পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ এলাকা ছাড়িয়ে অনেক দূরের শূন্যে, মহাকাশ যান জেমিনি ৭ নম্বরে চমৎকার ঘুম হয়েছে জেমস লোভেলের। চোখ মেলে একটা তৃপ্তির নিশ্বাস ফেলে সে অদূরে তার সঙ্গীকে দেখতে পেল। বন্ধ বাতাসে ভাসছে বিটোফেনের নবম সিমফনির সুর। যদিও বাইরের আকাশ দেখা যাচ্ছে না, তবু সেই সুরের মূর্ধনায় লোভেলের মনে হল এখন সব কিছুই গাঢ় নীল। কনুইয়ে ভর দিয়ে উঠে সে বলল, গুড মর্নিং, ফ্র্যাঙ্কি!
ফ্র্যাঙ্ক বোরম্যান একটি দূর-নিরীক্ষণ যন্ত্রে চোখ দিয়ে বসেছিল এবং রেকর্ডের সঙ্গীতের সঙ্গে সুর মিলিয়ে শিস দিচ্ছিল। মুখ তুলে সে বলল, এটা কি সকাল না সন্ধ্যা?
দু’জনেই হেসে উঠলো এক সঙ্গে। সত্যিই তো, এই মহাশূন্যে সকাল নেই, সন্ধ্যা নেই, দিন নেই, রাত্রি নেই, পূর্ব-পশ্চিম-উত্তর-দক্ষিণ নেই। স্বদেশ-বিদেশ নেই, এমনকি আবহাওয়া পর্যন্ত নেই। সীমাবদ্ধ মানুষের কল্পনায় এরকম অনেক কিছু না থাকলেও এখানে যেন আরও অনেক কিছু আছে।
ফ্লাস্ক থেকে একটি কাপে খানিকটা কফি ঢেলে লোভেলের দিকে এগিয়ে দিয়ে বোরম্যান বলল, চটপট তৈরি হয়ে নাও জিমি, আর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই জেমিনি ৬-এর সঙ্গে আমাদের দেখা হবে। আমরা খুব সম্ভবত একটি ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী হতে যাচ্ছি। এই নিবাত, নিষ্কম্প শূন্যমণ্ডলে দুটি মহাকাশ যানের মিলন যদি সম্ভব হয়, অর্থাৎ রান্দেভু ও ডকিং নিখুঁত হয়, তবে চাঁদে নামবার পথে আমাদের আর কোনো বাধাই থাকবে না। এরপর খুব শিগগিরই মানুষ একদিন চাঁদে পা দেবে!
ভালো করে উঠে বসে লোভেল বলল, যদি বলছো কেন, সম্ভব হবেই।
এই সময় পৃথিবী থেকে বার্তা আসতেই বোরম্যান বাজনাটা থামিয়ে দিল। ঘুমের রেশ তাড়াবার জন্য লোভেল চোখে জল দিয়ে দাঁতটা মেজে নিল দ্রুত, তারপর দু’জনেই কাজে লেগে গেল এক সঙ্গে।
লোভেল-এর চোখে ভেসে উঠলো পৃথিবীর ছবি। চার শো কোটি মানুষ অধুষিত পৃথিবীর এই রূপ এ পর্যন্ত দেখেছে মাত্র অঙ্গুলিমেয় কয়েকজন। সবুজ হাল্কা ঘেরা একটি পরিপূর্ণ গোলক, যেখানে মরুভূমি নেই, সমুদ্র নেই, নগর কারখানা নেই। মানুষের চিহ্নমাত্র নেই, তবু সেই গোলকটিকে প্রকৃতির একটা খেলনা মনে হয় না। মনে হয় অতিমাত্রায় জীবন্ত, সেখান থেকে বিচ্ছুরিত হচ্ছে স্নেহ-প্রেম-ভালোবাসা। মাধ্যাকর্ষণ ছাড়িয়ে এলেও লোভেল ও বোরম্যান সেই সুদূর, সবুজাভ পৃথিবীর দিকে যতবার তাকিয়েছে, তারা অনুভব করেছে বুকের মধ্যে প্রবল এক হ্যাঁচকা টান।
কমপিউটারের দিকে চোখ রেখে লোভেল বললো, ফ্র্যাঙ্কি,তুমি ওয়েনডেল উইকির লেখা ‘ওয়ান ওয়ার্লর্ড’ নামের লেখাটি পড়েছ? এখানে এসে আমার বারবার মনে হচ্ছে, আমাদের পৃথিবীটায় যদি একটাই মানুষ জাতি থাকতো, যদি এই পৃথিবীতে সব মানুষের সমান অধিকার থাকতো! তা নয়, ভাষা, ধর্ম, গায়ের রঙের ভেদাভেদে আমরা পরস্পর মারামারি করে মরছি। এই সুন্দর পৃথিবীটি কেন হিংসায় ভরা?
বোরম্যান গম্ভীরভাবে বলল, এক সময়ে তো সব সমানই ছিল। মানুষ বিচ্ছিন্ন হয়েছে। নিজের দোষে। তুমি ওল্ড টেস্টামেন্টের জেনেসিস অধ্যায়ের দশ ও এগারো নং চ্যাপ্টার পড়নি?
লোভেল বলল, আমাদের পরিবার তোমাদের মতন চার্চ গোয়িং নয়, আমি ইস্কুলে শিশুপাঠ্য বাইবেল ছাড়া আর বিশেষ কিছু পড়িনি। কী আছে জেনেসিস অধ্যায়ে? ৫৬৪
–তুমি টাওয়ার অফ ব্যাবেলের কথা জানো না?
–নামটা শুনেছি তো বটেই, অনেক লেখাতে উল্লেখও দেখেছি, কিন্তু ব্যাপারটা ঠিক কী তা। আমার জানা নেই।
–তবে সংক্ষেপে বলি শোনো। মানবজাতির আদি ভাষা ছিল হিব্রু…
লোভেল হা হা করে হেসে উঠল। তারপর দ্বিতীয় কাপ কফিতে একটা চুমুক লাগিয়ে বলল, তুমি এই গাঁজাখুরি কথাটায় বিশ্বাস কর? মানুষের আদি ভাষা হিব্রু? আমার ভাষাতত্ত্বে কোনই জ্ঞান নেই, তবু আমি এইটুকু অন্তত জানি যে প্রাচ্য দেশগুলিতে এর চেয়ে অনেক প্রাচীনতর ভাষার সন্ধান পাওয়া গেছে।
বোরম্যান শান্ত কণ্ঠে বলল, আমার বিশ্বাস-অবিশ্বাসের প্রশ্ন নয়। তুমি জেনেসিস অধ্যায়ের কাহিনীটা শুনতে চেয়েছো, সেটাই বলছিলুম। কোনো একটা সময়ে নিশ্চয়ই মানুষের একটাই ভাষা ছিল। জুডাইয়ো-খ্রীষ্টান ট্র্যাডিশনে মনে করা হয় সেই ভাষাটাই হিব্রু। নোয়ার বংশধররা ছিল হিব্রুভাষী, তারা প্রাচ্য দেশ ছেড়ে পশ্চিমে গিয়ে শিনার বা ব্যাবিলোনিয়ায় উপস্থিত হয়, সেখানে ব্যাবেল নামে একটি শহর নির্মাণ করে। পরবর্তীকালে সেই শহরেরই নাম হয় ব্যাবিলন। এই ব্যাবেল-এর রাজার নাম নিমরড, সে হচ্ছে নোয়ার দৌহিত্রের দৌহিত্র। এই নিমরড উত্তরাধিকারীসূত্রে এক জোড়া চামড়ার পোশাক পেয়েছিল, কোন পোশাক জানো? স্বয়ং ঈশ্বর অ্যাডাম ও ইভের জন্য যে পোশাক বানিয়েছিলেন, এই সেই পোশাক এবং এই পোশাক পরিধান করে নিমরড হয়ে উঠেছিল মহা শক্তিশালী বীর ও শিকারী। দুর্দান্ত অহংকারীও হয়ে উঠেছিল সে এবং ঈশ্বরের সঙ্গে পর্যন্ত স্পর্ধা করতে শুরু করল…জিমি, তোমার সামনের তিন নম্বর কমপিউটারে একটা সবুজ আলো জ্বলে উঠলো, কী বলছে দ্যাখো তো!
লোভেল সে যন্ত্রের গণনা পাঠ করে বলল, আমাদের তৈরি থাকতে বলছে। রান্দেভুর আর সত্তর মিনিট দশ সেকেণ্ড দেরি আছে। ফ্র্যাঙ্কি, তুমি নিমরডের গল্পটা শেষ করো।
বোরম্যান বলল, এই নিমরড এমন একটা গম্বুজ নির্মাণ করবে ঠিক করল, যার চূড়া আকাশ স্পর্শ করবে। সেই গম্বুজে উঠে সে স্বর্গ আক্রমণ করবে। তার পূর্ব পুরুষদের বন্যার জলে ডুবিয়ে মারা হয়েছিল বলে সে ঈশ্বরের ওপর প্রতিশোধ নিতে চায়। শেষ পর্যন্ত তৈরি হলো এই গম্বুজ, যা সত্তর মাইল উঁচু।
–সত্তর মাইল উঁচুতেই স্বর্গ?
–তখনকার কল্পনার পক্ষে আকাশের দিকে সত্তর মাইল উচ্চতা নিশ্চিত অনেকখানি! এই বিশাল গম্বুজের পূর্ব দিকে একটা সিঁড়ি, যেটি আরোহণের জন্য, আর পশ্চিম দিকে অবতরণের জন্য আর একটি সিঁড়ি। অর্থাৎ পৃথিবী থেকে দেখা সূর্যের উদয় অস্তের মতনই এই পূর্ব-পশ্চিমের সিঁড়ি দুটি। সমস্ত কর্মীরা অভিন্নমত হয়ে, মিলেমিশে সুশৃঙ্খলভাবে তৈরি করল এই প্রকাণ্ড ব্যাপারটি। এই স্তম্ভই টাওয়ার অফ ব্যাবেল নামে পরিচিত।
–এই নামটার সঙ্গে মানুষের নানান ভাষার কচমচির কী একটা যেন সম্পর্ক আছে না?
–হ্যাঁ, এবারে সেটাই বলছি। এক রাত্তিরে স্বয়ং ঈশ্বর সেই স্তম্ভ ও নগরীটি দেখতে এলেন। তাঁর সিংহাসনের চার পাশ ঘিরে আছে সত্তরটি দেবদূত। ঈশ্বর মানুষের সেই সদর্প কীর্তি অবলোকন করে বললেন, দ্যাখো কাণ্ড! এই মানুষেরা একই জাতি এবং একটাই ওদের ভাষা, ওরা ভবিষ্যতে কী যে করতে পারে, এটা সবে মাত্র তার শুরু।.এবং ওরা যা করতে চাইবে তা কিছুই আর অসম্ভব থাকবে না। তখন তিনি মানুষের ভাষার মধ্যে ধন্দ ঢুকিয়ে দিলেন, পরস্পরকে আর তারা বুঝতে পারলো না, তারপর তারা নিজেদের মধ্যে মারামারি শুরু করে দিল। গণ্ডগোলটা কী রকম হলো জানো? গম্বুজের কারিগরদের একজন হয়তো তার সহকারির কাছে একটা হামানদিস্তা চাইলো, সে ভাষা বুঝতে না পেরে এনে দিল ইট, বারবার এরকম ঘটতে থাকায় একজন আর একজনের মাথায় হঁট ছুঁড়ে মারল। কিছুদিন মারামারি করার পর সেই মানুষেরা ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে বিভিন্ন ভাষা নিয়ে ছড়িয়ে পড়লো সারা পৃথিবীতে। ভাষা নিয়ে সেই ঝগড়া এখনো চলছে।
–কিন্তু এই কাহিনীতে তো দেখা যাচ্ছে মানুষের কোনও দোষ নেই, ঈশ্বরই তাদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করেছেন। অথচ মানুষ জাতি এই তথাকথিত ঈশ্বরের সন্তান।
–মানুষ স্বর্গ দখলের স্পর্ধা দেখালে ঈশ্বর রাগ করবেন না? তা ছাড়া মানুষের ঐ একতা দেখে ঈশ্বরের নিশ্চয়ই ঈর্ষা হয়েছিল; একতাবলে মহাশক্তিশালী হলে মানুষ আর ঈশ্বরকে গ্রাহ্য। করবে না। এই জন্যই ওল্ড টেস্টামেন্টের ভগবানকে ঈর্ষাপরায়ণ ঈশ্বর বলা হয়েছে। অবশ্য অন্য কোনো ধর্মের ঈশ্বরকেই আমি কম হিংসুক বলতে পারি না সত্যের খাতিরে। কোনো ঈশ্বরই মনুষ্যজাতির অহিংস একতা চায় না এখনো।
–তাহলে, ফ্র্যাঙ্কি, তোমার কী মনে হয় না, আধুনিক মানুষের চিন্তার জগৎ থেকে এই ঈশ্বর নামের বিদঘুঁটে বিশ্বাসটিকে একেবারে ফিনাইল দিয়ে ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করে ফেলা উচিত? ভগবান নামে এই ভূতটাই তো মানুষের প্রধানতম শত্রু!
–তুমি আমি চাইলেই কি তা মুছে ফেলা সম্ভব! পৃথিবীর সব দেশেই ঈশ্বরের দালালগুলি অতিশয় শক্তিমান। এমন কি যারা ব্যক্তিগত জীবনে ঈশ্বর-টিশ্বরের ধার ধারে না অথচ ক্ষমতার উচ্চ শিখরে বসে আছে, তারাও নিজেদের সুবিধের জন্য নিরীহ জনসাধারণের ওপর ভগবান নামে একটা বিরাট বোঝা চাপিয়ে রাখে। ধর্ম হচ্ছে মাদক ককটেল আর তার মাঝখানের চেরি ফলটি হচ্ছেন ঈশ্বর।
–কিন্তু কমুনিস্টরা তো ঈশ্বরকে মুছে ফেলেছে। এই শতাব্দীতে এটা নিশ্চিত মস্ত বড় একটা ঘটনা…এই রে, আমাদের কথাবার্তা আর্থ সেন্টার শুনতে পাচ্ছে না তো?
–না, আমি আগেই প্রধান কমপিউটার রিডিং-এর সঙ্গে আর্থ সেন্টার জুড়ে দিয়েছি। আমাদের হাতে আর কতটা সময় আছে?
–অনেক। কথাবার্তা না বলে চুপ করে বসে থাকলে প্রতিটি মুহূর্তকেই মনে হয় অনন্ত মুহূর্ত। ফ্র্যাঙ্কি, আমার নিজের স্ত্রী-পুত্র-কন্যার কথা তেমন মনে পড়ছে না। গোটা মানবজাতির কথা এক সঙ্গে ভাবছি, যেন দেখতে পাচ্ছি একটিই অর্ধনারীশ্বরকে। এত দূরে এসেছি বলেই কি এরকম মনে হচ্ছে।
–নিশ্চিত তাই, জিমি। তুমি যে বললে, কমুনিস্টরা ঈশ্বরকে মুঝে ফেলেছে, সে সম্পর্কে আমি নিশ্চিত নই। সত্যিই কি মুঝে ফেলেছে? জনসাধারণের মাথার ওপর তারাও কি অন্য কিছু চাপিয়ে দিচ্ছে না? মার্কসইজম তো অবিকল একটি ধর্মেরই মতন, গত শতাব্দীতে উদ্ভূত হলেও এই শতাব্দীতেই প্রত্যক্ষত পরীক্ষিত ধর্ম। এই ধর্মেরও সার কথা, আমার জানা অন্য যে কোনো ধর্মেরই মতন, হয় সবাইকে নিজের দলে টানো, নয় তাদের মারো। সুতরাং মারামারি কাটাকাটি চলতেই থাকবে।
–হয়তো সারা পৃথিবীই কমুনিস্ট হয়ে গেলে মানুষের মধ্যে প্রকৃত শান্তি আসবে। সেটাই তো কমুনিজমের মূল কথা, তাই না?
–এটা একটা তত্ত্ব মাত্র। যদি শেষ পর্যন্ত তা না হয়? তা হলে তো মারামারি কাটাকাটি চলতেই থাকবে। ক্রিশ্চিয়ানিটিও তো এই একই কথা বলতে চেয়েছিল। সারা পৃথিবী জুড়ে তো ক্রিশ্চিয়ানিটিকে একবারও চান্স দেওয়া হয়নি; সকলেই ক্রিশ্চিয়ান হলে মানুষের মধ্যে সম ভ্রাতৃত্ববোধ আসতেও পারতো হয়তো।
–ক্রিশ্চিয়ানরা নিজেদের মধেই তো মারামারি করেছে?
–কম্যুনিস্টরা এর মধ্যেই বুঝি নিজেদের মধ্যে মারামারি শুরু করেনি? পৃথিবীতে এখন যে কটা কম্যুনিস্ট দেশ তাদের মধ্যে মতের মিল আছে? হাঙ্গেরিতে সোভিয়েট ট্যাঙ্ক নেমেছিল, চীন ও সোভিয়েট দেশের মধ্যে এখন মুখ দেখাদেখি বন্ধ। তুমি জানো কি, রুমানিয়ান ও হাঙ্গেরিয়ানরা পরস্পরকে সহ্য করতে পারে না? আমার এক বন্ধু চেকোশ্লোভাকিয়ায় গিয়েছিল, সেখানে সে দেখেছে, একটা মদের পার্টিতে হঠাৎ দু’দলে বেঁধে গেল প্রচণ্ড ঝগড়া। এই দুটো দল কাদের জানো? একদিকে চেক অন্য দিকে শ্লাভেরা, একই দেশের মানুষ এবং মার্কসইজুমে দীক্ষিত হয়েও এদের মধ্যে পুরোনো জাতিগত রেশারেশি রয়ে গেছে। পেটে একটু মদ পড়লেই তা বেরিয়ে পড়ে। এ যেন ওল্ড টেস্টামেন্টের সেই ঈশ্বরের অভিশাপের মতন, মানুষে মানুষে রেশারেশি থাকবেই, এমন কি সাম্যের বাণীও তা ঘোচাতে পারছে না।
–কিন্তু তোমার ঐ ওল্ড টেস্টামেন্টের ঈশ্বর তো মানুষে মানুষে ভাষার বিভেদ ও সেই কারণে জাতিগত বিভেদ সৃষ্টি করেছিলেন। কিন্তু যেখানে সেই বিভেদ নেই, যেমন ধরো পূর্ব ও পশ্চিম জামানি, একই ভাষা, একই সংস্কৃতি, অথচ মাঝখানে কী গভীর ক্ষত সৃষ্টি হয়ে গেল!
–তার কারণ ভাষা ও সংস্কৃতির চেয়েও ধর্ম অনেক বড় হয়ে ওঠে। আগেকার ইণ্ডিয়া ভেঙে ভারত ও পাকিস্তান হয়ে গেল যে কারণে। জার্মানিতেও ক্যাপিটালিজম ও কমিউনিজম নামে এ যুগের সব চেয়ে দুটি প্রবল ধর্মের সংঘাত, তার ফলে ঐ মাঝখানের দেওয়াল।
–কিন্তু, ফ্র্যাঙ্কি, পূর্ব জার্মানদের কি সোভিয়েটরা জোর করে তাঁবে রেখেছে বলতে চাও? তারা অন্য অংশের সঙ্গে মিলন চায় না? জামান জাত কি এত কাপুরুষ? দু’চারটে লোক পাঁচিল টপকে এদিকে আসার চেষ্টা করে বটে, কিন্তু পূর্ব জার্মানিতে সেরকম কোনো গণ অভ্যুত্থান তো হয়নি!
–পশ্চিম জার্মানির মানুষও কমিউনিজম মেনে নিয়ে অন্য জার্মানির সঙ্গে মিলতে চায় কি তা জানবারও কোনো উপায় নেই। কারণ, ওদিকে যেমন সোভিয়েতরা, এদিকে তেমনি আমরাও ওদের ঘাড়ে চেপে বসে আছি। শোনো জিমি, পূর্ব থাকলে পশ্চিম থাকবেই। সব দেশের মধ্যেই পূর্ব পশ্চিম আছে। আমাদের পৃথিবীটাও পূর্ব পশ্চিমে বিভক্ত, উত্তর দক্ষিণে নয়। এমন কি, ভালো করে ভেবে দ্যাখো, প্রত্যেক মানুষের মধ্যেও একটা করে পূর্ব পশ্চিম আছে। পূর্বের চেয়ে পশ্চিম অনেক বেশী বর্ণাঢ্য, কারণ ধ্বংসের আগে কিংবা অস্তাচলে যাবার আগে আভাটা বেশি হয়। এরপর পৃথিবীতে ফিরে গিয়ে পুবের আকাশ ও পশ্চিমের আকাশের দিকে তাকিয়ে লক্ষ করো। ৩
–ফ্র্যাঙ্কি, তুমি কি নৈরাশ্যবাদী?
–অ্যাঁ? না, না, আমি কখনোই নৈরাশ্যবাদী হতে চাই না। তবে আমি কোন আপ্ত বাক্য অর্থাৎ অন্যের প্রচারিত আদর্শবাদই বিনা যুক্তি-তর্কে গ্রহণ করতে রাজি নই। যাই হোক, জিমি, এখন আমাদের আশাবাদ নিবদ্ধ থাক আমাদের আশু সাফল্যের প্রতি। জেমিনি ৬ আর কত দূর? মানুষে মানুষে যতই বিভেদ থাক, দুই মহাকাশ যানের মিলন সার্থক করতেই হবে।
–আজ আমরা সার্থক হবই। আমি স্বপ্ন দেখেছি, রুশীদের আগে আমরাই চাঁদের মাটিতে পা দিয়েছি।
এবারে বোরম্যান মৃদু হাস্য করে লোভেলের কাঁধ চাপড়ে দিয়ে বলল, এতক্ষণ পরে তোমার ভেতর থেকেও বেরিয়ে এসেছে আসল মানুষটা! কেন জিমি, সোভিয়েট দেশের কেউ আগে চন্দ্র জয় করলে কী ক্ষতি আছে? সেও তো মানুষেরই জয়! তুমি সব মানুষের মিলনের কথা বলছিলে,কমিউনিজমের প্রশংসা করছিলে, তবু তোমার মধ্য থেকে থলে-বন্দী বিড়ালের মতন জাতি-বৈরী বেরিয়ে পড়ল।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে লোভেল বলল, ঠিক বলেছ; আমাদের শিক্ষাদীক্ষার ধরন ও প্রচার যন্ত্রগুলির অনবরত চিৎকারে এরকম একটা ধারণা আমাদের মনের মধ্যে গেঁথে গেছে। আমরা আমেরিকানরা, যে কোনো উপায়ে ছলে বলে কৌশলে সোভিয়েটদের ওপরে থাকতে চাই।
তার জন্য যদি পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যায়, তাতেও যেন কিছু আসে যায় না। দ্যাখো সোভিয়েটরা আর আমরা মহাকাশ অভিযানের প্রতিযোগিতায় নেমেছি। রাশি রাশি অর্থব্যয় হচ্ছে। অথচ দুটি দেশ এক সঙ্গে হাত মিলিয়ে যদি গবেষণা চালাতো, কত অর্থের সাশ্রয় হতো। অগ্রগতি ত্বরান্বিত হত! মনুষ্যজাতিই তো সেই ফল ভোগ করত। কিন্তু তা হবার নয়।
ক্যাপিটালিজম ও কমুইনিজ নামে এ যুগের দুই ধর্মের লড়াই তো পৃথিবীটাকে ধ্বংসের দিকেই নিয়ে যাচ্ছে! এ যুদ্ধের তো কোনো হারজিত নেই। কেন না, এরকম সর্বাত্মক ধ্বংসের অস্ত্র তো মানুষের হাতে আগে আসেনি।
–আশা করি আমাদের জীবকালের মধ্যে সেই মহাপ্রলয় দেখে যেতে হবে না।
–ফ্র্যাঙ্কি, ঈশ্বর নামে সত্যিকারের কেউ যদি থাকবেন, তা হলে এ সময় তিনি হস্তক্ষেপ করে কি মানুষকে বাঁচাতে পারবেন না? তিনি কি মনুষ্যজাতির ধ্বংসই চান? তাহলে তিনি মানুষ সৃষ্টি করেছিলেন কেন?
–এ পৃথিবীতে মানুষের পাপের ভরা পূর্ণ হলে এক সময় তিনি মহাপ্লাবন ঘটিয়েছিলেন, আবার তিনি হয়তো সেই কারণেই মহাপ্রলয় চান!
–ফ্র্যাঙ্কি, তুমি কি ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস করো?
বোরম্যান সহসা সে প্রশ্নের উত্তর দিতে পারল না। একটুক্ষণ মুখ নিচু করে রইলো। তারপর আস্তে আস্তে বলল, আমি ঠিক জানি না। বিজ্ঞানের ছাত্র হিসাবে আমি যুক্তি দিয়ে ঈশ্বরকে খুঁজে পাই না, তবু প্রায়ই এই প্রশ্নটা জাগে, একটা কোনও শক্তি কি নেই, যা এই জগৎ সংসার নিয়ন্ত্রণ করছে? শুধু আহার নিদ্রা মৈথুনের জন্যই কতগুলি বছর এই পৃথিবীতে কাটিয়ে যাওয়া, এটাই যদি শেষ কথা হয়, তাহলে জীবনটা অর্থহীন হয়ে পড়ে না? মানুষ কি কিছুই খুঁজবে না?
-–চেতনার উন্নত স্তরে পৌঁছবার চেষ্টা করে যাওয়াই তো মানুষের জীবনের পরম অনুসন্ধান! আমাদের পূর্বপুরুষদের অভিজ্ঞতাই আমাদের শিক্ষক, তা ছাড়া আর কোনো শিক্ষকের প্রয়োজন আছে কি?
–তুমি ঠিক কী বলতে চাইছো, জিমি, আমি ঠিক বুঝলাম না।
–জীবনের সার্থকতা হল বোধের বিকাশ। যে-কটা দিন বেঁচে গেলাম, জীবনটাকে বুঝে গেলাম। পৃথিবী ছাড়িয়ে এসে, এই দিকহীন মহাশূন্যে এসে বারবার টের পাচ্ছি, আমি নামে এই মানুষটা কত সামান্য, অণু-পরমাণুর চেয়েও ক্ষুদ্র, এই বিরাট বিশ্ব-সংসারে আমার যেন কোনো ভূমিকাই থাকতে পারে না। আবার সঙ্গে সঙ্গেই একথা মনে হয়, স্নেহ-প্রেম-মমতায় আমার যে জীবন, তাও তো কম বিশাল নয়, মহাকালের একটা অংশ আমি বহন করছি, আমার এই মগজে আমি এই নিখিল বিশ্বকে ধরে রাখতে পারি, আমার চেতনা এই আকাশের মতন পরিব্যাপ্ত। মানুষের এই বোধই তার জীবনটাকে সম্মানিত করতে পারে।
ফ্র্যাঙ্ক বোরম্যান উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আর বেশি দেরি নেই। সেই চরম মুহূর্ত আগতপ্রায়। কী সুন্দর, শুদ্ধ, পবিত্র এই মহাশূন্য। জিমি, ডকিং-এর সময় জেমিনি ৬-এর সঙ্গে সমান্তরাল হতে যদি আমাদের এক মাইক্রো মিলিমিটার ব্যবধান ঘটে, তা হলে এক প্রচণ্ড সংঘর্ষে আমরা টুকরো টুকরো হয়ে হারিয়ে যাবো। আমাদের আর কোনো চিহ্নও থাকবে না।
–তেমন যদি হয়ও, তা হলেও কি কিছু থাকবে না? ধ্বংস হয়ে গেলেও কী জীবন একেবারে হারিয়ে যায়?
–যায় না?
–ফ্রাঙ্কি, ফ্র্যাঙ্কি আমরা এখানে কী করছি? কেন আমরা এখানে এসেছি? কি হবে এই মহাকাশযান প্রতিযোগিতায়? চাঁদে নেমেই বা আমাদের লাভ কী হবে? মনুষ্য জাতি এর থেকে কী পাবে?
–এসব প্রশ্ন তুলে লাভ নেই, জিমি, সামনে এগিয়ে যাওয়াই আমাদের নিয়তি। মানুষের জীবনে এটাই তো একটা প্রধান ট্র্যাজিডি যে তাকে এগিয়ে যেতেই হবে, থেমে থাকার কোনো উপায় নেই। মহাকাল যেমন গত শতাব্দীতে থেমে থাকেনি, মানুষের জীবন যেমন যৌবনে থেমে থাকতে পারে না, বিজ্ঞান যেমন কখনো বলতে পারবে না, যথেষ্ট হয়েছে, আর চাই না, অস্ত্র প্রতিযোগিতা যেমন কোথাও শেষ হবে না, স্প্যানিশ জাহাজে চেপে কলম্বাস যেমন প্রথম দ্বীপটিতে পৌঁছেই বলতে পারেননি, আর যেতে চাই নাঃ…প্রবল এক অতৃপ্তি মানুষকে সব সময় ঘুরিয়ে মারে, এই অতৃপ্তি থেকেই যত সব উচ্চাকাঙ্ক্ষার জন্ম, হিংসারও জন্ম! এর পর যখন মহাকাশে পাশাপাশি দুটি মার্কিন ও সোভিয়েত মহাকাশ যান যাবে, আমরা অস্ত্র নিয়ে তৈরি থাকবো, আর একজন যাতে আগে যেতে না পারে, সেইজন্যে তাকে ধ্বংস করতে চাইবো, এমনকি এখন থেকেই অঙ্ক কষে অস্ত্র ছুঁড়ে পৃথিবীর বিশেষ বিশেষ দেশকে ঘায়েল করতে সুযোগও হারাব না!
–এটা যে মনুষ্যজাতির আত্মধ্বংস, তা তো একটা শিশুও বোঝে।
–অনেকেই বোঝে। যে বৈজ্ঞানিক অস্ত্র বানাচ্ছেন, তিনি বোঝেন না? অন্যকে মারতে গেলে নিজের মৃত্যুরও যে ডেকে আনার সম্ভাবনা থাকে, তা কে না বোঝে? তবু যেন কোনো উপায় নেই, মনুষ্যজাতির ইতিহাসের কোনো একটা বিশেষ অংশে দু’দণ্ড থেমে জিরিয়ে নেবার উপায় নেই। জন্ম থেকেই মানুষ একটা গড়ানে পাথরের ওপর চেপে বসে।
–ফ্র্যাঙ্কি, যদি আর একটু পরেই আমরা শেষ হয়ে যাই, তার আগে আবার পৃথিবীকে দেখে যেতে ইচ্ছে করছে। একবার দেখাও।
–এখন আমাদের চোখে আমাদের হাসি-কান্নার পৃথিবীটা আকাশের যে-কোনো গ্রহ তারকারই মতন। চোখ দিয়ে কিছুই দেখতে পাবো না। এসো আমরা কল্পনায় দেখি।
রকেটের পোর্ট হোল দিয়ে দু জোড়া ব্যাকুল চক্ষু চেয়ে রইলো বাইরে।
এই সময় পৃথিবীতে যথা নিয়মে প্রেম ও প্রতারণা, সেবা ও স্বার্থপরতা, আদর্শবাদ ও ভণ্ডামি, শান্তির বাণী ও যুদ্ধ, ক্ষুধা ও বিলাসী অপচয় সব কিছুই চলছে ঠিকঠাক। এরই মধ্যে একটি অতি ছোট্ট দৃশ্য এইরকম :
হরিদাসপুর পেট্রাপোল সীমান্তের দু’পাশে রক্ষীবাহিনী, কয়েকদিন আগেও তারা পরস্পরের দিকে রক্তচক্ষুতে তাকিয়ে অস্ত্র উঁচিয়ে ধরেছিল, আজ তারা অস্ত্র নামিয়ে রেখেছে পাশে। দু’দিকের রক্ষীবাহিনীর পিছনে যে সমস্ত মানুষ তাদের ভাষার বিভেদ নেই, সংস্কৃতির ঐক্য রয়েছে তবু তাদের মাঝখানে কঠোর সীমারেখা, তারা এখন দুই শত্রু দেশের নাগরিক। তারা ধর্মে কেউ হিন্দু, কেউ মুসলমান। অধিকাংশ হিন্দুই জানে না, তাদের ধর্মটা প্রকৃত পক্ষে ঠিক কী। বাপ-ঠাকুদার কাছ থেকে গালগল্প শুনেছে মাত্র অথবা কিছু অশিক্ষিত পুরুত পাণ্ডা যা খুশী বানিয়ে বলেছে; একটা অক্ষর সংস্কৃত ভাষা বোঝে না, তারা তবু ভুলভাল সংস্কৃত বচন শুনলে ভক্তিতে মাথা নোয়ায়। যারা মুসলমান তারাও অধিকাংশই কিছু জানে না ইসলামের মূলতত্ত্ব, মোল্লা ও হঠাৎ নেতারা যা শোনায় তাই-ই মাথা নিচু করে মেনে নেয়। সাকার-নিরাকারের দ্বন্দ্বে তাদের ভাত-কাপড়ের কী আসে যায় তা ভাবতে শেখেনি, এক বর্ণ বোঝে না আরবী ভাষা তবু আউড়ে যেতে হয়। এই দুই জাতির অন্তরে অন্তরে কোনো শত্রুতা নেই তবু একটা পারম্পরিক ঘৃণা ও অবিশ্বাসের ভাব জাগিয়ে তোলা হয়েছে।
যুদ্ধ বিরতির পর সম্প্রতি সীমান্ত একটু নরম হয়েছে, যেন সামান্য একটু ফাঁক করা হয়েছে দরজা। বন্দী ও অন্তরীণ মানুষদের বিনিময় চলছে। শুধু পশ্চিমবঙ্গেই ৩৮৫৩ জনকে যুদ্ধের দরুন আটকে রাখা হয়েছিল পাকিস্তানী নাগরিক বলে, পূর্ব পাকিস্তানে এই সংখ্যাটি হাজার পাঁচেক। মাত্র আঠারো বছর আগেই এরা ছিল একই দেশের নাগরিক, এখন এরা এসেছিল আত্মীয়-বন্ধুদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে, কেউ বা নিজের জন্মস্থান দেখতে, কেউ এনেছিল ওপার থেকে পাটালি গুড়,কেউ এপার থেকে নিয়ে গিয়েছিল স্পঞ্জ রসগোল্লা, এরা বন্দী হয়েছিল দিল্লি ও করাচীর কয়েকজন মাত্র মানুষের জেদাজেদিতে।
বন্দী বিনিময় চলছে গুণে গুণে, সুশৃঙ্খলভাবে। আশ্চর্য ব্যাপার, ছাড়া পেয়েও উৎফুল্ল হবার বদলে কেউ কেউ কাঁদছে, এদিকের মাটি ছেড়ে ওদিকে যেতে তাদের পদক্ষেপ দ্রুত হচ্ছে না। পশ্চিম সীমান্ত থেকে একটি ক্রন্দনরত পরিবার ওদিকে খানিকটা এগিয়ে যাবার পর হঠাৎ একজন রেডক্রশ কর্মী, সদ্য তরুণ সে, ছুটে গিয়ে সেই পরিবারের একজনের হাতে একটি ফুলের মালা দিয়ে বললো, আবার আসবেন!
তা দেখে পূর্ব দিকের একজন রক্ষী সেদিকের একজন ক্রন্দনরত মহিলার দিকে তাকিয়ে বললো, ঠিক আছে, আপনের পোটলাটা নিয়া যান। আর কাইন্দেন না, সময় ভালো হইলে আবার আসবেন!