তি ঝুটি বাঁধা কেশকলাপে সুপুরুষ পূর্ণদাসের গান ও বৃত্তাকার নাচ দেখে মুগ্ধ হই। গেরুয়া আলখাল্লা, গেরুয়া লুঙ্গি, একই রঙের কোমরবন্ধ ও পাগড়ি পরা পূর্ণদাসের যৌবনবিগ্রহ ও তেজি কণ্ঠ যেন অধুনাতন সময়ে একই সঙ্গে বাউল গানের পুনর্জাগরণ ও নবদ্যোতনা আনল। তাঁর কণ্ঠস্বরে, উচ্চারণে ও তারসপ্তকের টানে একটু কোমলতা ও নারীত্বের ভাব ছিল। দেখতে দেখতে সেটার অনুকরণে বাউল গায়করা হয়ে উঠল পূর্ণ-রই প্রোটোটাইপ যেন। এখনও সে ভাবটা পুরোপুরি কাটেনি। বাউলের জীবনে নাচের ছন্দ থাকলেও বাউল গানের পরিবেশনে তত নান্দনিকতা থাকার কথা নয়। নানা রঙের টুকরো কাপড় সেলাই করে জুড়ে আগেকার দরিদ্র বাউল সাধকরা যে লম্বা আলখাল্লা পরত তাকে বলত গুধরি। তারই যে টেলর-মেড নব সংস্করণ এখনকার সাজানো বাউল গায়করা পরিধান করে থাকে তাতে সচেতন চমক আছে, চেষ্টিত বর্ণময়তা আছে, নজরকাড়া শৌখিনতা আছে কিন্তু প্রাণ নেই। অবশ্য এই ধরনের সাজা বাউলের ইতিহাস এদেশে নতুন নয়। লালন ফকিরের আমলে কাঙাল হরিনাথ শখের বাউল গান লিখে ফিকিরচাঁদ ভণিতা দিয়ে দল বেঁধে গান গাইতেন প্রথমে কুষ্টিয়া-কুমারখালিতে, পরে জনাদরের টানে যশোহর, ঢাকা ও কলকাতাতেও। জলধর সেনের বর্ণনায় এদের চেহারা:

দেখিতেছি একদল ফকির: সকলেরই আলখেল্লা পরা; কাহারও মুখে কৃত্রিম দাড়ী, কাহারও মাথায় কৃত্রিম বাবড়ী চুল, সকলেরই নগ্ন পদ।

প্রাণকৃষ্ণ অধিকারীর বর্ণনায়:

খিলকা, চুল, দাড়ি, টুপী ব্যবহার এবং কাহার কাহার পায়ে নূপুরও থাকিত, বাদ্যযন্ত্রের মধ্যে ডুগী, খমক, খুঞ্জুরি, একতারা প্রভৃতি ফকীরের সাজে তাহারা বাহির হইত।

ফিকিরচাঁদের দলের সাফল্য দেখে ক্রমে ক্রমে গড়ে ওঠে বালকচাঁদ, গরিবচাঁদ, আজবচাঁদ ও রসিকচাঁদের দল। তাদের মধ্যে পাল্লাদারিও হত। কিন্তু তা স্থায়ী হয়নি।

এখানে লক্ষণীয় যে দুটো বর্ণনাতেই কৃত্রিম সাজে সজ্জিত গায়কদের ফকির বলা হয়েছে, বাউল বলা হয়নি। তাদের গেরুয়া অঙ্গবাসের উল্লেখ নেই। মীর মশাররফ হোসেন বর্ণনা করেছেন গানের ভাষায়:

ছেলেবুড়োয় সং সাজিয়ে

রং লাগিয়ে গান ধরেছে—

তারা বানিয়ে জটা লাগিয়ে আঠা

দাড়ি গোঁপে খুব সেজেছে।

আবার খেল্‌কা পরে হল্‌কা ধরে

মাজা নেড়ে খুব নাচিছে—

এ সকল উপরি চটক আল্‌গা ভড়ক

করে বলো ফল কী আছে?

বলা বাহুল্য এমন সাজানো, দলের বানানো গানের ঢেউ বেশিদিন চলেনি। সমকালীনরাও এমনকী একে ‘সং’ বলে চিহ্নিত ও পরিহাস করেছিল। গানের নামে এ যে গিমিক, ‘উপরি চটক’ ও ‘আলগা ভড়ক’ (অর্থাৎ ভড়কি) এবং শেষ পর্যন্ত এ প্রচেষ্টা যে নিষ্ফল তা ঘোষণা করতে সেকালের প্রাজ্ঞ বিবেকীদের সংশয় ঘটেনি। তা হলে আজ আমরা কেন এত উদাসীন ও অপারগ?

বাউল গানের নামে গেরুয়ার বিলাসিতা, সাজসজ্জা কেশবিন্যাসের ঘটা অথবা সাঁইবাবার মতো চর্চিত কেশের মাথা ঝাঁকানো কবে শেষ হবে? চোখের সামনে দেখছি, বাউলদের পাশে আসরে পাত্তা পাবার জন্য যুবক বয়সের ফকিরিগানের গায়ক সাদা পোশাক ছেড়ে পরছে কালো রঙের আলখাল্লা, গলায় পরছে নানা বর্ণের পাথরের মালা। চারপাশে জুটে গেছে নানা ধরনের গীতিকার— তারা সাধকও নয়, তাত্ত্বিকও নয়— গানের সরবরাহকারী। সরকারি আমলা, সভাধিপতি, লোকসংস্কৃতিগবেষক, বিধায়ক, বাউল সমাবেশের উদ্যোক্তা এমনকী মন্ত্রীদের কাছে গিয়ে তারা বিনয়বচনে জানায়, সব রকমের বাউলগান তারা লিখেছে, লিখে দিতে পারে। সাক্ষরতা, বয়স্ক শিক্ষা, পণপ্রথা বিরোধী, হিন্দু-মুসলমান ঐক্য ও সংহতি, মৌলবাদবিরোধী, চাইকি থ্যালাসেমিয়া ও এড্‌স্‌ নিয়ে তার লেখা গান আছে। সে সব গান নিয়মিত গেয়েছে, গায়, অমুক বাউল তমুক বাউল। গান চাই গান? কে নেবে গো বাউল গান!

আজ তাই সারা পশ্চিমবাংলার বাউল ও ফকিরদের বৃত্তান্ত লেখার চেষ্টা করতে গিয়ে মনে হচ্ছে, প্রথমে গত শতাব্দীর আগে থেকে এদেশে বাউল ফকিরদের নিয়ে যে সব চিন্তাভাবনা ছাপা বইতে লিখিত আকারে পাওয়া গেছে তার ধারাবিবরণ জানা জরুরি। মনে রাখতে হবে এসব রচনা হয়তো ছিল নিতান্ত ক্যাজুয়াল। তত কিছু গূঢ় গভীর সন্ধান করে সবাই লেখেননি, এসে গেছে লেখার টানে। কেউ কেউ আবার একটু গভীরে যেতে পেরেছেন। কেউ বাউলদের বিরোধী, কেউ দরদি। তবে দৃষ্টিকোণ যাই হোক, প্রান্তীয় বা উদার, ইতিহাসের প্রয়োজনে আমাদের জানতে হবে এই বৃত্তান্ত রচনার আগে কে কেমন ভেবেছেন নিম্নবর্গের এই গৌণধর্মীদের জীবন আর সাধনা নিয়ে। তার জন্য নানা রকম বইপত্র, পুথি, পুস্তিকা, পত্রিকা ও চিঠি থেকে উৎকলন সহযোগে জেনে নিতে হবে এর পরে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *