বৃষ্টির ছাঁট আসছে খুব, তবু সুলেখা জানলা বন্ধ করবে না। জানলার গরাদে সে মুখ চেপে আছে, যেন সে তৃষিতের মতন মুখ-চোখে শুধু বৃষ্টি মাখছে না, শেষবারের মতন দেখে নিচ্ছে বাংলার মাটি। একটু আগে রানীগঞ্জ ছাড়িয়ে গেছে, আর দু এক ঘণ্টার মধ্যেই এই ট্রেন বাংলা ছাড়িয়ে বিহারে ঢুকবে।
ওরা একটা ফার্স্ট ক্লাস কুপে পেয়েছে, দরজা বন্ধ করে রাখলে আর অন্য কোনো যাত্রীর সঙ্গে সংশ্রব নেই। সুতরাং এর মধ্যে যে-কোনো রকম ছেলেমানুষী করা যেতে পারে। বই থেকে চোখ তুলে ত্রিদিব মাঝে মাঝে সকৌতুকে লক্ষ করছেন সুলেখাকে। সুলেখার এমন ছটফটে ভাব তিনি আগে কখনো দেখেননি। যেন সে এই প্রথম কোনো দূর পাল্লার ট্রেনে চেপেছে, মাঝে মাঝেই সে উচ্ছলা হয়ে উঠছে বালিকার মতন।
একটা সেতুর ওপর দিয়ে যাবার সময় ট্রেনটার গতি মন্থর হয়ে এলো, সুলেখা মুখ ফিরিয়ে বললো, এই দ্যাখো, দ্যাখো, এক ঝাঁক বক কী রকম বসে আছে, কী সুন্দর।
ত্রিদিব হেসে বললেন, মনে হচ্ছে, আমরা আবার হনিমুনে যাচ্ছি!
সঙ্গে সঙ্গে সুলেখা জানলার কাছ থেকে সরে এসে স্বামীর কণ্ঠলগ্না হয়ে তাঁর বুকে মুখ ঘষতে লাগলো। অনেকদিন এমনভাবে দিনের বেলা সে তার স্বামীর কাছ থেকে আদর চায়নি।
ত্রিদিব সুলেখার প্রগাঢ় চুলে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। সুলেখার এই অস্থিরতার কারণ তিনি কিছুটা অনুমান করতে পারেন। সুলেখা নিজের মনের কাছেই অনেক কিছু চাপা দিতে চাইছে।
আসানসোল এসে পড়েছে, এখানে খাবার দেবে। সুলেখার পিঠে মৃদু চাপড় মেরে ত্রিদিব বললেন, এই, ওঠো!
সুলেখা মুখ তুলে বললো, আমার দারুণ ভালো লাগছে, আজকের দিনটাও কী চমৎকার, ঠান্ডা ঠান্ডা!
–দিল্লিতে কিন্তু গরম হবে। ওখানে দেরিতে বৃষ্টি নামে।
–দিল্লিতে আমরা ছাদে শোবো, অনেকেই শোয় শুনেছি, সত্যি?
–হ্যাঁ, গরমকালে অনেকেই শোয়।
–আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকলে ঘুম আসে? পাশের বাড়ির ছাদ থেকে কি আমাদের ছাদ দেখা যাবে? আমাদের বাড়িটা কী রকম হবে?
–শুনেছি তো বাংলো ধরনের বাড়ি। সঙ্গে বাগান আছে, কিন্তু ছাদ আছে কিনা জানি না!
–আমি দিল্লিতে গিয়ে বাগান করা শিখবো। তুমি আমাকে গার্ডনিং-এর বই কিনে দিও! আমার মায়ের ফুল গাছের শখ ছিল, আমি কোনোদিন গাছটাছ লাগাইনি।
ত্রিদিব আবার হাসলেন, কয়েকদিন ধরে সুলেখার মুখে প্রায় সর্বক্ষণ দিল্লির কথা। দিল্লি যেন একটা ইউটোপিয়া, ওখানে সবরকম সুখ পাওয়া যাবে।
ত্রিদিবের অফিস দিল্লিতে একটা ব্রাঞ্চ খুলছে, ত্রিদিবকে সেখানে ম্যানেজার হবার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। ত্রিদিব রাজি হননি। কলকাতায় তাঁর নিজস্ব বাড়ি, অনেকদিনের চেনা পরিবেশ, তাছাড়া সুলেখার কলেজের চাকরি আছে। নিজের চাকরি জীবনে বিশেষ উন্নতি করার দিকে ত্রিদিবের আগ্রহ নেই। তিনি নিরিবিলি নির্ঝঞ্ঝাটে থাকার মত মানুষ। নতুন জায়গায় নতুন অফিসের দায়িত্ব নেওয়া মানেই আবার অনেক নতুন লোকের সঙ্গে পরিচয়, অনেক বেশি ব্যস্ততা।
সুলেখাও প্রথম শুনে উড়িয়ে দিয়েছিল। কলকাতার থিয়েটার, সিনেমা, সঙ্গীতের জলসা, এসব কি পাওয়া যাবে আর কোথাও? তাছাড়া কলেজে পড়াতে তার ভালো লাগে, সে কাজ ছেড়ে দিয়ে দিল্লিতে শুধু হাউস ওয়াইফ হয়ে থাকতে রাজি নয় সুলেখা।
হঠাৎ এক সকালে সুলেখার মতের আমূল পরিবর্তন হলো। দিল্লি শহরের পঞ্চাশ রকম গুণপনা সে আবিষ্কার করে ফেললো, সে দিল্লিতেই যেতে চায়, কলকাতায় আর একটুও ভালো লাগছে না। ত্রিদিবকে একপ্রকার সে জোর করেই রাজি করিয়েছে।
ত্রিদিব বুঝেছিলেন, কলকাতা থেকে পালাতে চাইছে সুলেখা। রাতুলের কাছ থেকে? রাতুলটা এখনো ছেলেমানুষ, হঠাৎ হঠাৎ যুক্তিহীন আবদার ধরে।
বিপত্নীক রাতুল যে হঠাৎ সুলেখার প্রতি বেশি বেশি আকৃষ্ট হয়ে পড়েছে তা ত্রিদিব জানেন। সুলেখার রূপ ও ব্যবহার দেখে পুরুষ মাত্রই মুগ্ধ হয়, এমনকি রিকশাওয়ালারাও তার কাছ থেকে অতিরিক্ত ভাড়া নিতে চায় না। সুলেখার টানে অনেক বন্ধুরা তাঁর বাড়িতে আসেন, একথা ত্রিদিব বিয়ের কিছুদিন পর থেকেই বুঝতে পেরেছেন। কিন্তু এর মধ্যে খারাপ তো কিছু নেই। সুলেখার রূপ তো শুধু তার শরীরে নয়, তার চরিত্রে, তার ব্যবহারের মাধুর্যে। এই মাধুর্যের ভাগ অনেকেই নিতে পারে।
কিন্তু সুলেখার প্রতি যারা মুগ্ধ হয়, তারা সম্পর্কটাকে সহজ বা প্রকাশ্য রাখতে পারে না, গোপনীয়তার দিকে নিয়ে যেতে চায় কেন, এটাই ত্রিদিব বুঝতে পারেন না। এইসব মানুষদের কি সম্মান জ্ঞান নেই? এরা সুলেখার শরীরটা দেখে, মন বোঝে না?
রাতুলের পাগলামি, দুপুরে দেখা করতে আসা, গভীর রাত্রে টেলিফোন, এসব টের পেয়েও ত্রিদিব একটিও কথা বলেননি, সুলেখার ওপর তাঁর অগাধ ভরসা, সুলেখা যা চাইবে, তাই-ই হবে। এমনকি সুলেখা যদি রাতুলকে ঘনিষ্ঠ প্রশ্রয় দেয়, তাহলেও তিনি ধরে নিতে রাজি আছেন যে রাতুল ওরকম প্রশ্রয় পাবার যোগ্য।
কিন্তু এবারে রাতুলের জন্য সুলেখা কলকাতাই ছেড়ে চলে যেতে চাইলো? এতখানি বিরাগ
তো আগে কখনো ঘটেনি।
হাওড়া স্টেশনে রাতুল, শাজাহান ওদের বিদায় জানাতে এসেছিল। রাতুলের কেমন যেন বিহ্বল অবস্থা। ত্রিদিবরা যে কলকাতার পাট তুলে দিয়ে দিল্লি চলে যাচ্ছেন, এটা সে যেন বিশ্বাসই করতে পারছে না। সুলেখার চোখে চোখ ফেলে সে প্রশ্ন করার চেষ্টা করছিল, কিন্তু সুযোগ পায়নি। এক একবার মনে হচ্ছিল, সে যেন সুলেখার হাত চেপে ধরে সরাসরি কিছু জানতে চাইবে, কিন্তু শাজাহান সব সময় ছিল তার পাশেপাশে। শাজাহানও জানে, কিংবা অনেকটাই অনুমান করেছে। শাজাহানও সুলেখার খুব অনুরাগী, সেইজন্য সে রাতুলকে দূরে সরিয়ে দিতে চায়।
তাঁর স্ত্রীকে কেন্দ্র করে যে অন্য পুরুষদের মনে মনে নানারকম আবেগ-প্রবাহ চলছে তা অনুভব করে ত্রিদিব বেশ কৌতুকই বোধ করছিলেন। অন্য দম্পতিদের জীবনেও এরকম ঘটনা ঘটে কি না তা কে জানে! মানুষ সম্পর্কে তাঁর অভিজ্ঞতা কম, তবে উপন্যাসে ঘটে। অধিকাংশ উপন্যাসই তো ত্রিভুজ প্রণয়ের। বিবাহিত নারী-পুরুষদের প্রেম কাহিনী বাংলায় বিশেষ লেখা হয় না, কিন্তু ইওরোপিয় ভাষায় অজস্র। ওদের বিবাহ-বন্ধনটাও যে অনেক শিথিল।
আসানসোলে যখন কুপের দরজা খোলা হয়েছে, সেই সময় একজন দীর্ঘকায় পুরুষ উঁকি মেরে হাসিমুখে জিজ্ঞেস করলো, ত্রিদিববাবু, ডাব খাবেন?
ত্রিদিব সন্ত্রস্ত বোধ করলেন। হাওড়া স্টেশনে শাজাহান এই লোকটির সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়েছে, শাজাহানের ব্যবসার সঙ্গে এই ব্যক্তিটি কোনো সূত্রে যুক্ত, একই ট্রেনে দিল্লি যাচ্ছে।
লোকটির নামও ভুলে গেছেন ত্রিদিব, কী যেন মজুমদার।
ত্রিদিব বললেন, না, ডাব খাবো না।
লোকটি জোর দিয়ে বললেন, খান না, বেশ ভালো ডাব, শস্তা … বৌদি, আপনি খাবেন নিশ্চয়ই, এই ডাব, এদিকে এসো–
লোকটি হাঁকডাক করে একটা ছোঁকরা ডাবওয়ালাকে একেবারে ভেতরে নিয়ে এলো। সুলেখার হাতে নিজে ডাব তুলে দিল, ত্রিদিবের দাম দেবার ক্ষীণ প্রস্তাব উড়িয়ে দিল এককথায়। তারপর ডাবওয়ালাকে বিদায় করে নিজে জেঁকে বসলো সেখানে।
একটু বাদেই ত্রিদিব আর সুলেখার জন্য খাবারের ট্রে এলো।
ত্রিদিব জিজ্ঞেস করলেন, মিঃ মজুমদার, আপনি?
লোকটি বললো, আপনারা খাননা, খান, আমি বাড়ি থেকে খেয়ে এসেছি, সঙ্গে টিফিন আছে।
তৃতীয় ব্যক্তির সামনে, বিশেষত অচেনা কোনো লোকের সামনে খাওয়াটা ত্রিদিবের ঘোরতর অপছন্দ। তা হলে আর কুপে নেবার প্রাইভেসি রইলো কোথায়?
ত্রিদিব হাত গুটিয়ে বসে নিখুঁত ভদ্র গলায় প্রশ্ন করলেন। আপনাকে বুঝি প্রায়ই দিল্লি যাতায়াত করতে হয়, মিঃ মজুমদার।
–হ্যাঁ দাদা। মাসে অন্তত একবার তো বটেই। আমায় নাম ধরে ডাকবেন, আমার নাম বাসুদেব, আমার এক কাকা সত্যব্রত মজুমদার, করপোরেশনের কাউন্সিলার, নাম শুনেছেন নিশ্চয়ই?
ত্রিদিব ঐ নাম শোনেননি, হ্যাঁ-না কিছুই বললেন না। করপোরেশনের প্রত্যেক কাউন্সিলারের নাম না জানা যেন তাঁরই অজ্ঞতা।
–আপনারা তো এই প্রথম দিল্লি যাচ্ছেন শুনলুম। কোনো অসুবিধে হলে আমায় বলবেন। বৌদি, বাড়ি সাজাবার জন্য যদি আপনার ফার্নিচার লাগে, আমার কনট প্লেসে ভালো দোকান চেনা আছে, রাষ্ট্রপতি ভবনে সাপ্লাই দেয়…
সুলেখাও খাবারে হাত দেয়নি, সে ত্রিদিবের স্বভাব জানে। সে মিষ্টি করে জিজ্ঞেস করলো, আপনি বুঝি ট্রেনের খাবার খান না? ৪৪২
–না বৌদি, আমার ঠিক ডাইজেস্ট হয় না, বড্ড মশলা দেয় তো। আমাকে ঘন ঘন ট্রাভল করতে হয়।
যতই ইঙ্গিত দেওয়া হোক, লোকটি উঠবে না। ভদ্রতার প্রতিদান দেবার মতন মানুষ আজকাল খুঁজে পাওয়া শক্ত।
এর মধ্যে কামরার দরজার কাছে আর একটি লোক উঁকি মেরে বললো, বাসুদেব দা, আপনি এখানে? আপনাকে ওরা সবাই খুঁজছে, তাস খেলার জন্য।
বাসুদেব,সোৎসাহে বললো, আরে সুখেন, এসো, এসো, তোমার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই।
সুখেন নামের লোকটি সুলেখার দিকে একবার তাকিয়েই মন্ত্রমুগ্ধের মতন ভেতরে চলে এলো। এতটুকু ছোট কুপেতে আর দাঁড়াবারও জায়গা নেই। এই স্থান অসঙ্কুলানের একটা সুবিধে পাওয়া গেল, আর একজন তাস খেলোয়াড় এই দু জনকে খুঁজতে এসে ভেতরে ঢোকার সুযোগ পেল না, তাই বাসুদেব ও সুখেনকে সে জোর করে ডেকে নিয়ে গেল।
সুলেখা সঙ্গে সঙ্গে উঠে ছিটকিনি লাগিয়ে দিল দরজায়। ত্রিদিব হো হো করে হেসে উঠলেন।
সুলেখা বললো, তুমি হাসছো? খাবারের থালাটা একবারও ছুঁড়ে ফেলে দিতে ইচ্ছে করেনি তোমার?
ত্রিদিব বললেন, একবার পায়ের কাছে নামিয়ে রাখতে ইচ্ছে হয়েছিল বটে। একেই তো এরা ঠাণ্ডা খাবার দেয়, আরও ঠাণ্ডা হয়ে গেল!
–আর দিল্লি পৌঁছোবার আগে একবারও আমি দরজা খুলবো না। এই লোকটাকে তুমি আমাদের দিল্লির বাড়ির ঠিকানা দিও না, প্লীজ!
–শাজাহানের কাছ থেকেই জেনে যাবে। শাজাহান চিঠি লিখতে বলেছে।
–দিল্লিতে গিয়েও আমরা বাঙালীদের হাত থেকে রেহাই পাবো না?
–অবাঙালীরা এর থেকে বেশি ভদ্র হবে বলছো? আশা করা যাক।
সুলেখা সত্যিই আর কুপের দরজা খোলা রাখলো না দিল্লি পর্যন্ত। স্টেশানে ত্রিদিবের কম্পানির গাড়ি এসেছে, বাসুদেবের দলবল এসে ধরবার আগেই ওরা উঠে পড়লো সেই গাড়িতে।
কম্পানি থেকে ওদের জন্য সুন্দর একটি বাড়ি ভাড়া করে রেখেছে, কালকাজীতে একটি ছিমছাম বাংলো। সামনে-পেছনে অনেকখানি বাগান, ঘেঁষাঘেঁষি করা আর কোনো বাড়ি নেই। ত্রিদিবের কম্পানিটির মালিক আগে ছিল সাহেবরা, এখন একটি মাড়োয়ারি গোষ্ঠী কিনে নিয়েছে কিন্তু সাহেবি কায়দা অক্ষুণ্ণ রেখেছে। ম্যানেজারের বাংলোয় বাবুর্চি, দারোয়ান এমনকি মালি পর্যন্ত আছে।
এখানে শুরু হলো সুলেখার অন্যরকম জীবন।
সুলেখা আগে কখনো দিল্লি আসেনি, তাই প্রথম দিকে দ্রষ্টব্য প্রচুর। ত্রিদিব অফিসের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লো খুবই, কিন্তু শনিবার রবিবার সে অফিসের কাজ বাড়ি পর্যন্ত টেনে আনে না। ঐ দিন ওরা গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। সঙ্গে খাবারদাবার থাকে, হুমায়ুনস টুম্ব, কুতুব মিনার, লাল কেল্লা, জুম্মা মসজিদ এইসব জায়গায় সারাদিন কাটিয়ে দেয়। প্রত্যেক সপ্তাহান্তেই পিকনিক।
কলকাতার জন্য মন কেমন করে না সুলেখার। দিল্লিতেও ছবির এক্সিবিশন হয়, হলিউডের ফিম কলকাতার চেয়েও আগে দেখা যায়, উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের আসরও বসে। দিল্লির লোক যখন তখন কারুর বাড়িতে এসে উপস্থিত হয় না।
কলকাতার সঙ্গে এখন যোগাযোগ চিঠিপত্রে। সুলেখা চিঠি লেখে, অনেক চিঠি আসে। মমতা আর প্রতাপ দীর্ঘ চিঠি লিখেছেন। প্রতাপ কৌতুক করে লিখেছেন যে আদালত থেকে ফেরার পথে মাঝে মাঝে তিনি শ্বশুর বাড়িতে গিয়ে সুলেখার হাতে তৈরি চা খেতেন, এখন আর তিনি কোনো চায়েই স্বাদ পান না।…তালতলার বাড়িতে এখন ত্রিদিবের ছোট বোনরা এসে আছে, সুতরাং সে বাড়ি রক্ষণাবেক্ষণের কোনো চিন্তা নেই। সুলেখার দু’তিনটি ছাত্রীও খুব কাতর চিঠি পাঠিয়েছে।
রাতুলের চিঠি আসে সপ্তাহে অন্তত তিনখানা। রাতুলের হাতের লেখা চেনে সুলেখা, সে ওর একটা চিঠিও খোলে না, খাম শুন্ধুই ছিঁড়ে ফেলে দেয়।
একবার তো ভেবেছিল, দিল্লিতে এসে রাতুলকে সব কথা বুঝিয়ে চিঠি লিখবে। কিন্তু রাতুলকে সে এখন ভয় পায়। রাতুল যেন অন্ধ হয়ে গেছে, সে কোনো যুক্তি বুঝবে না। একজন যদি বারবার না না বলে, তবু আর একজন জোর করে প্রেম, ভালোবাসা চাইতে পারে? না, একে প্রেম বা ভালেবাসা বলে না, রাতুল চায় জোর করে তাকে অধিকার করতে। রাতুলের কথা ভাবলেই এখন সুলেখার ধিক্কার এসে যায় নারী জন্মে।
ত্রিদিবকে এখানে প্রায়ই যেতে হয় টুরে, কানপুর, মীরাট, আগ্রায়। কলকাতার তুলনায় তাকে খাটতে হচ্ছে অনেক বেশি। তার যেটা সবচেয়ে প্রিয় শখ, বিছানায় শুয়ে শুয়ে বই পড়া, তার জন্য সে সময়ই পায় না এখন। কিন্তু তার বিন্দুমাত্র অভিযোগ নেই। সে সব সময় উৎফুল্ল থাকে। সুলেখাকে খুশী দেখলেই তার ভালো লাগে।’
শাজাহান চিঠি লিখবে বলেছিল, কিন্তু চিঠির বদলে মাস দেড়েক বাদে সে নিজেই একদিন এসে উপস্থিত হলো।
তখন রাত সাড়ে আটটা, পরদিন ভোরে তাকে লখনৌ যেতে হবে। সুলেখা আর ত্রিদিব তখন সবে মাত্র ডিনার খেতে বসেছে। এখন তাদের রাত্রির খাবারের নাম ডিনার, কারণ বাবুর্চি প্রতি রাতে ঠিক সাড়ে আটটার সময় এসে বলে, মেমসাব, ডিনার লাগা দিয়া যায়?
শাজাহানকে দেখে তারা খুব খুশী হলো। সে কিছু খেয়ে এসেছে বললেও জোর করে তাকে বসানো হলো ডিনার টেবিলে। তারপর শুরু হলো কলকাতার গল্প।
শাজাহান এক সময় বললো, সুলেখা, তোমরা চলে এসেছো, কলকাতা একেবারে কানা হয়ে গেছে!
সুলেখা হেসে বললো, তাই নাকি। এরকম সুন্দর মিথ্যে কথা শুনতেও ভালো লাগে।
শাজাহান বললো, সত্যি বলছি। এখন সন্ধেবেলাগুলো কোথায় যাবো, ভেবেই পাই না। মাথা গ্রাহামের নাচের টিম এলো, কার সঙ্গে যাবো, কে বুঝবে, এই সব চিন্তা করে আর যাওয়াই হলো না। আনসা লোকের সঙ্গে যাওয়া যায় না। একেলা যেতেই ইচ্ছা করে না।
–আপনার স্ত্রীকে নিয়ে যান না কেন?
–জানো তো, সে এসব ওয়েস্টার্ন গান বাজনায় কোনো মজা পায় না। বাল-বাচ্চাদের ফেলে যেতেও চায় না কোথাও। যাক, আমি তো বিজনেসের জন্য মাঝে মাঝে দিল্লি আসি, এবার তোমাদের সঙ্গে দেখা করবার জন্য আরো ফ্রিকোয়েন্টলি আসবো।
ত্রিদিব জিজ্ঞেস করলেন, তোমার সঙ্গে দিল্লির কী বিজনেস কানেকশান? তোমরা তো চায়ের ব্যবসা করো, চায়ের অকশান হয় লন্ডনে, আর কলকাতা পোর্ট থেকেই বালক চা চলে যায় লন্ডনে। এর মধ্যে দিল্লি আসছে কোথা থেকে?
শাজাহান চোখ টিপে বললো, পাকিস্তান? পাকিস্তান!
এরপর শাজাহান যে কাহিনীটি বললো, সেটি চমকপ্রদ। পূর্ব পাকিস্তানের সিলেট অঞ্চলে যদিও যথেষ্ট চা হয়, তবু পশ্চিম পাকিস্তানের কয়েকজন ব্যবসাদার ভারতীয় চা কেনে। সেগুলো তারা কোথায় বিক্রি করে তা কে জানে! করাচীর একটি বিখ্যাত পরিবারের সঙ্গে ৪৪৪
দিল্লির ভগত্রাম নামে এক ব্যবসায়ীর কয়েক কোটি টাকার চা ও তামাকের ব্যবসা আছে। ব্যবসাটা ঠিক প্রকাশ্য নয়, তবে নরম সীমান্ত দিয়ে প্রায় দিন দুপুরেই মালপত্র চালান যায়। সে সব ব্যবস্থা আছে।
ত্রিদিব সবিস্ময়ে বললেন, দু’দেশে এখন এত টেনশান চলছে, এর মধ্যেও এক কট্টর ওয়েস্ট পাকিস্তানী ফ্যামিলির সঙ্গে দিল্লির মাড়োয়ারির ব্যবসা?
শাজাহান বললো, আরে ভাই, বিজনেসের ব্যাপারে ধর্ম-টর্ম কিছু না, দেশ-জাতি কিছু না। ভগরাাম নিরামিষ খায় আর হররোজ দু’বেলা হনুমানজীর পূজা করে। ওদিকে করাচীর আসফাঁকউল্লা দিনে পাঁচ ওক্ত নামাজ পড়ে। কিন্তু টাকার কোনো জাত নেই।
ত্রিদিব ভূকুঞ্চিত করে বললো, শাজাহান, তুমি এর সঙ্গে জড়িত। তাই আমি চিন্তা করছি। এর মধ্যে কোনোরকম বে-আইনী শেডি ডিল নেই তো?
শাজাহান তার কাঁধ চাপড়ে বললো, আরে না রে ভাই, আমি চা আর তামাক সাপ্লাই করি। আর আমি মুসলমান বলে ভগত্রাম মাঝে মাঝে পাকিস্তানের সঙ্গে বিজনেসের সময় আমার নাম ইউজ করে। করাচীতে আমার রিলেটিভস আছে, আমি বছরে একবার যাই কন্ট্রাক্ট পাকা করতে।
কথায় কথায় রাত সাড়ে দশটা বেজে গেল। ত্রিদিব দু’একটা হাই গোপন করলো। সপ্তাহের মাঝখানের দিনগুলো তাদের তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়া অভ্যেস হয়ে গেছে। তাছাড়া কাল তাকে ভোর সাড়ে চারটেয় উঠতে হবে। কিন্তু সে তো শাজাহানকে চলে যাবার জন্য ইঙ্গিত করতে পারে না।
সুলেখা জিজ্ঞেস করলো, আপনি দিল্লিতে এসে কোথায় উঠেছেন? শাজাহান জানালো যে ডিফেন্স কলোনিতে তার এক চাচার বাড়ি আছে। বেশ বড় বাড়ি, প্রায় ফাঁকাই পড়ে থাকে, সেই জন্য হোটেলের বদলে সে ওখানেই এসে ওঠে।
–সে জায়গাটা কত দূরে?
শাজাহান বুদ্ধিমান ব্যক্তি, সে সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে বললো, অনেক দূর এবার যেতে হবে, তোমাদের সঙ্গে গল্প করতে এত ভালো লাগছিল যে সময়ের কথা মনেই ছিল না।
ত্রিদিব ব্যস্ত হয়ে বললো, বসো, বসো, তুমি যাবে কী করে? তোমার সঙ্গে গাড়ি আছে?
শাজাহান জানালো যে সে দিল্লিতে এসে ট্যাক্সিতেই ঘোরাফেরা করে। কিন্তু গতকালই এসে সে এক কাহিনী শুনেছে যে এক মাসের মধ্যে রাত দশটার পর তিনজন ট্যাক্সি প্যাসেঞ্জার ছুরিতে খতম হয়েছে। রাত্রে দিল্লির ট্যাক্সি নিরাপদ নয়। সেইজন্য সে স্কুটারে যেতে চায়। ত্রিদিবের দারোয়ান একটা স্কুটার ডেকে দিতে পারবে না?
ত্রিদিবের অফিসের গাড়ি এখানে থাকে না। সেটা যেন তারই অন্যায়, সে জন্য সে সংকুচিত ভাবে দারোয়ানকে পাঠালো একটা স্কুটার ডেকে আনার জন্য। দারোয়ান কুড়ি মিনিট বাদে ফিরে এসে বললো, এ পাড়ায় এতরাতে স্কুটার পাবার কোনো আশা নেই।
আবার দাঁড়িয়ে পড়ে শাজাহান বললো, তবে তো ভারি মুশকিল হলো। তবে কি টেলিফোনে একটা ট্যাক্সিই ডাকবে?
ত্রিদিব আর সুলেখা চোখাচোখি করলো। ত্রিদিবের দৃষ্টিতে মিনতি।
সুলেখা বললো, তা হলে আপনি রাত্তিরটা এখানেই থেকে যান না। আমাদের একটা গেস্ট রুম আছে।
শাজাহান যেন এই প্রস্তাবের জন্যই অপেক্ষা করছিল। সে আগ্রহের সঙ্গে বললো, তা হলে তো খুবই ভালো হয়। আরও অনেকক্ষণ তোমাদের সঙ্গে গল্প করা যাবে!
ত্রিদিব আর সুলেখা আবার চোখাচোখি করলো।