সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে মামুন দেখতে পেলেন সদর দরজা ঠেলে ঢুকছে একটি দম্পতি। মামুন থমকে দাঁড়ালেন, এই প্রৌঢ় বয়েসেও তাঁর বুক কেঁপে উঠলো। মঞ্জু এসেছে।
কচি কলাপাতা রঙের শাড়ি পরে এসেছে মঞ্জু, তার বুকে তার শিশু সন্তান। তার স্বামীর পরনে সাদা কুর্তা-পাজামা। মামুন জানতেন যে মঞ্জুরা ঢাকায় ফিরেছে গত মাসের প্রচণ্ড ঝড়বৃষ্টির মধ্যে, কিন্তু এ পর্যন্ত মঞ্জু তাঁর সঙ্গে দেখা করেনি।
মঞ্জু বাচ্চা মেয়ের মতন চেঁচিয়ে উঠলো, মামুন মামা। তুমি বাইরে যাচ্ছিলে নাকি? মামুন বললেন, না। এসো।
মঞ্জ তার ছেলেকে স্বামীর কোলে দিয়ে দৌড়ে উঠে এসে মামুনের পা ছুঁয়ে কদমবুসি করলো। বাবুল চৌধুরী অবশ্য তা করলো না। তার দু হাত জোড়া এই ছল করে হাসিমুখে বললো, কেমন আছেন, মামুনভাই?
মঞ্জু অভিযোগের সুরে বললো, তুমি এখানে বাসা নিয়েছো, আমারে জানাও নাই কেন?
অনেকদিন পর শহরের রাজনীতির স্বাদ পেয়ে মামুন আর গ্রামে ফিরে যেতে পারেননি। বড় বোনের বাড়িতেও বেশিদিন আতিথ্য নিয়ে থাকা যায় না, তাই মামুন পুরানা পল্টনে আলাদা বাসা ভাড়া নিয়েছেন। ফিরোজা বেগম গ্রাম ছেড়ে আসতে চাননি, এই নিয়ে মতান্তর, মন কষাকষি চলেছে কিছুদিন ধরে। কিন্তু এই এক জায়গায় মামুন বজায় রেখেছেন তাঁর জেদ। ফিরোজা বেগম মাঝে মাঝে এখানে এসে থাকেন, যদিও সর্বক্ষণ তাঁর মন পড়ে থাকে মাদারিপুরে।
বাইরের লোকজনের গলার আওয়াজ শুনে মামুনের মেয়ে হেনা বেরিয়ে এলো বাইরে। নতুন বর্ষায় পুঁইডগার মতন সে ফনফনিয়ে লম্বা হয়ে উঠছে। মঞ্জু তাকে দেখে চোখ বড় বড় করে বললো, এটা কে, হেনা নাকি? উরি ব্রাইস রে! কত্ত বড় হইয়া গ্যাছে মাইয়াডা!
মামুন দেখছেন মঞ্জুকে। কত বদলে গেছে মঞ্জ। তার শরীরে সেই হিলহিলে ছটফটে ভাবটা একটুও নেই। তার ভুরুতে সব সময় মাখা থাকতো যে সরল বিস্ময়, তা কোথায় গেল? ঢাকায় পা দিয়েই সে মামুনের সঙ্গে দেখা করার জন্য ছুটে আসেনি। সে রকম আগ্রহ থাকলে সে তার মায়ের কাছ থেকে মামুনের এই বাড়ির ঠিকানা জোগাড় করতে পারতো না?
বসবার ঘরটি সংক্ষেপে সাজানো। এক পাশে একটি চৌকির ওপর সুজনি পাতা, বাইরের কোনো অতিথি এলে ওখানেই শুতে দেওয়া হয়। আর কিছু বেতের চেয়ার, একটি নিচু টেবিল যার ওপরে দাবার ছক আঁকা। এই দাবা খেলাটা মামুনের নতুন নেশা। রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপ বন্ধ হয়ে যাবার পর এতে বেশ ভালো সময় কাটে। এই একটি মাত্র খেলা, যাতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা নিঃশব্দ থাকা যায়।
ফিরোজা বাইরের লোকের সামনে বেরোন না। কিন্তু এরা তো বাইরের লোক নয়, মামুন দু’তিনবার স্ত্রীর নামে হাঁক দিলেন, তবু কোনো সাড়া শব্দ নেই। ফিরোজা বেগম একবার উঁকি মেরে দেখেই বাথরুমে ঢুকে বসে আছেন। তিনি অতিমাত্রায় রূপ সচেতন। নিজের তেলতেলে মুখ কিংবা রান্না করার শাড়ি পরা চেহারা তিনি কারুকে দেখাতে চান না। হেনার হাত ধরে মঞ্জু চলে গেল অন্দর মহলে।
বাবুল বললো, মামুনভাই, আজকাল তো আপনি খবরের কাগজে খুব লিখছেন। আপনার লেখাগুলি সব পড়ি।
মামুন বললেন, হ্যাঁ, আগে ছিলাম কবি, এখন হয়ে উঠেছি ঝানু সাংবাদিক।
-–কেন, কবিতা আর লেখেন না?
–নাঃ! আমার কবিতা কেউ চায়ও না, আমারও লিখতে ইচ্ছে করে না। তাও খবরের কাগজে কলম ধরেছিলাম রাজনৈতিক অ্যানালিসিস লিখবো বলে, এখন সেনসরশীপের ধাক্কায় ‘বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ কিংবা মধ্যপ্রাচ্যে জীবনের বিকাশ’ জাতীয় এলেবেলে জিনিস লিখি। লেখাটাই জীবিকা হয়ে গেছে যে।
–আবার তো ইলেকশন হবে হবে বলে একটা রব শোনা যাচ্ছে।
–হলেও সেটা বারো হাত কাঁকুড়ের তের হাত বিচি ছাড়া আর কিছু হবে না। ফ্রণ্ট ভেঙে গেল, কোনো দল কি একা একা পারবে সরকারি পার্টির সঙ্গে? আইয়ুব খান যথেষ্ট পপুলার। এদেশের মানুষ এখনো গণতন্ত্রের মূল্য বোঝে না।
–আমি তো গ্রামে থাকি, আমি দেখেছি, আপনাদের আওয়ামী লীগ এখনও যথেষ্ট পপুলার। আপনাদের পার্টি তো ইণ্ডিয়ার সাহায্য পায়, ইলেকশান হলে আপনাদের জেতবার যথেষ্ট চান্স আছে। ইণ্ডিয়ার ব্যাকিং-এই আপনারা মিনিস্ট্রি ফর্ম করতে পারবেন।
মামুন তীক্ষ্ণ চোখে বাবুলের দিকে তাকালেন। ছেলেটি কি তাঁকে বিদ্রূপ করছে? ‘আপনাদের আওয়ামী লীগ’ কথাটার মধ্যে প্রচ্ছন্ন খোঁচা আছে। তিনি খানিকটা ধারালোভাবে জিজ্ঞেস করলেন, ইণ্ডিয়া আমাদের সাহায্য করে কে বললো?
বাবুল হাসি মুখে বললো, লোকে বলে এই রকম কথা।
–লোকে তো অনেক কিছুই বলে। এমন বহু লোক আছে যারা বলে, পার্লামেন্টারি ডেমোক্রেসির চেয়ে সামরিক শাসন ভালো। তুমি লেখা পড়া জানা শিক্ষিত ছেলে, তুমি যা বলবে তা গুরুত্ব দিয়ে, ভেবে চিন্তে বলবে, এমন আশা করেছিলাম।
বাবুল হাসিটাকে আরো চওড়া করে বললো, আসলে ব্যাপার কী জানেন মামুনভাই, আমি আজকাল পলিটিক্স নিয়ে একেবারে মাথা ঘামাই না। কোনো খবরও রাখি না। আমি এখন–
মামুন তাকে বাধা দিয়ে বললেন, এতে নতুনত্ব কিছু নাই! অনেকেই তো এখন ভয় পেয়ে রাজনীতি ছেড়ে বাড়ির মধ্যে সেঁধিয়ে আছে।
–ঠিক বলেছেন। আমি এখন শুধু চিন্তা করি যাতে আমার বউ-ছেলের কোনোক্রমে কোনো ক্ষতি না হয়। তবে লোকে যেসব কথা বলে, তা কানে আসে, কান তো আর বন্ধ রাখতে পারি না।
–কান বন্ধ রাখা যায় না বটে, তবে নিজস্ব বিচার বুদ্ধিটাকেও বন্ধ করে রাখা কোনো সুস্থতার পরিচয় নয়।
বাবুল আর তর্ক না বাড়িয়ে চুপ করে গেল। মামুন হঠাৎ খেয়াল করলেন যে তিনি এই ছেলেটির সঙ্গে যেন প্রথম থেকেই রাগ রাগ সুরে কথা বলছেন। অথচ বাবুল চৌধুরী এখন তাঁর কুটুম্ব, অনেকদিন পর বেড়াতে এসেছে, একে বরং বেশি বেশি খাতির যত্ন করা উচিত।
এক সময় এই বাবুল চৌধুরীকে তিনি খুবই পছন্দ করতেন। এর বড় ভাই আলতাফের কাছে তিনি কৃতজ্ঞ, সে-ই তাঁকে প্রায় জোর করে অজ্ঞাতবাস থেকে টেনে এনেছে জনজীবনের স্পন্দনের মধ্যে। এক সময় কত খাতির করেছে তাঁকে। কিন্তু হঠাৎ সবকিছু যেন বদলে গেল। আওয়ামী লীগ ভেঙে যখন ন্যাপের জন্ম হলো, এরা দু ভাই চলে গেল ন্যাপে। রাজনৈতিক বিচ্ছেদে ব্যক্তিগত সম্পর্কও নষ্ট করতে হবে? মৌলানা ভাসানীর যেমন মুখ আলগা, তেমনি ন্যাপের ছেলেরাও আওয়ামী লীগ কর্মীদের প্রতি বিষোদগার করতে লাগলো যখন তখন, অথচ কিছুদিন আগেও দু’পক্ষই ছিল ভাই-ভাই। ইস্কান্দার মীজার আমলে আওয়ামী লীগের মন্ত্রীত্ব গ্রহণ এবং পশ্চিমী জোট বাঁধা বৈদেশিক নীতি আঁকড়ে থাকা ওরা সহ্য করতে পারেনি। ওদের মধ্যে আবার আলতাফ আর তার ঘনিষ্ঠরা আরও বেশি উগ্রপন্থী, ওরা একেবারে কট্টর কমুনিস্ট। মামুন লক্ষ করেছেন, এদেশের কমুনিস্টদের প্রধান হাতিয়ার হলো গালাগাল। বিরুদ্ধ পক্ষের লোক হলেই বিনা প্রমাণে তাকে পা-চাটা, সুবিধাবাদী, সি আই-এর দালাল বলতে একটুও মুখে আটকায় না। যে আলতাফ একদিন মামুনকে মাথায় তুলে নাচতেও রাজি ছিল, সে-ই কিনা প্রকাশ্যে তাঁকে বলেছে, লোভী, হারামখোর, গুণ্ডা শেখ মুজিবর রহমানের লেজুড়, আরও কত কী। মামুন দারুণ দুঃখ পেয়েছেন সেসব শুনে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতা পেলেও তিনি কি কখনো মন্ত্রিত্বের উমেদারি করতে গেছেন? তিনি কখনো সরকারি পদ গ্রহণ করে একটা পয়সাও ছুঁয়েছেন? একটা সময় এসেছিল, যখন জেল খাটা চোর-ডাকাতরাও ‘আমি সোহরাওয়ার্দি-হক-মুজিবগো সাথে জেইল খাটছি’ বলে পরিচয় দিয়ে সরকারি পদ পাবার চেষ্টা করতো। মামুন কখনো নিজের কারাবাসের কথা কারুকে জানিয়েছেন?
বাবুল চৌধুরী অবশ্য কখনো ওরকম ভাষা প্রয়োগ করেনি তাঁর প্রতি। ছেলেটি বরাবরই মিতভাষী ও অতিশয় লাজুক ও বিনীত। কিন্তু মামুন জানেন, ও ওর বড় ভাইয়ের চেয়েও বেশি উগ্রপন্থী, চীনের মাও সে তুং-এর ভক্ত। এই সব ছেলেরা ইলেকশানেও বিশ্বাস করে না। এরা চায় সশস্ত্র বিপ্লব। বাবুল গালাগালি করে না বটে, কিন্তু মামুনের সন্দেহ হয়, সব সময়েই ওর কথাবার্তার মধ্যে থাকে কটাক্ষ ও বিদ্রূপ।
পুরোনো কথা ভুলে যাবার চেষ্টা করে মামুন বললেন, তোমার কথা কও, বাবুল। তোমরা কি এখন ঢাকাতেই থাকবে?
বাবুল বললো, ঠিক নাই কিছু। এখন তো কলেজ বন্ধ, তাই চলে আসলাম। মঞ্জুও অনেকদিন বাপের বাড়ি আসে নাই।
–ভালো করেছো। তুমি তো ইচ্ছা করলেই ঢাকায় কাজ পেতে পারো। তুমি পি এইচ ডি-টা করলা না?
–এইবার করে ফেলবো ভাবছি। যদি ঢাকায় থাকি।
মঞ্জু ফিরে এলো এ-ঘরে। হেনার কোলে মঞ্জুর সন্তান। সে বললো, মামুনমামা, তুমি আমার ছেলেকে দেখলে না? বললে না ছেলে কেমন হয়েছে?
মামুন শশব্যস্ত হয়ে শিশুটির দিকে মুখ কঁকিয়ে তার গাল টিপে আদর করে বললেন, কী সুন্দর থোকা হয়েছে। এ যে রাজপুত্তুর। তা তো হবেই, বাপ-মা দু’জনেই এত সুন্দর। কী নাম রেখেছো।
মঞ্জু বললো, কোনো নাম রাখিনি। তুমি তো নাম ঠিক করে দেবে।
বিন্দুমাত্র চিন্তা না করে মামুন সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিলেন, নাম রাখো নজরুল ইসলাম। আমার প্রিয় কবির নামে। আমার ছেলে হলে আমি এই নাম রাখবো ঠিক করে রেখেছিলাম। কিন্তু আল্লাহর রহমতে আমার দুই-দুইটাই মেয়ে। তোমার ছেলের একটা ডাক নামও রাখতে হবে, কবি নজরুলের ডাক নাম শুনেছি দুখু মিঞা, সে নাম রেখো না, ওর নাম রাখে সুখু মিঞা। তোমরা যে-যাই বলো, আমি ওকে সুখু মিঞা বলেই ডাকবো।
মামুনের প্রথম পক্ষের স্ত্রীর একটি পুত্র সন্তান ছিল, বছর তিনেক আগে তার মৃত্যু হয়েছে। সেই ছেলেটিরও ডাক নাম ছিল সুখু।
মঞ্জু তাকালো তার স্বামীর দিকে। বাবুল কৃত্রিম ভদ্রতার সঙ্গে অতিরিক্ত উৎসাহ জুড়ে বললো, বাঃ বাঃ, এ তো অতি চমৎকার নাম। নজরুল ইসলাম আর সুখু! দারুণ! মামুনভাই ছাড়া এত সুন্দর নাম আর কে রাখবে?
মামুন বললেন, একটু দাঁড়াও, এখুনি আসতেছি।
চটি ফটফটিয়ে প্রায় দৌড়েই তিনি চলে গেলেন শয়নকক্ষে। ফিরে এলেন অল্পকালের মধ্যেই। আবার বাচ্চাটিকে আদর করতে করতে বললেন, দেখি দেখিরে সুখু মিঞা। হাতটা দেখি, বাঃ, কী সুন্দর গোলাপি রঙের হাত।
শিশুর রঙীন করতলে তিনি গুঁজে দিলেন একটি মোহর।
মঞ্জু বললেন, একী, ওকে ওটা কী দিলে, মামুনমামা?
মামুন বললেন, বিশেষ কিছু না। একটা মোহর। কলকাতা থাকার সময় আমি দেখেছি দু’এক বাড়িতে, নতুন শিশুকে প্রথম দেখার সময় গুরুজনেরা মোহর দেয়, তা আমার কাছে ছিল একটা
মঞ্জু বললো, না না, ওকে ওটা দিও না।
বাবুল বললো, আপনি মোহর দিলেন? ওর যে অনেক দাম।
মামুন ঈষৎ আহতভাবে বললেন, তুমি দামের কথা বলো না। আমার দিতে ইচ্ছা হলো–ছিল বাড়িতে একটা–মঞ্জুর সন্তান-সে যে আমার বুকের মণি…।
মঞ্জু ছোঁ মেরে বাচ্চার হাত থেকে মোহরটা তুলে নিয়ে বললো, আমি সেজন্য বলছি না। ছেলেটা এমন দুষ্টু হয়েছে হাতের কাছে যা পায় তাই-ই মুখে পুরে দেয়।
মামুন হাসতে হাসতে বললেন, যদি ও মোহর খেয়ে ফেলে, তাহলে বুঝতে হবে এই সুখু মিঞা একদিন পাকিস্তানের বাদশা হবে। থুড়ি এ যুগে তো বাদশা হয় না, মিলিটারি ডিকটেটর। হাঃ হাঃ হাঃ!
বাবুল তার স্ত্রীর হাত থেকে মোহরটি নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে পরীক্ষা করে দেখে বললে, আকব্বরী মোহর। এখন এটা এদেশে তো পাওয়াই যায় না। পূর্ব পাকিস্তানে যে কটা বা ছিল সবই পশ্চিমে চলে গেছে।
এই সময় ফিরোজা এসে ঢুকলেন হাতে একটি ট্রে নিয়ে। তিনি যে শুধু স্নান করে সেজেগুঁজে এসেছেন তাই-ই নয়, এর মধ্যেই বাড়ির নফরকে দোকানে পাঠিয়ে পাঁচ রকম মিষ্টি আনিয়েছেন। স্ত্রীকে দেখে মামুন মনে মনে প্রার্থনা করলেন, মোহর প্রসঙ্গটি যেন থেমে যায়।
ফিরোজা বেগমের ব্যক্তিত্বটি এমনই প্রবল যে তিনি যেখানেই থাকেন সেখানেই দৃশ্যের কেন্দ্রস্থলে তাঁর অবস্থান। তিনিই মূল কথাবাতার ধারা পরিচালনা করেন। ওদের তিনি জোর করে করে মিষ্টি খাওয়াতে লাগলেন, বাবুল মিষ্টি তেমন পছন্দ করে না, কিন্তু তার কোনো আপত্তি গ্রাহ্য হলো না, পাঁচ রকমের পাঁচটি সন্দেশ গলাধঃকরণ করতে হলো তাকে।
মঞ্জুকে তিনি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করতে লাগলেন তার সংসারের কথা, স্বরূপ নগরের বাড়িতে কখানা ঘর, কে রান্না করে, কলের পানি না পুকুরের পানি, মশা আছে কিনা। সেই সঙ্গে উপদেশ দিতে লাগলেন সন্তান পালন বিষয়ে।
মামুন চুপ করে রইলেন, এই সব কেজো কথা শুনতে তাঁর ভালো লাগে না। মাঝে মাঝেই তিনি দেখছেন মঞ্জুর মুখোনি, কিন্তু মঞ্জু তাঁর চোখে চোখ ফেলছে না। কতদিন মঞ্জুর গান শোনা হয়নি। মেয়েটা কি গানের চর্চা রেখেছে, না বিয়ের পর সব ভুলে গেছে? এখন মঞ্জুকে গান গাইতে অনুরোধ করা যাবে না, কারণ ফিরোজা গান-টান পছন্দ করেন না একেবারেই।
মঞ্জু কত দূরে সরে গেছে। আগে সে মামুনের কাছে কতরকম আবদার করতো, মামুনের অগোছালোপনা দেখে শাসন করতো, মামুন রাত করে বাড়ি ফিরলে জেগে বসে থাকতো সে। আর এখন এক মাসের ওপর ঢাকায় থেকেও সে মামুনের সঙ্গে দেখা করার জন্য ছুটে আসেনি। আজ এসেও সে মামুনের সঙ্গে ভালো করে কথা বলেনি, নিজের ছেলের বিষয়েই গল্প করে যাচ্ছে। বিয়ের পর মেয়েরা এই রকম হয়ে যায়?
মঞ্জ চলে যাবার পর মামুন আর একটাও কবিতা লেখেননি। কবিতাও তাঁকে ছেড়ে গেছে।
অথচ মামুন নিজেই তো উদ্যোগ করে মঞ্জুর বিয়ে দিয়েছিলেন। কলকাতার দুটি ছেলে এসে মঞ্জুর চিত্তচাঞ্চল্য ঘটাবার পর তার শিগগিরই একটা বিয়ে দেওয়া খুব জরুরি হয়ে পড়েছিল। মামুনই তাঁর আপা-দুলাভাইয়ের কাছে বাবুল চৌধুরীর নাম প্রস্তাব করেছেন, বাবুলের কতরকম গুণপনার বর্ণনা করেছেন। বাবুলের পরীক্ষার কারণে বিয়েটা এক বছর পিছিয়ে যায়, তার মধ্যেই ওদের দু’ভাইয়ের সঙ্গে মামুনের অনেকখানি মানসিক ব্যবধান ঘটে গেল। মামুনের জন্যই যে বাবুল চৌধুরী এমন একটি হীরের টুকরোর মতন মেয়েকে বউ হিসেবে পেয়েছে, সেকি তার জন্য মামুনের কাছে কৃতজ্ঞতা বোধ করে?
মামুন আড়চোখে বাবুলের দিকে তাকালেন। বাবুলও মেয়েদের কথাবার্তায় যোগ দেয়নি, তার ঠোঁটে একটা পাতলা হাসি লেগেই রয়েছে। এই ছেলের মনের মধ্যে কী যে চলে তা বোঝা শক্ত।
হঠাৎ মামুন উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, তোমরা গল্প করো, আমাকে একটু কাজে যেতে হবে।
বাবুলও সঙ্গে সঙ্গে বললো, আমরাও যাবো।
মঞ্জুর ছেলে তার মায়ের বুকের কাছে কোমল দুটি হাত ছুঁড়তে ছুঁড়তে খুঁ হুঁ শব্দ করছে, অর্থাৎ তার খিদে পেয়েছে। মঞ্জু খাটটার ওপর বসে পেছন ফিরে তাকে স্তন্য পান করাতে গেল। ফিরোজা হা-হা করে উঠে বললেন, ভিতরে যাও না, ভিতরে যাও।
মামুনের আর কিছুই ভালো লাগছে না। তাঁর বুকের মধ্যে একটা অজ্ঞাত ব্যথা। তিনি বাবুলের দিকে তাকিয়ে শুকনো গলায় বললেন, তোমরা আর একটু থাকো, আমাকে যেতেই হবে। একজনের সাথে দেখা করার কথা।
তারপর মঞ্জুর উদ্দেশ্যে গলা চড়িয়ে বললেন, তোমরা আবার এসো, মঞ্জু। কেমন? আমি গেলাম।
বাইরে বেরিয়ে এসে মামুন একটা সিগারেট ধরালেন। ফিরোজা সিগারেটের গন্ধ সহ্য করতে পারেন না বলে বাড়ির মধ্যে তাঁর সিগারেট খাওয়াই হয় না। অশান্তি এড়াবার জন্য তিনি ফিরোজার অনেক বিধিনিষেধই মেনে চলেন।
তবে কি সিগারেটের নেশাই তাঁকে বাইরে টেনে আনলো। এতদিন পর মঞ্জুর সঙ্গে দেখা তবু তিনি শেষ পর্যন্ত মঞ্জুর সঙ্গে রইলেন না। আর একটু অপেক্ষা করে তিনি ওদের সঙ্গে একসঙ্গে বেরুতে পারতেন, সেটাই ভালো দেখাতো। একথা অবশ্য ঠিক যে আবুল মনসুরের বাড়িতে তাঁর একটা মিটিং-এ যোগ দেওয়ার কথা আছে, কিন্তু সেটাও এমন কিছু জরুরি নয়, এক-আধ ঘণ্টা পরে গেলেও ক্ষতি ছিল না। কিন্তু কেন যেন বাবুল আর মঞ্জুর সঙ্গে এক সঙ্গে রাস্তা দিয়ে হাঁটার সম্ভাবনাটা তাঁর মনঃপূত নয়, তাই তিনি আগে বেরিয়ে এলেন।
মিটিং-এ যেতেও তাঁর ইচ্ছে হলো না। রাজনীতির কচকচি আজ সন্ধেবেলা আর ভালো লাগবে না। তাহলে কোথায় যাওয়া যায়? সংবাদপত্রে জনপ্রিয় কলামনিস্ট হয়েও মামুন কোনো কাগজে চাকরি নেননি। জীবিকার তাড়না তাঁর খুব একটা নেই, দেশের জমিজমা থেকে যা আয় আছে তাতেই অনেকটা চলে যায়। কেউ কেউ তাঁকে ওকালতি শুরু করার পরামর্শ দিয়েছিল। তাঁর একটা আইনের ডিগ্রি আছে। তাঁর ছাত্র বয়েসে কলকাতায় যারাই বি এ পাস করতো, তারা অনেকেই সঙ্গে একটা লডিগ্রি করে রাখতো। ল’ কলেজে হাজিরা দেবার বাঁধাবাঁধি ছিল না, পাস করাও ছিল সহজ। ঢাকায় মামুনের বন্ধুদের মধ্যে যারা আওয়ামি লীগ সরকারে মন্ত্রীটন্ত্রী হয়েছিল, রাজনীতি ঘুচে যাওয়ার পর তারা সবাই এখন চুটিয়ে ওকালতি করছে। বাংলায় কথাই আছে, যার নাই কোনো গতি, সেই করে ওকালতি। মামুন ওদিকে যাননি।
উকিলরা আদালতের চেয়ে বাড়িতেই বেশি ব্যস্ত থাকে, বিশেষত এই রকম সন্ধের সময়। তখন সব মক্কেলরা আসে। হঠাৎ করে এই সময়ে কোনো উকিল বন্ধুর বাড়িতে গেলে সে অস্বস্তিবোধ করবে! মামুন ভেবে দেখলেন, কবি জসীমউদ্দীনের বাড়িতে যাওয়া যেতে পারে, সেখানে প্রায় দিনই এই সময়ে আড্ডা জমে।
মামুন হাঁটতে লাগলেন জসীমউদ্দীনের বাড়ি ‘পলাশ বাড়ির দিকে। আগের তুলনায় ঢাকায় দোকান পাটের সংখ্যা অনেক বেড়েছে, রাস্তায় ঝলমলে আলো। হাঁটতে বেশ ভালোই লাগে।
কমলাপুর পৌঁছোতে বেশি দেরি হলো না। অনেকখানি জমির ওপর কবির বাড়ি। সামনে পেছনে বহু রকমের ফুল ও ফলের গাছ। কবি যেমন প্রকৃতি-পাগল তাঁর স্ত্রীরও সেই রকম গাছপালার খুব শখ। নারায়ণগঞ্জের এক চেনা বাড়ির মেয়ে মণিমালাকে বিয়ে করেছেন জসীমউদ্দীন, সেই বিয়ের সময় থেকেই কবির সঙ্গে মামুনের পরিচয়। নারায়ণগঞ্জের মরগ্যান স্কুলে মামুন পড়িয়েছিলেন কয়েক মাস, মণিমালা ছিল নামকরা সুন্দরী।
পলাশ বাড়ির সামনে এসে মামুন দাঁড়িয়ে পড়লেন। বাড়ির সামনে অনেক গাড়ি, দু’একখানা সরকারি বড়কর্তাদের গাড়ি বলে মনে হলো। এখানে আজ কোনো দাওয়াত উৎসব আছে নাকি? বিনা নিমন্ত্রণে যাওয়া তবে ঠিক হবে না। কিংবা সরকারের কোনো হোমরা-চোমরা দেখা করতে এসেছে। আশ্চর্য কিছু নয়। শোনা যায় স্বয়ং আইয়ুব খাঁও নাকি কবির খোঁজখবর নেন।
তা হলে থাক! মামুন পেছন ফিরে হাঁটতে শুরু করলেন আবার।
এই সন্ধ্যেবেলা তাঁর কোথাও যাবার জায়গা নেই। এটা যেন এক সমৃদ্ধ নগর নয়, তেপান্তরের মাঠ, মামুন কোনো দিক খুঁজে পাচ্ছেন না। এতদিন পর অকস্মাৎ মঞ্জুকে দেখেই কি তাঁর এই দিশাহারা অবস্থা হলো? অনির্দিষ্ট ভাবে হাঁটতে হাঁটতে মামুন নিজেকে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করলেন। তাঁর দিদির মেয়ে মঞ্জু তাঁর অতি স্নেহের, অতি আদরের, সে যথোপযুক্ত স্বামী পেয়েছে, একটি স্বাস্থ্যবান পুত্রের জননী হয়েছে, এসব দেখে মামুনের তো খুবই আনন্দিত হবার কথা। কিন্তু আজ মঞ্জুকে দেখার পরেই তাঁর বুকে যে কম্পন শুরু হয়েছে, তা শুধু সেই ধরনের আনন্দ নয়, অন্য কিছু। নিজের ওপরেই রাগ করলেন মামুন। না, না, এটা ঠিক নয়, এটা স্বাভাবিক নয়। এখন কোনো আড্ডায় গিয়ে তর্কাতর্কিতে মেতে উঠতে পারলে এই চিন্তা মুছে যাবে। কিন্তু কোথায় যাবেন তিনি? আর কোনো প্রিয়জনের নাম মনে পড়ে না। মঞ্জুর মুখোনি দেখার আরও কিছুক্ষণ সুযোগ ছিল, তবু তিনি শুধু শুধু বেরিয়ে এলেন কেন?