১.৪ দেহের দেহলী

দেহের দেহলী

ইহসাধক ও দেহবাদী বাউলদের প্রথম থেকে এই যে চিহ্নিত করা হল মিস্টিক ও একক অনুসন্ধানীরূপে, তার ঘোর আজও কাটল না। তার প্রমাণ পাচ্ছি ফ্রান্স থেকে প্রকাশিত বাউল-পরিচিতিতে, যা অতি সাম্প্রতিক এবং বিশ্বসকাশে বাংলা সংস্কৃতির পরিচায়ক বলেই চিন্তার বিষয়। বলা হচ্ছে ফোল্ডারে:

Across all ideas of ethnicity or caste, the Bauls of Bengal move from village to village (Madhukari). Whether they live in small communities or are engaged in a profession, the Bauls are always in search of the Supreme Being who resides in the temple of the body. Prossessed by ‘winds of the mind’, translation of the Sanskrit ‘Vakula’ or Baul, they utilise music and dance as props of the divine mad-ness. The artistic act, more than a simple imaged ritual is actually the accom-plishment of that meeting with the Supreme Being.

বিদেশে বাউল সম্পর্কে এই হল আমাদের প্রচারের নমুনা। এমন সব প্রচার পুস্তিকার রচয়িতাদের কে বলে দেবে যে, এখনকার বাউলদের বাস্তব এমন নয়। এ ধরনের বস্তাপচা কথা বলার দিন এবারে শেষ হওয়া দরকার। বাংলার বাউল মানে দ্বারে দ্বারে ভিক্ষাজীবী, মাধুকরীব্রতধারী, কে বলেছে? কে বলেছে নাচ আর গানে তারা দক্ষ? কে বলেছে তারা দিব্যোন্মাদ ব্যাকুল? বাউলদের একটি ক্ষুদ্র অংশ হয়তো ভিক্ষাজীবী, তেমনই খুব কম বাউলই গান গায় বা নাচে। বেশির ভাগই আচরণবাদী, প্রচ্ছন্ন ও সংগুপ্ত। এমনভাবে সাধারণ জীবনস্রোতে তারা মিশে থাকে যে হঠাৎ শনাক্ত করাও কঠিন। তারা বেশির ভাগই শ্রমজীবী ও মাটিঘেঁষা জীবনের লড়াইয়ে সামিল। অনেকে আবার বিপন্ন, মৌলবাদীদের অত্যাচারে। একজন বা দু’জন গায়ক-বাউল বীরভূম বা বাঁকুড়া থেকে মাঝে মাঝে যেতে পারেন প্রতীচীর মঞ্চে, গাইতে পারেন নেচে ঘুরে ঘুরে, কিন্তু তিনি কোনওভাবে কি বাংলার বাউলের প্রকৃত প্রতিনিধি হতে পারেন?

এ প্রশ্ন যে আমাদের মনে ওঠে না তার কারণ কিছু কৌশলী মানুষ বা চতুর স্পনসর আজকাল দেশে ও বিদেশে খুব দক্ষতার সঙ্গে বাউলদের ব্যবহার করছে নিজেদের অর্থ উপার্জনের জন্য। বাউলদের অনেকে নিজের অজান্তে এদের দ্বারা প্রতারিত হচ্ছেন। তাঁদের প্রতি গুরুর নির্দেশ ভুলে, স্বাভাবিক মূল্যবোধ জলাঞ্জলি দিয়ে, প্রযোজকের রুচি ও ব্যাবসাবুদ্ধি অনুসারে নিজেকে সং সাজাচ্ছেন প্রতিনিয়ত, আত্মপীড়ন করছেন যথেচ্ছ। আড়ম্বরপূর্ণ ভোগের জীবন এবং সব রকমের কৃত্রিমতার আড়ালে আত্মসংযত থাকার কথা বাউলের, কিন্তু প্রচার তাঁদের বিপথগামী করে প্রতিনিয়ত। এখন নানা নাগরিক অনুষ্ঠানে বা পুজো প্যান্ডেলে, গুরু বা ছোটখাটো অবতারকল্পের বাৎসরিক পালনে, বক্তৃতা, প্রতিযোগিতা, অষ্টম প্রহর তারকব্রহ্মনামের সঙ্গে অনুষ্ঠান সূচিতে লেখা থাকে ‘রাতে বাউলগান’। সন্ধ্যার মুখে এসে পড়েন খ্যাপা নামধারীরা এবং বিপুল জন সমাবেশে তারস্বরে চেঁচাতে থাকেন, গানের নামে। তাঁদের আশু লক্ষ্য অর্থোপার্জন, উদ্যোক্তাদের লক্ষ্য অনুষ্ঠানের সাম্বৎসরিক জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি। এঁরা প্রকৃত বাউল নয়— বাউলের অনুকল্প।

এমনতর ক্ষেত্রে কথা উঠেছে বাউলের মূল্যবোধ নিয়ে। নবনীদাস বা নিতাই খ্যাপা, রাধেশ্যাম বা ত্রিভঙ্গ দাসকে কি এভাবে ব্যবহার করা যেত? যেত না, কারণ তাঁদের বাউল সাধনার ভিত ছিল অনেক সুদৃঢ়, বোধ ছিল পরিপক্ক, নিজেকে প্রচ্ছন্ন রাখাই ছিল লক্ষ্য। আজ পটভূমি পালটে গেছে, আর্থ-সামাজিক পরিবেশ হয়ে গেছে অন্যতর, অস্তিত্বের সংকট হয়ে উঠেছে তীব্র। এ প্রসঙ্গে সমাজতাত্ত্বিক বিকাশ চক্রবর্তী মনে করিয়ে দিয়েছেন একটি নিবন্ধে যে,

১. বিদ্যমান সমাজের রীতিনীতি মূল্যবোধের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হওয়া সত্ত্বেও বাউলরা একান্তভাবেই সামাজিক মানুষ, কারণ সপ্তদশ শতাব্দীর সামাজিক প্রতিবেশই বাউল মতবাদের জন্ম ও ক্রমবিকাশকে সাহায্য করেছে এবং তারই ভিত্তিতে নিজস্ব বিকল্প মূল্যবোধ তারা গড়ে তুলেছে। তাই অন্যান্য ক্ষেত্রের মতো বাউল জীবন ও তার মূল্যবোধ মিথষ্ক্রিয়ার বন্ধনে আবদ্ধ।

২. একটা বিষয় খুব স্পষ্ট যে বাউল সাধনা কোন ক্ষণিকের সাধনা নয় বরং এক সামগ্রিক জীবনচর্যা, যার শুরু আছে কিন্তু শেষ নেই।

৩. প্রত্যেক সমাজ ব্যবস্থাই যে সম্পর্ককে সর্বাধিক গুরুত্বের সাথে বিচার করে এবং বিধিনিয়মের শৃঙ্খলে আবদ্ধ রাখে, তা হলো নারী-পুরুষের সম্পর্ক, কারণ এই সম্পর্ককে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে সম্পত্তির সংরক্ষণ ও উত্তরাধিকার ব্যবস্থা। বলা বাহুল্য, অন্যান্য সমস্ত ক্ষেত্রের মতো নারী-পুরুষের সম্পর্কের ক্ষেত্রেও বাউলরা সমাজ-অনুগামী নয়। খুব সহজেই তাই এদের বিরুদ্ধে বহুগামিতা ও স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ ওঠে। কিন্তু মনে রাখা প্রয়োজন যে তত্ত্বগতভাবে বাউল সাধনা যৌন স্বেচ্ছাচারকে আদৌ সমর্থন করে না। এই যুগল সাধনার প্রকৃতি-নির্বাচন-গ্রহণ-পরিত্যাগ গুরুর আদেশ ও অনুমতি সাপেক্ষ।

বিকাশ চক্রবর্তীর তিনটি বক্তব্যই গুরুত্বপূর্ণ ও অনুধাবনযোগ্য এইজন্য যে তাঁর সিদ্ধান্ত বাস্তব অভিজ্ঞতাভিত্তিক। বহু বছর ধরে বহু গুরুপাট ও আখড়ায় তাঁর যাতায়াত আছে এবং মেলা মহোৎসবে অগণ্য মানুষের অংশগ্রহণের আততি ও আনন্দ তিনি জানেন। বাউল সাধক ও তার সাধনসঙ্গিনী, তাদের গুরু ও তাঁর নির্দেশিকা বিকাশ চক্রবর্তীর প্রত্যক্ষভাবে জানা। বাউল আচরণ-বিধি ও বিধান তিনি সরেজমিন দেখে তাঁর সিদ্ধান্ত করেছেন। সেই জন্যেই তিনি বাউলদের যৌন-যোগাচারকে ভুলভাবে ব্যাখ্যা করেন না— বাউল জীবনের স্বেচ্ছা সাধনার ভিত্তিমূলে কঠোর সংযম ও শৃঙ্খলার কথা তাঁর অভিজ্ঞতায় থাকে। উপরন্তু সমাজতত্ত্ব তাঁর চর্চার বিষয় বলে এমন সিদ্ধান্তে আসতে পারেন যে,

যে-স্বয়ংশাসিত ও কৃষিজীবী সমাজে বাউল মতবাদের উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ, আধুনিকীকরণের প্রভাবে আমূল পরিবর্তন ঘটেছে সেই সমাজের। সমকালীন সমাজের দাবীকে প্রত্যাখ্যান করে বাউলরা চলে গিয়েছিলেন মূল স্রোতের বাইরে। সমাজপতিদের ভ্রূকুটি ও প্রতিরোধ সত্ত্বেও তাঁরা বজায় রাখতে পেরেছিলেন তাঁদের স্বতন্ত্র জীবনধারা, কারণ তৎকালীন সমাজের গড়নই তা সম্ভব করেছিল। আধুনিকীকরণ সঞ্জাত নগরায়ণ প্রক্রিয়া ও গণমাধ্যম দুর্বার গতিতে প্রবেশ করেছে দেশের প্রত্যন্ত প্রদেশে এবং এই অপ্রতিহত আগ্রাসনের কবল থেকে বিশেষ কোন অঞ্চল বা সম্প্রদায়ের মানুষের স্বাতন্ত্র্য রক্ষার প্রচেষ্টা নিতান্তই অসম্ভব। সামাজিক রূপান্তরের এই আঘাতে বাউলরাও বিপর্যস্ত। অস্তিত্বরক্ষার প্রয়োজনে পরিবর্তিত হচ্ছে তাদের জীবনবোধ, জীবনধারণের উপায়, এক কথায় সমগ্র জীবনচর্চা।

কথাগুলি বিবেচনাযোগ্য ও যুক্তিপূর্ণ। একসময়ে সমাজস্রোতের বিরুদ্ধতা করেও বাউলরা নিজেদের অস্তিত্ব আর স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখতে পেরেছিল সেই বিশিষ্ট সমাজ কাঠামোর জন্যই। আজ সেই সমাজ কাঠামো নিজেই বিধ্বস্ত তাই তার ঔদার্যের অভাবে বাউলরা অনিকেত। মূল সমাজ চরিত্র আজ পরিবর্তনের ঝড়ে দিশাহীন, তাই বাউলরা তাদের non conformist ভূমিকা থেকে সরে যেতে বাধ্য হয়ে নানা ধান্দা ও চাতুর্য এমনকী বৈদ্যুতিন যন্ত্ৰব্যবহারের কৃৎকৌশলে ক্রিয়াপর। একতারা আর এখন তাদের প্রতীক নয়, সহযোগী যন্ত্রও নয়—শো-পিস।

সহজধারার বাউল গায়ক আর তার মরমি শ্রোতাদের মধ্যে এখন রয়েছে বিভ্রম ও চমকের পরদা। চমকপ্রদ হওয়া এবং পেশাদারিত্ব অর্জন এখন বাউলের আচরিত কৃত্য। শ্রোতাদের মন এখন গভীরতা বা রহস্য অতলতার প্রত্যাশীও নয়। তারা তত্ত্ব চায় না, চায় তীব্র ঝোঁক আর দ্রুতচালের হালকা গায়নরীতি। রবীন্দ্রনাথ, ক্ষিতিমোহন, উপেন্দ্রনাথ, মনসুরউদ্দিন—কেউই বাউল গানের এত অবনমন দেখে যাননি। দেখে যাননি বাউল জীবন চর্যার অধঃপতন। হালফিল চারদিকে একটা নৈরাশ্যের পরিবেশ তৈরি হয়েছে। কয়েকটি সংলাপ এখানে উদ্ধৃত হচ্ছে প্রসঙ্গত।

মহিলা বাউল গায়িকা ননীবালাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, ‘বাউল মেলা মহোৎসবে যান? ননীবালার জবাব, ‘আগে যেতাম। এখন আর যাই না। গানের পরিবেশ নষ্ট হয়ে গেছে।’

কেঁদুলির মেলায় আদিত্য মুখোপাধ্যায় কয়েকজন সাধক বাউলের কাছে খাঁটি বাউলদের বিষয়ে জিজ্ঞাসা করেছিল। তার উত্তর পাওয়া গেছে নানারকম। যেমন—

‘বাউল কুথাগো ইখানে? ইখন তো ড্রেসের চমক আর খমকের কেরামতি’—

বলেছেন প্রবীণ রামেশ্বর দাস বাউল।

মনোহর দাসের উক্তি: ‘বাউল সুরের সেদিনই মৃত্যু হয়েছে, যেদিন বাউল একতারা ছেড়েছে।’

গায়ক পূর্ণদাসের গানের বিষয়ে জনৈক বাউলের টিপ্পনী : ‘পুন্ন আর বাউল কি গাইছে গো, বাউল গাইত নবনী দাস, পুন্নর বাবা।’

স্বয়ং পূর্ণদাসের স্বীকারোক্তি : ‘বিদেশীরা স্বীকৃতি দেবার আগে এবং সেখানে ব্যাপক প্রচার ও বিপুল সমাদরের পূর্বে আমাদের দেশে বাউল-সংস্কৃতি নিয়ে কেউ তেমন মাথা ঘামাননি।’

এবারে উঠবে এক গুরুতর প্রশ্ন—নবনীদাস বা তাঁর পুত্র ‘বাউল সম্রাট’ পূর্ণদাসকে কি আদপে বাউল বলা যাবে?

হঠাৎ কি এমনতর প্রশ্ন উঠল বলে মনে হচ্ছে? আসলে এটা একটা জারিত জিজ্ঞাসা, যা বহুদিন ধরে বহুবর্গের বাউলদের সঙ্গে মেলামেশা করতে করতে আমার মনের কোণে জেগেছে কিন্তু সমাধান করতে পারিনি। সমাধান করলাম বহুদিন পরে, মাত্র বছর কয়েক আগে। ঘটনাটা এইরকম।

সে সময় সিউড়ি শহরকে কেন্দ্র করে ঘুরছিলাম আশপাশের কয়েকজন বাউলদের সন্ধানে। জানা গেল সিউড়ির উপকণ্ঠে কেন্দুয়া পল্লিতে থাকেন সপরিবারে লক্ষ্মণদাস বাউল। লক্ষ্মণদাস, নামী মানুষ, কারণ নানা জায়গায় তাঁর গানের ডাক আসে, সরকারি অনুষ্ঠানেও, তার একটা কারণ তাঁর ঘরানা খুব অভিজাত। লক্ষ্মণদাস নবনীদাসের পুত্র, পূর্ণদাসের ভাই। বিদেশে গেছেন বেশ ক’বার, বিদেশিনী সংসর্গ করেছেন ব্যাপক— গায়ক-বাউলরা অনেকে তাঁর সৌভাগ্যে ঈর্ষাকাতর—কথাবার্তায় লক্ষ করেছি। তো এক গ্রীষ্মের বিকেলবিকেল গেলাম লক্ষ্মণদাসের বাড়ি—কেন্দুয়া পল্লিতে। বাড়তি একটা টান ছিল। শুনেছিলাম, জীবনের একেবারে শেষদিকে অসুস্থ ও বৃদ্ধ নবনীদাস বাউল আশ্রয় নিয়েছিলেন লক্ষ্মণদাসের ওই বাড়িতে—ওখানেই দেহ রাখেন। বাড়ির পাশে আছে তাঁর সমাধি।

লক্ষ্মণদাসের পল্লিকে একটা মোটামুটি বাউল পাড়া বলা চলে। নানা বয়সের বাউল ঘুরে বেড়াচ্ছে। ছোটখাটো তাদের কুটির। সকলেরই কেশ চুড়া করে বাঁধা, পরনে গেরুয়া অঙ্গবাস, গলায় নানারকম পাথুরে মালা। বেশ চমৎকার পরিবেশটি। আমার মনে পড়ল নদিয়া জেলার পরানপুরে এনায়েতউল্লা ফকিরের বাড়ির কথা। সেখানে অবশ্য গিয়েছিলাম এক যুবকের মোটর সাইকেলের পেছনে বসে। যুবকটি নানা কথা বলতে বলতে গাড়ি চালাচ্ছিল। বোঝাচ্ছিল দেশ কালের পরিস্থিতি, তার গ্রামের হালচাল। হঠাৎ একজন সাইকেল আরোহী ব্যক্তির আমরা মুখোমুখি। সে জিজ্ঞেস করল ভারিক্কি চালে, ‘আসছ কোথা থেকে? যাবে কোথায়?’

যুবকটি মোটর সাইকেল থামিয়ে বিনয় বচনে বলল, ‘ভাল আছেন কাকা? আসছি এখন নাজিরপুর থেকে, এঁকে পরান ফকিরের কাছে নিয়ে যাচ্ছি।’

‘বেশ বেশ’ বলে লোকটি চলে যেতেই ছোকরা বলল, ‘যাকে দেখলেন স্যার, ও হল এ দিগরের সবচেয়ে বড় ডাকাত। কী দিনকাল এসেছে ভাবুন।’

—কেন?

—ডাকাতের সঙ্গেও হেসে কথা বলতে হয়। কাকা বলেও ডাকতে হয়। খুব ঘেন্না ধরে যায় নিজের ওপর।

বাউল ফকিরের খোঁজে এসে ডাকাত দর্শন? পরে জেনেছি, বাউল ফকিরদের মধ্যে কেউ কেউ পূর্ব আশ্রমে ডাকাত ছিল। পরে অনুতপ্ত হয়ে সব ছেড়ে ছুড়ে ভক্ত বনে গেছে। সে কি পুলিশের হাত থেকে বাঁচতে ভোল পালটে একেবারে দেশান্তরী হওয়া? তা জানি না। তবে গতবছর মুর্শিদাবাদে এক ফকিরি গানের আসরে একজন দশাসই চেহারার গায়কের গান শুনছিলাম। বিশাল লম্বা চওড়া চেহারা, শক্ত গড়ন। কালো রঙের এক ঢাউস আলখাল্লা পরে ভাবাবিষ্ট হয়ে গান গাইছিল একতারা নিয়ে। যে বাড়িতে আসর বসেছে সেই গৃহস্বামী আমাকে কানে কানে বলেছিলেন— ‘কার রক্তে যে কে জন্মায়! এই যে গান করছে ইসমৎ ফকির, এর বাপ ছিল দুর্ধর্ষ ডাকাত—অন্তত পঞ্চাশ জনকে মেরেছে। এ ছোঁড়া কিন্তু ছোট থেকেই অন্যরকম—ঠান্ডা ভক্তিমান স্বভাবের। গান গাইতে গাইতে কাঁদে। বাড়ি ঘরদোর বউ ছেলে ছেড়ে ফকিরি নিয়েছে।’

এনায়েতউল্লা ফকিরের বাড়িতে একদিন একরাত বাস করে আমার চোখকান অনেকটা খুলে গিয়েছিল। বাউল ফকিরদের সম্বন্ধে হালকা ভাবাবেগ আর অকারণ মুগ্ধতা রয়েছে যাঁদের, তাঁদের উচিত এক আধরাত তাদের আস্তানায় কাটানো। এই যেমন এনায়েত ফকিরের ঘরে দেখছিলাম, চার-পাঁচটা ছোকরা নিমীলিত চোখে সশ্রদ্ধভাবে এনায়েতের সব কথা গিলছে। এরা হবু ফকির। খুব শিগগির ফকিরি পন্থা নেবে। কেন এই ধরনের কুড়ি থেকে পঁচিশ বছরের যুবকেরা ফকিরি পন্থায় আসছে— আজও আসছে— জানবার ইচ্ছে জাগল।

এনায়েতউল্লা আমাকে সম্পূর্ণ অবাক করে দিয়ে বললেন, ‘এরা আসে জন্মনিয়ন্ত্রণ শিখতে।’ আমার বাকস্কৃর্তি হচ্ছে না দেখে বোঝালেন, ‘মুসলমানদের ঘরে ঘরে, বিশেষত অশিক্ষিত গ্রাম সমাজে সন্তান সংখ্যা বেশি। তার ফলে চরম দারিদ্র্য আর অস্বাস্থ্য। এই যারা ফকিরি পথে আসতে চাইছে, এরা বিবাহিত, দু’-একটা সন্তানও হয়েছে। আর চায় না, তাই এ পথে আসছে। আমার কাছে দমের কাজ শিখতে পারলে সন্তান হবে না, এটা জানে। তাই পড়ে আছে।’

লক্ষ্মণদাসের বাড়িতে এসে এনায়েত ফকিরের কথা মনে পড়ল দুটো কারণে। প্রথমত, বাড়ির আশেপাশে যেমন বাউলদের দেখছি নানা বয়সের, তেমনি এনায়েতের বাড়ির ইতিউতি দেখেছিলাম ফকিরদের। ফকির পাড়া যেন। দ্বিতীয়ত, ফকিরের বাড়ির সামনে দেখেছিলাম একসার ইসলামি শৈলীর সমাধি, ছোট ছোট। এনায়েতের বাবা পাঁচুরুল্লা বিশ্বাসের কবর— আরও অনেকের। তার মানে মারফতি ফকির বলে গ্রামের ইসলামি কবরখানায় এঁদের স্থান হয়নি বা প্রতিবাদী চেতনা থেকে এঁরা নিজেরাই নিজের ভিটের আওতায় সমাধি দিয়েছে পূর্বজদের।

কেন্দুয়াতেও তাই। লক্ষ্মণদাসের বাড়ির পাশে বাউলদের সমাধিক্ষেত্র। সেখানে চিরনিদ্রাবৃত নবনীদাস বাউল। ভাবতেই বিহ্বল হয়ে পড়লাম। মানুষটার শেষ বয়সের চেহারা আমি দেখেছিলাম বহু পুণ্যফলে— সেকথা মনে পড়ল। ১৯৫৬ সালে কলকাতার বঙ্গ সংস্কৃতি সম্মেলনে গান গাইছিলেন নবনীদাস। দীনভিখারির বেশে কিন্তু উদ্দীপ্ত কণ্ঠে। পূর্ণদাসকেও ওই বছরে দেখি তবে নিজাম প্যালেসে। অসামান্য রূপ, অপূর্ধ চোখ, কপালে রসকলি, পরনে গেরুয়া। ঘুরে ঘুরে বৃত্তাকার নাচের সঙ্গে সেই চমৎকার যৌবনভরা কণ্ঠে গান আর তান। বীরভূমের গ্রামে গ্রামে মাধুকরী থেকে অবতীর্ণ হয়েছিলেন পূর্ণ একেবারে কলকাতার আলোকোজ্জ্বল আসরে—আগ্রহী মিডিয়ায়। নবনীদাস ফিরে গিয়েছিলেন স্বস্থানে— পূর্ণদাসকে আর ফিরতে হয়নি। ভাগ্য তাঁকে খ্যাতি বিত্ত প্রাসাদ দিয়েছে—তাঁর কণ্ঠের অক্ষম অনুকারক এখনও সারা বাংলায় ছড়ানো। তিনি এখন সংগত কারণেই ‘বাউল সম্রাট’। একজন লিখিত প্রশ্ন তুলেছেন : ‘সম্রাট শব্দটা তো সামন্ততান্ত্রিক। বাউলের নামের আগে এই শব্দটা বসে কি করে? অন্যরা এই উপাধি তাকে দিতে পারে। তারা অজ্ঞ। কিন্তু তিনি প্রতিবাদ করেছেন বলেও আমাদের জানা নেই!’ পূর্ণদাসের একটি ভিজিটিং কার্ডে লেখা আছে : Baul Samrat, Baul Kirtan Ratnakar, Baul Sagar (Benaras), Baul Mani of International fame, Lok Ragasree (Allahabad) মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন।

পূর্ণদাস আর লক্ষ্মণদাস সহোদর ভাই কিন্তু চেহারায় একেবারে মিল নেই, স্বাস্থ্যও আলাদা রকমের। গানের গলা আর জীবনযাপনও বেশ অন্যরকম বোঝা যায়। বিদেশিনীকে বাহুলগ্ন করে বেসামাল লক্ষ্মণদাসের গল্প অনেকে করে থাকেন। যাই হোক সেদিন কেন্দুয়ায় শেষ বিকালে লক্ষ্মণদাসকে পাওয়া গিয়েছিল আত্মস্থ অবস্থায়। নিতান্ত ভদ্র ও বিনয়ী মানুষ। তবে চেহারায় এক ধরনের ম্লানতা আর ক্লান্তির ছাপ। এ জাতীয় নানাদেশ ঘোরা পোড়খাওয়া প্রফেশনাল বাউলের সঙ্গে গভীর আলোচনা চলে না। এদের কাছে আমার জিজ্ঞাসা আর কীইবা থাকতে পারে? সাধনভজনের জীবন তো নয়। পূর্ণ বা লক্ষ্মণ নিজেরাই কবুল করেন : ‘আমার বাবার মধ্যে যেটা ছিল সেটা আমরা পাই নাই। তিনি ছিলেন বড় সাধক, ভাবুক মানুষ।’

সেটা জানেন বলে লক্ষ্মণদাসের মধ্যে চালাকি কম। ধীরে সুস্থে কথা চলছিল— নির্দিষ্ট কোনও লাইন ধরে বা তত্ত্বকথা নিয়ে নয়। গানের কথা, নবনীদাসের কথা…এখনকার বাউলদের পেশাদারি মনোভাবের কথা। আস্তে আস্তে কথা ঝিমিয়ে পড়ছিল। চা-বিস্কুট দিলেন ওঁর স্ত্রী, সাধারণ গ্রাম্য নারী। সন্তানরাও কাছাকাছি ঘুরে বেড়াচ্ছে। এবারে সন্ধ্যা নেমে এল। বাড়ির অন্দর থেকে বেজে উঠল সাঁঝবেলার শাঁখ। একটু চমকে গেলাম। বাউলের বাড়িতে শাঁখ? শঙ্খ ঘণ্টা প্রদীপ আরতি দেবারাধনা কখনও দেখিনি বাউলের বাড়ি। তাঁদের বিশ্বাসে ও আচরণে তো ওই বস্তুগুলি নেই। তবে?

লক্ষ্মণদাস কিছুটা কুণ্ঠিত ভঙ্গিতে বিনয় করে বললেন, ‘আপনারা বসুন—আমি একটু ভেতরে যাব, আধঘণ্টার মতো। সায়ংসন্ধ্যায় আমাদের ক্রিয়াকরণ থাকে তো!’

—আমরাও যেতে পারি তো?

—বিলক্ষণ। ভেতরে আসুন। ক্রিয়াকরণ দেখবেন?

সত্যি সত্যি কৌতুহল ছিল— বাউলের সান্ধ্য ক্রিয়াকরণ দেখার এমন সুযোগ হঠাৎ জুটে গেল। গেলাম বাউলের পিছু পিছু। ভেতরের ঘরের মধ্যে একটা উঁচু বেদিতে রাধাকৃষ্ণ মূর্তি। আমাকে সম্পূর্ণ বিস্মিত করে গমগম করে বেজে উঠল শঙ্খ ঘণ্টা কাঁসর এবং এমনকী একজন বাজাতে লাগল শ্রীখোল। ধূপ ধুনো জ্বলছে। একেবারে সাত্ত্বিক পরিবেশ। বাড়ির স্ত্রী-পুরুষ সকলেই কৃতাঞ্জলি করে আছেন। হরিধ্বনি হরিকীর্তনে সকলে সমস্বর। এ তো একেবারে বহুবার দেখা বৈষ্ণবীয় সন্ধ্যারতি। নবনীদাসের বংশ তবে কি বাউল নয়? জাতিবৈষ্ণব?

আরতির আসরে আমার মন চলে গেল কাটোয়া-পাটুলি-অগ্রদ্বীপ-দাঁইহাট-মাটিয়ারি আরও কত গ্রামে বৈষ্ণবদের, সহজিয়া আর জাতবৈষ্ণবদের আচার আচরণের স্মৃতির সরণি বেয়ে। মনে পড়ে গেল ক্ষিতিমোহন সেনের মন্তব্য কেঁদুলির মেলা সম্পর্কে … বাউল সম্পর্কে—‘আধা বৈষ্ণব আধা বাউল।’ এঁরা কি তাই? এবারে বিদ্যমকের মতো মনে পড়ে গেল শান্তিদেব ঘোষের একটি গভীর মন্তব্য। বহুদিন ধরে বহুজনকেই জিজ্ঞেস করেছি, রবীন্দ্রনাথ কেন বাউলদের সম্পর্কে উৎসাহ হারিয়েছিলেন? কেন তিনি কখনও যাননি বোলপুরের অত কাছে জয়দেব-কেঁদুলিতে? বীরভূমের বিখ্যাত বাউলদের সম্পর্কে কেন এক পঙ্‌ক্তিও ব্যয় করেননি? কারুর কাছে সদুত্তর পাইনি। শুধু শান্তিদেব ঘোষ বলেছিলেন, ‘বাউল গান বাউল নাচ সবই খুব ভালোবাসতেন গুরুদেব। কিন্তু বীরভূমের বাউল সম্পর্কে ওঁর উৎসাহ ছিল না কেন জানেন? ওরা বাউল নয় ঠিক, বরং সহজিয়া বৈষ্ণব। বাড়িতে রাধাকৃষ্ণ বিগ্রহ আছে। গুরুদেব বিগ্রহপুজোর বিরোধী ছিলেন। তাই যাননি।’

আরতির শেষে বাইরের বারান্দায় আবার এসে বসলাম সকলে। বিজলিবাতি জ্বলে উঠল। কিন্তু ততক্ষণে আমার মনের সুর কেটে গেছে। লক্ষ্মণদাসের পক্ষে সেটা বোঝা কঠিন। তিনি সহাস্যে বললেন, ‘দেখলেন তো আমাদের সন্ধ্যারতি, কেমন লাগল? আর কিছু জিজ্ঞাসা আছে আপনার?’

বললাম, ‘ভালই তো। না, আর কিছু জানবার নেই বিশেষ। কেবল একটাই প্রশ্ন আছে, আপনাদের গোত্র কী?’

—আমরা অচ্যুতানন্দ গোত্রের।

আমার প্রশ্ন শেষ, উত্তরও একেবারে যথাযথ, মানে যেমন ভেবেছিলাম। অচ্যুতানন্দ গোত্রই তো ভেবেছিলাম। বাংলার সব সহজিয়া আর জাতিবৈষ্ণবের একই গোত্র— অচ্যুতানন্দ। কিন্তু বাউলের তো কোনও জাত নেই, গোত্র নেই, তবে এরা কী? বাউল না বৈষ্ণব? নাকি আধা বাউল আধা বৈষ্ণব? এর উত্তর প্রকৃতপক্ষে পাওয়া খুব সহজ নয়। তবে বাউল আর বৈষ্ণব সম্ভবত দুটি আলাদা পথ। যেমন লিখেছেন দুদ্দু শাহ :

বাউল বৈষ্ণব ধর্ম এক নহে তো ভাই

বাউল ধর্মের সাথে বৈষ্ণবের যোগ নাই।

বিশেষ সম্প্রদায় বৈষ্ণব

পঞ্চতত্ত্বে করে জপতপ

তুলসী মালা অনুষ্ঠান সদাই।

বাউল মানুষ ভজে

যেখানে নিত্য বিরাজে

বস্তুর অমৃতে মজে

নারী সঙ্গী তাই।

লালন-শিষ্য দুদ্দু শাহ-র text অতীব প্রাঞ্জল ও নির্দেশক। বাউলদের সঙ্গে বৈষ্ণবদের কোনও সম্পর্ক নেই এই বিশ্বাস খাঁটি বাউলদের— কেননা তারা নারীপুরুষে যুগল দেহসাধনা করে গুরু বা মুর্শিদের দেখানো পদ্ধতিতে। তাদের লক্ষ্য বীর্যের স্থায়িত্ব সাধন এবং ঊর্ধ্বরেতা হয়ে কাম থেকে প্রেমে উত্তরণের আনন্দে আবিষ্ট থাকা। মানবদেহের অন্তর্গত বীর্য ও রজ নিয়ে তাদের সাধনা, সেটা কোনও অলীক অনুমানের নয়, দেবদেবতানির্ভর নয়, নরনারীর বাস্তব শরীরনির্ভর—তাই তাদের এক অর্থে বলা যায় বস্তুবাদী (‘বস্তু’ মানে পিতৃবস্তু ও মাতৃবস্তু) এবং মানববাদী। তাই ‘সবার উপরে মানুষ সত্য’। তারা এতদূর বলে,

যে বস্তু জীবনে কারণ

তাই বাউল করে সাধন।

অর্থাৎ তাদের সাধনা রাধাকৃষ্ণের বিগ্রহ পূজা নয়, নিজের শরীরের অন্তঃস্থিত পদার্থকে সংরক্ষণ। সেই বিশ্বাস এত প্রবল যে গয়া কাশী বৃন্দাবন নবদ্বীপ সবই তাদের কাছে অসার। তারা মনে করে :

জীবনই তীর্থ ধর্ম পথ

এই কথা বাউলের মত।

তীর্থ বলতে বাউলরা কোনও স্থানবিশেষকে বোঝে না। এই শরীরেই আছে মক্কা মদিনা, এখানেই মথুরা বৃন্দাবন—তবে আর কেন তীর্থে যাওয়া? স্পষ্ট করে বরং এইরকম ভাবা সহজ যে,

শুক্র ধাতু ভবেৎ পিতা

রজ ধাতু ভবেৎ মাতা

শূন্য ধাতু ভবেৎ প্রাণঃ

তার মানে রজবীর্যে গঠিত মানবদেহ, অনুমানের বিষয় নয়—একেবারে বাস্তব। আর প্রাণ? প্রাণ আসে শূন্য থেকে। তা হলে এই মানুষেই আছে সেই মানুষ—পিতার মধ্যেই পুত্র। বাউলতত্ত্বের এটাই মূল বিশ্বাস। সেইজন্যেই পিতৃবস্তু বা বীর্যকে অযথা ক্ষয় করা উচিত নয়—তাকে সংরক্ষণ করে অটল করতে হবে। সেই অটলই হল অধরমানুষ বা আলেক সাঁই। তার আরেক নাম ‘মনের মানুষ’। বাউল আর্তি করে বলছে: ‘আমি কোথায় পাবো তারে?’ তারে অর্থাৎ মনের মানুষ যে, তাকে। সে তো একমাত্র নরনারীর দেহযোগে পাওয়া যায়— সঠিক সাধনপথে, সেই পথ দেখিয়ে দেন গুরু বা মুর্শিদ। সে কারণেই নিতে হবে দীক্ষা, তারপরে শিক্ষা। যে শিক্ষায় কামকে এড়িয়ে নয়, পেরিয়ে, পেতে হবে প্রেমানন্দ। ‘কামে থেকে হও নিষ্কামী’ তাদের প্রতি নির্দেশ। অপক্ক দেহকে কর পক্ক। তার জন্যেই ভজন সাধন। সে সাধন মানে মন্ত্র জপ ধ্যান নয়। শরীরী সাধন। তারা প্রশ্ন তুলেছে—

ব্রজে ভজিল গোপী সাক্ষাৎ ভজনে

আমরা কেন ভজি অনুমানে?

অনুমানে করে ভজন যত সব অজ্ঞানে।

অতএব অনুমানের ভ্রান্ত পথ নয়, ধরো বর্তমানের দিশা। সেই দিশা পেলে বোঝা যাবে কোনও পুরাণপ্রসিদ্ধ দেবতা উপাস্য নয়, তবে তার স্বরূপ কি?

আমি নই অযোধ্যারই রাম

নই বৃন্দাবনের শ্যাম

সহজ থেকে বলছে ডেকে

সহজ আমার নাম।

বাউল মত হচ্ছে সহজকে অর্জন করবার কঠিন পথ। সেখানে বৈষ্ণবদের মতো তুলসী মালা, মালসাভোগের অনুষ্ঠান, তুলসী পাতা, গঙ্গাজল, পঞ্চতত্ত্ব—কিছুই লাগে না। শুধু লাগে সিদ্ধ দেহ ও মুক্ত মন। উপবাস, মন্ত্রজপ বা দেবতার বিগ্রহ লাগে না। শুদ্ধ প্রেমকে পেতে গেলে কামনাকে অঙ্গীকার করতে হয়। লালন যেমন বলেন,

শুদ্ধ প্রেম সাধলে যদি কাম-রতিকে রাখলে কোথা?

আগে উদয় কামের রতি

রস-আগমন তারি সাথী

সেই রসে হয়ে স্থিতি

খেলছে মানুষ দেখগে তোরা।

দেহকে নিয়ে দেহোত্তীর্ণ হওয়া, যাকে কেউ কেউ বলে ‘জ্যান্তে মরা’, বাউলের পরম অন্বিষ্ট।

তাই বলে এমন ভাবাও ঠিক নয় যে বাউল আর বৈষ্ণবে মুখ দেখাদেখি নেই বা সর্বদা লেগে আছে বিবাদ বিসংবাদ। আসলে লোকধর্মের মধ্যে সবসময়ে চলে পারস্পরিক দেওয়া নেওয়া—সমালোচনা আবার স্বীকরণ। একটু আগে যে ‘বাউল আর বৈষ্ণব এক নহে তো ভাই’ পদটি আমরা দেখলাম সেখানে বৈষ্ণব বলতে নৈষ্ঠিক বৈষ্ণবদের বোঝানো হয়েছে। সেই নৈষ্ঠিক ধর্ম ভেঙে আরও কত রকম লৌকিক বৈষ্ণবমত গড়ে উঠেছে তার হিসেব রাখা কি সহজ? তবে লোকায়ত বৈষ্ণবদের প্রধান দুই ধারা— সহজিয়া বৈষ্ণব আর জাত-বৈষ্ণব। এর বাইরে আছে রাধাশ্যামী, রূপকবিরাজী, চরণদাসী, হরিবোলা, গুরুদাসী, খণ্ডিত বৈষ্ণব, করণ বৈষ্ণব, বৈষ্ণব তপস্বী, কিশোরীভজনী, টহলিয়া বা নমো বৈষ্ণব ও চামার বৈষ্ণব। এরা সব গৌণ ধর্মী এবং নিম্নবর্গের মানুষ নিয়ে সংগঠিত। বাইরে থেকে তফাত বোঝার উপায় নেই— কেবল ক্রিয়াকরণে পৃথক এরা। বাউল দুদ্দু শাহ-র ধারণা—

নদের গোরা চৈতন্য যারে কয়

সে শাক্ত ভারতীর কাছে শক্তি মন্ত্র লয়।

এ হল একটা লোকায়ত বিশ্বাস যে, শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য শাক্ত কেশবভারতীর কাছে কিছুটা শক্তি সাধনায় দিশা নিয়েছিলেন। তার মানে মূল বৈষ্ণব ধর্ম অবিমিশ্র নয়, তাতে অন্য ভাবনা ও ক্রিয়াকরণের মিশেল ঘটেছে। পদে এবারে বলা হয়েছে :

পরে গিয়ে রামানন্দের কাছে

বাউল ধর্মের নিশানা খোঁজে—

তবে তো মানুষ ভজে

পরমতত্ত্ব পায়।

কেশবভারতীর কাছে শাক্ত দীক্ষাতেই শেষ নয়, মহাপ্রভু তারপর রায় রামানন্দের কাছে নিলেন বাউল মতের খোঁজ এবং সেই সুবাদে পেলেন মানুষজনের নতুন পথ—যা হল পরমতত্ত্ব অর্থাৎ নরনারীর যুগল-ভজন। মহাপ্রভুর আগে চণ্ডীদাস (তিনিও নাকি বাউল) বলেছিলেন ‘সবার উপরে মানুষ সত্য’। সেই ইঙ্গিত দিয়ে দুদ্দু শাহ এবারে বলছেন:

বাউল এক চণ্ডীদাসে

মানুষের কথা প্রকাশে

সেই তত্ত্ব অবশেষে বৈষ্ণবেরা নেয়।

তার মানে বৈষ্ণব ধর্মের অনেক আগে ছিল বাউলতত্ত্ব, সেই চণ্ডীদাসের পদে। সেই আদিবাউল চণ্ডীদাস যে মানুষতত্ত্ব প্রকাশ করেছিলেন সেই তত্ত্ব শেষ পর্যন্ত নেয় একদল বৈষ্ণব। আর যেসব বৈষ্ণব নেয়নি সেই মান্যতত্ত্ব, তারা হল মর্কট বৈরাগী।

মর্কট বৈরাগী যারা

এক অক্ষরও পায় না তারা

গীতা ভাগবত শাস্ত্র পড়া পণ্ডিত সবায়।

এই মর্কট বৈরাগীরা মানুষতত্ত্ব তথা বাউলতত্ত্ব না নিয়ে গীতা ভাগবত আর শাস্ত্র পড়া নীরস পণ্ডিত বনে গেছে। আর একদল আচরণবাদী বৈষ্ণব, তারা কেমন?

তিলক মালা কৌপীন আঁটার দল

জানে শুধু মালসাভোগের ছল

দিনরাত কিছু না বুঝে

মালা জপে যায়।

বৈষ্ণবদের সম্পর্কে সঠিক দৃষ্টিকোণ অর্জন করতে গেলে আমাদের একটু ইতিহাস ঘাঁটতে হবে। বেশির ভাগ লোকের ধারণা, শ্রীচৈতন্যদেব গৌড়বঙ্গে বৈষ্ণব ধর্ম প্রতিষ্ঠা ও প্রচার করেন। কথাটা অর্ধসত্য, কারণ নবদ্বীপ তথা গৌড়বঙ্গে তিনি তো বৈষ্ণব আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে পারেননি, চলে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন নীলাচলে। নবদ্বীপে মাত্র তেরো মাস মতো সময় তিনি আন্দোলন সংগঠন করেছিলেন, তারপরই সন্ন্যাস নিয়ে গৃহত্যাগ করেন। শিষ্য পরিকরগণ তখনও দায়িত্ব নেবার যোগ্যতা অর্জন করেননি। অদ্বৈতাচার্য বদ্ধ বলে নেতৃত্ব দেবার পক্ষে অযোগ্য ছিলেন। তাঁর শিষ্য ঈশান আর দুই শিষ্য কৃষ্ণদাস ও শ্যামাদাস, অদ্বৈত-র পত্নী সীতাদেবী আর তার সন্তান অচ্যুতানন্দ বৈষ্ণবধর্ম প্রচার করতে লাগলেন নিজের মতো করে। কোনও কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব বা নির্দেশ ছিল না। এই সময় থেকেই বাংলার বৈষ্ণবধর্মে নানা খণ্ডিত মত ও উপদলের সৃষ্টি হতে থাকে প্রধানত আচরণবিধির পার্থক্য থেকে। নানা জায়গায় বৈষ্ণবকেন্দ্র গড়ে উঠল। তার একটা শান্তিপুরে, একটা বাঘনাপাড়ায়, একটা খড়দহে, একটা নবদ্বীপে। এঁদের কেউ ব্রাহ্মণ্যবিরোধী, কেউ ব্রাহ্মণদের সঙ্গে আপোষকামী, কেউ শূদ্রদের বৈষ্ণবভুক্তির ব্যাপারে তৎপর। এঁদের এক একটা আলাদা তত্ত্ব ও বিশ্বাস ছিল। কেউ সরাসরি চৈতন্যপূজক, কেউ গৌরনগরবাদের প্রচারক, কেউ গদাইগৌরাঙ্গ তত্ত্বে বিশ্বাসী, কেউ গৌর-বিষ্ণুপ্রিয়ার উপাসক, কেউ রসরাজ সম্প্রদায় বলে নিজেদের পরিচয় দিত। অত অনুপুঙ্খে আমাদের যাবার দরকার নেই। আমরা কেবল বাউল উৎসে বা বিবর্তনে বৈষ্ণবদের সংযোগ খোঁজার চেষ্টা করব।

স্পষ্টত বৈষ্ণবদের নানা দল উপদল থাকলেও নিত্যানন্দ আর তাঁর পুত্র বীরভদ্র প্রধানত কাজ করেছিলেন অন্ত্যজ ও ব্রাত্যদের বৈষ্ণব সমাজে অন্তর্ভুক্ত করতে। তাঁদের ডাকে ব্যাপক সাড়া পড়েছিল। গৌড়বঙ্গে যে বিপুল পরিমাণ আত্মগোপনকারী নিম্নবর্গের বৌদ্ধ ছিল, যাদের বলা হত নেড়ানেড়ি, তাঁদের নিত্যানন্দ বা মতান্তরে বীরভদ্র ধর্মান্তরিত করেন। বৈষ্ণব মতে দীক্ষা নেবার সময় তাঁরা কেশমুণ্ডন করেছিলেন বলে তাঁদের নেড়ানেড়ি বলত সবাই। কথাটা পরে হীনার্থবাচক হয়ে পড়ে এবং নেড়ানেড়িদের বৈষ্ণবরা ততটা সম্মান করেনি বলে তাদের অনেকে বাউল পথে চলে যায়, অনেকে হয় ফকির। এই ফকিরদের ‘নাড়ার ফকির’ বলা হত বলে অনেকে বিশ্বাস করেন।

এদিকে চৈতন্যদেবের বাংলা ত্যাগের পর এবং পরে তাঁর অপ্রকটকালে বৃন্দাবনে গড়ে উঠছিল একটি বৈষ্ণবকেন্দ্র— তার সংগঠনে ছিলেন ছ’জন নৈষ্ঠিক বৈষ্ণব, তাঁদের বলা হয় ষড়গোস্বামী। এঁদের নাম রূপ ও সনাতন, তাদের ভাইপো জীব গোস্বামী, গোপাল ভট্ট, রঘুনাথ ভট্ট ও রঘুনাথ দাস। এঁদের মধ্যে রঘুনাথ দাস বাদে বাকি পাঁচজন ব্রাহ্মণ ও সংস্কৃত পণ্ডিত এবং পাঁচজনেই মূলে দক্ষিণ ভারতীয়। পাঁচজনের মধ্যে রূপ ও সনাতন ছিলেন গৌড়ের সুলতান হুসেন শাহের মন্ত্রী—উচ্চবর্গের আমলা। এঁরা দুজন এবং ভাইপো জীব গোস্বামী গৌড় থেকে বৃন্দাবন চলে গিয়ে কোনওদিন আর ফেরেননি৷ গোপাল ও রঘুনাথ ভট্ট কোনওদিন গৌড়বঙ্গের মুখই দেখেননি। অথচ চৈতন্য-তিরোধানের পর এঁদের ওপর বৃন্দাবনকেন্দ্রিক বৈষ্ণব আন্দোলনের নেতৃত্ব এসে পড়ে। বাংলার জনমানস ও সংস্কৃতির ওপর চাপিয়ে দেওয়া হল বৃন্দাবনী তথা উচ্চ ব্রাহ্মণ্য ভাবাদর্শ। গোপাল ভট্ট ব্রাহ্মণ্য ভাবাদর্শে লিখলেন বৈষ্ণবদের আচরণীয় স্মৃতিশাস্ত্র— যার নাম ‘হরিভক্তিবিলাস’।

বৃন্দাবনের বৈষ্ণবীয় অনুশাসন গৌড় বাংলার মূল বৈষ্ণব আদর্শের মুখকে একেবারে অন্য দিকে ঘুরিয়ে দিল। আচণ্ডালকে উদার ধর্মপরিবেশে ও মানবস্বীকৃতিতে আহ্বান করতে চেয়েছিলেন চৈতন্যদেব, ভাঙতে চেয়েছিলেন শাস্ত্র ও ব্রাহ্মণদের একাধিপত্য, করেছিলেন জাতিবর্ণ নির্বিশেষে পতিতদের উদ্ধার। ‘হরিভক্তিবিলাস’ সেই বৈষ্ণবীয়তাকে করে দিল শুদ্ধতাবাদী, ব্রাহ্মণ্যমুখী ও বর্ণাশ্রমী। তাঁদের নির্দেশ ছিল : ব্রাহ্মণ-বৈষ্ণব সবাইকে দীক্ষা দেবে, অব্রাহ্মণের থাকবে না দীক্ষাদানের অধিকার। অনুলোম প্রথা চলবে অর্থাৎ সামাজিক স্থিতাবস্থা— যে যেখানে ছিল সে সেখানেই থাকবে।

অদ্বৈত-নিত্যানন্দ-শ্রীবাস-গদাধর জাতীয় প্রত্যক্ষ চৈতন্য সঙ্গকারীরা কেউই বৃন্দাবনের সঙ্গে সংস্রব রাখতেন না। কিন্তু তাঁদের পরের প্রজন্মের অনেকে বৃন্দাবনের গোস্বামীদের কাছে নীতি-নির্দেশ নিতে থাকলেন এবং বৃন্দাবন হয়ে উঠল প্রধান বৈষ্ণবীয় কেন্দ্র। বৃন্দাবনে যেতেন যাঁরা, তাঁদের মধ্যে প্রধান ছিলেন— নিত্যানন্দের পত্নী জাহ্নবাদেবী, শ্রীনিবাস আচার্য, শ্যামানন্দ, নরোত্তম দত্ত, উদ্ধারণ দত্ত, রামচন্দ্র, গৌরীদাস পণ্ডিত, পরমেশ্বর দাস, গোবিন্দদাস কবিরাজ, রামচন্দ্র কবিরাজ। তবু এটা বুঝতে খুব অসুবিধে নেই যে, কেন্দ্রীয় নির্দেশ সকলের পক্ষে গ্রহণযোগ্য হবে না। সপ্তদশ শতকে বাংলার বৈষ্ণবরা নানাভাগে ভাগ হয়ে গিয়েছিল। সেই ভাগ হবার কারণ দুটি। এক, উপাসনা এখানে কেউ করতেন সখাভাবে, কেউ দাস্যভাবে, কেউ রাধাভাবে— ‘হরিভক্তিবিলাস’ নির্দেশ দিল একমাত্র সখীর সখী মঞ্জরিভাবে উপাসনার— সেটি সকলের মনঃপূত হয়নি। দুই, যে-কোনও জাতিবর্ণের বৈষ্ণব ছিলেন দীক্ষাদানের অধিকারী, সে অধিকার খর্ব হল— তাও মনঃপূত হবার কথা নয়। এইখানে অর্থনৈতিক প্রশ্ন ছিল— যার সঙ্গে জড়িত গুরুবাদ। কথাটি বুঝিয়ে বলেছেন, ‘জাতবৈষ্ণব কথা’ বইয়ে অজিত দাস, এইভাবে :

অর্থনৈতিক কারণে দল-উপদল তৈরির প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছিল বিশেষভাবে। বৈষ্ণব-আন্দোলন হোম-যজ্ঞ-পুজো-পুরোহিত প্রথা বাতিল করেছিল। কিন্তু তার স্থলে প্রবর্তিত হল গুরুবাদ। গুরু ছাড়া দীক্ষা নেই, মুক্তি নেই। ঘরে বসে হাতে তালি দিয়ে নামগান করলেই মুক্তি মিলবে না আর। পথপ্রদর্শক গুরু চাই। গুরু ঈশ্বরতুল্য। পুরোহিতের দক্ষিণা দেওয়ার মতো গুরুকে প্রণামী দেওয়া অবশ্য কর্তব্য। নইলে গুরুই বা জীবনধারণ করবেন কীভাবে? শিষ্যের বাড়িতে জন্ম-মৃত্যু-বিবাহের অনুষ্ঠানের সময় গুরুবরণ গুরুপ্রণামী বাঁধা। শিষ্যের সামর্থ্যানুযায়ী গুরুপ্রণামী। সেটা পাঁচ সিকা থেকে একটি জমিদারি অবধি হতে পারে প্রাপ্তি।

তাহলে যিনি যত শিষ্য করতে পারবেন, তাঁর তত আর্থিক নিশ্চয়তা বাড়বে, সাংসারিক দুর্ভাবনা কমবে। প্রধান গুরুর অধীনে সহকারী গুরুর হিসাবে কাজ করলে মূল গুরুকে প্রণামীর সিংহভাগ দিতে হয়। স্বাধীন স্বতন্ত্রভাবে গুরুগিরি করতে পারলে আর কাউকে ভাগ দিতে হয় না। তাই দল ভেঙে উপদল। এক থেকে বহু।

বোঝা গেল গুরুবাদ ও অর্থনীতি বৈষ্ণবদের বিভাজনে একটা বড় সূত্র তবে নিশ্চয়ই প্রধান নয়। অশ্য সপ্তদশ শতকে নানা মতে বিভক্ত, নানা গৌণ সম্প্রদায়ী আচরণে বিশ্বাসী বহুতর বৈষ্ণব রাজশাহীর খেতুরিতে সমবেত হয়ে যে-মহোৎসব করে সেখানে ব্রাহ্মণেতরদের দ্বারা দীক্ষাদানের তথা গুরুগিরির প্রশ্ন ওঠে এবং খানিকটা মীমাংসাও হয়। পরে কেউ কেউ স্বাধীনভাবে সম্প্রদায় ও তার আচরণবিধি গড়ে তোলে। সে সময়ে বৃহৎ ছিল গৌড়বঙ্গ, সারাদেশে ভৌগোলিক যোগাযোগ ছিল দুর্বল। আখড়াধারী বাবাজি সম্প্রদায় আর গৃহী বৈষ্ণবদের মধ্যে ধর্মাচারের নানা ধরন গড়ে উঠতে থাকল। কত যে উপসম্প্রদায় (নৈষ্ঠিক বৈষ্ণবদের ভাষায় ‘অপসম্প্রদায়’, ‘পাষণ্ড’) ও সহজিয়া স্রোত বইতে লাগল সপ্তদশ-অষ্টাদশ শতকের নানা সময়ে তার হদিশ এখন পাওয়া কঠিন। দক্ষিণী ব্রাহ্মণ তোতারাম ছিলেন বিষ্ণু উপাসক, অষ্টাদশ শতকে থাকতেন নবদ্বীপে। বৈষ্ণবদের শাখাপ্রশাখার শ্রীবৃদ্ধি দেখে ব্যথিত হয়ে তোলারাম বলেছিলেন :

আউল বাউল কর্তাভজা নেড়া দরবেশ সাঁই।

সহজিয়া সখীভাবুকী স্মার্ট জাত গোঁসাই ॥

অতিবড়ী চূড়াধারী গৌরাঙ্গনাগরী।

তোতা কহে এই তেরোর সঙ্গ না করি ॥

তেরোটি গৌণসম্প্রদায়ের মধ্যে আউল-বাউল-দরবেশ-সাঁই এমন কায়াবাদী সাধনার পাশে সহজিয়া আর জাত-বৈষ্ণবদের (যা বৈষ্ণবতার উপজাত) প্রতি অনাস্থা লক্ষণীয়। পরে এই সব উপসম্প্রদায় ক্রমে সংখ্যায় ও আচরণবাদের বৈচিত্র্যে বেড়ে গেছে। নৈষ্ঠিক বৈষ্ণবদের ধিক্কার তাদের প্রতিহত করতে পারেননি। তোতারাম আবারও খেদোক্তি করেছেন:

পূর্বকালে তেরো ছিল অপসম্প্রদায়।

তিন তেরো বাড়ল এবে ধর্ম রাখা দায় ॥

তিন তেরো উনচল্লিশটি অপসম্প্রদায়ের চাপে মূল গৌড়ীয় বৈষ্ণব শাখা বিপন্ন হয়েছিল এতে সন্দেহ নেই। ‘বৈষ্ণব ব্রতদিন নির্ণয়’ বইতে আরও অনেক গৌণধর্মীদের তালিকা আছে।

আমরা সেই বিস্তারে না গিয়েও মূল সত্যে পৌঁছতে পারি। সেটা এই যে, ব্রাহ্মণ্যলক্ষ্য মৌল বৈষ্ণবদের ধিক্কার ও সক্রিয় বাধা সত্ত্বেও বাংলার সমাজবিন্যাসে গৌণধর্মবিশ্বাসের ও করণকারণের রবরবা দেখা দিল। গুরু-শিষ্য, পির-মুর্শিদ, বাবাজি, আখড়াধারী, গৃহী— নানাস্তরে নানাভাবে চুইয়ে পড়তে লাগল চৈতন্যের সাম্যমন্ত্র। সমান্তরাল কাঠামোয় গড়ে উঠল গুরুবাদ ও ধনসম্পদ। সেই শক্তি থেকে স্বতন্ত্র শাস্ত্র, বিশ্বাস ও মন্ত্রতন্ত্র গড়ে উঠল। জেগে উঠল গান— দেহতত্ত্বের ও মনঃশিক্ষার, গুরুবন্দনা ও দৈন্যবোধের। পতিতা, বিধবা, স্বামী পরিত্যক্তাদের আশ্রয় জুটে গেল আখড়ায়— তাঁরা মান পেলেন। কায়াসাধনের সূত্রে বিকৃতি ও যৌন-স্বাধীনতার পথও কিছুটা অবারিত হল।

এইখানে একটা ভুল ধারণার অবসান ঘটানো দরকার। জাত-বৈষ্ণব বা সহজিয়া বৈষ্ণবদের সকলেই যে নিম্নবর্ণজাত বা অন্ত্যজ তা নয়। হয়তো তারা একটা গরিষ্ঠ অংশ কিন্তু ব্রাহ্মণ কায়স্থ নবশাখ বেনে আর মাহিষ্য সম্প্রদায় এদের মধ্যে অনেক ছিল। সহজিয়াদের ছিল নানা ধরনের সাধন-পদ্ধতি (কাটোয়া-স্রোত, পাটুলি-স্রোত, রূপ কবিরাজী ইত্যাদি) ও গুহ্যাচার— কেউ কেউ দুইচাঁদ বা চারচাঁদের করণ করতেন। তাই তাদের সঙ্গে বাউলদের কিছু কিছু ব্যাপারে মিল ছিল। জাত-বৈষ্ণবদের একটা অংশ ছিল ভক্তিমান গৃহস্থ আরেক অংশ আখড়াকেন্দ্রিক বাবাজি-সেবাদাসী সম্প্রদায়।

অজিত দাস তাঁর বইতে জাতবৈষ্ণব সমাজের সংখ্যাবৃদ্ধির ব্যাপকতার একটি হিসাব দিয়েছেন। ১৮৭৯ সালে অর্থাৎ ঊনবিংশ শতকের শেষের দিকে জাত-বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের সদস্য মেদিনীপুরে ছিল ৯৬,১৭৪ জন, বর্ধমানে ২৬,০০০ এবং হুগলিতে ১২,১০৭ জন। ১৮৮১ সালের সেন্সাস রিপোর্ট বলছে, সারা বাংলায় জাত-বৈষ্ণব ছিল, ৫,৬৮,০৫২। এই সংখ্যা নিষ্ঠাবান বৈষ্ণবদের পক্ষে চিন্তা ও উদ্বেগজনক। তাঁদের গোঁড়া দৃষ্টিভঙ্গিতে জাত-বৈষ্ণবরা বিকৃত হলেন। বিপিনচন্দ্র পাল বলেছেন, জাত-বৈষ্ণবরা সমাজবহির্ভূত। নৈষ্ঠিকরা মনে করতেন ১) ওরা ব্রাহ্মণদের কাছে অস্পৃশ্য। ২) ব্রাহ্মণ্যবাদ নির্দেশিত আচার মানে না। ৩) বিয়ে হয় মালাচন্দনে। ৪) বিবাহের অনুষ্ঠান এত সরল যে বৈধ মনে হয় না। ৫) ওদের মধ্যে বিবাহ ছাড়া সঙ্গম স্বাভাবিক ও বৈধ। ৬) ফলত ওরা জারজ এবং ৭) পরিণামে জাতবৈষ্ণবরা এক ভিক্ষুক সম্প্রদায়। সমাজে অধঃপতিত ও নিন্দাযোগ্য।

রমাকান্ত চক্রবর্তী তাঁর বিশ্লেষণে দেখিয়েছেন গোঁড়া দৃষ্টিভঙ্গির কারণেই শুধু নৈষ্ঠিকরা জাত-বৈষ্ণবদের বিরোধিতা করেননি। তাঁর মতে,

গোঁড়ামির কারণেই জাত বৈষ্ণবদের ওপর খাপ্পা হয়নি ব্রাহ্মণ-বৈষ্ণব সমাজ। নিজেদের গোঁড়ামির জন্য তারা সকলকে শিষ্য করতে না পারায় আর্থিক দিক থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছিলেন। জনসংখ্যা বাড়ছিল শহরে এবং সাধারণ ব্যবসায়ী আর সাধারণ মানুষের হাতে পয়সা আসছে, তাদের শিষ্য করতে না পারায় গুরু প্রণামীর আয় হচ্ছে না। সেটা বাবাজীরা গেয়ে যাচ্ছে। তাই উচ্চবর্ণের গুরুরা তাঁদের ধনী শিষ্যদের বাবাজীদের হাত থেকে রক্ষা করতে অপপ্রচার করতে বাধ্য হতেন যে বাবাজী আর নিম্নবর্ণের বৈষ্ণবরা অস্পৃশ্য।

সেই কুৎসা ও অনুশাসনে যখন কাজ হল না, তখন বিধান জারি করলেন,

ব্রাহ্মণগুরু দিয়ে গৌড়ীয় বৈষ্ণব মতে দীক্ষা নিতে হবে। অথবা উচ্চবর্ণের (অব্রাহ্মণ) ভেকধারী গৌড়ীয় বৈষ্ণব দিয়ে দীক্ষা নিতে হবে। অথবা উচ্চবর্ণের গৌড়ীয় বৈষ্ণব গৃহীগুরু হলেও হবে। জাতবৈষ্ণবরা নিম্নবর্ণ বা অস্পৃশ্য সমাজ থেকে আগত। ওরা গৌড়ীয় বৈষ্ণব নয়।

জাত-বৈষ্ণব গুরু আর সহজিয়া স্রোতের গুরুরা এ নির্দেশ মানবেন কেন? কাজেই অচিরে বাংলাব্যাপী গ্রাম্য জনসমাজ দলে দলে দীক্ষিত হতে থাকল গৌণধর্মে। তার মধ্যে একটা হল বাউলপন্থা, যাদের মধ্যে সহজ বৈষ্ণবপস্থা অলক্ষ নয়।

একটা চালু কথা গৌণ সম্প্রদায়ীদের সঙ্গে মিশলে জানা যায়, সেটা হল, এ-জাতীয় গুহ্য সাধনার চারটি স্তর : প্রবর্ত-সাধক-সিদ্ধ-সিদ্ধের সিদ্ধ। শিষ্য যখন গুরুর কাছে লোকায়ত সাধনার মানসে দীক্ষা নিতে আসে তখন বেশ কিছুকাল, ধরা যাক বছর খানিক, গুরু তাকে বলেন আখড়ায় আসাযাওয়া করতে, বাহ্য ক্রিয়াকরণের ব্যাপার-স্যাপার দেখতে, অন্যান্য গুরুভাইদের বাড়ি যেতে এবং সম্প্রদায়ের মেলা মহোৎসব, গুরুর জন্মদিন বা দিবসী উৎসবে যোগ দিতে। এ প্রসঙ্গে শিষ্যর নিষ্ঠা, একাগ্রতা ও আগ্রহ গুরু লক্ষ করেন। শিষ্যর স্বভাবনম্রতা, সেবাপরায়ণতা বা অনুরাগ নানা ঘটনায় প্রমাণিত হলে গুরু পরিতুষ্ট হন এবং তখন তিনি শিষ্যকে মন্ত্রদীক্ষা দেন আনুষ্ঠানিকভাবে। সেই সঙ্গে একটি নির্দেশ থাকে, এ-সাধনায় লজ্জা ঘৃণা ভয় তিনটিই ত্যাগ করতে হবে। কথাটার তাৎপর্য অনেকটাই গভীর, অর্থাৎ এতদিনকার যাপিত জীবন ও সমাজবোধের বিপরীত মার্গে এবার যেতে হবে শিষ্যকে। তার জন্য মানস-প্রস্তুতি চাই। বিদ্যমান সমাজের মূল্যবোধ থেকে বাউল জীবনের মূল্যবোধ, আচরণ, খাদ্যাভ্যাস ও সমাজ হবে স্বভাবত স্বতন্ত্র। তার ভবিষ্যৎ জীবন যতটা নিন্দিত হবে ততটা নন্দিত হবে না। সে হয়তো নিঃসঙ্গ হবে না কিন্তু তার এক বিচিত্র সমাজের অভিজ্ঞতা হবে, যে-সমাজ সংগুপ্ত ও আবদ্ধ, গুরুকেন্দ্রিক এবং অন্তর্মুখী।

প্রবর্ত অবস্থাতেই অনেকের সাধনজীবন কেটে যায়, তার বেশি এগোতে পারে না। এই অগ্রগতি আড়াআড়ি নয়, খাড়াখাড়ি অর্থাৎ ঊর্ধ্বগ। মনকে অচঞ্চল, সংহত ও ঊর্ধ্বগামী করতে পারে যদি শিষ্য, তখন গুরু তাকে উপযুক্ত মনে করলে সাধনপথে শিক্ষা দেন। মন্ত্রদীক্ষার পরে হয় রূপের দীক্ষা, যাতে সাধিকা দরকার। কারণ বাউল সাধনা দেহনির্ভর, কাম থেকে প্রেমে উত্তরণের লক্ষ্যভেদী, শ্বসনিয়ন্ত্রণের যৌন-যৌগিক ক্রিয়ার সফলতার উপর বিন্যস্ত। দেহসাধনা ও শ্বসনিয়ন্ত্রণের দ্বারা সাধকের অপব্ধ দেহ পকতা পায়। এর জন্য পদে পদে লাগে গুরুনির্দেশ, তাঁর প্রত্যক্ষ উপস্থিতি এবং অভিভাবকত্ব। সাধক সাধারণত তার সাধনসঙ্গিনীর সঙ্গে দেহচর্যা করে। কখনও কখনও গুরুই বেছে দেন শিষ্যের সঙ্গিনী। সাধনা ধৈর্য ও সংযমসাপেক্ষ। অনেকে পারে না, তাদের ঘটে ‘যোনিতে পতন’। কিন্তু যারা পারে তাদের আনুষ্ঠানিক দীক্ষা দেন গুরু এবং বলে দেন :

আপন সাধন কথা না কহিও যথাতথা

আপনার আপনিরে তুমি হইও সাবধান।

একেই বাউলরা বলেন ‘আপ্ত সাবধান’— নিজের বাকসংযম। অথচ লোকমধ্যে লোকাচারের নির্দেশ থাকে অর্থাৎ সাধারণ মেলামেশায়, সামাজিক ওঠাবসায়, বাউল থাকে প্রচ্ছন্ন হয়ে কিন্তু ওপর ওপর সকলের সঙ্গে সম্পর্ক রাখে। বিনয় বচনে ও সদাচারে তার জুড়ি মেলে না। গুরুকে ও গুরুপত্নীকে সে পিতৃমাতৃজ্ঞানে মান্য করে। গুরুভাইদের আপন বলে মানে। গুরুর ভুক্ত অন্ন শ্রদ্ধাসহকারে খায়। নিজের জীবনকে সে সমর্পণ করে গুরুর পাদপদ্মে। তার হয় নবজীবন। পূর্বাশ্রমের সঙ্গে সম্পর্ক থাকে না আর। নামটাও যায় পালটে। ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও সম্পদ বলে তার কিছু থাকে না। ভিক্ষাবৃত্তি করে, ভিক্ষার ঝুলি কাঁধে নিয়ে, কৌপীন সম্বল জীবন এবারে অনিকেত হয়ে যায়। গুরুর দেওয়া ইষ্ট মন্ত্র হয় তার অবলম্বন।

এত সব তত্ত্বকথা না আউড়ে একটি বাউল দীক্ষার প্রতিবেদন পেশ করা অনেক বাস্তবসম্মত হবে। এ প্রতিবেদন পাওয়া গেছে সমাজ-নৃতত্ত্ববিদ মানস রায়ের লেখা ‘The Bauls of Birbhum’ (১৯৯৪) বই থেকে। ১৯৮০ থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত কালপর্বে মাঝে মাঝে বিরতি দিয়ে লেখক ঘুরে বেড়িয়েছেন বীরভূমের নানা গ্রামে এবং সন্ধান করেছেন বাউলদের। এঁর বই থেকে পাওয়া প্রত্যক্ষ বিবরণ (দেবীদাস বাউলকথিত) এখানে তুলে ধরছি বাংলা অনুবাদে।

দেবীদাস বাউল পূর্বাশ্রমে ছিলেন ব্রাহ্মণ সন্তান। বীরভূম জেলার অন্তর্গত সাঁইথিয়ায় থাকতেন তিনি পিতামাতার সঙ্গে। তাঁর পিতামহ ছিলেন বৃত্তিতে পুরোহিত— পিতা ছিলেন জ্যোতিষী ও হোমিওপ্যাথ। আট ভাইবোনের মধ্যে দেবীদাস সর্বকনিষ্ঠ। দিদিদের বিয়ে হয়ে গিয়েছে, বড়দি মারা গেছেন। চার দাদার মধ্যে একজন সাঁইথিয়ায় স্কুলশিক্ষক, মেজদা রাজ্য বিদ্যুৎ পর্ষদে আর সেজদা রাজ্য পুলিশে কাজ করেন। কনিষ্ঠ দেবীকুমার চট্টোপাধ্যায় (এখন দেবীদাস বাউল) কাজ করতেন এক কারখানায়। ভগ্নস্বাস্থ্যের কারণে তিনি ছাঁটাই হন। অন্য কাজ চেষ্টা করেও জোটেনি— এসে যায় গভীর হতাশা। তবে তিনি গান গাইতে ও বাদ্যযন্ত্র বাজাতে পারতেন ভাল। বাউলদের গান আর জীবনযাপনের বৈচিত্র্য তাকে টানত। তাই বাউলদের সঙ্গে বিভিন্ন মেলা আর আশ্রমে আখড়ায় ঘুরতে ভাল লাগত। এইভাবে তার দেখা হল রামানন্দ গোঁসাইয়ের সঙ্গে, তাঁর দাসকলগ্রামের আশ্রমে। তাঁর কাছে মন্ত্রদীক্ষা নেবার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন দেবীকুমার, তক্ষুনি ইচ্ছাপূরণ হল না। রামানন্দের আশ্রমে অন্যান্য বাউলদের সঙ্গে মাসখানেক থেকে গেলেন। তারপরে গুরু তাঁকে দীক্ষা দিলেন— মন্ত্রদীক্ষা।

এবারে মন্ত্রদীক্ষার অনুষ্ঠান কেমন হল তা শশানা যাক শিষ্যের জবানিতে :

মন্ত্রদীক্ষা অনুষ্ঠানের দিনক্ষণ গুরু রামানন্দ গোসাই আগে থেকে ঠিক করে রেখেছিলেন। অনুষ্ঠানে যোগ দেবার জন্য তাঁর মন্ত্রশিষ্যদের ও গুরুভাইদের এক তালিকা করেছিলেন। আমাকেও পূর্বাহ্নে নির্দেশ দিয়ে রেখেছিলেন অনুষ্ঠানের উপকরণ জোগাড় করে রাখতে। সেগুলি হল : চিঁড়া, গুড়, দুধ, দই, ঘি, ছানা, লুচি, মিষ্টি, পাঁচরকম ফল (লালরং বাদে), পাঁচরকম ফুল (লালরং বাদে), তুলসীপাতা, একটি গামছা, একঘড়া গঙ্গাজল ও সাতখানি মেটে মালসা।

তিনদিনেই আমি এসব জোগাড় করে ফেললাম। তারপরে দীক্ষার দিন ভোরে স্নান করে আমি সাদা নতুন কাপড় পরলাম। যে ঘরে দীক্ষানুষ্ঠান হবে তার মেঝে নিকিয়ে নিলাম গোবর দিয়ে। এসব কাজ দীক্ষার্থীরই করার কথা। মূল অনুষ্ঠানে যে মচ্ছবভোগ বিতরণ হবে তার প্রস্তুতিতে অবশ্য আখড়ার কেউ কেউ সাহায্য করলেন আমাকে। আমি মালসাভোগ বানালাম চিড়ে, গুড়, দুধ, দই আর ঘি দিয়ে। তা রাখা হল পাঁচটা মাটির পাত্রে মানে মালসায়, সোজা সরলরেখায়। এগুলি উৎসর্গ করা হল গৌরাঙ্গ, নিত্যানন্দ, অদ্বৈত, গদাধর ও শ্রীবাস এই পাঁচ মহাপ্রভুর নামে। পবিত্র তুলসীপাতা, সুগন্ধি, পবিত্র গঙ্গাজল, পাঁচরকম ফুল আর ফল রাখা হল সাজিয়ে। ঐ ঘরে কেউই ঢুকতে পারবেন না। কিন্তু বাইরের দাওয়ায় নিমন্ত্রিতরা অনুষ্ঠান শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কীর্তন গাইতে লাগলেন। অনুষ্ঠানের সূচনায় গুরুদেব সাতটি মালসায় একটা করে তুলসী পাতা দিয়ে গঙ্গাজল ছিটিয়ে দিলেন তাতে, তারপর আমার মাথায় আর নিজের মাথায়। তারপরে তুলসী পাতায় চন্দন নিয়ে লাগিয়ে দিলেন আমার মাথায় কপালে, কষ্ঠে, বুকে, উদরে। এবারে প্রথমে গুরুদেব তাঁর নিজের গুরুর উদ্দেশে শ্রদ্ধা জানিয়ে স্মরণ করলেন পাঁচ মহাপ্রভুকে আলাদা আলাদা করে, স্বতন্ত্র মন্ত্র উচ্চারণে। তারপরে তিনি মালসাভোগ নিবেদন করলেন প্রথমে আত্মগুরু এবং পরে পঞ্চ প্রভুকে। অবশেষে তিনি আমাকে বীজমন্ত্র দিলেন এবং নামকরণ করলেন ‘দেবীদাস’। অনুষ্ঠান শেষ হল আমন্ত্রিত ব্যক্তি ও আশ্রমিকদের মহাপ্রসাদ বিতরণের মাধ্যমে। এবারে মচ্ছব শুরু হয়ে গেল।

এই অনুষ্ঠানের পর থেকে দেবীকুমার চট্টোপাধ্যায় হয়ে গেলেন দেবীদাস বাউল। গুরুর সম্প্রদায়, পরিবার ও গোত্রের অন্তর্গত হয়ে গেলেন তিনি। তাঁর হল ‘মধ্বাচার্য’ সম্প্রদায়, ‘নিত্যানন্দ’ পরিবার ও ‘অচ্যুতানন্দ’ গোত্র।

আমাদের মনে এবারে খটকা লাগে এই ভেবে যে, দেবীদাস বাউল হলেন না জাত-বৈষ্ণব মতে দীক্ষিত হলেন? বাউলদের তো গোত্র পরিবার বা সম্প্রদায়গত পরিচয় থাকে না। তারা মুক্ত ও অনিকেত। কোনও গোষ্ঠী বা সমাজভুক্ত নয় তারা। কিন্তু দেবীদাস তো বাঁধা পড়লেন এক সম্প্রদায়ী বন্ধনে। তা ছাড়া তুলসীপাতা, গঙ্গাজল, গোময় ও পঞ্চপ্রভুর অর্চনা— এসব বাউল সাধনায় কেন? তার অর্থ, দেবীদাস বাউলপন্থার মানুষ নন, যেমন নন লক্ষ্মণদাস বা পূর্ণদাস বা নবনীদাস। তাঁরা বাউলগান করেন কিন্তু তাঁদের আচরণ ও গোত্র হল জাত-বৈষ্ণবদের। এবার সাহস করে বলে ফেলা যাক, বীরভূমের বেশির ভাগ বাউল আসলে অচ্যুতানন্দ গোত্রের জাত-বৈষ্ণব। ক্ষিতিমোহন কি এঁদের মতো ব্যক্তিদের দেখে ‘আধা বৈষ্ণব আধা বাউল’ কথাটি প্রয়োগ করেছিলেন?

কিন্তু দেবীদাসের বৃত্তান্ত এখনও শেষ হয়নি। মন্ত্রদীক্ষার পর তাঁর লাভ করার কথা ‘শিক্ষাদীক্ষা’। তার জন্য গুরুর নির্দেশে বেশ কিছু ক্রিয়াকর্তব্য পালন করতে হয়। দেবীদাস বলছেন :

আমি গুরুর নির্দেশিকা অন্তরের সঙ্গে পালন করতে লাগলাম। যেমন, আশ্রম পরিষ্কার করা, গুরু-গুরুমা ও আশ্রমবাসীদের জন্য ভিক্ষা করা, গুরু আর গুরুমার পরিধেয় বস্ত্র এবং ব্যবহৃত বাসনকোসন পরিষ্কার করা। এর বাইরে আমি প্রতি বৃহস্পতিবার গুরু ও গুরুমাকে পূজার্চনা করতাম। এছাড়া প্রতিদিন সায়ংসন্ধ্যায় গুরুদেবের সামনে বসে শুনতাম তাঁর বাণী, তাঁর বলা দর্শন আর বাউলতত্ত্ব, বাউলের করণকারণ— যা থেকে হওয়া যায় একজন আদর্শ বাউল। শিখতাম বাউলের দেহতত্ত্ব সাধনার প্রসঙ্গ, গুহ্য ও গোপ্য নানা কথা। ঘুরতাম আশ্রম থেকে আশ্রমে, মেলা থেকে মেলায়— যেখানে দেখা মিলত কত রকম বাউল সাধকের। শুনতাম তাঁদের বাণী ও অভিজ্ঞতার কথা। প্রতিদিন অভ্যাস করতাম গুরুদেবের কাছে শেখা প্রাণায়াম। এভাবেই কেটে গেল একটি মাস। এবারে আমার অপেক্ষা শুরু হল শিক্ষাদীক্ষা লাভের জন্য।

মানস রায় লিখেছেন, মন্ত্রদীক্ষার একমাস পরেই গুরু রামানন্দ দেবীদাসকে দেন শিক্ষা। এ-পর্যায়ে লাগে নারীসঙ্গী, তাই গুরু তাঁর মেয়ে ললিতাকে বেছে নিলেন দেবীদাসের সাধনসঙ্গিনী হবার জন্য। শিক্ষাদীক্ষার আচার-অনুষ্ঠান প্রায় মন্ত্রদীক্ষার মতোই— প্রভুদের মালসাভোগ নিবেদনের পর দেবীদাস ও ললিতা পরস্পর তুলসীমালা বিনিময় করে আনুষ্ঠানিকভাবে হলেন পতি-পত্নী। এ অনুষ্ঠানের নাম ‘কণ্ঠিবদল’। দেবীদাসের কণ্ঠিবদল অনুষ্ঠান হল গুরু রামানন্দের উপস্থিতিতে এবং পাঁচজন বিশিষ্ট সাধকের সান্নিধ্যে। শিক্ষাদীক্ষা অনুষ্ঠানের তিনদিন পরে দেবীদাস আর ললিতাকে ডাকা হল গুরুর কাছে হাতে কলমে যৌন-যৌগিক গুহ্য সাধনা শেখবার জন্য। গুরু তাঁর নিজের সাধনসঙ্গিনীর সহায়তায় নবদম্পতিকে শিখিয়ে দিলেন যৌন সংযমের করণকৌশল, দমের কাজ আর দেহসংযমের কঠিন পথ পরিক্রমার রহস্য।

গুরুর নির্দেশিত পথে কঠিন সাধনায় শিষ্য অর্জন করে ‘সাধক’ স্তর। কিন্তু তার জন্য তাকে পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হতে হয়। একজন গুরু যত বেশি সাধক তৈরি করতে পারেন তত তাঁর মান্যতা বাড়ে। রামানন্দ গোঁসাই বলেছেন :

শিষ্য যখন সাধক-স্তরে পৌঁছতে চায় তখন তাকে কঠিন পরীক্ষা দিতে হয় নিজের যোগ্যতা প্রমাণের জন্য। গুরু ও সাধকের সামনে শিষ্যকে প্রমাণ দিতে হয় তার দেহগত সংযম ও আত্মশক্তির। শিষ্যর যেদিন পরীক্ষা হয় সেদিন গুরু ডেকে আনেন তাঁর গুরুভাইদের এবং আঞ্চলিক কয়েকজন বিখ্যাত সাধক ও তাঁদের সাধনসঙ্গিনীদের— এ যেন ‘প্র্যাকটিকাল’ পরীক্ষা নিতে আসা ‘এক্সপার্ট’-দের মতো। গুরুর ঠিক করা দিনক্ষণ অনুযায়ী পরীক্ষা শুরু হয়।

প্রথমে গুরুর আদেশে শিষ্য আর তার সাধনসঙ্গিনী রাত্রিবেলা ঢোকে এক বদ্ধ ঘরে। সাধক ও সাধনসঙ্গিনীরা ঘরের বাইরে বারান্দায় বসে একটানা ভক্তি সংগীত ও কীর্তন গেয়ে চলেন যতক্ষণ চলে সাধনা। আকাশে তারার চলন দেখে তাঁরা সময় নির্ণয় করেন। এইভাবে যখন আঠারো দণ্ড নিশা কেটে যায় (তার মানে ৭ ঘণ্টা ১২ মিনিট) তখন একজন অভিজ্ঞা বর্ষিয়সী সাধনসঙ্গিনী ঘরে প্রবেশ করেন এবং শিষ্যের সাধনসঙ্গিনীর যোনি পরীক্ষা করেন। পরীক্ষায় সন্তুষ্ট হলে তিনি ঘোষণা করেন যে শিষ্যের বীর্যচিহ্ন নেই স্ত্রীঅঙ্গে, অর্থাৎ এই দীর্ঘ সংগমে শিষ্য ঊর্দ্ধরেতা অবস্থায় থাকতে পেরেছে। তাকে এবারে সাধক শিরোপা দেওয়া যেতে পারে।

এমন পদ্ধতিতে সাধক পদমর্যাদা লাভ সহজ নয় তা বলা বাহুল্য। উদাহরণত দেখা যাচ্ছে দাসকলগ্রামের এই রামানন্দ গোঁসাইয়ের মোট শিষ্য সংখ্যা পনেরোজন— তার মধ্যে মাত্র একজন শিষ্য, চিন্ময় দাস, এই সুদুর্লভ সাধকের সম্মান লাভ করেছেন। উল্লেখ্য যে, গ্রামদেশে সকলেই সাধক হবার বাসনার গুরুর কাছে আসেনা। মদীক্ষা নিয়ে শিষ্য হওয়াই তাদের প্রাথমিক ও একমাত্র লক্ষ্য। যেমন দেখা যাচ্ছে, মানস রায়ের সমীক্ষা অনুযায়ী ময়ূরেশ্বরের রাধাশ্যাম দাস, গড়গড়িয়ার বাসুদেব দাস, মল্লারপুরের শান্তিরাম দাস ও বল্লভপুরের বাঁকাশ্যাম দাস দীক্ষা নিতে এসেছিলেন সামাজিক ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তার আশ্রয় পেতে। এদের মধ্যে মল্লারপুরের শান্তিরাম দাস পূর্বাশ্রমে ছিল একজন আসামি। ১৯৭৮ সালে ডাকাতির অপরাধে তার জেল হয়। সেখান থেকে জামিন পেয়ে বাউল মতে দীক্ষা নেয় সামাজিক নিরাপত্তার আশায়। মানস রায় তাঁর সরেজমিন অনুসন্ধানে অন্যতর তথ্যও পেয়েছেন। লক্ষ করা গেছে এ পথে অনেকে আসে খ্যাতি ও প্রতিষ্ঠার লোভে, টাকাপয়সার জন্য নয়। অনেকে বিত্তশালী। যেমন কালনার কৃষ্ণদাস বা বাউতিজোরের দীনবন্ধু দাস— এদের প্রচুর জমিজমা আছে, তবু দীক্ষা নিয়েছেন কারণ গান বাজনা ভালবাসেন, ইচ্ছা ওই ব্যাপারে কিছু নামযশ হোক। উচ্চবর্ণের ব্রাহ্মণসন্তান থেকে শুরু করে কায়স্থ, সদগোপ বা গন্ধবণিকের মতো মধ্যবর্ণের মানুষ এবং অস্পৃশ্য জাতের বাগদি, হাড়ি, মুচি ও ডোমেদের ঘরের ছেলে দীক্ষিত হচ্ছে বাউলমতে।

কিন্তু কারণ দেখে সংশয় জাগে রামানন্দের দ্বারা দীক্ষিত শিষ্যরা কি বাউল পন্থার না বৈষ্ণব পন্থার লোকায়তিক পর্যায়ের সদস্য? নাকি এরা এক বিমিশ্র পদ্ধতির উপজাত? কেননা পরবর্তী তথ্য থেকে দেখা যাচ্ছে দেবীদাস বাউল চারচন্দ্রের সাধনা শিখছেন ও অভ্যাস করছেন তাঁর গুরুর নির্দেশে। তাতেই অবশ্য প্রমাণ হয় না যে দেবীদাস ‘বাউল’ পর্যায়ের লোক, যেহেতু সহজিয়া বৈষ্ণবরাও অনেকে চারচন্দ্র সাধনা করে থাকে। আসল কথা হল, বঙ্গ সংস্কৃতির একটা সাধারণ স্বরূপ দেখা যায় মিশ্রণধর্মিতা— বহুরকম মত ও পথের। লোকায়ত গৌণধর্মে এমনতর বিমিশ্রণ অনেক বেশি— সদা সর্বদা সেখানে চলেছে গ্রহণবর্জন। ব্যাপারটা আরেকটু তলিয়ে বোঝবার জন্য এবার আমরা আর এক রকম বৈষ্ণবীয় দীক্ষার বিবরণ উপস্থাপন করব। অনুপম দত্তর রচনা, আখ্যানধর্মী, কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে অনুপম আমাকে জানিয়েছেন একটি চিঠিতে যে, এ-বিবরণ তাঁর আত্মজৈবনিক। অনুপম দত্ত প্রবীণ ব্যক্তি, থাকেন বীরভূমের দুররাজপুরে। ১৪ জুন ২০০০ দিনাঙ্কের চিঠিতে আমাকে তিনি লিখেছেন :

বৈষ্ণবীয় দীক্ষার যে বিবরণ সম্পর্কে আপনি শুধিয়েছেন তা ব্যক্তিগত জীবন ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে। বলতে গেলে, একটা প্রচণ্ড সময়ে আমাকে বৈষ্ণব ধর্মের কাছেই যেতে হয়েছিল। তারপরে আরো কোথাও। তথাকথিত সমাজ ধর্ম আমার পায়ের তলার মাটি কেড়ে নিতে চেয়েছিল। সেই সময় আমার গুরুদেব— সিউড়ির কাছে ‘ঝোরা মাঠ’ আশ্রমে, বর্তমানে বাতাসে মিশে যাওয়া গুরুদেব নিরঞ্জন গোঁসাই আমাকে দীক্ষা দিয়েছিলেন আর আমাদের মালাচন্দন ঘটিয়ে ছিলেন। তিনি আমার বর্তমান সহচরী।… তো বৈষ্ণব ধর্ম নিয়ে পায়ের তলার মাটি খুঁজব কিন্তু গুরু হবার নামে বৈষ্ণব এলেন। তারা বিধানক্রমে মাথান্যাড়া, কৌপিন খেঁচা, ঝুলি কাঁধে নগর ভিক্ষা এবং এর জন্য সময় লাগবে বৎসর খানেক তবে আমার বিচার হবে দীক্ষা যোগ্যতার। হয়তো জানতে পেরেছিলেন গুরুদেব। তিনি কিভাবে যে টেনে নিলেন তাঁর আশ্রমে। বললেন, ‘বাবা নিয়ম, হ্যাঁ, নিয়ম ঠিক আছে। তবে হয়, করলেই হয়। আসিস তোরা অমুখ তারিখে। হয়ে যাবে।’ তাঁর আশ্রম, উঠান ভরে ভক্ত বৈষ্ণবদের সমাধি, আর তাঁর ঘরে… পড়েছেন তো?

অনুপমের লেখা আখ্যানের মধ্যে থেকে এখানে শুধু দীক্ষা গ্রহণের অনুষ্ঠানটুকু আমরা ছেঁকে নেব। স্থান বীরভূমের এক গ্রামের বৈষ্ণবীয় আখড়া। গুরু রাধাকান্ত গোঁসাই, দীক্ষার্থী শিয্যের নাম পরেশ, তার সঙ্গিনীর নাম অনুরাধা।

গুরুর নির্দেশে পরেশ একটা ফর্দ লিখল অনুষ্ঠানের উপকরণ নিয়ে। প্রথমেই লেখা হল সিদ্ধি দশ গ্রাম, গাঁজা একভরি। তারপরে আট রকমের ফুল আর ফল। দুশো গ্রাম ধূপধুনো, দু’প্যাকেট ধূপকাঠি। এক টাকার আসলি চন্দনগুঁড়ো ও একটি রক্তচন্দনের বাঁট, একশিশি গঙ্গাজল, একশিশি অগুরু, একশিশি মধু, এক টাকার কপূর, দেড়শো গ্রাম খাঁটি গব্য ঘৃত, তুলসী কাঠের মালা দু’গাছা। একজোড়া কোরা ধুতি। একটা উত্তরীয়। ল্যাঙ্গট একজোড়া। পাঁচ হাত বহরের গামছা একজোড়া। একটি লালপাড় সাদা শাড়ি আর একটি জাম রঙের রেশমি শাড়ি, যার পাড় আর আঁচলায় সোনালি নকশা। তার সঙ্গে মানানো ব্লাউজ, সায়া ও অন্তর্বাস। দশকর্মা আর কাপড়ের দোকান থেকে এসব সংগৃহীত হল।

এ ছাড়া কেনা হল বাজার থেকে তরিতরকারি। একজন ভক্ত টাকা বার করে বললেন, ‘এই হরেন, ছুটে যা তো মাছ নিয়ে আয় দু’কেজি।’ কথায় বলে বৈরাগী হতে গেলে মাছ লাগে। একটা মহোৎসবের আয়োজনে বেরিয়ে পড়েছে আশ্রমের অনেকদিন অব্যবহারে থাকা হাতা হাঁড়ি গামলা কড়াই। কাজের শব্দে আর ব্যস্ততায় আশ্রমের এলাকা সজীব হয়ে উঠেছে।

পাঠক, অনুপম দত্ত-র বর্ণনার অনুপুঙ্খ আর মানস রায়ের প্রতিবেদনে ফারাকটা ধরতে পারছেন নিশ্চয়। এবারে দীক্ষা পর্বের বৃত্তান্ত :

একটা কম্বলের আসনে পরেশ বসে রয়েছে অন্য এক বেশে। গায়ে জড়ানো রয়েছে হালকা সাদা সুতির চাদর। কোরা ধুতিটির তলায় যে ল্যাঙ্গট সেটা বেঁধে দিতে সাহায্য করেছে গোঁসাইজি।

ঘরটি, যদিও দিনের বেলাতেও আবছা আলো স্পষ্টই চোখে পড়ে দেয়ালের একদিক ঘেঁষে সিমেন্ট বাঁধানো বড় বেদী। তার উপর ফ্রেমে বাঁধানো নানা দেবদেবীর স্বর্গীয় মূর্তি। উপরের দেয়ালে পুরনো একটা ছবি— নীল মেঘের ভিতরে নৃত্যপর শ্রীগৌরাঙ্গদেব। অন্য দেয়ালগুলোতে যেখানে সেখানে লালকালির বড় বড় হরফে ‘হরে কৃষ্ণ’ মন্ত্র লেখা। একগুচ্ছ ধূপকাঠির পুড়তে থাকা গন্ধ আর ধোঁয়ারেখা। প্রাচীন পিলসুজের উপর ঘিয়ের প্রদীপ জ্বলতে থাকা শিখা স্থির।

শিশি থেকে জল নিয়ে পরেশের মাথায় ও দরজার বাইরে বসে থাকা একজন দর্শকের উপর ছুঁড়ে দিলেন রাধাকান্ত গোঁসাই।… উৎসুক মানুষেরা বিড়ি টানছে, গাঁজার কক্কেতে দম দিচ্ছে। সামনের রাখা পুজোর টুকিটাকি জিনিসের মধ্যে থেকে একটি ছোট কঁচি তুলে নিলেন গোঁসাইজি। বললেন, ‘শাস্ত্র মতে মস্তক মুণ্ডন। কই দেখি মাথাটা একটু ঝুকিয়ে আনেনা তো।’ তার ব্রহ্মতালুর উপরের একগাছা চুল কেটে সেটাতে রাখলেন ডানপাশের বেদীর নিচে। বললেন, ‘বাবা, তোমার টিকির চুল কেটে এখানে রাখলাম। এটি আমার গুরু গোঁসাইয়ের সমাধি। তিনি এর ভিতরে শুয়ে আছেন। তোমার মন তোমার চেতনা এখানে বাঁধা থাকল। শাস্ত্রবিধি মতে এটাই। তোমার মস্তক মুণ্ডন হল বাবা। এরপর কর্ণছেদন।’

তামার কোষায় ভিজছে একটি খেজুর পাতা। তিনি সেটি তুলে, আসনে বসে থেকেই পরেশের ঘাড় টেনে মাথা কাত করে প্রথমে ডান কানের লতিতে পরে বাঁ কানের সেই জায়গায় পাতার ছুঁচলো শক্ত আগাটা সামান্য জোরে ফুটিয়ে তুলে নিলেন।

‘বৈষ্ণবধর্ম গ্রহণের জন্য তোমার দেহগত সংস্কার হল বাবা। এবার’—

রাধাকান্ত গোঁসাই বাটা চন্দনের সাথে খানিকটা গঙ্গামাটি মিশিয়ে অতি যত্নে পরেশের কপালে, নাকে, কানের লতিতে, দুই বাহুর উপর, বুকে এঁকে দিলেন তিলকচিহ্ন। পুজোর সামগ্রীর পাত্র থেকে তুলে নিলেন দু’গাছি তুলসী কাঠের মালা। পরেশের গলায় পরিয়ে দুই প্রান্তের খোলা সুতোয় গিট বেঁধে দিলেন।

‘এখন গুরুর কাছে বৈষ্ণব-মন্ত্র নেবার যোগ্য তুমি হলে বাবা। এখন থেকে তোমার নাম হল পরেশদাস বৈষ্ণব। আর সাধনপথে যখন যাবে তখন তোমার নামটি পরমানন্দ দাস বৈষ্ণব। এবার তুমি আমাকে যাষ্টাঙ্গে প্রণাম কর।’

‘কল্যাণ হোক কল্যাণ হোক’ শিষ্যের দু’হাত ধরে তুলে তাকে বুকে জড়ালেন। চুমু খেলেন কপালে। তারপর তাকে ছেড়ে দু’হাতের বিচিত্র সব মুদ্রা অনেকক্ষণ পরেশের সামনে করার শেষে বললেন, ‘এ হল ব্রহ্মচর্য মুদ্রা বাবা পরমানন্দ।’

… ‘তুই পরমানন্দ, কাল রাত থেকে এখন পর্যন্ত অনেক পল অনুপল ব্রহ্মচর্য পালন করে ব্রহ্মচারী হলি।… এখন তোকে মন্ত্র দেব। আসনে বোস।’ সামনা সামনি বসে পরেশের মাথাটি নিজের খোলা বুকে লাগিয়ে তার ডান কানে খুব ফিসফিসিয়ে কৃষ্ণ নামের একটা উচ্চারণ করলেন। মুখ সরিয়ে বললেন, ‘এ মন্ত্র তোর একার। খুব গোপনের। সব সময় একে জপ করবি। একে বলে বীজমন্ত্র।’

তারপর তিনি পরেশের দুই গালে দাড়ি ঘষে আবার সেই মন্ত্রটি একই গোপনতায় উচ্চারণ করে তার কানের লতিতে ভাঙা দাঁতের দুই মাড়ির চাপ দিয়ে কামড়ালেন, ‘মনে রাখিস! কখনও ভুলিস না।’ এবারে পরম স্নেহে পরম প্রেমে পরেশের দুই গালে দুটি নিবিড় চুমু খেলেন। পরেশ গড়িয়ে পড়ল গুরুর চরণে কাঁচা মাটির মূর্তির মত, অথবা নতুন প্রবাহের কোনো স্রোতের মত।

অনুপম দত্তর অনুভূতিময় বর্ণনে ও জাদুভাষায় যেন প্রত্যক্ষ শরীরী হয়ে উঠেছে সমগ্র পরিবেশ ও ব্যক্তি। বৈষ্ণবীয় দীক্ষাগ্রহণের এমন বিস্তারিত বিবরণ বড় একটা পাওয়া যায় না পুথিপত্রে। এ বর্ণনার অভিনবত্ব ও গভীর আবেদন মর্মস্পর্শী হয়ে উঠেছে এই কারণে যে, লেখক আখ্যানের কাঠামোয় ভরে দিয়েছেন নিজস্ব অভিজ্ঞতা ও সংবেদন। স্বাভাবিক মধ্যবিত্ত শিক্ষিত একজন জীবিকাধারী মানুষ যখন বৈষ্ণবীয় স্রোতোধারায় নিজেকে স্বেচ্ছায় মিলিয়ে দিয়েছেন তখন তাঁর রূপান্তরিত নবজন্ম বিস্ময়কর নয় কি? এক বিশ্বাস থেকে আরেক বিশ্বাসে, এক ধরনের যাপন থেকে সম্পূর্ণ অন্য এক যাপনের মধ্যে তিনি যাচ্ছেন। কিন্তু অনুষ্ঠান এখনও শেষ হয়নি। রোমাঞ্চিত বিহল হতচকিত মৃঘূর্তির মতো অবলুষ্ঠিত শিষ্যকে এবারে গুরু রাধাকান্ত গোঁসাই তুলে ধরে তার হাতে দিলেন বৈষ্ণবের ভিক্ষার ঝুলি। বললেন,

‘এতে আছে দুটি পথের কড়ি।’ তিনি বের করলেন, ‘আর এই দেখ,’ কড়ি রেখে উদ্দিষ্টটি বের করে তুলে ধরে বললেন, ‘চিরঞ্জীবী শিয়াল শিঙ্গি।’ তিনি ওটিকে ধূপশিখার কাছে আনলেন তারপর সিঁদুর চন্দন মাখিয়ে বললেন, ‘বাবা, এটি জ্যান্ত। প্রতিদিন সকাল সন্ধ্যা এর ধূপসেবা চন্দনসেবা চাই। তাহলে এর থেকে উঠবে মৃগনাভির গন্ধ।’ রেখে দিলেন ঝুলিতে, ‘আর এখানে আছে দেবী কামিখ্যের রজঃসিক্ত বস্ত্র। বাবা, তোমার এ জীবনে আজ থেকে এগুলিই হল শেষ সম্বল। নাও, ঝুলি ধর। নগর ভিক্ষায় যাও।’

সে জানে না কোন্ নগর? কতদূর তার পথ?

‘যাও পরমানন্দ’ গোঁসাইজি বললেন, ‘প্রথম ভিক্ষা রাধারানির কাছ থেকে আনবে।’

দীক্ষা ঘরে ফিরে পরেশ দেখল তার আসনের পাশে আরেকটি কম্বলের আসন।

গুরু বললেন, ‘এস বাবা, নগর ভিক্ষা হল?’

‘গুরুদেব, আমি শুধু অনুরাধার কাছে ভিক্ষা চেয়েছি।’

‘নারীই নগর বাবা! নগরের সব ঐশ্বর্য ধনে যে ধনী। তুমি নারীর কাছে ভিক্ষা চেয়েছ। মাতৃজাতির কাছে ভিক্ষা চেয়েছ। এতে বাবা, নারীকে মাতৃজ্ঞানে সাধনার কাজটি তুমি করলে। এবার ভিক্ষের ধন আমার হাতে দিয়ে বস তোমার আসনে।’

এই বিবরণের মধ্যে ভাষাবিন্যাস ও সংলাপের আন্তরিকতা লক্ষণীয়, সেই সঙ্গে বৈষ্ণবীয় মাধুকরীর বৃত্তান্ত খুব মধুর। বৈষ্ণব সাধনায় এই মাধুর্যরসই প্রধান। ভিক্ষাগ্রহণ ব্যাপারটিও প্রতীকী ব্যঞ্জনায় চমকপ্রদ। নারী সম্পর্কে দৃষ্টিকোণ অতীব গভীরতাস্পর্শী। বোঝা যায় লোকায়ত জীবনের মরমি রহস্যময়তা ও বাচনসৌন্দর্য। ওদিকে কিন্তু অনুষ্ঠান এগোচ্ছে। এরপরে রাঙা চেলি পরিয়ে অনুরাধাকে আনা হবে। পরেশ ও অনুরাধা পাশাপাশি দুই আসনে। সামনে গুরু রাধাকান্ত। তাঁর কণ্ঠে সংস্কৃতি মন্ত্র, নারীরা বাজাচ্ছেন শঙ্খ, সঙ্গে হুলুধ্বনি। গুরু বললেন,

‘এই ঘরে বেদীটি, আমার গুরু ভগবান মনোমোহন দাস বৈষ্ণবের সমাধি। আর যত ঠাকুর দেবতার ছবি, তাঁদের পাশে যারা মানুষ ছিলেন, ঠাকুর হয়েছেন তাদের সকলের সামনে আমি শ্রীরাধাকান্ত গোস্বামী, বনমালীপুরের আশ্রমের সেবাইত তোমাদের একটি নর আর নারীর প্রেম মিলনের জন্যে মালা-চন্দনের অনুষ্ঠান করছি। সবাই একবার গৌর গৌর বলুন, বাবারা।’

‘আজ আমি প্রজাপতি ঋষির নামে তোমাদের দুজনের মালাচন্দন করে দিচ্ছি। সাক্ষ্য রইলেন ছত্রিশকোটি দেবতা, জলস্থল আকাশ বাতাস আর আসরের মানুষেরা।’

এখানে যেটা বিস্ময়কর তা হল সামঞ্জস্যবোধ। বৈষ্ণব বিবাহ অনুষ্ঠানে সংস্কৃত মন্ত্র, প্রজাপতি ঋষির প্রসঙ্গ আর ছত্রিশকোটি দেবতাকে স্মরণ একরকম উদার সমন্বয়বাদের বোধ জাগিয়ে তুলছে না কি?

বাটির থেকে বাঁ হাতের কড়ে আঙুলে চন্দন তুলে তিনি অনুরাধার কপালে টিপ পরালেন, ‘এখন রাধারানির কপালে আমি চন্দনের টিপ দিলাম। সে হল আমার বৈষ্ণবী। আমার সেবাদাসী।’ একটু থেমে তিনি অনুরাধাকে বললেন, ‘কই, হ্যাঁ বল।’… ‘তুমি কি জানো না রাধারানি, শিষ্য যা কিছু পাবে তার সমস্তই গুরুর প্রসাদী। গুরু আগে ভোগ করবেন। তা দেখে শিষ্য মত হয়ে থাকবে। তারপর প্রসাদ পাবে। কি, বৈষ্ণবী হয়ে এসব কথা জানো তো?’

অনুরাধা চুপ করে থাকল।

‘না জানলে, বাবা পরমানন্দ তুমিও জেনে নাও গুরু হচ্ছেন ব্রহ্মা। গুরু কৃষ্ণ। তাই প্রথমে এই বৈষ্ণবীটি হবেন কৃষ্ণসঙ্গিনী।… এবার তুমি মেয়ে, বল।’

অনুরাধা রহস্য হাসি মুখে ফুটিয়ে বলল, ‘আমি আপনার বৈষ্ণবী হলাম গুরুদেব।’

গুরুপ্রসাদী কথাটার নানা কদর্থ আমরা আগে শুনেছি বা বইয়ে পড়েছি। কিন্তু বনমালীপুরের এই মালাচন্দনের অনুষ্ঠান রীতিমতো সুন্দর ও মহিমময়— নিগূঢ় তাৎপর্যপূর্ণ। এবারে বিবাহ কৃত্যের শেষপর্বের শুরু।

রাধাকান্ত গোঁসাই ডান হাতের তর্জনীর আগাটি ছুঁইয়ে অনুরাধার কপাল থেকে ভিজে চন্দন নিয়ে পরেশের কপালে টিপ এঁকে দিতে দিতে বললেন, ‘রাধারানির কপাল থেকে নিয়ে তোমার কপালে দিলাম বাবা পরমানন্দ। এখন থেকে ও বৈষ্ণবী তোমার হল।’ দু’ছড়া আকন্দ মালা দু’জনের গলায় পরিয়ে দিয়ে বললেন, ‘উঠে দাঁড়াও। নিজের নিজের মালা বদল কর।’

এরপরে সমবেত নারীকুলের শঙ্খধ্বনি, হুলুধ্বনি, পাঠক, এসব কল্পনা করতে পারবেন। গুরুর সক্রিয় ব্যবস্থাপনায় চাদরের আবরণের আড়ালে হল যুগলের শুভদৃষ্টি। গুরুদেব ঘোষণা করলেন,

‘এবার রাধাকৃষ্ণের মিলনলীলা।’ পরেশকে একটু ঠেলে সরিয়ে যেটা কিনা অনুষ্ঠানগত একটা কৃত্যমাত্র এমন ভঙ্গিতে তিনি অনুরাধার সামনে দাঁড়িয়ে তাকে দুহাতে জাপটে ধরে বুকে টানলেন। গভীর আলিঙ্গনে অনুরাধার মুখের উপর নামালেন চুল-দাড়ির অতি প্রবীণ বয়স্ক মুখখানি। দাঁতশূন্য দুই মাড়ির ঠোঁট নামালেন অনুরাধার দুই ঠোঁটের নিচে চিবুকে। একটা শান্ত দীর্ঘ চুম্বনের পর অনুরাধাকে ছেড়ে দিলেন গুরুগোঁসাই।

নিজের আসনে সরে এসে দাঁড়িয়ে তিনি বললেন, ‘এই আসরে উপস্থিত মানুষ-রতনদের সামনে তোমরা দুজনে আলিঙ্গনাবদ্ধ হয়ে পরস্পরের মুখচুম্বন কর।’ তিনি হেসে তাকালেন পরেশের দিকে, ‘বাবা পরমানন্দ, এ বৈষ্ণবী তোমার। এ তোমার নারীরত্ন। মনে রেখো, গুরুপ্রসাদে একে তুমি পেয়েছ। আমার এই রাধারানি আজ থেকে তোমার সাধনসঙ্গিনী হল বাবা। সে তোমার সাধনপথের গুরু। তাকে সেইভাবে দেখবে। সেইভাবে ভালবাসবে। তখন বুঝবে বাবা, সর্বজীবে প্রেম কী করে হয়, কাকে বলে।’

তারপরে গুরুর আদেশে পরেশ আর অনুরাধা একটি যেন মিথুনমূর্তি। সকলের উকিঝুঁকির মধ্যে পরেশ অনুরাধাকে গভীর চুম্বন করল। কিন্তু গুরুগোঁসাই জানেন সময় পরিমাণ। তাঁর ছোট ছোট হাততালির শব্দে তিনি ওদের মগ্নতা ভেঙে দিলেন। ওরা বিচ্ছিন্ন হল।

মানস রায় বর্ণিত দেবীদাসের বাউলদীক্ষার চেয়ে অনুপমের বর্ণনায় বৈষ্ণবীয় সহজিয়া মতের দীক্ষা অনেক প্রাঞ্জল ও স্পষ্টরেখ। গুরু-শিষ্যের ভূমিকা, গুরুর সঙ্গে শিষ্যের সাধনসঙ্গিনীর সম্পর্ক— এ সবই কৌতুহলোদ্দীপক আর মরমি বিন্যাসে গাঁথা। দুটি বর্ণনা থেকে এমনও মনে হতে পারে বুঝিবা দুই সম্প্রদায়ে কৃত্যগত বেশকিছু মিলও আছে। তবে একটা বিষয় পরিষ্কার যে দেবীদাসের দীক্ষা পুরোপুরি বাউল-ঘরানার নয়। কেন নয়, সেকথা স্পষ্ট করতে এবারে কার্তিকদাস বাউল-কথিত বিবরণ উপস্থিত করব। বীরভূমের এক গ্রামের কার্তিকদাস আর লতা দুজন দুজনকে ভালবেসেছিল। নানা বাধা বিপত্তি পেরিয়ে তারা আশ্রয় পেল জীবন গোঁসাইয়ের কাছে। এবারে কার্তিকের জবানিতে—

তিনি আমাদের দুজনকে আশ্রয় দিলেন। আমি তাঁর কাছে শিক্ষা পেয়েছি। লতা হয়েছিল আমার সাধনসঙ্গিনী।

সে শিক্ষার কথা কি বলব… প্রথমে ক’দিন আমাদের ব্রহ্মচর্য পালন। এমনকি দেখাসাক্ষাৎ বারণ দুজনের। আমি থাকি আশ্রমের একদিকের ঘরে আর লতা থাকে ভেতরে আরো ক’জন বৈষ্ণবীর সাথে। এ বড় কঠিন সাধনা… একে বলে পেয়ে-হারানো। কাছে আছে কিন্তু দেখা হবার নয়। বিন্দুধারণ শিক্ষা বাউল-সাধনার মূল শিক্ষা।

আমি বাউল ঘরে জন্মি নাই তাই বাউল বংশের আসল ভাবটি, রূপটি আমার পাওয়া হয় নাই। যাকে বলে সহজ পাওয়া, বংশধারায় পাওয়া। বাউলের ছেলে কি রকম বাউল হয় আমি তো তা জানি না। পূর্ণদাসের কথা ভাবো, তার বাবা নবনীদাস কত বড় বাউল। তাই সাধক বাউলের যদি ছেলে না হবে তবে দেশে আসল বাউল জন্মাবে কি করে?

কার্তিক দাস একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তুলেছেন। বিন্দুধারণ আর ঊর্ধ্বরেতা হয়ে, বাউল সাধনা যদি জন্মনিরোধ করে অটল মানুষকে শুধু চায়, তবে খাঁটি বাউল জন্মাবে কী করে? দীন হীন ভজনসাধনবিমুক্ত সাধারণ ব্যক্তি যখন বাউল হয় তখন তো তার উচ্চ পরম্পরা, তার ভাব ও রূপ থাকতে পারে না। সাধক বাউলের সন্তান সাধনজীবনে কিংবা গানের জীবনে অনেকটাই এগিয়ে থাকে স্বভাবজ কারণে। কার্তিকদাসের সে-পরম্পরা ছিল না, তার ছিল শ্রমজীবী জীবনের অভিজ্ঞতা। বাউল জীবন তার কাছে অপূর্বকল্পিত, একেবারে তরতাজা এক অন্য জগৎ। তার বাচনে—

ব্রহ্মচর্য সময়ে আমাকে তিনটি রস পান করতে হয়েছিল। প্রথমটি হচ্ছে প্রস্রাব। যতবার সেটি ত্যাগ করেছি ততবার পরপর তিনদিন সেটিকে আবার নিজের ভেতরে ফিরিয়ে নিয়েছি। যতবার প্রস্রাব করেছি ততবার একটা নারকেল মালুইয়ের পাত্রে ধরে সেটা খেয়েছি। সকালের বিষ্ঠার প্রথম অংশ খানিকটা তুলে যেতে হবে। বাকিটা থেকে খানিকটা তুলে নিয়ে দু’হাতের তালুতে সেটাকে ফেঁটে যেতে হবে। ফাঁটতে ফাঁটতে এক সময় সে-জিনিস মাখনের মত তেলতেলে হয়ে যাবে। তখন আর কোনো বদ্‌গন্ধ থাকবে না। এরপর সেটা মুখে বুকে পেটে ভাল করে মালিশ করে ভোর বেলাকার রোদে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। আধঘণ্টা পর ভাল করে স্নান করে ধুয়ে ফেলতে হবে। ওই জঙ্গলের ধারে, বালির খালে অনেকটা জল। আমি লাগাতার একমাস গুরুবাক্য পালন করে সেই জলে নেমে স্নান করেছি। সে খালও আর নাই। জলও নাই।

স্নানের পর দমের কাজ। এটাই আসল। এই দমের কাজই দেবে বিদ্যা-বুদ্ধি-বল। দমের কাজ হল গিয়ে শ্বাসের কাজ।… ভিতরকে দিতে হবে বাতাস। রেচক কুম্ভক করে সেই বাতাস বুকে ধরা আর ছাড়া হল দমের কাজ।

কার্তিকের আত্মবিবৃতি থেকে বোঝা সহজ যে, বাউলসাধনার সূচনাপর্বই বেশ কঠিন। বৈষ্ণবদের দীক্ষাপূর্ব স্তর অনেকটা ভাবময়, যা দেখা গেছে দেবীদাস আর পরেশের অভিজ্ঞতার বয়ান থেকে। বাউল সাধনা প্রথম থেকে লজ্জা-ঘৃণা-ভয়কে অতিক্রম করিয় নেয়। ব্যাপারটি ক্রমশ হৃদয়ঙ্গম হয় কার্তিকের পরবর্তী অভিজ্ঞতার বিচিত্র বিবৃতি থেকে—

তো এই দমের কাজের মধ্যে আমাকে এক মহারস আস্বাদন করতে হয়েছিল। সে এক সেঁকো বিষ। কুমারীর প্রথম রজ-রস… গুরু কোথা থেকে জোগাড় করে আমাকে দিয়ে বললেন, ‘খা বেটা’।… হাঁ করে মুখে ঢেলে দিলাম। খাওয়া হল। কোনো স্বাদ নাই, বিস্বাদও নাই। তারপর একসময় ঘুম এলো।… ঘুম নয় যেন যমে ধরল আমাকে। দিনরাত ঘুমে ঢলে আছি আর মাঝে মাঝে স্বপ্নে দেখতে পাচ্ছি একটি অষ্টদল পদ্ম যার মৃণাল চলে গেছে আমার জন্ম ঘরে সেখানে আমি একটি বিন্দু। আমাকে ঘিরে রক্তের ফুল থরে থরে সাজানো।

অদীক্ষিত একজন পল্লিবাসী অর্ধশিক্ষিত সাধকের পক্ষে এমনতর ভাবনিবিড় অবলোক একটু অস্বাভাবিক না লেগে পারে না— অন্তত আমাদের স্বাভাবিক যুক্তিবোধে। তবে গুহ্য চেতনার জগৎ আর যাপন তো আমাদের অভিজ্ঞতায় নেই, তাই তর্ক তোলা সাজে না। অতঃপর—

গুরু একদিন সকালেবেলায় বলে দিলেন, আজ তোর বিন্দু-ধারণ শিক্ষা হবে। সন্ধ্যের পর চলে যাবি অজয়ের বালির চরে। যেদিকে খুশি হটতে থাকবি। একসময় নিশানা পাবি। তখন সেই লক্ষ্য রেখে চলবি। যা এখন ঘরে বসে ধ্যানে থাক।

বৈপরীত্যটুকু বেশ চোখে পড়ে— এর আগে আমরা দুটি দীক্ষা উৎসবের বিবৃতি দেখেছি। তাতে নানা উপকরণ, পূজা, মন্ত্র, গুরুগিরি, গুরুপ্রণামী, মহাজনদের ছবি, ভোজন, কীর্তন, ফুল ফল সুগন্ধি কতকিছুর সমারোহ। নববস্ত্র, নগরভিক্ষা, কণ্ঠিবদল, চন্দনলেপন— আয়োজন ও সমারোহের যেন শেষ নেই। সে তুলনায় কার্তিকলাস আর তার বাউল গুরু জীবন গোঁসাই একেবারে অনাড়ম্বর ও অন্তর্মুখী। সরাসরি কায়াসাধনার কঠিন পন্থায় শিষ্যকে বৃত করতে গুরু তৎপর। বাউল সাধনা সব রকম কৃত্রিম ভজনপূজনকে এড়াতে চায়, দেবদেবীবিগ্রহকে অস্বীকার করে এবং সাধককে ঠেলে দেয় সাধনার গভীরে নির্জন পথে অনিকেত করে। কার্তিকের অভিজ্ঞতা শোনা যাক। গুরুর নির্দেশে সন্ধ্যার পর অজয়ের বালি চড়ায় নিঃসঙ্গ পরিক্রমায় তার কানে এল যেন দোতারার ঝংকার। সেই সুরের নিশানা ধরে এগোতে এগোতে অসাড় চৈতন্যে হঠাৎ একসময়ে আবিষ্কার করল গুরুকে। আর—

তাঁর কাছে লতা বসে। গুরু বললেন, ‘বোস’।

সে গুরুর কাছে বসতে গেল। তিনি বাধা দিয়ে বললেন, ‘আমার কাছে না, তোর সাধন-সঙ্গিনীর কাছে গিয়ে বোস।’

‘এবারে মন পেতে শোন্‌, যে কর্মে লিপ্ত হতে যাচ্ছিস তার পরিণাম ভয়ঙ্কর। তবু সাধক সেই ভয়ঙ্কর থেকেই পরমানন্দ প্রেম সংগ্রহ করে। মালকোঠায় ধন আগলে রাখে। আর এভাবেই রমণীর মন রক্ষা করে। বিন্দুধারণই সেই প্রেমসাধনা। আজ তা দুজনকে শেখাব।… নারী হচ্ছে আনন্দ সহচরী। সে এক মহামায়া। তিনিই সৃষ্টি ও স্থিতির জননী। আবার লয় বিলয়ের মহাশক্তিরূপিনী। সেই নারীর সঙ্গে লীলা সহজ কথা নয় বাবা। না বুঝে তার সঙ্গ করলে সমূলে নাশ হয়ে যাবি। তাই সাবধানে, ধীরে ধীরে, সুস্থিরে। যখনই বুঝবি উত্তেজনা তোকে গ্রাস করছে। কুম্ভক করবি। দম ধরে পিতৃধন রক্ষা করবি।’

এরপরে একটা দেহতত্ত্বের গান দোতারা বাজিয়ে শোনালেন গুরু জীবন গোঁসাই। গানটা কতবার শুনেছে সে কিন্তু অন্তর্গত তত্ত্বকথা বোঝেনি। গুরু গান শেষে বোঝাতে লাগলেন,

‘বোঝ্‌, ভালো করে বোঝ্‌, গানে রয়েছে গভীর জলে অষ্টদল পদ্মের কথা। সেই পদ্মের আটটি পাঁপড়ি প্রথমে জিভ দিয়ে অনুভব করবি। বুঝবি, সেই পদ্মের মৃণাল পেরিয়ে ফুল ঘিরে ফল জমাট বাঁধে। সেখানেই মানুষ বিরাজ করে। নারীসঙ্গ কালে এই ধ্যানটি সবসময় মাথার ভিতর ঢুকিয়ে রাখবি।’

কার্তিক দাস এই বলে শেষ করে তার বিবৃতি যে,

গুরু কৃপায় আমরা সেই বালিচরের উপর খুলে ফেললাম আমাদের গায়ের যত পোষাকের ছাল। লতা, যার সঙ্গে আমার দেহ সম্পর্ক আগে হয়েছে, এ যেন সে নয়। সে এক মোহ, প্রেম। আমি তার চুল, কপাল, ঠোঁট… তার মনোহর শরীরের সব জায়গা চুমাতে ভরিয়ে চললাম। তারপর গুরুনির্দেশিত প্রক্রিয়ায় আরম্ভ হল আমাদের কাজ। আমরা দুজনে দুজনকে জড়িয়ে ধরেছিলাম। সেই যেমন গানে আছে— ‘দেখে এলাম মর্তে/ একটি গর্তে/ দুই সাপের জড়াজড়ি’ সেই রকম। সে জিনিস বোঝানো যাবে না। করে দেখতে হবে। জীবনে তাকে পেতে হবে। সে জিনিসকে অনুভব করতে হবে। ভাবের জগতে বুঝতে হবে। ধ্যানে থাকতে হবে…

বাউল দীক্ষা ও গুরু নির্দেশিত কায়াবাদী সাধনার প্রত্যক্ষ জবানি এতক্ষণে আমাদের কাছে স্পষ্ট ও সত্য হয়ে উঠেছে। যদিও এর অনুভববেদ্য অংশটুকু, যা প্রধান অংশ, তা উপলব্ধি করা অসম্ভব। তবে এটা বোঝা যায় যে, প্রকৃত বাউল সাধনায় সফলতা আনতে হলে, কায় সংযম পেতে হলে, গুরু নির্দেশের সঙ্গে চারচন্দ্র সাধনও জরুরি। এ-পন্থা ইহবাদী ও বস্তুময়— লোভ, মোহ ও প্রলোভনে পদে পদে স্খলনের আশংকা। একা সাধক বাউল নয়, তার সাধনসঙ্গিনীর নিষ্কাম সহযোগিতা অনেক বেশি আবশ্যিক।

কিন্তু প্রসঙ্গত এমন প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, জীবন গোঁসাই যেমন পদ্ধতিতে কার্তিকদাস আর লতাকে ব্রহ্মচর্য থেকে দেহসংগম পর্যন্ত নিয়ে গেছেন সেটাই কি সব বাউল আখড়ায় গুরুরা অনুসরণ করেন? নাকি এটি নিতান্ত জীবন গোঁসাইয়ের আচরিত একক পদ্ধতি, যা সুনিশ্চিতভাবে তিনি অর্জন করেছেন তাঁর নিজস্ব গুরুর ঘরানা থেকে?

এ ধরনের পর্যালোচনা আর সরেজমিন সমীক্ষা থেকে বিচিত্র সব তথ্য উঠে আসে। প্রথমত, মনে হয়, অঞ্চলভেদে ও সম্প্রদায়ভেদে দীক্ষা ও শিক্ষার নিয়ম কানুন আলাদা। দ্বিতীয়ত, একেক,গুরুর একেক মত। কেউ মনে করেন দীক্ষার আগে একমাস পর্যবেক্ষণ ও গুরুগৃহে থাকা আবশ্যিক, কেউ মনে করেন অবস্থা অনুযায়ী সেটা কম সময়েই হতে পারে। যেমন জীবন গোঁসাই তো তিনদিনের ব্রহ্মচর্যের পরই কার্তিককে দীক্ষা শিক্ষা দিয়ে দিয়েছেন। তার কারণ তাদের দেহগত অভিজ্ঞতা আগে হয়ে গিয়েছিল এবং কার্তিক আগে আরেকটি আখড়ায় বেশ কিছুদিন ছিল— সেখান থেকেই সে লতাকে নিয়ে পালিয়ে এসেছিল। এক্ষেত্রে পরিস্থিতি ছিল জটিল এবং তাদের জরুরিভিত্তিতে সাধনজীবনে আশ্রয় দেওয়া ছিল প্রয়োজন। আসল কথা হল, মানুষের স্থূল দেহমনের আত্মিক সংস্কার না ঘটলে, সে লজ্জা-ঘৃণা-ভয়ের ঊর্ধ্বে উঠতে না পারলে, তাকে দীক্ষিত করা যাবে কী করে? কার্তিকদাস যে অত অনায়াসে মূত্র ও বিষ্ঠা গ্রহণে অভ্যস্ত হল, এত দ্রুত, তার কারণ ব্যাপারটি তার অজানা ছিল না। সে নির্দ্বিধায় গুরুপদাশ্রিত হয়েছিল— কায়মনোবাক্যে। বাউলদীক্ষায় এই নিঃসংশয় শরণ ও আত্মসমর্পণ নিতান্ত স্বাভাবিক ঘটনা এবং গুরুর গুরুত্ব এ-সাধনায় একমাত্র লক্ষণীয়।

শিষ্যের প্রস্তুতি ও মানসিক আকাঙ্ক্ষা এক্ষেত্রে বড় কথা, কারণ দেহকে আশ্রয় করে, আত্মসংযম আর শ্বসনিয়ন্ত্রণের সাহায্যে সে ব্রতী হবে এক বিপজ্জনক চর্যায়। বাউলগানে একে বলে ‘বাঁকা নদীর পিছল ঘাটে স্নান।’ এ-পন্থায় সংযুক্ত হবার আগে তাই জরুরি হল মনঃশিক্ষা। শিষ্যের মনের পাত্রটি উদার ও গ্রহিষ্ণু না হলে গুরু একা কী করবেন? বাউলরা বিশ্বাস করেন ‘সিংহের দুগ্ধ রয়না জেনো স্বর্ণপাত্র বিহনে’ সিংহের দুধ মানে গুরুবাক্য, স্বর্ণপাত্র মানে শিষ্যের মন। শিষ্যের সেই মন প্রথমে থাকে মৃৎপাত্রের মতো ভঙ্গুর বা অপক্ব, গুরু তাকে ক্রমে ক্রমে স্থায়ী ও পক্ব আকার দেন। তখন তা ধারণক্ষম হয়ে ওঠে, একদিনে নয়— দিনে দিনে। এবারে দেহ সাধনার কঠিন সরণিতে শিষ্যকে পদাতিক করে দেন গুরু, তাকে সাহস দেন আবার সাবধানও করেন। কামে থেকে নিষ্কামী হতে প্ররোচিত করেন অথচ বুঝিয়ে দেন সাধনার আনন্দ ও মুক্তির বার্তা। এই মুক্তি বৈরাগ্য সাধনের কঠোর তপশ্চর্যা কিংবা উপবাস ও ভোগহীনতার বিনিময়ে অর্জনীয় নয়। সেইজন্যই পদে পদে সাবধানতা, সতর্কতা ও গোপনতা লাগে।

নিজ সম্প্রদায় ও তার বিশ্বাসের জগতের বাইরে কেউ আকাঙ্ক্ষিত নন বাউলদের গুহ্য গোপ্য জগতে। ডাকা হয় শুধু সাধক ও মরমিদের, যাঁদের তাঁরা বলেন ‘মর্মিকজন’। তাঁদের সাহচর্য ও উপস্থিতি শিষ্যকে উদ্দীপ্ত করে, প্রেরিত করে। সে বোঝে, যে নিঃসঙ্গ গভীর কায়াবিশ্বে সে ভ্রমণশীল হয়ে উপার্জন করবে ‘রত্নধন’, সেই বিশ্বে তার আগে যাঁরা প্রবেশ করেছেন সেই সব মানুষরতনরা তার সামনেই আছেন। তাঁদের জন্য কোথাও হাতড়াতে হয় না। তাঁদের সজীব উপস্থিতি, সাধনসঙ্গিনীসহ, যেন জাগিয়ে তোলে পরম্পরার বোধ।

লোকায়ত সমাজের তো এটাই সবচেয়ে বড় শক্তি ও সংগঠন। সেখানে তৈরি হয় ‘কমিউনিটি’ বা সংহত স্বনির্ভর সমাজবিন্যাস। একক বিচ্ছিন্ন আত্মসর্বস্ব মানুষ, যাদের নির্মাণ করে ‘মেট্রোপলিটন’ মন, এই পরিবেশে তারা অবাঞ্ছিত। ব্যক্তিগত সম্পত্তি অর্জন বাউল সমাজের লক্ষ্য নয়, সে অনিকেত ও ভ্রমণশীল। তার সত্য একমাত্র তার পক্ষেই আহরণীয় কিন্তু সে একা নয়— রয়েছে সংবৃত এক গোপ্য সমাজের সমর্থন— দীক্ষার দিনে সেই অলক্ষ সমাজকে সে প্রত্যক্ষ করে। গুরু তার কাছে সেই সমাজসত্যের প্রতীকরূপে দেখা দেন। গুরূপদেশ হয়ে ওঠে বিকল্প এক জীবনসত্যের ফলিত ভাষ্য।

অভিজ্ঞতা থেকে এমন অনুমান হয় যে, অঞ্চলভেদে বাউলদের সাধনদীক্ষার রকমসকম আলাদা। আগে দেখা গেছে, যে বীরভূমের অন্তর্গত পল্লিসমাজে বৈষ্ণবতার এক স্বতঃস্ফূর্ত প্রবাহ আছে, যা বাউল সমাজের কিছুটা অনুপ্রবিষ্ট হয়েছে। দেবীদাসের দীক্ষানুষ্ঠান তো বৈষ্ণবীয় দীক্ষার ঘন সংলগ্ন বলে ভ্রম হয়। এবারে তাই অন্যতর অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য বা প্রতিতুলনার টানে দেখতে পারি মুর্শিদাবাদের বাউল সমাজকে, যাদের মধ্যে রয়ে গেছে ইসলামি পরম্পরা, বহুদিনের। গবেষক শক্তিনাথ ঝা দীর্ঘকাল মুর্শিদাবাদ ও নদিয়ার মুসলমান অধ্যুষিত গ্রাম সমাজের বাউলদের জানেন চেনেন এবং তাদের দুঃখবেদনা ও সংকটের দিনে ছুটে যান। মৌলবাদীদের সঙ্গে বাউলদের সংঘাত ও বিপন্নতার সংবাদ তিনি পৌঁছে দেন উচ্চবর্গের জাগ্রত বিবেকের কাছে, প্রশাসন ও সংবাদ মাধ্যমের কাছে। অবিরত লেখনীতে উন্মোচন করতে চান নানা সামাজিক অন্তর্ঘাতের স্বরূপ৷ সেইজন্য তাঁর সুদীর্ঘ ও প্রত্যক্ষ গবেষণালব্ধ বই ‘বস্তুবাদী বাউল’, যা প্রধানত মুর্শিদাবাদের আঞ্চলিক বাউল বৃত্তান্ত, আমাদের পক্ষে আকরিক ও নির্ভরযোগ্য মনে হয়। কৌতুহলবশত এবং প্রতিতুলনার কাজে তাঁর বই থেকে বাউল দীক্ষার অন্য এক চেহারা দেখতে পারি। তাঁর বক্তব্য:

বৈষ্ণবদের দীক্ষা, শিক্ষা এবং ভেকের পৃথক তিনজন গুরু এবং এদের শিক্ষাপ্রণালী স্বতন্ত্র। একজন শিষ্যকে নামমন্ত্র দেয়, অন্যজন দেহতত্ত্ব ও সাধনা শেখায়, অপরজন ‘ভেক’ দেয় এবং তৎসংক্রান্ত আচার-আচরণ শেখায়।… কিন্তু জেলার মুসলমান বাউলদের মন্ত্র, তত্ত্ব ও সাধনা একজনই শেখায়— এ মতে গুরু একজন।

বাউল মত নিতে আগ্রহী কোন নর বা নারী নির্দিষ্ট গুরুর সঙ্গে যোগাযোগ করে। নিয়মমত গুরু তাদের এক বছর ভক্তদের সঙ্গে মেলামেশা করতে বলেন। তার বাড়িতে যাতায়াত করতে বলেন। চেনা জানার পর কাউকে শিষ্য করাই সমীচীন হলেও বাস্তবে অনেকে তৎক্ষণাৎ বা অবিলম্বে বাছ-বিচার না করেই শিষ্য করে ফেলেন।

বাছবিচার না করে অবিলম্বে বা তৎক্ষণাৎ শিষ্য করে ফেলার কারণ কি? কারণ নিশ্চয় এটাই যে, না হলে অন্য কোনও গুরুর এক্তিয়ারে বা বৃত্তে চলে যাবে শিষ্য। তাতে তাঁর গুরুত্ব কমবে, শিষ্যসংখ্যাও কমে যাবে। এর পিছনে কিছুটা সামাজিক সম্মান ও অর্থনীতি থাকতে পারে। এটা অবশ্য সত্যি যে,

শিষ্যের যোগ্যতা বিচারের কোন অনড় নিয়মবিধি বাউল সমাজে নেই। গোপন দীক্ষা ছাড়াও নানা পদ্ধতির প্রকাশ্য দীক্ষার অনুষ্ঠান বাউলদের মধ্যে চলিত আছে। গুরুর বাড়িতে, নিজের বাড়িতে ছোট অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এ মত গ্রহণ করা হয়। কোন সাধুসভায় এ মত গ্রহণ করা হয়। একাধিকজন যৌথভাবে এ মত গ্রহণ করে। মতটি যুগলে নেওয়া হয় অথবা এককভাবে নেওয়া হয়। নারীর একক মত-গ্রহণ সর্বদা অনাড়ম্বরে বা গোপনে অনুষ্ঠিত হয়।

বৃত্তান্ত থেকে অনেক সংবাদ বেরিয়ে আসছে। মুর্শিদাবাদ অঞ্চলে বাউলফকিরদের (সংলগ্ন নদিয়াতেও) সংখ্যা খুব বেশি বলে আমার প্রত্যক্ষণ সাক্ষ্য দেয়। যদিও ‘বীরভূমের বাউল’ কথাটি প্রবচনের মতো প্রসিদ্ধ। বাউল মতে দীক্ষা-পদ্ধতির সরলীকরণ প্রমাণ করে মুসলমান বাউলদের ঔদার্য ও বিধিলঙ্ঘনের প্রবণতা। নারীর পক্ষে এককভাবে বাউল মত গ্রহণ বিষয়টি চমকপ্রদ। এরপর শক্তিনাথ লিখছেন:

প্রকাশ্য অনুষ্ঠানে সমবেত সাধুদের একজন দীক্ষা-প্রার্থীকে জিজ্ঞাসা করে যে সে কার কাছে মত নিতে চায়/ বা কাকে গুরু ধরতে চায়? তার পিতামাতার এতে অনুমতি আছে কিনা? স্বামী/ স্ত্রীর অনুমতি বা মত গ্রহণে সম্মতি আছে কিনা? প্রয়োজনীয় উত্তর পাবার পর এক গ্লাস জল এবং সামান্য চাল আনা হয়। গুরু প্রথমে চাল-জল করেন। গ্লাসে তার উচ্ছিষ্ট জল চালসহ শিষ্য এবং শিষ্যা গ্রহণ করে। অতঃপর গুরুকে বিশেষ ভঙ্গীতে প্রণাম করে। থালায় ৫ পোয়া চাল, ৫টি সুপারী, ৫টি পান, গামছা/ কাপড়/ পাঞ্জাবী এবং পাঁচ সিকে বা তদূর্ধ্ব টাকা দিয়ে গুরুকে অর্পণ করে। সবার সামনে তারা প্রতিজ্ঞা করে যে অক্ষরে অক্ষরে গুরুর কথা মেনে চলবে, গোপনীয়তা রক্ষা করবে।

লক্ষণীয় যে দীক্ষা গ্রহণের পক্ষে প্রয়োজনীয় উপচারগুলি সুলভ ও ক্রয়সীমার মধ্যে। লৌকিক সমাজের খুব সহজ পদ্ধতি অবলম্বিত হচ্ছে এবং অনুষ্ঠানে কোনও পুজোআচ্চা বা শঙ্খ ঘণ্টার নিনাদ নেই। নেই কোনও দেবমূর্তি বা চিত্র। এর মূলে ইসলামি প্রভাব থাকাই সম্ভব, কারণ ইসলাম কোনও প্রতিকৃতি বা দেহগত রূপকল্পনায় বিশ্বাসী নয়। পরবর্তী স্তরে দেখা যায়—

শিষ্য-শিষ্যাকে ঘরের ভেতরে নির্জনে, একেক করে বাঁদিকে বসিয়ে বাম কানে জপের জন্য একটি মন্ত্র দেন গুরু। এই মন্ত্রের তিন বা পাঁচ বা সাত অক্ষর। মন্ত্রগুলি: ‘লাইলাহা ইল্লালা,’ ‘আল্লা হু’, ‘হংস’, ‘হরেকৃষ্ণ’, ‘রাধার স্বামী’। হিন্দু সমাজের শিষ্যশিষ্যাকে হংস, হরেকৃষ্ণ বা পঞ্চনাম— কৃষ্ণ কৃষ্ণ গোবিন্দ রাধে কৃষ্ণ প্রভৃতি দেয়া হয়। পরবর্তীকালে বৈষ্ণব ঐতিহ্যে দেয়া হয়, কামবীজ ও কামগায়ত্রী।

বিবরণ অনুযায়ী মন্ত্রের নানা বিচিত্র চোখে পড়ার মতো। মুসলমান সমাজ থেকে আগত বাউল এবং হিন্দু সমাজ থেকে আগত বাউলের বীজমন্ত্রের পার্থক্য, প্রমাণ করে, অন্তত মুর্শিদাবাদে, যে বাউল সাধনা এক ও ঐক্যবদ্ধ নয়। সেখানে জাতিভেদ আছে। তবে বাউল মতে দীক্ষা নিলে জেগে উঠতে পারে শমতার কোনও বোধ এমন আশা করা স্বাভাবিক। তবে লেখক একটি কথা খোলসা করেননি, দীক্ষাদাতা গুরু মূলত কোন জাতিভুক্ত ছিলেন পূর্বাশ্রমে। যদি ইসলামি পরম্পরায় তাঁর জীবন অতিবাহিত হয়ে থাকে তবে বৈষ্ণবীয় কামবীজ ও কামগায়ত্রীর প্রতীক-তাৎপর্য তাঁর অধিগত থাকার কথা নয়। মন্ত্রের মধ্যে কিছুটা যে স্ববিরোধ আছে সেটাও স্পষ্ট। ‘লাইলাহা ইল্লালা’ উচ্চারণ ইসলামের কলেমার অন্তর্ভুক্ত, সাম্প্রদায়িক ধর্মবন্ধনমুক্ত ও শাস্ত্রবিরোধী বাউল কেন এমনতর ‘আকিদা’ (বিশ্বাস) নেবে যে আল্লাই একমাত্র উপাস্য?

এসব খুবই বিতর্কিত প্রসঙ্গ এবং বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়, এখানেও কাজ করছে আমাদের বিমিশ্রণধর্মী মানসপ্রবণতা, বিশেষত লোকায়ত চেতনায়। শাস্ত্রবাক্য সেখানে অমোঘ নয়— হয়তো তাদের কাছে আল্লা শব্দের তাৎপর্য অনেক অন্যরকম। বাউলফকিররা তো শব্দ নিয়ে কত খেলা খেলেন, আমি নিজেই এমন কত শুনেছি। যেমন ‘বিসমিল্লা’-কে তারা হয়তো বলে দিল ‘বিচ মে আল্লা’, তারপরে বলল, বীজ মে আল্লা’, বীজ মানে জন্মবীজ বা বীর্য। তার মানে আল্লা মতান্তরে মূলবস্তু বীর্য। এবারে বলা হল বীর্যই আল্লা এবং তিনি থাকেন দেহে। এমনতর উচ্চারণ মারাত্মক ও অনৈসলামিক বলে নৈষ্ঠিক মুসলমানদের মনে হতে পারে, হয় এবং এমনতর সব বাউল ব্যাখ্যানই তাদের সঙ্গে বিরোধের সূত্র তৈরি করে। বাউলদের শব্দের খেলা যেমন মজার তেমনই সৃজনধর্মী। যেমন ‘হংস’ শব্দকে উল্টে তারা অনেক সময় বলে ‘সহং’ বা ‘সোহং’— আমিই সে। আদম শব্দকে ভেঙে বলে আ + দম, যার মধ্যে ঈশ্বর দম বা শ্বাস রেখেছেন।

যাই হোক, শক্তিনাথ ঝা খুব বিস্তারে তাঁর বইতে দীক্ষাগ্রহণের পর শ্বাস নিয়ন্ত্রণের প্রণালী বুঝিয়েছেন। সেই পদ্ধতি বেশ জটিল ও অনুশীলন সাপেক্ষ। যেমন:

নাভি থেকে দক্ষিণ দিকে বাঁকিয়ে দম বায়ু বাঁদিকের হৃৎপিণ্ড ডান হৃৎপিণ্ড হয়ে কণ্ঠনালী দিয়ে ঊর্ধ্বে তোলার সশব্দ জপের পদ্ধতি গুরু দেখিয়ে দেন। সচরাচর মুসলমান সমাজভুক্ত শিষ্যকে ‘লাইলাহা ইল্লালা’ এবং হিন্দু সমাজগত শিষ্যশিষ্যাকে ‘ওঁ হুঁ চন্দ্রে বিন্দু গুরুবে নমঃ’ প্রভৃতি জপের মন্ত্র দেওয়া হয়। বায়ুকে ঊর্ধ্বগামী করার অন্যান্য মন্ত্র হল,

হু বিন্দু কর্তা হু নাম তোমার বিন্দু বিধাতা

ঐ বিন্দু নাম গণি

হু বিন্দু নামে উদ্ধার কর তুমি

উজানে যাও দয়ার সিন্ধু লাল বিন্দু মণি।

বা

রতির ঘরে বসল কালা

রতি যেন না যায় মারা

দোহাই কালা দোহাই কালা।

তথ্য থেকে আরও জানা যাচ্ছে, যোগ বা জপধ্যান এবং জিকিরের সাহায্যে পিরপন্থার সাধকরা দেহমার্জনা ও মূলবস্তু রক্ষা করে। কেউ কেউ ষটচক্রভেদ করা শেখান। বাউলরা বায়ু সাধনা করে কারণ তারা মনে করে শুধু জপ করে কায়াচর্যা বা বস্তুরক্ষা সম্ভব নয়। তার জন্য চাই রজবীজের সন্ধান ও সাধনা। সেই সাধনার নিয়ন্তা হলেন গুরু বা মুর্শিদ। প্রতীকী অর্থে যাকে বলে ‘বর্জোক’— বর্জোক মানে মধ্যবিন্দু, উপাস্য আর উপাসকের মাঝখানে। তিনিই মাধ্যম, তিনিই সেতু।

বীরভূমের বাউলদের সঙ্গে মুর্শিদাবাদের বাউলদের অনেকটাই মিল লক্ষ করা যায় গুরুর ভূমিকা থেকে। আমরা যেমন বলি গুরু-শিষ্য, কথান্তরে সেটা দাঁড়ায় পির-মুরিদ। জানা যাচ্ছে গুরুশিষ্য সংবাদের আরও রহস্য। যথা—

শিষ্য বা মুরিদের আরবি প্রতিশব্দ বায়য়াৎ। কোরাণে মোবায়াৎ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। এর অর্থ ক্রয়-বিক্রয়। শিষ্য বিক্রয়কারী, সে আপনার ধনপ্রাণ, যথাসর্বস্ব গুরুকে অর্পণ করবে। এর বিনিময়ে গুরু আজাত বা ত্রিতাপ জ্বালা থেকে মুক্ত করে স্বর্গসুখের রাজ্যে নিয়ে যাবে এবং দুঃখময় পুনর্জন্ম থেকে তাকে রক্ষা করবে। হিন্দু সমাজের অনেকে দেবতাকে প্রিয় জিনিস উৎসর্গ করে তা চিরতরে পরিত্যাগ করে। ইসলামের যথার্থ কোরবানীতে নফ্‌স্‌ বা কামনার ধনকে অর্থাৎ স্ত্রীকে কোরবানীর ব্যাখ্যা করে বাউল। নিজের স্ত্রীকে এবং নিজের মূল বস্তুকে গুরুকে দিয়ে দিতে হয় শিষ্যের। সে এগুলির মালিক নয় আর। স্বাধীনভাবে দেহমিলন বা সন্তান সৃষ্টির অধিকার তার থাকে না। দেহ দান এবং নিজের স্ত্রীকেও দান করে দেয়া অহং বিলোপের সাধনায় গুরুত্বপূর্ণ।

অন্যান্য বাউল গবেষকদের তুলনায় শক্তিনাথ ঝা অনেক সাহসী ও খোলামেলা। সেইজন্য তাঁর বইয়ে বাউলদের কিছু ক্রিয়াকরণ বা গোপন এবং অন্যকে বলা নিষেধ, তা অত্যন্ত স্পষ্টাক্ষরে লেখা হয়েছে। তবে কি এসব তথ্য তত গোপন নয়? নিশ্চয়ই বাউল সম্প্রদায়ের সদস্যভুক্ত মানুষ এসব গুহ্য বার্তা তাঁকে বলেছেন, নইলে তিনি জানলেন কী করে? এ ব্যাপারে আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলতে পারি। সত্তর দশক পর্যন্ত গ্রামাঞ্চলে বাউল ফকিরদের সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে কথাবার্তায় একটা সীমা বাঁধতে হত— অর্থাৎ এই পর্যন্ত জিজ্ঞাসা করা যেতে পারে, তার বাইরে আর নয়। কালু ফকির নামে এক তাত্ত্বিক আমাকে স্পষ্টই বলে দিয়েছিলেন, ‘বাইরে থেকে যতদূর জানা সম্ভব তা তোমার জানা হয়ে গেছে। বাকি যা আছে তা তোমাকে নিজে করে জেনে নিতে হবে। তোমাকে তার জন্য আমাদের কাছে বাউলদীক্ষা নিতে হবে। আমরা তোমাকে সব শিখিয়ে দেব। সাধনসঙ্গিনী হিসেবে নিজের স্ত্রীকে নিতে পারো। তাকে দীক্ষিত করে নিতে পারো, না নিলেও চলবে। তবে আমাদের ক্রিয়াকরণে তাঁর যদি আপত্তি থাকে তবে আমরা তোমাকে কায়াসঙ্গিনী দিতে পারি। তাঁর সাহায্যে ক্রিয়াকরণ জেনে নিলে তোমাকে আর পাঁচজনের কাছে ঘুরে বেড়াতে হবে না। বাবা, এ জিনিস মুখে বলে বোঝানো যায় না— আচরণ করে বুঝতে হয়, তার জন্যে গুরু-মুর্শেদ লাগে, সময় লাগে, ধৈর্য লাগে, লেগে থাকতে হয়।’

তবুও লক্ষ করেছি বিশ-পঁচিশ বছর আগে বাউল সাধকরা একটা আড়াল রাখতেন। ‘ওসব খুব নিগূঢ় তত্ত্ব’ বলে এড়িয়ে যেতেন। এখন আর তেমন নেই, বাঁধ ভেঙে গেছে। এখন তাঁরাই সব কথা খুলে বলতে আর আপত্তি করেন না। অনেকে গড়গড় করে বলে দেন। হঠাৎ এতটা হাওয়া বদল হয়ে গেল কেন? যাঁরা নিজেদের রাখতে চাইতেন আড়ালে, বাক্য ব্যবহারে থাকতেন কৃপণ হয়ে, শহুরে ভদ্রলোকদের তত বিশ্বাস করতেন না, ভয় পেতেন— এই বোধহয় সব রহস্য সবাই জেনে যাবে— তাঁরাই এখন অনর্গলভাষী কেন? একটা কারণ এই যে, বাউলদের সংবৃত বদ্ধ সমাজ এখন ভেঙে পড়েছে, প্রধানত অর্থনৈতিক কারণে। আর একটা কারণ, ভদ্রসমাজের সঙ্গে না হোক গ্রাম সমাজের সাধারণ স্তরে বাউল জীবন এখন তেমন আর ধিক্কৃত বা নিন্দিত নেই, চলছে অবাধ চলাচল। এ ছাড়া গায়ক বাউল সম্প্রদায় এখন রুজিরোজগার কিংবা যশ খ্যাতি প্রতিষ্ঠার তাড়নায় গ্রামসীমা ছাড়িয়ে ঢুকে পড়েছেন নাগরিক সমাজে। নাগরিক সমাজও ব্যাপক হারে অংশ নিচ্ছে গ্রাম্য মেলা ও পার্বণে, যেখানে বাউল গান তার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। সেই গান যাঁরা শুনছেন তাঁরা জানতে চাইছেন তার গূঢ়ার্থ। সভা-সেমিনারে এখন বাউলদের অংশগ্রহণ খুব স্বাভাবিক। সরকারি কিছু প্রতিষ্ঠান, লোকসংস্কৃতি ও আদিবাসী সংস্কৃতি কেন্দ্র, তথ্য সংস্কৃতি দপ্তর এবং পূর্বাঞ্চল সংস্কৃতি কেন্দ্র এখন বাউল-পোষণে সক্রিয় উদ্যোগ নিচ্ছে। তা ছাড়া হচ্ছে সাংস্কৃতিক বিনিময়। যেমন কলকাতায় অনুষ্ঠিত লালন-উৎসবে কুষ্টিয়া থেকে আনা হল সেখানকার একদল বাউল। এখান থেকেও তেমনই নিয়ত যাচ্ছেন বাউলরা— অনবরত ভাব ও তত্ত্বের লেনদেন হচ্ছে। জিজ্ঞাসু মানুষের সংখ্যা বাড়ছে তাই বাউলদের নিয়ে ডকুমেনটারি ফিল্ম তৈরি করা হচ্ছে। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা একবার তাদের ক্যাম্পাসে গাইতে নিয়ে এল কাঙালিনী সুফিয়া বা কালাচাঁদ দরবেশকে। এসবই নানা ধরনের লেনদেন এবং তার ফলে খুলে যাচ্ছে রহস্যের গুণ্ঠন, ভেঙে যাচ্ছে এতদিনকার চেষ্টিত আড়াল। ক্যাসেট সাম্রাজ্যের প্রসার রহস্যনিমীল গানকে করে দিচ্ছে সর্বত্রগামী। বেরোচ্ছে পত্রপত্রিকার বাউল সংখ্যা। বাউল তত্ত্বে বিশেষজ্ঞ গবেষকরা গত দশকে বহুতর লেখা প্রকাশ করছেন দুই বাংলায়। বাউল গানের এমন কয়েকটি সংকলন বেরিয়েছে যাতে শব্দের ভাবার্থ বা সংকেত সংযোজিত হচ্ছে— তার মান বা সত্যতা যতই বিতর্কিত হোক। মোট কথা ক্ষিতিমোহন বা মনসুরউদ্দিনদের কাল আর নেই। বাউল গান এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের চর্চার আওতায় এসে গেছে— হচ্ছে নিবিড় পর্যবেক্ষণ ও গবেষণার বিষয়ভুক্ত। বাউল গানের সুর নিয়ে সংগীতকাররা নতুন নিরীক্ষা করছেন। অবস্থা এমনই বিচিত্র যে, সেদিন এক সাংবাদিক কলকাতা থেকে টেলিফোনে জানতে চাইলেন, ‘হ্যাঁ মশাই, চাঁদের গায়ে চাঁদ লেগেছে গানটার মানে কি?’ বাধ্য হয়ে জানাতে হল, মানে নিশ্চয়ই একটা আছে কিন্তু সেটা এত সহজে জেনে যাবেন? এমনকী টেলিফোনে? একী কোনও তথ্য না সংবাদ না মন্তব্য? আর তা ছাড়া বললেই যে বুঝবেন তা কী করে জানলেন? টেলিফোনকারী নিশ্চয়ই প্রসন্ন হলেন না কিন্তু বোঝা গেল বাউল গান এখন সর্বজনীন কৌতুহলের অঙ্গ হয়ে উঠেছে। এ-তরঙ্গ রুখবে কে?

এবারে সার কথায় আসি। ইংরিজিতে যাকে বলে ‘নন-কমিউনিকেটিভ’, বাউলরা বহুদিন পর্যন্ত ছিলেন সেই দলে। আর এখন তাঁরা মাস-কমিউনিকেশনের বৃহত্তর বলয়ে আসতে চাইছেন— সেটা সময়ের দাবি। গ্রামিক সমাজের একটেরে মেটে দাওয়ায় বসে অন্তর্গুপ্ত মগ্ন সাধক সন্ধান করতে গেলে এখন হতাশ হতে হবে। বিশ-পঁচিশ বছর আগেও তাঁদের দেখেছি— এখন নেই। অথচ যাঁরা আছেন তাঁদের পক্ষে গোপনতা রক্ষা বাউল জীবনের কোনও শর্ত নয়। বীরভূমের গৌরবাবা প্রাঞ্জল ভাষায় আমার টেপ রেকর্ডারে স্বেচ্ছায় বলে গেছেন তাঁর সাধনবিবরণ— বিনা দ্বিধায়। এই সব ঘটনা বলে, ভূমিকা রচনা করে, এবারে শক্তিনাথ ঝা-র বই থেকে আরেকটু উদ্ধৃত করব।

শিষ্য-শিষ্যা যদি যথার্থ ভক্ত এবং বাউল তত্ত্ব জেনে থাকে এবং প্রার্থনা করে গুপ্ত দীক্ষা, তাহলে অন্য কতগুলি গোপন পদ্ধতি দীক্ষায় অনুষ্ঠিত হয়। যেমন ভরতপুর থানার তালগ্রামের গুরু লালবাবা শিষ্য-শিষ্যার জিহ্বা চুম্বন ও শোষণ করে দীক্ষা দেন। এতে নাকি কুলকুণ্ডলিনী জেগে ওঠে। দীক্ষার সময় নারী রজঃস্বলা থাকলে সে গুরুকে রজঃ দান করে; অন্যথায় রস বা স্তন দুগ্ধ দান করে।

কলস দীক্ষায় বারো বছরের এক কিশোরীর প্রয়োজন হয়। শিষ্য বস্ত্র এবং নারী দেবে গুরুকে; তিনি রজঃস্বলা নারী দেহে রজঃবীজের মিলন করে, ‘ওঁ পদ্ম শুক্রধারা’ মন্ত্রে এই দেহরস সংগ্রহ করে, তা দিয়ে শিষ্য-শিষ্যাকে দীক্ষা দেবেন। অনেক সময় গুরু নিজবস্তু দিয়ে শিষ্য-শিষ্যাকে দীক্ষা দেন।

এমন আশ্চর্য অন্তঃশীল গোপ্য জগতের সংবাদ যেমন অস্বস্তিকর তেমনই রুচিহীন লাগতে পারে অনেকের সংস্কারে, কিন্তু এ বিবরণে কোনও কল্পনা নেই। কারণ,

বাউলদের মধ্যে যথার্থ গুরুকরণ এক গুপ্ত সাধনা।… চারচন্দ্রভেদ বাউল সাধনার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। ‘চারচন্দ্র আলেক সাঁই তার উপরে কর্ম নাই’… এই চারচন্দ্রের সাধনা দিয়েই বাউল সনাক্ত করা যায়। দেহ রক্ষায়, বস্তু রক্ষায়, রোগের বিরুদ্ধে আত্মরক্ষায় বাউল পন্থায় চারচন্দ্র অনিবার্য এক সাধনা।… যৌনরোগী বা দেহসাধক যারা চারচন্দ্র ভেদ করে না, বাউল তাদের বৈদিক-যৌগিক সাধক বলে।

ক্ষিতিমোহনের দাবি, তিনি এই কায়াবাদের বিরোধী যোগপন্থার সাধক বাউলদের গান সংগ্রহ করেছেন।

বাউল দীক্ষার নানা বৈচিত্র্য, রীতিনীতি, গুপ্ত-ব্যক্ত সাধনার বহুচারী স্বভাব বর্ণনা করতে গিয়ে আঞ্চলিকতার প্রসঙ্গ উঠেছে। দেখতে পাচ্ছি, পশ্চিমবঙ্গের গায়ে-গা-লাগানো দুটি জেলা বীরভুম আর মুর্শিদাবাদে বাউল সম্প্রদায়ের কত কি স্বাতন্ত্র্য। এই স্বাতন্ত্র্যের কারণ নিশ্চয়ই আঞ্চলিকতা এবং পারস্পরিক সংযোগের অভাব। আধা বৈষ্ণব আধা বাউলদের সঙ্গে আধা মুসলমান আধা বাউলদের পার্থক্য দুস্তর। এরা যেন আলাদা গোষ্ঠীর মতো। দু’দলের অবস্থান ও প্রতিষ্ঠাও ভিন্ন। বীরভূমের গ্রামিক সমাজ-ছকে বাউলরা শ্রদ্ধা না পেলেও বিরুদ্ধতা পায়নি কখনও। তারা যেন আবহমান পল্লিজীবনের শরিক। তাদের মাধুকরী চলে হিন্দু গৃহস্থের বদান্যতায়। তাদের গানের শ্রোতা ও সমজদারও গ্রাম্য সমাজ। কিন্তু মুর্শিদাবাদে আলেমদের সঙ্গে বাউলদের সংঘর্ষ ও সংঘাত চলছেই। তার কারণ সেখানকার বেশির ভাগ বাউল শরিয়তি সমাজ ও নির্দেশ অগ্রাহ্য করে চলে এসেছে বাউল পন্থায়। এই আত্মবিচ্ছেদ মুসলিম মানসের পক্ষে অসহনীয়। তাদের ক্ষোভ ও আক্রোশ বাউলদের ওপর আরও বেশি এইজন্য যে বাহ্যত তারা মুসলিম সমাজের অংশরূপে থাকে এবং সেই সমাজকেই ভেতরে ভেতরে প্রতিবাদে প্ররোচিত করে। ইসলাম ধর্মে গান গাওয়া নিষিদ্ধ অথচ বাউলদের গানই একমাত্র আত্মপ্রকাশের বাণী। অন্যদিকে তারা স্বভাবত সৎ ও শান্তিপ্রিয়, অনাড়ম্বর এমনকী দরিদ্র জীবনযাপনে কৃতার্থবোধ করে। মৌলবাদী শক্তির প্রতাপে তারা অসহায় ও সংকুচিত। তাই মার খেলেও পালটা মার দিতে পারে না। মুর্শিদাবাদের একটি গ্রামে একজন বাউল আমাকে বলেছিলেন, ‘আমাদের হল চোরের মতো জীবন। আমরা সমাজে আত্মগোপন করে থাকি।’ হিন্দু সমাজ থেকে প্রতিবাদী মন নিয়ে যারা বেরিয়ে এসে বাউল হয় তাদের এমন দুর্গতি বা খেদ নেই। হিন্দু সমাজ কাঠামো অত্যন্ত সহনশীল ও উদার।

খোঁজ করলে সারা বাংলায় বাউল সাধনা ও দীক্ষা করণের নতুন নতুন খবর পাওয়া যাবে। কিন্তু এতক্ষণকার আলোচনায় আমরা মনে রাখিনি প্রতিবেশী বাংলাদেশের কথা। বাউল মত স্ফুরিত হয়েছিল অখণ্ড বাংলায়। রাজনৈতিক বিভাজনে দুটি দেশ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে কিন্তু বিশেষ করে গ্রামসমাজ ও লোকায়ত জীবনের কাঠামো, খাদ্যাভ্যাস ও ভাবনা বিশ্বাসে খুব একটা বিচ্ছেদ ঘটেনি— দুটি দেশকে অলক্ষে ধরে রেখেছে বাংলা ভাষা ও বাঙালিয়ানা, তার লয়ক্ষয় নেই। সেইজন্যই জানতে ইচ্ছা করে বাংলাদেশে বাউলদের বর্তমান অবস্থা কেমন এবং তাদের আচরণবাদ ও দীক্ষাশিক্ষার রীতিপদ্ধতি কতটা স্বতন্ত্র। অবশ্য সেই তথ্য উপস্থাপনের আগে মনে রাখা উচিত যে দেশ বিভাগের ফলে নানা প্রতিকূলতায় বাংলাদেশে বাউলরা প্রায় ক্ষয়িষ্ণু। তা ছাড়া সেখানে ইসলামের জঙ্গি ভূমিকা বিশ শতকের তৃতীয় দশক থেকেই বাউলধ্বংসে উদ্বুদ্ধ। তার ফলে লালন ফকির, পাঞ্জু শাহ, হাসন রজা, দীন শরৎ, শীতলাং শাহ, রশীদ, জালাল ও বিজয় সরকারের মতো উন্নত বাউল গীতিকারের দেশ এখন বন্ধ্যা। কুষ্টিয়ার আবুল আহসান চৌধুরীর পরিবেশিত তথ্য থেকে জানা যায়:

বাউল সম্প্রদায়ভুক্ত অনেকেই এখন নানাকারণে জাত-ব্যবসা ত্যাগ করে ভিন্ন পেশা গ্রহণ করেছেন। কেউ ক্ষুদে দোকানদার বা ব্যবসায়ী, কেউ নিম্ন চাকুরে, কেউ গতর খাটিয়ে জন-মুনিষ। কিছু সংখ্যক ভিক্ষাজীবীও আছে।

খোদ লালন ফকিরের আস্তানা ছেঁউড়িয়াতে এখন মাত্র কুড়িঘর বাউল থাকে। তাদের মধ্যে দীক্ষাপ্রাপ্ত বাউল স্রেফ ছ’জন। বাউল দীক্ষার অনুসন্ধান তাই সেদেশে বেশ আয়াসসাধ্য কাজ। তবু আবুল আহসান তেমন এক প্রতিবেদন পেশ করেছেন। কুষ্টিয়া অঞ্চলে প্রধানত লালন-পন্থার বাউলরা থাকে। দীক্ষা-প্রতিবেদন তাই সেই ঘরানার বলে ধরে নিতে হবে। বাংলার অন্য অঞ্চলের মতোই বাংলাদেশেও,

সাধনায় প্রবেশের জন্য বাউলকে গুরুর কাছে দীক্ষা নিতে হয়। একেক ঘরানার একেক পন্থা আর পদ্ধতি। লালনীয় মতে গুরু তিনবার কলেমা হক পাঠ করিয়ে ঘরে তোলেন দীক্ষার্থীকে। গুরুর হাত থেকে চাল-পানি ‘সেবা’ গ্রহণের পর দীক্ষার করণ পূর্ণ হয়। এরপর চলে সাঁইজীর নাম-গান। সবশেষে সাধুচরণে নিবেদিত হয় সাধ্য-‘সেবা।’ সাধারণত দীক্ষার এই অনুষ্ঠান গুরু বা শিষ্যের বাড়ি কিংবা লালন সাঁইজীর ধামে হয়ে থাকে।

কলেমা থেকে চাল-জল সেবা, শিষ্য বাড়ি বা গুরুগৃহ— কুষ্টিয়ার বাউলের সঙ্গে মুর্শিদাবাদের বাউলদীক্ষার অনুপুঙ্খ প্রায় এক, এর কারণ কি? কারণ দুই অঞ্চল খুব কাছাকাছি এবং দুই স্থানেই বাউলদের প্রধান অংশ দীক্ষিত হতে আসে মুসলমান সম্প্রদায় থেকে। কুষ্টিয়ার দীক্ষাকর্মে বাড়তি সংযোজন হল লালনগীতি এবং লালনের ধামের ঐশী অনুষঙ্গ। পরবর্তী বৃত্তান্ত,

দীক্ষার পর শুরু হয় শিয্যের পরীক্ষাকাল। গুরুর নির্দেশে চলতে থাকে সাধনভজনের ক্রিয়া-করণ। শিষ্য সাধনার ‘স্থূল’ বা ‘ফাশ্‌ফির শেখ’ পর্যায় অতিক্রম করলে ভেক খিলাফতের যোগ্য হয়ে ওঠেন। দীক্ষাগুরু কিংবা তাঁর অবর্তমানে গুরু-মা খিলাফত দিয়ে থাকেন। এঁদের উভয়ের অনুপস্থিতিতে তৃতীয় একজন সাধু এই দায়িত্ব পালন করতে পারেন। তবে তাঁকে পাঁচজন সাধুগুরুর সম্মতি নিতে হয়।

লালন পন্থা, দেখা যাচ্ছে, যথেষ্ট উদার। গুরুর বদলে গুরুমা, তাঁদের বদলে তৃতীয় কোনও সাধুজনের দীক্ষাদানের অধিকার ব্যাপারটি অভিনব। এরপরে আবুল আহসান ১৯৯০ সালের ১৯ অক্টোবর লালনের মাজারে (ছেঁউড়িয়ার) অনুষ্ঠিত এক পুরুষ-প্রকৃতির খিলাফত-পর্বের সরেজমিন বিবরণ দিয়েছেন। স্বচক্ষে দেখা বলে লেখকের ভাবাবেগ তার ভাষা-শরীরে প্রত্যক্ষ।

দম্পতির নাম আবুবকর সিদ্দিক ও রাইমা খাতুন ওরফে পারুল, নিবাস জেলা যশোরের ঝিকরগাছির কালিয়া গ্রাম। খিলাফত দেবেন প্রবীণ বাউল সাধক ফকির গোলাম ইয়াসিন শাহ। দীক্ষা হবে লালন শাহের মাজারে।

অনুষ্ঠান বিবরণের ভিতরে প্রবেশ করার আগে, পাঠক, জেনে নিতে পারেন আরও কিছু জরুরি তথ্য। যথা— ভেক খিলাফতের দুটি রকম আছে। একটি বৈষ্ণবীয় আরেকটি দরবেশি। দুটির পদ্ধতি ও পোশাক আলাদা, আনুষ্ঠানিক লালনগীতি আলাদা। ভেকে আঁচলা-ঝোলা, খিলাফতে শুধু আঁচলা। ভেকে ‘ভিক্ষা’ আর খিলাফতে ‘নজরানা’। লালনের লেখা ‘কাঙাল হব মেঙে খাব’ গাওয়া হয় ভেকের সময়। আর দরবেশি মতের খিলাফতে গাওয়া হয় ‘কপাট মারো কামের ঘরে।’ সেদিন আবুবকর-পারুলের হয়েছিল খিলাফত তবে বৈষ্ণবীয় মতে। এবারে খিলাফতের বর্ণনা—

মাজার-আঙিনার দক্ষিণ-পূর্ব কোণে সবাই এসে জড়ো হয়েছেন। চারজন সাধু চাঁদোয়ার চারকোণা ধরে রয়েছেন। সৌম্য-সুঠাম দীর্ঘদেহী আবুবকরকে এনে দাঁড় করানো হলো চাঁদোয়ার তলায়। লম্বা বাবরি ও ঘন কৃষ্ণ শ্মশ্রু গৌরবর্ণের ছটাকে আরও উজ্জ্বল করে তুলেছে। আমগাছের পাতার ফাঁক গলে নেমে আসা সূর্যের আভায় ঝলমল করছে সারা শরীর।

আবুবকরের এতদিনের শরীয়তি পোষাক খুলে নিয়ে পরিয়ে দেওয়া হলো ‘খিলকা’ নামের সেলাইবিহীন একখণ্ড শাদা কাপড় আর শাদা তহবন্দ। পরানো হল ‘ডোর কপনি’, লেঙ্গটি বা নেংটি; রুদ্ধ হলো কামের ঘর আর সৃষ্টির দ্বার। কাঁধে উঠলো আঁচলা-ঝোলা। গুরুমা গলায় পরালেন শাদা তস্‌বিহ বা জপমালা। মাথায় বাঁধা হলো শাদা পাগড়ি বা তাজ। সব কিছুতেই শাদা রঙের ব্যবহার এক বিশেষ প্রতীকী তাৎপর্য তুলে ধরে। হাতে ধরিয়ে দেওয়া হলো জলপাত্র ও একটি ছড়ি।

এবারে আনা হল ধর্মপত্নী পারুলকে। পাড়বিহীন শাদা কাপড়ে জড়ানো হলো তার শরীর, গায়ে চড়লো ‘খিলকা’। একে একে তাঁকেও পরানো হলো ভেকখিলাফতের পোষাক। মৃতের অন্তিম-যাত্রার সাজে সাজলেন তাঁরা, ‘জিন্দা দেহে মরার বসন।’

মনে হচ্ছে যেন একটা নতুন জগতে এসে পড়েছি আমরা। আধা ইসলামি আধা বাউল সংস্কারের মধ্যে দিয়ে চলছে এক নবজীবনের প্রস্তুতি। সেলাইবিহীন লম্বা ঝুলের খিলকা আর কোমরে জড়ানো তহবন্দ যেন একেবারে ফকিরি সাজ, যাতে নেই কোনও জৌলুস বা অলংকার। এসবই মৃতের সাজসজ্জা— লালনের গানে একেই বলা হয়েছে ‘জিন্দা দেহে মরার বসন’, ঠিকই। কিন্তু এ কেমন মৃত্যু? এ হল পার্থিব জগতের ভোগসুখকামী সত্তার মৃত্যু। মানুষটির আর কোনও সামাজিক দায়বদ্ধতা থাকল না— একেবারে পরিবর্তিত সত্তা, ‘জ্যান্তে মরা’। খেয়াল রাখতে হবে, শুধু বহিরঙ্গিক রূপান্তর নয়, বিশেষ মানসিক রূপান্তর ঘটে গেছে তার। ইসলামিয়া ছেড়ে সে সামিল হল লোকায়ত সাধনে। আজন্মের সংস্কার ত্যাগ করে এবারে তার অন্তরের অন্তস্তলে ঘটল নবভাবের অভ্যুদয়। বহুবর্ণরঞ্জিত জীবন থেকে সে শ্বেতশুভ্র রংকে আলাদা করে বেছে নিল— সাদা একরকম প্রতীকী বর্ণ। কীসের প্রতীক? অনন্তদাসের একখানা পদ পেয়েছিলাম জনৈক বাউলের সংগ্রহে। তাতে আছে:

বলো আমার বাবা কোথায় গেল?

দেখিতে দেখিতে আমার দিন গত হল।

শুধাই বৃদ্ধ মাতার কাছে

বাবা আমার কোথায় গেছে?

মা বলে তোর ঘরের ভেতর ছিল।

সহোদর বলে ভাই হাটে মিলে নাই

ভগ্নী বলে অগ্নিবেশে ঘর করেছে আলো।

বাবার দেহ বাবার মায় বাবার দোহাই দিয়ে বেড়াই

পিতাপুত্রে আলাপ নাই যে ভাল—

ইতিপূর্বে মাতৃগর্ভে দেখা হয়েছিল।

রহস্যভরা এমন দেহতত্ত্বের গানের উপজীব্য হল পিতৃবস্তু বা বীর্য— যা সন্তানের দেহেও বর্তমান। তাই মা বলছেন ‘তোর ঘরের ভেতর ছিল’। ঘর মানে দেহ, দেহঘর। সেই অমোঘ পিতৃবস্তু, যা সন্তান-সন্ততিক্রমে চলছে মানবসভ্যতার উষাকাল থেকে, তার বিলয় নেই। তা সদা সৃষ্টিশীল হয়ে ওঠে মাতৃগর্ভে গিয়ে। বাউল গানে চমৎকার কিছু পরম্পরার ছক থাকে, যেন অনন্ত সত্যের বিচ্ছুরণ। যেমন একটা পদে আছে, ‘ঝিয়ের পেটে মায়ের জনম।’ ঝি মানে মেয়ে বা কন্যা, সে জন্মেছে তার মা’র গর্ভ থেকে। আবার সে একদিন হবে মা, তখন বলা যাবে ঝিয়ের পেটে মায়ের জন্ম। তেমনই পিতৃবস্তু থেকে জন্মায় সন্তান, তার মধ্যে থাকে পিতৃবস্তু, যৌবনে সেই বস্তু থেকে সেও অর্জন করে পিতৃত্ব। তবে সেক্ষেত্রে মাতৃবস্তু বা রজের সংস্পর্শ চাই, অর্থাৎ ডিম্বাণু। বাউল ভারী রহস্য করে প্রতীকী আবরণ দিয়ে গানে বলেছে শুক্ররস আর ডিম্বাণুর মিলন কাহিনি— বলেছে,

বসত তাদের শুনি ভাণ্ডের মাঝেতে।

দুই দেশেতে তারা দুইজন বসত করে—

কী প্রকারে দেখা রাস্তার মাঝারে।

এদের রসান দিয়ে বলা হয়েছে ‘কালা’ আর ‘বোবা’। চমৎকার।

পিতৃসন্ধানী সেই সন্তানের কথা হচ্ছিল, যার প্রশ্ন: ‘মা, আমার বাবা কোথায় গেল?’ পিতাপুত্রে আলাপ নেই তেমন, কেবল অস্পষ্ট স্মৃতি চেতনায় মনে পড়ে যেন মাতৃগর্ভে একবার চকিতে দেখা হয়েছিল পিতাকে। সেই ধূসর স্মৃতি থেকে পিতৃসন্ধান কি সম্ভব? বিভ্রান্তিও তো কম নয়—

কেউ বলে গেছে এই পথে

কেউ বলে গেছে ওই পথে

নানা মুনির নানা মত কোন পথে বলো?

কেউ বলে নেমেছে জলে

কেউ বলে তব অনিলে

কেউ বলে অনলে পুড়ে গেল।

বাউল কল্পনায় শূন্যতার একটি ভূমিকা থাকে— ‘আছে শূন্যভরে একটি কমল।’ পিতৃবস্তু, যা জনয়িতা, তা পঞ্চভূত থেকে শরীরে আসে, পুষ্টির পথে, খাদ্যে ও জলে। আব-আকাশ-খাক-বাত, এই চার উপাদানে সব কিছু গড়া, তাই অনল-অনিল-জলের উল্লেখ। এরপরে শেষ কথাটা উচ্চারিত:

আত্মতত্ত্ব যে জেনেছে বাবার খবর সে পেয়েছে

সত্য করে আমার কাছে বলো।

বলো বাবার রূপবর্ণ নাম রূপ তার ভিন্ন ভিন্ন

অনন্ত কয় বিশেষ চিহ্ন

বাবা আমার কালো নয়, ধলো।

অনবদ্য এই জীবনমুখী গান। পিতৃবস্তু অর্থাৎ সাদা। এইজন্যই দীক্ষাবস্ত্রের সবই সাদা। আবুবকর ও পারুল এতদিনে বুঝেছে পিতৃবস্তুর বর্ণচিহ্ন আর মর্ম। সেইজন্যই তাদের সামনে উন্মোচিত হবে এবার দীক্ষান্ত জীবন, প্রসারিত ও প্রেমময়। কামের ঘরে কপাট মেরে সেখানে যেতে হবে। ঘরের চাবি দিতে হবে গুরুর হাতে। উষ্ণ সংযত সংবেদনে ভরা অনন্ত সাধনজীবন তো বৈরাগ্যের নয়, তাই লালনপন্থী বাউল কখনও গেরুয়া পরে না। আবুবকররাও পরেনি।

এবারে আমরা ফিরে যাই ছেঁউড়িয়ায় লালনের মাজারে— যেখানে চলছে এক আগ্রহী নরনারীর খিলাফতের প্রস্তুতি-পর্ব। প্রত্যক্ষদর্শী লিখছেন,

নিম্নস্বরে কলেমা বা মন্ত্র পাঠ করালেন খাদেম নিজাম শাহ। জীবিতের জানাজা শেষ হলে সকল দুষ্কর্ম ও পাপ থেকে দূরে থাকার হুকুম হিসেবে শাদা কাপড় দিয়ে দুজনের চোখ ও হাত বেঁধে দেওয়া হল। এরপর গুরু গোলাম ইয়াসিন শাহ্‌ কম্পিত হাতে মাজার-আঙিনায় একমুঠো চাল ছিটিয়ে বললেন, ‘ভূ-মণ্ডলে ছড়িয়ে দিলাম তোমাদের দানা, খুঁটে খাও।’ পারুল-আবুবকর গুরুর পায়ে মাথা ঠেকিয়ে ভক্তি দিলেন। সকল মায়া-মোহ থেকে আজ তাঁরা মুক্ত হলেন। স্বজন-সংসারের কোনো দাবি আর তাঁদের কাছে রইল না। জীবন মরণ, সাধ-আকাঙ্ক্ষা, আনন্দ-বেদনা সবকিছু আজ তাঁরা সঁপে দিলেন সাঁইজীর চরণে। জগৎ সংসারের কাছে তাঁরা আজ মৃত।

এবার শেষ দৃশ্য। হাত-চোখ বাঁধা পারুল-আবুবকরকে গুরুমা আর খাদেমের সেবাদাসী ধীরপায়ে নিয়ে গেলেন সাঁইজীর সমাধি-ঘরের পাশে, সাতবার তাওয়াফ (প্রদক্ষিণ) করতে হবে। তাঁদের পেছনে সাধু গুরুর দল, একতারা-খঞ্জরি-জুড়ি হাতে নিয়ে ভক্ত-শিয্যেরা গাইছেন দেলদরিয়ার তুফান-তোলা ভেক-খিলাফতের সেই গানটি:

কে তোমারে এ বেশ-ভূষণে

সাজাইল বলো শুনি।

জিন্দা দেহে মরার বসন

খির্‌কা-তাজ আর ডোর-কোপিনী।

জিন্দা মরার পোশাক পরা

আপন ছুরাত আপনি সারা

ভবলোককে ধ্বংস করা

দেখি অসম্ভব করণি।

যে মরণের আগে মরে

শমনে ছোঁবে না তারে

শুনেছি সাধুর দ্বারে

তাই বুঝি করেছ ধনি।

তাওয়াফ শেষ হল, গান থামল। এবার শুরু হল গ্রাম-পরিক্রমা ও ভিক্ষা সংগ্রহ।

পাঠকদের তরফে প্রশ্ন উঠতে পারে বাউলদের দীক্ষাশিক্ষা নিয়ে এতরকম ব্যক্তি-অভিজ্ঞতার সাহায্যে এত বিস্তারে কী প্রতিপন্ন করা হল? এ ব্যাপারে জানানো দরকার যে, বাংলা ভাষায় বাউলদের নিয়ে সুদীর্ঘকাল যাঁরা লেখালেখি করেছেন, তাঁরা সমাজবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ খুব কমই ব্যবহার করেছেন। আমাদের নিম্নবর্গের সমাজ কাঠামোর বিশেষত্বের সঙ্গে বাউল-ফকিরদের সংলগ্ন করে তাঁরা দেখেননি। একদল তাঁদের আচরণবাদকে ঘৃণা ও নিন্দা করে কার্যসমাধা করেছেন, আরেকদল উচ্ছ্বসিত হয়েছেন বাউল গানের বাণীর তাৎপর্যে, ভাবের মরমি রহস্যে। তাদের সাংকেতিক শব্দগুলির রহস্যভেদ না করে শিষ্টসমাজের শিক্ষিত দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ভাববাদী ব্যাখ্যা করে বসেছেন। এমনকী হেমাঙ্গ বিশ্বাসের মতো বস্তুবাদে বিশ্বাসী কমিউনিস্ট, বাউলদের সঠিক বোঝেননি। তিনি কোনও অজানা কারণে লিখেছেন,

বাউলরা প্রচলিত ধর্ম, জাতি বা বর্ণবৈষম্য, দেবদেবী, পূজা-আচার, নামাজ-রোজা, মন্দির-মসজিদ কণ্টকিত সামন্ত সমাজের ধ্যানধারণাকে প্রকাশ্যে অস্বীকার করতেন, এবং সেই ভাবধারাতেই আপ্লুত তাঁদের ‘মনের মানুষ’ এক নতুন মানবতাবাদের প্রতীক হয়ে উঠেছিল। সামন্ত সমাজে নিপীড়িত জনসমাজে তাই সেই মানুষটি আসন পাততে পেরেছিল।

তিনি বোঝেননি যে ‘মনের মানুষ’ তত্ত্ব কোনও নতুন মানবতাবাদের প্রতীক নয়— নিতান্তই যৌন-যৌগিক পরিভাষা। সেই ‘মনের মানুষ’-কেই তাঁরা সকলের কাছে আবৃত রাখতে চেয়েছিলেন। লালন-পাঞ্জু-দুদ্দু শাহ-র মতো মানুষতত্বে বিশ্বাসী বাউলদের আসল সংগ্রাম সামন্ত সমাজের সঙ্গে ছিল না, তাঁরা চেয়েছিলেন অজ্ঞ অশিক্ষিত কুহকে কুসংস্কারে আচ্ছন্ন সাধারণ মানুষের ভ্রান্তিমোচন ও নতুন পথ নির্দেশ। ভদ্রলোক শ্রেণি বা সামন্তশ্রেণি নিয়ে তাঁদের কোনও উৎসাহ বা দুশ্চিন্তা ছিল না, সেই শ্রেণির জন্য তাঁরা গানের একটি পঙ্‌ক্তিও রচনা করেননি। তাঁদের ব্যথিত ও উদ্বিগ্ন করেছিল গ্রামীণ সমাজে প্রবর্ধমান ‘বুত্‌পরোস্তি’ (পৌত্তলিকতা), ‘পীরপরোস্তি’ (ধর্মের অলৌকিকতায় অন্ধবিশ্বাস) এবং জাতিবর্ণভেদের তীব্রতা। দরগাতলায় হত্যে দেওয়া, আলেয়া, পেঁচোপেঁচি, ভূতপ্রেত, ফেরেস্তা, কাঠের ছবি, মাটির ঢিবি, হরিষষ্ঠী-মনসা-মাখালের মতো অপদেবতা নির্ভরতা, নামাজ রোজা, ব্রত উপবাস, তীর্থভ্রমণ ও নির্জনে গিয়ে বৈরাগ্য সাধন— এ সবই তাঁদের আক্রমণের লক্ষ্য ছিল। তাঁরা চাইছিলেন সাধারণ মানুষের মানস-উত্তরণ— অন্ধতা, কুসংস্কার আর আচরণবাদী শাস্ত্রসর্বস্বতা থেকে। এর পাশে মানবতার আদর্শ বা মানবতাবোধকে তাঁরা জাগাতে চাননি— কেননা সেসব উচ্চভাব তাঁদের অজ্ঞাত ছিল। যেমন ঊনবিংশ শতাব্দীর আগে দেশপ্রেম বিষয়টি বাঙালির অজ্ঞাত ছিল। এগুলি বিদেশাগত ধারণা, ঔপনিবেশিক সূত্রে প্রাপ্ত।

তা হলে লোকায়ত বাউলরা মানুষ বলতে কী বুঝেছিলেন? অন্তত হিউম্যানিজম বা হিউম্যানিটি বোঝেননি। তাঁদের কথার ধরতাই আগেও ছিল এখনও আছে যে, মানুষ ধরো। মানুষ রতনকে যত্ন কর। তাঁদের স্পষ্ট কথা: ‘মানুষ-তত্ত্ব যার সত্য হয় মনে/ সে কী অন্য তত্ত্ব মানে?’ এই মানুষতত্ত্ব গড়ে ওঠে মানুষরতনদের সমন্বয়ে। কিন্তু মানুষ রত্ন জন্মসূত্রেই অর্জনীয় গুণ নয়— তা হয়ে উঠতে হয়। তার জন্য আকুলতা, গুরুকরণ ও সাধনা চাই— চাই যৌনতার পথ, নারী ও আত্মসংযম। তবেই মানুষ হতে পারে মানুষরতন। কাজেই প্রথমে চাই মানুষতত্ত্বে বিশ্বাস—দেবতত্ত্বে বা কুহকতত্ত্বে নয়, অলৌকিকতায় নয়। দেবদেবতারা পর্যন্ত এই মানুষজন্মের জন্য পাগল, লালন বলেন। বাউল আসলে ‘মনের মানুষ’-চর্যার পথে মানুষকে ধরে, স্থিত হতে চায় অবিকল্প মানুষতত্ত্বে।

কখনও কখনও এমন হতে পারে যে বরাবর আমরা বাউলদের ভুল বুঝে চলেছি এবং হয়তো তাদের ভুলপথে চালনা করছি। অরুণ নাগ যেমন লক্ষ করেছেন:

পশ্চাদপটে শোলার কাজে আল্পনার মোটিফ, কর্তারা ধুতি পাঞ্জাবিতে মঞ্চে শোভিত, তেমন অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রসঙ্গীতের সঙ্গে বাউল গানও অবধারিত।

অরুণ অভিযোগের আঙুল তুলেছেন রবীন্দ্রনাথের দিকে, কেননা বাংলার বাউল নিয়ে আজ মধ্যবিত্ত শিক্ষিতজনের যে ভাবালুতা তার মূল কারণ রবীন্দ্রনাথের বাউল সম্পর্কে উৎসাহ, কিন্তু রবীন্দ্রনাথ কি বাউলদের সঠিকভাবে বুঝে তাদের যথাযথভাবে উপস্থাপিত করেছেন বাঙালির ভাবলোকে? অরুণ মনে করেন:

বাউল সম্পর্কে তাঁর আগ্রহ, দরদ সুপরিজ্ঞাত। আন্তরিকতা নিয়ে কোনোই সংশয় নেই, তবে সত্যের খাতিরে স্বীকার করা উচিত, তাঁর দর্শন খণ্ড-দর্শন। তার কারণ এই নয় যে বাউলদের ধর্ম তথা জীবনাচরণ নিয়ে সমকালে যে নিন্দাস্রোত প্রবহমান, সে সম্পর্কে তিনি নীরব। নিশ্চয় তা সমর্থনের নীরবতা নয়, পঙ্কজের সমাদর করতে পঙ্কের উল্লেখের প্রয়োজনীয়তা তিনি বোধ করেননি। তাঁর দর্শনের সীমাবদ্ধতা স্পষ্ট হবে অন্য একটি উদাহরণ দিলে। তিনি বাউল গানের রসিক, বহু গান প্রকাশ করেছেন, উদ্ধৃত করেছেন, কিন্তু বাউল গানের বিশিষ্ট শাখা, দেহতত্ত্বের গান তাঁর বিশেষ মনোযোগ পায়নি। বাউল ধর্ম অনুগামীর সংখ্যায় গৌণ হলেও যে-কোনো মুখ্য ধর্মের মতো তারও নিজস্ব সাধনপন্থা আছে, আছে আচার, পালনীয় অনুষ্ঠান। রবীন্দ্রনাথ তাতে অনাগ্রহী। স্বয়ং কবি, তথা ধর্মের উদার মানবতাবাদী। তিনি বাউলদের দেখতে চেয়েছেন মূলত মরমীয়া কবি হিসাবে, যাদের জাত পাতের ঊর্ধ্বে উদার মানবপ্রেমের কথা।

অরুণ নাগ এখানে অভিযোগটি সঠিক লক্ষ্যে নিক্ষেপ করেছেন কিন্তু তাঁর বক্তব্যও সম্পূর্ণ নয়। তিনি বলতে পারতেন, বাউলের জীবনচর্যার সামান্যই প্রতিফলিত হয়েছে বাউল গানে, কেননা তাদের মধ্যে ক’জনই বা গীতিকার? মূল বাউল স্রোতে সাধনমার্গী মানুষের সংখ্যা তো শত শত। তাদের মধ্যে ক’জনই বা গায়ক? তার মধ্যে আবার ক’জনই বা তত্ত্বজ্ঞ গায়ক? আমরা সভাসমিতিতে শোলার আল্পনার মোটিফ টাঙিয়ে রবীন্দ্র গানের পাশে যে বাউল গান শুনে থাকি, শুনতে চাই তা তো কোনও তত্ত্ব গান নয়— খানিকটা প্রহেলিকাময় গান, খানিকটা নাচ ও তালে স্পৃষ্ট মজার গান। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এমন একটা বাউল গানের নমুনা দিয়েছেন, যেমন—

এঁড়ে গরু বেড়া ভেঙে

খেজুর গাছে চড়েছে

কাল রাতের বেলা বউ আমাকে

বাবা বলেছে।

দু দু দুম দুদু দুম দুম দু-দু দুম

প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক যে এমন উদ্ভট গান কেন বাউল গায়? উত্তরটাও জানা: আমরা শুনতে চাই বলে। এইখানটায় একটা মস্ত ফাঁকিবাজি তৈরি হয়েছে। কিছু ফন্দিবাজ মানুষ বাউল গানের নামে অদ্ভুত সব গান লিখে চলেছে। তা গাইবার মতো সাজা বাউলেরও অভাব নেই।

কিন্তু অরুণ নাগের আরও শাণিত প্রশ্ন আছে, রবীন্দ্রনাথের বাউল-অন্বেষা সম্পর্কে। তিনি বলতে চেয়েছেন, আমাদের কাছে পথিকৃৎরূপে রবীন্দ্রনাথ যে-বাউল মূর্তি রচনা করেছেন তাতে মিশেছে তাঁর আপন মনের মাধুরী। অরুণ খেদ করেছেন এই বলে যে,

জাতীয়তাবাদের অভ্যুদয়ে রবীন্দ্রনাথ বারবার গর্ব অনুভব করেছেন, ধর্ম জাতের লড়াইয়ে দীর্ণ ভারত ভারতবর্ষের একমাত্র চেহারা নয়, তার অন্তরালে যুগ যুগ ধরে বয়ে আসছে, নিরক্ষর দরিদ্র সাধারণজন যে স্রোতকে সজীব রেখেছে, সেই উদার মানবপ্রেমের স্রোতস্বিনী। কিন্তু সেই সব ধর্মের বাহ্যিক রূপ, আচার, সাধনপন্থা সম্পর্কে তাঁর কৌতূহল নেই। ফলে কবির বাউল হয়ে উঠেছে আধেক কল্পনা, আধেক সত্যের বাউল, রবীন্দ্রানুরাগী শিক্ষিত বঙ্গ মানসে যার গভীর ছাপ পড়েছে।

আসল সংকট এই বাউল শনাক্তকরণ নিয়ে। কোন বাউলকে আমরা শিক্ষিত সভ্য মানুষরা চাই? কোন বাউলকে আমরা প্রোজেক্ট করছি? সে কি গরিব ট্রেনে-গান-গাওয়া অসহায় বাউল? সে কি বর্ণরঙিন বেশে নেচে কুঁদে আসর-জমানো বাউল? অথবা আমরা সত্যিই কি শরিক হতে চাই সেই রুদ্ধগীত বাউলের, মৌলবাদী মুসলমানরা যাদের হাতের একতারা ভেঙে দিচ্ছে? আমরা কি সেই বিপন্ন বাউলের সামাজিক বন্ধু ও প্রতিবাদী? অথবা আমরা শুধু জয়দেব কেঁদুলির মতো বার্ষিক মেলায় গিয়ে তাদের সঙ্গে গাঁজা খেতে উৎসাহী?

সারা দেশ ঘুরলে বাউল সম্পর্কে সংকটের আরও নানা চেহারা চোখে পড়ে। বেকার সমস্যা সমাধানের পক্ষে বাউল গান গাওয়া একটা ভাল পেশা। বর্ধমান, পুরুলিয়া, মেদিনীপুর, বাঁকুড়া সর্বত্র এমন যুবক আমি অনেক দেখলাম গত চার বছরে। বাবরি অথবা ঝুঁটি বাঁধা চুল, লম্বা ঝুলের দামি পাঞ্জাবি, মোট দশটা বিশটা বাউল গানের পুঁজি— আসর কাঁপাচ্ছে কর্ডলেস মাইক ধরে।

সারা বছর নজরুল গীতির টিউশনি করা যার জীবিকা, প্রয়াগ সংগীত সমিতির ‘সংগীত প্রভাকর’, মেলার আসরে তার স্বনির্বাচিত নাম সুধাকান্ত বাউল, গাইছে ভবা পাগলার গান। কিংবা ধরা যাক সেই প্রসিদ্ধ গোষ্ঠগোপাল দাসের কথা। আধুনিক ধাঁচের বাউল গানে অল্প দিনে বাজার মাত করে, কাঁচা পয়সার ঝুঁজে, অপরিমিত মদ্যপানে অকালে বিদায় নিল। কণ্ঠে জাদু ছিল, গায়করূপে যেতে পারত অনেকটা, ঝরে গেল অকালে। পুরুলিয়ায় দেখেছি নামকরা ঝুমুর শিল্পী বাউল গাইছে। কথা বলে বোঝা যায়, বাউলতত্ত্ব ও সাধনার কিছুই জানে না, কিন্তু গাইছে লালনের গান ঝুমুরের ধাঁচে। কিংবা ধরা যাক মামণি দাসের কথা। হাতে গুঁজে দিল একটা ক্যাসেট। ক্যাসেট কভারে লং শটে কালার ফোটো। টাঁর জমিতে একতারা হাতে চলেছে মামণি দাস।

এসব কি আমরা উপেক্ষা করব? দেখেও দেখব না? শহরের শিষ্ট মঞ্চে রবীন্দ্রজয়ন্তীতে গান হচ্ছে ‘বাদল-বাউল বাজায় রে একতারা।’ হঠাৎ উইংস থেকে মঞ্চে ধেয়ে এল এক বালিকা। চুড়ো করে বাঁধা চুল, লুঙ্গির মতো ধুতি আর গেরুয়া আলখাল্লা পরনে, হাতে একতারা (যা বাজছে না) নিয়ে দুরন্ত নাচ শুরু করে দিল। খেয়াল করলে চোখে পড়বে কপালে নাকে রসকলির ছাপ। পায়ে ঘুঙুর। মুখে বাঁধানো হাসি। ছোটবেলায় মফস্‌সলে জজকোর্টের মাঠে দেখতাম একজন ঠিক এইরকম বাউল সেজে পরিত্রাহি চেঁচিয়ে গান গাইত। তারপরে প্রচুর লোক জমে গেলে দাঁতের মাজনঅলা তার মাজনের গুণাবলি বলত। নানাভাবে বাউল আমাদের স্বার্থে ব্যবহৃত ব্যবহৃত ব্যবহৃত হয়ে…।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *