কেমিস্ট্রিতে ফার্স্ট ক্লাস পেয়েছে বারো জন, সেই তালিকায় অতীন মজুমদারের নাম সবার শেষে। এতে তার বন্ধুবান্ধব ও পরিচিতদের মধ্যে দুরকম প্রতিক্রিয়া হলো। কোনোক্রমে হলেও সে যে একটা ফাস্ট ক্লাস পেয়ে গেছে তাতেই অনেকে অবাক। কুলেজে সে প্রায়ই ডুব দিত, তার স্বভাবটাই ফাঁকিবাজ ধরনের, শেষের দিকে দু’তিন মাস রাত জেগে সে এরকম একটা কাণ্ড ঘটিয়ে ফেললো? আবার সিদ্ধার্থ, রবির মতন কয়েকজন অন্ধ ভক্ত আছে, তাদের ধারণা, অতীন একটি জিনিয়াস, সে ফার্স্ট ক্লাস ফাস্ট হতে পারতো অনায়াসে, ইচ্ছে করে ছেড়ে দিয়েছে।
বাড়িতে অবশ্য সবাই বেশ খুশী। সুপ্রীতি কালীঘাটের মন্দিরে পুজো দিয়ে এলেন, তিনি বাবলুর নামে মানত করেছিলেন। এবাড়ি থেকে মন্দির বেশ কাছে, তিনি একাই যাতায়াত করতে পারেন। যাবার সময় তিনি মমতাকে ডেকেছিলেন, মমতা একটা তুচ্ছ অজুহাতে এড়িয়ে গেছেন। ইদানীং মমতার ব্যবহার বোঝা খুব শক্ত। এক এক সময় মমতার চোখে এমন একটা ভাব ফুটে ওঠে যেন তাঁর জীবনে সুপ্রীতিই তাঁর প্রধান শত্রু। পিকলুর মৃত্যুর জন্য পরোক্ষে সুপ্রীতিই বুঝি দায়ী! কোনো যুক্তি আছে কি এরকম চিন্তার? পিকলু বাবলু-মুন্নিকে সুপ্রীতি কোনোদিন নিজের সন্তানের চেয়ে একটুও কম করে দেখেননি। বরং পিকলুর প্রতিই তার ভালোবাসা ছিল একটু অন্যায্য রকমের বেশি।
মমতা সব সময় এরকম ব্যবহার করলে অবশ্য এ বাড়িতে আর একসঙ্গে থাকা চলতোই। কিন্তু মমতার ব্যবহার মাঝে মাঝে, হঠাৎ হঠাৎ বদলে যায়। কোনো কারণে একবার সুপ্রীতিকে আঘাত দিয়ে কথা বললে কয়েকদিন বাদেই সেটা সুধরে নেবার চেষ্টা করেন, খাতির করেন বেশি বেশি। তাতেও সুপ্রীতির অস্বস্তি বোধ হয়। আস্তে আস্তে নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছেন সুপ্রীতি। এ বাড়িতে আসার পর স্বাভাবিক ভাবেই সংসারের কত্রীত্ব তাঁকেই নিতে হয়েছিল, কিন্তু এখন তিনি সরে দাঁড়িয়েছেন। সংসারের সব রকম কাজে সাহায্য করেন ঠিকই, কিন্তু কবে নুন ফুরোবে, কবে চিনি আনতে হবে, সে হিসেব তিনি আর রাখেন না। তিনি মনে মনে ঠিক করে রেখেছেন, তুতুল পড়াশুনো শেষ করলে তারপর সে বিয়ে করুক বা চাকরি করুক যাই-ই হোক, তখন সুপ্রীতি দেওঘরে মায়ের কাছে গিয়ে থাকবেন।
কালীঘাট থেকে পুজোর প্রসাদ নিয়ে ফেরার সময় সুপ্রীতি দেখলেন, বসবার ঘরে বাবলু রয়েছে তার দু’জন বন্ধুর সঙ্গে। সুপ্রীতি তখনই প্রসাদটা দিতে গিয়েও থমকে গেলেন। মমতার হাত দিয়ে দেওয়ানোই ভালো।
তিনি ভেতরে এসে বললেন, মমো, বাবলুকে ডেকে এই প্রসাদটা মাথায় ছুঁইয়ে দাও। ঠাকুরকে ডেকেছি, ঠাকুর আমাদের মুখ রক্ষা করেছেন।
মমতা অন্যমনস্কভাবে বললেন, ঐ তাকের ওপর রাখুন, ও আসুক ভেতরে, তখন দেবো।
সুপ্রীতি বললেন, তোমরাও নাও।
কিন্তু মমতা সে কথা যেন শুনতে পেলেন না, চলে গেলেন রান্না ঘরের দিকে।
সুপ্রীতির পরনে একটা কালো নরুণ পাড় সাদা শাড়ী। চেহারাটা ইদানীং এত রোগা হয়ে গেছে যে মুখখানা খুব ছোট্ট দেখায়। তাঁর কথায় ও ব্যবহারে যে ব্যক্তিত্বের জোর ছিল তা যেন আস্তে আস্তে মিলিয়ে গেছে কোথায়। এখন তিনি সব সময় সঙ্কুচিত হয়ে থাকেন। রবারের চটি জুতো জোড়া খুলে বাথরুমে পা ধুয়ে তিনি নিজের খাটে এসে মহাভারত খুলে বসলেন। আজকাল তাঁর খুব বই পড়ার নেশা হয়েছে, অন্য কোনো বই না থাকলে মহাভারতই পড়তে থাকেন যে-কোনো জায়গায়।
একটু পরে বাবলু ভেতরে এসে চেঁচিয়ে বললো, মা রান্না হয়েছে? আমি তাড়াতাড়ি খেয়ে দেয়ে বেরুবো!
মমতা বললেন, একটু দেরি আছে। চান করে নে আগে!
বাবলু বললো, আজ আর চান করবো না। যা রান্না হয়েছে, দিয়ে দাও, খিদে পেয়ে গেছে খুব।
মমতা মৃদু তাড়না দিয়ে বললেন, এই গরমের মধ্যে চান করবি না কী রে? তোর গায়ের গন্ধে ভূতও পালাবে এবারে। যা, মাথায় একটু জল দিয়ে আয়।
মমতা প্রায় ঠেলতে ঠেলতে বাবলুকে বাথরুমে পাঠালেন। ভেতরে ঢুকেও বাবলু চেঁচিয়ে উঠলো, চান করবো যে, জল কোথায়? মোটে দেড় বালতি জল ধরে রাখা আছে দেখছি। কলে জল নেই।
মহাভারতের পৃষ্ঠা থেকে চোখ সরিয়ে সুপ্রীতি নিজের ঘরে বসে সব শুনছেন। এ বাড়িতে জলের খুব কষ্ট। বাড়িওয়ালা উঠে যাবার জন্য তাড়া দিচ্ছে। কিছুদিন ধরে প্রতাপের শরীরটা বেশ খারাপ, মাঝে মাঝেই জ্বর হয়, নতুন বাড়ি খোঁজ করা সম্ভব হচ্ছে না। প্রায় দিনই রাস্তার কল থেকে ভারি দিয়ে জল আনাতে হয়।
কিন্তু সুপ্রীতির মনে খচখচ করছে একটা কথা। মমতা বাবলুকে প্রসাদ দিল না। পুজোর প্রসাদ কি ফেলে রাখতে হয়? ভাত খাওয়ার পরে প্রসাদ খেতে নেই। ছেলেটার খিদে পেয়েছে, এখনই তো গোটা দু’এক সন্দেশ খেয়ে নিলে পারতো।
তুতুল, মুন্নিরা কেউ বাড়িতে নেই, তিনটের সময় আবার জল এসে যাবে, বাবলু ঐ দেড় বালতি জলের মধ্যে এক বালতি দিয়ে স্নান সেরে নিলে পারতো, তা না করে সে রাস্তার কল থেকে জল আনতে গেল। সুপ্রীতি ভুরু কুঁচকে বসে রইলেন। আজকের দিনেও ছেলেটাকে না খাটালে হতো না? অতি দুরন্ত, অবাধ্য ছেলে ছিল বাবলু, তাকে নিয়ে কত ভয় ছিল, অথচ সে পরীক্ষায় এত ভালো ফল করেছে, আজ সে বেশি বেশি আদর পাবার যোগ্য।
আগেকার দিন হলে সুপ্রীতি উঠে গিয়ে বাবলুকে জল আনতে নিষেধ করতেন। মমতাকে একটু বকতেন। নিজের হাতে প্রসাদ তুলে দিতেন বাড়ির সবাইকে। কিন্তু এখন তাঁর সব ব্যাপারেই যেন দ্বিধা। তিনি আবার মন দিলেন মহাভারতের পাতায়।
খানিকবাদে তাঁর মনে একটা অন্য রকমের ভয় এলো। বাবলুর নামে তিনি পুজো দিয়ে এসেছেন, সেই প্রসাদ ছেলেটাকে না খাওয়ালে ওর অকল্যাণ হবে না? মমতা ভুলে গেলেও তাঁর মনে করিয়ে দেওয়া উচিত। তিনি মহাভারতখানা মুড়ে রেখে খাট থেকে নামলেন।
বাইরে থেকে জল এনে কোনোরকমে কাক স্নান সেরে বাবলু খাওয়ার টেবিলে এসে বসেছে। মমতা তাকে ভাত বেড়ে দিচ্ছেন। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে কুণ্ঠিত ভাবে সুপ্রীতি বললেন, মমো, ওকে প্রসাদ দিলে না?
মমতা বললেন, ও বাবলু, ঐ যে বারান্দার তাকে প্রসাদ আছে, একটু খেয়ে নে তো! মানত করা প্রসাদ গুরুজনদের কারুকে নিজের হাতে দিতে হয়। সুপ্রীতি বাবলুর নামে পুজো দিয়েছেন বলেই কি মমতা ঐ প্রসাদ সম্পর্কে কোনো উৎসাহ দেখাচ্ছেন না?
বাবলু উঠে গিয়ে শালপাতার ঠোঙাটা খুলে টপ করে একটা সন্দেশ মুখে পুরে দিয়ে বললো, বাঃ, খেতে ভালো তো! পিসিমণি, কোন দোকান থেকে কিনেছো?
সুপ্রীতি আস্তে বললেন, ঐ তো মন্দিরের পাশেই…আগেই খেয়ে ফেললি? কপালে একবার ছোঁয়াতে হয়!
–তা হলে আর একটা খাই?
আর একটি সন্দেশ নিয়ে বাবলু সাড়ম্বরে কপালে ও মাথার চুলে ছুঁইয়ে গলার মধ্যে ছুঁড়ে দিয়ে ঢোক গিলে জিজ্ঞেস করলো, কিসের প্রসাদ?
সুপ্রীতি বললেন, তোর নামে পুজো দিয়েছি। তুই ফার্স্ট ক্লাস পেয়ে বংশের মুখ উজ্জ্বল। করেছিস!
বাবলু সারা মুখে হাসি ছড়িয়ে বললো, আমরা খেটে খুটে ভালো রেজাল্ট করবো, আর পুজো পাবে মা কালী! বেশ মজা! পুরুতরা নিশ্চয়ই এর থেকে হা সন্দেশ মেরে দিয়েছে!
বাবলুর এ ধরনের কথাবার্তায় সুপ্রীতি দুঃখিত হলেন না, ছেলেমানুষরা এরকম বলেই। তিনি বরং খুশী হলেন বাবলু আরও একটি সন্দেশ খেয়ে নিল বলে।
মমতা বাবলুর সামনে ভাতের থালা ধরে দিয়ে বললেন, আগেই অত মিষ্টি খেলে ভাত খাবি কী করে? এবারে ওটা সরিয়ে রাখ।
রান্না ঘরটা লম্বা ধরনের। তারই এক পাশে খাবারের টেবিল পাতা। পুরোনো আমলের বাড়ি, দিনের বেলাতেও এ ঘরে আলো জ্বালতে হয়। দেয়ালে নোনা ধরে গেছে, একপাশের প্লাস্টার খসে খসে পড়ে মাঝে মাঝে, বাড়িওয়ালা সারাবে না। গরমকালে এই ঘরে বসে খাওয়ার সময় খুব ঘামতে হয়।
ডাল দিয়ে ভাত মাখতে মাখতে বাবলু অকস্মাৎ বোমা ফাটার মতন একটি চমকপ্রদ কথা ঘোষণা করলো।
মা ও পিসির মুখের দিকে তাকিয়ে সে বললো, আমি আর পড়াশুনো করবো না। এবারে আমি চাকরি করবো!
মমতা আর সুপ্রীতি দু’জনেই একসঙ্গে বললেন, কী?
বাবলুর যা বলার তাতে বলা হয়েই গেছে, সে মিটিমিটি হাসছে।
মমতা বললেন, কী বলছিস পাগলের মতন কথা? তুই আর পড়বি না?
বাবলু বললো, নাঃ! কী হবে এম এসসি পড়ে? আমার আর পড়াশুনো করতে ভালো লাগে না!
মমতা দু’চোখ বিস্ফারিত করে বললেন, কী সর্বনাশের কথা বলছিস, বাবলু? এত ভালো রেজাল্ট করে কেউ পড়াশুনো ছেড়ে দেয়?
বাবলু তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বললো, আমি এমন কিছু ভালো রেজাল্ট করিনি, মা! ডজনখানেক ছেলে-মেয়ে ফার্স্ট ক্লাস পেয়েছে। প্রত্যেক বছর এরকম ডজন ডজন ফার্স্ট ক্লাস পায়, তারা তাদের বংশের মুখ কতটা উজ্জ্বল করে তা আমি জানি না, তবে তারা কেউ রাজা-উজির হয় না, ভিড়ে হারিয়ে যায়।
সুপ্রীতি মিনমিন করে জিজ্ঞেস করলেন, তোর এম এসসি পড়তে ভালো লাগে না, অন্য কিছু পড়তে চাস?
বাবলু ঠোঁট উল্টে বললো, অন্য কিছু পড়েই বা কী হবে। পড়াশুনো তো চাকরির জন্য। চাকরির বাজারে এম এসসি যা, বি এসসিও তাই! আমি তো মাস্টারি করতে যাচ্ছি না।
মমতা বললেন, শোনো ছেলের কথা! আমরা যেন আর কিছু বুঝি না। এম এসসি বি এসসি যদি সমানই হবে, তাহলে এত ছেলে এম এসসি পড়তে যায় কেন?
–যাদের বাড়ির অনেক টাকা আছে তারা পড়তে যায়। যারা থোকা সেজে অনেকদিন ছাত্র থাকতে চায় তারা এম এসসি পড়ে, পি এইচ ডি করে, হায়ার স্টাডিজের জন্য বিদেশে যায়। আমার দ্বারা ওসব হবে না। আমার অন্য কাজ আছে।
–তোর অন্য কাজ আছে মানে?
–মানে, পড়াশুনো ছাড়াও মানুষের আরও অনেক কিছু করবার থাকতে পারে। তা ছাড়া, আমি চাকরি নিয়ে টাকা রোজগার করতে চাই।
–টাকা দিয়ে কী হবে?
–তুমি অদ্ভুত কথা বলছেছা, মা। টাকা দিয়ে কী হবে? টাকার দরকার নেই? আমাদের সংসারের জন্য টাকার দরকার নেই?
–দ্যাখ বাবলু, তুই বড্ড পাকা হয়েছিস! তোমাকে এর মধ্যেই কেউ টাকা পয়সা নিয়ে মাথা ঘামাতে বলেনি। তোমার বাবার যত কষ্টই হোক তোমাদের পড়াশুনোর খরচ কি কখনো আটকেছে? তোমার বাবা চান তুমি শেষ পর্যন্ত পড়াশুনো চালিয়ে যাবে, পিএইচ ডি করবে।
সুপ্রীতি চাইছেন এই কথা কাটাকাটি থামিয়ে দিয়ে অন্য কোনো একটা প্রসঙ্গ শুরু করতে। কিন্তু তিনি সুযোগ পাচ্ছেন না। এবারে তিনি মুখ তুলে দেখলেন, মমতা তাঁর দিকে জ্বলন্ত। চোখে চেয়ে রয়েছে। মমতা কি বলতে চায় যে মা ও ছেলের ঝগড়ার সময় সুপ্রীতির সেখানে থাকার দরকার নেই? কিন্তু সেখান থেকে চলে যেতে সুপ্রীতির পা সরলো না। বাবলুর ভবিষ্যৎ সম্পর্কে কি তিনি উদাসীন থাকতে পারেন?
বাবলু ঘাড় গুঁজে খেয়ে যেতে লাগলো।
সুপ্রীতি এবারে নরম ভাবে জিজ্ঞেস করলেন, হ্যাঁ রে, বাবলু, তোর যারা বন্ধু, যারা এ বাড়িতে আসে টাসে, তারা ইউনিভার্সিটিতে পড়তে যাবে না?
বাবলু বললো, দু’একজন পড়বে, দু’একজন অন্য লাইনে যাবে। একজন তার বাবার কারখানায় জয়েন করবে।
–তুই তা হলে একা হঠাৎ চাকরির কথা ভাবলি কেন?
সুপ্রীতিকে থামিয়ে দিয়ে মমতা বাবলুকে ধমক দিয়ে বললেন, আজ এত সাত তাড়াতাড়ি যাচ্ছিস কোথায়? মামা-মাইমাকে প্রণাম করে এসেছিস? ভবানীপুরের কাকাবাবুর সঙ্গে দেখা করবি আজ বিকেলেই। উনি কতবার খোঁজ নিয়েছেন তোর রেজাল্ট বেরুলো কি না।
বাবলু বললো, আর একটু ডাল দাও!
–ইউনিভার্সিটির ফর্ম দিতে শুরু করেছে না? আজই ফর্ম নিয়ে আসবি।
–ফর্ম এনে কী হবে? আমি এম এসসি পড়বো না বললুম তো!
–পড়বি না মানে? তোর মাথা খারাপ হয়ে গেছে? শোন্, তোর বাবা বলেছেন—
বাবলু হঠাৎ জ্বলে উঠে চিৎকার করে বললো, শোনো মা, বাবা কী চান তা আমি জানি। তুমি কি চাও তাও আমি জানি। তোমরা সবাই চাও আমি যেন দাদার মতন হই! দাদা ভালো ছেলে ছিল, দাদা জিনিয়াস ছিল, সবার কথা মেনে চলতে পারতো! কিন্তু আমি দাদার মতন জিনিয়াস নই! আমি প্রত্যেকটা পরীক্ষা দিই আর তোমরা সবাই হাঁ করে তাকিয়ে থাকো, আমার রেজাল্ট দাদার মতন হয় কি না দেখার জন্য। ওঃ, আমি আর পারছি না! আমি দাদার মতন নই! আমি অর্ডিনারি। আমাকে তোমরা ছেড়ে দাও!
মমতা হতবাক হয়ে বাবলুর দিকে চেয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। আস্তে আস্তে তাঁর চোখ জলে ভরে গেল। এখনও পিকলুর কোনো প্রসঙ্গ উঠলে তিনি নিজেকে সামলাতে পারেন না। আঁচলে চোখ চাপা দিয়ে তিনি দৌড়ে বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে।
সুপ্রীতিও স্তব্ধ হয়ে রইলেন একটুক্ষণ। তারপর বাবলুর কাছে এসে তার পিঠে হাত দিয়ে বললেন, ছিঃ, বাবলু, মায়ের মনে ওরকম আঘাত দিয়ে কথা বলতে আছে?
বাবলু গলার স্বর একটুও না বদলে বললো, কিছু তো আঘাত দিতে চাইনি, যা সত্যি কথা তাই বলেছি। তোমরা কেউ আমার দিকটা দেখতে চাও না কেন?
–নিশ্চয়ই তোর দিকটা দেখবো। তা বলে আজকের দিনে হুট করে ওরকম একটা কথা বললি?
–আজকের দিনটার স্পেশাল ব্যাপার কী আছে?
–আজ তোর রেজাল্ট বেরিয়েছে, কত আনন্দের কথা
–হুঁঃ! তা আমাকে কেউ আর কিছু খেতে টেতে দেবে না নাকি? এই ডাল-ভাত খেয়েই উঠে যাবো।
–বোস, আমি দিচ্ছি!
মমতা কড়াইতে ছোট ছোট চিঁড়ি মাছ ভাজার জন্য চাপিয়ে ছিলেন, এতক্ষণ এই উত্তেজনার মধ্যে সেদিকে আর নজর দেননি। চিঁড়িগুলো লাল হয়ে গেছে। কিন্তু এখনো পোড়েনি। সুপ্রীতি কড়াই নামিয়ে চিংড়ি কটা বাবলুর থালায় তুলে দিলেন।
আজ কী কী রান্না হয়েছে তিনি জানেন না। কিছুদিন আগে পুরোনো রাঁধুনী বামুনদিদি বিদায় নিয়ে দেশের বাড়ি চলে যাবার পর আর রান্নার লোক রাখা হয়নি। দিনের বেলার রান্না মমতা একাই করেন আজকাল। সন্ধেবেলার নিরামিষ রান্নার ভার সুপ্রীতির ওপর, এখন কোনো কোনোদিন তুতুলও রান্নায় সাহায্য করে।
বাটিগুলোর ঢাকনা উল্টে উল্টে দেখলেন সুপ্রীতি। আর একটা কুমড়োর তরকারি রয়েছে। বাবলু একেবারেই কুমড়ো খেতে চায় না সেইজন্যই মমতা তাকে ঐ তরকারি দেননি। মাছের ঝোল তো নেই? ঐ ছোট ছোট চিড়িগুলো ছাড়া আর কোনো মাছ রান্না হয়নি? অবশ্য আজকে মাসের আঠাশ তারিখ।
বাবলুকে তিনি আরও একটু ডাল ও ভাত দিলেন। সে এক মনে খেয়ে যাচ্ছে। ছেলেটা মিষ্টি দই ভালোবাসে, আজকের দিনে ওর জন্যে একটু দই এনে রাখলে হতো।
ওর এম এসসি পড়ার প্রসঙ্গ তিনি আর ভয়ে তুললেন না। এমন কি এই যে বাবলুকে তিনি এখন যত্ন করে খাওয়াচ্ছেন এতেও তাঁর একটু ভয় ভয় করছে, এজন্য আবার মমতা চটে যাবে না তো! মায়ের চেয়ে মাসির দরদ বেশি বলে একটা বক্রোক্তি আছে, মাসির বদলে অনায়াসে পিসি করা যেতে পারে।
তিনি আবার বাবলুর পিঠে হাত রেখে অনুনয়ের স্বরে বললেন, খেয়ে উঠে মায়ের পাশে গিয়ে একটু বোস। মা মনে দুঃখ পেয়েছে, তুই গিয়ে একটু ভালো করে কথা বললেই সব ঠিক হয়ে যাবে।
বাবলু ঘাড়টা বেঁকিয়ে সুপ্রীতির দিকে কয়েক পলক তাকিয়ে রইলো, কোনো কথা বললো না। মুখ থেকে তার রাগের জ্বলজ্বলে ভাবটা চলে গেছে।
কিন্তু আঁচাবার পর সে আর একটুও দেরি করলো না। একটা জামা মাথায় গলিয়ে হুড়ুম ধাডুম করে বেরিয়ে গেল বাড়ি থেকে।