আকাশে জোরে বিদ্যুৎ চমকালেই বজ্র গর্জন শোনা যাবে একটু পরে। আলোর থেকে শব্দের গতি অনেক কম, তাই মেঘ সংঘর্ষের পর প্রথমেই দেখা যায় আলোর চমক, তারপর এসে পৌঁছোয় বজ্র নিঘোষ। কতদিনই তো ঝড় বৃষ্টি হয়, তবু এক-একদিন যেন নেশার মতন হয়ে যায়, বিদ্যুৎ চমক দেখলেই প্রতীক্ষা করতে হয় বজ্রের শব্দ শোনার জন্য। সেই শব্দ এক-একবার এক রকম।
মামুনের ঘরের জানলার পর্দা কাঁচতে দেওয়া হয়েছে, মাঝ রাত্রেও কাঁচের জানলা দিয়ে দেখা যাচ্ছে আকাশের খেলা। বৃষ্টি তেমন নেই, বিদ্যুৎবজ ঝড়ের দাপটই বেশি। এখন কৃষ্ণপক্ষ, এক-একবার তীব্র বিদ্যুতের ঝলক যেন আকাশটাকে চিড়ে দিচ্ছে এক দিগন্ত থেকে অন্য দিগন্ত পর্যন্ত। ঘুম আসছে না মামুনের, তাঁর মাথার মধ্যে বারবার ঘুরে আসছে মাইকেলের একটি লাইন, “ক্ষণপ্রভা প্রদানে বাড়ায় মাত্র আঁধার, পথিকে ধাঁধিতে।” এই লাইনটা এমন কিছু কবিত্বময় নয়, তেমন কিছু স্মরণযোগ্য নয়, তবু কোনো কোনো দিন এরকম একটা কবিতার লাইন বা গানের লাইন মাথা জুড়ে বসে যুক্তিহীনভাবে, কিছুতেই যেতে চায় না।
বিদ্যুৎ আর বজ্র, এ দুটি যেন ক্রিয়া আর প্রতিক্রিয়া। মামুন আকাশের দিকে চোখ রেখে ভাবছেন, যে-কোনো ক্রিয়ারই প্রতিক্রিয়া থাকবেই। এটাও একটা অতি সাধারণ চিন্তা, তবু মামুন বারবার ঐ একই কথা ভেবে চলেছে। এক-একবার বজ্রের শব্দ এমন প্রচণ্ড যে বুক কেঁপে উঠছে তাঁর, তখন মনে হচ্ছে, অতি সাধারণ ক্রিয়ারও প্রতিক্রিয়া হতে পারে প্রচণ্ড। বড় খাটটার এ-পাশে ও-পাশে ছটফট করছেন মামুন।
ফিরোজা বেগম তাঁর দুই মেয়েকে নিয়ে পাশের ঘরে শুয়ে আছেন। অনেকদিনই এ রকম পৃথক শয়নের ব্যবস্থা। অফিস থেকে ফিরতে মামুনের প্রায়ই রাত হয়, তা ছাড়া ফিরেও মামুন টেপ রেকডারে কিছুক্ষণ গানবাজনা শোনেন, এ সব ফিরোজা বেগমের স্বাস্থ্যের পক্ষে হানিকর। কিছুদিন ধরে ফিরোজার প্রায়ই জ্বর হচ্ছে, ডাক্তারের সন্দেহ তাঁর পুরোনো বিকোলাই রোগটি ফিরে এসেছে। চিকিৎসায় ফল হচ্ছে না বিশেষ, অমন সুন্দর রূপ ও স্বাস্থ্য ফিরোজা বেগমের, ইদানীং তাঁকে ফ্যাকাশে দেখায়।
কিছুদিন ধরে মামুন পারিবারিক সমস্যায় বিব্রত। ফিরোজা বেগমের নিরন্তর অভিযোগ যে তাঁর স্বামী সংসারের প্রতি বিন্দুমাত্র মনোযোগ দেন না এবং সে অভিযোগ মিথ্যেও নয়। মামুনের ধারণা, সংসার চালাবার টাকা রোজগার করে এনে দেবেন তিনি, বাকি সব কিছু তো দেখবে স্ত্রী। মামুনের বড় মেয়ে হেনা বিবাহযোগ্যা হয়েছে, মামুন সে ব্যাপারেও মাথা ঘামাননি, মামুন চান তাঁর দুই মেয়েই অন্তত এম-এ পর্যন্ত পড়ুক, তারপর বিয়ের চিন্তা করা যাবে। তাঁর ছোট মেয়ে মীনা পড়াশুনোয় খুব ভালো, তীক্ষ্ণ বুদ্ধি তার, কিন্তু হেনা বি-এ পরীক্ষায় ফেল করেছে। হেনার জন্য ফিরোজা বেগম একটি পাত্র ঠিক করে ফেলেছেন এরই মধ্যে, সম্বন্ধ প্রায় পাকা হয়ে যাবার পর সে খবর জানতে পেরে তীব্র আপত্তি জানিয়েছেন মামুন। ছেলেটার একমাত্র যোগ্যতা, তার চেহারা সুন্দর, যেমন ফসা, তেমন দীর্ঘকায়, হঠাৎ দেখলে পাঠান বলে মনে হয়, কিন্তু সে কোনো চাকরিবাকরি করে না, কী একটা এজেন্সি ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। ছেলেটির বাবা জামাত-এ-ইসলামীর একজন ছোটখাটো নেতা, মামুন জানেন, ওঁদের পরিবার অতিমাত্রায় রক্ষণশীল, ঐ পরিবারের সঙ্গে মামুন কুটুম্বিতার সম্পর্ক রক্ষা করবেন কী করে? মামুন তাঁর দুই মেয়েকেই স্বাধীনভাবে চিন্তা করতে শিখিয়েছেন, হেনা একা একা স্কুল কলেজে গেছে, সে ঐ পরিবারের বউ হলে সুখি হতে পারবে?
আজ রাত্রে খাওয়ার সময়েও এই প্রসঙ্গ নিয়ে জোর কথা কাটাকাটি হয়েছে স্বামী-স্ত্রীর। শরীর ভালো নেই বলে ফিরোজা বেগমের মেজাজ আরও খিটখিটে হয়েছে, তিনি বেশ কিছু খারাপ ভাষা ব্যবহার করেছেন। এখনও মাথা গরম হয়ে আছে মামুনের, ঘুম আসবে কী করে?
হঠাৎ যেন দরজায় খটখট শব্দ হলো। দরজায় না জানলায়? বৃষ্টির সঙ্গে শিল পড়ছে নাকি? না, আবার দু’বার শব্দ হলো দরজাতেই। মামুন ভুরু কোঁচকালেন। তাঁরা থাকেন দোতলায়, একতলায় অন্য ভাড়াটে, এত রাতে সদর দরজা বন্ধ থাকবেই, সুতরাং দোতলায় উঠে এসে কেউ দরজা ধাক্কাবে কী করে?
শব্দ বেশি জোরে নয়, কিন্তু দৃঢ়। যে এসেছে, সে কোনো অধিকার নিয়েই এসেছে। আর একবার বিদ্যুৎ চমকালো, সঙ্গে সঙ্গে মামুনের মনে হলো, তা হলে কি আলতাফ! সুখবর দিতে ছুটে এসেছে এত রাত্রে? দু’দিন ধরে গুজব শোনা যাচ্ছিল, মামুন তাঁর সদ্য প্রকাশিত দ্বিতীয় কবিতা পুস্তকটির জন্য এ বছর আদমজী পুরস্কার পাবেন। মেয়ের বিয়ে দিতে হবে, টাকার এখন বিশেষ দরকার মামুনের।
বিছানায় উঠে বসে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, কে?
বাইরে থেকে উত্তর এলো, হক সাহেব, দরজা খোলেন, পুলিস!
অবাক হবার বদলে মামুন বিড়বিড় করে বললেন, “ক্ষণপ্রভা প্রদানে বাড়ায় মাত্র আঁধার, পথিকে ধাঁধিতে!” তারপর ভাবলেন, সুখবর দিতে হলে আলতাফ তো টেলিফোন করতেই পারতো, এত রাত্রে নিজে ছুটে আসবে কেন? তা ছাড়া, মামুন সরকারের নেক নজরে নেই, আদমজী পুরস্কার তাঁকে দেওয়ার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। তিনি নিজেও লোভীর মতন ঐ গুজবে বিশ্বাস করেছিলেন।
দরজা খুলে দেখলেন, তিনজন লোক দাঁড়িয়ে আছে, ইউনিফর্ম-পরা না থাকলেও চেহারা দেখেই পুলিস বলে বোঝা যায়।
পুলিস দেখে মামুনের ঠিক আতঙ্ক হলো না, বরং প্রথমেই এই প্রশ্নটা জাগলো যে, একতলার সদর দরজা খুলে দিল কে? নিচের ভাড়াটেরা? পুলিস দেখে তারা ওপরে এসে আগে মামুনকে খবর দিতে পারতো না? এদিকে তো তারা মুখে মামুনের সঙ্গে খুব খাতির দেখায়।
তিনজনের মধ্যে একজন মামুনকে অভিবাদন করে নিজের পরিচয় দিয়ে বললো, স্যার, আমি ডি এস পি সামসুজ্জামান, আপনারে একবার আসতে হবে আমাদের সাথে।
মামুন উম্মার সঙ্গে বললেন, এখন ক’টা বাজে? মাঝ রাতে ডাকতে এসেছেন মানে, ভোর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারলেন না?
ডি এস পি সাহেব বাঁ হাতের কজী ঘুরিয়ে দেখে নিয়ে বললেন, এখন বাজে চারটা চল্লিশ, স্যার, আপনারে ঠিক ডাকতে আসি নাই…
–গ্রেফতার করতে এসেছেন? আপনার কাছে ওয়ারেন্ট আছে?
–জী, আছে।
পরোয়ানাটা হাতে নিয়ে তিন-চারবার পড়ে দেখলেন মামুন। দেশরক্ষা বিধানের ৩২ ধারা মোতাবেক তাঁকে আটক করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সহজ ইংরাজি বাক্য, তবু তিনি যেন মানে বুঝতে পারছেন না। দেশরক্ষার কারণে আটক…তিনি কি দেশের শত্রু? পাকিস্তান সৃষ্টির দাবিতে তিনি তাঁর যৌবনের শ্রেষ্ঠ বছরগুলিতে সব রকম সাধ-আহ্লাদ বিসর্জন দিয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরেছেন, কতদিন আহার জোটেনি, কতদিন শুতে হয়েছে মসজিদের চাতালে, তখন কোথায় ছিল আইয়ুব খান বা মোনায়েম খান, কোথায় ছিল এই সব পুলিস অফিসাররা?
পরোয়ানার তারিখ ১৬ই জুন। হ্যাঁ, ইংরেজি মতে রাত বারোটার পরেই ১৬ই জুন পড়েছে, তাই এদের রাত ফুরোবার সবুর সয়নি। সাধারণ চোর-ডাকাতের মতন বাড়ি থেকে পুলিস তাঁকে ধরে নিয়ে যেতে এসেছে। তিনি পাকিস্তানের শত্রু!
পুলিস অফিসারটির দিকে কটমট করে তাকিয়ে রইলেন মামুন। অনিদ্রায় তাঁর চক্ষু লাল। কেন যেন তাঁর মনে হচ্ছিল, শিগগিরই কিছু একটা ঘটবে।
ফিরোজা ও তাঁর দুই কন্যা এখনো জাগেনি। বৃষ্টি বাদলার জন্য অন্য শব্দ শোনা যায় না, গাঢ় ঘুমে ঘুমোচ্ছে তারা। ওদের কি জাগাবার দরকার আছে? পরে তো জানবেই।
অফিসে একটা খবর দেওয়া দরকার, এত রাত্রে কেউ থাকবে না, আলতাফ কিংবা হোসেন সাহেবের বাড়িতে ফোন করা যায়। সম্পাদক হিসেবে তাঁর একটা দায়িত্ব আছে, তাঁর অনুপস্থিতিতে কে কী কাজ চালাবে সেই নির্দেশ দিয়ে যাওয়া। কিন্তু পুলিস কি তাকে ফোন করতে দেবে? থাক, এদের কাছে তিনি কোনো অনুরোধ জানাবেন না।
মামুন বললেন, চলেন, আমি রেডি। হাতকড়া দিতে চান তো দ্যান।
ডি এস পি বললো, স্যার, আমাদের ওপর রাগ করবেন না। আমরা হুকুমের চাকর। হাতকড়া দেবার কোনো অডার নাই। আমরা বাইরে অপেক্ষা করতেছি, আপনি কিছু পোশাক-আসাক গুছায়ে লন, যদি গোসল করতে চান, তাও করে নিতে পারেন।
মামুন, বললেন, কোনো কিছুর দরকার নাই, আমি এইভাবেই যাবো।
এবারে পাশের ঘরের দরজা খুলে ফিরোজা বেগম বেরিয়ে এলেন। পুলিস দেখা মাত্র তিনি দৌড়ে এসে মামুনকে আড়াল করে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলতে লাগলেন, না, ওনারে নিতে পারবেন না, আমারে না মেরে ফেলে…আমার আব্বাকে খবর দিতে হবে, জসিমদ্দিন সাহেবরে…আমার চাচা সরকারের বড় অফিসার…
মেয়ে দুটিও জেগে উঠলো। বড় মেয়ে হেনা বাবাকে বেশি ভালোবাসে। সে কাঁদতে শুরু করে দিল মামুনকে জড়িয়ে ধরে। এরকম নাটকীয় পরিস্থিতি মামুনের একেবারেই পছন্দ নয়। তিনি স্ত্রী ও কন্যাকে বোঝাতে লাগলেন যে ভয় পাবার কিছু নেই, নিশ্চয়ই এরা ভুল করে তাঁকে ধরতে এসেছে, তিনি দু’একদিনের মধ্যেই ফিরে আসবেন।
টুথ ব্রাস, পেস্ট ও এক প্রস্থ পোশাক সঙ্গে নিয়ে মামুন বেরিয়ে পড়লেন একটু পরেই। এই পুলিসের দলটি ব্ল্যাক মারিয়া আনেনি, এনেছে একটি জাপানী টয়োটা গাড়ি, পেছনের সীটে বসানো হলো মামুনকে, দু’জনের মাঝখানে। এখনও বৃষ্টি পড়ছে প্রবল ধারায়।
জেল গেটে পৌঁছোবার পর মামুন দেখলেন, আর একখানা গাড়িও থেমেছে সেখানে। সে গাড়ির চালক তাঁর চেনা, মানিক মিঞার বড় ছেলে মইনুল হোসেন হীরত। তারপর তিনি ভালো করে দেখলেন, গাড়ির মধ্যে দীর্ঘদেহী মানিক মিঞাও বসে আছেন পুলিস পরিবৃত হয়ে। তা হলে মামুন একা নন, ধরা হচ্ছে অন্য সম্পাদকদেরও!
প্রথমে তাঁদের দু’জনকে কিছুক্ষণ বসিয়ে রাখা হলো ডেপুটি জেলারের ঘরে। মানিক মিঞার মুখোনি অস্বাভাবিক রকমের বিমর্ষ। এককালে বন্ধুত্ব থাকলেও ইদানীং মানিক মিঞার সঙ্গে মামুনের সম্পর্ক ভালো যাচ্ছিল না। ইত্তেফাক’-এর প্রতিপত্তিশালী সম্পাদক মানিক মিঞা দেখা হলেই মামুনের সঙ্গে ব্যঙ্গের সুরে কথা বলেন। মামুনের দিনকাল পত্রিকার কোনো স্ট্যান্ডার্ড নেই, নীতির বালাই নেই, সম্পাদকীয় লেখা হয় এক সুরে, খবর পরিবেশন করা হয় অন্য সুরে। কথাগুলো একেবারে মিথ্যে নয়, তবু মামুন ঠিক সহ্য করতে পারেন না।
এখন দু’জনেই এক খাঁচার পাখি। মামুন খানিকটা রসিকতার সুরে মানিক মিঞাকে বললেন, পলিটিশিয়ানরা সব ফুরায়ে গেছে, তাই এবার ওরা আমাদের ধরছে, না কি বলেন?
রসিকতার উত্তর না দিয়ে মানিক মিঞা শুষ্কভাবে বললেন, ভাই, আমার মেয়ে বেবীর কাল রাতে একটা বড় অপারেশান হয়েছে, এখনো ক্রাইসিস কাটে নাই, এই অবস্থায় আমারে ধরে আনলো? বেবীর ভালো করে জ্ঞান ফেরার পর যদি এই খবর শোনে, যদি সেই ধাক্কা সামলাইতে না পারে… আমারে আর কয়েকটা দিন জেলের বাইরে রাখলে কি পাকিস্তানের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে যেত?
মানিক মিঞা এখন জবরদস্ত সম্পাদক নন, তিনি সন্তান স্নেহে কাতর এক পিতা। মামুন। তাঁর বাহু স্পর্শ করে বললেন, আল্লারে ডাকেন, আল্লা দয়া করবেন, বেবী ভালো হয়ে যাবে।
খানিক বাদে তাঁদের নিয়ে যাওয়া হলো বিশ নম্বর সেলে। সেই বাহান্ন সালের ভাষা আন্দোলনের সময় মামুন একবার কারারুদ্ধ হয়েছিলেন, তারপর এই দ্বিতীয়বার। ব্রিটিশ আমলে মামুন কখনো জেলখানা দেখেননি, জেলের অভিজ্ঞতা তাঁর স্বদেশী আমলেই। আগেরবারও মামুন এই বিশ নম্বর সেলেই ছিলেন।
এই সেলে আগে থেকেই অনেক আওয়ামী লীগের নেতা বন্দী হয়ে আছেন। মামুন চোখ বুলিয়ে দেখলেন, শেখ মুজিব সেখানে নেই। অন্য নেতারা সবাই বাইরের খবর জানবার জন্য মানিক মিঞাকে ঘিরে ধরলেন, মামুন তাঁদের বেবীর কথা জানিয়ে বললেন, ওনার মন ভালো নেই, এখন একটু শান্তিতে থাকতে দিন।
বিশ নম্বর সেলে কয়েকটি ছোট ছোট কক্ষ আছে। সি ক্লাস প্রিজনার হিসেবে মামুন ও মানিক মিঞাকে রাখা হলো সে রকম দুটি আলাদা কক্ষে, খোরাকী হিসেবে দৈনিক ভাতা বরাদ্দ হলো দেড় টাকা। লোহার দরজা ছাড়া সেই ঘরে কোনো জানলা বা ভেন্টিলেটার পর্যন্ত নেই। বাইরে বৃষ্টি অথচ এই ঘরের মধ্যে অসম্ভব গরম। আর দুর্গন্ধ। কাছেই একটি পায়খানা, আড়াইশো-তিনশো’জন রাজবন্দীর জন্য ঐ একটাই, প্রায় সর্বক্ষণ তার সামনে লম্বা লাইন।
কষ্ট সহ্য করার একটা নিজস্ব উপায় আছে মামুনের। মনটাকে শরীর থেকে সম্পূর্ণ বিযুক্ত করে নিতে হয়। শরীরটা শুয়ে থাকুক এই কারাগারে, মনটা চলে যাক কোনো আনন্দলোকে।
মামুন চোখ বুজে দৃশ্যের পর দৃশ্য পুনর্নির্মাণ করতে লাগলেন।
…অফিসে নিজের ঘরে একলা বসে মামুন তাঁর একটি লেখার প্রুফ সংশোধন করছিলেন, হঠাৎ তাঁর আদালি এসে খবর দিল, এক মেমসাব তাঁর সঙ্গে দেখা করতে চায়। কিছুতেই ছাড়বে না। রাত তখন ন’টা। এই সময় কোনো স্ত্রীলোক খবরের কাগজের অফিসে আসে না। আদালিকে তিনি বললেন, নিয়ে এসো।
আলুথালু বেশ, মাথার চুল খোলা, মঞ্জু! এর আগে কোনোদিন সে পত্রিকা অফিসে আসেনি। আজ এত রাত্রে…মামুনকে কোনো প্রশ্ন করার অবকাশ না দিয়ে সে ঘরে ঢুকেই দৌড়ে এসে মামুনের গায়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে কাঁদতে লাগলো। তার বিলাপের মধ্যে শুধু একটাই কথা, সে কোথায় গেল? সে আর ফিরবে না!
অফিসের মধ্যে এরকম একটা দৃশ্যে ভিড় জমে যাবেই। আলতাফ কিংবা হোসেন সাহেব সে সময় অফিসে ছিলেন না। মামুন অন্যদের চলে যেতে বলে দরজা বন্ধ করে দিলেন।
কী যে হয়েছে তা মঞ্জু কিছুতেই খুলে বলতে পারে না, শুধু কাঁদে। একটু একটু করে জানা গেল।
শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করার প্রতিবাদে সেদিন সমস্ত ঢাকা শহর উত্তাল। বিভিন্ন জায়গায় ছাত্র-জনতার মিছিলে লাঠি ও গুলি চলেছে। বাবুল দুপুরবেলা বেরিয়ে গেছে, আর বাড়ি ফেরেনি।
এ খবর শুনে মামুন প্রথমে বিচলিত বোধ করেননি। তিনি খুব ভালো করেই জানেন যে, বাবুল চৌধুরী ও তার বন্ধুরা শেখ মুজিবের সমর্থক নয়। ওরা ন্যাপের চীন পন্থী গ্রুপ। সুতরাং বাবুল কিছুতেই ঐ সব সভা-মিছিলে যাবে না। শেখ মুজিব লাহোরে গিয়ে ছয় দফা প্রস্তাবের নামে যে বোমা ফাটিয়ে এসেছে, যার জন্য আইয়ুবসাহী আবার বাঙালীদের ওপর খঙ্গহস্ত, সেই ছয় দফাঁকেও সমর্থন করে না বাবুল চৌধুরীরা। শেখ মুজিবের গ্রেফতারে তাদের খুশি হবার কথা।
কিন্তু ঐ সব সভা মিছিলে বাবুল যেতে না চাইলেও মঞ্জু তাকে জোর করে পাঠিয়েছে সিরাজুলের খোঁজ নেবার জন্য। সিরাজুলের সঙ্গে বাবুলের দেখাও হয়েছে, সিরাজুল বাড়ি ফিরেছে অক্ষত শরীরে, তবু কেন বাবুল ফিরলো না?
মঞ্জু ঝগড়া করেছিল তার স্বামীর সঙ্গে, বাবুল এক কাপ চা খেতে চেয়েছিল, মঞ্জু সেই চা-ও দেয়নি, তাই অভিমান করেছে বাবুল, সে বোধ হয় আর কোনোদিন ফিরবে না।
মঞ্জুকে কিছুতেই শান্ত করা যায় না। মামুন তাকে নিয়ে বেরুলেন একটা গাড়িতে, সব কটা হাসপাতালে গিয়ে খোঁজ নিলেন, হোম সেক্রেটারির সঙ্গে সাক্ষাৎ করে গ্রেফতারের লিস্টেও বাবুলের নাম পেলেন না। বাবুলের বিশেষ বন্ধু জহির, কামাল, পল্টনদের বাসায় গিয়েও বাবুলের কোনো সন্ধান পাওয়া গেল না, বাবুল যেন সত্যিই অদৃশ্য হয়ে গেছে।
মঞ্জুর তখন পাগলের মতন অবস্থা, কিছুতেই শান্ত করা যায় না তাকে। বাবুল এর আগেও অনেকবার বেশি রাত করে বাড়ি ফিরেছে, আজ অবশ্য শহরের অবস্থা খুব অস্বাভাবিক, কারফিউ জারি করা হয়েছে দশটা থেকে, এর পর আর সে কী করে ফিরবে?
মঞ্জুকে সামলাবার জন্য সারা রাত মামুনকে থেকে যেতে হলো ও বাড়িতে। বাচ্চা মেয়ের মতন মঞ্জুকে তিনি কোলে নিয়ে ঘুম পাড়াবার চেষ্টা করলেন, কিন্তু কিছুতেই সে ঘুমোবে না। মঞ্জুর কষ্টে মামুনেরও বুক যেন ছিঁড়ে যাচ্ছিল। কিন্তু বাবুলের জন্য তাঁর কোনো দুশ্চিন্তা হচ্ছিল না। বাবুল বাড়ি না ফেরায় মামুন যেন খুশিই হয়েছিলেন। আজকাল বাবুলকে তিনি একেবারেই পছন্দ করতে পারেন না।
হঠাৎ সবাঙ্গের রোমকূপ শিহরিত হলো এক উপলব্ধিতে। মামুনের মনে পড়ে গেল মুসাফির নামের বিচিত্র লোকটির কথা। অলৌকিক শক্তি আছে নাকি লোকটার, সে দূরের জিনিস দেখতে পায়, সে বলেছিল, মামুনের সংসার ও কর্তব্যের মধ্যে এসে দাঁড়াবে একটি রমণী। তবে কি সে মঞ্জুর কথাই বলেছিল। আর তো কোনো রমণী নেই তাঁর জীবনে! সপ্তাহে তিন-চার দিন অন্তত মঞ্জুকে চোখের দেখা না দেখে মামুন থাকতে পারেন না, মঞ্জুর মুখ তাঁর মনে পড়ে অহরহ, মঞ্জুকে আদর করে তিনি পরম শান্তি পান।
মামুন দু হাতে নিজের মাথা চেপে ধরলেন। মুসাফির যখন ঐরকম ইঙ্গিত করেছে, তখন অন্য লোকেও কি মঞ্জুর সঙ্গে তাঁর একটা নিষিদ্ধ সম্পর্কের কথা ভাবে? সেই জন্যই কি বাবুল আজকাল মামুনকে সব সময় এড়িয়ে যেতে চায়, দেখা হলেও কথা বলে না?
মাথার ওপর আল্লা আছেন, তিনি জানেন, মঞ্জু সম্পর্কে মামুন কখনো কোনো পাপ-চিন্তা করেননি। সেদিন সারা রাত মঞ্জুর সঙ্গে থাকলেও তো তিনি একবারও মঞ্জুকে কামভাবে স্পর্শ করেননি। মঞ্জুকে তিনি ভালোবাসেন ঠিকই, কিন্তু সে তো স্নেহের ভালোবাসা। মঞ্জু যেন তাঁরই সৃষ্টি, মঞ্জুকে তিনি গান শিখতে উৎসাহ দিয়েছেন, স্বাধীনভাবে চিন্তা করতে শিখিয়েছেন। বাবুল চৌধুরীর সঙ্গে তিনি নিজে উদ্যোগ করে মঞ্জুর বিয়ে দেননি? মঞ্জু তাঁর বন্ধু, মঞ্জু তার সব সুখ-দুঃখের কথা মামুন মামাকে বলে, মঞ্জুর সান্নিধ্যে এলে মামুনের কল্পনা উদ্দীপ্ত হয়, মঞ্জুর অনুরোধে তিনি আবার কবিতা লিখছেন, এসব অন্যায়?
বাবুল ফিরে এসেছিল পরদিন সকালে। সে রাত কাটিয়েছে পশ্চিম পাকিস্তানী এক আর্মি অফিসারের বাড়িতে। সেই অফির্সারটি পল্টনের বোন দিলারার স্বামী, তাদের বাসায় কাল। খানাপিনা ছিল, তাই বাবুলকে কিছুতেই ছাড়লো না।
এসব বলার সময় বাবুলের মুখে বিন্দুমাত্র অপরাধবোধ ফুটে ওঠেনি। যেন একটা রাত বাড়িতে খবর না দিয়ে অন্য জায়গায় কাটিয়ে আসা এমন কিছুই গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার নয়। যেন, পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালীরা যখন আইয়ুব সাহীর লাঠি গুলিতে মরছে, তখন পশ্চিম পাকিস্তানী এক আর্মি অফিসারের বাড়িতে খানাপিনায় যোগ দেওয়া অতি স্বাভাবিক ঘটনা।
মামুনকে দেখে সে যেন খুশিই হয়েছিল, পাতলা হাসির সঙ্গে বলেছিল, আমি তো জানতামই যে আপনি মঞ্জুর খবরাখবর নেবেন, আমি মঞ্জুকে বলেও গিয়েছিলাম আপনাকে খবর দিতে…
তখনই মামুন ঠিক করেছিলেন, তিনি আর কোনোদিন মঞ্জবাবুলদের বাড়িতে আসবেন না। মঞ্জুকে তিনি এতটাই ভালোবাসেন যে মঞ্জুর দাম্পত্যজীবন অটুট রাখার জন্য তিনি চিরকালীন বিচ্ছেদও সহ্য করতে পারবেন। সেই দিনটা ছিল ছ’ তারিখ, তার পরদিন প্রদেশব্যাপী সাধারণ ধর্মঘটের আগের দিন, তারপর এই দশ দিনের মধ্যে মামুন আর একবারও যাননি ঐ বাড়ির দিকে। এখন কতকাল জেল খাটতে হবে কে জানে, এমনিতেই দেখা হবে না।
দেখা না হলেও মনে মনে কথা বলতে তো বাধা নেই। নির্জন সেলে শুয়ে শুয়ে মামুন স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছেন, মঞ্জু সুখু মিঞাকে খাওয়াচ্ছে, জানলার ধারে দাঁড়িয়ে গুন গুন করছে গানের কলি, স্নান সেরে এসে সে চিরুনি চালাচ্ছে তার ভিজে, লম্বা চুলে। মঞ্জু কি এতক্ষণে মামুনের গ্রেফতারের খবর জেনে গেছে? এ খবর পেয়ে মঞ্জু কি কাঁদবে? না, তুই কাঁদিস না মঞ্জু, আমি যেখানে, যতদূরেই থাকি, আসলে সব সময় তোর পাশে পাশেই আছি।
হঠাৎ ধড়মড় করে উঠে বসলেন মামুন। মুসাফির নামের লোকটা আগেই তার জেলখাটার কথা ফোরকাস্ট করেছিল। লোকটা কি সত্যিই দূরদর্শী, না শয়তান? ওর কথা মনে পড়তেই রাগে মামুনের শরীর জ্বলে যাচ্ছে। এর পর কোনোদিন দেখা হলে ঐ লোকটির সঙ্গে একটা বোঝাঁপড়া করতে হবে।