নোয়াখালিতে বসিরের বাড়ি। বসিরের সঙ্গে আগে থেকে কথা হয়েছিল। তাই বাবুল প্রথমে নোয়াখালিতে গেল।
ভাদ্র মাস। নদী-খাল-বিল জলে একেবারে টইটম্বুর। যে দিকে তাকাও, শুধু সজল দৃশ্য। খানিকটা বাসে আর খানিকটা নৌকোয় আসতে হলো বাবুলদের। যাত্রা পথে বাবুল অনুভব করলো, শহরের চেয়ে গ্রাম্য প্রকৃতি তাকে অনেক বেশি উদ্বেল করে। নাম-না-জানা ফুলের গন্ধ, জলজ শ্যাওলার গন্ধ, এমনকি পাট-পচা গন্ধের মধ্যেও একটা মাদকতা আছে। একটা বিলের ওপর দিয়ে আসার সময় এক গুচ্ছ কচুরিপানার ফুলের সঙ্গে একটা হলদে রঙের ঢোঁড়া সাপের জড়িয়ে থাকার দৃশ্য দেখে তার মনে হয়, এই মুহূর্তে, এই বিল দিয়ে না গেলে এই বিশেষ দৃশ্যটি তো জীবনে দেখা হতো না! ছবিটি অকিঞ্চিৎকর, তবু যেন চোখে লেগে থাকে।
বসিররা এক পুরুষের বুদ্ধিজীবী। বসিরের বাপ-ঠাকুর্দা চাষবাস নিয়েই থাকতেন। বসিরই লেখাপড়া শিখে সাংবাদিক হয়েছে, বসিরের এক বড় ভাই পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে বড় অফিসার ছিলেন কিন্তু তিনি কোনো অজ্ঞাত কারণে আত্মহত্যা করেছেন গত বছর। আর এক ভাই আবার একেবারে গণ্ডমূর্খ, চাষবাসও করে না, সংসারের কিছু দেখেও না, গ্রামে মাতব্বরি করে।
বসিরদের বাড়িটি একটি খালের ধারে, বেশ ছিমছাম, পরিচ্ছন্ন, উঠোনের একপ্রান্ত থেকেই শুরু হয়েছে আম-কাঁঠালের বাগান। দুটি বড় বড় ধানের গোলা ও হাঁস-মুর্গির খোঁয়াড়, অবস্থা বেশ সচ্ছল বোঝা যায়, বসিরের এক চাচা এখনো দেড়শো বিঘে জমি চাষ করান।
খালের উল্টো দিকে হিন্দু পাড়া, এরা ঠিক বর্ণহিন্দু নয়, নমঃশূদ্র, এদের জীবিকা মাছ ধরা, জাল বোনা ও নৌকোয় আলকাতরা লাগানো। এদের মধ্যে আবার কিছু কিছু খৃষ্টানও রয়েছে। এই অঞ্চলে দাঙ্গা হয়নি, বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে এখনো সহজ মেলামেশা আছে, পাশের গ্রামে দুর্গাপূজাও হয়।
খালের ধারে ধারে ফুটে আছে কাশফুল, শিউলি গাছেও ফুল এসেছে। কিন্তু আকাশের চেহারা এখনো ঠিক শরৎকালের নয়, মেঘ সাদা হয়নি, নীল শূন্যতা তেমন চোখে পড়ে না, যখন তখন ঝেকে ঝেকে বৃষ্টি আসে। পায়জামা হাঁটু পর্যন্ত গুটিয়ে, খালি পায়ে, দু’খানা ছাতা নিয়ে বাবুল আর বসির গ্রাম ঘুরতে বেরুলো।
খানিকটা যেতেই সদ্য গোঁফদাড়ি গজানো এক ছোঁকরা দৌড়োতে দৌড়োতে এসে জুটে গেল ওদের সঙ্গে। এর নাম সিরাজুল, বসিরের এক পিসির ছেলে, বেশ গাঁট্টাগোঁট্টা চেহারা, সে বসিরের হাত ধরে অভিমানের সুরে বললো, আপনে কাইল রাতে আসলেন, আমারে একটা খবরও দিলেন না?
বসির বললো, আবার তুই এসে জুটলি? তোরে আমি ভয় পাই!
তারপর বাবুলের দিকে ফিরে বললো, এই ছ্যামড়াডা, মেট্রিক পাস করে বসে আছে, খুব ইচ্ছে কলেজে পড়ার। ওর বাপ-দাদারা ওরে পড়াবে না, তার আমি কী করি বলো তো?
সিরাজুল বললো, আমি কতবার আপনেরে কইলাম আমারে একবার ঢাকা নিয়া চলেন, তারপর আমি নিজেই সব মেনেজ করবো।
–মেনেজ তো করবি। কিন্তু ঢাকায় গিয়ে তুই থাকবি কোথায়?
–কেন, আপনের বাসায়?
বসির আবার বাবুলের দিকে তাকিয়ে বললো, আচ্ছা কও তো, আমার বাসায় ও ক্যামনে থাকবে? দুইখান মাত্র ঘর!
সিরাজুল চোখের ইশারায় জানতে চাইলো, ইনি কে?
বসির বললো, ইনি বাবুল চৌধুরী, ইকোনমিকসের লেকচারার; ঢাকায় গিয়ে যদি ল্যাখাপড়া করতে চাস তো এনারে ধর।
সিরাজুল অমনি বাবুলের দিকে তাকিয়ে কাতরভাবে বললো, সার, আমার একটা ব্যবস্থা কইরা দ্যান, সার!
বাবুল হাসলো, মফঃস্বলের ছেলেদের কাছে ঢাকার ছাত্রজীবন খুব রোমাঞ্চকর মনে হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু দিন দিন যেরকম খরচ বাড়ছে, তাতে সাধারণ গরিব ঘরের ছেলেদের আর ঢাকায় গিয়ে পড়াশুনো চালানো সম্ভব নয়।
বসির বললো, ও মনে পড়ছে, শোনলাম, তুই নাকি এর মধ্যে শাদী করেছিস? ঢাকায় কে যেন খবর দিল আমারে।
সিরাজুল লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করলো।
বসির একটু ধমক দিয়ে বললো, সত্যি কথা? এর মইধ্যেই শাদী করে ফেললে তুই আর পড়াশুনা করবি কী করে?
সিরাজুল বললো, কী করবো। আমার আব্বায় যে জোর কইরা আমার বিয়া দিল।
–জোর কইরা বুঝি বিয়া দেওয়া যায়? যাক যা করছোস তো করছোস, তোর বউ দেখাবি na? চল, তোর বউ দেইখ্যা আসি!
সিরাজুল এবার মাথা তুলে উজ্জ্বল মুখে বললো, যাবেন আমাগো বাসায়, যাবেন?
দু’পাশে পাট খেতের মাঝখান দিয়ে কাঁচা রাস্তা। কাদায় পা গেঁথে যায়। পাট গাছের ওপর প্রচুর ফড়িং ওড়াউড়ি করছে। এক জায়গায় একটা বাঁশের সাঁকো। একখানা মাত্র বাঁশ পায়ের নীচে, আর একখানা বাঁশ ধরে ধরে যাওয়া, বাবুলের ভয় ভয় করে। সে টাঙ্গাইল ও ঢাকা শহরেই বাল্য-কৈশোর কাটিয়েছে, তেমন গ্রামের অভিজ্ঞতা তার নেই। সন্তর্পণে সেই সাঁকো পার হতে হতে সে তলার জলের দিকে তাকিয়ে দেখলো ঈষৎ লালচে রঙের এক ঝাঁক মাছের পোনা, তার পাশেই রয়েছে একটা বড়, কালো রঙের শোল মাছ, যেন বাচ্চাগুলোর পাহারাদার। বাবুল এমন দৃশ্য আগে কখনো দেখেনি, সে মোহিত হয়ে থমকে যায়।
বসিরের সাংবাদিক প্রবৃত্তি জেগে উঠেছে এর মধ্যে। সে সিরাজুলের কাঁধে হাত দিয়ে জিজ্ঞেস করলো, এদিকে ভোটের গরম ক্যামন রে? কে জিতবে?
সিরাজুল বললো, ফতেমা জিন্না! আমরা কী শ্লোগান দেই জানেন না? ‘স্বৈরাচারী আইয়ুব খান, ভোট দিয়ো না এক খান! আমি এখনই কইতে পারি, এদিকে আইয়ুব খান একটাও ভোট পাচ্ছে না!
–কপ্-এর নেতারা কেউ এদিকে আসে?
–জী, আসে। আইজ বিকালেই তো রথতলার মাঠে মিটিং আছে, যাবেন?
–যাবো তো বটেই।
বাবুলের দিকে ফিরে সে বললো, পূর্ব পাকিস্তানর চল্লিশ হাজার ভোটের মধ্যে আইয়ুব কয়টা পাবে আমারও সন্দেহ আছে। পশ্চিম পাকিস্তানে মিস জিন্নার সাপোর্টার কম হবে না। যদি ফেয়ার ইলেকশন হয়, তাহলে আইয়ুবের জেতার কোনো চান্স নাই।
বাবুল বললো, জোর করে যে-লোক, প্রেসিডেন্টের আসন দখল করেছে, এখনও সিভিল-মিলিটারি সব ক্ষমতা যার হাতে, সে আবার প্রেসিডেনশিয়াল ইলেকশন ডেকেছে। কোনো কারণেই সে জায়গা ছাড়বে বলতে চাও? এটা শুধু নিজের পজিশানটাকে আইনসম্মত করা।
সিরাজুলদের বাড়ি বেশি দূর নয়। এরা বসিরদের তুলনায় অনেক দরিদ্র। খড়ের চালের ঘর, উঠোনে এক হাঁটু জল জমে আছে, সেই জলে ভাসছে কতকগুলো মুর্গির পালক।
জল ঠেলে দাওয়ায় উঠে বসির বললো, ও পিসি, বাড়িতে মেহমান আইছে। কী খাইতে দিবা কও!
বসির এ বাড়িতে মান্যগণ্য অতিথি। একদল বাচ্চা এসে ওদের ঘিরে ধরে। তারা বাবুলের দিকেও অবাক ভাবে চেয়ে থাকে। বাবুলের চেহারা এমনিতেই সুদর্শন, তার ওপরে শহুরে পালিশ আছে, গ্রাম্য শিশুদের চোখে সে যেন একজন অপরূপ মানুষ।
নারকোল কোরা ও মুড়ি খেতে দেওয়া হয় ওদের। মুড়ি খেলেই বাবুলের চা তেষ্টা পায় কিন্তু এ বাড়িতে বোধ হয় চায়ের পাটই নেই। সিরাজুলের এমন ইনিয়ে বিনিয়ে দুঃখের গল্প শুরু করে যে একটু পরেই বাবুলের অধৈর্য লাগে।
সিরাজুলের বালিকা বধূ কিছুতেই লজ্জায় ওদের সামনে আসতে চায় না। সিরাজুল তাকে ধরে প্রায় টানাটানি করতে লাগল। সে আরও বেশি লজ্জা পাচ্ছে বাবুলের জন্য, কারণ বাবুল বাইরের লোক। একই ব্যাপার অনেকক্ষণ চলতে থাকার পর বসির বললো, থাক সিরাজুল, তোর বিবির মুখ আমরা দ্যাখতে চাই না। তুই একলাই দেখিস।
বাবুল বললো, আমি না হয় বাইরে গিয়ে দাঁড়াই।
এই সময় দু’তিনজন সাঙ্গপাঙ্গ সমেত একজন মুরুব্বি গোছের লোক বাইরে থেকে হাঁক দিল, এই সিরাজুল, সিরাজুল!
দীর্ঘকায় লোকটির পরনে সিল্কের লুঙ্গি, খালি গা, গলায় একটা সোনার চেন। বাঁ হাতে একটা সিগারেটকে গাঁজার কল্কের মতন ধরে হুস হুস করে টানছে। তাকে দেখে বাচ্চারা ভয়। পেয়ে কোথায় অদৃশ্য হয়ে গেল। সিরাজুলের আঁচলে মুখ ঢেকে ঘরের মধ্যে ঢুকে গেলেন, সিরাজুলের যেন মুখ শুকিয়ে গেল। সে এক পা এক পা করে এগিয়ে গিয়ে গা মোচড়াতে মোচড়াতে দীন কণ্ঠে বললো, চাচা আপনি নিজে আইছেন, আমিই তো আপনের বাড়িতে যাইতাম, কাইলই যাইতাম।
লোকটি রাগে দাঁত কিড়মিড় করে, নিচু হয়ে পায়ের জুতো খুলে মারার ভঙ্গি করলো, কিন্তু পায়ে জুতো নেই! চড় তুলে বললো, হারামখোর, আবাগীর পুত, বেহায়া! তোরে কিছু কই না, তাই তুই মাথায় উইঠ্যা বসছোস? সেই বকরিদের সময় টাহা হাওলাৎ নিচ্ছিল, এহন আউস ধান উঠানের সময় হইয়া গেল, আমার নিজেরই এহনে টানাটানি, তার উপর তুই আমার ছুট ভাইরে মারতে গেছিলি। সাপের পাঁচ পা দেখছোস বুঝি, না?
বসির চোখ গোল গোল করে বললো, ওরে বাবা, সেই লোকের এখন এই অবস্থা? বাবুল জিজ্ঞেস করলো, এই অভদ্র লোকটা কে?
বসির বললো, এর নাম ইরফান আলি, আগে কী সব ছোটখাটো কাম কাজ করতো, এখন সার, পেস্টিসাইডের ব্যবসা করে শুনেছি। আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়েছে, গলার আওয়াজেও অনেক জোর হয়েছে, ইউনিয়ন কাউনসিলের মেম্বার!
–সিরাজুল টাকা ধার করেছে বলে তারে মারতে এসেছে?
–ভাবভঙ্গি তো সেইরকমই দেখি! দাঁড়াও, আমি দাবড়ানি দিচ্ছি। ব্যাটা কী যেন একটা ইলেকশনে দাঁড়িয়েছিল একবার। ওঃ হো, মনে পড়েছে, ইরফান আলি তো একজন বেসিক ডিমোক্রাট!
–বেসিক ডিমোক্রাট-এর একখান নমুনা?
–পূর্ব পাকিস্তানের চল্লিশ হাজার এলিটের একজন। কম কথা নয়!
বসির দাওয়া থেকে নেমে গিয়ে ভারিক্কি গলায় বললো, আরে, ইরফান ভাই যে! কী ব্যাপার, এত হল্লা কিসের?
ইরফান আলি যেন ভূত দেখলো কিংবা জোঁকের মাথায় নুন পড়লো। এখানে বসিরকে দেখতে পাবে, এটা যেন কল্পনাতীত ব্যাপার।
পূর্ব মূর্তি মুছে ফেলে সঙ্গে সঙ্গে কণ্ঠস্বরে কোমলতা ঝরিয়ে বিগলিত মুখে সে বললো, আরে বসির? তুমি কবে আইলা? আমারে একটা সংবাদ দাও নাই?
বসির বললো, তুমি তো এখন বিগ ম্যান। আমি তোমারে সংবাদ দেবো কোন সাহসে?
ইরফান আলি এগিয়ে এসে বসিরের হাত চেপে ধরে বললো, কী যে কও তুমি! আমরা হইলাম বিগ ম্যান, হেঃ! কেউ মানে না। বসির, তুমি এখন কুন্ পেপারে আছো?
বাবুল তাকিয়ে দেখলো, একটু দূরে সিরাজুলের পত্নী এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে বাইরের দিকে। এখন আর সে কাঠ-পুত্তলী নয়, এখন সে মানুষ, তার চোখেমুখ শঙ্কা। যতদূর মনে হয়, ধারেই এখন সিরাজুলদের সংসার চলছে, আজকের মতন এই রকম ঘটনা আগেও ঘটেছে। এ বাড়িতে।
হঠাৎ বাবুলের বুকটা কেঁপে উঠলো, কতই বা বয়েস মেয়েটির, বড় জোর পনেরো-ষোলো। আব্বা-আম্মাকে ছেড়ে একটি নতুন সংসারে এসেছে। সবার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে সময় লাগবে। তার আগেই এরকম অশান্তি! বাড়ি বয়ে এসে লোকেরা তার স্বামীকে মারতে আসে। স্ত্রীর চোখের সামনে যারা স্বামীকে অপমান করে, তারা কতখানি অমানুষ!
বাবুল আর একটা কথাও ভাবলো। সিরাজুলের স্বাস্থ্য ভালো, দেখলেই মনে হয় গায়ে বেশ জোর আছে। সে যদি একটা দলবল তৈরি করে নিতে পারতো তা হলে কেউ তার মুখের ওপর চোটপাট করতে সাহস পেত না। কিন্তু চেহারা বলশালীদের মতন হলেও সিরাজুলের প্রকৃতি নিশ্চয়ই নরম। গা-জুয়ারি করার বদলে সে আরও লেখাপড়া শিখতে চায়।
সিরাজুলের বউ এখন আর লজ্জাশীলা নয়। বাবুলের সঙ্গে একবার তার চোখাচোখি হলো। সেই দু’চোখে মিনতি। বাবুল নিজেই চোখ ফিরিয়ে নিল, তবু তার সারা অঙ্গে একটা ঝাঁকুনি লাগলো। মেয়েটি যেন খুব চেনাচেনা। না, বাবুল এই মেয়েটিকে আগে কখনো দেখেনি, কিন্তু গ্রাম বাংলার সরল অসহায় নির্যাতিতা তরুণী মেয়েদের মুখ আঁকার সময় সমস্ত শিল্পীরা যেন অবিকল এই মুখটিই আঁকেন। মাটির রঙের শরীর, মাটির মতন সর্বংসহা কিন্তু মাটির মতন বেশিদিন টিকে থাকতে পারে না।
বাবুল অধিকাংশ জায়গাতেই দর্শকের ভূমিকা পালন করে। সে মনে মনে ভালো-মন্দ, ন্যায়-অন্যায় বিচার করে, কিন্তু নিজে কোনো সক্রিয় অংশ নেয় না। এই মুহূর্তে হঠাৎ যেন সে একটা খোলস ছেড়ে বেরিয়ে এলো। সে উঠে দাঁড়িয়ে সিরাজুলের নবোঢ়ার দিকে তাকিয়ে চোখের ইঙ্গিতে জানালো, ভয় নেই। তারপর সে নেমে গেল দাওয়া থেকে।
বাবুল এমনিতে লাজুক ও মৃদুভাষী হলেও কখনো কখনো বেশ কঠোর হতে পারে। বসিরের মধ্যস্থতায় সিরাজুল ও ইরফান আলির মধ্যে একটা রফা হলো, বাবুল সেখানে গিয়ে দাঁড়ালো। বসিরের কথা থামিয়ে সে সিরাজুলকে ডেকে অন্যদের শুনিয়ে বেশ জোরে জোরে বললো, শোনো সিরাজুল, তুমি ঢাকায় যেয়ে যদি লেখাপড়া করতে চাও, আমার বাসায় থাকতে পারো। সেখানে থাকা-খাওয়ার কোনো অসুবিধা নাই। এখানে তোমার কত টাকা হাওলাৎ আছে? দুপুরে বসিরের বাড়িতে যেয়ে তুমি টাকাটা নিয়ে এসো আমার কাছ থেকে। তুমি পরে আমারে শোধ দেবে।
বসির হকচকিয়ে বাবুলের দিকে ঘুরে তাকাতেই বাবুল আবার বললো, চলো, ইস্কুল বাড়িটা দেখে আসি। এখানে আর কতক্ষণ থাকবে?
ইরফান আলি বিস্ফারিত লোচনে বসিরকে জিজ্ঞেস করলো, এনারে তো চেনলাম না? বসির সঙ্গে সঙ্গে বললো, চেনো না? মোনেম খাঁর ভাইর ব্যাটা, বাবুল চৌধুরী। বাবুলের চেহারা দেখে প্রথমেই ইরফান আলির মনে সমীহভাব জেগেছিল, তার ওপর পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মোনেম খাঁর নাম শুনে ভয় পায় না এমন ব্যক্তির সংখ্যা মুষ্টিমেয়।
আর সকলের থেকে বাবুল যেন আলাদা হয়ে গেল। সবাই শঙ্কা ও ভক্তি মিশ্রিত চোখে বাবুলকে দেখছে। ইরফান আলি রীতিমতন হাত কচলাতে শুরু করেছে। বসিরের ঠাট্টাটা সিরাজুলও বুঝতে পারে নি, সে ভাবলো, সত্যিই মোনেম খাঁ’র ভাইয়ের ছেলে এসেছে তার মতন এক গরিবের বাড়িতে? নিজে থেকেই তিনি অতগুলো টাকা দিয়ে দিতে চাইলেন? এ কী রূপকথা?
কোনো ঘটনারই কেন্দ্রীয় চরিত্রের ভূমিকা নেওয়া বাবুলের শখ নয়। কেন সে এমন একটা নাটকীয় কাজ করে ফেলল তা সে নিজেই বুঝতে পারছে না। তবে ইরফান আলির ব্যবহার দেখে তার গা জ্বলে যাচ্ছিল, সিরাজুলের বাচ্চা বউটার অসহায় দৃষ্টি দেখে তার মনে হয়েছিল, চিরকালই কি গরিবরা এ রকম অপমান সহ্য করে যাবে, কেউ তাদের ভরসা দেবে না?
যদিও বাবুল জানে, নিজের টাকায় একজন গরিবের ধার শোধ করে দেওয়াটা কোনো সমস্যার সমাধানই নয়। সে নিজের বদান্যতা জাহির করতেও যায় নি, সে শুধু ইরফান আলিকে একটু অপমান করতে চেয়েছিল।
ইরফান আলি গদগদ ভাবে বললো, আমাগো বাড়িতে একবার পায়ের ধুলা দেবেন না সার? একটু পান-তামুক খাবেন।
বাবুল কঠিন গলায় বললো, না। সময় নাই। চলো, সিরাজুল।
বিকেলবেলা ওরা গেল রথতলার মাঠে মিটিং শুনতে। একটি বড় পাকা বাড়ির সামনে প্রশস্ত মাঠ, এককালে এখানে ধূমধামের সঙ্গে রথটানা হতো, এখন বোধ হয় আর তেমন ধূমধাম হয় না কিন্তু একটি চালা ঘরের মধ্যে দোতলা সমান রথটি এখনো রয়ে গেছে।
মিটিং ডেকেছে কপ, তবে আওয়ামী লীগের কর্মীসংখ্যাই বেশি। প্রায় হাজার দেড়েক মানুষ এসেছে। সৌভাগ্যের বিষয় এই যে, দুপুরের পর থেকে আর বৃষ্টি পড়েনি। মাঠটিও বেশ উঁচু, কাদা জমে না। জনতার মধ্যে চাষাভূয়ো জেলে মুসলমান-হিন্দু সবরকমই আছে।
ফতিমা জিন্না নিজেই এখন সারা দেশে ঘুরে ঘুরে মিটিং করছেন। বক্তৃতাও ভালো দেন। তা বলে তিনি এত ছোট জায়গায় আসবেন তা আশা করা যায় না। তিনি আসেননি, তাঁর লিখিত ভাষণই পাঠ করা হলো, প্রথমে উর্দুতে, তারপর বাংলায়। তাঁর ভাষণে বেশ ভালো ভালো কথা আছে। তিনি ক্ষমতা হাতে পেলে সামরিক শাসনের অবসান ঘটাবেন। দেশে গণতন্ত্র আনবেন। প্রতিটি মানুষের সমান ভোটাধিকার থাকবে। অতি প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বেঁধে দেবেন। পাকিস্তান নিজের পায়ে দাঁড়াবে। তাঁর ভাষণের মাঝে মাঝেই জনতার হর্ষধ্বনি হচ্ছে। যারা নিজের নামটিও স্বাক্ষর করতে জানে না, তারাও গণতন্ত্রের নামে উত্তেজনা বোধ করে। গণতন্ত্র যেন এক ম্যাজিক, যা এলে সব সমস্যার সুরাহা হয়ে যাবে।
ছোট একটি প্যাডে নোট নিতে নিতে বসির বললো, তুমি সাধারণ মানুষের এনথুথিয়াজম লক্ষ করছো, বাবুল? এবারে দেশে একটা চেইঞ্জ না এসেই পারে না।
বাবুল কোনো মন্তব্য করলো না।
খানিকবাদে একজন বাঙালী নেতা বক্তৃতা শুরু করলো। সেই বক্তৃতার ভাষা সাদামাটা, কিন্তু কণ্ঠস্বরে বেশ নাটক আছে, তার বক্তব্য মন স্পর্শ করে।
বাবুল জিজ্ঞেস করলো, এই লোকটা কে?
বসির বললো, একে চেনো না? এই-ই তো আওয়ামী লীগের শেখ মুজিবর রহমান। ঐ পার্টির বড় বড় নেতাদের সরিয়ে দিয়ে সে এখন প্রধান হয়ে উঠেছে।
বাবুল প্রায় পাঁচ ছ’ বছর পর শেখ মুজিবর রহমানকে দেখলো। চেহারায় কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে, তাই সে চিনতে পারেনি। রাজনৈতিক দলে ক্ষমতার ওঠা-পড়ার সঙ্গে সঙ্গে নেতাদের চেহারা বদলায়। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দি আর ক্ষমতাচ্যুত সোহরাওয়ার্দির চেহারায় ও ব্যক্তিত্বে অনেক তফাত সে দেখেছে। এই শেখ মুজিবর রহমানও এক সময় যখন মওলানা ভাসানি আর সোহরাওয়ার্দির যুগল ছত্রছায়ায় ছিলেন তখন তাঁর চেহারা ছিল বেশি প্রশ্রয় পাওয়া ধনী ব্যক্তির নাতির মতন। এখন তাঁর কণ্ঠস্বরে পৃথক ব্যক্তিত্ব।
সভা অতি সার্থক ভাবে শেষ হবার পর বসির আর বাবুল একটা শিরীষ গাছের নিচে বসে রইলো কিছুক্ষণ। হেঁটেই তো ফিরতে হবে, সুতরাং কোনো তাড়া নেই।
শর্টহ্যাণ্ডে লেখা নোটগুলি পড়তে পড়তে বসির বললো, আরও দু’তিনটা মিটিং দেখে একটা সার্ভে রিপোর্ট লিখবো। ভালো কপি হবে। মামুনভাই খুশী হবে।
বাবুল কোনো মন্তব্য করলো না।
বসির আবার বললো, সাধারণ মানুষের এতখানি সাপোর্ট, ফতিমা জিন্না পাওয়ারে আসবেনই। আইয়ুব ইলেকশান ডেকে নিজের কবর খুঁড়েছেন।
বাবুল এবারে বললো, তোমাকে একটা কথা বলবো, বসির? মিটিং শুনতে শুনতে আমার বউয়ের কথা মনে পড়ছিল খুব। তুমি হাসবে শুনে, তবু আমি আমার বউয়ের একটা কথা বলি। মঞ্জু বলেছিল, “আমার সাপোর্ট করা না করায় কী আসে যায়? আমার কী ভোট আছে? এই কথাটাই আমার কানে বাজছিল এতক্ষণ। এই যে আজ হাজার দেড় হাজার মানুষ এসেছিল বক্তৃতা শুনতে, এত উৎসাহের সঙ্গে চ্যাঁচামেচি করলো, এদের কিন্তু কারুরই ভোট নাই। এমন কি শেখ মুজিবর রহমানেরও ভোট দেবার অধিকার নাই। এ এক অদ্ভুত ফার্স, একটা ইলেকশান হচ্ছে, যারা বক্তৃতা দিচ্ছে কিংবা বক্তৃতা শুনতে আসছে, তাদের প্রায় কারুরই ভোট দেবার অধিকার নাই, ভোট দেবে মাত্র আশি হাজার মানুষ।
বসির বললো, দেশের এত মানুষের যে স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন, তা কি অস্বীকার করা যায়? বেসিক ডেমোক্র্যাটরা এর উল্টো দিকে যেতে পারবে?
–মাদাম জিন্না যা ঘোষণা করেছেন, তার সার কথাটা কী? তিনি সকলের জন্য গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার এনে দেবেন। অর্থাৎ? বেসিক ডেমোক্রাটদের উচ্ছেদ। এরা কিন্তু সুবিধাভোগী শ্রেণীর। এরা নিজেদের সব সুযোগ সুবিধা বিসর্জন দেবে, ফতিমা জিন্নার জন্য? আশ্চর্য!
–তুমি এতটা নৈরাশ্যবাদী হয়ো না, বাবুল। রিগিং যাতে না হয় তার জন্য আমরা সর্বক্ষণ ভিজিলেন্স রাখবো।
–রিগিং হোক বা না হোক, বেসিক ডিমোক্রেসি তুলে দিতে চাইবে, ঐ ইরফান আলির মতন ডিমোক্র্যাটরা? এ আমি বিশ্বাস করি না। ফতিমা জিন্নার কোনো ভবিষ্যৎ নাই।
–তুমি বাজি রাখবে? এক বোতল স্কচ!
–আমি মদ খাই না, বসির।
এর পর চার পাঁচটা গ্রাম ঘুরে নির্বাচনী সভা দেখলো বাবুল আর বসির। সর্বত্রই সমান উত্তেজনা। কাগজে কাগজে লেখা হচ্ছে যে পশ্চিম পাকিস্তানের চেয়ে পূর্ব পাকিস্তানে ভোটের উৎসাহ অনেক বেশী। বাঙালীরা গণতন্ত্র-প্রিয়, তারা সামরিক শাসন চায় না, তারা ফতিমা জিন্নাকে চায়।
বাবুলের তবু মনে হয়, এ এক নিষ্ঠুর পরিহাস। যারা ভোটের জন্য এত লাফাচ্ছে, তাদের মতামতের আসলে কোনো মূল্যই নেই।
শেষ পর্যন্ত বাবুলের কথাই ঠিক হলো। নির্বাচনী ফলাফলে শোচনীয় ভাবে হেরে গেলেন বেগম ফতেমা জিন্না। আইয়ুব খাঁ শুধু পশ্চিম পাকিস্তানে নয়, পূর্ব পাকিস্তানেও সংখ্যা গরিষ্ঠ ভোট পেলেন, বিশ্বের চোখে তিনি হলেন পাকিস্তানের আইনসঙ্গত রাষ্ট্রপতি।